#মনকাননের_সুর – [০৬]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
ডাক্তার দেখানো শেষ করে বাড়ি ফিরতেই রামিশা দেখল তার ভাইয়ের বউ অর্থাৎ এনা ক্লান্ত মুখে সোফায় বসে। এনার গায়ে এখনো বোরকা জড়ানো। ঘর্মাক্ত মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এনা বাড়ি ফিরেছে বেশিক্ষণ হয়নি।
রামিশা জিজ্ঞেস করল,
–“ভাইয়া নিয়ে এসেছে তোমাকে?”
রামিশার প্রশ্নে ম্লান হাসল এনা। জড়ানো কণ্ঠে বলল,
–“না, দুলাভাই দিয়ে গেলেন। তোমার ভাই আজ কাজে একটু ফেঁসে গিয়েছে।”
ভাবীর সাথে রামিশা খুব সহজেই মিশতে পারেনি। এনা একটু ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। সহসা সবার সাথে মিশতে পারে না। তবে সে এই নতুন পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রামিশা তাকে সম্মান করে, সেই সম্মানের সম্পর্ক থেকেই যতটুকু কথা। রামিশা জিজ্ঞেস করল,
–“আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”
এনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বেশ কিছুদিন যাবৎ এনার বাবা অসুস্থ। এতদিন বাসাতে থাকলেও দুইদিন হলো হাসপাতালে ভর্তি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় তাঁর দুটো কিডনিই নষ্ট। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে এনাই ছোটো। তাই বাবার আদরেরও বেশি। এমতাবস্থায় বাবার অসুস্থতায় এনা কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। বারবার ছুটে যায় অসুস্থ বাবার কাছে। এতে কখনোই বাঁধা দেয় না রামিশার পরিবার। বরঞ্চ রাকিব এবং অটল সাহেব যখনই সুযোগ পাচ্ছে নিজ দায়িত্বেই এনাকে তার বাসায় কিংবা হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে। এনা তাঁদের দায়িত্ব, এনং তাঁরা তাদের দায়িত্ব সুন্দর ভাবেই পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে— যা এত দুঃখের মধ্যেও এনাকে মুগ্ধ করে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করায়।
এনা নিজেকে সামলে বলল,
–“দোয়া করিও যেন আবারও আব্বু আমাদের মাঝে ফিরে আসে, রামিশা।”
রামিশা মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমিন।”
—————–
এবারের চেকআপে রিপোর্ট ভালো হলেও শাহিনার নিজেকে কেমন কাহিল হয়ে আছে। ছেলের দুশ্চিন্তায় ভারী অস্থির অস্থির লাগে তাঁর। ছেলে নাকি দূরদেশে কোন মেয়েকে পছন্দ করে বসেছে। যার চেহারা সুন্দর তবে চলন-ধরণের ঠিক নেই। পোশাকের কথা ত বাদই রইলো। পোশাক দেখলে তাঁর গা গুলিয়ে বমি পায়। জীবনযাত্রা কিংবা যুগের নিয়ম, যতই পালটাক না কেন দিনশেষে তাঁরা বাঙালি। বাঙালির সংস্কৃতি কিংবা সৌন্দর্য শালীন পোশাকেই। তা অত্যন্ত শিক্ষিত, সফল এই ভদ্রমহিলা এখনো বিশ্বাস করেন। তাঁর হয়তো ন্যাশনাল এওয়ার্ড রয়েছে। তাতেই বা কী? সাফল্য অন্তত উনার নিজের পরিচয় ভুলিয়ে দেয়নি। সে মাছ-ভাত দেখলে নাক সিটকায় না। এতটা আধুনিকতাও তাঁর মাঝে নেই যতটা আশেপাশের মানুষজন তাঁকে ভেবেছিল।
শাহিনা সকলকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে বিরাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। শাদিফ বিয়ে করবেই, এবং তাঁর একমাত্র বউ হবে শুধুই রামিশা। আর কেউ নয়। এই জেদে তিনি নিজের মধ্যে অন্ধত্ব ধারণ করতেও দ্বিধা করছেন না। মা হয়ে কিছুতেই একমাত্র ছেলেকে অবনতির দিকে ঠেলে দিতে রাজি নন। তাই জীবনে যত কঠোর হওয়ার দরকার হয়, ততই হবেন।
আজ শাহিনা বেশ আয়োজনের সাথেই রামিশাদের বাড়ি আসেন। রামিশাও তৈরি হয়ে নিচে নামেন। এতদিনে ব্যস্ত শাদিফের বাবাও এলেন হবু বেয়াইর বাড়ি। তিনি খুলনার এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবে আছেন। তাঁর হাতে এর চাইতেও বিরাট সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়ার মতো মনস্থির করতে পারেননি। তাঁরা আছেনই দুই মিয়া-বিবি। এই বয়সে এসে এখন একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাদের আলাদা করে দেখার মতো কেউ নেই ছেলে ছাড়া। তবুও তো, দিনশেষে একা হয়ে পড়লে একে অপরকে সঙ্গ দেওয়া চাই।
রামিশা শাড়ি পরে বেশ তৈরি হয়ে এসেছে। আজ সে চশমা পরেনি, মাথা ব্যথা করলেও সে সয়ে যাচ্ছে। পিঁয়াজ রঙের শাড়িতে রামিশাকে কী দারুণই না লাগছে। শাহিনা মুগ্ধ হলেন উড়নচণ্ডী মেয়েটার মায়াবী রূপে। আদরের সাথে আগলে নিলেন রামিশাকে। রামিশা লজ্জা পাচ্ছে না। কিংবা বলা যায়, লজ্জা পাবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি এখন অবধি। তবে শাহিনা আচমকাই বললেন,
–“ভাগ্যিস তোকে আমার ছেলের বউ করে নিচ্ছি। নয়তো তুই দূরে গেলে আমার কত আফসোসই না হত। তুই ছাড়া আপন যে আর কাউকে লাগে না।”
মনিষা পেছন থেকে ঠাট্টার সুরে বলে উঠল,
–“শুধু কী তোমাদেরই আপন আন্টি? আমাদের দুলাভাই যে কী বিপদ নিয়ে যাচ্ছে, ভাবলেই আমার মাথা ধরে যায়।”
শাহিনা চোখ রাঙালেন। বললেন,
–“খবরদার এসব বলবে না। আমার রাশুকে যে আমার গাধা ছেলেটা পাচ্ছে এটাই ওর চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।”
রামিশা মুগ্ধ হলো, আলত করে হাসল। মেয়ে মানুষ এমন শাশুড়ি পেলে হাসতে হাসতে স্বামীহীনা জীবন পার করতে পারবে। তার এই মুহূর্তে উপলব্ধি হলো, শাদিফকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি।
শাহিনা রামিশাকে আংটি পরালেন। সেদিনই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। বিয়ে হবে আগামী শুক্রবারেই। সকলে যখন মিষ্টি-মুখ করতে ব্যস্ত তখন রামিশার কানে ফিসফিস করে মনিষা বলল,
–“দুলাভাই আজ না এসে কী যে মিস করেছে। তোকে দেখলে ঘটনাস্থলেই কাত হত।”
–“সত্যি? এতই ভালো লাগছে বুঝি?”
–“হ্যাঁ রে রামিশা। মেয়েদের বিয়ের ফুল ফুটলে তার চেহারা আচমকাই কেমন স্নিগ্ধ হয়। এটা বোধ হয় সৃষ্টিকর্তার দেয়া রহমত। তোকে সত্যি সুন্দর লাগছে।”
রামিশা কিছু একটা ভাবল। আচমকা হাতে ফোন নিয়ে কিছুক্ষণ আগে তোলা রামিশার কিছু সিঙ্গেল পিকচার এবং তাকে আংটি পরানোর ছবি পাঠিয়ে দেয় শাদিফের নাম্বারে। শাদিফ তখন পুরাতন কিছু বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত ছিল। ফোনে মেসেজ চেক করতেই মুখের সমস্ত চা অপ্রস্তুত ভাবে বেরিয়ে পড়ল আরেক বন্ধুর গায়ে। চোখ কপালে তুলে রামিশার মেসেজটা পড়ল সে,
–“দেখুন তো, আমাকে আপনার বউ বউ লাগছে কি না?”
সহসা শাদিফের বন্ধুরাও সেই ছবিগুলো দেখে ফেলে। ছবির আয়োজন এবং শাহিনার আংটি পরানোর দৃশ্যে তারা ঢের বুঝে যায় শাদিফের বিয়ে ঠিক হয়েছে এই মেয়ের সাথে। অতঃপর শাদিফ পড়ে গেল বন্ধুদের যা-তাকলে। ইনিয়ে বিনিয়ে ডেট পড়ে জানাবে বলে কেটে পড়ে সেই স্থান থেকে। বাড়িতে ফিরে মায়ের সাথে একচোট ঝগড়া হয় তার। শাদিফের অনুমতি ছাড়া তার মা রামিশাকে কেন আংটি পরিয়ে এসেছে? বিয়ে-শাদি এতই সহজ? সারাকে মায়ের সাথে এখনো দেখা করাতে পারল না ওদিকে মা একদম বিয়ের ডেটই দিয়ে এসেছে? শাদিফ হতভম্ভ!
শাহিনা ছেলেক রাগ দেখিয়ে বললেন,
–“ছাড় তোর এসব সারা ভেড়া! আমি বেঁচে থাকতে তোকে কখনোই অন্ধকারে ঠেলে দেব না।”
–“মা, বোঝার চেষ্টা করো। সারাকে আমার ভালো লাগে। তুমি ওর সাথে একটু দেখা করেই দেখো না, তুমিও ওকে পছন্দ করবে বলে বিশ্বাস!”
–“এই তোর এসব ভালো লাগা টাগা ছাড় ত। এসব শয়তানের ধোকা। নিজের ভালো না বোঝার মতো গর্ধবও তুই নস।”
–“কিসের সাথে কী বলছ মা?”
–“আচ্ছা, মানলাম তুই সারাকে পছন্দ করিস। এটা বুকে হাত দিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস কর তো? সারাকে তুই ভালোবাসিস? ভালোবাসা আর ভালো লাগার মধ্যকার পার্থক্য বুঝে আমার সাথে তর্ক করতে আসিস।”
শাদিফ সেদিন রাগ করে ঘরে চলে গেল। অফিসিয়ালি কিছু কাজের জন্যে হোয়াট’সএপে ঢুকতেই সে ভুলবশত রামিশার কনভারসেশনে ঢুকে যায়। পরপর চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিষ্টি সাজের রামিশা। চশমা ছাড়া মেয়েটার চোখ জোড়া কত সুন্দর লাগছে। চোখের মনির রং চেঞ্জ লাগছে, সম্ভবত লেন্স পরেছে। শাদিফ আনমনে চেয়ে রইলো। এই রামিশার মাঝে চঞ্চলতার ছাপ একদমই নেই। কে বলবে এই মেয়েটাই তাকে রাগিয়ে দেয় আজেবাজে বকে? শাদিফের মাথায় আচমকাই মায়ের কথাটা নাড়া দিল। সে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বুকে হাত রাখল। এগুলা কোনো ব্যাপার হলো? ওসব ফ্যান্টাসি নাটক-সিনেমা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাস্তবিক কোনো লজিকে এসব খাটে না। শাদিফ আরামেই চোখ বুঝল। ভাবল তার ভালো লাগার মানুষটাকে। কিন্তু, বড়োই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। শাদিফের চোখে ভেসে উঠল আজকের রামিশা। সারার চিহ্নটুকুও তার আশেপাশে নেই। শাদিফ চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখ জোড়া খুলেছে কিছুক্ষণ হলো। অস্থিরতায় ঘরময় পায়চারী করল। অনুভব করল কপালে ঘাম জমেছে। এসব কী ধরণের কাণ্ড? মায়ের কথায় বুঝি সে এবার পাগল হতে যাচ্ছে? মায়ের এসব ভুলভাল কথা সে বিশ্বাস করতে গেছে ভাবতেই বিরক্তিতে কপালে ভাজ পরল তার।
—————–
পরেরদিন রামিশা এবং শাদিফের দেখা হয় স্থানীয় এক সুপারশপে। রামিশা এসেছিল টুকটাক শুকনো খাবার কেনা-কাটা করতে। আর শাদিফ এসেছে মায়ের লিষ্ট অনুযায়ী জিনিসপত্র কিনতে। রামিশা শাদিফের ট্রলিতে দেখতে পেল পেট খারাপের ওষুধ। তা দেখে রামিশা চাপা হাসল। বেচারার জার্মানি থেকে আসার পর থেকে শান্তি নেই। প্রায়ই পেট খারাপ হয় খাবারে গড়মিল হলে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, খুলনার মানুষ ভীষণ ঝাল খায়। এই লোক যেন ব্যতিক্রম। জার্মানি থেকে মিঠে খাবারের অভ্যাস করে এসে এখানে খাবারের মশলা পেট সহ্য করতে পারছে না।
রামিশা বেশ হেসে বলল,
–“আরে আমার হবু বরমশাই, আপনি যে?”
শাদিফ ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
–“ভাইয়া, আমি তোমার ভাইয়া হই। একদম বাজে বকবে না, ইডিয়েট।”
ইডিয়েট কথাটা ভীষণ লাগল রামিশার। তবুও শাদিফের দুর্দিনের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই মন ভালো হয়ে গেল। কুটিল হেসে বাম হাতের অনামিকা আঙুলে চকচক করা আংটিটা দেখিয়ে বলল,
–“ভাইয়া আগে ছিলেন। এখন এই আংটিটা আমাকে অধিকার দিয়েছে, আপনাকে হবু বর ডাকার।”
–“আমার যেখানে সম্মতি নেই সেখানে তুমি আংটির ভ্রমে আছ কী ভেবে?”
–“ভ্রম নয়, সত্যি। খুব শীঘ্রই আমার বর হতে চলেছেন আপনি। বিয়ে যেহেতু শুক্রবারে, সেহেতু মেয়ে মানুষী কেচ্ছা এখনই ঝেড়ে ফেলুন। পরে কিন্তু আমি এদের একদমই বরখাস্ত করব না।”
শাদিফ এই মেয়ের কনফিডেন্ট দেখে নাক কুঁচকে সরে পড়ল। কিন্তু রামিশা কী আর এত সহজে পিছু ছাড়ার মেয়ে? কেনাকাটা শেষ করেও শাদিফের পিছুই নিচ্ছে শুধু। এতে শাদিফ ভীষণ বিরক্ত হয়ে রামিশাকে ধমক দিল। এতে রামিশা কিছুটা শান্ত হয়, মুখ থমথমে করে ফেলে। গমগমে গলায় বলল,
–“হবু বউকে নির্লজ্জের মতো একা ছেড়ে দিচ্ছেন, কেমন পুরুষ আপনি?”
শাদিফ শান্ত হলো। হতাশার সাথে রামিশাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে রামিশা পুরো রাস্তায় একবারের জন্যেও মুখে খুলেনি। শাদিফ কী বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলল নাকি? তার তো রামিশার নীরবতায় স্বস্তি পাবার কথা, এখন অশান্তি অনুভব হচ্ছে কেন? রিকশা থামল শাদিফদের বাড়ির মুখেই। ওরা দুজন নামতেই শাদিফের বাড়ি থেকে চেঁচামেঁচির শব্দ শোনা গেল। শাদিফ এবং রামিশা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। শাদিফ দ্রুত হাতে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে ছুটল, সঙ্গে রামিশাও। রামিশা শাহিনাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। তবে ভেতরে এসে দেখল অন্য চিত্র, সারা দাঁড়িয়ে তাদের বাড়ি। এই মুহূর্তে সারা রেগেমেগে বেশ কঠিন গলায় শাহিনাকে কথা শোনাতে ব্যস্ত।
চলবে~~