#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৭তম_পর্ব
“গবেষণায় বলে চুমু খেলে নাকি ছয় ক্যালোরি বার্ন হয়। “ফিল গুড” হরমোন নিঃসরণ হয় বলে মেদ গলে। যত আন্তরিকতার সাথে চুমু খাওয়া হয় তত ভালো ফলাফল। দাঁতের জন্যও চুমু বেশ উপকারী। আমার যদিও দাঁতের সমস্যা নেই, তবে বিয়েতে খাওয়াটা বোধ হয় বেশি হয়ে গেছে। হুট করে বিবাহে আমার স্ট্রেসও বেড়ে গেছে। তাই আমি কি তোমাকে চুমু খেতে পারি?”
পিউ শব্দ করে হাসলো। তার হাসি খুব রহস্যময়ী। নীলাদ্রির মনে হলো সে এতোদিন যে পিউকে দেখেছে সেই পিউয়ের সাথে এই পিউয়ের মিল নেই। লাল বেনারসীর এই নারী ভিন্ন, কোনো জটিল গণিতের সমীকরণ, কোনো দুর্লভ ফসিল যার ডিএনএ বোঝার সাধ্য নীলাদ্রির নেই অথবা হতে পারে কোনো দুর্বোধ্য কবিতার শেষ চরণ। প্রকৃতির সেই বিচিত্র রহস্য যা নীলাদ্রি কখনোই স্পর্শ করে নি। নীলাদ্রিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিউ সকৌতুক স্বরে শুধালো,
“নীলাদ্রি ভাই কি চুমু নিয়ে থিসিস করে এসেছেন?”
পিউয়ের প্রশ্নে কিঞ্চিত লজ্জা পেলো নীলাদ্রি। সে চুমু নিয়ে থিসিস করে নি। এই বিষয়গুলো সেই বয়ঃসন্ধিকালের কৌতুহলের সমাধান মাত্র। বন্ধুদের ঝোপের ভেতর মেয়ে বান্ধবীর সাথে ঘনিষ্ট হবার কারণ বের করতেই এই তথ্যের অনুসন্ধান। কিন্তু সেটা পিউকে বলতে ইচ্ছে হলো না। আসলে বিবাহ করাটা যতটা সহজ বলে ভেবেছিলো নীলাদ্রি, ততটা সহজ নয়। যতই বিবাহের কাছে সময় ঘনিয়ে যাচ্ছে ততটাই মনের মধ্যে আশংকা ডানা মেলছে। ডানা মেলছে বিবাহ পরবর্তী আচারণের। বিবাহ পরবর্তী ধাপ। প্রেমিক হলে এই ধাপ অতিক্রম করাটা হয় সহজ। প্রেমিকার অধরে হুমড়ি খাওয়া প্রেমিকার পক্ষে খুব কঠিন নয়। কোনো ভনিতা লাগে না। কিন্তু তার মতো ব্যক্তি কি করে সূচনা করবে? অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো। সে সারারাত গল্প করেই কাটাবে। কিন্তু কি গল্প করবে? তাই গুগলে টাইপ করলো, “বাসর রাতের গল্প”। ফলাফল যা আসলো তাতে গলা শুকিয়ে গেলো। এসব কি অসভ্য সমাধান! এমন আচারণ করলে পিউ কি ভাববে? না অসম্ভব। পুরুষের কামুকতাকে কখনো তেমন গুরুত্ব দেয় নি সে। সে শুদ্ধ পুরুষ। সুতরাং সে শুদ্ধই থাকবে।
কিন্তু সব শুদ্ধতা গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো পিউকে দেখে। প্রতিরোধ, কঠোর প্রতীজ্ঞা মাথা নুয়ে পড়লো। নির্লজ্জের মতো কিছু উপকারিতা সাজিয়ে চেয়ে বসলো উষ্ণ অধর স্পর্শ। এখন নিজের এমন আবদারে নিজেই লজ্জিত হতে হচ্ছে। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। পিউ বুঝলো মানুষটি বিব্রতবোধ করছে। তার এমন লজ্জামিশ্রিত মুখখানা দেখে ভীষণ মায়া হলো পিউয়ের। তাই তার কোমল হাতখানা নীলাদ্রির হাতের উপর রাখলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি আপনার স্ত্রী নীলাদ্রি ভাই, আমার কাছে চুমু খেতে চাবার জন্য এতো অজুহাতের প্রয়োজন নেই”
“জানি। কিন্তু দ্বিধা হয়। এমন অনৈতিক চাহিদা করলে তুমি যদি রাগ করো। যতই হোক, আমি তো তোমার প্রেমিক নই। প্রেমিক হলে হিসেব ভিন্ন হত”
পিউ হাসলো। আবার সেই রহস্যময়ী হাসি। হাটুতে দু হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকালো। মিষ্টি হাসিটা ঠোঁটে এটে বললো,
“কি অদ্ভুত দেখুন, আমার জীবনের প্রেম শব্দটার সূচনা আপনি। অথচ আপনি আমার প্রেমিক নন। আপনাকে নিয়ে আমার শত নির্ঘুম রাতের কবিতা, আমার মনবিণার ভৈরবী রাগের নাম আপনি। আমার মন আপনার জন্য তৃষিত নীলাদ্রি ভাই, কত বসন্ত এই তৃষ্ণা আমি আগলে রেখেছি হিসেব নেই। যে মিষ্টি অনুভূতির জন্য আমি প্রতীক্ষিত, সেই অনুভূতির স্বাদ পেলে আমি রাগ দেখাবো কি করে নীলাদ্রি ভাই?”
পিউয়ের চোখখানা ঝাপসা। হৃদয়টা ভার লাগছে। কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। মানুষ খুব আনন্দের ছোঁয়া পেলে বুঝি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। এক অচেনা ভয় হয়, ঝুলিভর্তি সুখ হারানোর ভয়। আজ পিউয়েরও সেই ভয়টা হচ্ছে। চোখের অশ্রুগুলো বোকার মত গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। হঠাৎ রুক্ষ্ণ অধরের উষ্ণ স্পর্শ পেলো চোখে। পড়ন্ত অশ্রুটি শুষে নিলো সে। তাতেই ক্ষান্ত হলো না সে। অগণিত চুমুতে ভরিয়ে দিলো সামনের বোকাপুরুষটি। চোখে, গালে, কপালে তার ঠোঁটের ছোঁয়া। পিউয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তের ঢেউ। উত্তাল জোয়ারের সর্বগ্রাসী আঘাত হানলো মনতটে। কালবৈশাখী ঝড় থেকেও প্রলয়ংকারী ঝড় উঠলো হৃদয়ে। পুরুষের স্পর্শে শিহরণ বয়ে গেলো সমস্ত শরীরে। নীলাদ্রি তার অশ্রুগুলো সযত্নে মুছে গাঢ় স্বরে বললো,
“তুমি আর কখনো কাঁদবে না পিউ। তোমার কান্না আমার কাছে অভিশাপ লাগে”
পিউয়ের অশ্রুরা সেই আদেশ মানলো না। বোকাপুরুষটিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। আকুল নিবেদন করে বসলো,
“আমি আপনাকে অসহ্যরকম ভালোবাসি নীলাদ্রি ভাই, আপনার মনশহরে আমাকে একটু ঠাঁই দিবেন?”
নীলাদ্রি তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। অদ্ভুত শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে জটিল অংকখানার সমাধানটা অবশেষে মিলে গেলো। অমীমাংসিত উত্তরটা সে পেয়ে গেছে। সে পিউকে পেয়ে গেছে। যদি এই অনুভূতি ভালোবাসা হয়, তবে সে ভালোবাসে পিউকে। হাজারবার ভালোবাসে। পিউয়ের মুখখানা তুললো আলতো হাতে। তার তিরতির করে কম্পিত ঠোঁটে মিশিয়ে দিলো অধরজোঁড়া। পৃথিবীর সকল অমৃতসুধা বৃথা এই স্বাদের কাছে বৃথা। বারোলো মদ মুখ থুবড়ে পড়বে। একটা সময় বেসামাল হয়ে উঠলো সে। ঠোঁটজোড়াকে মুক্তি দিয়ে গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি অনৈতিক দাবি করে বসলে তুমি রাগ করবে পিউ?”
পিউ হাসলো। সেই হাসিতে নীরব সম্মতি ছিলো। শুদ্ধ পুরুষ তার শুদ্ধতাকে অবিলম্বে পরিত্যাগ করে বেসামাল নষ্ট পুরুষে রুপান্তর হলো। তার উষ্ণ স্পর্শে দগ্ধ হলো পিউ। বাহিরে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। আশ্বিনা বৃষ্টি।
******
বিয়ে বাড়ি থেকে আসতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অভ্র। শরীর আর চলছে না। আজ কম শ্রম যায় নি। শ্বশুরবাড়ির হাজার ফরমাইশের পর পিউয়ের বাবার সাথে লুকোচুরি। সব মিলেই শরীরের শেষ বিন্দু শক্তিটুকুও নিঃশেষ। ঐন্দ্রিলা এসে গয়নাগুলো খুললো। মেঘ ডাকছে। তীব্র বৃষ্টি হবে। আজকাল রাত হলেই আকাশ বিরহে আচ্ছাদিত প্রেমিকার মতো কান্না শুরু করে। আজ মনে হচ্ছে একটু বেশি বৃষ্টি হবে। তবে আজকের রাতের একটা বিশেষত্ব আছে। তা হলো আজ পূর্ণজ্যোৎস্না। নির্মল রুপোর থালার মতো চাঁদখানা নিজের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য নিয়ে কালো আকাশে উন্মোচিত হয়েছে। কালো মেঘেরাও তাকে আড়াল করতে পারছে না। আঁধারিয়া আকাশে রুপালী জ্যোৎস্না, সেই সাথে শারদীয়া বৃষ্টি এক অলীক প্রকৃতি। কাঠগোলাপটাও ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সেই বর্ষণে। ঐন্দ্রিলা জানালার দিকে চেয়ে বললো,
“এই অভ্র, বৃষ্টিতে ভিজবি?”
“ক্ষেপেছে?”
অভ্র কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলো। ঐন্দ্রিলা তার উত্তরে অপ্রসন্ন স্বরে বললো,
“চল না ছাদে। কি সুন্দর বৃষ্টি। একটু ভিজি। এতো আনরোমান্টিক কেনো তুই?”
অভ্র তার হাত সরিয়ে চোখ মেললো। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“রোমান্স করতে চাইলে আমার কাছে আয়, প্রেমের বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছি। এই রাতদুপুরে শেওড়াগাছের পেত্নীর মতো ছাদে বৃষ্টিবিলাশ করতে হবে না”
অভ্রের কন্ঠে মৃদু ঠাট্টার আমেজ। ঐন্দ্রিলা কপাল কুঁচকে ক্ষুদ্ধ স্বরে বললো,
“মর তুই”
“ঐন্দ্রি, ঠান্ডা লাগবে”
ঐন্দ্রিলা পাত্তা দিলো না। তরতর করে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো। এই অলীক রাতের মোহ কাটাতে পারলো না যেন।
*****
ঝুমঝুম শারদীয়া বর্ষণ। শীতল বর্ষণের মাদকতায় দু হাত মেলে ভিজছে ঐন্দ্রিলার তুলতুলে দেহ। শাড়িটা লেপ্টে আছে পেলব শরীরে। অভ্র হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের লোহার গেটের ধারে। রাত বিরাতে নিজের স্ত্রীকে একা ছাড়তে পারে নি সে। বলা তো যায় না, কারোর নজর যদি পরে। যেমনটা তার হয়েছে। তার গাঢ় নয়ন আটকে আছে লাস্যময়ীর দিকে। আলোআঁধারিয়ায় তার প্রলেপ স্পষ্ট। পুরুষ কি এমন ভাঁজেই সুখে খুঁজে? পূর্ণচন্দ্রিমার রুপালী আলো, শীতল বারির জলকেলি আর তার পুতুল। স্বর্গীয় স্বাদ বুঝি এটাই। এমন সৌন্দর্য্যে মহাকাব্য লিখে ফেলতে পারবে যেনো অভ্র। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে হাটতে হাটতে খুঁজে পাওয়া এই তো সেই শান্তি, সেই বনলতা সেন। নিজেকে জীবনানন্দ দাশ মনে হলো যেনো অভ্রর। হাসলো। বৃষ্টির শীতলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলো সে ঐন্দ্রিলার কাছে। হাতের বেষ্টনীতে বাঁধলো পুতুলকে। শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে অনাবৃত শীতল উদরে হাতের স্পর্শ পেতে কেঁপে উঠলো ঐন্দ্রিলা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অভ্রর দিকে। নেশাতুর চাহনী ঐন্দ্রিলা। তার ঠোঁটে চুমু খেলো অভ্র। মিষ্টি স্বরে বলল,
“ঘরে যাবি না?”
ঐন্দ্রিলা দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরল। চোখে চোখ রেখে বললো,
“দেখ চাঁদটা কি সুন্দর!”
“আমার চাঁদ আরোও সুন্দর”
অভ্রর ভেজা গলদগম্ভীর নয়নে বুকের ভেতরে ঝড় উঠলো ঐন্দ্রিলার। তুমুল আবেগের ঝড়। ছাঁদের কর্নিশের কাঠগোলাপ গাছ, এই নিটল পূর্ণিমা আর শারদীয়া বর্ষণকে সাক্ষী রেখে দেখালো মস্ত বড় নির্লজ্জতা। পায়ের পাতার উপর ভর করে ভেজা ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিলো অভ্রর নিকোটিনে পোঁড়া ঠোঁটে। চুম্বন কতটা দীর্ঘ হলো সেই হিসেব রাখলো না। নিঃশ্বাসে টান পড়লে সরে এলো। মাতাল কন্ঠে বললো,
“আমি খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছি অভ্র, না চাইতেও তোর মায়ায় আটকে গেছি। আমি বোধ হয় তোকে অশৈল্যভাবে ভালোবেসে ফেলছি, যা আমার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো কিছু নয়”
“ভালোবেসে ফেলেছি” কথাটা শুনতেই মস্তিষ্কের নিউরনে আলোড়ন জাগলো। স্তম্ভিত হলো অভ্র। কিন্তু তার পুতুল আজ সব দায়রা ভেঙ্গে তাকে কাছে চাইছে। শারদীয়া বৃষ্টিবিলাশের পর সে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে প্রেমের বৃষ্টিতে ভেজার লোভে। একটু একটু করে সেই উন্মাদনায় টগবগ করে উঠলো পুরুষের নিষিদ্ধ চেতনা। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে সব প্রতিরোধ। মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে দুটো প্রাণ। একে অপরের মাঝে ডুবে যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।
****
অভ্রর বুকে লেপ্টে আছে ঐন্দ্রিলা। ঘনঘন নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে। গভীর ঘুমে সে। কিন্তু অভ্রর চোখে ঘুম নেই। ঐন্দ্রিলা তাকে ভালোবাস্তে শুরু করেছে। যে চোখে ঘৃণা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত সেই চোখে এখন কেবলই আবেগ, প্রেম। নারীর প্রেম ভয়ংকর। তারা ভালোবাসে না, আরাধনা করে। সেই আরাধনার তাপ লাভার মতো গিলে ফেলে সব কিছু। অভ্র তার আধিপত্য চেয়েছিলো, আরাধ্য হবার ইচ্ছে ছিলো না। আসক্তি হতে চেয়েছিলো, প্রেম নয়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপরাধবোধ জানান দিচ্ছে। ঐন্দ্রিলার শান্ত মুখখানার দিকে তাকালেই ব্যথা হচ্ছে। এই ভালোবাসা শব্দটির ভার সহ্য হচ্ছে না। মাথা ব্যথা করছে। অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার ফল? নাকি ঐন্দ্রিলার ভালোবাসার বর্ষণে ভেজার ফল? ভালোবাসার বিপরীতে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে হয়। নয়তো পাপীর খাতায় নাম লিখাতে হয়। পুতুলের প্রতি নিষ্ঠুর আকর্ষণ থাকে, মোহ থাকে। ভালোবাসা কি থাকে? ঐন্দ্রিলা কি তার মোহ নাকি ভালোবাসা? মাহাবুল হক কি কাউকে হৃদয় বিকিয়ে দিতে পারে? আর চিন্তা করতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী হচ্ছে। মাথাব্যথা করছে। জ্বর আসবে? প্রেমজ্বর?
*****
অভ্র তিনদিন পর আজ ঘর থেকে বের হচ্ছে। মাঝে তীব্র জ্বর হলো। ঐন্দ্রিলার অপরাধবোধ হলো। সে জানে মানুষটির ঠান্ডার বাতিক তবুও অন্যায় আবদার করেছে। সাধ্য অনুযায়ী সেবাও করেছে। অভ্রর কাছে এই অনুভূতিটা নতুন। ঐন্দ্রিলার এমন কোমলতা তার জন্য বরাদ্দ ছিলো না কখনো। কিন্তু মেয়েটির সবকিছুতে এখন সে। আধিপত্যের সাথে সাথে আরাধ্য হবার ভার অনুভূত হচ্ছে। সেও স্বামীর সকল দায়িত্ব পালন করছে। আজ ঐন্দ্রিলাকে কলেজ থেকে আনতে গিয়েছে। খরখরে রোদে বাইশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেছে। চমকে দেবার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেয়েটি এখনো বের হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই ভেতরে গেল সে। ক্যাফেটেরিয়া পার হতেই দেখা মিললো দু বান্ধবীর। ঐন্দ্রিলা অভ্রকে দেখে সত্যি চমকে গেলো। কিন্তু তার মুখে একটা লুকোচুরি ভাব প্রকাশ পেলো। হঠাৎ নজরে পড়লো ঐন্দ্রিলা কনুই চেপে রেখেছে। সেখান থেকে গলগল করে পড়ছে তাজা রক্ত। রক্ত দেখতেই মাথা ঘুরে উঠলো অভ্র। মুখখানা কঠিন হয়ে গেলো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। স্নায়ু কাজ করছে না। মেঘস্বরে জেরা করে উঠলো,
“হাতে লাগলো কি করে?”
ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে চাইলো না। কিন্তু পিউ চুপ থাকলো না। গরগর করে বললো,
“ওই যে ছাত্রদের নেতা আছে না আশরাফ, ও বাইক দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে ঐন্দ্রিলাকে। ইটের উপর পড়ে কি বাজে ভাবে কেটে গেছে দেখ। ও ইচ্ছে করে কাজটা করেছে। ক্ষমতার জোর দেখায় সবসময়। আস্তো বেয়াদব”
“কোথায় পাবো আমি তাকে?”
হিম কন্ঠে বুক কাঁপলো ঐন্দ্রিলার। অভ্রর হাত ধরে বললো,
“ঝামেলা করিস না। ছেলেটা ভালো না”
কিন্তু অভ্র শুনলো না। ফাঁকতালে পিউ বলে দিলো,
“অশ্বথ গাছের নিচে দল নিয়ে সিগারেট খাচ্ছে”
অভ্রর শিরা উপশিরার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। রাগে তার গা কাঁপছে। তার পুতুলকে ব্যথা দেবার কথা কেউ কল্পনাও কিকরে করে? এদিকে তার রুদ্রমুর্তিতে ভয় প্রগাঢ় হলো ঐন্দ্রিলার। একবার এক জুনিয়র ঐন্দ্রিলার প্রতি নিষিদ্ধ চিন্তা করেছিলো বলে তাকে বেদম পিটিয়েছিলো অভ্র। আজ হয়ত খু’ন করে ফেলবে। ঐন্দ্রিলা বাঁধা দিতে চাইলো কিন্তু শুনলো না অভ্র। হনহন করে অশ্বথ গাছের কাছে গেলো। আশরাফ সেখানে দু পাঁচটা ছেলের সাথে সুখটান দিচ্ছে গাঁজার স্টিকে। গাঁজার গন্ধে নাড়িভুড়ি উগড়ে যাবার যোগাড়। এই ছেলেটিকে সবাই এড়িয়ে চলে। একেই রাজনীতি করে, উপরন্তু অভদ্র এবং অসভ্য। বাজে স্বভাব তো আছেই, সেই সাথে অর্থের গরম আছে। কাউকে পরোয়া করে না। কিন্তু অভ্রর জেদি স্বভাবের কাছে তার স্বভাব খাটল না। একপ্রকার নির্ভীক চিত্তে তার সামনে দাঁড়ালো। আশরাফ গাঁজায় রক্তিম চোখ তুলে হুংকার ছাড়লো,
“কি চাই?”
অভ্র উত্তর দিলো না। একহাতে তার কলার ধরে টেনে তুললো। তারপর ছিটকে ফেললো মাটিতে। আশরাফের সাঙ্গপাঙ্গ্রা তটস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র ক্ষান্ত রইলো না। বেধরক মা’রতে লাগলো। ঘায়েল বাঘের মত গর্জালো,
“আমার পুতুলের গায়ে হাত দেবার সাহস হলো কি করে তোর? জানোয়ার কোথাকার”
মা’রের ফলে আশরাফের গাল ফুলে গেলো। গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো। কিন্তু অভ্র থামলো না। উন্মাদের মতো তাকে ঘু’ষির পর ঘু’ষি মা’রতে লাগলো। আশরাফ প্রতিরক্ষাও করতে পারলো না। তার ঠোঁট কেটে ঝুলে গেলো। সে আধমরার মত মা’র খাচ্ছে। তার দলবল ঠেকাতে এলো, কিন্তু অভ্রর মাথায় খু’ন ভর করেছে। আজ প্রা’ণ নিতেও তার কোনো দ্বিধা নেই। কলেজে সকলে জড়ো হয়ে গেলো। আতঙ্ক গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। ঐন্দ্রিলা ছুটে গেলো অভ্রকে থামাতে। পাছে অঘটন না হয়। অভ্র হাত ধরে অনুরোধ করলো,
“অভ্র ছেড়ে দে”
কিন্তু অভ্র তার সজ্ঞানে নেই। সজোরে ধাক্কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে আবার পেটাতে লাগলো আশরাফ ছেলেটিকে। হঠাৎ চিৎকার কানে এলো পিউয়ের,
“অভ্র, ঐন্দ্রিলা”
অভ্র থেমে গেলো। আধমরা আশরাফের কলার ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। ভাঙ্গা ইটের স্তুপে নিথর পড়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার মাথার পেছন থেকে বইছে টকটক রক্তিম লোহুস্রোত………
চলবে
#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৮তম_পর্ব (প্রথম অংশ)
আধমরা আশরাফের কলার ছেড়ে পেছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। ভাঙ্গা ইটের স্তুপে নিথর পড়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার মাথার পেছন থেকে বইছে টকটক রক্তিম লোহুস্রোত। পিউ কান্নাভেজা স্বরে ডেকে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে। কিন্তু তার সাড়া নেই। অভ্রর পাজোড়া ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ দু টন পাথর বেঁধে দিয়েছে। চলতেই চাইছে না। রক্তাক্ত ঐন্দ্রিলার দৃশ্যটি এতো বিশ্রী লাগছে কেনো? ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে কেন?
****
সাদা টাইলসের করিডোরের নীল প্লাস্টিকে নতমস্তকে বসে আছে অভ্র। তার টিশার্টটা ভিজে আছে রক্ত। হাত জোড়ার রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে। কি বিশ্রী তীক্ষ্ণ গন্ধ। কিন্তু হেলদোল হলো না অভ্রর। কেমন অনুভূতিশূন্য চোখজোড়া। পিউ তার পাশে বসে আছে। অঝোরে কাঁদছে। তার কান্নার স্বর কানে বিঁধছে কাঁটার মত। তার কান্না দেখে যে কেউ ভাববে ঐন্দ্রিলা মারা গেছে। অন্যসময় হয়ে অভ্র রামধমক দিয়ে বসতো। কিন্তু আজকে সে নিশ্চুপ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মেঝের দিকে। তীব্র বিরহে মনখানা দূর্বল হয়ে আছে। কথা বলতেও অনীহা লাগছে। গলার কাছটায় মনে হচ্ছে কাঁটা বিধে আছে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখখানা জ্বলছে। বুকে তীব্র হাহাকার জড়ো হয়েছে। কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র উত্তেজনা তাকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঐন্দ্রিলার নিথর দেহখানা দেখার পর থেকেই এই অনুভূতি হচ্ছে। সেই প্রথমবার হাত কাঁপছিলো অভ্রর। জমে যাওয়া পাগুলো কোনোমতে টেনে ঐন্দ্রিলার কাছে গেলো। খুব ক্লান্ত স্বরে দুবার ডাকলো,
“ঐন্দ্রি, এই ঐন্দ্রি?”
কিন্তু ঐন্দ্রিলা সাড়া দিলো না একবারো। ঘটনায় লোকজনের চঞ্চলতা বাড়লো। পিউ বিধ্বস্তের মতো সাহায্য চাইতে লাগলো। জমায়েত ছাত্রদের মধ্যেই একজন এম্বুলেন্স ডাকলো। অভ্র তখনো নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঐন্দ্রিলার দিকে। সব কিছু যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই প্রথম বোধ হয় মাহাবুক হক অভ্র ভুলে গেলো তার কি করা উচিত। এই প্রথম বোধ হয় সে নিজের চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পিউ তাকে ধাক্কা দিলে সে অর্বাচীনের মত চাইলো। পিউ অধৈর্য স্বরে বললো,
“ঐন্দ্রিলাকে তোল”
“ও কি ম’রে যাবে?”
অভ্র বিড়বিড় করে আওড়ালো। পিউ উত্তর দিতে পারলো না। চোখজোড়া ভিজে এলো তার। ভেজা স্বরে বললো,
“এখন এসব বলার সময় নেই অভ্র। ঐন্দ্রিলাকে হাসপাতালে নিতে হবে”
অভ্র আর প্রশ্ন করলো না। অনুভূতিশুন্য মানুষের মতো কোলে তুলে ঐন্দ্রিলাকে এম্বুলেন্সে উঠালো। পুরোটা রাস্তা তার হাতখানা ধরে থাকলো। যেনো হাতটা ছেড়ে দিলেই ঐন্দ্রিলা হারিয়ে যাবে চিরতরে। হাসপাতালে আনার পর প্রায় আধঘন্টার মাঝেই ঐন্দ্রিলাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হয়েছে। এখনো অপারেশন চলছে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গিয়েছে। নার্স শুধু একবার বেড়িয়ে বলেছে,
“রক্তের প্রয়োজন, রক্ত যোগাঢ় করেন এ পজেটিভ”
অভ্র তখন অনেক কষ্টে শুধিয়েছিলো,
“ঐন্দ্রিলা কেমন আছে?”
“অবস্থা ভালো না। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন। দোয়া করেন যেনো ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ না হয়। ইটে বাজেভাবেই আঘাত পেয়েছেন। স্কাল ফ্রাকচার হয়েছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখছেন”
খ্যাচখ্যাচে গলায় কথাটা বলেই নার্স চলে গেলো। পিউ সাথে সাথেই বাসায় ফোন করেছে। নিজের পরিচিত কিছু মানুষকে রক্তের জন্য ফোন করেছে। অভ্র কখনো নির্বোধের মতো তাকিয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের দিকে। বুকখানা কাঁপছে তার, তার পুতুল ফিরবে তো? এতো অশান্তি লাগছে কেনো? এই অনুভূতি কতৃত্ব হারাবার নয়। প্রিয় খেলনাটা ভেঙ্গে যাবার নয়। এই অনুভূতি তার থেকেও গাঢ়, বুকের বা পাশের ব্যথাটা খুব তীক্ষ্ণ। খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলার তিতকুটে অনুভূতি এটা। অভ্রর মনে হলো তার পৃথিবীটা কেমন থেমে গেছে। কেউ তার সাজানো জীবনে বিরহের কালো রঙ ঢেলে দিয়েছে। সব শুন্য লাগছে। নিজেকে অসাড় লাগছে। প্রাণহীন লাগছে সব কিছু। পুতুল ভাঙ্গার যন্ত্রণা কি এতো গভীর হয়?
*****
পিউয়ের ফোন পাবার প্রায় পনেরো মিনিটের মাঝেই সাবেরা, সালাম সাহেব এবং নীলাদ্রি ছুটে এসেছে। তার দশ মিনিট পর কানন, ইদ্রিস সাহেব, আউওয়াল সাহেব এবং বিল্লাল এসে পৌছালো হাসপাতালে। নীলাদ্রি পিউয়ের কাছে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালো,
“ঐন্দ্রিলা কোথায়?”
“ও.টিতে”
“তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যা”
খুব ক্ষীন স্বরে উত্তর দিলো পিউ। তার মুখ দেখে মোটেই ঠিক মনে হলো না। খুবই বিধ্বস্ত লাগলো তাকে। কাঁধতে কাঁধতে চোখজোরা ফুলে গেছে। নীলাদ্রি তাকে সান্ত্বনার স্বরে বললো,
“ঐন্দ্রিলার কিছু হবে না”
পিউ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। সাবেরা অভ্রর সামনে দাঁড়িয়ে রুঢ় স্বরে শুধালো,
“কি করে হলো এমন? আমার মেয়ে এখন অপারেশন থিয়েটারে কেন?”
অভ্র উত্তর দিলো না। এখনো মেঝের দিকেই চেয়ে রইলো। তাকে জড়োবস্তুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে নিয়ন্ত্রণ হারালেন সাবেরা। সর্বোচ্চ শক্তিতে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো অভ্রর গালে। তার এমন আচারণে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। কানন কিছু বলতে চাইলো ছেলের সাফাই গেয়ে। কিন্তু ইদ্রিস সাহেব আটকে দিলেন। আউওয়াল সাহেবও রুষ্ট চিত্তে বসে রইলেন। যতই হোক আজ তার ঘরের বউ ও.টিতে। সাবেরা চিৎকার করে উঠলো,
“আমি ভরসা করে মেয়েকে তোমার হাতে দিয়েছিলাম। ওকে লাশের মতো শুয়ে থাকতে দেখার জন্য তোমার সাথে বিয়ে দেই নি। এতো রাগ হবে কেনো তোমার? আজ তোমার জন্য ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা? এই তোমার ভালোবাসা?”
“সাবেরা শান্ত হও। এটা হাসপাতাল”
“কেনো শান্ত হবো আমি, আমার মেয়ে মরতে বসেছে। যদি ওর কিছু হয়ে যায়? ও যদি, ও যদি…”
কথাটা শেষ করতে পারলো না সাবেরা। তার গলা ধরে এসেছে। মেয়ে যে তার খুব আদুরে সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও মা-মেয়ের সমীকরণটা ভিন্ন। নিজেদের আত্মজেদের কারণে নিজেদের মাঝে বিশাল বড় অভিমানের পাহাড় গড়েছেন। কিন্তু ভালোবাসায় তো খামতি নেই। সালাম সাহেব স্ত্রীকে শান্ত করতে চাইলেন। অভ্র তখনো নিশ্চুপ। তার মুখে কথা নেই। মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। রক্তের তাগিদা দিতে আবারো নার্স এলো। বিরক্ত স্বরে বললেন,
“রক্ত কোথায়?”
নীলাদ্রি এবং বিল্লাল এগিয়ে গেলো। তাদের রক্ত “এ পজেটিভ”। এর মাঝেই ঘটলো বিপদ। কোথা থেকে পুলিশ উপস্থিত হলো। আশরাফের অবস্থা ভালো নয়। আইসিউতে ভর্তি, জ্ঞান ফিরে নি। তার পরিবারের অর্থ, ক্ষমতার অভাব নেই। তাদের ছেলেকে কেউ মে’রে যাবে সেটা তো হয় না। অভ্রর নামে জি.ডি করেছে তারা। ফলে পুলিশ এসেছে অভ্রকে গ্রেফতার করতে। পুলিশ যখন তার হাতে হাতকড়া পড়াতে গেলো, তখন অভ্র তার নিরবতা ভাঙ্গলো। অনুনয়ের স্বরে বললো,
“আমার পুতুলকে এখনো ওরা ওই দরজা থেকে বের করে নি, আমাকে এখনই নিয়ে যাবেন না দয়া করে”………
চলবে
#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৩৮তম_পর্ব (শেষ অংশ)
“আমার পুতুলকে এখনো ওরা ওই দরজা থেকে বের করে নি, আমাকে এখনই নিয়ে যাবেন না দয়া করে”
সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র অনুনয় করছে। তার কন্ঠ ভেজা। তীব্র বিরহে আকন্ঠ ডুবন্ত তার চোখজোড়া। কিন্তু আইনি লোকের কাছে আবেগময় কথার মূল্য থাকে না। তাদের হতে হয় কঠিন, দয়ামায়াহীন। অপরাধীদের সাথে দয়ার স্থান নেই। তাই পুলিশরাও শুনলো না। হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে এখনি। ইদ্রিশ সাহেব, সালাম সাহেব বাধা দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। কানন মুখে আঁচল গুজে কাঁদতে লাগলো। খুব অসহায় লাগছে তার। ছেলের বউ অপারেশন থিয়েটারে। এখন ছেলেকে জেলে নিয়ে যাচ্ছে। এমন দিন কখনো দেখবেন সেটা তো আশা করেন নি। সাজানো সংসারে কার নজর লাগলো। গতকালও একত্রে রাতের খাবার খেয়েছিলেন সবাই। আড্ডার রোল পড়েছিলো। কি সুন্দর সংসার তার। অথচ এখন সব ই কাঁচের মতো চূর্নবিচূর্ন লাগছে। সাবেরা কঠিন মূর্তির মত বসে আছে। তার কিচ্ছু যায় আসে না। তার চিন্তা তার মেয়েকে নিয়ে। ইদ্রিশ সাহেব রুষ্ট স্বরে শুধালেন,
“আমার ছেলেকে কেনো ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? কি দোষ করেছে সে?”
“আশরাফ হোসেন নামক ছেলেটিকে বেরহমের মতো পিটিয়েছে। এখন সে আইসিউতে। জ্ঞান ফিরে নি। তার পরিবারের লোক জিডি লিখিয়েছে। কলেজে গুন্ডামি করে বেড়ায় আবার বড় গলায় জিজ্ঞেস করেন কি করেছে। উনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। যদি কিছু বলার থাকে থানায় বলবেন”
পুলিশের তাড়া। তারা অভ্রকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। তার চোখজোড়া তাকিয়ে রইলো অপারেশন থিয়েটারের দিকে। এই বুঝি কেউ খবর দিবে। কেউ তো বের হবে। কাতর স্বরে বললো,
“আমি কথা দিচ্ছি অপারেশন শেষ হয়ে আমি আপনাদের সাথে জাহান্নামেও যাবো। দয়া করে আমার পুতুলের অপারেশনটা শেষ হোক”
কেউ শুনলো না। তিন জন কন্সটেবল তার ঘাড় ধরে গাড়িতে ভরলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো চালক। একটা সময় হাসপাতাল ছাড়িয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। অভ্র বাহিরে তাকিয়ে রইলো। হৃদয়ের ব্যাথাটা তীব্র হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেললেও হয়তো শান্তি মিলবে না।
*****
থানার হাজতের মেঝেতে বসে আছে অভ্র। ডান হাতের রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। হাতখানা ফুলে আছে। কিন্তু তার অনুভূতিশূন্য। এই হাতের জন্যই আজ ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা। কি করে পারলো সে ঐন্দ্রিলাকে ধাক্কা দিতে। আজ তার জন্য ঐন্দ্রিলার এই অবস্থা। এই রক্ত তো সামান্য শাস্তি মাত্র। হাতখানা কেঁটে ফেলতে হচ্ছে। এতোটা গ্লানি কখনো অনুভূত হয়েছিলো কি অভ্রর? জানা নেই। এই প্রথম হয়তো গ্লানি, আফসোসের অনুভূতি হচ্ছে।
“ভাইজান কি কানতেছেন?”
পাশের এক কয়েদির কন্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো অভ্র। তার দিকে অর্বাচীনের মতো চাইল সে। ছোট ছেলে, কত বয়স হবে? উনিশ অথবা বিশ। হ্যাংলা, শুকনো চেহারায় উশখোখুশকো কিছু অনিয়ন্ত্রিত দাড়ি। মুখখানা ফুলে আছে৷ চোখের কাছটায় রক্ত জমাট। ভ্রুর কাঁটা অংশে রক্তরস বের হচ্ছে। চুরি করে ধরা পড়েছে বলে গণপিটুনি খেয়ে এখন জেলে। সে হাসি মুখে বললো,
“কাইন্দেন না, ওরা বেশিক্ষণ ধইরা রাখবো না। ঘন্টাখানেক পর এমনেই ছাইড়ে দিবো। আপনেও কি চুরি করছিলেন?”
অভ্র মাথা নাড়লো। ছেলেটা কৌতুহলের সাথে শুধালো,
“তাইলে?”
“একজনকে পিটিয়ে আইসিউতে পাঠিয়েছি”
“এতো বিশাল সংবাদ। তয় আপনি কান্দেন কেন? আমি যতদূর জানি যারা মা’রে তারা কান্দে না! যারা মা’রে তারা হাসে”
অভ্র উত্তর দিলো না। তার গাল কি ভিজে গেছে? শেষ কবে কেঁদেছিলো সে? অভ্র নিজেও জানে না সে কাঁদছে কেনো! শুধু এতোটুকু অনুভূত হচ্ছে, তার ঐন্দ্রিলার কিছু হলে সে হয়তো নিজেকে সুস্থ রাখতে পারবে না। আচ্ছা ঐন্দ্রিলা কেমন আছে? সুস্থ আছে তো? ওর জ্ঞান ফিরেছে? মেয়েটা যতই ভাব দেখাক সে ভেতর ভেতর বড্ড ভীতু। সে কি অভ্রকে খুঁজছে? আজকাল অভ্রকে সে চোখে হারায়। অভ্রর যখন জ্বর হলো কি দুশ্চিন্তা তার। তিনটে দিন মেয়েটির জীবন যেনো ওষ্ঠাগত হয়েছিলো। ক্ষণে জ্বর মাপা, কি খাবে না খাবে নিয়ে ব্যস্ততা। ঘন্টায় ঘন্টায় চা বানিয়ে দেওয়া, ডেঙ্গু হলো কি না সেই নিয়ে চিন্তা আলাদা। তার জীবন যেনো পরিক্রমণ করছে অভ্রকে ঘিরে। অভ্রর বাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে ঐন্দ্রিলার এমন মিষ্টি ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া। আচ্ছা, ঐন্দ্রিলা ছাড়া জীবনটা কেমন হবে? কথাটা ভাবতেই বুকখানা কেঁপে উঠলো। তখন ই একজন কন্সটেবল এসে হাজতের দরজা খুলে দিলো। কর্কশ স্বরে বললো,
“আপনার জামিন হয়ে গেছে”
অভ্র জেল থেকে বেরিয়ে দেখলো অসি সাহেবের সামনে পিউ এবং আউওয়াল সাহেব বসে আছেন। অসি তাদের নোনতা বিস্কিটের সাথে লাল চা খেতে দিয়েছেন। আউওয়াল সাহেব চা খেলেন না, কিন্তু সৌজন্যতাবোধের জন্য একটা নোনতা বিস্কিট খেলেন। অভ্র আসতেই অসি সাহেব হাত বের করে বললেন,
“জোয়ান পোলাপাইন, রক্ত গরম। মাথায় রক্ত উঠলেই মারতে ইচ্ছে করে। বাবা এমন আর কইরো না ঠিক আছে? হেহে”
অভ্র দাদাজানকে দেখে মাথা নামিয়ে ফেললো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অসি সাহেব খুব অতিথি আপ্প্যায়ন করছেন আউওয়াল সাহেবের। কারণ তিনি অভ্রর গ্রামের ছেলে। তার পড়াশোনার সময় আউওয়াল সাহেব টাকাও ধার দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে খুব সম্মান করে সে আউওয়াল সাহেবকে। সেজন্য তিনি একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছেন। উপরন্তু পিউ আশরাফের বিরুদ্ধে অ্যাবিউজের কেস করবার হুমকি দিয়েছে, ঐন্দ্রিলার আজকের অবস্থা আশরাফের জন্য এমন দাবিও তার। কয়েকজন বন্ধুদের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে তৈরি করেছে। আশরাফের জ্ঞান ফেরাতে হুমকিটা ভাল করেই কাজে লেগেছে। ফলে কেস উঠিয়ে নিয়েছে আশরাফের পরিবারের লোকজন। এজন্য চারঘন্টা পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছে অভ্র। আউওয়াল সাহেব অভ্রর সাথে কথা বললেন না। অসিকে আন্তরিক স্বরে বললেন,
“হেলাল, তোমার অনেক ধন্যবাদ”
“কাকা যে কি বলেন! আপনাকে সহায়তা করতে পেরেছি এটা আমার সৌভাগ্য”
“আজ তাহলে উঠি”
“জি কাকা”
*****
থানার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে বিল্লাল। অভ্র তাকে দেখেই প্রথম যে কথাটা শুধালো,
“ঐন্দ্রি কেমন আছে?”
বিল্লাল চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
“তুই কি ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে চিন্তিত?”
তার কন্ঠে ভৎসনার তীক্ষ্ণতা অনুভূত হলো। অভ্রর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ক্রোধিত স্বরে বলল,
“ফাজলামি করতেছিস?”
“ফাজলামিটা শুরু করেছে অভ্র?”
খুব শান্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন শুধালো বিল্লাল। বিদ্রুপ টেনে বলল,
“শখের পুতুল কি সারাজীবন থাকে? একটা সময় তো নষ্ট হয়ে যায়, পুরানো হয়ে যায়। আর পুতুল যেহেতু তাকে ভালোবাসার সাথে রাগও সহ্য করতে হবে। ঐন্দ্রিলাও সেটাই সহ্য করছে। রাগ হয়েছে ভেঙ্গে ফেলেছিস তুই? সমস্যা নেই, খেলনা ভেঙ্গে গেলে এমন কষ্ট সব বাচ্চাদের হয়। নতুন খেলনা পেয়ে গেলেই ভুলে যাবি”
বিল্লালের শান্ত স্বরে কথাগুলোর ধার ক্ষতমাংসে পচন ধরানোর মতো যন্ত্রণা দিলো যেনো। অভ্র নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। গলা চেপে ধরলো নিজের পরম বন্ধুর। তার চোখ লাল হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত। এখন ই খু’ন করে ফেলতে পারে বিল্লালকে। বিল্লাল হাসলো। খুব নরম স্বরে বলল,
“গ্রো আপ অভ্র। পুতুল পুতুল করে যার সাথে খেলে এসেছিস তাকে ভালোবেসে ফেলেছিস তুই। সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র প্রেমে পড়েছে। আকন্ঠ প্রেমে ডুবেছে। মেনে নে। ঐন্দ্রিলা তোর আসক্তি নয়। কখনো ছিলো না। তুই সারাটাজীবন ওকে ভালোবেসেছিস। যদি তা না হত তাহলে আজ তুই এতো বিধ্বস্ত হতি না। পাঁচ বছর আগেও যখন ঐন্দ্রিলা তোর মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলো একই অবস্থা হয়েছিলো তোর। ওর মনোযোগ আকর্ষণে পাগল হয়ে গিয়েছিলি। পাগলও তোকে দেখে বলে দিবে তুই প্রেমে দেবদাস হয়ে গিয়েছিস”
বিল্লালের গলা ছেড়ে দিলো অভ্র। মস্তিষ্ককোষের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলো। সে ঠকায় নি ঐন্দ্রিলাকে। সে ঠকায় নি।
*****
হাসপাতালে ঐন্দ্রিলাকে দেখার সুযোগ পেলো না অভ্র। ঐন্দ্রিলার একটি ব্রেইন সার্জারি হয়েছে। ইটের উপর পড়ার কারণে তার ডিফিউজ এক্সোনাল ইঞ্জুরি নামক ট্রমাটিক ব্রেইন ইঞ্জুরি হয়েছে। যার ফলে মস্তিষ্কের পশ্চাৎভাগের এক্সন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মোট তিন ঘন্টার অপারেশন ছিলো। নয়টা সেলাই লেগেছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি ঐন্দ্রিলার। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ডাক্তাররা বেশ চিন্তিত। বারবার মিটিং বসছে। শহরের বড় নিউরোসার্জনকে ডাকা হয়েছে। জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছু বলা যাচ্ছে না। সাবেরার নিষেধাজ্ঞার জন্য এক পলক তাকে দেখতে দেওয়া হয় নি। সালাম সাহেব কোনোমতেই স্ত্রীকে বোঝাতে পারে নি। নীলাদ্রি বোঝানোর চেষ্টাও করে নি। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, অভ্রকে প্রচুর মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হাসপাতালে অসভ্য মানুষের মত মারপিট অশোভনীয়। অভ্র অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলো ভোর অবধি। অবশেষে তাকে জোর করে কানন বাড়ি দিয়ে আসলো।
*****
ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো অভ্র। ঘরময় ঐন্দ্রিলার গন্ধ। ঐন্দ্রিলার জামাকাপড়গুলো এলোমেলো হয়ে পরে আছে বিছানার উপর। অভ্র জামাটা হাতে নিলো। নাকের কাছে ধরে বসে রইলো। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। চোখখানা জ্বলছে। ঘরের সব কিছু ভেঙ্গে ফেললে ই এই হাহাকার থামবে। দমবন্ধ লাগছে। টেবিলের উপর ঐন্দ্রিলার বইখাতাগুলো হা করে খোলা। মেয়েটির সামনে পরীক্ষা। পড়তে পড়তে খোলা রেখেই চলে গেছে। এসে আবার চিৎকার করবে কেনো বইগুলো কেউ গুছায় নি। অভ্র টেবিলের সামনে যেতেই চোখে পড়লো খাতায় কাটাকাটি করে কিছু লেখা। খাতাটা হাতে নিতেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। ঐন্দ্রিলা চিঠি লিখেছে। চিঠিটা পড়তে শুরু করলো অভ্র,
“অপ্রিয়, অসভ্য, নির্লজ্জ পুরুষ,
প্রিয়র তালিকায় তোকে আমি কখনোই রাখতে পারলাম না অভ্র। তোর মনে আছে আমার প্রিয় পুতুলটা কি বিশ্রীভাবে ভেঙ্গেছিলি তুই? বিনিময়ে আমি তোর হাত কামড়ে রক্তাক্ত করেছিলাম। সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। তোর কাজ ই তো আমাকে কাঁদানো। মনে আছে, স্কুলে আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিলি। তোর জন্য আমার মাজা অবধি চুল কেটে ফেলতে হয়েছিলো। তোর জন্য আমাকে শুধু কাঁদতে হয়েছে। আমাদের ছেলেবেলা ঠিক যেন এক চিরন্তন দ্বন্দ্বের কাব্য। শৈশব, কৈশর—আমরা পাশাপাশি থেকেও যেন দূরে ছিলাম। তুই ছিলি আমার চিরশত্রু, যে প্রতিনিয়ত আমাকে খোঁচা দিত, বিদ্রুপের আগুন জ্বালিয়ে রাখত। আমাদের শৈশবের সেই ঝগড়াগুলো ছিল যেন প্রতিদিনের নিয়ম, কৈশরের সেই অভিমান আমাদের গল্পের উপত্যাকায় টানা সেই বিরামচিহ্ন। আমাদের সমীকরণটা কতো ভিন্ন তাই না? কখনও কথার তীর, কখনও অবজ্ঞার আঘাত। বিয়েটাও ছিলো কোনো নাটিকার মধ্যাংশের মতো।
তবে আজ সবটাই মনে হয় অহেতুক, সেই শত্রুতার আড়ালে কিভাবে যেনো অনুভব করছি এক অদ্ভুত টান, এক অমোঘ আকর্ষণ। তুই হয়ে গেলি আমার জীবনের এমন এক উপস্থিতি, যাকে উপেক্ষা করতে চেয়েও পারছি না। তোর সঙ্গ, তোর প্রতিটা তর্ক যেন আমার প্রতিদিনের প্রয়োজন। তুই আমার রাগের কারণ, আবার সেই রাগের মাঝে লুকিয়ে ছিল এক মিষ্টি অনুভূতি, কি অদ্ভুত তাই না?
তুই, যে একসময় ছিলি আমার শত্রু, আজ আমার হৃদয়ের গভীরে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছিস যে, তোকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবা যায় না। তোর সেই বিদ্রুপের হাসি, যে হাসি একদিন আমাকে বিষময় মনে হতো, আজ তা যেন আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর সুর। তোর প্রতিটা ঝগড়া, প্রতিটা খোঁচা আজ প্রেমের এক অমলিন রং মাখা স্মৃতি।
তুই-ই আজ আমার জীবনের কবিতা, তুই-ই আমার সমস্ত অনুভূতির ভাষা। তুই-ই আমার সমস্ত চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, তুই ছাড়া আমার জগৎ আজ শূন্য। তোকে মেঘেদের সাথে গল্প করতেও আমার ক্লান্তি আসে না। আমি আর কাঠগোলাপের কাছে তোর নালিশ করি না। বরং চাঁদের জ্যোৎস্নার নিচে তোর মাঝে ডুবে থাকার পায়তারা করি। আচ্ছা, শত্রুতার এই গল্প থেকে কি আমাদের সমীকরণ বদলাবে? প্রণয়ের মিষ্টতা মিশে কি আমরা লিখতে পারবো কোনো মহাকাব্য? কি মনে হয়? আমার প্রেমে পড়তে পারবি অসভ্য ছেলে! উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইতি
তোর একমাত্র বউ
অভ্র চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে অশ্রুকনা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। পুরুষদের কি কাঁদতে আছে? কিন্তু আজ যে মনটা ভার হয়ে আছে। এই অশ্রুগুলো যার জন্য সে কি কখনো জানবে, এই অভদ্র ছেলেটি শুধু কাঁদাতে নয়, কাঁদতেও পারে।
*****
আজ এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ঐন্দ্রিলার জ্ঞান ফিরেছিলো পরদিন। মাথার আঘাতটা খুব গুরুতর নয়। আইসিউ থেকে আজ কেবিনে শিফট করা হবে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। লম্বা চুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে ছয়মাস রেস্ট নিতে হবে। মস্তিষ্কে কোনো চাপ দেওয়া যাবে না। যা ক্ষতি হয়েছে তার বিশ্রাম এবং ঔষধই যথেষ্ট। সেলাই শুকাতে সময় লাগবে। সবাই তাকে সময় সময় করে দেখা করতে এলেও অভ্র এখনো আসে নি। তার চোখজোড়া তো শুধু তাকেই খুঁজছে। আর না পেরে সাবেরাকে শুধিয়েই বসলো,
“অভ্র কোথায়? ও আসে না কেনো আমাকে দেখতে?”
সাবেরা উত্তর দেয় না। নীলাদ্রি কিছু বলে না। অবশেষে কেবিনে শিফট করা হলো ঐন্দ্রিলাকে। শ্বশুরবাড়ির সবাই এসেছে আজ একসাথে। সুযোগ পেয়ে কাননকে শুধালো,
“মা, অভ্র কোথায়? ও কি খুব ব্যস্ত?”
কথাটা বলতেই গলা ধরে এলো ঐন্দ্রিলার। কানন মলিন হাসলো। সাবেরার দিকে তাকালো। সাবেরা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কাননও কম জেদি নয়। এতোদিন ঐন্দ্রিলার অসুস্থতা এবং ছেলের নিরবতায় সে মেনে নিয়েছে সবকিছু। আর নয়। মলিন স্বরে বলল,
“সাবেরার কার্ফিউ ভেঙ্গে কি করে তোমাকে দেখতে আসবে সে। যতই হোক দোষী সে, তাই শাস্তি তো প্রাপ্য”
“মানে?”
“আমার ছেলেটা বাহিরে বসে আছে। এখন নয়। এই সাতটা দিন সে তীর্থের কাকের মত বসে ছিলো আইসিউ এর বাহিরে। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। সে অপেক্ষা করছে তার পুতুলের”
ঐন্দ্রিলার হতবাক বসে রইলো। চোখজোড়া ঝাপছা হয়ে আসছে। অভিমানী স্বরে বললো,
“সে তো কারোর কথা শোনার মানুষ নয়। তাহলে?”
“তোমার জন্য সে সবকিছু মেনে নেয়”
“তাহলে তাকে বলুন আমি ডাকছি”
কানন হাসলো। সাবেরা দ্বিরক্তি করার সুযোগ পেলো না। কানন অভ্রকে টেনে কেবিনে নিয়ে এলো। অভ্র নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো দরজার ধারে। ঐন্দ্রিলার মেজাজ খারাপ হল খুব। রাগী স্বরে বললো,
“মরে গেলে আসিস”
এই বাক্যটাই যেন যথেষ্ট ছিলো অভ্রকে নাস্তানাবুদ করতে। একপ্রকার ছুটে এলো সে। উন্মাদের মত জড়িয়ে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। মুহূর্তবাদে ঐন্দ্রিলা অনুভব করলো তার কাঁধে উষ্ণতরলের উপস্থিতি। অভ্র কাঁদছে?………
চলবে