মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-৩৩+৩৪

0
38

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৩তম_পর্ব

“আন্টি, আমরা পিউয়ের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি”

নীলাদ্রির কন্ঠ অতিশয় স্বাভাবিক। তার বচনভঙ্গি শুনে মনে হলো এটা খুব সাধারণ একটি কাজ। “বিয়ের প্রস্তাব” ব্যাপারটি নিত্যদিনের তালিকাভুক্ত কাজ। মানুষ খাওয়া, ঘুমানোর সাথে সাথে দু একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়েও দু এক দরজায় করাঘাত করে। আজ পিউয়ের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার পালা। পিউয়ের মা নিতুল হা করে চেয়ে তাকিয়ে আছেন। তার মুখখানা খোলা। যেকোনো সময় মাছি ঢুকে যেতে পারে। সাবেরার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো ছেলের কথা শুনে। সালাম সাহেব সাথে সাথেই কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলেন “ইডিয়ট” বলে। পিউ এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে। কপাল চাপড়ে ফুটো করে দিতে ইচ্ছে করছে। কোন অলুক্ষণে সে নীলাদ্রিকে ম্যাসেজটা করতে গিয়েছিলো!

ঘটনাটি সকালের। বারান্দার গ্রিলে সদ্য বসে থাকা নিঃসঙ্গ কাকটা গলা চিরে ডাকছে। শকুনতলা চার পা ছড়িয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। পশমী পেলব ক্ষুদ্র দেহ মেঝের টাইলসের ঠান্ডায় আরামে মশগুল। নীলাদ্রি কিছু বইপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। চোখে চশমাটা নাকে নেমে এসেছে। আজকাল চশমা পড়তে হচ্ছে। মাথা ব্যাথার বাতিক শুরু হয়েছে। বাহিরে বাদশাহর কন্ঠ পাওয়া যাচ্ছে। সে জোরে জোরে ইংরেজী ক্যালেন্ডারের মাসের নাম শিখাচ্ছে ছাগলদের। কিছুদিন পর এই ছাগলের রেজালা হবে এখন ইংরেজী শিখানোর হেতু বিশ্লেষণ করতে পারে নি নীলাদ্রি। অবশ্য তার বিয়েতে আসা গেস্টদের ভাগ্য বেশ চমৎকার। তারা শিক্ষিত ছাগলের রেজালা খাবে। যদিও “মে” এর আগে বাদশাহ আগাতে পারে নি। যদিও বাদশাহ এর ভাষ্য,
“নীলাদ্রি ছাগল নীলাদ্রি ছাগলের মতোই বুদ্ধিমান। সে ইংরাজী বর্ণমালা আয়ত্ত করেছে। তারে যদি জিগানো হয় সে পা দিয়ে দেখায় দেয়। মাশাআল্লাহ”

যদিও নীলাদ্রির বিশ্বাস হয় নি। বাদশাহ সালাম সাহেবের বিশ্বস্ত ভৃত্য। সে সালাম সাহেবের কথার বাহিরে বাথরুমেও যায় না। পায়খানা এলেও আটকে রাখে। সালাম সাহেবের সাথে এমনি ছাগল আর শকুনতলার লড়াই হচ্ছে। সেখানে বাদশাহ কিভাবে সত্যি বলতে পারে? উপরন্তু ছাগল ধার চাওয়ার পর ছাগলদের প্রতি যত্ন যেন বেড়ে গেলে। সালাম সাহেবের প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে সে ছাগলদের “ইংলিশ অলিম্পিয়ার্ড” এ পাঠাবেন। নীলাদ্রি চশমাটা খুলে গা এলিয়ে দিল তার গদি চেয়ারে। শকুনতলার জিনোম পরীক্ষা এখনো চলছে। ফলপ্রসু কিছু পাওয়া যায় নি। তবুও সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। নীলাদ্রি বরাবরই এমন। একটা পোকা মাথায় ঢুকলে সে মোটেই নামতে চায় না। এখন যেমন মাথায় বিয়ে পোকা ঘুরপাক খাচ্ছে। পিউকে রাজী করানো তার মিশন। কিন্তু মেয়েটা বলেছে,
“আমার সামনে আসবেন না আপনি”

তাই তার সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। হবু বউয়ের কথা তো অমান্য করা যায় না। অন্যসময় হলে পিউকে নিজের সামনে বসিয়ে ধমক দিয়ে রাজী করানো যেত। কিন্তু এখন তা করা যাচ্ছে না। যতই হোক এটা নীলাদ্রির দাদার শিক্ষা। সালাম সাহেবের সব কাজ বিরক্ত লাগলেও একটি স্বভাব খুব প্রিয় নীলাদ্রির। তা হলো সে তার স্ত্রীকে পারলে মাথায় তুলে রাখেন। সালাম সাহেবের এই গুনটা রপ্ত করতে চায় নীলাদ্রি। তাই ভদ্র পুরুষের মত তার আজ্ঞার পালন করে সাতশত তেপ্পান্নতম বারের মত ম্যাসেজ করলো,
“পিউ আমি বর হিসেবে খুব একটা মন্দ হবো না। তুমি একটা ট্রাই করে দেখো”

সাথে সাথে একটি ম্যাসেজ এলো,
“আমি এতো ট্রাই ফাই করতে পারবো না। বিয়ে মানুষ দশ-বারোবার করে না, একবার করে। আমি একবারই করবো। যদি আপনি সত্যি সত্যি বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস হন, তাহলে প্রস্তুতি নিন। এই পিউ একবার ঘাড়ে উঠলে কিন্তু বান্দরবানে গিয়ে লুকালেও পার পাবেন না”

ব্যাস নীলাদ্রিকে আর পায় কে! এক লাফে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে। মাথা ব্যাথা যেনো ছু মন্তর। ঘর থেকে বাদশাহ এর উদ্দেশ্যে বললো,
“ইংরাজি পড়ানো থামাও। কসাইয়ের ব্যাবস্থা কর। ছাগলের এখন রেজালা হবে”

তারপর সালাম সাহেব আর সাবেরাকে কিছু না বলেই এখানে দিয়ে আসলো। তাও সালাম সাহেব কোনো মতে মিষ্টি কেনার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে রক্ষা। নিতুল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। সাবেরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ও কি ঠিক বলছে সাবেরা আপা?”
“হ্যা, আপা। আমরা পিউয়ের জন্য এসেছি। আসলে নীলাদ্রি পিউকে পছন্দ করে”

সাথে সাথে নিতুল পিউয়ের দিকে তাকালো। পিউ মাথা নিচু করে ফেললো। নিতুল অপ্রস্তুত স্বরে বললো,
“এমন তো কিছু কখনো ভাবি নি। ছোটবেলা থেকেই পিউয়ের বড় ভাইয়ের মতই নীলাদ্রিকে দেখেছি আপা। এখন বিয়ে কিভাবে সম্ভব?”
“কিন্তু আন্টি, আমি তো পিউকে আমার ছোটবোনের মত দেখি নি। আমি সবসময় ওকে পিউ হিসেবে দেখেছি। আর পিউ আমার রক্তের বোন না। আমাদের বিয়েতে কোনো ঝামেলা হবার কথা নয়। আমাদের রক্তের গ্রুপ আলাদা। আমার কোনো রোগ নেই আল্লাহর রহমতে। আমি সারাজীবন গোল্ড ম্যাডেল পেয়েছি পড়াশোনায়। আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট পানির মত স্বচ্ছ। জীবনে আমার নারীসঙ্গ ছিলো না। আমার বন্ধুর পরিধি সীমিত। তাই আমার বদ অভ্যাস নেই। আমার নিজস্ব সম্পদ এখন তেমন কিছু নেই। তবে বান্দরবানে আমার নিজস্ব একটা রিসোর্ট আছে যা আমি এতো দিনের কামাইএ কিনেছি। আমি আমার বাবা-মার উপর নির্ভর নই। আমার রিসার্স আর ডকুমেন্টারি ইনকাম মন্দ নয়। যদিও সেটা ছয় অংকের নয়। কিন্তু আমাদের জন্য যথেষ্ট। এবার বলুন আমার জীবনে কি কিছু কমতি আছে?”

সালাম সাহেব সাবেরার কানে কানে বললো,
“তোমার ছেলের জীবনে কোনো কমতি নেই, শুধু বুদ্ধির কমতি। এভাবে হবু শ্বাশুড়িকে কে পটায়”

সাবেরা কড়া নয়নে তাকালেন স্বামীর দিকে। স্বামী একটু দমলেন। নিতুল নীলাদ্রির কথা খন্ডন করার সুযোগ পেলেন না। ফলে গাইগুই করে বললেন,
“ওর বাবা আসুক। উনি তো বাড়ি নেই”

নীলাদ্রি অবাক স্বরে বললেন,
“আপনার মত বুদ্ধিমান মহিলার থেকে এমন আচারণ আশা করি নি আন্টি”
“কেনো বাবা?”
“আমি তো আংকেলকে বিয়ে করবো না। আমি পিউকে বিয়ে করবো। আপনার যদি জিজ্ঞেস করতে হয় তাকে জিজ্ঞেস করুন। আংকেলের সাথে পরামর্শ করে কি হবে? সংসার তো আমরা করব”

সাবেরা কিড়মিড়িয়ে বললো,
“নীলাদ্রি, এটা বিয়ে। এখানে অনেক কিছু রয়েছে”
“না, মা। এটা তোমাদের কিছু জংধরা মানুষের বক্তব্য। যদি আমাকে নিয়ে সন্দেহ থাকেই, তাহলে আমার ইন্টারভিউ নিক আন্টি”
“এভাবে তো বিয়ে হয় না। তুমি পৃথিবীর নিয়মের বহির্ভুত একজন হলেও আমরা তো নই। পিউয়ের বাবা আসুক। উনারা সময় নিক”
“তাহলে তো আমাকে আংকেলের সাথে একবার ইন্টারভিউতে বসতে হবে”

নীলাদ্রি কন্ঠ অনড়। সে দৃঢ় প্রতীজ্ঞাবদ্ধ সে পিউকে বিয়ে করবে। তার এমন উতলাপনা দেখে বেকুব হয়ে গেলো নিতুল। আমতা আমতা করে শুধালো,
“বাবা নীলাদ্রি, তোমাদের কি সম্পর্ক ছিলো কোনো?”
“ছিঃ ছিঃ, আন্টি। এমন কথা বলবেন না। পিউয়ের সাথে আমার সম্পর্ক এখনো বান্ধবীর ভাই আর বোনের বান্ধবীতেই সীমাবদ্ধ। অহেতুক প্রশ্ন করে আপনি পিউকে কলঙ্কিত করবেন না”

নীলাদ্রির উত্তরে নিতুল বিমূঢ় চাইলো সালাম সাহেবের দিকে। সালাম সাহেব দাঁত বের করে বললেন,
“আমার গুনে গুণান্বিত পুত্র”

****

ছাদের এক পাশে আরাম কেদারা দিয়ে বিকালের রোদ পোহাচ্ছে পৌড় শরীর। গায়ে সফেদ পাঞ্জাবী। দোল খেতে খেতে চোখে লেগে এসেছে। আউওয়াল সাহেব বুড়ো হয়েছেন। ব্যাপারটা শরীর চিৎকার করে জানান দিচ্ছে। আজকাল বুড়ো হাড়ে জোর পান না। সকালে উঠতে গেলে হাটুতে ব্যাথা করে। ঘন ঘন প্রসাব হয়। বহুমূত্র রোগ হলো নাকি। তিনি তো চিনি খান না। তবে কেনো? অভ্রটার চিন্তায় হয়তো এমন হচ্ছে। ছেলেটা এতো জেদি। সে যদি একটু দায়িত্ববান হত চিন্তা কমতো আউওয়াল সাহেবের। এখন আবার লোন নিচ্ছে। ব্যাংকের লোন সাপের মত, ফনা তুলে ছোবল মারলে বাঁচার কায়দা থাকে না। কিন্তু অভ্রকে কে বুঝাবে। সে একবার ঠিক করে নিয়েছে যখন কারোর সাধ্য নেই তাকে বুঝানো। মাঝে মাঝে মনে হয় টাকাটা দিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। বিয়ে তো করেছে, সংসারও করছে। আজকাল তাদের সম্পর্কের সমীকরণটা সরলরৈখিক। কিন্তু কখন পেঁচে যায় ঠিক নেই। বাচ্চাকাচ্চা হলে নিশ্চিন্ত। হঠাৎ পায়ের শব্দ কানে আসলে চোখ মেলেন আউওয়াল সাহেব। মেঘস্বরে শুধালেন,
“কি চাই?”
“আপনাকে একটা সুখবর দেওয়ার ছিলো দাদাজান”

নির্লিপ্ত কন্ঠ অভ্রর। আউওয়াল সাহেব নড়ে চড়ে উঠলেন। কৌতুহল নিয়ে শুধালেন,
“কি সুখবর? তুমি বাবা হচ্ছো?”
“প্রসেসিং চলছে। আপাতত সেটা বলতে আসি নি। আমার লোন হয়ে গিয়েছে”
“কার জমি মর্টগেস দিলে?”
“আপনার ছেলের”

সাথে সাথে ধরফরিয়ে উঠলেন আউওয়াল সাহেব। রাশভারী স্বরে ক্রোধ জাহির করলেন,
“ইদ্রিসের জমি? তাও আমাকে না জানিয়ে”
“হ্যা, সেও একটা বাজি ধরেছিলো আমার সাথে। আমার ঐন্দ্রিলার সাথে বিয়ে হলে আমি যা চাইব সে দিবে। সেই বাজি সে হেরে এখন আমার লোনের গ্যারান্টার তিনি। আপনারা কেনো যে আমার সাথে বাজি লাগেন আমি বুঝি না। মাহাবুক হক অভ্র বাজিতে হারে না দাদাজান। এখন আমার আপনার টাকার প্রয়োজন নেই। আমার ব্যাবসা চ্যালচেলিয়ে এখন চলবে”

বলেই একটু থামলো অভ্র। তারপর বিদ্রুপ টেনে বললো,
“আর আপনি টাকাটা প্রস্তুত করে রাখুন দাদাজান। আমার সন্তানের মুখ দেখে তাকে দিবেন”

আউওয়াল সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অভ্রর দিকে। অভ্রর মুখখানা শক্ত হয়ে আছে। সেই মুখাবয়বে তীব্র অভিমানের ছাপ। কিন্তু আউওয়াল সাহেব এই অভিমানের ধার ধারে না। তিনি জানেন তিনি সঠিক। এই ছোট ছোট ছেলেপেলেদের থেকে তার অভিজ্ঞতা অনেক। জীবন সে অভ্রর থেকে অধিক দেখেছেন। তাই জীবনের মর্ম জানেন, সম্পর্কের মর্ম জানেন। হয়তো আজ অভ্র আউওয়াল সাহেবকে ভুল বুঝছে কিন্তু একটা সময় তাকে ধন্যবাদ জানাবে। কারণ আউওয়াল সাহেবের জেদের জন্য হলেও সে তার স্ত্রীকে নিজের করে পেয়েছে। সংসারের সুখ পেয়েছে। আউওয়াল সাহেব হেসে বললেন,
“শোনো অভ্র, প্রোপৌত্রের মুখ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। এই সুখ টাকায় হিসেব করা যায় না”

অভ্র বুড়োর কথা অপেক্ষা করলো না। আউওয়াল সাহেব সেখানেই বসে রইলেন। তার মুখে হাসি। বিজয়ের হাসি। নাতী জিতে গেলেও, আসল বাজিমাত সে করেছে।

****

সন্ধ্যের গন্ধে ধরনী বুদ। সূর্যের কমলা আলো শুষে রজনী তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। অনেক বছর পর গিটারে সুর তুলেছে অভ্র। ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। নিকোটিন পুড়ানো ধোঁয়ায় ধু ধু করছে বারান্দা। সেই হাতে রুক্ষ আঙ্গুল চলছে গিটারের স্ট্রিং এ। এর মাঝে প্লেট ভর্তি গরম গরম পিয়াজু নিয়ে উপস্থিত হলো ঐন্দ্রিলা। কানন মাত্র কড়াই থেকে তুলে বললো,
“তোমার বরকে দিয়ে এসো”

বর এদিকে সিগারেট ফুকছে। দেখেই গা জ্বললো ঐন্দ্রিলার একদফা। সাথে সাথে ঠোঁটের ফাঁক থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা নিয়ে ছুড়ে ফেললো রেলিং থেকে। এমন আকস্মিক হামলায় হাত থামলো অভ্র। সুর থেমে গেলো। সূঁচালো নয়নে তাকালো ঐন্দ্রিলার দিকে। এতে ঐন্দ্রিলার যায় আসে না। কিছুই হয় নি এমন একটা ভাব করে সে দিব্যি চেয়ার টেনে অভ্রের পাশে বসলো। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পিয়াজু খাওয়া শুরু করলো। অভ্র এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাঢ় স্বরে শুধালো,
“এটা কি হলো?”
“আমার সামনে সিগারেট খাবি না। আমার অসহ্য লাগে”

অভ্র এখন তাকিয়ে আছে। ঐন্দ্রিলা পিয়াজু খাচ্ছে। হঠাৎ তার চুলের পেছনে বলিষ্ট হাতটা নিয়ে মাথাটা টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো অভ্র। বিনা সতর্কতায় ঐন্দ্রিলার ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। এমন কান্ডে নয়ন বিস্ফারিত হলো ঐন্দ্রিলার। পোড়া ঠোঁট অমৃত সুধা পান করেই ক্ষান্ত হলো। মাঝখান থেকে সদ্য মুখে পুরা পিয়াজুটাও হাপিস করে দিল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
“মাকে বলিস ভালো হয়েছে”
“এটা কি ছিলো?”
“তুই তো বললি সিগারেট না খেতে। নেশা তো এমনি এমনি ছাড়ে না। আমি উপায় খুঁজে নিলাম। ভালো মেডিসিন। এমন চুমুর ভাগিদার হতে কোনো পুরুষ ই সিগারেট খাবে না”
“নির্লজ্জ”

ঐন্দ্রিলার রাগে হাসলো অভ্র। একদম পাত্তা না দিয়ে বললো,
“তোর ভাইয়ের তো বিয়ে ঠিক হচ্ছে শুনেছিস?”
“তোর শ্বশুরবাড়ি তুই শুনে বেড়া”

অভ্র গিটারটা নামিয়ে রাখলো। কপালের চুলগুলো টানতে টানতে বলল,
“বাড়ির একমাত্র জামাই, কত কাজ আমার। শ্বশুর আব্বা ফোন করেছিলেন। বলেছেন বিয়ের ডেট পড়লেই চলে যেতে। যদিও কবে পড়বে সেটা নিয়ে তিনি সন্দিহান। আদৌ পড়ে কি না”
“আমাকে বলছিস কেনো এগুলো? পিউকে দেখতে যাবার সময় একবার আমাকে জানিয়ে কেউ? ভাইটা আহাম্মক কিন্তু তোর শ্বশুর শাশুড়ীও তো জানালো না”

অভ্র মিটিমিটি হাসলো। ঐন্দ্রিলা ধমকে উঠলো,
“হাসবি না একেবারে”
“ওকে হাসবো না। এই যে ঠোঁটে তালা মারলাম। অবশ্য আরেকটা উপায় আছে। এই ধর তুই চুমু নিয়ে ঠোঁট আটকে দিলি”

সাথে সাথেই ঐন্দ্রিলা পিয়াজু পুরে দিল অভ্রর মুখে। অভ্র হাসতে হাসতে বললো,
“আসলে আমার শ্বশুর, শাশুড়ীর দোষ নেই রে। তোর ভাই তাদের হাড় জ্বালাচ্ছে। তাদের কপাল খারাপ”
“আমার ভাইকে গালমন্দ করবি না। তুই কি? আমার শ্বশুরের কপাল তো আর সোনায় বাঁধানো না। তোর মত ছেলের জ্বালায় এই বয়সে তার বিপি রোগ”
“খুব তরফদারি করছিস? তোর শ্বশুর পারলে আমাকে ঘরছাড়া করে বৃক্ষবাসী করে। তখন বারান্দায় বসে পিয়াজু খাওয়া লাগবে না। গাছপাতায় উঠতে হতো”
“হাহ! নিজের যখন নিজের মত ছেলে হবে তখন বুঝবি আমার শ্বশুরের কষ্ট”
“এজন্য আমার একটা মেয়ে চাই, একদম তোর মত পুতুল”

কথাটা বলেই একটু থামলো অভ্র। প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“পুতুলের মতো মেয়ে হলে আমার মতো লাফাঙ্গা ছেলেগুলো ওর হাড় জ্বালাবে। রিস্ক হয়ে যাবে। তাই মেয়ের সাথে আমার একটা ছেলেও চাই। আমার মতো বদের হাড়ি। তাহলে আমার মেয়েকে প্রটেকশন দিতে পারবে। এটাই ফাইনাল, আমার জমজ বাবু চাই। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে”

ঐন্দ্রিলা তার কথা শুনে চোখ মুখ খিঁচিয়ে তাকালো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই বাচ্চা না দারাজে জিনিস অর্ডার করছিস। মামা এটার রঙ ভালো না, ওটার ফিটিং ভালো না। বাচ্চা কি তোর কাস্টমাইজেশন অনুযায়ী কুরিয়ারে আসবে? ছাগল কোথাকার। আল্লাহ যা দিবেন তাই আলহামদুলিল্লাহ। ছেলে হোক বা মেয়ে, সুস্থ হোক”
“তার মানে তুই আমার বাচ্চার মা হবার জন্য রেডি। তাই তো?

ঐন্দ্রিলা জমে গেলো। এই ছেলেটা লজ্জা কি করে দিতে হয় এই বিষয়ে পিএইচডি করা। গোল গালগুলো উষ্ণ হয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলার উত্তর না পেয়ে হেসে উঠলো অভ্র। তার হাসি ঘরময় আলোড়িত হলো। এরমাঝেই ঐন্দ্রিলার ফোন বাজলো। নীলাদ্রি ফোন করছে। কিন্তু নীলাদ্রি তো তাকে ফোন করে না। কৌতুহল নিয়ে ফোনখানা ধরলো ঐন্দ্রিলা। ওপাশ থেকে ভাঙ্গা স্বর,
“ঐন্দ্রিলা”
“কি হয়েছে ভাই”
“আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবি? খুব বিপদে পড়েছি”
“কি বিপদ?”

ঐন্দ্রিলার কন্ঠে উৎকুন্ঠা। ওপাশের মানুষের কন্ঠ বিষন্ন। ম্লান স্বরে বললো,
“পিউয়ের বাবা আমার সাথে পিউয়ের বিয়ে দিবে না”……………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৪তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলার কন্ঠে উৎকুন্ঠা। ওপাশের মানুষের কন্ঠ বিষন্ন। ম্লান স্বরে বললো,
“পিউয়ের বাবা আমার সাথে পিউয়ের বিয়ে দিবে না”

নীলাদ্রির কন্ঠ কাঁপছে। ছেলেটির পক্ষে কথা বলাই কষ্টকর ঠেকছে যেনো। মাঝে মাঝে একটু নাক টানছে। কেঁদেছিলো কি? নীলাদ্রি তথাকথিত পুরুষবর্গের মধ্যে পড়ে না। সে তার অনুভূতিগুলো কখনো “আমি পুরুষ” এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে না। যদি সে কষ্ট পায়, সে কাঁদে। কারণ তার ধারণা অনুভূতিগুলো বুকে চেপে রাখার মানে নেই। কঠিন পুরুষ হয়ে নিজেকে জাহির করে বেড়াতে হবে, এটাই সবচেয়ে বড় কাপুরুষতা। নিজের ভয়, ভীতি, কষ্টকে আলিঙ্গন করতে হয়। যদিও সে পিউয়ের শোকে কাঁদতে পারে এটা অবিশ্বাস্য। কারণ তার ভাষ্যমতে সে পিউকে ভালোবাসে না। ভালোবাসা নামক মরীচিকার পেছনে সে ছুটে না। ঐন্দ্রিলা স্মিত হেসে শুধালো,
“বিয়ে দিবে না কেনো বলেছে?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে অভ্র খাওয়া থামালো। তার বড় শ্যালকের মত পদার্থকে কেউ বাতিল ঘোষণা করে শুনে তার কৌতুহল হচ্ছে। হাসিও পাচ্ছে। কিন্তু কারোও দূর্দিনে হাসা উচিত নয়। আল্লাহ পাপ দেয়। তাই সে অতিকষ্টে হাসি চাপা দিলো। ঐন্দ্রিলাকে ইশারায় বোঝালো ফোনটা লাউডস্পিকারে দিতে। ঐন্দ্রিলা সেটাই করলো। ওপাশ থেকে নীলাদ্রির দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো। তারপর ভাঙ্গা স্বরে বলল,
“উনি আজকে বিকালে একটি রেস্টুরেন্টে ডেকেছিলেন। আমি উনার ডাক তো প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। হবু শ্বশুর বলে কথা। প্রথমে আমাকে বললেন কি খাবে! আমার তখন ই সন্দেহ হয়েছিলো। মেয়ের বাবারা যখন মিষ্টিলাপ করে তখন বুঝতে হবে ঘাপলা আছে”

ঐন্দ্রিলা কৌতুহলী স্বরে শুধালো,
“ঘাপলা কি?”
“তার আমার উদবাস্তু কাজ পছন্দ নয়। নিজের একমাত্র মেয়েকে পাহাড়ে শুটকি মাছ হতে দেখতে পারবেন না। তার চাই এমন জামাই যার ইনকাম হবে ফিক্সড, তার জীবনে চাকরি হবে নিশ্চিত। তবে আমার এন্থুজিয়াজমের প্রশংসা করলেন। এমন একজন যে তার কন্যাকে মাথায় করে নৃত্য করবে, পাওয়া খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই আমাকে একটা সুযোগ দিতে চান। পিউয়ের মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি যদি বিসিএস ক্যাডার হয়ে যেতে পারি তাহলে তিনি নিজে পিউয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি যদি না পারি তাহলে পিউকে ভুলে যেতে বলেছেন। পিউয়ের জন্য অনেক ক্যাডার লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাদের একজনের সাথেই বিয়ে দিবে”
“তুমি কি এখন বিসিএস দেবার কথা চিন্তা করছো?”

নীলাদ্রি একটু চুপ করে থেকে বললো,
“উপায় নেই। আমি পিউকে অন্যের বউ হতে দেখতে পারবো না। যদি পিউয়ের সাথে আমার বিয়ে না হয় আমি কখনো বিয়ে করবো না। তাই যদি বিসিএস ক্যাডার হওয়াটাই আমার যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, তবে সেটাই সই। তুই শুধু আমাকে সাহায্য কর গাইডলাইন আর বই ম্যানেজ করে দে”

ঐন্দ্রিলা নীলাদ্রির কথায় হতবাক হয়ে গেলো। শব্দরা নীরব হয়ে গেলো। এই ছেলে বলে কি! বিসিএস কি মুখের কথা? সারাদেশের মানুষ বছরের পর বছর লেগে থাকে এই একটা চাকরির জন্য। নীলাদ্রি পরীক্ষাহলে যাবে আর তাকে ধুপধুনো দিয়ে আমন্ত্রণ করার জন্য কেউ বসে নেই। উপরন্তু নীলাদ্রির বিসিএসের বয়সও আছে আর দুবছর। তাও এই বছর আর সামনের বছর। যে কখনো শৈবাল, পাথর, আবর্জনা ছাড়া কিছু চিন্তাও করে নি, সেই ছেলে সব ছেড়ে বিসিএস দিবে? মাথা কি পুরোপুরি গেছে? ঐন্দ্রিলার হাত থেকে মোবাইলখানা নিয়ে অভ্র হিনহিনে স্বরে বললো,
“শুনেন ভাইজান, এসব সরকারি চাকরির মুলো ছেলেদের গলায় ঝুলানোই হয় যেনো মেয়ের বিয়ের দিতে না হয়। আপনি এখন বিসিএস পরীক্ষায় বসবেন ওদিকে আপনার হবু শ্বশুর পিউয়ের বিয়ে নিজের পছন্দ মতো এক ভেড়ার সাথে দিয়ে দিবে। এখন আপনিই ভাবেন আপনি কি বসে বসে সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করবেন নাকি বীরের মতো নিজের প্রেমিকা না সরি হবু বউকে নিয়ে পালাবেন”

অভ্রর কথা মোটেই নীলাদ্রির পছন্দ হয় নি। তাই রুক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“আমার হবু শ্বশুর তোমার শ্বশুরের মতো বুদ্ধিহীন নয় যে যার তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দিবে”

ফোন লাউডস্পিকারে থাকায় ঐন্দ্রিলাও কথাটা শুনলো। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসলো। অভ্র ক্ষুদ্ধ স্বরে অভিযোগ জানালো,
“তোর ভাই কিন্তু আমাকে অপমান করছে ঐন্দ্রি। আমি কিন্তু সাহায্য করবো না”

ঐন্দ্রিলা সাথে সাথে তার বাহুতে হাত বুলিয়ে বললো,
“হবু শ্বশুরের কাছে ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। ইগ্নোর কর”

অভ্র বউয়ের মুখ দেখে অপমান গিলে ফিসফিসিয়ে বললো,
“শুধু তোর কথা ভেবে তোর ভেড়া ভাইকে বরদাস্ত করছি। নয়তো স্যার বলে পায়ে ধরলেও এই গাধা পাবলিককে আমি অভ্র সাহায্য করতাম না”

সাথে সাথেই নীলাদ্রি উত্তর দিলো,
“আমি কি তোমার সাহায্য চেয়েছি?”

অভ্র আবার ঐন্দ্রিলার দিকে তাকালে ঐন্দ্রিলা তার চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে বললো,
“বাদ দে”

অভ্র গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো বার দুয়েকবার। তারপর রাগী স্বরে বললো,
“নীলাদ্রি ভাই, আপনি বিসিএস পরীক্ষা দিবেন খুব ভালো কথা কিন্তু কথা হচ্ছে আপনার হবু শ্বশুর কি নিশ্চিত করেছেন যে এই সময়টাতে তিনি পিউয়ের বিয়ে দিবেন না?”

নীলাদ্রি চুপ হয়ে গেলো। কারণ পিউয়ের বাবা আকরাম সাহেব এমন কিছুই বলেন নি। তিনি শুধু শর্ত দিয়েছে যা মাথা নাড়িয়ে শুনে চলে এসেছে পিউ। ঐন্দ্রিলা সাথে সাথে চেচিয়ে উঠলো,
“তুমি তার কাছ থেকে কোনো কথা নাও নি?”
“না, আমি উনার শর্ত শুনেই এতো ভেঙ্গে পড়েছিলাম যে কিছু বলার কথা মনেই ছিলো না”
“উদ্ধার করেছো তুমি!”

অভ্র ভাই বোনকে থামিয়ে বললো,
“ওকে রিলাক্স, এককাজ করেন আগামীকাল পিউকে নিয়ে আমার দোকানে আসেন। একসাথে বসে একটা ব্যাবস্থা করতে হবে”
“পিউ আমার ফোন ধরছে না। আসলে ওকে না জানিয়ে ওর বাসায় চলে যাওয়ায় ও রাগ করেছে। ম্যাসেজে ব্লক করে দিয়েছে। ফোন ধরছে না”
“বাপ-মেয়ে মিলে তো আপনাকে চিপায় ফেলে দিয়েছে”

অভ্রের কথায় ক্ষিপ্র স্বরে নীলাদ্রি বললো,
“অসভ্য ভাষা প্রয়োগ করবে না। চিপায় ফেলা কেমন শব্দ?”
“আপনার অবস্থা যা তাতে এই শব্দটাই পার্ফেক্ট”

নীলাদ্রি খট করে ফোন কেটে দিলো। ঐন্দ্রিলা রাগী স্বরে বললো,
“দিলি তো ভাইয়াকে চটিয়ে?”
“তো কি চুমু খাবো? আমার চুমু শুধু আমার বউয়ের জন্য বরাদ্দ। এই যে তোর ভাইয়ের জন্য আমার মস্তিষ্ক খাটাতে হবে, সেটা কিন্তু ফ্রি নয়। প্রতি মিনিটে একটা করে চুমু। এই যে আমি দশমিনিট কথা বললাম। এতে দশটা চুমু। আমি বাকিতে কাজ করি না। সব নগদ। তাই এখনই দশটা চুমু দিবি। তাহলেই আমি বুদ্ধি দিবো”

ঐন্দ্রিলার মুখখানা হা হয়ে গেলো। এই ছেলে কি বলে? এক মিনিটে একটা চুমু? এটা কেমন অসভ্য কথা!। অভ্র সাথে সাথে গুনতে থাকলো,
“দশ, নয়, আট…”
“গুনছিস কেন?”
“তুই দশ সেকেন্ডে চুমু না দিলে ডিল ক্যান্সেল। তোর ভেড়া ভাই তুই বুঝে বেরা। পাঁচ, চার”
“সাত, ছয় কই গেল?”

ঐন্দ্রিলাকে পাত্তা না দিয়েই অভ্র গুনলো,
“তিন, পৌনে তিন, আড়াই”
“আচ্ছা, আচ্ছা। চোখ বন্ধ কর”

ঐন্দ্রিলার কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অভ্র। ঐন্দ্রিলা বিব্রত স্বরে বললো,
“আমার লজ্জা লাগে”
“নেকুপিসি, এই আমার কাছে কিসের লজ্জা? একদম আমার সাথে টাল্টুফাল্টু করবি না”
“তুই চোখ বন্ধ করবি নাকি আমি গেলাম”

বলেই উঠতে নিলে অভ্র হাত টেনে তাকে বসালো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করতে হলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কাঙ্খিত কিছু পাবার। সময় কাটতে লাগলো। এক এক সেকেন্ড শত ক্রোশের মত ঠেকছে। মস্তিষ্ক বলছে ব্যাপারটা অসম্ভব। সবার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। কিছু কাঙ্খিত ব্যাপার না চাইতেও অনাকাঙ্খিত খাতায় নাম লেখায়। উপরন্তু এটা ঐন্দ্রিলা। তার চোখে লজ্জা আনতেই কাঠখড় পুড়িয়ে পৃথিবীকে অর্ধেক কাঠশূন্য করে দিয়েছে অভ্র। অপেক্ষা অধৈর্য্যে পরিনত হলো। চোখখানা মেলতেই যাবে ঠিক তখনই নরম ঠোঁটের স্পর্শ লাগলো খরাময় কপালে, তারপর চোখের পাতায়, রুক্ষ্ণ গালে অতঃপর হালকা ছোঁয়া পাওয়া গেলো পুরু ঠোঁটে। তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই স্পর্শ। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ক্ষণিকের মিষ্টি অনুভূতি। অভ্র চোখ মেলে চাইলো। নিরবিচ্ছিন্ন আঁধারে তখন ছায়াও নেই। ঐন্দ্রিলা পালিয়েছে। সিগারেটে পোঁড়া ঠোঁটে নিজ থেকে চুমু একেছে ঐন্দ্রিলা। অভ্রর ঠোঁটে সপ্রতিভ হাসি। দৃষ্টিতে আত্মতৃপ্তি।

****

ঐন্দ্রিলাদের কলেজ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি নতুন খাবারের দোকান খুলেছে। দোকানের সাজসজ্জা একেবারের বাঙ্গালিয়ানা। নামখানাও খাসা, “বনলতাসেনের পঞ্চভোগ”। নীলাদ্রির নাম পছন্দ হয় নি। বনলতাসেন তো আর রাধুনি ছিলেন না। এই নাম অর্থহীন। সে একটা খাতায় অনেকক্ষণ যাবত নতুন বাঙ্গালিয়ানা নাম লিখার চেষ্টা করলো, কাটাকাটি করলো। আবার লিখলো। অভ্র বিরক্তি নিয়ে বড় শ্যালকের এমন অহেতুক কাজ দেখছে। তার পাশে মুখ ভার করে বসে রয়েছে বিল্লাল। তাকে দেখে যে কেউ বলবে সে অসুস্থ। তার অসুখ হয়েছে, মনের অসুখ। মনে ভীম জ্বর, খাস বাংলায় যাকে বলা হয় ছ্যাকা। সে সদ্য প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছে। কিন্তু অবাককর ব্যাপার সে ছ্যাকা খায় নি। কারণ সে প্রেম করে না। অভ্র তাকে দেখেও বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সেদিনের পর থেকে বড্ড বেখায়াল হয়েছে এই ছেলেটা। তৃষার নাম নিলে আগে জ্বলতো। এখন মুখ লটকিয়ে থাকে। পালিয়ে বেড়ায় যেন। কাহিনীটা কি বুঝতে পারছে না অভ্র। আপাতত নীলাদ্রি নামক মানুষের সমস্যাটা নিবারণ করা জরুরি। বিল্লাল কেসটা এরপর হাতে নিবে।

ঐন্দ্রিলা একরকম জোর করে নিয়ে এসেছে পিউকে। রেস্টুরেন্টে এসেই সে হতবাক হয়ে গেলো। নীলাদ্রি, অভ্র এবং বিল্লাল বসে রয়েছে। নীলাদ্রিকে দেখে পিউ তার অভিমানটা সতেজ করতে চাইলো। কিন্তু জলদগম্ভীর স্বর,
“পিউ তুমি এসেছো?”

এই লোকটা এমন কেনো? তার গভীর চোখের মায়ায় বারবার হৃদয় হারানো যেন ফরজ হয়ে গিয়েছে। অস্বীকার তো করতে পারবে না, লোকটির কাটকাট, সরল কথাগুলোই তার হৃদয় কাঁপানোর জন্য যথেষ্ট। তবুও নিজের মনকে লাগামছাড়া হতে দিল না পিউ। কঠিন স্বরে বললো,
“এখানে এমন দরবারের কি হেতু?”
“তোর বাপ যে আমার ভেড়া শ্যালককে বিসিএসের মুলো ধরিয়েছে জানিস?”

অভ্রর ভনীতাহীন প্রশ্নে বেবাক হলো পিউ। কৌতুহলী স্বরে শুধালো,
“বাবা আপনার সাথে দেখা করেছে?”

নীলাদ্রি মাথা নাড়লো। পিউ পরমুহূর্তে শুধালো,
“কি বললেন আপনি?”
“আমি তার শর্ত মেনে নিলাম”
“পাগল? বিসিএস কি আপেল যে গাছে উঠলেন আর পেড়ে ফেললেন?”
“তোমার জন্য এটুকু তো করতে পারবো তাই না?”

পিউ কাঁপলো ঈষৎ। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো বোকা ছেলেটার বোকা কথায়। অভ্র বিরক্তি টেনে বলল,
“আমার প্লান অনুযায়ী কাজ করলে সাপও মরবে না লাঠিও ভাঙ্গবে না। বিসিএস লাগবে না বাপ বাপ করে তোর বাপ বিয়ে দিবে”
“বাপ বাপ কি? বাবা বলতে পারছো না?”

নীলাদ্রির কথায় মুখ খিঁচিয়ে অভ্র বললো,
“নামে কি যায় আসে ভাইজান। ইমোশন দেখেন”
“প্লান কি তোর, সেটা বল”

মাঝখান থেকে ঐন্দ্রিলা বলে উঠলো। অভ্র হাসলো। হাসিটা দূর্বোধ্য।

******

সকালে সোনা রোদের মৃদু তাপে প্রতিদিনের মত জগিং এ বেরিয়েছে পিউয়ের বাবা আকরাম সাহেব। ডায়াবেটিসের জন্য প্রতিদিন একঘন্টা ব্যায়াম করা অবাঞ্চনীয়। আজকাল মনটা ভালো নেই। প্রতিদিন একটা আননোন নাম্বার থেকে তাকে ফোন দেওয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজি কল। যদিও মানুষটি তিনি ভীত নয়। কিন্তু তার একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার জন্যই ভয় হয়। পার্কের এক চক্কর কেটে বেঞ্চে বসতে না বসতেই কোথা থেকে দশ বারোটা জোয়ান ছেলে তাকে ঘিরে ধরলো। তাদের ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট। ভোস ভোস করে টানছে তা। ভেজা প্রকৃতির নির্মল বাতাস মুহূর্ত তীক্ষ্ণ গন্ধে ভরে গেলো। আকরাম সাহেব কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হলেন। পাশের ছেলেটা হেসে বলল,
“কি কাকা, কেমন আছেন?”
“কে তোমরা?”

আতংকের ছাপ তার স্বরে। ছেলেটা হাসলো ঠোঁট বাকিয়ে। সিগারেটটা বেঞ্চের গায়ে নিভিয়ে বললো,
“চিনতে পারলেন না কাকা, আমি মাহাব। আমাদের তো প্রতিদিন কথা হয়। ভুলে গেলেন”

এই ছেলেটাই প্রতিদিন চাঁদাবাজির জন্য ফোন দেয়। আকরাম সাহেব আশেপাশে তাকালেন। মোট দশ বারোটা ছেলে। কিঞ্চিত সাহস নিয়ে বললেন,
“কি চাই তোমার?”
“আমি তো ফোনে বলে দিয়েছি কি চাই”
“এতো টাকা আমি কোথায় পাব”
“ঠিক আছে আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিন”

ছেলেটার এমন অসভ্য প্রস্তাবে উত্তেজিত হয়ে গেলেন আকরাম সাহেব। রাগে গা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঝাঝালো স্বরে বললেন,
“বেয়াদব ছেলে তোমার সাহস কি করে হলো?”

ঠিক তখন ই ছেলেটা দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“চিল্লাবেন না কাকা। হার্টবিট বেড়ে যাবে”

ছেলেটার স্বাস্থ্য ভালো। সুউচ্চ, সুবিশাল দেহের ভার হাতেই বুঝতে পারলেন যেন আকরাম সাহেব। ঠিক তখনই কোথা থেকে নায়কের মতো আবির্ভাব ঘটলো নীলাদ্রির। শক্ত হাতের ঘুষি বসিয়ে দিল ছেলেটির মুখে। ফলে ছিটকে ঘাসের উপর পড়লো সে। আকস্মিক আক্রমণে ঠোঁট চিরে রক্ত বের হলো। ছেলেটা হতভম্ব তাকিয়ে রইলো। নীলাদ্রি তখন জাহির করে বললো,
“আর একবার আমার হবু শ্বশুরের সাথে বেয়াদবি করলে একেবারে পুলিশে দিব”………

চলবে