মনকাননের সুর পর্ব-০৫

0
342

#মনকাননের_সুর – [০৫]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

রামিশা বিয়ে ভাঙেনি। ভাঙবেও না। এর কারণ শাদিফের কাছে অস্পষ্ট লাগলেও রামিশার কাছে দূর-দূরান্ত অবধি স্পষ্ট। সে স্পষ্ট ভাষায় শাদিফকে বলে দিয়েছে শাদিফের প্রয়োজন হলে সে যেন নিজ দায়িত্বে বিয়ে ভাঙে। এভাবে তার ওপর ব্যাপারটা চাপিয়ে দেওয়া কাপুরুষি লক্ষণ। এই দুটো বাক্য শাদিফের এতটাই আত্মসম্মানে লেগেছে যে সে দুদিন এমুখো হয়নি। এমনকি রাস্তা-ঘাটে রামিশার সাথে দেখা হলেও সে তাকে এড়য়ে চলেছে। এতে রামিশাকেও বিশেষ আগ্রহ দেখাতে দেখা গেল না। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে অথচ দুজন দুজনের চেহারাও দেখতে পারছে না।

রামিশার ভেতরকার গল্প অবশ্য ভিন্ন। সে ভীষণ চটপটে এবং অভদ্র স্বভাবের হলেও শাদিফের বেলায় কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছিল। যেন কোনো নিভু নিভু মোম। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে যখন সে দ্বিতীয়বারের মতো ভাবতে চেয়েছিল তখনই তার রং নাম্বার থেকে কল আসে। সেই কলটা ছিল সারার। এবং এই একটা কলই রামিশাকে নাড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।

সারা কোনো একভাবে রামিশা এবং শাদিফের বিয়ের ব্যাপারে জানতে পেরেছে, সেই জানার পরপরই রামিশার নাম্বার যোগাড় করে তাকে কল করা। সারা সেদিন যা নয় তাই বলে অপমান করল রামিশাকে৷ সে অন্যের সম্পদের ওপর নজর দেয়, ভাইকে নিয়ে বিচ্ছিরি বিয়ের স্বপ্ন দেখে। সম্পর্কে তারা ভাই-বোনসহ অন্যান্য আরও নিকৃষ্ট কথা। রামিশা সব সইতে পারে, তবে চরিত্রে আঙুল তোলা সইতে পারে না। সে ততক্ষণ অবধি থামে না যতক্ষণ অবধি সেই আঙুল সে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সে যে কী ধরণের জেদী মেয়ে, তা সারার কল্পনারও বাইরে। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করেছিল, দুর্বলতা এবং ভদ্রতা এই দুটি গুণ দেখিয়ে সে বিরাট বড়ো ভুল করে ফেলেছে। এজন্য সে তখনই সিদ্ধান্ত নিল, এই বিয়ে ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না। শাদিফও যখন বিয়ে ভাঙার কথা বলল তখন সেও বিয়ে ভাঙার সঠিক কারণ দেখাতে পারেনি। সে এখনো স্বীকার করছে সারা তার বন্ধু, তার প্রতি অনুভূতিটা ভালো লাগা অবধিই সীমাবদ্ধ। তবে রামিশা মূর্খের মতো বিয়ে কেন ভাঙবে? ইচ্ছে তো করেছিল সারার মুখে ঝামটা ঘষে দিতে, তার সঠিক জায়গা চিনিয়ে দিতে। কিন্তু সে এসব করেনি, শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা। সারা শাদিফের বন্ধু হয়, আর রামিশা হবু বউ। অধিকার কাকে বলে তা সে খুব করে চিনিয়ে দিতে জানে।

রামিশা তিরিক্ষি মেজাজে চায়ের দোকানে এসে বসেছে। এই টঙটা তাদের গলিতেই। টঙে মেয়েদের চাইতে পুরুষ মানুষের আনাগোনা বেশি। এক্ষেত্রে উপস্থিত মধ্যবয়সী কেউ এভাবে একা মেয়ে মানুষকে চা খেতে ভালো চোখে দেখবে না। রামিশা অবশ্য কখনো সেসবে নজর দেয়নি। সে নিজ স্বাধীনভাবে চলতে, সবকিছু উপভোগ করতে পছন্দ করে। যেখানে ঘরের মানুষেরই বারণ নেই সেখানে বাইরের মানুষের বারণ শোনার সময় কার আছে? তবে টঙে বসা সামাদ চাচা তার পরিচিত। উনি রামিশার বান্ধবীর বাবা হন। সামাদ চাচা এককালে চাকরিজীবি হলেও আচমকা রাস্তার দুর্ঘটনায় পায়ের শক্তি হারিয়েছেন। এখন হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়েই জীবন চলছে তাঁর। এখানের স্থানীয় মুখ সে, যথেষ্ট শিক্ষিত ধরণার। দুই পা হারিয়ে এভাবে বোঝা হয়ে কারো ঘাড়ে বসে থাকতে তার বড্ড অস্বস্তি। মরে যাবে, তবুও আত্মসম্মান খুইয়ে স্ত্রীর খোঁটা শুনতে প্রস্তুত নয়। পা নেই তো কী হয়েছে, হাত দুটো ত এখনো অচল আছে। এরপর আর কী, নিজের বাড়ির পাশের খালি জায়গাটাতেই জমানো টাকা দিয়ে ছোটোখাটো টং গড়ে তুললেন। টঙের পাশাপাশি আরও দুটো দোকান ভাড়ায় দিয়েছেন তিনি। সবমিলিয়ে বেশ রমকম চলছে তাঁর জীবন।

সামাদ চাচা এবং রামিশার মধ্যে সম্পর্ক বেশ মিষ্টি। সামাদ মেয়ের মতো করেই স্নেহ করেন রামিশাকে। রামিশা এবং তাঁর মেয়ে সমবয়সী। মেয়ে পাশে নেই, এজন্য রামিশাকে চা খাইয়ে মেয়েকে মনে করেন তিনি। মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে সুখের সংসার করছে। নানা হবারও সুযোগ হয়েছে তাঁর। সামাদের চায়ের হাত দারুণ। চা-ওয়ালা হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি আছে এই এলাকায়। তাইতো প্রায়ই ভীড় জমে ওঠে এই সামাদের টঙে। তিনি রামিশার থেকে চায়ের দাম নিতে চান না, যা রামিশাকে ভীষণ আহত করে। তার বেশ যুদ্ধ করতে হয় এই টাকা নিয়ে। যখন কিছুতেই সামাদের সাথে তর্কে পারে না, তখন রামিশা সামাদের টঙে আসাই বন্ধ করে দেয়। এতে সামাদই আবার তার মান ভাঙায় রামিশার থেকে টাকা নিয়ে। এভাবেই বেশ চলে যায় সামাদের দিন।

এত পুরুষ মানুষের মাঝে টঙে রামিশাকে প্রায়ই দেখেছে শাদিফ। সে ব্যাপারটা যে ভালো ভাবে নেয় না তা তার কুঁচকানো কপাল দেখলেই বেশ বোঝা যায়। তবুও শাদিফ কয়েকদিন এড়িয়ে যায় এই ব্যাপারটা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সপ্তাহের পাঁচদিনই তাকে সামাদ চাচার টঙে চা খেতে দেখে। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু বলেই শাদিফ আচমকা রামিশার কাছে চলে যায়। সেই সময়টায় মোটামুটি ভীড় আছে টঙে, সামাদ চাচা তখন চা বানাতে ব্যস্ত। শাদিফকে এখানে দেখে রামিশা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেও তা প্রকাশ করে না। শাদিফ গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“এখান থেকে চলো।”

বিয়ের কথা ওঠার পর থেকেই শাদিফ তুই সম্বোধন থেকে তুমিতে নেমেছে। তাও মায়ের কড়া আদেশে। সে অবশ্য আগে তুই তুমি গুলিয়ে ফেললেও এখন তুমি করেই বলে।

শাদিফের এহেম আদেশ মাখা গলা রামিশার হজম হলো না। বরং সে ভীষণ বিরক্ত হলো।
–“দেখতে পাচ্ছেন না চা খাচ্ছি? খাওয়ার সময়ে ব্যঘাত একদম অপছন্দ করি আমি।”
–“চায়ের কাপ নিয়েই চলো, তবুও তুমি এখানে থাকবে না।”
–“কেন? আপনার কথায় চলব নাকি আমি? বিয়েও করবেন না আবার হুকুমও জারি করবেন? এটা কেমন হলো?”

সামাদ চাচা চা বানানোর ফাঁকে দেখলেন শাদিফকে। শাদিফকে সে চিনে। তবুও রামিশাকে জিজ্ঞেস করলেন,
–“ও কে হয় তোর, মা? বিরক্ত করছে কেন?”

রামিশা চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
–“তোমার মেয়ের হবু জামাই হয় চাচা। বলেছিলাম না আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ইনিই সেই জার্মান ফেরত জ্ঞানী মানুষ।”

রামিশার কথা সামাদই শুনল এমন নয়, তার আশেপাশে থাকা সবাই এই খবর শুনলো। সঙ্গে সঙ্গে শাদিফের দিকে সবাই এমন চাহনি দিল যেন রামিশা কী মহা পাপের কথা শুনিয়ে ফেলেছে। শাদিফের এতে চরম অস্বস্তি হয়। সে তৎক্ষণাৎ রামিশার হাত থেকে খালি চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে সামাদের সামনে রাখল। অতঃপর শাদিফ শক্ত গলায় বলল,
–“তুমি আসবে আমার সঙ্গে? আমি কোনো সিনক্রিয়েট চাচ্ছি না।”

রামিশা ভ্রু কুচকে উঠে দাঁড়াল। মুখ বাঁকিয়ে সামাদের উদ্দেশে বলল,
–“আমি যাচ্ছি চাচা। টাকা কিন্তু সব শোধ করে দিব।”

রামিশা এই বলে বেশ রয়েসয়েই টঙ থেকে বেরিয়ে গেল, যেন তার কোনো তাড়া নেই। শাদিফ সামাদ চাচাকে তার বিল মিটিয়ে দিতে চাইলে সামাদ চাচা মুচকি হেসে বললেন,
–“লাগবে না, তুমি যাও পাগলিটার পিছে। চা খেতে এসো, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগবে।”

ভদ্রলোকের কথার ভঙ্গি শাদিফের পছন্দ হলো। তাই সে সৌজন্যতার সাথে মাথা নাড়ায়। সামাদ চাচা থেমে আবার বললেন,
–“মেয়েটার যত্ন নিও। পাগলাটে ধরণার হলেও ভীষণ লক্ষী। আমার মেয়ের অনুপস্থিতি অনুভবই করতে দেয় না।”

শাদিফ রামিশার প্রসংশা শুনেই টং থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু টং থেকে বের হতে না হতেই একজন নাক কুঁচকে তাকে বলল,
–“এমন অভদ্র মেয়েকে বউ করবে কী করে? এই মেয়ে তো ঘরে থাকবে কম বাইরে দৌড়াবে বেশি।”

শাদিফ সেই লোককে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। দূরে দেখা যাচ্ছে রামিশা জুতোর দোকানে জুতা দেখছে। শাদিফ রামিশার কাছে এসে বলল,
–“তোমাকে নিয়ে সব জায়গায় এত বদনাম করে কেন মানুষ?”
–“কারণ ওরা আপনার মতোই অন্ধ, ভালো দিক দেখার মতো চোখের জ্যোতি ওদের নেই। আপনিও ওদের মতো গুড়ো মাছ এভোয়েড করতেন তাই না?”

শাদিফের মেজাজ বিগড়ে গেলেও শাদিফ নিজের মেজাজ গিলে নেয়। এই মেয়েটা ইদানীং এত অবাধ্য হয়েছে। সেদিনও তো পানির মতো সরল ছিল। বিয়ের কথা উঠতেই না উঠতেই এমন ধানিলঙ্কার রূপ নিল কেন? শাদিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তুমি এ জীবনে শুধরাবে না।”
–“টঙে যেতে নিষেধ করলেন কেন?”
–“তোমাকে বলতে বাধ্য নই।”
–“বাধ্য নন? তাহলে টেনে আনলেন কেন?”
–“এই তোমার কাজ নেই? এত বাইরে বাইরে ঘুরো কেন? বাসায় একদণ্ড বসতে পারো না?”
–“এমন ভাবে বললেন যেন আমি আপনার বিবাহিতা বউ? অধিকার তখনই খাটাবেন যখন অধিকার খাটানোর সম্পর্ক হবে।”
–“ওকে ফাইন। ভুল হয়েছে আমার টং থেকে নিয়ে আসা। যাও আবার গিয়ে টঙে বসো, গো এহেএড!”

বলেই শাদিফ হনহনিয়ে চলে গেল। রামিশা টঙে গেল না, তবে শাদিফের পেছন পেছন যেতে লাগল। শাদিফ তা দেখে বলল,
–“কী চাই?”
–“ওমা, রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও দোষ?”
–“আমার পিছু নেওয়া দোষ।”

রামিশা নাক-মুখ অস্বাভাবিক কুঁচকে বলল,
–“এত খারাপ দিন পড়েনি আমার।”
–“এজন্যই বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছ।”
–“এক্সকিউজ মি, কে বলল আপনাকে এ কথা?”
–“তাহলে বিয়ে ভেঙে তা প্রমাণ দাও?”

রামিশা হো হো করে হেসে দিয়ে বলল,
–“রাস্তা বোধহয় আপনার জার্মানি পয়সায় কেনা তাই না, যেখান দিয়ে হাঁটলে বিয়ে ভেঙে নিজের উদ্দেশ্য প্রমাণ দিতে হবে? আপনারা পুরুষ জাত এত অদ্ভুত কেন? মাত্রই বললেন বাড়িতে থাকতে, এখন আবার উলটো পালটা বকছেন।”

শাদিফ বুঝল রামিশা তার বাড়ি যাবে। সে অযথা তর্কে জড়াল না। বরং বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল সামনে,
–“পুরুষজাত নয়, নারীজাত হচ্ছে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী। সঙ্গে পরিবর্তনশীলও। যা পাঠ্যপুস্তকে এতদিন পড়ে আসলেও আজ এক্সপেরিমেন্ট করছি।”

রামিশা শাদিফের পিছু পিছু তার বাড়িতেই এলো। এটা দেখে শাদিফের ভ্রু কুচকে যায়। যখনই বাড়িতে প্রবেশ করে রামিশাকে কিছু বলতে নিবে ওমনি শাহিনা তৈরি হয়ে এলেন। সেই মুহূর্তেই শাদিফের প্রশ্ন,
–“আমি জানতাম তুমি আমার পিছু নিচ্ছিলে।”

শাহিনা বোধ হয় শুনতে পাননি সে কথা। তিনি রামিশাকে আরও তাড়া দেখিয়ে বললেন,
–“এত দেরী করলি কেন আসতে? দ্রুত চল, সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। আমার সিরিয়াল নাম্বার এসে যাবে ত।”

মায়ের কথা শুনে শাদিফ রামিশার দিকে তাকাল। রামিশা মিটিমিটি হাসছে। রামিশার চোখ জোড়াই বলে দিচ্ছে শাদিফের প্রশ্নের উত্তর। রামিশা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
–“আমাকেই কেন চেকআপের সময় ডাকো মামী? তোমার জলজ্যান্ত একটা ছেলে আছে ত।”

শাহিনা এতে ভীষণ বিরক্ত হলেন। ছেলের নামই শুনতে পারছেন না আজকাল। চাপা ক্ষোভ থেকে বললেন,
–“কিসের ছেলে? এসব ছেলে-পেলের কোনো দাম নেই আমার। এটা এমন গর্ধব হবে জানলে ছোটো থাকতেই এর একটা ব্যবস্থা করে ফেলতাম।”

রামিশা বেশ মজা পেল শাদিফের এমন অপমানে। শাদিফ তার মুখ পাংশুটে করে বলল, “মা!”

শাহিনা শাদিফকে এড়িয়ে আবারও বলল,
–“আগে জানতাম ফরেইন থেকে সন্তান বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে ফেরে। আর আমারটায় ফিরেছে গাধা হয়ে। একে দূরে পড়তে দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। এই রাশু, চল তো। লেট হচ্ছে।”

চলবে~~

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ নজরে দেখবেন।