#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#৪১তম_পর্ব
অভ্র নিচে নামলো তিনটে বড় বড় ট্রলির সাথে। ঐন্দ্রিলার মুখে আষাঢ়ের মেঘ। কানন মনক্ষুন্ন স্বরে শুধালো,
“এতো ব্যাগ কেনো? ঐন্দ্রিলা কি চিরকালের জন্য যাচ্ছে নাকি। পাশেই তো। যখন তখন জামাকাপড় নিয়ে যেতে পারবে”
“না মা, এখানে শুধু ঐন্দ্রিলার কাপড় নয়। আমারও কাপড় আর জিনিসপত্র আছে। আমিও তিন/চার মাসের জন্য শ্বশুরবাড়ি শিফট হচ্ছি”
অভ্রর ঘোষনায় বসার ঘরে উপস্থিত সকলে আশ্চর্যে স্তম্ভিত হলো। আউওয়াল সাহেব অবিশ্বাস্য চোখে তাকালেন নাতীর দিকে। সাবেরার মুখখানা হতবিহ্বল হয়ে গেলো। কানন কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঐন্দ্রিলা চমকালো কিঞ্চিত। কিন্তু পরমুহূর্তে শরতের এক পশলা বৃষ্টি বাদের নির্মল সমীরের দোলা খেয়ে খেলো মানসপটে। আনন্দটা উঁকি দিলো চোখের ফেলো। ইদ্রিশ সাহেব নির্লিপ্ত বসে আছেন। তার দৃষ্টি প্রথম আলোর পঞ্চম পাতায় আটকে আছে। জাগতিক বিষয়সমূহে তার আগ্রহ নেই। যা পারে করুক। কানন বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“আসলেই?”
“হ্যা, এতে এতো অবাক হবার কি আছে?”
সালাম সাহেব গলা খাকারি দিলেন। মস্তিষ্কে তার গোয়াড় জামাইকে কি বলবেন, সে প্রশ্ন দাঁড় করালেন। তারপর বিনীত স্বরে শুধালেন,
“তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে?”
শ্বশুরের প্রশ্নে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে অভ্র উত্তর দিলো,
“আজ্ঞে হ্যা, আমার বউকে আমি একা ছাড়বো না। স্বামী হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব আছে, সেটা তো ভুলে যেতে পারি না। তাই ঢেং ঢেং করে বউকে বাপের বাড়ি পাঠাতে পারছি না”
সালাম সাহেব কিছুটা বেকুব বনে গেলেন। এই ছেলে ত্যাদর প্রকৃতির। তার কথাবার্তার ধার সবসময়ই বেশি। বিয়ের আগ থেকেই দেখে এসেছেন সালাম সাহেব। একমাত্র এই জামাই ই তার মতো মানুষকে নাস্তানাবুদ করতে পারে কথার প্যাচে। তিনি এখনো হতবিহ্বল ভাবটা কাটাতে পারলেন না। বিমূঢ় স্বরে বললেন,
“তাই বলে শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকবে?”
“কেনো বাবা, আমার বউ যদি তার শ্বশুরবাড়িতে দিনের পর দিন পড়ে থাকতে পারে আমি কেনো পারবো না? আমাকে আপনারা নিতে না চাইলে নিবেন না, আমিও আমার বউকে নিয়ে যেতে দিবো না। সে এখন সালাম মজুমদারের মেয়ে পরে, সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্রর বউ আগে। বিয়ে দিয়েছেন এখন তো রঙঢং করলে তো হবে না”
অভ্রর কন্ঠে জড়তা নেই। আবারোও নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিলো। সালাম সাহেব পালটা প্রশ্ন করার ভাষা পেলেন না। কি প্রশ্ন করবেন? সাবেরা এতক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অভ্রর দিকে। নিজের মেয়ের দিকে চাইলেন তিনি। খুব গম্ভীর স্বরে শুধালেন,
“তোমার কি মতামত?”
“আমি অভ্রকে ছাড়া ও বাড়ি যাবো না। এখানে তো মতামতের কিছু নেই মা। বিয়ের পর মেয়েদের বাড়ি তো সেটাই হয় যেটা তার স্বামীর বাড়ি থাকে। এমন শিক্ষাই তো তোমার থেকে পেয়েছি। আমি চাই না সেই শিক্ষাকে অসম্মান করতে। আমার এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যাটা তখন হবে যদি অভ্র আমার পাশে না থাকে। আমি ওর উপর নির্ভরশীল। আমার ঔষধটাও ও খুলে খাওয়ায়। আমার পায়ের নখ অবধি সে কেটে দেয়। গোসল করা থেকে শুরু করে সবকিছুতে আমি ওর উপর নির্ভরশীল। সেখানে হুট করেই আমি তোমার উপর নির্ভরশীল হতে পারবো না। যদি তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও, আমি আমার স্বামীসহ যাবো”
দৃঢ় স্বরে উত্তর দিলো ঐন্দ্রিলা। তার উত্তরে আউওয়াল বাকুয়ীর প্রৌঢ় ঠোঁটে হাসি উন্মোচিত হলো, বিজয়ের হাসি। তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো অহংকার, গর্বের ছাপ। এই গর্ব সাবেরা বা সালাম সাহেবকে পরাজিত করার নয়। নিজের নাতির কাছে পরাজয়ের গর্ব। ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রর সম্পর্কের অটুন বন্ধন তাকে মুগ্ধ করছে। তার ভেতরটা আজ তীব্রভাবে প্রফুল্ল। তিনি আজ আশংকা মুক্ত। বিয়ের পর থেকেই নাতীর বিয়ে নিয়ে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে তীব্র দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন তিনি। অভ্রর বেপরোয়া স্বভাব, জেদ, উগ্রতা তাকে ভাবাতো। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন বিবাহবন্ধন পুরুষকে বদলায়; পিছুটানের সৃষ্টি করে। পিছুটান জেদ, উগ্রতা, দায়সারা স্বভাব লাঘব করে। ঐন্দ্রিলা বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়েছিলো। সেই ঘটনা তার বৃদ্ধ মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিলো। আতংকিত হয়েছিলেন তিনি। তাই তো শর্ত জুড়েছিলেন। আজ সেই শর্তে একেবারে বিধ্বস্তরুপে পরাজিত হয়েছেন তিনি। ঐন্দ্রিলা অভ্রকে ভালোবাসে; এতে বিন্দুপরিমান সন্দেহ নেই তার। এই পরাজয়ে তিনি শুধু প্রফুল্লই নন, গর্বিত। গর্বের কিছুটা কৃতিত্ব নাতীটাকেও দেওয়া যায়। তার নাতীর মতো পুরুষ যে ঐন্দ্রিলার মতো নারীর হৃদয়ে খুটি গাড়তে পেরেছে এটাই পৃথিবী নবম আশ্চর্য।
সাবেরা কোনো কথা বললো না। বেশ শান্ত ভঙ্গিমায় উঠে হাটা দিলো নিজের বাড়ির পানে। অভ্রও তাদের ব্যাগগুলো হাতে নিলো। একটা ব্যাগ সালাম সাহেবের সাগরেদ বাদশাহকেও দিলো। পাড়ি জমালো শ্বশুরবাড়ি।
******
আকাশখানা ধূসর চাদরে মুড়েছে। খানেক পূর্বের তীব্র সব মলিনতা ধুয়ে মুছে এমন স্বচ্ছ হয়ে আছে। এখন আবার বর্ষা নামার পায়তারা করছে। নীলাদ্রির হাতে দুটো পলিথিনের ব্যাগ। তাতে আড়াই কেজি করে মোট পাঁচ কেজি পেয়ারা এবং আমড়া। গন্তব্য শ্বশুরবাড়ি। ডায়াবেটিস হবার পর থেকে আকরাম সাহেব বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে গেছে। তিনি কোনো মিষ্টি ফল খান না। ভিটামিন সি যুক্ত ফল তিনি সেবন করেন। সেখানেও বেশ বাছবিচার। পেয়ারা এবং আমড়াতেই তার অনীহা আসে নি এখনো। তাই নীলাদ্রি পেয়ারা এবং আমড়া কিনেছে। যদিও ফলগুলোর দাম কম। আধা কেজি আমড়াও অনেক লাগে চোখে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি আধা কেজি আমড়া নিয়ে যাওয়াটা দেখতে ভালো দেখায় না। তাই সে আড়াই কেজি পেয়ারা এবং আড়াই কেজি আমড়া কিনেছে। দশ-বারোটা পেয়ারা চোখে ভালো ঠেকলেও আমড়া দেখে মনে হচ্ছে পুরো দোকান তুলে এনেছে সে। নিতুলের তো সেটাই মনে হলো। পারছে না বলতে,
“বাবা, বস্তা ভরে আমড়া, পেয়ারা কেনো এনেছো? খাবে কে এতো?”
কিন্তু নতুন জামাইকে এমন কথা বলাটা ভালো দেখায় না। সেই জোর করে হেসে ব্যাগদুটো নিলো। হাসিমুখেই বললো,
“যাও বাবা, ঘরে যাও। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও”
“না আন্টি, মানে আম্মা। আমি আসলে আব্বার সাথে কথা বলতে এসেছি। জরুরি কথা। বলেই চলে যাবো”
“সে কি, এলেই তো মাত্র”
“হ্যা, আসলে অনেক কাজ জমে আছে। প্যাকিং করা, গোছগাছ। বুঝেন তো। তেরঘন্টা জার্নি করতে হবে”
“কোথাও যাচ্ছো তুমি?”
“শুধু আমি নই, পিউও আমার সাথে যাচ্ছে। আমরা বান্দরবন যাচ্ছি”
নীলাদ্রির কথা শোনামাত্র মাথায় বাজ পড়লো যেনো নিতুলের। মেয়ে তো এমন কিছু জানায় নি। এই তো এক সপ্তাহ হলো তার ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হলো। ভাবছিলো মেয়ে উঠিয়ে দেবার কথা পারবে সালাম সাহেব এবং সাবেরার কাছে। কিন্তু এখন তো জামাই অন্য সুর তুলছে। নিতুল বিহ্বল স্বরে শুধালো,
“পিউ তো কিছু বললো না, এই সিদ্ধান্ত কবে নিলে?”
“সিদ্ধান্ত বেশিদিন পূর্বে নেওয়া হয় নি। যদিও প্রস্তাব আমি অনেক আগেই দিয়েছি। কিন্তু গতকাল রাতে পিউ ফাইনাল জানিয়েছে। সে আমার সাথে বান্দরবন যাচ্ছে। সেটাই জানাতে এসেছি আব্বাকে। তার মতামত নেওয়াও প্রয়োজন। আপনিও আসুন। বৈঠক যখন হবেই সব সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন। কি বলেন আম্মা?”
নিতুল উত্তর খুঁজে পেলো না। তার মাথা ঘুরছে। শহরের জাকজমকপূর্ণ সহজ জীবন ছেড়ে মেয়েটা কি করে থাকবে বনবাদরে? এটা কি ফাজলামি? আর পিউয়ের মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে পাগল বরের সাথে হ্যা তে হ্যা মিলাচ্ছে?
বসার ঘরে বৈঠক বসেছে। গুরুতর বৈঠক। আকরাম সাহেব থমথমে মুখে বসে আছেন। তাতে অপ্রসন্ন ঠেকছে। নীলাদ্রি খুব আগ্রহী নিজে বাদাম বিস্কিট খাচ্ছে। পিউ তার পাশে বসা। তার চোখে মুখে কিঞ্চিত ইতস্ততবোধ। সে বাবা-মাকে বান্দরবন যাবার কথাটা বলে নি। বললে যে কি প্রলয় উঠবে তার কিছুটা হলেও তার জ্ঞান আছে। ভেবেছিলো, হানিমুন নামক বাহানা দেখিয়ে চলে যাবে। পরে ফোনে জানাবে “আমি আর ফিরছি না”। কিন্তু এমন করার সুযোগ এই বান্দরবনের পাগল দিলো না। তার কাজ স্বচ্ছ, পরিষ্কার। মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া পছন্দ নয় তার। আকরাম সাহেব চোখ মুখ কুচকে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তুমি পিউকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে চাইছো”
“জি, আব্বা”
“পাহাড়ে আমার মেয়ে কি করে থাকবে নীলাদ্রি। আমার একমাত্র মেয়ের যত্নে আমি যে কোনো কমতি রাখি নি, তুমি জানো। যতদূর জানি তোমার কটেজ থানচির দিকে। শহরেও না। বিদ্যুৎ নেই, নেটওয়ার্ক পেতে হলে চোঙ্গের উপর উঠতে হয়। পিউয়ের অসুস্থতার বাতিক আছে, দূর্বল শরীরতার। পাহাড়ের রুক্ষ্ণতায় ও কি করে সামলে নিবে? ডাক্তার কোথায় পাবে? তুমি বিগত চার/পাঁচ বছর যাবৎ সেখানেই পড়ে আছো তোমার শরীর মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমার মেয়ে তো কোনোদিন পাহাড়েই যায় নি। ও কি করে থাকবে? তুমি তোমার জেদ আমার মেয়ের উপর তো চাপিয়ে দিতে পারো না”
পিউ সাথে সাথেই বলে উঠলো,
“বাবা, আমি পারবো। তুমি যদি আমাকে কোনো সরকারী চাকরিজীবী ছেলের সাথে বিয়ে দিতে আর তার পোস্টিং কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় হতো, যেখানে বিদ্যুতের শর্টেজ আছে; আমি কি সেখানে থাকতাম না? তখন তো তুমি কোনো কথা বলতে না বাবা। অভিযোগ তুলতে না। আমি কি তাহলে ধরে নিবো নীলাদ্রি আমার পছন্দ বলে তুমি এমন অভিযোগ তুলছো?”
মেয়ের এমন অভিযোগের মুখে পড়ে ভ্যাবাচেকা খেলেন আকরাম সাহেব। নিতুল সাথে সাথেই মেয়েকে থামানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“এ কেমন আচারণ পিউ? তুমি তোমার বাবার সাথে এমন ব্যাবহার করতে পারো না”
পিউ উত্তর দেবার পূর্বেই নীলাদ্রি কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
“পিউ, তুমি শান্ত হও। আমি বলছি”
নীলাদ্রির শীতল আদেশে থেমে গেলো পিউ। তারপর নীলাদ্রি খুব নরম স্বরে বললো,
“আব্বা, আমি জানি পাহাড়ে থাকা সহজ নয়। আমি নিজেও থেকেছি। সেখানে মানিয়ে নিতে সময় লাগে, ধৈর্য্য লাগে। সেখানের খাবার, আবহাওয়া, জীবনধারনের প্রক্রিয়া সব ব্যতিক্রম। আর আমিও কৃত্রিমতা পছন্দ করি না বলে আমার কটেজ প্রত্যন্ত এলাকায়। পিউয়ের জন্য চিন্তা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। একমাত্র মেয়ে সে আপনার। অনেক আদরে পুতুলের মত মানুষ করেছেন। ওখানে তার কষ্ট হোক আপনি চান না। তবে একটা জিনিস কি বলুন তো, ঝামেলাটা আমার। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে প্রকৃতিতে মিশে থাকার। শহুরে জীবন আমার জন্য বিরক্তিকর। আমি মানিয়ে নেবার চেষ্টায় আছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনের উপর জোর খাটে না। এতে করে বিতৃষ্ণা বাড়ে। সেই বিতৃষ্ণার তীক্ষ্ণতা পিউ অনুভব করুক আমি সেটা চাই না। ব্যাপারটি শুধু আমার উপর প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়। একইভাবে পিউ পাহাড়ি জীবনে অভ্যস্ত নয়। সেখানে চিরজীবনের জন্য তাকে আটকে রাখলে তারও মনে বিতৃষ্ণা জন্মাবে। ফলে আমাদের সম্পর্কের মাঝে একটা বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। বিয়ের সম্পর্কটা একটা জার্নির মত যেখানে গাড়ি রুপে দম্পতিকে যাত্রা করতে হয়। গাড়ির দু চাকা একত্রে না চললে যাত্রাটা এবড়োখেবড়ো হয়। তাই আমি চাই আমাদের যাত্রাটা হোক দুজনের সমন্বয়ের। চিন্তা করবেন না, একমাস আমরা পাহাড়ে থাকবো একমাস শহরে। এতে করে দুজনই দুজনের জীবনকে আপন করে নিবো। বিতৃষ্ণা জন্মানোর সুযোগ নেই”
নীলাদ্রি খুব শান্ত স্বরে তার বক্তব্য রাখলো। আকরাম সাহেবের দৃষ্টি নরম হলো। পিউ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সামনে বসা বোকাপুরুষের দিকে। মনে মনে বললো,
“দেখে নাও পৃথিবী, আমি এই বোকাপুরুষ বেছে ভুল করি নি। ঠকি নি”
******
শ্বশুরবাড়িতে মন্দ কাটছে না অভ্রর দিন। ঐন্দ্রিলা নিজ ঘরে এসে বেশ শান্তিতে আছে। তার মাথার পেছনের ফোলাভাবটা কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সাবেরা তাকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টায় আছেন। সকাল থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় তার সামনে হাজির হয় খাবারভর্তি প্লেট। যা অভ্র বসে থেকে শেষ করায়। অভ্রর প্রতি রাগটা একটু হলেও নরম হয়েছে সাবেরার। ছেলেটি তার মেয়েকে মাথায় করে রাখে, এতে সন্দেহ নেই। এই তো সেদিনের ঘটনা, হঠাৎ করেই ঐন্দ্রিলার অরুচি হলো। একেবারে বমি করে ভাসিয়ে দিলো অভ্রর গা। খুবই নোংরা এবং কুরুচিপূর্ণ অবস্থা। কিন্তু অভ্র নাকও কুচকালো না। তার পিঠ ঢলে দিতে লাগলো। তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো তীব্র দুশ্চিন্তা। ঐন্দ্রিলার মাথায় পানি দিলো। তারপর তাকে পরিষ্কার করলো। নিজে পরিষ্কার হল। সবকিছু পরিষ্কার করলো সে নিজ হাতে। এমন দৃশ্য যেকোনো মায়ের জন্যই খুবই আত্মতৃপ্তিদায়ক।
নীলাদ্রি এবং পিউ থানচি চলে গিয়েছে। সালাম সাহেবের দিন কাটছে না। প্রতিদিন ছেলেকে গালি দিতে পারছেন না। নীলাদ্রি অনুপস্থিতি তাকে বিরক্ত করছে। অভ্রর সাথে তার সম্পর্কটা সরল না। ছেলেটা ত্যাদর। তাকে বলদ, ছাগল বলে গালি দেওয়া যায় না। তবে সে একটি ভালো কাজ করেছে। দুটো ছোট ছাগল কিনে এনেছে আজ সকালে। একটা কালো, একটি বাদামী। ফলে ছাগলকে শিক্ষিত করার ভুত আবার মাথাচড়া দিলো সালাম সাহেবের। একমাস পর নীলাদ্রি ফিরলে তাকে দেখিয়ে দিবেন সালাম সাহেব। বাদশাহ যদিও সন্দিহান বিষয়টি নিয়ে। অভ্র অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে সে সাহায্য করবে। দেখা যাক মিশন, “ছাগল শিক্ষা” কতদূর আগায়।
*****
আজ আশ্চর্যজনক বিশেষ দিন। অভ্রর সাগরেদ তরুনের আজ বিয়ে। হুট করেই গত পরশু এসে জানানো তার বিবাহ ঠিক হয়েছে। তাও প্রেমের বিয়ে। যে সে প্রেম নয়, দশ বছরের প্রেম। গুরু হিসেবে অভ্রর থাকা অবাঞ্চনীয়। অভ্র মেলাতেই পারছে না ব্যাটা প্রেমটা করেছে কোন বয়সে। শুধু হিসেব করা হয় তাহলে কনে যখন ক্লাস ফাইভে তখন থেকে তারা প্রেম করছে। কি অদ্ভুত! অথচ সে বা বিল্লাল কেউ টের অবধি পায় নি। ভোলাভালা মুখ করে থাকা ছেলেটা তলে তলে স্টিমার চালাচ্ছিলো। তরুন ঘটা করে তার ভাবীআপুকে দাওয়াত দিয়েছে। না গেলে সে বিয়েই করবে না এমন ভাব। কিন্তু ঐন্দ্রিলার মনটা ভালো নেই। বিয়ে মানেই শাড়ি পড়ার একটা বাহানা। সাজগোজের জন্য এটাই মুখ্যম সুযোগ। কেউ বাধা দিতে পারবে, বিদ্রুপ করতে পারবে না। তার শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে, সাজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু নারীর সৌন্দর্যের সবচেয়ে আকর্ষনীয় অলংকার তার চুল। তার মাথার চুলগুলো যদি বিগত মাস দেড়েকের খানিকটা বড় হয়েছে। কিন্তু শাড়ির সাথে খুবই বেমানান। বিয়ে বাড়িতে এমন বেশে যাওয়াটা মন সায় দিচ্ছে না। আয়নায় নিজেকে দেখছে। চিরুনী দিয়ে চার আঙ্গুলের চুলগুলো আচরাচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ক্লাস নাইন টেনের বাচ্চাদের মতো পা ছড়িয়ে কাঁদতে। ভীষণ কাঁদতে। মস্তিষ্ক শাসাচ্ছে আচ্ছামতো। কিন্তু এই নরম, অভিমানী মনটা শুনছে না। ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। চোখজোড়া হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসলো। গাল ফুলিয়ে তিন চারবার নিঃশ্বাস ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লো সে বিছানায়। অভ্র তখন ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েছে। গাঢ় নীল রঙ্গের একটি পাঞ্জাবী পড়েছে। হাতা গুটিয়ে রেখেছে হাতা অবধি। দাড়িগুলো ট্রিম করে পরিপাটি করা। চুল ভীষণ কায়দা করে পেছনে উলটে রেখেছে। যেকোনো নারীর হার্টথ্রব হতে তার একনজর যথেষ্ট। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নিলো। ঘড়িটা হাতে পড়লো। একেবারে ফিটবাবু। তাকে দেখে ঐন্দ্রিলার কান্নার বেগ বাড়লো। নিজেকে একেবারেই বেমানান লাগছে অভ্রর পাশে। টপটপ করে গাল বেয়ে গড়ালো অশ্রুরেখা। ঘটনা দৃষ্টিগোচর হতেই ব্যস্ত হলো অভ্র,
“কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো? খারাপ লাগছে শরীর?”
ঐন্দ্রিলা মাথা নাড়ালো। আবেগী স্বরে বললো,
“আমি যাবো না, তুই যা”
“কেনো?”
“আমাকে বাদরের মত লাগছে। আমাদের একসাথে দেখলে মনে হবে বাদরের গলায় মুক্তো মালা। আমি যাবো না”
ঐন্দ্রিলার বাচ্চাসুলভ অভিযোগে না চাইতেই হেসে ফেললো অভ্র। খুব আহ্লাদের সাথে অশ্রু মুছে গালে চুমু খেলো। আলতো করে চোখের পাতায় চুমু খেলো। ঠোঁটে দীর্ঘচুম্বন খেলো। ঐন্দ্রিলা কাঁদতে ভুলে গেলো। এমন আদরে কি কাঁদা যায়? কিন্তু ফুপানো থামালো না। অভ্র তার গাল ধরে বললো,
“আমার কাছে একটা সারপ্রাইজ আছে। আমার বউকেও এখনো ডাকসাইটে সুন্দরী লাগবে”
ঐন্দ্রিলার জন্য দামী উইগ কিনে এনেছে অভ্র। দেখলে মনে হয় আসল চুল। দাম শুনে ঐন্দ্রিলা ভিড়মি খেলো। বিশ হাজার টাকা দিয়ে পরচুলা কে কিনে? অবশ্য অভ্রর মতো পাগলের পক্ষে সম্ভব সব। উইগ পড়ার পর আর অসুন্দর লাগছে না। বরং ঐন্দ্রিলার সব দুঃখগুলো যেনো সানসেটে উঠে গেলো। দূর্ঘটনার পর থেকে তার চুল নিয়ে ভীষণ আক্ষেপ ছিলো। এখন কোন আক্ষেপ অবশেষ নেই। অভ্র তার কপালে চুমু একে বললো,
“কি আর আমার বউকে বাঁদর বলবি? বললেই কিন্তু জরিমানা ঠুকবো”
তরুনের বিয়েতে বিল্লালের পেছনে লাগা হলো ভীষণভাবে। তিনজনের মাঝে একজন ই বাদ আছে। অভ্র তো বলেই বসলো,
“এবার একটা বিয়ে কর। চুলে পাক ধরলো বলে। আমাদের বাচ্চা হয়ে যাবে কিছুদিন পর। তখন ভাইয়া থেকে কাকা হয়ে যাবি। অন্তত আমার বাচ্চা হবার আগে বিয়েটা কর। তরুন তোর ছোট হয়েও বিয়ে করে ফেলেছে। তাও দশ বছর প্রেম করে। লজ্জা কর একটু। বল তো মেয়ে দেখি”
বিল্লাল হাসি টেনে বললো,
“আমাকে নিয়ে তোদের চিন্তা করা লাগবে না। ইনশাআল্লাহ আবিয়াত্তা থাকবো না”
অভ্র কথাটার মর্মার্থ বুঝলো না। বিল্লাল হাতঘড়ি দেখে বললো,
“থাক আমার কাজ আছে”
“কিসের কাজ তোর”
“বলা যাবে না, সিক্রেট”
বলেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো বিল্লাল। ছেলেটা আজকাল খুব টালবাহানা শুরু করেছে। রাত দশটার পর তাকে মোবাইলে পাওয়া যায় না, ব্যাস্ত দেখায়। অনলাইনে ম্যাজেস দিলেও সিন করে না। ব্যাপার যে জন্ডিস সেটা অনুমান করাই যায়। কিন্তু ঘটনাটা আসলে কি?
*****
কড়া, তপ্ত, খরখরে রোদের মাঝে বিনা নোটিশে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হলো। কোন কুক্ষনে যে ছাতিটা বাড়ি ফেলে এসেছে তৃষা। এখন আফসোস হচ্ছে। আকাশ যদি মানুষ হতো তাহলে তার কান টেনে ছিড়ে ফেলতো তৃষা। এতো মুড সুইং কেনো বাপু। এইতো ঝলমলে রোদ ছিলো। কি উত্তাপ, কি তেজ সূর্যের। অথচ এখন সে ঘাপটি মেরে আছে কৃষ্ণ জলধরের আড়ালে। তেজ এখন পানি হয়ে গেছে। যাক গে, এসব শুধু মনের অবান্তর চিন্তা। প্রকৃতির এই মুড সুইং অগ্রহায়ন মাসটাতে সহ্য করতেই হবে। আর তো দুটো সপ্তাহ তারপর পৌষ নিজেকে জাহির করবে হাড় কাঁপিয়ে। একটা ফুটো টিনের দোকানের নিচে ব্যাগ খানা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা। রাস্তায় একটাও রিক্সা নেই। সবাই কি আজ স্ট্রাইক করেছে। কি যন্ত্রণা! যখনই প্রকৃতি ক্ষ্যাপাটে হবে তখন ই যানের আকাল। ঠিক এমন সময়েই একটা মোটরসাইকেল ব্রেক করলো তার সম্মুখে। পুরুষ ভিজে একাকার পাঞ্জাবিটা গায়ে লেপ্টে আছে। সুঠাম দেহ তাই কাপড় ভেদ করেও বোঝা যাচ্ছে। হেলমেটের ঢাকা তুলে বললো,
“ব্যাংকার ম্যাডাম কি লিফট লাগবে?”
তৃষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। কিছুসময় তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে তাকালো। যেনো পুরুষটিকে পাত্তা দেবার প্রয়োজন নেই। পুরুষটি অভাবেই বসে রইলো। অপেক্ষা নারীর এগিয়ে আসার। সময় গড়ালো, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনেরো মিনিট। এবার পুরুষের কন্ঠের ধার বাড়লো,
“আমি ব্যাংকার না হলেও আমার সময়ের দাম আছে, ম্যাডাম”
“কেউ তো তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নি”
“তাহলে চলে যাই”
“দেখো যা ভালো মনে করো”
ওমা তৃষাকে অবাক করে আসলেই লোকটি বাইক স্টার্ট দিলো। আশেপাশে জনমানবের ভীষণ অভাব। অসহায়ের মতো চাইলো তৃষা। সত্যি সত্যি চলে যাবে নাকি? এ কেমন পুরুষ। দুমাস আদুরে বিড়ালের মতো ঘুরঘুর করে যেই প্রেমের টিকিট পেলো অমনি সিংহ হয়ে গেলো? এই বুঝি প্রেমিকের স্বভাব। বিল্লাল হেলমেট খুললো। চুলগুলো বাহাতে পেছনে ঠেলে বললো,
“তুমি কি পেছনে বসবে, নাকি সত্যি চলে যাবো”
“যাও, যাও। আমি তোমার বাইকে বসার জন্য হেঁদিয়ে মরছি না”
“আমি তরুনের বিয়ে ছেড়ে এসেছি তৃষা”
গাঢ় স্বরে বললো বিল্লাল। তৃষা তার দিকে চাইলো। কন্ঠের ধারখানা কমে আবারোও নরম হলো যেনো। মায়া হলো তৃষার। সে তাই অভিমান ছেড়ে হনহন করে যেয়ে তার বাইকের পেছনে বসলো। বিল্লাল নিঃশব্দে হাসলো। তৃষা তার ঘাড়ে হাত দিলো। সেটা পছন্দ হলো না তার। হাতখানা টেনে কোমড়ের কাছে আনলো। গাঢ় স্বরে বললো,
“আমি কিন্তু জোরে চালাই, পড়ে যাবে। শক্ত করে ধরো”
তৃষাকে নামালো তার বাসার দু গলি আগে। বৃষ্টির ধার বেড়েছে। জনমানব একটাও রাস্তায় নেই। সন্ধ্যার কালো রঙ্গ শুষে নিয়েছে সব আলো। উপরন্তু বৃষ্টির জন্য লোডশেডিং হয়েছে বোধ হয়। রাস্তার আলোও জ্বলছে না। তৃষা বাইক থেকে নামলো। লুকিয়ে প্রেম করার জ্বালা আছে। আশপাশে চিলের মতো নজর রাখতে হয়। কখন কে দেখে ফেলে বলা তো যায়।
“আসছি”
বলে চলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরলো বিল্লাল। তৃষা হতবাক নয়নে চাইলে সে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“আমার ভাড়া?”
“কোন ভাড়া?”
“অফিস থেকে যে নিয়ে এলাম, সেই ভাড়া”
“হাতটা ছাড়ো বিল্লাল, কেউ দেখে ফেলবে”
“ভাড়া না দিলে আমি ছাড়ছি না। দুদিনের ভাড়া এখনো পেন্ডিং। চারটে চুমু বাকি আছে। আজকে দুটো। ছটা চুমু দাও। তারপর জাহান্নামে যাও, আমি আটকাবো না”
বলেই হাতের বাঁধন শক্ত হলো যেনো। তৃষা পড়লো বিপাকে। ছেলেটাকে যত ভদ্র ভেবেছিলো সে মোটেই তেমন নয়। অসভ্য, চূড়ান্ত পর্যায়ের অসভ্য। তৃষা গাইগুই করলো। কিন্তু বিল্লাল অনড়। একদম বাঁধন ছাড়লো না। তৃষা করুন মুখে তাকালো। কিন্তু ঝাপসা চোখগুলোতে একেবারে করুনা হলো না। ফলে আশেপাশে একবার দেখলো। না কেউ নেই। কুকুরও অবধি নেই রাস্তায়। উপরন্তু অন্ধকার। তাই টুক করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়েই পালানোর ধান্দা। কিন্তু বিল্লাল তার সুযোগ দিলো। কোমড়খানা শক্ত করে চেপে ধরে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো নরম অধর জোড়ায়। প্রলম্বিত চুম্বনে নারীকে মাতাল করে দেবার তীব্র আকাঙ্খা যেনো। বেপরোয়া ওষ্ঠদ্বয়ের উন্মাদনায় পিষ্ট হলো তৃষা। বিল্লালের আরেকখানা হাতপ শক্ত করে চেপে ধরেছে ঘাড়ের নিন্মোংশ। যখন শ্বাসে টান লাগলো তখন অসভ্য পুরুষের থেকে মুক্তি পেলো। তৃষা হতভম্বের মতো চেয়ে রইলো। কিছুই হয় নি, এমন একখানা ভাব দেখিয়ে বিল্লাল বললো,
“বাকি পরিশোধ, এখন বাড়ি যাও”
“তুমি, তুমি একটা”
“আমি কি?”
“তুমি খুব বাজে”
“উহু, আমি তোমার প্রেমিক সোনা। প্রেমিকদের একটু বাজে হতে হয়। এজন্য বলছি বিয়ে করে নেও। বিয়ে করে শুদ্ধ পুরুষ হয়ে যাবো”
বলেই চোখ টিপ্পনী কেটে বাইকে স্টার্ট দিলো। তৃষা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। গালজোড়া গরম হয়ে আছে। কি লজ্জা, কি লজ্জা।
*****
লোডশেডিং হয়েছে অনেকক্ষণ। এখনো কারেন্টের নাম গন্ধ নেই। জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। দমকা হাওয়া স্পর্শ করছে মুখবিবর। অভ্রর ঘর দেখা যাচ্ছে। উহু, তাদের ঘর দেখা যাচ্ছে। ঐন্দ্রিলার মনে আছে বিয়ের আগে এই জানালা সে খুলতো না। কারণ অভ্রকে দেখা যাবে তাই। অভ্রকে দেখলেই তার অস্থিমজ্জায় অগ্নিসংযোগ হত। অথচ এখন প্রতিমুহূর্তেই এই পুরুষকে চাই তার। প্রতিক্ষণে তার জন্য ব্যাকুল থাকে অন্তঃস্থল। সম্পর্কটার কতটা পরিবর্তন হয়েছে। আনমনে হাসলো ঐন্দ্রিলা। নিজের ঘরে সেই মায়া অনুভব হয় না যতটা ওই বাড়ির ঘরে হয়। দিনতো কম হলো না। এবার শ্বশুরবাড়ি যাবে ঐন্দ্রিলা। আর মন টিকছে না কেনো যেনো। নিজের বাড়ি যাবে সে।
“নে, কফি”
গাঢ় স্বরে নড়েচড়ে উঠলো ঐন্দ্রিলা। পাশে ফিরতেই আঁধারে অভ্রর অবয়ব দেখলো। ঐন্দ্রিলার দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিলো সে। কফিতে চুমুক দিলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র তখন বললো,
“অন্ধকারে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ঐন্দ্রি?”
“ভাবছিলাম”
“কি?”
“এই যে মানুষের জীবন কত বদলায়”
“যেমন”
“তোর মনে আছে আমি আগে এই জানালাটা সবসময় বন্ধ করে রাখতাম। যেনো তোকে না দেখতে হয়। আর তুই করেই শার্ট ছাড়া পর্দা না টেনে ঘুরতি”
“হ্যা, তোকে পটানোর ট্রাই করতাম, আমার খোলা হালকা লোমশ বুক দেখে যদি পটে যাস”
“অসভ্য”
অভ্র হাসলো শব্দ করে। ঐন্দ্রিলা ভাবুক স্বরে বললো,
“গতবছরও আমি ভাবি নি, তোর সাথে একসাথে দাঁড়িয়ে কফি খাবো। খুব লাগে জানিস, কতটা পথ পেরিয়ে এলাম তাই না? আচ্ছা অভ্র?”
“কি?”
“তুই আমাকে কেনো বিয়ে করেছিস?”
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে হতচকিত হলো অভ্র। গলার কাছে কাটা বিঁধলো যেনো। অনুভূতিগুল কেমন তেতো হয়ে গেলো। সে ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসলেও অস্বীকার করার তো জো নেই বিয়েতা সে দাদার শর্তেই করেছে। দাদাকে হারানোর জন্য ঐন্দ্রিলাকে নিজের প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে, দূর্বল করেছে। তার উদ্দেশ্য ছিলো অসৎ, কুৎসিত। এতো সুন্দর সংসারের পেছনের সত্যটা যে নোংরা। ঐন্দ্রিলা যদি কখনো জানে অভ্রর প্রণয়ের পেছনে কখনো কুৎসিত উদ্দেশ্য ছিলো সে কি মেনে নিবে সত্যটা? সে বুঝতে চাইবে অভ্র কখনো টাকার জন্য তাকে বিয়ে করে নি। হ্যা, হয়তো হন্যে হয়ে তড়িঘড়ি করে সে টাকার লোভে বিয়ে করেছে। কিন্তু সে ঐন্দ্রিলাকে মন থেকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসায় খাঁদ নেই। ঐন্দ্রিলা কি বুঝবে তা? মিথ্যের উপর জীবন কাটানো যায় না। অভ্রর সত্যটা বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সাহসে কুলালো না। এখনো সে সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। আরেকটু সুস্থ হোক। তারপর না হয় বলা যায়। অভ্রকে চুপ থাকতে দেখে আবার শুধালো ঐন্দ্রিলা,
“এই অভ্র”
ধ্যান ভাঙ্গলো অভ্রর। “কিছু না” বলেই নিজেকে সামলাতে তড়িঘড়ি করে গরম কফিতে চুমুক দিলো সে। অমনি ঠোঁটখানা পুড়ে গেলো। “সসসস” করে উঠলো জ্বলনের প্রভাবে। মুখ চেপে ধরে কফির মগ রেখে দিলো সে। ঐন্দ্রিলা সাথে সাথেই বললো,
“কি হলো, পুড়লো?”
“হ্যা”
ঐন্দ্রিলা হাসলো। পাশের ছোট টেবিলে মগটা রেখে এগিয়ে এলো সে। আঁধারের মাঝেও চোখের আলোয় যেনো দেখতে পেলো তাকে অভ্র। ঐন্দ্রিলা কাছে এসে তাকে অবাক করে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। নরম ঠোঁটজোড়া পোড়া অংশে ছুঁয়ে মাতাল স্বরে বললো,
“মলম চাই বাবু?”
অভ্র অবাক হলো। বিস্মিত স্বরে শুধালো,
“হ্যা?”
“কথা দিচ্ছি ব্যাথা দিবো না”
ঐন্দ্রিলার মনোবাঞ্চা বুঝতে কষ্ট হলো না অভ্রর। প্রণয়নীর এমন অচেনা রুপ পুরুষসত্তায় উদিত করলো নিষিদ্ধ কামনা। কোমড়খানা টেনে পেলব শরীরটাকে নিজের সুঠাম দেহের সাথে মিশিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“আগুন খেলিস না বাবু?”
“ক্ষতি কি? পুড়লাম না হয়। মোমও তো আগুনের কাছে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়। আমিও না হয় একটু ছাই হলাম। অন্তত নিজের পুরুষের কাছে পুড়বো। আক্ষেপ নেই তাতে”
ঐন্দ্রিলার মাতাল চোখের ভাষা আরোও মাতাল করলো অভ্রকে। বাহিরে প্রবল শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোকছটা গলে পড়ছে ঘরের মেঝেতে। অভ্র সেই আলোয় সুক্ষ্ণ চোখে দেখলো তার প্রিয় নারীকে। ক্ষিপ্রভাবে কোলে তুলে নিলো সে। ঐন্দ্রিলা মিশে গেলো তার মাঝে। বাহিরের প্রকৃতির উন্মাদনায় স্পর্শ করলো ঘরের প্রতিটি কোন। সুপ্ত নিষিদ্ধ চাহিদার পরিস্ফুটন হলো। একে অপরের মাঝে প্রণয়ের নেশায় মাতলো নরনারী। লজ্জার সাক্ষী হলো দেওয়াল আর একরাশ নীরবতা।
****
ঐন্দ্রিলার এম.আর.আই করা হয়েছে। ফোলা অংশ কমে গেছে। আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ অংশ এখন ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে। সময় আরোও লাগবে। কিন্তু এখন তাকে সুস্থ বলা যায়। নিজের বাসা থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছে সে। আজ অভ্রর জন্মদিন। বিশেষ একটি দিন। এমন দিনে উপহার হিসেবে নিজের মনের কথাগুলো বলবে ঐন্দ্রিলা। প্রেমনিবেদন করবে বিশেষ ভঙ্গিতে। তাই নিজেই দুপুরের রান্না করেছে সে। যদিও কানন বাঁধা দিচ্ছিলো। অভ্র জানলে ঘর মাথায় করবে। কিন্তু ঐন্দ্রিলাও কম চালাক না। বান্দা দোকানে যেতেই সে এই কাজ করেছে। কেক অর্ডার করেছে দোকান থেকে। সন্ধ্যা বেলায় যখন অভ্র আসবে একেবারে চমকে দিবে। সেজন্য একখানা লাল জামদানী বেঁছে নিয়েছে সে। কিন্তু শাড়ির সাথে কি গয়না পড়বে বুঝতে পারছে না। শ্বাশুড়ির কাছে চাইলে মন্দ হয় না। কাননের অনেক গহনা। মহিলা কিছু করুক না করুক কেনাকাটায় একেবারে সিদ্ধহস্তী। তাই ঐন্দ্রিলা তার কাছে গহনা চাইতে গেলো। ঘরে প্রবেশই করছিলো অমনি দাদাজানের ভারী স্বর কানে এলো,
“আমি ভেবেছি, অভ্রকে এবার ওর টাকা বুঝিয়ে দিবো বউমা। অনেক তো হলো লুকোচুরি। সে তার কথা রেখেছে। বিয়েটা করেছে। নাতবউয়ের ভালোবাসা আদায় করেছে। সে আমার দেওয়া সব শর্তই পূরণ করেছে। এবার এই টাকাটা তার প্রাপ্য। কি বলো?”………………………
চলবে