#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৭.
বাথরুমের দরজাটা দড়াম করে লাগিয়ে দিলো সানা। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা মারল বেশ কিছুক্ষণ। মাথার চাঁদিও ভেজাল৷ রাগ নামছে না তবুও৷ ফারনাজের মুখটা যতবার দেখছে ততবারই রাগে দপদপ করছে মাথা৷
রাত বারোটা বাজতে চলেছে৷ ঘুমিয়েই পড়েছিল বাড়ির সবাই৷ শারফানের সাথে কথা বলার পর থেকে জেগেছিল শুধু সেই৷ এর মাঝে ঘরের মূল ফটকে ঠকঠক আর কাকা‚ কাকা বলে ফারনাজের ডাকাডাকি। ইচ্ছা করে সে ডাকে সাড়া নেয়নি সানা‚ দরজাও খুলতে চায়নি৷ কিন্তু সে না খুললে কী হবে? কলিজার ভাতিজা এসেছে শুনতে পেয়ে মোস্তফা সাহেব কি আর ঘুমিয়ে থাকতে পারেন?
তারপর থেকে শুরু হয়েছে ফারনাজের নাটক‚ প্রহসন। সানা আর মেহার দুর্ঘটনার ব্যাপারে জেনে দুই বোনকে দেখতে ছুটে এসেছে সে এই মাঝরাতে৷ অথচ এ খবর জেনেছে সে দুুপুরবেলাতেই৷ তাও সানা বুঝ নিয়েছিল আজকের ঝামেলার জন্য ব্যস্ততায় সময় পায়নি ওদের খোঁজ নেওয়ার৷ তাই কাজ শেষে রাতের বেলা এসেছে৷ কিন্তু যখন ওকে আর ঘুমন্ত মেহাকে ডেকে উঠিয়ে পুলিশের মতো জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল শারফান আর রিহানের বিষয়ে। মেজাজ আর তখন সামলে রাখতে পারল না সানা। এদিকে বাবা সামনে থাকায় সে পারছিল না ফারনাজকেও ভালো-মন্দ কঠিন কঠিন কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে৷ যার জন্য বাথরুমে আসার বাহানায় সরে এসে রাগ নামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে৷
শারফান আর রিহানে উপকারের কথা দুপুরে সরল মনে মোস্তফা সাহেব জানিয়ে দিয়েছিলেন ফারনাজকে৷ নয়তো সানা জীবনেও বলত না ওদের ব্যাপারে৷
শারফান যে ফারনাজকে ডোবানোর চেষ্টা চালাচ্ছে‚ তা বুঝেও সানার খারাপ লাগছে না ফারনাজের জন্য৷ মানুষ চেনাতে পটু নয় সে। তবুও আজ সারাটাদিনে ফারনাজ আর শারফানকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে দুজনের চারিত্রিক একটি দিক চিনতে পেরেছে ও।
নিজেকে কখনো দুরকমভাবে দেখানোর চেষ্টাও করে না শারফান৷ সে ভেতরে যা বাইরেও তা-ই প্রদর্শন করে থাকে৷ তাতে কে তাকে ভালো ভাবল আর কে খারাপ‚ এ নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ করে না। বরং সে নির্ভয়ে নিজের খারাপটাকেও প্রকাশ করে দেয় মানুষের কাছে। পক্ষান্তরে ফারনাজ সব সময় লোকস্মুখে একটা নকল রূপ তুলে ধরে নিজের। মিষ্টি মিষ্টি কথা‚ হাসি আর সহজেই যে-কোনো শ্রেণীর মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে উদারতার ভান। অথচ ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সে খসিয়ে ফেলে ওই নকল রূপটা। তখন প্রকাশ পায় তার কারও প্রতি প্রতিশোধের পরিকল্পনা আর নিজের স্বার্থপরতার গল্প।
শারফানের মতো নিজের খারাপকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা মানুষ থেকে ফারনাজের মতো বিড়ালব্রতী স্বভাবের মানুষই হয় সব থেকে বেশি বিপজ্জনক আর ভয়ঙ্কর—এটুকু বিচার করতে পেরেছে সানা। তাই তো শারফানের থেকেও রাগ আর ঘৃণা বেশি অনুভব করছে সে ফারনাজের প্রতি৷ হয়তো ফারনাজ আপনজন বলেই।
***
বিকাল ৪:৩০ মিনিট
প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও অনির কল পেয়ে শারফান ছুটে এসেছে তার বাসায়। আসার পরই ওকে জানানো হলো সানা ওর সাথে একটু কথা বলতে চায়৷ বসে আছে সে অনির ঘরেই। গতরাতের কথা মনে পড়ল তখন শারফানের৷ সঙ্গে সঙ্গেই রাগ চড়ে উঠল তার। গতরাতই মনে হয়েছিল মেয়েটাকে হাতের কাছে পেলে টেনে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিতো। ভালো হয়েছে নিমকহারাম মেয়েটা নিজেই ধরা দিয়েছে। উপকারের উপকার স্বীকার না করতে চেয়ে ওকে যে অপমান করা হয়েছে‚ তার শোধ এবার নেবে সে নিষ্ঠুরভাবে।
পকেটে হাত দু হাত পুরে থমথমে চেহারায় সে অনির ঘরে ঢুকল। দু পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে আছে সানা। ভেবেছিল ওকে ভয়ে জড়সড়ভাবে বসে থাকতে দেখবে৷ কিন্তু চেহারাটা স্বাভাবিকই লাগল। পরনে ওর গতকালের সাদা-কালো রঙা সেলোয়ার-কামিজটাই আজও। কিন্তু কিছু একটা অস্বাভাবিক লাগছে যেন। ভালো করে ওকে লক্ষ করতে গিয়ে দেখল‚ সাদা ফিনফিনে ওড়নার একপাশটা গলা থেকে কিছুটা নিচে পড়ে আছে ওর৷ যার জন্য ফরসা গলা আর সুডৌল মাঝারি বুক চোখে বিঁধছে খুব। সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল শারফানের৷ সেই অনুভূতির দরুন নজর ফেরাতেও ইচ্ছা হলো না৷ আবার কিছুক্ষণ আগে যে রাগ আর শক্ত মনোভাব নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল‚ সেই রাগের কিঞ্চিৎ পরিমাণও নেই মনের কোথাও৷ সেখানে এক কোমল‚ বুকের ভেতর জুড়ে শিহরণ বয়ে চলা অন্যরকম কিছুর আভাস। সানাকে দেখতে দেখতেই কী ভেবে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে। এরপর শ্লথ গতিতে এগিয়ে এলো ওর কাছে৷ ভাবল‚ কিছু বলবে এবার সানা। কিন্তু মাথা নুয়িয়ে আগের মতোই চুপচাপ রইল ও। তাই সেও কোনো কথা বলল না। কয়েক নজর নিষ্পলক ওকে দেখার পর জিজ্ঞেস করল‚ “ডেকেছ কেন?”
মাথাটা তুলে তখন শারফানের চোখে চাইলো সানা৷ তখনই ওকে আবিষ্কার করল শারফান ভেজা চোখে৷ চোখের কোটরে লেগে আছে অশ্রুজল৷ ঠিক গতকাল যেমন অবস্থায় ওকে পেয়েছিল‚ এখনো সেই একই রূপ। আবারও কোনো বিপদে পড়েছে নিশ্চয়ই? তার এ ভাবনার মধ্যে সানা উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ভেঙে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল। গতকালও এমন অসহায়ের মতো ওকে কাঁদতে দেখে শারফানের খারাপ লেগেছিল খুব৷ আজও তাই৷ কিন্তু কালকের মতো রূঢ় ব্যবহার আর খোঁচা দেওয়া কথা শোনাল না সে। বৃদ্ধা আঙুলের ডগায় মুছে দিলো ওর চোখের পানি৷ এমন আদুরে মুখাবয়ব মেয়েটার! চাইলেও সে পারে না একটু শাস্তি দিতে৷ উপরন্তু মনে অন্য চিন্তা চলে আসে। একটু ছুঁতে মন চায়—কখনো হাতের ছোঁয়া‚ বা কখনো ঠোঁটের। বুকের সাথে মিশিয়েও রাখতে মন চায়৷ এখনো তাই-ই মনটা চাইছে৷ মনের চাওয়াকে আজ আর নিয়ন্ত্রণ করল না শারফান। পরে যা হওয়ার হবে ভেবে অবিলম্বেই ছুঁয়ে দিলো সে—সেঁটে থাকল সানার ঠোঁট তার ঠোঁটের ফাঁকে৷ ঘটে গেল দীর্ঘ সময়ের একটি ক্লাসিক কিস। কামজ অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে দ্বিধা করল না সে। সানার কটিদেশ জড়িয়ে ওর চিবুক দু ঠোঁটের মাঝে আঁকড়ে ধরে রাখল কিছুক্ষণ‚ চোখ বুজে ওর মসৃণ গলার ত্বকেও ঠোঁট ডোবাল।
এর মাঝেই হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কানে আসলো কোনো এক ছেলের খিলখিল করে হাসার শব্দ। পাত্তা দিতে না চাইলেও হাসির বিচ্ছিরি শব্দটা ধীরে ধীরে এতটা বাড়ল যে শারফান বাধ্য হলো চোখ মেলতে৷ তারপরই ভড়কে গেল চোখের সামনে সহসা কুৎসিত আঁধার দেখে৷ শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে কিছুটা। মাথা কাজ করল না ওর। কোথায় এলো সে? সানাই বা গেল কোথায়? অন্তত মিনিটখানিক পর টের পেলো সে কম্বলের নিচে ডুবে আছে। দ্রুত মুখের ওপর থেকে কম্বলটা সরাল। কানে এলো পাশ থেকে রিহানের হাসাহাসির আওয়াজ। ফোনে কথা বলছে ব্যাটা প্রেমিকার সাথে। এতক্ষণ যে সে স্বপ্ন দেখছিল আর স্বপ্নটা ভেঙেছে রিহানের হাসির শব্দে‚ তা বুঝতে পারল ও। কম্বলের নিচে হাত দিয়ে শরীর বুলাল নিজের। না‚ সর্বনাশটা ঘটেনি। তবে বহুদিন পর এমন পঁচা স্বপ্ন দেখল। তাও কিনা সানাকে নিয়ে! ভেবেই চমকাল সে। ঘুমানোর আগে মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা করেছিল আর গালাগালিও৷ এজন্যই মনে হয় লিস্টের লাস্যময়ীগুলোর পরিবর্তে স্বপ্নে ওকে দেখল। নিস্তেজের মতো পড়ে রইল শারফান। যা হলো তা ভালো হয়নি মোটেও। কারণ‚ স্বপ্নটা সে পুরো দেখতে পায়নি। যার জন্য এখন অস্বস্তি লাগছে‚ কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। বলতে নেই‚ আফসোসের মাত্রা এতখানি যে শারফানের ইচ্ছা করছে সানাকে এখনই তুলে নিয়ে আসা দরকার। আর সেটা সম্ভব নয় বলে বেজায় রেগে গেল সে রিহানের ওপর৷ ছাগলটা তখন অত জোরে না হাসলে কি ওর ঘুম ভাঙত? হাতটা বাড়িয়েই রিহানের চোয়ালের ওপর ধুম করে দিলো লাগিয়ে এক ঘুষি।
অকস্মাৎ ঘুষিতে প্রথমে চমকাল রিহান৷ তারপরই ব্যথায় উঠল চেঁচিয়ে। চোয়াল ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শারফানকে জেগে থাকতে। “জানোয়ার‚ ঘুমিয়ে মারলি না ইচ্ছা করে? উহঃ”‚ ডলতে থাকল চোয়ালটা।
জবাবে শারফান এবার দিলো রিহানের কোমর লক্ষ করে সজোরে এক লাথি। ছিটকে মেঝেতে গিয়ে পড়ল বেচারা। দ্রুত কলটা কেটে দিয়ে ব্যথায় আর্তনাদ শুরু করল আর গালাগালি করল শারফানকে‚ “হারামির বাচ্চা হারামি‚ ঘুমের মধ্যেও মাতলামি মারাচ্ছিস! শালার জাউড়া‚ দাঁড়া! সকালেই মামার কাছে বলব কত গ্যালন মাল ঢালিস পেটে প্রতিদিন। শালা পাগলের বাল!”
নির্লিপ্ত শারফান বিছানা ছেড়ে ঘরের লাইট জ্বালাল৷ তারপর বিছানার পাশের সেন্টারটেবিল থেকে সিগারেটটা নিয়ে চলে গেল ব্যালকনিতে৷ গায়ে একটা ঢলঢলে সাদা টি-শার্ট আর কালো ট্র্যাক প্যান্ট। অনেক শীত করলেও নড়ল না ও। চুপচাপ সিগারেটে টান দিতে থাকল।
রিহান ওর মতিগতি বুঝল না৷ কোমর চেপে ধরে মেঝেতে বসেই অবাক চোখে দেখতে থাকল ওকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ওর কাছে৷ চেহারার শান্ত ভাব দেখে আরও অবাক হলো সে। তার মানে স্বপ্নের ঘোরে বা ঘুমের ঘোরে মারেনি তাকে! তাহলে হঠাৎ কী জন্য মারল? কী করেছে সে এই রাত একটাই? মনে করার চেষ্টা করল একবার৷ কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পেলো না। তখনই মেজাজ দেখিয়ে বলল‚ “মারলি কেন‚ বোকা** ? ইঁচার গু কি মাথায় উঠে গেছিল রাত-বিরেতে?”
টু শব্দ করল না শারফান৷ তাই দেখে আরও মেজাজের সঙ্গে ধমকাল রিহান‚ “এখন কথা বলিস না কেন‚ হারামজাদা?”
শারফানের উদাস দৃষ্টি অদূরের জবা ফুল গাছটার দিকে। রিহানের ঘ্যানঘ্যানানি শুনে ওর তেজস্বী‚ গম্ভীর গলায় বলে উঠল‚ “ঘরে যা৷ আমার ফোনটা নিয়ে আয়।”
“ফোট‚ মাদারবোর্ড! কোথাকার জমিদার তুমি‚ হাঁ?” আবারও ধমকে উঠল রিহান‚ “মারলি কেন আগে তাই বল?”
তখনই বেচারার ঘাড়ে ঠাঁস করে এক থাবড়া দিলো শারফান‚ “শিয়ালের মতো গলা নিয়ে খিকখিক করে হেসে এই মাঝ রাত্তিরে আমার ঘুম নষ্ট করেছিস। লাথি আরেকটা খেতে না চাইলে ফোন নিয়ে আয় জলদি।”
“এই শুয়ার! তুই ভুলে গেছিস আমি তোর বড়ো?” চেঁচিয়ে উঠে রিহান চলে গেল ঘরে। আরও গালি-গালাজ করতে করতে ফোনটা নিয়ে ফিরে এলো শারফানের কাছে‚ “আমি বুঝেছি‚ তুই হিংসার ঠেলায় আমাকে মেরেছিস৷ আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাতে একটু গরম কথা বলি‚ চুমাচুমি করি। তা শুনে নিশ্চয়ই তোর গরম লেগে যায় গেঞ্জি আর শর্টসের নিচে। আর হিংসা হয় তোর মতো ভিলেন আর খবিশের সাথে কোনো মেয়ে থাকতে চায় না বলে। এসবের ঝাল তুই আমার ওপর ওঠালি আজ‚ তাই না?”
“আর একটা কথা বললে ঝাল এমন জায়গায় ভরে দেবো…” ব্যালকনি দ্রুত ত্যাগ করল রিহান শারফানের কথা শেষ হওয়ার আগেই৷ ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক‚ শারফান যে চটেছে খু্ব তার প্রমাণ দুই দুইবার পেয়েছে সে৷ পাছে সত্যি সত্যি তাকে মারধোর শুরু করলে সে পারবে না ওর সাথে মারামারি করে৷ ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি কখনোই পারেনি৷ “শয়তানটা মনে হয় পেট থেকেই কুস্তি শিখে ডাউনলোড হয়েছিল”‚ বিড়বিড়িয়ে গালাগাল করতে করতে বিছানায় এলো সে।
মানুষটা শারফান রগচটা আর বেপরোয়া হলেও যখন কোনো কিছু করতে মন চায় তা করার পূর্বে সে অন্তত একবার চিন্তাভাবনা করে নেয়। কিন্তু এই প্রথম এ কাজের বিপরীত ঘটছে আজ-কাল। তাও কেবল সেটা সানার ব্যাপারেই। এই যে এখনই আগেপিছে কিছু না ভেবে সানাকে কল করে বসল সে৷ রিসিভও হলো দুবার রিং হতেই।
কাঁচা ঘুম ছিল সানার। সবেই পাকাপোক্ত হচ্ছিল ঘুমটা। শারফানের নাম দেখে প্রথমে রিসিভ করতে না চাইলেও পরে হুমকি-ধমকির কথা মনে পড়তেই দ্রুত রিসিভ করল সে‚ “হ্যাঁ‚ বলুন।”
মুহূর্তেই বিমোহিত হলো শারফান। এত নিষ্পাপ‚ সুন্দর লাগে কেন কণ্ঠটা? ঘুম মাখা কণ্ঠটা শোনায় আরও বেশি আদুরে। শুনতে ভালো লাগে ভীষণ।
“হ্যালো? আছেন আপনি?” সানা ডেকে উঠল ওর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে।
কিন্তু মাথা ফাঁকা এ মুহূর্তে শারফানের৷ কী বলবে সে? কল দিলোই বা কেন তাও তো জানে না৷ স্রেফ মনে হলো সানাকে এখনই প্রয়োজন৷ আর তাকে পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম আপাতত ফোন। কিন্তু এখন কি ফোনে বলা যায়‚ “তুমি স্বপ্নে এসে সিডিউস করে গেছ আমাকে। তারপর উস্কে দিয়ে মাঝ পথেই ছেড়ে পালিয়ে গেছ৷ বাকি রোমান্স সম্পূর্ণ করার জন্য এক্ষুনি আমার সামনে এসে হাজির হও?”
এমনি সময় হলে সানাকে বিরক্ত বা বিব্রত করার জন্য আর টেনশনে ফেলার জন্য হাজারটা দুষ্টু ধরনের কথাবার্তা বলতে পারত সে। কিন্তু এখন সানার গলা শুনেই তো কেমন হাঁসফাঁস লাগছে ওর। মনে হচ্ছে কল না দিলেই বরং ভালো হত। খট করে কলটা কেটে দিলো তাই৷ তারপর ঘরে ফিরে কোনো দিকে না চেয়ে ফোনটা ছুঁড়ে মারল বিছানায়‚ চলে গেল সে বাথরুমে।
রিহান শুয়ে শুয়ে ওর ভাবগতি লক্ষ করছিল এতক্ষণ। ওকে তখন দেখল কানে ফোন ঠেকাতে৷ কিন্তু কোনো কথা বলল না। কাকে কল করেছিল ও? তা দেখার জন্য দ্রুত ফোনটা হাতে নিলো৷ ভাগ্যিস ফোন লক হয়নি। কল হিস্টোরি চেক করে দেখল রিসিভারের নামটা ‘সানাপোনা’। বুঝতে সময় লাগল না এই সানাপোনা কে। উঠে বসে ফোনের দিকে চেয়ে গভীর এক চিন্তায় মগ্ন হলো সে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ফোন হাতে রিহানকে থমকে থাকতে দেখে শারফান হ্যাঁচকা টানে ফোনটা নিয়ে নিলো। বাঁকা চোখে একবার তাকে দেখে গেল লাইট বন্ধ করতে। তার আগেই বারণ করল রিহান‚ “আলো আগেই নেভাস না।”
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল শারফান। ঠান্ডা গলায় হুমকি দিলো‚ “কানের কাছে এখন নিকনিক করলে গলার ওপর পাড়া দিয়ে ধরব।”
“করব না।” শান্ত সুরে সে ডাকল ওকে‚ “এসে বস‚ দুইটা কথা বলব শুধু।”
ভ্রু‚ কপাল কুঁচকে শারফান এসে বসল রিহানের পাশে। কোনো ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করল রিহান‚ “তুই পছন্দ টছন্দ করিস সানাকে?”
“কাকে?” ভ্রু কুঁচকেই চেঁচাল শারফান।
“যাকে কল করেছিলি মাত্র।”
বিরক্ত লাগল শারফানের‚ “কল করলেই কি পছন্দ করা হয়ে যায়‚ আবালের বাচ্চা?”
“না। কল করলেই পছন্দ করা হয়ে যায় না তা আমিও জানি‚ পাগলের বাচ্চা। আমি এখনের বিষয় না‚ দুপুরের বিষয়টা থেকে নোটিস করে বলছি এই কথা।” একটু থামল রিহান। তারপর জিজ্ঞেস করল‚ “সানা বিপদে পড়েছে এ কথা জেনেছিলি কীভাবে বল তো?”
“দেখলি না তখন? অনির বোন জানিয়েছিল ওকে সানার কথা৷ আমি যেহেতু ওখানেই ছিলাম তাই আমাকে কল করেছিল অনি।”
“কল করে কী বলেছিল তাও শুনেছিলাম তোর পাশে বসে। দুজন দোকানে আরামে বসে স্পিড খাচ্ছিলাম আর মারামারি দেখছিলাম। অনি ফোন করে তোকে রিকুয়েস্ট করল‚ মারামারির মধ্যে সানা ফেঁসে গেছে। যেন দ্রুত ওকে সেইফ করিস তুই। কারণ‚ সে আসতে আসতে মেয়েটার একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। তোকে বলেছিল সেইফ করে এনে একটা রিকশায় তুলে দিতে৷ সানার বিপদের কথা শুনে তোর চেহারায় তখন চিন্তা দেখেছিলাম আমি। তা কি জানিস? তারপর তুই কী করলি? ঝামেলার মধ্যে ঢুকে পড়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে আরম্ভ করলি সানাকে। যখন ওকে পেলি তখন দেখলি বেশ হেনস্থার শিকার হচ্ছে বেচারি৷ তাদেরকে মারার জন্য তেড়েই যাচ্ছিলি প্রায়৷ আমি জলদি আটকালাম তোকে। আর এরপর তো রিকশায় তুলে দেওয়ার পরিবর্তে নিজের গাড়িতে তুলে নিলি। এখন বল তো‚ এ থেকে কী প্রমাণ হয়?”
রিহানের দিকে চেয়ে মৌন বেশে তার কথাগুলো শুনল শারফান৷ কথা শেষের প্রশ্নটা রিহান আবারও পুনরাবৃত্তি করল‚ “বলিস না কেন কী প্রমাণ হয়?”
থ হয়ে যাওয়ার মতো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেই রইল শারফান। তারপর আচমকা রিহানের দু কান নিদারুণ বেগে টেনে ধরে নিজের মুখের সামনে তার মুখটা এনে ‘শ’ জাতীয় একটা গালি দিয়ে বলল‚ “তোর মতো বকরীর থেকে আমি প্রেম পিরিতের ফিলিংস চিনব! এমন দিন আসেনি আমার।”
ধাক্কা মেরে ওকে সরিয়ে দিলো রিহান৷ পরপর চোয়াল‚ কোমর‚ কানের ব্যথায় একদমে এ‚ বি‚ সি‚ ডি বলার মতো অনর্গল গালাগালি করে গেল সে শারফানকে। শেষে বলল‚ “তোর এমন দিন আল্লাহ দেবে যেদিন আমার কাছেই এসবের পরামর্শ ভিক্ষা করতে আসবি। সেদিন তোর কালা হোগা থাবড়ে লাল করে তারপর পরামর্শ দেবো আমি।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৮.
নিউজ চ্যানেলে শিরোনাম হয়ে গেছে ফরিদপুরে দুই এমপি প্রার্থীর মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা। ব্যাপারটা নিয়ে দলের চেয়ারপারসন ফারনাজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছে বেশ। ফোনে অনেকটা সময় নেত্রীর সাথে কথাবার্তা শেষে মাত্রই ফোন রেখেছে সে। তারপর থেকে বসে আছে কেমন গুম হয়ে৷
সৈয়দ কবির বসে কথা চালাচ্ছেন অন্যান্য ব্যক্তিদের সাথে। যারা গতকাল ঝামেলায় জড়িয়েছিল তাদের মধ্যে দুজনই নিকটাত্মীয়। একজন ফারনাজের খালাতো ভাই‚ আরেকজন ওর ফুপাতো ভাই। কী করে এমন ভুল তারা করতে পারল‚ এ নিয়েই বকাঝকা করছেন তিনি।
“ভুল তো শুধু ওরা করেনি‚ আব্বা”‚ বলল ফারনাজ‚ “ভেতরে শত্রুর এজেন্ট ঢুকে পড়ল‚ কাজ শেষে পালিয়েও গেল৷ কেউ কিচ্ছু টের পেলাম না৷”
“কত পোলাপানই তো এসে কাজ করছে আমাদের হয়ে৷ কে শত্রু‚ কে এজেন্ট‚ তা কি বোঝা সম্ভব? কেউ এসে কান ভরাল আমাদের। আর আমরাও সেই সব কথায় নাচলাম। এমন গাধার মতো ব্রেইন নিয়ে রাজনীতি করতে চাস তোরা?” শেষের কথা ঘরের সবাইকেই বললেন কবির সাহেব।
বসার ঘরে সকলেই কাঁচুমাঁচু মুখ করে বসে আছে৷ তাদের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে ফারনাজ বলল বাবাকে‚ “ভুল করেই শেখে‚ আব্বা। ওরা সবাই আমার আস্থাভাজন আর ঘনিষ্ঠ। সেজন্যই আমাকে নিয়ে করা কটূ মন্তব্য ওরা চুপচাপ হজম করতে পারেনি৷ ঠিক আছে‚ এখনের মতো বাদ দাও আফসোস-আক্ষেপ। আগামীর জন্য সাবধান হতে হবে আমাদের সবাইকে।”
“ভাই‚” ফারনাজকে বলল ওর ফুপাতো ভাই রাকিব‚ “শাকিবুলের ভাতিজার একটা কঠিন ব্যবস্থা করবা না? কুত্তার ছাওডা খুব বাড়াবাড়ি দেহাইতেছে। ও চেনে নাই আমাগের। চেনানো দরকার।”
“খবরদার”‚ কবির সাহেব ধমক লাগালেন। “ইলেকশনের আগে আর কোথাও যদি হাঙ্গাম লাগাস একটাও!”
“ও তো থাইমে থাকব না‚ মামা৷ ওইডে তো পাক্কা হারামজাদা। একেবারে কিরমিনালি চাল চালতেছে৷ ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো।”
“আমাদেরও সেরকমই করতে হবে। কিন্তু শাকিবুলের লোকজন তোদের মতো মোটা মাথার না। সবগুলো সেয়ানা। তাই আমি বলব এখন কিচ্ছু করবি না তোরা৷ করতে পারতি তখন‚ যদি ওই ছেলে তিনটাকে ধরে রাখতি। যদি পারিস‚ ওই তিনটাকে খোঁজ৷ তাহলে মুখোমুখি বসে গরম দেওয়া যাবে শাকিবুলকে।”
ফারনাজ চুপচাপ শুনতে থাকল আলোচনাগুলো৷ শারফানের প্রতি সে বাকিদের মতো শুধু রেগে নেই৷ মনেপ্রাণে সে ঘৃণা করতে শুরু করেছে ওকে। এক অঘোষিত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে শারফান‚ তা বেশ উপলব্ধি করছে সে৷ তাই শুধু মেরে হাত-পা ভাঙলেই আশ মিটবে না তার। চিকিৎসা নিলে কদিন পর তো ঠিকই চলতে ফিরতে পারবে। ওকে কিছু করার হলে সে এমন কিছুই করবে‚ যেন মাথা উঁচু করে বা মেরুদণ্ড সোজা করে চলার ক্ষমতা চিরকালের জন্য হারায় ও।
***
মাথায় সেলাই নিয়েই মেহা চলে এসেছে মেজো চাচার বাসায়৷ মোস্তফা সাহেব বাদে বাড়ির সবাই-ই এসেছে৷ কারণ‚ দিনাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে৷ প্রস্তাবটা হঠাৎ করেই এসেছে৷ ছেলে কাস্টমস অফিসার। তাই আর ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হয়নি কারও৷ দিনাকে পছন্দও হয়ে গেছে ছেলের৷ দুপুরের খাওয়া-দাওয়া চলছে এখন৷ হাতে হাতে সানা মা-চাচিকে সব কিছু এগিয়ে জুগিয়ে দিচ্ছে৷ তবে ফারনাজের পরিবার থেকে কেউ আসেনি৷
খাবার টেবিল থেকে কে যেন লেবু চাইলো। তড়িঘড়ি ঘরে লেবু কেটে নিয়ে সানা এলো ডাইনিং টেবিলে। লেবুর পিরিচ রাখতে গিয়ে চোখ গেল পাত্রের ছোটো ভাইটার দিকে। খেতে খেতে ছেলেটা আড় নজরে দেখছে তাকে বারবার৷ শুধু এখনই নয়৷ আসার পর থেকেই ছেলেটা তাকে চোরা দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে শুধু৷ আবার তারও কেমন চেনা চেনা লাগছে ছেলেটাকে৷ কিন্তু কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না। নেহাৎ অতিথি বলেই এমন ছ্যাঁচড়ামি সহ্য করছে‚ চোখ রাঙাতেও পারছে না বেচারি।
মাকে পাঠিয়ে সরে এলো সানা। ঠিক তখনই ছেলেটার ফোন বেজে উঠল৷ স্ক্রিনে নামটা দেখে দ্রুত রিসিভ করল সে‚ “হ্যাঁ‚ বল শায়াফ।”
“কই তুই? তোকে বললাম এসে পিক কর আমাকে। গাড়ি বের করব না আজ।”
“দাঁড়া‚ খাচ্ছি কেবল। খেয়েই আসছি আমি।”
“দুপুর তিনটাই লাঞ্চ করায় যে মেয়েপক্ষ‚ সেই বাড়ির মেয়েকে বউ করবি তোরা? ঠিকঠাক জামাই আদর পাবে না তোর ভাই।”
হেসে ফেলল সাদ্দাম‚ “চুপ যা‚ ব্যাডা৷ খাওয়া শেষ করে কল দিচ্ছি।” বলেই কলটা কেটে দিলো।
এদিকে ঘরে বসে মেহা দিনার মাথা খেয়ে ফেলছে নানান প্রশ্ন করে৷ অসুস্থ বলে দিনা পারছে না তার মাথায় একটা গাট্টা দিতে৷ তার প্রশ্ন‚ “তোর বয়ফ্রেন্ড কষ্ট পাবে না‚ দিনাপা? আশ্চর্য! তোকে দেখতে আসছে জেনেও কিছু বলল না তোকে? এ আবার কেমন প্রেম? তাহলে তোরা টাইম পাস করেছিস দুজন? মানে তোরা দুজনেই জানিস তোরা অন্য জায়গায় বিয়ে করবি? সব জেনে-বুঝেই প্রেম করতি? এই দিনাপা‚ তাহলে কি পান্থ আর আপুর প্রেমও ওরকম? এই তোর পছন্দ হলো কী করে পাত্রকে? সে তোর বয়ফ্রেন্ড থেকে দেখতে খারাপ না?”
এর মাঝে সানা ঘরে ঢুকল৷ ওকে দেখেই দিনা বলে উঠল‚ “আমাকে রক্ষা কর এই পাগলের কাছ থেকে। ওকে নিয়ে রান্নাঘরে কাজে ভিড়িয়ে দিয়ে আয় তো।”
“কী হয়েছে?” বলে এগিয়ে এলো সানা মেহার কাছে‚ “ওঠ একটু। বাইরে গিয়ে ইব্রাহীম ভাইয়ার ছোটো ভাইটাকে দেখবি একবার৷ দেখবি চেনা চেনা লাগে নাকি।”
“কেন?” দিনা‚ মেহা একত্রেই জিজ্ঞেস করল।
“আমার কেমন চেনা চেনা লাগছে৷ আর এসেছে পর থেকে ছাগলের মতো তাকিয়ে থাকছে শুধু৷ কানের নিচে দিতে মন চাচ্ছে। কিন্তু কোথাও দেখেছি নাকি ছেলেটাকে ঠিক মনে করতে পারছি না।”
“চল তো দেখে আসি”‚ বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল মেহা।
খাওয়া শেষ করেই সাদ্দাম বাইরে এসেছে। কথা বলছে শারফানের সাথে‚ “আমার তো পাত্রীর চাচাতো বোনকে পছন্দ হয়ে গেছে‚ ভাই। মন চাচ্ছে আমার বিয়েটার পাকা কথাও সেরে যাই।”
“তা জানা তোর মাকে। প্রস্তাব দিয়ে আসুক।”
“প্রস্তাব দেওয়ার ব্যবস্থা এখনই করতাম”‚ মিনমিন গলায় বলল সাদ্দাম‚ “যদি ফারনাজের নজর না পড়ত ওর ওপর।”
“ফারনাজ!” অবাক হলো শারফান‚ “ফারনাজ আসলো কোত্থেকে?”
“ইয়ে মানে…”‚ ইতস্তত করে বলল সাদ্দাম‚ “ফারনাজের মেজো চাচার মেয়েকে দেখতে আসছি আমরা। তোকে কাল বলার সাহস পাইনি আসলে।”
“এখন সাহস পেলি কীভাবে?”
মাথা চুলকাতে থাকল সাদ্দাম। কী বলবে বুঝে পেলো না৷ তার নীরবতা টের পেয়ে শারফান বলল‚ “ভেবেছিলি সম্বন্ধ এগোতে দেবো না? ফারনাজের চাচাতো বোন কেন‚ ওর আপন বোনকে বিয়ে করে দেখাতে পারলে তোকে ঘাড়ে তুলে নাচতাম‚ বোকাচো** !”
ভয় কেটে গেল সাদ্দামের। উপরন্তু বন্ধুর আশকারা পেয়ে মনে লাড্ডু ফুটল তার‚ “ওদের কেউ তো আসেনি৷ আসলে দেখতে পেতাম ওর বোনটা কেমন। তাহলে চাচাতোটার জন্যই সাহস করে প্রস্তাবটা দিতে বলি‚ কী বলোস?”
“দে। দুই ভাই এক বাড়ির জামাই হবি‚ এক সঙ্গে জামাই আদর খাবি।”
“আরে না‚ এক বাড়ির হতে পারব না। আমার শ্বশুরবাড়ি হবে তো প্রফেসরের বাড়ি। ওনার বড়ো মেয়েটা তো দেখতে বেশ খাসা। তুই তো কালকেও দেখেছিস ওকে। সুন্দর না‚ বল?”
“সানা!” চরম বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল শারফান‚ “তুই সানার কথা বলছিস?”
“হ্যাঁ… সানাই তো নামটা মনে হয়।”
ফোনের এপাশে শারফানকে দেখা গেল দারুণ হতবাক৷ সাদ্দাম হঠাৎ ওর কোনো আওয়াজ না পেয়ে হ্যালো‚ হ্যালো করে ডাকাডাকি আরম্ভ করল। তার মাঝেই আচমকা গালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল শারফান‚ “তোর পেটের ওপর দাঁড়িয়ে পাছা দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনব‚ ভেড়ার বাচ্চা! একদম দেখবি না ওকে… কোনো প্রস্তাব দিবি না৷ ঠিকানা বল তোর ভাই’র শ্বশুরবাড়ির।”
তাজ্জব বনে গেল সাদ্দাম‚ “এই‚ তুই কী বলোস? কবে থেকে পছন্দ করিস‚ শালা?”
বিরক্ত হলো শারফান‚ “কিসের পছন্দ‚ বাল! ওটা টার্গেট আমার।”
“কিসের টার্গেট ও?” সাদ্দামের বিস্ময় ভাব কাটেনি।
“আছে।”
“তুই ওকে লাভ ট্র্যাপে ফেলবি না-কি? কবে ভাবলি? জানালি না কেন?”
“কোনো প্ল্যান করিনি এখনো। তাই জানাইনি৷ বাড়ির অ্যাড্রেসটা পাঠা৷ আসছি আমি।”
“আরে আসবি কেন? হ্যালো…”‚ সাদ্দাম বলতে বলতেই কল কেটে দিয়েছে শারফান। ভালোই ভাবনাতে পড়ল সে৷ সানাকে মনে ধরেছিল আজ৷ কাছের বন্ধু যেহেতু এগোতে বারণ করেছে‚ এগোবে না আর। কিন্তু সানা মেয়ে ভালো৷ তাকে নিয়ে বন্ধুর তামাশা কী হবে জানে না সে৷ তবে যা হবে তা নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে না৷ ব্যাপারটা বেশ চিন্তার বিষয়। তার দ্রুত খোলাখুলি কথা বলতে হবে শারফানের সঙ্গে।
ইলেকশনের পর বিয়ের দিন‚ তারিখ নির্ধারণ করা হবে। এর মাঝে একদিন এসে দিনাকে আংটি পরিয়ে যাবে সাদ্দামের পরিবার৷ কথাবার্তা প্রায় শেষ দু পরিবারের৷ শুধু দিনা আর ইব্রাহীমকে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠানো হয়েছে। তাদের কথা শেষ হলেই বিদায় নেবে সাদ্দামরা৷ আর সানাও৷ এখান থেকে বেরিয়ে সে যাবে অনির প্রাইভেটে।
সাদ্দাম বাসার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল শারফানের জন্য। এসেও গেল সে। ওকে দেখে ঘড়িতে একবার সময় দেখল সাদ্দাম৷ কী দ্রুত গতিতে গাড়ি টেনেছে শারফান তা দেখে দ্বিতীয় দফায় অবাক হলো৷
এদিকে বাসার সামনে আরেকটা গাড়ি এসে থামতে দেখলেন দিনার বাবা। তিনি বেরিয়ে এলেন সাদ্দামের কাছে। গাড়ি থেকে তখনই নামল শারফান। “আমার বন্ধু‚ আঙ্কেল”‚ অপ্রস্তুতভাবে হেসে সাদ্দাম জানালানে সৈয়দ মোশতাককে‚ “একটু কাজ ছিল আমাদের৷ বের হবো। তাই রিসিভ করতে এসেছে আমাকে।”
“আচ্ছা আচ্ছা”‚ মোশতাক সাহেব বিনয়ী হেসে শারফানকে আমন্ত্রণ জানালেন‚ “ভেতরে চলো‚ বাবা। এভাবে বাইরে থেকেই চলে যাবে না-কি? কষ্ট পাবো তাহলে।” সাদ্দামকে বললেন‚ “ওকে ভেতরে নিয়ে এসো‚ সাদ্দাম।”
কৃত্রিম হাসি টানল সাদ্দাম‚ “আঙ্কেল‚ ওর সময় হবে না…”
“হ্যাঁ‚ চলুন আঙ্কেল”‚ বন্ধুর কথার মধ্যেই শারফান বলে উঠল‚ “ভাবিকে এক নজর দেখে যাই।”
থতমত খেয়ে গেল সাদ্দাম। হতবুদ্ধি চেহারায় হাসল সে মোশতাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে। দুই বন্ধুর কথা শুনে হাসি পেলেও সেভাবে হাসলেন না তিনি৷ সাদ্দামের চোরা কঠোর চাহনিকে অবজ্ঞা করে শারফান তাকে ফেলেই আগে আগে চলে গেল।
বসার ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে উপস্থিত সবার নজর পড়ল শারফানের ওপর৷ সানগ্লাসটা খুলতে খুলতে এগিয়ে এলো সে সাদ্দামের ভাইয়ের কাছে৷ ওকে দেখে “আরে শায়াফ দেখি”‚ বলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে সে জড়িয়ে ধরল ওকে।
“সাদ্দামকে রিসিভ করতে এসেছিলাম৷ তাই ভাবলাম এলামই যখন ভাবিকে একটু দেখে যাই।”
“হ্যাঁ‚ ভালো করেছিস। বস বস।”
ওর হঠাৎ আগমনে সাদ্দামের বাবা-মাও বেশ খুশি হয়েছেন৷ কারণ‚ শাফিউল আর শাকিবুল সাহেবের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলের সাথে তাদের ওঠা-বসা আছে‚ এ ব্যাপারটা মেয়ে পক্ষকে জানানোর সুযোগ পেলেন কিনা তারা। ওর পরিচয় দিলেন তারা খুব আগ্রহ ভরে। তাই নতুন করে আবার তোড়জোড় শুরু হলো নাশতা-পানি আনার৷ মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণও দেওয়া হলো ওকে৷ ভরা পেটের কথা বলে তা ফিরিয়ে দিলো সে৷
নাশতার ট্রে নিয়ে‚ নাজমা বেগম আর দিনার মায়ের সাথে সানাও এলো৷ তার হাতে শরবতের ট্রে৷ শারফানের সামনে থেকে ইব্রাহীম সরে দাঁড়াতেই সে চমকাল ওকে দেখে৷ বসার ঘরে আসার পথে তাকে আগেই আড়চোখে দেখে নিয়েছে শারফান।
এবার সানার মনে পড়ল সাদ্দামকে কবে‚ কোথায় দেখেছিল সে। চোখে চোখ পড়ল দুজনের৷ সবার কথাবার্তার জবাব দেওয়ার ফাঁকে শারফান তাকিয়েছে। তারপর থেকে আর চোখ নামাচ্ছে না। যা কথাবার্তা চালাচ্ছে তা সানার দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখেই।
আড়ষ্টতায় সানা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না তখন। দরজার আড়ালে গিয়ে চুপিচুপি দেখতে থাকল ওকে৷ নজর ফেরাতে একটু কষ্টই হচ্ছে আজ৷ শারফানকে কেমন অন্যরকম লাগছে যেন। ফ্যাশান দুরস্ত পোশাকের জন্য কি? পায়ে সাদা স্নিকার্স‚ পরনে ক্রিম রঙা প্যান্ট‚ তার ওপর বোতাম ছেড়ে রাখা অলিভ রঙের শার্ট‚ শার্টের নিচে ক্রিম রঙা গোল গলার টি শার্ট৷ হাতা গোটানো। ডান হাতে রোলেক্সের ঘড়ি। চেহারাটাও খেয়াল করল সানা৷ তারপর বুঝল ভালো লাগার কারণ। দাড়িগোঁফ হালকা ছেঁটেছে আজ। আর আবছাভাবে এক পাশে সিঁথি রেখে চুলগুলোকে পরিপাটি করেছে মার্জিত বেশে।
চলবে।