#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১.
“শায়াফ‚ তুই কি উঠেছিস? শায়াফ?” কোনো সাড়া না পেয়ে মেজাজ হারালেন শাফিউল হক। রেগে গিয়ে দরজায় বিশাল একেক থাবা দিতে শুরু করলেন‚ “দশ মিনিটের মধ্যে ঘরের বাইরে তুই না আসলে তোর গাড়িতে আগুন দেবো আমি।”
জেসমিন রান্না করছিলেন। স্বামীর কথা শুনে ভয়েই খুন্তি নাড়ানো থেমে গেল তার৷ হুমকিটা কথার কথা শোনালেও আজ এ ঘটনা ঘটিয়েই ছাড়বেন শাফিউল। অনেকক্ষণ ধরেই ছেলেকে ডাকতে ডাকতে ধৈর্য হারাচ্ছেন তিনি। রান্নাঘর থেকে জলদি বেরিয়ে এলেন জেসমিন। মেয়ে জারা ঘরে বসে ফোন চাপছিল। “এই জারা!” ফিসফিসানির মতো তাকে ডেকে বললেন‚ “তরকারির কাছে যা তো।” বলেই ছুটলেন ছেলের ঘরের দিকে। শাফিউল সাহেব পেছনে হাত মুড়ে দাঁড়িয়ে তখনো ঘরের দরজায়।
“আপনি যান। আমি ডাকছি ওকে।” রাগে লাল হওয়া স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু করে বললেন জেসমিন।
জবাবে বউকে কঠোর চাউনি দিয়ে চলে গেলেন শাফিউল সাহেব। তার পরপরই বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকল গোটা তিনেক গাড়ি। শোবার ঘর থেকে আবার তখন বেরিয়ে এলেন শাফিউল। “তারা চলে আসছে কিন্তু”‚ হুঁশিয়ার গলায় স্ত্রীকে বলেই নিচে চললেন অতিথিদের গ্রহণ করতে।
জেসমিন বেগম এবার বিচলিত হয়ে ডাকাডাকি আরম্ভ করলেন ছেলেকে‚ “শায়াফ আব্বা‚ উঠেছিস? ওনারা চলে আসছে তো৷” ছেলের সাড়াশব্দ না পেয়ে বললেন‚ “তোর আব্বুকে আর রাগাস না‚ আব্বা। ঘরে অশান্তি শুরু হয়ে যাবে। কালকে কাদের মারধোর করে আসছিস তা নিয়ে এমনিতেই টেনশনে আছে তোর আব্বু আর চাচা৷ ওঠ‚ আব্বা।”
শুধু দরজার বাইরেই ডাকাডাকি চলছে না। কম্বলের ভেতর চলে যাওয়া ফোনটাতেও লাগাতার রিং হচ্ছে৷ ডাকাডাকিতে সাড়া দিতে মন না চাইলেও ফোনকলের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে শারফান বিশ্রী গালি দিলো কলারের উদ্দেশে৷ ফোনটা খুঁজে স্ক্রিনে চোখ ফেলল—বড়ো চাচার নাম। “মাঙ্গের নাতি”‚ চিড়বিড়িয়ে গালিটা দিয়ে উঠে বসল সে। জেসমিন তখনো ডাকাডাকি করে যাচ্ছেন দরজায় চাপড় দিতে দিতে। মায়ের আদর স্বর উপেক্ষিত হলো দরজার ওই গুঁতাগুঁতির শব্দের জন্য। ক্ষিপ্র মেজাজে হুমকি দিয়ে উঠল তাই‚ “আরেকবার দরজা থাবড়া-থাবড়ি করলে ঘরের একটা দরজাও আস্ত থাকবে না!”
ভয়ে জেসমিন দরজায় আর হাত দিলেন না। মিনতি স্বরে শুধু বললেন‚ “সবাই চলে আসছে‚ বাবু। জলদি রেডি হয়ে বাইরে আয়।”
হাত বাড়িয়ে বেড সাইড সেন্টারটেবিল থেকে সিগারেট আর লাইটারটা তুলে নিলো শারফান। বাপের হুমকি-ধমকি‚ মায়ের কাকুতি-মিনতিকে কুছ পরোয়া না করে সিগারেট ধরাল আর কী যেন ভাবনায় মশগুল হলো। এর মধ্যে আবার বেজে উঠল ফোনটা । স্ক্রিনে ‘শাকিবুল কাকু’ নামটা দেখেও নির্বিকারভাবে স্ক্রিনে চেয়ে থেকেই সিগারেটটা শেষ করতে থাকল সে ধীরে ধীরে। কল কেটে গিয়ে সপ্তমবারের মাথায় কলটা আবার এলে রিসিভ করল‚ “আমি ফরিদপুর ঢুকেছি ভোর সাড়ে পাঁচটায়। ঘুমাতেও কি দেবেন না?” একরকম খেঁকিয়েই উঠল সে চাচার ওপর। ওপাশ থেকে শোনা গেল তখন‚ “সিরাজ কাজী‚ আহসানুল বাশারকে কি মুখের ওপর বলা যায় ভাইপো আমার ঢাকা থেকে মারমারি করে বাড়ি ফিরে রেস্ট নিচ্ছে‚ আপনারা কালকে আসলে ওরা দেখা পাবেন? তোর আব্বাকে চেতাস না‚ বাপ। পাছে দেখা গেল তোকে শেয়ার দেওয়ার ডিসিশন পালটায় ফেলবে ও।”
“ডিসিশন পালটালে আমিও পালটাই যাব”‚ সিগারেটে টান দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল‚ “পাঁচ বছর কামলা দিয়ে আপনাদের ফকিন্নি হক কোম্পানির প্রফিট বাড়ালাম‚ ইনভেস্টর আনলাম৷ কামলা শেষে যদি বেনিফিট না পাই তো কোম্পানির হোগায় চেরাগ জ্বালিয়ে কোম্পানির রেস্ট ইন পিস করে দেবো—এ আর এমন কী কাজ!”
“এগারোটা চল্লিশ বাজে। পঞ্চাশের ভেতর রেডি হয়ে চলে আয়‚ বাপ।” দ্রুত ফোন কাটলেন শাকিবুল সাহেব। ভাইপোর কথার জবাব দেওয়ার ভুল করলেন না একদম। সামনেই আবার সংসদ নির্বাচন। ভাইপোকেই লাগবে এ কাজেও। কিন্তু মনে মনে তিনি আফসোস করলেন খুব‚ কেন আল্লাহ তার ঘরে একটা ছেলে দিলেন না? তাহলে কি আর ছোটো ভাইয়ের এই হিটলার শয়তান ছেলেকে ভরসা করতে হত?
কথা শেষ করে তিনি ফিরে এলেন বসার ঘরে। শাফিউল সাহেব তখন খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলছেন বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সিরাজ কাজীর সঙ্গে। শাফিউল আর শাকিবুল সাহেবের কোম্পানি হলো ভোজ্যতেল‚ চিনি‚ গুঁড়াদুধ আর দুগ্ধজাত পণ্যের। বাপ-দাদার আমলে কোম্পানিটা ভালো চললেও তাদের হাতে আসার পর থেকে দিন-দিন অবনতিই ঘটছিল ব্যাবসার। শারফান তখন বিবিএ শেষ করতে না করতেই শাফিউল সাহেবের কাছে হঠাৎ আবদার করল সে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করবে। কিন্তু পুঁজি দিতে রাজি হলেন না শাফিউল। উলটে ছেলেকে শর্ত জুড়ে দিলেন তার কোম্পানির কর্মী হতে। যদি এক বছর ভালো কাজ দেখাতে পারে তবে ওকে ম্যানেজার করা হবে এবং রেস্টুরেন্টের জন্যও টাকা দেওয়া হবে। পরের হুকুম‚ পরের ফরমায়েশ খাটবে না বলেই শারফান নিজের আলাদা ব্যাবসা দাঁড় করাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাপের কুচক্রী পরিকল্পনার কারণে সেই আশা তার পূরণ হলো না তখন। অনেক ভেবেচিন্তে যুক্ত হলো সে বাপ-চাচার ব্যাবসাতে। আর তারপরই ঘটে গেল যেন বিস্ময়কর ব্যাপার। শারফান এতটাই নিষ্ঠাবান হয়ে কাজ দেখাল যে এক বছর নয়‚ ছ মাস পরই পরিচালনা পর্ষদের সাথে আলোচনা করে ওকে ম্যানেজার করা হলো৷ এবং ম্যানেজার হওয়ার পর থেকে শারফানের ধীশক্তির জন্যই নাকি কেবল আল্লাহর রহমতের জন্যই কে জানে কোম্পানির মেরুদণ্ড সোজা হতে শুরু করল। পণ্য বাজারে ঢুকতে না ঢুকতেই শুধু লাভ আর লাভ। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসতে থাকল তখন। পাঁচ বছরে শাফিউল আর শাকিবুল সাহেবের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে আনতে পারল তাদের অতীতের সুনাম আর মুনাফা। এর মাঝে শারফানের আশাও পূরণ করে দিলেন শাফিউল৷ কিন্তু শারফানকে যেতে দিলেন না ব্যাবসা ছেড়ে। শারফানও সে ইচ্ছা প্রকাশ করল না। ধৈর্য ধরে বছরের পর বছর কোম্পানিতে খেটেখুটে মোক্ষম চাল দিলো সে পাঁচ বছরের মাথায়। বাপ আর চাচাকে প্রস্তাব দিলো‚ কোম্পানির চল্লিশ পারসেন্ট শেয়ার ওর এখনই চাই। এবার কোম্পানির কোনো বেতনভুক্ত কর্মকর্তা নয় বরং অংশীদার হতে চায় সে। অর্থাৎ বাপ আর চাচার ভাগ থেকে বিশ বিশ করে দিতে হবে ওকে। আর তা না দিলে একেবারে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে সে অন্য কোথাও।
শাকিবুল আর শাফিউল সাহেব দুই ভাই-ই। বোনেরা আছে পাঁচজন। শাকিবুলের কোনো ছেলে সন্তান নেই। তিন মেয়ে। বড়ো দুই মেয়ে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তাদের আজ পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি তিনি। কারণ‚ জামাই দুটোই অযোগ্য আর লোভী প্রকৃতির। ছোটো ভাই শাফিউলের ছেলেই তাই নিজের ছেলের জায়গা নিয়েছে। কিন্তু শারফানের প্রস্তাবে তাদের দু ভাই প্রথমে একদম রাজি ছিলেন না। ছেলের হুমকিকেও কোনো গুরুত্ব দেননি। এ নিয়ে শারফানের সঙ্গে গোলমাল চলল তাদের কিছুদিন। শারফান ওর সমস্ত টাকা-পয়সা একদিন ব্যাঙ্ক থেকে বের করে নিলো হঠাৎ। ঢাকায় আর ফরিদপুরের রেস্টুরেন্টও বিক্রির জন্য খদ্দের খুঁজতে আরম্ভ করল। দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্যও প্রস্তুতি নিতে থাকল সেই সাথে। এসব যখন জানতে পারলেন শাফিউল‚ পাগলের মতো ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন৷ শারফান কোনোভাবেই ধরা দিলো না৷ তারপর উপায়ন্তর না পেয়ে দুই ভাই শেয়ার লিখে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন ওকে। সেই আশ্বাসও ওকে ফেরাতে পারল না। শাফিউল সাহেব তখন কোম্পানির উকিলের মাধ্যমে যোগাযোগ করালেন। উকিল ওকে অংশীদারিত্ব দলিলের ছবি পাঠালে তারপর শারফান বাড়ি ফিরল। কিন্তু ফিরল তাও গায়েগতরে একগাদা জখম নিয়ে। আজ সকালে মগবাজার থানার ওসি ফোন করে শাকিবুল সাহেবের সেক্রেটারিকে জানাল শারফান ওর দলবল নিয়ে গত রাতে শ্যলে বারে তুমুল মারামারি করেছে তাদের প্রতিদ্বন্দী কোম্পানির মালিকের নাতির সাথে। পুলিশ পৌঁছনোর আগেই শারফান ওর সঙ্গীদের নিয়ে কেটে পড়ে। কিন্তু মামলা খেতে গিয়েও বেঁচে গেছে বার ম্যানেজার ওর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি বিধায়৷ কেন বলেনি তা জিজ্ঞেস করতেই জানা যায়‚ বেরিয়ে আসার আগে শারফান ক্ষতিপূরণের দাম দ্বিগুণ দিয়ে এসেছে।
“তা কোথায় শারফান শায়াফ”‚ সিরাজ কাজী চায়ে চুমুক দিতে দিতে খোঁজ করলেন৷ “ওর ইনটেলিজেন্স আর ডিরেকশনের গল্প বাশার সাহেবের কাছে এত শুনেছি তা তো জানেন না।”
আহসানুল বাশার হক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন খু্ব বেশিদিন হয়নি। অল্প কয়েক মাসেই শারফানের কাজ আর ওর বিচারবুদ্ধি দেখে তিনি আর তার মেয়ে রীতিমতো মুগ্ধ। তাই সন্তুষ্ট হয়েই সিরাজ কাজীর কোম্পানির সাথে হক কোম্পানি কোলাজ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সে।
মিথ্যা আন্তরিক হাসি শাফিউল মুখে ঝুলিয়ে শাকিবুলের দিকে তাকালেন একবার। তারপর বললেন‚ “এক্ষুনি আসছে। ফ্রেশ হচ্ছে ও৷”
শেষ কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গেই শারফানের আগমন ঘটল। হলুদ রঙের বাটিক লুঙ্গি পরনে আর গায়ে জড়ানো ওর শোবার ঘরের খয়েরী রঙা মোটা কম্বলটা৷ বহুদিনের না কামানো গোঁফ-দাড়ির মাঝে মস্ত বড়ো হা করে হাই তুলতে তুলতে সিঁড়ি বেঁয়ে নামছে সে। মাথা ভর্তি সোজা চুলগুলো এতখানিই লম্বা হয়েছে যে কপাল ঢেকে তা চোখের নিচে নেমে নাক ছুঁয়েছে৷
শাকিবুল সাহেব চায়ে চুমুক বসিয়েছিলেন সবে৷ শারফানকে দেখা মাত্রই বিষম খেয়ে বসলেন আচমকা। শাফিউলের ‘ফ্রেশ হচ্ছে’ কথাটাকে এইভাবে মিথ্যা বানিয়ে দিলো হতচ্ছাড়াটা! কী তাণ্ডব শুরু হয় আজ বাপ-ছেলের মাঝে এই শঙ্কা করতে থাকলেন এবার শাকিবুল।
চলবে।