মনবিবাগী দিওয়ানা পর্ব-৯+১০

0
1

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

ইথিকা ঘরে ঢুকেই কাবিরের শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। হাতে মালিশ করতে করতে কাবিরের দিকে তাকাল আহত চোখে। এত শক্ত হাত। উফ! মধু মাখতে পারেনা হাতগুলোতে? এত মধু করে কি? হাতে মাখলে হাতটা তো অন্তত নরম থাকে। এতক্ষণ ধরে তার আঙুলগুলো লোকটার লোহার শিকলের মতো হাতে গেঁথে ছিল। আরেকটু চাপ দিলেই বুঝি হাড়গোড় ভেঙে যেত।

কাবির ধীরস্থির চোখে তার দিকে তাকাল। ইথিকার মুখ অর্ধেক ঢাকা ওড়নায়। আজ সে সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। এমনকি ওড়নাও। যা বিরল দৃশ্য। তার সঙ্গে একদম বেমানান। কাবির অবাক হয়েছে। হয়ত বাড়ির বাকি সদস্যরাও। আনঝিল খানমকে চেনার সাধ্য কার?

কাবির একবারে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত তাকে নিরীক্ষণ করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

“তুমি যদি সবসময় এটুকু শালীনতা বজায় রাখতে, তাহলে আর কোনো অভিযোগ রাখতাম না। কিন্তু তুমি তা করবে কেন? তোমাকে সবসময় তোমার পারিবারিক কুশিক্ষার ফল দেখিয়ে বেড়াতে হবে সবাইকে।”

ইথিকার চোখমুখ কঠিন হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে সে কাঁধ থেকে ওড়নাটা টেনে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে।

কাবিরের চোখ ধপ করে উঠল। সে ওড়নার দিকে তাকাল। তারপর আবার ইথিকার চোখে চোখ রাখল।

আজকাল সহজেই মেজাজ হারাচ্ছে সে। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ছে। ইথিকা তার দিকে চোখা দৃষ্টিতে তাকাল। কাবির রাগ সামলে বলল,

“আমার সবচেয়ে বড় ভুল তোমাকে বিয়ে করা। দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে তোমার মতো বেয়াদবকে মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচান। ওখানে ছেড়ে আসতাম তাহলে লাশ হয়ে ফিরতে।”

ইথিকা অন্যত্র মুখ ফিরিয়ে নিল। তাকে বাঁচিয়ে উদ্ধার করে ফেলেছে। মরে গেলে যেত। কে বলেছে তাকে বাঁচাতে? এত মহৎ কাজ করতে কে বলেছে?

কাবির তার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, “অসহ্য” শব্দটা উচ্চারণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ইথিকা দরজার কাছে ছুটে এসে দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে বলল,

“আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। একা থাকতে চাই। আর ঘরে আসতে পারবেন না।”

কাবির ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। শক্ত কন্ঠে ব্যঙ্গ করে বলল,

“চেহারাটার কি হাল হয়েছে দেখেছ? তোমার সাথে ঘুমাতে আমার ভয় করবে না?”

ইথিকা চেঁচিয়ে উঠল,”কাবির!”

কাবির হালকা বিদ্রুপের সুরে বলল,”ভাইদের মতো ফাঁকা আওয়াজটা ঠিকঠাক দিতে জান। আর এটা জান না যে এইসব ফাঁকা আওয়াজকে দেওয়ানরা ভয় পায় না।”

ইথিকা ধপ করে দরজা বন্ধ করে দিল।
তারপর দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বালিশের উপর থাকা ফোনের দিকে তাকাল। মেঝ ভাইয়াকে ফোন দেয়া দরকার। সে ছুটে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে আর্যাব খানকে ফোন দিল। ফোনটা রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে আর্যাব খান বলল,

“আবার কি অঘটন ঘটিয়েছিস?”

ইথিকার কণ্ঠ কাঁপছে রাগে-দুঃখে।

“তুমি ওই কামরান দেওয়ানকে কবে ছাড়ছ ভাইয়া?”

ওপাশ থেকে আর্যাব খানের ভারী, স্থির গলা ভেসে এল।

“শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওদিকের হয়ে গেলি নাকি? একটা কথা ভুলে যাস না। বিয়েটাই সম্ভব হয়েছে ওই কামরান দেওয়ানের জন্য। ওই ব্যাটাকে আমি এত সহজে ছাড়ব না।”

ইথিকা চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। মাথার ভেতর ধপধপ করছে কেন যেন। সে চোখ খুলে শক্ত গলায় বলল,

“আমি মোটেও এজন্য ফোন দিইনি যা তুমি ভাবছ। কামরান দেওয়ানকে ছাড়লে এরা আমাকে আরও পেয়ে বসবে। একদম ছাড়বে না।”

ওপাশে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর গম্ভীর কণ্ঠের ভেতর দিয়ে চাপা হাসির শব্দ ভেসে এল।

“এই না হলে আনঝিল খানম!”

_____________

নীচে প্রচন্ড হৈচৈ লেগেছে। কি হয়েছে ইথিকা জানেনা। কাজের বুয়া ঝিনুককে ডাক দিতেই সে ছুটে এল। মাথায় কাপড় তুলে জানতে চাইল,

“কিছু লাগবে বৌমণি?”

ইথিকা জানতে চাইল,”নীচে কি হয়েছে?”

ঝিনুক বলল,”কল্প আপা আর কিরণ এখনো বাড়ি ফেরেনি।”

ইথিকার ভ্রু কুঁচকে গেল। বাড়ি ফেরেনি? কিন্তু কেন? আবার কার পাল্লায় পড়ল?

এসবে ভাইয়াদের হাত নেই তো? ফোন দিয়ে জেনে নেবে? না যদি সন্দেহ মিথ্যে হয়? কিন্তু আপাতত দেওয়ানদের শত্রু খানরা ছাড়া আর কেই বা আছে?

ঝিনুক তখনও তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ইথিকা সেটা টের পেয়ে এক ঝটকায় তার দিকে তাকাল।

“হাঁ করে কি দেখছ? যাও। আমার রাতের খাবার এখানে পাঠিয়ে দেবে। আমি ডাইনিংয়ে বসে খাব না।”

ঝিনুক অবাক হলো। বাড়িতে এমন পরিস্থিতি আর এই মেয়ে আছে খাওয়ার তালে। কি নিমকহারাম। কাবির ভাইজানের কপালে এটা কি জুটে গেল? কত ভালো মানুষ এরা। আর আত্মীয় করেছে এইসব নিমকহারামদের সাথে। তার ননদরা নিখোঁজ আর সে আছে খাওয়ার তালে।

কাবির বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ হলো। লুবনা বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ঝিনুক। লুবনা বেগম চিন্তায় পড়ে গেছেন। মেয়েগুলো সহিসালামতে বাড়ি ফিরবে তো?

কলিমউদ্দিন দেওয়ানের শরীর খারাপ। উনি ভেবেই নিয়েছেন আর বেশিদিন বাঁচবেন না। কিন্তু খানদের শেষটা দেখে যেতে পারলে আরও ভালো লাগত।

কাওসার দেওয়ান পায়চারি করছেন। অস্থির লাগছে। যা ভাবছেন তা যদি হয় তাহলে এবার তুলকালাম কান্ড ঘটবে। কাবির এবার আর ছাড়বে না তাদের। সব তছনছ হয়ে যাবে এবার। সব ছারখার হয়ে যাবে।

ইথিকা নীচে এসে সবার চেহারা পরখ করছে। তার দিকে তাকাল লুবনা বেগম। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখ সরিয়ে নিল। ইথিকা বলল,

“আপনারা পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?”

কাসেদ ছিল দাদাভাইয়ের পাশে। বলে উঠল,

“পুলিশই তো আসল দূর্নীতিবাজ।”

ইথিকার মেজাজ তুঙ্গে উঠল। কাসেদকে ধমকে বলল,

“আমি তোমার সাথে কথা বলছিনা।”

কাসেদ বলল,”আমি তোমার সাথে কথা বলছি। অত দরদ থাকে তো নিজের পুলিশ ভাইকে জানাও খবরটা। কল্পকিরণকে খুঁজে বের করে দিতে বলো।”

ইথিকা বলল,”অবশ্যই বলব। কিন্তু তোমার কথায় নয়। আমার ইচ্ছে হলে। তোমার সাহস কি করে হয় আমার সাথে এভাবে কথা বলার?”

কাওসার দেওয়ানের মুখ থমথমে। তিনি ধমকে উঠে বললেন,

“কাসেদ তর্কে জড়িও না। তোমার বড় ভাইকে ফোন দাও। কী বলে শোনো।”

মুখ শক্ত করে ফোনটা তুলে নিল কাসেদ। একনাগাড়ে ফোন করতে লাগল।

রিং বাজে… কেটে যায়।

আবার ডায়াল।

একই অবস্থা।

ফোনকল ব্যস্ত দেখায় বারবার।

কাসেদের মুখে বিরক্তি খেলে গেল।

“ফোন ব্যস্ত দেখাচ্ছে।”

কাওসার দেওয়ানের পায়চারি থেমে গেল। এত দুশ্চিন্তা আর নেয়া যায় না। তিনি আবারও লুবনা বেগমকে বকতে লাগলেন।

“কতবার বলেছি মেয়েদের একা ছাড়বে না। চতুর্দিকে শয়তান উৎপেতে বসে আছে। কিন্তু কে আমার কথা কানে নেয়? তুমিও কেমন কাসেদ? ওদের একা ছাড়লে কেন? তুমি জান না আমাদের শত্রু ঘরে বাইরে বসে আছে আমাদের হেনস্তা করার জন্য?”

কথাটা ইথিকার গায়ে গিয়ে লাগল। সে আর দাঁড়াল না। উপরে চলে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর ধীরেসুস্থে ফোনটা হাতে নিয়ে আশিষ খানকে ফোন দিল।

হালকা নীলচে আলোয় মাখা পুরো হলঘর। সিলিংয়ে ঝুলছে ক্রিস্টালের চাঁদোয়া। ডান্সফ্লোরে বাজছে হালকা ওয়েস্টার্ন বিট। ড্রিংকস কাউন্টারে কয়েকজন ছেলেমেয়ে উচ্ছল হয়ে হাসাহাসি করছে। সোফার এক কোণায় ধোঁয়ার কুয়াশায় ঢাকা একটা ছায়া বসে আছে।

সে আর কেউ নয়। আশিষ খান।

গায়ে কালো শার্ট, হাতের বুড়ো আঙুলে মোটা রুপার আংটি। তাকে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন লোক। কয়েকজন গ্লাস হাতে নিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। আশিষ খান বিড়বিড় করে গালি দিয়ে ঠোঁটে সিগারেট চাপল। অসহ্য অসহ্য। সহ্য করতে না পারলে এখানে এলি কেন? ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল সে।

ইথিকা ফোন করছে বারবার। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে নামটা, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। সে ফোনটা দেখেও ধরছে না। তার চোখ জ্বলছে অন্যরকম ঝাঁঝে। ইথিকাকেও গালি দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন ফোন দিয়ে গালিগালাজ করলে আর্যাব খানের কানে গিয়ে পৌঁছাবে কথাটা। বদ মেয়েটাকে গালি দিয়েও শান্তি নেই। কোথাও গিয়ে তার জ্বালায় দুদন্ড বসে থাকা যায় না। শেষে আর না পেরে ফোনটা রিসিভ করল। তারপর ঝাঁজাল গলায় বলল,

“কে মরেছে?”

ইথিকা রেগে গিয়ে বলল,”উফ আবারও মদ খেয়েছ?”

“হ্যাঁ তো?”

“তুমি জান কল্প কিরণকে কারা তুলে নিয়ে গেছে?”

আশিষ খান বলল,”না জানিনা। আবার কার মরার ইচ্ছে জাগল?”

ইথিকা বলল,”মেঝ ভাইয়াকে ফোন দাও।”

“তোর হাতে কি হয়েছে?”

“উফ, আমার ভয় করছে। যদি ব্যস্ততার সময় ফোন করি বকবে আমাকে। তুমি দাও। আর যদি জানতে পার যে ওরা ভাইয়ার জিম্মায় তাহলে বলবে ছেড়ে দিতে। দেওয়ান বাড়ির সবাই অলরেডি সন্দেহ করা শুরু করেছে। যদি ভাইয়া ধরা পড়ে যায় তাহলে সব যাবে।”

“শ্বশুরবাড়ির হয়ে কথা বলছিস?”

“মোটেও না। আমি জাস্ট সাবধান করছি।”

আশিষ খান হেসে উঠে বলল,

“যদি ভাইয়ের হাতে পড়ে তাহলে এটা জেনে রাখ ওদের নিস্তার নেই। ওস্তাদের মার শেষ রাতে তো পড়বেই।”

ইথিকা চেঁচিয়ে উঠল,

“আমি ওদের ভয় পাচ্ছিনা। কিন্তু ভাইয়া বিপদে পড়ে যাবে। কল্প খুব চালাক মেয়ে। যেমন ভাই তেমন বোন। ভাইয়া কেন এসব করছে আমি জানিনা। কিন্তু এত কাঁচা খেলা কেন খেলছে দেওয়ানদের সাথে?”

“হাট্ট! কীসের কাঁচাখেলা? কাঁচাখেলা খেললে তোর বিয়েটা হত? তোকে পা দেখিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিত ওই কাবির দেওয়ান।”

ইথিকা বলল,”এত বাজে বকো না। খোঁজ নাও মেঝ ভাইয়া কোথায়? আর বড় ভাইয়া?”

“বউ বাচ্চা চলে যাওয়ার চলে যাওয়ার দুঃখে কোথায় পড়ে আছে কে জানে।”

“ভাবি আসবেনা বলেছে?”

“শুধু আসবেনা বলেনি। ইনামের চেহারা অব্দি দেখায়নি। বাপের বাড়িতে উঠে তার দেমাক বেড়েছে।”

ইথিকা শান্ত গলায় বলল,”ওকে ওসব পরে দেখা যাবে। তুমি এখুনি খোঁজ নাও মেঝ ভাইয়া কোথায়।”

“ওকে।”

ফোন রেখে ইথিকা ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। তার সন্দেহ ঠিক না হোক। কিন্তু খানদের শত্রু আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই মেঝ ভাইয়ার কাজ।

________

রাস্তার মাঝখানে নিথর দাঁড়িয়ে আছে আর্যাব খানের কালো রঙের গাড়ি। গভীর রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে জ্বলজ্বল করছে রাস্তার সড়ক বাতিগুলো। তবুও চারপাশে একটা ধোঁয়াশা ছড়িয়ে আছে।

গাড়ির ছাদে শুয়ে আছে আর্যাব খান। চোখ দুটো আধভেজা, কিন্তু ঘুমিয়ে নেই।

হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।
আর্যাব খান ধীরস্থির ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিল। স্ক্রিনে একটা মেসেজ,

“কাজ হয়ে গেছে স্যার। হি ইজ নো মোর।”

এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ করল আর্যাব খান। ঠোঁটের কোণে ধীরলয়ে ফুটে উঠল কুটিল হাসি। বহুদিনের অপেক্ষার শেষে প্রতিশোধের স্বাদ মিলেছে তবে। আজ তার মতো খুশি আর কেউ নেই। খান বাড়ির আদরের কন্যার খুনী আজ তার যোগ্য শাস্তিটা পেয়েছে। কিন্তু নিজের হাতে মারার তৃপ্তিটা অন্যরকম। আর্যাব খানের আফসোস রয়ে গেল। নিজের হাতে মারার রিস্কটা সে নেয়নি। কেন নেয়নি তার পেছনে হাজারটা কারণ আছে। কিন্তু এবার অপেক্ষা লাশ পেয়ে দেওয়ানদের কি দশা হয় তা দেখার। মনে মনে হাসল সে। বেচারা কাবির! শেষ রক্ষা আর হলো না।

একপেশে হেসে মেসেজটা সে ডিলিট করে দিল একটানে। তারপর ফোনটা আঙুলের ক্লিকে লক করে পকেটে রাখল। রাতের ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে লাগছে। আঙুলের ডগায় সিগারেটটা পুড়ে অর্ধেক হয়ে এসেছে। আস্তে করে উঠে বসলো সে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। দূরে কোথাও কুকুর ডেকে উঠল। সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায়। তারপর গাড়িতে উঠে বসল। একবার লাশের মুখদর্শন করা উচিত। শেষবিদায়!

___

রাতের নিঃস্তব্ধ অন্ধকারে ম্লান জ্যোৎস্নার আলো ঝরে পড়ছে রাস্তার ধুলো মাখা ইটের ওপর। দূরে কোথাও কুকুরের কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছে। একনাগাড়ে ডাকছে কুকুরগুলো। থামছেনা। রাতের নিশাচর পাখিগুলোর ডানা ঝাপটানো কানে আসছে। ভয়ংকর লাগছে চারপাশ। কিন্তু লোকটা ভয় পাচ্ছে না। সে এসবে অভ্যস্ত।

লোকটা ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে নির্জন গলিপথ ধরে। কাঁধে ঝুলছে আরেকটা নিথর শরীর। দেহটা শ্যাওলা পড়া আলগা কাপড়ে মোড়া। লোকটা হাঁটছে চুপচাপ। পায়ের শব্দও হচ্ছে না। তার গন্তব্য দূরে কোথাও। দ্রুত ওখানে পৌঁছাতে হবে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ। এত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সে আগেও করেছে। কিন্তু এবারেরটা ভিন্ন রকম। তার ভয় লাগছেনা কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে। সে এবার দ্রুত পা চালাল। কয়েক কদম হেঁটে একটু থামল। আবারও পা চালাল। থামলে চলবে না। আজ রাতের মধ্যেই সব সমাধান করতে হবে। কল্পনা দেওয়ান কি আছে সেখানে?

কল্পনার গলা কাঁপছে। বাঁধা চেয়ারে বসে ছটফট করছে সে। ঘরের দেওয়ালে ফাটা আলোর মতো একটা হলুদ আলো ঝিম ধরে জ্বলছে।

“কিরণ! ওঠ! প্লিজ ওঠ!”

কিরণ নিথর। মাথাটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ। শ্বাস চলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

কল্পনা এবার নিজের বাঁধা হাতগুলো একসঙ্গে ঘষে ঘষে ছুটানোর চেষ্টা করল। চোখে পানি এসে যাচ্ছে তবু সে থামছে না।

“কে আছ? বাইরে কে? বাঁচাও! তোমরা কারা? কি চাও? কথা বলছ না কেন?”

ঘরের বাইরে দূরে কারা যেন হাঁটছে। কল্পনা আন্দাজ করতে পারছেনা এরা কারা? হঠাৎ মনে পড়ল আর্যাব খানের কথা। পথে আসার সময় তো আর্যাব খানকে দেখেছিল তারা। সে গালিও দিয়েছিল রাগে। তার হাত নেই তো এসবে?

কল্পনার বুকের ভেতর ধকধক শব্দ বাড়ছে।

হঠাৎ করেই দরজার ওধারে ভারী পায়ের আওয়াজ…

কেউ আসছে।

কল্পনা দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে।

দরজায় শব্দ হলো। কাঁধে একটা লাশমতো কিছু নিয়ে একটা ছায়ার মতো কিছু একটা দাঁড়াল। কল্পনা চেঁচিয়ে উঠল,

“কে তুমি? কি চাও? আমাদের ছেড়ে দাও।”

লোকটা ভেতরে ধীরপায়ে প্রবেশ করল। কল্পনা তার চেহারা দেখে চমকে উঠল! এই লোকটা? যে রোজ তার পিছু নিত? কিন্তু এই লোকটা এখানে কি করছে? কাঁধে এটা কে?

লোকটা কিছু না বলে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর কাঁধে থাকা লোকটাকে মেঝেতে শুইয়ে দিতেই কল্পনা দ্বিগুণ চমকে উঠল। টপটপ করে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

আব্বা! তার আব্বা!

সে চোখজোড়া তুলে লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা এগিয়ে এসে তার বাঁধন খুলে দিল। কল্পনা বাবার কাছে ছুটে গেল। বাবার মুখ ধরে ডাকাডাকি করতে লাগল। কপালে আর হাতের আঙুলে চুমু খেল। তার কান্নাকাটি শুনে কিরণের জ্ঞান ফিরে এল। লোকটা কিরণের বাঁধনও খুলে দিল।

বাবা কথা বলছেনা দেখে কল্পনা হু হু করে কেঁদে উঠল। তারপর আচমকা তেড়ে এসে লোকটাকে জোরে একটা ধাক্কা দিল।

“কি করেছেন আমার বাবার সাথে? আমি আপনাকে ভালো মানুষ ভাবতাম। আপনি আমার বাবাকে গুম করে রেখেছেন এতদিন। আপনাকে ছাড়ব না আমি। মেরে ফেলব। অমানুষ।”

লোকটা তাকে বাঁধা দিল না। কল্পনা ধাক্কা দিয়ে থামেনি। লোকটাকে ক্রমাগত আঘাত করতে উদ্যত হলো। আর তখুনি লোকটা নকল দাঁড়ি তার হাতের কাছে চলে এল। কল্পনা তৃতীয়বারের মতো অবাক হলো। স্তব্ধ হয়ে গেল। পা জমে গেল তার।
হাঁ করে চেয়ে রইল সে। কি হলো এটা? কে এই লোক? কি চায় সে?

লোকটা এক পা এগিয়ে এসে নিজের চুলগুলোও খুলে ফেলল। কল্পনা তার দিকে তাকিয়ে অগোছালোভাবে বলল,

“কে আপনি?”

লোকটা তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল,

“Special Secret agent. Joshep Mehtaj. You can call me Joshep.”

“আপনি কী চান?”

“I’m here to protect you. kabir dewan has hired me.”

“আর বাবা!”

“He is unconscious at the moment. I have rescued him from Arzab Khan’s grasp.”

কল্পনা কান্না চেপে অস্ফুটস্বরে বলল,

“Thank you. Thank you so much.”

“But I want to hear something Special.”

কল্পনা থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আপাদমস্তক কেমন শিরশির করে উঠল লজ্জায়।

বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজায় আওয়াজ। জোসেফ মেহতাজ দরজা খুলে দিতেই কাবির, কাদিন আর কয়েকজন অস্ত্রধারী একসাথে ঢুকে পড়ল ঘরটাতে। কল্পনা বাবাকে দেখিয়ে কাদিনকে বলে উঠল,

“ভাইয়া দেখো বাবা।”

কাদিন ছুটে এল। বাবাকে নিজের কোলের উপর তুলে ডাকাডাকি করতে লাগল। কি হাল করেছে মানুষটার। অমানুষগুলোকে সে ছাড়বে না।

কাবিরের চোখ জোসেফের দিকে পড়তেই তাদের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার লেনদেন হলো। জোসেফ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর দাঁড়ি, চুল আবারও লাগিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর হতে। বেরোনোর সময় কল্পনার সাথে একবার চোখাচোখি হলো। ওটা কাবিরের চোখ এড়ায়নি।

চলমান….

#মনবিবাগী_দিওয়ানা
#পর্ব_১০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কামরান দেওয়ানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার অযত্ন অবহেলায় শরীরে নানান রোগ বাসা বেঁধেছে। এখনো চোখ মেলে সন্তান আর পরিবারের মানুষদের দেখেননি। কল্পনার চিন্তা হচ্ছে। জোসেফ মেহতাজ কি এমন করেছে যার জন্য বাবা এমন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এখনো?

হাসপাতালে বাড়ির সবাই এসেছে। এমনকি ইথিকাও। সে চুপচাপ করিডরে বেঞ্চে বসে আছে। কাবির কেবিন থেকে বেরিয়ে তাকে দেখল। কিছু না বলে পাশ কেটে চলে গেল ফোনে কথা বলতে বলতে। জোসেফ এখনো কোনো খবর দেয়নি। আর্যাব খান এখন তার পেছনে লাগবে। এরা এত সহজে শোধরানোর নয়। পুরো পরিবার মিলে বড় জ্যাঠাকে বন্দী করে রেখেছে। অথচ দিনের পর দিন মিথ্যে বলে গেছে। এমনকি ইথিকাও।

কাবিরের মাথার রগ দপদপ করছে। কপাল ঘামছে। বড় জ্যাঠার কিছু হয়ে গেলে সে কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না। ভাগ্য ভালো সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক এগিয়েছে। জোসেফ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। নইলে বড় জ্যাঠার লাশ পড়ত। উনি জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে এটাই অনেক।

এই অপরাধের জন্য কাবির ওদের শাস্তি দেবেই। একচুল পরিমাণও ছাড় দেবেনা সে। আসলাম খান, আর্যাব খানকে সবার আগে শাস্তি দেবে। আনঝিল খানমও বাদ যাবেনা। ও সব জানত। যে মেয়ে এত নীচে নামতে পারে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে সে আর যাইহোক ভালো জীবনসঙ্গী কোনোদিনও হতে পারে না। তার প্রতি কাবিরের ঘৃণা আরও বেড়ে গেল।

রাত দেড়টায় কামরান সাহেবের জ্ঞান ফিরল। একদফা কান্নাকাটি হয়ে গেল কেবিন রুমে। অনেকগুলো দিনপর পরিবারকে পেয়ে তিনি নিজেই কাঁদতে লাগলেন বাচ্চাদের মতো। কল্পনা শিয়রে বসে চোখের পানি মুছে দিতে লাগল ওড়না দিয়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলল,

“আর কোনো ভয় নেই বাবা। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কামরান দেওয়ান চোখ মেলে বাড়ির বাকি সদস্যদের দিকে একে একে তাকান। কাদিন এসে পাশে বসে। কল্পনা বলল,

“ভাইয়া।”

কামরান দেওয়ান ছেলের দিকে তাকান। হাত বাড়িয়ে দেন। কাদিন হাতটা ধরে উল্টোপিঠে চুমু দেয়। কাসেদ এসে বলল,

“বড় কাকা এবার তোমাকে আমরা আর পালাতে দেব না।”

কামরান দেওয়ানের ঠোঁটের কোণায় হঠাৎ হাসির রেখা ভেসে উঠে। তারপর আচমকা দরজার দিকে তাকিয়ে চোখজোড়া কঠিন হয়ে আসে উনার। ইথিকা দ্রুত সরে পড়ে। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কল্পনা জানতে চায়,

“বাবা কি হয়েছে?”

কামরান দেওয়ান অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে,”আমিন খান!”

_____

ইথিকা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে তার ভাইদের। কেউ ফোন তুলছেনা। ইথিকার চিন্তা বেড়ে গেল। ভাইয়াদের হাত থেকে কামরান দেওয়ানকে কিভাবে উদ্ধার করেছে কাবির? কে সাহায্য করেছে? মেঝ ভাইয়ার হাত থেকে কামরান দেওয়ানকে উদ্ধার করা এত সহজ কাজ নেই। কিভাবে সম্ভব করেছে কাবির?

শেষ মুহূর্তে আর্যাব খান ফোনটা তুলল। ইথিকা রেগে গিয়ে বলল,

“কামরান দেওয়ানকে কি রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছ ভাইয়া?”

আর্যাব খান ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলল,

“পাগলা কুকুর রাস্তাতেই থাকে ডার্লিং।”

ইথিকা ক্ষোভ চেপে বলল, “পাগলা কুকুর এখন তোমাকেই মনে হচ্ছে। কাবির তার জ্যাঠাকে ছাড়িয়ে এনেছে!”

শব্দ করে একটা শ্বাস নিল আর্যাব খান। তারপর ঠাণ্ডা হেসে কটাক্ষ ছুঁড়ে বলল,

“সেই খুশিতে বরের সাথে একটা জম্পেশ ডান্স সেরে নে ইথি। অফ কোর্স ম্যাকালান এইটিন যেন তালিকা থেকে বাদ না যায়!”

“ম্যাকালান তুমি খাও। কাবির বেরিয়ে গেছে দেখলাম। জানিনা ও পরিকল্পনা করছে। তোমার কি অবস্থা করে দেখো। কল্পনা কিরণকেও দেখলাম ওদের সাথে ফিরেছে। তারমানে ওদেরকেও তুমি কিডন্যাপ করেছ?”

আর্যাব খান আবারও হাসল। ইথিকার নিজেরই গা জ্বলছে ভাইয়ের বিদ্রুপাত্মক হাসির শব্দ শুনে।

“হ্যাঁ করেছি। কিন্তু কল্পনার ডার্লিং শোঁ করে এসে আমার হাত থেকে চোঁ মেরে তাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।”

ইথিকা কপাল কুঁচকে বলল,

“কল্পনার ডার্লিং কে?”

“ওই ফকিরটা।”

“কোন ফকির?”

“আন্দাজ করছি কোনো সিক্রেট এজেন্টকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে তোর বর।”

ইথিকা বলল,”তুমি আমার বরকে পুতুল মনে করেছ?”

আর্যাব খান সহসায় রেগে গেল।

“ঠাস করে চড় মেরে কান লাল করে দেব। আমার বর আমার বর করবি না। বরের কোলে চড়ার জন্য ওই বাড়িতে যাসনি। গলায় ছুরি চালাতে গিয়েছিস। আর সেটাই কর। নইলে গুলি করে মারব।”

ইথিকা চুপ হয়ে গেল। বলল,

“বাড়ি যাচ্ছি। ওখানে আসো।”

আর্যাব খান পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,

“বাড়িতেই আছি। তোর বরের হাতে গুলি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

“উফ!”

আর্যাব খান হেসে ফোন রেখে দিল। ইথিকা চার ভাইকে বাড়িতে উপস্থিত থাকতে বলে নিজেই রওনা দিল। কাবির কোথায় গেছে কে জানে। সে ফিরে আসার আগে তাকে দেওয়ান বাড়িতে পৌঁছে যেতে হবে।

সে একটা সিএনজিতে উঠে বসল। খান বাড়ি পৌঁছে গেইট ঠেলে দৌড়ে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকল। চার ভাই একসাথে বসে আছে। শেষের দু’জন আধশোয়া। আসলাম খান বসে ঝিমাচ্ছে। আর্যাব খান পায়ের উপর পা তুলে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।

সবার শুরুতেই আসলাম খান তাকে দেখল।

“ইথি!”

আর্যাব খান পা নামিয়ে হাসল। দাঁড়িয়ে পড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

“আরেহ আরেহ দেওয়ান বাড়ির বউ যে। আসুন আসুন। আপনার পায়ের ধূলো আমাদের বাড়িতে পড়েছে এটা তো সৌভাগ্যের কথা।”

ইথিকা রাগ চেপে আসলাম খানের দিকে তাকাল।

“বড় ভাইয়া ভাবি আসবেনা বলেছে?”

আসলাম খান মাথা ঝাঁকাল।

“আমার ছেলেটার মুখ পর্যন্ত দেখতে দেয়নি। আমি ওকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে এসেছি। এবার যদি আমার ছেলেকে না দেখায় তাহলে আমি ওকে খুন করব।”

ইথিকা বলল,”বেশ করেছে ভাবি। তোমার বউ বাচ্চা কেউ আর আসবে না।”

আর্যাব খানের দিকে আঙুল তুলে বলল,

“তুমি তো বউই পাবে না। আর এই দু’জন এভাবেই চিরকুমার থাকবে।”

আর্যাব খান হো হো করে হেসে উঠে আবারও সোফায় বসে পড়ল। বলল,

“বউয়ের জন্য মরে যাচ্ছি।”

আশিষ আর আরিশ খান তাল মিলিয়ে হেসে বলল,

“আমরা তো মরেই গেছি। হা হা।”

ইথিকা চেঁচিয়ে ডাকল,”মম!

ইলিনা বেগম তার গলার আওয়াজ শুনে তড়িঘড়ি করে ছুটে এল।

“তুমি? কেমন আছ বাচ্চা? কবে এলে?”

ইথিকা বলল,”কামরান দেওয়ানকে পেয়ে গেছে কাবির। মেঝ ভাইয়াকে সাবধান করো। আমার কথা গায়েই মাখছেনা।”

ইলিনা বেগম কিছু বলার আগেই আমিন খান আর আখতারুজ্জামান খান বাড়িতে প্রবেশ করল। ইথিকাকে দেখে বাবা খুশি হলেও তার বাড়ি আসার কারণটা শুনে হকচকিয়ে গেল।

আর্যাব খানের দিকে রেগে চেয়ে থাকল আমিন খান।

“কি করেছ?”

আর্যাব খান ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে বলল, “কি করেছ নয়। বলো মহারাজা তোমারে সালাম!”

আমিন খান বিরক্ত হয়ে গলায় ধমকের সুর এনে বলল, “আজেবাজে কথা বন্ধ করো। এতটা অসতর্ক হলে কি করে? এখন কী করবে?”

আর্যাব খান এবার হাসি মুছে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল নীচের দিকে। হিসেব মিলিয়ে নিয়ে তারপর ধীরস্থির ভঙ্গিতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠান্ডা গলায় বলল,

“আগে ওই ফকিরটার লাশ ফেলব। তারপর বাকিটা দেখা যাবে।”

ইথিকা তেড়ে এসে বলল,”ভাইয়া এখন না। এত রিস্ক নেয়া যাবে না। আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো। কাবির তলে তলে অনেক কিছু করছে যা তোমরা আন্দাজও করতে পারছ না।”

ইথিকার কথা কানে নিল না আর্যাব খান। ইথিকা বলল,”ভাইয়া প্লিজ এখন কোথাও যেওনা।”

আর্যাব খান বলল,”আমার অনেক হিসেব মেলানো বাকি আছে। সর।”

ঠিক তখনই ফোনটা কাঁপতে কাঁপতে বেজে উঠল। এসপি স্যারের ফোন। আর্যাব খান এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। আশপাশে তাকিয়ে বড়সড় একটা শ্বাস ফেলল, তারপর ধীরেসুস্থে ফোনটা কানে তুলল।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

ওপাশ থেকে এসপি স্যারের ভারী কণ্ঠ ভেসে এল,

“ওপাশ থেকে এসপি স্যারের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো—

“আপনাদের পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে আর্যাব। কাবির দেওয়ান থানায় উপস্থিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়ের করেছেন আপনার পরিবারের বিরুদ্ধে। এই ব্যাপারে আপনার কি মতামত? অলরেডি আমাদের হাতে প্রমাণ এসে গেছে।”

আর্যাব খানের আঙুল শক্ত হয়ে এলো ফোনের গায়ে। চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেল। বুকের ভেতর চাপা একটা ঢেউ খেলছে। কিন্তু মুখের ভাষা তখনও রুদ্ধ। ঠোঁট শক্ত করে সে আওড়াল, “কাবির তোকে শেষ করতে পারলে আমি শান্তি পেতাম।”

ওপাশ থেকে এসপি স্যার অপেক্ষা করলেন, তারপর আরও শান্ত গলায় বললেন, “থানায় আসুন। আপনার সাথে কথা আছে।”

আর্যাব খান বলল,

“Sir, this is a private family matter that does not warrant legal intervention. It is an internal issue that we are handling within the family, and there is no need for external involvement.”

“ফ্যামিলি ম্যাটার?” কটমট করে উঠলেন এসপি স্যার।

“In the eyes of the law, enforced disappearance, abduction, or unlawful detention can never be a private family matter Arzab khan!”

আর্যান খান মনে মনে বলে উঠল,”তোর জবান বন্ধ করব বেশি বাড়াবাড়ি করলে।”

নিজেকে শান্ত করল সে। তারপর বলল,

“আমি কাবিরের সাথে কথা বলছি।”

“আপনি আপনার বাবাকে নিয়ে আগে আমার সাথে দেখা করুন।”

“ওকে স্যার।”

ফোনটা রাখার পর আর্যাব খান বাবাকে বলল,”থানায় যাচ্ছি।”

“আমিও যাচ্ছি। চলো।”

আসলাম খান বলল,”আমিও। চল। দেখি কি করে।”

ইথিকা চিন্তিত হয়ে বলল,”কাবির কিছু করেছে?”

আর্যাব খান বলল,”হ্যাঁ। এখন জামাই আদর খেতে যাচ্ছি। তুই যাবি?”

ইথিকা রাগ করে বলল,”মম দেখো।”

“আহা আর্য!”

আর্যাব খান বেরিয়ে পড়ল মুখবাঁশি বাজাতে বাজাতে।

_______________

আমিন খান আর আসলাম খানকে পুলিশি হেফাজতে নিয়েছে শুনে ইথিকার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দেওয়ান বাড়িতে সে কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছেছে। তার পরপরই কাবির এসেছে।

তার পিছুপিছু হাসপাতাল থেকে বাকিরাও এসে গেছে। দেওয়ান বাড়িতে উৎসব উৎসব আমেজ। কাসেদ আর কাদিন কামরান দেওয়ানকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করছে। সবার ঠোঁটে হাসি। কল্পনা বাবার গায়ের শাল নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে উপরে চলে এল। ইথিকার সাথে চোখাচোখি হওয়ামাত্র তার চোখমুখ কঠিন হয়ে এল।

ইথিকা বুকে হাত ভাঁজ করে নীচে চেয়ে রইল। কল্পনা তার পাশ কেটে চলে গেল। কল্পনার পিছুপিছু কিরণও এল। ইথিকা তাকে থামিয়ে দিল।

“তোমাদের কে আটকে রেখেছিল?”

কিরণ কিছু না বলে চলে গেল। ইথিকার রাগ তরতর করে বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর কাজের বুয়া ঝিনুক এল। বলল,

“ভাবি আপনাকে ছোট মা ডাকছেন রান্নাঘরে।”

ইথিকা চুপ করে রইল। ঝিনুক চলে যেতেই ইথিকা রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল। লুবনা বেগম চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে খুন্তি। ইথিকা উনার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

“কেন ডেকেছেন?”

লুবনা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ইথিকার দিকে। এগিয়ে এসে পরম মমতায় হাতটা ইথিকার গালে রাখলেন। বললেন,

“তুমি আমার বড় ছেলের বউ। এমনকি এই বাড়ির বড় বউ। তুমি ভালোমন্দ সব বোঝো। তুমি তোমার বাপ ভাইদের পক্ষ নিয়ে কাবিরের সাথে শত্রুতা বাড়িওনা মা।”

ইথিকা অন্যত্র তাকিয়ে রইল। তার বাবা ভাই এখন থানায়। তার এখন এসব নীতিজ্ঞান ভালো লাগছেনা। সে হাতটা একঝটকায় সরিয়ে দিতে গিয়েও দিল না। আলতোভাবে হাতটা ধরে নামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপনার ছেলেকে বলে দেবেন আমাকে শত্রুদের মেয়ে মনে করা বন্ধ করতে।”

বলেই সে বেরিয়ে যাচ্ছিল। লুবনা বেগম বললেন,

“তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। কাবির তোমাকে নিয়ে সংসার করতে ইচ্ছুক নয়। সে খুব শীঘ্রই তোমাকে তালাক দেবে।”

ইথিকার কপাল কুঁচকে গেল। লুবনা বেগমের দিকে ফিরে বলল,

“কি বললেন?”

লুবনা বেগম বললেন,”হ্যাঁ তাই। যেই বাড়ির ছেলে তোমার ফুপুকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করার মতো স্পর্ধা রাখতে পারে সেই বাড়ির ছেলে তোমাদের বাড়ির মেয়েকে ডিভোর্সও দিতে পারে। কাবিরকে এত নির্মম হতে দিওনা। এই কাজটা করতে বাধ্য করো না।”

ইথিকার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। লুবনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার কি দোষ এখানে?”

“তোমার দোষ দুই পরিবারের বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে কাবিরকে বিয়ে করা। যে তোমাকে ঘৃণা করে তাকেই কেন তোমার বিয়ে করতে হলো ইথিকা? তোমার সাথে যে ছেলেটার সম্পর্ক ছিল, মাজহাব। সে কাবিরের খুব কাছের মানুষ ছিল। তোমরা তাকে গুম করে কি জঘন্যভাবে খুন করেছ। ভাগ্য ভালো বড় ভাইজান আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। তোমার ভাইরা তাকেও খুন করার পরিকল্পনা করেছে। তুমি তো সবকিছু সাক্ষী ইথিকা।”

“আপনি না জেনে কথা বলছেন। মাজহাব তার শাস্তি পেয়েছে। ও আমাকে ঠকিয়েছে। আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। আমার গায়ে কলঙ্ক ছিটিয়েছে। আমাকে সমাজের চোখে নষ্টা বলে ঘোষণা করেছে। তাই ও মৃত্যু উপহার পেয়েছে। বেশ করেছে ওকে কুপিয়ে মেরেছে। ও সেটা ডিজার্ভ করে।”

“আল্লাহ সইবেনা এসব। মুখে উচ্চারণ করতে তোমার বুক কাঁপছেনা?”

“না কাঁপছেনা। ও আমাকে ঠকিয়েছে তাই ওকে আমি মৃত্যু দিয়েছি। আপনার ছেলে আমাকে দেখে থুতু ছিটিয়েছে তাই তাকেও আমি শান্তি দেব না।”

“তোমাকে দেখে থুতু ছিটানোর যথেষ্ট কারণ ছিল।”

“আপনার ছেলের জীবনটাকে জাহান্নাম বানানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট কারণ আছে। আমাকে নর্দমার উচ্ছিষ্ট বলেছিল আপনার ছেলে। বলেছিল, খান বংশে যত মেয়ে জন্মেছে সবার গায়েই কলঙ্ক। সবাই নর্দমার উচ্ছিষ্ট। সবার চরিত্র খারাপ। এমনও বলেছিল যে ভিক্ষা করে খায়, মানুষ খুন করে, সবচেয়ে নোংরা জঘন্য কাজ করে সেও আমাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবেনা।
ওইদিন সবচেয়ে বেশি ঘৃণা আমি আপনার ছেলের চোখে দেখেছি। তাই আমিও তাকে দেখিয়ে দিয়েছি ওই উচ্ছিষ্টের সাথে সম্মানিত কাবির দেওয়ানের সংসার করতে কেমন লাগে।”

“তুমি কাবিরকে চেনো না। ওর প্রতিটি পদক্ষেপ ভয়ানক। ওর পরীক্ষা নিওনা।”

“ও আমাকে চেনেনা। আমাকে তালাক দিক। আমিও…

“কোপাবে?”

“প্রয়োজন পড়লে তাই করব।”

লুবনা বেগম কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ইথিকা হতভম্ব! ঝিনুক এসে দৃশ্যটা দেখে চমকে গেল। দ্রুত কল্পনাকে ডেকে নিয়ে এল। কল্পনা এসে লুবনা বেগমকে সরিয়ে নিলেন। লুবনা বেগমের কন্ঠস্বর কাঁপছে।

“তুমি আমার ছেলের মুখদর্শনও করবে না বেয়াদব মেয়ে। তুমি ওর যোগ্য নও। ওর পাশে তোমার মতো মেয়েকে মানায় না। তুমি ওর পায়ের যোগ্যও নও।”

ইথিকা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে আসামাত্রই দেখল কাবির হালকা গা এলিয়ে শুয়েছে ডিভানে। হাতে কিছু কাগজপত্র। পায়ের আওয়াজ পেয়ে কাগজ থেকে মুখ তুলে ইথিকার দিকে তাকাল সে। চোখ সরু বলল,

“বাড়িতে গিয়েছিলে?”

ইথিকা ভারমুখে বলল,”এত জেনে কি করবেন?”

কাবির শক্ত কন্ঠে বলল,

“এমন ভঙ্গিমা করে কথা বলবে না আমার সাথে।”

ইথিকা মুখ ফিরিয়ে নিল। কাবির শোয়া থেকে উঠে কাগজপত্র নিয়ে তার পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল। ইথিকা বলল,

“তালাক কবে দিচ্ছেন?”

কাবির থমকাল। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। ইথিকার তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। চোখে একরাশ ক্ষোভ। কাবির বলল,

“মিস বাংলাদেশ কেতাব নিয়ে ফিরে এসো। তারপর কথা হবে।”

“সে আপনি না বললেও কেতাব নিয়ে ফিরব। আমার সে যোগ্যতা আছে যা আপনার বোনদের কারো নেই। হতেও পারে না।”

“ওই যোগ্যতা দেওয়ানরা গোণায় ধরেনা।”

ইথিকা গর্জে উঠল,

“আমার বাবা ভাইদের জেলে রাত কাটাতে বাধ্য করছেন কোন সাহসে?”

কাবির শান্ত কণ্ঠে বলল,

“তোমাকেও আর বাকিদের কেন নিয়ে যেতে বলিনি তার কৈফিয়ত চাইছ?”

“হ্যাঁ চাইছি।”

“তবে অপেক্ষা করো। ওই জেলের ঘানি একদিন তোমাকেও টানতে হবে।”

বলেই চলে যাচ্ছিল কাবির। হঠাৎ দরজার কাছে গিয়ে থমকাল। ইথিকার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,

“এমন পরিস্থিতি ডেকে এনো না যার জন্য আফসোস করতে করতে মরতে হয়।”

“আমার মৃত্যু হোক আর আফসোসটা আপনার।”

“আনঝিল!”

ইথিকা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,

“আপনাকে আমি মারতে এসেছি। আমাকে রাগালে ক্ষতি আপনার।”

“আমাকে মারো। আমার পরিবারকে নয়।”

ইথিকা চোখ অন্যত্র সরিয়ে বলল,

“আপনি মরলে আপনার পরিবার এমনিতেও মরবে।”

কাবির তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেল।

_____

রাতের খাবার টেবিলে কামরান দেওয়ানকে আনা হয়েছে। যদিও তিনি কল্পনার হাতেই খেলেন। তবুও বহুদিন পর পরিবারের সাথে একসাথে বসে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা অন্যরকম। যদিও কাবির ছিল না। সবাই যখন উনাকে এটা ওটা বলে হাসাচ্ছিল তখন উনি বললেন,

“কানিজ এসব দেখল না। ওকে এসব দেখতে দিল না ওরা। ওকে মেরে ফেলল ওরা। মেরে ফেলল।”

কল্পনার চোখ ভিজে গেল। সবার খাওয়া থেমে গেছে ততক্ষণে। কাদিনও ভাতের প্লেটে হাত রেখে থমকে গেছে। কল্পনা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“মা উপর থেকে সব দেখছে বাবা।”

লুবনা বেগমের চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। আহা মানুষটা সহধর্মিণীকে হারিয়ে সেই পাগল হয়েছে এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। পৃথিবীতে কত রকমের পুরুষ মানুষ যে আছে। বড় আপা কত ভাগ্য করে মানুষটাকে পেয়েছিল জীবনসঙ্গী হিসেবে সে কি জানে? কত কষ্ট দিয়ে একা করে চলে গেল। খাবার টেবিলে কি খাওয়াদাওয়া হবে? সবার চোখ ভিজে উঠল কামরান দেওয়ানের আহাজারিতে।

“আমি এক জীবনে এত কষ্ট কেন পেলাম? কেন পেলাম? কি অপরাধ আমার? ওরা আমার সংসার কেন ছারখার করে দিল? কেন ওকে ওভাবে মারল?”

কল্পনা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। লুবনা বেগম তাকে ধমক দিলেন,

“তুই মানুষটার সামনে এভাবে কাঁদছিস কেন কল্প? বন্ধ কর। কান্না থামা।”

কাদিন এসে শেষমেশ কল্পনাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বাবাকে কানেকানে বলল,

“বাবা কল্প কষ্ট পাচ্ছে এসবে। তোমার সাথে যারা যারা অন্যায় করেছে সবাই শাস্তি পাবে। আর কেঁদো না।”

মানুষটা এমন বাচ্চার মতো কাঁদে মায়ের কথা মনে পড়লে। মা কত ভাগ্যবতী নিজেও বোধহয় জানতে পারেনি কখনো।

“কল্প বড় হয়েছে?”

“হ্যাঁ বড় হয়েছে তো। দেখো কল্পকে। কতবড় হয়ে গেছে।”

কামরান দেওয়ান বাচ্চাদের মতো মাথা দোলান।

“হু হু বিয়ে দিতে হবে।”

চোখে অশ্রু নিয়ে সবাই হেসে উঠল। কল্পনা বাবাকে জড়িয়ে বলল,

“আমি তোমাকে অনেক বছর পর পেয়েছি। আর কোথাও যাব না বাবা।”

ওদের পারিবারিক মিষ্টিমধুর সময় কাটছিল ঠিক তখুনি আর্যাব খান দেওয়ান বাড়িতে প্রবেশ করল।

ইথিকা নেমে এল দ্রুত।

“ভাইয়া তুমি?”

“তোর বর কোথায়?”

ইথিকা এদিকওদিক তাকাল। কামরান দেওয়ান তাকে দেখামাত্রই রাগে ফুঁসছেন। কাঁপছেন। কল্পনা এগিয়ে এসে বলল,

“এই আর্যাব খান বেরিয়ে যাও এখন। যাও বলছি।”

আর্যাব খান তাকে পাত্তা না দিয়ে ইথিকাকে বলল,”তোর বরকে ডাক। কোথায় তোর বর? কথা আছে ওর সাথে।”

ইথিকা মনে মনে বিড়বিড় করছিল যাতে কাবির এইসময় না আসে। কিন্তু কাবির এসে পড়েছে। সাথে জোসেফ মেহতাজও। দুজনেই হাসতে হাসতে ঢুকছিল বাড়ির ভেতরে। কাবির থমকাল আর্যাব খানকে দেখে। জোসেফও।

আর্যাব খান সবার চোখ অনুসরণ করে কাবিরের দিকে ফিরল। ঠোঁটের কোণায় বাঁকা হাসি টেনে বলল,

“সারেন্ডার।”

কাবির বলল,”এসব নাটকের মানে কি? এই বাড়িতে এসেছিস কেন?”

আর্যাব খান নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

“নাটক না। সত্যি কথা। মামলা তুলে নাও দ্রুত। পারিবারিক বিষয় কোর্টে গড়ালে সমস্যা হবে।
তোমার পায়ে ধরে মাফ চাইব?”

ইথিকা এগিয়ে এসে বলল,”ভাইয়া কি করছ?”

আর্যাব খান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই কাবির তাকে কষে একটা চড় বসিয়ে দিল। সবাই কেঁপে উঠল। কাদিন ছুটে এসে কাবিরকে সরিয়ে নিতে চাইলে কাবির তাকে সরিয়ে দিয়ে আর্যাব খানের গালে আরও একটা চড় বসিয়ে দিল। আর্যাব খান রক্তচক্ষু নিয়ে কাবিরের দিকে তাকাল।

কাবির রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,”প্রথম চড়টা জেঠাকে গুম করেছিস সেই কারণে। দ্বিতীয়টা কল্প কিরণকে বন্দী করেছিস সেই কারণে। তোদের মাফ নেই। তোর চাকরি আমি খেয়েই ছাড়ব। বের হ বাড়ি থেকে।”

ইথিকা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। কেন এখানে শুধু শুধু অপমানিত হতে এসেছে? আর্যাব খান বেরিয়ে যেতে লাগল একরাশ অপমানের বোঝা নিয়ে। কাবির ইথিকাকে নিয়ে গেল।

জোসেফ এগিয়ে এসে কাদিনের সাথে হাত মিলিয়ে কল্পনার দিকে তাকাল। কাদিন সরে যেতেই মৃদুস্বরে বলল,

“হাই!”

কল্পনা দ্রুত সরে পড়বে তার আগেই জোসেফ পকেট থেকে একটা ক্লিপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“এটা আপনার?”

কল্পনা এগিয়ে এসে ক্লিপটা নিতে নিতে জোসেফের চোখের দিকে তাকাল। বলল,

“আর্যাব খান আপনাকে কিছু বলেনি কেন?”

“সাহস নেই।”

“সাবধানে থাকবেন।”

“এখন থেকে একটু বেশিই থাকব।”

কল্পনা মেকি হেসে বলল,”শুনে খুশি হলাম। যাইহোক আপনাকে কিন্তু সেরা অভিনেতার পুরষ্কারটা দিতেই হবে।”

“পুরস্কারটা আপনার হাত থেকে পেলে জীবন ধন্য।”

“থ্যাংকস আমাকে এত ভ্যালু দেয়ার জন্য।”

“কিন্তু আমি থ্যাংকসের বদলে অন্যকিছু শুনতে চাই।”

“বুলশিট।”

দরজার একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখে একরাশ ক্ষোভ আর মুখে কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে তাদের কথোপকথন দেখে আর্যাব খান বিড়বিড় করল,

“এরা ইটিশপিটিশ করছে সবার সামনে দাঁড়িয়ে? এত নষ্টামি আর্যাব খানের চোখ সইবে কেমন করে?”

চলমান….