#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১১
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
জোসেফ কাবিরের সাথে আজ একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করল। খাওয়ার ফাঁকে দেওয়ান পরিবারের প্রায় সবাইয়ের সাথেই তার পরিচয় হলো। সবার আন্তরিকতায় সে মুগ্ধ।
কল্পনা লুবনা বেগমের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে। কাবির যখন জোসেফের সঙ্গে কল্পনার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, জোসেফ হেসে বলে উঠল,
“আই নৌ হার ভেরি ওয়েল।”
কাবির হেসে বলল, ” ভুলেই গিয়েছিলাম!”
জোসেফ মাথা নেড়ে বলল, “ব্যাপার না।”
তারপর কিরণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “ও আপনার বোন না?”
কাবির মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, কিরণ।”
কিরণ হালকা হাসল জোসেফের সাথে।
অল্প সময়ের আলাপচারিতা শেষে জোসেফ দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
“আমাকে বেরোতে হবে মিস্টার দেওয়ান।”
কাবিরও তখন চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
“আমিও বেরোবো। আপনি একটু বসুন।’
জোসেফ মৃদু হেসে বলল, “জি।”
তারপর কল্পনার দিকে তাকাতেই কল্পনা আরেকটু সরে দাঁড়াল যাতে তাকে না দেখা না যায়। জোসেফও আরেকটু সরে দাঁড়াল যাতে তাকে আরও ভালো করে দেখা যায়। কল্পনা কিরণকে ফিসফিস করে বলল,
“একে এখন কি করতে ইচ্ছে করে?”
কিরণ ফিক করে হেসে উঠে বলল,”এভাবে বলছো কেন? উনি পিউর জেন্টলম্যান।”
কল্পনা চোখ গরম করে তাকাতেই কিরণ চুপসে গেল।
কাবির জোসেফকে বসিয়ে রেখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। ইথিকা বিছানার ওপর চুপচাপ শুয়ে আছে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কাবির ওয়েস্টকোট গায়ে চাপিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল, কিন্তু দোরগোড়ায় পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল। কী যেন মনে পড়ল হঠাৎ। আনঝিল সত্যিই ঘুমোচ্ছে?
ফিরতি পথে নীরবে আবার ঘরে ঢুকল সে। ইথিকার দিকে ভালো করে তাকাল। গালের পাশে শুকিয়ে আসা অশ্রুর রেখা, ঠোঁট হালকা ফুলে আছে, এলোমেলো কয়েকটা চুল মুখে এসে পড়েছে।
কাবির কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আর কিছু না ভেবে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল, নিঃশব্দে।
জোসেফ নীচে অপেক্ষা করছিল। কাবির এসে বলল,
“চলুুন।”
জোসেফ সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। বিশেষ করে কল্পনার কাছ থেকে। তাও ইশারায়। কল্পনা তার ইশারা দেখামাত্রই লুকিয়ে পড়েছিল। কি আজব লোক রে বাবা!
কাবির আর জোসেফ বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ করেই দেওয়ান বাড়ির সামনের সড়কটা গুমোট হয়ে উঠল। দূর থেকে গর্জনের মতো শব্দ ভেসে এল। মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে ধুলো উড়িয়ে শাঁ শাঁ শব্দে কয়েকটা বাইক ছুটে এলো রাস্তা ধরে।
সবচেয়ে সামনে আশিষ খান আর আরিশ খান। কালো জ্যাকেটের কলার উঁচিয়ে, লাল রঙা রেসিং হেলমেট পরে। তাদের ঠিক পেছনে আরও কয়েকজন, সবার চোখেমুখে দেমাগি ভঙ্গি। সবকটা আগুনদৃষ্টিতে রাস্তা চিরে ছুটে চলেছে রাতের নীরবতা ভেঙে।
তাদের ঠিক পেছনেই ধীরগতিতে এগিয়ে এল কয়েকটা পুলিশের গাড়ি। ইচ্ছে করে সাইরেন বাজাচ্ছিল।
বাড়ির জানালা থেকে কিরণ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল দৃশ্যটা। সে বুঝল না এত রাতে এই শোরগোলের মানে কী? ওরা কোথায় যাচ্ছে? আমিন খান, আসলাম খান কি ছাড়া পেয়েছে?
কল্পনা বাবার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার পাশেই শিয়রে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমটা গভীর হলেও খুব বেশি দীর্ঘ হলো না। রাত তখন বারোটা। কিরণের ডাকেই চমকে উঠে চোখ খুলল সে। ঘরের আবছা আলোয় কিরণের উৎকণ্ঠিত মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল। কণ্ঠে ঘুমঘুমে আচ্ছন্নতা মিশিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
কিরণ জানালার দিকে ইঙ্গিত করে ফিসফিসিয়ে বলল, “রাস্তা দিয়ে পুলিশের গাড়ি যাচ্ছে। কয়েকটা বাইকও। ওরা নিশ্চয়ই ছাড়া পেয়ে গেছে।”
কল্পনার শঙ্কিত হয়ে বলল, “আসলাম খান?”
কিরণ মাথা ঝাঁকালো। “হ্যাঁ।”
কল্পনার কপালে ভাঁজ পড়ল। “ছাড়া পাবে কীভাবে? বড় ভাই এখনো ফেরেনি?”
কিরণ নিচু গলায় বলল, “না।”
কল্পনা বাবার গায়ে আলতো করে কাঁথা টেনে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশে একবার তাকাল। ছোট মা ঘুমিয়ে পড়েছেন, ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ললিতা খালা আর শিউলিও বোধহয় শুয়ে পড়েছে, তাদের সাড়াশব্দ নেই। পুরো বাড়িটা নীরব, শুধু কল্পনা আর কিরণই জেগে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে কল্পনা কাবিরের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ভেজানো ছিল। ঠিকমতো লাগানো হয়নি। হাত বাড়িয়ে একটু ঠেলতেই দরজাটা শব্দহীনভাবে পুরোটা খুলে গেল। কল্পনা একটু অবাক হলো। ঘর এত অন্ধকার!
আলো জ্বালাতেই সে দ্বিগুণ চমকে উঠল।
বিছানাটা খালি! ইথিকা কোথাও নেই!
একটা অস্বস্তি বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিল। সে দ্রুত ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে কিরণকে ডাক দিল,
“এই কিরণ ভাবি নেই কেন?”
কিরণ ঘরের ভেতরে ঢুকে এল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখল বিছানাটা সত্যিই খালি! ভাবি নেই! এত রাতে কোথায় গেল? বাবার বাড়ি গেছে? নাহ, এত রাতে অসম্ভব! তাহলে?
কল্পনা সোজা কাবিরের ফোনে কল দিল। রিং বাজল, কিন্তু কাবির ফোন ধরল না।
কিরণ বলল, “ভাবির ফোনে কল দাও। দাদাজান জানতে পারলে তুলকালাম হবে। আমি ভয় পাচ্ছি…”
কল্পনার কপাল কুঁচকে গেল। “কিসের ভয়?”
কিরণ গলা শুকিয়ে এল।
“ভাবি ওই জায়গাগুলোতে যায়নি তো? ওখানে ওরা নিয়মিত যাতায়াত করতো আগে।”
কল্পনা সাথে সাথে ধমকে উঠল, “কি সব বাজে কথা বলছিস? ও আগে গিয়েছে। এখন কেন যাবে? আর যদি গিয়ে থাকে, তাহলে এই বাড়িতে ওর জায়গা হবে না আর। যা ইচ্ছে করুক। বড় ভাইয়ের জীবনটা ছারখার করতে এসেছে।”
কল্পনা ইথিকার নম্বরে একের পর এক কল দিতে লাগল। ব্যস্ত সুরে রিং বাজতেই থাকল, কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়া নেই।
অস্থিরতায় কল্পনার হাত কাঁপছে। মাথার ভেতর দুশ্চিন্তার ঝড়। ভাবি ফোনটা রিসিভ করুক। ভাই আসার আগে ফিরে আসুক।
কিরণ বলল,”রিসিভ করবে না। হুঁশে আছে কিনা সন্দেহ।”
কল্পনা তাকে থামতে বলল। শেষমুহূর্তে ইথিকা ফোনটা রিসিভ করেছে। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই ভেসে এল গুঞ্জন। একসঙ্গে অনেকগুলো পুরুষের কণ্ঠস্বর, গানের বীট। কারো কথা স্পষ্ট নয়। কিন্তু অতগুলো পুরুষ লোকের গলার স্বর কল্পনার রক্ত জমিয়ে দিল। ভাবি আবারও ওসব জায়গায় গিয়েছে?
কয়েকজনের উচ্চ হাসির শব্দ ফোনের ওপাশ থেকে ধাক্কা দিল কল্পনাকে। কল্পনা ফোনটা শক্ত করে কানে ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। মাথার রগ দপদপ করে উঠল তার। আশিষ খানের গলার আওয়াজ শোনা গেল না? ভাইবোন সবকটা ওখানে? কল্পনা ফোন কেটে দিল। কিরণ জানতে চাইল,”কি হলো?”
কল্পনা বলল,”তুই ঠিক ভেবেছিস।”
কিরণ শঙ্কিত হয়ে বলল,”এখন কি হবে?”
“কি আর হবে। বড় ভাই জানতে পারলে ওখানে যাবে। আর চড়াতে চড়াতে বাড়ি নিয়ে আসবে। বড় ভাই ওকে কিভাবে সহ্য করে সেটাই তো বুঝতে পারছিনা আমি।”
কিরণ বলল,”ও ওর ভাইদের আস্কারা পাচ্ছে।”
কল্পনা ঘরে গিয়ে শুতে পারল না। ঘরময় পায়চারি করতে করতে কিরণকে বলল,
“আমার কি মনে হচ্ছে জানিস কিরণ?”
“কি?”
“আর্যাব খান এত সহজে হাল ছাড়বে না। সে চড় খেয়ে নীরবে চলে গেল কি করে?”
“তোমার কি মনে হচ্ছে?”
“ও তলে তলে আরও ফন্দি আঁটছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে। ওর মতো নষ্ট লোকদের আমি বিশ্বাস করিনা।”
______________
কাবির বাড়ি ফিরে সোজা ঘরে চলে এসেছে। বিছানার উপর কোলবালিশদুটি। কোলবালিশের উপর কম্বল থাকায় মনে হচ্ছিল কেউ শুয়ে আছে গুটিসুটি মেরে।
কাবির ওয়েস্টকোট খুলে, কব্জি থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে আয়নার দিকে একবার তাকাল। আজকে অনেক দখল গিয়েছে। একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন। ক্লান্ত লাগছে। কাল সকালে আবারও থানায় যেতে হবে।
ঘড়িটা খুলে সে সে ডিভানে পা টেনে এক পায়ের উপর অন্য পা রেখে শুয়ে পড়ল। হাত মুঠো করে করে ঠোঁটের উপর চেপে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আকাশকুসুম ভাবছিল।
হঠাৎ কি মনে পড়তেই কপাল কুঁচকে গেল। আয়নার দিকে ফের তাকাল। রাতে আয়নার সামনে সচরাচর পর্দা টেনে রাখে সে। পর্দাটা ইথিকা সরায় যদি তার সাজগোজের প্রয়োজন হয় তখন।
কাবিরের চোখ কুঁচকে গেল। সে পা নামিয়ে সরাসরি বিছানার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল। তারপর আচমকা ভারী গলায় গর্জে উঠল!
“কল্প! কিরণ!”
কল্পনা আর কিরণ তড়িঘড়ি করে ছুটে এল। বুক কাঁপছে। কাবির তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আনঝিল কোথায়?”
কল্পনা গলার কাঁপুনি লুকিয়ে বলল,”পার্টিতে। ওর ভাইরাও আছে ওখানে। আমি ফোন দিয়েছি রিসিভ করেনি। আপনাকেও ফোন দিয়েছিলাম। আপনি ফোন তোলেননি।”
কাবির ওয়েস্টকোট, ঘড়ি সব ফেলে গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কল্পনা দিশেহারা হয়ে পিছুপিছু ছুটল।
“একা যাচ্ছেন? ভাইকে ডেকে দিই?”
কাবির শক্ত কণ্ঠে বলল,”কাউকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আমি চলে আসব কিছুক্ষণের মধ্যে। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
কাবির বেরিয়ে গেল। পার্টিতে গিয়ে দেখল ছেলেমেয়ে একসাথে নাচছে। অবিশ্বাস্য উন্মাদনা তাদের। ছেলেমেয়ে একে অপরের সাথে ঢলাঢলি করছে। হাত ধরাধরি, কোমরে চেপে ধরে শরীরের নানান অঙ্গভঙ্গি, এমনকি অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তও। কাবির চোখ সরিয়ে নিল। তার অস্থির মন ইথিকাকে খুঁজছে। হঠাৎ একটা লোক এসে জিজ্ঞাসা করল,
“কে আপনি?”
কাবির দাঁত চিবিয়ে বলল,
“কাবির দেওয়ান। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।”
লোকটা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে হকচকিয়ে সরে গেল।
কাবির সামনে এগিয়ে গেল। আনঝিল কোথায়?
হঠাৎ কেউ একজন কাবিরের পথ আটকে দাঁড়াল।
“আরেহ দুলাভাই!”
কাবির আশিষ খানের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। কলার চেপে ধরল সাথে
সাথে।
“নিজেরা নষ্টামি করছিস কর। সেখানে বোনকে কেন ডেকে এনেছিস?”
আশিষ খান হাসল। বলল,
“সে এখানকার রাণী। বুঝলে? রাণী।”
কাবির তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই তাকে ধরে ফেলে শিষ বাজাতে বাজাতে আর্যাব খান হাজির। চোখেমুখে বদমায়েশি হাসি। তাকে দেখামাত্রই কাবিরের রাগ তরতর করে বেড়ে গেল।
নির্লজ্জ! দুটো চড় খেয়েও লজ্জা নেই। কাবিরকে দেখামাত্রই সে হেসে উঠে বলল,
“আরেহ জামাইবাবু যে! বউয়ের প্রতি এত টান! বউয়ের লেজ ধরে হাঁটা শিখে গিয়েছ দেখছি। গুড গুড গুড। ভেরি গুড। আমার তো হেব্বি জোস লাগছে তোমাকে এখানে দেখে।”
কাবির বলল,”বারো ঘন্টাও যায়নি আমার চড় খেয়েছিস।”
আর্যাব খান হাসল নির্লজ্জের মতো। ঘাড় চুল্কাতে চুল্কাতে বলল,
“আসলে হয়েছে কি, আমি আর্যাব খান গুরুজনদের মারধরে মাইন্ড করিনা।”
কাবির তার বুক বরাবর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আর্যাব খান বুক চেপে ধরল। ব্যাথা পেয়েছে শক্ত হাতের জোরাল ধাক্কাটায়। তবুও বদমায়েশি হেসে বলল,
“জামাইবাবু বুকে হাত দেয়। জামাইবাবুর বোন কলিজায়। ভেরি ইন্টারেস্টিং!”
আশিষ খান তার দিকে বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”ব্রো তোমার কম হয়ে গেছে। আরেকটু নাও।”
আর্যাব খান বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে খেল। তারপর আশিষের কোমরে লাথি বসিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“জামাইবাবু কোথায় গেল? ওইইই জামাইবাবু!”
কাবির ইথিকাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ থমকে গেল। মনে হলো পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গিয়ে সব কিছু ঝাপসা হয়ে এসেছে। কয়েকটা লোকের মাঝখানে ইথিকা সোফায় বসে আছে। একহাতে ধোঁয়া ওঠা জ্বলন্ত সিগারেট, অন্য হাতে ম্যাকালের বোতল। তার ড্রেসের রঙ তার গায়ের রঙের সাথে মিশে এক হয়ে গেছে। বোঝায় যাচ্ছে না কি রঙের পোশাক পরেছে। ড্রেসের ডান হাতা আছে, তবে বাম হাতা অনুপস্থিত, সারা শরীর খোলামেলা। গলায় ঝুলছে ঝলমলে চেইন। ঠোঁটে মাখা টকটকে লাল লিপস্টিক তার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠোঁটদুটো বেশি নজর কাড়ছে। চোখে এত গাঢ় কাজল বোধহয় সে আগে কখনো পরেনি। মুখের চকচকে ত্বক অল্প আলোর মাঝেও অপরূপ দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
কাবিরের আর এগোতে ইচ্ছে করলো না। সে একপাও এগোলো না। এত অধঃপতন!!
হঠাৎ তার সাথে ধাক্কা লেগে একজনের হাত থেকে গ্লাস জাতীয় কিছু পড়ে গেল। লোকটা কাবিরকে কথা শোনাতেই কাবির বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তাকে আচমকা ঘুষি বসিয়ে দিল রাগের বশে। লোকটা তার দিকে তাকাতেই দেখল তার
চোখ দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। আর একমুহূর্তও সেখানে ব্যয় না করে সে চলে এল। লোকটাকে ঘুষি দেয়ার পরপরই ইথিকার চোখে পড়েছে তার দিকে। সে কোনোমতে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে এক আঙুল বাড়িয়ে দিল কাবিরের দিকে। ডাকার আগেই আবারও ঢলে পড়ল কারো কোলে।
কাবির একা ফিরেছে বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করেনি। বাইরে বাগানের শান বাঁধানো বেঞ্চে বসে আছে। আকাশে পূর্ণিমার আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে ঝলমল করছে। আকাশটা অস্থির ঠিক তার মনের মতো। কাবির দুচোখ বন্ধ করে বসে রইল। রাগ কমলে বাড়িতে ঢুকবে। নইলে কখন কাকে কি বলে বসবে। নিজেকে শান্ত রাখাটা তার কাছে একটা যুদ্ধের সমান। কার উপর রাগ দেখাবে সে? সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ওই বাড়ির মেয়েকে সে তার জীবনে কেন এই বাড়িতে আর কোনোদিন প্রবেশ করতে দেবে না। তার কথায় শেষ কথা।
বাড়ির ভেতরে সবাই জেগে উঠেছে। কাবির বাড়ির ভেতরে হৈচৈ শুনে ভেতরে প্রবেশ করল। লুবনা বেগম ছুটে এল,
“বউ কোথায় কাবির?”
কাবির মায়ের প্রশ্ন শুনে বাবা কাওসার দেওয়ানের দিকে তাকাল। মনে ক্ষোভ পুষে একটাই জবাব দিল,”জাহান্নামে।”
চলমান…,
#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১২
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
কাওসার দেওয়ান কি বলবেন?
না ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে পারলেন, না বলতে পারলেন তিনি নিজ হাতে ইথিকাকে শায়েস্তা করবেন। লুবনা বেগমের এখনো সবটা পরিষ্কার হয়নি। তিনি কাবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ছাইপাঁশ খেয়েছে?”
কাবির মায়ের দিকে কিছুটা অবাক চাহনি নিক্ষেপ করল। মা কি সবটা বিস্তারিত জানতে চাচ্ছে? তাকে এখন নিজের মুখে বলতে হবে তার বিবাহিত বউ পরপুরুষের সাথে কি কি করছে?
কল্পনা আর কিরণ জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবি কখন বেরিয়েছে তারা জানেনা। অপরাধবোধে ভুগছে তারা। ভাই কি তাদের উপর রেগে আছে? কিন্তু তাদের কি করার ছিল? তারা ভাবতেও পারেনি ভাবি এমন পরিস্থিতিতেও ওখানে যাওয়ার মতো মানসিকতা রাখে। অথচ তার মেঝ ভাইকে বড় ভাই চড় মারায় কি কান্নাটাই না করছিল। কি অদ্ভুত মেয়ে সে! ভাইয়ের চেহারার দিকে তাকালে তার কি একফোঁটা অনুশোচনা হয় না? তার এখন মনে হচ্ছে একটু সতর্ক থাকলে ভাবি বেরোতে পারতো না। কিন্তু কেউ কি দেখেনি ভাবিকে বেরোতে? এটা কিভাবে সম্ভব? ছোট মা’রা না হয় ঘুমিয়ে ছিল। বাকিরা কোথায় ছিল? সে তো বাবার ঘরেই ছিল। কিরণ তার ঘরে। ঝিনুক কি দেখেনি?
সে সন্দিহান হয়ে ঝিনুকের দিকে তাকাল। তাকে কপাল কুঁচকে তাকাতেই দেখে ঝিনুক সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। কল্পনার সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। তারমানে ঝিনুক কিছু না কিছু জানে। ভাবি কি তাকে হাত করেছে কোনোভাবে?
কাবির নিজের ঘরে চলে গেল। যাওয়ার আগে স্পষ্ট জানিয়ে গেল ইথিকা এলেও তাকে যেন এই বাড়িতে ঢুকতে না দেয়া হয়। এই বাড়িতে হয় সে থাকবে নয়ত ইথিকা থাকবে।
লুবনা বেগম এত দুশ্চিন্তা আর নিতে পারছেনা। কেন যে ওই খানদের সাথে সম্পর্কে জড়াতে হলো। ওরা না নিজেদের ভালো বোঝে, না অন্যের। সবসময় নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলে। অন্যের কি ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই।
লুবনা বেগম ধীর পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরে এলেন। বিছানায় একপ্রকার ভেঙে পড়ার মতো বসে পড়লেন। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। ছেলেটা এখন কী করবে? এমন একটা মেয়ের সঙ্গে সংসার অসম্ভব। এভাবে কতদিন চলবে?
তালাক দেবে? কিন্তু সেখানেই তো সবচেয়ে বড় ভয়। তালাক হলে ‘খান’ পরিবার এই অপমান সহজে মেনে নেবে না। তারা চুপ করে থাকবে না, বরং আরও ভয়ানক, আরও জঘন্য কোনো ফাঁদে ফেলবে কাবিরকে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়িয়ে ছাড়বে। বহুবছরের বিবাদের সমাপ্তি না ঘটে আবারও নতুন করে বিবাদ শুরু হবে। কাবির যদি কোনোদিন আবারও নতুন করে জীবন শুরু করে তাহলে তার জীবনটা তার বড় জ্যাঠার জীবনের মতো ছারখার করে দেবে ওরা। কি জঘন্য খেলা খেলছে খানরা। এমন এক জঘন্য খেলায় ওরা মেতে উঠেছে যেখানে না ওদের সাথে উঠবস করা যাচ্ছে না ওদের সওয়া যাচ্ছে।
কাওসার দেওয়ান ঘরে ঢুকে দরজা চাপা দিয়ে দিলেন। তারপর ভারি পায়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমি ওদের উপর থেকে মামলা তুলে নিচ্ছি লুবনা।”
লুবনা বেগম মুহূর্তেই জমে গেলেন। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,”মানে?”
কাওসার দেওয়ান ধীরে মাথা নেড়ে বললেন,
“হ্যাঁ ঠিকই শুনেছো। তবে শর্তসাপেক্ষে।”
লুবনা বেগম হতভম্ব হয়ে উঠলেন। গলার স্বর একটুখানি কাঁপল,
“আপনি দয়া করে আগবাড়িয়ে কোনো কাজ করতে যাবেন না। কাবির এবার রেগে যাবে। ওকে ওরমতো করে সবটা সামলাতে দিন। ছেলেটা আপনার চাইতে সব ভালো বোঝে। ও অনেক কষ্টে ওদের জেলে দিয়েছে। আর্যাবের চাকরি যাবে হয়ত কালকে। ওকেও জেলে দেবে। আপনি এখানে কোনো হঠকারিতা দেখাবেন না।”
কাওসার দেওয়ান স্ত্রীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর হাসেন। লুবনা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
“হাসছেন কেন?”
“খানদের কবে থেকে এত বোকা ভাবছ লুবনা? তোমার কি মনে হয় ওরা এই মামলায় ভয় পেয়েছে? ভয় পেলে ওরা নাচতে গিয়েছে নাইট ক্লাবে? আসলাম খানের মতো দালালের নামে শতশত মামলা অভিযোগ হওয়ার পরও সে বুক ফুলিয়ে হাঁটে কিভাবে একবার ভেবেছ? আর্যাব খানের মতো অসৎ, ঘুষখোর পুলিশ অফিসারের দিনদিন পদোন্নতি কিভাবে বাড়ছে টের পেয়েছ? আমিন খানের মতো দূর্নীতিবাজ লোক ব্যাংকের ঋণ খেলাপির মতো জঘন্য কাজ করার পরও কিভাবে মানুষের চোখে দেবতা সেজে বসে আছে দেখেছ? তোমার কি মনে হচ্ছে জেলে ঢুকিয়ে পুলিশ ওদের পেটাচ্ছে? ওদের আপ্যায়ন করা হচ্ছে। খবর নিলে দেখা যাবে ঝোল মাংস দিয়ে ভুঁড়ি ভোজ হচ্ছে। আর সেই খুশিতে ওর তিন ছেলে আর মেয়ে মিলে নাইট ক্লাবে মাস্তি করছে। কাল দেখবে বড় অফিসারদের ফোনে কয়েকটা উপরওয়ালার ফোন এসে গেছে। আর ওরা খানদের ছেড়ে দিতে বাধ্য। সেখানে আমার তোমার কাবিরের কিচ্ছু করার নেই।”
লুবনা বেগম স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কাওসার দেওয়ানের দিকে। সবটা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন,
“এখন আপনি ঠিক কী করতে চাইছেন?”
কাওসার দেওয়ান গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“ওরা চাইলে এখনই জেল থেকে বের হতে পারত। কিন্তু ইচ্ছা করেই বেরোচ্ছে না। ওরা কাবিরকে দেখাচ্ছে ওরা শাস্তি মেনে নিয়েছে। কারণ, যদি তারা জেদ করে এখনই বেরিয়ে আসে তাহলে কাবির তাদের সঙ্গে করা সব চুক্তি বাতিল করে দেবে। ওরা সেটা জানে। আমি এখন স্বেচ্ছায় ওদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেব। শর্ত থাকবে আমাদের বাকি চুক্তিগুলো যেমন ছিল, তেমনই চলবে। বিনিময়ে কাবিরের জীবন থেকে ওদের মেয়েটিকে সরিয়ে নিতে হবে চিরতরে। সেই মেয়েটারও কাবিরের সঙ্গে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই। সে শুধুই জেদের বশে, খামখেয়ালিপনায় কাবিরের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। ওদের পরিবারেরও কোনো সময় সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল না কাবিরকে জামাই করার। সবটাই মেয়েটার সাজানো খেলা ছিল। একটা কুৎসিত প্রতিশোধ নিয়েছে সে। কাবিরকে অপদস্থ করার জন্যই সে বিয়েটা করেছে। কাবিরকে দেখিয়ে দিয়েছে ও যা চায়, সেটাই হয়। কাবির তার হাতের পুতুল। যাকে ইচ্ছে হলে নাচানো যাবে আর দরকার ফুরালে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে। ও প্রমাণ করে দিয়েছে যাকে কাবির সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত, সেই ঘৃণ্য মেয়েটাকেই তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে। কাবিরের অহংকার, পছন্দ-অপছন্দ, সবকিছুকে পিষে দিয়ে সে নিজের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়েছে।”
লুবনা বেগম বললেন,”ওদের কি কোনো বিচার হবে না?”
“হবে কিন্তু শক্তপোক্ত অভিযোগের দায়ে। বড় ভাইকে গুমের অভিযোগটা অত শক্ত কারণ না। কারণ ওই মানুষটার গায়ে একজন জেলখাটা খুনীর তকমা লেগে গেছে। তাও খানবাড়ির মেয়েকে। ওদের গুম করার বিষয়টা অপরাধ কিন্তু অতবড় অপরাধ নয় যার কারণে তাদের বড় শাস্তি হতে পারে।”
“আমি আর নিতে পারছিনা এসব। এরা বারবার অন্যায় করে পার পেয়ে যাচ্ছে। মাজহাবকে খুন করেছে ওরা। আপনি কি জানেন মাজহাবের বউও নিখোঁজ?”
কাওসার দেওয়ান অবাক হয়ে তাকান। কপাল কুঁচকে জানতে চান,
“মাজহাব বিয়ে করেছিল?”
“হ্যাঁ, ওকে খুন করে ওর বউকে কোথায় গুম করেছে তা আজ পর্যন্ত কেউ জানেনা। গুম করেছে নাকি মাজহাবের মতো খুন করেছে জানিনা।”
কাওসার দেওয়ান হিসেব মিলাতে পারলেন না। অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
“মাজহাব বিবাহিত স্বত্বেও ইথিকার সাথে সম্পর্ক রেখেছিল?”
“ওই মেয়ে মাজহাবকে বাধ্য করেছে তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে। জোর খাটিয়ে মাজহাবকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। মাজহাব চায়নি বলে ওর ভাইদেরকে দিয়ে খুন করিয়েছে। আমার তো মাজহাবের স্ত্রীর কথা ভেবেই ভয় করছে। মেয়েটার কি দশা হলো কে জানে? কাবির ওর খোঁজ করছে। পেয়ে গেলে তো ভালোই। কত ভালো একটা মেয়ে। ওরকম একটা মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে পেলে…..
সাথে সাথে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে কিরণ।
“মা ভাবি এসেছে। কেমন ঢুলছে। এখন কি করব? ভাইয়া বাড়িতে না ঢোকাতে বলেছে।”
লুবনা বেগম দ্রুত ছুটে গেলেন। ইথিকা কলিং বেল বাজাচ্ছে একনাগাড়ে। সাথে অস্ফুটস্বরে কি কি যেন বলছেও। লুবনা বেগম দরজা খোলামাত্রই দেখল, দুটো লম্বা লম্বা লোকের কাঁধে ঝুলে ইথিকা বাড়ি ফিরেছে। মাতলামি করছে। লোকদুটো ইথিকাকে ছেড়ে দিতেই ইথিকা লুবনা বেগমের দিকে ঝুঁকে পড়ল। লুবনা বেগম ইথিকাকে ধরল না। বরং কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন। ইথিকা হতভম্ব হয়ে তাকাল! আবারও ঢুলে পড়তে নিল। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে গেল। মদের বাজে গন্ধ ভাসছে তার শরীর থেকে। লুবনা বেগমের দিকে আঙুল তুলে বলল,
“এই বুড়ি!”
লুবনা বেগম রেগে গিয়ে কষে আরও একটা চড় বসাতে চাইলে ইথিকা সাথে সাথে উনাকে ধাক্কা দেন। আর তিনি পড়ে যেতে নিলে ছেলের বুকে গিয়ে পড়েন। কাবির মাকে শক্ত করে ধরে হাতের উল্টো পিঠ ঘুরিয়ে ইথিকার গালে চড় বসায় সর্বশক্তি দিয়ে। ইথিকা এবার টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল নীচে। কপালটা মেঝেতে ঠুকল। কাবিরের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। কাবির আঙুল দিয়ে বাইরে দেখিয়ে বলল,
“দূর হও এই বাড়ি থেকে। এই বাড়িতে নষ্ট মেয়েমানুষের জায়গা হবে না।”
ইথিকা সেভাবেই তাকিয়ে রইল। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। লুবনা বেগম কাবিরকে শান্ত হতে বললেন। বললেন,
“ও এভাবে যাবে না। কল্প একটা ওড়না নিয়ে আয়।”
কাবির কল্পনার দিকে তাকাল। কল্পনা দ্রুত একটা ওড়না নিয়ে এসে ইথিকার গায়ে জড়িয়ে দিল। ইথিকা সেটা গায়ে দিল না। কাবিরের পা বরাবর ছুঁড়ে মারল। কাবির তার পায়ের দিকে তাকাল। লুবনা বেগমকে ছেড়ে পায়ের কাছ থেকে ওড়নাটা তুলে নিয়ে ইথিকাকে বলল,
“আমি ওড়না দিয়ে ঢেকে তোমাকে যেমন সম্মান দিতে জানি তেমন এই ওড়না প্যাঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিতেও জানি। আমাকে রাগিওনা।”
ইথিকা মেঝে থেকে উঠতে উঠতে “থুহ” শব্দ করে থুতু ছুঁড়ল কাবিরের দিকে তাকিয়ে। লুবনা বেগম হকচকিয়ে গিয়ে মুখে হাত দিলেন। কাবিরের চোখদুটো দপদপ করে উঠল রাগে। কল্পনা আর কিরণ হতভম্ব!
কাবির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইথিকা থুতু ছুঁড়ে ঘরে চলে গেল ঢুলতে ঢুলতে। কাবিরও দেরী করেনি। ঘরে এসে ধাক্কা দিয়ে ইথিকাকে ঘর থেকে বের করে দিল। ইথিকা মুখ থুবড়ে চৌকাঠের বাইরে গিয়ে পড়ল। কাবির তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে কপাল চেপে ধরে। দরদর করে ঘামছে সে। আর না। এই মেয়ে আর সহ্য না। একটা মুহূর্তও না।
ইথিকা দরজা ধাক্কাচ্ছে ইচ্ছেমতো। দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বলল,
“কাবির! দরজা না খুললে আমি খুন করব। মেরে ফেলব। আমার নাম আনঝিল খানম। আমি মারতে জানি। দরজা খুলতে বলছি। কাবির!!!”
তার চিৎকারে বাড়ি কাঁপছে। বাড়ির সবাই আর বেরোচ্ছে না। কাবির দরজা খুলবে না। ইথিকা চেঁচাল দরজা ধাক্কা দিতে দিতে।
“কাবির দরজা খুলতে বলছি। দরজা না খুললে আমি মাথা ফেটে ফেলব।”
কাবির ভেতর থেকে সাড়া দিল।
“যা ইচ্ছ করো। মরে যাও। কিচ্ছু যায় আসে না আমার।”
ইথিকা দরজায় মাথা ঠুকতে লাগল। এবার চিৎকার চেঁচামেচির সাথে বিলাপ করে কান্না। কাবির তবুও দরজা খুললো না। বেশ কিছুক্ষণ পর ইথিকার আর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কাবির তবুও দরজা খুলেনি। সে নিজের সিদ্ধান্ত অটল, অবিচল। ইথিকার প্রতি সে কোনো মায়া দেখাবে না। কিছুতেই না। মাঝরাত্রিরে হঠাৎ চোখটা খুলে এসেছিল। কাবির বালিশে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ঘুম ছুটতেই সে সোজা দরজা খুললো। সাথে সাথে চোখে পড়ল ইথিকা মেঝেতে শুয়ে আছে। কাবির ধীরেধীরে তার সামনে বসে পড়ল। মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েকে দেখে তার বোঝা হয়ে গেছে কেন বড় জ্যাঠা তার ফুপু অন্তরা খানমকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করেছিল। বড় জ্যাঠার জীবনটাও এরকম অশান্তিতে ভরিয়ে তুলেছিল অন্তরা। ঠিক একই পথে হাঁটছে ইথিকাও। কিন্তু কাবির তার জ্যাঠার মতো ভুলটা করবে না। খুব বড় কিছু হয়ে যাওয়ার আগে সে ইথিকাকে তার জীবন থেকে বের করে দেবে আর সেটা কালই।
_________________
তাহমিনা ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বেরিয়েছে। নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে হঠাৎ ভীড় দেখে সে এগিয়ে গেল। এত হৈচৈ কীসের? ভীড়ের মধ্যিখানে আসলাম খানকে দেখে বুকের ভেতর ধড়ফড়িয়ে উঠল তার। এই লোক তো জেলে ছিল। ছাড়া পেল কিভাবে? ছাড়া পাওয়ামাত্রই এখানে মরতে চলে এসেছে? সে কিছুতেই এই লোকটার সামনে যাবে না। তার জীবনটা সে গুছিয়ে নেবে নিজের মত করে। ওই বাড়ি থেকে সে যখন একবার বেরোনোর সুযোগ পেয়েছে তখন সেই সুযোগ সে হাতছাড়া করবে না। এই খানরা কোনোদিন শোধরানোর না। তাকে কাজের লোকের মতো খাটাতে পারছেনা বলে আসলাম খানের যত অশান্তি। তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মতো বোঝাপড়া, ভালোবাসা নেই যার কারণে আসলাম খান তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এমন করছে। সে দ্রুত পিছু হাঁটল। একজন হঠাৎ ডেকে বলল,
“ভাবি চলে যাচ্ছেন কেন? ভাই আপনাকে খুঁজতে এসেছে দেখছেন না?”
তাহমিনা চোখ রাঙিয়ে দ্রুত হাঁটা ধরল। আসলাম খান তাকে দেখামাত্রই ছুটে এল। তাহমিনা তার আগেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেছে। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে। গেইট ধাক্কাচ্ছে আসলাম খান।
“তাহু খুন করব বলে দিচ্ছি। তোমার সাথে আমার কথা আছে। আমার সামনে এসো।”
তাহমিনা গেইটের দিকে তাকিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। হাতের কাগজপত্রগুলো দ্রুত কুড়িয়ে নিয়ে সটকে পড়বে তার আগেই কাবিরকে দেখে সে থমকে গেল।
“ভাইয়া আপনি!”
কাবির শান্ত স্বরে বলল,”এখানে সধবা নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না মিনা।”
তাহমিনার চোখজোড়া ছলছল করে উঠল।
“আমি বিধবাই ধরে নিন।”
কাবির গেইটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“গেইটের বাইরে তাহলে কে?”
তাহমিনার গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল।
“একটা জ্বলজ্যান্ত অমানুষ।”
চলমান….
#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
তাহমিনার কথা শুনে কাবির কিছু বলল না। তবে একটু সময় নিয়ে বলল,
“জীবনে নিজের ভালো থাকাটা খুব দরকার মিনা। ভালো থাকার জন্য কষ্ট করতে হয়। আমি আশা রাখব তুমি সব সামলে এখানে কাজ শিখতে আসবে। তুমি জানো খানদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন। কোনো ছুতো পেলে ওরা তিলকে তাল করে ছাড়ে।”
তাহমিনা কাবিরের কথার মানে পুরোপুরি বুঝে গেছে। সে আর কিছু বলল না। শুধু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক তখনই গেইটের বাইরের শব্দে চারপাশ গমগম করে উঠল। দারোয়ানের সাথে রীতিমতো ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে আসলাম খান। সে গেইট ধাক্কাচ্ছে, গালিগালাজ করছে, চিৎকারে পুরো রাস্তা মাথায় তুলেছে। ভেতরের দারোয়ান কাবিরকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, দ্রুত সালাম দিল। কাবির হাত উঠিয়ে ইশারা করল,‘গেইট খুলে দাও।’
দারোয়ান একমুহূর্তও দেরি না করে গেইট খুলে দিল।
গেইট খুলতেই আসলাম খান প্রায় ছুটে এসে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু সামনে কাবিরকে দেখে তার পা হঠাৎ থেমে গেল।
কাবির শান্ত গলায় বলল,
“এভাবে গেইট ধাক্কাচ্ছিস কেন? লোকজনের মুখে পাগল ডাক শুনতে তোদের বেশ ভালোই লাগে মনে হচ্ছে।”
আসলাম খান দাঁত খিঁচিয়ে চুপ করে রইল। তার দৃষ্টি তখন কাবির নয়, কাবিরের পেছনে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিনার দিকে। চোখ সরু হয়ে এলো। তাহমিনা এখানে? কাবিরের কাছে? সে এখানে কী করছে? তাকে তো সাফ বলে দেওয়া হয়েছিল কাবির যেদিকে যাবে, সেই পথ তার জন্য নিষিদ্ধ। কাবিরের ছায়াও যেন না মাড়ায়। তাহলে? সে আবার এখানে কেন?
অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে সে তাহমিনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কাবির বলল,
“এখানে কোনো ঝামেলা নয়। তোর বউ তুই বাড়ি নিয়ে গিয়ে শাসন করবি।”
আসলাম খানের পা থেমে গেল। কাবিরের দিকে ফিরে বলল,”তোর খুব লাগবে নাকি ওকে শাসন করলে?”
কাবির তার চোখে চোখ রাখল।
“সারাক্ষণ তোকে অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয় কেন? এত বছর সংসার করার পরও এখনো তোকে বউ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগতে দেখে আমার আফসোস হয়। নিজের জায়গাটা এবার নিজেই শক্ত কর। অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নিজে কতবার সাধু সাজবি?”
“জ্ঞান দিচ্ছিস নাকি?”
“ওটাই মনে কর। আমার দয়ায় তো জেল থেকে বেরিয়ে এলি। সময় থাকতে শোধরা। নইলে এমন দিন আসবে যে আর আফসোস করলেও সুযোগ পাবিনা।”
“মুখ সামলে কথা বলবি।”
কাবির দ্বিগুণ গর্জে বলল,”তুই এখান থেকে বের হ। এটা একটা প্রতিষ্ঠান। তোদের নাইট ক্লাব নয়।”
তাহমিনা বিরক্তি প্রকাশ করে আসলাম খানের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি এখানে ঝামেলা বাঁধাবেন না। আমি যাব না আপনার সাথে। আমার কাজ আছে।”
আসলাম খান বলল,”আমি অপেক্ষা করছি বাইরে। তুমি কাজ সেড়ে বেরিয়ে এসো।”
কাবির তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে বেরিয়ে গেল লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে। তার চলে যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একরাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তাহমিনা। বুকের ভেতর জমে থাকা বিষাক্ত ভারটা একটু হালকা হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে আসলাম খানের শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
“আমি যদি তোমাকে আরেকবার ওর পেছনে দেখি…”
তাহমিনা ধীরে ফিরল। চোখে তাচ্ছিল্যে ভাসছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “খুন করবেন?”
আসলাম খানে চোখে আগুন। দাঁত খিঁচিয়ে সে বলল,
“তোমার ধারণা নেই আমি কী করতে পারি।”
তাহমিনা শান্ত কণ্ঠে বলল, “আর আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমি কী কী করতে পারি। আমি আর আপনার কাছে ফিরব না। কোনোদিন না। ওই বাড়িতে আমি পা রাখব না। আপনি যা ইচ্ছা করেন। আমি ফিরব না। এটাই শেষ কথা।”
আসলাম খান ব্যঙ্গ করে বলল,
“তোমার জন্য আমি মরে যাচ্ছি?”
তাহমিনা শক্ত কণ্ঠে বলল,
“কোনোদিন যদি সত্যি সত্যি মরেও যান তবুও ফিরব না।”
আসলাম খান দাঁতে দাঁত কটমট করে বলল
“তোমার কী দশা যে আমি করব তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
তাহমিনা বলল, “আপনি আমার গলায় ছুরি চালালেও ফিরব না। এটা আমার নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা।”
“তুমি এত জোর পাচ্ছ কোথা থেকে? কে দিচ্ছে?”
“আপনি যা ইচ্ছা মনে করুন। যা ইচ্ছা বলে যান। কিন্তু একটা কথা আমি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিই। আমি আপনার কাছে আর জীবনেও ফিরব না। কথায় কথায় আমাকে তালাকের ভয় দেখাতেন না? যান এবার তালাক দিন। আমি না খেয়ে মরব, দরকার পড়লে ভিক্ষা করব তবুও আপনার দুয়ারে আর জীবনেও যাব না। আমার উপর করা সমস্ত নির্যাতনের শোধ আমি এভাবেই নেব।”
আসলাম খান ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তাহমিনা ভেতরে চলে গেল তার চোখ রাঙানিকে ভয় না পেয়ে। সে জানে তার পথটা কঠিন হবে কিন্তু এবার সে আর আসলাম খানকে ভয় পাবে না। দরকার পড়লে মরণ বেঁচে নেবে তবুও না। ওই জাহান্নামে সে আর ফিরবে না। যেখানে তার সম্মান নেই সেখানে সে থাকবে না।
________
রিং বাজতেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা বের করল আর্যাব খান। অন্য হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেটের শেষাংশ নিভু নিভু করে জ্বলছে। ধূর্ত হেসে ফোন রিসিভ করে কণ্ঠে রসিকতার ছোঁয়া এনে বলল,
“জেল থেকে বেরিয়ে সোজা বউয়ের আঁচলে ঢুকে পড়েছ নাকি?”
ওপাশ থেকে আসলাম খানের কণ্ঠে চাপা বিষ। থমথমে গলায় বলল,
“ও বলেছে আর ফিরবে না।”
আর্যাব হেসে বলল, “কিছুক্ষণ কেঁদে নাও।”
আসলাম খান গর্জে উঠল, “লাথি মেরে ভুঁড়ি বের করে দেব। ও দিকের কি খবর?”
আর্যাব খান গা ঝাড়া দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে জানাল, “আমিন খান ছাড়া পেয়েই বউয়ের আঁচলের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। নড়েনি এক ইঞ্চি।”
আসলাম খান রেগে বলল, “তোকে পাই আমি।”
আর্যাব খান হাসল। আসলাম খান বলল,
“আজ কাবিরকে দেখলাম।”
“কি বললো?”
“কিচ্ছু না। চুপচাপ চলে গেল। ওরা হঠাৎ মামলা তুলে নিল কেন?”
আর্যাব খান ভ্রু কুঁচকে বলল, “সেটা ড্যাড জানে। আমি না। ওদের মধ্যে কি বোঝাপড়া হয়েছে সেটা এখনো আমার অজানা।”
আসলাম খান চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমাদের না জানিয়ে কিছু ঠিকঠাক করে ফেললে গন্ডগোল হবে আর্য।”
“তা ঠিক। আমি আজকের মধ্যে ওই জোসেফ মেহতাজের সব ডিটেইলস বের করব। তারপর ওকে বুঝিয়ে দেব কার সাথে খেলতে আসছে। আমার সাথে শয়তানি?”
আসলাম খান চুপচাপ সিগারেটে আগুন দিল, ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“ওকে কিছু করিস না। কাবির তোকে ছিঁড়ে খাবে। কাঁচা খেলা খেলিস না। ইথুর সাথে কথা বলেছিস?”
আর্যাব খান এবার গম্ভীর হয়ে গেল।
“না, খবর নিলে দেখা যাবে এখনো ঢুসেঢুসে ঘুমোচ্ছে।”
কথা বলতে বলতে আর্যাব খান হঠাৎ খেয়াল করল গাড়িতে বসা কাবিরকে। তার কপাল কুঁচকে গেল। এরা সবাই দলবেঁধে যাচ্ছে কোথায়? কি পরিকল্পনা করছে সবাই মিলে? এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও এত নির্লিপ্ত আচরণ কেন?
__________
.
ইলিনা বেগম বেশ চিন্তিত। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। পরিবারসহ সিঙ্গাপুর পাড়ি জমাবেন তারা এটা অনেক পুরোনো সিদ্ধান্ত। সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক। শুধু একটাই বাধা তাহমিনা। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এই পরিবারের সঙ্গে সে আর এক কদমও এগোবে না। সে ভালো করেই জানে এই পরিবার দুর্নীতির জালে জড়িয়ে আছে, দেশের মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না আর কিছুদিন পর। তাই পালানোই একমাত্র পথ। কিন্তু তাহমিনার আপত্তি অন্য জায়গায়। সে তার ছেলেকে এই পরিবারের ছায়ায় মানুষ হতে দেবে না। এই পরিবারের ছায়ায় বড় হয়ে সে ছেলেও যে একদিন এমনই হয়ে উঠবে, তাহমিনা তা হতে দেবে না কিছুতেই। জীবন দিয়ে হলেও না।
ঠিক সেই সময় ঘরে প্রবেশ করল আমিন খান। ইলিনা বেগমের চিন্তিত মুখ দেখে থমকে দাঁড়াল। খানিক দ্বিধায়, ধীরে সামনে গিয়ে বসলেন তিনি। দুজনের চোখাচোখি হলো। দেওয়ানদের শর্তে রাজী হয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনো ব্যাপারটা ইথিকাকে জানাননি এখনো।
ইলিনা বেগম বললেন,
“ইথু রাজী হবে না।”
আমিন খান বলল,
“কিন্তু ওকে বুঝতে হবে এভাবে জেদ দেখিয়ে কাবিরকে ভেঙে ফেলা যাবে না। ও যা করতে চাইছে সবটা ছেলেমানুষী। এভাবে শোধবোধ নেয়া যায় না। মাঝখান থেকে ওর স্বপ্নগুলো মাটি হবে।”
আমিন খান কথাটা ভুল বলছেনা।
যে বাড়ির ছেলে খান বাড়ির মেয়েকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করতে পেরেছে সেই বাড়ির ছেলে ইথিকাকেও খুন করতে পারে। সব জেনেশুনে ওই বাড়ির ছেলের সাথে সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে তারা কেউ চায়নি।
এমনকি তার চার ছেলের কেউ রাজী ছিল না। কিন্তু ইথিকা দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। সে কাবিরের চোখে ঘৃণা দেখেছে। এত ঘৃণা তাকে কেউ করেনি। তাকে নর্দমার কীটের সাথে তুলনা করেছে। কাবিরের সমস্ত অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে সে জেদ ধরেছিল বিয়ে করলে কাবিরকেই করবে। কিন্তু কাবির সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে। খান বাড়ির মেয়ে দেওয়ান বাড়ির বউ হবে এটা খানদের দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই তো কামরান দেওয়ানকে গুম করে তাদের হুমকির মধ্যে রাখা হয়েছিল যাতে সে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়। মেয়ের জেদ, তার ছেলেমানুষীর কাছে উনারা হার মেনেছিলেন।
কিন্তু এখন যা হচ্ছে তাতে উনারা বুঝতে পারছেন ক্ষতিটা ইথিকারই হবে। সে কাবিরকে ভাঙতে পারবে না এত সহজে। উল্টো নিজেই বিপদে পড়বে। দেওয়ানরা এমনিতেই শান্ত। কিন্তু রাগ মাথায় উঠলে তারা অস্ত্র ধরতে জানে। আর যখন অস্ত্র ধরে তখন প্রাণ নিয়েই ছাড়ে তার প্রমাণ স্বয়ং কামরান দেওয়ান।
এখনো অন্তরার রক্তমাখা লাশটা চোখে ভাসে তাদের। কি নির্মমভাবে তাকে খুন করেছে কামরান দেওয়ান। চার চারটা বুলেট তার শরীরের গেঁথে গিয়ছিল। প্রকাশ্যে দিনের আলোয় দুই পরিবারের মানুষের সামনে অন্তরার দিকে গুলি ছুঁড়েছিল কামরান দেওয়ান। অথচ ও পাগলের মতো ভালোবাসতো কামরান দেওয়ানকে।
“ইথু ফোন রিসিভ করেছে?”
ইলিনা বেগম বললেন,”করেনি। ওই বাড়ির কাজের মেয়েটা ফোন রিসিভ করেছে।”
“কি বলল?”
“ইথু এখনো ঘুম। ঘুম থেকে উঠলে ও মেয়েটা ইথুকে জানাবে বলেছে।”
আমিন খান হাত দিয়ে পুরো মুখ মুছলেন। বললেন,
“ইথু রাজী না হলে সমস্যা হবে। কাবির সব চুক্তি বাতিল করবে। জমিজমা হাতছাড়া হবে। ব্যবসার শেয়ার বাতিল হবে।”
ইলিনা বেগম বললেন,”ইথু রাজী হবে আদৌ?”
আমিন খান তার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বাইরে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল।
ইলিনা বেগম কান পেতে বললেন, “আর্য এসেছে নাকি?”
তারপর যাচাই করতে ডাকলেন, “আর্য!”
কিছুক্ষণ পর দরজার কাছে এসে দু’পাশে হাত রেখে ভর দিয়ে দাঁড়াল আর্যাব খান। মুখে চেনা হাসি।
“মাইন্ড না করলে ভেতরে আসব।”
ইলিনা গলা নরম করে বললেন, “আসো।”
আর্যাব খান সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাবা মায়ের মাঝখানে বসে কোন রাখঢাক না করে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। চোখ আধখোলা। গলায় আলস্য মাখানো।
“বলো।”
আমিন খান তার দিকে তাকালেন। মুখে কড়াকড়ি ভাব, চোখে গাম্ভীর্য।
“তুমি দেওয়ান বাড়িতে যাও। ইথুকে নিয়ে এসো।”
আর্যাব খান ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“কেন?”
আমিন খান একটুও গড়িমসি না করে সবটা খুলে বললেন। শোনা মাত্রই আর্যাব খান এক লাফে উঠে বসল বিছানায়। মুহূর্তে বদলে গেল তার গা-ছাড়া ভাব। পকেট থেকে ফোনটা বের করে আবার পকেটে পুরল শক্ত হাতে। তারপর বলল,
“ঠিক আছে। আধঘন্টার মধ্যে ওকে নিয়ে হাজির হচ্ছি।”
আর্যাব খান দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে ইলিনা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কাজের বুয়া পাচ্ছি না। তুমি একটা বিয়ে করে ফেলো।”
আর্যাব খান থমকে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কপাল কুঁচকে ঠাট্টা করে বলল,
“জেসি! সে তোমাদের রান্না করে খাওয়াবে? হাউ ফানি ইয়োমম!”
আমিন খান এবার কষে ধমক দিলেন, “তাহলে তুমি কাজের বুয়াকে বিয়ে করবে নাকি? আজব কথা বলছো!”
আর্যাব খান গম্ভীর সুরে বলল,
“এসব ঝামেলায় আমি নেই। বিয়ে মানেই প্যারা। চোখের সামনে তো উদাহরণ আছে। ইলিনা বেগম এন্ড তার বড় পুত্রবধূ তাহমিনা।”
ইলিনা বেগম চড়াও হলেন, “আর্য! মুখ সামলে কথা বলো!”
আর্যাব খান দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে হালকা হেসে বলল,
“এভাবে ডাকলে একদম দিলে গিয়ে লাগে।””
ইলিনা বেগম রাগ করলেন,”কেউ আমার কথা শোনেনা। একজন আমার অজান্তে বিয়ে করে নিল। এখন সেই বউই তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। তোমাদের যা ইচ্ছা করো।”
______________
“কোন বেয়াদব এভাবে কলিং বেল বাজাচ্ছে? একবার বাজালেই তো হয়। আশ্চর্য!”
বকবক করতে করতে কল্পনা দরজা খুলে দিল। সাথে সাথে দেখল দেয়ালে হাত চেপে আর্যাব খান দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে সেই চিরাচরিত বদমায়েশি হাসিটা। ঠোঁট গোল করে শিঁষ বাজিয়ে বলল,
“কেমন আছেন বেয়াইন সাব!”
কল্পনা তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল। আর্যাব খান একঠেলায় তাকে সহ সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সোজা সোফায় বসল পায়ের উপর পা তুলে। ঝিনুককে বলল,
“এই বুয়া আমার বোনকে ডেকে দে।”
ঝিনুক দ্রুত মাথা দুলিয়ে উপরে চলে গেল। লুবনা বেগমকে নিয়ে কাসেদ ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। কাবির আর কাদিন কামরান দেওয়ান আর কাওসার দেওয়ানের সাথে জমিজমা দেখতে গিয়েছে। কামরান দেওয়ান যদিও হুইল চেয়ারে বসা এখনো।
বলতে গেলে বাড়িতে পুরুষ লোক দুজন। দাদাভাই নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। আর বাগানের মালি জামাল চাচা বাইরে কাজ করছেন। মানুষটা বড়ো ভীতু।
আর্যাব খান একের পর সিগারেট শেষ করে মেঝেতে ফেলছে। অথচ এইমাত্র ঝিনুক আর সে মিলে মেঝেটা মুছেছে। অভদ্র লোক। এদের কিছু বলতে ঘৃণা লাগে কল্পনার। অমানুষ বললেও কম হয়।
কল্পনা তার ঘরে চলে যাচ্ছিল। আর্যাব খান ডাক দিল,
“চা নয় কফি নিয়ে আসো।”
কল্পনা ফিরে তাকাল। কটাক্ষের সুরে বলল,
“তোমাকে কফি খাওয়ানোর মতো নির্লজ্জ বেহায়া আমি নই।”
আর্যাব খান শীতল হাসল। ইথিকা নেমে এল তখন। বোঝায় যাচ্ছে সবেমাত্র শাওয়ার নিয়েছে। চুল ভেজা। শুকোনোর সময়ও পায়নি। গায়ে একটা ঢিলেঢালা চিকেনকারি থ্রি পিস। দেওয়ান বাড়ির সৌজন্যেতার খাতিরে ওড়নাও নিয়েছে। আর্যাব খানকে দেখে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ছুটে এল। আর্যাব খান গম্ভীর মুখে তাকে দেখল। ইথিকা এদিকওদিক ফিরতেই ঝিনুককে দেখল।
“এখনো নাশতা দাওনি কেন?”
“দিচ্ছি ভাবি।”
ইথিকা আর্যাব খানের পাশে গিয়ে বসল। হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে বলল,
“তুমি হঠাৎ!”
আর্যাব খান সোজাসাপ্টা বলল,”তোকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
ইথিকার হাসিমাখা চেহারা মলিন হয়ে হয়ে এল।
“কেন?”
আর্যাব খান তাকে আপাদমস্তক সবটা খুলে বলতেই ইথিকা পাশে সরে গেল। আর্যাব খান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কোনো সমস্যা? চল। এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সামনেই তোর প্রোগ্রাম।”
ইথিকা রাজী হলো না। আর্যাব খান বলল,”মাথা খারাপ করিস না। চল আমার সাথে। তোর জিনিসপত্র ওরা পাঠিয়ে দেবে।”
ইথিকা সোফা ছেড়ে দাঁড়াল। বলল,
“এখন এভাবে যেতে পারব না মেঝ ভাইয়া।”
আর্যাব খান বলল,”শেষবারের মতো বলছি। চল।”
ইথিকা চলে যেতে যাচ্ছিল। আর্যাব খান তার হাত খপ করে ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। ইথিকা চেঁচিয়ে বলল,
“ভাইয়া যাব না বলেছি আমি। আমার কথা শোনো। এভাবে যাওয়া যায় না। কাবিরের সাথে কথা বলব আমি।”
আর্যাব খান শোনার নয়। কল্পনা আর কিরণ ছুটে এল। তারা কিছু বুঝতে পারল না। ইথিকা আর্যাব খানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আচমকা দৌড় দিল। একটা গাড়ি ঢুকে আসছিল গেইট পার হয়ে। ইথিকাকে পাশ কাটিয়ে গেল। কাবির গাড়ি থেকে বের হওয়ামাত্রই ইথিকা কাবিরের পেছনে গিয়ে লুকোলো। কাবির হালকা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকে দেখল কপাল কুঁচকে। ইথিকা হাঁপাচ্ছে। তার ঠোঁট কাঁপছে। তাকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। কাল রাতের ইথিকা আর এই ইথিকা ভীষণ আলাদা। কাবির তার হাত শক্ত ধরাটা দেখে জানতে চাইল,
“কি সমস্যা!”
ইথিকা তার বাহু আরও শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি যাব না।”
কাবির এবার সবটা বুঝে গেল। হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা বলল,
“যেতে হবে।”
ইথিকা ঝাপটে হাত ধরে রেখে বলল,
“না। প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন। আমি সব ঠিক করে দেব।”
“তোমাকে এক সেকেন্ড সময়ও দেব না আমি। হাত ছাড়ো।”
ইথিকা হাত ছাড়ল না। বলল,
“আমি সময় চাইছি, সুযোগ চাইছি। কাবির প্লিজ।”
আর্যাব খান এগিয়ে এসে কাবিরের পেছন থেকে তাকে কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ইথিকা কাবিরের শার্ট ধরে রাখল শক্ত করে। অসহায় কণ্ঠে ডাকল।
“কাবির!”
আর্যাব খান হ্যাঁচকা টানে তাকে নিয়ে চলে যেতে লাগল। ইথিকা কাবিরের দিকে চেয়ে কান্নাজড়ানো গলায় বলল,
“এভাবে যাব না আমি। কিছুতেই যাব না। কাবির!”
কাবির ওর চোখেমুখে অস্থিরতা, অনুশোচনা, অনুতাপ আর ব্যতিক্রম আচরণ দেখে ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলল,”ওর হাত ছেড়ে দে আর্য।”
আর্যাব খান তারপরও টেনে নিয়ে যেতে লাগল। গাড়ির কাছাকাছি নিয়ে যেতেই কাবির গর্জে উঠল,
“আর্য!”
আর্যাব খানের হাত থেকে ইথিকার হাত ফস্কে বেরিয়ে গেল। ইথিকা কাবিরের কাছে ছুটে এসে বুকে হামলে পড়ল। কাবির পিছিয়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। আর্যাব খান অবাক হয়ে বলল,
“আরেব্বাস ইতনি মহব্বত কাহা সে আয়ে?”
ইথিকাকে সে নিয়ে যেতে পারল না। ইথিকা থেকে গেল। দেওয়ান বাড়ির বউ হয়ে।
চলমান…