মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-২৯+৩০

0
36

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#২৯তম_পর্ব

“আপনার পছন্দমত কেনো সাজবো?”
“কারণ আমি তোমাকে দেখতে আসবো”

নীলাদ্রির কথাটি শোনার পর পিউয়ের মাঝে খুব একটা ভাবান্তর হলো কি না বোঝা গেলো না। তার নির্লিপ্ত চাহনী আগের মতোই হইলো। নীলাদ্রি ভেবেছিলো এমন কিছু বললে হয়তো মেয়েটি লজ্জা পাবে। যদিও পিউ খুব একটা লজ্জাবতী লতা নয়। তবুও উপন্যাসের পাতা ঘাটলে অহরহ প্রমাণ পাওয়া যায় নারী এমন ধরণের বাক্যে লজ্জায় গলে যায়। তাদের চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে। কেউ স্তব্ধ চোখে অশ্রু ছেড়ে দেয়। অথবা ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারে কারণ তার কথাটি পছন্দ হয় নি। পিউয়ের মাঝে তিনটি লক্ষণের একটিও লক্ষ করা গেলো না। ফলে এই প্রথম ভয় দেখা গেলো নীলাদ্রির অক্ষিকোটরে। পিউ স্বাভাবিক। খুব ঠান্ডা স্বরে শুধালো,
“আমি কি চিড়িয়াখানার জন্তু যে আপনি ঘটা করে দেখতে আসবেন?”

নীলাদ্রি কিছু সময় বেকুবের মতো চেয়ে রইলো। হতবাক স্বরে বললো,
“এ দেখা সে দেখা নয়”

পিউ এবার একটু এগিয়ে এলো। তাদের মধ্যকার দূরত্ব গুছিয়ে শুধালো,
“এ দেখা কোন দেখা নীলাদ্রি ভাই?”
“তুমি কি সত্যি এতোটা অবুঝ পিউ? নাকি ভান করছো?”
“হতে পারি দুটোই”

নীলাদ্রি শুকনো ঢোক গিললো। তার কপাল ঘেমে গেছে। বুক ধরফর করছে। লক্ষণ গুলো রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার। ঘাড় টনটন করে ব্যাথা করছে। নীলাদ্রির এমন অনুভূতি হয়েছে ইন্টার পরীক্ষার বায়োলজির দিন। হুট করেই মনে হচ্ছিলো সে কিছুই পারে না। প্রশ্নগুলো কাগজ থেকে উঠে নৃত্য করছে। এই প্রশ্ন পৃথিবীর প্রশ্ন নয়, মহাজাগতিক কিছু। এই অনুভূতিটা আবারও হচ্ছে। তবুও কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমায় বিয়ে করবে পিউ? আমি জানি… আমি জানি তোমার জন্য আমি একেবারে অযোগ্য মানুষ। আমার মতো পাগল ছাগলকে বিয়ে করা আর গাছের সাথে জীবন কাটানো একই। প্রেমিক, প্রণয়ন শব্দগুলো আমার জন্য বৃথা। তবুও আমি আমি তোমাকে চাই। আমার স্ত্রী রুপে, আমার বন্ধু রুপে, আমার জীবনসঙ্গীনি রুপে। তোমাকে নিয়ে ভাবলেই মনে হয়, আমি যেন এক অলীক জগতে হাঁটছি, যেখানে তোমার প্রতিটি কথা, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি স্পর্শ আমাকে নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমার পৃথিবী তোমার চারপাশে আবর্তিত হয়, আর তুমি ছাড়া সেই পৃথিবী যেন নিঃসঙ্গ, বিবর্ণ। তোমার অনুপস্থিতিতে আমি যেন এক শূন্যতায় ভেসে থাকি, আর তোমার উপস্থিতি আমার সমস্ত অস্তিত্বকে পরিপূর্ণ করে দেয়। তুমি আমার ভেতরের প্রতিটি না বলা কথার উত্তর, প্রতিটি নির্জন মুহূর্তের সঙ্গী। আমি সইতে পারি না তোমার হাসিটুকু অন্যকারোর জন্য হোক। আমি তোমার প্রেমে পড়ি নি পিউ। আমি তোমাকে হয়তো পুজি”

নীলাদ্রির কন্ঠ কাঁপছে। তার চোখ ছলছল করছে। অন্যপ্রান্তের মানুষটি ঠোঁট কামড়ে ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ধরা স্বরে শুধু কোনমতে বললো,
“খেতে আসুন”

নীলাদ্রির শক্ত বাঁধন ততসময়ে ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো। ফলে হাত ফসকে গেলো কোমল হাতখানি। পিউ একপ্রকার ছুটে পালালো। নীলাদ্রি তাকিয়ে রইলো সেই যাবার পথে। আলো আঁধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে মেয়েটিকে মনে হলো সে যেনো কোনো মহাকাব্যের শেষ পঙক্তি। চোর মহাশয় এতোসময়ে মুখ খুললো যেনো,
“ভাইজান, আপনের পছন্দ ভালা। তয় আপনে এক্কান বলদ। আমি জীবনে কাউরে এমনে বিয়ের প্রস্তাব দিতে দেহি নাই”

নীলাদ্রি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই প্রথম আফসোস হলো সে কেনো প্রেমিকপুরুষদের মতো নয়।

***

অভ্রের জানালাটা খোলা। হালকা বৃষ্টি মিশ্রিত ভেজা বাতাস প্রবেশ করছে খোলা জানালা দিয়ে। অভ্র দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার জানালা দিয়ে ঐন্দ্রিলার আলোহীন ঘরটি ব্যাতীত শুধু আকাশ দেখা যায়। কৃষ্ণ আকাশ। চাঁদ নেই আজ। তাই আকাশটিকেও আজ বড্ড পানসে লাগছে। অভ্র ভসভস করে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ছে। সিগারেটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না ঐন্দ্রিলার। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। কারণ তাকে সেই আটকে রেখেছে। বারান্দার দরজাটা নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। যদি আবার চোর আসে। চোরের আতঙ্কটা একটু বেশি জেকে বসেছে হৃদয়ে। অন্যদিকে সেই সুযোগটা নিয়ে অভ্র রুমের ভেতর স্মোকিং করছে। ভসভস করে সিগারেটটা শেষ করে না নিভিয়েই ফিল্টারটুকু ফেলে দিলো। ঐন্দ্রিলা সাথে সাথেই বললো,
“নিভাস নি তো, আগুন ধরে গেলে?”
“ড্রেনে পড়েছে। আগুন ধরবে না”
“তুই তো সবজান্তা শমশের!”

অভ্র পারফিউম দিয়ে সিগারেটের ঝাঝালো গন্ধকে অপসারণ করার চেষ্টা করলো। এর মাঝে কানন এলো খাবার নিয়ে। ট্রে রাখতে রাখতে হুকুমের স্বরে বললো,
“ঐন্দ্রিলাকে খাইয়ে দে”
“ওর হাতে কি ন্যাবা হয়েছে নাকি?”
” ঠাটিয়ে চড় লাগাবো। ওর হাত কেটে গেছে দেখিস নি? উপরে কি ভয় না পেয়েছে। আমার তাই আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। চোরটা গবেট বলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি সত্যি সত্যি গলায় ছুরি বসিয়ে দিতো?”

অভ্র চুপ করে রইলো। কানন ঐন্দ্রিলাকে তিনবার আয়াতুল কুরসি পড়ে ফু দিলেন। ঐন্দ্রিলাকে সাহস দিয়ে বললেন,
“ভয় পাবে না কেমন। ভয় লাগলে ডেকো দরকার হলে আমি রাতে তোমার সাথে ঘুমাবো ঠিক আছে?”

ঐন্দ্রিলা মাথা নাড়ালো। অভ্র বিরক্তি টেনে বললো,
“কোনো দরকার নেই। ও এখন ভয় পাচ্ছে না। আর পেলে আমি দেখে নিব। তুমি নিজে যাও। আনন্দ কর”

কাননের ঠোঁট উলটে বললো,
“চোর বেয়াদবটার জন্য তোদের পিকনিকটা নষ্ট হয়ে গেলো। ইশ! কি যে খারাপ লাগছে”
“আপনি মন খারাপ করবেন না মামনি। অভ্র তো আছে এখানে। আপনি মজা করুন। আমার জন্য আপনাদের আনন্দ মাটি হলে আমি কষ্ট পাবো”
“শুনেছো তো এবার নিচে যাও মা”

একরকম জোর করেই অভ্র তাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। দরজার ছিটকিনি আটকে বসলো ঐন্দ্রিলার পাশে। হাত পেছনে হেলান দিয়ে শুধালো,
“খাইয়ে দিতে হবে?”
“আমি কারোর দয়া চাই নি৷ এতো অসুবিধা হলে বাধ দে। আমি খেয়ে নিবো”

অভ্র সরু চোখে তাকালো। তারপর হাত ধুয়ে প্লেট হাতে নিলো। পোলাও এর সাথে মুরগীর লটপটি এবং ডিম নিলো। মুরগীর রোষ্টটা দেখতে মাত্রাতিরিক্ত লাল লাগছে। ঐন্দ্রিলা ঝাল খেতে পারে না বেশি তাই শুধু মাংসটুকু নিলো। সে ডিমের কুসুম পছন্দ করে। তাই তাই নিজের ডিমের কুসুমটুকুও প্লেটে নিলো। ব্যাপারটা লক্ষ করলো ঐন্দ্রিলা। প্রশ্ন করলো,
“তুই খাবি না?”
“জিম শুরু করবো ভেবেছি। তাই কুসুম খাওয়া ছেড়ে দিবো”
“জিম করা লাগবে কেনো? এমনেই তো বেলুনের মতো ফোলা হাত পা। গলায় পড়লে দম বের হবার যোগাড়”
“এটাকে ফিট হওয়া বলে, নাও হা কর”

বলেই লোকমা তুলে দিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলার বা হাত কেটেছে। তাও সে ফিট বাবুর মতো বসে বসে অভ্রর হাতে খেতে লাগলো। কেনো যেনো মন্দ লাগছে না। বরং এক অবর্ণনীয় তৃপ্তি যেনো। ঐন্দ্রিলা পা গুটিয়ে অভ্রের দিকে ফিরে বসলো। গাল ভর্তি খাবার নিয়ে চাবাতে চাবাতে বললো,
“তো কাকে পটানোর জন্য এই জিম করা শুনি?”
“মাহাবুল হক কাউকে পটানোর জন্য রুপচর্চা করে না। প্রয়োজন ই নেই৷ ফুল সুন্দর হয় নিজের জন্য। ভ্রমরের কাজ তার সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হওয়া। তবে যদি রানী মৌমাছির কথা হয় তবে কাহিনী আলাদা”
“এই রানী মৌমাছিটি কি তৃষা?”

ঐন্দ্রিলার কঠিন প্রশ্নে থেমে গেলো অভ্রের হাত। ঠোঁটের কোনায় ফিঁচেল হাসি। ঐন্দ্রিলার ঠোঁটের কোন বা হাত দিয়ে মুছে দিতে দিতে মৃদু হেসে বললো,
“আমাকে নিয়ে বড্ড বেশি কৌতুহলী হয়ে যাচ্ছিস দেখছি! তোর জেরা শুনে একটা বউ বউ ফিলিংস হচ্ছে। সাবধান ঐন্দ্রিলা, আমি কিন্তু আমার টেনে ধরে তোকে আমার পুতুলের সংসারের খেলায় মত্ত হব”

ঐন্দ্রিলার অক্ষিকোটর বড় হল। অভ্রের হাসির মাত্রা বাড়লো। এরপর নীরবতা বিস্তৃত হলো ঘরে। অভ্র ঐন্দ্রিলাকে খাইয়ে দিলো। পুরোটা সময় কোনো কথা বললো না ঐন্দ্রিলা। তাকে খাইয়ে অভ্র খেয়ে নিলো।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে খাটের এক পাশে হেলান দয়ে শুয়ে পড়লো সে। বিল্লাল ফোন করছে। অভ্র ফোন ধরে গম্ভীর স্বরে বললো,
“তৃষাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয়”
“আমি কেন? আপদ তো তুই এনেছিস”
“এখন কয়টা বাজে দেখেছিস?”

বিল্লাল আর উত্তর দিলো না। ফোন খট করে কেটে দিলো। ছেলেটা মোটেই পছন্দ করে না তৃষাকে। কেনো করে না সেটাও প্রকাশ করে না। ব্যাপারটায় বিনোদন পায় অভ্র। এজন্য আরোও তৃষার দিকে বিল্লালকে ধাক্কা দিয়ে ইচ্ছে হয়। কথাটা ভাবতেই অভ্র হাসলো। ঐন্দ্রিলা হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসলো। পানির কনা লেপ্টে আছে তার কোমল মুখে। অভ্র তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই কোমল মুখশ্রীতে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত গভীরতা, যেন সেখানে মিশে আছে সমুদ্রের অতলান্ত রহস্য আর আকাশের অবিনশ্বর স্বপ্ন। যার দিকে তাকিয়ে হৃদয় ভরে যায় প্রশান্তির মৃদু বাতাসে। মেয়েটি কি এটা জানে! ঐন্দ্রিলা তখনো অন্যমনস্ক। তার নুয়ে থাকা নেত্রপল্লবে লেপ্টে আছে অগণিত গল্পসমারহ। মেয়েটিকে নিয়ে লিখতে বসলে অভ্রের পাতার সংকট হবে। এমন অমার্জিত কাজ অভ্র করে না। সৌন্দর্য তো হবেই। নারী মানেই সুন্দর। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য সৃষ্টিকর্তা তাদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। আর রুক্ষতা দিয়েছেন পুরুষকে। এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। অভ্র তো প্রকৃতির বহির্ভূত নয়। তাই এই সৌন্দর্যের মাঝে সে আকর্ষিত হয় না। আকর্ষিত হয় সেই নোনাজলের। বসন্তের বর্ষণের মত ঐন্দ্রিলার অশ্রু তাকে মুগ্ধ করে। সেই অশ্রু এক চিরন্তন স্রোতের মতো, যা বয়ে নিয়ে চলে এক অমোঘ যাত্রা। ঐন্দ্রিলা লক্ষ করলো অভ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বললো না। শুধু ধীর স্বরে বললো,
“তৃষাকে কে বাসায় দিয়ে আসবে?”
“বিল্লাল পৌছে দিবে”
“তুই যাচ্ছিস না?”
“প্রয়োজন নেই”

কথাটায় একটু হলেও যেনো স্বস্তি পেলো ঐন্দ্রিলা। মস্তিষ্ক জুড়ে এক অদ্ভুত চিন্তা বাসা বেঁধেছে। কিন্তু চিন্তাগুলো বিক্ষিপ্ত যেনো। এই বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো তাকে শান্তি দিচ্ছে না। আত্মসম্মানের দেওয়াল ভেঙ্গে বলতে ইচ্ছে করছে,
“তোর সাথে তৃষার কি সম্পর্ক”

কিন্তু প্রশ্নটা করাই হচ্ছে না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। হঠাৎ উষ্ণ হাতের স্পর্শ লাগলো হাতে। পাশে ফিরতেই দেখলো অভ্র তার হাত ধরে আছে। ধীর স্বরে বললো,
“ভয় লাগলে আমার হাত ধরে থাক। ভয় লাগবে না। একবার ঘুম চলে এলে দেখবি সব ওকে”

কথাটায় কিছু একটা ছিলো। বিশ্বাস, ভরসা? জানা নেই। তবে ভয় লাগছে না ঐন্দ্রিলার। চোখ বুজতেই ঘুম নেমে এলো চোখের পাতায়। যেনো কত বছরের ক্লান্তি।

****

“আমি তোর থেকে মুক্তি চাই ঐন্দ্রিলা”

বলেই একটা কাগজ এগিয়ে দিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা খাদি কাগজটির দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক স্বরে বললো,
“কিন্তু বিয়েটা তোর জেদে হয়েছে”
“আমি ভেবেছিলাম, তোর সাথে এডজাস্ট করে নিবো। কিন্তু মিথ্যে সম্পর্ক টানা যায় না”
“আমি তোর ঘরের পারফেক্ট বউ হবার জন্য দিন রাত এক করে দিচ্ছি আর তুই এমন কথা বলার সাহস কোথা থেকে পাস?”
“কিন্তু আমার বউ তো হতে পারছিস না। আমার দমবন্ধ লাগছে”

অভ্রের কন্ঠ অনড়। কোনো ভাবান্তর নেই। কঠিন মুখখানায় কোনো অভিব্যাক্তি নেই। ঐন্দ্রিলার মনে হলো শিরদাঁড়া বেয়ে কোনো ব্যাথার স্রোত বয়ে গেলো। হৃদয়ের অভ্যন্তরে বেদনার জলোচ্ছ্বাস ক্রমে তীব্র হয়, আর অভ্যন্তরীণ স্তব্ধতা নিঃশব্দে গোপন কষ্টের কথা বলছে যেন। সব কিছু ঝাপসা লাগছে। সব কিছু লেপ্টে আছে পানসে আভায়, যেনো কোনো নীরব প্রার্থনা মূর্তি। সাথে সাথেই ধরফরিয়ে উঠলো ঐন্দ্রিলা। সারা দেহে ঘাম দিয়েছে। সে এতটা সময় স্বপ্ন দেখেছে। বিশ্রী স্বপ্ন। ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠলো অভ্রের প্রতিবিম্ব,
“কি হয়েছে? বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?”

ঐন্দ্রিলা কোনো কথা বললো না। হাতজোড়া এগিয়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলো সে অভ্রকে……

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩০তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা কোনো কথা বললো না। হাতজোড়া এগিয়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলো সে অভ্রকে। গলাটা এতটাই জোরে ধরেছে নিঃশ্বাস আটকে যাবার যোগাড়, কিন্তু ঐন্দ্রিলার সমস্ত শরীর কাঁপছে। ঘামে চুলের গোড়া থেকে নোনা জলের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীর ভেজা। ঘাড়ের উপর বিন্দু বিন্দু ঘামকনার দিকে নজর যেতেই চোখ সরিয়ে নিলো অভ্র। সকাল সকাল কোনো অভদ্র চিন্তা করতে চায় না। একেই দিনের পর দিন বউয়ের পাশে মরা ভেটকি মাছের মত শুয়ে থাকা খুব দূর্বিষহ। যতই হোক সে পুরুষমানুষ। না চাইতেও কিছু চিন্তা মস্তিষ্কে চেপেই বসে। উপর থেকে পাশে শায়িত মানুষটি ঐন্দ্রিলা। এরমধ্যে সেই মানুষটি বিনা নোটিশে এভাবে জড়িয়ে ধরলে মেকি মুখোশ ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অভ্র তো এত ভালো মানুষ নয়। নিজের একটি সহ্য ক্ষমতাও আছে। ফলে অতিকষ্টে বলে উঠলো,
“ঐন্দ্রিলা আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ছাড়”

অভ্রের কথাটা কানে আসতেই সম্বিৎ ফিরলো তার। চোখ খুলে আশপাশ দেখলো। নিজেকে দেখলো। সে অভ্রকে জড়িয়ে আছে। ফলে তড়িৎ গতিতে তাকে ছেড়ে পেছনে সরে বসলো ঐন্দ্রিলা। তার চোখ মুখ বিভ্রান্ত। অভ্র অবাক স্বর শুধালো,
“সকাল সকাল আমার গলা চেপে ধরার কি মানে?”

ঐন্দ্রিলার মস্তিষ্ক থেকে এখনো স্বপ্নের আবছা স্মৃতিগুলো মলিন হয় নি। বারংবার কানে বাজছে “তুই আমার বউ তো হতে পারছিস না। আমার দমবন্ধ লাগছে”। অভ্র এখনো চেয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। ফলে আমতা আমতা স্বরে বললো,
“আমি ভয় পেয়েছিলাম”
“কেনো?”

অভ্রের পালটা প্রশ্নে ঐন্দ্রিলা নিজেকে সামলে নিয়ে খুব সাবধানে বললো,
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”
“কি! চোর তোর গলা কেটে দিয়েছে?”

ঐন্দ্রিলা মাথা নাড়ালো। সে সত্যটা বলতে পারছে না। বলবেও না। কি বলবে, “স্বপ্নে দেখেছি তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, তাই ভয়ে মাথা হ্যাঙ হয়ে গেছে”

একেই দুম করে জড়িয়ে ধরার জন্য সে বেশ বিব্রত। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আছে। অভ্র কিছুসময় তার দিকে চেয়ে রইলো। ফিঁচেল হাসি হেসে বললো,
“গলা কাটা অবস্থায় তোকে দেখতে কেমন লাগছিল? এমনেই তোকে শাকচুন্নীর মত লাগে, গলা কাটা অবস্থায় নিশ্চয়ই আরোও বিশ্রী লাগছিলো!”

অভ্রর কথা শুনে দুম করে জমাট অনুভূতিগুলো পলায়ন করলো। লালচে আভায় রাঙ্গা ঐন্দ্রিলার চোখ ধিক ধিক করে জ্বলে উঠলো রাগে। রাগী স্বরে বললো,
“তোর গলা কেটে দিয়ে দেখাবো কেমন লাগছি?”
“কি সাংঘাতিক! একেবারে খু’ন? অবশ্য তোর নরম হাতে আমি হাজারবার খু’ন হতে পারবো”

বিনা সতর্কতায় এমন নির্লজ্জ কথা বলা অভ্রর স্বভাব। অন্য সময় হলে মুখ ভেঙ্গচি কেটে উঠে পড়তো ঐন্দ্রিলা। কিন্তু এখন তা হলো না। উলটো বিষন্ন গলায় বললো,
“এগুলো শুধু মুখে কথা”

অভ্র মুখখানা আরোও কাছে এনে বললো,
“তুই কি চাস আমি স্বেচ্ছায় তোকে গলা পেতে দেই যেন তুই কাঁটতে পারিস?”

তার অনড় দৃষ্টি স্থির ঐন্দ্রিলার দিকে। বড্ড বেপোরয়া এই দৃষ্টি। হুট করে বুকে লাগে। সকাল সকাল এমন নেশাতুর দৃষ্টি হৃদয়ের জন্য একেবারেই ভালো নয়। স্বচ্ছ দিঘীর মতো গভীর দৃষ্টিতে হুট করে হৃদয় ফসকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ঐন্দ্রিলার হৃদয় এমনিতেই দূর্বল হয়ে আছে কিছুদিন যাবৎ। এই দূর্বলতা নিয়ে এমন দৃষ্টির সম্মুখীন হওয়া মোটেই ভালো কিছু নয়। ঐন্দ্রিলা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“সেটা কখন বলেছি?”
“আমার মৃত্যু সইতে পারবি না বুঝি?”
“সকাল সকাল অলুক্ষণে কথা বলিস কেনো?”
“সকাল সকাল আমার গলা চেপে ধরছিস আর বলতে দোষ? জানিস আমার কত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ দোকানে ব্যাংকের লোক আসার কথা। তৃষা সকাল থেকে ফোন দিতে দিতে কানের পোকা বের করে দিয়েছে। জানিস কত দেরি হয়ে গিয়েছে?”
“তুই এখন তৃষার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস?”

কথাটা যেন একটু জোরেই বললো ঐন্দ্রিলা। অভ্র তার কান সাথে সাথে হাত দিয়ে চেপে। হতভম্বের মত উত্তর দিল,
“হ্যা”
“কেনো?”

অভ্র আবারো হতভম্বের মত উত্তর দিল,
“ভিজিটিং এ আসছে ব্যাংকের ম্যানেজার তাই”

ঐন্দ্রিলার মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো,
“তৃষার কি কাজ সেখানে?”

অভ্র ঐন্দ্রিলার প্রশ্ন শুনে নিঃশব্দে হাসলো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“কেনো তুই কি চাস আমি যাব না? কিছুদিন আগে তো বলছিলি তোর কিছু যায় আসে না। আমি দশ জন নিয়ে ঘুরলেও তোর কিছু যায় আসে না”

ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে পারল না। ঠোঁট কামড়ে হজম করল কথাটা। অভ্রের হাসি বিস্তৃত হলো। কোথাও না কোথাও রাগী মেয়েটি তার জন্য জ্বলছে। একটু একটু করে তার হৃদয়ে নিজের নাম খোদাই করতে সে সক্ষম। পৈশাচিক এক হাসি উন্মোচিত হলো তার ঠোঁটে। খুব দেরি নয় যখন নাক উঁচু, রাগী মেয়েটি আত্মসমর্পন করবে তার কাছে। সেদিনটা অভ্রের জীবনের সবথেকে সুখময় দিন হবে। একটু সবুর, একটু সবুর।

*****

খাবার টেবিলে তীব্র তাড়া দিলো অভ্র। তার বের হতে হবে। কাননের উদ্দেশ্যে বললো,
“মা আমাকে এককাপ চা দাও, আমার বের হতে হবে”
“তোমার মা কেনো দিবে? তোমার বউকে বলো”

আউওয়াল সাহেব সংবাদপত্রে মুখ গুজে রাশভারী স্বরে বললেন। এই বাড়ির অদ্ভুত নিয়ম। স্বামী স্ত্রীর হাতে ছাড়া চা খায় না। দাদী মারা যাবার পর থেকে দাদাজান চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এই নিয়মের মর্মার্থ হলো স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার প্রেম বাড়ানো। এক কাপে দুজন চা খাবে। যদিও বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার। কিন্তু ঐন্দ্রিলার বিশ্বাস নেই। গতবারের মত মরিচ গুলিয়ে খাইয়ে দিতে পারে। কি ভরসা? আজ কোনো চান্স নিতে রাজী নয় অভ্র। তাই সে উঠে গেলো চেয়ার থেকে। আউওয়াল সাহেব তার চশমাটা সাদা পাঞ্জাবীতে মুছতে মুছতে বললেন,
“শুনলাম, তুমি নাকি লোনের জন্য এপ্লাই করছো?”

অভ্র বিনা সময় নষ্ট করে বললো,
“জি, আমি অহেতুক সময় নষ্ট করতে অপছন্দ করি”
“আমি কিন্তু কোনো পেপারে সাইন দিবো না”

আউওয়াল সাহেবের কথায় একটু থমকালো অভ্র। কঠিন হলো কন্ঠস্বর,
“মানে?”
“মানে আমি থার্ড পার্টি হয়ে মর্টগেজ দিবো না। জানো তো কোনো সম্পত্তি ছাড়া লোন হয় না”
“সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা নেই”

খুব রুক্ষ্ণ গলায় গলায় উত্তর দিল। আউওয়াল সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তার মুখ দেখে যে কেউ আন্দাজ করবে কেউ যেনো তার বুকে সুঁচের গুতো দিয়েছে। অভ্র অপেক্ষা না করেই প্রস্থান করলো। বাইকে স্টার্ট দিতেই মুখে একটা অর্ধেক রুটির অংশ গুজে জুতো পড়তে পড়তে বেরিয়ে এলো ঐন্দ্রিলা। এসে দাঁড়ালো তার বাইকের সামনে। অভ্র বিরক্ত গলায় বললো,
“কি?”

কোনোমতে রুটি গিলে বললো,
“আমাকে কলেজে দিয়ে আয়”
“আমার দেরি হচ্ছে”
“অন্য মেয়ের জন্য সেজে বের হতে পারিস আর নিজের বউকে কলেজে দিতে পারবি না? কেমন পুরুষ তুই?”
“হ্যা?”

অভ্রের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে পেছনে চেপে বসলো। হুকুম দিয়ে বললো,
“কলেজ যাব”

অভ্র সাইড মিররে ঐন্দ্রিলাকে দেখলো কিছু সময়। তারপর বাধ্য হয়ে কলেজের দিকে গেলো।

কলেজে পৌছেই ঐন্দ্রিলা চলে যেতে নিলে অভ্র পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো। আকস্মিক টানে ঘাবড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। তার বিস্ময়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে উঠলো,
“ম্যাডাম ভাড়াটা?”
“কিসের ভাড়া?”
“এই যে আমার তেল পুড়ালেন সেই ভাড়া”

ঐন্দ্রিলা নাক মুখ কুচকে ফেললো। অভ্রও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ঐন্দ্রিলার হাত আরোও শক্ত করে ধরে বললো,
“এখনি একশ টাকা বের কর”
“একশ কেনো, বাসা থেকে বিশ টাকা ভাড়া”
“তাহলে রিক্সা দিয়ে আসতি। আমার বাইকে চুল উড়িয়ে আসতে কে বলেছে?”
“আমার কাছে টাকা নেই”
“মানে?”
“ওয়ালেট বাড়ি রেখে এসেছি”
“বাহানা দিলে হবে না”
“সত্যি বলছি”
“উহু, হবে না। টাকা বের কর”

ঐন্দ্রিলা ঠোঁট উলটে ফেললো। সে আসলেই তাড়াহুড়োতে ব্যাগ আনে নি। সে জানে অভ্র তাকে নিয়ে আসবে। যাবার সময় পিউ তো আছেই। অভ্র তার হাতে হালকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে?”
“কি?”
“চুমু খা গালে”…………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩০তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)

ঐন্দ্রিলা ঠোঁট উলটে ফেললো। সে আসলেই তাড়াহুড়োতে ব্যাগ আনে নি। সে জানে অভ্র তাকে নিয়ে আসবে। যাবার সময় পিউ তো আছেই। অভ্র তার হাতে হালকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“ছেড়ে দিতে পারি এক শর্তে?”
“কি?”
“চুমু খা গালে”

অভ্রর প্রস্তাবে চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড় হলো যেনো ঐন্দ্রিলার। অথচ ছেলেটির চোখে-মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। মাঝরাস্তায় সে কলেজ গেটে তাকে চুমু খেতে চাচ্ছে। ব্যাপারটি মোটেই স্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তার মুখ দেখলে মনে হচ্ছে এটা অহরহ হয়। ঐন্দ্রিলার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো উষ্ণ রক্তের স্রোত। হঠাৎ করেই চুপসানো বেলুনের মতো নেতিয়ে গেলো। স্বর নেমে এলো খাঁদে,
“হাত ছাড়”

অভ্রর কোনো ভাবান্তর নেই। সেই শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। ঐন্দ্রিলা অসহায় স্বরে বললো,
“ক্লাস শুরু হয়ে যাবে?”
“হোক”
“আমার দেরি হচ্ছে”
“তাহলে তাড়াতাড়ি চুমু খা”

অন্যসময় হলে ঐন্দ্রিলা রাগ দেখাতো, গা’লি দিতো, চোখ রাঙ্গাত। আজ কিছুই হচ্ছে না। চিবুকখানা গলার কাছে বেঁধে আছে। চোখে লজ্জার ধার। লজ্জাটা শুধু অভ্রর জন্য। এমন লজ্জা দেখার লোভ বহুদিনের। ঐন্দ্রিলা কোনোমতে বললো,
“তোর দেরি হচ্ছে”
“সেটা আমি বুঝে নিবো”
“মানুষ দেখছে”
“মানুষের দেখার মানুষ দেখছে”
“কি ভাববে?”
“তাদের যা ইচ্ছা তারা ভাববে, তাদের ভাবনা তো আমি ভাবতে পারবো না”
“তুই একটা…”
“হু, আমি একটা?”

ঐন্দ্রিলা কথাটা শেষ করতে পারলো না। দাঁত পৃষ্ট করলো নিন্মোষ্ঠ। নিন্ম স্বরে বললো,
“চুমু খেতেই হবে?”
“শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার শ্রমের মূল্য দিতে হয়। আমি তোর জন্য কতটা ঘাম ঝরালাম। এই চুমু আমার ঘামের মূল্য। নিয়ে দে আমি ছেড়ে দিচ্ছি”

এই ছেলে নাছোড়বান্দা। চেষ্টা করেও লাভ নেই। ঐন্দ্রিলা চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দূরত্ব গোছালো এগিয়ে এসে। অভ্র তার গাল পেতে আছে। অবিশ্বাস্য, দুর্দান্ত মুহূর্ত। গাল এবং ওষ্ঠের দুরত্ব ক্ষণিকের। অভ্রর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো যেন। খুব কাঙ্খিত তবুও অনাকাঙ্খিত মুহূর্ত। ঐন্দ্রিলা অভ্রর গালের কাছে আসতেই মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। জোরে কামড় বসিয়ে গিলো গালে। আকস্মিক আক্রমণে হাত ছেড়ে দিল সে। আর সেই ফাঁকে ছুটে পালালো ঐন্দ্রিলা। অভ্রর গাল লাল হয়ে আছে। দাঁতের দাগ বসে গেছে। মুখ খানা ঘষতে ঘষতে বললো,
“এক মাঘে শীত যায় না বউ”

******

ক্লাসের সর্বশেষের বেঞ্চে বসে রয়েছে পিউ। তার মন নেই ক্লাসে। হাসাহাসি, গল্পের গুঞ্জনে সে নিজের মনোজগতে ব্যস্ত। মস্তিষ্কে পর্যাবৃত্ত গতিতে ঘুরছে নীলাদ্রির কথাগুলো। ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের প্রতিফলন দেখা স্বপ্নের মতো; যেন একটি চিত্রকর্মে রঙের খেলা। এই প্রতিফলন পিউ দেখেছে নীলাদ্রির চোখে। সে বলে সে তাকে ভালোবাসে না। অথচ তার কাজ, তার কথা কিছুই মিলে না তার উক্তির সাথে। সে তাকে বিয়ে করতে চায়, সে তাকে অন্যের কাছে হারিয়ে ফেলার ভয় পায়। এগুলো কি ভালোবাসা নয়! পিউ দ্বিধাগ্রস্থ। নীলাদ্রিকে পাবার আনন্দ এতটাই গাঢ় যে, সেই আনন্দ থেকে হাজার ভয় তাকে ঝাপটে ধরছে। ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে ফেলার ভয়। যদি এই অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে যায়? পেয়েও ভালোবাসা যদি হারিয়ে ফেলে পিউ? হারানো ভালোবাসা একটি শুকনো ফুলের মতো। যা একসময় হয়তো জীবনের রঙিন অধ্যায় রুপে থাকে কিন্তু হারিয়ে ফেললেই তা কেবল একটি নিঃসঙ্গ স্মৃতি; সেই ফুলের পাপড়িতে সব জীবন্ত স্মৃতিগুলো ছাই থাকে কিন্তু তার সুবাস থাকে না। চিন্তাগুলো আসতেই কুওড়ে যায় পিউ। আনন্দ বিষিয়ে যায়।

ঐন্দ্রিলা এসে বসলো ঠিক পিউয়ের পাশে। ধড়াম করে রাখলো ব্যাগ। ফলে পিউয়ের ধ্যান ভেঙ্গে গেলো। ঐন্দ্রিলা বসলো। ছুটে আসতে গিয়ে হাপিয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলা পিউয়ের গায়ে গা এলিয়ে দিল। পিউ শুধালো,
“শরীর কেমন এখন?”
“ভালো আবার ভালো না”
“ভালো না কেনো?”
“স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নের পর থেকেই মাথায় ব্যামো দেখা গেছে। এমন এমন কাজ করছি যে নিজেও আগা মাথা বুঝছি না”
“তোদের ভাইবোন কি সবগুলোর এমন মাথার ব্যামো আছে?”

ঐন্দ্রিলার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। অবাক স্বরে শুধালো,
“ভাইয়া কি করেছে আবার?”

পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আস্তে ধীরে সবটা খুলে বললো। পিউয়ের কথা শুনতেই ঐন্দ্রিলার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। হতভম্ব, বিমূঢ় স্বরে শুধাল,
“ভাইয়া তোকে প্রপোজ করেছে? মানে ভাইয়া?”
“না তোর ভাইয়ার ভুত। বলছি কি, আগামীকাল আসছে আমাকে দেখতে। তার মত সাজতে বলেছে”
“তুই কি সিদ্ধান্ত নিলি?”

পিউ চুপ করে গেলো। হাতের মাঝে দলিত হলো ওড়নার ত্রিকোন। ঐন্দ্রিলা বললো,
“আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার ভাই বিয়ে করার জন্য প্রপোজ করতে পারে। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হয়ে নবম আশ্চর্যের কাজ করেছে। কিন্তু আমাকে জানায় নি। বিয়েতে যদি তুই রাজী হস, তাহলে আমি পাত্রীপক্ষে থাকবো। ওর গাধার জুতো চুরি করে ওকে ঘোল খাওয়াবো”
“আমার কি রাজী হওয়া উচিত?”

পিউয়ের কন্ঠে দ্বিধা। ঐন্দ্রিলা হাসলো। গালে হাত দিয়ে বললো,
“তোর মনকে জিজ্ঞেস কর। উত্তর পেয়ে যাবি”
“যদি এটা পাগলামি হয়? ক্ষণিকের পাগলামি?”
“মনে হয় না”
“কেনো?”
“ভাইয়ার রুমে কখনো গিয়েছিস?”
“হ্যা?”
“ভাইয়ার গুপ্তধনের বক্সটা দেখেছিস?”
“গুপ্তধন?”

ঐন্দ্রিলা হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ভাইয়ার একটা গুপ্তধনের বক্স আছে। সেই বক্সে ভাইয়ার সব গুপ্তধন রাখা। যদিও হাবিজাবি, নুড়ি পাথর, শৈবাল, যত দুনিয়ার আবর্জনা। কিন্তু একটা বক্স আছে যার নাম পিউ। কখনো তার কাছে সেই বক্সটা চেয়ে দেখিস”

পিউ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনা টলমল করছে। এই বক্সটাই কি পুড়ে গিয়েছিলো নীলাদ্রির বৃক্ষপ্রাসাদের সাথে। সেদিন খুব কেঁদেছিলো ছেলেটি। বুকের ভেতরটায় তীক্ষ্ণ ব্যাথা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাথাটা তিক্ত নয়। সব ব্যাথা তিক্ত হয় না, কিছু ব্যাথা বুঝি সুখময়ী হয়।

******

দোকানে আসতে না আসতেই বিল্লালের গোমড়া মুখের সম্মুখীন হলো অভ্র। যে সাগরেদ কখনো তর্ক করে না, সেই সাগরেদ খ্যাক করে উঠলো,
“এত দেরি কেনো তোর? জানিস না ব্যাংক থেকে ভিজিটিং আসবে”
“শোন আমি বিবাহিত, অনেক কাজ থাকে আমার। আমার একটা বউ আছে”
“নিকুচি করেছে তোর বিবাহিত হওয়ায়। এই বউয়ের উছিলায় গতকাল শাকচুন্নির সাথে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিস। বউকে জ্বলাতে এনে আমার ঘাড়ে তুলে দিয়েছিস”
“কার কথা বলছিস?”
“তৃষা ছাড়া পৃথিবীতে আর কয়টা শাকচুন্নি আছে?”
“কেনো ঘাড় মটকে দিয়েছে নাকি রক্ত চুষে খেয়েছে?”

কথাটা শুনতেই বিল্লালের গাল, কান লাল হয়ে গেলো। লজ্জা পেলো নাকি রাগ হলো বোঝা গেলো না। অভ্র তাকে এমন প্রথম দেখেছে। নাক চুলকে বললো,
“আমাকে আর ওর সাথে কোথাও পাঠাবি না। এই প্রথম আর এই শেষ”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। অভ্র কি বলবে বুঝতে পারলো না। গতরাতে দুজনের মধ্যে হয়েছে কি?

******
কলেজের গেট থেকে বের হতেই দেখা হলো আহাশের সাথে। ছেলেটির সাথে সেদিনের পর থেকে কথা হয় নি পিউয়ের। উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত ছেলেটি দুম করেই গুমড়ে গেছে। ঐন্দ্রিলা তাকে দেখেই পিউকে বললো,
“আমাকে ত্রিশটাকা দে”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“যাচ্ছি এক শয়তানের মাথা ভাঙতে”
“আর আমি?”
“ছোট্ট দেবদাসকে সামাল দাও। হৃদয়দহনে জ্বলছে ছেলেটা”

পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আহাশের সেদিনের কথাগুলোর উত্তর দেওয়া হয় নি তার। আহাশ একটা প্রপার উত্তর প্রাপ্য। তাই এখন এড়িয়ে গিয়ে কাপুরুষতা দেখাবে না পিউ। আহাশের সামনে যেতেই সে মিষ্টি করে হাসলো। শুধালো,
“ভালো আছো পিউ আপু?”
“হ্যা”
“আজ তোমার সময় হবে?”

*****

ঐন্দ্রিলা যখন দোকানে পৌছালো তখন অভ্র ভীষন ব্যাস্ত। দোকানে ব্যাংক থেকে তিন চারজনের টিম এসেছে। তাদের আপ্পায়নে ব্যাস্ত সে। বাহিরের ঘরে বসে আছে বিল্লাল। ঐন্দ্রিলাকে দেখে সে বললো,
“একি ভাবিয়াপু তুমি এখানে? দরকার কিছু?”
“না, তোমার গুরুর কাছে এসেছিলাম। ও কি ব্যাস্ত?”
“হ্যা, ব্যাংকের লোকরা এসেছে তো তাই”
“আমি ভেতরে যেতে পারবো না?”

বিল্লাল একটু চিন্তায় পড়লো। অভ্রকে বোঝা যায় না। সে হুট করেই চটে যাওয়া ব্যাক্তি। তাই সে বাহির থেকেই অভ্রর ফোনে ফোন করলো। অভ্র ফোন রিসিভ করতেই বিল্লাল ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভাবিয়াপু এসেছে, কি করবো?’

অভ্র কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো,
“ভেতরে আসতে বল”
“সমস্যা নেই তো?”
“নাহ”

বলেই ফোন কেটে দিল। বিল্লাল ঐন্দ্রিলাকে বললো,
“তুমি ভেতরে যাও”

ভেতরে যেতেই দেখলো ব্যাংকের সবাই বসে রয়েছে। সে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি তার দিকে ভিড়লো। অভ্র হেসে বললো,
“আমার স্ত্রী, ঐন্দ্রিলা”

ব্যাংকের ম্যানেজার অবাক স্বরে বললেন,
“কি বলেন, আপনি বিবাহিত?”
“জি স্যার।“
“ইশ! কই ভাবলাম আমার বোনের জন্য একটা চান্স নিব”

বলেই হাসির রোল পড়লো। ঐন্দ্রিলা বেশ অপ্রস্তুত হলো। অভ্র একটা চেয়ার টেনে তাকে বসতে বললো। ঐন্দ্রিলা সবাইকে সালাম দিল। তারপর চেয়ারটি নিয়ে ঠিক তৃষা এবং অভ্রের মধ্যকার ফাঁকা জায়গায় বসলো। ম্যানেজার সাহেব বেশ খেতে পছন্দ করেন। তিনি মিষ্টির পর মিষ্টি খাচ্ছেন। সে মোটামোটি বেশ প্রসন্ন অভ্রর উপর। তার খাতাপত্র, তার ট্রাঞ্জেকশন সবই বেশ আশানুরুপ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অভ্রর সাথে হাত মেলাতে মেলাতে বললেন,
“আসলেই আমি ইমপ্রেসড। ইয়াং জেনারেশনের এমন এন্থুজিয়াসম আমার ভালো লাগে। আশা করি ভালো কিছু হবে”

তারা বেরিয়ে গেলেন। অভ্র তাদের বিদায় দিল। রয়ে গেলো তৃষা। সে অনেকক্ষণ যাবৎ অভ্রের সাথে কথা বললো। পুরোটা সময় ঐন্দ্রিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে। চোখ দিয়ে কাউকে ভস্ম করে দেবার উপায় থাকলে হয়তো সে চোখ দিয়েই তৃষাকে ভস্ম করে দিত। তৃষা সেই দৃষ্টিতে উপেক্ষা করে বললো,
“কোনো নিউজ আসলেই আমরা নক দিচ্ছি”

অভ্র হাসিমুখে মাথা নাড়ালো। তৃষা চলে যেতেই সে ঐন্দ্রিলার দিকে না তাকিয়ে বললো,
“চোখ দিয়ে খুন করা বন্ধ কর”

অভ্রের কথায় চমকে উঠলো ঐন্দ্রিলা। তড়িঘড়ি করে বললো,
“আমি কখন চোখ দিয়ে খুন করলাম? আমি কিছু করি নি”

অভ্র চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। ফিঁচেল হেসে বললো,
“আচ্ছা?”
“আমার খিদে পেয়েছে। চল খেতে যাবো”
“যা আমি কি মানা করেছি?”
“তুই নিয়ে যাবি। আমার কাছে টাকা নেই”
“এতে আমার কি লাভ? সকালের ঘটনা কিন্তু ভুলি নি। চুমুটা এখনো বাকির খাতায় জমা আছে”

কথাটা শুনতেই ঐন্দ্রিলা চুপসে গেলো। মিনমিনিয়ে বলল,
“বউয়ের বেলায় এতো লাভ ক্ষতি হিসেব করিস কেনো?”
“কে বউ? কই বউ? আমি তো দেখছি না”

আশেপাশে দেখে অবুঝ ভাব নিয়ে শুধালো অভ্র। বিদ্রুপ টেনে বললো,
“সকাল থেকে এতো বউ বউ আচারণ করছিস কেনো শুনি?”

অভ্রর প্রশ্নে সকাল থেকে জমানো ক্ষোভ, রাগ, ঈর্ষা সব যেনো মুহূর্তেই মাথায় উঠে গেলো যেনো ঐন্দ্রিলার। অভ্রর শার্টের কলার টেনে ধরে বললো,
“বিয়ে যখন করেছিস, বউ বউ আচারণ তো করবোই। পৃথিবী উলটে গেলেও আমি ই তোর বউ থাকবো। সেটা তুই কেনো তোর চৌদ্দ গুষ্টি বদলাতে পারবে না”

ঐন্দ্রিলার শরীর কাঁপছে। তার দৃষ্টি অভ্রতে আবদ্ধ। অভ্র নিঃশব্দে হাসলো। মাথাটা নুইয়ে টুপ করে ঐন্দ্রিলার ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে বলল,
“যেহেতু তুই বউয়ের মত আচারণ করছিস, আমিও তাহলে বর বর আচরণ করি, কেমন?”…………

চলবে