#মনবিবাগী_দিওয়ানা #পর্ব_১ (কপি নিষিদ্ধ)
বহু বছরের রক্তক্ষয়ী বিবাদ, প্রতিশোধের অগ্নিশিখা, আর সীমাহীন শত্রুতার পর অবশেষে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবার এক গোপন বৈঠকে বসেছিল গত পরশু। গোপন বৈঠকখানায় ঘরটিতে টানটান উত্তেজনা। বৈঠক ঘরে আলো কম থাকায় বাতাসও ভারী হয়ে উঠেছিল সেদিন। টেবিলের ওপর রাখা অস্ত্রগুলো এক মুহূর্তের অসতর্কতায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলতে পারত।
তর্কবিতর্ক চলল দীর্ঘক্ষণ। জমি, ব্যবসা, বাণিজ্য, মামলা-মোকদ্দমা সবকিছুই এল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কেউ নত হতে চায় না, কেউ পিছু হটতে রাজি নয়।
শব্দের আঘাতে দেয়াল কাঁপল, তবু ধৈর্য হারাল না দেওয়ান বাড়ির কেউ। দীর্ঘ আলোচনার পর, শত্রুতার গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে এক ফোঁটা সমঝোতার আলো দেখা গেল। কিন্তু সেই আলো স্থায়ী হবে, নাকি নতুন কোনো আগুনের স্ফুলিঙ্গ লুকিয়ে আছে এর আড়ালে তা কেউ জানেনা।
অবশেষে বহু তর্ক-বিতর্ক, শর্ত আর পাল্টা শর্তের পর, পুরোনো শত্রুতা একপাশে সরিয়ে রেখে দুই পক্ষই নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হলো। তবে এই সমঝোতা নিঃশর্ত নয়। স্বার্থের হিসাব-নিকাশে বাঁধা। একপক্ষ নিজেদের সুবিধার জন্য প্রস্তাব রাখল, অপরপক্ষ তা মেনে নিল, কিন্তু মনে মনে নিজস্ব হিসাব-নিকাশ ঠিক রাখল।
তবে উত্তেজনা পুরোপুরি চাপা থাকেনি। মাঝেমধ্যে কথা কাটাকাটি চরমে উঠলে খান বাড়ির পুরুষেরা ক্ষিপ্ত হয়ে অস্ত্র তুলে গর্জে উঠল। কিন্তু দেওয়ান বাড়ির পুরুষেরা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। তাদের অভিব্যক্তিতে কোনো হুমকি নেই, বরং যে অদৃশ্য শাসন লুকিয়েছিল তা খান বাড়ির সদস্যদের কাছে খুব বেশি অপরিচিত নয়।
শেষমেশ, বয়োজ্যেষ্ঠদের হস্তক্ষেপে খানদের রাগ নিভল। শান্ত হল। পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বৈঠক শেষ হলো। দীর্ঘ আলোচনার পর, বহুবছরের শত্রুতার অবসান টানার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো।
সবাই মিলে কৃত্রিম হাসিতে মুখ রাঙিয়ে, হাতে হাত মিলিয়ে, জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। তা দেখে মনে হলো সব রেষারেষি, হিংসা আর রক্তের দাগ মুছে গেছে অতীতের পাতায়। আসলেই কি তা সত্যি? এত সহজে সব ভোলা যায়?
মিষ্টিমুখ করা হলো, পান বিলানো হলো, চারপাশে উৎসবের আমেজে চেয়ে গেল। কিন্তু সেই হাসির আড়ালে চাপা পড়ে রইল এক নির্মম সত্য। দেওয়ান বাড়ির কেউ এই ভণ্ডামির অংশ হতে চায়নি, তবু তাদের বাধ্য হতে হলো। কারণ তারা জানে, এই সমঝোতা না হলে তাদের পরিবারের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে।
দেওয়ান বাড়ির বড় সন্তান এখন খান বাড়ির সন্ত্রাসদের হাতে বন্দী। সহজ কথায় গুম করা হয়েছে।
খান বাড়ির লোকেরা যতই সেকথা অস্বীকার করুক দেওয়ানদের পক্ষে তা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। তারা জানে এই শর্ত মানতে না চাইলে কী ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে বন্দীর জন্য।
তাই আপাতত মাথা নিচু করে, গলার কাঁপুনি লুকিয়ে, চোখের ভাষা অস্বীকার করে মিষ্টির টুকরো মুখে তুলল তারা। তাদের একটাই লক্ষ্য যেভাবেই হোক তাদের আপনজনকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনা।
________
দেওয়ান বাড়িতে আজ বিয়ে। রঙিন আলোর ঝলকানি, অতিথিদের কোলাহল, রান্নাঘরে ব্যস্ততা সব মিলিয়ে হুলস্থুল অবস্থা। কিন্তু যার বিয়ে সে-ই অনুপস্থিত সকাল থেকে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। জানার কথাও নয়। কারণ সে কখনও নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেয় না।
গত দুদিন ধরে মুখে বাড়ির এক ফোঁটা খাবার তোলেনি, কারও সঙ্গে কথা বলেনি, বাপ-দাদার সামনে আসেনি। ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছে, অথচ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তার মা যখন কি হ’য়েছে জানতে চাইলেন, সে সোজাসাপটা বলে দিয়েছে—”সব ঠিকঠাক। কোনো অহেতুক প্রশ্ন শুনতে চাই না।”
কিন্তু কোনোকিছুই যে ঠিক নেই তা তার মায়ের চাইতে ভালো আর কে জানে?
শৈশব থেকেই ছেলেটা অদ্ভুত। তার রাগের কারণ বোঝা যায় না, তার আনন্দের উৎসও অজানা। হুট করে খুশি হয়, হুট করেই মাথায় আগুন ধরে যায়।
বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে মা জানতে চেয়েছিলেন,
“তোমার পছন্দ-অপছন্দগুলো জানিয়ে দিলে আমাদেরই সুবিধা হয় কাবির। তোমার বাবা জানতে চাইলেন, তুমি কেমন মেয়ে চাও?”
কাবির দেওয়ান তখন এক কথায় জানিয়ে দিয়েছিল, মেয়ে সাদামাটা হলেই চলবে। শালীন চলাফেরা করে এমন কেউ। নামাজ-কালামে যত্নশীল হলে ভালো। গায়ের রং, উচ্চতা এসব তার কাছে কোনো বিষয় নয়। সে শুধু একজন পরহেজগার স্ত্রী চায়।”
সন্তানের এই চাওয়া শুনে মা খুশি হয়েছিলেন। মনে হয়েছিল সব ঠিকঠাক মতোই এগোবে। কিন্তু সেই খুশির স্থায়িত্ব বেশি দিন হলো না। গত পরশু থেকেই মায়ের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা।
কারণ যার সঙ্গে কাবিরের বিয়ে ঠিক হয়েছে সে শত্রুপক্ষের এক কন্যা। অতুলনীয় রূপ, অহংকারী চাহনি, আধুনিকতা আর উচ্চবিলাসিতায় গড়া নারী সে। তার চলাফেরায়, কথাবার্তায় কঠোর শাসনহীনতার ছাপ দেখতে পেয়েছেন তিনি। যে মেয়ে কঠোর শাসনে বড় হয় সে এমন হতে পারেনা কিছুতেই। আর সবচেয়ে বড় কথা পরিবারের শেখানো সমস্ত বেলাল্লাপনা তার মধ্যে নিহিত।
_____
বিয়েবাড়িতে উৎসবের আমেজ। ঝলমলে আলো, আতর-মিশ্রিত বাতাস, আর বাদ্যের তালে জমে উঠেছে বিয়ের আয়োজন। খান বাড়ির লোকেরা প্রতিটি আয়োজন নিখুঁত করে তুলতে বদ্ধপরিকর।একটুও কমতি রাখেনি তারা।
বরের পরনে সাদা শেরওয়ানি, তার চারপাশে সাদা পাঞ্জাবিতে আবৃত অসংখ্য পুরুষ। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথোপকথনে ব্যস্ত সবাই।
কিন্তু মুহূর্তেই বদলে গেল পরিবেশ যখন খানরা এসে পৌঁছাল। মজলিশ সরব হয়ে উঠল। খান বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ এগিয়ে এসে হাসিমুখে হাত বাড়ালেন কাবিরের দিকে।
“এসো এসো দেওয়ানি। তুমি আমার নাতজামাই হতে যাচ্ছ। এসো তোমাকে মন ভরে দেখি।”
কাবির দেওয়ান নিথর দাঁড়িয়ে রইল। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু টানটান, হাতের মুঠো শক্ত হতে চাইল, কিন্তু বাবার চোখের ইশারায় সেই প্রবল আক্রোশ নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।
নিজের সমস্ত অনুভূতি লুকিয়ে রেখে, সমস্ত ক্ষোভ পেটে চেপে সে এগিয়ে গিয়ে বুক মিলিয়ে নিল।
কনের চার ভাইও বিয়ের আসরে উপস্থিত। তাদের চোখেমুখে উপহাস। একজন এগিয়ে এসে কাবিরের কাঁধে হাত রেখে খোঁচা দিয়ে বলল,
“একটু হাসো এবার। রত্ন পেতে যাচ্ছ। মুখের ভঙ্গিমা দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ জোর করে বিয়েটা করাচ্ছে।”
কাবির দেওয়ান হাসল না। মুখের রেখা একটুও নরম হলো না। বরং স্বভাবসুলভ গলায় বলল,
“দেওয়ানিরা জানে কখন হাসতে হয়, কখন কাঁদতে হয়। মিষ্টি পানের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা হয়েছে? তোমাকে একটা পান খাওয়ার অনুরোধ রইল।”
কথার সুর যতটা স্থির, তার ভেতরে জমে থাকা অগ্নি ততটাই ভয়ংকর ঠেকলো সবার কাছে।
কনের দ্বিতীয় ভাই ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি টেনে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,
“জি না। আমাদের বিয়েবাড়িতে এসবের প্রচলন নেই। তবে হ্যাঁ এক চুমুক কিন্তু দিতেই পারো।”
কাবিরের ভ্রু কুঁচকে উঠল, “কীসে?”
“মদের গ্লাসে।”
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তারা। কাবির দেওয়ান ভাষা হারিয়ে ফেলল। চারপাশের আলো, উৎসব, হৈ-হুল্লোড় সব এক ঝটকায় স্তব্ধ হয়ে গেল তার জন্য।
এতদিন সে ভেবেছিল এই বিয়েতে সে কেবল নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে তাদের পরিবারের সমস্ত নিয়মনীতি ভেঙেচুরে দেয়ার যুদ্ধ শুরু করেছে এরা। যেই যুদ্ধ ধারালো অস্ত্র দিয়ে করতে হয় না। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আর অবমাননার ধারালো ফলায় যথেষ্ট এরজন্য।
কাবির দেওয়ানের ভেতরে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল বাবা কাওসার দেওয়ান। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,
“রাগ সামলাতে শেখো কাবির।”
কাবিরের দাঁতে দাঁত চেপে থাকা টের পেলেন তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা চাইছিলেন না।
এদিকে খানদের বয়োজ্যেষ্ঠ আখতারুজ্জামান খান খোলাখুলি হেসে উঠলেন। পুরো পরিস্থিতি নিছকই এক রসিকতা বলে উড়িয়ে দিলেন। কলীমুদ্দীন দেওয়ানের দিকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“ওদের কথা ছাড়ো। এসো আমরা বাকি আলাপ সেরে নিই।”
দুই প্রবীণের করমর্দন হলো তারপর।
কাওসার দেওয়ান যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে কাবির দেওয়ানের দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলেন। সান্ত্বনাবাণী হচ্ছে এমন যে ,
“এই পরিবারের মানুষদের সাথে নয় তুমি সংসার করবে এই পরিবারের মেয়ের সাথে। সে তোমার মনের মতো হলেই হলো। না হলেও সমস্যা নেই। তাকে মনের মতো করে গড়ে নিতে হবে তোমাকে।”
___
খান বাড়ির খোলা আঙিনায় বিয়ের আসর সাজানো হয়েছে। সবুজ ঘাসের ওপর সাদা চাদর বিছানো, তার মাঝখানে রজনীগন্ধা আর গোলাপের সৌরভে মোড়ানো পর্দা দুলছে বাতাসে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে সোনালি ঝালরের নিচে বসে আছে বরপক্ষ আর কনেরপক্ষের লোকজন।
সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, ঠিক তখনই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেসে এলো,”কনে হাজির!”
সাথে সাথে উচ্চস্বরে গান বাজতে শুরু করল, আলো ঝলসে উঠল একের পর এক। অসংখ্য ক্যামেরাম্যান দৌড়ে এসে ঘিরে ফেলল কনেকে। ফ্ল্যাশের আলোয় দেখা গেল একটা মিষ্টি চেহারার বধূ।
সবার সাথে সাথে কাবির দেওয়ানও হালকা ঘাড় ঘুরালেন। খোলা ঝরঝরে চুলে, মাঝখানের সিঁথিতে শোভিত টিকলি ঝুলিয়ে আর পরনের লেহেঙ্গা খানিকটা উঁচু করে নিজের ফরসা পা উন্মোচন করে হাসতে হাসতে কনে এগিয়ে আসছে।
কাবির দেওয়ানের রক্তগরম হয়ে আসে আরও একটা দৃশ্য দেখে। কনে লেহেঙ্গাটা এমনভাবে পরেছে তার পেট, এমনকি নাভিকমল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নেয় কাবির। বসা থেকে হঠাৎই উঠে দাঁড়ায়।
সাদা পাঞ্জাবি পরা পুরুষেরা, হাসিখুশি কনে পক্ষের আত্মীয়রা সবাই একসঙ্গে চমকে তার দিকে তাকায়।
একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “কি হল কাবির?”
কাবির দেওয়ান চোয়াল শক্ত করে, ভেতরের ক্ষোভ আর অপমানের আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে বলে ওঠে,
“এই বিয়ে হবে না।”
চলমান…