মনকাননের সুর পর্ব-০৩

0
407

#মনকাননের_সুর – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

এক পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ফলে দেশের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শাদিফের একটু সমস্যা হলো বটে। বিয়ের পরদিনই আচমকা জ্বর-ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়ে। বউ-ভাতের অনুষ্ঠান শেষ হতেই মনিষাকে সঙ্গে নিয়ে রামিশা আসলো শাদিফদের বাড়ি। হাতে তার মায়ের পক্ষ থেকে দেওয়া কিছু খাবার। রামিশা শুনেছে আগামীকাল নাকি তাদের বাড়ি মেহমান আসবে। যেহেতু শাদিফ এসেছে, সেহেতু তার সাথে দেখা করতে, ভাব-বিনিময় করতে এখন আত্নীয়-স্বজনের বাড়ি আসার সিরিয়াল লাগবে এটাই স্বাভাবিক।

রামিশা এ বাড়ি এসে দেখলো শাহিনা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। রামিশা তাকে ডাকতেই শাহিনা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলেন। পরপর চিন্তিত মুখটায় এক চিলতে হাসির রেশ ফুটে ওঠে। রামিশা এগিয়ে যায় শাহিনার কাছে। সেসব খাবার রান্নাঘরের একপাশে রাখলো। তা দেখে শাহিনা বললেন,
–“এসবের কী দরকার ছিল?”
–“মা পাঠিয়েছে। তোমার বাড়ির নতুন সদস্য নাকি অসুস্থ, তাই।”

পরপর রামিশা জলন্ত চুলোয় তাকিয়ে বলল,
–“কী রান্না করছ?”
–“স্যুপ। খাবি তুই? এখানেই খাবি নাকি বাড়ি পাঠিয়ে দিব?”

রামিশা স্যুপের কথা শুনে চোখ-মুখ তেঁতো করে ফেলল। কেন যেন তার স্যুপ ভালো লাগে না। সেটা শাহিনা জেনেও কেন যে স্যুপ খেতে বলে কে জানে? রামিশা নেতিবাচক মাথা নাড়িয়ে বলল,
–“আমি খাব না। শাদিফ ভাইয়া কোথায়?”

শাহিনা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–“ওপরে। নিজের ঘরে বিশ্রাম করছে।”
–“জ্বর সেরেছে?”
–“না। রাতে স্যুপ আর ওষুধ খাইয়ে দিব। দেখা যাক কী হয়।”
–“আমি দেখে আসি।”

বলেই রামিশা মনিষাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে যায়। মনিষা হেসে রামিশাকে বলল,
–“তোর এই মামাতো ভাইটা কিন্তু হ্যান্ডসাম রামিশা। আমার জন্য পটিয়ে দে না। তোর সাথে তো ভালো সম্পর্ক, দেখিস তুই আমার কথা বললে একদমই বারণ করবে না।”

রামিশার সেই মুহূর্তে মনে হলো কেউ যেন বুকের বা পাশ থেকে এক মুঠো মাংস খামচে তুলে নিয়েছে। রামিশা চোখ রাঙিয়ে তাকায় মনিষার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তুই ইতিমধ্যেই ভাবীর বাড়ির একজনের সাথে কথা-বার্তা বলছিস। কয়টা লাগে তোর?”
–“ওটা ক্যান্সেল। তুই এটার ব্যবস্থা কর।”

রামিশা আচমকা মনিষার পথ আগলে বলল,
–“চোখ তুলে নিব তোর। সব জায়গায় নজর দেওয়া খাটে না।”

বলেই রামিশা হনহনিয়ে উপরে চলে যায়। মনিষা এক মুহূর্তের জন্যে বেকুব বনে গেলেও পরপর রামিশার পেছন পেছন চলে যায়। মনিষাকে নিজের পেছনে দেখে রামিশা বলল,
–“আমার পিছু আসবি না।”
–“তো তোর অসুস্থ ভাইকে দেখব না?”
–“না। তুই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। তোর রুমে ঢোকা নিষিদ্ধ।”

মনিষা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বলল,
–“কী ব্যাপার, আমার নাকে পোড়া গন্ধ এসে ধাক্কা খেল কেন? রামিশা?”

রামিশা থমকে দাঁড়ায়। মনিষা তাকে আপাদমস্তক সন্দিহান নজরে দেখে বলল,
–“প্রেমে-টেমে পড়েছিস?”

রামিশা হেসে উড়িয়ে দিয়ে শাদিফের ঘরের সামনে পৌঁছায়। ভেতরে উঁকি দিতেই দেখলো শাদিফ লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে। গায়ে মোটা কম্বল, কপালে জলপট্টি। চোখের চশমাটা নেই, চোখ বুজে আছে সে। তাকে এই করুণ অবস্থায় দেখে রামিশার মায়া হলো, তবে ভেতরে যাওয়ার সৎ সাহসটুকু পেল না। এজন্য দরজা থেকেই ফিরে যাওয়া ধরতেই ভেতর থেকে শাদিফের পিছু-ডাক পেল। মনিষা এতে মিটিমিটি হেসে বলল,
–“ঠিক আছে, আমি দরজাতেই দাঁড়াচ্ছি। তুই ভেতরে যা।”

রামিশা ডান হাতের তালু খামচে তাকাল মনিষার দিকে। রামিশাকে এভাবে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে মনিষা হো হো করে হেসে ফেলল। এটা সেই সাহসী মেয়েটা, যে কি না সারাক্ষণ উদ্ভট কাজ-কর্ম করে বেড়ায়, কাউকে ভয় করে না? মনিষা হাসতে হাসতে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। রামিশা শাদিফের রুমে যেতেই শাদিফ উঠে বসার চেষ্টা করলো। সক্ষমও হলো। মাথা তার অসম্ভব ভার হয়ে আছে, তবুও সে মানিয়ে নিল। রামিশা বলল,

–“চশমা ছাড়া আমাকে চিনলেন কীভাবে?”
–“ঝাপসা চোখে যতটুকু দেখলাম, মনে হলো তুই।”
রামিশা মিনমিন করে বলল,
–“যতটা কানা ভেবেছি ততটা কানাও না।”
–“তুইও তো অন্ধ।”

রামিশা রেগে গিয়ে বলল,
–“আমি অন্ধ না।”
পরপর নিজের চোখ থেকে চশমাটা খুলে বলল,
–“চশমা খুলেও আপনাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।”

শাদিফ দুর্বল হাতে নিজের চশমাটা হাতে নিয়ে চোখে পড়ে নেয়। রামিশার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আমিও এবার তোকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।”

রামিশার রাগ ভাবটা উবে যায় শাদিফের এহেম কথা শুনে। রামিশা প্রসঙ্গ বদলালো।
–“জ্বর কেমন এখন? বেশি খারাপ লাগছে?”
–“জ্বর ভালো মতোই কাবু করেছে। ঘাড়, মাথা ভার হয়ে আছে।”
–“মামী খাবার আনছে, আনলে খেয়ে নিয়েন। কাজের বোঝাটা নামিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েন।”

শেষ কথাটা বলে রামিশা শাদিফের বিছানার ধারের ল্যাপটপের দিকে নজর দিলো। শাদিফ সেই ইশারা বুঝতে পেরে হাসতে গিয়েও পারলো না। তবুও কোনো রকমে বলল,
–“তুই এতদিকে খেয়াল রাখিস কীভাবে? কাজ না করলে আমাকে স্যালারি দিবে কেন? স্যালারি না দিলে খাব কী? তুই খাওয়াবি?”

রামিশা জবাবে কিছুই বলল না। শাদিফের দিকে একনজর চেয়ে বলল,
–“রেস্ট করো। আমি যাচ্ছি।”

রামিশা যেতে নিলে শাদিফ পিছু ডাক দিয়ে বলল,
–“আম্মাকে কফি বানাতে বলিস তো।”

রামিশা মাথা নেড়ে চলে যায়। তবে কফিটা সে নিজের হাতে বানিয়ে বাড়ি চলে যায়। শাহিনা রামিশার এহেম পাগলামিতে শুধু হাসলো।

সেদিনের পর থেকে মনিষা উঠতে বসতে রামিশাকে শাদিফ কেন্দ্রিক খোঁচা দিতে শুরু করে, সঙ্গে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা তো আছেই। রামিশার শক্ত ধমকেও কোনো কাজ হচ্ছে না। মনিষা যেহেতু রামিশাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করছে, সেহেতু বিয়ের পর সব মেহমান চলে গেলেও মনিষা বাড়িতেই। মনিষা রামিশার বড়ো চাচার মেয়ে। তারা সমবয়সী। শুধু তাদের ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন।

এর মাঝে একদিন বাড়িতে গুঞ্জন ওঠে রামিশা এবং শাদিফের বিয়ের। শাহিনা সরাসরি রামিশার বাবা অর্থাৎ অতল সাহেবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তাঁর এই প্রস্তাবে আপত্তি নেই, তবে মেয়ের সিদ্ধান্তের ওপর সব ছেড়ে দিয়েছেন। রামিশার না চাইতেও শাদিফকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কোথাও না কোথাও হয়তো শাদিফকে হবু বর হিসেবে কবুলও করে নিয়েছে সে। শাদিফের পরিবার যে এমনিতেও তার দ্বিতীয় পরিবার। তাঁরা যেভাবে ছোটো থেকে রামিশাকে আগলে রেখেছে, তার সমস্ত বাচ্চামোকে হাসি-মুখে গ্রহণ করেছে, তাঁদের থেকে অন্তত মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতো অকৃতজ্ঞ সে নয়। মানুষও দিনশেষে সুখের কাঙাল। সুখ পায়ে ঠেলে দেয় তো মূর্খরাই।

আজ শাদিফ এবং রামিশা একটু রেস্টুরেন্টে দেখা করছে। রামিশা ভার্সিটি থেকে সোজা এখানেই এসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেলেও রেস্টুরেন্টের এসির শীতলতা তাকে স্বস্তি দিচ্ছে। রেস্টুরেন্টে সে আগে আসলেও শাদিফের খবর নেই। রামিশার অবশ্য এত তাড়া নেই। সে বোতলের মুখে খুলে পানি খেতে খেতে রেস্টুরেন্টে চোখ বুলায়৷ শাদিফ আসলো কিছুক্ষণ বাদেই। তাকে দেখে রামিশা জড়তায় মিইয়ে গেল। অথচ এতটা নার্ভাসনেস কখনোই কাজ করেনি তার। হয়তো শাদিফের সাথে তার বিয়ের কথা উঠেছে বিধায়। শাদিফ রামিশার সম্মুখে বসে বলল,
–“কী ব্যাপার, মা বলল তুই নাকি আমাকে রেস্টুরেন্টে ডেকেছিস?”

রামিশা থতমত খেল। অবাক হয়ে বলল,
–“আমাকেও তো আপনার কথা বলে পাঠানো হলো। কী নাকি বলবেন?”

শাদিফের চোখ-মুখ দেখে রামিশা ঢের বুঝে গেল, শাদিফ এসব সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না। রামিশা তা বুঝতে পেরে বলল,
–“এখন লাঞ্চটাইম, আমারও খুদা লেগেছে। কিছু অর্ডার করছি। বিল আপনার।”
শাদিফ হাসলো। সেও মেন্যুকার্ড হাতে তুলে নিলো।

রামিশা যখন খেতে ব্যস্ত তখনই আচমকা কোত্থেকে এক মেয়ে এসে দাঁড়ায় তাদের টেবিলের সামনে। মেয়েটা একবার শাদিফকে দেখে তো আরেকবার রামিশাকে পরখ করে নেয়। রামিশা তখনো খেয়াল করেনি মেয়েটাকে। আকস্মিক মেয়েটা বলে ওঠে,
–“হাই, আমি সারা। শাদিফের গার্লফ্রেন্ড। আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আপনি কে আপু?”

রামিশার খাওয়া তখনই লাটে ওঠে। একটুর জন্য খাবারটা গলায় আটকায়নি। কোনো রকমে খাবারটা গিলে নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। একটা অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে দাঁড়ানো তার সামনে। মেয়েটার পোশাকে বাঙালি ভাব নেই, ওয়েস্টার্ন পরেছে সে। রামিশা শাদিফের দিকে তাকালো। শাদিফের চোখ-মুখে বিরক্তি ভাব স্পষ্ট। রামিশা কিছু বলার আগেই শাদিফ বলল,
–“ও আমার কাজিন হয় সারা। আর তুমি এখানে কী করছ?”

কাজিন শুনতেই সারা নামের মেয়েটা বোধ হয় স্বস্তি পায়। পরপর শাদিফের পাশে বসে বলল,
–“ওহ, আই সি। আমি এখানে কী করছি সেটা ম্যাটার করে না। বরং ভালোই হলো তোমাদের এই লাঞ্চে যোগ দিতে পারছি। ওয়েটার!”
সারাও খাবার অর্ডার করলো। অতিরিক্ত গা ঘেঁষে বসার চেষ্টাও করলো সে শাদিফের। রামিশার খাবার আর গলা দিয়ে নামলো না। সে নিজেকে বহু কষ্টে সামলে নিলো।

খাবারের বিল শাদিফের দেওয়ার কথা থাকলেও রামিশা নিজের বিল নিজে পে করে। তা দেখে শাদিফ কিছুটা রেগে যায়। তা দেখে রামিশা শুকনো হেসে বলল,
–“আমি তখন মজা করছিলাম। অন্য একদিন নিব নাহয় ট্রিট। আজকে যা সারপ্রাইজ পেলাম।”

সারার থেকে বিদায় নিয়ে দুজন হাঁটতে লাগল। রামিশা আনমনে বলল,
–“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে, আগে বললেন না তো?”

শাদিফ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“গার্লফ্রেন্ড না। এখনো আমরা বন্ধুই আছি। সম্পর্কে জড়াতে একটু টাইম নিচ্ছি।”

–“কতদিনের আলাপ?”
–“জার্মানি থেকেই। বন্ধুর কাজিন। টুরিস্ট ভিসায় গিয়েছিল, সেখানেই পরিচয়। এরপর দেশে ফেরার সময় একই ফ্লাইটেই ছিলাম।”

রামিশা কিছুক্ষণ যাবৎ অনুভব করছে, তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। শাদিফের প্রতিটা কথায় সে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। তাও দিব্যি সে হাসি-মুখে বলল,
–“ভালোবাসেন আপুটাকে?”

শাদিফ আনমনে বলল,
–“ভালোবাসি কি না জানি না, তবে সারাকে আমার ভালো লাগে।”

রামিশার চোখে আচমকা শাদিফের তখনকার বিরক্ত ভাবটা ভেসে ওঠে। সেই বিরক্তিতে তো ভালোবাসার চিহ্নমাত্র ছিল না। তবে? সে কী ভুল দেখলো তবে? শাদিফ বলল,
–“মাকে এখন কিছু বলিস না। আমি পরে জানাব।”

রামিশা একপলক তাকাল শাদিফের দিকে। শুকনো মুখটায় হাসি ফুটিয়ে বলল,
–“বলব না, এক শর্তে।”

শাদিফ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে গেল। রামিশা চোখ জোড়ায় ব্যথা ফুটিয়ে বলল,
–“আমাকে আরেকটা বেলিফুলের গাছ কিনে দিবেন?”

চলবে~~