মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-২৩+২৪+২৫+২৬

0
144

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৩তম_পর্ব

এটুকুতেই সীমাবদ্ধ রইলো না অভ্র। মধ্যকার দূরত্ব অচিরেই ঘুচিয়ে ঐন্দ্রিলার পাতলা অধরজোড়ায় উষ্ণ ঠোঁট মিশিয়ে দিলো সে। উষ্ণ ঠোঁটের কোমল স্পর্শে কেঁপে উঠলো সারা দেহ ঐন্দ্রিলা। স্তব্ধ হয়ে গেলো যেনো মস্তিষ্ক। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো তার। বিমূঢ় চেয়ে রইলো সে। বিহ্বলতা কাটতেই নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ফলে আগ্রাসী হয়ে উঠলো সেই চুম্বর। নমনীয়তা হারিয়ে গেলো। একটা সময় ঠোঁটে হালকা কামড় বসিয়ে দিলো সে। ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো ঐন্দ্রিলা। ছাড়ানোর চেষ্টা বেড়ে গেলো। একটা সময় অভ্রও তাকে এবার মুক্ত করলো নিজের থেকে। তার ঠোঁটে উন্মোচিত হলো চিত্তশীতলকারী হাসি। তার গাঢ় নয়নে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ঐন্দ্রিলার হতবিহ্বল মুখবিবর। ঐন্দ্রিলার নিন্মোষ্ঠে কামড়ের চোঁটে ক্ষত হয়েছে। কিঞ্চিত রক্তও বেড়িয়েছে। অভ্র তার ক্ষত ঠোঁটজোড়ায় রুক্ষ্ণ আঙ্গুল ছুয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“আমাকে রাগানোর ছোট্ট শাস্তি।”

বলেই নির্লজ্জের মতো হাসছে সে। ঐন্দ্রিলার চোখজোড়া ছলছল করছে। মিশ্র এক অনুভূতি তার গলায় দলা পাকাচ্ছে। সে কেনো অভ্রের উপর রাগ করতে পারছে না। সে কেনো তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানায় চড় বসাতে পারছে না৷ ঐন্দ্রিলা উঠে যেতে নিলেই অভ্র তার হাত ধরে টান দিলো। ফলে টাল সামলাতে না পারায় তার উপর পড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র বিনা ভনীতায় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ঐন্দ্রিলা কোপিত স্বরে বললো,
“আমাকে ছাড়”

ঐন্দ্রিলা গলার স্বর কাঁপছে। টলমল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। অভ্র খুব যত্নে তা মুছলো। তাকে ঠিক বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঘোরলাগা স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমার সবচেয়ে প্রিয় তোমার কান্নামিশ্রিত মুখ। তোমাকে কাদাতে আমার ভালো লাগে।
ওগো প্রিয়,
তোমার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা হোক সবার,
শুধু ঐ মুক্তোদানা অশ্রু হোক আমার”

স্তব্ধ হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে তার। গলার কাছটা কেমন শুকিয়ে এলো যেন। হাত পা অবশ লাগছে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না।সে মুখ তুললে অভ্র তার কপালে গাঢ় চুম্বন আকলো। এলোমেলো, অবিন্যস্ত চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজলো। তারপর বিড়বিড়িয়ে বললো,
“তুমি আমার জন্য কেনো কাঁদো না। তুমি কি জানো না….”

বলতে বলতেই ঘুমিয়ে গেলো অভ্র। তার কথাগুলো আর স্পষ্ট হলো না। ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“কি জানি না? এই বল, কি জানি না”

কিন্তু লাভ হলো না। মাতালাল মানুষটি ঘুমের অতল গহ্বরে ডুবে গেলো। আর হাজারো চিন্তার মাঝে ফেলে গেলো ঐন্দ্রিলাকে। সে অভ্রের ঘুমন্ত মুখের দিকের চেয়ে আছে। এই ছেলেটাকে বোঝার সাধ্য তার নেই! সে কি আদৌ তাকে ভালোবাসে! যদি ভালোবেসেই থাকে তবে এমন নিমপাতার ভালোবাসা কার কাম্য! ঐন্দ্রিলার রাগ হলো। প্রচন্ড রাগ। রাগে অভ্রের চুল মুঠো করে কিছুসময় ঝাকালো। কিন্তু কাজ হলো না। কারণ যাকে আঘাত করার প্রয়াস সে চালাচ্ছে সে তো আপাতত ধরনীতেই নেই। আছে স্বপ্নের জগতে।

****

ঐন্দ্রিলাদের বাড়িতে সকাল হলো খুব আয়োজন করে। একটু পর হ্যাপি এবং তার পরিবার চলে যাবে । বিকালের শেষে ঐন্দ্রিলাও তার শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। উৎসবের আমেজ এখন ফুরয়ে এসেছে। ঘরময় ছোটাছুটি করছে নীলাদ্রির কুকুর শকুন্তলা ছোটাছুটি করছে। নীলাদ্রি বদৌলতে এই ছোট কুকুরটি এখন ঘরময় উথাল পাথাল করে। তাকে বাহিরে আটকায় না নীলাদ্রি। কারণ সে নাকি ভয় পাবে। তার থাকার জায়গা ছাঁদে করা হয়েছে। কিন্তু এই কুকুর ঘরময় ছোটাছুটি করে। নীলাদ্রির ঘরটা পিউ কিভাবে যেনো সালাম সাহেবের থেকে উদ্ধার করেছে। সাবেরা সেটা জানে না। জানতে গেলেও স্বামী বলবে না। এর মাঝেই হ্যাপি ছুটে এলো। হাপাতে হাপাতে বললো,
“ভাবী, ভাইজান পাগল হয়ে গেছে”

সকাল সকাল কোথা থেকে জোড়া ছাগলের আমদানী হলো ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি। বাদশাহ ছাগলের দড়ি ধরে আছে এক হাতে। আর অপর হাতে কাঠাল পাতার ডাল। ছাগলগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে পাতা খাবার জন্য। ম্যা ম্যা করে সকালের শান্ত পরিবেশ ছিড়ে ফেললো। গৃহকর্ত্রী ছাগলের ডাকে বেরিয়ে এলেন। নীলাদ্রি তার শকুনতলাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সালাম সাহেব তার ভুড়িখানা আদর করছে। আর গদগদ স্বরে বললো,
“বাদশাহ তোমার কাছে আমি অত্যন্ত খুশি। এই জন্য তোমাকে আমি একশত টাকা বকশিস দিবো”

বাদশাহ স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“স্যার এখন একশত টাকায় ট্রাফিক পুলিশেরো মন গলে না”
“তাহলে একশত টাকা বাদ। দাঁড়িয়ে থাকো তুমি”

এর মাঝে সাবেরা শুধালো,
“ছাগল কেনো এনেছো তুমি?”
“আমি ছাগল পালবো”
“পাগল হয়েছো নাকি?”
“কেনো? কেনো? তোমার ছেলে কুত্তা পালতে পারলে আমি ছাগল পালতে পারবো না কেনো। আমি তো নামও ঠিক করে রেখেছি। ওই কালোটার নাম নীলাদ্রি আর বাদামীটার নাম হ্যাপি। আহা শান্তি”

সালাম সাহেবের মুখে নিজের নামে ছাগলে নামকরণ শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো হ্যাপি। রাগে গজগজ করে বললো,
“ভাইজান আপনি ছাগলের নাম আমার নামে রাখলেন! আপনি এমন কাজ করতে পারলেন?”
“ছিঃ ছিঃ। তোর নামে ছাগলের নাম রেখে ওকে আমি অপমান করবো না। আমি হ্যাপি রেখেছি কারণ দেখ ছাগলটা কেমন হাসি হাসি। তাই ওর নাম হ্যাপি”

হ্যাপি সাবেরা দিকে চাইলো। ভাইয়ের সাথে কথায় সে পারবে না। তাই হাতিয়ার ফেলে ভাবির সরনাপন্ন হওয়াই ভালো। সাবেরা কঠিন স্বরে বাদশাহকে হুকুম দিলো,
“বাদশাহ এই জোড়া ছাগল এখন এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাবে। যেখান থেকে এসেছে সেখানে রেখে আসো”
“তা সম্ভব না ম্যাডাম। এরা আশ্চর্যময়ী ছাগল। কথা বলতে পারে। কথা বলা ছাগলজোড়া আমি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি। এখন তা ফেরত দিলেও টাকা ফেরত আসবে না”
“কথা বলা ছাগল মানে?”

বাদশাহ একটা ছাগলকে শুধালো,
“বলো নীলাদ্রি এপ্রিলের আগে কোন মাস?”

নীলাদ্রি নামকরণ করা ছাগলটি “ম্যা” করলো। বাদশাহ মুখে দুশো ভোল্টের হাসি ফুটিয়ে বললো,
“দেখুন ম্যাডাম। সে মে বলেছে। নীলাদ্রি ছাগল নীলাদ্রি স্যারের মতোই বুদ্ধিমান”

সালামি সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। নীলাদ্রি চোখ কুচকে বললো,
“এটা সব ছাগল ই বলে। ছাগল ম্যা বলবে না কি ভ্যা বলবে। আপনাকে বোকা বানিয়ে টাকা লুটেছে। যেমন মুনিব তেমন তার ভৃত্ত। বোকার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করবেন দুজন”

নীলাদ্রির কথায় ক্ষেপে গেলেন সালাম সাহেব। ক্ষিপ্র স্বরে বললেন,
“হ্যা, হ্যা তুমি তো বিদ্যাধর হয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চালাক ভাবো তো! এজন্যই তোমার ঘরে বাজ পড়ে। আমি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি। এক মাসের মধ্যে আমার ছাগল তোমার ওই কুত্তার থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে দেখাবে”
“ওর নাম শকুনতলা। ওকে শকুনতলা বলে ডাকবে বাবা। আর গাধা পিটিয়ে যেমন ঘোড়া হয় না। তেমন নীলাদ্রি নাম রাখলেই ছাগল বুদ্ধিমান করা যায় না”

বলেই ঘরের ভেতর চলে গেলো নীলাদ্রি। সাবেরা স্বামীর উপর ক্ষিপ্ত হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। এই ছাগলকান্ড পড়েও সামলানো যাবে।

****

ঐন্দ্রিলা চেয়ার টেনে বসলো নাস্তার টেবিলে। সারাটা রাত কেটেছে নির্ঘুম। চোখজোড়া তার রক্তিম হয়ে আছে। অভ্রের শক্ত বাধন থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। মানুষটি এখনো ঘুম। নাস্তার টেবিলে ছাগলকান্ড নিয়ে হট্টগোল হলেও পাত্তা দিলো না ঐন্দ্রিলা। তার জীবনে তো অভ্রকান্ডের অভাব নেই। এর মাঝে সালাম সাহেব শুধালেন,
“অভ্র কোথায়?”

অভ্রের কথা শুনতে হতচকিত হলো ঐন্দ্রিলা। আমতা আমতা করে বললো,
“ঘুমাচ্ছে”
“কাল রাতে কখন ফিরলো ও?”
“বারোটার পরে”

সালাম সাহেব আর প্রশ্ন শুধালো না। এর মাঝেই হ্যাপি বেফাঁস বললো,
“তোর ঠোঁট লাল হয়ে আছে কেন ঐন্দ্রিলা?”

কথাটা শুনতেই জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার মুখ লাজে রক্তিম হয়ে উঠলো। সেই সাথে স্পষ্ট হলো রাতের স্মৃতি। ঐন্দ্রিলা কোনোমতে বললো,
“ব্যাথা পেয়েছি”
“কিভাবে?”

সকলের নজর ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা মাথা চুলকে বললো,
“বাথরুমে আছাড় খেয়েছি রাতে”

হ্যাপি মিটিমিটি হাসলো। বাকিরা সেটাকে গুরুত্ব দিলো না। সাবেরা তখন ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার ঘরে এসো। কথা। কথা আছে তোমার সাথে”

****

বাবা মায়ের ঘরে যেতেই মাকে দেখলো আলমারি খুলছে সে। ঐন্দ্রিলাকে দেখে আলমারি থেকে কিছু জিনিস বের করে খাটে রাখলেন সাবেরা। তার মধ্যে কিছু পুরানো শাড়ি এবং গহনার বাক্স। গহনার বাক্সটি ঐন্দ্রিলার দাদীর। এই রুপোর কারুকাজ করা বাক্সের প্রতি প্রচন্ডলোভ ছিলো ঐন্দ্রিলা। সাবেরা তার দিকে জিনিসগুলো এগিয়ে বললো,
“বিয়েরদিন এগুলো নাও নি তুমি। গুছিয়ে নাও”

ঐন্দ্রিলা কথা বললো না। জিনিসগুলো নিলো না সে। চুপ করে বসে রইলো। সাবেরা কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
“আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। আমার কথা শুনতেও তুমি অপছন্দ কর। তবে শুধু এটুকু বলবো, এই বাড়ি তোমার ছিলো, তোমার আছে, থাকবে। যদি রাগ হয়, জেদ হয় তাহলে এখানে চলে এসো। তোমার ভাঙ্গন তহবিল এখনো অক্ষত। আমি হয়তো তোমার কাছে খুব খারাপ মা। তবে তুমি আমার কাছে আমার প্রিয় আমড়া কাঠের ঢেকি। সারাজীবন তাই থাকবে”

ঐন্দ্রিলা মায়ের দিকে তাকালো। তার মুখে ম্লান হাসি। সে জিনিসগুলো নিলো হাতে। ছোট করে বললো,
“আমি আসছি”

******

অভ্রের ঘুম ভাঙ্গলো খুব দেরিতে। তখন ঘড়ির ছোট কাটাটা ভিড়েছে বারোটার ঘরে। এতোটা সময় শেষ কবে ঘুমিয়েছে মনে নেই। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে, মাথাটা ভার হয়ে আছে। সেই সাথে তীব্র ব্যাথা। যেনো কেউ তার চুল টেনে ছিড়ে ফেলেছে। অভ্র সময় নিলো স্বাভাবিক হতে। খুব ক্ষুদা লেগেছে। আশপাশটা দেখে ধাতস্থ হলো সে ঐন্দ্রিলার রুমে। গতকালের স্মৃতিগুলো খুব স্পষ্ট নয়। খুব অস্পষ্ট। ঐন্দ্রিলার খুব রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো সে। বৃষ্টিতে ভিজেও যখন মেজাজ ঠান্ডা হয় নি তখন দোকানে চলে যায় সে। ফোন করে ডাকলো বিল্লাল এবং তরুনকে। তরুন বেচারা বাধ্য হয় আসতে। তুলতুলে আবহাওয়ায় ঘুমের বেশ আয়োজন করেছিলো সে। কিন্তু অভ্রের জন্য সেটাকে বাতিল করতে হয়েছে। আর বিল্লাল তো আধ ঘুম থেকে উঠে আসে। টাকা দিয়ে বলে,
“দু বোতল ভালো দেখে জিনিস যোগাড় কর। আমি মদ খাবো আজ”
“পাগল তুই! তুই এখন শ্বশুরবাড়ি আছিস। জানলে কেলেঙ্কারি হবে। ভাবিআপু তোকে গিলে খাবে”

বিল্লাল চেঁচিয়ে বললো। অভ্র গম্ভীর স্বরে বললো,
“হোক কেলেঙ্কারী। কুচ পরোয়া নেহি। আমি কি কাউকে ভয় পাই? সবাই কি পেয়েছে আমাকে। যার যেমন ইচ্ছে তেমন আমার উপর চাপিয়ে দিবে। জীবন আমার সার্কাস হয়ে গেছে। আর তুই তো ঐন্দ্রিলার চামচা হয়ে গেছিস দেখছি। আর একবার ভাবিআপু, ভাবিআপু করলে তোর মুখে জুতা খুলে মারবো। তোর ভাবিআপুকে আমি ভয় পাই নাকি! ”

অভ্রের উত্তরে তরুন বললো,
“ভাই, আমার কেন মনে হচ্ছে আপনি একটা বিশ্বরেকর্ডের ধান্দায় আছেন। বাংলাদেশের প্রথম পুরুষ যার বিবাহকাল তিনদিন! প্রেস্টিজ আর থাকবে না ভাই।”

কিন্তু সাগরেদদের কথা আমলে আনে নি। বিনা কোনো বাধায় সে মদ সেবন করেছে। কথাগুলো মনে পড়তেই কিছুক্ষণ কপাল চাপড়ালো সে। এর মাঝেই শাড়ি আর গয়নার বাক্স হাতে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র মুখ তুলে তাকালো তার দিকে। চোখাচোখি হলো। ঐন্দ্রিলা গম্ভীর স্বরে বললো,
“মহারাজের ঘুম ভাঙ্গলে ফ্রেশ হয়ে যেতে হবে। মানুষ তো তার মহারাজের জন্য অপেক্ষা করবে না”

ঐন্দ্রিলার ঠোঁটের ক্ষত নজরে আসতেই আবছা স্মৃতি স্পষ্ট হলো। সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো অভ্রের। এর মাঝে ঐন্দ্রিলা ব্যাগ গুছাতে গুছাতে ব্যাঙ্গ করে বললো,
“আগে তো জানতাম শুধু মারামারি করা হয়। এখন তো দেখছে মদ খেয়ে মাতলামি করা হয়। দিনে দিনে আর কি কি জানবো কে জানে। ভাগ্যিস বাবা মা টের পায় নি। নয়তো কেলেঙ্কারি হত। কেউ কি একবার ভেবেছে আমার বাবা-মার মান সম্মান কোথায় থাকতো! ঘর ভর্তি মেহমান আর ঘরের জামাই এসেছে মদ খেয়ে। ছিঃ”

হঠাৎ পেছনে ঘুরতেই দেখলো অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র খানিকটা এগিয়ে এসে তার দিকে ঝুকলো,
“যে পুরুষের শুধু দেহে লোভ সে তো খারাপ পুরুষ। খারাপ পুরুষ মদ খাবে, মারামারি করবে এটাই স্বাভাবিক না!”

ঐন্দ্রিলা বুঝতে পারলো অভ্র কিসের জের ধরে আছে। কিছু বলতে গেলেও সে থেমে গেলো। অভ্রও অপেক্ষা করলো না। সে হনহন করে বাথরুমে চলে গেলো। মাথাটা ঠান্ডা করা প্রয়োজন। সেই সাথে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো অভ্র। সিদ্ধান্তটা অতিদ্রুত বাস্তাবায়িত করতে হবে।

******

সালাম সাহেব বাড়ির বাগানে হাটছেন। পাশে অভ্র। খাওয়ার পর শ্বশুরমশাইয়ের হঠাৎ তলবে খানিকটা অপ্রস্তুত হল অভ্র। কিঞ্চিত ভয় হচ্ছে। লজ্জাও লাগছে। গতকালের ঘটনা তিনি জেনে গেলে ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন জানা নেই অভ্রের। সালাম সাহেব হাটতে হাটতে বাড়ির পেছনে আসলেন। গতকালকের বৃষ্টিতে কাঁদা পানিতে চপচপ করছে জায়গা। সেখানে একটি কাঠের বসার স্থান। সেখানে পেপার বিছিয়ে বসলেন। তার ছাগলের ম্যা ম্যা ডাক কানে আসছে। তিনি ধীর স্বরে বললেন,
“আমি দুটো ছাগল খরিদ করেছি। দেখেছো”
“জি না”

নিচু স্বরে উত্তর দিলো অভ্র। সালাম সাহেব হাসলেন। বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“এই ছাগল জোড়া আমাদের মাঝে অমিল কি জানো”

অভ্র উত্তর দিলো না। মৌন রইলো। সালাম সাহেব বললেন,
“আমরা হলাম মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ আমাদের মাঝেই বিবেক দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন। তাই আমাদের দ্বারা ভালো কাজ হয় মন্দ কাজ হয়। আমাদেরকে ভালো কিংবা খারাপের দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায়। ঠিক কি না?”
“জি ঠিক”
“আমরা বাদে অন্য কোনো পশুর মাঝে বিবেক নেই, বুদ্ধি নেই। আমাদেরকে সমাজে যেমন ভালো মানুষ এবং খারাপ মানুষের ভাগে ফেলা যায় ওদের কিন্তু যায় না। কোনো বাঘ মানুষ খেয়ে ফেললে তাকে কিন্তু বলে না তুমি খারাপ বাঘ। বা আমার এই ছাগলগুলো কাল কোনোভাবে আমার প্রাণ বাঁচালেও তাদের বলা হবে না ভালো ছাগল। এটা হয় শুধু মানুষের জন্য। ঠিক না?”
“জি ঠিক”

অভ্র বুঝতে পারছে না তার শ্বশুর আধ্যাত্মিক
কথা কেন বলছে। এই গোলগাল ছোট ভুড়ি ওয়ালা মানুষটির মস্তিষ্কে কি চলছে! সালাম সাহেব আবার বললেন,
“আমাদের মানুষের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। আমাদের বিয়ে করতে হয়, সংসার করতে হয়। একটা ভিন্ন মানুষের সাথে আমাদের এই সম্পর্কটা সৃষ্টি শুরু থেকেই আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন। এর মাঝে অদ্ভুত সৃষ্টি মেয়ে। অন্য বাড়ির মেয়ে সব ফেলে একটা পুরুষের সাথে চলে যাবে। সেখানে তার পরিবারের সাথে মিলে থাকতে হয়। আমার মা বলতেন জানো, “শোন বগা, মাইয়্যা মাইনসেরে আল্লাহ বানাইছে অনেক ধৈর্য্য আর মায়া দিয়া। নয়তো অন্য ঘরে সে নিজেকে মানাইতে পারতো না। মাইয়্যা মানুষই পারে এক্কান দালানরে ঘর বানাইতে। তাই তার দুইডা গালিও মাথা নুয়াইয়্যা হুনবি”– এটা কেন বলেছি জানো?”
“জি না”

সালাম সাহেব হাসলেন। তার কন্ঠ এবার আরোও ধীর হলো,
“আমার ধারণা গতকাল তোমার এবং আমার মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া হয়েছে। সেই রাগে তুমি বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেছো। পুরুষ মানুষের রাগ দেখানোর জন্য পুরো পৃথিবী আছে। তোমার রাগ হলো তুমি বাহিরে কাউকে একটা ঘুষি মেরে দিলে, কিন্তু মেয়েদের তা নেই। তারা তাদের আপনজনের সামনেই চিৎকার করে, চেঁচেমেচি করে। তাদের সাথে ঝগড়া করে। সেই ঝগড়া লেশ তারা আজীবন টানে। পুরুষও যদি একইভাবে তার সাথে রাগ দেখায়। ঝগড়া করে, রাগ করে বাড়ি না আসে। তাহলে কি সেই সম্পর্ক টিকবে। সম্পর্কগুলো তুলোর মতো। তাদের আগলে রাখতে হয়, নয়তো উড়ে যায়। পশুদের সম্পর্ক ঠিক রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু মানুষের আছে। তাই বলছি তোমাদের জীবনটা মাত্র শুরু হয়েছে। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি। তুমি গতকাল আরেকটি পঁচা কাজ করেছো। তুমি কাল ঐন্দ্রিলার উপর রাগ দেখিয়ে মদ্যপান করেছো। আমার মেয়েটা সবার আড়ালে তোমাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছে যেনো কেউ টের না পায়। আমি জানি কারণ আমি দেখেছি। আমি তোমাকে খারাপ ভালোর ভাগে ফেলবো না। কারণ একটা কাজেই কাউকে খারাপ বা ভালো বলা যায় না। তবে আশা রাখছি তুমি এমনটা হরহামেশ করবে না। স্ত্রীর সাথে রাগ করে মদ্যপান মোটেই ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না। আশাকরি তুমি বুঝেছো। তুমি বুদ্ধিমান। তোমার বিবেক আছে, এখন বাকিটা তোমার বিবেক যা বলবে তাই করো। তবে আমার মেয়ে কিন্তু আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। ওর চোখে অশ্রু আমি সহ্য করবো না।”

অভ্র মাথানত করে রইলো। তার মুখ থেকে একটা শব্দ বের হলো না। সালাম সাহেব হাসলেন। গুনগুন করে গাইলেন,
“হায়রে প্রেম আমার,কেন যে বারবার,
তারই কথাই শুধু বলেরে,
যে গেছে হারায়ে,দু’বাহু বাড়ায়ে,
আঁধারে খুজে শুধু মরেরে,
হায়রে প্রেম আমার”

****

পিউয়ের ধুম জ্বর। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে তার রাতে জ্বর আসলো বিনা নোটিশে। সেই জ্বর এখনো কমার নাম নেই। সারা গায়ে ব্যাথা। মনে হচ্ছে একশ হাতি তার উপর দাঁপিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠার শক্তিটুকু নেই। এরমাঝে শুধু একটু পর পর সকাল থেকে ফোন বাজছে। ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এতো কার ঠেকা পড়েছে! পিউকে এতো কিসের জরুরি তলব। পৃথিবী কি সে ছাড়া অচল। বিরক্তির ঠেলায় সে ফোনটাই বন্ধ করে রেখেছে সে। ঘুম আসছে খুব। একটু ঘুমালে কি ভালো লাগবে। এর মাঝে মায়ের স্বর কানে এলো,
“পিউ কি ঘুমাচ্ছিস মা? দেখ কারা এসেছে।”

পিউ চোখ মেলে তাকালো। ঝাপসা চোখে দেখলো কোথা থেকে একটা ডাক্তারকে রীতিমতো বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে আহাশ এবং নীলাদ্রি। তাদের দেখতেই চোখ কচলে তাকালো পিউ। আহাশ অভিমানী স্বরে বললো,
“তোমার জ্বর এসেছে বলো নি কেনো পিউ আপু?”

পিউ উত্তর দেবার আগেই নীলাদ্রি তার সামনে ডাক্তারকে বসিয়ে বললো,
“এই যে রোগী, নেন চিকিৎসা করেন”
“আরে ভাই আমি তো মানুষের ডাক্তার নই। আমি পশুপাখির ডাক্তার”……..

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৪তম_পর্ব

“আরে ভাই আমি তো মানুষের ডাক্তার নই। আমি পশুপাখির ডাক্তার”

ডাক্তারের কথাশুনে নীলাদ্রি তড়িৎগতিতে তাকালো আহাশের দিকে। আহাশ মুখ ছোট হয়ে গেলো।

ঘটনার সূত্রপাত দুঘন্টা পূর্বে। নীলাদ্রি হাসপাতালে গিয়েছিলো তার আগামী ডকুমেন্টারির ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে। ব্যাটা নীলাদ্রির সাথে দেখা করতে তার শহরে এসেছিলো। সব কাজ ফেলে নীলাদ্রি এখানে এসে বসে আছে ব্যাপারটি তার হজম হয় নি। কিন্তু ভাগ্যের দোষ, এসেই তার ডেঙ্গু হতে হলো। তাকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। তার সাথে দেখা করতে আসাটা অতীব জরুরি নয়। কিন্তু নীলাদ্রি এসেছে কারণ সে আগামী একবছর কাজ করবে না। করবে রিসার্চ। কারণ পাহাড়ে তার এসিসট্যান্ট অজল জানিয়েছে শকুনতলা সেখানে নেই। সে নাকি হারিয়ে গেছে। অথচ শকুনতলা তার কাছে। ব্যাপারটি বেশ বিস্ময়কর। শকুনতলার মাঝে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে। পৃথিবীর অনেককিছুই আমরা জানি না। মানুষের জ্ঞানের বাহিরে একটা আস্ত ব্রহ্মান্ড আছে। সেই ব্রহ্মান্ডের রহস্য বোঝার সাধ্য মানুষকে দেয় নি সৃষ্টিকর্তা। মানুষ নিজেকে অতীব জ্ঞানী ভাবলেও সে আসলে একটা গাধা। তবুও সে চেষ্টা করে। রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা। নীলাদ্রিও এমন একটা চেষ্টা চালাবে। তার নিজের ভার্সিটির রিসার্চারের সাথে যোগাযোগ করেছে। তারা একটা ল্যাব প্রতিদিন একঘন্টার জন্য তাকে ধার দিবে। সেই সময়ে সে গবেষণা করবে শকুনতলার ডিএনএ নিয়ে। ডিরেকটর ব্যাটাকে সেটাই জানাতে এসেছিলো সে। ব্যাটা তা শুনে ডুকরে কাঁদছে সে এখন নীলাদ্রির মতো মানুষ পাবে কোথায়? কারণ নীলাদ্রির পাহাড় সম্পর্কে জ্ঞান অনেক গভীর। কিন্তু নীলাদ্রি তার কান্নাকে মূল্য দিলো না। সে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। নীলাদ্রির মতে মানুষ অহেতুক ছোট ছোট বিষয়ে কাঁদে। পৃথিবীতে গবেষকের অভাব নেই। অথচ সে না খুঁজেই নীলাদ্রিকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। এটাতে বোঝা যায় এই লোক উচ্চতর পর্যায়ের বোকা মানুষ, যার কাছে কিছু হাত থেকে ফসকে যাওয়া মানে জীবন বৃথা। নীলাদ্রির জীবনে সব জিনিসের একটা আলাদা মর্ম আছে। তার কোনো জিনিসের প্রতি অত্যধিক পিছুটান নেই। তবে তার ধারণা এই কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। তার পিছুটান আছে। কিছু হাতেগোনা ব্যাক্তিবর্গের প্রতি তার এই পার্থিব পিছুটান আছে। এবং তার মধ্যে পিউ অন্যতম। পিউয়ের প্রতি নীলাদ্রির টানটা খুব সূক্ষ্ণ হলেও বেশ শক্ত প্রকৃতির। কিন্তু এই টানটাকে ঠিক কোন সম্পর্কের মধ্যে ফেলা যায় বুঝতে পারে না নীলাদ্রি। ভালোবাসা নামক অপার্থিব জিনিসকে সে বিশ্বাস করে না। একটি মানুষ নিজেকে ব্যতীত কাউকে ভালোবাসবে এটা অকল্পনীয়। কিন্তু পিউয়ের প্রতি সে দূর্বল। যদি কখনো বিয়ে করে তবে সে পিউকেই বিয়ে করবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পিউকি তাকে বিয়ে করতে চাইবে? তারমত মানুষের সাথে পিউ কি থাকতে চাইবে? সে যদিও বুদ্ধিমতী মেয়ে, কিন্তু অপার্থিব জিনিসে সে বিশ্বাস করে। ভালোবাসার দাবি সে করতেই পারে। নীলাদ্রি তো তাকে ভালোবাসতে পারবে না, সিনেমার নায়কদের মতো কাব্যিক কথা তার আসে না, সে তাকে চমকে দিতে পারবে না, মিঠা কথার বানে তার হৃদয়ে দোলা দিতে পারবে না। তবে হ্যা মেয়েটিকে দুঃখ পেতে দিবে না সেই দৃঢ়তা তার মাঝে আছে। তাকে সবসময় সম্মান করবে, আগলে রাখবে। তবে এই প্রতিশ্রুতি কি মেয়েটা নিবে! এই সমাজের সব কিছু ফেলে পাহাড়ে তার সাথে সাধারণ জীবন কাটাতে পারবে! হয়তো না! তাই নীলাদ্রির হাজার পিছুটান থাকা সত্ত্বেও সে পিছিয়ে যায়। মেয়েটিকে আঁকড়ে ধরতে পারে না।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় নজরে পড়লে হাসপাতালের করিডোরে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে রীতিমত টানছে। দ্বিতীয়পুরুষটি নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও পারছে না। একটু কাছে যেতেই দেখতে পেলো সে পুরুষটি টানাটানি করছে সে আর কেউ না আহাশ। তার রীতিমতো ক্রোধিত স্বর,
“যাবেন না মানে! ডাক্তার হয়ে আপনি যাবেন না কেন। রোগী এদিকে মরে যাচ্ছে। আর এদিকে আপনি এমন পাষান কাজ করছে৷ এগুলো আপনাদের শিখানো হয়! আসলে এই দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে আপনাদের জন্য, দ্যস্ফুনক্তিওনাল”

আর অসহায় ডাক্তার বলছে,
“আরে ভাই আমি ডাক্তার, কিন্তু আমি যাবো না। কথা বুঝেন আমার। আমাকে টানাটানি কইরেন না”

এই আহাশ ছোকরাটা পিউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। যা অতিশয় বিরক্ত করে নীলাদ্রিকে৷ ছেলেটার মাঝে বাড়াবাড়ি একটা ব্যাপার আছে। ফলে ডাক্তারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে এগিয়ে এলো নীলাদ্রি। ধমকের স্বরে আহাশকে বললো,
“এই ছোকরা, তুমি এভাবে টানাটানি করছো কেনো! ডাক্তার বেচারা তো এখানেই হার্ট ফেইল করবে! ছাড়ো উনাকে”
“এই আপনার এতো কিসের সমস্যা! সব কিছুতে লম্বা নাক দিয়ে ঢুকে পড়েন। এদিকে পিউ আপুর জ্বরে বেহুশ হাল। এই ডাক্তার চলুন। এক্কনি”

আহাশ উল্টো গর্জালো। পিউয়ের কথা শুনতেই নীলাদ্রির টনক নড়লো। মেয়েটার জ্বর! কবে থেকে! সেদিন না বাড়ি পৌছে দিয়েছিলো! বৃষ্টির জন্য জ্বর হলো! নীলাদ্রি খানিকটা অস্থির হলো। ডাক্তারের আরেকহাত শক্ত করে ধরে বললো,
” চল ব্যাটা। তুই যাবি তোর ঘাড় যাবে”
“আপনি তুই তুকারি করছেন কেনো?”
“তুই না গেলে আমি “ব”, “চ”, ” ম” বর্গীয় গালিও দিবো”

এভাবেই ডাক্তারকে বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে এই পুরুষ। পিউ হতভম্বের মত চেয়ে রইলো। এই মহান দুই পুরুষ তার জন্য পশুপাখির ডাক্তার তুলে এনেছে। আহাশ কাচুমাচু স্বরে বললো,
“আপনি ডাক্তার না! তাহলে আপনি ডাক্তারের চেম্বারে বসেছিলেন কেনো?”
“অদ্ভুত ডাক্তারের চেম্বারে মানুষ কেনো যায়! আমি তো ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। আপনি তো বিনা বাক্যে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন। আপনার সাথে এই মানুষটিও যুক্ত হলো। দুজন মিলে তো আমার কোনো কথাই শুনলেন না। উলটো এই আহাম্মক লোক আমাকে গালি দিচ্ছিলো। আমি বারবার তো বলছিলাম, শুনুন শুনুন”

নীলাদ্রি বিরক্ত হলো। আহাশের উদ্দেশ্যে বললো,
“জার্মান গর্দভ। আর এই ডাক্তার, আপনার এখানে কাজ নেই। আপনি আসতে পারেন”

ডাক্তার মুখ খিঁচিয়ে বললো,
“আমি আসতেও চাই না। যতসব পাগল”

নীলাদ্রি গা মাখালো না। সে নির্লিপ্ত, এমন ভাব যেনো কিছু হয় নি। স্বাভাবিকভাবে পিউকে বললো,
“তুমি জ্বর বাধালে কিভাবে?”
“অদ্ভুত! আমি কি ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছো?”
“তোমার মতো বুদ্ধিমান মেয়ের এমন ইরিস্পন্সিবলের মত কাজ বেমানান। এবার উঠো। হাসপাতালে যাবে। এই জার্মান গর্ভদ তো ভেট তুলে এনেছে”

আহাশ প্রতিবাদ করতে চেয়েও করলো না। সে আসলেই ডাক্তারের পরিচয় জানতে চায় নি। পিউয়ের মাথা ব্যাথা করছে। এই ডাক্তার কান্ডে সেই ম্যাথা বাড়ছে। কিন্তু নীলাদ্রি ঠিক তার সম্মুখে বসা। বিরক্তি গিলে বললো,
“আমি কোথাও যাবো না নীলাদ্রি ভাই। আমার উঠার শক্তিও নেই। আপনাদের জন্য মাথা ব্যাথাটা বেড়েছে। আপনারা বরং চলে যান। আমি সুস্থ হয়ে যাবো”

নীলাদ্রি চোখ কুচকে তাকিয়ে রইলো মিনিট দুয়েক। তারপর পিউকে চমকে দিয়ে একটা অবাককর কাজ করলো। বিনা নোটিসে তাকে কোলে তুলে নিলো। এমন কাজে চমকে গেলো পিউ। পিউ ছটফট করতে নিলে নীলাদ্রি গাঢ় স্বরে বললো,
“চুপ, একদম চুপ। একে অসুস্থ হয়ে অস্থির করবে। আবার নখরামি দেখাবে। আমি কিন্তু এগুলো পছন্দ করি না পিউ”

পিউ ভাষাহীন হলো। এই মানুষকে নাকি সে অস্থির করেছে মানা যায়! পিউয়ের মাকে বলে তার সামনেই কোলে নিয়ে বের হলো নীলাদ্রি। আহাশ চুপ করে সেই দৃশ্য দেখলো। এই অধিকারটি পিউ তাকে কেনো দেয় না! পিউ তার অস্থিরতা কেনো দেখে না!

******

বাকুয়ী মহলে ঐন্দ্রিলার জীবন পাল্টেছে। এখন বারোটা পর্যন্ত সে ঘুমায় না। উঠে সকাল সকাল। যে ঐন্দ্রিলা রান্নাঘরমুখো হত না সে রান্নাঘরে যায়। ছবিরনের কাছ থেকে রান্নার ট্রেনিং নেয় সে। এবাড়ির নিয়ম ভিন্ন। দাদা খায় ঠিক দেড়টায়। এটা নিয়ম। তাই রান্নাবান্না সব সেই সময়েই হয়ে যায়। ঘরের মহিলারা তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। বউ হওয়ার জন্য এই কদিন যাবৎ ঐন্দ্রিলাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দাদা সেদিন খাবার সময় বলছিলেন,
“কানন এবার ঐন্দ্রিলাকে হেসেলের দায়িত্ব দেও। তোমার বয়স তো কম হলো না”

কথাটায় কানন এবং ঐন্দ্রিলার উভয়ের মুখ ছোট হলো। কাননের কাছে তার হেসেল তার রাজত্ব। আর ঐন্দ্রিলা হেসেলের হ বুঝে না। তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জোর পূর্বক হাসলো। আউওয়াল সাহেব ঐন্দ্রিলার উদ্দেশ্যে বললো,
“নাতবউ, তুমি শ্বাশুড়ির থেকে শিখে নাও। নাকি তোমার আবার অন্যকোনো মতলব আছে! যে মেয়ে বিয়ের দিন পালাতে পারে তার মন বোঝা যায় না”

দাদার কটুক্তি ভালো লাগলো না ঐন্দ্রিলার। সে তাই জেদ ধরেছে সে রান্না শিখবে। তাই তার শিক্ষক হলো ছবিরন। ছবিরন কড়া শিক্ষক৷ কিন্তু সেই সাথে একটু বেফাঁস কথা বলার বাতিক আছে। এই যেমন আজ যখন ঐন্দ্রিলা মাছ ভাজছিলো ছবিরন ফট করে বলে উঠলো,
“বউ তোমার ঠোঁটের ঘা তো এক্কনও হুকায় নাই। নাকি অভ্রবাপে প্রত্তিদিন কামড়াইয়া ঘা বাড়ায়”

কথাটায় জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র ঠিক সেই সময়ই রান্নাঘরে প্রবেশ করছিলো। ছবিরনের কথাটা তার কর্ণপাত হলো। ঐন্দ্রিলাকে সেই সময় ডেকে বললো,
“ঐন্দ্রি একটু ঘরে আয় তো! আমি বের হব”

আর কি লাগে ছবিরন আরোও মিটিমিটি হাসতে লাগলো। ঐন্দ্রিলা পারে না গর্ত করে মাটিতে ঢুকে পড়তে। ঘরে আসতেই কিড়মিড়িয়ে বললো,
“কি! ডাকছিস কেনো?”

একটা মলম এগিয়ে অভ্র গম্ভীর স্বরে বললো,
“ঠোঁটে লাগিয়ে নে। ঘা হয়ে যাবে তো”
“থাক, জুতো মেরে গরু দান করতে হবে না। আদিক্ষেতা। বুঝি না আমি। মাতাল হয়ে চুমু খাবে, ঠোঁট কামড়ে ঘা করবে আবার এখন আদিক্ষেতা করছে। আবার বড় বড় কথা! লজ্জা করে না বড় বড় কথা বলতে। কি বলেছিলি আমার প্রতি লোভ নেই তো তাহলে এগুলো কি! মাতাল হয়ে আমার ইজ্জতে হানা দিলি কেনো! যতসব। নোংরা ছেলে কোথাকার!”

ঐন্দ্রিলা গরগরিয়ে বলে দিলো কথাগুলো। সেদিনের লুকায়িত রাগ জাহির করলো যেন। অভ্র ঐন্দ্রিলার দিকে সুচালো নয়নে তাকিয়ে রইলো। কোনো কথা বললো না। কিন্তু উত্তরটা দিলো রাতের বেলা। ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র খাটের ঠিক মাঝবরাবর দু তিনটে পর্দা টানালো। ঐন্দ্রিলা তার দিকে সূচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ঠিক কি চায় বুঝতে চাইছে। অভ্র সেই পর্দাগুলো টেনে দিয়ে বললো,
“নে এবার শো”
“এই বর্ডার কেন?”
“খারাপ ছেলেরা অনেক কিছু করে! মদ খেয়ে চুমু খেয়েছে৷ ঘুমের মধ্যে যদি ন্যাংটো হয়ে নৃত্য করে! বলা তো যায় না। তাই তোকে প্রটেকশন দিলাম”

এই কথার মর্মার্থ বুঝতে কষ্ট হলো না ঐন্দ্রিলার। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো সে। অভ্র ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আসুন মহারানী ঘুমান”

ঐন্দ্রিলা কিছু বললো না। মুক শক্ত করে শুয়ে পড়লো তার জায়গায়। আজ সে ঘুমাবে। শান্তিতে ঘুমাবে। নিশ্চিন্তে ঘুমালেও সকালে যখন চোখ মেললো তখন আবিষ্কার করলো সে রীতিমতো অভ্রের বুকের উপর শুয়ে আছে। আজ অভ্র তার জায়গা ছাড়ে নি। কিন্তু ঐন্দ্রিলা তার স্থানে নেই। মুখখানা তুলতেই ঘুমচোখে দেখলো অভ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাঁকা হেসে বললো,
“এখন কে কার ইজ্জত লুটছে!”…….

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৫তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা মুখখানা তুলতেই ঘুমচোখে দেখলো অভ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাঁকা হেসে বললো,
“এখন কে কার ইজ্জত লুটছে!”

অভ্রের টিটকারিমূলক কথায় নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ঐন্দ্রিলা। অভ্রের শান্ত দৃষ্টি তার উপর নিবিদ্ধ। ঐন্দ্রিলা চোখ নামিয়ে নিলো। থমথমে স্বরে বলল,
“আমি কিভাবে এখানে আসলাম?”
“আমি কি জানি! আমি তো এক বিন্দু সরি নি”

অভ্রের উত্তরে ঐন্দ্রিলার মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠলো যেন। লজ্জায় মুখ থেকে তর্ক বের হলো না। ফলে সে সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। ঐন্দ্রিলা উঠতে নিলেই কোমড়ের অস্থি চেপে ধরলো অভ্র। ফলে মুখ থুবড়ে পড়লো সে অভ্রের বুকে। অভ্র তার মুখের উপর আসা এলোমেলো চুলগুলোকে আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। গালে রুক্ষ্ণ আঙ্গুল ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“পালাচ্ছিস কোথায়! খারাপ ছেলের বুকের উপর শুয়ে ভস ভস ঘুমানোর সময় তো একবারও মনে পড়ে নি, এই ছেলেটা যেকোনো সময় তোর ইজ্জত লুটে নিবে!”

ঐন্দ্রিলা চুপ করে রইলো। বিব্রতবোধ হচ্ছে। মুখখানা লাজে রক্তিম। অভ্র হাসলো নিঃশব্দে। তার রুক্ষ আঙ্গুল তখন বিচরণ করছে ঐন্দ্রিলার গালে। গাঢ় স্বরে বললো,
“তুই আমার স্ত্রী, আমার তোর উপর অধিকার আছে। তোকে ছুতে হলে আমার মদ খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তোকে চুমু আমি যখন তখন খেতে পারবো।”

বলেই ঐন্দ্রিলার ঠোঁটের খতকে চুমু খেলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা চমকালো। অভ্রের গাঢ় চুম্বনে শরীর কাঁপলো। বিহ্বল হলো দৃষ্টি। অভ্র তার গাল ছুয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
“তোর শরীরের খাঁজে নিজের অধিকার জমাতে আমার একমিনিটও সময় লাগবে না ঐন্দ্রি। কারণ পুরোদস্তর আমার। শুধু আমার। তুই জানিস তুই আমাকে কতটা যন্ত্রণা দিস! আমি ভালো হতে চেয়েছি। আমি তোকে সময় দিয়েছি। ধৈর্য ধরেছি। আমার জানোয়ার সত্ত্বা তোকে দেখাই নি। অথচ আমি খারাপ। বেশ! আমি খারাপ ই সই। লাগবে না আমার তোর ভালোবাসা। লাগবে না আমার সংসার। এখন থেকে আমি তোর কাছে তখন আসবো, যখন তুই চাইবি। এই সংসার, এই সংসার খেলা এখন থেকে বন্ধ। এই সম্পর্ক এখন থেকে স্থগিত। যেদিন তুই মনশহরে নিমন্ত্রণ দিবি সেদিন ই এই মাহাবুল হক অভ্র তোর মনশহরে প্রবেশ করবে। নিজ থেকে আমি চেষ্টা করবো না। আজ থেকে আমার পুতুল মুক্ত”

ঐন্দ্রিলা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। অভ্র তাকে বুকে থেকে নামিয়ে দিলো। পকেটে হাত দিয়ে হনহন করে বাথরুমে চলে গেলো সে। ঐন্দ্রিলা সেখানে ঠায় বসে রইলো। এমনটাই কি সে চাইছিলো না? তাহলে হুট করে কেনো শেষ কথাটা কানে বাজছে। সংসার সংসার খেলাটা কি তাহলে সত্যি সত্যি শেষ? তার দগ্ধ করবে না কেউ! অবশেষে কি শান্তির দেখা মিলবে? যদি তাই হয় তাহলে খুশি হতে এতো কিসের দ্বিধা? ঐন্দ্রিলার মনে হলো কোথাও একটা শুন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সে নিজেও জানে না সেই শুন্যতাটা কিসের! ঐন্দ্রিলা এখনো বসে রয়েছে। ফাঁকা মস্তিষ্ক। যেনো বিকারহীন কোনো জলছবি।

****

দোকানের সব থেকে ভেতরের ঘরে বসে রয়েছে অভ্র। বেশি বড় নয় এই রুমটি। ছোট রুম। এসি লাগানোর উপায় নেই। কারেন্টের লাইনে বেশি লোড দেওয়া যাবে না। মাথার উপরে একটা ফ্যান চলছে। তাও খুব ক্ষীণ গতিতে। কত পুরোনো হবে তা জানা নেই। ক্যাপাসিটর পাল্টাতে হবে। জানালাগুলো খোলা। বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। এই সময়ের এক দোষ। কথা নেই বার্তা নেই ধুমধাম মন পরিবর্তন। এই যে একটু আগের কথা কি ঝলমলে স্বর্ণালী রোদ ছিলো। অথচ এখনই মেঘেরা বিদ্রোহ করেছে। বৃষ্টি হলেও গরম কমছে না। ভ্যাপসা ভাবটা কাটছে না। গতমাসের বিলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিলে। সেগুলো দেখতে হবে। পাশে চায়ের কাপ। থেকে থেকে ঠান্ডা হয়ে গেছে। আজকের চা বোধ করি অভ্রের খাওয়া শ্রেষ্ঠ অখাদ্য চায়ের লিষ্টে নাম লিখিয়েছে। চিনির স্তুপে এক মুঠো চায়ের কষ পাতা। চুমুকে জিহবা থেকে শুরু করে অন্তরের ভেতরটাও তিতকুটে বিশ্রী স্বাদে ছেয়ে গেছে। এর উপরে চাপ সৃষ্টিকারী নতুন সমস্যা এই মাসে খরচাটা বেশি হয়েছে। মাসের শেষে নতুন দোকানের এডভান্স করার কথা ছিলো। ছিলো তবে ব্যাটারটা এখন কতদূর আগাবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ এখন হাতে কোনো টাকা নেই। ব্যাপারটা খুব চিন্তার। কিন্তু অভ্র খুব একটা চিন্তা করছে না। কারণ সে মোটামোটি আত্মবিশ্বাসী দাদাকে একটু নাকানী চুবানি সে খাওয়াতে পারবে। দাদার স্বৈচারিতা স্বভাব আর দম্ভকে চুরমার করতে পারবে সে। এতোটুকু বিশ্বাস আছে। বিল্লালের যদিও চিন্তার শেষ নেই। সে প্রতিদিন টাকার জন্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তার চিন্তার শেষ নেই। অবশ্য অভ্রের চিন্তা হচ্ছে না সেটা নয়। চিন্তা হচ্ছে। চিন্তাটা টাকার নয়। চিন্তার নাম ঐন্দ্রিলা। ছোটবেলা থেকেই এই একটি চিন্তা তার মস্তিষ্ককে গ্রাস করে রেখেছে। অভ্র, একজন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, জেদি, দাম্ভীক ছেলে। তার জেদ, দম্ভ তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। কোনোকিছুর প্রতি তার আগ্রহ ছিলো না। ছিল না বলাটা অতিরঞ্জিত। ছিলো তবে কম। শখের খেলনা কিনে দিলেও তা এক ঝটকায় ভেঙ্গে ফেলতো সে। অথবা কখনো দশ মিনিট খেলতেই বিরক্তি চলে আসত। সেই খেলনা তখন পড়ে থাকতো ধুলোর আস্তরণে। সেই আস্তরণ কখনো ফিরেও দেখতো না অভ্র। তার আগ্রহ নেই। সমবয়সীদের সাথেও খুব একটা মিশতো না। এড়িয়ে যেতো, একাকীত্ব ভালোবাসত। এর মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো ঐন্দ্রিলা। ছোট, গোলগাল মুখ, কিঞ্চিত খাঁড়া নাক আর গোলগোল বিস্ময়ে ভরা চোখ। একেবারে পুতুল। হ্যা পুতুল ই সে। বিশ্বাস করে তার কান্না। দোকানের পুতুলগুলো এভাবে কাঁদতে পারে না। অভ্রের এখনো মনে আছে সে নিষ্ঠুরভাবে ঐন্দ্রির শখের পুতুল ভেঙ্গে দিয়েছিলো। ঐন্দ্রি রেগেমেগে ওর হাত কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিলো। অথচ অভ্র ছিলো নির্বিকার। তার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে না। সে শুধু খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। সেই প্রথম তীব্র আগ্রহ জন্মেছিলো এই মেয়েটির প্রতি। তাকে রাগাতে ভালো লাগে, কাঁদাতে ভালো লাগে। এই কাজে বিরক্তি আসে না, একঘেয়েমি আসে না। মেয়েটি যেন তার একান্ত পুতুল। সেই অধিকারবোধটা কখন তৈরি হলো হয়তো অভ্র খেয়াল করে নি। খেয়াল করতে চায় নি। তবে একটা জিনিস সে জানে ঐন্দ্রিলাকে কাঁদানোর অধিকার শুধু তার। তাই তো যখন সৌরভ তার এই দূর্বলতার সুযোগ নিতে চেয়েছিলো সে মোটেই সহ্য করে নি। তবে তার এই দূর্বলতাকে সবাই প্রেম নামে আখ্যা দিয়েছে বহুবার। প্রেম কি জানে না অভ্র। ঐন্দ্রিলার প্রেমে পড়া হয়তো ফরজ অভ্রের জন্য। রুপবতী মেয়ে, হাসলে যেকোনো পুরুষের হৃদয় নাড়িয়ে দিবে হয়তো। আর কাঁদলে মনে হয় সব কিছু উজার করে দিলেও আফসোস নেই। কিন্তু তার প্রেমে কি এই মাহাবুল হক পড়েছে? যে তার নিজস্ব তার প্রেমে নতুন করে পড়ার কোনো স্বার্থকতা দেখে না অভ্র। বড় হবার সাথে সাথেই দাদার স্বৈচারিতা যেনো মাত্রাতিরিক্ত বাড়লো। ব্যাবসা বড় করার জন্য অভ্র যখন তার কাছে টাকা চাইলো তিনি শর্ত জুটে দিলেন “বিয়ে”।

বিয়ে এই শব্দটার অর্থই বাঁধন। একজনের সাথে সারাটা জীবন কাঁটানো কি সহজ কথা? স্বাধীনচেতা মনকে সাংসারিক একটা কালকুঠুরীতে আটকানো কি সহজ কথা? যে অভ্র কখনো নারী সত্ত্বায় মত্ত হয় নি সে অপরিচিত অজানা একটি মানুষের সাথে কি করে তার জীবন কাটাবে। বিয়ে কি ছেলে খেলা? কোনো আগ্রহ, ইচ্ছে, আকর্ষণ ব্যাতীত কি করে বিয়ে নামক ধাধায় আটকাবে। তখন প্রথম যে নামটা স্মরণ হলো সেটা হলো ঐন্দ্রিলা। টক-ঝাল সম্পর্কটায় মিষ্টতা না থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো একঘেয়েমি নেই। অভ্র কখনো ঐন্দ্রিলার থেকে বোর হয় না। সে একটা এডভেঞ্চার যেনো। ফলে অভ্র বিয়েতে রাজী হয়ে গেলো। কিন্তু এর মাঝে দাদা আবারোও তার স্বৈরাচারিতা দেখাচ্ছে। সেও হার মানবে না। সংসারের মত সংসার করে সে দেখিয়ে দিবে দাদাকে। ঐন্দ্রিলার সাথে সংসার করতে হলে মেয়েটির তাকে ভালোবাসতে হবে। উথাল পাথাল ভালোবাসা। এখানে মার খেলো অভ্র। ভালোবাসা ছাড়াও তো সংসার হয়। জোর করে, মতের বিরুদ্ধে। কিন্তু অভ্র সেটা চায় না। ঐন্দ্রিলা এমন মানুষ যাকে জোর করলে সে কেঁচোর মতো গুটিয়ে যায়। তাই সে ধৈর্য্য ধরেছিলো। ভালো ছেলে হতে চেয়েছে। ঐন্দ্রিলার মন গলাতে চেয়েছে। অভ্রের খুব ইচ্ছে করে এই মানুষের মুখোশ ছিড়ে নিজের মধ্যের হিংস্র জানোয়ারটাকে বের করে আনতে। ঐন্দ্রিকে নিজের করে নিতে। তার প্রতিটা নিঃশ্বাসে অভ্রের স্পর্শ লিপ্ত করতে। ঐন্দ্রিলার সর্বত্র নিজের আধিপত্য খোদাই করে নিতে। কিন্তু সে তা করে নি। তার বিশ্বাস ছিলো একদিন ঐন্দ্রিলার চুলের গন্ধে অভ্রের সকাল হবে। অভ্রের নামের শক্ত শেকলে তাকে আটকে ফেলবে। ভেবেছিলো মেয়েটির নরম হৃদয়ে দয়া হবে। কিন্তু মেয়েটি সেই সুযোগ দেয় নি। এখন তাই নিজের পরিকল্পনা বদলেছে। এখন ঐন্দ্রিলার কাছে যাবে না সে, তাকে বিরক্ত করবে না। তার প্রতি ভালোবাসা দেখাবে না। কথায় আছে মেয়েদের কৌতুহল তাদের ডুবায়। ঐন্দ্রিলা কৌতুহলপ্রবণ। সে এই জালে পড়বেই। নিশ্চিত। এর মাঝেই প্রায় ছুটে প্রবেশ করলো বিল্লাল। অভ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“তুই কি লোন নেবার কথা ভাবছিস?”

অভ্র চোখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মেজাজ খারাপ হলো কিঞ্চিত। অভ্রের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে যায়। তাই এটা নতুন নয়। সে নির্বিকার হয়ে বললো,
“হ্যা”
“এত্তোগুলো টাকা তুই কেনো নিচ্ছিস? শোধ দিবো কি করে আমরা?”
“সে চিন্তা আমাকে করতে দে। আমার দাদা আছে কেনো?”
“মানে?”

অভ্র কিছু সময় চুপ থেকে বললো,
“বিয়ে করিস নি তো। তাই এসব বুঝবি না। বাদ দে”
“বুঝিয়ে বল, তাহলে তো বুঝছি”
“লং কথা শর্টে, আমার বাচ্চা হলে দাদা আমাকে টাকা দিবেন। তখন লোন পরিশোধ করে দিব”

ভাবলেশহীন উত্তর। বিল্লালের মেজাজ খারাপ হলো তীব্রভাবে। রোষানলে দগ্ধ স্বরে বললো,
“তুই কি তাহলে এজন্য বিয়ে করেছিস? টাকার জন্য?”

অভ্র উত্তর দিলো না। বিল্লাল তার নিস্তব্ধতায় আরোও রেগে গেলো। হিনহিনে স্বরে বললো,
“আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম সে তো তোর পুতুল। তা বলি খেলা শেষে বুঝি এবারো তার স্থান হবে ধুলির স্তুপে? খেলনাই তো কি যায় আসে তার হৃদয় ভাঙ্গলো কি না। হোক সেই মেয়েটা কিন্তু আবেগপ্রবণ”

বিল্লালের কথাগুলো মোটেই ভালো লাগছে না। খুব বিশ্রী ভাবে বাজছে যেনো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সে বিল্লালের দিকে কিন্তু বিল্লালের ভাব পরিবর্তন হলো না। মুরিদ আজ পীরকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমনটাই তো হবার ছিলো।

****

রাতের নিরবতা জানান দিচ্ছে তার গভীরতা। খাবার নিয়ে বিসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। অপেক্ষা বেয়াদব ছেলেটির। সে এখনো আসে নি। কেনো যেন সেও ঘুমাতে পারছে না। চিন্তা হচ্ছে। তাই যখন কলিংবেল বাজলো ছুটে গেলো সে। অভ্র ক্লান্ত পায়ে প্রবেশ করতেই প্রশ্ন ছুড়লো,
“এত্তো দেরি করলি কেনো? জানিস কত সময় ধরে বসে আছি”
“কাজ ছিলো”

অভ্রের নির্বিকার উত্তরে ঐন্দ্রিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার বাড়ছি”
“খাবো না, খিদে নেই”

এবার আর সহ্য হলো না। অভ্রের কথায় গা জ্বলে উঠলো ঐন্দ্রিলার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“নাটক কম কর পিও”

ঐন্দ্রিলার এই অধিকারবোধটা মন্দ লাগলো না অভ্রের। কিন্তু তার ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো না। ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে খেলো। তারপর বিনাবাক্যেই শুতে চলে গেলো। দুজনের মাঝের দূরত্বটা বড় নয়। কিন্তু মনজোড়া যেনো বহুদূরে।

****

পিউ এর ডেঙ্গু এখন সেরে গেছে। বহুদিন পর কলেজ এসেছে। এই কয়দিন আহাশ এবং নীলাদ্রি এই দুটো মানুষের যন্ত্রণায় সে বিরক্ত ছিলো। তাদের অতিরিক্ত যত্ন বিরক্তির কারণ ছিলো যেন। বাধ্য হয়ে দরজায় সাইনবোর্ড ঝুলাতে হলো,
“এখানে পাহাড়ি এবং জার্মানি পাগলের প্রবেশ নিষিদ্ধ”

কলেজে এসেও শান্তি নেই কারণ ঐন্দ্রিলার মন ভালো নেই। সে যেনো নিজের চিন্তায় কোথাও হারিয়ে গেছে। তাই জোরপূর্বক তাকে নিয়ে কলেজ বাঙ্ক করে এসেছে ফুচকা খেতে। অনেকদিন কেনাকাটাও হয় না। নিউমার্কেটের কাছে যেতেই একটা রেস্টুরেন্টের কাচের দিকে তাকাতেই পিউ বিস্মিত হলো। অন্যমনস্ক ঐন্দ্রিলাকে ধাক্কা দিয়ে শুধালো,
“ওটা অভ্র না?”

অভ্রের নাম শুনতেই তড়াক করে চাইলো ঐন্দ্রিলা। সাথে সাথেই বিষন্নতা ছেয়ে গেলো হৃদয়। হ্যা সেই রেস্টুরেন্টের কাঁচের ওপারের মানুষটি অভ্র। তার পাশে একজন রমনী। তারা হাসছে…….

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৬তম_পর্ব

“ওটা অভ্র না?”

অভ্রের নাম শুনতেই তড়াক করে চাইলো ঐন্দ্রিলা। সাথে সাথেই বিষন্নতা ছেয়ে গেলো হৃদয়। হ্যা সেই রেস্টুরেন্টের কাঁচের ওপারের মানুষটি অভ্র। তার পাশে একজন রমনী। তারা হাসছে। কাঁচের মোটা পরদ ভেদ করে রমনীর মুখখানা স্পষ্টত দেখা গেল না বটে কিন্তু অভ্রের হাস্যোজ্জ্বল, মুখখানা যেনো দৃষ্টি এড়ালো না। ঐন্দ্রিলার মুখখানা ম্লান হয়ে গেলো। যে শুন্যতাকে স্মরণ করতে চাইছিলো না সেই শুন্যতাই আবার নিজের উপস্থিতি প্রকাশ করলো। কে এই রমনী? তার সাথে দিনে দুপুরে রেস্টুরেন্টে বসে হাসিঠাট্টার কি মানে? দুশ্চরিত্রতা কি এখন প্রকাশ করা খুব প্রয়োজন? অভ্র কি একটিবারও ভাবলো না তার কথা? বাড়িতে বউ থাকা সত্ত্বেও বাহিরে কোনো নারীর সাথে ঘনিষ্ঠতাকে দুশ্চরিত্রতা ছাড়া আর কোনো উপাধি কি দেওয়া যায়? জানা নেই ঐন্দ্রিলার. ম্লান মুখখানা রাগে কিঞ্চিত শক্ত হয়ে গেলো।নিন্মোষ্ঠ কাঁমড়ে ধরলো সে। ক্ষত বিক্ষত হলো নরম নরম ঠোঁট। বান্ধবীর শক্ত মুখখানা দৃষ্টির আড়াল হলো না পিউয়ের। নিজের ভুল কাজটা টের পেলো ভালোভাবে। জোর করে হেসে বললো,
“কি গরমটাই না পড়েছে! চল এখান থেকে দাঁড়িয়ে কাজ নেই”

ঐন্দ্রিলার হাতখানা ধরে টানতে গেলো পিউ। কিন্তু এক ইঞ্চি নড়লো না ঐন্দ্রিলা। বরং বললো,
“কফি খাবি? কোল্ড কফি? আমার খেতে ইচ্ছে করছে”
“এই মাঝরাস্তায় কফি পাবি কই?”
“কেনো রেস্টুরেন্ট কি মরে গেছে!”

কথাটা বলেই পা বাড়ালো সেই রেস্টুরেন্টের দিকে। তার পায়ের গতি ক্ষিপ্র। পিউ প্রায় ছুটে টেনে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো,
“পাগল হয়ে গেলি নাকি? ওদিক যাচ্ছিস কেনো?”
“কেনো? দিনে দুপুরে কেউ নির্লজ্জের মতো অন্য মেয়ের সাথে বসে আছে বলে আমি সেইখানে যেতে পারবো না? ও কি রেস্টুরেন্ট কিনে রেখেছে”
“বোন আমার, সিন ক্রিয়েট করিস না”
“তুই কি যাবি?”

কঠিন স্বরের সামনে হাটু ভেঙ্গে পড়তে হলো পিউয়ের। ঐন্দ্রিলার জেদ ভালো করেই জানা। রেস্টুরেন্টে একটা কান্ড না ঘটাতে মেয়েটির শান্তি নেই। পিউয়ের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। জার্মান আর বান্দরবানের জোড়া পাগলের অত্যাচার থেকে দুদন্ড মুক্তি চেয়েছিলো। ভুল হয়ে গেছে। সাংঘাতিক ভুল। পিউয়ের রাগ হয় না। কিন্তু আজ হচ্ছে। প্রচন্ড হচ্ছে তাও অভ্রের উপর। বাড়িতে টিকিং বোম্ব ফেলে সে বাহিরে হেসে খেলে বেড়ানোর দুঃসাহস দেখায় কি করে?

রেস্টুরেন্টটা একেবারে রাস্তার ধারে। নতুন ওপেনিং হয়েছে। চাকচিক্যভাবটা বেশ ঠিকরে উঠছে। মডার্ণ ভাষায় “ভাইব আছে”। পিউয়ের চোখ ঘুরে ঘুরে দেখছে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে প্রকাশ পাওয়া রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়ার ডিজাইন। আধুনিকতার প্রকাশ পেলেও একটু বাঙ্গালী ছোঁয়া আছে। কিন্তু ঐন্দ্রিলার নজর সেখানে নেই। সে দেখছে অভ্রকে। তারা বসেছে ঠিক অভ্রের দু টেবিল পর। যেখান থেকে তাদের দেখা যায়। কিন্তু আফসোস হচ্ছে কথা শোনা যাচ্ছে না। শুধু মেয়েটির হাসির কলতান। যা রাগে গা জ্বলিয়ে দিচ্ছে। কি কথা বলছে? হঠাৎ চোখ আটকালো অভ্রের চোখে। সে তাকিয়ে রয়েছে ঐন্দ্রিলার দিকে। শান্ত দৃষ্টি। ঘাড়টা একটু হেলিয়ে ভ্রু একত্র করে যেনো খুতিয়ে দেখলো অভ্র। ব্যাস গলা শুকিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে নিজেকে বকলো এখানে আসার জন্য। তীব্রভাবে চেষ্টা করলো যেনো সে অভ্রকে দেখেই নি। কি নিঁখুত অভিনয়। অভ্রের হাসি প্রসস্থ হলো। সে তোয়াক্কা না করেই তার সামনে বসা রমনীর দিকে কিঞ্চিত ঝুকে গেলো। কিছু বললো একেবারে ধীর স্বরে। সাথে সাথেই রমনী পিছনে ঘুরলো। সাথে সাথেই ঐন্দ্রিলা মেনু দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। পিউ ঐন্দ্রিলার এমন কাজে শুধালো,
“মেনু কি মুখস্থ করছিস নাকি?”
“দেখে ফেলেছে আমাদের”
“হ্যা?”
“অভ্র দেখে ফেলেছে”

পিউ আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। ভীত স্বরে বলল,
“কি করবি এখন?”
“জানি না”
“বলেছিলাম এখানে না আসি। কি দরকার ওদের ফলো করার‍। মান সম্মান আর রাখলি না। এখন মেন্যু কার্ড দিয়ে মুখ লুকানো লাগছে।”

পিউয়ের কথাটা অহমিকায় লাগলো। মেনুকার্ড নামিয়ে বললো,
“কেনো রে রেস্টুরেন্ট কি আমার শ্বশুরের যে শুধু ওই বদের হাড়িটাই টাল্টু ফাল্টু করতে আসতে পারবে? কোল্ড কফি খেতে এসেছি। কোল্ড কফি খেয়েই যাবো”

বলেই একটা ওয়েটারকে ডাকলো সে। অর্ডার করলো। ভেবেছিলো অভ্র হয়তো উঠে আসবে কিন্তু এমন কিছু হলো না। সে কথা বলায় মত্ত। ঐন্দ্রিলার অশান্তি লাগছে। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তাও চিন্তা যাচ্ছে না। মেয়েটার পিঠ তাদের দিকে। তাই তার মুখখানা দেখার উপায় নেই। যখন পেছনে ফিরলো তখন ঐন্দ্রিলা ভয়ে মুখের সামনে কার্ড ধরে রেখেছিলো। তাই চাইলেও দেখতে পারে নি। তবে পিউ কিছু ভাবছে। সে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। সে কিছু চিন্তা করলেই ভ্রু কুচকে ফেলে। কপালে ভাঁজ ফেলে। এক নজরে অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে থাকে। তাকে ভাবতে দেখে ঐন্দ্রিলা বললো,
“আমেরিকা আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে আম্মা। তারা এখন আমাদের সেন্ট মার্টিনে দখলও জমিয়ে দিবে। তুই চিন্তা করেও কিছু উদ্ধার হবে না”
“চুপ কর। আমি ভাবছি অন্য কথা”
“কি?”
“মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেনো দেখেছি! মনে হচ্ছে অভ্রের সাথেই দেখেছি। কিন্তু মনে পড়ছে না। তোর মনে পড়ছে”

ঐন্দ্রিলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“মহারানীর পিঠ দেখে আমার কারোর কথা মনে পড়ছে না রে”
“সত্যি বলছি”

ঐন্দ্রিলার মাথা গরম হয়ে আছে। এখন একটু মুখ ধুতে হবে। কোল্ড কফি চলে এসেছে টেবিলে। পিউ এখনো ভাবছে। তাই ঐন্দ্রিলা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তুই ভাব, ভেবে দেশ স্বাধীন কর। আমি আসছি”

বলেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো সে।

পানির ঝাপটা একের পর এক মুখে দিলো ঐন্দ্রিলা। আয়নায় নিজেকে দেখলো। সে এখানে কি করছে! কেনো পিছু নিয়েছে অভ্রর! অভ্রর প্রতি এতো আগ্রহ কেনো! মস্তিষ্ক তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো অভ্র তার কেউ নয়। তারা কেবল ই একটা কুহেলিকার আস্তরণে একে অপরের সাথে জড়িত। অভ্র যদি অন্য কারোর সাথে সুখী হতে চায় এখানে তো দোষের কিছু নয়। কথাটা ভাবতেই শ্রাবণের মেঘ জমলো মুখবিবরে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে পেছনে ফিরতেই দেখলো ওয়াশরুমের দরজার কাছে বুকে দু হাত বেঁধে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি নিরুত্তাপ। ঐন্দ্রিলা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। অভ্র তাকে এড়িয়ে কল ছেড়ে হাত ধুলো। খুব দায়সারাভাবে শুধালো,
“তোর কলেজের ক্লাসগুলো এখন বুঝি রেস্টুরেন্টে হয়?”

অভ্রর প্রশ্নে মেজাজ তেতে উঠলো, ঐন্দ্রিলা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
“কেনো? রেস্টুরেন্ট কি কারোর নিজস্ব সম্পত্তি যে এখানে আসা যাবে না? ক্লাস নেই তাই ঘুরতে এসেছি। অন্য কারোর জন্য নির্লজ্জতামি তো আর করছি না”

অভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঐন্দ্রিলা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো। অভ্র কিছুটা এগিয়ে এসে তার কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
“কেন? জ্বলছে বুঝি?”

অভ্রর কথাটা শোনা মাত্র বিদ্রুপ টেনে উত্তর দিলো,
“বয়েই গেছে। তুই একজন কেন দশজনকে নিয়ে ঘুর। আমার কি! যত্তসব”
“মনে থাকে যেনো”

বলেই হাত মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ দাঁত পিষে দাঁড়িয়ে রইলো। ইচ্ছে করছে হ্যান্ডওয়াশের বোতলটা দিয়েই এই পুরুষের মাথা দু ভাগ করে দিতে। টেবিলের কাছে আসতেই দেখলো। রমনী বা অভ্র কেউ নেই সেখানে। ততসময়ে চিন্তাবিদের মুখ উজ্জ্বল। পিউ অধৈর্য্য কন্ঠে বললো,
“মনে পড়েছে, মেয়েটা কে”
“কে?”
“তৃষা”
“কোন তৃষা?”
“আরে স্কুলে থাকতে অভ্রের একটা ন্যাকাপ্রেমিকা ছিলো না? নাকি নাকি সুরে কথা বলতো”
“যাহ! ও চিকনে হ্যাংলা মেয়েটা? ওর এতো বড় চুল ছিলো নাকি?”

পিউ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আট নয় বছরে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার চলে এসেছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর তুই আছিস চুল নিয়ে? কিন্তু আমার প্রশ্ন নেকু তৃষার সাথে এখন অভ্রর কি সম্পর্ক”

ঐন্দ্রিলা মুখ শক্ত করে বললো,
“জাহান্নামে যাক সে। আমি কি তাতে? তুই আর কখনো ওকে নিয়ে আগ্রহ দেখাবি না। নয়তো তোর আর আমার বন্ধুত্ব থাকবে না”

পিউ বেকুবের মতো চেয়ে রইলো! ও কখনো আগ্রহ দেখালো? ওকে তো ঐন্দ্রিলা টেনে নিয়ে আসলো। এই ভাইবোনের মাথায় খুব বড় ধরনের সমস্যা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

****

সালাম সাহেব বসে আছেন পায়ের উপর পা তুলে। সামনে বাদশাহ বর্ণলিপি খুলে বসে আছে। ছাগলযুগলকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নীলাদ্রি ছাগলটা বেশি কথা বলে না। প্রশ্ন করলে ভদ্র বাচ্চার মতো বলে “ম্যা”। যা কিছুটা আশার বানী। কিন্তু হ্যাপি নামক ছাগলটা খুব জ্বালায়। সে কথা শুনে না। তাকে যতবার প্রশ্ন করা হয় সে মুখখানা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখে। সালাম সাহেব ছাগলদের নিয়ে খুব চিন্তিত। চিন্তায় চিন্তায় সকালের চাও খান নি। চা খেলে আজকাল গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। বাদশাহ মুখ কালো করে বললো,
” স্যার, ছাগলগুলো অবাধ্য। ওদের শাসনের প্রয়োজন। কথা শুনছে না”
“এখন কি তুমি ছাগলদের কান ধরে উঠবস করাবে?”

বাদশাহ মুখ ঝুলালো। ছাগলগুলো কেনার পর থেকে জীবন ছাগলময় হয়ে গেছে। সে প্রশংসা কুড়াতে চেয়েছিলো। কিন্তু তা হয় নি। নীলাদ্রির কুকুর বেশ বুদ্ধিমতী কুকুর। তাকে যা বলা হয় একেবারে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এদিকে ছাগলগুলো শুধু কাঠালপাতা খায়। আর পায়খানা করে। পায়খানাকে পায়খানা বলা যায় না। ইংরেজিতে পটি বলতে হয়। কারণ সালাম সাহেবের ছাগলযুগল উচ্চ শিক্ষিত। বাদশাহ আকাশের দিকে তাকালো। হাত উঁচু করলো, মনে মনে বললো,
“আল্লাহ, তুমি আমার মালিকের মাথায় বুদ্ধি দিও। বেচারা বুইড়া মানুষটা বিনা বুদ্ধিতেই মইরে যাবে”

সালাম সাহেব দেখলেন বাদশাহ মোনাজাত করছে। ফলে চোখ কুচকে শুধালেন,
“কি দোয়া করলি?”
“দোয়া বলতে হয় না জনাব। দোয়া বলে দিলে দোয়া কবুল হয় না”
“হো তোমাকে বলছে”
“আমার আম্মা বলেছে”
“হইছে কথা কম। আজকে ছাগলদের ইংরেজী বর্ণমালা শেখানো শুরু কর”

বাদশাহ হতাশ মুখে ঘাড় নাড়ালো। আবার জোরে জোরে বললো,
“বলো হ্যাপি, এ ফর আপেল”
“এপেল”
“স্যার, আপেল কন আর এপেল ছাগল শুধু ম্যা ই বলবে”
“গাধা কোথাকার”
“জ্বী আচ্ছা”

সালাম সাহেব তেতে উঠলেন। বাদশাহ ছেলেটা দিন দিন গাধা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় এতো গাধার আমদানী হচ্ছে যে একদিন তিনি নিজেও গাধা হয়ে যাবেন। কথা বলার পরিবর্তন “অহচি অহচি” করবেন। ইশ! কি বিভৎস দৃশ্য।

*****

পিউয়ের বাসার নিচে আহাশ দাঁড়িয়ে আছে। এতোটা সময় সে অপেক্ষা করছিলো পিউয়ের। পিউ সারাদিন রুদ্রমূর্তি ঐন্দ্রিলাকে সামলে সামলে ক্লান্ত সে। এখন বিছানায় হাত পা ছুড়ে ঘুমাতে পারলে যেনো শান্তি। গেটের কাছে আসতেই দেখলো আহাশ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখজোড়া রক্তিম, চোখের নিচে কালি, মুখখানা মূর্ছানো। পিউয়ের সাথে মুখোমুখি হতেই বললো,
“পিউ আপু, তোমার কাছে কি আমার জন্য সময় হবে?”

আহাশের ভাঙ্গা গলা শুনতেই কিছুটা চমকে উঠলো পিউ। কিছু শুধানোর পূর্বেই তার হাতজোড়া নিজ আয়ত্ত্বে নিলো আহাশ। ব্যগ্র কাতর স্বরে বললো,
“না করো না প্লিজ!”

***

ক্রীড়া এবং সংস্কৃতিক মাঠের একটি দোলনায় বসে রয়েছে পিউ। এই মাঠটি তার বাসা থেকে দুই রোড পরে। মানুষের উপস্থিতি এখানে বেশ। বাহিরের চায়ের দোকানে মানুষের ভিড়। অপোজিটে বড় একটি হাসপাতাল আছে। অধিকাংশ মানুষ ডাক্তার দেখিয়ে এখানে আসে দুদন্ড নিঃশ্বাস নিতে। হয়তো খুব বড় রোগ ধরা পড়েছে, হয়তো চিকিৎসার টাকা দিতে দিতে জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখানের মানুষের গল্পগুলোই আলাদা। পিউ খেয়াল করলো একটি মেয়ে ক্ষণে ক্ষণে চোখ মুছছে। কে জানে কি তার গল্প। প্রতিটা মানুষ নিজের গল্পের টানাপোড়েনেই ক্লান্ত। আহাশ দুটো কাপ দিয়ে হাজির হলো। দুধ চা, স্বর ভাসছে। পিউ হেসে বললো,
“দুই লোকাল পানির চা খাবি?”

আহাশ উত্তর দিলো না। তার মুখখানা থমথমে। পিউয়ের পাশের দোলনায় বসলো সে। পিউ তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার কথা শোনার জন্য। কিন্তু ছেলেটা চুপ। পিউ ঘাটালো না। অপেক্ষা করলো নীরবতা ভাঙ্গার। কিন্তু যখন ভাঙ্গলো তখন নিজেকে সামলাতে পারলো না। আহাশ তার সামনে হাটু গেড়ে বসলো। তার হাতজোড়া নিজের হাতে নিয়ে বললো,
“পিউ, তোমাকে আপু বলতে পারছি না আর। আমাকে ছোট ভাইয়ের বদলে পুরুষরুপে দেখতে পারো না তুমি? আমার ভালোবাসাটা গ্রহণ করা কি খুব কঠিন?”

পিউ বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। আহাশ তাকে জড়িয়ে ধরে ধীর স্বরে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি পিউ। তোমার কল্পনার বাহিরে। আমাকে একটা সুযোগ দাও। কথা দিচ্ছি, অভিযোগের সুযোগ দিবো না”

পিউ স্তব্ধ তাকিয়ে রয়েছে। শুধু পিউ নয়। আরেকটি মানুষও স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে প্রতি সন্ধ্যায় তার আদুরে শকুনতলাকে হাটতে বের হয়……….

চলবে