মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
1

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ইথিকাকে আজই হাসপাতাল থেকে ছাড় দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগের রাতেই কাবিরের অনুপস্থিতির সুযোগে খান পরিবার চুপিচুপি তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সকালে যখন কাবির হাসপাতালে পৌঁছাল তখন সে দেখল ইথিকার বেড ফাঁকা। কোণায় রাখা বড় একটা ব্যাগ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে কেউ রেখে গেছে। ব্যাগটা খুলতেই তার চোখে পড়ল পরিচিত ইথিকার ব্যবহৃত তোয়ালে, আধভরা পানির বোতল, কিছু সুতির কাপড়, আরাম দিতে ব্যবহার করা হিটব্যাগ আরও অন্যান্য জিনিস।

অবশ্য কথা ছিল না ইথিকাকে তারা দেওয়ান বাড়ি পাঠাবে। কিন্তু তবুও কাবির চেয়েছিল সে ইথিকাকে দেওয়ান বাড়িতেই নিয়ে আসবে। আর খানরা সেসব মানতে বাধ্য। কারণ হাজারবার জঘন্য অপরাধ করা স্বত্বেও খানরা তাদের সুযোগ দিয়েছে সেখানে তারাও একটা সুযোগ অনায়াসেই পেতে পারে।

কিন্তু তাদের এমন চালাকি দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। কাদিনও এসেছিল সাথে। সে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারল,

“রাত দেড়টার দিকে তারা হাসপাতাল ছেড়েছে।”

কাবির সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালো। আসলাম খান, ইলিনা বেগম কেউ ফোন ধরলো না। আমিনও খানও না। শেষে বাধ্য হয়ে আর্যাব খানকে ফোন করলো। আর্যাব খান ফোন রিসিভ করে সাথে সাথে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম জামাই সাব।”

কাবির রাগে সালামের জবাব দিল না। বলল,

“আনঝিল কোথায়?”

“ঘুম।”

“ওকে নিয়ে গেছিস আমাকে জানালি না কেন?”

“সত্যি বলব নাকি মিথ্যে বলব?”

“যেটা বললে তোর কান বরাবর চড় পড়বে না।”

আর্যাব খান হাসলো।

“একবার দেওয়ান বাড়ি গিয়ে দু দুটো চড় খেয়ে ভালো ছেলের মতো ফিরে এসেছিলাম। চড়টা তোলা রেখেছি খুব যত্ন করে। কেউ রেগে হোক আদর করে। গাল ছুঁয়ে দিলেই আমি সেটা যত্ন করে তুলে রাখি।”

বলেই হাসতে লাগল অভদ্রের মতো। কাবির অনর্থক কথাগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বলল,

“আমি আনঝিলকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসব।”

“না না সেটা না করে বরঞ্চ তুমি তল্পিতল্পা গুছিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে আসো। সমস্যা নেই। তুমি বললে আমি আশিষ আরিশ আর বড় ভাই মিলে তোমাকে আনতে যাব। খান বাড়ির জামাই বলে কথা।”

কাবির টোটালি নিজের রাগ সামলাতে পারছেনা। আর্যাব খানের ভাগ্য ভালো সে এমন রসিকতা কাবিরের সামনে দাঁড়িয়ে করার দুঃসাহস দেখায়নি। কাবির নিজের কথায় অটল থাকলো। গলার স্বরেও তার ভেতরে গনগন করে জ্বলতে থাকা রাগ আঁচের একফোঁটাও টের পাচ্ছে না।
সে শান্ত গলায় বলল,

“আমি যাব কিন্তু আনঝিলকে নিয়ে তবেই ফিরবো। তোরা আমাদের সাথে যা করেছিস তা ভুলে যাবিনা। জোসেফের বদলে তুই একটা খুনীকে নিয়োগ করলে জেঠা আজকে আর আমাদের মাঝে থাকতো না। তারপরও তোরা সুযোগ পেয়েছিস। নিজেদের পূর্বের সব কাজকে স্মরণ করবি তারপর দেওয়ানদের সামনে ভালো সাজতে আসবি। আর একটা কথা। আমি যাব আর আনঝিলকে নিয়ে ফিরব। তোর বাপও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি আমার কথা থেকে সরবো না। খবরদার আনঝিলকে কোথাও সরানোর চেষ্টা করবি না।”

আর্যাব খান কাবিরের শক্ত শক্ত কথাগুলো সইতে না পেরে ফোন কেটে দিল। ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মারতে যেয়েও আবারও থেমে গেল। রাগ তার ফোন নষ্ট করবে। তার পকেটের মাল গচ্ছা যাবে। এত লস আর্যাব খান মানবে কেন?

সে ফোনটা পকেটে পুরে থানা থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো।

________________

জোসেফ কফিশপে এসেছে জেসিকে নিয়ে। কল্পনার আসার কথা। সে জেসি আর কল্পনাকে সামনাসামনি বসিয়ে সব ঠিকঠাক করে নিতে চায়। কল্পনার ফোনটাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সাউন্ডে সমস্যা।

ওইদিন তার হাত থেকে ফোনটা পড়ার পর থেকে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জোসেফ তাকে একটা ফোন দিতে চেয়েছিল। কল্পনা বিয়ের পর নেবে বলেছে। এখন আপাতত চলছে।

কিছুক্ষণ পর একটা কল এল। জোসেফ কল রিসিভ করে কানে দিতেই মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায়?”

কল্পনা বলল,”রিকশায়। কিরণের ফোন থেকে দিলাম। আমার ফোনটা গেল। কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। আর পাঁচ মিনিট।”

“ওকে।”

কল্পনা ফোন রেখে দিল। কিরণ বলল,

“বড় ভাই খান বাড়িতে গেছে। আমার ভয় করছে। ওরা সারাক্ষণ বড় ভাইকে হেনস্তা করার তালে থাকে।”

কল্পনা বলল,”ওরা বড়ভাইকে যথেষ্ট সমীহ করে। ততটা বাবাদেরও করেনা। আমি তাই নিশ্চিন্তে আছি।”

“মেয়ে জামাইয়ের সামনে ঢং করে।”

“সেটা করবেই। বড় ভাইকে হাত করা ওদের কতদিনের স্বপ্ন জানিস না?”

“তুমি হাসপাতালে মিনা আপুকে দেখেছ? কি পরিমাণ শুকিয়ে গেছে?”

“দেখেছি। এখন অনেক ভালো আছে যদিও। ওই বাড়িতে নাকি যায়না এখন।”

“আসলাম খান নাকি বলেছে তালাক দিয়ে দেবে। মিনা আপুও তালাক চায়। কিন্তু ইনামের কি হবে?”

“মাঝখান থেকে বাচ্চাটা কষ্ট পাবে। তুই দেখিস আসলাম খান ধেইধেই করে আরেকটা বিয়ে করে নেবে। ওরা সব পারে। মিনা আপা ভাবছে ওদের টাইট দেবে কিন্তু ওরা যে কতবড় শয়তান সেটা আমরা ছাড়া আর কে জানে?”

দুই বোন গল্প করতে করতে পৌঁছে গেল কফিশপে। সেখানে জেসিকে দেখে কল্পনা অবাক হলো। জোসেফ জেসিকে ইশারা করলো। জেসি ইশারা পেয়ে কল্পনার সাথে মেকি হেসে কুশলাদি বিনিময় করলো। কল্পনা বলল,

“ভালো লাগছে তোমাকে দেখে।”

জেসি হাসল। জোসেফ কিরণকে বলল,

“ভালো আছ তুমি?”

কিরণ বলল,”জি। জেসি আপু থাকায় ভালো লাগছে নইলে আপনাদের মাঝখানে…

জোসেফ আর কল্পনা হেসে ফেলল। কিরণও হাসলো তাদের হাসতে দেখে। জোসেফ কোল্ড কফি আর কিছু স্ন্যাকস অর্ডার করলো। কিছুক্ষণ অন্যান্য গল্পসল্পে সময় কাটলো। জেসিকে অন্যমনস্ক দেখে কল্পনা বলল,

“জেসি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছে।”

জেসি চমকে উঠে বলল,”কই না।”

জোসেফ নড়েচড়ে বসলো। কফি এসে গেছে। জোসেফ সবার দিয়ে কফি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,

“জেসি ভাইয়া তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি সেটা বলেছি কিন্তু। ”

জেসির মন খারাপ হয়ে গেল। হাসিখুশি চেহারাটা হঠাৎ করে এভাবে মলিন হয়ে যাবে কল্পনা ভাবতেও পারেনি। তার জেসির জন্য খারাপ লাগছে। জেসি বলল,

“হ্যাঁ জানি। কল্প ভাবির কিছু বলার থাকলে বলতে পারে।”

জোসেফ কল্পনার দিকে তাকাল। কল্পনা ইতস্তত বোধ করলো। বলল,

“আমার তেমন কিছু বলার নেই। যেখানে তোমার ভাইয়া আমার বাবাকে তোমার বন্ধুর জিম্মি থেকে উদ্ধার করেছে সেখানে আমার আর নতুন করে কি বলার থাকতে পারে? আন্টি আমাকে বলেছে কিছু প্রমাণ যেন তোমাকে দেখাই। তুমি আশা করি বুঝতে পারছো কথাটা উনি কেন বলেছেন।”

জেসি চুপ করে রইলো। জোসেফ বলল,

“বিয়েটা ফ্যান্টাসি নয় জেসি। ভাইয়া তোমাকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলছি কারণ এটা আমার দায়িত্ব। তুমি কথা না শুনলে ভাইয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক খারাপ হবে। তারপর পরবর্তীতে তোমার কিছু হলেও তুমি আমার কাছে আসতে পারবেনা। তুমি একশবার ভাবো। আর্যাব খানের কাছে তোমার কোনো প্রায়োরিটি নেই। এরচেয়ে বড়ো কারণ আর কি হতে পারে?

আমি জানি পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ হয় না। কিন্তু ওরা যা যা দূর্নীতি করেছে তা লোকসম্মুখে এলে ওরা মুখ লুকোনোর জায়গা পাবেনা। সামনের ইলেকশনে হয়তো আমিন খান মন্ত্রী পদে বসবে। তখন তাদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হবে। আর তারা আরও বেপরোয়া হবে। তোমার সাথে অন্যায় হলে তুমি প্রতিবাদ করতে পারবে না। তোমার সেই স্পর্ধাটুকুও হবে না। তুমি বাচ্চা মেয়ে নও। আমি জানি তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে সবটা বিচার করবে। আর হ্যাঁ আমি কল্পকে নিয়ে এসেছি যাতে তোমার আর তার মধ্যকার সব মনোমালিন্য মিটমাট হয়ে যায়। কারণ বিয়ের পর ও তোমাদের সাথে থাকবে। আম্মুর মধ্যে যা যা কনফিউশান ছিল ওকে নিয়ে আমি সব দূর করে দিয়েছি। চেয়েছি তোমারটাও দূর হোক। আশা করছি আমি পেরেছি।”

জেসি চোখ নীচে নামিয়ে রেখেছে। তার চোখে জল টুইটুম্বুর করছে। জোসেফ সস্নেহে তার মাথায় হাত রাখলো। জেসি কেঁদে উঠলো। কল্পনা বলল,

“প্লিজ তুমি আমাকে ভুল বোঝো না। তুমি আর্যাব খানকে কিছুদিন ইগনোর করো ওর সরূপ তোমার সামনে বেরিয়ে আসবে। আমার কথাটা মিলিয়ে নিও। ও আমার সাথে যা করেছে….

জেসি হুট করে প্রশ্ন করলো,

” ও কি তোমাকে পছন্দ করে?”

কল্পনা হকচকিয়ে গেল। জোসেফও কপাল কুঁচকে ফেললো। কিরণ বলে উঠল,

“নাহহহ। অসম্ভব।”

কল্পনা বলল,”মাথা খারাপ নাকি? ওরমতো লোক। ছিঃ। না না।”

জেসি তাদের রিয়েক্ট বলল,”সরি আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে আমার মাথা ঠিক নেই। ভাইয়া আমি এখন আসি?”

“কোথায় যাবে?”

“কাছেই। যাই?”

“যাও। দ্রুত বাড়ি ফিরবে।”

জেসি দ্রুতপায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল।

সে বেরিয়ে যাওয়ামাত্রই জোসেফ বলল,

“আর্যাব খান সবসময় তোমার পেছনে পড়ে থাকে কেন?”

“ও ভেবেছে ও আজেবাজে কথা বলবে আর আপনি সেটা বিশ্বাস করবেন। আমার সাথে না। কিরণের সাথেও এমন করে।”

পরক্ষণেই ভাবনায় পড়ে গেল কখন আর্যাব খান কিরণের সাথে অসভ্যতামি করেছে। কিন্তু একবারও মনে পড়লো না।

__________

কয়েকটা পাখি কিনে এনেছে আমিন খান। ইথিকার সামনে খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিয়েছে। পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে। কথাও বলতে জানে। সবাই যখন ইথিকাকে ইথু ইথু ডাকছে। ওরাও অনুকরণ করে ডাকছে,

“ভিতু ভিতু।”

ইথিকা হাসছে ওদের কথা শুনে। আর্যান খান সকালে বলেছিল, “ঠাস করে চড় মেরে বেহুঁশ বানিয়ে দেব। সারাক্ষণ প্যানপ্যান করে। পাখি পাখির মতো থাক। মানুষের মতো কথা বলবি কেন?”

সেই থেকে খেপে আছে। একটা দানাও মুখে নেয়নি এখনো। ইথিকা এখন তাদের আদর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সে হুইল চেয়ারে বসা। পায়ে জোর দিয়ে হাঁটাচলা করা নিষেধ। তবে অল্পসল্প হাঁটতে হবে। একেবারে বসে থাকলেও সমস্যা।

বাড়ির কাজের কর্মী একজন এসে ইলিনা বেগমকে তাজা খবর দিল,

“জামাই এসেছে।”

ইলিনা বেগম ফোনকলে ব্যস্ত ছিলেন। কাবির এসেছে শুনে তড়িঘড়ি করে নীচে নামলেন। কাবির সোফায় বসে আছে। গায়ে একটা সাদা শার্ট। উপরে কালো ওয়েস্টকোট। চেহারা গম্ভীর সম্ভীর। উজ্জ্বল কপালে ঘাম চিকচিক করছে।

ইলিনা বেগম ফোনে আমিন খানকে বললেন,

“কাবির এসেছে দেখলাম। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো।”

কাবির দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল,

“আনঝিল ঘুম নাকি জেগে?”

ইলিনা বেগম বললেন,”ওর বাবা ভাইরা না আসার আগে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারছিনা। তুমি এসেছ যখন, তখন বসো। চাচা চা কফির আয়োজন করুন।”

কাবির বলল,”আমি খেতে আসিনি। আনঝিলের সাথে দেখা করতে চাই।”

“তুমি চাইলেই তো আর আমরা দেখা করতে দিতে পারছিনা। ওকেও চাইতে হবে। ও বাইরের লোকজনের সামনেই যেতে চাচ্ছে না লজ্জায়। ও এখনো ওই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।”

কাবির বলল,

“আমি বাইরের লোক নই।”

“তাই তো বের করে দিয়েছিলে।”

“তার মাশুল এখনো দিচ্ছি। আমি দেখা করবো ওর সাথে। আমাকে যেতে দিন।”

ইলিনা বেগম তার সাথে উঁচুস্বরে কথা বলতে পারলেন না। বললেন,

“ওর বাপ ভাই আসুক। তারপর। ওর বাবা তোমার সাথে কথা বলবে।”

“উনাকে বলুন ইলেকশন নিয়ে থাকতে। আমি পরপুরুষ নই যে আনঝিলের সাথে দেখা করার জন্য আমার পারমিশন লাগবে।”

ইলিনা বেগম তার সাথে বেশিক্ষণ যুক্তিতর্কে পেরে উঠলো না। কাবির উপরে চলে গেল। বাড়ির কাজের পরিচালক আহমেদ চাচা হুইল চেয়ার ঠেলে ইথিকাকে নিয়ে আসছিল। কাবিরকে দেখে থমকে গেল। কাবির বলল,

“ও জরুরি জিনিসপত্র আর ঔষধের বাক্সটা নিয়ে আসুন গাড়িতে।”

আহমেদ চাচা মাথা দুলিয়ে চলে গেলেন। কাবির তারপর ইথিকার দিকে তাকাল। ইথিকার পরনে সাদা কামিজ। কালো ওড়না গলায় জড়ানো। রুগ্ন চেহারায় আগের চাইতে খানিকটা উন্নতি এসেছে। কোনো কথা বললো না সে। হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে কাবিরের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কাবির আটকে ফেলল। শক্ত করে চেয়ারটা ধরে রাখলো। ইলিনা বেগম এসে বললেন,

“কাবির ও অসুস্থ এখনো। ওই বাড়িতে ওর প্রপার ট্রিটমেন্ট হবে না। ওখানে সবাই ওর শত্রু। ওকে এখানে থেকে সুস্থ হতে দাও।”

কাবির বলল,”আমি ওকে এখানে রাখবো না ব্যস।”

ইলিনা বেগম ইথিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

“মা ওকে বলে দাও তুমি যেতে চাওনা ওর সাথে।”

ইথিকা বলল,

“I’m so tired Mom, I really need to rest.”

কাবির বলে উঠলো,

“দেওয়ান বাড়িতে রেস্ট নেওয়া যাবে।”

ইথিকা চোখ তুলে তাকাল। কাবির নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। বলল,

“তুমি আর ওদের লাই দিওনা। আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করো। আমার সাথে ফিরে চলো আনঝিল।”

ইলিনা বেগম বলল,

“সমাজের চোখে ও একজন ধর্ষিতা। তোমার একজনের ধর্ষিতার সাথে সংসার করতে লজ্জা করবে না? স্বামী হিসেবে ওকে নিজের কাছে রেখে সুস্থ করার জন্য নিতে আসা তোমার দায়িত্ব। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। এবার তুমি এসো কাবির। ও তোমার সাথে যাবে না।”

কাবির ইথিকাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে হুইল চেয়ার টেনে তুললো। কোলে তুলে নিয়ে হুইল চেয়ারটা পায়ে ঠেলে দিয়ে নীচে চলে যেতে লাগলো। ইলিনা বেগমের হৈচৈ কানে তুললো না। ইথিকা নির্বাক চেয়ে রইলো।

আর্যাব খান বাড়িতে ঢুকে কাবিরকে নামতে দেখে বক্রহেসে বলল,

“আরেব্বাস মজনু তার লাইলিকে নিয়ে যাচ্ছে দেখছি। ম্যাচিং করে কাপড়ও পরেছে দেখলাম। গোপনে গোপনে ফোনকল চলে নাকি ইথুর মা ভীতু?”

ইথিকা কিছু বলার শক্তি যোগাড় করার আগেই কাবির আর্যাব খানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর্যাব খান বলল,

“জামাই চা বিস্কুট খান। বউ নিয়ে এত তাড়াহুড়ো কেন?”

কাবির ইথিকাকে গাড়িতে বসালো। তারপর আর দেরী না করে গাড়ি ছেড়ে দিল। ইথিকা হাঁ করে চেয়ে আছে। কাবির হঠাৎ তার দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি নরম হয়ে এল। ইথিকা চোখ সরিয়ে নিল।

___

আহমেদ চাচা ইথিকার ব্যাগপত্র নীচে নামালো। ততক্ষণে কাবির চলে গিয়েছে। আর্যাব খান ইউনিফর্ম পাল্টে এসে স্যুটকেসটা নিয়ে বলল,

“বোনের শ্বশুরবাড়ি কি খালিহাতে যাওয়া যায়? এইসব নিয়েই না হয় যাই?”

আহমেদ চাচা খানিকটা রাগ মিশিয়ে বলল,”ওখানে যেয়ে তোমার কাজ কি?”

আর্যাব খান হাসল। আহমেদ চাচার ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“কাজ তো অনেক আছেরে টাকলা।”

আহমেদ চাচা অপমানিত বোধ করলেন। এই বাড়ির ছেলেগুলো এত বেয়াদব। তিনি মুখফুটে প্রতিবাদ করতে গেলে আরও বেইজ্জত করবে। তাই কিছু বললেন না। পেটের দায়ে কাজ করে খেতে তো হবে। কিন্তু এই বেয়াদবগুলোকে তিনি একদিন দেখে নেবেন।

আর্যাব খান কাবিরের পিছুপিছু দেওয়ান বাড়িতে হাজির। তখন কল্পনা আর কিরণ হাসতে হাসতে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে সবেমাত্র। তাদের হাতে হাওয়ায় মিঠাই। জোসেফ অনেকগুলো হাওয়ায়মিঠাই কিনে দিয়েছে। খাওয়ার পরেও অবশিষ্ট থেকে গেছে অনেকগুলো। ঝিনুক আর লায়লা খালা পছন্দ করে। ওরা খাবে।

আর্যাব খান সোফায় বসেছিল এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে। পা নাচাচ্ছিল। তা দেখে কল্পনা আর কিরণ থমকে দাঁড়ালো। আর্যাব খান ধীরেধীরে মাথা ঘুরালো। কল্পনা আর কিরণকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট গোল করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বলল,

“বেয়াইন। এসে পড়েছি কিন্তু। আদর আপ্যায়ন না নিয়ে যাচ্ছি না।”

কল্পনা হাতের মুঠো শক্ত করে উপরে চলে গেল। কিরণও দৌড় লাগালো। আর্যাব খান হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে রিমোট চেপে টিভির সাউন্ড বড়ো করে দিল। সাধারণত নিউজ দেখার জন্য টিভিটা বসানো হয়েছে এখানে। নইলে এভাবে নাচগান দেখেনা কেউ।

লায়লা খালা এসে টি টেবিলটা মুছতে লাগলো। আর্যাব খানকে বলল,

“জুতা বাইরে খুলে আসবা। জুতায় এত ময়লা নিয়ে ভিতরে আসবানা এরপরের বার থেইকা। বেডা তো দেখতে সুন্দরসান্দর আছো কিন্তু অমন বেয়াদব ক্যা?”

আর্যাব খান এই সোফা থেকে লাফ দিয়ে সামনের সোফায় গিয়ে গা এলিয়ে পা টেনে বসলো। বলল,

“বেশি সুন্দর আমি? মেয়ের জামাই বানাবে?”

“আমার কুনো বেডি নাই। সব বেডা। বেডারা বিয়া করে ফ্যালচে। বউ পাইয়্যা এহন আমারে ভাত দেয় না।”

আর্যাব খান হাসতে লাগল।

“দেওয়ায়ই উচিত না।”

তক্ষুণি কল্পনার ডাক ভেসে এল।

“খালা তাড়াতাড়ি উপরে আসো। হাওয়ায় মিঠাই খাবে।”

আর্যাব খান তার গলার আওয়াজ শুনে আবারও একলাফে সোফা বদল করে বসে উপরে তাকাল যাতে কল্পনা তাকে দেখতে পায়। কিন্তু কল্পনাকে দেখা গেল না।

লায়লা খালা হঠাৎ ভুরু কুঁচকে বলল,

“তোমরা সবকটা ভাই বাঁদরের মতো এত তিড়িংতিড়িং করে লাফাও ক্যান বাপু? একজায়গায় স্থির হয়ে বইসা থাকতে পারো না?”

আর্যাব খান কপাল কুঁচকে বলল,” কি বললে?”

লায়লা খালা বলল,”কিছু না।”

আর্যাব খান হে হে করে হেসে উঠে বলল,

“শুনে ফেলেছি কিন্তু।”

“শুনছো ভালা কথা। তো আবার জিগাও ক্যান?”

“কি বললে?”

“কিছু না।”

আর্যাব খান গলা কাত করে বলল,

“শুনে ফেলেছি কিন্তু।”

লায়লা খালার চিক্কুর দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। আর বলতে ইচ্ছে করল, ঝাঁটাটা কোথায় রেখেছি। কেউ খুঁজে দে। এরে ঝাঁটা মেরে বিদেয় করি।

লায়লা খালাকে বিড়বিড় করতে দেখে আর্যাব খান আঙুল তাক করে বলল,

“শুনে ফেলেছি কিন্তু।”

লায়লা খালা চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“গোলামের ফুতাইনরে…

লুবনা বেগম, ঝিনুক, কিরণ সবাই তার একডাকে উপস্থিত।

কি হলো কি হলো রব পড়ে গেল। খান বাড়ির দুই নম্বর বাঁদরটা মুরব্বিটাকেও ছাড়ল না?

চলমান….

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ইথিকা কারো সাথে কথাবার্তা বলছেনা আসার পর থেকে। লুবনা বেগম জিজ্ঞেস করেছিল, তার শরীর এখন কেমন, ইথিকা জবাব দেয়নি। কাবির তাই মাকে বারণ করে দিয়েছে যাতে এখন তার সাথে কোনোরূপ কথাবার্তা না বলে। আগে স্বাভাবিক হোক।

নীচে স্যুটকেস আনতে যেতেই কাবির দেখল লায়লা খালার সাথে আর্যাব খান হাসিঠাট্টায় মজে আছে। লুবনা বেগম, কিরণ, ঝিনুক সবাই লায়লা খালাকে ডাকছে। কিন্তু লায়লা খালা আর্যাব খানের উপর বেজায় রেগে গেছে। চেঁচাচ্ছে। আর্যাব খানও ঠান্ডা মাথায় জবাব দিচ্ছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। কাবিরকে দেখে লায়লা খালা থেমে গেল। ঘোমটা টেনে নিয়ে বলল,

“দেইখো বড়োসাব তোমার সম্বন্ধি আমার লগে কিরকম বেয়াদবিটা করতেছে।”

আর্যাব খান বলল,”বেয়াদব বেয়াদবি তো করবেই।”

কাবির স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“সবার সাথে তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই।”

লায়লা খালা মুখ মোচড় দিয়ে চলে গেল। আর্যাব খান হাসলো। কিরণ তাকে হাসতে দেখে ঝিনুককে বলল,”অদ্ভুত লোক। এরকম ত্যাদড় লোক আমি জীবনে দেখিনি। আপুর সাথে ওইদিন যা যা করলো। ভাগ্যিস জিজু আন্টিকে ম্যানেজ করেছে। বলে কিনা আপু ওর সাথে লং ড্রাইভে গিয়েছে। অসভ্য মিথ্যেবাদী জানোয়ার।”

আর্যাব খান তার দিকে তাকাতেই কিরণ দ্রুত চলে গেল সেখান থেকে। আর্যাব খান মনে মনে হাসল। ছোটে দেওয়ানিরও তেজ কম না।

কাবির ঘরে ঢুকেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে কাপড়চোপড় নামিয়ে বলল,”চেঞ্জ করতে চাইলে করে নাও। আমি একটু বেরোবো। তাড়াতাড়ি ফিরব। তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।”

ইথিকা মুখ ফিরিয়ে চুপ করে বসে আছে। চোখে জমাট বাঁধা কষ্ট। তাকে ফিরিয়ে এনে কি প্রমাণ করতে চাইছে উনি? তাকে খুব ভালোবাসে? তাকে চোখে হারাচ্ছে? তারমতো মেয়েকে ভালোবাসা এত সহজ নয়। সে সমাজের চোখে একটা নর্দমার কীটের মতো ঘৃণিত। দেওয়ানদের কাছে তা আরও জঘন্য। এসব কি কাবির দেওয়ানের দয়া নয়? ইথিকার মাথার রগ দপদপ করছে। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। অতিরিক্ত চিন্তা নেয়া যাচ্ছে না। কাবির ফাইলপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ তার দিকে তাকাল। জানতে চাইল,

“শরীর খারাপ লাগছে?”

“আমার শরীরটা এমনিতেই খারাপ। আমি কিছুদিন বাইরে ঘুরতে যেতে চেয়েছি।”

“কোথায় যেতে চাও? কার সাথে?”

“একা।”

কাবির বলল,

“বেশ। তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও কোথায় যাবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু একা নয়। আমি তোমাকে একা কোথাও ছাড়তে পারব না।”

ইথিকা স্যুটকেস থেকে বের করা কাপড়চোপড়গুলো দেখে নিতে নিতে বলল,

“পরে জানাব। এখানে সব টপস আর ভারী ড্রেসগুলো দিয়েছে। এখানে এসব পরিনা আমি।”

কাবির ড্রেসগুলোর দিকে তাকালো। বলল,

“কাবার্ডে তোমার আরও ড্রেস আছে। বের করে দেব?”

ইথিকা শক্ত কণ্ঠে বলল,

“এত দয়াদাক্ষিণ্য চাই না আমার।”

কাবির থমকে গেল। কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো ইথিকার দিকে। ইথিকা তাকাতেই তার সাথে চোখাচোখি হলো। কাবির ধীরে বলল,

“তুমি এসব করেও আর পালাতে পারবেনা এখান থেকে।”

ইথিকা জানতে চাইল,

“যাকে বিশ্বাস করেন না তার সাথে সংসার করবেন?”

“ভুলের মাশুল দিতে কার্পন্য করেনা দেওয়ানরা। মাশুল নাও তবুও কোথাও যেতে পারবে না। যেতে দেব না আমি।”

_______________

দেওয়ান বাড়িতে খান বাড়ির সবাই উপস্থিত। শুধু ইলিনা বেগম আসেননি। আমিন খান গর্জে গর্জে বলল,

“কাবির! নীচে এসো। তোমার সাহস কত আমার মেয়েকে এভাবে নিয়ে এলে? তোমার আমাকে ফোন দেয়ার দরকার ছিল। ফোনে না পেলে অপেক্ষা করতে পারতে। আমি ব্যস্ত মানুষ তোমার মাথায় থাকার কথা।”

আর্যাব খান তার বাপ ভাইকে দেখে বলল,

“আরেহ ইলিনা হকের ডার্লিং হিরো এসে গেছে দেখছি।”

আমিন খান তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“হাঁদারাম। তোমার সামনে ইথুকে নিয়ে এল তুমি কিচ্ছু করতে পারলে না?”

“বরের কাছ থেকে বউয়ের হাত ছাড়িয়ে নেয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কোল থেকে নামিয়ে নেয়া মানেই সশ্রম কারাদণ্ড। ড্যাড প্লিজ কাম। চা খাও। মাথা ঠান্ডা করো। আজকে দেওয়ান বাড়িতেই আমাদের লাঞ্চ।”

আসলাম খান বলল,

“তোকে চড়াতে চড়াতে বয়রা করে দিতে ইচ্ছে করে। সারাক্ষণ নাটক মারাস।”

আর্যান খান মাথা হেলিয়ে হাসলো। আশিষ চেঁচিয়ে ডাকল,

“ইথু এই ভীতুর মা তোর বরকে আসতে বল।”

আরিশ খান বলল,”আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমাদের বোনকে নিয়ে এল। কত্ত সাহস বেড়েছে এদের।”

কামরান দেওয়ান বেরিয়ে এল। বাকিরা বাড়িতে নেই। কাবিরের সাড়াশব্দ নেই। কামরান দেওয়ান আমিন খানকে দেখে কঠোর চাহনিতে তাকাল। রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে বলল,

“অনেকদিন পর।”

আমিন খান চোখ সরিয়ে নিল। সোফায় গিয়ে বসলো। কামরান দেওয়ান পায়ে ভর দিয়ে নামতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে। কাবির এসে উনাকে ধরলো। সবার দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল।

কামরান দেওয়ানকে নিয়ে নেমে এসে বলল,

“আপনার মেয়ে কোথাও যাবে না।”

আমিন খান গম্ভীরমুখে তাকালেন। আর্যাব খানের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে চাপলেন। বললেন,

“তুমিও যদি আমাকে গ্যারান্টি দাও ইথুর আর কোনো বিপদ হবে না। তোমাকে বিশ্বাস কিভাবে করবো?”

আসলাম খান বলল,”ওকে বিশ্বাস করা আর কুত্তাকে বিশ্বাস করা একি কথা।”

কাবির তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল।

“কুত্তার উপর যখন এতই বিশ্বাস একমাত্র বোনের বিয়েটা কুত্তার সাথে দিলেই পারতি।”

আসলাম খান দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। কাবির কামরান দেওয়ানকে বসিয়ে আমিন খানের সামনের সোফায় গিয়ে বসলো। আর্যাব খানকে বলল,

“পা নামা।”

আর্যাব খান পা নামাতেই কাবির আমিন খানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনার চার ছেলেকে সাথে না এনে আপনি একা এলে আপনার কোনো ক্ষতি করবেনা দেওয়ানরা।”

“সেই সাহস কোথায় কাবির?”

“তাহলে পরবর্তীতে ওদের নিয়ে আসবেন না। যাইহোক সেকথা বাদ। জেঠাকে গুম করার অপরাধে করা সব মামলা তুলে নিয়েছিলাম। আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইলে আমি ওই মামলা আবারও দায়ের করতে পারি। প্রমাণ আমার হাতেই আছে। আপনার ইলেকশন সামনে। আমি আশা করব আপনি আর আপনার ছেলেরা খুব সাবধানে পা ফেলবে। কারণ ওসব ছোটখাটো মামলার কারণে আপনার কিছু না হলেও হতে পারে কিন্তু যদি মিডিয়ায় জানাজানি হয় তাহলে অনেক বড়ো ক্ষতির মুখে পড়বেন।”

আমিন খান মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়লেন। শান্ত হয়ে সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কাবির বলল,

“আমি আনঝিলকে না আনলেই পারতাম। আমার অপরাধবোধ আছে। আমাকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সেটা আটকাচ্ছিল। তবুও আমি দাঁড়িয়েছি। কারণ আমার মনে হয় সে মানুষ হিসেবে দশটা ভুল করতে পারলে একটা দুটো আমিও করতে পারি। আর সেই অপরাধবোধ স্বীকার করার সাহসও আমার আছে। যাইহোক আমাদের স্বামী স্ত্রীর সমস্যা আমরা সমাধান করে নেব। আমি চাইনা কোনো বহিরাগত মাঝখানে সমস্যা তৈরি করুক।”

আসলাম খান বলল,

“ইথু চাইনা তোর কাছে থাকতে। ও কাল আমাদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। তুই ওকে জোর করে নিয়ে এলি কেন?”

“কারণ আমার সেই অধিকার আছে। আমি তার কথা শুনে না আনলেও পারতাম। তারপর সম্পর্কটা আরও খারাপ হতো। তোরা যদি চাস আমাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবি তাহলে তোদের বোনকে নিয়ে যা। আর যদি চাস ও এখানে আমার সাথে থাকবে তাহলে তোরা বেরিয়ে যা।”

আমিন খান বলল,”তুমি রেগে যাচ্ছ কেন দেওয়ান? ওদের একটামাত্র বোনকে ওদের শত্রুর কাছে বিয়ে দিয়েছে। টেনশন তো থাকবেই।”

“সেটা বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল। বিয়ের পর কম নাটক তো দেখিনি।”

চা নাশতা চলে এল। আমিন খান দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,

“ইথুকে ডেকে দিলে ভালো হবে। আমাদের বেরোতে হবে।”

কাবির বলল,”চা শেষ হোক। তারপর আসবে।”

আমিন খান বসে গেল। চায়ের কাপ তুলে নিল। ছেলেদের ইশারা করলো। সবাই চায়ের কাপ তুলে নিল। আর্যাব খান হঠাৎ বলে উঠল,

“বিষ বিষ।”

কথাটা শোনামাত্রই সবার মুখ থেকে চা ফস্কে পড়লো। উপস্থিত সবাই হতবাক। ঝিনুক আর লায়লা খালা হতভম্ব হয়ে গেল। সবাইকে বড় বড় চোখ করে তাকাতে দেখে আর্যান খান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল।
তারপর আঙুলে চাবি চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ থেমে গিয়ে লায়লা খালার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আবার আসব কিন্তু।”

লায়লা খালা হকচকিয়ে গেল। চা খাবে বলে বলে গলা ফাটাচ্ছিল হারামজাদা। কিন্তু এখন চা টা এভাবে বরবাদ করে চলে গেল। কত দুধ চা পাতা খরচ হয়েছে দেওয়ানদের তার কোনো হিসেব আছে ব্যাটা?”

______________

কাবির কারখানায় পরিদর্শনে এসেছে। সাদা অ্যাপ্রন পরে, মাথায় হেয়ার ক্যাপ, পায়ে শু-কাভার সব নিয়ম মেনে সে ঢুকেছে প্রোডাকশন ইউনিটে। সেখানে অটোমেটেড মেশিনে ট্যাবলেট প্রস্তুত হচ্ছে। মেশিনের এক পাশে কর্মীরা ফয়েল প্যাকেজিংয়ে ব্যস্ত। গ্লাভস পরা টেকনিশিয়ানরা ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষা করছে। কাদিন আর কাসেদ সেখানকে দেখা যাচ্ছে।

কাবিরের কয়েকটা নমুনা সংগ্রহ করলো পরীক্ষাগারে পাঠানোর জন্য।

ঠিক তখনই নাজিফা এসে হাজির।

“ভাইয়া আপনি?” বিস্ময়ের সুর তার গলায়।

কাবির অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি এখনো এখানে কি করছো? ডিউটি তো শেষ।”

নাজিফা বলল, “একটা রিপোর্ট সাবমিট করা বাকি ছিল। চলে যাব এখন।”

কাবির বলল,”বাইরে অনেক ঝড়। সাবধানে যাবে। আমাদের গাড়ি আছে। ড্রাইভারকে বললে পৌঁছে দেবে। একা যেওনা।”

নাজিফা বলল,”একটা কথা বলার ছিল ভাইয়া।”

“বলো।”

নাজিফা একটু ইতস্তত বোধ করে বলল,

“আন্টির সামনে আমি কথাটা তুলতেই পারছিনা। আমি আর ওই বাড়িতে থাকতে চাইছিনা। যেহেতু চাকরি হয়েছে আমি এফোর্ট করতে পারব বাসা ভাড়া।”

কাবির ভেবেচিন্তে বলল,

“কল্পর বিয়ে অব্দি থাকো। তুমি তো রাতটুকুই বাড়িতে থাকছো। এত আনইজি ফিল করার দরকার নেই।”

নাজিফা মাথা দুলিয়ে বলল,

“জি। আরেকটা কথা ভাইয়া।”

“বলো।”

নাজিফা হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,

“আসলে ওইদিন বড় আঙ্কেল ছটফট করছিল দেখে আমি কল্পকে বলতেই ছুটে যাচ্ছিলাম কিন্তু পথিমধ্যে ভাবির দেখা হওয়ায় উনি জানতে চাইলেন আমি কেন ওভাবে ছুটছিলাম। আমি কারণটা বলার পর উনি নিজেই এগিয়ে গেলেন দেখার জন্য। আর কল্পকে বলার জন্য। আমি কল্পকে বলতে পারিনি ও বাড়ি ছিল না বলে। কল্প তার কিছুক্ষণ পর বাড়ি এসেছে। আর যখন এসেছে তখন আঙ্কেল অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”

কাবির বলল,”বুঝেছি। আমি তোমার ভাবির সাথে এই বিষয়ে পরে কথা বলবো।”

নাজিফার চোখ নীচে। সে বলল,

“মাজহাবের খোঁজ কি পেয়েছেন?”

কাবির হঠাৎ খেয়াল করলো নাজিফার নাকে এখনো নাকফুল, হাতে এখনো চুড়ি রয়ে গেছে। মেয়েটা কি অন্ধ? তার স্বামী তাকে ঠকিয়েছে শোনার পরও কিভাবে সে এখনো তার চিহ্ন নিয়ে ঘুরছে? কাবিরের হঠাৎ কার উপর রাগ হলো সে নিজেও বুঝতে পারল না। হয়তো মাজহাবের উপর। ও কি করে পারল এমন একটা মেয়েকে ঠকাতে?

সে কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে বলল,

“না। কিন্তু আমি খুঁজছি।”

“কল্প আমাকে জিজ্ঞেস করছিল ওইদিন।”

“কেন?”

“জানিনা। জানতে চাচ্ছিল আপনি মাজহাবের কোনো খবর আমাকে দিয়েছেন কিনা।”

কাবির বলল,”সব ঝামেলা একত্রে এসে পড়েছে। আমি একটু ফ্রি হই। তুমি এখন চিন্তামুক্ত থাকো। আরেকটা কথা এসব চুড়ি, নাকফুল আর পরো না। মাজহাব ফিরলেও এসব পরার দরকার নেই। ও তোমার যোগ্য না।”

নাজিফা অবাক চোখে তাকাল। কাবির চলে গেল তার অবাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে। মানুষ কি করে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ঠকায়? পাপ করার সময় নিষ্পাপ চেহারাটা একবার মনে পড়েনা?

_____________

রাত সাড়ে এগারোটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। কলিমউদ্দিন দেওয়ানের ঘর থেকে কাশির শব্দ ভেসে আসছে। মানুষটা নানান অসুখবিসুখে ভুগছে। এতদিন তিনিও গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। লুবনা বেগমের যত্ন আত্তিরে এখন একটু সুস্থ। উনার ঘরে দুই ছেলে আর এক মেয়ের বৈঠক বসেছে কাবিরের বউ নিয়ে।

বড়ফুপু বললেন,”আর যাইহোক। মেয়েটার বদনাম হয়ে গেছে। গায়ে কালি লেগে গেলে তা সহজে মুছে না। আমার কাবিরের মানসম্মান আর রইলো না। দশটা মানুষের সামনে ও এই বউ নিয়ে দাঁড়াতে পারবে? আমার ভাবতেই খারাপ লাগছে আমার ভাইপোকে এরকম মেয়ের সাথে সংসার করতে হচ্ছে।”

কাওসার দেওয়ান আর কামরান দেওয়ান নিজেদের মতামত জানাল। কামরান দেওয়ান বলল,

“কাবির নিয়ে এসেছে ওকে। শুনেছি ও আসতে চাচ্ছিল না। কাবির যখন এনেছে তখন সেখানে আমাদের কিছু বলার থাকতে পারেনা।”

কথার প্রসঙ্গ উল্টেপাল্টে গেল এক বৈঠকে। প্রসঙ্গ গিয়ে থামলো সেদিনকার ঘটনায়। কাওসার দেওয়ান কথায় কথায় বলল,

“ওদের খুনগুম করতে হাত কাঁপেনা। কল্পর সামনেই নাকি একজনকে কুপিয়ে বস্তাবন্দি করে নিয়ে গেল। কাবিরের সামনে একজনের মগজ বের করে নিল। ওরা সব পারে। আমার কাবিরের জন্য ভয় হয়। ছেলেটা কীসের মধ্যে জড়িয়ে পড়লো। যাদের কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছি চিরকাল তাদের সাথেই জড়িয়ে পড়তে হলো।”

কামরাম দেওয়ান বলল,

“তুই এত টেনশন করছিস কেন? ওদের সাথে তো ওঠবস করতে হচ্ছেনা কাবিরকে। ওর বউ ঠিক থাকলেই হলো। মেয়েটাকে ওর মা আর বাপ ভাইরা শান্তি দিচ্ছে না। ফোনে মনে হয় এটাসেটা বলে ফুঁসলায়। তাই অমন করে। নইলে তো ছাড়াছাড়িটা তখন হয়ে যেত।”

লুবনা বেগম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এবার কথা বলে উঠলেন,

“ঠিক বলেছেন দাদা। বৌমা সেবার একা একা পালিয়ে এসেছিল। ওর মন না থাকলে এতদিনে ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত। বৌয়ের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওর বাপ ভাইরা ওকে ফুঁসলায় কাবিরের বিরুদ্ধে।”

বড়ফুপু বলল,”বাপ ভাইয়ের কথায় চললে সংসার ভাঙবে। কারো কিছু হবে না। সে নিজেই কাবিরকে হারাবে। ওরকম ছেলে লাখে একটা সেটা তখন বুঝবে।”

লুবনা বেগম বেরিয়ে গেলেন। সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এসে বললেন,

“ও এসে গেছে। হয়েছে চুপ যান আপনারা। দেখেন আগেপরে কি হয়। কল্পর বিয়েটা ভালোই ভালোই মিটে যাক। তারপর ওর সাথে কথাবার্তা বলবেন।”

______

কাবির প্রায় ভিজে বাড়ি ফিরেছে। লুবনা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,

“এমা ভিজলে কিভাবে?”

“মাঝপথে একটা গাছ ভেঙে পড়লো। কয়েকজন মিলে ওটা সরালাম তারপর এলাম। তোমরা খেয়েছ?”

“আমি আর লায়লা খাইনি। বাকিদের খাইয়ে দিয়েছি।”

“ও খেয়েছে?”

“ঘরে দিয়ে এসেছি। খেয়েছে কিনা জানিনা। দরজা বন্ধ দেখলাম তাই আর ডাকাডাকি করিনি।”

কাবির বলল,”আচ্ছা আমি চেঞ্জ করে আসি। নাজিফা এসেছে না?”

“হ্যাঁ সে তো কবে এসেছে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চলে যাবে যাবে বলছে। আমি বললাম থাকো আর কিছুদিন। তোমাকে আর পাচ্ছি কোথায়?”

মা ছেলে কথা বলতে বলতে কিছুদূর গেল। তারপর লুবনা বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। যেতে যেতে কল্পনাকে বললেন,

“আহা সকালে বলিস কথা। ঘুমা এখন। না ঘুমিয়ে চোখের নীচে কালি ফেলে দিচ্ছে।

এই কিরণ এত হাসাহাসি কীসের? ঘুমিয়ে পড় দুজন।”

বড়ফুপু বলল,”কার সাথে কথা বলছ?”

“কল্পকে ডাক দিলাম। এত কীসের কথা যে বলে ছেলেটার সাথে। কিরণও যোগ দিয়েছে। কি বলে এত হাসাহাসি করে কে জানে।”

বড়ফুপু হাসল।

“আজকালকার ছেলেদের কথা বলো না। এরা বউ বলতে অজ্ঞান। আর আমরা পাশাপাশি বসে কথা বলার সুযোগটাই পেতাম না তখন।”

“হ্যাঁ, কিরণ বলল, কল্প কথা না বললে নাকি আবারও রাগটাগ দেখায়।”

“ওই ছেলেকে আমার ভালোই লাগে। বলুক গে কথা। হবু বউয়ের সাথেই তো বলছে।”

“হ্যাঁ বিয়ের দিনতারিখ পড়লে কাজ বেড়ে যাবে বাড়িতে। যাই কাবিরের জন্য ভাতটা বেড়ে দিই।”

__

কাবির ঘরের দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। সে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিতেই কপাল কুঁচকে ফেলল। ইথিকা কোথাও নেই। আবার কোথায় গেল?

সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে লুবনা বেগমকে ডাকলো,”মা!”

লুবনা বেগম দ্রুতপায়ে ছুটে আসতে আসতে বলল,

“কি হয়েছে?”

উনাকে দেখামাত্রই কাবিরের মাথায় এল আনঝিল ওয়াশরুমে নয়তো? সে তো চেক করেনি। লুবনা বেগম তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কি হয়েছে কাবির?”

“না, কিছু না। ভাত বাড়ো।”

“হ্যাঁ বেড়েছি। তাড়াতাড়ি এসো।”

তিনিও চিন্তিতমুখে চলে যেতে লাগলেন। ছেলেটার আবার কি হলো। কাবির ঘরে চলে এল। আবারও ঘর অন্ধকার। আলো না জ্বালিয়ে সে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে যাবে তখুনি ইথিকার সাথে ধাক্কা। আর সাথে সাথে ইথিকার চিৎকার।

চিৎকার করতে করতে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে কাবির তার মুখ চেপে ধরে বলল,

“আমি আমি। তুমি আলো বন্ধ করলে কেন? আশ্চর্য!”

ইথিকা চুপ করে গেল। কাবির দ্রুত আলো জ্বালিয়ে দিল। ইথিকা জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা ভেজা শাড়ি। একটা গামছা জড়ানো উপরে। কাবির অবাক হয়ে এগিয়ে এসে বলল,

“এই অবস্থা কেন?”

ইথিকা চোখ সরিয়ে উত্তর দিল,”বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম।”

কাবিরের বিস্ময় ঝড়ে পড়ল।

“এই পা নিয়ে? তুমি এই শরীরে ভিজছিলে?”

ইথিকা তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। বলল,

“আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন?”

“না, জিজ্ঞেস করছি তুমি এই শরীরে কেন ভিজতে গেলে।”

“আমার হচ্ছিল বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে ভালো লাগবে।”

কাবিরের চোখ গেল তার পায়ের কাছে। পায়ে ক্ষত চিহ্নের দাগ স্পষ্ট। এখনো অনেকটা ক্ষত ভালো করে শুকোয়নি। কাবির অবাক হয়ে বলল,

“তাই বলে এভাবে?”

ইথিকা গম্ভীর মুখে বলল,”আমি চেঞ্জ করব।”

“করো।”

“আলো নিভিয়ে দিন।”

কাবির আলো নিভিয়ে দিল। নিজের ভেজা ওয়েস্টকোটটা খুলে টেবিলের দিকে ছুঁড়ে মারলো। ওদিকে ইথিকা দাঁড়িয়েছিল। ওয়েস্টকোটটা তার মুখের উপর গিয়ে পড়লো কাবির সেটা খেয়াল করেনি।

সে চেঞ্জ করে আলো জ্বালিয়ে ইথিকার দিকে ফিরতেই দেখলো তার ওয়েস্টকোটে ইথিকার মুখ ঢেকে আছে।

ইথিকা ধীরেধীরে ওয়েস্টকোটটা টেনে নামিয়ে নিল। সেদিন এই ঘ্রাণটা নাকে আসার পর তার মনে হয়েছিল সে বেঁচে গেছে। সে আর মরবে না। কাবির তার দিকে এগিয়ে এসে ওয়েস্টকোটটা নিয়ে নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,

“আমি খেয়াল করিনি। টেবিলের দিকে ছুঁড়ে মেরেছি।”

ইথিকা ওয়েস্টকোটটা দিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আপনি ওইদিন একটু দেরী করলেই পারতেন। স্বচক্ষে দেখতে পেতেন আমি কতবড় নষ্টা।”

কাবির তার দিকে তাকিয়েই রইলো। সে এসব কথা শুনে রাগবে না। কারণ সে নিজেই বলেছিল, অভিযোগের পাহাড় নিয়ে ফিরে আসতে। ফিরে এসেছে এটাই যথেষ্ট তার কাছে। অভিযোগের পাহাড় উঠুক। একদিন সব অভিযোগ পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে ভেঙেচুরে, ভালোবাসার ঝড়ে।

কাবির কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ইথিকা আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গালের পাশে, ঠোঁটের পাশে, গলার পাশে এখনো বিশ্রী দাগ রয়ে গেছে। ইথিকা আলতোভাবে গলার পাশে হাত রাখলো। ডুকরে উঠে ভেতরে কান্না গিলে নিল বহুকষ্টে। কিন্তু চোখের জলদের আটকানো যায়নি। আর সেই জল কাবির দেওয়ানের কাছ থেকেও আড়াল করা যায়নি। যদিও ইথিকা চাচ্ছিল না কাবিরকে তা দেখাতে। তবুও কাবির দেখে ফেললো।

চলমান…

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_২৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

[যারা আগে পড়েছেন তাদেরকেও পড়তে হবে]

কাল রাতে ইথিকা শারীরিক যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। কাবিরের ঘুমটাও ভালো হয়নি। ইথিকার ছটফটানি দেখে তারও ঘুম আসেনি। স্বাভাবিক। একটা মানুষ কাতরাচ্ছে আর অপর মানুষটা আরামে ঘুমাতে পারেনা।

সকালে কাবির কাজে বেরোনোর সময় দেখলো ইথিকার অনেক কাপড়চোপড় জমিয়ে রাখা আছে। ইথিকা সেসব ধোয়ার জন্য হাতে নিয়েছে। একপ্রকার রাগ কিংবা দুঃখ থেকে ঝিনুককে ধুতে দিচ্ছে না। নিজেই ধুবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কাবির আড়চোখে তা দেখে বলল,

” আমি ধুয়ে নেব। বালতি রেখে দেয়া হোক।”

ইথিকা তার কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কাবির তার নড়চড় না দেখে এগিয়ে এসে বালতিটা নিয়ে নিল। বলল,

“রেস্টে থাকা জরুরি।”

ইথিকা বলল,”দেখে তো মনে হচ্ছে আমার প্রতি অনেক দরদ।”

“তা সবার জন্যই আছে।”

ইথিকা বলল,

“হ্যাঁ বন্ধুর বউয়ের জন্যও।”

কাবির কিছু বুঝে উঠার আগেই ইথিকা বলল,

“আমি ইলেকশন পর্যন্ত আছি। তারপর ড্যাড আমাকে নিয়ে যাবে। আপনি একটা ভালো দেখে আপনার মনের মতো কাউকে বিয়ে করে নেবেন। বছর যেতে না যেতেই বাচ্চা নেবেন। সংসার করবেন। মাঝেমধ্যে আমি উঁকিঝুঁকি মেরে যাব। ব্যাপারটা দারুণ হবে। আমি কিন্তু অন্তরা খানম নই। আমি খুব উদার মনের। আপনার বুকের উপর অন্য কেউ লুটোপুটি খাবে সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারব। আমার একফোঁটাও কষ্ট হবেনা। আমি তো আর আপনাকে ভালোবাসতে পারব না। আপনিও পারবেন না আমার মতো মেয়েকে ভালোবাসতে। তাহলে কি দরকার একসাথে থাকার?”

কাবির জবাব দিল না। কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। ধরেই নিয়েছে ইলেকশনের পর এই বাড়ি ছাড়বে? তারমানে সব পূর্বপরিকল্পিত? এখন কোনো ঝামেলা চাইছেনা বলেই থেকে গেছে? তারমানে সে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। সে এত বোকা কবে থেকে হলো?

কাবির আর কিছু বললো না।

তবে কিছু না বললেও স্বামী হিসেব স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে কোনো কার্পণ্য করলো না।

ইথিকার সব কাপড়চোপড় ধুয়ে বালতিতে রেখে দিল। বেরোনোর আগে লুবনা বেগম, কিরণ আর কল্পকে বলে গেল যাতে ওর সাথে মিশে, কথা বলে, একা করে না রাখে, ঔষধ খাচ্ছে কিনা তার তদারকি করে।

লুবনা বেগম বলল,”তুমি তো বাড়ি আসছো রোজ। এমনভাবে বলছ মনে হচ্ছে তুমি কোথাও চলে যাচ্ছ।”

কাবির বলল,”এতদিন হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেক কাজ পড়ে আছে। আমি অনেক ব্যস্ততার মধ্যে থাকব। কল্পর বিয়ের আগে যেন একটু ফ্রি হতে পারি। রাত বেশি হয়ে গেলে আর বাড়িতে ফিরবো না। ওর সাথে কিরণ অথবা কল্প যেকোনো একজন থেকো রাতে।”

লুবনা বেগম বলল,”ওর এখন তোমাকে বেশি জরুরি। তুমি বাড়ি না ফিরলে অন্য কিছু মনে করতে পারে।”

কাবির সেকথার জবাব দিল না। কারণ সে জানে সে না থাকলে আনঝিল খানমের চাইতে খুশি আর কেউ হবে না।

___________

কাবিরের বাড়িতে না থাকা নিয়ে ইথিকার কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া কেউ দেখতে পেল না। রাতে কিরণ থেকেছে তার ভাবির সাথে। ভাবি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা বাবা আর ভাইদের সাথে কথা বললো ফোনে। কিন্তু একবারও ভাইয়ের খোঁজ করলো না। কিরণ ভেবে কূল পেল না স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হয়? অথচ সে ছোটবেলা থেকে দেখেছে বড়মা বড়জেঠার সম্পর্কের কথা। মা মামার বাড়ি গেলে বাবা হন্য হয়ে ছুটে যেতেন মাকে নিয়ে আসার জন্য। মা এখনো নিজে খান না বাবা না খেলে। অথচ এরা? অবশ্য এসব কি স্বাভাবিক নয়? ভাইয়া আর ভাবি দু’জন দুপ্রান্তের মানুষ। তবুও কিরণকে কেন বিষয়টা এত কষ্ট দিচ্ছে কে জানে?

কাবির গোটা গোটা সাতদিন বাড়ি ফেরেনি। অবশ্য ফোনে যোগাযোগ রেখেছে লুবনা বেগমের সাথে। সেদিন সকালে ফোন দিল। ইথিকা এখন একটুআধটু হাঁটছে। হুইল চেয়ার আর ব্যবহার করতে চাইছেনা সে। বাড়িতে মায়ের বকুনির ভয়ে জোর করে ব্যবহার করতে হতো।

সে রান্নাঘরে কল্পনা আর কিরণের পাশে দাঁড়িয়ে ওদের বলছে একটা রেসিপি বানাতে। ওখানে কি কি লাগে সেগুলো যোগাড় করছে কল্পনা আর কিরণ।

তখুনি কাবিরের ফোন এসেছে। ইথিকা স্পষ্ট দেখলো লুবনা বেগম কাবিরের সাথে কথা বলছে। কিন্তু তবুও সে কিছু বললো না।

কল্পনা নাশতাটা বানিয়ে প্লেটে তুলে ইথিকার দিকে বাড়িয়ে দিল। ইথিকা একা খেল না। ভাগ করলো। তারপর নিজের ভাগেরটা নিয়ে ঘরে চলে এল।

____________

কাবির কাজের প্রেক্ষিতে ঘুরছে এই জেলা থেকে ওই জেলা। সেদিন জুমার নামাজ পড়ে বাড়িতে এল। লুবনা বেগম বলেছেন, আজ যেন সে খাবারটা বাড়িতে খায়। বাইরে যত দামী খাবার খাক না কেন বাড়ির রান্না কাবিরের পছন্দের। মায়ের হাতের রান্নার তুলনায় হয় না।

কাবির আসায় লুবনা বেগম ভীষণ খুশি হয়েছেন। সকাল থেকেই রান্নাঘরে কাজকর্ম চলছিল। ইথিকা গরম পানি নেয়ার জন্য এসেছিল দু একবার। কিছুক্ষণ বসেছিল। লুবনা বেগম চলে যেতে বলায় আবার ঘরে চলে গিয়েছে। এমন নয় যে পিরিয়ড চললে সে ঘরের কোণায় বসে থাকতো। কিন্তু ওই ঘটনাটির পর দীর্ঘদিন অসুস্থতা আর শরীরের উপর নানা ঝড়ঝাপটার কারণে এইবারের পিরিয়ডের সময় কোমর বসে আসতে চাইছে। এমন পেইন কখনো লাগেনি। সাথে মাথাটাও চরম ব্যাথা করছে।

কাবির বসার ঘরে বসা ছিল। বাবা জেঠুর সাথে কথাবার্তা বলছিল। সাথে করে একজন ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে। তিনি তার ব্যবসায়িক সম্পর্কের মানুষ। সে প্রায়সময় এভাবে সাথে করে দু একজন বাড়িতে নিয়ে আসে। সেও যায়। আত্মীয় অনাত্মীয় মানুষের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক।

কাবির এসেছে শুনে লায়লা খালা সবার আগেই ইথিকার ঘরে ছুটে গেল। ইথিকা গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছিল। লায়লা খালা দরজার সামনে থেকে উঁকি দিয়ে বলল,

“বউ সাহেব মিয়া আইছে।”

ইথিকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। একটু থেমে বলল,

“আমাকে কি করতে বলছেন?”

লায়লা খালা ভড়কে গেল। এটা কেমন ধরণের প্রশ্ন করে এই মেয়ে। তার জামাই বাড়িতে থাকেনা এই নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। এখন এসেছে তা নিয়েও খুশিটুশি নেই। এক আজব জামাই বউ তারা। তাইলে কীসের দায়ে এমন সংসার করতাছে এরা?

“কিছু করোন লাগবো না। এমনি কইতাছি।”

“এমনি এমনি বলা লাগবে না।”

লায়লা খালা চলে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে লুবনা বেগমকে বললেন,

“কইছি তোমার জামাই আইছে। বাপরে বাপ আমারে যে ঝাড়ি মারলো। আমি আর জীবনেও কথা কইতাম না তোমাগো বউয়ের লগে।”

লুবনা বেগম কড়া গলায় বললেন,

“তুই সব জায়গায় পন্ডিতগিরি দেখাস। তোকে কে বলেছে বলতে? থাকুক কিছুদিন দূরে দূরে।”

অবশ্য তাদের ধারণা ভুল। ইথিকা ঘর থেকে বেরিয়ে একটু গা ঢাকা দিয়ে কাবিরকে দেখেছে। সাদা পাঞ্জাবি পরে সোফায় বসে গল্পগুজব করছিল। মনে হচ্ছিল এই বাড়ির মেহমান।

_______

ভাত তরকারি বেড়ে খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। কল্পনা আর কিরণ কাসেদকে তাড়া দিল সবাইকে ডেকে আনার জন্য।

ইথিকা ঘর থেকে বেরোলো। ঠিক সে-সময় বাবা ভাইদের সাথে কথা বলতে বলতে কাবির আসছিল।

তখুনি ইথিকার সাথে একঝলক চোখাচোখি হলো। দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।

কাওসার দেওয়ান বললেন,

“বৌমা খেয়েছ?”

ইথিকা বলল,

“না।”

“খেয়ে নাও খেয়ে নাও। তোমার তো মেডিসিন আছে। কাবির এসো।”

সবাই ভেতরে চলে গেল। কাবির দাঁড়িয়ে রইলো। ইথিকার দিকে তাকালো। লিনেন কাপড়ের সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। ওড়নাটা বুকের সামনে ভি আকৃতির ভাঁজ করে দুই কাঁধে তুলে দিয়েছে। পূর্বের ভঙ্গিতে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম। দেখে ভালো লাগছে।”

কাবির মাথা একটু দুলিয়ে বলল,

” ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম ওইদিন।”

ইথিকা সাথে সাথে বলল,”ও হ্যাঁ তখন রান্নাঘরে ছিলাম। পরে ব্যাক করতে ভুলে গিয়েছি।”

কাবির আর কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল। ইথিকা বলল,

“একটা কথা বলার ছিল আপনাকে। সামনাসামনি বলবো ভেবেছি।”

“বলো।”

ইথিকা বলল,

“ড্যাড বলেছে কাগজপত্রের বিষয়টা ভেবে দেখতে। যেহেতু ইলেকশনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি তো আর খালি হাতে যেতে পারিনা।”

কাবির যা বুঝার বুঝে গেল। বলল,

“সেটা আমার মাথায় আছে। ইলেকশনের আগেই তুমি কাগজপত্র পেয়ে যাবে হাতে।”

“জি ধন্যবাদ।”

কাবির আর কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেল। ইথিকা রান্নাঘরে চলে এল। তার হাঁটতে একটু সময় লাগছে। লুবনা বেগম বলল,

“ঝিনুক নিয়ে যাচ্ছিল তোমার খাবার। আসতে গেলে কেন আবার?”

ইথিকা বলল,”খাব না। আমার খিদে নেই। এটা বলার জন্য এসেছি।”

“এমা খাবেনা কেন? বসো। দুপুরে কেউ না খেয়ে থাকে? বসো বসো। আমি বেড়ে দিচ্ছি।”

লুবনা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইথিকা হঠাৎ করে বলল,

“আপনি আমাকে সব বলেন। কিন্তু আপনার ছেলে আসবে সেটা একবারও বলেননি।”

লুবনা বেগম একটু থমকালেন। কারণ কথাটাতে একপ্রকার অভিমান লুকিয়ে ছিল। তিনি বললেন,

“তুমি রাগটাগ করবে তাই বলিনি।”

“রাগ করবো সেটা কেন মনে হলো?”

“লায়লা বলায় রাগ করোনি?”

_____

কাবির খাওয়াদাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে সামনে এল। বেরিয়ে পড়ার আগে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। তখুনি দেখলো লুবনা বেগম ভাত মাখছেন। ইথিকা পাশে বসা। উনি ইথিকাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। শ্বাশুড়ি বৌমা কথা বলতে বলতে হাসাহাসিও করছে। কাবির বলল,

“মা বেরোলাম। টাকাপয়সা লাগলে কাদিন কাসেদকে বলবে। আমি আসি।”

সাথে সাথে ইথিকার হাসি নিভে গেল। সে ভাত চিবোতে লাগলো। লুবনা বেগম হাত ধুয়ে হাত মোছার তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এলেন।

“আর কবে আসবে? কারখানায় কিছু সমস্যা হয়েছে বললে। সমাধান হলো?”

“হ্যাঁ হয়েছে। আমি আসার আগে ফোন করে জানিয়ে দেব।”

“সাবধানে যেও।”

“ওর কিছু লাগে কিনা জেনে নিও। এলাম তবে। আনঝিল আসছি।”

লুবনা বেগম ইথিকার দিকে তাকালেন। ইথিকা লেগপিস চিবোচ্ছিল। ওভাবে লেগপিসটা নিয়ে এসে বলল,

“দাঁড়ান।”

কাবির থেমে গেল। কিন্তু ফিরলো না। ইথিকা জানতে চাইল,

“ব্যাংক একাউন্টে একটা বড় এমাউন্টের টাকা এসেছে। কীসের সেটা?”

কাবির বলল,”দেনমোহর। আরও কিছু বাকি আছে। সেটা আগামী সপ্তাহের দিকে একাউন্টে ঢুকে যাবে। দেরী দেওয়ার জন্য দুঃখীত।”

চলমান…