#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
নাচগানের উন্মাদনায় গমগম করছে গোটা দেওয়ানবাড়ি। চারপাশে ঝাঁঝালো সাউন্ডবক্সের তালে তালে কেঁপে উঠছে বাড়ির দালান। আলো-ছায়ার খেলায় ঘরজুড়ে অদ্ভুত উন্মাদনা। এর মাঝেই সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য হচ্ছে ইলিনা বেগমও নাচছে ছেলেদের সাথে। দেওয়ান বাড়ির মানুষ শুধু হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে। এসব হচ্ছেটা কি?
ইনামকে টেনে নিয়ে এসেছিল তাহমিনা, কিন্তু ধস্তাধস্তি করতে করতে ছেলেটা আবারও ছুটে গিয়েছে চাচাদের পাশে।
আসলাম খান ক্লান্ত ভঙ্গিতে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। এক চুমুক দিয়ে হাত নেড়ে বললেন,”নাচ নাচ!”
ইনাম ছুটে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“পাপা বম ডিগি ডিগি বম বম!”
আসলাম খান হো হো করে হেসে উঠলেন। পাশ থেকে তাহমিনা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এই বয়সেও নাচার কত শখ!”
আসলাম খান হাসি থামিয়ে এবার চোখ তুলে তাকাল তাহমিনার দিকে,
“কাকে বললে? আমার মাকে? তুমি নাচতে পারবে এরকম করে? তুমি এক বাচ্চার মা হয়ে বুড়ি হয়ে যাচ্ছ। আমার মায়ের পাঁচটা বাচ্চা। তাও দেখো কত এনার্জি।”
তাহমিনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কথায় পারবে না এদের সাথে। আমি ওদিকটায় যাচ্ছি।”
আসলাম খান তার যাওয়া রুখে দিয়ে বললেন,
“কোথাও যেতে হবে না।”
“আমি কি আপনার আঙুল ধরে বসে থাকব নাকি?”
“যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছো দেখে তো মনে হচ্ছে এই বাড়িটাই তোমার শ্বশুরবাড়ি। অথচ আমাদের বাড়ির এক কোণায় চুপটি করে পড়ে থাকো।”
তাহমিনা গলা নামিয়ে বলল,
“আপনার যা মনে হয় তাই ভাবুন।”
আসলাম খান ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
“না হওয়া শ্বশুরবাড়ির প্রতি এত মায়া!”
তাহমিনা সোজা চোখে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ এত মায়া। আর ওই বাড়িটা একটা জাহান্নাম! তাই এখানে দুদণ্ড স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।”
আসলাম খানের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কাবির দেওয়ান কোথাও নেই। তাই তাহমিনাকে যেতে দিল। নইলে ডিউটি করতে হতো ওর পেছন পেছন।
_____________
কামরান দেওয়ান আর কাওসার দেওয়ান হাজির হতেই আমিন খান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আরেহ আরেহ বেয়াই সাব আসুন আসুন বসে কথা বলি। ছেলেপেলেরা মজা করুক। বিয়েতে মজা করবেনা তো কি করবে?”
কাওসার দেওয়ান কিছু বললেন না। মুরব্বিরা পাশের রুমে গিয়ে বসলো। সেখানে আমিন খান একাই কথাবার্তা বলে চললো। কামরান দেওয়ান, কাওসার দেওয়ান কেউ আগবাড়িয়ে কিছু বলতে গেল না।
এদিকে হঠাৎ হৈচৈ পড়ে গেল নীচে। নাচগানের বহর খানিকটা থমকে দাঁড়ালো। ইথিকা লেহেঙ্গা ধরে ধরে নামছে।
সবাই একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। ইথিকার গায়ে হলদে রঙের ঝলমলে লেহেঙ্গা, চুল খোলা। তার তিন ভাই একযোগে মুখে বাঁশি তুললো। আবারও গানের ঝঙ্কারে মাতোয়ারা হয়ে উঠল চারপাশ। সেও সবার সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে শুরু করলো।
চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল সবার!
দোতলায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে সবাই দেখছে ইথিকাকে। বড়ফুপু বলল,
“দেখলি দেখলি কাবিরের বউয়ের কান্ড দেখলি? এতগুলো মানুষের সামনে কেমন নর্তকীদের মতো নাচছে। তার উপর এতবড় বিপদ গেল দুদিন হয়নি। মেয়েটা এখন সবার সামনে এসে নাচগান করছে। বুড়িটাও দেখ না। নাচনেওয়ালীর সবকটা নাচুনে ছেলেমেয়ে হয়েছে।”
লুবনা বেগমও অবাক হয়ে গেছেন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা এতদিন যাবত কোনো উচ্ছৃঙ্খল কাজকর্ম করেনি। একদম শান্ত হয়ে ছিল। হঠাৎ এমন নাচার তাল উঠলো কেন?
___________
কিরণ, আর কাজিন, বান্ধবী সবাই ইথিকার নাচ দেখছে। কিরণের বান্ধবীরা তার ভাবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কি সুন্দর নাচছে!
কিরণ দ্রুত কল্পনার ঘরে চলে গেল। কল্পনা এক কোণে আয়নার সামনে বসে আছে চুপচাপ।
হলুদ, গাঢ় সবুজ, গোলাপি আর গোল্ডেন রঙের মিশেল তার লেহেঙ্গাটি। চোলিটা গোল্ডেন রঙের। হাতা তিন-চতুর্থাংশ লম্বা। গলায় সামান্য নেকলাইনের চারপাশে মুকুটের মতো নকশা আছে। পিছনে পাতলা ফিতা বাঁধা। নেটের ঘোমটায় সূর্যমুখীর পাঁপড়ির ডিজাইন। ঘোমটার চারপাশে সোনালি লেইস আর ছোট ছোট পুঁতির ঝালর। গোলাপ আর জুঁইফুলের গয়না পরেছে সে।
এমন সাজে কল্পনাকে দেখে কারও চোখ সরানো ভার। অথচ তার চোখেমুখে একরাশ বেদনা ভাসছে। কিছু্ক্ষণ আগে জেঠাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে সে। সবচেয়ে আনন্দের দিনে কাছের মানুষগুলোকেই বোধহয় বেশি মনে পড়ে।
এতদিন ধরে বিয়ে নিয়ে শত কল্পনা জল্পনা করলেও আজ কিছুই ভালো লাগছে না কল্পনার।
মনটা ভার হয়ে আছে বাবাকে নিয়ে। শিশু বয়স পেরিয়ে কৈশোর তারপর তারুণ্য সবটা কেটেছে বাবার অনুপস্থিতিতে। এখন যেই একটু একটু করে বাবার স্পর্শটা ফিরে পাচ্ছিল আবার যেতে হচ্ছে অন্য ঘরে, অন্য জীবনে।
এই সব ভাবনার ভেতরেই কিরণের গলা শোনা গেল,
“আপু নীচে কি হচ্ছে জানো?”
কল্পনা মাথা না তুলেই বলল,
“জানি।”
কিরণ অবাক হয়ে বলল,
“ভাবি পর্যন্ত নাচছে। বড়ফুপু চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। খালাম্মা আর মামিরা এটা নিয়ে বলাবলি করছে। এমনকি ভাবির মাও।”
কল্পনা অবাক হলো না। তার ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতেও ইচ্ছে হলো না।
কিরণ তার সাথে কথাবার্তা বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কল্পনা বলল,”কিরণ শোন ভাবিকে ডেকে বল বড় ভাই আসার আগে যেন সব বন্ধ করে দেয়। নইলে পরে ঝামেলা হবে। আজ অন্তত কোনো ঝামেলা না হোক।”
কিরণ বলল,”আমি যেতে পারব না ওখানে। ওরা ওখানে টেনে নিয়ে যাবে। মেঝ ভাই আর ছোট ভাইকে ইতোমধ্যে টেনে নিয়ে গেছে। ওরা কোনোমতে গা বাঁচিয়ে চলে এসেছে।”
তখুনি তাহমিনাকে দেখা গেল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে কল্পনাকে দেখে হাসলো সে।
কল্পনা খুশি হয়ে বলল,”আপা!”
তাহমিনা এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো দুজন দুজনকে। তাহমিনা তার গালে হাত রেখে বলল,
“তোকে কি মিষ্টি লাগছে রে কল্প।”
কল্পনা বলল,”তুমি একটু আগে আসবে না?”
“আমি আসব আগে? মাথা খারাপ? ইনামের বাবা আমাকে ছাড়বে একা?”
কল্পনা চুপ হয়ে গেল। সে ভুলেই গিয়েছিল আসলাম খান তাহমিনা আপার আশেপাশে কাবির দেওয়ানের ছায়াকেও ভয় পায়। সে তাহমিনার শাড়িটা ছুঁয়ে বলল,
“ভাবি পাঠিয়েছে নাকি?”
“হ্যাঁ, বললো সবাই নাকি এরকম শাড়ি পড়বে। তোর লেহেঙ্গাটাও সুন্দর হয়েছে। আমি আর কিরণ তো মিলে গেলাম।”
কিরণ হাসলো। সে শাড়িটা লেহেঙ্গার মতো পরেছে। তাহমিনাকে বলল,
“তুমি কিছু খেয়েছ?”
“হ্যাঁ খেয়েছি। ইনামটাকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। চাচাদের পেলে না ওর আর কাউকে লাগেনা।”
কল্পনা বলল,”তুমি আমার সাথে বসো আপা। আমরা কিছু কথা বলি।”
তাহমিনা বলল,”আমি আছি।”
কিরণ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কল্পনা পায়েস খাচ্ছিল। তাহমিনাকে বলল,
“আপা খাবে একটু?”
তাহমিনা বলল,”আর না রে। যথেষ্ট হয়েছে। আন্টি আমাকে পেট ভরে খাইয়েছে। শোন না একটা কথা বলার ছিল। মাজহাব ভাইয়ার বউকে দেখলাম না? উনি নাকি অনেকদিন যাবত এখানে থাকেন।”
কল্পনা বলল,”হ্যাঁ তুমি জানতে না?”
“জানতাম। কিন্তু এতদিন থাকবে সেটা তো ভাবিনি।”
“এসেছে, থেকে গেছে। আর ও চাকরি করে। সারাদিন তো বাইরেই থাকে।”
“ইথি কিছু বলেনা?”
“না, ভাবির সাথে ওর তেমন কথাবার্তাও হয় না।”
“হবেওনা। আমার ননদকে আমি চিনি। তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে তো?”
কল্পনা হেসে ফেললো।
“ননদের ব্যাপারে ঝালাই করছো?”
তাহমিনাও হাসলো।
“আর বলিস না ভাই। ওই মেয়েকে তো আমি চিনি। কি কাহিনীটাই না করলো মাজহাবের সাথে।”
কল্পনা তার দিকে একচামচ পায়েস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমাদের সাথেও প্রথম প্রথম অনেক ঝগড়াঝাটি হয়েছে। এখন ওসব হয় না। ভাবি ভাবির মতো থাকে, আমরা আমাদের মতো।”
“তাহলে তো বেশ ভালো।”
দরজা ঠেলে তখুনি কাদিন ঢুকে এল। তাহমিনাকে দেখে বলল,
“ভাবি দেখছি এখানে। আপনাকে আসলাম ভাই খুঁজছে। যেতে বলছে।”
তাহমিনা হতাশ চোখে কল্পনার দিকে তাকালো। বিষয়টা দুঃখজনক হলেও কল্পনার হাসি পেল।
সে শব্দ করে হাসলো। তাহমিনা চলে গেল। কল্পনা কাদিনকে ডাকল,”ভাইয়া পায়েস খাও।”
“না।”
“আরেহ খাও না।”
কাদিন দাঁড়ালো। কল্পনা এক চামচ পায়েস বাড়িয়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর কাসেদও ঢুকে এল। কল্পনাকে দেখে বলল,
“আরেহ ভূতনী দেখছি পায়েস খাচ্ছে।”
কল্পনা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”খাবে?”
“তুই খা।”
কল্পনা তার দিকে পায়েস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”বিয়েবাড়িতে অনেক মেয়ে এসেছে। দুজন দুটো পছন্দ করে নাও। বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
দুজনেই হাসলো। কাসেদ পায়েস খেতে খেতে বলল,
“নীচে যেতে পারলে দেখতে পেতি মাতালের নাচ চলছে।”
“এসব আর নতুন কিছু? বড় ভাইয়ের বিয়ের দিন দেখলে না?”
কাদিন বলল,”ভাবির মায়ের যে নাচ! বাবাহ!”
তিনজনই একসাথে হেসে ফেললো। সাথে সাথে দরজা ঠেলে ইথিকা ঢুকলো। তাড়া দিয়ে বলল,
“কল্প চলো চলো নীচে চলো।”
ইথিকার পিছু পিছু লুবনা বেগম ঢুকে এসে বললেন,
“না না বৌমা নীচে অনেক ছেলেপেলে। ওখানে ওকে নিয়ে যাওয়া হবে না। ওর বাবা চাচারা খেপে যাবে।”
ইথিকা বলল,”আমি নিয়ে যাচ্ছি। আমিই সাথে করে নিয়ে আসবো।”
কাদিন বলল,”ভাবি ওকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখানে স্টেজ করা হয়েছে।”
“আই নৌ কাদিন। মম ওকে দেখতে চাইছে। আমি ওকে নিয়ে যাব আর আসব। কল্প চলো।”
লুবনা বেগম বলল,”ও লজ্জা পাচ্ছে বৌমা। যাবে না। থাক বাদ দাও।”
ইথিকা বলল,”ওকে, ঘোমটা নামিয়ে দিচ্ছি হালকা করে। তাহলে আর লজ্জা পাবেনা।”
ইথিকা কারো কথা শুনলো না। কল্পনার ঘোমটা নামিয়ে দিল। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। নীচে তখনো নাচগান চলছে।
বউ হাজির শুনে সবার মনোযোগ ছুটে এল কল্পনার দিকে। ক্যামেরার লেন্স ঘুরে গেল সেই দিকেই, গানের তালে হঠাৎই বদল এল। ক্যামেরার আলো পড়লো কল্পনার মুখে। সে হালকা ঘোমটা টেনে ধরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে সাবধানে। ইথিকা তার পাশে। কল্পনার অস্বস্তি হচ্ছে খুব।
ফ্লোরের মাঝখানে থেমে গেল নাচানাচি। আশিষ আরিশের সাথে আরও অনেকেই দাঁড়িয়েছিল পাশে। আর্যাব খান তাদের সরিয়ে তাকাল গম্ভীর ভঙ্গিতে,
“বেয়াইননন হাজির! সাইড দে!”
কল্পনার দিকে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোলাপের পাঁপড়ি।
আর্যাব খান ধীরে ধীরে আশিষের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। চোখ দুটো সরু করে তাকায় কল্পনার মুখের দিকে। তারপর চিরাচরিত বদমায়েশি হাসিটা ছুঁড়ে বলল,
“বেয়াইনকে দেখে তো বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”
তারপর কাঁধের একপাশে মাফলার ছুঁড়ে তুলে এক আঙুল তুলে ইশারা করলো,
“মিউজিক!”
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপরেই ভূকম্পনের মতো কেঁপে উঠলো দেওয়ানবাড়ি। ড্রাম বিটে জমে উঠলো রক্তমাংসের স্পন্দন। আলো ঝলসে উঠলো আবার।
আর্যাব খান ধীরস্থির ভঙ্গিতে শরবতের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে গা এলিয়ে বসে পড়লো সোফায় এক পা আরেক পায়ের উপর তুলে। চোখজোড়া ধূর্ত শেয়ালের মতো টিক করে তাকিয়ে আছে সেই ঘোমটার নীচে লুকিয়ে থাকা মুখটার দিকে।
কল্পনাকে নিয়ে ইলিনা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ালো ইথিকা। ইলিনা বেগম হাসলেন। থুতনি ধরে কল্পনার মুখ তুলে বললেন,
“লজ্জা পাচ্ছ নাকি? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমরা আমরাই তো।”
কল্পনা হালকা হাসার চেষ্টা করলো। ইলিনা বেগম তার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে বললেন,”তোমার জন্য উপহার আছে। দাঁড়াও একটু। এই আর্য!”
আর্যাব খান শরবতের গ্লাসে ঠোঁট ডুবিয়ে এদিকটাই তাকিয়েছিল। মায়ের ডাকে হাত তুললো।
“ইয়েস!”
ইলিনা বেগম ইশারা করলেন।
“ওটা নিয়ে এসো।”
আর্যাব খান ধীরেধীরে সোফা ছেড়ে দাঁড়াল। পাঞ্জাবির ওপর পরা কালো ব্লেজারের ভেতরের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে বের করল একটি চকচকে রিং বক্স।
তারপর কল্পনার পেছনে এসে দাঁড়াল। কোনো কথা না বলে বক্সটা এগিয়ে দিল ইলিনা বেগমের দিকে।
ইলিনা বেগম বক্সটা নিয়ে মৃদু হাসলেন। তারপর কল্পনার ডান হাতটা তুলে আঙুলে আংটিটা পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার।”
আর্যাব খান কথার মাঝখানে বলে উঠলো,
“ছোট্ট উপহারটার দাম দুই লাখ আঠারো হাজার আটশো টাকা।”
ইলিনা বেগম ধমকালেন চোখ রাঙিয়ে। আর্যাব খান হেসে সরে গেল।
আশিষ খান আর আরিশ খানের হাতে ওয়ারলেস মাইক্রোফোন। তারা গান গাইছে। আশপাশের ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে তাল মেলাচ্ছে, কেউ কেউ গলা মেলাচ্ছে সেই সুরে।
তার মাঝেই কল্পনা বলল, “আন্টি উপরে আসুন। ছোট মার সাথে তো দেখা হয়নি এখনো।”
ইলিনা বেগম হাসিমুখে বললেন, “যাব। ইথু যাও, ওকে নিয়ে যাও।”
ইথিকা কল্পনার হাত ধরেই বলল, “চলো!”
কল্পনার পা বাড়াতেই চোখের পলকে ইথিকা কল্পনাকে ভীড়ের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। তখুনি ভেসে এল আর্যাব খানের গলার স্বর,
“মিউজিক! মিউজিক!”
ততক্ষণে কল্পনার মাথা গোলকধাঁধার ভেতর পড়ে গেছে। কারো শক্তিশালী হাত তার আঙুল ধরে তাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছিল যে পায়ের নীচের মাটিও যেন সরে যাচ্ছিল। সুর আর কোলাহলের মধ্যে সে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লো। কান মাথা ভনভন করছে।
হঠাৎ নিজেকে সামলে দাঁড়াতেই সামনে তাকিয়ে দেখল যে তার হাত ধরে এতক্ষণ তাকে ঘোরাচ্ছিল, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং আর্যাব খান!
কিছু বুঝে উঠার আগে তার ঘোমটাও তুলে দিল আর্যাব খান। কল্পনা রাগে ফুঁসে উঠলো। মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো ঠিকরে পড়ছে বিস্ময়ে। সে বুঝে উঠতে পারলো না লজ্জায় মুখ লুকাবে, না জোরে একটা চড় কষাবে।
আর্যাব খান পেছনে হাত বাড়ালো কল্পনার সাথে হেসে। ডাকল, “আশিষ!”
আশিষ খান তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে হাতে একটা গোলাপের মালা ধরিয়ে দিল।
আর্যাব খান সেই মালাটা কল্পনার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল,
“বেয়াইনের জন্য একটা বাসি ফুলের মালা। অযথা পয়সা খরচ করা আর্যাব খানের স্বভাব না।”
কল্পনা মালাটা খুলে নিচ্ছিল। আর্যাব খান মালাটা ধরে কল্পনাকে টেনে এনে বলল,
“সরি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার আনার দরকার ছিল ফেয়ার এন্ড লাভলী। বেয়াইন যে কালা সেটা তো আমার মনেই ছিল না শালা।”
বলেই হো হো করে হাসলো। কল্পনা তার দিকে চেয়ে রইলো। চোখে ভয়ংকর রাগ। সে কিছু একটা করে ফেলবে এখন। করবেই।
কাদিন আর কাসেদ নাচানাচির ভীড় ঠেলে আসতেই পারছেনা। কিরণ যেই গেল। আশিষ খান তাকে পায়ে মেরে ফেলে দিল। আবার হাত বাড়িয়ে টেনেও তুললো। ঘাড় চুলকে বলল,
“ওদিকে যাওয়া বারণ!”
কিরণ বলল,”আমি কি তোমার সাথে কথা বলছি?”
“আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”
কিরণ বলল,”নির্লজ্জ, গায়ে পড়ে কথা বলবে।”
আশিষ খান বলল,”জি জি আপনি বিশ্বসুন্দরী তাই।”
কিরণ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“এই সরো। তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাইনা একদম।”
আশিষ খান বলল,”কাক করেছে ময়ূরীর সাজ।”
কিরণ প্রচন্ড রেগে গেল। বলল,
“নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছ?”
“দেখেছি, আ”এম ড্যাম হ্যানসাম।”
কিরণ তীর্যক হেসে বলল,
“একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও তুমি ঠিক দেখতে কেমন। তোমাকে দেখলেই মানুষের বমি পাবে।”
আশিষ খান বলল,”তোমাকে দেখে অলরেডি আমার কয়েকবার বমি হয়ে গেছে।”
কিরণ বিরক্তি নিয়ে সরে পড়লো সেখান থেকে। কাদিন আর কাসেদ ভীড় ঠেলে কল্পনার কাছে গিয়ে বলল,
“কল্প চল। এই আর্য মালাটা ছাড়। আজকের দিনে অন্তত ওর সাথে বদমায়েশি করিস না। ছাড়।”
আর্যাব খান মালাটা ছেড়ে হাত ঝাড়া দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখুনি দেখলো কল্পনা মালাটা খুলে ছিঁড়ে ফেললো সর্বশক্তি দিয়ে। তারপর পায়ের নীচে ফেলে তারউপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল কাদিন আর কাসেদের সাথে।
এদিকে ইথিকা যখন গানের তালে কোমর দুলিয়ে একেবারে মগ্ন হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই কাবির পা রাখলো বাড়ির দরজায়। বেজে চলা গানের তালে চারদিক মাতোয়ারা অথচ কাবিরের ভ্রু একটুও কুঁচকালো না। বাড়িতে এমন উচ্ছ্বাস দেখে মুহূর্তেই তার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল কারা এসেছে।
তার চোখ গিয়ে ঠেকলো মাঝখানের সেই মেয়েটির ওপর।
বিচ্ছিন্ন আলোয় ইথিকা একঝাঁক ছেলে-মেয়ের মাঝখানে ঘূর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে নাচছে।
ইলিনা বেগম এসে ঝটকা দিয়ে ইথিকার হাত ধরলেন। চাপা গলায় বললেন,
“পেছনে তাকাও।”
ইথিকা থমকে গেল। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো দরজায় পাশে কাবির দাঁড়িয়ে।
চোখাচোখি হতেই ইথিকা জিহ্বায় কামড় দিল।
সবার নাচ থেমে গেল। গানের শব্দ নিস্তব্ধ হলো এক নিমিষে।
খানরা সোফায় বসে শরবত খেতে লাগলো। আর কাবির বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো চুপচাপ।
ইথিকা তাকিয়ে রইলো তার চলে যাওয়ার দিকে, তারপর হঠাৎই ছুটে গেল পেছন পেছন। কাবির থামলো না। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজার কপাট ঠেলে বন্ধ করার আগেই ইথিকা ভেতরে ঢুকে পড়লো।
ঝাঁপিয়ে পড়ে কাবিরকে জড়িয়ে ধরলো দুই হাতে। বুকের কাছে নিজেকে চেপে ধরে মুখটা তুলে আনলো তার গালের কাছে। তারপর চেপে একটা চুমু খেল।
কাবির শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ইথিকা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সরি, আমি আর কখনো নাচবো না সবার সামনে।”
কাবির তার দিকে তাকালো এবার। বলল,”কেন? ভালো লাগছিল দেখতে। দারুণ নাচো তুমি। মন ভরে গেছে আমার।”
ইথিকা তার বলার ধরণ দেখে ধীরেধীরে তাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। মুখের দিকে চেয়ে রইলো আহত দৃষ্টিতে। কাবির কিছু টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
“জোসেফরা আসছে। আপ্যায়নে ত্রুটি যেন না থাকে। আফটার অল তুমি কল্পর ভাইয়ের বউ একজনই আছ।”
ইথিকা তার পিছুপিছু ঘর থেকে বের হলো। ঠিক তখুনি বড়ফুপু তেড়ে এসে বললেন,
“বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! তুমি এভাবে বাড়ির মানসম্মান সব ডুবিয়ে দিলে?”
ইথিকা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। বড়ফুপু চেঁচিয়ে বললেন,”কি বেয়াদব মেয়ে দেখেছ তোমরা? আমার কথাকে অগ্রাহ্য করছে।”
ইথিকা নাকতুলে বলল,”আমার মম একজন নাচের স্কুলের টিচার। তার মেয়ে হয়ে আমি নাচব না তো কে নাচবে? সবসময় শাসন করবেন না। এইসব ফালতু জ্ঞান অন্যকোথাও গিয়ে দেবেন। অসহ্য! সবসময় চুপ থাকি বলে মাথা কিনে নেননি।”
বড়ফুপু তার গালে কষে একটা চড় বসালো। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। ইথিকা অবাক হয়ে তাকালো। চোখে জল টলমল করে উঠলো। কাবির ফিরতি পথে আসছিল। চড় মারাটা সে দেখেছে। ইথিকা তার দিকে টলমলে চোখে তাকালো। কাবিরের কপাল কুঁচকে গেল বিরক্তিতে। আর এইসব ঝামেলা নেয়া যাচ্ছে না। বিয়েবাড়িতেও শান্তি নেই দুদণ্ড। সে চলে গেল সেখান থেকে। থাকবে না সে আর এই বাড়িতে। ক্লাবে থেকে যাওয়া উচিত ছিল।
বড়ফুপুকে টেনে নিয়ে গেল কিরণ। ইথিকা চোখের জল আড়াল করে নীচে চলে এল।
জোসেফ আর জেসির আসার কথা ছিল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। সকাল থেকে ওদের জন্যই ভেতরে ভেতরে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছিল কল্পনা। কিন্তু সন্ধ্যায় জোসেফ জানিয়ে দিল তারা আসবে না। মুখে না বললেও ভেতরে ভেতরে অনেকটা খারাপ লেগেছিল কল্পনার।
কিন্তু সে জানত না।
এই না-আসার খবরটাই ছিল জোসেফের সারপ্রাইজের অংশ।
রাত গড়িয়ে তখন প্রায় দেড়টা বাজে।
তখনই দেওয়ান বাড়ির সদর দরজায় হইচই তুলে হাজির হলো জোসেফ। সাথে বন্ধু-বান্ধব, কাজিন।
সে এসেছে শুনে কল্পনা দোতলায় এসে দাঁড়াল। জেসি একদম বাড়ির ভেতর ছুটে এল কাউকে পরোয়া না করে। তার পরনেও লেহেঙ্গা। আর্যাব খানকে সোফায় বসা দেখে থমকে গেল। আর্যাব খান গলা কাত করে তার দিকে তাকালো।
জেসি মুখ বাঁকিয়ে তাকে এড়িয়ে গেল খুব সুনিপুণভাবে। তারপর কল্পনা আর কিরণকে নীচে চলে এল। জোসেফ আর তার কাজিনদের নিয়ে কাদিন আর কাসেদ হাসাহাসি করছে। জেসি চেঁচিয়ে বলল,
“সাইড সাইড বউ চলে এসেছে!”
সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। সমস্বরে সালাম দিল।
“আসসালামু আলাইকুম ভাবি!”
কল্পনা সালামের জবাব দিয়ে বলল,
“এত দেরীতে?”
সবাই সরে গিয়ে জোসেফকে জায়গা করে দিল। কপালের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে জোসেফ তাকে সালাম দিল। কল্পনাও হেসে তাই করলো। তা দেখে সবাই হাত তুলে হু হু করে আওয়াজ তুললো।
জামাই বরণ করে ভেতরে নিয়ে আসা হলো। জোসেফের কাজিনরা তখন নতুন বর বউকে ঘিরে রীতিমতো উচ্ছ্বাসে নাচছে। কল্পনা কথা বলছে জোসেফের সাথে। কাবির এইমাত্র বেরুলো সেটাও বললো।
ঠিক তখনই শুরু হলো কাওয়ালি গানের সুর। তবলা আর হারমোনিয়ামের শব্দ আর কাওয়ালি গানের তালে পুরো আসর বদলে গেল।
নতুন বউ-বর আর তাদের আত্মীয়-পরিজনদের ঘিরে নাচ, গান, হাততালি, হাসাহাসির মাঝখানে খানদের অস্তিত্ব মিলিয়ে গেল। ওরা একপাশে সরে গিয়ে শুধু দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমিন খান এসে বলল,”চলো সবাই। অনেক আনন্দ হয়েছে।”
আর্যাব খান বলল,”তুমি তোমার ডার্লিং নিয়ে চলে যাও। আমি আমার ডার্লিং নিয়ে তবেই ফিরব।”
ইলিনা বেগম তাকালেন জেসির দিকে। অবাক হয়ে বললেন,
“আজ এখানে কোনো সিনক্রিয়েট নয় আর্য! জেসিকে কিছু বলো না। কিছু করো না।”
আশিষ আশ্বাস দিয়ে বলল,”মশকরা করছে। চিন্তার কিছু নেই।”
আর্যাব খানের তীক্ষ্ণ, একদৃষ্টিতে খেপে চেয়ে থাকা চোখ দুটো গিয়ে তখন ঠেকেছে কল্পনার মুখে। এতক্ষণ তাকে দেখে মনে হচ্ছি যেন কেউ বোমা ফাটিয়ে গেছে তার উপর।
আর এখন?
বর আসার পর থেকে তার আনন্দের শেষ নেই। আর্যাব খান তার এত আনন্দ সহ্য করতে পারলো না।
______
বিয়ের অনুষ্ঠান রাতে। কাছের একটা নামীদামী ক্লাবে। যেহেতু আকদ পরানো হয়নি তাই সাড়ে আটটার দিকে কল্পনাকে নিয়ে ক্লাবে হাজির হওয়ার কথা ইথিকার। ইথিকাই নিজ হাতে সাজাবে কল্পনাকে এরূপ কথা ছিল। কিন্তু তার মেজাজ এতটা খারাপ ছিল বড়ফুপুর চড় খাওয়ার পর থেকে সে সাজানোর বদৌলতে একটা মেকআপ আর্টিস্ট ঠিক করে দিল। কল্পনা পার্লারে সাজতে চায়নি। যেহেতু ক্লাবে আর ফটোসেশান হবে না সেহেতু অল্প করে সাজলেই হয়ে যেত। কিন্তু ইথিকা বললো মন ভালো না থাকলে সে সাজাতে পারেনা। তাছাড়া পার্লারে সে তো থাকবে। চিন্তার কিছু নেই। তার পরিচিত পার্লার।
গাড়িতে ইথিকা, কিরণ, কল্পনা আর তাদের মামাতো বোন অহনা ছিল। সবাই কল্পনাকে হাসাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে কাঁদছিল খুব। চোখমুখ ফুলে গেছে।
পার্লার থেকে সাজগোছ করে সবাই রওনা দিল ক্লাবের দিকে। হঠাৎ ইথিকার ফোনে কল এল কার একটা ফোন তারা পার্লারে ফেলে এসেছে। কিরণ সাথে সাথে বলল,
“আমার!”
গাড়িটা অগত্যা থামাতে হলো। কিরণ অহনাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল। ইথিকাকে বলল,
“ভাবি আমরা সিএনজি নিয়ে ক্লাবে চলে যাব। আপু!”
কল্পনা চোখ বুঁজে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসেছিল। কিরণ ডাকতেই চোখ খুললো। কিরণ বলল,”আমি পার্লারে যাচ্ছি, ফোনটা ফেলে এসেছি।”
“যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।”
“আচ্ছা।”
কাবির যেহেতু ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে সেহেতু ইথিকাকে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হলো ক্লাবের উদ্দেশ্যে। কল্পনার ঘুম চলে এসেছে প্রায়।
______________
গভীর রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ। যে বাড়িটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বহুপুরোনো।
বাড়িটার রং বোঝা যাচ্ছে না। ধুলোমাখা দেওয়াল, কাঁচভাঙা জানালা, ছাদে জঙ্গল হয়ে ওঠা আগাছা। মূল ফটকের লোহার গ্রিলটা আধা খোলা, বাতাসে মাঝেমধ্যে হালকা কঁকিয়ে উঠছে। বাড়ির ভেতর আলো নেই কোথাও।
শুধু মাঝে মাঝে চাঁদের আলোয় ছায়া এসে পড়ছে ভাঙা সিঁড়ির গায়ে। সিঁড়ির কিনারায় জমে আছে পাতা, ধুলো।
দরজার নীচ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শীতল, স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। পচা কাঠ আর ছত্রাকের ঘ্রাণ। দেয়ালে পলেস্তার খসে পড়েছে। ভেতরের ইট পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। একটা জানালার পর্দা বাইরে উড়ছে হাওয়ায়।
বাড়ির অন্ধকার চৌহদ্দির ভেতরে একটা ঘর, দরজা বন্ধ, জানালায় পোকায় খাওয়া নোংরা পর্দা। ভেতরে আলো বলতে শুধু বাইরে থেকে আসা একফালি চাঁদের ঝাপসা আভা। সেই অন্ধকার ঘরের এক কোণে একটা কাঠের পুরনো খাট। খাটের ওপরে শুয়ে আছে একটা মেয়ে বধূবেশে।
সে নিঃশব্দ, স্থির। লাল শাড়ির আঁচলটা মেঝের উপর গড়িয়ে পড়েছে, গায়ে কোনো গয়না নেই। শ্বাস চলছে অল্পস্বল্প। ঘাড়ের কাছে ঘেমে উঠেছে চুলগুলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে।
ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে, ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে… কিন্তু স্বর বেরোচ্ছে না।
তখনই একটা ছায়া প্রবেশ করে ঘরের ভেতরে।
দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকেই ছায়াটা থেমে যায়।দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটার দিকে চেয়ে।
বিছানায় শুয়ে থাকা কল্পনা আধোআধো চোখে তাকায়… চোখের পাতা ভার, দৃষ্টি ঝাপসা। সে ছায়াটাকে চিনতে পেরে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। অস্ফুটস্বরে ডাকে,
“…জোসেফ!”
একটা হাত অর্ধেক উঠে যায়। আঙুলগুলো কাঁপে।
কিন্তু হাতটা হঠাৎই শক্তি হারিয়ে ধপ করে বিছানায় পড়ে যায়। ডেট রেপ ড্রাগ রোহিপনল তখন সবেমাত্র কাজ শুরু করেছে।
চলমান…..
#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
[একটা অতি জঘন্য বিশ্রী পর্ব]
কল্পনা আর ইথিকা দুজনেই নিখোঁজ হওয়ার পর কেটে গেছে দু’ঘণ্টা। সময় যত গড়াচ্ছে, আতঙ্ক ততই ঘনিয়ে আসছে। কাবির রাগে ফুঁসছিল। কিরণকে এমন বকুনি সে জীবনে কখনও দেয়নি। কিরণ বকুনি খেয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ দিয়ে টলটল করে জল পড়ছে, কাঁদতে কাঁদতে নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে।
ইথিকার ফোন বারবার ডায়াল করা হচ্ছে, কিন্তু সাড়া নেই। কাবির বসে থাকার মানুষ নয়। আসলাম খানকে জেরা করেছে সে। কিন্তু আসলাম খান সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ। সে কিচ্ছু জানেনা এসবের ব্যাপারে। ইলিনা বেগম জানালেন তিনিও কিছু জানেন না।
আশিষ খান আর আরিশ খানও ইথিকাকে ফোন করে যাচ্ছে। শুধু অনুপস্থিত আর্যাব খান। তাকে অনুপস্থিত দেখে আর কারো সন্দেহ রইলো না এসবের পেছনে কার হাত থাকতে পারে।
ক্লাবের ভেতর সবাই অস্থিরভাবে পায়চারি করলেও কাবির বেরিয়ে পড়েছে অপেক্ষা না করে। কল্পকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে।
কাদিন আর কাসেদের সাথে ক্লাবেই আশিষ আর আরিশের সাথে কথা কাটাকাটি লেগে গেছে। আর কথা কাটাকাটি একপর্যায়ে মারামারি পর্যন্ত গড়ালো। কাদিন ইচ্ছেমতো মেরেছে আশিষকে। সবাই মিলে না ছাড়ালে খুনাখুনি হয়ে যেত। কাদিনকে ধরে রেখেছে সবাই। কাদিন বলল,
“এই কুত্তার বাচ্চাগুলো জানে কল্প কোথায়। ওরা সবাই চালাকি করছে।”
বড়ফুপু বললেন,”সব নষ্টের মূল কাবিরের বউ। আমি বলেছিলাম ওই মেয়ে শেষ করে দেবে সব। কেউ আমার কথা শোনেনি।”
জোসেফের মা বোন সবাই ক্লাবে এসে সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। জোসেফের মা জাহানারা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“কল্প আর্যর সাথে?”
কামরান দেওয়ান বললেন,”না জেনে এভাবে বলাটা ঠিক না বেয়াইন। আমরা এখনো জানিনা কল্প কোথায়, কার সাথে।”
জাহানারা বেগম বললেন,
“কাল অনুষ্ঠানেও ছেলেটা কল্পকে মালা পরিয়েছিল। আপনারা তখনো কোনো সন্দেহ করেননি?”
সবাই কপাল কুঁচকে তাকালো উনার দিকে। কামরান দেওয়ান অবাক হয়ে বললেন,
“মালা?”
জাহানারা বেগম উনার হোয়াটসঅ্যাপে আর্যর ফোন থেকে আসা ছবিটা দেখালেন সবাইকে। কামরান দেওয়ান বলল,
“ওই পরিবারের সবকটা ছেলে এমন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই বেয়াইন।”
“তাহলে এখন কি হবে?”
“কল্পকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“আর না পেলে তখন?”
লুবনা বেগম একটু কড়া গলায় বললেন,
“মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না আর আপনি ভাবছেন না পেলে তখন কি হবে?”
ইলিনা বেগম আসলাম খানের সাথে কথা বলছে। ফোন করছে একের পর এক। আসলাম খান বলল,
“মরেছে মনে হয়। একটাও ফোন ধরছেনা কেন?”
ইলিনা বেগম ঘামছে। আর্য কোনো অঘটন ঘটালে দেওয়ানরা এবার ছাড়বে না। কি যে হবে। ইথু কোথায় গেল। সেও আর্যর সাথে তাল মিলিয়েছে নাকি? তিনি আশিষের কাছে গেলেন। কাদিনের হাতে মার খেয়েছে। রাগে ফুলে বসে আছে। ইলিনা বেগম বললেন,”আর্য কোথায় আশিষ?”
আশিষ চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে।
“জাহান্নামে গেছে।”
“একচড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব। তুমি জানো কিছু? জেনে থাকলে বলো। আরিশ তুমি জানো? সত্যি কথা বলো আমাকে। তোমার ড্যাড জানলে কি হবে ভাবতে পারছো?”
আরিশ বলল,”আমি জানিনা কিছু। জানলে অবশ্য বলতাম।”
ক্লাবে জাহানারা বেগমের সাথে বড়ফুপুর কথা কাটাকাটি লেগে গেছে। জাহানারা বেগমের মতে সবাই সবটা জেনেশুনে কল্পকে উনার ছেলের ঘাড়ে তুলে দিতে চেয়েছে। বড়ফুপু বললেন,
“ছেলেমেয়েরা একে অপরকে পছন্দ করে বিয়ে করছে সেখানে অন্যজন এসে পড়লে মেয়েটার কি দোষ? আপনি শুধু আমাদের মেয়ের দোষ দেখছেন বেয়াইন?”
জাহানারা বেগম বললেন,”মেয়ের দোষ দিচ্ছি না। দোষ আপনাদের। আপনারা দেখেছেন মেয়েটার পেছনে পড়েছে ওই বাড়ির ছেলে। কিন্তু আপনারা চুপ থেকেছেন। দেখেও না দেখার ভান করেছেন। আপনারা কথাবার্তা বলে সমাধান করে নিতে পারতেন।”
বড়ফুপু বিরক্ত হয়ে বলল,
“আপনি তখন থেকেই একটা কথা বলে যাচ্ছেন শুধু। আমরা কিছু জানতাম না। ওই ছেলে আপনার মেয়ের পেছনেও তো পড়েছিল। সেটা অস্বীকার করবেন?”
“অস্বীকার করবো না। কল্পর পেছনে পড়েছে বলেই তো জেসিকে ছেড়েছে। নইলে কি ছাড়তো?”
লুবনা বেগম বললেন,
“তাহলে আপনি চুপ ছিলেন কেন? জেনেশুনে আপনি কেন মেয়েটাকে বউ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন?”
“আমার ছেলের জন্য। তার সাথে ওই ব্যাপারে কথায় বলতে পারিনি। সে শুনতেই ইচ্ছুক নয়। এখন মিললো তো আমার কথা। জেসি দেখলে তো? কাল আমার ছবিটা তোমার ভাইয়া দেখতেই চাচ্ছিল না।
জেসি চুপ করে আছে। সবটা অবিশ্বাস্য লাগছে তার। সে ভাবিকে জিজ্ঞেস করেছিল ভাইয়ার সামনে আর্য তাকে পছন্দ করে কিনা। ভাবি চমকে উঠেছিল।
তাহলে কি আসলেই কিছু টের পাননি ভাবি? নাকি ভেতরে ভেতরে টের পেয়েও, বিষয়টাকে তুচ্ছ ভেবে উপেক্ষা করেছেন ঘৃণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখেছেন বলে? এখন কি হবে? ভাবিকে কোথায় নিয়ে গেছে আর্য?
কাওসার দেওয়ান কিরণকে চড়ও বসিয়ে দিয়েছে। কেন সে কল্পকে একা ছাড়লো। কিরণ কাঁদছে। সবাই তাকে দোষারোপ করছে। তাকে কাঁদতে দেখে কাদিন বলল,
“এই চুপ। একদম কাঁদবি না। পার্লারে ফোন কেন ফেলে আসতো গেলি তুই? ও ওভাবে ঝিমুচ্ছিল সেটা টের পেয়েও সন্দেহ করিসনি কিছু? বেকুব মেয়ে কোথাকার।”
কিরণ বলল,”আমি কি করে বুঝবো? ভাবিকে কি কেউ সন্দেহ করেছিল এর আগে?”
কাসেদ বলল,”আরেকটা কথা বললে চড়াবো। চুপ থাক। ওর কিছু হলে তোকে ছাড়ব না আমি।”
________________
পুলিশ, র্যাব সব বাহিনীই কল্পনাকে খুঁজতে নেমেছে। চারদিকে তল্লাশি চলছে। কিন্তু তার কোনও হদিস মেলেনি এখনো।
জোসেফও আর বসে থাকেনি। শেরওয়ানি পাল্টে সে নেমে গেছে গোয়েন্দা দলের সঙ্গে। কিরণ আর অহনার কাছ থেকে সে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়েছে। তারপর তারা গিয়েছিল পার্লারে। খুঁটিয়ে তদন্ত চললো। প্রতিটি কোণ ঘেঁটে দেখা হলো। পানির গ্লাসে ড্রাগসের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
কাবির স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো!!
আর্যাব খান একজন অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা। তদন্তের নিয়মকানুন, আইনের ফাঁকফোকর, গোয়েন্দাদের মনস্তত্ত্ব সবই তার নখদর্পণে। সে জানে কিভাবে গা ঢাকা দিলে আইনের অনুসন্ধানী চোখও তাকে খুঁজে পাবেনা।
জোসেফ কাবিরকে কিছু বললো না। সে স্পষ্ট দেখলো কাবির দেওয়ান নিজের মধ্যে নেই। স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি স্তব্ধ হয়ে গেছেন।
জোসেফ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। তার কল্পর জন্য চিন্তা হচ্ছে। আর্যাব খান ওর সাথে জঘন্য কিছু করে বসবে না তো?
________________
কুয়াশায় ঢাকা বাড়িটার চারপাশ। জানালার ফাঁক গলে হুহু করে ঢুকে পড়া ঠান্ডা বাতাসে পর্দাটা বারবার দুলে উঠছে। আকাশের চাঁদটাও আজ ক্লান্ত। আলোর বদলে তার চোখে ঘুমঘুম নিস্তব্ধতা। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারির খেলা, আর বাইরে নিস্তব্ধ প্রকৃতি সব মিলিয়ে রাতটা অস্পষ্ট, অপ্রকাশ্য, ভয়ংকর বটে।
আঙুলের ফাঁকে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা সিগারেট হতে ধোঁয়া উড়ছে ঘরের মধ্যে। বিছানায় হাত পা মেলে একটা অপ্রকাশ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে কল্পনা। অদ্ভুত হলেও সিগারেটের গন্ধটা তাকে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। তার শরীরটা মোচড়াচ্ছে, কাঁপছে, মাঝেমাঝে খিঁচুনি উঠছে। কিছুক্ষণ আগে ঘামলেও এখন তার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। ভারী কিছু তার গায়ের উপর চাপিয়ে দিলে খিঁচুনিটা থেমে যেত। ছায়াটা তখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখদুটো প্রশ্নবিদ্ধ।
চোখটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে কল্পনা আরও একবার জোসেফের দিকে তাকালো। তার মস্তিষ্কে হানা দিল টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি। তার বিয়ে। বধূসাজে সে। সে জোসেফের হয়ে গেছে। তাহলে জোসেফ তার কাছে আসছেনা কেন? দূরে দাঁড়িয়ে কেন? সে আবারও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটার দিকে তাকালো। বুকভরে সিগারেটের গন্ধটা টেনে নিল। তারপর অতিকষ্টে হাতটা একটু একটু করে তুলে বাড়িয়ে দিল।
হাতটা বেশি উঠতে পারেনি ধীরেধীরে পড়ে যাচ্ছিল। তখুনি ছায়াটা হাত বাড়িয়ে দেয়। ধরে ফেলে কল্পনার হাত। কল্পনা শেষবারের মতো নিজের শক্তি প্রয়োগ করে হাতটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শরীরটা ততক্ষণে মোচড়াচ্ছে ভীষণ, মনে হচ্ছে হাত পা সহ পুরো শরীরটা যেন বেঁকে যাচ্ছে খিঁচুনির তীব্রতায়।
তার দিকে ঝুঁকে থাকা সবল পুরুষদেহটির ভারও কল্পনার খিঁচুনি থামাতে পারছিল না। সে নিজের শরীরের উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিল না। অস্থিরতায় কাঁপছে, কান্নায় গলার স্বর ফেটে যাচ্ছে, ছটফট করছে অসহায়ভাবে। শ্বাসগুলো যেন বুক চিরে বেরিয়ে আসছে। চোখের কোণে জমা হচ্ছে অশ্রু, শরীরটা ক্রমশ খিঁচে গিয়ে একপাশে জমে যাচ্ছে।
ঠিক তখুনি কল্পনা মুখের উপর একটা গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ টের পেল। সিগারেটের তীব্র গন্ধে যেখানে তার দমবন্ধ হয়ে আসার কথা সেখানে উল্টো সে সেই ঘ্রাণটাকে আকুলভাবে টেনে নিতে লাগলো নিজের ভেতর। সামনে যা ছিল ছায়া, স্পর্শ, ঘ্রাণ সবকিছুকে কম্পিত দু-হাতে আঁকড়ে ধরে সে সেই নিশ্বাসটাকে নিজের মধ্যে নিয়ে নিল কি এক অবিশ্বাস্য আক্রোশে। মনে হচ্ছিল ঠোঁটের ভেতরে পুড়ছে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। সেটাই তাকে নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করছে। অবশ্য সেটা সিগারেট নয়। পোড়খাওয়া একজোড়া শক্ত ঠোঁট । যা কল্পনার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এমনকি সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিল তীব্র ঘর্ষণে। কল্পনার শরীরটা এক মুহূর্তে মোচড়ে উঠলো পুরুষ শরীরটার তীব্র চাপে। সেই জ্বলন্ত সিগারেটের মতো আগুনমাখা ঠোঁটজোড়া তখন ধীরে ধীরে তার গলা বেয়ে নেমে আসছিল অসহ্য উত্তাপ ঢেলে ঢেলে। একটা পিস্তল, একটা ধারালো চাকু, কয়েকটা মদের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইলো ঘরজুড়ে। কল্পনা সেইরাতে নিজের ভয়ংকর মৃত্যু দেখেছে। হয়তো মরে গেলেও সে বেঁচে যেত।
চলমান…..
#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩৭
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ঘরটায় ঢুকে পড়ছে।
জানালার বাইরে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারদিক। আধখোলা চোখে শুয়ে আছে কল্পনা। চোখের পাতা এতটা ভারী যে তুলতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরটা অদ্ভুত রকমের হালকা লাগছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা। হাত-পা নিস্তেজ। দুদণ্ড শক্তি নেই তার শরীরে।
শরীরটাকে সোজা করে একটু উঠে বসার চেষ্টাও দুরূহ কাজ। চোখ মেলে একটু তাকানোর চেষ্টা করলো তার পরপরই ক্লান্তিতে আবার চোখ বন্ধ হয়ে এল। ধীরে ধীরে আবারও ঝাপসা হয়ে এল দৃষ্টিপট। চুপচাপ ঘোরলাগা নিঃস্তব্ধতায় সে পড়ে রইল বিছানায়।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে কল্পনার কানে ঠকঠক শব্দ ভেসে এল। দূরে কোথাও কেউ অবিরত হাতুড়ি চালাচ্ছে। দেয়ালে পেরেক ঠোকার মতো শোনাচ্ছে। নিশ্চিত হতে পারছে না সে। মাথার ভেতর যেন কিছু থেঁতলে যাচ্ছে। কপাল জুড়ে একটানা যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না।সবকিছু ঝাপসা। সে কোথায় আছে, কীভাবে এখানে এল, এমনকি সে শুয়ে আছে না বসে, সেটাও বোঝার মতো ক্ষমতা নেই তার।
অবচেতন মন শুধু এটুকুই জানে জোসেফ এখানেই তার আশেপাশে আছে। সারারাত ছিল। তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল সারা রাতভর। কতক্ষণ ধরে সে ঘুমিয়ে ছিল সে তাও জানেনা। কিন্তু তার শরীরের প্রতিটি শিরায়, ঘাড়ের পাশে, আঙুলের ফাঁকে এখনো জোসেফের স্পর্শ লেগে আছে সেটা অনুভব করতে পেরেছে সে।
_____________
“তুমি ওকে খুঁজলেও পাবেনা জোসেফ। আর্য কল্পকে নিয়ে যেতই। আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি। কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। তুমিও দেওয়ান পরিবারের সদস্যদের মতো বিষয়টা আমলে নাওনি।”
জোসেফ মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। চোখজোড়া টকটকে লাল। জাহানারা বেগম থামলেন না। বললেন,
“হতেও পারে কল্পও সেটা বুঝতো। তার পক্ষ থেকেও কিছু ছিল। তাই তো জেসিকে সে বারণ করে দিয়েছিল..
জোসেফ মাকে থামিয়ে বলল,”এরকম কিছুই ছিল না মা। আমি কল্পকে চিনি। ও আর্যাব খানকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। ওই নামটা অব্দি সে নিতে চাইতো না। ওরকম একটা ঘৃণ্য পুরুষ মানুষের সাথে সে স্বেচ্ছায় যাবে সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না। ড্রাগস দেয়া হয়েছে ওকে। ভয়ংকর ড্রাগস। এতকিছু শোনারও পরও তুমি কি করে কল্পর উপর আঙুল তুলছো আমি জানিনা।”
জাহানারা বেগম বললেন,”আর কোথায় খুঁজবে তুমি কল্পকে? সারারাত খুঁজলে, পেলে না। আর কিছুক্ষণ পর ভোর হবে।”
জোসেফ সবেমাত্র ক্লাবে এসে বসেছে। সারারাত ছোটাছুটির উপর ছিল। আবার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যাবে। কাবির দেওয়ানের ওয়াইফকে খুঁজে পেতে হবে আগে। তাহলে আর্যাব খানের খোঁজ পাওয়া যাবে। পুলিশ আর্যাব খানের নাগালও পাচ্ছে না। সন্দেহ করা হচ্ছে সে কোনো গুপ্ত জায়গায় গা ঢাকা দিয়েছে।
জোসেফ মায়ের সাথে আর তর্কে না গিয়ে চুপ করে বসে রইলো। দরদর করে ঘামছে তার কপাল।
কল্পনার শেষ মেসেজটা বারবার মনে পড়ছে,
“আমি ছবি পাঠাচ্ছি না। সামনাসামনি বউয়ের সাজে দেখবেন।”
কিন্তু দেখা আর হলো না। কিচ্ছু হলো না। এক রাতেই সব শেষ। সব স্বপ্ন, সব পরিকল্পনা, সব অপেক্ষা শেষ। এমন একটা জায়গায় গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে জোসেফ বুঝে উঠতে পারছেনা তার কি করা দরকার এই মুহূর্তে।
আর্যাব খানের নামটা মনে হতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। নিজের বোনকে ঠকানোর অপরাধে যে ছেলে একটা মানুষকে মৃত্যু দিতে পারে সেই ছেলে কি কখনো অন্য একজনের বোনের ইজ্জত নিতে পারে?
নাকি তাদের বেলায় সব নিয়ম উল্টো? শুধু অন্যদের বেলায় শাস্তি প্রযোজ্য, আর তাদের বেলায় সব খুন মাফ?
র্যাবের চৌকস অফিসাররা বিষয়টা শুরুতেই পারিবারিক বিবাদ বলে পাশ কাটাতে চাইছিল। জোসেফ বুঝে গেছে আর্যাব খানের বিরুদ্ধে কেউ সহজে মুখ খুলবে না। উপরে যারা বসে আছে, তারা জানে আর্যাব খান কে? তার হাত কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে সেই হিসেব ভালো করেই রাখে তারা।
আর্যাব খান যদি এখনই ফিরে আসে তবুও আমিন খান তাকে আইনের গণ্ডির বাইরে রাখবে। এমন সাক্ষী দাঁড় করাবে যেগুলো চোখের সামনে সত্য থাকা সত্ত্বেও মিথ্যে প্রমাণ করে ফেলবে সব।
জোসেফের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। রক্তচাপা রাগ তার আঙুলের ফাঁক গলে পড়তে চাইছে। আর্যাব খান যদি কল্পনার কোনো ক্ষতি করে, যদি এক চুল স্পর্শও করে তাকে… তাহলে সেই জানোয়ারকে সে গুলি করবে নিজের হাতে। দরকার হলে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজে জেলে যাবে। কিন্তু মারবেই।
___________
ইথিকার ফোন নম্বরের শেষ ট্রেস পাওয়া গিয়েছিল। সেই স্থানেই পৌঁছেছে সবাই। সারারাত নির্ঘুম, অনাহারে আছে কাবির, কাদিন, কাসেদ, জোসেফ সবাই। তারা যে জায়গায় এসেছে তা ভয়ানক নির্জন, অন্ধকারে ডুবে থাকা একটি পরিত্যক্ত এলাকা। চারপাশে কোথাও কোনো জনবসতি নেই।
একটি সরু, অগোছালো রাস্তা চলে গিয়েছে ভেতরে। জায়গাটা ভীষণ নির্জন। এখানে ইথিকা কি করছিল তা সম্পর্কে ধারণাও করতে পারছে না কাবির।
চার-পাঁচজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা উপস্থিত সেখানে। তাদের মধ্যে একজন মহিলা জিন্নাত সিদ্দিকী। তিনি একজন দক্ষ সাইবার স্পেশালিস্ট। তিনি স্পষ্ট বললেন,
“আনঝিল খানম সেসময় এখানেই ছিলেন। হয়তো আশেপাশে আছে এখনো।”
জোসেফ বলল,”তাহলে আমাদের খুঁজে দেখতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।”
কাবির বলল,”আপনি নিশ্চিত?”
জিন্নাত সিদ্দিকী বললেন,”ইয়েস মিস্টার দেওয়ান। আমাদের এই সূত্র ধরেই এগোতে হবে।”
কাদিন জানতে চাইল,”এই পথটা কোথায় গিয়ে থেমেছে?”
কাবির বলল,”তুমি দেখতে পাচ্ছ না এদিকে মানুষজনের হাঁটাচলা নেই?”
কাদিন তার কথার জবাবে বলল,”তাহলে ওরা এদিকেই গিয়েছে সেটা নিশ্চিত কিভাবে হলেন?”
কাবির পথটার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ভেবে বলল,
“আমাদের শেষ অব্ধি দেখতে হবে। তাহলে কিছু একটা আন্দাজ করা যাবে। আর কিছু করার নেই।”
জোসেফ তাড়া দিল। সে একটুও সময় নষ্ট করতে চাইছেনা। সে নিশ্চিত আনঝিল খানম যেখানে উপস্থিত সেখানে আর্যাব খানও আছে। এমনকি কল্পনাও।
__________
কল্পনা নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। জানালাটা টেনে বন্ধ করে দেওয়া। বাইরের হাওয়া কিংবা শব্দ যেন তার স্বপ্নে ব্যাঘাত না ঘটায় তার জন্য। এরূপ নিস্তব্ধতায় হঠাৎ নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে একজোড়া পা। সাদা মার্বেলের মতো মসৃণ ত্বক, নখে হালকা রঙের পালিশ। সেই পায়ের ছায়া পড়ে বিছানার পাশে। ধীরে ধীরে দেখা মেলে পুরো অবয়বের এক নারী। অলঙ্ঘনীয় সৌন্দর্যে মোড়া সে। মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত সবকিছুতে আভিজাত্যের অহংকার তার।
সে এগিয়ে আসে কল্পনার দিকে। নিঃশব্দে বসে পড়ে বিছানার পাশে। হাতে একটা সিরিঞ্জ। এক নিঃশ্বাসে খুব সুনিপুণভাবে দক্ষ হাতে কল্পনার বাহুর কাছে সিরিঞ্জটি পুশ করে দেয় সে। কল্পনার শরীর সামান্য কেঁপে ওঠে কিন্তু সে ঘুমন্তই থাকে।
কাজটি শেষ হতেই নারীটি একবার কল্পনার মুখপানে তাকায়। তারপর নিঃশব্দ পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কল্পনা কতক্ষণ বিছানায় পড়ে ছিল কে জানে? যখন সে একটুখানি চোখ মেললো, শরীরে জোর পেল তখন প্রায় দুপুর। কিন্তু ঝিম ধরা প্রকৃতিতে এখনো সূর্যের দেখা মিলেনি।
সে অস্থিরতায় ছটফট করে উঠলো। অবিশ্বাস্যভাবে চোখদুটো ভালো করে মেলতে না পারলেও বিছানা থেকে নেমে কেমন খোঁড়া পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তাকে দেখে যে কারো হুট করে মনে হবে গায়ে অশরীরী ভর করেছে। হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল কল্পনা।
দেয়ালে পিঠ চেপে চোখজোড়া একদম বুঁজে বসে রইলো। অস্ফুটস্বরে কিছু একটা উচ্চারণ করলো।
একটু সময় পরে কোথা থেকে যেন আবার একরাশ শক্তি ফিরে এল তার শরীরে। সে দাঁড়িয়ে পড়লো। এবার আরও অস্থিরভাবে হেঁটে চললো হুড়মুড় করে। চোখে দেখছেনা ভালো করে তবুও।
আবারও একটা হোঁচটা খেল। এবার ঝাপসা ঝাপসা দেখলো সামনের স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ির মাথায় একটা লোক বসে আছে। পরনে কালো পোশাক। পিঠ করে বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। ঠিক তখনই কল্পনা পেছন থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আঁকড়ে ধরে।
লোকটা স্থির হয়ে যায় মুহূর্তে। পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া শরীরটার কাঁপুনি ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে ওঠে। কল্পনার খিঁচুনি শুরু হয়ে গেছে। এনব খিঁচুনি দেখে মনে হলো তার শরীরটা অসম যুদ্ধের ময়দানে লড়ছে নিজের সত্তার সাথেই। খিঁচতে খিঁচতে জমে যাচ্ছে সে।
লোকটা ধীরে ধীরে তাকে সামনে ফিরিয়ে আনে। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার দেহ। কল্পনার মাথা হেলে পড়ে লোকটার বুকে। নিঃশ্বাস হাঁপাচ্ছে, ঠোঁট কেঁপে উঠছে অস্পষ্ট কিছু বলার চেষ্টা করে।
লোকটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ, নিঃশব্দে, নিঃসীম কৌতূহলে ভরা দৃষ্টিতে। কল্পনার চোখ বুঁজে আসে আবার। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে ধীরেধীরে।
কিছুটা দূরে সেই নারীটি এসে দাঁড়ালো তখুনি। আনঝিল খানম!
গম্ভীর মুখে বলল,
“ইটস নর্মাল! ঔষধ কাজ করছে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। জাস্ট ভাবো ও এই অবস্থায় এভাবে হেঁটে চলে এসেছে যখন একটু সুস্থ হবে তখন কি করবে।”
আর্যাব খান একটাই উত্তর দিল,”মেরে শুইয়ে দেব।”
চলমান…….