#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৩.
রাত ৩:১০ ।
ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ানো চারটি বাইক। হেলমেট পরিহিত আরোহী সাতজন বসে আছে চুপচাপ৷ কিন্তু তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। একটা শেয়াল‚ কুকুরও জেগে নেই কোথাও।
রাস্তার ডান পাশে মৃদু নীলচে আলোয় স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছে ডুপ্লেক্স একটি বাড়ি। রাত নেমে এলেই অট্টালিকার চারধারে ডাউনলাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ দেখতে বেশ লাগে। পথচারীরা যখন এ পথ হয়ে যাতায়াত করে তখন যেতে যেতে একটিবারের জন্য হলেও বাড়িটির দিকে এক পলক না চেয়ে পারে না। বাড়ির মালিক অবশ্য যতখানি না সৌন্দর্য বৃদ্ধির চিন্তা করেছে‚ তার চেয়ে বেশি বিবেচনা করেছে নিরাপত্তার দিক।
মূল ফটকের পাশে কালো নেমপ্লেটে সোনালী অক্ষরে লেখা ‘সৈয়দ ভিলা’। ফটকের বাইরে ও ভেতরে নজরদারি করছে একটি সিসি ক্যামেরা। এবং গেটের ভেতরে বসে ঝিমাচ্ছে একজন সিকিউরিটি গার্ড৷ বাড়িটাতে কড়াকড়ি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে জেনেও সাতজন আরোহীর কারও মাঝেই কোনো বিকার নেই‚ ভয় নেই৷
আয়তাকার এক জোড়া চোখের সরু দৃষ্টি থামল এবার ভিলার ওপরে। শীতল আর অত্যন্ত ভরাট কণ্ঠী সে। শুনশান সড়কের মাঝে বেজে উঠল সেই কণ্ঠ‚ “সিসি ক্যামেরা অক্ষত রেখে‚ সোলার লাইট না ভেঙে‚ গার্ডকেও ফাঁকিঝুকি না দিয়ে ফারনাজের ঘুম হারাম করবি তোরা৷ আছে এই হেডম?”
“হেডম না হয় দেখালাম”‚ জবাবে তাকে বলল রিহান‚ “ফুটেজে যখন দেখবে আমাদের‚ না চিনলেও সন্দেহ তো তোকেই করবে। আরেকটু ভেবে দেখবি?”
“আরেকটু না‚ পাঁচটাদিনে রিপিট ভেবে ভেবেই আজকে ফারনাজের হোগায় হালকা করে টোকা মারতে এসেছি।” বলল শারফান।
“তাহলে আর কী”‚ শ্রাগ করল অনি। “শুরু হোক তবে স্লিংশট শুটিং?”
“ইয়েস”‚ হাসল শারফান‚ “লেটস বিগিন।”
সবার মধ্যেই কিন্তু দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেল—কতগুলো বছর পর আজ গুলতি খেলতে যাচ্ছে তারা! সিসিটিভি ফুটেজে যে রেকর্ড হয়ে থাকছে তা নিয়ে ভয়ের ছিঁটেফোঁটাও নেই কারও মধ্যে। তবে হাতের নিরিখ যাদের ভালো বেশি তারা গুলতি খেলবে না৷ তারা খেলবে তিন থেকে চার ইঞ্চি আকারের পাটকেল দিয়ে। তাদের মাঝে একজন শারফান৷ বাইকগুলো এমন অবস্থানে দাঁড় করাল ওরা‚ যেখান থেকে গুলতি আর ঢিল দুটোই গিয়ে সরাসরি লাগবে জানালার থাই গ্লাসে।
চোখের সামনে থেকে হেলমেটের গ্লাস নামাল না কেউ-ই৷ বাইক থেকে নেমে‚ সৈয়দ ভিলায় চোখ রেখে‚ হাতের পাটকেটলটা ছুঁড়ে বারবার ক্যাচ ধরতে ধরতে শারফান পরিকল্পনা বলতে থাকল সবাইকে৷ তারপর যার যার স্থানে তৈরি হয়ে নিলো। ব্যালকনির ডান পাশের ঘরের জানালাতে সাদ্দাম‚ অনি‚ রিহান আর রিপন মারবেল ছুঁড়ল গুলতি দিয়ে পরপর তিনবার৷ তারপর শারফান সহ আরও দুজন সেই একই সঙ্গে প্রচণ্ড গতিতে ছুঁড়ে মারল পাটকেগুলো।
বসার ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে তখন ফারনাজের মা জাহিদা সুলতানা। আচমকা কপালের মাঝে চেপে ধরে “ও আল্লাহ গোওও…” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
ডাইনিং থেকে পানি খেয়ে তিনি শোবার ঘরে ফিরছিলেন। তখনই মারবেলগুলো বসার ঘরের জানালায় এসে লাগে৷ সেই শব্দে তড়িঘড়ি করে তিনি ছুটে যান সেখানে। লাইট জ্বালানোর আগেই শারফানদের ছোঁড়া পাটকেলগুলো ছুটে আসে ঘরে। যার একটি আঘাত করে বসে তার কপালে।
পাটকেলের আঘাতে কাচ ভাঙার শব্দ সবাই-ই পেয়েছিল। দরজা খুলে তারা দৌড়ে আসতে না আসতেই জাহিদা বেগম ততক্ষণে আহত।
“মা!” চিৎকার করে উঠে ফারনাজই ছুটে এলো সবার আগে৷ ঘরের লাইট জ্বালাতেই দেখল ভাঙা জানালা‚ মেঝেতে দুয়েকটা মারবেল‚ তিনটা পাটকেল আর জাহিদা বেগমের রক্তাক্ত কপাল। সেখানে চেপে ধরে বসে পড়েছেন তিনি টি-টেবিলে। তা দেখে ফারনাজের ছোটো বোন নিশা আর সৈয়দ কবিরও চিৎকার করে উঠল।
সিকিউরিটি গার্ডের ঘুমও ভেঙে গেছে৷ ভাঙা জানালার দিকে একবার তাকিয়ে সে গেট খুলে বাইরে এলো৷ কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারের মাঝে সুদূরে তখন মিলিয়ে যাচ্ছে শারফানদের বাইকগুলো৷ সে দুটো বাইক দেখতে পেল শুধু।
***
বাড়ির গলিতে নেমে পড়ল রিহান আর শারফান৷ বাকিরা চলে গেল যার যার বাড়ির উদ্দেশে৷ ছেলেবেলার একটা মুহূর্ত বহুবছর পর উপভোগ করতে পেরে চঞ্চল রিহান তা এক্ষুনি প্রেমিকাকে মেসেজে জানানো শুরু করল৷ হাঁটতে হাঁটতে তা দেখতে পেয়ে শারফানের মনে কী যেন ভাবনা উদয় হলো৷ ঝটপট সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লাগাল ‘সানাপোনা’ নামে সেভ করা নম্বরটাই।
রাত একটা পর্যন্ত ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করে‚ পান্থর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর ঘুমিয়েছে সানা। আর এই সময়টা হলো সবার গভীর ঘুমের সময়৷ বালিশের নিচে অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা কেঁপে যাচ্ছে। প্রথম দু’বার কলটা কেটে গিয়ে তৃতীয়বারের সময় টের পেল সানা। ঘুম জড়ানো চোখে ঠিকঠাক দেখতে পেল না নম্বরটা৷ এত রাতে অপরিচিত কারও থেকে তো কল আসে না কখনো ওর কাছে। তাই ভেবে নিলো হয়ত পান্থই হবে৷ কারণ‚ পান্থর ফোন নম্বর কোনো নামেই সেভ করে না সে।
“হ্যালো”‚ খুব বিরক্তির সঙ্গে বলল সানা‚ “কী হয়েছে?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকল শারফান। তারপর কী ভেবে ঠোঁটে ওর মুচকি হাসি ফুটল‚ “হেই পামকিন!”
বুকের বাঁ পাশটাই ধক করে উঠল সানার‚ গলাটা শোনা মাত্রই। ওপাশ থেকে পালটা প্রশ্ন এলো‚ “বয়ফ্রেন্ড আছে না-কি?”
“আপনি!” ফিসফিস আওয়াজ বের হলো সানার বিস্ময় কণ্ঠ থেকে। বুকের ভেতর ধকধকানি বাড়তে থাকল ক্রমাগত।
“কাকে ভেবেছিলে? বয়ফ্রেন্ড‚ না?”
“কেন কল করেছেন আপনি?” লেপের নিচে ডুব দিয়ে আবারও ফিসফিসাল সানা৷
“কল কেন করে মানুষ?”
“আশ্চর্য! এত রাতে আমার কাছে আপনি কেন কল করবেন?”
শারফান চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। ঘুম মেশানো সানার নরম‚ মিষ্টি কণ্ঠে ফিসফিসানি শুনতে কেমন বিশেষ অনুভূতির আবির্ভাব ঘটছে ওর অন্তস্তলে। আর সে অনুভূতিটা ভীষণ বিব্রতপূর্ণ।
“ফোন রাখুন”‚ অনুরোধ সুরে বলল সানা‚ “আর কল করবেন না প্লিজ।”
তা শুনে শারফান দৃপ্তকণ্ঠে হুমকি দিলো‚ “তুমি নরমালি কথা বলো নয়ত তুলে নিয়ে আসব।”
ফিসফিসিয়েই বলল সানা‚ “রাত তিনটা‚ চারটার দিকে ফোন দিয়ে বলছেন নরমালি কথা বলতে? আপনার সমস্যা কী? রাতে ঘুমান না?”
হাসল শারফান‚ “ঘুমাতাম। কিন্তু আজকের পর তো মনে হচ্ছে নাইট শিফট ডিউটি শুরু করতে হবে।”
“যেই শিফট মনে হয় সেই শিফট করুন৷ আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন? রাখুন তো। না‚ আমিই রাখছি। প্লিজ আর কল করবেন না।”
“কল কাটলেই তোমার বাড়িতেও ডাকাত পড়বে কিন্তু।”
“এদিকে ডাকাত পড়ে না কোনোদিন।”
“কারণ‚ ডাকাত এতদিন ঢাকায় থাকত। তোমার খোঁজ জানত না৷ তাই পড়ত না। কিন্তু এখন পড়বে।”
“উফঃ”‚ রেগেমেগে লেপের ভেতর থেকে মুখটা বের করে বলল সানা‚ “আপনি দিনের বেলাও তো কল করতে পারতেন। পাশের ঘর থেকে আমার আব্বু‚ আম্মু নয়ত দাদী যদি শুনতে পায়! আমার কী হবে জানেন?”
“বিয়ে করিয়ে দেবে ফারনাজের সাথে‚ তাই তো?”
“না”‚ রাগের চোটে দাঁতের ওপর দাঁত রেখে বলল সানা‚ “ফারনাজকে আমি বিয়ে করব না। আমার আব্বু আম্মুও করাবে না। আপনি ফারনাজের নাম বলে বলে আর খেপাবেন না তো।”
দাঁত বের করে হাসতে থাকল শারফান‚ “তাহলে কার নাম বললে আরাম পাবে বলো?”
“আরাম পাবো আবার কেমন কথা?”
“আরাম লাগা কথা। ভালো লাগে না শুনতে?”
“না‚ বাজে লাগে।”
শব্দটা প্রয়োগের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আসলেই বাজে। আজ-কালের বখাটে ছেলেপুলেরা নানানভাবে বলে বেড়ায় মেয়েদের ইঙ্গিত করে৷ শারফান অবশ্য আজই প্রথম প্রয়োগ করল।
“ঠিক আছে‚ তো বলো তোমার বয়ফ্রেন্ডের কথা। ভেবেছিলে সে-ই কল করেছে৷ তাই অত সেক্সি ভয়েজে ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করেছিলে‚ তাই না?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ”‚ বিড়বিড়াল সানা। ঝট করে কলটা কেটে দিলো। লজ্জায় কান দিয়ে ওর ধোঁয়া ছুটছে যেন৷ এক নাগাড়ে গালাগাল করল শারফানকে। তখনই কল দিলো শারফান। ধরল না ও। কল কেটে যাওয়ার সেকেন্ডের মাথায় হুমকিস্বরূপ মেসেজ এলো‚ “রিসিভ করো। নইলে সত্যিই চলে আসব।”
“এসেই দ্যাখ বাড়ির সামনে!” ফোনের দিকে চেয়েই গালাগাল করল সানা‚ “তোর জাঙ্গিয়া খুলে একদম আগুন লাগিয়ে দেবো‚ ল্যাওড়ার পুত।”
কল করল শারফান আবার৷ না ধরার বদলে সানা সরাসরি কলটা কেটেই দিলো৷ দ্বিতীয় মেসেজ এলো এরপর‚ “ওকে‚ হানি… নাও হ্যাভ আ সুইট ড্রিম অ্যাবাউট মি। চেক দ্য হোয়াটসঅ্যাপ।”
হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশন এলো তারপরই। গতকাল কনভেনশন হলের ওয়াশরুমে ওকে সেই জড়িয়ে ধরার ছবিটা পাঠিয়েছে শারফান। ফোনের দিকে চেয়ে ঝড়ের বেগে উঠে বসল সানা। ওর চোখের সামনেই তো ছবিগুলো ডিলিট করে দিয়েছিল শারফান৷ তাহলে বদমাশটা কী করে পেল আবার? বুকের ভেতর কাঁপন তো শুরু হলোই‚ হাতটাও কাঁপতে আরম্ভ করল ওর৷ শারফান যে চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ তা সে বুঝে গেছে এ কদিনেই৷ সেই ছেলের কাছে এমন ছবি থাকা মানে ওর ইজ্জত হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছে শয়তানটা। ভয়ে কান্না পেয়ে গেল বেচারির। কল করল শারফানকে সঙ্গে সঙ্গেই।
কিন্তু ধরল না শারফান। সানাও থামল না। লাগাতার কল করেই গেল। এক পর্যায় গিয়ে শুনতে পেল নম্বরটা ব্যস্ত আছে বলছে। চেষ্টা করল সে তারপরও কয়েকবার৷ একই কথা বলতে থাকল ফোনের ওপাশ থেকে৷ শেষমেশ বুঝতে পারল ওর নম্বর ব্লক করে দিয়েছে শারফান৷ কিন্তু তা নিশ্চয়ই সারাজীবনের জন্য নয়? পরবর্তীতে আবার যখন ওকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা হবে তখনই কল করবে শারফান।
***
হক বাড়ির স্টিলের বিরাট গেটে প্রবেশের পর সামনে পড়ে পরিষ্কার‚ পরিচ্ছন্ন কর্টইয়ার্ড। তার মাঝ দিয়ে চলে গেছে পার্কিং লট অবধি পেভমেন্ট কংক্রিট টাইলসের সরু রাস্তা। শারফানের লাল সেডান‚ শাফিউল আর শাকিবুল হকের দু দুটো সাদা আর কালো ল্যান্ড ক্রুজার পার্ক করা।
বাড়ির সামনে বড়ো উঠোন থাকলে গৃহকর্ত্রী অথবা বাড়ির মেয়েরা শখ করে ফুল গাছ‚ ফল গাছ বা সবজির বাগান করে৷ কিন্তু শাফিউল সাহেবের বাড়িতে শুধু শোভাবর্ধক হিসেবে কর্টইয়ার্ডের চারপাশে কিছু নানা জাতের পাতাবাহার আর শারফানের পছন্দ অনুযায়ী দু’চারটা ফুল গাছ লাগানো। বাগানের প্রতি একমাত্র শারফানের একটু আধটু শখ থাকলেও কেন যেন শখ নেই জেসমিন বেগমের। এই জায়গা শুরুতে যার ছিল কেবল সেই ব্যক্তি বহু বছর আগে ব্যাক ইয়ার্ডে লাগিয়েছিল গোটা তিনেক নারকেল গাছ‚ একটা বড়ই গাছ‚ আমড়া গাছ‚ লিচু আর একটা কামরাঙা গাছ। তার বদৌলতেই সেগুলো আজ এই বাড়ির সম্বলরূপে রয়েছে। মূলত ফলের মৌসুমে গ্রামের বাড়ি থেকে অঢেল পেয়ে থাকেন হক ভাইয়েরা। এজন্যই নতুন করে ফলের বাগান তৈরির কোনো আগ্রহ নেই কারও।
সকাল সকাল শারফানের ঘুম ভাঙলে ব্যাক ইয়ার্ডে আর নয়ত ছাদে গিয়ে লাফঝাঁপ করে‚ ব্যায়াম করে৷ গতকাল রাতে চারটার পর বাসায় ফিরে বেচারার ঘুমটা মোটেও ভালো হয়নি। ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত৷ বিছানাতে গাটা কোনোভাবে এলিয়ে দিলেই সে ঘুমে বেহুঁশ হয়ে যায়৷ অন্যদের মতো এ-কাত‚ ও-কাতও করতে হয় না৷ ভোর ছটা পর্যন্ত চেষ্টা করেও যখন ঘুমটা হলো না তখন খিটখিটে মেজাজটা নিয়ে সে বাইরে এলো কিছুক্ষণ শরীরচর্চার জন্য। ভোরে হাড় কাঁপানো শীত অনুভব হয়। তারপরও কালো হাফ প্যান্ট আর ধূসর রঙা ঢলঢলে একটা টি-শার্ট পরনে ওর৷ স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে দাঁড়াল। শিশির ভেজা ঘাস৷ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আশেপাশে চোখ বুলাল কতক্ষণ। মাথার ওপর‚ গাছের ফাঁকে ফাঁকে জলবিন্দুর পুঞ্জ ধোঁয়ার মতো দেখা যায় কুয়াশাকে। শীতের এই কুয়াশাজড়ানো সকাল ওর সব সময়ই খুব পছন্দ৷ তাতে যতই ঠান্ডা লাগুক।
বড়ই গাছের নিচু মোটা ডালটাই রিং ঝোলানো। রিং দুটো ধরে ডিপস হয়ে ঝুলে পড়ল সে। অল্পক্ষণেই গা দিয়ে ঘাম ছুটে গেল। মিনিট পনেরো শুরু করল পুল আপস দেওয়া। শীতের কোনো স্পর্শই আর অনুভব হচ্ছে না।
ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে শাফিউল সাহেব অভ্যাস মোতাবেক বাউন্ডারি করা বাড়ির চারপাশে হেঁটে বেড়ান৷ পেছনে দু হাত বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে আজও বাড়ির পেছন দিকে এলেন৷ হাঁটার মাঝে বেখেয়ালেই চোখ গেল রিঙে মাসল আপস দিতে থাকা ছেলের দিকে। মাটির দিকে দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে ব্যায়ামে মগ্ন সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তা নিষ্পলক দেখলেন কতক্ষণ তিনি৷ চোয়ালদুটো কঠিন হয়ে ঘামে ভেজা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠেছে শারফানের। শাফিউল সাহেব বুঝতে পারলেন প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে ছেলেকে। এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন ওর সামনে‚ “নামাজটা পড়ে এসেও তো এক্সারসাইজ করা যেত।”
উত্তর দিলো না শারফান। তাকালও না। নিজের নির্দিষ্ট সময় অবধি আরও কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে তারপর নেমে দাঁড়াল। একটানে টি-শার্টটা খুলে মুছে নিলো আগে মুখটা। শাফিউল কাছ থেকে দেখলেন আজ ছেলের পরিশ্রমে বানানো শরীরটা—সুগঠিত‚ পেশিবহুল হাত‚ প্রশস্ত বুক আর কাঁধ‚ নাভির নিচে এবং ওপরে ভাজ ভাজ‚ পেটের পেশি শক্ত হয়ে নতুন আকার। চুল আর চেহারার পিছেও অবশ্য কম মেহনত যায় না ছেলের। নিজেকে আকর্ষণীয় আর পরিপাটি রাখার মতো যদি টাকাগুলোরও যত্ন নিতো! মনে মনে আফসোস করে মাথাটা দোলালেন মৃদু।
“সবরকম ফরমালিটি শেষ”‚ গা মুছতে মুছতে শারফান জানাল বাবাকে‚ “এহসান কনফার্ম করল গতকাল। নির্বাচনের পরই এসএস কোম্পানি ওপেনিং করব।”
“অফিসের ইন্টেরিয়র ওয়ার্ক শেষ?”
“পুরোটাই বাকি।”
“তাহলে ওপেনিং করবি কীভাবে? আমি তো আর কোনো খরচা দেবো না।”
শুষ্ক গলায় বলে উঠল শারফান‚ “দিতে বলেছি তোমাকে? রেস্ট্রন্ট ওইটা বিক্রি হয়ে গেছে৷ টাকা আজকের মধ্যে ঢুকবে অ্যাকাউন্টে। এই মাসের ভেতরেই বাকি কাজ সব শেষ হয়ে যাবে।”
নিজের জমানো এবং বাবার থেকে ধার নিয়ে নির্মাণসামগ্রী আর রাসায়নিক দ্রব্যের নতুন একটি কোম্পানি করার কাজে হাত দিয়েছিল সে গত বছরই৷ একটু একটু করে সবটা তৈরির কাজে খরচা করছিল। কিন্তু গত দু-তিন মাসে বাপ-চাচার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে সেই কাজ পিছিয়ে পড়ে। শেয়ার লিখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে শাফিউল সাহেব এক পয়সাও আর ব্যয় করেনি সেখানে। কারণ‚ কোম্পানির স্বত্বাধিকার ওটা একান্তই ওর। লাভ-ক্ষতির সম্পূর্ণ দায়ভারও ওকেই নিতে হবে। এবং মাসে মাসে নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা বাবাকে ধারের টাকা বাবত পরিশোধ করতেই হবে।
তেরছা চোখে বাবার দিকে তাকাল শারফান‚ “হক গ্রুপের সঙ্গেই যে সিরাজ কাজী কোলাবোরেশন করবে এমনটা ভেবে বসে থেকো না। কারণ‚ এসএস কোম্পানি কিংবা হক গ্রুপ যে-কোনো একটির সঙ্গে কোলাবোরেশন করবে সে। হতে পারে আমার সঙ্গেই করল শুধু।”
কথাটা শোনা মাত্রই থমথমে ভাব দেখাল শাফিউল সাহেবের চেহারা‚ “তুই এখনই আমাদের টপকানোর চেষ্টা করছিস?” তর্জন করে উঠলেন‚ “খবরদার শায়াফ‚ হক গ্রুপের কোনো পার্টনার‚ কোনো ক্লায়েন্টের দিকে যদি হাত বাড়াস তুই!”
বাপের কথায় মুখ নুয়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল শারফান। “সিরাজ কাজী হক কোম্পানির কিছুই না‚ আব্বু”‚ বলে দৃষ্টি তুলল‚ “সে তার মর্জি মাফিক কাজ করবে। টপকাতে চাইলাম কখন?”
“সেদিন তুই কথা বলেছিস তার সঙ্গে আমাদের গ্রুপের জন্য আর গোপনে মিটিং করেছিস তোর কোম্পানির জন্য। তাহলে কখন টপকাতে চাইলি তা খাতা কলমে লিখে বোঝাতে হবে?”
“সে আমার সঙ্গে দেখা করতে ফরিদপুর এসেছিল”‚ নিজের বুকে আঙুল তাক করে শারফান বলল দম্ভের সঙ্গে। “ভুলে গেছ?”
“হক গ্রুপে টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট শেয়ার আছে তোর”‚ ধমকে বললেন শাফিউল‚ “সেটা ভুলে গেছিস?”
“একদম ভুলিনি”‚ মুচকি হাসল সে। “আমি আমার এই…”‚ কপালের পাশে তর্জনী আঙুল ঠেকাল শারফান‚ “এই মগজটার দৌড় জানি। দৌড় দেওয়াতেও জানি। এই পাঁচ বছরে যখন এটার ওপর ভরসা করে গেছ। এখনো করতে হবে৷”
“আমাকে ভেড়া ভাববি না একদম। সিরাজ কাজী যেখানে কোলাবোরেশান করবে সেখানে কতটা ফলপ্রসু হবে তা স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাও বুঝবে।”
“তাকে তার মর্জির ওপর ছেড়ে দাও না!” ফিচেল হেসে বলল সে‚ “চলো ঘরে। কাকাকে ডেকে তিন কাপ গ্রিন টি নিয়ে বসি।” দাঁড়াল না আর তারপর।
গম্ভীর চেহারাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শাফিউল। শুধু লাগাম ছাড়া ঘোড়ায় নয়‚ বেপরোয়া এক পাগলা ঘোড়া তার ছেলে৷ সেই ছেলের লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা বহু আগেই হারিয়েছেন তিনি৷ শাকিবুল সাহেব যখন জানবেন শারফানের মনোবাসনা বা গোপন উদ্দেশ্য‚ কী যে তাণ্ডব শুরু হবে তখন হক বাড়িতে! সম্পর্ক ঠিক জায়গাতে থাকবে তো? আরেকটা ভাবনা মাথায় এলো তার৷ কোম্পানির মামলা যদি মানিয়েও নেন তার ভাই। মিথির সঙ্গে বিয়েটা চূড়ান্তভাবে ঠিকঠাক হওয়ার পর পাজিটা যদি বেঁকে বসে তখনই তো মহাপ্রলয় ঘটিয়ে ছাড়বেন শাকিবুল। তাই ঠিক করলেন বিয়ের সিদ্ধান্তটা তারা বড়োরা মিলে নিলেও তার একটা আভাস বা সিদ্ধান্তর ব্যাপারে এখনই জানিয়ে রাখা উচিত শারফানকে৷
“ওই দাঁড়া”‚ পিছু ডেকে এগিয়ে গেলেন শাফিউল ছেলের দিকে।
দাঁড়িয়ে পড়লেও শারফান ফিরে তাকাল না। কোমরের দু পাশে হাত দিয়ে বড়ো বড়ো করে তিনবার নিঃশ্বাস টেনে নিলো৷ বাবা এসে পড়লে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করল তারপর। তখন জিজ্ঞেস করলেন শাফিউল সাহেব‚ “মিথিকে কেমন লাগে তোর?”
“ন্যাস্টি।”
“কী!” ভ্রু কুঁচকে ফেললেন শাফিউল।
উদাস গলায় জানাল শারফান‚ “ভাল্লাগে না।”
“কেন?” চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিতে নিতে ছেলের মুখটা দেখলেন শাফিউল‚ “স্টুডেন্ট ভালো‚ ভিকারুন্নেসাতে পড়ে‚ দেখতে শুনতেও সুন্দর। কী মিষ্টি একটা মেয়ে! তোর পছন্দসই স্মার্ট আর মডার্নই তো।”
“আলট্রা মর্ডান৷ পানিতে পড়ার আগেই সাঁতার কাটতে চায়”‚ বলে সে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে।
কিন্তু ওর কথার কোনো মানে বুঝলেন না শাফিউল সাহেব‚ “এই‚ কী বললি? ক্লিয়ার করে বল।”
বসার ঘরে এসেই শারফান ধপ করে বসে পড়ল সোফায়৷ “আম্মু”‚ চিৎকার করে জেসমিন বেগমকে ডেকে বলল‚ ঘর থেকে কমফোর্টারটা একটু এনে দাও।”
“গোসল না করে কোথাও ছাগলের মতো গা ঘষাঘষি করে বেড়াবি না”‚ ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন শাফিউল সাহেব গুরুগম্ভীরভাবে‚ “আর মিথির বিষয়ে সোজাসুজি বল৷ ফাজলামি‚ ফালতু কথাবার্তা বলবি না একদম।”
গা এলিয়ে বসে নির্লিপ্ত চোখে তাকাল শারফান‚ “ভালো হতে বলো তাই ভালোভাবে‚ ভদ্রভাবে বললাম। পছন্দ হলো না তাও?”
“হেহ্”‚ তিরস্কার গলায় বলে উঠলেন তিনি‚ “তুইও ভালো হবি আর কলাগাছও মানুষ হবে।” তারপরই অকপটে জানালেন‚ “নির্বাচনের পরই মিথিকে বউ করে তোমার ঘরে নিয়ে আসব। সেটাই জানানোর ছিল তোমাকে‚ জানিয়ে দিলাম৷ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ো বিয়ের।”
“বউ করে আমার ঘরে ঢোকাবে?” কপট সরল মুখ করে বলল শারফান‚ “ওর বাড়ি গেলে ও তো এমনিতেই নিশিরাত‚ ভরদুপুর‚ যখন তখন আমার ঘরে ঢুকে পড়ে৷ ফ্রিতে পাওয়া কত স্পেশাল মিষ্টি জীবনে মুখে দিলাম না। আর ওর মতো আলগা থাকা‚ মাছি পড়া মিষ্টিকে কিনে খাবো না-কি? আর তার থেকে বড়ো কথা হলো‚ সিনেমা রিলিজ হওয়ার আগেই আমার দেখা শেষ। দেখা জিনিস আবার খরচা করে দেখার কী আছে?”
শাফিউল সাহেব যেন মূর্তি বনে গেলেন। আর তার চেহারার অবস্থাটা দেখাল ডুবন্ত তেলে ফুলে ওঠা লুচি হঠাৎ করে ফেটে যাওয়ার মতো। নিজের চরম ভুলটাও মনে করে ভাবলেন‚ আর কোনোদিনও ছেলেকে সোজা সাপটা কথা বলতে বলবেন না। নির্বিকারভাবে তার বিব্রত আর চুপসানো মুখটা দেখে শারফান পা বাড়াল সিঁড়িতে। ওকে যেতে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারলেন না তিনি৷
সিঁড়ির মাঝপথে গিয়ে শারফান হঠাৎ গলা ছেড়ে বলে বসল‚ “ওসব অখাদ্য‚ দুর্গন্ধ আমার ঘরে এনো না‚ আব্বু। ভেঙেচুরে বস্তায় ভরে সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে তুলে দেবো কিন্তু।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৪.
নিশা এসে কফি টেবিলের ওপর নাশতার ট্রে রাখল। এক নজর ট্রেটা দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো সানা। এক গ্লাস পানিও স্পর্শ করবে না সে বড়ো চাচার বাড়ির। পাশে বসা মেহার হাতটা চেপে ধরে ইশারায় সতর্ক করল তাকেও।
মাথাটা সোফার গায়ে এলিয়ে বসে আছেন জাহিদা বেগম আর তার পাশেই নাজমা বেগম আর দিনার মা সাবিহা। গতরাতের দুর্ঘটনা শুনে তারা দেখতে এসেছেন জাহিদাকে। কপাল ফেটে চারটা সেলাই লেগেছে তার৷ আজ দুপুর অবধি হাসপাতালেই ছিলেন৷ বড়ো ভাইয়ের থেকে খবর পেয়ে সকালে গিয়ে দেখে এসেছিলেন মোস্তফা সাহেব। বাসায় ফিরে স্ত্রীকে তিনিই বলেন পুরোনো কথা আপাতত ভুলে অসুস্থ মানুষকে দেখে আসা উচিত। তাছাড়া আত্মীয়তার সম্পর্ক তিনি একবারে ছিন্নও করতে চান না৷ তার কথা মতোই বিকাল হলে মেজো জা‚ শাশুড়ি আর দুই মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন ফারনাজের বাসায়। ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় ব্যথার চোটে গোটা দিন দারুণ ভুগেছেন জাহিদা বেগম৷ কথা বলছেন আঘাত পাওয়া কুকুরের মতো কুঁই-কুঁই আওয়াজে। তাই দেখে মেহা মুখ ঘুরিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছে।
প্রায় বছরখানিক পর ওদের আসা হলো ফারনাজের বাসায়। বসার ঘরে বসতেই সেদিনের অপমানগুলোর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠল সানার চোখের সামনে। যেখানে ওরা দুই বোন বসে আছে সেখানটিতেই নত মুখে বসেছিলেন মোস্তফা আর নাজমা বেগম। আর জাহিদা বেগম ওখানেই বসেছিলেন বড়ো মেয়ে ফারিয়া আর ফারিয়ার শাশুড়ির সঙ্গে৷ তাদের সেদিনের বলা প্রতিটি কথায় স্মরণে আছে ওর৷ পান চিবুতে চিবুতে ফারিয়ার শাশুড়ি বলেছিলেন বৃদ্ধা জোহরাকে‚ “এহনকার পোলাপাইনরা সমানে সমানে বিয়া করে‚ মাউই৷ ডাক্তারে করে ডাক্তাররে‚ উকিলি করে উকিলরে‚ ইঞ্জিনিয়ারে করে ইঞ্জিনিয়াররে৷ আর বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী‚ নেতাকুতারা করে তাগের ওজনের ফ্যামিলিতি।”
ঠিক এই কথাগুলোর পরই ফারিয়া হাসতে হাসতে কটাক্ষের সুরে বলেছিল দাদীকে‚ “রাজা বাদশাদের যেইসব ছেলেপুলে অযোগ্য থাকত সেইসব ছেলেদের বিয়া করাইতো ছোটোখাটো পদমর্যাদার পরিবারে৷ তোমার নাতি কি অযোগ্য‚ দাদী? ভাইয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথেই তো যায় না সানার। বাকিসব হিসাবের কথা বাদই দিলাম।”
ফারিয়ার স্পষ্ট তিরস্কার ছিল এজন্যই যে‚ ফারনাজ পড়োশোনা শেষ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সানা সেখানে ফরিদপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে।
অস্বস্তি আর অপমানে মোস্তফা সাহেব শীতল কণ্ঠে কেবল বলেছিলেন জাহিদাকে‚ “আম্মা শুধু নিজের শখ থেকেই বলেছে‚ ভাবি। আপনি ওনার কথায় গুরুত্ব দিয়েন না।”
পাশে বসা নাজমা বেগম তখন পারছিলেন না স্বামীর মতো করে শান্তভাবে অপমানটা গায়ে সয়ে নিতে৷ তার মুখের কাঠিন্যতা টের পেয়ে জাহিদা বেগম তখন তাকেই ইঙ্গিত করে জবাব দিয়েছিলেন‚ “কোনোখান থেকে সায় না পেলে কি আম্মা এমন শখ টিকায় রাখতে পারে‚ মোস্তফা? আমার ফারনাজের জন্য যেসব ঘর থেকে সম্বন্ধ আসতেছে তা কি আম্মা দেখতেছে না? এমপির ভাগ্নি‚ ইকবাল হাসান স্টিল কোম্পানির মালিকের মেয়ে‚ ফরিদপুরের আরও কত বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীর ঘর থেকে আসতেছে… মাশা আল্লাহ। সেইসব সম্বন্ধ দেখার পরও আম্মা সানার মতো মেয়েরে নিয়ে শখ করতেছে। তা তো আর খালি নিজের শখ থেকে না।”
আর এ কথাগুলোর পরোক্ষ ইঙ্গিত নাজমা বেগমের বুঝতে অসুবিধা হয়নি সেদিন। স্বামীর মতো চুপচাপ আর হজম করতে পারেননি তিনি৷ জবাবের পিঠে জবাব দিতে দিতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বিরাট হাঙ্গামা— জাহিদা আর ফারিয়ার অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ‚ নাজমা বেগমের পরিবারকে ছোটো করে অপমান‚ মোস্তফা সাহেবের আর্থিক অবস্থা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা‚ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়া নিয়ে সানাকে হেয়।
“লোভী‚ চালাক কুত্তা‚ ফারনাজরে ছাওয়াল মানো‚ না? কীজন্য অরে অত আদর সুহাগ ঠেঙাও তা যেন বুঝিনে? ফারদার আমার ফারনাজের ওপর চোখ দিস! তোগের মেয়াসহ তোগের চোখ খুঁইচা নিবো আমি।” হুঙ্কার স্বরে মোস্তফা আর নাজমা বেগমকে বলা এটিই ছিল শেষ কথা জাহিদার।
সেদিনটা মনে পড়তেই রাগে দপদপ করে উঠল সানার মাথাটা। আহত জাহিদার দিকে তাকাল ঘৃণাভরে। তাকে দেখতে দেখতে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল মেহা‚ “যত যা-ই বলুক আব্বু। এই মহিলার কাতরানি দেখতে আমার খুব ভালো লাগছে। যেদিন আব্বু আম্মুকে গালাগাল করেছিল সেদিন না আমার ইচ্ছে হয়েছিল এরকম করেই ওনার মাথাটা ফাটিয়ে মেরে ফেলতে। কালকে রাতে ঢিলটা যে মেরেছিল তাকে কোনোদিন সামনে পেলে তার পায়ে ধরে সালাম করতাম আমি।”
শেষ কথাটা কানে পৌঁছতেই ভাঙা জানালাটার দিকে তাকাল সানা। মনে পড়ল শারফানের কথা৷ রাত তিনটাই যখন কল করেছিল ওকে শয়তানটা তখন নিশ্চয়ই এই অকাজ ঘটিয়ে ফিরছিল সে! ব্যাপারটাতে ওর এক বিন্দুও সন্দেহ নেই যে শারফানই ঢিলগুলো ছুঁড়েছিল৷ কী দুঃসাহস রে বাবা! তাকে সন্ত্রাসের লিডার বলে তো মেহা একেবারেই ভুল করেনি।
“আম্মু”‚ হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলল সানা‚ “আমার পড়া আছে পাঁচটায়। বের হতে হবে এখনই।”
ওর কথা শুনে জাহিদা বেগম তাকালেন। দেখলেন সামনে রাখা নাশতা পানির কিছুই মুখে তোলেনি দুই বোন৷ “ওরে সানা”‚ কোঁকাতে কোঁকাতে ওদের বললেন‚ “খাইস নাই তো কিছু। খা‚ খাইয়া তারপর যাইস।”
“বেলা করে দুপুরের খাবার খেয়েছি সবাই৷ তাই আর পেটে জায়গা নেই‚ কাকি। অন্যদিন এসে খাবো।” বলেই মাকে ইশারা করল‚ “ওঠো তাড়াতাড়ি।”
নিশাও সাধাসাধি করল‚ “আরে অল্প কিছু তো মুখে দে। একেবারেই কি না খেয়ে যাবি?”
“আমরা কি মিসকিন? খেতে আসছি তোদের বাড়ি?” চোখা দৃষ্টিতে চেয়ে কথাটা বলল মেহা মনে মনেই। আর সানা কোনো জবাবই দিলো না। সোফা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তা দেখে জাহিদা বেগম বললেন দুই জাকে‚ “তা আজকে থাক তোরা।”
জোহরা খাতুনও এসেছেন। তাকে দেখিয়ে নাজমা বললেন‚ “আম্মা থাকতে চাইলে আম্মাকে রেখে দেন‚ ভাবি। আমার তো থাকার কায়দা নেই।”
দিনার মাও তা-ই বললেন। কিন্তু জাহিদা বেগম পীড়াপীড়ি করলেন তাদের আরও কিছুক্ষণ। এর মধ্যেই প্রবেশ ঘটল ফারনাজের। সরাসরি চোখাচোখি হলো সানার সঙ্গে। নিমেষেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সানা তাড়া দিলো মাকে আবারও। ফারনাজ বলল চাচিদের‚ “তোমরা দুজন অন্তত থাকো আজকে৷ ওদের দুই বোনকে নামিয়ে দিয়ে আসব আমি।”
শুনলেন না নাজমা বেগম। জাকে সাবধানে থাকার কথার বলে‚ বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ফারনাজ নিজের গাড়ি ছাড়া ছাড়ল না তাদের। মেজো চাচিকে পৌঁছে দিয়ে তারপর এলো সে ছোটো চাচার বাসায়৷ সানাকে ঘরে ঢুকে বই নিয়েই আবার বেরিয়ে পড়তে দেখে চাচার বাসায় আর দাঁড়াল না দু দণ্ড৷ ওকে পিছু ডেকে বলল‚ “গাড়িতে ওঠ। আমি দিয়ে আসছি।”
অনিহার সঙ্গে বলল সানা‚ “বিকালে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যেস আমার। হেঁটে ছাড়া যাব না আমি।”
গম্ভীর হলো ফারনাজের মুখটা। “একটা দিন অভ্যেস বাদ দিলে ক্ষতি নেই”‚ বলেই চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল নাজমাকে‚ “ছোটো কাকি‚ সানাকে আমি নামিয়ে দিয়ে আসব?”
গেটের সামনেই দাঁড়ানো দুজনে। তাই ভেতর থেকে শুনতে পেলেন নাজমা। এগিয়ে এসে বললেন‚ “সানা চাইলে দিয়ে আয়।”
“বলছে তুমি বললে যাবে”‚ সানার দিকে চেয়ে নিম্ন ঠোঁট মুখের ভেতরে নিয়ে মৃদু হাসল ফারনাজ‚ “তুমি বলো ওকে।”
গেটের মুখে এসে দাঁড়ালেন নাজমা। নীরস মুখে এক হাতে অ্যাকাউন্টিংয়ের বই ধরে দাঁড়ানো সানাকে কয়েক নজর দেখলেন। “ঠিক আছে‚ “নিয়ে যা।”
***
প্যাসেঞ্জার সিটে সানা আর ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত ফারনাজ। তাকে আজ হঠাৎ ড্রাইভার ছাড়া দেখে জিজ্ঞেস করল সানা‚ “রাতে অমন হামলা হওয়ার পর আজকে ড্রাইভার ছাড়া‚ লোকজন ছাড়া একা গাড়ি নিয়ে বের হলেন? ভয় করছে না?”
জবাব দিলো না ফারনাজ। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর প্রশ্ন করল আকস্মিক‚ “কুত্তার বাচ্চাটা কি তোকে এখনো বিরক্ত করে?”
শারফান! গালিটা শুনে চকিতেই শারফানের কথা মনে এলো সানার৷ তারপরও না বোঝার ভান করল‚ “কার কথা বলছেন?”
জবাব সঙ্গে সঙ্গেই দিলো না ফারনাজ৷ বেশ কিছুক্ষণ পর বলল‚ “তোকে ইদানিং বিরক্ত করে একজনই। আর কারও সাহস নেই তোর দিকে তাকানোর।”
ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে তাকাল সানা৷ ফারনাজের মতো শারফানকে কুত্তার বাচ্চা গালিটা দিতে না পারলেও কুত্তাই বলল সে মনে মনে। যেদিন থেকে ওই ছেলেটা ওর জীবনে ঢুকেছে সেদিন থেকে এমন এক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছে যার সমাধান সে খুঁজেই পাচ্ছে না। না পারছে বাবাকে জানাতে আর না পারছে ফারনাজকে। আদৌ বলা উচিত কি না বলা উচিত‚ আসলে সেটাই সে বুঝতে পারছে না৷ এই যে ফারনাজের বাড়িতে রাতে যে হামলাটা করল শারফান‚ সেটা ফারনাজ ইট ছুঁড়েছিল বলেই তো তারই জবাবে পাটকেল খেল৷ আবার ওকে যেভাবে হয়রানি করছে শারফান তার জন্য সত্যিই এক চোট মার খাওয়া উচিত শয়তানটার। ফারনাজকে জানালে এর বিপরীত হবে না। কিন্তু মাঝখান থেকে তো ফাঁসবে সে। বিষয়টি নিয়ে যখন জলঘোলা পর্যায়ে যাবে তখন সবাই জানবে এক নারী ঘটিত মামলার কারণে দুই প্রতিপক্ষের মাঝে গোলমাল সৃষ্টি হয়েছে৷ ওর নাম জানবে‚ ওর বাবার মতো সম্মানিত ব্যক্তির নাম জানবে সবাই৷ একেকজন একেকভাবে তখন বিচার করবে। আরও নানান পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। বর্তমানের থেকেও মূলত সামনে কী হতে পারে এসব বিবেচনা করেই সানা পড়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে।
গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল ওয়াসিত্ব টাওয়ারের সামনে৷ তা দেখে সানা বলল‚ “আমাকে অম্বিকা হলের ওখানে যেতে হবে।”
ভ্রু কুঁচকে জানালার বাইরে তাকানো ফারনাজ বলল অমনোযোগভাবে‚ “যাব ওখানেই। বস।” বলেই আচমকা গাড়ি থেকে নামল সে। তার দৃষ্টি লক্ষ করে সানাও তাকাল। দোকানটাই ফাস্টফুডসহ চা‚ ফুচকা বিক্রি হয়। সেখানেই অপ্রত্যাশিত শারফানের দেখা পেল ও। গোটা তিনেক বন্ধুর সাথে বসে চা খাচ্ছে৷ খেয়াল করল‚ আরও অপ্রত্যাশিতভাবে শারফানের নজর ছুটে এসেছে ওর দিকেই৷ কিন্তু ভয়াবহ বিষয় হলো তার কাছেই ফারনাজ হেঁটে যাচ্ছে। গতরাতের হামলা যে শারফানই করেছিল তা নিশ্চয়ই সে বুঝে গিয়েছে আগেই? ধারণাটা হতেই সানার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। শোধ তুলতে গেল না তো ফারনাজ?
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গাড়ির ভেতরে বসা সানাকে দেখল শারফান সরু দৃষ্টিতে। আর সেই দৃষ্টিজোড়া দেখতে দেখতে এগিয়ে আসতে থাকল ফারনাজ। সফেদ‚ পরিষ্কার পাজামা-পাঞ্জাবি আর ওপরে জড়ানো কালো শাল৷ অনায়াসেই প্রায় সকলের মনোযোগ টেনে নিলো সে। সানাকে দেখা শেষে শারফানও দৃষ্টি ফেলল তার দিকে।
“কীরে‚ মাদার**টা কি আমাদের কাছে আসতাছে?” মৃদুস্বরে বলে উঠল রিপন।
“তাই তো দেখতেছি”‚ বলল সাদ্দাম। “চা খাওয়ার দাওয়াত দিস‚ শায়াফ।”
কোনো উত্তর দিলো না শারফান৷ ফারনাজের ধারাল চোখদুটোই চোখ রেখে নির্বিকার রূপে চায়ে চুমুক দিতে থাকল৷ ফারনাজ এসে থামল ওর থেকে তিন হাত দূরত্বে। ওর দিকে পূর্বের চাউনি বজায় রেখেই কথা বলতে শুরু করল দোকানদারের সাথে‚ “ফ্রেশ বার্গার আছে?”
“আছে‚ ভাই৷ কেবলই করছি।”
“তিনটা রেডি কর। কোক দিস একটা।” তারপরই প্রশ্ন ছুঁড়ল শারফানকে‚ “হদিস টদিস পেলে কিছু?”
“না‚ বড়ো ভাই”‚ মুচকি হেসে বলল শারফান‚ “সন্তোষজনক খবর দিতে পারছে না ওসি৷ তুমি পেলে নাকি কিছু?”
“নাহ‚ পলাতক”‚ হাসল ফারনাজও। ধূর্ততার ইঙ্গিত বহন করা সেই হাসি ধরেই তারপর বলল‚ “তবে সাহসের পরিচয় দিয়েছে‚ বাস্টার্ডগুলো। আজ না হলেও কাল ওদের সাহসের ওজন করবই‚ ছোটো ভাই৷ টেনশন নিয়ো না।”
এবার বড়ো করে হাসল শারফান‚ “নিই না তো। সারাজীবন ওটা দিয়েই আসছি। তুমি রাতের ঘুম হারাম করে এসবের পিছে দৌড়াদৌড়ি কোরো না। সময় খরচা হুদাই৷ তার থেকে মনোযোগ দাও প্রচারে‚ মিছিল মিটিঙে। কাজে দেবে। আসো‚ চা খাও ছোটো ভাইগুলোর সাথে।”
“আসেন‚ ভাই”‚ চেয়ার এগিয়ে দিলো সাদ্দাম‚ “বসেন।”
“না‚ সময় নেই আজকে৷ কিন্তু বসব তোমাদের সাথে নিশ্চয়ই কোনো একদিন”‚ বলে তাকাল আবার শারফানের দিকে‚ “রাতের ঘুম হারাম ফারনাজ কবির হুদাই করে না কখনো৷ মনোযোগ এক সঙ্গে অনেকদিকে রাখার অ্যাবিলিটি নিয়েই ফারনাজ খেলতে নেমেছে ময়দানে।”
বার্গারের প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো দোকানদার। সেটা হাতে নিয়ে ফারনাজ বলল‚ “দোয়া রাখি তোমাদের জন্য। বড়ো ভাইয়ের জন্যও রেখো তোমরা। দেখা হবে ইনশা আল্লাহ শীঘ্রই৷ আসি।”
‘আসি’ বলার জবাবে শারফান মুচকি হেসে ঘাড় কাত করল একবার। সেভাবে থেকেই চোখ ঘুরিয়ে তাকাল গাড়ির ভেতরে। চোখাচোখি হলো সানার সাথে। অপ্রস্তুতভাবে তখনই সানা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আড়চোখে তাকাল তারপর৷ বিভ্রান্ত হলো শারফানের অভিব্যক্তি নিয়ে৷ সে ভেবেছিল শয়তানটা বাঁকাচোরা হাসি দিয়ে কোনো খারাপ ইশারা ইঙ্গিত করবে৷ কিন্তু চেয়ে আছে চুপচাপ কেমন দুর্ভোদ্য চোখে।
ফারনাজ গাড়িতে উঠল এর মাঝেই৷ গাড়ি ছাড়ার আগে শেষবারের মতো আরেকবার দেখে নিলো সানা শারফানকে। একটি ব্যাপার আবিষ্কার করল সে‚ বেয়াদবটার কাজকর্ম বখাটে আর মস্তানদের মতো হলেও হাবেভাবে‚ পোশাক পরিচ্ছদে বেশ ফ্যাশন-দুরস্ত।
“রাতে ওই বাস্টার্ডই দলবল নিয়ে ইটপাটকেল ছুঁড়েছিল জানালায়”‚ গাড়ি চালু করে ফারনাজ বলে উঠল‚ “নির্বাচনটা বেরিয়ে যাক শুধু৷ চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে সাইজ করব ওকে।”
কেন যেন বিষয়গুলো মোটেও ভালো লাগছে না সানার৷ অন্তরিন্দ্রিয় খুব খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে ওর জন্য। “একটু তাড়াতাড়ি চলুন”‚ প্রসঙ্গ থেকে বের হতে চাইলো সে। “দেরি হয়ে গেছে আমার।”
বার্গারের ছোটো ব্যাগটা ফারনাজ কোলে রাখল ওর‚ “খেয়ে নিস মেহার সঙ্গে।”
বিরক্ত হলো সানা খুব‚ “এখন কি আমি বাসায় ফিরছি? ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা৷”
“রেখে দে তোর ব্যাগে। বাড়ি ফিরে গরম করে খাস। আমি তো আর যাচ্ছি না আজ৷ নয়ত আমিই নিয়ে যেতাম।”
“কোনো দরকার ছিল না”‚ কর্কশ গলাতেই বলল সানা।
ফারনাজ তাকাল তখন। রাগ আর বিরক্ত স্পষ্ট ধরতে পারল সানার চেহারাটা দেখে। “আগের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা জরুরি তোর সাথে”‚ বলল গমগমে গলায়৷ “কিন্তু কথা বলার সুযোগই দিস না। এখন আবার সময় নেই তোর৷ একবার কথা বলার সুযোগটা দে আমাকে।”
“আমি মহা গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষ না‚ ভাইয়া। আমার সঙ্গে আলোচনা করার মতো কোনো কথা থাকার কথায় না।”
“তুই দেখতে সরল‚ সাদাসিধে হলেও ভেরি ইনটেলিজেন্ট‚ সানা৷ বুঝদারও খুব৷ তোর জন্য তাই ইশারায় যথেষ্ট।”
বেশ অপ্রতিভ দেখাল এবার সানাকে। ফারনাজের কথার ইঙ্গিত আর কথার মোড় কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারল। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে পারে জানলে ভুলেও গাড়িতে উঠত না।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওকে ফারনাজ৷ বিব্রত হচ্ছে বুঝতে পেরে আপাতত কথা আর ওই প্রসঙ্গে এগোলো না সে৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল‚ “ওর নাম শারফান৷ এখানকার মানুষ ওকে যতটা ভালো বলে জানে‚ বাস্তবে ও ততটাই বাজে। খুবই ডেঞ্জারাস। অনেক সাবধানে থাকবি৷ কোনো সমস্যা ফেইস করলে হেজিটেশন করবি না আমাকে জানাতে। এভাবে বলছি কারণ‚ তোর সেইফটির ব্যাপার জড়িত এখানে৷ তাই আবারও বলছি‚ সাবধানে থাকবি খুব।”
হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না সানা৷ কিন্তু চেহারায় চিন্তার গাঢ় ছায়া নামল ওর।
***
মাঝে কিছুদিন অনির কাছে বিরতি দেওয়ায় অনেক অঙ্কই জমা হয়ে গেছে৷ পড়া শেষ করে সেগুলোই রিয়ার কাছ থেকে বুঝে নিয়ে খাতায় তুলতে তুলতে দেরি হয়ে গেল সানার৷ পাশে বসে রিয়া মজা করে বার্গার খাচ্ছিল৷ বই‚ খাতা গোছাতে গোছাতে সানা উশখুশ করল তাকে কিছু বলার জন্য৷ কথাগুলো শারফানকে নিয়ে৷ যেহেতু অনির ছোটোবেলার বন্ধু শারফান৷ রিয়াও ভালোভাবে জানবে হয়ত তার ব্যাপারে৷ কিন্তু কীভাবে নিজের সমস্যাগুলোর কথা খুলে বলবে বান্ধবীকে আর কথাগুলো সে পেটের মধ্যে রাখবে কিনা ভবিষ্যতে‚ তাও ভাবনার বিষয়৷ এখানেও দ্বিধায় ভুগল খুব৷ শেষমেশ নিজের ওপরই বিরক্ত হলো৷
“বের হবি এখন?” জিজ্ঞেস করল রিয়া।
“হুঁ”‚
“চল‚ একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।”
নীরব সম্মতি দিয়ে সানা বের হলো রিয়াকে নিয়ে৷ গল্পের মাঝে রিয়া খেয়াল করল না ওর উদ্বিগ্নতা। রিয়ার কথার মাঝেই অবচেতন মনে আচমকা বলে উঠল সানা‚ “অনি ভাইয়ের মতো ভালো মানুষের বন্ধু হলো কী করে ওই শারফান শায়াফ?”
“হ্যাঁ? তুই চিনিস শায়াফ ভাইকে?”
“শুনেছিলাম আরকি তার বিষয়ে কিছু কথা”‚ একটু বিব্রত হয়ে বলল সানা।
“কী শুনেছিস?”
সাজিয়ে গুছিয়ে উত্তরটা দিতে পারল না সানা। রিয়াকেও বলতে হলে কিছু ভাবনাচিন্তার বিষয় আছে৷ কারণ‚ রিয়া ভালো বন্ধু হলেও কথা পেটে রাখতে পারে না সে। তাই তাকে এড়াতে বলল‚ “আর যেতে হবে না তোকে৷ বাসায় ফিরে যা। কাল কলেজে গিয়ে কথা বলব।”
বাসা থেকে অনেকটাই দূরে এসে পড়েছে দেখে রিয়াও আর জোর করল না এগোনোর৷ বিদায় নিয়ে সে ফেরার পথ ধরতেই সানা দ্রুত পায়ে চলতে থাকল৷ মাগরিবের সময়টাতে বের হয়ে ভুল করেছে আজও৷ এই সময় গলি একদম ফাঁকা থাকে৷
মিনিট তিনেক পরই পেছন থেকে হেডলাইটের আলো এসে পড়ল ওর গায়ে৷ নিরাপদ পাশে চেপে গেল সে দ্রুত। গাড়িটা ওর কাছাকাছি আসতেই হর্ন বাজিয়ে উঠল হঠাৎ। তারপর গতিও কমিয়ে দিলো৷ তখন ফিরে তাকাল সানা। লাল গাড়িটা দেখা মাত্রই চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওর। তার ওপর গাড়িটা একদম ওর পথ আগলে দাঁড় করাল শারফান। মুহূর্তেই চেঁচিয়ে হুমকি দিলো সানা‚ “আমি সবাইকে ডাকব যেতে না দিলে।”
তৎক্ষনাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না শারফান। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকা সানার চোখে স্থির কত সময় চেয়ে থাকল শুধু। তারপর দিলো ওকে চমকটা। ফোনের স্ক্রিনটা মেলে ধরল সামনে৷ জানালার কাছাকাছিই দাঁড়ানো সানা৷ স্পষ্ট দেখল ওদের সেই ছবিটা৷ নির্বাক চেয়ে থাকল তখন।
“তুমি ভয় পাও আমাকে”‚ বলল শান্ত গলায় শারফান‚ “সেটা আমাকে স্যাটিসফাই করে। তাই নিশ্চিন্ত থাকো আপাতত।”
“যেতে দিন”‚ থমথমে মুখ সানার।
“কখন বললাম নিয়ে যেতে এসেছি? আপাতত কিছু কথা বলব তাই গাড়িতে এসো বসো।”
আবার চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো সানা। মুখটাও হা করেছিল। তখনই সাবধান করল শারফান‚ “ছবি কিন্তু ফোনের স্ক্রিনে থাকবে না শুধু৷ ফেসবুকেও ঘুরে বেড়াবে যদি আরেকবার শাউট করো।” গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো তারপরই‚ “বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা তোমার‚ আমার দুজনের জন্যই প্রবলেম। সেইফ গাড়ির ভেতরই৷ চলে আসো। বললাম তো নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।”
“কী কথা বলবেন আপনি?” রূঢ় সুরে জিজ্ঞেস করল সানা।
“উফ্… এত পেইন কেন তুমি?” সত্যিই বেজায় বিরক্ত হলো শারফান। ধমক লাগিয়ে দিলো‚ “আসতে বলছি আসো!”
তবুও সানা ঠাঁই কতক্ষণ দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল শারফানের দিকে। তাই দেখে শারফানও বসে দেখতে থাকল ওকে চুপচাপ। সেই সাথে মনে মনে সানার ভাগ্যের প্রশংসা করতে থাকল। এই কয়দিনে যতবার সে চটেছিল ওর ওপর‚ তাতে থাপ্পড় কয়েকটা গালে পড়েনি ওর ভাগ্যের জোরেই তো৷ এই যে এখনো যেভাবে মেজাজ ধরে রেখে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে সে! সেটাও কি ভাগ্য নয়? না‚ শুধু ভাগ্যই নয়। নেহাৎ নিষ্পাপ একটা কণ্ঠ আর সরল চেহারাটা ছিল বেচারির। এজন্যই মায়াটা হয় বারবার।
বেশ ভাবনাচিন্তা আর হিসাবনিকাশ করে সানা উঠে এলো গাড়িতে৷
“দরজাটা বন্ধ করো”‚ ভারিক্কি সুরে আদেশ দিলো শারফান।
“না না”‚ চঞ্চল সুরে বলে উঠল সানা‚ “খোলায় থাকবে।”
“সিরিয়াসলি! তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই তো হত।” ঠেঁটার মতো বলল শারফান‚ “সবাইকে আমাদের থোবড়া দেখাতে দেখাতে প্রেমালাপ চালাতাম।”
“কীসের প্রেমালাপ”‚ ক্ষুব্ধতার সঙ্গে আবার চেঁচিয়ে উঠল সানা‚ “ফাইজলামি পেয়েছেন?”
“ফাইজলামি তো তুমি করলে”‚ বলতে বলতে দরজাটা নিজেই বন্ধ করে দিলো শারফান৷ “দেখে বোঝায় যায় না কী ঝানু মাল তুমি! এমন চটকদার অভিনয়টা করলে যেন ফারনাজকে দুই চক্ষে সহ্যই করতে পারো না। আর আজকে দেখা গেল একদম একাকী দুজন। কচি বউকে আবার কোক‚ বার্গার খায়িয়ে পড়তে পাঠাল ফারনাইজ্জা! কী আদর রে শালার।”
এসব তিরস্কার বাক্য আর মিথ্যা অভিযোগ একদম সহ্য হলো না সানার৷ কিন্তু ভুল শোধরানোর বদলে রেগেমেগে বলে উঠল‚ “তাতে আপনার সমস্যা কী? আর কোনো মেয়ে নেই ফরিদপুরে? আমার পিছু কেন পড়ে আছেন? এত অপমান করি তাও লজ্জা লাগে না?”
শেষ বাক্যটা শেষ হতে না হতেই সানা আর্তনাদ করে উঠল‚ “উহঃ আল্লাহ! ছাড়ুন আমার মুখ।”
বিচ্ছিরিভাবে ওর গালদুটো চেপে ধরেছে শারফান৷ দাঁতের সাথে গালের ভেতরের মাংস এমন শক্তভাবে লেগে আছে যে ব্যথা আর ভয়ে কেঁদে ফেলল সানা শব্দ করে। ছেড়ে দিলো তখনই শারফান। দরজাগুলো লক করল হঠাৎ। মাথা ঠান্ডা করতে তারপর বড়ো করে তিনবার শ্বাস টেনে নিয়ে আস্তে করে বলল সানাকে‚ “আমি প্রচণ্ড শর্ট টেম্পারড। কথাবার্তা তাই হিসাব‚ জ্ঞান করে বলবে।”
“দরজাটা খুলুন”‚ ফুঁপিয়ে উঠল সানা‚ “আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
গাড়ির আলোটা জ্বললে শারফান দেখতে পেত তার হাতের নির্দয় চাপে সানার গাল দুটো কেমন লাল হয়ে উঠেছে৷ সানার অনুরোধ‚ কান্না‚ কোনোটাই তোয়াক্কা করল না সে। ফোনে কিছু একটা ঘাটাঘাটি করতে করতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল‚ “কয়েকটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে ডেকেছিলাম তোমাতে। রুড হওয়ার ইচ্ছায় ছিল না। কিন্তু বাধ্য করলে”‚ বলেই হোয়াটসঅ্যাপের একটা কনভারসেশন সামনে ধরল সানার। সেখানে চোখ আটকাতেই লজ্জা আর ঘৃণায় ‘ছিঃ’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সানা।
“ছি বললে তো হবে না৷ দেখতে হবে তোমাকে৷ না দেখলে জোর করে দেখাব৷ মেয়েটাকে চেনো তুমি৷ ভালো করে দেখো।”
“ভালো করে দেখতে হবে না”‚ মুখ অন্য পাশে ফিরিয়েই জবাব দিলো সানা‚ “রুশা রিয়ানা ওটা। এবারের মিস বাংলাদেশ সে।”
“হুঁ‚ স্ক্রল করে ওপরে গেলে এমন খোলামেলা আরও ছবি দেখতে পেতে। কিন্তু মিস করলে”‚ বলতে বলতে আরেকটা কনভারসেশন বের করল শারফান‚ “এদিকে তাকাও৷ আরেকটা দেখো এবার৷ একেও চিনবে।”
“আমি দেখব না… আমাকে যেতে দিন শুধু!” মুখটা ঢেকে কাতর গলায় আকুতি জানাল সানা। তা কানে না তুলে ওর চিবুকের কাছে ধরে মুখটা জোর করেই ফেরাল শারফান‚ “এখানে নুড পিক নেই। দেখো বলছি!”
আঙুলের ফাঁক থেকে নজর ফেলল সানা। বিশেষ কোনো মেসেজ বা ছবি নেই। আঙুল ঠেলে শারফান ওপরের দিকে যেতে থাকল আর সে দেখতে থাকল‚ নাটকের জনপ্রিয় একজন নায়িকার কাহিনি। তার অসংখ্য মিসড কল আর কল রিসিভ করার জন্য অনুরোধ। তৃতীয় আরেকটি কনভারসেশনে ঢুকল শারফান। সেখানে বেশ অশ্লীল মেসেজ দেওয়া নেওয়া করা হয়েছে। মেসেজগুলোতে চোখ বুলাতেই সানা উপলব্ধি করল‚ একজন পুরুষের থেকেও কতটা লম্পট আর নোংরা হতে পারে একজন মেয়ে মানুষ! ঢাকায় থাকা খালাতো বোনদের কাছে দুশ্চরিত্রা মেয়েদের গল্প শুনেছে সানা। যারা নিজেরাই উস্কানিমূলক আর নোংরা আচরণ করে ছেলেদের প্রলুব্ধ করে থাকে। এই কনভারসেশনে তেমনই প্রমাণ পেল। ওকে শোনাতে একটা ভয়েজ মেসেজ চালু করে দিলো সে৷ মেসেজের মতোই বেহায়া‚ বিশ্রী মেয়েটার কথাবার্তা আর কথা বলছেও এমনভাবে‚ যেখানে স্পষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করছে সে কামজ উত্তেজনায় ভীষণ উত্তেজিত।
শারফান জানাল‚ “এখনেরই বিখ্যাত এক আরজে ও৷ আরজে শায়লা লিখে ফেসবুকে সার্চ দিয়ো।”
মুক হয়ে সানা বিস্ফারিত চোখে দেখতে থাকল শুধু শারফানকে। কোন পর্যায়ের জঘন্য এই শয়তান তা আজ পুরোপুরি জানতে পারল সে৷ আর এর মতো খারাপের পাশে সে কী করে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে?
“এসব লাস্ট এই ছয় মাসের কেস”‚ অনিহার সঙ্গে ঠোঁট বাঁকাল শারফান‚ “রুচি নেই আর একটার ওপরও।” বিদ্রুপ হেসে তাকাল তারপর সানার দিকে‚ “এখন বলো‚ এরা যদি আমার অরুচির হয় তাহলে তুমি কি আমার রুচির হতে পারো‚ যে তোমাকে চেখে দেখার জন্য তোমার পিছু পড়ে থাকব?”
চলবে।