মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
1

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩৮
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

সরু রাস্তাটা পার হতেই একটা বড় রাস্তার খোঁজ মিললো। সেখানে দু’পাশে গড়ে উঠেছে স্থানীয় লোকজনের বসতি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টিনের চালা, পাকা দালান, ছোট ছোট দোকান, আর দূরে দেখা গেল একটা খাল। সেখানে কিছু বাচ্চা জাল ফেলে মাছ ধরছে। এক এক করে প্রতিটি জায়গায় খুঁজে দেখা হলো। সময় গড়িয়ে দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও কল্পনার খোঁজ মিললো না।

শেষমেশ আবারও গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। গাড়ি ঢুকে পড়লো আরও নির্জন জায়গায়। চারপাশে শুধু গাছপালা আর পাখির ডাক। যত এগোচ্ছে ততই আলো কমে আসছে। সূর্যের রশ্মি পাতার ফাঁকে পেরিয়ে আসতে পারছেনা মাটির কাছে।

কাবির পানির বোতলটা ঠোঁটে তুলে গলা ভিজিয়ে জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বসে আছে। চোখের নীচে কালি, কপাল কুঁচকে আছে দুশ্চিন্তায়।অনিদ্রা, অনাহার, ক্রোধে সে অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

জোসেফ একপলক তার দিকে তাকালো। আনঝিল খানমের নাম অব্ধি নেয়া যাচ্ছে না তাঁর সামনে। তিনি শুধু চাইছেন আনঝিল খানমের খোঁজ। তার নাম ধাম ধরে আর কোনো কথা নয়।
কোনো কথা শুনতে সে ইচ্ছুক নয়।

জোসেফ জানেনা সামনে কি হবে। সে শুধু কল্পকে উদ্ধার করতে চায়। আর ওই আর্যাব খানের চরম শাস্তি। দরকার পড়লে ভয়ংকর মৃত্যুও।

হঠাৎ জোসেফের ফোন বাজলো। মায়ের ফোন। সে ধীরেসুস্থে ফোনটা রিসিভ করলো।

“মা এখনো গাড়িতে আমরা।”

গাড়িটা তখনো সুনসান সরু পথ ধরে এগোচ্ছে। সবাই সতর্ক হয়ে আছে। বিপদ চতুর্দিকে। বলা যায় না কখন কি ঘটে যায়।

জোসেফের মা অস্পষ্ট স্বরে কথা বলছে। জোসেফ জানে মা বলবে ফিরে যেতে। কল্পকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় যতক্ষণ না আর্যাব খান চায়।

মা কল্পকে কেন অপছন্দ করে তার কারণটা সে আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। আর্যাব খান কল্পর পিছু নিত বলে? কিন্তু এতে কল্পর দোষটা কোথায়? জোসেফ জানে কল্প ওই লোকটাকে পছন্দ করে তো দূর তার নামটা অব্দি উচ্চারণ করতে চাইতো না। সে মনেপ্রাণে অসম্ভব ঘৃণা করে আর্যাব খানকে। বাবাকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীকে ঘৃণা করবে নাই বা কেন?

জোসেফ শেষমেশ বলল,”মা কিছু শুনতে পাচ্ছি না। নেটওয়ার্কের সমস্যা বোধহয়।”

জাহানারা বেগম অনেকক্ষণ পর স্পষ্টভাবে বললেন,”জোসেফ আমি দেওয়ান বাড়ির বউকে দেখলাম এইমাত্র। আমার পাশ দিয়ে গাড়ি করে গেল। চোখে কালো সানগ্লাস ছিল। আমি নিশ্চিত ওই আনঝিল। তোমরা ওখানে কি করছো? ওরা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চলে এসো তোমরা।”

জোসেফ ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে বসলো।

“মানে! আনঝিল খানম ওখানে?”

তার কণ্ঠে বিস্ময় আর ক্রোধ একসাথে। পাশে বসা কাবিরও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। চোখেমুখে বিস্ময়, কৌতূহল।

জাহানারা বেগম বললেন,

“হ্যাঁ, আমি এইমাত্র দেখলাম। নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে গেল মাত্র। মনে হচ্ছে খান বাড়িতে যাবে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।”

জোসেফ বলল,”মা এটা সিরিয়াস ইস্যু। তুমি সত্যি দেখেছ?”

“তুমি মাকে অবিশ্বাস করছো জোসেফ?”

জোসেফ বলল,”না কিন্তু….

তোমার পাশে কেউ আছো?”

“হ্যাঁ, জেসি আর তোমার বাবাও দেখেছে। জিজ্ঞেস করো।”

জাহানারা বেগম জেসিকে ফোনটা দিলেন। জেসি ফোন কানে চেপে বলল,

“ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলে এসো তোমরা। আমি আনঝিল খানমকে দেখলাম এইমাত্র। আশিষ আর আরিশের সাথে। আমি নিশ্চিত ওরা খান বাড়িতে গেছে। আর্য কোথায় ওরা সবাই জানে।”

জোসেফের বাবাও একই কথা বললো। জোসেফ তার টিমের কয়েকজনকে দ্রুত বিষয়টা জানালো। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিল তারা। কাবির বলল,

“জোসেফ আমরা আরও কিছুদূর যেতে পারতাম।”

জোসেফ বলল,”আনঝিল খানম বলতে পারবে কল্প কোথায়। আমাদের তাড়াতাড়ি তার কাছে যেতে হবে।”

কাবির জোসেফের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। কিন্তু তার মন কেন যেন সায় দিচ্ছে না এভাবে মাঝপথ থেকে চলে যেতে। এটা আনঝিল খানমের নতুন চাল নিশ্চয়ই। তাদের মিসলিড করছে এভাবে যাতে তারা সঠিক গন্তব্যে না পৌঁছায়।

জোসেফ কাবিরের কথা শুনে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিল সে তার টিমের সাথে সামনে এগিয়ে যাবে। আর কাবির ফিরে যাবে শহরে।

কাবির তার সিদ্ধান্তে খুশি হলো। তাদের গাড়িটা ফিরতি পথে ছুটে গেল আবার। জোসেফ চলে গেল তার টিমের সাথে। যদি কাবির দেওয়ানের কথা সত্যি হয় তাহলে আজ রাতের মধ্যে কল্পকে খুঁজে পাবে সে। পাবেই।

___________

ওদের গাড়িটা যখন সুনসান রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল ঠিক তখুনি জোসেফকে তার টিমের বাকি সদস্যরা খোঁজ নিয়ে জানালো জাহানারা বেগম যা বলেছেন তা সত্যি। খান বাড়িতেই অবস্থান করছে আনঝিল খানম। জোসেফ সেটা কাদিনকে জানিয়ে দিল ফোনে।

কাদিন খবরটা পাওয়ার পরপরই শহরে ঢুকে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট কিনে ফিরল গাড়িতে। প্যাকেট খুলে কাবিরের সামনে এগিয়ে দিলো।

“বড় ভাই তোমার কিছু খাওয়া দরকার।”

কাবির চুপ করে বসে আছে। ক্লান্ত, বিষণ্ণ চোখে তাকাল খাবারের দিকে।

কাদিন অনুরোধ করল,
“না খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে কল্পকে খুঁজবে কিভাবে? একটুখানি হলেও খেয়ে নাও।”

কাবির নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। ক্লান্ত শরীরে কিছুটা খাবার চুপচাপ তুলে নিল মুখে। মুখে একটা বিস্বাদ ভাব রেখে খাবার শেষ করে বলল,

“তাড়াতাড়ি খান বাড়িতে চল। নইলে ওরা আবার গা ঢাকা দেবে।”

বিকেল হয়ে গেছে ততক্ষণে। তখনই খান বাড়ি পৌঁছেছে তারা। কিন্তু আহমেদ চাচা আর মকবুল চাচা বললেন, তারা এইমাত্র বের হয়েছে।

কাবির জানতে চাইল,”কোথায় গেছে?”

আহমেদ চাচা বললেন,

“তা তো জানিনা বাবা। হুড়মুড় করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল সবাই।”

কাবিরের কপালে হাত। আবার কোথায় খুঁজবে তাদের? জোসেফকে বিষয়টা জানাতেই জোসেফ খবর নিয়ে জানালো ওরা সবাই দেওয়ান বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। সাথে আমিন খান আর তার লোকলস্কর আছে।

কাবির কাদিনকে তাড়া দিয়ে বলল,”বাড়ি চলো দ্রুত। সময় নষ্ট করা যাবে না।”

কাদিন দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল। কাবির তার পাশে এসে বসলো। বলল,

“কাসেদকে সাবধান করো আমাদের কথা যেন ওদের না জানায়।”

কাদিন কাসেদকে মেসেজ করে দিল। কাবির কপালে আঙুল বুলিয়ে ভাবল, ওরা ঠিক কি কারণে দেওয়ান বাড়িতে যেতে পারে। তার অনুপস্থিতিতে কিছু করার মতলব এঁটেছে কি? কি উদ্দেশ্য তাদের? এত স্পর্ধা ওরা দেখায় কি করে দেওয়ানদের সাথে?

________________

বাড়ির সামনের লনের মসৃণ ঘাসে সোনালি রোদ পড়ছে। সেখানে প্যাটিও ছাতার নীচে বসানো চেয়ারে নিশ্চুপ বসে আছেন আমিন খান। চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে তিনি ভাবনায় ডুবে আছেন। তখুনি কাওসার দেওয়ান আর কামরান দেওয়ান বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ওদের আসার খবর পেয়ে। লুবনা বেগম আজ সব লাজশরম রেখে তাদের পিছুপিছু ছুটে এল কাপড়ে মুখ ঢেকে। ইথিকার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। ইথিকা আমিন খানের পেছনে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কোনো ভয় নেই, কোনো ত্রাস নেই। কি আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে! এত অপরাধ করার পরও মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এভাবে?

লুবনা বেগম বললেন,”বৌমা! কল্প কোথায়? তুমি কোথাথেকে আসছো?”

ইথিকা উনার দিকে তাকালো। কোনো জবাব দেয়ার প্রয়োজন মন করলো না। কামরান দেওয়ান গর্জন করে বলল,”এখানে কেন এসেছ তুমি? আমার মেয়ে কোথায়?”

আমিন খান পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,”আজ সব মিটমাট করে নিতে এসেছি। শান্ত হয়ে বসো সবাই। সবটা বলছি আমি।”

কামরান দেওয়ান দ্বিগুণ গর্জে উঠেন,”তোদের সাথে আর কোনো বৈঠক হবে না আমাদের। বেঈমান মুনাফিকের দল। এই বেঈমান মেয়ে জবাব দাও কল্প কোথায়।”

ইথিকা নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বলল,”আপনাদের ছেলে তো খুঁজতে গিয়েছে। সে নিশ্চয়ই কল্পকে নিয়ে ফিরছে এতক্ষণে।”

লুবনা বেগম বললেন,”তুমি কল্পর সাথে এরকমটা করতে পারলে? আমি তোমাকে কত বিশ্বাস করেছি। কিন্তু তুমি? আমার বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিলে? কাবিরকে তুমি এইভাবে ঠকালে?”

ইথিকা চুপ করে রইলো। আশিষ বলল,

“ইথু তোর যা যা নেওয়ার নিয়ে নে। আমরা আছি এখানে।”

লুবনা বেগম বললেন,”কি নেবে? কাবির না আসা অব্দি তোমরা কোথাও যেতে পারবে না। কল্প বাড়ি আসবে তারপর তোমরা ছাড়া পাবে।”

কাসেদ মাকে ইশারা করলো বড় ভাই আসছে সেকথা না বলার জন্য। কামরান দেওয়ান আর কাওসার দেওয়ানকেও চুপ থাকতে বললো। আপাতত তাদের কথায় তাল মিলাতে হবে। ইথিকার সাথে দু’জন মেয়ে এসেছে। ওদের ইশারা করলো ইথিকা। মেয়ে দুটো ফর্মাল পোশাকে। ইথিকার ইশারা পাওয়ামাত্রই তারা ইথিকার পেছন পেছন বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

বড়ফুপুকে একটা ঘরে বসিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি সেখানে বসে চেঁচাচ্ছেন। ঝিনুককে ডেকে বলছেন,

“দরজাটা খুলে দে। আমি ওই শুয়োরগুলোর মুখে ঝাঁটা মারি। ওই বেঈমান মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা দিয়ে শান্ত হই। দরজা খুলে দে তোরা।”

ইথিকা চুপচাপ হেঁটে ঘরে চলে গেল। নাজিফার সাথে দেখা হলো পথিমধ্যে। ইথিকা তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরে চলে গেল।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখলো ক্লাবে যাওয়ার আগে ঘরটা যেরকম এলোমেলো করে রেখে গেছে সে ঠিক সেভাবে এলোমেলো হয়ে আছে। তার আর কাবির দেওয়ানের কাপড়চোপড়, নানান জিনিসপত্র।

ঘরে ঢুকে তার জরুরি জিনিসপত্র গোছগাছ করে স্যুটকেসে ভরে নিতে লাগলো। মেয়েদুটো তাকে এটাওটা জিজ্ঞেস করে স্যুটকেস গোছাচ্ছে। হঠাৎ Clearblue প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটটা এসে ইথিকার সামনে পড়লো। মেয়েটা ছুটে এসে সেটা তুলে নেয়ার আগেই ইথিকা সেটা পায়ের নীচে টেনে নিয়ে বলল,”অন্য কাজ করো।”

মেয়েটা অন্য কাজে মনোযোগ দিতেই
সে কিটটা তুলে নিয়ে নিজের পার্টসে নিয়ে নিল। তারপর মেয়েগুলোর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে নিজের জরুরি জিনিসপত্র গুলো স্যুটকেসে নিয়ে নিতে লাগলো। ততক্ষণে কাবির চলে এসেছে দেওয়ান বাড়িতে। গাড়ি থেকে হনহনিয়ে নেমে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে এল সে। ইথিকাকে না দেখে আন্দাজ করে নিয়েছে সে কোথায় থাকতে পারে।

বাড়ির সবাই আতঙ্কে চুপসে গেছে। দুরুদুরু বুকে সবাই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো কাবিরের পিছু পিছু। কাবির তার ঘরের সামনে গিয়ে থামলো।
মেয়ে দুটো বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। কাবির সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল।

দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে তাকালো ইথিকা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কাবিরের দিকে। কাবির তার চোখে চোখ ফেলেনি। ওয়াশরুমে চলে গেল। ইথিকা দেখলো কাবির দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে। তার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। কি করতে চাইছে কাবির? তার আরও আগে বেরিয়ে যাওয়া উচিত ছিল? তারমানে ওরা শহরে চলে এসেছে?

ওয়াশরুমের দরজা খোলা। ইথিকা স্পষ্ট দেখলো চোখেমুখে পানি দিচ্ছে কাবির। ভেজা মুখে বেরিয়ে এসে ডিভানে বসলো। চুলও ভিজে গেছে। ইথিকা তোয়ালে খুঁজলো। পেল না এই মুহূর্তে। তাড়াহুড়ো বশত হেয়ার ড্রায়ারটা এনে বাড়িয়ে দিল। কাবির তার দিকে না তাকিয়ে হেয়ার ড্রায়ারটা নিল। ইথিকা এককোণায় দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।

কাবির ড্রায়ারটা নড়াচড়া করতে করতে তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। ইথিকা তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকালো। সাথে সাথে বিকট শব্দ!

ইথিকা কেঁপে ওঠে চোখ বন্ধ করে নিল। চোখ খুলতে খুলতে দেখলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ফাটল!

হেয়ার ড্রায়ারটাও নীচে ছিটকে পড়েছে। ইথিকা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।

কাবিরের গায়ে কল্পনার বিয়ে উপলক্ষে পরা পাঞ্জাবিটা। সে মাথা হেলিয়ে হাতায় কান বেয়ে পরা পানিটুকু মুছে উঠে দাঁড়ালো। কাবার্ড খুলে কাবিননামা, জমির কাগজ, কয়েকটা চুক্তিপত্র, তার বিয়ের শেরওয়ানি, দেওয়ানদের পক্ষ থেকে ইথিকাকে দেয়া বিয়ের লাল শাড়িটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। জমিজমার কাগজে আগুন ধরিয়ে শাড়ি আর শেরওয়ানিতে আগুন লাগাতে যাবো তখুনি ইথিকা এসে তার হাত ধরে আটকে ফেললো। দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,

“কাবির এসব ভালো হচ্ছে না।”

এক ঝটকায় তাকে ছুঁড়ে ফেললো কাবির। সে পালঙ্কের কোণায় গিয়ে পড়লো। কাগজের আগুনটা শেরওয়ানিতে ধরে গেল। তারপর শাড়িতে। বদ্ধ ঘরের ভেতর দাউদাউ করে আগুন লেলিহান শিখায় জ্বলছে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে ইথিকার। সে হঠাৎ কাশতে শুরু করল। বুকটা যেন চেপে ধরছে কেউ। ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকল ঠিকই কিন্তু বাতাসে আর অক্সিজেন নেই শুধু ধোঁয়া আর তাপ। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে গলাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে সে।

আগুনের ওপারে ডিভানে নির্বিকার বসে আছে কাবির। আগুনের প্রতিফলনে তার চোখ দুটো কেমন ভয়ানক, নির্মমভাবে জ্বলছে। একটুও দৃষ্টি সরালো না সে। ইথিকা কাশতে কাশতে তাকাল কাবিরের দিকে। তার ছটফটানিতে কাবিরের চোখের পাতা অব্দি নড়লো না আজ।

ইথিকা নিঃশ্বাস ফেলতে না পেরে ওয়াশরুম থেকে পানি আনতে যাচ্ছিল উঠে দাঁড়িয়ে। কাবির অসম্ভব শান্ত গলায় বলল,

“এই আগুন নিভলে, আগুন আমি তোমার গায়ে লাগিয়ে দেব। খবরদার!”

ইথিকা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তার সামনে এসে বসলো। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে চাবিটা খুুঁজতে লাগলো। না পেয়ে কাবিরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

“চাবি কোথায়? আমার কষ্ট হচ্ছে। চাবি দিন।”

কাবির বলল, “এই ঘরের সবকিছু পুড়বে। যেখানে যেখানে তোমার স্পর্শ লেগেছে।”

“তাহলে আগে নিজের গায়ে আগুন দিন।”

কাবির কষে চড় বসিয়ে দিল তার গালে। ইথিকা গালে হাত চেপে তার দিকে তাকালো। কাবির বলল,

“তোমার মতো মেয়ের জন্য কাবির দেওয়ান নিজের প্রাণ দেবে সেটা তুমি ভাবলে কি করে?”

ইথিকা বলল,”আমার গায়ে হাত তুলবেন না। আমি কি করতে পারি তা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই।”

কাবির তার গালে আরও একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

“আমি দেখতে চাই তুমি আর কি কি করতে পারো।”

ইথিকা কাশতে কাশতে স্যুটকেসের কাছে গিয়ে ধপ করে বসলো। আলগোছে পিস্তলটা বের করে নিল। দরজার ওপাশে সবাই দরজা ধাক্কাচ্ছে তখন। পিস্তল বের করে কাবিরের দিকে তাকাল সে।

কাবির তার হাতে পিস্তল দেখে হেসে উঠলো। ভীষণ অবজ্ঞার হাসি। গায়ে জ্বালা ধরে গেল ইথিকার। কাবির হাসতে হাসতে তার যে বউ সাজে ছবি ছিল দেয়ালজুড়ে সেটা জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ওকে, শুট মি! আজকে তুমি আমাকে মারবে নয়তো তুমি আমার হাতে মরবে। তোমাকে আমি আবার নতুন করে বাঁচার সুযোগ দেব না। তাই সময় থাকতে সদ্ব্যবহার করো। গো অন। শুট মি ইউ বিচ!!!”

সাথে সাথে ঘরটা কেঁপে উঠলো। ঝনঝন করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাঁচ ভেঙে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো।

__________

কল্পনার খিদে পেয়েছে। ঘরের দরজাটা বন্ধ। সে বিছানা থেকে নেমে দরজা ধাক্কালো। হাতে জোর নেই তবুও যেভাবে পারলো সেভাবে দরজা ধাক্কালো। গলা শুকিয়ে গেছে। পানি না পেলে বোধহয় মরে যাবে।

জোসেফ কি কোথাও গিয়েছে? এটা কার ঘর? এখানে সে কি করছে? কিভাবে এসেছে এইসব প্রশ্ন মাথায় আসার আগে তার মাথায় এখন খাবারের চিন্তা ঘুরছে। খিদেয় পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে পোড়া মাটি দিলেও সে খেয়ে নিতে পারবে। শরীরটা অসম্ভব কাঁপছে। মনে হলো এইসব মৃত্যু যন্ত্রণা! এরচেয়ে ভয়ানক যন্ত্রণা আর হয় না। সে কয়েকবার ডাকল,

“জোসেফ পানি খাব। জোসেফ!”

দরজাটা খোলার শব্দ হলো। কল্পনা একটু পিছিয়ে গেল। দরজাটা খুলতেই পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিল একটা হাত। কল্পনা পানির গ্লাস নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। দু-পায়ে ভর রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ঢকঢক করে পানি খেয়ে সে বলল,

“ভাত নেই? রুটি?”

একটা থালা ঢুকলো ভেতরে। নরম নানরুটি, আর কবুতরের মাংস হয়তো। কল্পনা থালাটা নিয়ে ঘুরে বসলো। কিছুক্ষণ পর ধপ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে।

খেতে খেতে দরজার দিকে ফিরে দরজায় কিল বসিয়ে কেঁদে উঠে ডাকল,

“জোসেফ!”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। কল্পনা দরজায় মাথা ঠুকে কাঁদতে লাগলো।

“জোসেফ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এত লুকোচুরি কেন? দরজা খুলুন।”

ভারী পায়ের শব্দটা কল্পনার কানে ঘনিয়ে এল। দরজাটা ভালো করে খুলে গেল। কল্পনা হামাগুড়ি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো দরজা খুলে ঢুকে পড়া মানুষটার বুকে।
মাটিতে হাঁটু ফেলে মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরলো। কল্পনা গা দুলিয়ে কেঁদে উঠলো। আর্যাব খান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“দেওয়ানি আমি হাজির। তোমার আর ভয় নেই।”

কল্পনার কান্না থেমে গেছে। কণ্ঠস্বরটা!!

এই লোকটা জোসেফ নয় মোটেও।

সে আর্যাব খানকে ছেড়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকালো। সাথে সাথে গরম জল চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। বিস্ময়ে বিড়বিড় করল,

“জোসেফ কোথায়?”

আর্যাব খান হালকা হাসলো।

“আপনপুরুষের সামনে পরপুরুষের নাম ধরা বারণ দেওয়ানি।”

কল্পনা চোখ বন্ধ করে নিল। দুঃস্বপ্ন দেখছে সে? সবটা দুঃস্বপ্ন? জোসেফ কোথায়? এই আর্যাব খান তার সামনে কেন?

আর্যাব খান কিছু বলতে যাবে তার আগেই কল্পনা পাশ থেকে থালাটা তুলে তার মুখে ছুঁড়ে মারলো। ঘর ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

“জোসেফ!”

আর্যাব খান তারচেয়ে দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বলল,

“চুপ! একদম চুপ! জোসেফ নেই এখানে।”

কল্পনা চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আমি জোসেফকে ভালোবাসি। আমি ওর বউ। ও আমার বর। তুমি কেউ না, কেউ না।”

আর্যাব খান বলল,”আমি তোমার বিয়ে করা বর। জোসেফ টোসেফকে ভুলে যাও। কাজ হবে না।”

কল্পনা তার কথাগুলোকে নিজের ভুল মনে করার জন্য চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলতে লাগলো,

“আমি জোসেফ ভালোবাসি, জোসেফ আমার বর, আমি ওর বউ, আমি জোসেফকে ভালোবাসি…

আর্যাব খান তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,” তুমি কাল আমার সাথে থেকেছ এখানে, এইঘরে। একদম বুকের সাথে লেগে ঘুমিয়েছিলে সারারাত। অবিশ্বাস করে লাভ নেই দেওয়ানি।”

কল্পনা কানে হাতচাপা দিল। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো। যা খেল সব আর্যাব খানের গায়ে ভকভক করে বমি করে দিল। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ!!!!

চলমান…..

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৩৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

দেয়ালে বিকট শব্দে বিঁধে গেল গুলিটা। পোড়া গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল তখুনি। কয়েক সেকেন্ডেই পুরো ঘরটা দম বন্ধ করা ধোঁয়ায় ভরে উঠল। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল ভাঙা আয়নার ধারালো কাঁচ।

বাইরে হুলস্থুল কান্ড!

আশিষ আর আরিশ খান তীব্রভাবে ধাক্কাচ্ছে দরজাটা। লুবনা বেগম এক কোণায় দাঁড়িয়ে দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছেন। দরজা খুলতে বলছেন। কিন্তু কাবির সেইসব শুনতে পাচ্ছে না। শোনার কথাও নয়। ইথিকা ঠোঁট আঁটসাঁট করে আবার ট্রিগার চাপ দিল। কিন্তু গুলি বের হলো না। ফুরিয়ে গেছে।

কাবির স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইথিকার দিকে।তীব্র অবজ্ঞা ঝরছে চোখেমুখে। সে এক চুলও নড়েনি। বরঞ্চ ইথিকা নিজেই সুযোগটা মিস করেছে।

গুলি বের না হওয়ায় ইথিকা হতবিহ্বল। রাগে তার শরীর কাঁপছে। শিরা টনটন করছে কপালে। প্রচণ্ড অপমানে আর আক্রোশে সে পিস্তলটা ছুঁড়ে মারলো দেয়ালে। আওয়াজ তুলে সেটি ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর।

কাবির দেরি না করে একদম সামনে থেকে ইথিকার মুখের দিকে ছুঁড়ে মারলো একটা মোটা ফাইল। অপ্রস্তুত ইথিকা সামাল দিতে পারলো না। ফাইলটা ঠক করে লেগে গেল তার কপালে, তারপর মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে পড়লো। কপাল চেপে ধরে কাশতে কাশতে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লো ইথিকা।

কাবির জানতে চাইল,”কল্প কোথায়?”

ইথিকা কাশতে কাশতে তাকালো। সে বলবে। কাবির চেঁচালো। ইথিকা তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“জীবনেও বলব না ও কোথায়। মরে গেলেও না।”

কাবির আরও একবার জানতে চাইলো। ইথিকা বললো না। কাবির চুপচাপ চেয়ে রইলো তার দিকে।

তাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করলো কল্পনা কোথায়। ইথিকা চেঁচিয়ে বলল,

“পারলে খুঁজে বের করুন।”

কাবির নিজের হাতঘড়িটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো তার মুখে। ঘড়িটা ইথিকার মুখে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে ছিটকে গিয়ে ইথিকার পায়ের একদম সামনে পড়লো। সে দ্রুত পা সরিয়ে নিল, কিন্তু ততক্ষণে ঘড়িটার কাঁচ চুরমার হয়ে গেছে। আঘাতে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো ইথিকা, তারপর ধীরে ঘড়িটার দিকে তাকালো। ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে চোখ তুলে তাকালো কাবিরের দিকে। প্রচন্ড রাগ থেকে উচ্চারণ করলো,

“আমি আপনাকে সাবধান করছি আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করবেন না। পরে আপনাকে আফসোস করতে হবে।”

কাবির ঘর কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো, “চুপ! একদম চুপ। তোর মতো বেঈমানের জন্য আমি জীবনেও আফসোস করবো না। বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, নষ্টা। কাবির দেওয়ানের ঠেকা পড়েনি যে একটা বেঈমানের জন্য আফসোস করবে।”

ইথিকার মুখ তেতে উঠল রাগে। চিৎকার করে উঠল,

“আপনি আবারও একই ভুল করছেন কাবির দেওয়ান! আমাকে নষ্টা ডাকবেন না। বারবার করে বলছি নষ্টা ডাকবেন না।”

কাবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। দাঁত চিবিয়ে তীব্র ঘৃণায় বলল,

“তুই একটা নষ্টা মেয়েমানুষ। নষ্টা, নষ্টা… আর নষ্টা!”

ইথিকার ভিতরটা রাগে ফেটে পড়ল। সে গলা ছিঁড়ে চিৎকার করল,

“নষ্টা ডাকবেন না আমাকে! আমি রাস্তার মেয়ে নই! আর একবার বললে… আমি সব শেষ করে দেব। খুন করে ফেলব! আপনি জানেন না আমি কী করতে পারি। এক বিন্দু ধারণাও নেই আপনার কাবির দেওয়ান!”

কাবির আর সহ্য করতে পারল না। সে ধেয়ে এসে ইথিকার গলায় হাত চেপে ধরলো। ইথিকা দুই হাতে কাবিরের শক্ত হাতদুটো ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে শ্বাসের তাগিদে।

কাবিরের চোখে তখন খুনচাপা উন্মাদনা। রাগে লাল চোখে হিসহিসিয়ে বলল,

“তোর মতো বেঈমানকে মেরে ফেললেও কেউ আমাকে প্রশ্ন করতে পারবে না। আমি তোকে আমার জীবনে জায়গা দিয়েছিলাম, সম্মান দিয়েছিলাম। আমার নীতির বাইরে গিয়ে তোকে নিজের জীবনে রেখেছিলাম। আর তুই সেই সম্পর্কের উপর থুথু ছুঁড়লি। এত ছলনা কেন করলি? কেন ছেলেখেলা করলি বিয়ের মতো সম্পর্ক নিয়ে? উত্তর দে বেঈমান।”

ইথিকা হাড়ভাঙা যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করছে। বুকটা উঠছে-নামছে কিন্তু শ্বাস নিতে পারছে না। হাত পা ছুঁড়ছে। ধীরে ধীরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।

কাবিরের চোখ জ্বলছে উন্মাদ আগুনে। হাতের চাপটা আরও শক্ত হয়ে এল। তাকে দেখে মনে হলো এ অন্য একটা মানুষ। কাবির দেওয়ান নয়।

ইথিকা হাঁসফাঁস করছে। তার চোখের তারা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, শরীর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে, পা কাঁপছে। কিন্তু কাবির সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে না। সে নিজেই নিজের ভেতরের দানবের দখলে।

ইথিকার পা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। সেই ঝাঁকুনিই কাবিরকে টেনে আনলো বাস্তবে। আচমকাই সে হাত সরিয়ে নিল। ইথিকা ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। নির্বাক, নিস্তব্ধ, নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো।

কাবির দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। শ্বাস উঠানামা করছে দ্রুত, চোখ বিস্ফারিত। সে নিজেই ভড়কে গেছে নিজের কাজ দেখে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলো সে ইথিকার দিকে।

তারপর ধীরে এগিয়ে গিয়ে দরজার তালাটা খুলে দিল।

দরজা খুলতেই আশিষ আর আরিশ খান এক ঝটকায় ঢুকে পড়ল ঘরে। দুজনের চোখ চলে গেল ইথিকার নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে।

পেছন থেকে ছুটে এলেন লুবনা বেগম। চোখ ভেজা। কাবিরকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন,

“কাবির কি হয়ে গেল এসব?”

কাবির চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। সে কিছু না বলে চুপচাপ হেঁটে চলে গেল। ঘরের অবস্থা লন্ডভন্ড। আশিষ আগুন নিভিয়ে দিল শুরুতেই। আরিশ ইথিকাকে ডাকলো,

“ঠিক আছিস?”

ইথিকা ধীরেধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার। মনে হচ্ছে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে সে। আশিষ তাকে টেনে তুললো।

“চল এখান থেকে। তোকে বলেছিলাম গয়নাগাটি টাকাপয়সাগুলো লাগবে না। বিপদে পড়বি। কথা শুনিসনি। চল।”

ইথিকা তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লুবনা বেগম তাকে দেখামাত্রই বলল,

“আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি। তুমি জীবনেও শান্তি পাবেনা। জীবনেও না। তুমি এতগুলো মানুষের বিশ্বাস ভরসা নিয়ে দিনের পর দিন খেলা করেছ। আল্লাহ ছাড়বেন না তোমাকে।”

ইথিকা চুপচাপ কেটে পড়লো। ফালতু কথা শুনতে সে আগ্রহী নয়। সে আজকে চিরতরে এই বাড়িকে বিদায় জানাতে এসেছে। তার ডিভোর্স চায়। মুক্তি চাই। এই জেলখানার মতো বাড়ি থেকে সে চিরদিনের জন্য বেরিয়ে যেতে চায়। জেদ চেপে যে বিয়ে সে করেছিল সেই ভুল বিয়ে থেকে সে বেরিয়ে নিজের মতো করে জীবন উদযাপন করতে চায়। সে জেদ ধরে বিয়েটা করার সময় কল্পনাও করতে পারেনি এই বাড়িটা এতটা দমবন্ধকর হবে। অন্তরা খানমের কথা ভেবে আজ তার মায়া হচ্ছে। এমন একটা কারাগারে থাকার জন্য সে কি করে নিজের জীবন বাজি রেখেছিল? কি বোকা ছিল অন্তরা খানম! আর একই বোকামি সেও করেছে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে কাবির দেওয়ানকে বিয়ে করে। সে শীঘ্রই এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায়। আর এই মুক্তিই হবে দেওয়ানদের জন্য মোক্ষম জবাব। দেওয়ানদের অহংকার আর রক্তকে পায়ে মাড়িয়ে সে বিদায় নেবে। এমনি এমনি যাবে না।

স্যুটকেসগুলো নামিয়ে আনা হলো। কেউ কোনো বাঁধা দিল না। ইথিকা আমিন খানের সামনে এসে বলল,

“ড্যাড পেপার্সগুলো দাও। আমি আর এখানে থাকতে চাই না।”

আমিন খান কাওসার দেওয়ানের হাতে একটা পেপার্স দিল। কাওসার দেওয়ান চোখ বড়বড় করে তাকালো।

“ডিভোর্স পেপার?”

আমিন খান বলল,”হ্যাঁ, আর একটা কথা আর্য কল্পনাকে নিয়ে আজ কালের মধ্যে ফিরবে। এত পুলিশ গোয়েন্দা লাগানোর কিছু হয়নি। অযথা ঝামেলা তোরা তৈরি করছিস।”

কাবিরের গলার আওয়াজ শোনা গেল তখুনি।

“এইসব ছোটলোকদের স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি আমি।”

আশিষ খান বলল,”কাদের ছোটলোক বলছো?”

কাবির তাদের দিকে কোম্পানির কাগজপত্রগুলো ছুঁড়ে মেরে বলল,

“একদম চুপ ছোটলোক জোচ্চর কোথাকার। একটা নষ্টা, বেঈমান মেয়ে তুলে দিয়েছিস আমার ঘাড়ে। তোদের মতোই বেয়াদব তোদের বোন। নারীজাতির কলঙ্ক। আমার অবাক লাগে এই বেঈমানটাকে আমি বিশ্বাস করেছি অতকিছুর পরও। বিশ্বাসঘাতক বেঈমান..

ইথিকা বলল,”মুখ সামলে কথা..

কাবির তার মুখের উপর বলল,

“এই চুপ। তুই সর আমার সামনে থেকে। যা তোকে এখুনি তালা…

লুবনা বেগম ছুটে এসে তার মুখ চেপে ধরলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো। ভেঙে গেল সংসারটা! ভেঙে গেল। সবটা শেষ হয়ে গেল। না না উচ্চারণ করো না এসব।

কাবির মায়ের হাত সরিয়ে ইথিকার মুখের দিকে আঙুল তুলে বলল,

“সবার সামনে তোকে তালাক দিলাম! যা বের হ। তোর এই মুখ আমাকে কোনোদিন দেখাবি না। এই মুখ আমি কোনোকিছুর বিনিময়ে দেখতে চাই না। এরপর থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে পুরো খান বংশকে নির্বংশ করে দেব। বের হ। বের হ বলছি। বের হ অমানুষের বাচ্চা।”

ইথিকা কিছুক্ষণ নড়াচড়া ছাড়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত গলায় বলল,”থ্যাংকস।”

কাবির আশিষকে বলল,”তোরা কোথাও যেতে পারবি না। কল্পর খোঁজ দে আগে। নইলে সবার লাশ ফেলবো আজকে। মাথা খারাপ হওয়ার আগে তাড়াতাড়ি বলে ফেল। নইলে তোদের কি অবস্থা করবো ভাবতেও পারছিস না।”

ইথিকা বলল,”আগে সাইনটা।”

কাবির তার দিকে তাকালো। কি যেন ভেবে বলল,

“সাইন লাগবে না। দু মিনিট অপেক্ষা কর। ওয়েট।”

সে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল দেওয়ান বাড়ির মধ্যে। কাবিরের পিছু ছুটে আসছে কাদিন, কাসেদ, লুবনা বেগম, কিরণ সবাই। কেউ তাকে আটকাতে পারছেনা। তার হাতে লাইসেন্সধারী বন্দুক। কামরান দেওয়ান ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিল। উনার হাতেও একটা বন্দুক।

খানদের দিকে আঙুল তাক করে কাবিরকে বললেন,

“শেষ করে দে ওদের। বিশ বছর ধরে ওরা দেওয়ানদের সামনে চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায়নি। আজ যখন আবার মাথা তুলেছে তখন তাদের শিকড়টাই উপড়ে দে। যেন আগামী চল্লিশ বছরেও এরা এই দেওয়ান বাড়ির মাটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস না পায়। আমি বলছি মেরে দে ওদের। আমি আছি তোর পেছনে। এদের কিভাবে জবাব দিতে হয় সেটা আমি খুব ভালো করে জানি।”

কিছু বুঝে উঠার আগেই কাবির ইথিকার দিকে বন্দুক তাক করলো। সাথে সাথে চারপাশটা কম্পিত হলো। ইথিকাকে ধাক্কা দিয়েছে আশিষ খান। ফলস্বরূপ তার গায়ে বুকে গিয়ে পড়লো গুলি। ইথিকার মুখে রক্ত ছিটকে পড়লো।
কাবির থামেনি। আবারও বন্দুক তাক করে গুলি ছুঁড়লো। ইথিকা চিৎকার দিয়ে আশিষ খানকে ধরে মাটিতে ধপ করে বসে পড়েছে ভাগ্যিস! নইলে গুলিটা তার গায়ে ঠিকই লাগতো।

আমিন খান স্তব্ধ হয়ে গেছে। ইথিকা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।

কাবির বন্দুকটা নিয়েই বসে পড়লো চেয়ারে। কাওসার দেওয়ানের হাত থেকে কাগজ নিয়ে স্বাক্ষর দিল। ইথিকা কাঁদতে কাঁদতে কাবিরের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল,

“কাবির দেওয়ান, তোমাকে মৃত্যু না দেওয়া অব্দি আমি শান্ত হবো না।”

কাবির ডিভোর্স পেপার্সটা আমিন খানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“শেষবারের মতো দয়া দেখালাম। ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যান। বাঁচলেও বাঁচতে পারে। পুলিশ পাঠাবেন। আমি প্রস্তুত।”

________________

নিজের শার্ট পাল্টে এসে পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হলো আর্যাব খান। কল্পনা পানি না খেয়ে কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো তার দিকে।

সে দ্রুত পা সরিয়ে নিল। গ্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কল্পনা একদৃষ্টিতে টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

আর্যাব খান বুঝতে পেরেছে তার উদ্দেশ্য। সে কাঁচের টুকরোগুলো দ্রুত কুড়িয়ে নিতে লাগলো। কুড়িয়ে নেয়ার সময় হঠাৎ চোখ তুলে দেখলো কল্পনা তার দিকে তাকিয়ে আছে। গালে জল শুকিয়ে গেছে। চোখের নীচে কালি বসে গেছে। চুল এলোমেলো। ওকে কোনোদিন মাথার কাপড় ছাড়া দেখা যায়নি এর আগে। আর্যাব খান ফিসফিস করে বলল,

“দেওয়ানি তোমাকে মঞ্জুলিকার মতো লাগছে। বাট আই লাইক ইট।”

বলেই চোখ টিপে দিল। কল্পনা সাথে সাথে তার হাত থেকে একটা কাঁচ তুলে তার কাঁধেই গেঁথে দিল।

“আউচ!”

লাফ দিয়ে সরে গেল আর্যাব খান। কাঁধে হাত চেপে ধরলো। হাতে তরল জাতীয় কিছু লাগছে। সে হাত তুলে দেখলো রক্ত!

কল্পনা আরও একটা কাঁচ তুলে তার মুখে ছুঁড়ে মারবে ঠিক তখুনি আর্যাব খান তাকে একহাতে চেপে ধরে আরেক হাতে লেগে থাকা রক্ত তার ঠোঁটে ঘষে দিল।

কল্পনা বুক চেপে ধরে করতে ভকভক করতে লাগলো। পেটের ভিতর কিছু না থাকায় বমি আসছে না।

আর্যাব খান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে কল্পনার কোমর জড়িয়ে ধরে ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা রক্ত দেখিয়ে দিয়ে বলল,

“দেওয়ানি, মনে হচ্ছে আমার চুমুর জোরে তোমার ঠোঁটের আশেপাশে লিপস্টিক লেগে গেছে। আর যা বুঝলাম তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক ঠিকঠাক থাকার চাইতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে বেশি ভালো লাগে।”

কল্পনা তার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। আর্যাব খান তার চাহনি দেখে বলল,

“এভাবে তাকালে সর্বনাশ হয়ে যাবে বেয়াইন!”

কল্পনা তার মুখ বরাবর একদলা থুতু ছুঁড়ে বলল,

“তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তাই এভাবে উড়ছো তুমি। জোসেফ আসবে আর তোমাকে কেটে ফালাফালা করবে। আমার কথা মিলিয়ে নিও।”

আর্যাব খান তার শাড়ির আঁচল টেনে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

“যেগুলো মুখে ছুঁড়লে সেগুলোই কাল রাতে আমাদের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে। তাই আমার ঘেন্না হচ্ছে না।”

কল্পনার গলার কাছে আবারও উথলে উঠলো বমি। সে সর্বশক্তি দিয়ে আর্যাব খানকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। গা দুলিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে ডাকল,

“জোসেফ!! আমি জানোয়ারটার সাথে পারছিনা।”

আর্যাব খান তার সামনে বসে পড়লো। বলল,

“কাল রাতে তুমি আমার সাথে ছিলে। এসব অস্বীকার করতে পারবে না। জোসেফকে সব প্রমাণ দেখালে সে দুই সেকেন্ডে তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তোমার কিছু করার নেই দেওয়ানি। উই আর ম্যারিড কাপল। তুমি আমাকে কবুল বলেছ। আমি তোমাকে। ব্যস।”

বলেই হাসলো। কল্পনা কাঁদতে লাগলো।

সে কাল রাতে জোসেফ ভেবে?

না….

সে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। মরে যাবে সে। কিন্তু এই লোকটার কথা সে বিশ্বাস করবেনা।

তাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়লো আর্যাব খান।

বাইরে কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি শুরু হয়েছে। কল্পনা তখন দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। গোলাগুলির শব্দে সে জেগে উঠলো। জোসেফ! জোসেফ এসেছে?

একছুটে দরজার কাছে গেল সে। দরজা ধাক্কালো। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কা দিল সে। কিন্তু দরজা খুললো না কেউ।

হঠাৎ কি মনে করে হাত থেমে গেল। জোসেফের সামনে কোনমুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে?

কোনোমতে হেঁটে খাটের পেছনে এসে লুকিয়ে পড়লো সে। থরথর করে কাঁপছে হাত পা, সমস্ত দেহ। কল্পনা কাঁপা কাঁপা হাতে মুখ মুছলো শাড়ির আঁচল তুলে। জোসেফের সামনে এভাবে যাবে? কি করে যাবে? না যাবে না। জোসেফের ঘৃণা সে সইতে পারবে না। জোসেফ কি তাকে অবিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করে নেবে আর্যাব খানের কথা? বিশ্বাস করবে ওইসব বিয়েটিয়ে সত্যি? কল্পনা আবারও কাঁদতে লাগলো। আবারও নামমুখ মুছে নিল। হাতের ভর দিয়ে মেঝে থেকে উঠে বোতলের পানি ঢেলে মুখ ধুয়ে নিল। ভাঙা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ পুরোটা মুছে নিল। এবার জোসেফ কিছু বুঝবে না।

বাইরে গোলাগুলির শব্দ তীব্র হয়ে উঠেছে। অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ। কল্পনার বুকের ভেতর তড়পাচ্ছে। হঠাৎ সেই প্রিয় কণ্ঠস্বর কানে বাজলো।

“কল্প!”

কল্পনা পাগলের মতো ছুটে গেল দরজার কাছে। দরজায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। কান্নার চোটে কথা অব্দি বলতে পারলো না। দরজার সামনে মুখ ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। ভারী পায়ের শব্দটা ঘনিয়ে আসছে। কণ্ঠস্বরটা আরও গাঢ় হয়ে বাজলো কানে।

“কল্প!”

কল্পনা আর নিতে পারলো না। একদৌড়ে খাটের পেছনে গিয়ে বসে পড়লো। মুখ চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো।

দরজায় লাথি পড়ছে। লাথালাথির কিছুক্ষণ পর বিকট শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। কল্পনা দমবন্ধ করে বসে রইলো খাটের পেছনে। বাইরে তুমুল চেঁচামেচি। আর্যাব খানকে খুঁজছে সবাই।

জোসেফ ঘরের কোণায় কোণায় পিস্তল তাক করে সতর্কতার সাথে এগোতে এগোতে ডাকল,

“কল্প কোথায় তুমি? এই আর্যাব খান বের হ শুয়োরের বাচ্চা।”

ঘরের মধ্যে একজন গোয়েন্দা সদস্য ঢুকে পড়ছে।
কল্পনা উঁকি দিয়ে দেখলো জোসেফকে। কান্নাদের আর আটকানো গেল না। হায় আল্লাহ কি হবে তার? এই মানুষটাকে ছাড়া সে একমুহূর্তও ভাবতে পারেনা। কল্পনা তার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। ঠিক সেই সময় কান্নার শব্দ শুনে জোসেফ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই কল্পনা জমে গেল। বড় বড় চোখ করে কান্না থামিয়ে চেয়ে রইলো। তাকো এমন অবস্থায় দেখে জোসেফ তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ডাকল,

“কল্প! তুমি ওখানে কেন? কি হয়েছে? আমি জোসেফ। এসো।”

কল্পনা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। জোসেফ তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে কপালে, গালে চুমু খেয়ে বলল,

“আমি এসে গেছি আর ভয় নেই। রিল্যাক্স! কান্না থামাও। কেঁদো না। দেখো আমি জোসেফ।”

কল্পনা কেঁদে যাচ্ছে। জোসেফ তার কান্না এই প্রথম দেখছে। তার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। জানোয়ারটা লুকোলো কই?

কল্পনা তার দিকে মুখ তুলে তাকালো। দু-হাত বাড়িয়ে গাল ছুঁলো। আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শক্ত করে ধরে রাখলো। বাকিসব মিথ্যে হয়ে যাক। জোসেফও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আচমকা একটুখানি শব্দ কানে আসতেই সে চমকে পেছনে ঘুরে তাকাল।

চেয়ারে গা ছড়িয়ে বসে এক পা আরেক পায়ের ওপর তুলে ঠোঁটের কোণে সিগারেট গুঁজে ধীরে ধীরে আগুন ধরাচ্ছে আর্যাব খান।

জোসেফ লাথি দিয়ে চেয়ারসহ ফেলে দিল তাকে। আর্যাব খান পড়ে গিয়েও কল্পনার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

চলমান…

#পর্ব_৪০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কল্পনা জোসেফের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ থেকে টপ টপ করে গরম জল গড়িয়ে পড়ছে। আর্যাব খানের দিকে আঙুল তাক করে বলল,

“মেরে দিন ওকে। ছাড়বেন না। জানোয়ার, অমানুষ! এদের মতো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। মেরে ফেলুন ওকে।”

আর্যাব খানের ঠোঁটে তখনও বিকৃত, দানবীয় হাসি। সেই হাসির ধৃষ্টতা আর সহ্য করতে পারলো না জোসেফ। এগিয়ে গিয়ে আবারও চেয়ারটা এক ধাক্কায় এমনভাবে লাথি মারলো আর্যাব খান ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও মুখের হাসি সরলো না তার। ঠিক তখনই জোসেফ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কলার চেপে ধরে একের পর এক ঘুষি মারলো মুখে। হাসতে হাসতেই ছিটকে দূরে পড়ে গেল আর্যাব খান।

মাটিতে বসেই সোজা হয়ে তাকালো জোসেফের চোখে। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেখা টেনে বলল,

“মাথা খারাপ হলে কি করব আমি নিজেও জানি না। যে পথে এসেছিস, সেই পথে চলে যা ভাই। ওটা… মিসেস আর্যাব খান। মানুষের বউয়ের দিকে তাকালে ওটাকে পরকীয়া বলে। হালাল মানুষের হারাম কাজ করা সাজে না। চলে যা।”

জোসেফ থমকে গেল। কপাল কুঁচকে তাকালো আর্যাবের দিকে। তারপর পেছনে তাকিয়ে ভয়ার্ত, কুঁকড়ে থাকা কল্পনাকে দেখলো। কল্পনার তার শার্ট আঁকড়ে ধরে দুপাশে মাথা নাড়লো। সব মিথ্যে। তাদের কোনো বিয়ে হয়নি। সে স্বেচ্ছায় জীবনেও আর্যাব খানকে স্বামী হিসেবে মানেনি। মানবে না। সব ওর চক্রান্ত। ষড়যন্ত্র।

জোসেফ তার স্পর্ধা দেখে কল্পনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর তেড়ে গিয়ে আর্যাব খানের কলার চেপে ধরে বলল,

“আরেকবার বল কি বললি।”

আর্যাব খান বিকৃত হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,

“কেন তোর কানে সমস্যা? চেপে চেপে ভরে দিতে হবে কথা? তাহলে শোন!”

জোসেফের বুকে চাপড় মারলো সে। তারপর জোসেফের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কল্পনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ওটা আমার বিয়ে করা বউ। আমি তাকে কবুল বলেছি। সে আমাকে কবুল বলেছে। তাই না দেওয়ানি?”

কল্পনা জোসেফের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে রাখলো। আর্যাব খানের এই চাহনিও তার সহ্য হচ্ছে না। অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে এই চাহনি সহ্য করার চাইতে মৃত্যুও সহজ। জোসেফের চোয়াল শক্ত হচ্ছে। চোখের কোটায় আগুন। কপালের রগ ভেসে উঠেছে ক্রোধে। আর্যাব খান কল্পনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার মুখের দিকে বলল,

“বিয়ের বয়স চব্বিশ ঘন্টা। এবার তুই তোর রাস্তা মাপ। বিয়ে করা বউকে তার বরের কাছে রেখে যা। এবার কথা ভালো করে শুনেছিস? ওহ তোর তো আবার প্রমাণ লাগবে। ওয়েট…

প্রমাণ দেখানোর সুযোগ না দিয়ে জোসেফ সাথে সাথে একটা ঘুষি বসালো। আর্যাব খান দেয়ালের কাছে ছিটকে পড়লো। কিছুক্ষণ দেয়ালের সাথে কপাল ঠুকে বসে রইলো নড়াচড়া ছাড়া। কল্পনা স্তব্ধ হয়ে গেল। মরে টরে গেল নাকি?

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আর্যাব খান দেয়ালের সাথে ঠেসে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“দেওয়ানি! এসব ভালো না। আমি মার খাচ্ছি আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছো। খুব খারাপ।”

কল্পনা জোসেফের পিঠে কপাল ঠুকে রাখলো। এই লোকটার চাহনি, ডাক, কথা কিছুই সে নিতে পারছেনা। তার বমি পাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর। এত এত ঘৃণা করে সে এই লোকটাকে। আল্লাহ কেন বারবার এই লোকটাকে তার সামনে ফেলে? মরে যাক সে। যাতে তার দুচোখের সামনেও কোনোদিন না পড়ে। কল্পনা তার দিকে তাকালোও না।

জোসেফ কল্পনার হাত ধরে বাকি তদন্ত কর্মকর্তাদের বলল,

“ওর একটা ব্যবস্থা করুন।”

বলেই সে কল্পনাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আর্যাব খান একলাফে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁধে কল্পনার কাঁচ গেঁথে দেয়া জায়গা থেকে জমে থাকা রক্ত আঙুল দিয়ে ঘষে তুলে এনে ঠান্ডা চোখে জোসেফের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুই বোধহয় কানে শুনিস না বয়রা।”

জোসেফ নিজের রাগ সামলে তার কাঁধে হাত রাখলো। আলতোভাবে চাপড়ে দিয়ে বলল,

“আমি স্পষ্ট শুনেছি তুই কি বলেছিস। বড়লোকের বখাটে ছেলে তুই। তাই তোর হঠাৎ মনে হবে ওর ওই জিনিসটা আমার চাই। তখনই তোর ওটা পেতে হবে। না পেলে ছিনিয়ে নিতে হবে। কিন্তু ব্রো, এটা আমার। জোসেফ মেহতাজের। তুই কোন ক্ষেতের মুলা যে বলবি এটা তোর বউ, আর আমি তোকে নাচতে নাচতে দিয়ে দেব। তোর এইসব বালের পাওয়ার তোর বাপের সামনে গিয়ে দেখা। আমি এইসব অনেক দেখেছি। সর। মাথায় খুন চাপলে তোর টেরোরিস্ট বাপ ভাইরা কিছু করতে পারবে না। হেডম দেখাস না আমার সামনে।”

আর্যাব খান ঘুষি দিয়ে জোসেফের উপর হামলে পড়লো। জোসেফ সামলাতে পারলো না। দু’জনের শরীর গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।

কল্পনা আঁতকে উঠে আর্যাব খানকে পেছন থেকে টেনে ধরে চিৎকার করে উঠলো,,

“না না ওকে ছাড়ো। আর্যাব খান ছাড়ো বলছি। মারবে না ওকে। নইলে আমি তোমাকে খুন করবো।”

জোসেফ আর্যাবকে ধাক্কা মেরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,”শুয়োরের বাচ্চা পথ ছেড়ে দাঁড়া। আমার হাতে খুন হতে না চাইলে সর। এক কথা বারবার বলবো না।”

আর্যাব খান হো হো করে হাসলো। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে দিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,”আরেহ বয়রা তোকে কতবার করে বলছি আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। একসাথে থেকেছি আমরা কালরাতে। দেওয়ানি বলো কাল রাতে কি কি হয়েছে। তুমিই তো আমাকে…

জোসেফ তেড়ে এসে তার গলা চেপে ধরে বলল,

“তুই আমার চোখের সামনে প্রমাণ তুলে ধরলেও আমি তোকে বিশ্বাস করিনা। আমি ওকে বিশ্বাস করি। আর আমি জানি ও তোর মতো লোককে স্বেচ্ছায় জীবনেও কবুল বলবে না। দূরে গিয়ে মর। ওর দিকে হাত বাড়ালে হাত ভেঙে তোর বাপের কাছে পার্সেল করবো। কুত্তার বাচ্চা সরে দাঁড়া।”

বলেই জোরসে একটা ধাক্কা মেরে পথ থেকে সরিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের ইশারা করলো জোসেফ। সবাই ভেতরে ঢুকে এসে আর্যাব খানকে আটকে ফেললো। জোসেফ কল্পনাকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

আর্যাব খান গর্জন করছে। কল্পনা জোসেফের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এল। সে হাঁটতে পারছেনা। এতটাই ক্লান্ত লাগছে যে মনে হচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে আরেকবার ঝড় গেলে বাঁচা মুশকিল।

জোসেফ তাকে গাড়িতে এনে বসালো। কল্পনা তার হাত ধরে রাখলো। তার গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। জোসেফ বুঝতে পারছে তার শরীর খারাপ লাগছে। সে আলতোভাবে তার গাল মুছে দিয়ে বলল,

“আমি জানতে চাইব না কি হয়েছে কি হয়নি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তুমি আমার উপর ভরসা রাখো। ওই আর্যাব খান আর তার বাপের কুকর্ম যদি আমি ফাঁস না করি তবে আমার নামও জোসেফ মেহতাজ নয়। এইসবের পেছনে অনেক বড় পরিকল্পনা চলছে ওদের। তুমি আন্দাজও করতে পারছো না ওরা কি করতে চলেছে।”

কল্পনা আতঙ্কিত হয়ে বলল,”ওরা খুন করে দেবে আপনাকে। ওরা সব পারে।”

জোসেফ কঠিন গলায় বলল,

“আমি খুন হলে ওদের স্বপরিবারকে শেষ করে তবেই খুন হবো।”

কল্পনার গলা রুদ্ধ হয়ে এল। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল, “আর আমি?”

জোসেফ তার চোখের দিকে তাকালো। কল্পনা জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে আছে।

জোসেফ তার কাঁপতে থাকা হাত দুটো নিজের হাতে নিল। আশ্বাস দিয়ে বলল,

“আমি সবসময় তোমার সাথে আছি।”

______

কাবিরের কাছে জোসেফের ফোন এসেছে এইমাত্র। জোসেফ জানিয়েছে সে কল্পনাকে নিয়ে ফিরছে। সে একটু অসুস্থ কিন্তু মারাত্মক কিছু হয়নি। আর্যাব খানের ডেরা থেকে তাকে উদ্ধার করেছে শুনে দেওয়ান বাড়ির মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কামরান দেওয়ান বলল,

“আমি জোসেফের সাথে কল্পর বিয়ে পড়িয়ে দেব কালকে। জোসেফের কাছে ও ভালো থাকবে। ওই জানোয়ারগুলো নইলে আমার মেয়ের জীবনটা শেষ করে দেবে। আমি ওদের আর সুযোগ দেব না।”

হাসপাতালে আশিষের চিকিৎসা চলছে। খবর এসেছে তাকে অনেক রক্ত দিতে হচ্ছে। তা শুনে কামরান দেওয়ান বলল, ওদের কপালে এত সহজ মৃত্যু লেখা নেই।

কাবির ফিরতেই বাড়ির সবাই চুপচাপ। লুবনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যেই সংসারটা চোখের সামনে জোড়া লাগতে দেখেছেন সেই সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মেয়েটা অমন মায়া লাগিয়ে এত আঘাত কেন দিল? এত ছলনা কেন করলো? একটা মানুষের সব মিথ্যে হতে পারে? সব? অথচ কয়েকদিন ধরে উনার মনে হচ্ছিল বাড়িতে একটা বাচ্চা কাচ্চা এলে মন্দ হয় না। কোলে বাচ্চা এলে মেয়েরা আরও সংযত হয়ে যায়। স্বামী, সংসারে আরও মন বসে। কিন্তু এসব কি হয়ে গেল? মেয়েটা মনে এত কাঁদা রেখে কিভাবে পারলো এত নিখুঁত অভিনয় করতে? কি চেয়েছে সে? কিইবা পেয়েছে এসব করে? এমন স্বামী সংসার ক’জন পায়? সে কেন মূল্য দিতে জানলো না। এখন কোথায় যাবে? কিভাবে ওরা একে অপরকে ছাড়া থাকবে, আলাদা জগত বানাবে। এমনও হয়? একসাথে একঘরে একই ছাদের নীচে থাকার পরও একটা মানুষকে অমনভাবে ঠকানো যায়? এত আঘাত করা যায়? স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুক কাঁপলো না? নাকি ওইসব মেয়েদের বুক কাঁপে না? উনি নিজেকে বুঝ দিতে পারছেনা সংসারটা আর নেই। একটা সম্পর্কের মৃত্যু, একটা সংসারের মৃত্যু, আর চোখের সামনে নিজের ছেলেটাকে চুরমার হয়ে যেতে দেখা কোন মা মানতে পারে?

কাবির অবশ্য খুব রেগে গেল মায়ের আহাজারি দেখে। ভীষণ রকম বিরক্ত হয়ে বলল,

“আমার কষ্ট হচ্ছেনা একটুও। তুমি কেন এরকম করছো? যে যাওয়ার সে যাবে। তাকে ধরেবেঁধে রাখা যাবে না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এইসব বন্ধ করো। কল্প ফিরছে এটা শুনে খুশি হও। এত আবেগি হওয়া ভালো না। বেশি দয়ামায়াই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জন্য। আমার মেজাজ খারাপ করো না আর।”

লুবনা বেগম বললেন,

“ওরা তোমার জীবনটা ছারখার করে দিয়ে গেল। প্রথমেই তাহমিনাকে কেড়ে নিল। সবাই জানে ইচ্ছাকৃতভাবে তাহমিনাকে কেড়ে নিয়েছিল ওরা।
তারপর ছলনা করে তোমার জীবনে ওদের মেয়েকে জড়ালো। আর যখন সত্যি সত্যি জড়িয়ে গেল তারপর ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। ওরা তোমাকে শান্তি দেয়নি। তোমাকে শেষ করে দিয়ে চলে গেছে। তুমি ওদের ক্ষমা করবে না। ওরা ক্ষমার যোগ্য নয়।”

বড়ফুপু বললেন,”বউকে আরও লাই দে তুই। আমি আগেই বলেছি ওই মেয়ে বেয়াদব। বাপ ভাইয়ের প্ররোচনায় এইসব করেছে ওই মেয়ে। জীবনেও সুখী হবেনা ওই মেয়ে। তোর দোষও আছে। তুই সুযোগ দিয়ে ভুল করেছিস। ওই মেয়ে তোর যোগ্য? একটা নর্তকীর মেয়ে আর কত ভালো হতে পারে? যে মেয়ে দেশবিদেশে পরপুরুষের সাথে ঘুরে বেড়াতো সেই মেয়ে হুট করে কেন ঘরবন্দী হতে চাইলো সেই প্রশ্ন তোর মাথায় আসেনি?”

কাবির কঠোরভাবে বলল,”এখন কি করবো আমি? কি করার আছে বলো। বেঈমানগুলোকে আর কিভাবে শাস্তি দেব? আমি ওকে সুযোগ দিয়েছিলাম সেটাই আমার ভুল? সুযোগ না দিলেও তো কথা থেকে যেত যে আমি তাকে একটা সুযোগও দিইনি। আমি কি করিনি ওকে রাখার জন্য? কোনোকিছু চাপিয়ে দিইনি ওর উপর। ওকে নিজের মতো করে চলতে দিয়েছি। কারণ জোরাজোরি করে মানুষকে পাল্টানো যায় না। তারপরও থাকেনি। তলে তলে শয়তানি করে গেছে। বাপ ভাইদের কথা শুনে আমার সাথে বেঈমানী করেছে। আমার কি করার আছে এখানে?”

কাওসার দেওয়ান বলল,

“তোমার মা তোমার কথা ভেবে কাঁদছে।”

“আমার কথা ভেবে কাঁদার দরকার নেই। আমার কিছু হয়নি। বরং ভালোই হয়েছে ওরকম একটা আপদ বিদেয় হয়েছে।”

কাওসার দেওয়ান বললেন,

“তোমার মা ভাবছে তুমি কষ্ট পেয়েছ। বোঝাও তোমার মাকে। তাকে আমরা বোঝাতে পারছিনা। দেখো লুবনা তোমার ছেলে এত সহজে ভেঙে পড়ার মতো ছেলে নয়। বরং ওই মেয়ের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। তার জীবন থেকে চলে গিয়ে তোমার ছেলেরই লাভ হয়েছে। ক্ষতি কিছু হয়নি।”

লুবনা বেগম ছেলের মুখপানে চেয়ে রইলেন। কাবির বলল,

“তুমি কান্না থামাবে না তাই তো? কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে ভর্তি হও যাও। আর কিছু বলবো না আমি। বাড়িতেও শান্তি নেই। যাব কোথায় আমি?”

সে ঘরে চলে গেল। ঘরটা পরিষ্কার করছে ঝিনুক আর লায়লা খালা। ঘরজুড়ে ভাঙা কাঁচ।জিনিসপত্র এলোমেলো। অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে ঘরটা। জিনিসপত্র কমে গেছে তাই। কাবিরকে দেখে ঝিনুক মাথার কাপড় টেনে নিল আরও। কাবির বলল,”কাজ কতদূর?”

ঝিনুক দ্রুত কাঁচগুলো তুলে নিয়ে বলল,

“হয়ে গেছে ভাইয়া।”

লায়লা খালা ঘর মুছে দিতে দিতে বিড়বিড় করলো,

“এইবার নিজে পছন্দ কইরা একখান বিয়া করো বাপু। এজন্যই মাইনষ্যে কয় অতি সুন্দরীর বর জোটেনা, অতি ভালো মাইনষ্যের বউ টিকেনা। মাঝেমধ্যে কঠোর হওয়া লাগে।”

কাবির বলল,”কিছু বললে?”

লায়লা খালা চমকে উঠলো।

“না বাপ। তোমার মাথা গরম আজকে। কিছু কইতাম না। তুমি আরাম করো যাও। ঝিনু চল চল।”

ঝিনুক বালতি নিয়ে বেরিয়ে গেল চুপচাপ। লায়লা খালা তার পিছু পিছু বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

“হারামিটা কি খেলটাই না দেখাইলো। তোরে তো টাকাপয়সা দিত তার কাপড় ধুতিস তাই। এইবার দিয়া গেছে?”

ঝিনুক দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,

“নাহ দেইনাই। পরে দিবে বলছিলো। সেই পরে আর আসবেনা জানি। মার গেল টাকাগুলো।”

লায়লা খালা বলল,”এজন্যই তোরে বারবার সাবধান করি টেকাপয়সার বেলায় ছাড় দিস না। হুহ ওরা কত্ত টেকাপয়সা নিয়া ঘোরে তোর কোনো ধারণা আছে?”

ঝিনুক বলল,”চুপ করো তো। আমারে নিজ থেকে না দিলে চেয়ে নেব নাকি? আমি এই বাড়ির কারো কাছ থেকে কোনোদিন টাকা চাইছি তুমি বলতে পারবা?”

“বেশি ভালো মানুষি দেখাইস না। সাহেব মিয়ার কি অবস্থা হয়ছে দেখ। বেশি ভালা মাইনষ্যের দাম নাই এই দুনিয়ায়।”

দুজনেই কথা বলতে বলতে চলে গেল।

কাবির ঝকঝকে তকতকে ঘরময় খালি পায়ে পায়চারি করলো কিছুক্ষণ। তারপর বিছানার এককোণায় বসে আরেককোণার দিকে তাকালো। তিনটা তালাকে কিচ্ছু হয়নি। তাকে রাগিয়ে দিয়ে ওখানে হেসে লুটোপুটি খাওয়া শরীরটা শুধু মিসিং। চিরুনীতে কয়েকটা চুল। ঘরজুড়ে অসংখ্য কাপড়ের ছড়াছড়ি। আর ড্রেসিং টেবিলে সাজসরঞ্জামগুলো। আর কিচ্ছু পরিবর্তন হয়নি। কিচ্ছু না। একটাও সেকেন্ড কারো অনুপস্থিতিতে থমকে দাঁড়ায় না। অথচ মনে হয় সে না থাকলে জীবনটায় থমকে যাবে।

সবাই ভাবেছে মেয়েটা খারাপ ছিল আগে থেকেই। সে তা জেনে-বুঝেই সুযোগ দিয়েছিল তাই আজকের এই পরিণতি। তারা নিজেরা যা দেখেছে, শুনেছে, সেটুকুই সত্য ভেবে রায় দিয়েছে। কিন্তু তাদের হিসাব আর কাবির দেওয়ানের হিসাব এক নয়।

কারণ, কেউ জানে না চার দেয়ালের ভেতর সেই জটিল, বাইরে থেকে ধোঁয়াটে সম্পর্কটার গভীরতা কতটুকু ছিল। কতটা গাঢ় ছিল সেই সম্পর্ক! কতটা অন্তরঙ্গ ছিল।

একটা মেয়ে বাধ্য হয়ে অনেক কিছু সহ্য করতে পারে অপছন্দের কাজ, অপছন্দের সংসার, এমনকি অপছন্দের জীবনও। কিন্তু নিজের শরীর? নিজের সম্মান? ওটা কি এতটাই সহজে তুলে দেওয়া যায় এমন একজনের হাতে, যার প্রতি নেই কোনো টান, মায়া, নেই এক ফোঁটা বিশ্বাসও?

তবু আনঝিল খানম সেটা করল।
কীভাবে পারল সে? নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এতবড় ছলনা!

বিশ্বাস অর্জনের জন্য এত নীচে নামা যায়?
তাহলে সেইসব মুহূর্তগুলো যেগুলো চোখ বুজে স্মরণে আসে সেগুলোর প্রতি অগাধ আস্থা সবই কি মিথ্যে ছিল? এত বড় মিথ্যে?

কাবির দেওয়ান বহুদিন পর বসে বসে রাত পার করেছে। একটা শূন্যতা ঘরটাকে ভয়ংকর করে তুলেছিল। কাবির শুধু দেয়ালে আর মেঝের উপর পড়া মেয়েলী ছায়াটাকে দেখে দেখে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। মনের ভুল কতরকমের হতে পারে তা জানা হয়ে গেল সেই রাতে।

ফজরের আজান কানে এলেই তার ধ্যান ভাঙলো। কেবলামুখী হয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ার পর আচমকা ভীষণ অদ্ভুতভাবে তার চোখদুটো ঝিমিয়ে এল ক্লান্তিতে। ভীষণ ক্লান্ত সে। এতবড় ধাক্কা সামলে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। এইবার একটু ছুটি চায় তার। লম্বা ছুটি।

জোসেফ কাদিনকে আপডেট জানিয়েছে কিছুক্ষণ পরপর। কল্পনা গাড়িতে তারপাশে বসে, হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে ঘুমিয়ে ছিল সারারাত ভর। মাঝেপথে মাথাটা হেলে পড়েছিল তার কাঁধে। জোসেফ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথাই ভেবেছিল, এই রাতটা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রাতটির মধ্যে একটি ছিল। যে মেয়েটি পাশে থাকলে আর কিচ্ছু লাগেনা তাকে সে নিজের জীবনের বাজি রেখে হলেও পাশে রাখবে। রাখবেই।

সকালে শোনা গেল কল্পনা হাসপাতালে ছিল। সেখান থেকে জোসেফ তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। দেওয়ান বাড়ির মানুষকে সে জানায়নি তারা ইতোমধ্যে অশান্তির মধ্যে আছে তাই। তবে কল্প এখন অনেক সুস্থ। কাদিন, কাসেদ সবাই কল্পনাকে দেখতে গিয়েছে মেহতাজ ভিলায়। কল্পনা তখন বিছানায় শোয়া। জেসি তার জন্য স্যুপ করেছে। কল্পনাকে ঘুম থেকে তুলে চামচ দিয়ে স্যুপ খাওয়াচ্ছিল জেসি। কাদিনকে দেখামাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠলো কল্পনা। কাদিন বিছানায় বসে বোনকে বুকে টেনে নিল। কল্পনা গা দুলিয়ে কাঁদছে। কাদিন মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। কাঁদিস না।”

কল্পনা কান্না থামিয়ে বলল,”বড় ভাই আসেনি?”

কাদিন চুপ করে রইলো। কাসেদ বলল,

“ভাবি আর ভাইয়ের তালাক হয়ে গেছে। আসবে কিছুক্ষণ পর। তুই ভাবির ব্যাপারে কিছু বলিস না।”

কল্পনার দুচোখ বিস্ফারিত! টপটপ করে জল পড়তে থাকলো তার গাল বেয়ে। কাদিন গাল মুছে দিয়ে বলল,

“ডিভোর্স নিতে এসেছিল বাড়িতে। বড় ভাই দিয়ে দিয়েছে। গুলি ছুঁড়েছিল। আশিষ খানের বুকে গিয়ে লেগেছে। বাড়িতে এখনো কোনো পুলিশ আসেনি। আমিন খান নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্ল্যান করছে। কে জানে কি হয়।”

কল্পনা বলল,”বড়ভাইকে পুলিশে নিয়ে যাবে?”

“বড় ভাই তো রাতভর অপেক্ষা করলো। কিন্তু কোনো পুলিশ এল না। হয়তো এইসব তাদের আরেকটা ছাল। আশিষ সুস্থ হলে দেখবি কি করে। ওরা আমাদের জীবনেও শান্তি দেবেনা। এখন তো আরও পিছে লাগবে কারণ দেওয়ান বাড়িতে তাদের মেয়ে নেই। তুই চিন্তা করিস না।”

জেসি মজা করে বলল,”শুধু বোনের সাথে কথা বললেই হবে? এখানে কিন্তু আরও একজন আছে।”

কাদিন তার দিকে তাকালো। বলল,

“সরি দেখিনি।”

জেসি চোখ বড়বড় করে বলে উঠলো,

“দেখিনি মানে? একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ঘরে আর আপনি দেখেননি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

কাদিন একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

“আপনি কি সবসময় ঝগড়া করার মুডে থাকেন?”

জেসি বলল,”মোটেই না। আপনারই ভাবা উচিত যে আপনার সাথেই কেন আমার ঝগড়াঝাটি হয়?”

কাদিন শান্তভাবে বলল,”কারণ আপনি আমার সাথে ঝগড়া করতে পছন্দ করেন। আমার সাথে যে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায় সেটা আপনি জানেন না?”

“আমি আপনার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলিনি শুরুতেই? আপনিই আমাকে ত্যাড়ছাভাবে জবাব দিলেন।”

তখুনি জোসেফ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো দুই মগ কফি নিয়ে। সবাইকে দেখে বলল,

“সবাই দেখছি এখানে। জেসি পাকনামি না করে আর দুই মগ কফি নিয়ে এসো।”

জেসি বেরিয়ে গেল। কাদিন বলল,”খেয়ে এসেছি আমরা।”

“খেয়ে এলেও চা কফি খেতে হয়। কল্প নাও। কিছুক্ষণ পর তোমাকে ঔষধ খেতে হবে। করে খেয়ে নেবে। আমি একটুপর বেরোবো। ফিরতে দেরী হবে।”

কল্পনা হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিল। জোসেফ যত্ন করে কফিটা বানিয়েছে। কল্পনা জানতো সে খুব ভালো কফি বানাতে পারে। আজ খাওয়ার সৌভাগ্য হলো। কল্পনা মগে চুমুক বসালো। জোসেফ তার দিকে চেয়ে আছে। কল্পনা কফি খেয়ে চোখের ইশারায় জানালো ভীষণ ভালো হয়েছে। জোসেফ তা দেখে গলা ঝেড়ে কেশে বলল,

“তা কাবির সাহেব কোথায়? উনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। কল্প তুমি একা বসতে পারবে এখানে? আমরা বারান্দায় বসে কথাবার্তা বলতাম।”

কল্পনা বলল,”জি।”

জোসেফ কাদিন আর কাসেদকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে কল্পনার সামনে ওইসব ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে চাইছেনা।

কল্পনা কফিটা শেষ করে চোখ বুঁজলো। মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত ঘিনঘিনে গায়ের ঘ্রাণ লেপ্টে আছে তার গায়ে। অবচেতনে যেটুকু স্পর্শে সে আশ্রয় খুঁজেছিল এখন তা-ই তাকে বিদগ্ধ করে তুলছে। ঘৃণার কাঁটা হয়ে বিঁধছে মনের ভেতর।

_________________________

কল্পনা জোসেফদের বাড়িতেই আছে। জোসেফ বলেছে সে আর দেওয়ান বাড়িতে ফিরবে না। এখানেই তাদের বিয়েটা হবে। কল্প এখানেই নিরাপদ।

দেওয়ান বাড়ির সদস্যরা মেহতাজ ভিলায় এসেছে সন্ধ্যা নাগাদ। কল্পনা কামরান দেওয়ানের বুকে লুকিয়ে কাঁদলো অনেকক্ষণ।

রাতেই তাদের বিয়ে পরানোর কথা ঠিক হলো। আর্যাব খানের নামে মানহানীর মামলাও হয়েছে। জোসেফ রাতে বাড়ি ফিরলো কাজী সাহেবের সাথে। সবাই উপস্থিত মেহতাজ ভিলায়।

কল্পনাকে একটা লাল শাড়ি পরানো হয়েছে। অল্প করে সাজিয়েছে জেসি। যদিও জোসেফ বলেছে আর সাজগোজের কোনো দরকার নেই। কিন্তু তবুও জেসি আর কিরণ মিলে তাকে হালকা সাজালো।

জোসেফ নিজের ঘরে এসে শার্ট পাল্টে পাঞ্জাবি পরে নিল। হাতে ঘড়ি পরার সময় আচমকা মা ঘরে ঢুকে তার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল। জোসেফ কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নিল। ফোনের স্ক্রীনে একটা ছবি। জোসেফ সাথে সাথে ফোনটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারলো চিৎকার করে। জাহানারা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। জোসেফ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল,

“জানোয়ারটাকে আমি কেটে টুকরো টুকরো করবো। দেখে নিও তুমি।”

বলেই জোসেফ বেরিয়ে যাচ্ছিল। জাহানারা বেগম তার পথ আটকে বলল,

“তুমি ছবিগুলো ভালো করে দেখো। ভিডিওটা দেখো। কল্প কবুল বলেছে আর্যাব খানকে। ওরা একসাথে থেকেছে কালরাতে। সব জেনেশুনে তারপর কথা বলো জোসেফ।”

জোসেফ কড়াস্বরে বলল,

“কিচ্ছু দেখতে চাইনা আমি। কিচ্ছু শুনতে চাই না। একটা মেয়েকে ড্রাগস দিয়ে অনেককিছু করতে পারে ওরা। এইসব দেখার কোনো দরকার নেই আমার।”

জাহানারা বেগম চেঁচিয়ে বললেন,

“কল্প বিবাহিত জোসেফ। তুমি মানো আর না-ই মানো।”

“কল্প বিবাহিত না অবিবাহিত সেটা তুমি মানো আর না-ই মানো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

“জোসেফ!”

জোসেফ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কল্পনার সাথে বসে কথা বলছিল কিরণ আর জেসি। জোসেফ হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ওরা বেরিয়ে গেল। জোসেফ সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে কল্পনার দিকে ছুটে এসে তার দুগাল আঁকড়ে ধরে বলল,

“কল্প আমাকে শুধু একটা কথা বলো।”

কল্পনা তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,”কি?”

“তুমি আমার জন্য তোমার নীতির বিরুদ্ধে যাবে? সব নিয়ম অস্বীকার করবে? সবকিছুর উর্ধ্বে আমাকে রাখবে?”

কল্পনা হাঁ করে চেয়ে রইলো। এইসব প্রশ্ন আসছে কেন? কেন নীতির বিরুদ্ধে যেতে হবে? এমন কিছুই হয়নি তার সাথে। সে জানে সে কি করেছে, কি করেনি। জোসেফ বলল,

“আনসার মি কল্প। তুমি একবার হ্যাঁ বলো। আমি তোমাকে আমার কাছে রেখে দেব। পাপ হোক।”

কল্পনা তার দু-হাত নিজের মুখে চেপে ধরে বলল,”আমি যেদিন বিয়ের লাল শাড়িটা গায়ে দিয়েছি সেদিনই জোসেফ মেহতাজকে কবুল করে নিয়েছি। পাপপুণ্যর কথা জানিনা। কিন্তু আমার জীবনে জোসেফ মেহতাজই একমাত্র সত্য। আর সেটা আমি মৃত্যু অব্দি মেনে যাব।”

জোসেফের ঠোঁট কাঁপছে।

“আমার যেদিন মনে হ’য়েছে তোমাকে আমার লাগবে আমি সেদিনই তোমাকে কবুল করে নিয়েছি। আজকেও আবারও বলছি। তোমাকে কোটিবার কবুল। তোমার সমস্ত কলঙ্ক, অপবাদ কবুল।

মা…মা কীসব আজেবাজে বকছে। তুমি এখন সজ্ঞানে আছ। আমাকে কবুল বলে দাও। কোনো আয়োজন মানিনা আমি। এখন বলে দাও।”

কল্পনা চোখের জলে ভেসে কবুল বলে দিল। জোসেফ তার হাত ধরে বের করে আনলো ঘর থেকে। নীচে আসতেই দেখলো জাহানারা বেগম কাজী সাহেবকে বিদায় জানিয়েছেন। ছবি ভিডিও সবাইকে দেখাচ্ছেন। জোসেফ তা দেখে ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল,

“মা খবরদার ভিডিওটা তুমি কাউকে দেখাবে না। কল্প তখন সজ্ঞানে ছিল না। ও এখন সজ্ঞানে আছে। ওকে জিজ্ঞেস করো ও কি চায়। কল্প ওদের সবার সামনে বলো তুমি আমাকে সজ্ঞানে কবুল বলেছ। বলে দাও।”

কল্পনা বাপ ভাইদের দিকে তাকালো। বলল,

“ওরা জানে আমি কাকে কবুল বলতে পারি। ছোটমা তুমি জানো না? কিরণ তুই জানিস না? বল তাহলে।”

লুবনা বেগম বলল,

“আমি তোকে বিশ্বাস করি রে মা।”

কাবির এগিয়ে এসে বলল,”জোসেফ আমি..

জোসেফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার কাছ থেকে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কল্পকে আমি আপনাদের হাতেও দেব না। দু’জন মানুষ একসাথে থাকার জন্য এরচেয়ে বেশি কিছু আর প্রয়োজন হয় না। অজ্ঞান অবস্থায় একটা মেয়েকে কবুল বলিয়ে যে তামাশা করা হয় সেটাকে যদি বিয়ে বলা হয় তাহলে সেই বিয়ে আমি নিকুচি করি। সেই বিয়ে আমার দরকার নেই। আমি কল্পকে কবুল বলেছি, কল্প স্বেচ্ছায় আমাকে কবুল বলেছে আমার কাছে এটাই চরম সত্য। এই সত্যকে বাঁচানোর জন্য আমি সব করবো। আর্যাব খানের মতো পিশাচকে যদি খুন করতে হয় তাও করবো।”

জাহানারা বেগম চিল্লিয়ে বললেন,

“পাগল হয়ে গেছ তুমি? আরেকজনের বউকে কবুল বলেছ! ছেড়ে দাও ওর হাত। মেয়ের কি অভাব পড়েছে জোসেফ? তুমি কীসে কম? কেন পাগলামি করছো? তোমাকে এসবে মানাচ্ছে না জোসেফ। কল্প তুমি কেন ওকে মানা করছো না?”

কল্পনা বলল,”আন্টি আপনি অন্যায়টাকে সাপোর্ট করছেন? আমি কখনোই আর্যাব খানকে কবুল বলিনি। আমি বলতে পারিনা। আপনি বুঝতে পারছেন না একটা পিশাচ আমার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।”

জাহানারা বেগম মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। কামরান দেওয়ান বললেন,

“আপনি নিজের মেয়ের সাথে এরকমটা হলে কি করতেন বেয়াইন? আমি মানিনা ওই বিয়ে। আপনি যা দেখালেন সব বানোয়াট। এরকম তামাশা খানরা হরহামেশাই করে। আমরা কেউ মানিনা এটা বিয়ে। যে কবুল বলেছে সে নিজেই সজ্ঞানে ছিল না তাহলে সেটা কিভাবে বিয়ে হয়? আপনিই বলুন একবার।”

জাহানারা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না। জেসি মাকে বলল,”তুমি নিজেই তো বলেছিলে আর্য কত খারাপ। এখন ভাবিকে ওর দিকে ঠেলে দিচ্ছ কেন? আমি ভাবির জায়গায় থাকলে কি করতে?”

জাহানারা বেগম তাকে ধমকে বলল,”জেসি তুমি কথা বলো না এখানে।”

কামরান দেওয়ান কল্পনার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কল্প উনার সাথে কথা বলার দরকার নেই। আমি তোকে বলছি জোসেফ যেটা বলবে তুই সেটাই করবি। তোর মন যাকে চায় তুই তার সাথেই থাকবি। কেউ যদি বলে তা পাপ। তবে পাপ হোক। এত ভালো হতে হবেনা যাতে পাপীদের পাপকে আস্কারা দেয়া হয়।”

কল্পনা বাবার কথায় কাঁদতে লাগলো। কেন আল্লাহ তাকে এমন দোটানায় ফেললো। কি করবে এখন সে?

কামরান দেওয়ান এগিয়ে এসে জোসেফের হাতে কল্পনার হাতটা তুলে দিয়ে বলল,”আমরা বাড়ি ফিরলাম জোসেফ। তোমার উপর আমার মেয়ের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। তুমি ওকে মারো কাটো বকো যাই করো না কেন, কৈফিয়ত কোনোদিন চাইবো না। আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি এটুকু জানি যে কল্পকে তোমার চাইতে ভালো কেউ রাখতে পারবে না। কাজী অফিসে গিয়ে দুজন কাল বাকি কাজ সেড়ে নেবে। চলি। বেয়াইন চললাম আমরা।”

দেওয়ান বাড়ির মানুষ বিদায় নিল। জাহানারা বেগম কল্পনাকে বলল,

“তুমি জোসেফের জীবনে ঝড় ডেকে এনেছ কল্প। না তুমি শান্তি পাবে, না আমার ছেলেটাকে শান্তি দেবে। আমার ছেলেটার যদি কিছু হয় আমি তোমাকে মাফ দেব না। আর্যাব খান..

নামটা শোনামাত্রই জোসেফ বলে উঠলো,”কল্প ঘরে যাও।”

কল্পনা তার কথামতো উপরে চলে গেল। জোসেফ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“মা একটা কথা শুনে রাখো, পাপকে দমাতে পাপীদের বাপ হতেও রাজী আছি আমি। আল্লাহর কসম করে বলছি আমি কল্পকে আর্যাব খানের হাতে কিছুতেই দেব না। আমার গলায় ছুরি ধরলেও না।”

জাহানারা বেগম চিল্লিয়ে বললেন,

“মরবে তুমি? মরবে? মরতে চাও? একটা মেয়ের জন্য দেওয়ানা হয়ে গেছ তুমি। পৃথিবীতে ওই একটা মেয়েই আছে শুধু?”

জোসেফ দ্বিগুণ চিল্লিয়ে বলল,

“হ্যাঁ একটাই আছে আমার জন্য। মরতে হলে মরবো। কিন্তু তবুও দেব না। মরলেও দেব না। দেব না মানে দেব না। ব্যস। যাও তুমি যা করার করো।”

জাহানারা বেগম চোখে জল এনে বললেন,

“জোসেফ মায়ের সাথে এভাবে কথা বলে?”

জোসেফ হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল”মা যখন ছেলেকে বুঝতে চায় না তখন বলতে হয়। মা তুমি বড্ড অবুঝ। এই অবুঝ মাকে আমি চিনিনা।”

মা বললেন,”এই অবুঝ জোসেফ মেহতাজকে আমিও চিনিনা।”

জোসেফ আর কোনো কথা না শুনে ঘরে চলে গেল। বিছানার এককোণায় বসে রইলো চুপচাপ। কোনো দিকে তার ধ্যান নেই, হুঁশ নেই।

কল্পনা হঠাৎ ডাকল,”জোসেফ!”

জোসেফ চমকে তাকালো তার দিকে। কল্পনা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জোসেফ তাকে একঝটকায় কাছে নিয়ে এল। এত দূরত্বের পর আর দূরত্ব সয় না। কল্পনা কাঁদছে বুক উজাড় করে। সে থাকবে না এখানে। কারো জীবনে থাকবে না সে। জোসেফ তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,

“ডোন্ট লিভ কল্প। আমি কি করে থাকবো তোমাকে ছাড়া? আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বোঝো একটু। কারো কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই।”

কল্পনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে লাগলো একটু একটু করে। সে অনেকদূরে চলে যাবে। অনেকদূরে। যেখানে ভালোবাসা নেই, ঘৃণাও নেই। জোসেফ তাকে ঝাঁকিয়ে গর্জে উঠলো,

“কোথায় যাবে তুমি? কোথায় যাবে? সবাই বলছে তো ওটা বিয়ে? বেশ, ডিভোর্স দিয়ে দেবে। আর ভয় কীসের? কোথাও যাবেনা তুমি। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি সব ঠিক করে দেব।”

কল্পনা কেঁদে উঠে বলল,”আমরা একসাথে থাকাটা পাপ।”

জোসেফ গর্জে উঠলো গলা ফাটিয়ে,

“তুমি একদম বাজে অজুহাত দেবেনা।”

কল্পনা অসহায় হয়ে বলল,

“আমি কি করবো বলুন? কি করবো আমি? আমি জোসেফ মেহতাজ ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারব না। পারিনা। কিন্তু… আমি এখন এভাবে এখানে থাকতেও পারব না। এভাবে থাকা যায় না। এত কলঙ্ক নিয়ে আপনার সাথে থাকতে পারব না আমি।”

জোসেফ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,”কোথায় যাবে তুমি? কোথায় যাবে বলো?”

শেষে গর্জে উঠলো সে। তার গর্জনে কল্পনা কেঁপে উঠে বলল,”জানিনা। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমি কি করবো? কেন আমাদের সাথে এমন হলো? আমি কিছু জানিনা। কিছু না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

জোসেফ বলল,”সব ভুলে যাও। কিছু হয়নি তোমার। ওটা কোনো বিয়েই না।”

কল্পনা তবুও নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। দরজার কাছে ছুটে গেল। জোসেফ চেয়ে রইলো তার দিকে। সে কি করতে পারে জোসেফ তা দেখতে চায়।

দরজার খিল ধরে আবারও পিছু ফিরলো কল্পনা অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, বড়ো মায়ায়, চেনা টানে। এই মায়া ছাড়বে কিভাবে সে? কিভাবে, কিভাবে? জোসেফের কাছে ফেরে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে উঠলো সশব্দে। হায় আল্লাহ ভালোবাসায় কেন এত পাপ জড়ালো? এত দেয়াল কেন উঠলো?
জোসেফ তাকে ছাড়লো না আর। কল্পনা এত ধস্তাধস্তি করলো জোসেফ তাকে ছাড়লো না। একদম বুকের সাথে চেপে ধরে বসে গেল নীচে। কল্পনা কাঁদছে। এই কান্নার দাম আর্যাব খানকে দিতে হবে। কল্পনা কান্নাকাটি থামিয়ে চোখমুখ মুছে জোসেফের দিকে তাকালো। জোসেফ তার কপালে অধিকারবোধের মত আগ্রাসী চুম্বন রাখতেই কল্পনা আরও সশব্দে বুকের ভেতর থেকে ছিঁড়ে আসা কান্নায় ভেঙে পড়ল আবার। এই স্পর্শকে পাপ মনে হওয়ার আগে আল্লাহ তাকে কেন মৃত্যু দিল না?

সে জোসেফকে ভেঙেচুরে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। জোসেফ যেভাবে বসে ছিল সেভাবে বসে রইলো।

কল্পনা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। সাথে সাথে জোসেফের গর্জন ভেসে এল। সাথে দরজায় ধাক্কা, লাথি।

“তুমি আমার দেয়া শাড়ি পরে ওই বিয়ের অজুহাতে চলে যাচ্ছ এভাবে? তাহলে মনে রেখো তোমাকে বিধবা সাজানোর দায়িত্ব আমার।”

কল্পনা নীচে নেমে এল। জাহানারা বেগম বলল,

“বাড়ি যাও। ড্রাইভার আছে বাইরে।”

কল্পনা চোখ মুছে নিয়ে বলল,”যে বিয়ে আমি মানিনা সেই বিয়ের জন্য আমি যাচ্ছি না। যাচ্ছি আপনার কথার ভয়ে। আমি একদিন এই বাড়িতে সসম্মানে আসবো। সেদিন আপনার কিছু বলার থাকবেনা।”

জাহানারা বেগম বললেন,

“আমিও চাই সেইদিনটা আসুক। আমার ছেলের ভালো থাকাটা আমার কাছে সবার আগে।”

কল্পনা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল। জাহানারা বেগম আর্যাব খানকে মেসেজে জানিয়ে দিয়েছেন সেই কথা।

____

“তোমাকে আমি এইবার ছাড় দিলাম। আশিষের কিছু হয়ে গেলে তোমার যাবজ্জীবন অবধারিত ছিল। ও বেঁচে গিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে দিল।”

কাবির হালকা করে হাসলো। ফোনের ওপাশে থাকা আমিন খানের উদ্দেশ্য বলল,

“আপনি আমাকে ছাড় দেননি। নিজেরা বিপদে পড়বেন তাই গা বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ আশিষ খানের গুলির রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে আর্যাব খান না ফেঁসে যায়।
তবে একটা কথা শুনে রাখুন এই যশ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার আপনার ছেলেমেয়ের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে একদিন। আজ আইন আপনাদের কাছে বিক্রি হয়েছে। কাল তা হবে না। তখন আপনি আপনার মেঝ ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না। কল্পর সাথে সে যা করেছে তার শাস্তি সে পাবেই। আপনার মেয়ে আমার সাথে যা করেছে তার শাস্তিও সে পাবে। দেওয়ানরা নিজ হাতে শাস্তি দেয়, নইলে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়। বিচার একদিন হবেই। আর সেদিন কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।”

আমিন খান হাসলো। বলল,”আর্য যা করেছে তাতে আমাদের হাত নেই। বিশ্বাস না করলে কিছু করার নেই। তবে তার কাছে যখন প্রমাণ আছে বিয়েটা হয়েছে তখন তোমাদের অস্বীকার করার উপায়ও নেই।”

কাবির বলল,”আমি ওসব ব্যাপারে কথা বলতে চাইনা আপনার সাথে।”

“ইথু..

কাবির থামিয়ে দিয়ে বলল,

“তার ব্যাপারেও না। আপনার কথা শেষ হলে রাখুন।”

আমিন খান ফোন রেখে দিল। কাবির পরিবারের সদস্যদের সাথে বাড়ি ফিরছে। রাস্তাটা সুনসান। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ। গাড়িতে কেউ কথা বলছেনা। হঠাৎ তাদের অবাক করে দিয়ে একটা গাড়ি থামলো সবার সামনে। গাড়ি থেকে নামলো আরিশ খান। কাবির স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। কাদিন গাড়ি থেকে নামলো। আরিশ তার হাতে একটা মেডিকেল রিপোর্ট- দিল। কাদিন বলল,

“কার?”

“তোর বড় ভাইকে দে। ইথু অসুস্থ। হাসপাতালে আছে। কিছু বলার থাকলে ওখানে গিয়ে যেন বলে আসে। কারণ ও বেশিদিন দেশে থাকবেনা।”

কাদিন রিপোর্টটা খুলতে খুলতে কাবিরের কাছে এল। পুরোটা খুলতেই তার চোখ বিস্ফোরিত!

Pregnancy Test Report.

Patient Name: Anzill Khanam
Date: 15 January 2019
Test Name: Urine β-hCG (Pregnancy Test)
Result: Positive (+)

কাবির কাদিনের হাত থেকে রিপোর্টটা নিয়ে পড়লো। একমুহূর্তও দেরী না করে হাসপাতালে ছুটে গেল। আনঝিল খানমকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে ঠিক তখুনি কাবির পৌঁছে গেল হাসপাতালে। হাসপাতালে সবাই আছে। এমনকি তাহমিনাও। ইনাম কাঁদছে তাই তাকে শান্ত করাচ্ছে পিঠে আলতোভাবে হাত চাপড়ে।

ইথিকার গায়ে তখনো হসপিটাল গাউন। বেণী করা লাল চুলগুলো একপাশে পড়ে আছে এলোমেলো হয়ে। চোখের নীচে কালি হওয়া স্বত্তেও তার সৌন্দর্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি।

কাবির আর তার পরিবারকে দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। এমনকি ইথিকাও। এখনি আসতে হলো তাদের? উফ! এখন আবার কি ঝামেলা করে কে জানে।

ইলিনা হক বললেন,

“আমরা বাড়ি যাচ্ছি। ইথু কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।”

কাবির ইলিনা হকের বারণ শুনলো না। ইথিকার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইথিকা চোখ তুলে তাকালো কাবিরের দিকে। কাবির বলল,” Anzill I want my baby.”

ইথিকা অবাক হলো। আরিশের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো বিষয়টা কি। সে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,”But I Don’t.”

কাবির শান্ত মেজাজে বলল,

“আগে যা হয়েছে সবটা ফিরিয়ে নেব আমি। এইসব পারিবারিক বিবাদের জন্য একটা নিষ্পাপ প্রাণকে বলি হতে দেয়া যায় না। আমি জানি তুমি মা হিসেবে সেটাই চাইবে। আমিও তাই। বাচ্চাটাকে আসতে দাও। বাকি সব পরে হবে।”

ইথিকা বলল,”সরি মিস্টার দেওয়ান। আপনি কি শুনে এখানে এসেছেন জানিনা। তবে আমার মনে হয় এই রিপোর্টটা আপনার দেখা উচিত।”

কাবির তার বাড়িয়ে দেয়া রিপোর্টটা নিল।

এবোরশন মেডিকেল রিপোর্ট! বিস্ফোরিত চোখজোড়া বুলিয়ে পুরোটা পড়তে লাগলো,

Medical Report.

Patient Name: Anzill khanam
Age: 25 Years
Husband’s Name: Md. kabir Dewan

The patient is approximately 8 weeks pregnant. She has expressed significant emotional distress and clearly stated that she is not mentally prepared for motherhood at this stage.

Doctor’s Signature:
Dr. Lily Haque
MBBS, FCPS (Gynae)

কাবিরের বিশ্বাস হলো না। সে রিপোর্টটা এপিঠ ওপিঠ উল্টালো। এটা ভুল রিপোর্ট। ভুল। এ হতে পারে না। আনঝিল এত নীচু কাজ করতে পারে না। নিজের সন্তানের সাথে কোনো মা এমন করতে পারেনা। এ অসম্ভব!

সে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ইথিকার দিকে তাকালো। অবাক বিস্ময় নিয়ে বলল,”তুমি এটা কেন করলে? কি করে করলে? কেন করলে?”

হাসপাতালের করিডোর কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো সে। ইথিকা ক্ষোভের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। কাবির তার বাহু চেপে ধরে বলল,

“ও কি দোষ করেছে? তুমি আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে বাচ্চাটাকে শাস্তি দিলে কেন? কেন দিলে? আমাকে যা ইচ্ছে তা শাস্তি দিতে কিন্তু বাচ্চাটাকে কেন? তুমি না মা?”

ইথিকাকে ঠেলে দিল সে। ইথিকা দেয়াল আঁকড়ে দাঁড়ালো। ভীষণ রকম কঠিন গলায় বলল,

“যাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি তার রক্তবীর্য শরীর থেকে উপড়ে ফেলে আমি কোনো ভুল করিনি। আমি আপনাকে ঘৃণা করি, আপনার রক্তকেও। আমি স্বাধীন হয়ে বাঁচতে চাই। ওই পরাধীনতার বীজ নিজের গর্ভে লালন করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল। তাই আমি তাকে আমার গর্ভে জায়গা দিইনি। আজ দেওয়ানদের রক্ত, সমস্ত অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলাম আমি। আজ আমি মুক্ত, স্বাধীন। দেওয়ানদের রক্তের অপমানই আমার প্রতিশোধ। আমি আপনাকে ভেঙেচুরে দিতে পেরে খুশি। আর কিচ্ছু চাইনা আমার।”

লুবনা বেগম কাবিরকে ধরে রাখলেন। কাবির হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে ক্রোধের সাথে উচ্চারণ করলো।

“আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি। তোমাকে অভিশাপ, তোমার নারীত্বকে অভিশাপ। তুমি আমাকে নও নিজের একটা অংশকে অস্বীকার করেছ। খুন করেছ। খুনী আনঝিল খানম তোমার পঁচে যাওয়া বিবেকের মৃত্যু হোক একদিন। আজ খুব করে চাইছি পৃথিবীর বুকে তোমার মতো নিকৃষ্ট নারীর আর জায়গা না হোক। বাপ ভাইয়ের কথায় এসব করছো তুমি তাই না? একদিন ওরাই তোমাকে ধ্বংস করে দেবে। ওরাই তোমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে।”

ইথিকা হালকা হাসলো।

“আপনার অভিশাপেই আমি ভালোভাবে বেঁচে থাকবো মিস্টার দেওয়ান। খুশি হোন এটা ভেবে যে আমাদের আর কোনোদিন সামনাসামনি দেখা হবেনা। ভালো থাকবেন। আলবিদা।”

ইথিকার হুইল চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলো ইলিনা বেগম। লুবনা বেগম বাকহারা হয়ে দেখলেন ভালোবাসা, টান, মায়া, সমস্ত স্মৃতি, দুঃখ–সুখের স্নেহমাখা মুহূর্ত সবটাকে পায়ে গুড়িয়ে দিয়ে সে কেমন ঔদ্ধত্যের সাথে হেঁটে চলে যাচ্ছে একবারও পিছু না ফিরে। লুবনা বেগমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, আরেহ মেয়ে একবার ফিরে দেখ কাকে কীসের মধ্যে ফেলে চলে যাচ্ছিস? বাকিসব না হয় মিথ্যে ছিল স্বামীটা তো মিথ্যে ছিল না। আমি আমার ছেলেকে চিনি রে। ও কোনোদিনও তোর সাথে ছলনা করেনি।

কাবির ধপ করে বেঞ্চিতে বসে পড়লো। লুবনা বেগম হু হু করে কাঁদছেন। মায়ের কান্না দেখে কিরণও কাঁদছে। ডাক্তারের সাথে চিল্লাচিল্লি করছেন কাওসার দেওয়ান আর কাদিন।

দূরে কোথাও মায়ের কোলে বাচ্চা কাঁদছে।
এমনকি তাহমিনার কোলে ইনামও। কাবির রক্তচক্ষু তুলে তাহমিনার দিকে তাকালো। এলোমেলো সুরে বলল,

“মিনা তুমি কি আমাকে সেদিন অভিশাপ দিয়েছিলে? আসলাম খানের হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারিনি বলে?”

তাহমিনা চোখের জল লুকিয়ে দুপাশে মাথা নাড়লো।

“না, আপনাকে আমি কেন অভিশাপ দেব? দোষ তো আমার কপালের।”

কাবির বলল,

“তাহলে নিশ্চয়ই নাজিফা দিয়েছে। ওর স্বামীর খুনীকে বিয়ে করেছি বলে। নাজিফা না দিলে মাজহাবের পরিবার দিয়েছে। কেউ না কেউ তো দিয়েছে।”

লুবনা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”তোমাকে কেউ কেন অভিশাপ দেবে কাবির? এসব তোমার কপালে ছিল। তোমাকে কেউ অভিশাপ দিতে পারেনা। তুমি কোনোদিন নিজের ভালোর জন্য কারো ক্ষতি করোনি। কারো ক্ষতি চাওনি। তোমাকে কেউ কেন অভিশাপ দেবে?”

কাবির বলল,”তাহলে ওই নিষ্পাপ প্রাণটা কেন তার মায়ের রোষের বলি হলো বলতে পারো? ওর কি দোষ ছিল? ওকে ওর মা খুন করে দিল। এটা তো একপ্রকার খুন।”

কামরান দেওয়ান তার কাঁধে হাত রাখলো। কাবির হাত নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কামরান দেওয়ান বললেন,

“তোমাকে সুখী হতে হবে কাবির। তোমাকে ওরা ভেঙে দিয়ে গেল। কিন্তু তুমি ভাঙবে না। তুমি মাথা উঁচু করে বাঁচবে চিরকাল। তুমি কাবির দেওয়ান। ছলনার, শঠতার জবাব তোমাকে তোমার কাজ দিয়েই দিতে হবে।”

কাবির বেরিয়ে পড়লো। ইনামের কান্না তার বুক ছিঁড়ে ফেলছে। তাহমিনা আসলাম খানকে এত ঘৃণা করার পরও খানদের রক্ত ধারণ করেছে নিজের গর্ভে। মাতৃত্বকে সে সম্মান দিয়েছে। আনঝিল খানম কেন পারেনি? এমন তো নয় যে তাহমিনার চাইতে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে সে দেওয়ান বাড়িতে। তাহলে কেন?

কাবির রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো একা একা হাঁটতে। মাঝপথে এসে দেখলো কল্পনা বন্ধ হয়ে যাওয়া টং দোকানের বাইরে রাখা বেঞ্চে বসে আছে। কাবির ডাকল,

“কল্প!”

কাবিরকে দেখামাত্রই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো কল্পনা। কান্না থামাতে চেয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। কাবির তার মাথায় হাত রাখলো।

“কাঁদে তো তাহমিনারা। কল্পনারা নয়।”

কল্পনা তার হাতটা মাথায় চেপে ধরে রেখে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো। কাবির সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না। সান্ত্বনা কি একফোঁটা কষ্টও কমায়?

চলমান…