মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
3

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

অনেক দিন পর নাজিফাকে দেখল কাবির। নাজিফা মাজহাবের স্ত্রী। সংসার জীবনের মাত্র দুই বছরেই স্বামীকে হারিয়েছে। এমনকি মাজহাবের লাশটাও পাওয়া যায়নি।

নাজিফা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। গায়ে পুরোনো, জীর্ণ একটা বোরকা, তবু তার সৌন্দর্য মলিন হয়নি। শ্যামলা মুখে অনন্ত বিষাদ। মনে হচ্ছে শত জনমের দুঃখ সেখানে চেপে বসে আছে।

কাবির তাকে চুপচাপ বসিয়ে নাশতার ব্যবস্থা করল। সে ক্ষুধার্ত ছিল, অনেকটা সময় কিছু খায়নি হয়তো। লজ্জার বালাই না রেখেই পরপর সবগুলো নাশতা খেয়ে নিল। কাবির চুপচাপ তাকিয়ে থাকল তার দিকে। তার মনে প্রশ্ন ঢেউ খেলছে। এখানে কিভাবে এসেছে নাজিফা? এতদিন কোথায় ছিল? এখানে সে আছে তার খোঁজ কিভাবে পেল? কে দিল?

খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর কাবির মৃদু গলায় বলল,

“তুমি ঠিক আছ? মনে হচ্ছে তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।”

নাজিফা সোজা বলল,

“আমার একটা চাকরি দরকার ভাইয়া।”

কাবির অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

“চাকরি?”

“জি, বাড়িতে আর জায়গা হচ্ছে না। ভাইয়ের বউরা আমাকে সংসারে রাখতে চায় না। তাই আমার একটা চাকরি প্রয়োজন যাতে নিজে আলাদা থাকতে পারি। মাজহাবের নিখোঁজ হওয়ার পর আমি ওর বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু সেখানেও থাকতে পারলাম না। তার মা-বোনরা আমার জীবনটা অসহনীয় করে তুলেছিল।”

এসির ভেতরেও কাবির ঘামছে। নাজিফা কি এখনো জানেনা মাজহাব আর নেই? খানদের বলি হয়ে গেছে সে? কিন্তু সে এখানে কীসের চাকরি দেবে নাজিফাকে? এখানে সবাইকে চাকরি দিলে ইথিকার সামনে তার মান থাকবে না। নাজিফার শিক্ষাগত যোগ্যতা অত বেশি নেই। সে মাজহাবের মুখে শুনেছে তাকে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষাটাও দিতে দেয়নি মাজহাবের মা। বাড়ির বউয়ের বিয়ের পর আবার কীসের লেখাপড়া?

কাবির জানতে চাইল,

“মাজহাবের খোঁজ করোনি তুমি?”

নাজিফা ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীরে বলল,
“করতে ইচ্ছে করে না ভাইয়া।”

কাবির অবাক হলো। “কেন?”

নাজিফা শুকনো হাসল।

“ওর জন্যই তো আজকে আমাকে এই পথে এসে বসতে হয়েছে।”

কাবিরের কৌতূহল আরও বেড়ে গেল।

“কীভাবে?”

নাজিফা একটু সংকোচ করল, কিন্তু কাবিরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর চাপা জোরাজুরিতে শেষমেশ বলল,
“ওর সঙ্গে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল। কোনো এক শিল্পপতির ভাগ্নি। টিভিতে বিজ্ঞাপন করত, অনেক নাচের অনুষ্ঠানেও দেখা যেত। তবে মডেল হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল। শুনেছি তার মা নৃত্যশিল্পী। বাবা মনে হয় মেয়র শাহাদাত খানের কোনো আত্মীয়। বড় ব্যবসায়ী। এমনকি তার একটা ভাইও নাকি পুলিশ অফিসার।”

কাবির চুপচাপ সব শুনছে। কি বলবে সে? কি বলার আছে তার? নাজিফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“ওর মতো প্রভাবশালী মেয়েকে আমি কীভাবে জব্দ করব বলুন? সাহসই হয়নি তার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু আমার মনে হয় ওরাই জানে মাজহাব কোথায়। হয়তো মেয়েটার সঙ্গেই থাকে।”

কাবির সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “না, ভুল!”

নাজিফা হতভম্ব হয়ে তাকাল। কাবিরের এমন তীব্র প্রত্যুত্তরে সে কিছুটা ভড়কে গেছে। কাবির গ্লাস টেনে নিয়ে এক ঢোক পানি খেল। নাজিফা হকচকিয়ে তাকিয়ে আছে এখনো। কাবির টিস্যু টেনে মুখ মুছে শান্ত স্বরে বলল,

“মাজহাবের সঙ্গে যে মেয়েটার… মানে যাকে তুমি বলছ তার নাম আনঝিল খানম। ও এই কোম্পানির সিইও। আমার বিজনেস পার্টনার।”

নাজিফার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল! কাবির তার অবাক দৃষ্টি লক্ষ করল, তারপর শান্ত গলায় বলল,

“আমি যা বলছি তাই। আমিন খানের মেয়ে।”

নাজিফার হয়তো এখন ভয় হচ্ছে। কৌতূহলও হচ্ছে। সে হয়ত ভাবছে মাজহাবের খবর ইথিকা জানে। কিন্তু তা নয়। মাজহাব আর নেই। ওর শেষ চিহ্নটুকুও রাখেনি খানরা।

কাবির কিছু একটা ভাবল। তারপর ফোন হাতে নিয়ে কাদিনকে কল দিল। “অফিসে আসো, জরুরি কথা আছে।”

কাদিন বলল,”ওকে আসছি।”

একটু সময় চুপ থেকে নাজিফা প্রশ্ন করল,
“উনি কি মাজহাবের খবর জানেন?”

কাবির বলল,

“আমি জানি না। তুমি আপাতত আমাদের বাড়িতে যাও। বাকি কথা ওখানে বলব। আমি তোমাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন তুমি ছিলে না।”

নাজিফা দম নিয়ে বলল,

“আমি আমার এক দূরসম্পর্কের খালার বাড়িতে ছিলাম। আমাকে একটা চাকরি দিলে খুব উপকার হবে ভাইয়া।”

কাবির তাকে আশ্বস্ত করে বলল,”আমি ভাবব সেটা নিয়ে। আপাতত তুমি বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

দরজা ঠেলে কাদিন ভেতরে ঢুকল। ভেতরে এসে নাজিফাকে দেখে সেও একটু চমকে গেল।

“আপনি!”

কাবির বলল,”হ্যাঁ উনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো। নিশ্চিত হয়ে তবে ফিরবে।”

কাদিন মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা। আসুন।”

নাজিফা কিছু না বলে কাদিনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

কাবির চেয়ার থেকে উঠে ডিভোর্স পেপারটা হাতে তুলে নিল। কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ফোন হাতে তুলে আমিন খানকে কল দিল।

ওপাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল আমিন খান।

“বলো জামাই। কোনো সমস্যা?”

কাবির সরাসরি প্রশ্ন করল,”মেয়েকে চাপ দিচ্ছেন ডিভোর্সের জন্য?”

আমিন খান হালকা হেসে বলল,
“চাপ না দিলে ডিভোর্সটা হবে? ও তো চাইছেনা তোমাকে ডিভোর্স দিতে। শর্ত অনুযায়ী, তুমি আমাদের সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করবে না যদি ডিভোর্সটা হয়। চুক্তি কিছুতেই বাতিল করা যাবে না। তাই ইথিকাকে কোম্পানিটাই বেছে নিতে হলো। ব্যবসা তো আর আবেগ দিয়ে চলে না দেওয়ান!”

কাবির কণ্ঠস্বর শক্ত শোনাল।

“ও নিজে বেছে নিয়েছে? নাকি আপনারা তাকে বাধ্য করেছেন?”

আমিন খানের কণ্ঠ আরও মসৃণ শোনাল,

“হ্যাঁ বাধ্য করেছি। কারণ শর্ত তো তোমরাই দিয়েছিলে। বিবাহবিচ্ছেদ হলে চুক্তিগুলো অটুট থাকবে। শর্ত তুলে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি ইথিকাকে তোমার কাছে রাখতে চাও তাহলে সিদ্ধান্ত তোমার দেওয়ান!”

কাবির ঠোঁট চেপে ধরল শক্ত করে। তারপর কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল। কেন সবসময় তাকেই আগবাড়িয়ে সবটা সামাল দিতে হবে? সম্পর্কের দায় দু’জনের। এমন তো নয় যে ওকে ছাড়া তার চলবে না। দিব্যি চলে যাবে। বরং আরও ভালোই যাবে। স্বস্তির সঙ্গে বাঁচবে সে।

এটাই তো চেয়েছিল সে। চিরকালের মতো খানদের প্রভাব থেকে মুক্তি। তাহলে তার অস্থির হওয়ার মানেটা কি?

নিজ থেকেই সে এই বিবাহবিচ্ছেদ কিছুতেই আটকাবে না, মরে গেলেও না। সে আনঝিলকে একটা সুযোগ দিয়েছে। আনঝিল যদি হালকা মনে সেই সুযোগ ফেলে দেয়। নিজের পরিবারের সঙ্গে জেদ দেখিয়ে সুযোগটা নষ্ট করে, তবে তার কিছু করার নেই।

_______________

লুবনা বেগমের ফোন থেকে ইথিকার ফোনে কল এসেছে। ইথিকা একবারও রিসিভ করেনি। লুবনা বেগম শেষবারের মতো ইথিকার সাথে কথা বলতে চায়। কল্পনা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বলল,

“বাদ দাও না। ওরকম ছেলের বউ দিয়ে তুমি করবেটা কি? এরচেয়ে ভালো ডিভোর্সটা হয়ে যাক। ভাইয়ের জন্য এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখব আমরা। বড় ভাইয়ের পাশে ওই মেয়েকে মানায়?”

লুবনা বেগম চুপ করে গেলেন। কল্পনার সব কথা সত্যি। কাবিরের সাথে ইথিকার কোনোদিক দিয়ে যায় না। তিনি নিজেই চাননি ইথিকা এখানে থাকুক। কাবিরের সাথে সংসার করুক। তিনি সুযোগ দেয়ার কথা কোনোদিন ভাবেননি। ভেবেছিলেন যদি কোনোদিন ডিভোর্সের সুযোগ আসে তাহলে তিনি বিনাবাক্যে রাজী হয়ে যাবেন সেই সিদ্ধান্তে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরোটাই পাল্টে গেছে। মেয়েটা যখন ওইদিন কাবিরের কাছে থেকে যাওয়ার জন্য তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গেল তখন তার চোখ-মুখে একটা ভয় দেখা গিয়েছিল। সে হয়ত একটুও পাল্টায়নি কিন্তু সে কাবিরের সাথে থাকতে চায়। অবশ্য তখনো উনি তা মানতে চাননি। মনে হচ্ছিল মেয়েটি নাটক করছে। কিন্তু কাবির ঠিকই তাকে সুযোগ দিয়েছে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে।

কিন্তু এখন যা করছে তা কি সে ঠিক করছে?
যে মেয়েটি থেকে যাওয়ার জন্য এত কাকুতি মিনতি করলো সে হুট করে এত শক্তপোক্ত সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে? কাবিরকে পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে!

ভাগ্যিস রাগের মাথায় কাবির কোনো স্বাক্ষর দেয়নি এখন অব্দি।

মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। তার শেষ সিদ্ধান্ত কি এটাই? নাকি সে বাধ্য হয়ে এমনটা করছে?

নাজিফাকে নিয়ে কিরণ। নাজিফা কল্পনার একটা সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। লুবনা বেগম তাকে দরজার সামনে দাঁড়াতে দেখে ঠোঁটে মেকি হাসি টানলেন।

“এসো মা।”

নাজিফা ঘরে প্রবেশ করল। জলপাই রঙের কামিজটা তার গায়ে দারুণ মানিয়েছে। ভালো করে ওড়না দিয়েছে সে মাথায়। অবশ্য সে ভালো পরিবারের মেয়ে। তার বাবা একজন সৎ স্কুল মাস্টার ছিল। মা বাবা মারা যাওয়ার পর তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সংসারটা ঠেকেনি। কি মায়াবী চেহারা। আচ্ছা যারা সংসারী হতে চায় তাদের সংসার হয় না কেন? অথচ যে সংসারী হতে চায় না সে না চাইতে কত সুন্দর একটা সংসার পেয়ে যায়। কিন্তু মূল্য দিতে জানেনা।

“তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে এখানে?”

নাজিফা উত্তর দিল,”না আন্টি। ঠিক আছি। কাবির ভাইয়া কবে আসবে? আসলে বাড়ি…

লুবনা বেগম বললেন,”আরেহ থাকো না কিছুদিন। মনে করো বেড়াতে এসেছ। মাজহাবের বাড়ি ছিল এটা। ও দিনরাত এখানে এসে পড়ে থাকতো। বিয়ের কয়েক বছর আগে থেকে আসাযাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু যখন আসতো তখন একেবারে বাড়িটা মাতিয়ে তুলতো।”

নাজিফা মাথা নীচু করে বসে রইল। কিরণ বলল,

“ভাবি আপনি যাবেন না প্লিজ। থাকুন আমাদের সাথে। দরকার পড়লে আপনার ভাইয়ের সাথে মা কথা বলবে।”

নাজিফা হ্যাঁ না কিছু বললো না। সে একটা চাকরির খোঁজে বেরিয়েছে। তাকে এখানে পড়ে থাকলে তো হবে না।

কল্পনা তখনো ফোন দিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেশ ইথিকা রিসিভ করল। গলা ভাঙা শোনাল।

“হ্যালো!”

লুবনা বেগমের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল কল্পনা। তিনি ফোনটা নিয়ে কানের সাথে লাগিয়ে বললেন,

“হ্যালো আমি কাবিরের মা বলছি।”

ইথিকা একটু থমকালো। খানিকক্ষণ পর বলল,

“জি বলুন।”

“তুমি একবার এই বাড়িতে আসবে মা?”

ইথিকা এবার চুপ করে গেল। লুবনা বেগম বললেন,

“আমি তোমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”

ইথিকা মৃদুস্বরে বলল,”কি জানতে চাইবেন আমি জানি।”

লুবনা বেগম বললেন,”জানলে উত্তরটাও দিয়ে দাও।”

ইথিকা তাড়া দিয়ে বলল,

“রাখছি মা।”

লুবনা বেগম সাথে সাথে বললেন,”না না। আমি শুনতে চাই। বলো আমাকে। তোমাকে তোমার বাপ ভাই ভয় দেখিয়েছে? ধমকেছে, বকেছে?”

ইথিকা বলল,”আমি কি বাচ্চা মেয়ে যে এসবে ভয় পাব?”

“তাহলে?”

“আপনার ছেলে যা চাইছে তাই হচ্ছে। উনি শর্ত দিয়েছিলেন ডিভোর্স না হলে চুক্তি বাতিল করবেন। এই মুহূর্তে চুক্তি বাতিল করলে কোটি টাকার লস হবে আমাদের। এতবছর ধরে যে জমিজমার মীমাংসা হতে যাচ্ছিল সব ভেস্তে যাবে। শুধুমাত্র একটা অনিশ্চিত দাম্পত্য জীবনের জন্য আমার ড্যাড আর ভাইয়ারা কেন এত লস মানবে? যেখানে আমাকে সারাক্ষণ শুনতে হয় আমি দেওয়ানি বউ হওয়ার যোগ্য নয়? আমি রাখছি মা।”

লুবনা বেগম বলে উঠলেন,

“বৌমা শোনো শোনো। দুজনেই এমন করলে কি করে চলবে? তোমরা বসো। তারপর আলোচনা করো। এমন করো না। একটা সংসার বাঁধতে অনেক কষ্ট হয় ঝড়ঝাপটা আসে। কিন্তু ভাঙতে সেকেন্ডের ব্যাপার। তুমি একটিবার ভাবো। কাবির রাগের মাথায় সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু সে তো চায় না তুমি চলে যাও।”

ইথিকা নীরব হয়ে গেল। হয়ত শেষ কথাটা শুনে। কাবিরও তখুনি লুবনা বেগমের ঘরে প্রবেশ করেছে। নাজিফা তাকে দেখামাত্রই কিরণ আর কল্পনার সাথে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লুবনা বেগম কাবিরকে দেখামাত্র বলল,

“কাবির শোন না বাবা।”

ইথিকা ফোনটা শক্ত করে ধরে রাখল। হাতটা হয়ত কাঁপছে। কণ্ঠস্বরও।

“আমি রাখছি।”

ফোনের ভলিউম বেশি হওয়ায় কথাটা কাবির শুনতে পেল। সে সাথে সাথে বজ্রকণ্ঠে বলল,

“মা তাকে বলে দাও কেউ যদি শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে চায় তাহলে সব শর্ত তুলে নেয়া হবে। আর হ্যাঁ ফিরে আসতে চাইলে আজই যেন ফিরে আসে। নয়ত রাস্তা বন্ধ করার দায়িত্ব আমি নেব। খান বাড়ি থেকে দেওয়ান বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। কথাটা নিশ্চয়ই সে শুনতে পেয়েছে।”

কথাটা বলেই কাবির বেরিয়ে গেল। লুবনা বেগম ইথিকাকে বলল,

“বৌমা শুনেছ? শুনেছ কি বলল?”

ইথিকা কম্পিত গলায় বলল,

“আমি শুদ্ধতা কি সেটা জানিনা। যদি আবারও ভুল করি?”

“না জেনে ভুল করলে সেটা দোষ নয়। জেনে ভুল করলে সেটাই দোষের। জেনেশুনে তুমি আর কোনো ভুল করবে না সেটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ফিরে এসো মা। এমন স্বামী সংসার সবার কপালে জোটেনা।”

__________

রাত এগারোটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। লুবনা বেগমের চিন্তিত। মেয়েটা সত্যি এল না? কাবির এবার সত্যি সত্যি কাল সকালে সাইন করে দেবে পেপারে? শেষমেশ শেষ রক্ষা হলো না।

খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর সবাই যখন ঘুমোতে চলে গেল তখনো লুবনা বেগম বসার ঘরে ঝিনুক আর লায়লার সাথে বসে গল্পগুজব করছে। লায়লা বলল,

“আপনার ফুতের বউ আর আইতো না ভাবিজান। ওই মাইয়্যার সাথে আমাগো বাবুর যায় না মুটেই। কত্ত ভালা পোলা আপনার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া ভাত খায় না। সেই ব্যাটার লগে ওই ব্যাটির যায়? মাথায় কাপড় দিবো থাক হাত কাটা কাপড়চোপড় পড়ে। শাড়ি পরেও নাভি দেখাইয়া হাঁটে। লজ্জা শরমের বালাই নাই।”

লুবনা বেগম চিন্তা ঝেড়ে ঝিনুককে বললেন,”ঝিনু নাজিফা ঘুমিয়েছে?”

ঝিনুক বলল,”হ্যাঁ ছোট মা কল্প আপাদের ঘরে শুইছে।”

লুবনা বেগম বিলাপ করে বললেন,

“এজন্যই বলে মেয়েদের সুন্দরী হওয়ার আগে কপাল সুন্দর হতে হয়। কত্ত সুন্দর মেয়ে। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে গেল।”

লায়লা আরও কিছু জানার উৎসাহ দেখাচ্ছিল। তখুনি কলিং বেল বাজল। লুবনা বেগম আচমকা দৌড় দিয়ে দরজা খুললেন। যা ভেবেছেন তাই।

ইথিকা! তার হাতে জুতোজোড়া।
একটা জুতোর ফিতা ছিঁড়ে গেছে। হয়তো দৌড়ার কারণে। পায়ে কাঁদা। গায়ে একটা ঢিলেঢালা কর্ড সেট। ওড়না নেই। চুলগুলো খোলা। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে লুবনা বেগমকে বলল,

“ভেতরে যাই?”

“আসো। এ কি অবস্থা!”

ইথিকা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দ্রুত উপরে চলে যেতে যেতে বলল,

“পালিয়ে এসেছি।”

লুবনা বেগম উনার ঘরে নিয়ে গেলেন ইথিকাকে। ইথিকা ওয়াশরুমে ঢুকে পা ধুয়ে বলল,

“ঘরে যাই?”

লুবনা বেগম বললেন,”বেকুব মেয়ে। এভাবে গেলে কাবির কি ভাববে?”

“কিভাবে যাব?”

লুবনা বেগম ঝিনুককে ডেকে আনলেন। কি কি যেন বুঝিয়ে বললেন ঝিনুককে। ঝিনুক মাথা দুলিয়ে উনার চাবিটা নিয়ে আলমারি খুলে একটা লাল রঙের শাড়ি বের করল। তারপর লুবনা বেগমের কথামতো ইথিকাকে পরিয়ে দিল। ইথিকা বলল,

“আমাকে যদি ঢঙী ডাকে?”

লুবনা বেগম না চাইতেও হেসে ফেললেন।

“ওসব সহ্য করতে হয় বুঝলে?”

ইথিকা প্রতিবাদ করে বলল,

“মোটেও না। কাবির খুব বাজেভাবে ব্যঙ্গ করে আমাকে।”

লুবনা বেগম আবারও হাসলেন। বললেন,

“আজ করবে না। তোমাকে যা মিষ্টি লাগছে। একটুও ব্যঙ্গ করবে না। তাই না রে ঝিনু?”

ঝিনুক হেসে মাথা দোলাল। লুবনা বেগম তার মাথার উপর ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেন,

“এবার যাও।”

ইথিকা ঘোমটাটা চেপে ধরে কাবিরের ঘরে চলে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কুলকুল করে ঘামতে লাগল। তারপর কাঁপা হাতে দরজায় ঠোকা দিল। কাবিরের সাড়াশব্দ নেই। ঘর অন্ধকার। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ইথিকার এবার রাগ লাগছে। রাগে চোখদুটো জ্বলছে। সে এড়িয়ে চলা কিংবা তাকে পাত্তা না দেয়ার ব্যাপারগুলো নিতে পারেনা সহজে। সে জোরে দরজা ধাক্কাল। কাবির সাড়া দিল,

“আসছি।”

ইথিকা বিড়বিড়িয়ে বলল, “আসতে হবে না। ঘুমান নাক ডেকে।”

কাবির ঘুমের আলসেমাখা চোখ নিয়ে দরজা খুলল। ইথিকা চমকে তাকাতেই মাথার ঘোমটা পড়ে গেল সাথে সাথে। কাবির ঘুরে চলে যাচ্ছিল। থমকে গিয়ে আবার ফিরে তাকাল। তার চোখ কি সত্যি দেখছে নাকি আবছা অন্ধকারে ভুলভাল কিছু দেখছে?

সে চোখ দুটো পিটপিট করে কপালটা আরও বেশি করে কুঁচকে তাকাল ইথিকার দিকে। ইথিকা জল ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। সে রাগে ফুঁসছে এই ভেবে তাকে কি মঞ্জুলিকার মতো দেখতে লাগছে? নইলে এভাবে দেখার কি আছে? নাকি কয়েকদিন বউ ছিল না বলে ভুলে গেছে বউয়ের চেহারা কিরকম?

কাবির পরীক্ষা করার জন্য দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল ইথিকা তার বুক বরাবর ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর দরজার খিল দিয়ে পিঠ দিয়ে দরজা চেপে দাঁড়াল।

কাবির বলল,”তুমি!”

ইথিকা এগিয়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে অন্ধকারে তার মুখ বরাবর তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ইয়েস, কল্পনার বিয়ে খেতে এসেছি। বিয়ে খেয়ে চলে যাব।”

“তো গায়ে পড়ছ কেন? ডিভোর্স পেপার দিয়েছিলে আজ। ভুলে গেছ?”

“ডিভোর্স পেপারের কোথায় লেখা আছে, ডিভোর্সের আগে গায়েপড়া যাবে না?”

কাবির তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। ইথিকার চোখ থেকে এখনি রক্ত পড়বে এরূপ অবস্থা। রাগে রক্তজল জমে উঠেছে চোখে। তবুও চোখদুটোতে কি ভীষণ অসহায়ত্ব। যেন তার চাইতে অবলা নারী আর দুটো নেই পৃথিবীতে। কাবির সইতে না পেরে আলো নিভিয়ে দিল।

ইথিকা আগের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়চড় না দেখে কাবির আবারও আলো জ্বালিয়ে দিল। সাথে সাথে চোখে পড়ল ইথিকার গাল ভিজে যাচ্ছে। অথচ সে স্থির দাঁড়িয়ে। কাবির চোখ সরিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইথিকাকে পিঠ করে।

আশ্চর্য! সে কি এমন বলেছে যার জন্য কাঁদতে হবে?

ইথিকা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ওভাবে। কাবিরের নড়াচড়া না দেখে সে এবার গটগট পায়ে হেঁটে দরজার কাছে চলে যাচ্ছিল। কাবির তার শাড়ির আঁচল খপ করে ধরে ফেলে বলল,

“কল্পর বিয়ের জন্য এলে আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাও। তা না হলে আঁচলটা হাতে প্যাঁচ খাবে আরও।”

ইথিকা যাবে না তাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। শাড়ির আঁচল কাবিরের হাতে প্যাঁচ খেল বটে!

চলমান…

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ভোরের স্নিগ্ধতা ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে শহরকে। আকাশের কোণে কোণে নীলচে-ধূসর আভা। শীতল বাতাস ঘরের পর্দার কিনারায় আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জানালার পাশে রাখা ফুলদানিতে রাখা গন্ধরাজ ফুলের হালকা গন্ধ মিশে আছে ঘরের হাওয়ার সঙ্গে।

ইথিকার ঘুম ভাঙছে ধীরে ধীরে। নরম কাঁথার ওম ছেড়ে ওঠার ইচ্ছে নেই তার, অথচ বাইরের হিমেল বাতাস কেমন যেন মুগ্ধ করে ডাকছে তাকে। বিছানার উপর হাত-পা মেলে পড়ে আছে সে। শাড়িটা এখনো খুঁটির সাথে বাঁধা।

ঝিনুক এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। অনেকবার ডাকল। শেষে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ইথিকার দিকে। কীসের অভাব এই মেয়ের? সৌন্দর্য আছে, বুদ্ধি আছে, গুণেরও কমতি নেই। একটু ভদ্রভাবে চলতে পারলে কি এমন ক্ষতি হতো? দেওয়ানরা তো তখন মাথায় করে রাখত তাকে!

পর্দার ফাঁক গলে আলো এসে পড়েছে ইথিকার মুখে। দেখতে কি মায়াবি লাগছে। এমন সুন্দর একটা মেয়ে অমন কুৎসিত কাজকারবার করতে পারে ভেবে ঝিনুকের আফসোস হয়।

ইথিকা অনেকক্ষণ পর উঠল ঘুম থেকে। তার শাঁড়ির আঁচলটা পালঙ্কের খুঁটি থেকে খুলল। বাইরে কে যেন কার নাম ধরে ডাকল। নামটা চেনা তবুও অচেনা।

“বাড়িতে কি মেহমান এসেছে?”

ঝিনুক বলল,

“হ্যাঁ।”

ইথিকা হাই তুলতে তুলতে বলল,

“কে এসেছে?”

“কাবির ভাইজানের বন্ধুর বউ।”

ইথিকার কপাল কুঁচকে গেল।

“কোন বন্ধু?”

ঝিনুক মাজহাবের নাম উচ্চারণ করার আগেই কিরণের ডাক ভেসে এল। ঝিনুক দ্রুত চলে গেল। ইথিকা বিছানা থেকে নামল। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই রাগ তরতরিয়ে বাড়ল। তার শাড়ির আঁচলটা নিজের পাশে পালঙ্কের খুঁটির সাথে বেঁধে দিয়েছিল কাবির। এমনভাবে বেঁধেছিল ইথিকাকে গিঁট খুলতে হলে কাবিরের উপর দিয়ে যেতে হতো। তাকে ওরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে ঢুসে ঢুসে ঘুমিয়েছে বদলোকটা। অথচ চেহারাটা দেখলে কেউ বলবে না এই মহাপুরুষ এত বদ।

ইথিকা ব্রাশ করে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। ঝিনুক, কল্পনা কিরণ সবাই একসাথে কাজবাজ করছে। ইথিকাকে দেখে লুবনা বেগম বললেন,

“তুমি ঘরে যাও। তোমার নাশতা পাঠিয়ে দেব।”

ইথিকা চুপচাপ সবার কাজকর্ম দেখতে লাগল। বলল,”আপনাদের সাথে নাশতা করি।”

কল্পনা একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। চোখা দৃষ্টিতে চেয়ে আবারও কাজে মনোযোগ দিল। ইথিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার কাজকর্ম দেখতে লাগল। লুবনা বেগমকে বলল,

“আমিও কমবেশি রান্না পারি।”

“কি কি রান্না পারো?”

ইথিকা আর লুবনা বেগমের গল্প প্রায় জমে উঠল। বাড়ির ছেলেদের নাশতা পাঠিয়ে দিয়ে মেয়ে বউরা সবাই রান্নাঘরের গোল টেবিলে নাশতা করতে বসছিল ঠিক সেসময় কল্পনার সাথে নাজিফা ঘরে প্রবেশ করলো। তাকে দেখে চমকে গেল ইথিকা। নাজিফাও তাকে দেখে থমকে গেছে। দুজনের কেউই বিশ্বাস করতে পারছেনা তারা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে!

লুবনা বেগম দু’জনকে দেখে ভড়কে গেলেন। কাবির বলেছে ইথিকার সামনে নাজিফাকে যেতে না দিতে এমনকি তারা যেন একঘরে দাঁড়িয়ে কথাও না বলে। কল্প আর কিরণ এটা কি করল? এখন কি হবে?

ইথিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে লুবনা বেগমের দিকে তাকাল।

“ইনি কে মা?”

লুবনা বেগম কাষ্ঠ হেসে বললেন,

“আমাদের আত্মীয়।”

ইথিকা নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হাই!”

নাজিফা মৃদু হাসল প্রত্যুত্তরে। ইথিকা এমন ভাব ধরলো মনেই হলো না সে নাজিফাকে চেনে। সবাই তার ব্যবহারে অবাক হলো। নাজিফা বুঝতেই দিল না এই মেয়েকে দেখে তার কষ্ট হচ্ছে। মাজহাবের কথা মনে পড়ছে।

এই মেয়েই তবে কাবির ভাইয়ার বউ? একে জেনেশুনে উনি বিয়ে করেছে কিভাবে? এই আনঝিল খানম তাহলে কাবির দেওয়ানের বিজনেস পার্টনার নন লাইফ পার্টনারও। কি আশ্চর্য! এই মেয়ের সাথে কোনোদিক দিয়ে কাবির ভাইয়ার যায় না। ওদের বিয়েটা হলো কিভাবে? নাজিফা আর অতকিছু ভাবল না। নাশতার টেবিলে বসে নাশতা খেল। ইথিকা বেশিরভাগ খাবার এঁটো রেখে উঠে গেছে। কল্পনা চিড়বিড় করছিল কিছু বলার জন্য। লুবনা বেগম তাকে বাঁধা দিলেন। বললেন,

“আস্তেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। এরকম করিস না তো তোরা।”

কিরণ হতাশ হলো। এই মেয়ে যখন চলে গেল তখন তাদের খারাপ লাগছিল। এখন যখন ফিরে এসেছে তখন তাদের বিরক্তি লাগা শুরু হয়েছে আবার।

_________

ইথিকা চুল আঁচড়ে তার সকালের স্কিন কেয়ারটা সেড়ে নিচ্ছিল। সে ব্রেকফাস্ট করার আগে স্কিন কেয়ার সেড়ে চুল আছড়ে নেয়। কিন্তু আজ সবকিছুতে অনিয়ম। শাড়িটা পাল্টে নিয়েছে সে। সেলোয়ার-কামিজ কামিজ পরেছে। একটা স্কার্ফ নিয়ে গলায় প্যাঁচিয়েছে। তারপর একজোড়া সিম্পল এয়ার রিং পরে, সানগ্লাসটা বের করে চুলের উপর আটকালো। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখল কাবির ঘরে ঢুকছে। মুখটা গম্ভীর। কোনোদিনও অকারণে হাসেনা। অদ্ভুত!

“মনে হচ্ছে আর্য এসেছে। যাও।”

ইথিকা তার দিকে ফিরে জানতে চাইল,

“আমি আপনার সাথে যাচ্ছি।”

কাবির হাতের কব্জিতে ঘড়ির বেল্ট লাগাতে লাগাতে তার দিকে তাকাল। চোখ সরু করে বলল,

“ভয় হচ্ছে?”

ইথিকা রেগে গেল। দাঁত চিবিয়ে বলল,

“আনঝিল খানম ভয় পায় না কাউকে। আমার ভাইদের আমার ভয় হবে কেন?”

কাবির কটাক্ষ করে বলল,

“না, কাল একজন শুনলাম কাঁদা মেখে, ছেঁড়া জুতো নিয়ে পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।”

ইথিকা তেড়ে গেল তার দিকে। আঙুল তুলে বলল,

“একদম মেরে ফেলব।”

“খানরা ওটা বেশ পারে।”

“দেওয়ানরা আরও বেশি পারে। একদম প্রকাশ্যে।”

“ওদের সম্পর্কের জোর কত শক্ত জানো না। ওরা যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার খুনের বদলে খুন করতে পারে।”

ইথিকার একটু নরম হয়ে এল।

“আর যারা তাদের ভালোবাসে তাদের ভালোবাসার দাম নেই?”

কাবির আয়নার দিকে ফিরে চুল ঠিকঠাক করে গায়ে পারফিউম মাখছিল। ইথিকা বলল,

“সবকটা পাথর।”

“ওদের আগবাড়িয়ে ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা কোনোটাই করতে যেওনা। দুটোই ক্ষতিকর।”

ইথিকা বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। ধীরপায়ে হেঁটে কাবিরের পাশে এসে দাঁড়াল। আয়নায় কাবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আপনাকে ভালোবাসি?”

কাবির হেসে উঠল,

“কি আশ্চর্য! কবে হলো এসব?”

ইথিকা ভেজায় রেগে গিয়ে চোখমুখ শক্ত করে তাকাল। কাবির হেসে উঠে সরে পড়ল। ইথিকা ধপ করে পালঙ্কে বসে পড়ল।

“কোত্থাও যাব না আমি।”

কাবির কপাল উঁচিয়ে বলল,

“এখানে বসে বসে ডিম পাড়বে?”

ইথিকা মুখের উপর জবাব দিলে,

“হ্যাঁ পাড়ব।”

“পাড়ো। আমার কি?”

কাবির চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে কুটিল হেসে বলল,

“মোরগ ছাড়া ডিম পাড়া যায়?”

ইথিকা রেগেমেগে হাত পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল,

“মম!!!!”

কাবির হেসে উঠে চলে গেল।

___________

বৈঠকের জায়গাটা খোলামেলা। চারপাশে উঁচু উঁচু গাছ দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো। ঘনগাছ, বট, পাকুর গাছের ছায়া মিলেমিশে সবুজ ছাদ তৈরি করেছে মাথার উপর। দিনের বেলায়ও জায়গাটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন। রোদ এখানে তেমন আসে না। গাছের ডাল থেকে মাঝে মাঝে শুকনো পাতা খসে পড়ে, পায়ের নিচে চাপ পড়লে মচমচ শব্দ হয়।

জায়গাটা সাজানো হয়েছে খান ও দেওয়ানদের মতো বসার উপযোগী করে।

মাঝখানে রাখা আছে এক বিশাল গোল টেবিল, পুরু কাঠের তৈরি। টেবিলের চারপাশে গাঢ় কাঠের ভারী চেয়ারগুলো সাজানো, সেগুলোর হাতল আর পিঠে খোদাই করা রয়েছে সূক্ষ্ম নকশা। বহু পুরোনো চেয়ার। টেবিলের উপর কিছু সিগারেটের প্যাকেট। দেশলাই। পানির জগ আর গ্লাস।

দুই পাশে দুই পরিবারের লোকজন দাঁড়িয়ে। খানরা সবসময় আগে থেকেই উপস্থিত। দেওয়ানদের দুটো গাড়ি এসে থামল পরপর। কামরান দেওয়ানকে বের করে হুইল চেয়ারে বসানো হলো। কাওসার দেওয়ান কাদিন আর কাসেদকে ইশারায় কি কি যেন বললো। তারা কলিমউদ্দিন দেওয়ানকে ধরে এনে বসাল চেয়ারে। আর্যাব খান আখতারুজ্জামান খানের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

“দেখো ওই বাড়ির বুড়োটা মরতে যাচ্ছে। তুমি কবে ঘাড় থেকে নামছ?”

আখতারুজ্জামান খান রেগে তাকাতেই আর্যাব খান হেসে বলল,”নেভার মাইন্ড প্লিজ। বউ ছাড়া বেশিদিন থাকা উচিত না তাই বললাম। হে হে।’

“তোমার ছেলেগুলোকে আমি খুন করব আমিন।”

আমিন খান চোখ রাঙিয়ে তাকাল আর্যাব খানের দিকে। আর্যাব খান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

“জাস্ট কিডিং।”

ততক্ষণে কাবির নেমে এসেছে গাড়ি থেকে। তার পিছুপিছু ইথিকা। ইথিকাকে দেখামাত্রই আশিষ খান তেড়ে আসছিল। বজ্জাত মেয়ে কাল সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল বরের কাছে। বরদরদী! ইথিকা কাবিরের শার্ট খামচে ধরে লুকিয়ে পড়ল। উঁকি দিয়ে দেখল আর্যাব খান আশিষের কাঁধে হাত রেখে তাকে থামিয়ে দিয়েছে। ইথিকা যেভাবে তাকিয়ে আছে, আর্যাব খানও আশিষ খানের পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে আশিষের কাঁধ চেপে ধরে বলল,

“আশিষ, ও এখন শুধু তোর বোন নয়। দেওয়ানি বউ। গায়ে হাত তোলার আগে প্রথমে ওযু করবি। তারপর সালাম দিবি। তারপর রয়েসয়ে আদর করে একটা চড় মেরে দিবি।”

আশিষ বলল,”ছাড়ো আমায়। ওকে না মারলে আমার রাগ কমবে না।”

আর্যান খান হাসল। বলল,

“কাম ডাউন বেবি। ওকে চড় মেরে পালাতে হবে। নইলে ওর সিংহপুরুষ বর থাবা মেরে আমাদের চ্যাপ্টা করে ফেলবে।”

আশিষ মেঝ ভাইয়ের এত রসিকতা নিতে পারছেনা। আর্যাব খানের হাত নামিয়ে দিয়ে সে বলল,

“ওকে আমি চড় তো মারবোই। কথা ছিল কি আর সে করলো কি।”

আর্যাব খান তার কথা পুরোপুরি না শুনে কাবিরের দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার অপেক্ষায় ছিলাম জামাইবাবু।”

কাবির হাত না মিলিয়ে পাশ কেটে চলে গেল। আর্যাব খান তার হাতটা মাথার পেছনে বুলিয়ে ইথিকাকে বলল,

“চড় এখন খাবি নাকি বৈঠকের পর খাবি?”

ইথিকা চালাকি করে কাবিরকে ডাক দিল। কাবির চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল। ইথিকার ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তারপর হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ইথিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ইথিকা যেতে যেতে আর্যাব খানের দিকে তাকিয়ে মুখ মোচড়ে দিল। আর্যাব খান রেগে খুন! এত্তবড় সাহস! খাইয়ে পরিয়ে আদর করে এ কাকে বড় করেছে তারা চার ভাই? কার পেছনে এতগুলো বছর খেটেছে তারা? এত আদর যত্নের বিনিময়ে এসব পেল? হিসেবে গড়মিল! ভীষণ গড়মিল!

_________

দুই বাড়ির মানুষদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হলো। কাবির আজ মোক্ষম চাল দিয়েছে। জমিজমার কাগজে স্বাক্ষর খুঁজতেই কাবির বলল, সেইসব জমির সমস্ত মালিকানা সে আনঝিলকে দেবে।

তখন দেবে যখন তার মনে হবে ইথিকা দেওয়ানি বউয়ের যোগ্য। ওইসব সম্পত্তির দায়ভার নেয়ার যোগ্য। নইলে এই অমীমাংসিত জমিগুলো তারা শুধু কয়েকটা আইনি উদ্যোগের কারণে খানদের হাতে ছাড়তে পারেনা।

সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার সময় কলিমউদ্দিন দেওয়ান বেশি জায়গাজমি পেয়েছিল। সেই জমিগুলোতে খানরা তাদের ভাগ দাবি করেছে। কলিমউদ্দিন দেওয়ানের ভাষ্যমতে সে জোর করে জমিগুলো নেয়নি। তাকে দিয়েছে বাবা নিজেই। তাহলে খানদের দাবি তিনি মানবেন কেন?

এই নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছে দুই ভাইয়ের। এখন নাতি নাতনিদের হাতে এসে পড়েছে সব। কাবির চায় সব মীমাংসা হয়ে যাক। বাড়তি জমিগুলোর ভাগ ওরা পেয়ে যাক। এতে দেওয়ানিদের সম্পত্তির একভাগও নড়চড় হবে না। কিন্তু আর খুনাখুনি নয়। কিন্তু এখন সে তার মত পাল্টেছে। যেহেতু আনঝিলকে ঘিরে সব হচ্ছে সেহেতু এইসব অমীমাংসিত জমির দখলদারও আনঝিলেরই হওয়া উচিত। তাকে ব্যবহার করে সব আদায় করছে খানরা। তাহলে তার লাভটা কি থাকলো?

খানদের মুখ চুপসে গেছে। কাবির এমন খেল দেখাবে তারা ভাবতেও পারেনি। আসলাম খান বলল,

“এখন সই করে দে।”

কাবির জিজ্ঞেস করল,

“কেন? সই করার পর তোদের বোনকে নিয়ে যাবি নাকি?”

আখতারুজ্জামান খান বলল,

“আরেহ ভাই এরকমটা কখনোই হবে না। তোমার বউ তোমার কাছেই থাকবে।”

“তাহলে তো চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমার বউকে আমি যখন ইচ্ছা কাগজ দিয়ে দিতে পারি। হতেও তো পারে আজ সই দিয়ে দিলাম। আর আপনাদের নাতনি সব পেয়ে যাওয়ায় আমার সাথে ছলনা করল?”

ইথিকার মুখ মলিন হয়ে গেল।

আর্যাব খান বলল,”নিজের বউয়ের উপর বিশ্বাস নেই।”

কাবির সাথে সাথে গর্জে উঠল,”এই তুই কথা বলবি না এখানে। তোর এই মুখটা থানায় গিয়ে চালা। আমার সামনে নয়।”

আর্যাব খান বলল,

“কুল কুল।”

কাদিনের ইচ্ছে হলো জুতো ছুঁড়ে মারতে। একদম সহ্য হয় না ওর।

কাবির সব শর্ত তুলে নিয়েছে। বৈঠক শেষ হলো তার কিছুক্ষণ পর। সবাই গাড়িতে উঠার সময় আসলাম খান ইথিকাকে ডেকে নিয়ে কিছু কথা জিজ্ঞেস করছিল। ইথিকা ঠিকঠাক জবাব দিল। ভাবিকে ফিরিয়ে আনতে বললো ভালোভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। আসলাম খান তার মাথা চাপড়ে দিল। তক্ষুণি হাওয়ার বেগে আশিষ খান আর আরিশ খান ছুটে এল। ইথিকাকে যে যেভাবে পারল সেভাবে গালে, মাথায়, পিঠে ধুমধাম দিয়ে বসল ছোটবেলায় ইথিকা তাদের চকলেটে ভাগ বসালে মা নাচের স্কুলে চলে যাওয়ার পর ইথিকাকে ঠিক যেভাবে মারতো সেভাবে। ইথিকা চেঁচিয়ে আমিন খানকে ডাকল,

“ড্যাড!”

গাল জ্বলে উঠতেই চোখও ভিজে গেল। আমিন খান বলল,”কি হলো?”

“তোমার ছেলেরা আমাকে.. রাস্কেল….

আশিষ খান আর আরিশ খান দৌড়ে পালিয়েছে। আমিন খান গর্জে উঠল,

“আর্য এদের কিছু বলো।”

আর্যাব খান ধমকাতে ধমকাতে এগিয়ে এল। কাবির একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। আর্যাব খান ইথিকার কাছে এসে বলল,”গাল লাল হয়ে গেছে। ওই তোদের সাহস কত আমার বোনকে মারিস।”

ইথিকা বলল,”ওদের মারো। নইলে আমি আজ এখান থেকে যাব না।”

আর্যাব খান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর আচমকা ঘাড় চেপে ধরে ধাক্কা মারল। ইথিকা ছিটকে পড়ল কাবিরের উপর। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে রাগে, ক্ষোভে। রাগে গর্জাতে গর্জাতে নীচে বসে পড়ে বলল,

“ড্যাড ওদের না মারলে আমি আজ কোত্থাও যাব না।”

আমিন খান তিন ছেলের উপর ক্ষিপ্ত। ইথিকা চোখ বন্ধ করে কাঁদছিল। সেই ফাঁকে আর্যাব খান এসে গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠে সরে পড়ল। ইথিকা আরও জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো।

আমিন খান বলল,”ওঠো। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এখানে।”

ইথিকা ওঠল না। বসে রইল। জেদ দেখিয়ে বলল,

“না। ওদের মারো আগে। কান ধরতে বলো। আমি যাব না। ওদের মারোওওওওওও। নইলে আমি মাথা ফেটে ফেলব। মারো ওদের। এক্ষুণি সরি বলতে বলো। বলো। ও গড আই কিল দেম।”

কান্নায় ফেটে পড়ল সে। রাগে নাকমুখ লাল। হাঁপাচ্ছে। কাবির অবাক হয়ে গেছে। মেয়েমানুষ হয়েও এত্ত রাগ। আমিন খান তাকে শান্ত করাতে পারল না। আসলাম খানকে বলল,

“তুমি দেখো শান্ত করাতে পারো কিনা।”

আসলাম খান কাবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ওই তুই তোর বউকে শান্ত করাতে পারছিস না?”

কাবির বলল,

“তোদের তামাশা দেখতো ভালোই লাগছে।”

আশিষ আর আরিশ দূরে দাঁড়িয়ে ইথিকার কান্নাকে ব্যঙ্গ করছে। ইথিকা আরও জোরে জোরে চেঁচিয়ে কাঁদছে। সে এত অপমান নিতে পারছেনা।

আমিন খান আঙুল তুলে আর্যাব খানকে বলল,

“তোমরা তিনজন কানে ধরো। নইলে বাড়ির দরজা তোমাদের জন্য বন্ধ। কানে ধরো। ওকে বেশি কাঁদিওনা। বেশি কাঁদলে ও অসুস্থ হয়ে যায়। কানে ধরো বলছি।”

আর্যাব খান বলল,”কান না ধরে নাক ধরলে হবে?”

ইথিকা একটা পাথর খুঁজে ছুঁড়ে মারল। আর্যাব খান সরে পড়ল। ইথিকা বলল,

“কানে ধরে ওঠবস।”

আমিন খান বলল,”করো। আশিষ, আরিশ!”

ইথিকা ওঠছেনা। কান্নাও থামাচ্ছেনা। তাই আশিষ আর আরিশ খান কান ধরল। কিন্তু আর্যাব খান আগেভাগেই গাড়িতে বসে সিগারেট ফুঁকছে। কানে সে ধরবে না। ওরকম বোন মরে গেলে কি হয়? একটা মানুষ জীবন্ত অবস্থায় আর কত অপমান হবে? দেওয়ানদের সামনে কানে ধরা। ছ্যাহ! এত অকাল পড়েনি আর্যাব খানের।

কাবির ইথিকার সামনে হাঁটুভেঙে বসে বলল,

“ওঠো। তুমি কি বাচ্চা মেয়ে যে এভাবে কাঁদছ? ডি’কের মালিকের কি হাল!”

ইথিকার মুখ থমথমে। সে কাবিরকে বলল,

“উঠব না। আর্য বেয়াদবটা কানে ধরেনি। আগে ওকে কানে ধরতে বলেন। নইলে একপাও নড়ব না আমি।”

“ওঠো আনঝিল।”

“উঠব না, উঠব না, উঠব না।”

কাবির গর্জে উঠে বলল,”চোপ!”

ইথিকা চুপসে গেল। আর একটা কথাও বলল না। চেঁচাল না। কাঁদল না। আখতারুজ্জামান খান বলল, ওর জন্য কাবিরই ঠিক আছে। বদমাশ মেয়ে।

আমিন খানকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল কাবির। উনারা চলে গেল। দেওয়ানদের একটা গাড়িও চলে গেল। কাসেদ, কাবির আর ইথিকা থেকে গেল। কাসেদ গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। কাবির ইথিকার হাত ধরে টেনে তুললো। ইথিকা ত্যাড়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল। কাবির তার দিকে ফিরে বলল,

“কি হলো?”

ইথিকা তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একা একা হাঁটতে লাগল। কাবির বলল,

“মাথা কি গেছে?”

“আমি হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাব।”

কাবির তাকে হাজার ডেকেও থামাতে পারল না। এত ঘাড়ত্যাড়া মেয়েমানুষ। শেষমেশ কাসেদকে বলল চলে যেতে। কাসেদ চলে যেতেই কাবির হাঁটতে লাগল। ইথিকা হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গিয়েছে। জুতো পড়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাই জুতো খুলে হাঁটছে। আবার মাঝেমধ্যে কাবিরের দিকেও ফিরে তাকাচ্ছে। কাবিরের হঠাৎ হাসি পেল। এই মেয়ে তো বাচ্চা রয়ে গেল। কিভাবে সে এর সাথে সংসার করবে?

কিছুদূর যেতে না যেতেই ইথিকা হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ল। পায়ের নীচে মস্তবড় একটা কাঁটা গেঁথে গেছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ইথিকা হাত দিয়ে চেপে ধরল সেই তালুতে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। সে কাবিরের দিকে ফিরে তাকাল। কাবির কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসছে।

“কি হয়েছে?”

ইথিকা কাঁটাটা বের করে রক্তমাখা পায়ে হাঁটতে লাগল। কাবির ওই জায়গাটায় এসে থামল। রক্ত দেখে ইথিকার দিকে তাকিয়ে গর্জে ডাকল,

“এই দাঁড়াও! আর এক এগোবে তো খবর করে দেব।”

ইথিকা দাঁড়িয়ে থাকল। কাবির এগিয়ে এসে বলল,

“কোথায় কেটেছে দেখি।”

ইথিকা পায়ের নীচে ক্ষতটা দেখাল। রক্তে পা মাখামাখি হয়ে গেছে। কাবির হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল,

“তুমি ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেঁদে ভাসাও। আর এতবড় ক্ষত নিয়ে দিব্যি হাঁটছ?”

ইথিকা বলল,

“নিজের মানুষের ছোটখাটো মারধর আমার সহ্য না। তাই কাঁদি। একশো বার কাঁদব। আমার হাসি কান্নাও কি আপনাকে বলে বলে আসবে?’

“একদম চুপ।”

ইথিকা চুপ থাকলো না। বলল,

“থামালেন কেন? কোলে নিয়ে হাঁটবেন নাকি?”

“শাটআপ।”

কাবির বিরক্ত হয়ে চলে যেতে লাগল। মেইম রোডে উঠে গাড়ি নিতে হবে। ইথিকা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কাবির তার দিকে ফিরে বলল,

“কি হলো?”

ইথিকা জেদ দেখিয়ে বলল,

“কোলে করে নিয়ে যান। নইলে একপাও নড়ব না।”

কাবির বলল,”আমার মাথা খারাপ।”

ইথিকা কিছু বললো না। একপাও নড়ল না। কাবির বলল,

“আমি কিন্তু তোমাকে ফেলে চলে যাব।”

ইথিকা কিছু বললো না। সে নড়বে না মানে নড়বে না। কাবিরও তাকে কোলে করে নিয়ে গেল না।

অনেকদূর চলে যাওয়ার পর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখল ইথিকা নেই। সে হকচকিয়ে গেল। কোথায় গেল?

কাবির হন্য হয়ে তাকে খুঁজতে লাগল। নাম ধরে অনেক ডাকল। ইথিকা সাড়া দিল না। কাবিরের এবার চিন্তা হলো। এরকম জেদি মেয়ে সে আর দুটো দেখেনি। গেল কোথায়?

কাবির চারপাশ তাকাতে তাকাতে হঠাৎ একটা মোটা গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

হঠাৎ কানে এল কেউ গুনগুন করে কেউ গান গাইছে। এত সুন্দর গানের গলা।

লইয়া যাইয়ো দিল দেশে
কইও কথা নিশিতে

হলুদিয়া ফুলবনে
আসমু সাজি দিল টানে

দিল ডাকিয়া…
দিল ডাকিয়া কয় মোরে

এক নজর তোরে দেখি বসিয়া…
দিল আমার কিছু বোঝেনা…

ও দিল আমার
দিল আমার কিছু বোঝেনা
দিল আমার কিছু বোঝেনা…

কাবির ধীরপায়ে এগুলো। যাতে পায়ের আওয়াজ না হয়।

গাছের আড়াল থেকে দেখল,

ইথিকা গাছের নীচে বসে গান গাইতে গাইতে পায়ের নীচে বন্য লতার রস দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করছে।

কাবির হতবাক! এই মেয়ে কি তাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে? সে কপালে হাত চাপল।
এইসময়ে গান গাইছে মনের আনন্দে? তাও আবার এত নিশ্চিন্তে?

ইথিকা চোখ তুলতেই অগ্নিশর্মা কাবির দেওয়ানকে দেখে দ্রুত পা ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল কাবির তাকে ধরে ফেলল। জুতোজোড়া সহ কোলে তুলে নিয়ে হুমকি দিয়ে বলল,

“তুমি আমাকে একদম জ্বালাবে না। পাগল বানিয়ে ছাড়ছ আমাকে।”

ইথিকা তার গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপসে যাওয়া মুখে চেয়ে রইল। কাবির লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে। মেজাজের পারদ চরমসীমায়।
ইথিকার তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। কাবির তার হাসির কারণ কি জানতে তাকাল। ইথিকা বলল,

“আপনাকে রাগলে যা লাগে।”

“ননসেন্স।”

“লজেন্স। লজেন্সের মতো মিষ্টি।”

“চুপ।”

“হাউ কিউট!”

কাবির তার মুখের দিকে তাকাল। লাল নাকমুখ নিয়ে ইথিকা হাসছে। কাবিরের চোখে এরচেয়ে নিষ্পাপ চেহারা আর হয় না। কিন্তু এই জেদি মেয়ের নিষ্পাপ চেহারা মানায় না। এত জেদ, এত রাগ ভালো না। অন্তরা খানমও এমন জেদি ছিল। এত্ত জেদ যে তিনি যাকে চেয়েছেন তাকে পাননি বলে খুন করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেননি।

“আপনি সুন্দর বলে খুব অহংকার তাই না?”

“তোমার অহংকার কম কীসে?”

“তাই বলে আমি তো আর বরের সামনে অহংকার দেখাইনা।”

“আমিও যার তার সামনে অহংকার দেখাইনা।”

“আমার সামনে দেখান।”

“ফালতু কথা।”

“তাহলে একটা চুমু দেন।”

কাবির তার দিকে হকচকিয়ে তাকাতেই ইথিকা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,

“পুরুষ মানুষ অহংকার পাশে রেখে তারপর বউকে চুমু খায়। এই দেখুন আপনার চোখেমুখে কত অহংকার। দ্যাট মিনস আপনি চুমু খেতে পারবেন না।”

কাবির বিড়বিড় করল,”ষ্টুপিড।”

হাঁটতে হাঁটতে গাছের শিকড়ের সাথে হঠাৎ হোঁচট খেল সে। ইথিকা তার কোল থেকে ঢলে পড়ে যেত। ইথিকা তার গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাবিরও তাকে শক্ত করে ধরে নিজের ভারসাম্য ধরে রাখল। সেই ফাঁকে কাবিরের কড়কড়ে গালে তার নরম তুলতুলে গাল ঠেকে গেছে। ইথিকার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল। কাবিরের সেদিকে হুঁশ নেই। হাঁটছেই। সে অতটা খেয়াল করেনি ব্যাপারটা। হঠাৎ ইথিকার দিকে তাকাতেই দেখল ইথিকা কেমন করে তাকিয়ে আছে।

“কি হলো?”

ইথিকা রসিয়ে রসিয়ে বলল,

“কতকিছু হইয়্যা গেল, খবর পাইলা না।”

চলমান……..

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

“পায়ে আবার কি হলো?”

ইথিকা বিছানায় বসেছিল। পায়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। অনেক রক্ত গেছে। ক্ষত গভীর ছিল। সে বিছানা থেকে পা নামিয়ে নিল লুবনা বেগমকে দেখে। বলল,

“কাঁটা গেঁথেছে। তেমন কিছু না।”

লুবনা বেগম বললেন,”একটু দেখেশুনে হাঁটলে কি হয়? নামতে হবেনা তোমাকে। বসো। কিছু কথা বলার জন্য এসেছি।”

ইথিকা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল,

“কি কথা?”

ইথিকা ভাবল আজকের বৈঠকের ব্যাপারে কিছু বলবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে লুবনা বেগম বললেন,

“আমি কল্পকে নিয়ে ওর মামার বাড়িতে যাচ্ছি। বিয়েশাদি ঠিক হয়েছে তাই ওরা ওকে বেড়াতে যেতে বললো। কাল রাতেই কথা হয়েছিল। এখন সকালবেলা ওরা ফোন দিয়ে তোমাকেও দাওয়াত করেছে। তুমি ছিলে না তাই ফোনটা দিতে পারিনি। তুমি এলে কল দিতে বলেছে।”

ইথিকা শুকনো হাসল। তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কল্পনার মামার বাড়ি যাবে সে? তাদের রক্ত যেখানে ওদের মেয়ের খুনী? অসম্ভব। ওরা তাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে অপমান করবে।

“আমার পায়ের এই অবস্থা। কি করে যাব। আপনি বলে দিন কোনো একসময় যাব।”

লুবনা বেগম কথাটা শুনে একটু মলিন মুখে বললেন,”গেলে ওরা খুশি হতো।”

ইথিকা বলল,”আমি বুঝতে পারছি সেটা। কিন্তু কি করে যাব বলুন? পায়ের এই অবস্থা।”

কল্পনা দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। ইথিকার কথা সে শুনতে পেয়েছে। লুবনা বেগমকে বলল,

“ছোটমা বড়মামা ফোন দিয়েছে।”

লুবনা বেগম ফোনটা নিয়ে এলেন। কানে ধরে রেখে বললেন,

“জি ভাইসাব বউ বাড়িতে এল এইমাত্র। কথা বলবেন?”

ওপাশের জন হ্যাঁ বলাতে লুবনা বেগম ফোনটা ইথিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“নাও কথা বলো।”

ইথিকা ফোন নিল না। লুবনা বেগম জোর করে বললেন,

“নাও, একটু কথা বলো। তোমার বাবার বয়সী মানুষ। সালাম দিয়ে কথা বলো।”

ইথিকা দূরে সরে গিয়ে বলল,

“কথা বললে যেতে হবে। আপনি একটু ম্যানেজ করুন।”

কল্পনা তৎক্ষনাৎ রেগে গেল। ফোনটা লুবনা বেগমের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কানে ধরে বলল,

“মামা কাউকে জোরাজোরি করার দরকার নেই। আমার দাওয়াতে অন্য কেউ গেলে আমি নিজেই যাব না।”

মামা ওপাশ থেকে কি বললো কে জানে কল্পনা হ্যাঁ আচ্ছা বলে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিল। তারপর লুবনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,

“না গেলে না যাক। এত জোরাজোরির কি আছে? বেশি পাত্তা দিলে সমস্যা ছোটমা। চলো রেডি হও।”

ইথিকা অবাক হয়ে গেছে কল্পনার আচরণে। কল্পনা হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে যেতেই ইথিকা লুবনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ও কেন আমার সাথে এভাবে কথা বলবে। আপনি বলতে পারবেন, আপনার ছেলে বলতে পারবে। ও কে? ও আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস পায় কোথায়?”

তার গলার আওয়াজ উঁচু হওয়ায় কল্পনা শুনতে পাচ্ছে। সে সেখান থেকে উত্তর দিল।

“সঠিক কথা বলতে সাহসের দরকার হয় না। তুমি সামাজিকতা জানো? তুমি দাওয়াতে নাই বা যেতে। ফোনে কথা বলতে কি সমস্যা ছিল? তোমার কোনো ধারণা আছে বড় ভাইকে সবাই কি পরিমাণ স্নেহ করে? তুমি তার বউ হয়ে এভাবে ত্যাড়ামি করলে সেসব মানায় না।”

ইথিকা লুবনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,

“সাহস দেখেছেন ওর?”

লুবনা বেগম কিছু বলার আগেই ইথিকা কল্পনার উদ্দেশ্যে বলল,

“তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলবেনা কল্পনা।”

লুবনা বেগম কল্পনাকে থামাতে পারলেন না। কল্পনা চেঁচিয়ে বলল,

“একশো বার বলব। তুমি এসব ঘাড়ত্যাড়ামি তোমার বাপ ভাইয়ের সামনে দেখাবে। খবরদার আমাদের বাড়িতে এসব দেখাবেনা। ভাই তোমাকে লাই দিতে পারে। আমরা পারব না। অত তেল মেরে চলতে পারব না তোমাকে।”

ইথিকা চেঁচিয়ে উঠল। লুবনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে কল্পনাকে টেনে নিয়ে গেল। কিরণ কল্পনাকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ভাইয়ের ফোন এসেছে। যেকোনো সময় বাড়ি আসবে। এখন চুপ যাও না। কেউ থামো না তোমরা। আমার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে।”

কল্পনা রাগত স্বরে বলল,”ও কি বেয়াদব দেখলি না? বড়মামা কত করে বলল ও ফোনটা একবারও হাতে নিল না। গাদ্দার কোথাকার।”

লুবনা বেগম কল্পনাকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইথিকার কাছে এসে বলল,

“বৌমা কাবির এলে এসব বলো না। এরকম ননদ থাকলে দু একটা কথা কাটাকাটি হয়। সবকথা ছেলেদের কানে তুলতে নেই।”

লুবনা বেগমের মুখের উপর ইথিকা বলল,

“আপনাদের মেয়েকে সামলান। এভাবে ওর মুখ চললে বিয়েটাই হবে না। ভিজেবিড়াল সেজে থাকে সবার সামনে। ওর আসল রূপ দেখলে জোসেফের মা বেঁকে যাবে। এমনিতেও গায়ের রঙ নিয়ে অনেককিছু হচ্ছে।”

লুবনা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন।

“এসব কথা বলো না বৌমা। ওর কানে গেলে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। ওর গায়ের রঙ কি খারাপ?”

“ওর সাথে জোসেফের আর ওর বাড়ির মেয়ে বউদের সাথে যাচ্ছে?”

“তাও তুমি এভাবে বলতে পারবে না।”

“আমি বলেছি একবারও? আপনাদের মেয়ে আমাকে রাগিয়েছে তাই বলছি। ওর ননদ জেসি আমাকে সবটা বলেছে। জোসেফ পছন্দ করেছে বলে কল্পকে ওরা ওই বাড়ির বউ করে নিয়ে যাচ্ছে। নইলে কেউ রাজী নেই। আপনাদের মেয়ের স্বভাব চরিত্র আচার ব্যবহার সম্পর্কেও ওরা আন্দাজ করতে পেরেছে। শুধু ছেলের জন্য কিছু করতে পারছেনা।”

লুবনা বেগম একেরপর এক অবাক হচ্ছেন। জেসির সাথে ইথিকার কি সম্পর্ক?

“তুমি জেসিকে চেন?”

“হ্যাঁ চিনি। ও জোসেফের বোন সেটা এইদিন জানলাম।”

“জেসিকে কিভাবে চেন?”

ইথিকা কোনোরূপ ভণিতা না করে বলল,

“মেঝ ভাইয়ার বান্ধবী।”

লুবনা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন। দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলেন। ওই বাড়ির মেয়ে কি করে আর্যাব খানের মতো লোকের বান্ধবী হয়? ওরাও কি তাহলে একই মানসিকতার? নইলে জেনেশুনে একটা অসৎ পুলিশ অফিসারের বান্ধবী কি করে হতে দেন নিজেদের মেয়েকে? লুবনা বেগম চিন্তিত হয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

______

লুবনা বেগমের সাথে কল্পনা আর কাসেদ গিয়েছে মামার বাড়িতে। দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে ক্লান্ত পদক্ষেপে বাড়ি ফিরল কাবির। সারাদিন ব্যস্ত ছিল সে। কারখানা পরিদর্শন, অফিসের হিসাব-নিকাশ সামলানো, আর নতুন প্রকল্প নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুরুতর মিটিং।
তবে এই ব্যস্ততা বেশিদিন নয়। আর কদিন পর কাদিন আর কাসেদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সে পাড়ি জমাবে সৌদি আরবে। ব্যবসার কাজকর্ম সেখানেও চলছে, কিন্তু এবারের সফর শুধু ব্যবসার জন্য নয়। এবার তার লক্ষ্য হজ। আগেরবার তিনবার ওমরাহর সৌভাগ্য হয়েছিল, এবার হজে উপস্থিত থাকার নিয়ত করেছিল সে।

লায়লা খালার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

“মাইয়্যাডা একদম ভালা না। গুরুজনদের মুখে মুখে তক্ক করে। একটা কাজকাম করেনা। খালি হুমুক দেয়। বিয়াদব মাইয়া।”

“কার বলছ খালা?”

কাওসার দেওয়ান আর কামরান দেওয়ানের আর বড় ফুপুর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল বুয়া লায়লা। কাবিরের গলার আওয়াজ শুনে তার মুখ চুপসে গেল। তবে বড়ফুপু চুপ থাকলেন না। ভাইপোর উদ্দেশ্যে বললেন,

“তোমার বউদের কথা বলতেছে।”

কাবির সোফায় এসে বসল। বড়ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আবার কি হলো?”

বড়ফুপু বলতে লাগলেন।

“তুমি আর তোমার মা ওকে আহ্লাদ করছে বলে মাথায় উঠে বসেছে এখন। কিছু বলা যায় না চ্যানচ্যান করে উঠে। বাপ ভাইয়ের কথা বলে সবাইকে ধমকাচ্ছে। কল্পর সাথেও মনে হয় ঝামেলা বেঁধে গিয়েছিল দুপুরে।”

কাবির চুপচাপ শুনল। লায়লা খালাও একটু সুযোগ খুঁজছিল। সাহস করে কিছু বলে ওঠার আগেই কাবির দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,

“কিরণ ওরা পৌঁছেছে কিনা ফোন করে জেনে নাও। আমার গরম লাগছে। গোসল নেব।”

কিরণ লায়লা খালাকে চুপ থাকতে ইশারা করে জবাব দিল, “জি ভাইয়া ফোন দিচ্ছি।”

কাবির পা বাড়াচ্ছিল তখুনি বড়ফুপু বললেন,

“ওই মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”

কাবির থামল। কাওসার দেওয়ানও উশখুশ করছেন কিছু বলার জন্য। কাবির শান্ত গলায় বলল,

“এসব বিষয়ে পরে কথা বলব।”

কাওসার দেওয়ান বোনকে ইশারা করলেন কথা না বাড়াতে। কাবির চলে যেতেই বড়ফুপু বলল,

“আজকালকার ছেলেপেলেরা বউপাগল। কাবিরও সেই তালে পড়বে ভাবিনি কখনো। ওই মেয়ের শিরায় শিরায় ত্যাড়ামি আর অহংকার। আমাকে বলে কিনা আমার বাড়িতে আমি পানি ঢেলে অব্ধি খাইনি। আমার পেছনে তিন চারটে বুয়া লেগে থাকতো। আমি কাজ করে খাওয়াতে পারব না কাউকে। আপনাদের ছেলে কাজের বুয়া রেখেছে। তারা করবে যা করার। আপনাদের করতে জোর করিনি।
ইচ্ছে করে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই। আমার ভাইপোটার মাথা খাচ্ছে বেয়াদব মেয়ে।”

কামরান দেওয়ান উনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

“থাম। কাবির কি বাচ্চা ছেলে। ও সব বোঝে। ওর বউ ও সামলাবে।”

“সামলাবে না ছাঁই। ওর কোন কথা শুনছে মেয়েটা? আজ বাবাশ্বশুর, জেঠা শ্বশুর, দাদাশ্বশুর, দেবর সবার সাথে বৈঠকে চলে গেল ধেইধেই করে। মাথায় কাপড়টা অব্দি দেয়নি। কোন পরিবারে বউ হয়ে এসেছে ওর কি সেটা খেয়াল থাকেনা? একদম ওর বাপের বোনের মতো হয়েছে।”

কামরান দেওয়ান রেগে গেলেন।

“তোকে থামতে বলছি তো।”

কাওসার দেওয়ান বলল,”বড় আপা থামো।”

_______

কাবির ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে পা রেখে ওয়েস্ট জ্যাকেটটা ছাড়াতে ছাড়াতে ঘরের একোণা ওকোণায় তাকাল। ঘরের রঙ পাল্টে গেছে।
দেয়ালে ইথিকার অসংখ্য ছবি। ছবিতে কখনো সে হাঁটছে, কখনো দৌড়াচ্ছে, কখনো স্কাই ডাইভিং করছে, কখনো রোলার কোস্টারে বসে উল্লাসে চিৎকার করছে, কখনো সুইমিংপুলে ভেজা পোশাকে হাবুডুবু খাচ্ছে এরকম অসংখ্য অসংখ্য ছবি। বেশিরভাগ ছবিতেই সে নগ্ন কাবিরের দৃষ্টিতে। কিছু কিছু ছবিতে সে একটা হাফপ্যান্ট আর মিনি টপস পরা, চুলের উপর সানগ্লাসটা আটকানো। একঝাঁক বিদেশি বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই আঙুল তুলে নানান ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে ছবি তোলা। ঘরের পর্দাটা খানিকটা দুলে উঠল। ইথিকা পর্দার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল। পরনে একটা কালো গাউন। ফুলহাতা, গলাটা একটু বড় হওয়ায় কালো গাউনের উপর ফর্সা গলাটা বেশি নজর কাড়ছে। চুল খোলা। সাদা পাথরের টানা কানের দুলটা চুলের পেছনে গিয়ে আটকে আছে। চোখে কাজল। কাবির গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

ইথিকা হাসিমুখে বলল,

“একটা ছোটখাটো শুটিং আছে।”

“স্পট?”

“এখানেই।”

কাবিরের ভ্রু কুঁচকে গেল।

“এখানে মানে?”

“এখানে মানে দেওয়ান বাড়ির ছাদে। ওখানকার ভিউটা দারুণ।”

“বাঁদর খানরা আসছে?”

“না, আমার বন্ধু আর তার টিম মেম্বার। কোনো সমস্যা হবে?”

কাবির তার দিকে ফিরল ঘড়ি খোলা থামিয়ে। তার চাহনি দেখে ইথিকা খানিকটা ভড়কে গেল।

“আস্ত একটা সমস্যা যখন সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করে।”

ইথিকা তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠল,

“আমি সমস্যা?”

কাবির সাথে সাথে আঙুল দিয়ে বালিশ দেখিয়ে দিল। ইথিকা তাকাল সাথে সাথে। কাবির থমথমে কণ্ঠে বলল,

“বালিশের নীচে কাবিননামা, ডিভোর্স পেপার আর চেক রাখা আছে। গলার আওয়াজ নীচে থাকবে। নইলে সেগুলো নিয়ে চলে যাও। তোমাকে সাপোর্ট করবে এমন অনেক পরিবার আছে। তুমি সেখানে ভালো থাকবে। এখানে নয়। এখানে পদেপদে তোমার চলাফেরা কথাবার্তা আচার আচরণে ভুল ধরবে সবাই। আর সেটা স্বাভাবিক। দেওয়ান পরিবারের মহিলাদের চলাফেরা আর নিজের চলাফেরার পার্থক্যটা এখনো ধরতে না পারলে আমার কিছু করার নেই।”

ইথিকা চুপ করে রইলো। কিছু বললো না।
নিজেকে কোনোমতে সামলে নিল সে। কিছুক্ষণ পর ভিডিওগ্রাফারের কল এল। লোকটা দেওয়ান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টিম নিয়ে। ইথিকা তাদের ভেতরে আসতে বললো। বলে দিয়েছে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কার অনুমতি নিয়ে এসেছে তারা তাহলে যেন কাবির দেওয়ানের নামটা বলে দেয়।

কাওসার দেওয়ান কাবিরের নাম শুনে তাদের ভেতরে আসতে অনুমতি দিয়েছেন। বড়ফুপু তা শুনে চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন।

“বলেছিলাম না? বাড়িটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে। এই দেখো খেলা শুরু করে দিয়েছে ওই মেয়ে। কাবির কেন ওকে প্রশয় দিচ্ছে আমি জানিনা। এই বাড়িতে কখনো এসব নাচগান হয়েছে?”

বড় ফুপুর চেঁচামেচি কাবির শুনতে পেয়েছে। তবুও সে শোয়া থেকে উঠেনি। চোখ বুঁজে বিছানায় শুয়ে থেকেছে। তাকে আবারও বেরোতে হবে। এখন বিশ্রাম নেয়া জরুরি।

ছাদে সাউনবক্স ছেড়ে শুটিংয়ের কাজ চলছে। হয়ত বিজ্ঞাপন কিংবা কোনো প্রোডাক্টের মার্কেটিংয়ের কাজে শর্ট ভিডিওগ্রাফি হচ্ছে।

ভিডিওগ্রাফির কাজ শেষ হতে হতে প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে গেল। ইথিকা ক্লান্ত শরীরে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ছাদ থেকে নামতে যাবে তখুনি দেখল নাজিফা, কিরণ, ঝিনুক আর লায়লা খালা এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখছিল। ইথিকা তাদের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে যেতে লাগল। গুনগুন করে গানও গাইছিল তখন। লায়লা খালা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“বাপজানটার কপালটা পুড়ছে বজ্জাত মাইয়া।”

নাজিফা বিড়বিড়িয়ে বলল,”আমারও।”

কেউ শুনতে পায়নি তার কথাটা।

কিরণ বলল,”ভাইয়া এসব কেন এলাউ করছে বুঝতে পারছিনা। বিরক্ত লাগছে আমার। আজকে এদের নিয়ে এসেছে। কাল দেখবে বাড়িতেই পার্টি হচ্ছে। মদ খেয়ে নাচানাচি করছে।”

লায়লা খালা বলল,”তোমার ভাই বউয়ের দিওয়ানা হইয়া গেছে। বউ তার মাথা খাইছে চিবাইয়া চিবাইয়া।”

কিরণ নাজিফার সামনে বেশি কথা বাড়াল না।

____

দরজা খুলতেই ইথিকার চোখ পড়ল বিছানার দিকে। লম্বাটে একটা শরীর নির্ভার ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে বিছানার একপাশে। লোকটার ঘুমেরও একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে। ইথিকা মুগ্ধ না হয়ে পারেনা। তার বিপরীত একটা মানুষের প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে সে তা জীবনেও কল্পনা করেনি।

সে সবসময় ওয়েস্টার্ন কালচারে অভ্যস্ত মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছে। নাচ গান, নাইট ক্লাবে মাতাল রাত্রি, উচ্ছলতা, হৈহল্লায় ব্যস্ত থাকা তার জীবনে এমন সাদামাটা মানুষের ঠাঁই হতে পারে তা সে কখনো ভাবেনি। মাজহাব কাবিরের বন্ধু হলেও এমন সাদামাটা ছিল না। সে ভীষণ বেপরোয়া ছিল। ইথিকার মতো ধুরন্ধর চালাক মেয়েকেও সে ধোঁকা দিতে পেরেছে। সম্পর্কে তার মতো মেয়ের সাথে অপরদিকে বিয়ে করেছে সাদামাটা এক বোরকাওয়ালীকে।

আচ্ছা কাবির কি করে ওরকম একটা ছেলেকে নিজের বন্ধু বানিয়েছিল? নাকি মাজহাবের আসল রূপ সে জানতো না। অবশ্য মাজহাব ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ ছিল। সে ইথিকার সাথে নাইট ক্লাবেও যেত। আবার কাবিরের সাথে মসজিদেও। ইথিকা ঘৃণা হয় নিজের উপর। এত বোকা ছিল সে। মাজহাব কি জঘন্য খেলাটাই না খেলল তার সাথে। ইথিকাও কম নয়। যে তাকে ঠকানোর চেষ্টা করে তার জীবন সে ছারখার করে দেয়। মাজহাব তাকে ঠকিয়েছিল। ইথিকা তার জীবনটাই কেড়ে নিয়েছে। ওরকম লোকদের বেঁচে থাকার দরকার নেই।

নিঃশ্বাসের সুনসান ওঠানামায় ঘরের নিস্তব্ধতাকে বিন্দুমাত্র না ভেঙে পা টিপে টিপে ইথিকা ঘরে প্রবেশ করলো যাতে কাবিরের ঘুম না ভাঙে। ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। পুরো ঘর গোলাপি আভায় ভরা।

ইথিকা ধীরে ধীরে দুল খুলে রেখে দিল, ওড়নাটা নামিয়ে বিছানায় উঠে এল। তারপর নিঃশব্দে কাবিরের বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিল। বুকের ওঠানামার তালের সঙ্গে মিলিয়ে তার শ্বাসও ভারী হয়ে এল। অনেকক্ষণ সে তেমনই স্থির হয়ে নিঃশব্দে শুয়ে রইল, একফোঁটাও নড়ল না।

তারপর হালকা দুষ্টুমির ঝোঁকে আঙুল বাড়িয়ে আলগোছে কাবিরের শার্টের বোতাম খুলে হাত বুলিয়ে দিল তার উষ্ণ বুকের ওপর। স্পর্শের আবেশে কাবিরের নিদ্রা মুহূর্তেই উড়ে গেল, গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে বিস্ময়ে তাকাল ইথিকার দিকে।

ঘটনার আকস্মিকতায় সে হকচকিয়ে গেছে। ঘুমজড়ানো চোখ মেলে গা ঝাড়া দিতেই ইথিকা মাথা তুলে তাকাল বিরক্ত হয়ে। এত নড়াচড়ার কি দরকার? কাবিরের চোখমুখ শক্ত সবসময়ের মতো।

“পাশে শুতে পারো।”

নির্লিপ্ত স্বরে বলেই বুকের নিচে হাত গুঁজে নিয়ে পিঠ ফেরাল। ইথিকা কাবিরের পিঠের উপর মাথা রেখে চোখ বুঁজে নিল। মৃদুস্বরে বলল,

“আগেই পেমেন্ট নিয়ে ফেলেছিলাম। তাই ফিরিয়ে দিতে পারিনি। আর এই ধরনের কাজ করবো না। সত্যি। প্রমিজ।”

“সরে যাও। ভালো লাগছেনা এসব।”

ইথিকা সরলো না। নড়লো না। কাবির ধমকের সুরে বলল,”আনঝিল!”

ইথিকা একচুল পরিমাণও নড়লো না। বরঞ্চ কাবিরের বুকের নীচে হাত দুটো গুঁজে দিয়ে পিঠের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

____________

“স্যার ওরা আমাকে রেপ করতে চেয়েছিল।”

মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে কথাটা বললো। তাকে কয়েকটা ছেলে মিলে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে তাদের হাত থেকে কোনোমতে পালিয়ে এসেছে। আর্যাব খান সরু চোখে মেয়েটার কাঁপুনি খেয়াল করলো। সে বাড়ি ফিরছিল গরম মেজাজে। কারণ আজ পকেট গরম হয়নি। পকেট গরম না হলে মেজাজ গরম থাকে। সে তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,

“তুমি একা একা এতরাতে যাচ্ছিলে কোথায়?”

“স্যার আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। রোজ বাড়ি ফেরার পথে ওরা আমাকে জ্বালায়। আজ গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল। আমার পেছনের গাড়িতে যারা ছিল ওরা অনেক চিল্লিয়েছে কিন্তু ওরা শোনেনি।”

আর্যাব খান নীচের দাঁত দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,”সুন্দরী আছ। জ্বালাবেই।”

মেয়েটা করজোড়ে অনুরোধ করল,

“আমাকে বাঁচান স্যার। আমি রোজগার করে মা বোনকে খাওয়াই। আমার বাপ ভাই নাই।”

আর্যাব খান সিগারেট ফুুঁকতে ফুঁকতে বলল,

“সমস্যা বিরাট। চলো গিটারিস্টদের মুখদর্শন করে আসি।”

মেয়েটা ভড়কে গেছে। আর্যাব খান হেসে বলল,

“আরেহ গিটারিস্ট মানে যারা তোমাকে দেখে গিটার বাজাতে চাইল। চলো।”

মেয়েটা বুঝল না। আর্যাব খান তার বোকা বোকা চেহারা দেখে হেসে বলল,

“না বুঝলে ছেড়ে দাও। চাপ নিয়ে বয়স বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো। গাড়িতে ওঠো।”

মেয়েটা ভয়ে ভয়ে গাড়িতে উঠল। সে গাড়িতে উঠে ভালো করে দরজা বন্ধ করার আগেই আর্যাব খান গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেছে। তার গায়ে ঘাম ছুটল। সে এই পুলিশকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। যদি তাকে একলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে? না এসব কি ভাবছে সে। তবুও মনের ভয়টা কাটল না।

কিছুদূর যেতে না যেতেই মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,

“স্যার স্যার ওইতো ওইতো ওরা ওরা। স্যার গাড়ি থামান। ওদের ধরেন।”

আর্যাব খান গাড়ি নিয়ে ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে চলে গেল। মেয়েটাকে ভয় ঝেঁকে ধরলো পুনরায়। এই লোকটা তো তাহলে মস্তবড় শয়তান। চলে যাচ্ছে কেন এভাবে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আর্যাব খান গাড়িটাকে পিছু নিয়ে যেতে লাগল। গাড়ি উল্টো চলছে দেখে মেয়েটা আরও ভড়কে গেছে। আর্যাব খান গাড়িটা একেবারে ছেলেগুলোর সামনে দাঁড় করাল। জানালা দিয়ে গলা বের করে হাত নেড়ে ডাকল,

“হ্যাল্লো গিটারিস্ট।”

ছেলেগুলো ফিরে তাকাল। আর্যাব খান দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ছেলেগুলো গাড়ির ভেতরে মেয়েটাকে দেখে ভড়কে গেছে। ভেবেছে পুলিশের গাড়িটা এমনিই যাচ্ছিল এদিক দিয়ে। কিন্তু এটা কি হলো? মেয়েটা সোজা পুলিশ ডেকে নিয়ে এল? তারা হকচকিয়ে গেছে। ভয় পেয়ে গেছে। শালার ঘুষখোরটাকে ঘুষ দেয়ার মতো টাকাও হাতে নেই তাদের।

আর্যাব খান গম্ভীর মুখে সবাইকে একএক করে দেখে বলল,

“গিটার বাজা দেখি। বহুত দিন গিটারের সুর শুনিনা। বাজা বাজা।”

ছেলেগুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আর্যাব খান বদমায়েশি হেসে বলল,

“আরেহ আমি ব্যাটামানুষ। আমার সামনে বাজাতে কি সমস্যা? আমরা আমরাই তো। গিটার তো একই। বাজা।”

ছেলেগুলো এবার তার কথার ঢঙ বুঝে গেল। তারা তরতরিয়ে ঘামছে। একজন একটু তোষামোদি করতে ছুটে এল। আর্যাব খান আঙুল বাড়িয়ে দিল,

“নো নো। দূরে দাঁড়িয়ে কথা বল। শালা পারফিউম মাখিস না।”

ছেলেটা দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল,

“আসলে ছ্যার হয়ছে কি। ওরে ভালা লাগে বড়ো। কিন্তু আমারে ও ভয় পায়।”

মেয়েটা সাথে সাথে বলে উঠল,

“স্যার সব মিথ্যে কথা। ওদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল। স্যার ওদের নিয়ে যান। ওরা আমাকে কাল হাতের কাছে পেলে আর ছাড়বে না। ওরা আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বাজেভাবে গায়ে হাত দিয়েছে।”

আর্যাব খান একজনকে আঙুলের ইশারায় ডাকল। ছেলেটা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এল।

আর্যাব খান বলল,”কিছু দিবি নাকি গিটারের তার কাটব?”

ছেলেটা তরতর করে ঘামছে। বাকিদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। সবাই যে যার পকেট হাতড়ে টাকা বের করল। ল্যাম্পপোস্ট আর গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাস্তা একেবারে ফকফকা পরিষ্কার। মেয়েটা স্পষ্ট দেখল পুলিশ অফিসার টাকা নিয়ে পকেটে ভরছে। সে ভয়ে কাঁপতে লাগল। এই পুলিশ অফিসারের কাজ সন্দেহজনক। আর্যাব খান টাকা পকেটে ভরে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

“ঘুষ পেয়ে আমার পকেট আপাতত গরম। পকেট গরম হলে আমার দিল হয়ে যায় নরম। এখন তোদের কোন স্টাইলে মারব? কোন স্টাইলে মারলে মেয়ে মানুষ দেখলে তোদের গিটার বেজে উঠবে না।”

ছেলেগুলো তার হাবভাব বুঝতে পারছেনা। এই ঘুষখোরটা দেখছি মেয়েদের সামনে হিরোও সাজতে চায় আবার তাদের টাকায় পকেটও গরম করতে চায়। তারা পুলিশটার ঠোঁটের বদমায়েশি হাসির কারণ বুঝতে পারল না। আর্যাব খান যেই একজনের কলার চেপে ধরতে যাবে অমনি কোথাথেকে একটা জুতো ছুটে এসে একটা ছেলের মাথায় পড়ল। ভারী জুতো হওয়ায় আঘাত পেয়ে একটা ছেলে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল আর্যাব খানের সামনে। জুতো আরও একটা ছুটে এল সামনে থেকে। সেটা সরাসরি আর্যাব খানের বুকের উপর। জুতো কে ছুঁড়ে মেরেছে? মেয়েদের জুতো যেহেতু সেহেতু বোঝায় গেল জুতোর মালিক কোনো মেয়েই হবে। সবাই হকচকিয়ে গেছে। বিশেষ করে আর্যাব খান। কারণ জুতো ছুড়ে মেরেছে কল্পনা! এতবড় সাহস! তার গায়ে জুতো ছুঁড়ে মারা?

তাকে দেখে ছেলেগুলো আর্যাব খানকে পরোয়া না করে দৌড়ে পালাতে লাগল। আর্যাব খান হকচকিয়ে গেছে পুরোটাই। কি হয়ে গেল!

কল্পনা হনহনিয়ে এগিয়ে এসে রাস্তা থেকে একটা জুতো কুড়িয়ে নিয়ে আর্যাব খানের দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

“সবাই মিলে মেয়েটাকে উত্যক্ত করছো তাই না? আমাদের সামনের গাড়ি থেকে ওকে তোমরা তুলে এনেছে। আমি ভাবতেও পারিনি এসব নোংরা কাজের পেছনে তোমার হাত থাকতে পারে। নিজের বোনের সাথে এসব করতে পারতে? বদমাশ নচ্ছার ঘুষখোর পুলিশ কোথাকার। লজ্জা হয় না তোমার? বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই না? তুমি ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছ। আমি ছবি তুলে নিয়েছি। তুমি ঘুষ নিচ্ছিলে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। প্রমাণও আছে। এবার দেখো আমি তোমার কি হাল করি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেব তোমার এসব কুকর্ম। হাঁ করে কি দেখছ?”

আর্যাব খান ভণিতা করে বলল,

“তোমাকে দেখছি। তুমি কালো কিন্তু তোমার কথাগুলো ভীষণ ভালো।”

কল্পনা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

“আমি এতক্ষণ কি বললাম শুনতে পেয়েছ?”

আর্যাব খান কাঁধ নাচিয়ে বলল,

“অবশ্যই। মেয়েমানুষের কথা আমি মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে শুনি। তোমার কথা দিল দিয়ে শুনেছি। হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।”

বলেই বিশ্রী হাসল। কল্পনার গা জ্বালা ধরে গেল। সে জুতোটা দেখিয়ে বলল,

“তোমার মতো ভাই ভাগ্যিস আমার নেই। থাকলে জুতো দিয়ে পিটিয়ে সোজা করতাম।”

আর্যাব খান হে হে করে হেসে উঠে বলল,

“ভাগ্যিস তোমার মতো বোন নেই। থাকলে পাউডার কিনে দিতে দিতে ফতুর হয়ে যেতাম। গায়ের যা রঙ।”

কল্পনা চেঁচিয়ে বলল,

“তোমার বোনের চাইতেও দামী আমি। আমাকে এসব বলে কষ্ট দিতে পারবে না। আমার ব্রাউন স্কিন নিয়ে আমি হ্যাপী। তোমার বাঁদরের মতো চেহারায় আমি থুতু ছুঁড়ি। থুহ!”

আর্যাব খান মুখ ফিরিয়ে নিল। কল্পনা থুতু রাস্তায় ফেলেছে যদিও। কিন্তু আর্যাব খানের ভারী অপমান লাগল। যদিও সে সহজেই মাইন্ড খায় না। অপমান সে ভিটামিন হিসেবে খেয়ে নেয়। তার অপমান গায়ে লাগেনা। ঘুষখোর, দূর্নীতিবাজ ডাকলে মনে হয় প্রশংসা করছে। সে তার পরিচয় নিয়ে প্রাউড ফিল করে। এমন ঘুষখোর উপাধি পেয়েও গর্বের সাথে পুলিশের চাকরি করে মাস শেষে পকেট গরম করার মতো দুঃসাহসিক কাজ করতে গেলে আর্যাব খান হয়ে জন্মাতে হবে। কিন্তু অপমান আজ ভিটামিন হিসেবে নেয়া গেল না। এক জুতার বাড়ি, দুই থুতু। তাও দেওয়ান বাড়ির মেয়ের কাছ থেকে। এত অপমান নেয়া যাচ্ছে না। কি করা যায়? রক্তে একটুআধটু ভালো মানুষি মিশে আছে বলে মেয়েমানুষের সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করেনা। কিন্তু বেয়াইন হলে অন্য কথা। ঝগড়া তখন গায়ে পড়ে করতে ইচ্ছে করে কিন্তু বেয়াইন আজকে তার গায়েপড়ে ঝগড়া করছে সত্যিটা না জেনে। বেয়াইনের জানা উচিত সে ঘুষ খেয়ে ঘুষদাতার সাথে বেঈমানি করে পুলিশের ডিউটি পালন করে। পুরো মাস জুড়ে ঘুষ খেলেও মাস শেষের ইনকামটুকু না হয় একটু বৈধ হলো। ভালো আর খারাপে মানুষ। তার খারাপটা একটু বেশি। বেয়াইনের চোখে সে ইবলিশের তালতো ভাই। একদম খাঁটি কথা।

কল্পনা মেয়েটার সাথে কথা বলছে। মেয়েটাও তাকে সবটা খুলে বলছে।

কাসেদ দৌড়ে দৌড়ে এল এতক্ষণে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সে হাঁপাচ্ছে। কল্পনাকে পেয়ে শান্তি পেল সে। কিন্তু আর্যাব খানকে দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। এই বাঁদরটা এখানে কেন?

মেয়েটা কল্পনার পাশ থেকে এগিয়ে এসে আর্যাব খানকে বলল, “স্যার আমি জানিনা আপনি কেন ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু আমি এই আপাকে বলে দিয়েছি আপনার কোনো দোষ নেই এতে।”

আর্যাব খান বলল,”এজন্য তোমাকে লাল সেলাম। তোমার আপাকে বডিগার্ড বানিয়ে নাও। চাকরির পয়সা থেকে কিছু পয়সা ওকে দিও। পাউডার কিনতে পারবে মুখে মাখার জন্য।”

মেয়েটা চুপসে গেছে। এরা নিশ্চয়ই পূর্ব পরিচিত।

“আমার মুখ সুন্দর করার জন্য না হয় পাউডার আছে। তোমাদের চরিত্র ঠিক করার কোনো ঔষধই কারো জানা নেই। নির্লজ্জ।”

আর্যাব খান গলা একপাশে কাত করে হাসল।

“আজ লজ্জা নেই বলে।”

কাসেদ এগিয়ে এসে বলল,”আরেহ বড়ভাই ফোন দিচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে কেউ এভাবে ছোটে? চল। কে এই মেয়েটা?”

কল্পনা বলল,”ওকে আমি চিনি। কিন্তু কথা হয়নি কোনো সময়। ওকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল দেখে ছুটে এসেছি। এই মেয়ে চলো আমার সাথে। কাল থানায় জিডি করে রাখবে। আরও কিছু প্রমাণ বড় স্যারকে দেখাব।”

কথাটা আর্যাব খানের ঘুষ নেয়াকে ইঙ্গিত করে বলেছে বুঝতে পেরে আর্যাব খান বলল,

“বেয়াইন যা টেবিলের নীচ দিয়ে চলে তা আমি উপর দিয়ে চলাই। এই হচ্ছে পার্থক্য। আর্যাব খান অসৎ কাজ করতে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। অসৎ কাজে লজ্জা নেই। গোটা গোটা পয়সা পাওয়া যায়। পকেট গরম থাকে। মেজাজ নরম থাকে। একটুআধটু শরমও থাকে। নইলে মুখ খারাপ হয়।”

কল্পনা বলল,”তোমাদের মতো পুলিশ অফিসাররা লজ্জার।”

আর্যাব খান হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,”লজ্জা পাচ্ছেন? লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু তো করিইনি বেয়াইন।”

চলমান.