মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-২৭+২৮

0
39

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৭তম_পর্ব

পিউ স্তব্ধ তাকিয়ে রয়েছে। শুধু পিউ নয়। আরেকটি মানুষও স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে প্রতি সন্ধ্যায় তার আদুরে শকুনতলাকে হাটতে বের হয়। নীলাদ্রি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার শান্ত অবয়ব হুট করেই অস্থির হয়ে উঠলো। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো সে মাঠের ভেতরে। দোলনার কাছে যেতেই তার হাত ছেড়ে দিলও শকুনতলার দড়ির বাধন। কলার ধরে আহাশকে ছাড়ালো পিউয়ের থেকে। আকস্মিক ঘটনায় পিউয়ের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আহাশ নিজেকে সামলাতে পারলো না। নীলাদ্রি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ফলে ছিটকে বেসামাল হয়ে ধুলোময় মাটিতে আছড়ে পড়লো আহাশ। হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো রুদ্রমূর্তির দিকে। নীলাদ্রির মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে। তার পরোয়া নেই কেউ তাদের দেখছে কি না। অগণিত চোখ একরাশ কৌতুহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেও সে দায়সারা। পিউ হতভম্বের মত বসে রয়েছে। মস্তিষ্ক এখন আহাশের প্রেম নিবেদনে ধাতস্থ হতে পারে নি। তন্মধ্যেই নীলাদ্রির এমন রুপ।

নীলাদ্রি, বইপোকা মানুষ। বইপোকা মানুষের জগৎ বইয়ের মতো চমৎকার। তার মধ্যে গুনী গুনী ভাব আনার জন্য সে কখনো রাগ, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষকে স্থান দেয় নি। প্রকৃতিকে ভালোবাসতে চেয়েছে। যেন তার চিত্ত শীতল থাকে। প্রকৃতির মাঝে শান্তি খোঁজা মানুষটি তার রাগে কাঁপছে। যে নীলাদ্রিকে ছেলেবেলা থেকে চিনে তার পক্ষে নীলাদ্রিকে এমন রুপে দেখা অবিশ্বাস্য। শেষ কবে এতটা রাগের বহিঃপ্রকাশ করেছিলো নীলাদ্রি? হয়তো নিজেও জানে না। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। রাগ তার হৃদয়কে গ্রাস করছে। আহাশকে এখন নিজের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম শত্রু মনে হচ্ছে। যে শত্রুকে বধ করে ফেললেও বোধহয় আফসোস হবে না নীলাদ্রির। নীলাদ্রি তার বলিষ্ঠ হাতে কলার টেনে তুললো আহাশকে। গায়ের সকল শক্তি দিয়ে ঘুষি মারলো সে আহাশকে। ফলে নাক ফেটে গলগলিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলো। আহাশও চুপ করে থাকার পাত্রটি নয়। নীলাদ্রি দ্বিতীয় আঘাত করার পূর্বেই সে প্রতিহত করলো তাকে। ফলে দুজনের মধ্যে বেশ কোন্দল লাগলো। দুজন দুজনকে মারছে। উপস্থিত সকলে চোখ ছেকছে এই দৃশ্যে। পিউ চুপ করে থাকতে পারলো না। কোনোমতে দুজনকে পৃথক করলো। চিৎকার করে শুধালো,
“কি করছেন নীলাদ্রী ভাই, ছাড়ুন ওকে?”

নীলাদ্রির মুখখানা শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁট ফেটে গেছে। রক্ত গড়িয়ে সাদা টিশার্ট রক্তিম হয়ে গেছে। তবুও সে ফুসছে রাগে। যেনো এসবে কিচ্ছু যায় আসে না তার। এই মানুষটার অগ্নিরুপ কখনো দেখতে হবে কল্পনাতীত ছিলো পিউয়ের। তবুও সে সাহস করে দাঁড়িয়ে আছে দুই পুরুষের মধ্যিখানে৷ । আহাশ তার নাক মুছে নিলো। কালচিটে পড়েছে তার চোখের নিচে। কেটেও গেছে গালের কিছু অংশ। নীলাদ্রির শক্তির কাছে কিঞ্চিত দূর্বল হয়ে পড়লো যেনো সে। কিন্তু প্রেয়সীর সামনে সেই দূর্বলতা দেখাতে নারাজ সে। পরমুহূর্তেই শুনলো নীলাদ্রির অগ্নিঝরা কন্ঠ,
“ওর সাহস কি করে হলো তোমাকে ছোঁয়ার!”

পিউ নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“তো?”
“তো? ও তোমাকে ছুঁবে আর আমি বসে বসে দেখবো?”
“কেনো দেখতে পারবেন না নীলাদ্রি ভাই? আমি আপনার কে হই?”

পিউয়ের এমন প্রশ্নে থমকে গেলো নীলাদ্রি। গলায় আটকে এলো শব্দ। উত্তর নেই। সত্যিই তো তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। পিউ, ঐন্দ্রিলার বান্ধবী। আর নীলাদ্রি ঐন্দ্রিলার ভাই। ছোটবেলা থেকে একে অপরকে চিনে। এছাড়া কোনো সম্পর্ক কি আদোপি আছে? না নেই। পিউকে তার ভালো লাগে, মেয়েটি বুদ্ধিমতী, শান্ত; বিয়ে করার জন্য একেবারে উপযুক্ত ম্যাটেরিয়াল। এই মেয়েটির সাথে জীবন কাটানোর কথা চিন্তা করলে বিয়ে নামক প্রথাটিকে খুব একটা কঠিন লাগে না। কিন্তু পিউ তার প্রেমিকাও নয়। সেই অর্থে নীলাদ্রি পিউয়ের জীবনের একজন বহির্গত পুরুষ। নীলাদ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে পিউ তার সম্মুখে এগিয়ে এলো। কঠিন স্বরে বললো,
“আমি আপনার কে হই নীলাদ্রি ভাই? কেনো এতো অধিকারবোধ?”

নীলাদ্রি তখনো চুপ করে রইলো। সে যুক্তিতর্কের মানুষ। যুক্তিছাড়া কথা বলে না। পিউয়ের সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নেই। পিউ সম্পর্কে তার কেউ হয় না, কথাটা মিথ্যে নয়। অপরদিকে, তার এমন কাজও কাম্য নয়। সে একজন সতর্ক নাগরিক হয়ে রাস্তায় অভ্রের মতো লাফাঙ্গাগিরি করতে পারে না। সে নিজেও নিজেকে বুঝাতে পারছে না কেনো তার ভেতরটা পুড়ছে, জ্বলছে। এই জ্বলন ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। প্রেম নামক সস্তা অনুভূতিকে নীলাদ্রি সর্বদা অগ্রাহ্য করে এসেছে। তার তীব্র বিশ্বাস সে কখনো প্রেমে পড়তে পারে না। তবে কি সেই বিশ্বাস মিথ্যে? নীলাদ্রিকে বোকার মত মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিউয়ের মন বিষিয়ে উঠলো। রুদ্র কন্ঠে বলল,
“কি হলো চুপ করে আছেন কেনো নীলাদ্রি ভাই? উত্তর নেই নাকি? সর্বজ্ঞানী মানুষটির কাছে উত্তর নেই?”
“উত্তর নেই কারণ আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। সবসময় অধিকারবোধের জন্য সম্পর্কের প্রয়োজন হয় না। আর সম্পর্ক এখন তৈরি হয় নি, তবে হতে কতক্ষণ। কিন্তু তাই বলে কেউ তোমাকে জড়িয়ে ধরবে সেটা আমাকে সহ্য করতে হবে?”
“হ্যা হবে, কারণ আপনি একটা বলদ। আপনার মত আহাম্মক আমি ইহজনমে দেখি নি নীলাদ্রি ভাই। আপনার দ্বারা কিচ্ছু সম্ভব নয়। কিচ্ছু না। তাই আপনি কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরলে সেটা আপনি শুধু দেখবেন। বুঝলেন?”

রাগ, ক্রোধ, যন্ত্রণায় ফেটে পড়লো পিউ। নীলাদ্রি অবাক নয়নে চেয়ে রইলো তার দিকে। কঠিন স্বরে বলল,
“না, আমি দেখতে পারবো না। যে মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই সেই মেয়েকে কেউ জড়িয়ে ধরবে আমার সহ্য হবে না। এক মিনিট, এই ছোকরার জড়িয়ে ধরায় তোমার সম্মতি ছিলো? ডন্ট সে তুমি এই ছোকরার সো কল্ড প্রেমে পড়েছো তুমি?”
“কিহ?”

পিউ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে আহাশ বেকুবের মতো চেয়ে রইলো। মারামারিতে আহত হলেও, রক্ত ঝড়লেও সেই ব্যাথাটা অনুভূত হচ্ছিলো না। কিন্তু নীলাদ্রির কথাটা শোনার পর থেকে ভেতরটায় তীব্র দহন শুরু হলো। কি বিশ্রী চিনচিনে যন্ত্রণা। পিউ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। মাথা তার কাজ করছে না। ধীর স্বরে বলল,
“নীলাদ্রি ভাই, মাথা ঠিক আছে আপনার? কি উলটা পালটা বলছেন?
“না ঠিক বলছি। নয়তো তুমি ডিফেন্ড করছো কেনো? তোমার ওকে থাপ্পড় মারা উচিত ছিলো। ইউ নো হোয়াট। আমার ভুল ছিলো। তুমি তোমার ছোট প্রেমিকের সাথে থাকো। কংগ্রেচুলেশন”

বলেই হাটা শুরু করলো। পিউ হতভম্বের মত চেয়ে রইলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। রাগে মাথার চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো। এই প্রথম মনে হলো কেনো সে নিজের বান্ধবীর মতো রাগী নয়। কেনো বান্ধবীর মতো উত্তাল হতে পারে না। চিৎকার করে বললো,
“জাহান্নামে যান আপনি। আই ডোন্ট কেয়ার”

নীলাদ্রি পাত্তা ছিলো না। শকুনতলাকে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। পিউ হাটু ভাজ করে বসে পড়লো ধুলোতে। দু হাত দিয়ে মুখ বুজে কান্নায় ফেটে পড়লো সে। তার তো খুশী হওয়া উচিত কারণ নীলাদ্রি তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু সেই মুহূর্তটাকে একেবারে তেতো বানিয়ে জনাব হাটা দিল। বুঝতেও চাইলো না পিউকে। আহাশ বসলো ঠিক তার পাশে। কাঁপা হাতে তার উশখো খুশকো চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“তুমি নীলাদ্রি ভাইকে ভালোবাসো তাই না পিউ আপু?”

কাতর চোখে তাকালো পিউ। তার চোখ টলমল করছে নিদারুন যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণা ছাপিয়ে এই বিক্ষিপ্ত হৃদয়ের পুরুষের বিষাদটুকুও অনুভব হলো। আহাশের চোখ ঝাপসা। মনে হচ্ছে কেউ চরম নিষ্ঠুরতার সাথে ভোতা ছুড়ি গলিয়ে দিয়েছে ঠিক অন্তস্থলে। তবুও অভিযোগ নেই। ভেতরটা চিৎকার করে বলতে চাইলো,
“ছাড় ওই গাধাকে। আমি তোমাকে মাথায় করে রাখবো”

কিন্তু বলা হলো না। ভালোবাসলে বোধ হয় স্বার্থপর হওয়া যায় না। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আহাশের চোখ থেকে। এজন্য কবি বলে প্রথমপ্রেম খুব কষ্ট দেয়।

***

হনহন করে বাড়িতে প্রবেশ করলো নীলাদ্রি। তার মুখখানা লাল হয়ে আছে। সালাম সাহেব এবং সাবেরা তখন চা খাচ্ছিলো আয়েশ করে। অনেকদিন তাদের জীবনে কোনো ঝামেলা নেই। ঠিক তখনই খাম্বার মতো দাঁড়ালো নীলাদ্রি। থমথমে স্বরে বললো,
“মা আমি বিয়ে করতে চাই। বিয়েটা এই সপ্তাহে হলেই ভালো হয়”

সালাম সাহেব ছেলের কথা শুনে গরম চায়ে জিহবা পুড়িয়ে ফেললেন। সাবেরার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেলো। সে কারেন্টের বিদ্যুৎ শক খাওয়া মানুষের মতো চেয়ে রইলো। নীলাদ্রি তাকে পরোয়া না করে বললো,
“মেয়ে ভালো, তোমরা চিন। তাই আমার মনে হয় না সমস্যা হবে। আমরা দুদিনের মধ্যে মেয়ে দেখতে যাব”
“কিন্তু বাপ মেয়েটা কে”
“জানিয়ে দিবো। এখন আমার মাথায় রাগ চেপে বসেছে। আমি কাউকে খু’ন করে ফেলতে পারি। বিশেষ করে বাবার ছাগল দুটোকে। সালাম সাহেব আপনার ছাগলজোড়া আমার বিয়ের জন্য ধার দিবেন? ছাগল কেনার ঝামেলা থাকবে না। বিয়ের পর নতুন ছাগল কিনে দিব”

সালাম সাহেব এতোটা হতবাক যে তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। নীলাদ্রি অপেক্ষা করলো না। সে শান্ত স্বরে বললো,
“আপনি ভাবুন। আমি গোসল করে আসছি। উত্তরটা যেনো হ্যা হয়”

বলেই হনহন করে নিজ ঘরে চলে গেলো নীলাদ্রি। সাবেরা এবং সালাম সাহেব এখনো হা করে বসে রইলো। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা তাদের জীবনে কোনো ঝামেলা নেই।

***

ব্যাংকে একটি টেবিলে বসে রয়েছে বিল্লাল এবং অভ্র। বিল্লাল কপাল কুচকে বসে আছে। তার চোখে মুখে তীব্র বিরক্তির ছাপ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি টেবিলের ওপাশের রমনীর দিকে। রমনী অবশ্য সেদিকে নজর দিচ্ছে না। তার পুরো ধ্যান কাগজের মধ্যে। কোথাও কোনো ভুল করা যাবে না। দুবছরের চাকরির প্রথম লোন ক্লাইন্ট। অভ্র খুব নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে। বিল্লাল মুখখানা কানের কাছে এনে শুধালো,
“লোন নিচ্ছিস খুব ভালো কথা, তাই বলে নিজের প্রাক্তনের কাছ থেকে কে লোন নেয়?”
“আমি”

বিল্লাল কঠিন নয়নে তাকালো। অভ্র নির্বিকার। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“পৃথিবীতে ব্যাংকের অভাব ছিলো নাকি লোন অফিসারের অভাব ছিলো?’

অভ্র উত্তর দেবার পূর্বেই তৃষা চোখ তুলে গম্ভীর স্বরে বললো,
“সাইন কর অভ্র।“

বলেই কাগজ এগিয়ে দিল। অভ্র সাইন করার জন্য কাগজগুলো নিলো। ক্ষণসময়ের জন্য বিল্লাল এবং তৃষার চোখাচোখি হলো। দুজনের চোখেই একে অপরের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেলো চোখ দ্বারা কাউকে ভস্ম করার উপায় থাকলে বুঝি এই দুজন দুজনকে ভস্ম করে দিল। অভ্র অবশ্য এদের পাত্তা দিল না। সাইন করে তৃষার হাতে কাগজগুলো দিতেই তৃষা হেসে বললো,
“আশা করছি পজেটিভ নিউজ দিতে পারবো। আসলে বিনা মর্টগেজে আপাতত আমাদের ব্যাংক লোন দেবার সাহস দেখায় কি না? উপরন্তু তুই আমার বন্ধু। তাই কাজটা তাড়াতাড়ি হবে। হাজারবার ইন্সপেকশনের ঝামেলাটা কম”

কথাটা বিল্লালকে শুনিয়ে বললো যেনো। অভ্র হাত বের করে হাসলো বিল্লালের দিকে চেয়ে। যার অর্থ, “শুনেছিস? এবার আর মাথা খাস না”। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে অভ্র বললো,
“পরশু আসছিস তো?”
“কোথায়?”
“আমাদের পাড়াতে পিকনিক হবে। এতোদিন ডাকাত পাহাড়া দিয়েছি তো। তাই পরশু একটা ছোট গেটটুগেদার। আয় ভালো লাগবে তোর”

তৃষা উত্তর দিতে পারলো না। তার কথাটা গিলে বিল্লাল বললো,
“ওকে বলছিস কেনো? ও এসে কি করবে? তোমার আসার প্রয়োজন নেই তৃষা। আমাদের পাড়ার পিকনিকে বহিরাগত নিষিদ্ধ”

অভ্র অবাক স্বরে বললো,
“তুই তো পাড়ার কেউ নস”
“তাতে কি আমি তোর বন্ধু”
“তৃষাও আমার বন্ধু হিসেবেই আসবে”

বিল্লাল দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“ পিকনিকের চাঁদা বেশি। ও যদি টাকা না দেয়?”

এতোক্ষণ তৃষা চুপ থাকলেও চিকন স্বরে বলে উঠলো,
“আমি চাঁদা দিতে পারব বিল্লাল। নো টেনশন”
“পিকনিক রাতে মানে দুটোর পর। তোমাকে বাসায় কে দিয়ে আসবে?”
“অভ্র দিয়ে আসবে। আর না হলে ওর বাসায় থাকবো। কোনো সমস্যা অভ্র?”

অভ্র প্রায় সাথে সাথেই বললো,
“না কোনো সমস্যা নেই। তুমি কিন্তু আসবে”

বিল্লাল কটমট করে অভ্রের দিকে চাইলো। ছেলেটাকে বোঝার শক্তি তার নেই। এদিকে তৃষার উপরেও রাগ হচ্ছে। মেয়েটি কোনোদিন শুধরাবে না। অজানা কারণেই এই মেয়েটিকে তার পছন্দ নয়। যখন অভ্রের সাথে সম্পর্ক ছিলো তখনও নয়, এখনো নয়। যেদিন তাদের বিচ্ছেদ হয়েছিলো দু রাকাত নফল নামাজ পড়েছিলো বিল্লাল। ব্যাংক থেকে বের হতেই সে প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুই কাজটা ঠিক করলি? ঐন্দ্রিলা কি ভাববে? ক্লাস টেনের প্রাক্তন হোক সে তোক প্রাক্তন”

অভ্র মলিন হেসে বললো,
“ঐন্দ্রিলা ভাববে? ভাবলে তো ভালো। চিন্তা করিস না। ওর কিচ্ছু যায় আসে না। আমাদের ও আগেও দেখেছে”

বলেই হাটা দিল। বিল্লাল আরোও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বলতে পারলো না।

***

রাতের গভীরতা অনেক। পাড়ায় জমজমাট আয়োজন। কয়েকদিন যাবৎ বেশ আতঙ্কতে কেটেছে তাদের। কোথা থেকে ডাকাতের একটা প্রাদুর্ভাব হয়ে ছিলো। পাড়ার সব জোয়ান ছেলেগুলো সারারাত পাহাড়া দিয়েছে। আজ তাদের শেষ দিন পাহাড়ার। তাই একটা পিকনিক মন্দ নয়। সবাই আনন্দ করলেও ঐন্দ্রিলার মনে মোটেই সুখ নেই। তৃষা নামক ন্যাকা চক্ষুশুল তার চোখের সামনে ঘুরছে। অবশ্য সে একাই যে দুঃখিত তা নয়। আরোও তিনজনও এই দুঃখী দলের সদস্য। পিউ, নীলাদ্রি এবং আহাশ। এই তিনজনের মুখ থেকে ছোট বাচ্চাও বলবে এরা পৃথিবী বিখ্যাত ছ্যাকা খেয়েছে………………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৮তম_পর্ব

সবাই আনন্দ করলেও ঐন্দ্রিলার মনে মোটেই সুখ নেই। তৃষা নামক ন্যাকা চক্ষুশুল তার চোখের সামনে ঘুরছে। অবশ্য সে একাই যে দুঃখিত তা নয়। আরোও তিনজনও এই দুঃখী দলের সদস্য। পিউ, নীলাদ্রি এবং আহাশ। এই তিনজনের মুখ থেকে ছোট বাচ্চাও বলবে এরা পৃথিবী বিখ্যাত ছ্যাকা খেয়েছে। আহাশের চোখ মুখ ফুলে গেছে। কাটা অংশ এখনো শুকায় নি। বাসায় তাকে দেখে ঐন্দ্রিলার শ্বাশুড়ি কাননের কি চিন্তা! জামা ছেড়া, নাক থেকে রক্ত গলগলিয়ে পড়ছে। ছেলের চোখ ফোলা। নির্জীব চলন। আহাশ অভ্রের মত নয়। শান্ত ছেলে, সে মারামারি করতে পারে না। অথচ এমন বিধ্বস্ত অবস্থা তার। শত প্রশ্নের পরও আহাশ উত্তর দিল না। আউওয়াল সাহেব নাতীর মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারলো না। অভ্র তক্ষণ বাসাতেই ছিলো। উদাসীন গলায় বলল,
“পুরুষমানুষের একটু কাটলে কিছু হয় না। এত আদিক্ষেতার কিছু নেই”

ঐন্দ্রিলা কঠিন চোখে চাইলো তার দিকে। কিন্তু অভ্র নির্লীপ্ত। পুরুষমানুষের রক্ত একটু ঝরলে কিছু হয় না। রক্ত না ঝরলে তার পুরুষত্ব প্রমাণ হবে কি করে?

এদিকে নীলাদ্রি ঘুষি খেলেও তামাটে মুখে সেই দাগ স্পষ্ট নয়। হ্যা, তবে রাতে গায়ে ব্যাথা উঠেছিলো। মনে হচ্ছিলো একশো ফোঁড়ার ব্যাথা। আজীবনে কোনোদিন মারপিট না করার কুফল বুঝি এটা। রাতে সাবেরা হলুদ মিশিয়ে দুধ বানিয়ে দিয়েছিলো। সেই দুধ খেয়ে পরদিন বেলা বারোটায় উঠেছে। সালাম সাহেব ডাইনিং টেবিলে পেপার হাতে কঠিন মুখে বসে ছিলেন। সরকার পতনের দিন তার মিলের গেট খুলে নিয়ে গেছে কেউ। এতো কিছু ছেড়ে লোহার গেট? এতো চুরির সর্বোচ্চ অবমাননা। চুরি করতে হবে সরকারের মতো থাকে থাকে লাখ কোটি টাকা হাপিস কেউ টিকি ধরতে পারবে না। অথচ তেমন কিছু না সালাম সাহেবের তেলের মিলের লোহার গেট নিয়ে পালিয়েছে। পুলিশে কমপ্লেইন করার সুযোগ হচ্ছে না। এখনো এখানের থানার অসি জয়েন করেন নি। এসব চিন্তা তো আছেই এরমধ্যে নীলাদ্রি বিয়ের সংবাদটা একেবারে বদহজম করিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে ঘনঘন তার বাথরুমে যেতে হচ্ছে। কিছুই যেনো সহ্য করতে পারছে না পেট। তার মুখখানা আরোও কঠিন হলো যখন দেখলো নীলাদ্রি ভোঁতা মুখে ঘর থেকে বেরিয়েছে। তার মুখ খানা দেখে মনে হলো সকাল সকাল সালাম সাহেবের ছাগল জোড়া মনে হয় তার মুখের উপর একনম্বর করে দিয়েছে। এটা একটা তৃপ্তির বিষয় হতে পারে। সালাম সাহেব গলা গম্ভীর করে শুধালেন,
“মেয়ের বাড়ি কবে যাচ্ছি?”
“তোমাদের বউ মা আমার ফোন ধরছে না। মনে হয় রেগে আছে। আমরা দু/তিনদিন পর যাব। আগে ওর রাগ ভাঙ্গাতে হবে”
“তুমি সত্যি করে বলো তো, তুমি কি প্রেম করছো?”
“ছিঃ ছিঃ কি বলেন এগুলো সালাম সাহেব? আপনার মতো বৃদ্ধের মুখে এমন অশোভনীয় শব্দ আসাও গর্হিত অপরাধ। দিনদিন বয়সের সাথে সাথে আপনার মাথায় ব্যামো হচ্ছে। সেটাকে ঠিক করা প্রয়োজন”

নীলাদ্রির এমন ভাষ্যে বেকুবের মত চেয়ে রইলেন সালাম সাহেব। দূর্বৃত্তরা তার মিলের লোহার গেটের পরিবর্তে নীলাদ্রিকে ডাকাতি করে নিয়ে গেলে বোধ হয় একটু শান্তি পেতেন।

********

সালাদের জন্য সবজি কাটা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে কোথা থেকে মানুষের আমদানি হয়েছে। যা আগে পয়ত্রিশ জন ছিলো সেটা এখন পঁচাশি জন্য। নতুন অনুপ্রবেশদের জন্য রাত দশটার দিকে বাজার থেকে আবার বাজার করে এনেছেন সালাম এবং ইদ্রিশ সাহেব। কমতি থাকা যাবে না। আইটেম পরিবর্তন হয়েছে। এখন পোলাও, মুরগীর লটপটি, রোস্ট এবং ডিমভুনার আয়োজন হচ্ছে। সালাদ কাটার দায়িত্ব পড়েছে ঐন্দ্রিলা এবং পিউয়ের উপর। দুশো শশা ছিলতে ছিলতে বেকায়দা অবস্থা ঐন্দ্রিলার। পিঠ ধরে আসছে। আবার ক্ষণে ক্ষণে চোখ যাচ্ছে তৃষা এবং অভ্রের দিকে। নির্লজ্জের মতো ছেলেটা হাসছে তার প্রাক্তনের সাথে। বেহায়া, চরিত্রহীন। বিড়বিড় করে বললো,
“ইচ্ছে করছে এই পিলার দিয়ে মুখটাই পিল করে দিতে”
“লাভ নেই। বেডামানুষ মানেই মাথার যন্ত্রণা”

পিউ মনমরা হয়ে উত্তর দিল। ঐন্দ্রিলা থেমে গেলো। পিউয়ের মন ভালো নেই। খুব বড় কিছু না হলে পিউ নামক নারীর মন খারাপ হয় না। সে ছোট ছোট বিষয়ে মন খারাপ করে না। গায়েই মাখায় না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘটনা সুবিশাল। কিন্তু ঐন্দ্রিলা জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলো না। পিউয়ের বিষন্ন চোখজোড়া তাকে খুব ভাবাচ্ছিলো। এখন সুযোগ পেয়েছে। তাই ফট করেই শুধালো,
“কেনো তোর পুরুষ আবার কি করেছে?”

পিউয়ের হাত থামলো। হাতের ছুরিটা থেমে গেলো। কাঠের তক্তায় কাটার জন্য রাখা টমেটোটা গড়িয়ে গেলো। পিউয়ের মনের ভেতর হাজার কথা থাকলেও মেয়েটা তার প্রকাশ্যে আনে না। এটা তার বিশেষত্ব। যে সবার দুঃখ ছুয়ে দিবে কিন্তু তার দুঃখ কেউ দেখবে না, ছুবে না। কিন্তু ঐন্দ্রিলা আজ ছাড় দিবে না। বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করতে নেই, কিন্তু বিনিময় তো করাই যায়। সে পিলার রেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো পিউকে। সেই উষ্ণ আলিঙ্গনে কিছু ছিলো যেন। নিজস্ব সেই বানোয়াট দেওয়াল নরম হলো। অতঃপর গলতে লাগলো। মনের ভেতরে খুব আগলে রাখা টুকরো কথাগুলো অশ্রুর রুপে গলে পড়তে লাগলো। একটা সময় কান্নার বেগ বাড়লো। মুখ লুকিয়ে ফেললো পিউ। ঐন্দ্রিলা বিনাবাক্যে বান্ধবীর অশ্রু মুছলো। প্রশ্ন করলো না। তার অশ্রু যে সামলেছে সে এখন কাঁদছে। এখন নরম হওয়া বারণ। নিষিদ্ধ।

*******

পিউয়ের চোখ মুখ ফুলে গেছে। ঠান্ডা মোজো খুলে দিল ঐন্দ্রিলা। সে এক ঢোকে আড়াই মিলির বোতল ফাঁকা করে দিল। তারপর তীক্ষ্ণ চাকু বেরহমের মতো টমেটোর উপর চালাতে চালাতে বললো,
“পুরুষ মানেই ব্যাঙ্গের ছাতা। ঘটে দুআনার বুদ্ধি নেই শুধু দাদাগিরি”
“সেটার চাক্ষুস প্রমান আমার স্বামী”

বলেই শসার উপর ক্ষিপ্র চাকু চালালো ঐন্দ্রিলা। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অভ্রের দিকে। সেই কখন থেকে সে তৃষার সাথেই চিপকে আছে। এতো অসহনীয় কেনো এই পুরুষ? এদিকে তৃষ্ণা শুকনো ঢোক গিলে অভ্রকে বললো,
“তোর বউ আমাদের দেখছে”

কথাটা শুনে বিভ্রান্ত হলো না অভ্র। বরং যেনো তাকে অধিকতর পুলকিত দেখালো। সেই পুলক ঠিকরে উঠলো গাড় নয়নে। নির্ভার স্বরে উত্তর দিল,
“জানি”
“জানিস যখন জেনেবুঝে আমাকে আগুনে ফেলছিস কেনো শুনি?”
“আগুনে ফেলছি না বল ঘুমন্ত সিংহীর মুখে ফেলছি। শিকারের গন্ধে যদি সে একটু জেগে উঠে!”

তৃষা কটমটিয়ে তাকালো। অভ্রের মুখে নির্লজ্জ হাসি। তৃষা দাঁত পিষে বললো,
“তোর মত হারামী পৃথিবীতে একটাই আছে”
“কিন্তু সেটা বুকড হয়ে গেছে তাও আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটামাত্র বউয়ের জন্য। তোর কপালে আমি নেই”
“আল্লাহর অশেষ রহমত”

তার কথা শুনে মেকি হাসির রোল উঠলো অভ্রের মুখে। তার হাসি দেখে তৃষা গায়ের জোরে চিমটি কাটলো অভ্রের হাতে। এই চিমটি অভ্রের কাছে পিপড়ের কাঁমড়। অথচ এমন একটা ভাব নিলো যেনো তার হাত খসে গেছে। “আহ” বলে শব্দ করলো। হাত এগিয়ে বললো,
“ফু দে”
“হ্যা?”
“যা বলছি কর”
“অভ্র, ভালো হবে না”
“এমনেও জীবনে খুব ভালো কিছু হচ্ছে না। খরা চলে। তোর ফু তে যদি বৃষ্টি হয়”

তৃষা দেখিয়ে দেখিয়ে ফু দিল। যাকে দেখানোর জন্য নাটক সে ঠিক দেখলো। কাজও দিলও। রাগের চোটে হাতের উপর ছুরি চালিয়ে দিল। ফলে আঙ্গুল কেটে গেলো মনের অশান্তিতে। সে নিয়ে ছোটখাটো হট্টগোল হলো। কানন ছুটে এলো। সাবেরা ব্যাস্ত হলো। যতই হোক মেয়ে তো তার আমড়া কাঠের ঢেকি। কানন রাগী স্বরে বললো,
“তোমার শসা কাটতে হবে না। আমি কেটে দিব। তুমি চলো ঘরে”

বলে বৌমাকে নিয়ে গেলো বাসায়। ঔষধ লাগাতে হবে। বেশ গাঢ় না হলেও কেটেছে ভালোভাবেই। অভ্র নির্বিকার চোখে দেখলো সবটা। তৃষা অবাক স্বরে শুধালো,
“তুই এভাবে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঘষে দেখবি?”
“হ্যা”
“মানে কি?”
“তুই বুঝবি না। অভাব না তৈরি হলে প্রয়োজন বুঝে না মানুষ। তাই অভাব টের পাওয়ানোটাই বেশি জরুরি”

তৃষা হাসলো। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“আমার কথা তাহলে সত্যি হলো। আমি বলতাম না তুই ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসিস। তখন তো হেসে উড়িয়ে দিতি”

অভ্র মুখে বিরক্তি টেনে বলল,
“তোদের মেয়েদের কাছে ভালোবাসা, প্রেম বাদে আর কোনো কিছু নেই নাকি? কান পঁচিয়ে দিলি তো”
“তাহলে তুই ই ব্যাখ্যা দে না, ঐন্দ্রিলার প্রতি তোর অনুভূতিটার মর্মার্থ কি? এত আকর্ষণ, অবসেশন কেনো?”

অভ্র উত্তর দিল না। সে এড়িয়ে গেলো। অভ্রের এমন আচারণের সাথে খুব পরিচিত তৃষা। তাদের মধ্যে খুব দহরম মহরম সম্পর্ক নেই। তবে একটা সময় কিছু ছিলো। তৃষা মত্ত ছিলো এই ঠোঁট কাটা, অসভ্য, অভদ্র ছেলেটার জন্য। হয়তো সুদর্শন ছিলো বিধায়, হয়তো জনপ্রিয় ছিলো বিধায় অথবা তার ব্যাক্তিত্ব আকর্ষণ করতো। অপক্ক বয়সের এই মোহের কারণ নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় নি। কারণ এই মোহ দীর্ঘস্থায়ী ছিলো না। তার স্থায়ীত্বকাল ছিলো ছয়মাসেরও কম। খুব দ্রুতই বুঝে গিয়েছিলো এই অভদ্র ছেলেটি একটি রাগী মেয়ের লালচে রাগে নিজেকে অর্পন করেছে। তার অশ্রুতে নিজেকে গুম করেছে। নারী সব সহ্য করলেও একটা বিষয় সহ্য করতে পারে না। নিজের পছন্দের পুরুষের চোখে অন্যের প্রতিবিম্ব তাকে পুড়ায়, কাঁদায়। নিঃস্ব করে। তৃষা নিঃস্ব হতে চায় নি। তাই নিজেকে সরিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের মনে হলো। অঘোষিত ব্রেকাপ হলো তৃষা এবং অভ্রের প্রেমের। প্রেম তো ছিলো না। ছিলো একটা কুহেলিকা। এর মাঝেই তীব্র চিৎকার কানে আসে। চিৎকারটি অভ্রদের বাড়ি থেকে। এবং গলাটা পরিচিত। ঐন্দ্রিলা চিৎকার করছে। সবাই তা শুনতেই ছুটে গেলো। চিৎকার অনুসরণ করে অভ্রের ঘরে ঢুকতেই একটা হ্যাংলা, কালো, বাটি সাট চুলের চোরকে দেখা গেলো। সে ঐন্দ্রিলার গলায় ছু’রি ধরেছে। বলছে,
“এগুলেই চালিয়ে দেব”

অভ্রের মুখে কাঠিন্য ফুটে উঠলো। ঐন্দ্রিলার চোখে মুখে ভীতি। চোখ টলমল করছে। তাদের চোখাচোখি হলো ক্ষণ সময়ের জন্য। সেই দৃষ্টিতে সাহস ছিলো নাকি সান্ত্বনা বোঝা গেলো না। এমন দৃশ্য সবার মনেই একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করলো। নীলাদ্রি বলল,
“আপনি তো নিজেই কাঁপছেন। ছুরি নামান, আসুন আমরা কথা বলি”
“আপনাদের সাথে কোনো কথা নাই। আগাইলেই খতম”

চোরের গা কাঁপছে। বিল্লাল কিছু একটা বললো অভ্রকে। অভ্র মাথা নাড়ালো। অন্য সময় হলে সে এক থাবা দিয়ে তাকে কাত করে ফেলতে পারতো। কিন্তু এখন সম্ভব নয়। কারণ সে ছুরিটা ঐন্দ্রিলার গলায় ধরে রেখেছে। এগুলে হিতে বিপরীত হবে। চোরটিকে ধরার পূর্বে ঐন্দ্রিলার নিরাপত্তার প্রাধান্য বেশি। নীলাদ্রি চোরকে শান্ত করতে চাইলেন,
“দেখেন ভাই, আপনি পালাতে পারবেন না। তাই বোকামি করবেন না। আমরা এখানে পিকনিক করছি। আপনি একটা রোস্ট বেশি খাইয়েন। কিন্তু ছুরি নামান”

চোর ভয়ে ঘামছে। তবুও সে ছুরি নামাচ্ছে না। তার ঠিক পেছনেই অভ্রের ঘরের বারান্দা। বারান্দার থাইটুকু খোলা। চোরটি পিঠ করে থাকায় তার পেছনে কেউ আসলে সে টের পাবে না। সেই সুযোগটাই নিলো বিল্লাল। পাইপের মাধ্যম্যে বারান্দায় চড়লো। তারপর ঠিক পেছন থেকে খপ করে ধরলো চোরকে। প্রথমে হাতে সজোরে আঘাত দিয়ে তার ছুরি ফেলে দিল। ফলে মুক্তি পেয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অভ্রকে। অভ্রের প্রশস্থ বুকের সাথে মিশে গেলো কম্পিত পেলব দেহ। অভ্র মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ধীর গলায় বললো,
“কিচ্ছু হয় নি, কিচ্ছু হয় নি”

কিন্তু ঐন্দ্রিলার ভয় কাটলো না। সে রীতিমত ফুপাচ্ছে। অভ্র গম্ভীর স্বরে বললো,
“তোমরা সবাই চলে যাও। আমি আছি ঐন্দ্রির সাথে”

ঐন্দ্রিলা এখনো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে অভ্রকে। চোরটি তাদের ঘরেই ঘাপটি মেরেছিলো। নিজের ঘরে এসে আলো জ্বালাতেই সে বেরিয়ে এলো। আলমারীর তালা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলো সে। ঠিক সেই সময় ঐন্দ্রিলার আগমন ঘটে। নিজেকে বাঁচাতে পুটলি থেকে ছুঁরি বের করে। কিন্তু ততসময়ে চিৎকার করে সকলকে জানান দেয় ঐন্দ্রিলা। সবাই ছুটে আসলেই চোর ঐন্দ্রিলার গলায় ছুরি ধরে। যদিও তার মাঝে হিংস্রতা ছিলো না। কিন্তু ঘটনাটি ভীত করেছে ঐন্দ্রিলাকে। অভ্র ঐন্দ্রিলাকে বসালো। পানি খাওয়ালো। তার গাল ভেজা। ভয়ে মেয়েটা কেঁদেছে। অভ্র চলে যেতে নিলেই সে হাত ধরে বসে। কাঁপা স্বরে শুধায়,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“দরজা আটকে আসি?”
“না দরকার নেই। এখানেই থাক”

অভ্র মেনে নিলো। পাশে বসলো তার। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“ভয় লাগছে নাকি?”

ঐন্দ্রিলা উত্তর দিল না। তার ভয় লাগছে। কিন্তু অভ্রের উপস্থিতিতে সেই ভয়টা খুব গাঢ় মনে হচ্ছে না। আরোও একটি কারণে সে অভ্রকে বাহিরে যেতে দিতে চায় না। সেটা অবশ্য মুখে বলা যাবে না। সেটা থাকুক মনের মাঝে।

*********

চোর বেশ মার খেয়েছে। অভ্র মারে নি। কারণ সে মারলে মরে যাবার সম্ভাবনা ছিলো। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। নীলাদ্রি তার পাশে বসা। সে একটি কাগজে লিখছে। তারপর শুধালো,
“তাহলে বলুন, প্রথম কোথায় চুরি করেছিলেন?”
“তহন আমার বয়স সাত বছর। পেডে খানা নাই। কেউ মুখে ভাত তোলার নাই। লোকাল বাসে আসিলাম, টিকিডের পয়সা আছিলো না। তখন ওস্তাদের লগে পরিচয়। নিখুঁত হাতের কাম। কন্ডাকডরের পকেট থেইক্যা মানিব্যাগ হাপিস। হইলাম শেষ্য। ওহান দিয়া হাতেখড়ি। পত্থম চুরি তার থেকে সাত মাসের মধ্যে। ব্লেড দিয়ে হালকা চাশা দিয়া পকেট কাটতে হবে যেনো চামড়ায় আছড় না লাগে। ভিড়ের মধ্যি করতে হয়। সময় এক মিনিটেরও কম। ট্রেনিং নিছি সাতমাস ধইর‍্যা। প্রথম মার্কেটে নামছি শায়েদাবাদে। প্রথম হাতে দশটা মানি ব্যাগ। মোট মিল্লা পঁচিশ হাজার টেকা”
“বাম্পার ফলন। তো ঢাকা থেকে এখানে কেনো?”
“ভাগ্যের দোষ ভাইজান। আসলে কি হইছে বলেন তো……”

চোর তার কাহিনী শুরু করলো, নিলাদ্রি লিখছে। মাঝে মাঝে চোরকে মোজো খাওয়াচ্ছে। চোরের সাথে এরপূর্বে তার দেখা হয় নি। তাই সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ হয় নি। এই সুযোগ এখন হাত ছাড়া করতে চাইছে না। এর মাঝেই পিউ এসে দাঁড়ালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“নীলাদ্রি ভাই, রান্না শেষ। আন্টি খেতে ডাকে”

বলে পিউ যেতে ধরলেই খপ করে তার হাত ধরলো নীলাদ্রি। পিউ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“হাত ছাড়ুন নীলাদ্রি ভাই”

পিউয়ের কথার উত্তরস্বরুপ নীলাদ্রি বললো,
“আমি খাজুরে আলাপের জন্য হাত ধরি নি, অতিগুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিতে হাত ধরেছি। আগামীপরশু বিকালে বাসায় থাকবা। সুন্দর একটা শাড়ি পড়বা। পারলে নীল রঙ্গের শাড়ি পড়বা। হালকা সাজবা, শুধু কাজল আর লিপজেল হলেই ভালো। টিপ দিবা না। আমার অপছন্দ”
“আপনার পছন্দমত কেনো সাজবো?”
“কারণ আমি তোমাকে দেখতে আসবো”…………………

চলবে