মনকাননের সুর পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
335

#মনকাননের_সুর – [শেষ পর্ব]
লাবিবা ওয়াহিদ

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আচমকা এনার বাবার মৃত্যুর খবর এলো। বেলা দশটা নাগাদ তিনি ইন্তেকাল করেন। এ খবর শুনে রামিশার পরিবারের সবাই ছুটে যায়, রামিশা ছাড়া। রামিশা তখন পরীক্ষার হলে, কেউ কল করে তাকে পায়নি। এজন্য তাকে ছাড়া একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছে। এনা প্রায় পাগলপ্রায় হয়ে আছে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। ভোরেই সে বাবার সাথে সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটিয়ে এসেছে। বাবা চোখে চোখ রেখে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন,
–“যা মা, বাড়ি গিয়ে একটু খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আয়। আমি ত এখন সুস্থই৷ তোর অপেক্ষা করব, এখন যা। নিজের কী হাল করেছিস দেখেছিস?”

এনার বাবার অপেক্ষা আর ফুরোয়নি। মেয়েকে একা রেখে, সমস্ত আশ্বাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নীরবে চলে গেলেন। বাবার যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন তিনি মেয়েকে এক দেখাতেই ভ্রু কুচকে বলেছিলেন,
–“আমার তরতাজা মেয়ের চোখ-মুখ এমন শুকনো কেন? শ্বশুরবাড়ি থেকে খেতে দেয় না?”

মেয়েরা বাবার কাছে তাঁর রাজকন্যা হয়। তাই জীবনে যত কষ্টই হোক, বাবারা তাঁদের রাজকন্যার মুখের হাসি ভালোবেসে যেকোনো কিছুই করতে রাজি হন। তাঁরা তাঁদের আরেক মাকে ভীষণ আগলে রাখেন, ঢাল হয়ে থাকেন সর্বদা। আচমকা সেই ঢাল কিংবা আস্থা দেওয়া মানুষটাকে আজীবনের মতো হারিয়ে ফেললে সব অন্ধকার লাগে। বাবারাও তাঁদের মেয়েদের অসম্ভব প্রিয় হয়, তারা পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে শুধু তাদের এই বাবা নামক ছায়াকে চেয়ে যায়। এনাও চেয়েছিল তার বাবা আবার সুস্থ হয়ে ফিরুক, তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বিভিন্ন গল্প শোনাক, তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন, তার খেতে ইচ্ছে না করলে জোর করে খাওয়াবেন। কিন্তু.. সেসব চাওয়া এখন চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ। বাবাকে ঘিরে থাকা অসংখ্য সুখের স্মৃতি ভেবে এনা বারংবার মূর্ছা যাচ্ছে, যাওয়ার পথে প্রায় চিল্লিয়ে কেঁদে উঠে বলছিল,
–“আব্বা, আব্বাগো। আমার আব্বা!”

এ ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ অজানা রামিশা পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখে সদর দরজায় বড়োসড়ো দুটো তালা ঝুলছে। তা দেখে রামিশার ভ্রু কুচকে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই সে ফোন চেক করে। পরীক্ষার সময়ে সে সবসময় ফোন সুইচড অফ করে দেয়। যেহেতু ক্লান্ত লাগছিল সেহেতু আজ ফোন চেক করেও দেখেনি। কিন্তু ফোন অন করতেই কতকগুলো কলের পাশাপাশি রাকিব ভাইয়ের মেসেজ পেল৷ দুঃসংবাদটা চোখে পড়তেই রামিশার চোখজোড়া বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। মিনমিন করে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ে নেয়। সে কল করে তার মাকে। আয়েশা কল রিসিভ করে ব্যস্ত গলায় বললেন,
–“বল।”
–“পৌঁছে গেছ?”
আয়েশা ভরাট গলায় বললেন,
–“হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেক হলো। একটু আগে তোর আঙ্কেলের লা* আনল।”

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আয়েশার কেমন গলা ভেঙে আসল। রামিশা কলের ওপাশের সবার কান্নার সুর শুনতে পাচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আঙ্কেল নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ ছিলেন। আয়েশা থেমে আবার বললেন,
–“ভাইজান অনেক ভালো মানুষ ছিলেন, তোর বাবার এতদিনের চেনা..”

–“আমি আসব?”

আয়েশা বারণ করলেন। বললেন,
–“না, একা একা পন্ডিতি করার দরকার নেই। এখানে তোর বাবা-ভাই দুজনেই ব্যস্ত। এনাকে একা রেখে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।”

–“তো তুমি বলতে চাচ্ছ আমি একা এখানে থাকব? ভাবীর এই দুর্দিনে তাকে সঙ্গ দেব না?”
–“দিতে বারণ করিনি। তবে তুই মেয়ে মানুষ, এতদূরে কিছুতেই একা আসার দরকার নেই। তখন কল ধরলে আমাদের সাথেই আনতাম। এত ভাবিস না, আমি সামলে নিব। বিকালের দিকে দেখি রাকিবকে বলে তোকে নিয়ে আসব।”

–“ভাবী এখন কেমন আছে? ঠিক আছে তো?”
–“ঠিক নেই রে মা। দোয়া কর। আর হ্যাঁ, শাহিনা আপার বাসায় চলে যা এখন। আপাকে বলে এসেছি আমি।”

রামিশা ভীষণ অবাক হলো। দুদিন পর যার সাথে বিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে সে এখন উঠবে? অসম্ভব। মায়ের কল কেটে রামিশা অন্য পরিকল্পনা আটতে লাগল। সে দরকার হলে রাস্তায় বসে থাকবে তাও নাক উঁচু শাদিফের বাড়ি এখন যাবে না। অবশ্য তার সমস্ত ভিমরতি ওইদিন সারার বাড়ি আসাতেই কেটে গিয়েছে। রামিশা সেদিন ভালো করেই উপলব্ধি করেছে সারা ঠিক কতটা জঘন্য মানসিকতার মেয়ে। শাহিনা মামীকে যা খুশি তাই বলেছে সে। এমনকি শাদিফ এবং রামিশাকে নিয়ে বাজে কথা বলতেও ছাড়েনি সে। শাদিফকে সেদিন প্রথমবারের মতো রাগতে দেখেছে সে। এর সাথে এও প্রমাণ পেয়েছে, শাদিফ শুধুমাত্র তার সাথে বিয়ে নিয়েই হম্বিতম্বি করেছে, সারার প্রতি তার যতটুকু ভালো লাগাও ছিল সব সেদিনই উপড়ে ফেলেছে সে। সেদিন শাদিফ সারাকে ছাড় দিয়েছিল মেয়ে মানুষ বলে। হাত ওঠাতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল।

কিন্তু রামিশা আবার এত ভদ্র, সভ্য মেয়ে নয়। এজন্য সে বলেছিল,
–“আপনি হাত তুলতে পারছেন না। ফাইন, আমি তো তুলতে পারবই।”

বলেই রামিশা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সারাকে যেই চড় দিয়েছিল, মেয়ের গালে আঙুলের দাগ বসে গিয়েছিল। রামিশা সেদিন কী পরিমাণ খেপে গিয়েছিল তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ছিল সেই আঙুলের দাগগুলো। অনেকদিন তার রাগ অল্প অল্প করে জমিয়েছিল সে, সুযোগ হাতছাড়া করত কী করে? সে এমন অপমান করেছে, সাথে শাদিফ ত ছিলই আগুনে ঘি ঢালার জন্যে। শাদিফ নিজে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সারাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এতে অবশ্য শাহিনা ভীষণ স্বস্তি পেয়েছেন। এই মেয়ে যে কোনোদিন তাঁর ছেলের যোগ্য ছিল না সেই প্রমাণ ত তাঁর বুদ্ধিহীন ছেলেটা বুঝেছে— ওতেই হবে।

সেদিন এতকিছু ঘটা সত্ত্বেও রামিশা শাদিফের সাথে কথা বলেনি। আর না আজ বলবে। রামিশা যেই পালাতে নিচ্ছিল ওমনি শাহিনা ধরে ফেলেন তাকে। রামিশা এবং শাদিফের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় শাহিনা গেটের সামনে দাঁড়াতেই রামিশাকে দেখতে পান। হাঁক ছেড়ে ডাকেন হবু বউমাকে। চোর ধরা খাবার মতোই মুখটা শুকিয়ে যায় রামিশার। শাহিনা আয়েশার কল পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এসেছেন রামিশাকে নিতে। অগত্যা, রামিশাকে শাদিফের বাড়ি যেতেই হলো।

শাদিফ তখন ঘুম দিয়ে এলোমেলো অবস্থাতে নিচে নেমে এসেছে। গতরাতে অদ্ভুত অস্থিরতায় ঘুম হয়নি তার, এছাড়াও জার্মানির কোম্পানিতে মিটিং ছিল তার। জার্মানি এবং বাংলাদেশের সময়তে পাঁচ ঘণ্টার ডিফারেন্স। জার্মানি সময়ের রাত আটটা বাজে একটা মিটিং পড়ে যায় তার। সেই মিটিং গড়িয়ে শেষ হতে সময় নেয় আরও দেড় ঘণ্টা। অফিস টাইম কখনোই এত বেশি হয় না তাদের, তবে মাঝেমধ্যে ক্লায়েন্টদের সাথে জরুরি মিটিং পড়ে গেলে কোনো না কোনো ভাবে দেরী হয়েই যায়।

এই অসময়ে রামিশাকে তার বাড়ি সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখে শাদিফের ভ্রু কুচকে গেল। দুদিন পর বিয়ে তাদের, অথচ এই মুহূর্তে হবু বউ হবু শ্বশুরবাড়িতে বসে টিভি দেখছে, ভারী অদ্ভুত কাণ্ড। চোখের চশমাটা ঠিক করে সে এগিয়ে গেল রামিশার দিকে। রামিশার ধ্যান তখন টিভিতে, শাদিফকে খেয়াল করেনি সে। শাদিফ পেছন থেকে ডেকে উঠল,
–“তুমি এখানে?”

রামিশা বেশ রয়েসয়ে পেছন ফিরে, মাথা তুলে তাকায় কপালে এলোমেলো চুল লেপ্টে থাকা শাদিফকে। অতিরিক্ত ঘুমানোর কারণে শাদিফের চোখ ফুলে আছে, যা চশমা থাকা সত্ত্বেও ঢের বুঝে নেয় সে। পরপর আবার নজর ফিরিয়ে নিল কিন্তু কিছু বলল না। শাদিফ বলল,
–“আর ইউ অলরাইট রামিশা?”

রামিশা টিভির পানে তাকিয়েই মুখ খুলল এবার।
–“সুস্থ আছি, বিচলিত হবার প্রয়োজন নেই।”

শাদিফ আবার বলল,
–“দুদিন পর বিয়ে..”
–“এমন ভাবে বলছেন যেন আপনি বিয়ে করতে রাজি?”

শাদিফ অস্ফুট স্বরে বলল,
–“না, ঠিক তা নয়..”
শাদিফকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে রামিশা বলল,
–“ভাগ্যিস না বলেছেন..”
–“কেন? হ্যাঁ বললে কী হতো?”
–“বিয়ে ভেঙে দিতাম। এই মুহূর্তেই। আপনি যদি কবুল বলার আগেও হ্যাঁ বলেন তবে আমি সেই মুহূর্তেই বিয়ে ভেঙে আপনার মুখে ঝামা ঘষে দিব।”

রামিশার এহেম অহেতুক জিদ শুনে শাদিফ পুরোই আলুথালু হয়ে গেল। এই মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে কি না তা নিয়ে বেশ ভয়! যেই মেয়ে দিন-রাত তাকে বিয়ে করবে বলে কান ঝালাপালা করে সেই মেয়ে নাকি তার সম্মতি শুনলে বিয়ে ভেঙে দিবে? এ কেমন অদ্ভুত মেয়েরে বাবা? শাদিফ দুনিয়া চক্কর দিয়েছে, কিন্তু এই মেয়ের মতো তাঁরছিড়া কোথাও দেখেনি। শাদিফ আবারও প্রশ্ন করল,
–“তুমিই না বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছ, তোমার তো চাওয়া উচিত যেন আমি সম্মতি জানাই। সেখানে এই উলটো নিয়ম কেন? মাথা ঠিক আছে?”

রামিশা এবার শক্ত চোখে তাকাল তার পানে। চোখে চোখ রেখে খুব তেজী গলায় বলল,
–“একদম ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আপনি সম্মতি দিলেই আমি সাথে সাথে বিয়ে ভেঙে দিব। আমিও আপনার মুখে সেই প্রত্যাখান লেপ্টে দিব যেটা প্রতিনিয়ত আপনি আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন।”

রামিশা আর কিচ্ছুটি বলল না। সেই একই স্থানে শক্ত হয়ে বসে রইল আর শাদিফ থম মেরে একই স্থানে বসে রইলো। এই মেয়ের তেজ এবং জেদ তাকে পুরোদমে কনফিউজড বানাতে সক্ষম। এরমধ্যে শাহিনা আসলেন। শাদিফ সহসা জানতে পারল রামিশার এখানে থাকার আসল কারণ। দুঃসংবাদ শুনে শাদিফেরও বেশ খারাপ লাগল। সে মায়ের পিছে পিছে রান্নাঘরে চলে গেল। রামিশা শাদিফের যাওয়ার পানে তাকাল। শাদিফ ইদানীং ফ্রেমসহ পুরো চশমাই চেঞ্জ করেছে। থিন ব্রিজ ফ্রেমের চশমা এটা। কিছুটা রূপালি বর্ণের হওয়ায় শাদিফের ফরসা মুখে দারুণ দেখায় এটা। রামিশা চোখের মুগ্ধতা কাটাতে পারল না। এই মানুষটাকে ঘিরেই তার সমস্ত অনুভূতি, অভিমান। মনের সুর বাজে একমাত্র এই মানুষটার নামেই। অথচ এই মানুষটা অবুঝপনা করে যায় সবসময়।

পরেরদিন রামিশা এনাদের বাড়ি গেল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার কারণে রামিশার বিয়ের ডেট পিছিয়ে যায়। বিয়েটা এই জুম্মায় সম্ভব নয় বিধায় আগামী জুম্মায় আয়োজন করা হয়েছে। এই সপ্তাহটা রামিশা প্রায়ই ছাদে একাকী সময় কাটিয়েছে, নিজেকে সময় দিয়েছে সে। বিয়েটা তার জন্যে বিরাট সিদ্ধান্ত, একটা মানুষের সাথে, নতুন পরিবেশে আজীবন কাটানোর যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা একটা মেয়ের জন্যে কতটা কঠিন সেটা রামিশা টের পাচ্ছে। সঙ্গে অপেক্ষায় আছে, শাদিফের হ্যাঁ শোনার। শাদিফ হ্যাঁ বললেই সে প্রত্যাখ্যান ছুঁড়বে তার দিকে। এই জেদে পুরোপুরি অনড় সে। রামিশা যখন আকাশের পানে তাকিয়ে এসব ভাবত তখন শাদিফ নিজ বারান্দা থেকেমুগ্ধ চোখে শুধু রামিশাকেই দেখে যেত। মেয়েটা একটু তাঁরছিড়া ধরণার হলেও তাকে ঘিরে একটা টান অনুভব করে সে। এই টান কিংবা মেয়েটার প্রতি দিনকে দিন ঝুঁকে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

নির্ধারিত দিনে, নির্দিষ্ট সময়েই দুই জেদী ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। গবেষক পরিবারে আচমকা একাউন্টিং-এর ছাত্রী নিজের নাম লিখিয়ে ফেলল। বিয়েটা রামিশার জেদের বশে হলেও কবুল বলার পর থেকেই অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগছে সে। বিবেক বারবার বলছে অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও শাদিফকে বিয়ে করে তার জীবনে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হয়নি। বরং শাদিফের প্রতি সে অন্যায় করেছে। আর বিয়েতে ছেলে-মেয়ের উভয়েরই সম্মতি থাকা জরুরি। নয়তো সেটাকে বিয়ে বলে না বলেই তার ধারণা। তার এই মন-বিবেকের মিলিত খচখচানি শাদিফের সজ্জিত রুমে বসেও একবিন্দু কমেনি। এবার তার কান্না আসার উপক্রম। জেদের বশীভূত হয়ে সে কী চরম ভুলটাই না করে বসল।

শাদিফ রয়েসয়েই রুমে প্রবেশ করল। শাদিফকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রামিশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
–“আপনাকে জোর করে বিয়ে করে আমি অন্যায় করেছি তাই না?”

শাদিফ একমুহূর্তের জন্যে বেকুব বনে যায়।
–“মানে?”
–“শুনেছি জোর করে বিয়ে করলে নাকি সেই বিয়ে জায়েজ হয় না। আমার জেদের জন্য আমি আপনার প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি।”

রামিশার এহেম বোকা বোকা কথা এবং ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনে শাদিফ নিজের হাসি আটকাতে পারল না। রামিশা শাদিফের হাসি দেখে নিজেও বেকুব বনে যায়, সে হাসির কী বলেছে? শাদিফ হাসি বজায় রেখেই রামিশার পাশে এসে বসল। রামিশাকে বউ সাজে এমনিতেই সুন্দর লাগছে। তার ওপর লাল লাল ঝাপসা চোখ, লালচে বর্ণের নাক সব আরও আদুরে করে তুলেছে তাকে। শাদিফ রামিশার নাকে টোকা দিয়ে বলল,
–“জীবনে শুনেছ কোনো পুরুষ মানুষকে জোর করে বিয়ে দেওয়া সম্ভব? তোমার মতো বিচ্ছু মেয়ে তা করবে ভাবলে কী করে?”

রামিশা ভীষণ চমকে যায়। এর মানে শাদিফ নিজের সম্মতিতেই বিয়েটা করেছে? এবার রেগে গেল রামিশা। রেগে নাম কুঁচকে বলল,
–“মিথ্যেবাদী, আপনি একজন বদ লোক। চরম মিথ্যেবাদী।”

বলেই উঠতে নিলে শাদিফ তাকে ধরে ফেলল। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে শাদিফ বলে ওঠে,
–“সম্মতি আছে জানলে তুমি প্রত্যাখ্যান করে দিতে, যা তাঁরছিড়ে মেজাজ তোমার।”
–“তো প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারতেন না কেন? আমি কীভাবে আপনার প্রত্যাখ্যান সহ্য করেছি হ্যাঁ? আপনি তো দেখছি আস্ত ভীতুর ডিম!”

শাদিফ আচমকা রামিশার কোমর চেপে তাকে কাছে টেনে নিল। এতে রামিশা ঘাবড়ে যায়। শাদিফ তার চোখে চোখ রেখে বলল,
–“আমি ভালোবাসার খাতিরে সত্যিই খুব ভীতু। পূর্ণতার এত কাছে এসে তোমাকে হারানোর ক্ষমতা আমার নেই। জীবনে এমনিতেই কম ভুল করিনি। সেসব ভুলের মাশুল এত দ্রুত চাইনি।”

–“মিথ্যে বলছেন আপনি সব, সব মিথ্যে। আপনি সারাকে ছেড়ে এখন আমার উপর করুণা দেখাচ্ছেন। পুরুষ মানুষ এমনই হয়৷ একজন জোটেনি বলে আমাকে অপশন হিসেবে চুজ করেছেন।”

শাদিফ হাসল। হেসে উত্তর দেয়,
–“সারা আমার জীবনের একটা ভুল ছিল। তুমি নিজেও জানো সারাকে আমার ভালো লাগলেও ওর প্রতি কখনো ভালোবাসা জন্মায়নি। এটা আমি মায়ের সাথে সেই ঘটনার দিনই বুঝতে পেরেছি। ভালোবাসলে যেই পীড়া বুক ছিন্নভিন্ন করে দেয় সেই পীড়া আমি অনুভব করিনি, যতটা অনুভব করেছি তোমার চুপসে যাওয়া এবং আমাকে এড়িয়ে চলা দেখে। আমি আসলেই গর্ধব, যে কি না নিজের মনকাননের সুর চিনতে পারেনি।”

রামিশা তাতেও মানতে নারাজ। সে শাদিফের কোনো যুক্তিই শুনবে না। হঠাৎ শাদিফ ঘনিষ্ঠ হয়, রামিশা তার স্পর্শে শিহরিত হয়। খামচে ধরে শাদিফের শেরওয়ানির কাঁধের অংশ। অনুভূতিতে অসম্ভব রকম ভাসিয়ে নেয় তাকে। কিছুক্ষণ পর শাদিফ রামিশার ঠোঁট ছেড়ে দেয়। রামিশা চোখ ঝাপটে বন্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। শাদিফ কপালে কপাল ঠেকায়। গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–“আমার স্পর্শে কী অনুভব করেছ তুমি বউ? শুনেছি মেয়ে মানুষের সিক্সথ সেন্স খুব প্রখর হয়। মিথ্যে কিছু অনুভব করেছ?”

রামিশা নীরব। সে মুখ লুকাতে চাইলো। এই বিদেশী আস্ত অসভ্য তার প্রমাণও পেল। শাদিফ মুচকি হেসে রামিশার কানের কাছে মুখ নিল। কানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই রামিশা শিউরে উঠল, দূরে সরে যেতে চাইলেই শাদিফ তাকে ধরে ফিসফিস করে বলল,
–“তুমি আমার আগের মৃ* বেলীফুলের গাছটা এখনো যত্ন করে রেখেছ তাই না?”

রামিশা চমকে যায় এ কথা শুনে। শাদিফ কী করে জানল এ কথা? শাদিফ আবারও রামিশার কানে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
–“একটা গোপন কথা বলি, সেদিন বেলীফুলের গাছটা মা পাঠায়নি। বরং আমি নিজ হাতে কিনে এনেছিলাম তোমার মতো পাগলির রাগ ভাঙানোর জন্য। তুমি এমনই এক তোঁতাপাখি আমার জীবনে, যার সামান্য চুপ করে যাওয়াও আমি সহ্য করতে পারি না, রামিশা। আরও বেলী গাছ এনে দিব, রাগ ঝাড়ো আমার প্রিয়তমা। ভালোবাসি।”

সমাপ্ত।