মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
1

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৩
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

🚫 [ Violence Alert ]

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। এতরাতে তুমি? কোনো সমস্যা আর্য?”

আর্যাব খান বলল,

“আমার কাছে জোসেফের নাম্বার নেই তাই আপনার ফোনে কল করতে হলো। তার হবু বউ আমার কাছে। আমি মেসেজে ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওকে এসে নিয়ে যেতে বলুন।”

জাহানারা বেগম অবাক হয়ে গেলেন।

“তোমার সাথে? কল্পনা তোমার সাথে কেন? ওর ভাইদের ফোন দাওনি তুমি?”

“না ওদের সাথে আমার শত্রুতা আছে। কথা হয় না। জোসেফকে খবরটা দিন।”

“কল্পনা এখন কোথায়?”

“আপাতত আমার পাশেই আছে।”

“ফোনটা ওকে দাও।”

আর্যাব খান ফোন বাড়িয়ে দিল। কল্পনা তার হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“কথা বলব না আমি। সরো।”

আর্যাব খান নিঃশব্দে হাসল। কল্পনার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে জাহানারা বেগম। কল্পনা কথা বলতে চাইছেনা? কেন? মেয়েটা কি জোসেফকে ঠকাচ্ছে?

আর্যাব খান বলল,”তুমি কথা বলো। জোসেফকে ফোন দিয়ে সবটা বলতে চেয়েছিলে না? নাও তার মাকে সবটা বলে দাও।”

কল্পনা একঝটকায় ফোনটা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারল।

“তোমার চালাকি আমি ধরতে পেরেছি আর্যাব খান। একটা কথা শুনে রাখো এসব করে তুমি আমার বিয়ে ভাঙতে পারবে না। জোসেফ আমাকে বিশ্বাস করে। আমি তোমার বোনের মতো চরিত্রহীন নই যে সে আমাকে কথায় কথায় অবিশ্বাস করবে।”

আর্যাব খান ফোনটা কুড়িয়ে নিল। চার্জ শেষ। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ইথিকা এখনো ফোন রিসিভ করছেনা। হারামিটা গেল কোথায় এত রাতে? এই শয়তানিকেও এখন ছাড়তে হবে। তার যা করার সে করে ফেলেছে।

সে গাড়ি স্টার্ট দিল। কল্পনা বলল,

“সোজা দেওয়ান বাড়িতে যাবে। নইলে আজকে তুমিও মরবে, আমিও মরবো।”

আর্যাব খান হো হো করে হাসল।

“বেয়াইন আসুন আপনি আমি একসাথে মরে যাই।”

কল্পনা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। তার রক্ত টগবগ করছে রাগে। তার কাছে যদি কোনো ধারালো অস্ত্র থাকতো এই মুহূর্তে। সে আর্যাব খানকে ফালাফালা করে দিতেও দুবার ভাবতো না। ইতোমধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। আন্টি নিশ্চয়ই কথাটা এখন সবাইকে বলে বেড়াবে যে সে এতরাতে আর্যাব খানের সাথে আছে। সে কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছে সেটা কেউ জানতে চাইবে না। জোসেফ কি তাকে অবিশ্বাস করবে? না এত সহজে অবিশ্বাস করার মানুষ জোসেফ নয়।

গাড়িটা খান বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। কল্পনা গাড়ি থেকে নামল না। আর্যাব খান গাড়ি থেকে নেমে জানালার কাছে মাথা নামিয়ে বলল,

“বেয়াইন গাড়িতে ঘুমাতে চাইলে ঘুমাতে পারবেন। নো প্রব। কিন্তু আমরা কুটুমদের এভাবে ঘুমাতে দিইনা। আসুন।”

হাত বাড়িয়ে দিল আর্যাব খান। কল্পনা তাকালও না। হাত বাড়িয়ে দেওয়া তো দূর। আর্যাব খান যা করার করে নিক। সে এমন খেল দেখাবে আর্যাব খান মুখ লুকিয়ে পার পাবেনা। এখনো কামরান দেওয়ানের মেয়েকে এই আর্যাব খান একফোঁটাও চেনেনি।

আর্যাব খান আচমকা শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরল। টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ইলিনা বেগম ছুটে এল।

“আর্য তুমি এখানে? ইথু কোথায়? কল্পনা এখানে কি করছে?”

“আমার সাথেই ছিল। বাকি রাতটুকুও এখানেই থাকবে।”

ইলিনা বেগম রেগে গেলেন।

“এই সিচুয়েশনে দাঁড়িয়েও তুমি ইয়ার্কি করছ? ইথুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাবির ফোন করেছে। সে নাইট ক্লাবেও নেই। কোথাও নেই। কোথায় চলে গেল মেয়েটা?”

আর্যাব খান ধীরেসুস্থে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় গিয়ে বসলো। হাঁটুর উপর তুলে দেয়া পা”টা নাচাতে নাচাতে বলল,

“ভালোই হয়েছে। ডিভোর্স নিলে এতকিছু হতো না। দেওয়ানিদের সাথে থাকতে চাইলে বিপদ তো ঘটবেই।”

“বাজে বকো না।”

“বাজে কোথায় বকছি? ওরা কেউ তোমার মেয়েকে গ্রহণ করেছে? তাহলে ওর কীসের ঠেকা পড়েছে ওখানে থাকার? তোমার মেয়ে জামাই তোমার মেয়েকে চায়? না পারতে সহ্য করছে। মুখের উপর বলে দিতে পারছেনা তোমাকে আমার চাই না। তোমার মেয়ে শালার চরম বেহায়া। হঠাৎ করে জামাই পাগল হয়ে গেল ডিভোর্সের কথা উঠতেই। নিজের মর্জিমতো চলবে আর দেওয়ানি বউও হবে। হাস্যকর।”

ইলিনা বেগম ধমকে উঠলেন,”ও ভুল কি করছে? ডিভোর্স নেবে বলে তো বিয়ে করেনি।”

“দাঁড়াও হেসে নিই একটু। তারপর কথা হচ্ছে।”

কল্পনা চেঁচিয়ে উঠল তারমধ্যে।

“আমি বাড়ি যাব।”

আর্যাব খানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। ধমকে উঠল সে,

“হাসতেও দেবেনা এরা শান্তিতে।”

কল্পনা ইলিনা বেগমকে বলল,

“আপনার ছেলে আমাকে হাসপাতাল থেকে তুলে এনেছে। আমাকে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখিয়েছে। এইসব হেনস্তার জন্য আমি মামলা করবো আপনার ছেলের নামে।”

আর্যাব খান তার দিকে সরু চোখে চেয়ে বলল,

“মনে হচ্ছে ছোট্ট সোনামণি লজেন্স না পেয়ে আন্টির কাছে বিচার দিচ্ছে।”

কল্পনা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠে বলল,

“আমি তোমাকে পরে দেখে নেব। আগে বাড়ি যাব।”

বলেই গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে প্রচুর অন্ধকার। কোন পথ দিয়ে যাবে, কিভাবে যাবে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

আবারও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো সে। আর্যাব খান সোফায় মাথাটা এলিয়ে চোখ বুঁজে রেখেছে। শার্টের বুক খোলা। কল্পনাকে প্রবেশ করতে দেখে ফট করে চোখ মেলে হাসলো।

“ললনা দেখি ফিরে এসেছে।”

ইলিনা বেগম পায়চারি করতে করতে কাকে যেন ফোন দিচ্ছিলেন। কল্পনা বলল,

“আন্টি ফোনটা দিন। ভাইয়াকে ফোন করবো। গাড়ি পাঠাক।”

ইলিনা বেগম ফোনটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তক্ষুণি কল্পনার মাথার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে চোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিল আর্যাব খান। ফোনটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“এটা তো সম্ভব নয় বেয়াইন। আপনি আজকে খান বাড়ির মেহমান। উপরের ঘরে চলে যান। খালি পেটে আরামসে ঘুমান। তারপর সকালে উঠে খালি পেটে আরামসে হেঁটে হেঁটে দেওয়ান বাড়ি চলে যাবেন।”

কল্পনা ইলিনা বেগমের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। ইলিনা বেগম বললেন,

“ফোনটা দাও আর্য। আমি ইথুকে ফোন দিচ্ছি।”

“ওকে ইতোমধ্যে পুলিশ খুঁজছে। খুঁজে পেলে আমাকে কনফার্ম করবে বাড়িতে এসে।”

“তুমি এত নিশ্চিত কি করে? তোমার বোন বিপদে আছে।”

আর্যাব খান ত্যাড়ছা গলায় বলল,

“বিপদ ডেকে এনেছে কেন? এখন বিপদকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো ছাড়া উপায় নেই। বেয়াইননন!”

কল্পনা চমকে উঠল। আর্যাব খান হেসে বলল,

“যান বিপদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমান। খালি পেটে কিন্তু হুহ। গো।”

কল্পনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সে এই বাড়িতে কিছুতেই থাকবে না। ইলিনা বেগম আর্যাব খানের পিছুপিছু ছুটল।

“আর্য ফোন দাও। মায়ের সাথে এভাবে কেউ এভাবে ইয়ার্কি করেনা।”

“আর্যাব খান করে।”

ইলিনা বেগম চেঁচালেন।

“আর্য!”

“সামনেই তো আছি। আস্তে করে ডাকলে হয় না?”

“কি করতে চাইছ তুমি?”

“আপাতত হারামিটাকে খুঁজে বের করবো।”

“কল্পনাকে ওর বাড়ি পৌঁছে দাও।”

“ওকেও আমার বোনকে খুঁজে দিতে হবে।”

ইলিনা বেগম তার পিছুপিছু ঘরে গেল। আর্যাব খান শার্ট পাল্টে নিল। হাতে গ্লাভস পরে পিস্তলে গুলি লোড করলো। পিস্তল পকেটে ভরে নিল সাথে একটা চকচকে নাইফ। তারপর শার্টের কলার ঝাড়তে ঝাড়তে নীচে নেমে এসে কল্পনার সাথে হাসল।

“বেয়াইন চলুন। আপনি যেহেতু থাকতে চাইছেন না তখন আর জোর করব না।”

“কোথায় যাব এখন? আমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাও।”

“আপনার ভাবিরাণীকে খুঁজে পেলে তার সাথে আপনাকেও দেওয়ান বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পিংকি প্রমিজ।”

______________

ইথিকাকে যেখানে এনে ফেলা হয়েছে সেখানের মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে। বৃষ্টির পানি ছাদ গড়িয়ে পড়ছে। দরজা জানালা সব বন্ধ। ইথিকার যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার মনে পড়ল সব ঘটনা। একটা ছেলে তার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে ঠিকানা খুঁজছিল। সে কাগজটা পড়তে গিয়ে মাথা দুলে উঠেছিল। তারপর তাকে কি যেন খাওয়ানো হলো। ওসব মদ ছিল? তার দামী ফোন, ফোনের কভারের নীচে টাকা ছিল। হাতের চুড়িদুটোও নেই। গলার চেইনটাও। নাকের ডায়মন্ডের নোজপিনটা।
অজ্ঞান পার্টির লোক ছিল নাকি? তার মাথাটা এখনো টলছে।

সে মেঝে থেকে উঠে বসলো। মুখের একপাশে কাঁদা লেগে আছে এখনো। থুতু ফেলল সে মেঝেতে। বমি পাচ্ছে। গা গুলাচ্ছে। মাথা ঘুরছে। সে চেঁচাল,

“কে আছ বাইরে? দরজা খুলে দাও।”

দরজা খুললো না কেউ। ইথিকা টলতে টলতে দরজার কাছে এসে একেরপর এক ধাক্কা দিতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। একসাথে অনেকগুলো লোক ভেতরে ঢুকে এল। ইথিকা ভড়কে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

“আমাকে ছাড়ো। কারা তোমরা?”

লোকগুলো লোাভাতুর চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ইথিকার এবার ভয় করতে শুরু করলো। এতগুলো লোকের সাথে সে পারবেনা। কিন্তু কি করবে এখন?

লোকগুলো পরিকল্পিত ভাবে ঘরে ঢুকেছে। দু’জন এসে তার গায়ের ওড়না খুলে নিল। সেই ওড়না দিয়ে ইথিকার হাত বেঁধে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো। ইথিকার সাথে ধস্তাধস্তিতে চললো। বড় বড় নখ তার গাল ছিঁড়ে ফেললো। একজনের নখ ইথিকার চোখের কোণায় গিয়ে গেঁথে গেছে। অন্যজনের নখ ঠোঁটের ভেতরে ঢুকে টান দেয়ায় ভয়ংকরভাবে ছিঁড়ে গেছে। ইথিকার সাদা দাঁত রক্তে মেখে গেল। চুল টেনে ধরেছে একজন। বুকের কাপড় টেনে ছিঁড়ে নিল একজন। তারপর মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল একঝটকায়। ইথিকা দু’হাতে বুকের অংশ ঢেকে পিঠ করে মেঝেতে নিথর হয়ে শুয়ে রইলো। দুবার বমি করল। কাঁদা, বমি, রক্তে মাখামাখি হলো সে। যতটুকু হুঁশে আছে ততটুকু দিয়ে বুঝতে পারল তাকে সোজা করে শুইয়ে তার পা দুটো বাঁধা হচ্ছে। গলা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে এইতো আর কিছুক্ষণ। গলায় পানি না পড়লে মৃত্যু সন্নিকটে।

তার মধ্যেই চোখে পড়ল সবচেয়ে বিকৃত, জঘন্য দৃশ্যটা। একটা লোক ধীরে ধীরে নিজের পোশাক খুলে ফেলছে একটা একটা করে। ইথিকার নিঃশ্বাস আটকে গেল। ঘিনঘিনে একটা ঘ্রাণ বাতাসের রন্ধ্রে ঢুকে বুক চেপে ধরল। পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখে ভেসে উঠল রক্তজবা রঙের বিভৎসতা। সে আর সহ্য করতে পারল না। গলা বেয়ে উঠে এল গরম তিক্ত বিশ্রী স্বাদের বমি। গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত বমি। চোখের কোণা দিয়ে রক্ত তো পড়ছেই।

চলমান…….

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

নিশির নিঃশব্দতা ছিঁড়ে চারদিক কাঁপিয়ে বাজছে পুলিশের সাইরেন। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে উঠছে। ইথিকা ছটফট করছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে। হাত পা বাঁধা, মুখে রক্ত জমাট। হঠাৎ তার হালকা গোঙানির শব্দ ছুঁয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কারও কান।

এক মুহূর্তের মধ্যে আড়াল থেকে ছায়ার মতো এগিয়ে আসে দুজন লোক। তাদের চোখে হিংস্রতা, লোভার্ত দৃষ্টি, হাতে রশি। একজন ইথিকার গলায় ঠেসে ধরে মোটা দড়িটা, যাতে তার একটাও শব্দ না বেরোয়। অন্যজন চেপে ধরে তার মুখ।
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বুকটা ধকধক করছে। ইথিকার শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বুকের অর্ধেকটা কাপড় ছেঁড়া। রক্তে ভিজে যাচ্ছে মেঝে।

কয়েকজন ফিসফিস করে বলল,

“এখনো শব্দ বেরোচ্ছে কেন? কোনো কাজ পারিস না। পুলিশের বাচ্চারা চলে এসেছে। রশিটা জোরে টান।”

রশিটা গলায় পেঁচিয়ে ইচ্ছেমতো টানতে লাগলো তারা। ইথিকার গলায় গড়গড় শব্দ হচ্ছে।

___

ধুলার পরত জড়িয়ে আছে পুরনো বাড়িটাতে। পুলিশের টিম বাড়ির সামনে থেমে গেল। কাবির কাদিন সবাই নামল গাড়ি থেকে। ফ্রন্ট ইউনিটের সাথে সামনে চলে গেল তারা। কাবির তাড়া দিচ্ছে পুলিশকে। কারো অনুমতি লাগবে না। তাড়াতাড়ি করুন।

তার পেছন পেছন আর্যাব খানের গাড়ি এসে থেমেছে। ইয়ারপিসে জুনিয়র অফিসারের সাথে কানেক্ট হওয়ার পর থেকে সে এই পথে চলে এসেছে। কল্পনার বুক কাঁপছে। কোথায় চলে এসেছে সে? এখানে এত পুলিশ।

গাড়ি থেকে ত্বরিতে নেমে এল আর্যাব খান। সাব ইন্সপেক্টর এসে সালাম ঠুকে বলল,

“স্যার ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বলছে ভেতরে অস্ত্রধারী কয়েকজন লোক আছে। ফ্রন্ট ইউনিট বলছে দরজা ভেতর থেকে লক করা। আমরা আসার আগেই কয়েকজন পালিয়েছে।”

আর্যাব খান সামনে এগিয়ে গেল। কল্পনা তার পিছুপিছু গাড়ি থেকে নেমে এল। বলল,

“আমি এখন কি করব এখানে?”

আর্যাব খান ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। দাঁত চিবিয়ে বলল,

“আমার কোলে উঠবে? এসো কোলে উঠে বসে থাকো।”

কল্পনা মুখ ফিরিয়ে নিল। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। এই বেয়াদবটার সাথে কথা বলারও ইচ্ছে নেই।

আর্যাব খান আর দেরী না করে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ির সামনে চলে গেল। পুলিশের দল সেদিকে ছুটল।

কাবির আর কাদিনকে দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। কিন্তু এখন কিছু বলার সিচুয়েশনে নেই সে।

সে চোখে ইঙ্গিত দিলেন দুই নম্বর অফিসারকে। তাঁর হাতে রাইফেল, কিন্তু দরজা ভাঙার জন্য সেটাই যথেষ্ট না। কড়া গলায় বলল,

“সামনের তালায় শটগান লাগাও।”

দুই নম্বর অফিসার এগিয়ে গিয়ে দরজার ডেডবোল্ট লক্ষ্য করে শটগান ছুঁড়ল,

‘ধড়াম!’

প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল বাড়ির সামনের দেয়াল। তালা খুলে গেল না, কিন্তু আটকে রাখা কাঠের অংশ ফেটে গিয়েছে। আর্যাব খান বলল,

“আরেকটা দাও কব্জার এর নিচে!”

দ্বিতীয় গুলি হিট করল দরজার কব্জায়। এবার কাঠ চিড় ধরল। আর্যাব খানের দৃষ্টি শানানো। সে এবার ইশারা করল।

“Go!”

দুজন অফিসার একসাথে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো দরজায়। ফাঁটা কাঠ ও ভাঙা কব্জায় ভর দিয়ে দরজাটা হুড়মুড় করে খুলে গেল। দরজার পাশের কাঠ ভেঙে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চমকে উঠল সবাই।
এরপরেই একটার পর একটা বুটের শব্দ, আর সেই সঙ্গে আর্যাব খানের গর্জন,

“কেউ নড়াচড়া করলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করব।”

দড়ি হাতে থাকা লোকটা হতচকিত হয়ে পেছনে ঘুরতেই গায়ের ওপর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। আরেকজন পালাতে চাইলো, কিন্তু ততক্ষণে আর্যাব খান হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে তার পেছন থেকে চেপে ধরেছে। ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি চড় মারতে লাগল নিজের সর্বশক্তি দিয়ে।

ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা টর্চটা কাবির তুলে ধরতেই আলোটা গিয়ে পড়ে ইথিকার মুখে। পা জোড়া থমকে গেল তার। গলার কাছে মনে হলো কিছু একটা আটকে আছে। বুকের উপর মস্তবড় একটা পাথর!

রক্ত, ঘাম আর কষ্টে জর্জরিত ইথিকার মুখ। গলায় দড়ির দাগ। মুখ, চোখ, নাক সব দিক দিয়ে রক্ত নির্গত হচ্ছে। তবুও চোখ দুটো খোলা। প্রাণে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটা এখনো টিকে আছে। কাবির পাথর হয়ে গেছে। কোনো বোধশক্তি নেই। ঠোঁট ফুঁড়ে অস্ফুটস্বরে একটা শব্দ বের হলো। এমন পরিণতি তো সে চায়নি। কিছুতেই চায়নি।

ঘরটা এবার আলোয় ভরে গেল। ইথিকাও তাকে দেখল। হাতটা নড়ে উঠল। গালটা হাঁ করে রইলো।
কাবির চোখের পলকে ছুটে এসে তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরল শক্ত করে। ইথিকার মুখটা তার বুকে স্পর্শ হলো। তার শরীরটা রক্তে ভেজা। জানোয়ারগুলো কি করেছে তার সাথে? কাদিন পায়ের বাঁধন খুলে দিল। কাবির ডাকল,”আনঝিল তাকাও। ”

ইথিকার শরীরটা এতক্ষণ তড়পাচ্ছিল। কাবিরের বুকে ঠাঁই পাওয়ামাত্রই থমকে গেল। দেওয়ানদের কাছে দেয়া তার দেওয়া শেষ পরীক্ষা হয়তো এটাই। কাবির আরও শক্ত করে তাকে বুকের সাথে চেপে ধরল। হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকাল। গর্জে উঠে বলল,

“জানোয়ার! অফিসার এদের এক্ষুণি মৃত্যু দিন। এক্ষুণি।”

সাথে সাথে গুলির শব্দ। একঝটকা রক্ত কাবিরের মুখ বুক ভরে উঠল। তাদের পাশেই মুখ থুবড়ে পড়লো একজন। রক্তের গরম ঘ্রাণে কাবিরের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। আর্যাব খান কাঠের চেয়ার টেনে জোরে বাড়ি দিল লোকটার মাথায়। লোকটার মাথা ফেটে ছিটকে পড়ল কুচকুচে কিছু জিনিস। মগজের চুর্ণ অংশ, রক্ত, হাড়ের টুকরো। কাবির তা দেখে ইথিকাকে বুকে চেপে ধরে ছুটে বেরিয়ে গেল রক্তভেজা ঘরের দরজা পেরিয়ে। কাদিনকে চেঁচিয়ে বলল,”গাড়ির দরজা খোলো। যাও।”

কাদিন ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুললো।

পুলিশ আর লোকগুলোর মধ্যে তখনো ধস্তাধস্তি চলছে। একজন পুলিশ আহত!

ঘর থেকে একজন মারধর খাওয়া স্বত্বেও পালিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে আর্যাব খানের হাত ফস্কে। কাবির আর কাদিন ইথিকাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে।

কল্পনা তাদের দেখে এগিয়ে আসছিল তখুনি লোকটা কল্পনার দিকে ছুটে এল।

কল্পনা বুঝতে পারছিল না কি করবে। ইথিকার অবস্থা দেখে সে হুঁশ হারা। ও মরে টরে যাবে না তো? তাহলে তো সব শেষ। ওরা কেন এমন করলো ভাবির সাথে?

লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখে কল্পনা গাড়ির পাশে চলে গেল দৌড়ে।

তখুনি একটা ধারালো কুড়াল ছুটে এসে লোকটার পিঠে বিঁধলো তখুনি। তাদেরই কুড়াল। আর্যাব খান ছুঁড়ে মেরেছে।

লোকটা কল্পনার সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল। গায়ে কাপড় নেই। একটা প্যান্ট কোনোমতে কোমরের নীচ অব্দি নামানো। আর্যাব খান সেটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে কুড়াল দিয়ে কুপাতে লাগল কল্পনার সামনে। কল্পনা ভকভক করে বমি করতে লাগল গাড়ির অন্যপাশে গিয়ে।

আর্যাব খান লোকটাকে কুপিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারের মধ্যে। চোখের পলকে কি যেন হয়ে গেল।

কল্পনা পায়ে শক্তি ধরে রাখতে না পেরে গাড়ির সাথে লেগে নীচে বসে পড়ল। আশিষ খান আর আরিশ খান অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। রক্তাক্ত লাশটাকে বস্তাবন্দি করে পুলিশদের চোখের আড়ালে নিয়ে চলে গেল কল্পনার চোখের সামনে দিয়ে। কত দক্ষ হাতে কাজটা করলো। মনে হলো তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে এসবে। কল্পনার বুকের ভেতরটা লাফাচ্ছে। কান ভোঁ ভোঁ করছে। ছটফট করতে লাগল সে। এত নৃশংস!

বাকিদেরকে পুলিশের সামনে পিটিয়েছে আর্যাব খান। তারাও চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তড়পাতে তড়পাতে মরবে। নইলে সে অন্যভাবে এদের মারবে।

সিনিয়র অফিসারের পদমর্যাদা থাকায় সে একেবারে নির্বিকারভাবে পিটিয়েছে। তার সামনে কেউ বাধা দেয়ার সাহস করেনি। আইনের নিয়মবিধি তার পায়ের নীচে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। কাল যা হবার হবে। তার ভয় নেই। বালের আইনকে সে ভয় পায় না।

পুলিশ সবাইকে নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করল। আর্যাব খান গাড়িতে উঠে বসলো। হাসপাতালে রওনা দেবে সে। এবার ওই দেওয়ানদের দেখে নেবে। খুন করে ফেলবে সবকটাকে।

তখুনি খেয়াল হলো কল্পনার কথা। মরণটা তার ভাইদের সাথে যেতে পারেনি। গেল কোথায়? একে গলা টিপে মারবে সে। সে তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নামল। ওপাশে ঘুরে যেতেই দেখলো কল্পনা গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে বসা। চেতনা হারিয়েছে। আর্যাব খান গাড়ির ভেতর থেকে পানির বোতল নিয়ে কল্পনার মুখের উপর ঢালতে লাগল।

কল্পনা হুঁশ ফিরে পেয়ে কাঁদতে লাগলো।

“ছাড়ো আমাকে। খুনী।”

আর্যাব খান গর্জে উঠে বলল,

“আরেকটা কথা বললে তোকে খুন করে পুঁতে ফেলব একদম। চল।”

কল্পনা তার দিকে তাকাচ্ছে না। তার ঘেন্না লাগছে রক্ত দেখতে। পেট মোচড় দিচ্ছে। আর্যাব খান তার সামনে বসে পড়লো। কল্পনা বিড়বিড়িয়ে বলল,

“খুনী।”

আর্যাব খান শান্ত গলায় বলল,

“এক থেকে তিন গুণব। তারমধ্যে গাড়িতে উঠে বসো। নইলে ফেলে চলে যাব। কুত্তা ছিঁড়ে খাবে।”

কল্পনা তার কথা শুনলো না। আর্যান খান গর্জে উঠে তার কপালে রিভলবার ঠেকাতেই কল্পনা হু হু করে কেঁদে উঠে বলল,”সরো।”

আর্যাব খান সরে গেল। কল্পনা পায়ে ভর দিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলো। আর্যাব খান শার্ট ছাড়িয়ে বোতলের বাকি পানিটুকু মুখে ঢালল। তারপর শার্টটা দিয়ে মুছে নিল যতটুকু সম্ভব।

তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি বড় সড়কে উঠে যেতেই কল্পনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মাঝপথে গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষল। গাড়ি থামতেই আশিষ খান গাড়িতে উঠে এল। তার হাত থেকে শার্ট নিয়ে আর্যাব খান গায়ে শার্ট জড়াল। নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলে আবারও ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিল। কল্পনা আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। হাসপাতালে আর কোনো ঝামেলা না হোক।

আশিষ খানের ফোন বাজছে। সে ফোন সাথে সাথে রিসিভ করে আর্যাব খানের সামনে রাখল। আর্যাব খান বলল,

“ড্যাড!”

আমিন খান কিছু জানতে চাইল। আর্যাব খান বলল,

“হসপিটালে নিয়ে গেছে। ওদের কারণেই এসব হয়েছে। আমি ওদের ছাড়ব না।”

কল্পনার দিকে ফিরে তাকাল আশিষ খান। বলল,

” একে বাঁচিয়ে রেখেছ কেন? ইথুর কিছু হয়ে গেলে একেও ওইভাবে মারব।”

কল্পনা চুপসে গেল। আর্যাব খান ফোনে মেজাজ চড়িয়ে বলল,

“ওদের মনে হয় পুলিশি হেফাজতে রাখবে। দুজন স্পট ডেথ। একজনকে আশিষের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। সেও অবশিষ্ট নেই। বাকি তিনজন পুলিশের হাতে। মরে গেল তো বেঁচে গেল। যদি বেঁচে ফিরে মুন্ডু কেটে হাতে ধরিয়ে দেব।”

আমিন খান ফোনের ওপাশে গর্জন করছে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কল্পনার ভয় লাগছে। হাসপাতালে নিশ্চয়ই দুই পরিবারের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাবে। গাড়ি দ্রুতবেগে ছুটে চলছে। আর্যাব খান শেষমেশ উত্তপ্ত গলায় উচ্চারণ করল,

“Yes, Attempted Rape!”

___________

হাসপাতালের সামনে পুলিশের গাড়ির সাইরেন, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ, আমিন খানের পরিচিত নানান ব্যক্তিবর্গ, দেওয়ানদের পরিচিত মানুষজন, আত্মীয়স্বজন, ডাক্তার নার্সের ভীড়। গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালে ঢুকে পড়ল আর্যাব খান আর আশিষ খান। কল্পনাও মুখ ঢেকে তাদের পিছুপিছু গাড়ি থেকে নামল। আর্যাব খানকে দেখে সরে দাঁড়াল মানুষজন। তাকে বিধ্বস্ত ভয়ংকর দেখাচ্ছে। কানে রক্ত লেগে আছে। তাকে দেখামাত্র ইলিনা বেগম ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠল,

“ও কি মরে যাবে আর্য? ওর হাত পা কাটা। গলা কাটতে চেয়েছিল। রশি দিয়ে ফাঁস দিতে চেয়েছিল। ওর এই দশা কারা করলো?”

আর্যাব খান মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে চোখ তুলে কাওসার দেওয়ানের দিকে তাকাল। কাওসার দেওয়ান তাকে দেখামাত্রই চোখ সরিয়ে নিল। কে জানে এখন কি শুরু করবে এই হাসপাতালে। ওরা চিরকাল অশান্তির জাত।

ইথিকাকে হাসপাতালের এমারজেন্সি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করানো হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। ডাক্তাররা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। দুই বাড়ির মানুষ, আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাইকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ কথা বলছে। জোসেফ আর তার পরিবারও এসেছে। কাদিনের সাথে কথা বলে জোসেফ কল্পনার দিকে এগিয়ে গেল। তার এরূপ অবস্থা দেখে জানতে চাইল, কি কি হয়েছে। কল্পনা জোসেফকে সবটা খুলে বলতে লাগল। জেসি সবটা শুনে আর্যাব খানের কাছে গেল। আর্যাব খানের সাথে কাদিনের তর্ক বেঁধে গিয়েছে ইতোমধ্যে। কাদিন বলল,

“এর আগেও ভাবি নাইট ক্লাবে একা একা গিয়েছে। এইবারও সে কথাটায় বড় ভাইয়ের মাথায় এসেছে। স্বাভাবিক। তুই হলে তোর মাথায়ও এটাই আসতো।”

আর্যাব খান গর্জে বলল,”কীসের স্বাভাবিক? তোরা ওকে এই ঝড়ের রাতে একা ছাড়লি ভালো কথা। কিন্তু আমাদের জানালিনা কেন? ওর কিচ্ছু হলে তোরা কেউ হাসপাতালের বাইরে পা রাখতে পারবি? একটাকেও জান নিয়ে ফিরতে দেব না।”

কাদিন বলল,”ভয় দেখাচ্ছিস নাকি? তোরাই তো ধর্ষকদের সাথে ওঠাবসা করিস। আগে ওদের শায়েস্তা কর। তোরাই মেয়েদের পেছনে ওসব ধর্ষকদের লেলিয়ে দিস। অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেখানে নিজেদেরই পড়তে হয় এটা বুঝতে শেখ আগে। তোরা এসব ধর্ষকদের টাকা দিয়ে পালিস। অন্যায় কাজে লাগাস। বিপদে পড়লে তখন তোদের মুখে নীতিকথা শোনা যায়। তার আগে না।”

আর্যাব খানকে ধরে রেখেছে ইলিনা বেগম আর আরিশ খান। তাকে উত্তেজিত হতে জেসি তার হাত ধরে রেখে বলল,”প্লিজ তুমি থামো। আগে ইথিকা সুস্থ হোক। তারপর ঝগড়া করো। এখন এসব করার সময় নয়। কান বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। টিস্যু নাও।”

আর্যাব খান টিস্যু নিল তার হাত থেকে। কপাল, কান মুছে টিস্যুটা ছুঁড়ে ফেলতে যাবে তখুনি দেখল কল্পনা একনাগাড়ে কথা বলছে জোসেফের সাথে। হাত নেড়ে নেড়ে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে সবটা খুলে বলছে।

হঠাৎ কথা থেমে গেল তাকে তাকাতে দেখে। কল্পনা জড়োসড়ো হয়ে গেল। এই ভয়ংকর জানোয়ারটার সাথে তার আর কোনো কথাবার্তা নেই। জেসিও কল্পনার দিকে তাকাল আর্যাব খানের চোখ অনুসরণ করে। তারপর ধীরেধীরে আর্যাব খানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কল্প ভাবি তোমার সাথে ছিল?”

আর্যাব খান চোখ সরিয়ে নিল। কিছু বললো না। তার বদনাম গাইছে দেওয়ানি? ওর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে এবার।

জাহানারা বেগম কল্পনাকে বললেন,”তারপর?

কল্পনা একনিশ্বাসে বলল সে কেন আর্যাব খানের সাথে ছিল। তাকে কিভাবে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কারণ তাকে পরিষ্কার থাকতে হবে হবু শ্বাশুড়ির কাছে। শেষে বলল,

“ওই বাড়িটাতে যাওয়ার পর আমার সামনেই লোকটাকে কুপিয়ে মেরে বস্তাবন্দি করে নিয়ে গেছে ওরা। আমার সামনেই। বিশ্বাস করুন আন্টি।”

জেসি এসে বলল,”ঠিকই তো করেছে। তোমার সাথে এমন হলে তোমার ভাইরা চুপ করে থাকবে?”

কল্পনা হাঁপাচ্ছে। জেসিকে বলল,

“না চুপ করে থাকবে না। কিন্তু এভাবে ওরা মানুষকে মারতে পারে আমি ভাবতেও পারছিনা। আমি কি দেখলাম। ওরা খুব ভয়ংকর। খুব। আমি এক্সপ্লেইন করতে পারছিনা কিভাবে মেরেছে আমার সামনে।”

জেসি বলল,”ঠিক কাজ করেছে।”

কল্পনা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,”ওরা খুব ভয়ংকর জেসি। এত অন্ধবিশ্বাস ভালো না। আর্যাব খান একটা সাইকো। ওরা কিভাবে মানুষ মারে। তুমি প্লিজ সরে এসো। তুমি ভালো থাকবে না ওদের কাছে। ওরা এরচেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।”

তার হাত পা তরতর করে কাঁপছে। জোসেফ তাকে ধরে এনে একটা বেঞ্চে বসাল। পানির গ্লাস নিয়ে এসে তার সামনে বসলো। বলল,

“আগে পানিটা খাও। রিল্যাক্স। জেসির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না এখন। শান্ত হও।”

কল্পনা পানির গ্লাস দু-হাতে ধরল। বলল,

“বড়ভাই কোথায়?”

“মেবি ব্লাড কালেক্ট করা নিয়ে বিজি আছে। পানিটা খাও। কিরণ!”

কিরণ সাড়া দিল,”জি জিজু।”

জোসেফ বলল,”তুমি তোমার আপুর পাশে বসো। আমি দেখছি কাবির সাহেব কোনদিকে গেছেন। তোমরা এখানেই থাকো। আমি আসছি।”

কল্পনা গ্লাসে ঠোঁট বসাতে যাবে তার আগেই রক্তভেজা টিস্যুর দলা এসে পড়ল গ্লাসের ভিতর। কল্পনা ভকভক করে বমি করতে লাগল সবার সম্মুখে। জেসি দ্রুত আর্যাব খানের দিকে তাকাল। টিস্যুটা কেন ছুঁড়ে মারলো ও?

কল্পনা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বমি করতে করতে আবারও সেন্সলেস হয়ে পড়েছে ওখানে। জোসেফের বাবা তাকে ইশারা করে কিছু বলল। জোসেফ তাকে কোলে তুলে একটা কেবিনে নিয়ে গেল আর্যাব খানের পাশ কেটে।

__________

ইথিকাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। কারো অপেক্ষা ফুরচ্ছে না। দুই বাড়ির কোন্দলও যেন অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আত্মীয়স্বজনের সামনে কেউ কোন্দলে জড়াতে পারেনি। নইলে খুনাখুনি হাসপাতালে হয়ে যেত।

সকালের দিকে তাহমিনা এসেছে। তাকে দেখামাত্র আসলাম খান কোথাথেকে ছুটে এল।

“আমার বোন মরেছে কিনা দেখতে এসেছ?”

তাহমিনা অবাক হয়ে বলল,”ফালতু কথা বলবেন না একদম। ও আমারও বোন। ওকে আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে দেখতে এসেছি। সবাইকে নিজেদের মতো মনে করবেন না।”

“আমার ছেলে কোথায়?”

“সেটা আপনাকে বলব কেন? সামনে থেকে সরুন।”

আসলাম খানকে ডিঙিয়ে চলে গেল তাহমিনা। কিরণ এদিকে আসছিল। তাহমিনাকে দেখল সে। অবাক কণ্ঠে বলল,

“আপু তুমি?”

তাহমিনা কিরণের সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে গেল। করিডরে জেসি বসেছিল। তাহমিনা তাকে দেখে বলল,

“আমার মেঝ জাও এখানে আছে দেখছি। কবে এলে?”

জেসি বলল,

“ভোররাতে বাড়ি গিয়েছিলাম। এইতো কিছুক্ষণ আগেই এলাম।”

“ইথিকার অবস্থা এখন কেমন?”

“ডাক্তার সন্তোষজনক কিছু জানাননি।”

তাহমিনা ইথিকাকে একপলক দেখতে চাইল। এত মানুষ দেখার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু ডাক্তার তার হাজবেন্ড আর বাবা মা ছাড়া কাউকে এলাউ করছেনা আপাতত।

কল্পনাকে বাড়ি নিয়ে গেছেন লুবনা বেগম। সেও একটা ট্রমার ভেতর আছে। জন্মের পর থেকে দুই বাড়ির কোন্দল দেখলেও সামনাসামনি অমন বীভৎস দৃশ্য সে জন্মের পর দেখেনি।

সারাদিন দুই বাড়ির মানুষ আর আত্মীয়দের ভিড়ে হাসপাতালটা মুখরিত ছিল। সন্ধ্যা নামতেই সব শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এলো। সেই নীরবতার ভেতর কাবির চুপচাপ এসে ইথিকার শয্যার পাশে বসলো।

ইথিকার মুখে, গলায়, হাত-পায়ে একের পর এক ক্ষতচিহ্ন। শরীরজুড়ে ব্যান্ডেজের সব সাদা পট্টি।
চোখদুটো বন্ধ, নিথর। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে বহুদিনের ক্লান্তিতে।

কাবির ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন শাস্তি সে কখনো দিতে চায়নি আনঝিলকে। সে শুধু চেয়েছে তার অন্তর কলুষিত মুক্ত হোক। কোনো ছলনা না থাকুক। কিন্তু এটা কি হলো? তাকে এত অনুতাপের মধ্যে ডুবিয়ে ও এভাবে শুয়ে থাকতে পারেনা। সে জীবনে এতটাও পাপ করেনি যে এতবড় অনুতাপ, অনুশোচনার বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। আনঝিলকে উঠতে হবে। সুস্থ হতে হবে। জীবনকে সুযোগ দিতে হয়। আনঝিলকেও দিতে হবে।

সে ধীরেসুস্থে ইথিকার হাতটা আলতোভাবে ধরল। তারপর ইথিকার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“তুমি বলেছিলে এই জনমে আমাকে আর ছাড়ছো না। তাহলে এখন ছেড়ে যাবার এত আয়োজন কেন? তুমি অভিযোগের পাহাড় নিয়ে এসো। তবু ফিরে এসো। আমরা আবার ভাঙবো, আবার গড়বো। তুমি ফিরে এলে এবার তোমার হাতটা আমি শক্ত করে ধরবো। প্রমিজ।”

___________

দেওয়ান বাড়িতে জোসেফের মা বাবা এসেছে। তারা এই শহরে এসেছে মাস তিনেক হচ্ছে। আগে তারা অন্য শহরে ছিল। এখানেও আছে বছর তিনেকের মতো। ইথিকা লাইফ সাপোর্টে আজ চার দিনের মতো পড়ে আছে। কোনো উন্নতি নেই। উন্নতি আছে কিন্তু কাবিরের মনে হচ্ছে না সেটা কোনো উন্নতির পর্যায়ে পড়ে। আনঝিল যেদিন চোখ খুলবে সেদিন সে বিশ্বাস করবে।

কাবির হাসপাতাল থেকে জোসেফের মা বাবাকে নিয়ে এসেছে। দুপুর তারা বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করবে। জেসিকে আসতে বলেছিল। কল্পনার সাথে তার দ্বন্দ্ব চলছে। তাই আসতে চায়নি।

কাবির নিজেই বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকেনি। বেরিয়ে গিয়েছে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার সময় খাবার টেবিলে বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলো। জাহানারা বেগম বললেন,

“আপনাদের বাড়ির বউ সুস্থ হোক। তারপর বাকি কথা।”

লুবনা বেগম জানতে চাইলেন,

“মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দিবেন মনে হচ্ছে।”

জাহানারা বেগম বললেন,

“হ্যাঁ মেয়ের পছন্দের পাত্র আছে। আপনাদের আত্মীয় হয় তা তো জানেনই।”

দীর্ঘদিনের শত্রুতা আর পরিচিত বলে কাওসার দেওয়ান কিছু লুকোলেন না। জাহানারা বেগমকে বললেন,

“আমার ভাইজানকে তো জোসেফই উদ্ধার করেছে আর্যাব খানের হাত থেকে। বন্দী করে রেখেছিল নিজেদের ডেরায়। এদিকে আমাদের বলছিল তারা কিছু জানেনা। কতবড় মিথ্যেবাদী দেখুন। সবটার মূলহোতা ছিল ওই আর্যাব খান। জেনেশুনে মেয়েকে অমন ছেলের হাতে তুলে দেবেন না। ওর ভবিষ্যতের প্রশ্ন। ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি।”

জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”তা তো জানি। কিন্তু মেয়েটার সাথে ওই ছেলের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। জেসির ওই বাড়িতে যাতায়াতও ছিল। ইলিনা হকের নাচের স্কুল থেকে যাতায়াতটা বেড়েছে। এখন মেয়েটাকে কিভাবে বোঝাই?”

“ওকে বোঝান। বিয়ের পর তো আর কিছু করা যাবে না। ওদের বাড়ির বড় বউটাকে দেখুন। এত নির্যাতিত হয়েছে যে এখন আর ফিরতেই চায় না। দেখুন একটা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার আগে দশবার যাচাই বাছাই করা জরুরি। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা নয়।”

জাহানারা বেগম মাথা দুলিয়ে বললেন,”তা ঠিক।”

কিরণ খাবার দাবার বেড়ে দিতে লাগলো। জাহানারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“কল্প কোথায় কিরণ?”

কিরণ বলল,”ঘুমোচ্ছে।”

“আমরা আছি। আর ও এখনো ঘুমোচ্ছে?”

লুবনা বেগম কাষ্ঠ হেসে বলল,”শরীর অসুস্থ তো।”

জাহানারা বেগম চুপ করে রইলেন। কিরণ সবাইকে খাবার দাবার বেড়ে দিয়ে কল্পনার কাছে চলে এল। তাকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বলল,

“এই আপু ওঠো। তোমার শ্বাশুড়ি তোমাকে খুঁজছে।”

কল্পনা তার ডাকাডাকিতে উঠলো। নীচে গিয়ে জাহানারা বেগম আর হবু শ্বশুরের পাতে তরিতরকারি তুলে দিল। জাহানারা বেগম জানতে চাইলেন,

“আর্যর বিপক্ষে তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কল্প?”

কল্পনা হকচকিয়ে গেল। লুবনা বেগমের দিকে তাকাল। তারপর মৃদুস্বরে বলল,

“আপনার ছেলেই তো আমার বাবাকে উদ্ধার করেছে। আরও প্রমাণ লাগবে?”

“জেসিকে তো দেখাতে হবে। মেয়েটা কথা শুনতে চাইছেনা। ও বলছে পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই। আর্যও নিখুঁত নয়। আর্য ওসব করেছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে।”

কল্পনা বলল, জেসিকে বুঝতে হবে আন্টি। ও এখন একটা ফ্যান্টাসির মধ্যে আছে। যখন এটা থেকে বেরিয়ে আসবে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যাবে।”

জাহানারা বেগম ভাতের মধ্যে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন,”তুমি কষ্ট করে কিছু একটা যোগাড় করো যেটা দেখে জেসি বুঝতে পারবে আর্য ওর জন্য সঠিক নয়। মেয়েটাকে আমি বোঝাতে পারছিনা। তুমি পারবে কিছু একটা যোগাড় করতে মানে কোনো প্রমাণ?”

কল্পনা চিন্তায় পড়ে গেল।

চলমান….

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

রাত নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশে তারা নেই, শুধু অন্ধকার। হালকা বাতাসে ল্যাম্পপোস্টের আলো দুলছে। রাস্তার পাশে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার ছাদে শুয়ে আছে আর্যাব খান। চোখে ভাবলেশহীন স্থিরতা।

জেসি একটু থেমে নিজের গলা শান্ত রেখে বলল,
“তুমি মা আর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে যে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণেই এসব করেছ।”

আর্যাব খান ধীরে চোখ তুলল। তারপর নিঃশব্দে গা ঝাঁকিয়ে গাড়ির ছাদ থেকে নেমে এল। পায়ের নীচে সিগারেটটা চেপে নিভিয়ে দিয়ে বলল,

“তুমি আমাকে চেনো কতদিন ধরে?”

জেসি একটু থতমত খেয়ে বলল,
“কেন… দেড় বছর?”

“দেড় বছর ধরে চেনো। পরিচয় হয়েছে আট মাস আগে। আর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে চার মাস ধরে।”

“তবু তো এটা কম সময় নয়।”

“তোমার কাছে নয়। কিন্তু আমার কাছে কম। খান আর দেওয়ানদের এই দ্বন্দ্ব অনেক বছর ধরে চলছে। তুমি অল্প ক’টা মাসে এসেই সব বুঝে যাবে না। তোমার পক্ষে সম্ভব না। তোমার হলে থাকো, না হলে চলে যাও।”

জেসির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
“তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?”

আর্যাব খান চোখ নামিয়ে ফেলল। নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“ফিরিয়ে দিচ্ছি না। শুধু বলছি আমি কারো সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলব না। আর্যাব খান কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।”

জেসি অনুরোধের সুরে বলল,
“শুধু মা-বাবার সামনে বলবে।”

আর্যাব খান চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল,
“পারব না।”

“কেন পারবে না? তাহলে আমাদের বিয়েটা হবে না। মা-বাবা তোমার হাতে আমাকে তুলে দেবে না কখনো।”

আর্যাব খান দাঁতে দাঁত চেপে ঠান্ডা স্বরে বলল,
“ওদের বাপ দেবে।”

জেসির ধৈর্য ভেঙে গেল। সে রাগে, কষ্টে জবাব দিল,

“ভাইয়া এখন আমার সঙ্গে কথাই বলে না। এক কথায় জানিয়ে দিয়েছে তোমাকে বিয়ে করলে আমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবে। মা, বাবা, ভাবি তাদের সাথেও আমাকে সম্পর্ক রাখতে দেবে না। আমি একা হয়ে যাব আর্য।”

আর্যাব খান বলল,
“সম্পর্ক রেখো না। ব্যস। আমি আছি না?
আমি একাই যথেষ্ট।”

জেসি নিজের রাগ সামলে নিয়ে বলল,

“আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো আর্য।”

আর্যাব খান তার গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,”ডার্লিং আমার সাথে পথ চলতে কষ্ট আছে। আমি খান বংশের দুই নম্বরী ছেলে। দুই নম্বর কাজ করে পেট চালাই। তোমার হলে থাকো। না হলে অন্য কাউকে খুঁজে নাও। আমার সাথে আর দশজনের মতো সংসার করার কথা ভাবলে সমস্যা। বিরাট সমস্যা। কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বয়ে যাবে। কিন্তু কূল পাবে না।”

“এভাবে কি জীবন চলে আর্য?”

“দিব্যি চলছে। বিন্দাস আছি। শোনো জীবনে এত প্যারা নিয়ে বেঁচে লাভ নেই। যা মনে নয় তাই করো। বাঁচবে কতদিন?”

জেসির চোখে জল জমছে। সে জেদ দেখিয়ে বলল,

“তোমার মা ঠিকই বলে। তুমি আমাকে জাস্ট সবার সামনে শো করার জন্য নিজের পাশে রেখেছ। আমার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই তোমার।”

“মেয়েমানুষের প্রতি আমার ফিলিংস আসেনা। আমার সব ফিলিংস মানিব্যাগে বন্দী।”

জেসি আঙুল উঁচিয়ে বলল,

“ভাবি ঠিকই বলে। তোমার সাথে বিয়ে হলে আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে যাবে।”

“সেটা তোমার ভাবির কথা নয় আমার কথা ডার্লিং। তোমার ভাবি তো মুখস্থ করে বলে দিয়েছে। আমি তোমাকে বলছি। আমাকে বিয়ে করলে জীবন জাহান্নাম। তুমি তো এসব জেনেই বিয়ে করতে রাজী হলে। এখন দুই নম্বরী কথা বলছ কেন?”

জেসি বলল,”এখন যেভাবে আছ। সারাজীবন এভাবে থাকবে?”

“মানুষ পরিবর্তন হয় কষ্টে থাকলে। আমি তো বিন্দাস আছি।”

জেসি তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলল,

“আমাকে সাফ সাফ একটা কথা জানিয়ে দাও।”

আর্যাব খান তার মুখের দিকে তাকাল।

“যদি এটাই শেষদিন হয় তোমার আমার তাহলে একটা কেন। হাজারটা সাফ সাফ কথা আমি অনর্গল বলে দিতে পারি।”

জেসি বলল,”তুমি আমায় ভালোবাসো কি বাসো না।”

“না তোমাকে ভালোটালো বাসিনা। কিন্তু যেতেও দেব না।”

“ভালো না বাসলে আমি তোমার সাথে থাকবো কেন?”

“আমি রাখব তাই থাকবে। আমি দেখতে চাই তোমাকে কে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়। তুমি না চাইলে তোমাকে কে নিয়ে যাবে। অত সাধ্যি কার বলো ডার্লিং।”

জেসির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। সে চেঁচিয়ে বলল,

“তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আবার নিজের কাছেও রেখে দেবে এসব কেমন কথা?”

“এসব দুই নম্বরী কথা। ভালোবাসা ছাড়া দিব্যি সংসার হয়। বাচ্চা হয়। আসলাম খান এন্ড মিসেস তাহমিনা খানম তার উদাহরণ।”

“তুমি আমার সাথে এখনো মজা করে যাচ্ছ আর্য।”

“তুমি আমাকে মাঝরাস্তায় এসব বলার জন্য দাঁড় করিয়েছ?”

“আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিলে তোমার আপত্তি থাকবে না?”

“অফকোর্স থাকবে। চল্লিশ দিন পর্যন্ত নিয়ম করে কান্না করবো। তারপর অন্য কাউকে পেলে পটিয়ে নেব। একটা মেয়েমানুষ পাশে দরকার। দেখতে সুন্দর লাগে। ভালোবাসা টালোবাসা জরুরি না।”

জেসির ঠোঁট কাঁপল রাগে, কষ্টে, অভিমানে। সে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আর্যাব খানের ফোনটা বেজে উঠল। এক ঝলক স্ক্রিনে তাকিয়েই সে রিসিভ করল। গলার স্বর নিচু, কিন্তু তাড়াহুড়া স্পষ্ট।

“ওকে… আমি আসছি।”

ফোন কেটে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইঞ্জিনের শব্দ বেজে উঠল। জেসি হকচকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“কোথায় যাচ্ছ?”

গাড়ির দরজা খুলে আর্যাব খান পেছনে না তাকিয়ে বলল,”হাসপাতালে যাচ্ছি।পরে কথা হবে।”

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল। তারপর চোখের পলকে আর্যাব খান গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। জেসি কিছুদূর গেল তাকে ডেকে ডেকে। রাগে দুঃখে তার ইচ্ছে করছে গাড়ির রাস্তায় জান দিয়ে দিতে। ঠিক তখুনি পেছন থেকে একটা গাড়ি রীতিমতো হর্ন বাজিয়ে চলেছে। জেসি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। গাড়িতে বসা লোকটা জানালা দিয়ে গলা বের করে হাত দিয়ে ইশারা করল।

“সরুন।”

জেসি কপাল কুঁচকে তাকাল। নড়লো না একটুও।
কাদিন গাড়ি থেকে নেমে এসে গজগজ করতে করতে বলল,

“সমস্যা কি? মাঝরাস্তায় দৌড়াচ্ছেন কেন? মাথা খারাপ নাকি?”

জেসি তাকে চেনামাত্রই বলে উঠল,

“আপনি আমার সাথে এভাবে ব্যবহার করছেন কেন?”

“তো কিভাবে ব্যবহার করবো?”

“আমি আপনাদের কুটুম হই।”

“তা জানি। এভাবে মাঝরাস্তায় দৌড়ালে কুটুম বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। মানুষ তো পাগল বলছে আপনাকে।”

“আমি পাগল? কীসের ভিত্তিতে পাগল বললেন? আপনাকে দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না। অথচ এখন বকরবকর করছেন।”

কাদিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

“সরি আপনি পাগল নন। আপনি একটা ছ্যাঁচড়া।”

শেষের কথাটা ছোট করে বলল কাদিন। জেসি চেঁচিয়ে বলল,”কি বললেন?”

“কিচ্ছু না। যার গাড়ির পেছনে ছুটছিলেন এক্সিডেন্টে হলে কিন্তু সে সবার আগে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে। তাই সাবধানে থাকুন।”

কাদিন গাড়িতে উঠে বসলো। জেসি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বলল,

“আপনি আমাকে ছ্যাঁচড়া বললেন?”

কাদিন বিরক্ত হয়ে বলল,”শুনুন আমাকে ইমার্জেন্সি হসপিটাল যেতে হচ্ছে। আপনার সাথে বাজে কথা বলার সময় নেই।”

জেসি উৎকণ্ঠিত গলায় বলল,”হসপিটালে কেন? কি হয়েছে?”

কাদিন মৃদুস্বরে বলল,”ভাবির জ্ঞান ফিরেছে।”

জেসি বলল,”আমিও যাব।”

কাদিন সোজাসাপটা বলল,”দুঃখীত।”

জেসি এবার রেগে গিয়ে বলল,”আমি ছ্যাঁচড়া হলে আপনিও গায়েপড়া। গায়েপড়ে ঝগড়া করছেন আমার সাথে।”

কাদিন বিরক্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,”আরেহ যান তো। ফালতু। পাঁচ মিনিট নষ্ট হলো।”

_________

হাসপাতালে আবারও দুই পরিবারের মানুষ আর স্বজনরা ভর্তি হয়ে গেছে। খানরা বলে দিয়েছে ইথিকাকে দেওয়ান বাড়ির কেউ দেখতে পারবে না কাবির ছাড়া। অন্য কাউকে তারা এলাউ করবে না। ইলিনা বেগম খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছেন। ডাক্তাররা জানিয়েছেন সে বিপদমুক্ত। কিন্তু অনেকদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে তাকে। খুব যত্নে রাখতে হবে। মানসিক চাপ তৈরি করা যাবে না। ইলিনা বেগম তাকে চোখ খুলতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বললেন,

“আমার একমাত্র মেয়েটার উপর কেন এত বিপদ আসে?”

আমিন খান তাকে আটকে ধরে রেখেছেন। ইলিনা বেগম কেঁদে চলেছেন। আজ মেয়ে বিপদমুক্ত তবুও তিনি কান্না থামাতে পারছেনা।

লুবনা বেগমের শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কিরণ আর কল্পনা উনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে কাবিরের কথামতো।

খানরা সবাই খুশি। তাদের বোন বিপদমুক্ত নয় বলে সবাই এতদিন চুপ করে ছিল। এবার দেওয়ানদের উচিত শিক্ষা দেয়ার পালা।

কল্পনা লুবনা বেগমকে কিরণের হাতে তুলে দিয়ে জোসেফের ফোনে কল দিল এটা জানাতে যে সে এসেছে। কিরণকে বলল,

“ছোটমাকে নিয়ে যা তুই। জোসেফ কোথায় দেখি।”

কিরণ বলল,”আপু বেশিদূরে যেওনা।”

“আচ্ছা। ছোট মা তুমি কিরণের সাথে যাও।”

“বেশিদূরে যাস না মা।”

“ভাইয়ারা আছে। চিন্তা করো না। জোসেফও এসেছে।”

লুবনা বেগম একটু স্বস্তি পেলেন।

চারপাশে দেওয়ান আর খানদের পরিচিত মানুষজন। কল্পনা যাদের চেনে তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে জোসেফকে কল দিয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল।

হঠাৎই ভীড়ের মধ্যেই পা বাড়িয়ে দিল আশিষ খান। ঠোঁটের কোণে ধরা না পড়া বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে এককোণায় দাঁড়িয়ে রইল আর্যাব খান।

কল্পনার এক মুহূর্তের অগোচরে ভারসাম্য হারিয়ে শরীরটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ফোনটা হাত ছুটে ছিটকে গেল দূরে।

“আহারে! মেয়েটা পড়ে গেল!” ছুটে এলো কয়েকজন মহিলা। ঘিরে ধরল কল্পনাকে। কেউ মাথায় হাত রাখল। জিজ্ঞেস করল, “ব্যথা পেয়েছ?”

সেই ফাঁকে আশিষ খান এগিয়ে এসে একটা লাথি মারল ছিটকে পড়া ফোনটায়।

ফোনটা বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে গিয়ে থামল আরিশ খানের পায়ের কাছে। ঝুঁকে ফোনটা কুড়িয়ে নিল সে।

তারপর আর্যাব খানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত বদল করে নিল। তারপর তিনজন তিন জায়গায়। কারো দেখাসাক্ষাৎ নেই আর।

কল্পনাকে টেনে তুলল কয়েকজন মহিলা। একজন তার কাপড়ের ধুলো ঝাড়ল। বলল, “সাবধানে হাঁটা উচিত ছিল।”

কল্পনা হাতের তালু আর কুর্তির ভাঁজ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলে ফ্যাকাসে মুখে বলল,
“আমার ফোন!”

ঠিক তখনই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো কাসেদ। চোখে ভ্রুকুটি,

“কিরে হোঁচট খেলি নাকি?”

পাশ থেকে কাদিনও এসে দাঁড়াল।

“সাবধানে হাঁটবি না? এত ভিড় এখানে।”

কল্পনা ওদের কথা শুনেও অন্য কোথাও তাকিয়ে আছে। চোখের চাহনিতে সন্দেহ। সে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল আশপাশটা।

“ফোনটা কোথায় পড়ল?”

সঙ্গে সঙ্গে সবাই খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু ফল শূন্য। কাসেদ বলল,

“ফোনে কল দে দেখি।”

কল্পনা দ্রুত কাদিনের ফোন থেকে নিজের নম্বরে কল দিল। কয়েক রিং যাওয়ার পরই একটানা শব্দ ভেসে এলো,

“The number you are trying to reach is currently switched off.”

চারপাশের কোলাহলের মধ্যেও যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর কল্পনার বুকের ভেতর একটা ধাক্কা দিল। ফোনটা কেউ হাতিয়ে নিয়েছে? এত অল্প সময়ের মধ্যে? সে চারপাশে চোখ বুলালো। তন্নতন্ন করে ফোনটা খুঁজতে লাগলো। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করল,

“আমার ফোনটা কেউ দেখেছেন? এখানেই তো পড়েছিল… কেউ কি দেখেছেন? সাদা কেইস। স্ক্রীনে ফাটল। কেউ দেখেছেন?”

সবাই মাথা নাড়ল। একজন বলল, “এত ভিড়ে খোয়া গেলে পাওয়া মুশকিল মেয়ে।”

কল্পনা তারপরও তার ফোনটা খুুঁজতে লাগল। কাদিন আর কাসেদও খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক কোণে। একটা স্তম্ভের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর্যাব খান। ছায়ার মতো ঠাঁই, কিন্তু চাহনিতে নিখাদ কটাক্ষ।

তাকে লক্ষ্য করতেই ঠোঁটের কোণে টেনে তুলল একটুখানি বদমায়েশি হাসি। তারপর ঠোঁট কামড়ে ফেলল। মনে হলো সে একটা চাপা আনন্দ পাচ্ছে এসব করে।

হঠাৎ কল্পনার চোখে পড়ল তার হাতে ধরা ফোনটি। তার হারিয়ে যাওয়া ফোন!

কান ঘেঁষে ধরে কথা বলছে কারও সঙ্গে। আর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে কল্পনার দিকেই।

এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল কল্পনা। বুকটা ধক করে উঠল। গলার ভেতর শুকিয়ে এলো। কার সাথে কথা বলছে তার ফোন থেকে?

সে এক দৌড়ে ছুটে গেল কাদিনের কাছে। দম না নিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ভাইয়া আমার ফোনটা আর্যাব খানের কাছে! ওরাই কুড়িয়ে পেয়েছে। ওরা আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।”

কাদিন বলল, “দাঁড়া আমি যাচ্ছি।”

কল্পনার বুক ঢিপঢিপ করছে। যদি জোসেফ ফোনটা তুলে ফেলে?

সে কাদিনকে টেনে ধরল, “ভাইয়া আমার ফোনটা… প্লিজ…”

কাদিন তখনই কাসেদকে ডাকল, “এই কাসেদ! এদিকে আয় তো।”

কাসেদ এগিয়ে এসে বলল, “কী হয়েছে?”

কাদিন গম্ভীর গলায় বলল, “ওর ফোনটা আর্য কুড়িয়ে পেয়েছে। গিয়ে নিয়ে আয়, কথা কম বলবি।”

কাসেদ তাড়াতাড়ি চলে গেল। কল্পনার চোখেমুখে অস্থিরতা। মিনিটখানেক পর কাসেদ ফিরে এল, মুখ গম্ভীর।

“ওরা তো বলছে ফোন পায়নি। অস্বীকার করছে।”

কল্পনা রেগে লাল হয়ে উঠে বলল, “মিথ্যে বলছে! আমি স্পষ্ট দেখেছি। আমার ফোনে থেকে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল!”

কাসেদ রেগে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য! ওরা অস্বীকার করছে সেখানে আমার আর কী করার আছে?”

কাদিন ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আচ্ছা তুই থাক। আমি দেখছি কী করা যায়।”

সে চুপচাপ হেঁটে গেল। কয়েক মিনিট পরে ফিরে এল। হাতে কল্পনার ফোন। কল্পনার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে। বাঁদরামি করতে করতে ওরা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিই!”

কল্পনা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। ফিসফিস করে বলল, “ধন্যবাদ ভাইয়া।”

তখনই দেখা গেল জোসেফ আর তার মা–বাবাকে। কল্পনা ওদের দেখে হালকা হাসল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সালাম করল, কুশল বিনিময় করল। জোসেফের দিকে তাকিয়ে একটুআধটু হাসল। বলল,
“ভাবি এইমাত্র চোখ মেলেছে। আপাতত বিপদমুক্ত। বড় ভাই ভেতরেই আছেন। আপনারা ভেতরে চলুন।”

জোসেফ শান্ত গলায় বলল, “মা আর বাবা যাক। তুমি একটু দাঁড়াও। কথা আছে।”

কল্পনা একটু থমকে বলল, “তাহলে কিরণকে ডেকে পাঠাই?”

জোসেফ মাথা নাড়িয়ে বলল, “দরকার নেই। মা–বাবা একাই যেতে পারবে।”

ঠিক তখনই হঠাৎ আর্যাব খান এসে হাজির। জোসেফের মা বাবাকে সালাম দিয়ে ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি টেনে বলল,

“দেওয়ানি তোমার ফোনের কভারের নিচে যে এক হাজার টাকার নোটটা রেখেছিলাম, সেটা দাও তো।”

কল্পনার চোখ জ্বলে উঠল। সে দাঁতে দাঁত চেপে কথা আটকে রাখল। জোসেফ আর তার মা পাশে দাঁড়িয়ে। কিছু বললেও পরিস্থিতি বিপক্ষে চলে যাবে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“কোনো টাকা নেই আমার কাছে। তোমার টাকা আমি রাখব কেন?”

আর্যাব হেসে বলল, “আরে মশকরা কোরো না। টাকাটা দাও। দরকার ছিল রাখলাম। এখন ফেরত দাও। তুমি নিজেই কভারের নীচে রেখেছ।”

কল্পনা মুখ শক্ত করে ফোনের কভার খুলল। সত্যিই এক হাজার টাকার ভাঁজ করা নোটটা বেরিয়ে এল!

সে একটু অবাক হওয়ার সুযোগও পেল না। তার আগেই নোটটা কেড়ে নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে হাঁটতে লাগল আর্যাব খান। মাঝপথে থেমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার কাছ থেকে কিন্তু এখনও পঞ্চাশ টাকা পাওনা রয়ে গেছে। মনে আছে? সেদিন ফুচকা খেয়েছিলে আমার টাকায়। শোধ না করলে কিন্তু বদহজম হবে।”

বলেই হাসল। কল্পনা শুধু তাকিয়ে রইল। চোখে চেপে রাখা অপমানের আগুন, ঠোঁট সোজা রেখেও কাঁপছে। জোসেফ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কল্পনার ভেতরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সে জোসেফের চোখের দিকে তাকাল। তারপর রাগে দুঃখে তেড়ে আসা কান্নাদের ঢোক গিলে ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলল,

“আর্যাব খান তোমাকে আমি…

__________

ইথিকা ধীরে ধীরে চোখ মেলেছে। মা বাবাকে দেখেছে। তারপর কাবিরকে। কাবিরের দিকে চোখ রাখার পর সময় নিয়েই চোখ সরিয়েছে। এই অল্প দিনে আগের ইথিকার অবশিষ্ট কিছু নেই। শরীর শুকিয়ে এতটুকুনি হয়ে গেছে।

ইলিনা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“আর কোনো ভয় নেই মা। এবার তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা তোমাকে অনেকদূরে নিয়ে যাব। তোমাকে আমরা আর একা ছাড়ব না এবার।”

ইথিকা নির্বাক। স্থির, পাথরের মতো শুয়ে আছে। কথা নেই, সাড়া নেই, মাঝেমধ্যে পলক পড়ছে দু একবার। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে চৌচির।

আমিন খান কি মনে করে ইলিনা বেগমকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

তারা বেরিয়ে যেতেই নার্স আর ডাক্তাররাও একটু হালকা করে দিলেন কেবিনটা। ইথিকা এখনো সোজা তাকিয়ে আছে। কাবির তার শয্যার পাশে এসে বসল নিঃশব্দে। ইথিকার চোখের পাতা পড়ছেনা এবার। কাবির গলা পরিষ্কার করে ডাকল,

“আনঝিল!”

ইথিকার নড়চড় নেই। কাবির ধীরেসুস্থে তার হাত ধরলো। ইথিকার শরীর একটু কেঁপে উঠল। কাবির তার মুখের দিকে তাকাল। বলল,

“তুমি ওদের বলে দেবে তুমি কোথাও যাবে না। তোমার সাথে আমার অনেক হিসেবনিকেশ বাকি। আমি তোমার পাওনাদার হয়ে থাকতে চাই না। আমাকে ঋণমুক্ত করে তবেই যেতে পারবে।”

ইথিকা এখনো সোজা শুয়ে আছে রোবটের মতো। এদিকে তার চোখের চোখের কোণা বেয়ে জল গড়াতে গড়াতে কান ছুঁয়ে গেছে ততক্ষণে। কাবির চোখের জল মুছে দিতেই ইথিকার ভেতর থেকেই।একটা কান্নার সুর উথলে উঠে আবারও ভেতরে ঢুকে গেল। গলার কাছে আটকে থাকলো। কাবির বলল,

“আমার সামনে তুমি কাঁদতে পারবে।”

ইথিকার চোখের জল অবিরত পড়তে লাগলো।

চলমান..