#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১৯.
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সানা এদিক-ওদিক চেয়ে রিকশা খুঁজছে আর ফোনে কথা চালাচ্ছে পান্থর সাথে‚ “কলেজে দেখা করা সম্ভব নয়। ইলেকশনের আগে আর কলেজ যাচ্ছি না৷ দেখা করার হলে ওয়েট করো৷ ভোট দিয়ে ইলেকশনের দিনই দেখা করব।”
“এখনো কতদিন বাকি!” ফোনের ওপাশ থেকে পান্থর হতাশ সুর‚ “তাহলে এত তাড়াতাড়ি এসে কী করব?”
“অদ্ভুত! তুমি কি শুধু আমার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা থেকে আসবে?”
“অদ্ভুত লাগলেও তাই-ই। ভেবেছিলাম এবার অন্তত তুমি একটু সময় দেবে আমাকে।”
“আমি ভাবিনি এমন কিছু”‚ কিছুটা বিরক্ত দেখায় সানাকে। পান্থর কথাতেও আর রিকশা খুঁজে না পাওয়াতেও৷ “আচ্ছা রাখছি এখন৷ বাসায় ফিরে কল করব।”
কোনো বিদায় সংলাপ ছাড়াই খট করে কলটা কেটে দিলো পান্থ। সানা বুঝতে পারল ওর প্রতি পান্থর রাগ আর বিরক্তও৷ তবুও ওর খারাপ লাগল না। কারণ‚ কয়েকদিন আগে ও সরাসরিই বলেছিল সম্পর্কটা আর টানতে চাইছে না। শুরু থেকে আজ অবধি কোনো অনুভূতিই খুঁজে পায়নি সে এই সম্পর্কে। কিন্তু সেদিন ওর সিদ্ধান্তে পান্থ রাজি তো হয়ইনি। বরঞ্চ গোটারাত ফোনের ওপাশে বসে নানরকম কথা বকে গেছে শুধু ওকে মানানোর জন্য। না চাইতেও সেসব কথায় মায়া লেগেছিল ওর। সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছিল তাই। এরপর কেটে গেছে প্রায় এক সপ্তাহ। পান্থ এখন দিনে-রাতে কল‚ মেসেজ করে অসংখ্যবার। কিন্তু তাও কোথায় কী যেন একটা শূন্যতা অনুভব হয় সানার। শুধু মনে হয় ওর জন্য পান্থর মুগ্ধতা‚ আবেগঘন কথা‚ বিষণ্ণতা সবটাই মেকি। বিশ্বাসটুকুই যদি না আসে মানুষটার অনুভূতির প্রতি৷ তবে কী করেই বা ভালোবাসবে সে? এসব ভাবলে ওর নিজের ওপর খুব রাগ আর আফসোস হয়—কেন যে সেদিন বোকার মতো দিনা আর রিয়ার কথা শুনে এই প্রেমে জড়াল?
“ধ্যাত!” বলেই হাঁটা আরম্ভ করে সানা৷ একটা খালি রিকশা মিলল না৷ মেহারা ফিরবে রাতে৷ মোস্তফা সাহেব এসে নিয়ে যাবেন ওদের৷ অনির প্রাইভেট থাকায় সে আগেই বেরিয়ে এসেছে।
হাঁটতে হাঁটতেই সে ভাবে পান্থর ব্যাপারটা৷ কথা ছিল‚ এই ডিসেম্বর মাসটাই হবে দুজনের অনুভূতিকে পরখ করার শেষ সময়। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সে জানিয়ে দেবে নির্বাচনের দিন সরাসরি দেখা করেই৷ এভাবে শুধু শুধু নামমাত্র সম্পর্কটাই ঝুলে থাকার কোনো মানেই হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে মূল সড়কে চলে এলো৷ খালি অটো আর রিকশা যাচ্ছে ভালোই। যে-কোনো একটা দাঁড় করানোর জন্য বাঁ পাশে দাঁড়াল সে। রাস্তার ডান পাশে একটা খালি রিকশার দেখা মিলল নিমিষেই। “এই রিকশা”‚ হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে ডাকল রিকশাটাকে৷ রিকশাচালক তাকানোর আগেই ওর সামনে ভোঁ করে ছুটে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল লাল সেডান—তাও একদম গা ঘেঁষে। ভয়েই দুপা পিছিয়ে পড়ল সে। আশেপাশের মানুষগুলোও দেখল ব্যাপারটা। সানা চেঁচালেই তারা গাড়িচালকের কলার চেপে ধরতে চলে আসবে এমন একটা ভাবমূর্তি তাদের৷ কিন্তু তা হলো না৷ দরজাটা যখন খুলল শারফান। সানগ্লাস চোখে নিয়ে ভেতরে বসা তাকে দেখে সবাই তখন সানার অভিব্যক্তি লক্ষ করতে থাকল৷ কী যেন বলতে দেখল তারা শারফানকে৷ মিনিটখানিকের মাঝেই তারপর দেখল সানাকে গাড়িতে চেপে বসতে৷
সাঁই করে গাড়িটা এগোলো সানার গন্তব্যের রাস্তা ধরে। একটু অস্বস্তিতে কোলে রাখা ব্যাগের ফিতা আঙুলে প্যাঁচাচ্ছে আর বাঁকা চোখে দেখছে সানা শারফানকে৷ এর মাঝেই শারফান পাশ ফিরে তাকাল সরাসরি। দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেলে সানা বিব্রত হয়ে দৃষ্টি ফেরালেও সে আরও দুবার তাকাল ড্রাইভিঙের ফাঁকে৷ একবার দেখল ওর লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটজোড়া। “কী কালার মেখেছে এটা”‚ মনে মনে আওড়াল‚ “নাকি রাসবেরি ডলে নিয়েছে? চেপে ধরে একটু খেয়ে দেখব?” শেষ ভাবনা মনে আসতেই আরেকবার দেখল ওর সারাটা অঙ্গ। মনের চিন্তা দূর করতে হঠাৎ বলল‚ “রিহানের নাম্বার তো বাইরে দাঁড়িয়েই নিতে পারতে। কী মনে করে আমার গাড়িতে চড়ার সাধ জাগল? ভয়ও পাচ্ছ না দেখছি।”
“থ্যাঙ্কস জানাতে চাই আপনাকে”‚ কোমল স্বরে বলল সানা।
“ও আচ্ছা।” হেসে তিরস্কার গলায় বলল সে‚ “সেধে দাওয়াত চাওয়ার পর বলছ‚ আসবেন আমার বাড়িতে। দুইটা গোশত‚ পোলাও‚ ভাত খেয়ে যাবেন।”
প্রচণ্ড বিব্রত হলো সানা৷ সাথে একটু রাগও হলো। যেচে পড়ে ধন্যবাদ চাইলো৷ আবার দিতে গেলে খোঁচাও মারছে। শয়তান লোক! “গরু দান করার পর জুতো মারলে কি ভক্তি-শ্রদ্ধা আসে”‚ জানালার বাইরে চেয়ে বিড়বিড় করল সে।
“কী বললে?” ধমকে উঠল সে মুহূর্তেই। তার পূর্ণ মনোযোগ ওর ওপরই ছিল৷ তাই কথাগুলো কানে আসা মাত্রই গাড়িতে ব্রেক কষল সে।
চমকে গেল সানা। এক টানে সানগ্লাসটা খুলে কঠিন চোখে তাকাল শারফান। তারপর ধমক দিলো আবার‚ “কী বললে জোরে জোরে বলো।”
“গাড়িটা কোথায় থামালেন?” নার্ভাস চেহারায় সানা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল ব্যস্ত সড়কেই আছে ওরা৷ তা দেখে বেশ স্বস্তি পেলো। গাড়ির কাচগুলো যদিও কালো৷ বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যায় না‚ ভেতরের শব্দও বাইরে যায় না। তবুও একটা ভরসা আছে যে এই দিনে-দুপুরে মাঝ রাস্তায় বসে সে বাড়াবাড়ি কিছু করবে না ওর সঙ্গে।
কপালে ভাঁজ আর সংকীর্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল শারফান‚ “তোমার সাহস আর আমার কন্ট্রোল‚ দুটোই আমাকে অবাক করে। আমি যে আজ-কাল আমার মেজাজের কন্ট্রোল করতে পারছি এটা সত্যিই আমার জন্য সারপ্রাইজ মামলা। নয়ত তোমার তুলা তুলা গালে আমার হাতের সবগুলো রেখার স্পষ্ট ছাপ বসে যেত। আমার একটা থাপ্পড়ের ওজন জানো তুমি?”
কথাগুলোই মনে মনে একটু আশকারায় পেলো সানা৷ এতদিন যেহেতু গালে ওই ছাপ বসেনি তার মানে আজও বসবে না। আশকারার আভাস ওর চেহারাতেও পড়ল‚ “জানি না। বক্সিং পাঞ্চ মেশিনে মেপেছিলেন না-কি? কত ওজন?”
বিকারশূন্য চেহারায় সানা প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই হাত তুলল শারফান। “এই না”‚ অমনি চিৎকার করে সে মুখ ঢাকল।
“ওজন জানতে চাইলে। এখন চিল্লাও কেন?”
“তাই বলে আপনি সত্যি আমাকে মারতে চাইবেন?” বিস্মিত চেহারা ওর।
“অফকোর্স”‚ শ্রাগ করল শারফান। “বক্সিং পাঞ্চ মেশিনে পাঞ্চ করলে তো পাঞ্চের ওজন দেখায়৷ তোমার মেশিনে থাপ্পড় মেরে থাপ্পড়ের ওজন দেখাতে চাইলাম।”
“আমার মেশিন কোন ধরনের কথা‚ হ্যাঁ”‚ চকিতেই রেগে গিয়ে বকুনি দিলো সানা‚ “ওয়ার্ড সিলেকশন বুঝে-শুনে করবেন কিন্তু।”
চোখা চাউনিতে চাইলো শারফান৷ “না করলে?” ভ্রুজোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “বুঝে-শুনে না করলে কী হবে?”
রাগ ঝেড়ে পালাল সানার। তবুও কপট গম্ভীর হয়ে বলল‚ “কিছু হবে তা তো বলিনি। আমি মেয়ে মানুষ৷ তাই আমার সঙ্গে আপনার কথাবার্তা মার্জিত আর শালীন হওয়া উচিত সেটাই বলতে চেয়েছি। এটুকু নিশ্চয়ই বুঝেছেন?”
“না বুঝিনি”‚ বলে সিটবেল্টটা আচমকা খুলে ফেলল শারফান। তারপর ওর কাছে সরে এলো‚ “বোঝাও আমাকে। প্লিজ টিচ মি হাও টু চুজ ওয়ার্ডস।”
“আরে এসব কী?” বলতে বলতে জড়সড় ভাব নিয়ে দরজার সঙ্গে সেঁটে বসল সানা। “এগিয়ে এসেছেন কেন? ফাজলামো বাদ দিন৷ আমি প্রাইভেটে যাব৷ হয় এখানেই নামিয়ে দিন নয়তো পৌঁছে দিন।”
“দেবো। কিন্তু আমাকে ওয়ার্ড সিলেকশন করা শেখাতে হবে এখনই৷”
“পারব না”‚ দৃঢ় কণ্ঠ সানার। তারপর জানালার বাইরে চেয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল‚ “আপনাকে ধন্যবাদ বলতে গাড়িতে উঠেছি৷ ওয়ার্ড সিলেকশন শেখাতে না৷ তাই শুনুন‚ গতকালের জন্য আপনার কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ থাকব সব সময়৷ থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর হেল্পিং মি। এখন আমাকে নামিয়ে দিন এখানেই।”
ওর বলা শেষ হলেও শারফানের থেকে কোনো জবাব পেলো না। তা দেখে সে ভীত চোখের কোনা দৃষ্টিতে তাকাল। কেমন ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে শারফান ওর দিকে৷ সেটা দেখা মাত্রই মনে মনে ভয় পেতে লাগল আরও। মহাসড়কের বাঁ পাশে গাড়িটা থেমে আছে বলেই না এমন সাহস করে গম্ভীর ভাব-ভঙ্গি দেখাল সে! কিন্তু তাও কি নিশ্চয়তা আছে এই আফ্রিকান গরিলাটার কাছে? এতদিনে সে জেনে গেছে‚ শয়তানটার মুখের আগে হাত চলে। এবার যদি সত্যিই টেনে চড় লাগিয়ে দেয়! এই আতঙ্কের মাঝেই সে আচমকা অনুভব করল ওর মাথার ওপর শারফানের একটা হাত। এক ঝটকায় ফিরে তাকাল তার দিকে। তখনই ওর মাথাটা চেপে ধরে টেনে আনল শারফান মুখোমুখি। বলল ভীষণ ধীর সুরে‚ “তোমার ওভার থিঙ্কিঙে আমার থিঙ্কিংও পালটে এখন হটি হয়ে গেছে। শোনো তাই‚ বক্সিং পাঞ্চ মেশিনের সঙ্গে আমি তোমার মেশিনের তুলনা করতেই পারি না৷ কারণ‚ ওটাকে সর্বোচ্চ শক্তিতে হিট করতে হয়। আর তোমাকে…” ওর মাথা থেকে শরীরের যতটুকুতে চোখ বুলানো সম্ভব বুলিয়ে বলল‚ “হিট করলে কখনো নরমভাবে করব‚ কখনো একটু বিপজ্জনকভাবে‚ কখনোবা উষ্ণ ঠোঁটে‚ আবার কখনো বরফ শীতল…”
“চুপ করুন”‚ গলা ফাটিয়ে চেঁচাল সানা কথার মাঝ পথেই। “আপনি এত নোংরা… ছিহ! আপনার…”‚ রাগের চোটে কথায় বের হলো না ওর।
“ওয়ার্ড সিলেকশন ঠিক হয়নি এবার?”
দরজা খোলার চেষ্টা করল সানা৷ কখন লক করা হয়েছে তা টেরও পায়নি৷ “দরজা খুলুন নয়ত জানালার কাচ ভাঙল আমি”‚ হুমকি দিলো শারফানকে৷
“ভাঙতে পারলে ভাঙো”‚ ওর ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে শারফান নির্বিকার গলায় বলল‚ “কিন্তু এমন রিয়্যাক্ট করছ কেন? তোমাকে তো শেখাতে বললাম তখন। শেখালে না। আর তুমি হচ্ছে একটা মিটমিটে বজ্জাত‚ তা জানো? আমার কথার ডাবল মিনিং বের করে আবার আমাকেই ধমক দাও! কত সাহস! পাকনামি কথা আর পাকনামি চিন্তাভাবনা যত কম বলবে‚ কম করবে ততই ভালো। নয়তো আগামীতে আমার ওয়ার্ড সিলেকশন আজকের চেয়ে আরও উন্নত হবে।”
কর্কশ গলায় বলল সানা‚ “আজকের পর জীবনে আর আপনার সামনে আসব আমি? সেল্ফ রেসপেক্ট থাকলে ভবিষ্যতে আমার পথ আগলাবেন না আপনি‚ আমার সাথে কথাও বলার চেষ্টা করবেন না।”
তারপরই সে দরজাটা খোলার চেষ্টা করল পুনরায়। ওকে অবাক করে দিয়ে কোনো কথা ছাড়াই লক খুলে দিলো শারফান৷ ভ্রু কুঁচকে সে বাঁকা চোখে তখন তাকাল একবার তার দিকে৷ চেহারার ভাবটা তো বরাবরই গম্ভীর৷ কিন্তু তবুও মনে হলো না রেগেছে ওর ওপর৷ রাগলে অন্তত চোখের চাউনিতে প্রকাশ পেতো৷ অত আর ভাবল না। গাড়ি থেকে নেমেই দরজাটা দড়াম করে লাগিয়ে চলে গেল সামনে।
ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল শারফান নিমেষহীন। ঝিকিমিকি করা কী সব কারুকাজ ওর পরনের গাঢ় নীল আর কাঁচা হলুদ রঙা সেলোয়ার-কামিজে। চোখ ধরাতে পারছে না সে রোদের কারণে। দুচোখ ধাঁধিয়ে যেতে চাইছে যেন। কিন্তু তা কি শুধুই পোশাকের জন্য? ওকে এ নিয়ে দুবার দেখল সে চুল ছেড়ে দেওয়া আর চোখে-মুখে প্রসাধানী মাখা সাজসজ্জায়। এবং দুবারই তার দৃষ্টিজোড়া থমকে থেকেছে ওর প্রতি৷ আজ যদি ছুটে না আসত সে‚ তবে বুঝতই না সাদ্দাম কেন আটকে গিয়েছিল। একটু সাজলেই মেয়েটা নজরে চলে আসে যে কারও। কিন্তু তার তো শুধু নজরে এসেই থামেনি৷ রীতিমতো তার স্বপ্নে এসেও হাজির হয়েছে৷ যে স্বপ্নের রেশ আজ সারাটাদিনেও কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। থেকে থেকেই মনের মধ্যে এসে হানা দিয়েছে সানা। কেন এত মনে পড়েছে ওকে? এমনভাবে মনে না পড়লে সে কি এই ভরদুপুরে বিনা নিমন্ত্রণে আসত ওর চাচার বাড়ি? শয়তানি হাসি হাসল সে‚ “আমার মাথার মধ্যে‚ মনের মধ্যে গেঁড়ে বসার সাজা তোমাকে না দিয়ে ছাড়ি আমি?” বিড়বিড় করে বলল তারপর‚ “সাজগোজ করে‚ চুল ছেড়ে চললে নাকি আশিক জিনের খপ্পরে পড়ে মেয়েরা! আর তুমি রাসবেরি পড়েছ শারফান জিনের খপ্পরে। আমার যা দেওয়ার তা তো আমি দেবোই তোমাকে।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২০.
৫ জানুয়ারি‚ ২০১৪
ফরিদপুর-৩ সদর আসনে প্রার্থী সংখ্যা চার। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা কলস মার্কা আর ছাতা মার্কার মাঝে।
ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোতে ফারনাজ ছিল খুবই সর্তক আর ঠান্ডা মেজাজে। দলের ছেলেদের সাথে রাত-দিন লেগে থেকেছে‚ কথা বলেছে ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে‚ তাদের সকলরকম আশ্বাস দিয়েছে দৃঢ় কণ্ঠে‚ এজেন্টদের মাধ্যমে টাকাও গুঁজে দিয়েছে বহু মানুষের হাতে। তাকে নিয়ে বেশ ইতিবাচক সাড়াশব্দই পাওয়া গেছে সাধারণ জনতার মুখে।
শাকিবুল হকের মাঠও খারাপ নয়৷ শাফিউল সাহেব আর শারফানের সঙ্গে ফরিদপুর সদরের সকল পল্লীতে ছুটে বেড়িয়েছেন শেষ মাসে৷ যথেষ্ট পরিশ্রম আর টাকা ব্যয় করেছেন তিনিও। কিন্তু তবুও এবার তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অথচ সৈয়দ কবিরের মতো জনপ্রিয় প্রতিদ্বন্দীদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দুবারের মতো বিজয় লাভ করেছিলেন তিনি একটা সময়। আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ার প্রধান একটি কারণ হলো তার নিজের ভাইয়ের কিছু কর্মকাণ্ড৷ তিনি যেসব পরিকল্পনা করে শারফানকে মাঠে নামিয়েছিলেন এবার‚ সেসবের অনেক কিছুতেই সরাসরি বাধ সেধেছেন শাফিউল৷ শক্ত গলায় বলেছেন তাকে‚ “শায়াফের পুরো জীবনটাই সামনে পড়ে আছে‚ ভাই। ওর স্বপ্ন আমাদের থেকেও অনেক বড়ো। রাজনীতিতে জড়িয়ে ওর সেই স্বপ্নের দিক বদল হোক‚ বড়ো বড়ো অপকর্ম‚ দুর্নীতি করার প্রশ্রয় পাক‚ এসব আমি কোনোদিনই মানব না। ও যখন ছিল না তখনো তুমি জিতেছিলে। তাই এবারও জিতলে ওকে ছাড়াই তুমি জিতবে। তোমার ম্যান পাওয়ার আমার আর শায়াফের থেকেও অনেক বেশি।”
অর্থাৎ শাফিউল সাহেব তার কথায় এটাই স্পষ্ট করেছেন‚ যা করতে চান শাকিবুল সাহেব তা যেন শারফানকে ছাড়াই করেন বা অন্য কারও হাত দিয়ে করেন৷ অনৈতিক আর দুর্নীতিযুক্ত পরিকল্পনার অংশ যেন শারফানকে করা না হয়।
ভাইয়ের প্রতি প্রচণ্ড নারাজ হয়েছেন শাকিবুল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। রাগ সৃষ্টি হয়েছে তার শারফানের ওপরও৷ যে ছেলে ব্যাবসার বড়ো বড়ো সিদ্ধান্তে বাপকে তোয়াক্কা করে না‚ যখন তখন যার তার সামনে বাপকে অসম্মান করার পায়তারা করে‚ সেই ছেলেও হেলাফেলা ভঙ্গিমায় বলেছে‚ “যেখানে শাফিউল হক আমাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সেখানে বেকার খাটনি কেন করতে যাব‚ কাকা?”
ভাই আর ভাইপোর জবাবগুলো মোটেও ভালোভাবে নেননি শাকিবুল সাহেব। নির্বাচনে যদি জিতে যান তাহলে এ কথাগুলোর কোনো হিসাব-নিকাশ তিনি করবেন না৷ আর যদি এর উলটোই হয় তবে নির্বাচনের পরই ছেঁকে ধরবেন দুজনকে। নিজের কোনো ছেলে নেই বলে বোনের ছেলেপুলে রেখে একমাত্র ভাইয়ের ছেলেটাকে আপন করে নিয়েছেন। সেই ছেলের আবদারে নিজের শেয়ারের অংশ দিতেও দুবার ভাবেননি। স্বার্থ আদায় করা হয়ে গেছে বলে এখন তাকে আর চিনবে না শারফান‚ শারফানের বাপ! এত সহজ তার সঙ্গে গাদ্দারি করা?
অথচ শাফিউল সাহেব জানতেও পারেননি শাকিবুল হকের মনের ভেতরে দেবে থাকা এই আগ্নেয়গিরির খোঁজ।
***
সকাল ৭:২০ মিনিট।
কোনো পারফিউমই কেন যেন পছন্দসই লাগছে না আজ শারফানের৷ মনে মনে কী যেন ভেবে চলে এলো বাবা-মার ঘরে। বিছানায় বসে ফোনে কারও সাথে গভীর আলোচনায় মগ্ন শাফিউল সাহেব। ছেলেকে ঢুকতে দেখেও তেমন গ্রাহ্য করলেন না। শারফানও তাকে না দেখার মতো করে এসে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়াল৷ সেখানে রাখা সব কিছু ওলট-পালট করে খুঁজে বের করল আতরের বক্স। একেকটার ঘ্রাণ নিতে নিতে বিড়বিড় করল‚ “পাঞ্জাবি হলো অভিজাতপূর্ণ পোশাক৷ এর সাথে কি পারফিউমকে এলিট লাগে? আতরই পারফেক্ট।” তারপর পছন্দ করল সৌদি আরব থেকে আনা একটি আতরের খুশবু৷ মনমতো জামায় আর ঘাড়ে মেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চাইলো। কিন্তু বরাবরের মতো অপছন্দের পিছু ডাকের জন্য বাধ্য হলো দাঁড়াতে।
ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে শাফিউল সাহেব উঠে এলেন ছেলের কাছে। গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিলেন‚ “ফারনাজ কবিরের এজেন্টদের সঙ্গে আজ কোনোরকম ঝামেলা যেন না হয় তোর দ্বারা।”
“আমি হুদাই কারও পাছাতে আঙুল দিই?” বাবার মতোই গম্ভীরভাবে বলল শারফান।
“হুদাই দিস না৷ কোনো কারণে দিলে দেওয়াও তো আর থামাস না। ফারনাজ কিন্তু সবই জানে। তবুও সে চুপ করে আছে৷ তাই বলে মনে করিস না সে তোর থেকে কম ঘাগু। এই ইলেকশনে সে জিতে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আমি চাই না তার সাথে চরম শত্রুতার সৃষ্টি হোক। তাছাড়া তোরা দুজন দুই ফিল্ডের৷ সে রাজনীতির মানুষ আর তুই ব্যাবসার৷ নেক্সট ইলেকশনে আমি তো তোকে আর ঢুকতেই দেবো না এসবে। তাহলে সাময়িক পরিস্থিতির জন্য কোনো প্রয়োজন আছে শত্রু বাড়ানোর?”
“তোমার ভাইকে সামাল দিতে পারবে তো?” শারফান ভ্রুকুটি করে চাপাস্বরে বলল‚ “হেরে গেলে পাছে তোমাকেই না শত্রু ভাবে সে!”
“কেন শত্রু ভাববে? গত পঁচিশ বছর ধরে রাজনীতিতে যুক্ত ও। এর জন্য ব্যাবসার পুরো ভার রাত-দিন আমি বহন করেছি৷ সব সামলেছি আমি। দিন-সকালে তোর ঘাড়েও দায়িত্ব তুলে দিয়েছি৷ সে মাসে একবার কি দুবার এসে হিসাবপত্রের খোঁজ নিয়ে গেছে শুধু। পরিশ্রম আমি বেশি দেওয়ার পরও কোনোদিন এক পয়সা বেশি লাভের দাবি করিনি৷ এখন সে তোকে শেয়ার দিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্তে৷ বলতে পারবে না আমি কোনো প্রেশার ক্রিয়েট করেছি। তার প্রথম ইলেকশনের প্রায় অর্ধেক খরচ দিয়েছি আমি স্বেচ্ছায়৷ আর সাহায্য-সহযোগিতার হিসাব তো আলাদাই৷ ইলেকশনে হারলে তাকে বুঝতে হবে দিন সব সময় এক থাকে না‚ জনগণের মর্জিও সব সময় এক থাকে না৷”
“হুঁ…”‚ বড়ো এক নিঃশ্বাসের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করল শারফান। “তাহলে এত সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে যেয়ে আর কাজ নাই আমার। যাই‚ আরেকটু ঘুমাই।”
“ঘুমাবি মানে? কাজ নাই কে বলল? পোলিং এজেন্ট কে কে হয়েছে যেন?”
“অনি‚ রিপন‚ সাদ্দামসহ আছে তোমাদের পুরোনো বাড়ির ছেলেরা।”
“আমাদের সেন্টারে আছে কে?”
“অনি।”
“চলে যা সেন্টারে। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে এখন থেকেই৷ ঝামেলা একটা তো হবেই। কখন আর কোথায় হবে তা তো আর বলা যাচ্ছে না৷ এলার্ট থাকতে হবে।”
হক বাড়িতে হুলুস্থুল অবস্থা। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেছে কিনা গত পরশু থেকে! শাকিবুল সাহেব সপরিবারে উপস্থিত এখন ভাইয়ের বাড়িতে। এমনকি পালিয়ে বিয়ে করা দুই কন্যাও ঠাঁই পেয়েছে। তবে বর ছাড়াই৷ তারা যদি ফরিদপুর সদরের বাসিন্দা হতো তাহলে নির্বাচনের অছিলায় আজ তারাও জায়গা পেত। একটা ভোটও হাতছাড়া করতে চান না ছাতা মার্কার এই প্রার্থী৷ তাই এত বছর দূর দূর করা মেয়েদুটোকে নিজেই ফোন করে ডেকেছেন।
সকাল আটটা থেকে ভোট শুরু হবে। সবার আগে শাকিবুল সাহেব ব্যালট পেপার ফেলবেন বাক্সে। বাড়ির পুরুষ সদস্য চারজন। তাই তাদের জন্য জেসমিন আর তার বড়ো জা হাফসা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নাশতার আয়োজন করেছেন। টেবিলে খাবারগুলো রেখে হাফসা বেগম ছোটো মেয়ে মিথিকে ইশারায় খাবার টেবিলের কাছে দাঁড়াতে বলে চলে গেলেন আবার রান্নাঘরে৷ দুপুরের রান্নাবান্নাও চলছে। দ্রুত রান্না শেষ করে সাড়ে আটটার মধ্যে তারা সবাই যাবেন ভোট কেন্দ্রে৷
শাফিউল সাহেবকে বেশ যত্নের সাথে খাবার বেড়ে দিলো মিথি৷ নিজের বাবাকে দেওয়ার সময় টেবিলে এসে বসল রিহান আর শারফান৷ আতরের এক দারুণ সুঘ্রাণ তখন ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ ঘ্রাণটা শারফানের গা থেকে আসছে বুঝতে পেরেই মিথির কেমন এক মাতাল মাতাল অনুভব হলো৷ দ্রুত বাবাকে খাবার বেড়ে দিয়ে এসে দাঁড়াল ওর পাশে৷ ওপর থেকে নিচে নেমে আসা অবধি ওর নজর রয়েছে ফোনের স্ক্রিনেই। তাই খেয়াল করেনি পাশে এসে দাঁড়ানো মানুষটা মিথি৷ মাকে ভেবে বলল সে‚ “ভাত বেশি দিয়ো না।”
এই প্রথমবার ‘তুমি’ সম্বোধন পেলো মিথি ওর থেকে৷ এত ভালো লাগা বোধ হয় তার এ জীবনে আর কখনো আসেনি৷ তবে নিশ্চয়ই ওদের মাঝে হতে চলা নতুন সম্পর্কটাকে শারফান মানতে শুরু করেছে এখন থেকেই! এজন্যই তুই থেকে তুমি-তে আসার চেষ্টাও করছে সে!
এই আনন্দেই মিথি আনমনাভাবে সবজির বদলে ডিমের তরকারি তুলে দিলো শারফানের পাতে। ফোনটা বন্ধ করে খেতে উদ্যত হলো শারফান । অমনি মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওর‚ “ডিমের তরকারি খাই না তা কবে থেকে ভুলে গেলে‚ মা?” বিরক্তে চেহারা কুঁচকে মায়ের দিকে তাকাতে গিয়েই সে মিথিকে আবিষ্কার করল৷ মেজাজ আর চেপে রাখার প্রয়োজনবোধ করল না তখন৷ কাউকে তোয়াক্কা না করে বাজখাঁই গলায় তাকে ধমক বসাল‚ “তোকে কে বলেছে খাজানদারি করে বেড়াতে? তাও পুরোটা ঝোল দিয়েছিস ভাতের মাঝখানে।”
“বেয়াদব! চিল্লাচ্ছিস কেন ওর ওপর?” শাফিউল সাহেব ছেলেকেই ধমকালেন। “ছোটো মানুষ ও। তাও কত সুন্দরভাবে সার্ভ করছে সবাইকে। ও কি জানে তুই গরু সব খেলেও রান্না ডিম খাস না?”
কিন্তু শাকিবুল সাহেব আবার পালটা মেয়েকেই রাগ দেখালেন‚ “তুই জিজ্ঞেস করে নিবি না? শিখেছিস কী? থাবড়ে কান‚ চোয়াল ফাটিয়ে দেবো‚ কুত্তার বাচ্চা। যা‚ আরেকটা প্লেট নিয়ে আয়!”
“থামেন‚ মামা। রাগারাগি করার কিছু হয়নি। প্লেট নিয়ে আসতে হবে না”‚ বলে নিজের খালি প্লেটের সাথে শারফানের প্লেটটা বদলে নিলো রিহান।
শাকিবুল সাহেব তবুও কতক্ষণ গরম চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে৷ মিথি শারফানের ধমক খেয়েই ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছিল৷ বাবার চাউনি দেখে তার এবার হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করল৷ জমের মতো ভয় করে সে বাবাকে।
মূলত বড়ো দুই মেয়ের দুর্ঘটনাগুলোর পর থেকে মিথিকেও সহ্য করতে পারেন না শাকিবুল। কিন্তু তার এই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠার সঠিক কারণটা ধরতে পারলেন শাফিউল সাহেব৷ শারফানের আচরণটা পছন্দ হয়নি তার ভাইয়ের৷ আর রাগটাও আগে থেকেই জমা ছিল মনে। তা শারফান কিংবা তার ওপরই। সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন এভাবে৷ খেতে খেতে তাই কিছু একটা চিন্তা শুরু করলেন তিনি।
শারফানেরও ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি৷ সে তো আগে থেকেই অনুমান করে আসছে চাচার ভেতরের এই উষ্মা ভাবটা৷ কিন্তু যেখানে বাবা এসব থেকে ওকে গুরুগম্ভীরভাবে দূরে সরে যেতে বলেছেন‚ সেখানে কেনই বা কামলা দিয়ে বেড়াবে সে? সে তো পারলে কালই ত্যাগ করবে ফরিদপুর৷ কতগুলো ফালতু সময় কাটাল এতদিন ঘুরে-ফিরে!
***
বেলা ১২: ৪০ মিনিট।
রোদের তেজটা ভালোই আজ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিজগিজ করছে মানুষে। প্রাঙ্গণে এসে সবেই দাঁড়াল সানা। তার বাড়ির সবাই খুব সকালে এসে ভোট দিয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে শুধু সে-ই৷ বলেছে‚ বান্ধবীদের সাথে করে ভোট দিতে আসবে৷ কিন্তু তার আসল কারণ হলো পান্থ৷ ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে বলেই এ অজুহাত দিতে হয়েছে তাকে৷ সে অবশ্য সত্যিই একা নয়। দিনাও এসেছে সঙ্গে৷ সে খোঁজ করতে গেছে খুব পরিচিত কেউ আশেপাশে আছে কি-না। যদি তেমন কেউ না থাকে তাহলে পান্থর সাথে কোথাও একটা দাঁড়িয়ে সে এখনই কথা বলবে। চাইলে নিরিবিলি বা কেউ দেখে না ফেলার মতো জায়গাতে গিয়ে দেখা করতে পারত। কিন্তু সে তো করবে সম্পর্ক ছিন্ন৷ আর পান্থর তাতে সায় থাকবে না নিশ্চিত। তাই যেন পান্থ কথা বাড়ানোর সুযোগ না পায় বা হঠাৎ আবেগের চোটে তার হাত ধরে বসে জোরজবরি করতে না পারে‚ এজন্যই এমন একটা ব্যস্ত জায়গা বেছে নিয়েছে। তাছাড়া কথা যদি পান্থ বাড়াতে চায়ও‚ তখন যেন বাবা-চাচা বা ভাই-ব্রাদারের উপস্থিতির ভয় দেখিয়ে দ্রুত কেটে পড়তে পারে সে। ব্যাপারটা যদিও ঝুঁকিপূর্ণ। যদি সত্যিই কেউ দেখে ফেলে! তাই কথা বলবে সে সাধারণ পরিচিতের মতো হয়ে। যাতে তাদের দেখলেও সন্দেহজনক না লাগে।
দিনা ফোন করল সানাকে৷ রিসিভ করলে তাকে জানাল‚ “সেরকম রিস্কি পার্সন কেউ নেই। কিন্তু ইব্রাহীমের সঙ্গে এসে দেখা হয়ে গেছে আমার।”
“মানে কী? উনি কোত্থেকে আসলেন?”
“বন্ধুরা সাথে আছে তাও৷ আমি তো সামনে পড়ে এখন ফেঁসে গেছি। তোর কথা জানাইনি পান্থর জন্য। ওকে ডেকে কথা সেরে ফেলবি?”
“ধুর”‚ মেজাজের সঙ্গে বলল সানা‚ “তুই কি পাগল? আমি একা দেখা করব ওর সাথে? ব্রেকআপ করতে আসছি আমি৷ ডেট করতে না। তোর থাকাটা দরকার ছিল।”
“তাহলে কি এখন ওকে বলব যে তুই হঠাৎ এসেছিস?”
“সেটা তোর আগেই জানানো উচিত ছিল৷ ফোনে কথা বলার এক্সকিউজ দিয়েছিস কার কথা বলে? আমার কথা না? এখন আবার হুট করে বলবি আমি চলে এসেছি। ওনার কাছে সেটা সন্দেহজনক লাগবে এমনিতেই।”
ভাবনায় পড়ল দিনা‚ “তাহলে কী করব?”
“কী আর করার আছে এখন? বরকে নিয়ে বরের বন্ধুদের সাথে খোশগল্প আরম্ভ কর”‚ বলেই কলটা কেটে দিলো। দিনার কাণ্ডে আর রোদের তেজে মাথাটা তার উত্তপ্ত হয়ে গেছে একদম। সে জানে‚ ইব্রাহীমকে দেখে দিনা নিজেই দৌড়ে দৌড়ে গেছে তার কাছে৷ বিয়ের আগেই মেয়েটা কেমন বর পাগল হয়ে গেছে! “ছিহ” করে উঠে মনে মনে ওকে গালাগাল করল কিছুক্ষণ। তারপর ভাবল এখন কী করবে সে?
তখনই একটা মেসেজ করল দিনা‚ “দশটা মিনিট ওয়েট কর‚ বোন। আমি আসছি।”
অবজ্ঞা ভরে পড়ল সানা মেসেজটা৷ ফিরতি মেসেজে সে জবাব দিলো‚ “তোর মতো বেহায়া বর পাগলের দশ মিনিট মানে ষাট মিনিট তা আমি ভালোই জানি।”
কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলো ভোটটা দিয়ে আসা যাক। ততক্ষণে নিশ্চয়ই দিনার গল্পগুজব শেষ হবে। মাথায় ভালো করে ওড়নাটা টেনে মাস্কটা মুখে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে লাইনে। মুখটা যদি খোলা থাকত তাহলে আর এই লাইনে দাঁড়ানো হতো না তার৷ ফারনাজের সাঙ্গপাঙ্গরা কেউ দেখলেই মেকি সম্মান দিতে ছুটে আসত।
বেশ লম্বা লাইন। ধৈর্য ধরে সানা এগোতে থাকল আর ফেসবুকের নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করতে থাকল। ভোট কেন্দ্রের ভিড় আরও বাড়ছে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর অনেকটা সামনে চলে এলো সে। আর তার পিছে আবার লম্বা লাইন হয়ে গেল। পেছনের কয়েকজনের থেকে হঠাৎ কানে এলো‚ কয়েকটা কেন্দ্রের অবস্থা নাকি ভালো নয়৷ হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে ছাতা মার্কা আর দোয়েল মার্কার প্রার্থীর লোকেদের মাঝে। এ দুটো মার্কার প্রার্থী সম্পূর্ণ বিরোধী দলের দুজন। তাহলে সেসব জায়গায় কলস মার্কার কী অবস্থা? কোনো ঝামেলা ছাড়াই চলছে ভোট? ভাবল সানা৷
ভোটকক্ষে প্রবেশের পালা আর একটু পরই। ফোন থেকে চোখদুটো তুলে সানা কক্ষের ভেতরে দেখার চেষ্টা করল গলাটা লম্বা করে। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটল তখনই। পোলিং এজেন্ট অনি দরজার সামনে দাঁড়ানো৷ আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল শারফান৷ বন্ধুর সাথে কথা বলে যখন ফিরে দাঁড়াল‚ একদম তখনই সানার চোখে চোখ পড়ে গেল ওর। দেখার ভুল হলো না-কি? তা ভেবেই চোখ থেকে গুচির সানগ্লাসটা নামাল সে দ্রুত৷
ওড়না টানাটানি করে মুখ ঢাকার চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত হলো সানা। ভুলেও আর সামনে তাকাল না৷ কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হলো? অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেও টের পেলো বদখত লোকটা হেঁটে এসে ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়েছে। প্রায় সপ্তাহখানিক হলো তাকে ফোনে আর বিরক্ত করছে না৷ ভেবেছিল‚ ক্ষান্ত হয়েছে মনে হয় ইবলিশের চ্যালাটা। ডিসেম্বরের প্রায় পুরো মাসটা জুড়ে তাকে যে পরিমাণ জ্বালিয়েছিল! একদম ত্যক্তবিরক্ত করে তুলেছিল ফোন করে আধা ঘণ্টা‚ এক ঘণ্টা ধরে কথা বলে বলে৷ মাঝে মাঝে তো কোনো কথা ছাড়াই ফোন রিসিভ করে রাখতে হতো তাকে। ওই সময়গুলোতে দেখা যেত তাকে ফোনের ওপাশে রেখেই আশেপাশের লোকেদের সাথে কথা বলছে শারফান। নয়তো কোনো কাজ করছে আর সেসবের ঠুকঠুক আওয়াজ শুনতে হচ্ছে তাকে৷ বেশি বিরক্ত করত সে ভোরবেলাতে৷ ঘুম ভেঙেই যে তাকে কল করেছে তা বোঝা যেত ওর ঘুম-ঘুম গলা শুনে৷ তখন এমন এমন জঘন্য জঘন্য কথা বলত যা শুনলেই তার ইচ্ছে হতো‚ ঘর মোছা ন্যাতাটা নিয়ে গিয়ে ওর গলার মধ্যে ঢুকিয়ে মেরে ফেলে আসুক সে। শেষ যেদিন ভোরে কথা হলো সেদিন এই দৈত্য ভোঁদড়টা তাকে বলেছিল‚ “ঠেসে ঠেসে আটা চটকাতে ভালোই লাগে‚ তাই না? তোমাকেও আমার অমন করে চটকাতে মন চাচ্ছে খুব। আসব না-কি? ঘরে ঢুকতে দিতে হবে না৷ আমার ডার্লিং সেডানেই আছে এনাফ স্পেস।”
এক চোট গালি-গালাজ করে কলটা কেটেছিল সানা সেদিন। তারপর আর আজ অবধি কোনো কল আসেনি শারফানের৷
কোনো কথার জবাবে সে যদি চুপ থাকত বা ফোনটা রিসিভ করে সরিয়ে রাখত কখনো। তাহলেই হুমকি-ধমকি দিতো শারফান‚ জোর করে তোলা সেই ছবিগুলো তার বাবার কাছে আর ফারনাজের কাছে পাঠানোর। এসবের জন্য কত যে ওকে অভিশাপ দিয়েছে সে! কিন্তু একটা দোয়াও আল্লাহ কবুল করেননি।
“ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেই কি সানা থেকে মোনা হয়ে যাবে?” টিটকারি করে বলল শারফান‚ “না-কি ঘোমটা দিয়ে থাকলেই কোনো হুজুর বেডার বেডি হয়ে যাবে? যেন চেনাই যাবে না তোমার স্ট্রাকচার!”
হতাশার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সানা ঘাড়টা সোজ করে সামনে তাকাল। ধরা যেহেতু পড়েই গেছে আর লাভ নেই ঘোমটা দিয়ে রেখে৷ ওড়নাটা মুখের সামনে থেকে তুলে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এক মুহূর্তের জন্যও দেখল না শারফানের মুখ।
তাতে বিশেষ অসন্তোষ দেখাল না শারফানকে। সে ঠাট্টা করা চালিয়েই গেল‚ “বাই চান্স আমাকে এক নজর দেখতে লাইনে দাঁড়িয়েছ না-কি? নয়তো সকালেই তো ফারনাজের কলস কাঁখে করে সিল মেরে যাওয়ার কথা।”
ঠিক করেছে কোনো জবাবই দেবে না সানা। একজন মানুষ একা একা আর কতক্ষণই বা মুখ চালাবে যদি অপরজনের কাছ থেকে কোনো জবাব না পায়?
শারফান তার দিকে চেয়ে প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষাতেই ছিল৷ কিন্তু গম্ভীর হাবভাব দেখে বুঝে গেল কথা না বলার পণ করেছে সানা। ঠোঁট বাঁকিয়ে একবার হাসল সে‚ “সন্ধ্যা বেলার শোক কি এখন থেকেই পালন করতে চাইছ?”
এবারে তাকাল সানা ভ্রু কুঁচকে‚ প্রশ্ন চোখে৷ তাতে হাসি আরেকটু চওড়া করল শারফান‚ “শোকের রং গায়ে তুলেছ যে? পুরো ব্ল্যাক আউটফিটস। মন্দ লাগছে না অবশ্য৷ ওড়নাটা মাথা থেকে নামিয়ে দাও শুধু। মাস্ক খুলে বদনটাও একটু দেখাও। কতদিন দেখি না!”
“কোথাকার কে আপনি যে আপনার কথায় মাস্ক খুলব‚ ওড়না নামাব?” নিচুস্বরে সানা রাগ ঝাড়ল‚ “মানুষের ধোলাই না খেতে চাইলে দূর হন আমার কাছ থেকে। একটা চিৎকার দিয়ে শুধু বলব‚ আমাকে টিজ করছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।”
“তাই না-কি?”
বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় বলল সানা‚ “দেখতে চান? দেখাব?”
সেই ভঙ্গিমা দেখে শারফান মোটেও ভড়কাল না। চেঁচামেচি করলেই ফোনে যত্ন সহকারে রাখা ছবিটা সে দেখাবে সবাইকে। সানাকে প্রেমিকা দাবি করে উদ্ধার হয়ে যাবে তখন সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু দিনটা গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। তাই কোনোরকম ঝুঁকি নেওয়ায় উচিত হবে না আজ। সানার একটু কাছে এলো সে‚ “দেখতে ভীষণ চাই।” ফিসফিসিয়ে বলল ‚“কিন্তু সবার সামনে না। শুধু তুমি-আমি দুজনে… আমার ঘরে।”
কটমট করে চাইলো সানা। সেই চোখেই দুষ্টু চাউনির চোখজোড়া রেখে হাসল শারফান মিটিমিটি। রাগের চোটে সানা ওর হাঁটুর নি ক্যাপে দিলো এক লাথি। কিন্তু নিমেষেই পা’টা ডানে সরাল শারফান আর দুঃখজনকভাবে লাথিটা চলে গেল ওর দু পায়ের মাঝ দিয়ে‚ লাগল হাওয়াতে৷ মনে মনে একটু আশ্চর্যই হলো সানা আর রাগও বাড়ল। বদমাশটা এত সতর্ক থাকে সব সময় কীভাবে? নির্লজ্জের মতো হাসতে হাসতে তাকিয়ে ছিল তো তার দিকেই। তাহলে সে যে পা’টা তুলছে তা তো দেখতে পাওয়ারই কথা না।
“ওয়ানা হিট মি?” চোখদুটো কপালে তুলে কপট বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল শারফান। তারপরই চশমাটা চোখে পরে হাসল‚ “দেন ইউ নিড মোর প্র্যাকটিস‚ মাই ডিয়ারি অ্যাংগ্রি ব্ল্যাক বেরি।”
বলার পর হাসতে হাসতেই বিদায় নিলো সে৷ সানার পায়ের তলা থেকে মাথার চাঁদি পর্যন্ত জ্বলতে‚ পুড়তে শুরু করল৷ জীবনটা তার মাত্র দুটো মাসেই ছেঁড়া ত্যানা বানিয়ে ফেলেছে এই লোকটা৷ আর সে বিপরীতে একটা কাঠির খোঁচা পর্যন্ত দিতে পারছে না৷ আজকে সাহস করে যাওবা লাথিটা দিতে চেষ্টা করল সেটাও গেল বিফলে! এই রাগে-দুঃখে চরম এক সিদ্ধান্ত নিলো সে৷ ফোনে মেসেজ লিখতে আরম্ভ করল—
“তুই শারফান‚ দেখায় তোকে ট্যারা হনুমান। তুই আমাজনের নুলা‚ ল্যাংচা‚ ফোকলা দাঁতের একখান ব্ল্যাক কেইম্যান। কারণ‚ তোর হাত কেটে‚ পা কেটে করব আমি খান খান। তোর রেড জোনও ছেঁচে পিস বানিয়ে করব আমি নয় ডজন। তোর তো লজ্জা নাই জানি৷ তোকে দেওয়া দরকার তাই সবার সামনে আরেকবার মুসলমানি। ইনশা আল্লাহ তোকে জীবনে একবার হলেও করব আমার পা-দানি।”
এক মুহূর্ত দেরি না করে মেসেজটা দিলো পাঠিয়ে শারফানের নাম্বারে। ভীষণ শান্তি অনুভব করল সে এবার৷ এতকাল তো মনে মনে আর আড়ালে-আবডালেই গালাগালি করে গেল৷ তাতে কিছুই যায় আসেনি শারফানের। এরকম একটা মেসেজ পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই ওর চোখের সামনেও ভাসবে নিজের এই পরিণতি! এতেই তুষ্ট হবে সানা।
ভোটকক্ষে ঢোকার আগে আবার ঘোমটা দিয়ে নিলো সে৷ ব্যালট পেপারে কীভাবে সিল দিতে হয় তা একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার দেখিয়ে দিতে গেলে বারণ করল‚ “প্রয়োজন নেই৷ জানি আমি।”
তখনই পোলিং এজেন্ট ঘুরে তাকাল তার দিকে৷ তার কণ্ঠ পেয়ে এগিয়ে এলো সে‚ “তুমি এত লেটে কেন‚ সানা?”
একটু চমকাল সানা৷ অনিকে দেখে অবাকও হলো। প্রত্যাশা করেনি তাকে৷ “ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আসব বলে সকালে আসিনি‚ ভাইয়া”‚ বলে দ্রুত সিল দিয়ে আরও দ্রুত ব্যালট পেপার ভাঁজ করে বাক্সে ফেলল সে৷
তার কাণ্ড দেখে অবাক হলো অনিও। কিন্তু কিছু বলল না৷ নখে অমোচনীয় কালির দাগ নিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো সানা৷ কিন্তু অদূরে তৈরি হওয়া বড়ো জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল বারান্দাতে। তারপর একদম চোখের পলকে শুরু হয়ে গেল তুমুল মারামারি। এমন সংঘর্ষ ফারনাজের সেই মিছিলেও দেখেনি সে৷ এত ভোটার এখানে! সবাই দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে চাচ্ছে।
একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানে দৌড়ে এসে দাঁড়াল সানা। হাঁপাতে হাঁপাতে কল দিলো দিনাকে। দিনা ধরল না। ওর বরের নাম্বারেও চেষ্টা করল দুবার৷ রিসিভ করল না সেও৷ এদিকে মারামারি করা কিছু লোক আহত হয়ে পড়েছে কিছুক্ষণের মাঝেই৷ কারা মারামারি করছে এভাবে তা বুঝল না সে৷ এদিক-ওদিক ছুটে একটু সুযোগ খুঁজতে থাকল স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ার৷ এই ফাঁকে বাবাকে কল করে পরিস্থিতি জানিয়ে দিলো সে।
কিন্তু মোস্তফা সাহেব এই মুহূর্তে অন্য এক কেন্দ্রে। মেয়ের চিন্তায় তার হাত-পা কাঁপছিল কথা বলার সময়। তা ফোনের এপাশ থেকে জানতে পারল না সানা৷ তাকে কোনো ফাঁকা ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি কল লাগিয়েছেন আপনজনদের। রওনা হয়েছেন তিনিও৷
স্কুলের বারান্দাতে ওঠার সাহসই পায়নি সানা। বারান্দায় এখন পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে চলছে মারামারি‚ ধাক্কাধাক্কি৷ টিউবওয়েলের এদিকে এসে কয়েকজনের সঙ্গে দাঁড়িয়েছে সে৷ তখনই কল এলো তার ফোনে৷ কিন্তু নামটা দেখে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ল ধরবে কি ধরবে না। তা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আবারও এলো কলটা৷ এবার ধরল সে আর সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের ওপাশ থেকে মেঘনাদ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল শারফান‚ “কোথায় তুমি? ফোন তুলছিলে না কেন‚ হ্যাঁ? বের হয়েছ স্কুল থেকে?”
“না”‚ দুর্বল সুরে জানাল সানা‚ “পারিনি বের হতে।”
“তাহলে কোথায় তুমি?” উত্তেজিত কণ্ঠের তেজ আরও বাড়ল শারফানের‚ “কোথায় আছ জলদি বলো?”
ঘাবড়ে থাকা সানার ভীতসন্ত্রস্ত চোখজোড়া হঠাৎ গিয়ে থামল ভিড়ের মাঝে সাদা পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘ উচ্চতার পুরুষটির ওপর৷ কানে ফোন ঠেকিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশে দৃষ্টি বুলাচ্ছে শারফান। তাকে খুঁজছে? প্রশ্নটা মন করে উঠতেই বিড়বিড় করে জবাব দিলো সানা‚ “হ্যাঁ‚ সে তো আমাকেই খুঁজছে।”
আর এই মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মতো সে বাদামী বর্ণের ওই পুরুষকেই একমাত্র নিরাপদ স্থান মনে করল। যেখানে পৌঁছতে পারলে এই বিপদ আর তাকে কিছুই করতে পারবে না। এমন এক বিশ্বাস জেগে উঠতেই সে চিৎকার করে উঠল‚ “শায়াফ…!”
ডাকটা কানে যেন ঝংকার তুলল শারফানের। আর এদিকে ডাকার পরই সানাকে দেখাল অপ্রতিভ৷ সরাসরি নাম ধরে ডাকার পরিকল্পনা তার ছিলই না৷ চেয়েছিল শায়াফের পর ভাই যুক্ত করবে। কিন্তু কী করে যে মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল শুধু শায়াফ নামটা!
“আস্তে ডাকো”‚ ফোনের মধ্যে বলে উঠল শারফান‚ “এই হট্টগোলের মধ্যে তোমার মুরগির বাচ্চার মতো চ্যাঁও চ্যাঁও গলা সরাসরি আমার কান অবধি আসবে না। হাত উঁচু করো আর কোনদিকে আছ সেটা বলো।”
“টিউবওয়েলের এখানে”‚ বিব্রত হয়ে জানাল সানা। “এই যে হাত তুলেছি। আপনাকে দেখতেও পাচ্ছি।”
দেখতে পেলো শারফানও। ছুটে গিয়ে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সানার হাতটা ধরে দৌড়ে ঢুকে পড়ল একদম ফাঁকা একটা ক্লাসরুমে৷ দরজা‚ জানালা‚ সব কিছু বন্ধ করতে থাকল সে৷ সানার তাতে আরও চিন্তা বাড়ল‚ ভয় হলো‚ “বের হতে পারব না স্কুল থেকে?”
জানালা বন্ধ করে ফিরে তাকাল শারফান৷ কোনো জবাব না দিয়ে এসে দাঁড়াল তার কাছে। তখন সানা খেয়াল করল ওর বাম ভ্রুটা কেটে গেছে। ফুলে উঠেছে ওখানে। পরিপাটি করা ঝরঝরে চুলগুলোও এখন এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কপালের ওপর৷ ওর হাতের দিকে তাকাল সে৷ ডান হাতের আঙুলের গাঁটে নীলচে হয়ে আছে৷ বোধ হয় পিঠের মধ্যেও খুঁজলে লাঠির বাড়ির কয়েকটা দাগ মিলবে৷
“আপনাকে মেরেছে?” বিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সানা।
“মেরেছে মানে কী?” সে দাম্ভিকতার সাথে উত্তর দিলো‚ “মারতে গিয়ে আর মার ঠেকাতে গিয়ে দুয়েকটা লেগে গিয়েছে কোনোভাবে।”
“মারধর করছে আসলে কোন দলের ছেলেরা?”
প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে বলল শারফান‚ “এখন সব দলের ছেলেরাই নেমে পড়েছে৷ তোমার ভাইয়ের ছেলেদের দোষ অবশ্য কম। ওরা ছিল মাঠে আগে থেকেই৷ কিন্তু নজরদারি করছিল শুধু। হামলা শুরু হলে আর বসে থাকেনি৷ ফারনাজ পাঠিয়েছে আরও৷ এখন সবার হাতে লাঠির বদলে তার থেকেও ভারী কিছু থাকতে পারে। পুলিশ‚ বিজিবি এসে সবটা কন্ট্রোল না করা অবধি ভোট আর কেউ দিতে পারবে না।”
“আমরা কি এখানে সেইফ থাকব? বেরিয়ে যেতে পারব না?” আতঙ্কিত দেখাল সানাকে।
বাইরের অবস্থা সত্যিই জটিল। ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়েছে শাকিবুল সাহেবের পাঠানো বিশেষ দল৷ অফিসার আর এজেন্টদের থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানো আরম্ভ করেছে তারা৷ আর বাইরে ঠেকিয়ে চলছে তাদেরই আরেকদল৷ এ কাজ যে তারই তা বুঝতে পেরেছে শারফান প্রথমেই৷ কিন্তু ওর আর শাফিউল সাহেবের ওপর রেগে থাকায় আগাম কিছুই জানতে দেননি ওদের। শাকিবুল সাহেবের পরিকল্পনা ছিল এই ছেলেদের কীভাবে পরিচালনা করতে হবে‚ তাদের কোথায় কী কাজে লাগাতে হবে তার সব কিছু দেখাশোনা শারফানই করবে। আর এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়ান শাফিউল সাহেব।
কিন্তু ফারনাজ সবটা সুষ্ঠুভাবেই হতে দিচ্ছিল৷ তবে ধারণা কিছুটা সেও রেখেছিল একটা গন্ডগোল করবেনই করবেন শাকিবুল হক। তাই কজনকে মাঠে সকাল থেকে সতর্ক থাকতে বলেছিল সে৷ ঝামেলা যদি শুরুই হয় তবে যেন শারফানকে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়‚ এই হুকুম দিয়ে রেখেছিল সে আগেই৷ এজন্যই হামলাটা করা হয় ওর ওপর৷
সানাকে উত্তর দিলো না শারফান। ফোন থেকে হঠাৎ মেসেজটা বের করে তার সামনে ধরল৷ ভয়ানক জলদগম্ভীর গলাটাই আরও গম্ভীরতা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “এটা কী? হোয়াট ইজ দ্য রেড জোন? যেটাকে ছেঁচে পিস বানিয়ে তুমি করতে চেয়েছ নয় ডজন? হোয়্যার ডু আই হ্যাভ দ্যাট? শো মি।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২১.
ঘাবড়ে গেল সানা। এ মেসেজের কথা তো ভুলেই বসেছিল সে! এখন তো মনে হচ্ছে এক পাল ষাঁড়ের ধাওয়া থেকে বেঁচে ফিরে পড়ল এবার জাগুয়ারের খপ্পরে। ইতিউতি চেয়ে বলল কোনোরকমে‚ “এসব কি এখন বলার সময়?”
সে কথা কানে না তুলে শারফান জিজ্ঞাসা সুরে পুনরাবৃত্তি করল‚ “আমি দেখতে ট্যারা হনুমান?”
“আরে না…”‚ সানা থতমত খেলো‚ “ওসব তো…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই শারফান আবার জিজ্ঞেস করল‚ “আমি আমাজনের ব্ল্যাক কেইম্যান?”
জোরে জোরে মাথা নাড়াল সানা‚ বিড়ালের সামনে পড়া সন্ত্রস্ত প্রাণ ইঁদুরের মতো করুণ চেহারা করে।
“আমার হাত-পা কেটে খান খান করবে”‚ সানার আরও কাছে এগিয়ে আসতে আসতে শারফান বলে গেল‚ “আমাকে তোমার পা-দানি বানাবে‚ আমাকে আবার মুসলমানিও করাবে! এত সাহস? এত ক্ষমতা?”
ঝেড়ে দৌড় দেওয়ার খুব ইচ্ছেটা সানার তৃতীয়বারের মতো জাগল৷ কারণ‚ শারফানের ভাবমূর্তি সুবিধার ঠেকছে না একদম। দরজা‚ জানালা বন্ধ করার ব্যাপারটাও এখন লাগছে তার ভিন্ন কিছুই৷ কানে ধরে মাফ চেয়ে আজকের মতো যদি কোনোভাবে ছাড় পায় তবে আর জীবনেও এই লোকের চোখের সামনে পড়বে না। ফোনও আর ব্যবহার করবে না সে।
“প্লিজ ওসব ভুলে যান”‚ হাতজোড় করে বলতে শুরু করল সানা‚ “রাগের মাথায় আমার দাদীকে‚ বোনকেও ভুলভাল কত কিছু বলে ফেলি।”
“আমি তোমার দাদী না-কি বোন লাগি‚ যে ভুলে যাব?” চাপা ধমকের সাথে বলল শারফান।
কিন্তু এবার বোধ হয় সহায় হলো সানার ভাগ্য। তার ফোনটা আকস্মিক বেজে উঠল। হাতেই ধরে ছিল সে৷ তাই স্ক্রিনে ওঠা ‘আব্বু’ নামটা দেখতে পেলো দুজনই৷ এক মুহূর্ত বিলম্ব করল না সানা রিসিভ করতে‚ “আব্বু? আব্বু তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসো না!”
মূলত শারফানের ভয়েই একটু বেশি উত্তেজিতভাবে বলে উঠল সে৷ অথচ মোস্তফা সাহেব ভাবলেন মেয়ের সাথে নির্ঘাত কোনো বিপদ ঘটে গেছে। তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন‚ “এইতো মা… এই তো আমি চলে এসেছি প্রায়। তুমি কোথায়? কী হয়েছে তোমার? কিছু হয়েছে‚ হ্যাঁ? কেউ ফোন করেনি এখনো? খুঁজে পায়নি ওরা তোমাকে? আমি তো কল করে দাউদকে যেতে বলেছি। ওর বন্ধুদের নিয়ে পৌঁছে যাওয়ার কথা এতক্ষণে। ফারনাজও তো তোমাকে খুঁজতে পাঠিয়েছে বলল।”
দাউদ দিনার বড়ো ভাই। মাত্র বছর দুয়েকের বড়ো সে। স্কুলের সামনে পুলিশ আর বিজিবি মজুদ হয়েছে এই মাত্রই। বাইরে থেকে আর কাউকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না তারা৷ কিন্তু সেটা মোস্তফা সাহেবকে ফোনে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি ছেলেটা৷ সানাকেও একটা কল করে খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবেনি। এমনকি দিনার হবু বর ইব্রাহীম দিনাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দিনাও খেয়াল করেনি তার কথা। আর এদিকে ফারনাজের খালাতো-মামাতো ভাইয়েরা তাকে খুঁজছে বলে জানালেও তারা মারপিট করতেই ব্যস্ত এখনো।
ফোনের বাইরে থেকে কথাগুলো জোরেই শোনা যাচ্ছিল। সবটাই তাই শুনতে পেলো শারফান। তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে মনে মনে বলল‚ “বিপদেই আপনদের মুখোশ উন্মোচন হয়।”
সানার ওপর বিরক্ত হলো সে৷ বেচারা লোকটির চিন্তা কমানোর বদলে চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছে গাধা মেয়েটা! ছোঁ মেরে ফোনটা তাই নিয়ে নিলো সে। কানে ধরেই বলতে শুরু করল‚ “আসসালামু আলাইকুম‚ আঙ্কেল৷ আমি শায়াফ। মনে আছে বোধ হয় আমাকে? শাফিউল হকের ছেলে আমি৷ আপনার মেয়ে একদম সেইফ আছে। আমার সামনেই পড়েছিল ও। এখন আমার সঙ্গেই আছে আর একদম ঠিক আছে৷ বাইরে থাকা রিস্ক বলে আপাতক ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিয়েছি। আপনি টেনশন করবেন না প্লিজ৷ আস্তে ধীরেই আসুন। আর পুলিশ না আসা অবধি এখন আপনার স্কুলের ভেতরে না ঢোকায় ভালো৷ ক্যান্ডিডেটের নিজেদের লোকজন দেখলেই হামলা করা হচ্ছে। কাইন্ডলি আমার ওপর ভরসা রাখুন।”
মোস্তফা সাহেব আসলেই দ্রুত বাইক টেনে আসছিলেন। পথিমধ্যে আবার থেমেছেন মেয়ের খোঁজ নেওয়ার জন্য৷ আচমকা শারফানের উপস্থিতি বুঝে কিছুটা চমকালেন। তারপর ওর কথাবার্তা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে শুনলেন। গত মাসে ফারনাজ ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছিল তাকে। সানাকে নাকি বিরক্ত করত ছেলেটা‚ এ কথাও বলেছিল সে ওই রাতে মেহাকে দেখতে এসে। পরদিন সকালে তিনি সানাকে সরাসরি এসব জিজ্ঞেস করলে সানা জবাব দিয়েছিল সাবলীলভাবে৷ জানিয়েছিল‚ ঝামেলার প্রথম সূত্রপাত ঘটিয়েছিল ফারনাজই৷ আর শারফান রেগে তাকে বিরক্ত করেছিল দুদিন এজন্য যে‚ তাকে ফারনাজের আপন বোন ভেবেছিল সে।
রিহান আর শারফান সেদিন যেভাবে উপকার করেছিল তাদের দু বোনকে! সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই সানা শারফানের বিষয়ে সত্যটা প্রকাশ করেনি। তাছাড়া তার চিন্তাভাবনা ওই মুহূর্তে শারফানের জন্য বেশ ইতিবাচক হয়ে উঠেছিল। যদিও পরদিনই তার সে ভুল ধারণা ভেঙে যায়। কিন্তু ভাতিজার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে অবগত থাকায় মোস্তফা সাহেব বিচার করেছিলেন শারফানকে মেয়ের বয়ানকে গুরুত্ব দিয়েই৷ তাছাড়া তিনি তো সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে করা ওর উপকারের কথাও ভোলেননি৷ যে ঘটনার কথা অবশ্য আজ অবধিও সানা জানে না।
না চাইতেও তাই শারফান মোস্তফা সাহেবের মনে ভালো ব্যক্তিরূপেই ঠাঁই পেয়েছে। ওকে বললেন‚ “আমার আসতে আর বিশটা মিনিট সময় লাগবে‚ বাবা। ওকে ততক্ষণ দেখে রাখো।”
“আমি আছি৷ আর আপনাকে আবারও সাবধান করছি‚ আঙ্কেল৷ পরিস্থিতি পুলিশের কন্ট্রোলে না যাওয়া অবধি আপনি স্কুলের ভেতরে ঢুকবেন না। প্রয়োজনে আমি চেষ্টা করব সেইফলি ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার। নিন‚ ওর সাথে কথা বলুন।” ফোনটা সানার কাছে এগিয়ে দিয়ে সে মৃদুভাবে ধমক লাগাল‚ “সুস্থ সবল দাঁড়িয়ে আছ না? সেটা না জানিয়ে উলটে বাপের প্রেশার বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছ কেন?”
তাই তো! সে অমন করে কথা বলে তো ভয়ই পায়িয়ে দিয়েছিল বাবাকে। বাবা তো নিশ্চয়ই বাইক নিয়ে ছুটে আসছেন। আল্লাহ না করুন যদি টেনশন নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় রাস্তায়? আবার এই মারামারির মধ্যে স্কুলের ভেতর ঢুকলে যদি সত্যিই কেউ আক্রমণ করে বসে বাবাকে? বিষয়টি উপলব্ধি করেই শান্ত সুরে কথা বলার চেষ্টা করল সানা‚ “তুমি একদম জোরে গাড়ি চালিয়ো না‚ আব্বু। আমি আলহামদুলিল্লাহ একদম ঠিক আছি। ঝামেলা না থামা পর্যন্ত ভেতরেও এসো না খবরদার।”
মেয়েকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে ফোনটা রাখলেন মোস্তফা সাহেব। আর রাখার আগে জানালেন‚ তিনি শীঘ্রই পৌঁছে যাবেন।
“ওয়েল…”‚ বেঞ্চের কোনায় বসল শারফান বুকের ওপর হাত বেঁধে‚ “নাও লেট’স গেট ব্যাক টু দ্য ডিসকাশন।”
পান্থর মেসেজ এসেছে কথা বলার মাঝে। সেটা সবেই পড়তে শুরু করেছিল সানা। শারফানের কথাটা শোনা মাত্রই আশ্চর্য চেহারায় ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলল৷ বাবার সাথে না কত বিনয়ী হয়ে কথা বলল সে? তার খেয়াল রাখবে বলেও তো কথা দিলো৷ তাহলে আবার পূর্বের আলোচনায় ফিরবে মানে কী? তখন কি তবে নাটক করল শয়তানটা তার বাবার সঙ্গে? এত ধুরন্ধর লোক! সেকেন্ডের মধ্যে রূপ বদলে ফেলল কী করে!
“আপনি কি এই আলোচনার জন্যই আমাকে এখানে এনেছেন? আর আব্বুকে সব মিথ্যে সান্ত্বনা দিলেন‚ তাই না?” আবার অসহায় হয়ে উঠল সানার মুখটা‚ “আমি তো এজন্যই ভয় পেয়ে আব্বুকে জলদি আসতে বলেছিলাম।”
“ভয় পাওয়ার মতো কিছু তো করিইনি। তার আগে জানতে চাই…”‚ চোখদুটো ছোটো ছোটো করে কপট চিন্তিত মুখ করল শারফান‚ “আমার মাথা থাকতে‚ গলা থাকতে‚ পেট থাকতে আমার বংশ বৃদ্ধির গাছ কর্তন করার খায়েশ কেন তোমার?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ”‚ লজ্জায় চোখ-মুখ খিঁচে বলল সানা‚ “চুপ করুন প্লিজ।”
“হ্যাঁ…”‚ ব্যঙ্গোক্তি করল শারফান ঘাড় নাড়িয়ে‚ “আমি বললে আস্তাগফিরুল্লাহ‚ না? আর নিজে যখন ছেঁচতে চাইলে‚ আমার সাত বছরে দেওয়া মুসলমানি জিনিসকে আবার দিতে চাইলে‚ তখন আর আস্তাগফিরুল্লাহ মুখে আসেনি তোমার। আস্ত এক মিচকে শয়তান‚ ভেজা বিড়াল তুমি! দেখতে আলাভোলা… কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাজির পা ঝাড়া।”
লজ্জার চোটে আর অসহায়ত্বে হাউমাউ করে কাঁদতে মন চাইলো সানার। অমন একটা মেসেজ দেওয়া পর সে কি ভেবেছিল এ জীবনে আর কখনো মুখোমুখি হবে এই ভিলেনটার? সেজন্যই না সাহস করে ওই লাগাম ছাড়া গালিগুলো দিলো সে! ওর দিকে তাকানোর হিম্মতটুকুও আর এখন নেই তার। মিনমিনে স্বরে অনুরোধ করল‚ “এবারের মতো ছেড়ে দিন। আর কিচ্ছু বোলেন না প্লিজ!”
“হুঁ‚ দেবো৷ শুধু এবারের জন্য নয়৷ আজকের পর একেবারেই ছেড়ে দেবো”‚ স্থির চোখে চেয়ে রহস্য গলায় বলল শারফান‚ “যেজন্য নিয়ে এলাম তা আগে আদায় করে নিই… তারপর ছেড়ে দেবো।”
অবাক চোখে তাকাল সানা‚ “কী আদায় করতে নিয়ে এসেছেন?”
নিম্ন ঠোঁট মুখের ভেতর নিয়ে শারফান হাসল মৃদু। সানাকে খুঁটিয়েও দেখল তখন। “পেবল নাকি পেঅফ?” বিভ্রান্ত সে এমন অভিব্যক্তিতে বলল‚ “না-কি ট্যারিফ? কোনটি অ্যাপ্রোপিয়েট হবে? ওটা তুমিই নির্ধারণ করো।”
“এসব কীসের কথা বলছেন আপনি?” ধন্দে পড়ে গেল সানা।
“বিজনেসের স্টুডেন্ট হয়ে এমন প্রশ্ন করে তো আমার বন্ধুর পড়ানোর ওপর আঙুল তুলছ৷ কিন্তু ও আমার মতোই ভালো স্টুডেন্ট ছিল।”
“আপনি হেঁয়ালি বন্ধ করবেন? ভালো লাগছে না কেন যেন”‚ বলে মোস্তফা সাহেবকে কল করার জন্য ফোনটা খুলল সানা৷ তখনের মতো আবারও ফোনটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো শারফান। তাতে রাগ হলো সানার‚ “ফোন নিলেন কেন? আব্বুকে কল করব আমি।”
তাকে শঙ্কিত করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল শারফান। ঠান্ডা গলায় নিজের মর্জি জানাল তারপরই‚ “আমাকে চুপচাপ দশ মিনিট সময় দেবে তুমি। আই অনিল হ্যাভ টু নিডস ফ্রম ইউ।”
ঢোঁক গিলতে গিয়ে সানা টের পেলো তার গলা‚ বুক শুকিয়ে কাঠ। শারফান কী চাইছে তা নারী মনের সহজাত অনুভূতি থেকে ইঙ্গিত পাচ্ছে সে৷ কিন্তু সেই অনুমান যেন মিথ্যা হয় মনে মনে তার জন্য প্রার্থনা করতে থাকল সে আল্লাহর কাছে।
“কথা বলছ না কেন? বোঝোনি? আরও খোলাসা করে বলতে হবে?”
“আমার ফোনটা দিন।”
সানার ভয়াতুর মুখটা দেখল শারফান‚ “তার মানে বুঝেছ? তাহলে আর কথা বাড়ানোর কোনো দরকার পড়ছে না৷ তুমি যত সহজ হবে তত দ্রুত বের হতে পারবে। আর যদি চেঁচামেচি করতে চাও। দেন…”‚ থেমে গিয়ে নিজের ফোন থেকে বিশেষ একটি ভিডিয়ো চালু করল। সেটা সানার চোখের সামনে ধরল সে‚ “আই উইল শো ইট টু এভরিওয়ান। আই উইল অলসো শো আওয়ার প্রিভিয়াস রোমান্টিক পিকচারস। লুকিয়ে রোমান্স করতে গিয়ে ধরা পড়া কাপলদের মতো হবো আমরা।” শ্রাগ করে বলল তারপর‚ “বদনাম তখন দুজনই হবো এই যা।”
ভিডিয়োটা দীর্ঘক্ষণের৷ দিনাকে দেখতে আসার দিনে যখন শেষবার সানা শারফানের গাড়িতে উঠেছিল। সেদিন যতক্ষণ ছিল সে ওর সাথে‚ ভিডিয়োটা ততক্ষণ সময়েরই৷ কখন‚ কীভাবে এই ভিডিয়ো ধারণ করেছিল শারফান তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে।
কান্না ঠেলে আসা কণ্ঠে সানা জিজ্ঞেস করল ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে‚ “আপনি আরও আগে থেকে এই পরিকল্পনা বানিয়ে যাচ্ছিলেন?”
“পরিকল্পনা?” ভাবুক মুখ করে বলল শারফান‚ “এই ভিডিয়ো কি ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ক্যাপচার করেছিলাম? স্যরি‚ ঠিক মনে পড়ছে না৷”
“আমি কি আপনার প্রতিশোধের শিকার হচ্ছি? ফারনাজ আমাকে চায়৷ ওকে শিক্ষা দিতেই তাই আমাকে টার্গেট করেছেন‚ তাই না?”
“আমার বাতিল করা প্ল্যানিং তুমি ক্যাচ করে ফেললে! মার্ভেলাস!” মুচকি হেসে বলল শারফান‚ “এতটাও কুটিল ভেবো না আমাকে।”
পা জোড়া টলমল করে উঠল সানার৷ মাথার ভেতর সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে যেন। “জ্ঞানহারা হই আমি। নয়তো একেবারেই মরে যাই‚ আল্লাহ। কবুল করে নাও আমাকে এখনই”‚ বিড়বিড়িয়ে কামনা করে গেল নিজের মৃত্যুর।
তা কানে পৌঁছল না শারফানের৷ সানার চন্দন বরন‚ কোমল সুন্দর‚ চৌকা মুখপানে অনিমেষ চেয়ে থাকতে থাকতে ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ল সে। “এই”‚ আকস্মিক টানে তাকে কাছে নিয়ে এলো‚ “আর সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না আমি।”
সানা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই তার কোমর আঁকড়ে ধরে দুজনের মাঝের দূরত্বটুকু পুরোপুরি নিঃশেষ করে ফেলল শারফান। সে বেঞ্চে বসা বিধায় সানা দাঁড়িয়েও দুজনের কপাল জোড়া অনিচ্ছাতেই মিশল একবার৷ চকিতেই ওকে ধাক্কা মেরে বসল সে। কিন্তু এক চুল নড়তে পারল না ওর বাহুবন্ধ থেকে আর না নড়াতে পারল ওকে।
চিৎকার করতে যাবে সানা ঠিক তার আগেই শারফান দৃঢ়তার সঙ্গে বলল‚ “গত এক মাস জুড়ে যে অসহ্য অস্থিরতা দিয়েছ তার জন্য মাত্র দশ মিনিট নিচ্ছি। তোমার তাই উদার হওয়া উচিত৷ আর শুনে রাখো‚ আজ যা হচ্ছে তার সব দায় শুধু তোমার আর তোমার। তাই আমাকে আটকালে সব থেকে খারাপ করব আমি তোমাকেই সবার সামনে।”
ক্রুদ্ধস্বরে জবাব দিতে সানা ঠোঁটদুটো সবে খুলল আর সুযোগসন্ধানী শারফান একটুখানি বিলম্ব করল না ঠোঁটের গাঢ় ছোঁয়াতেই তার কণ্ঠকে অবরুদ্ধ করে ফেলতে।
শিকারী এক জোড়া পুরু ঠোঁটের অন্দরে লুকিয়ে রইল সানার ঠোঁটজোড়া। ধারাল নখের খামচি তখন পড়ল প্রথমে শারফানের কাঁধে। পাঞ্জাবির কারণে রক্ষা পেলো সে অংশটুকু। কিন্তু দ্বিতীয় আক্রমণে ওর খোলা ঘাড়ে নখের চিহ্ন বসিয়ে দিলো সানা স্পষ্ট। কিন্তু তবুও বেচারি নিস্তার পেলো না। গাল ভিজে আসা তার নোনাপানির স্পর্শেও শারফান ক্ষান্ত দিলো না। উপরন্তু তার কোমরের এক পাশটা খামচে ধরল সেও। আর পিঠে রাখা হাতটাতে রাখল কোমলতায়৷ বন্ধ চোখের মানসপটে ও দেখতে পেলো শুধু স্বপ্নের সেই মায়াজালে আটকা মুহূর্তটাকেই। যেই মুতূর্ত ওকে কতগুলো দিন আর রাত নাজেহাল করে তুলেছিল। অনুভূতির প্রগাঢ়তা যত বেড়ে চলল‚ ততই সে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠল৷ চোখ মেলে তাকালও হঠাৎ এর মাঝে। এক পলের জন্য দেখল লিপগ্লস মাখা সানার নিম্ন ঠোঁটটাকে লাল পদ্মের পাপড়ি বেশে। দেখা মাত্রই দ্বিতীয়বারের মতো হারাল সে মিঠেকড়া এই মেয়েটার অধরপল্লবের ভাঁজে। তারপর স্বপ্নে দেখা সেই মসৃণ কণ্ঠের মাঝেও৷ সানার নিঃশব্দের কান্নাকাটি‚ জোরালো ছটফটানি এক সময় থেমে যেতে বাধ্য করল ওকে।
ওড়নাটা দুজনের মাঝখানে পড়ে ছিল৷ সেটা তুলে সানার দু কাঁধের ওপর মেলে দিলো শারফান নীরবে। তার রক্তিমা গালদুটোই চোখের পানিতে একাকার অবস্থা দেখে ওর ভালো লাগল না একটুও।
হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে‚ কাঠিন্য চোয়ালে‚ চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দেই কাঁদছিল সানা৷ কান্নার দমকে গা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কতক্ষণ তাকে চুপচাপ দেখে হঠাৎ গালদুটো মুছে দিলো শারফান৷ তার কাঁধের ওপর চিবুক ঠেকিয়ে নিচুস্বরে বলল সে‚ “আই অ্যাম নট লাইক দ্যাট। আই হ্যাভ নেভার বিন লাইক দ্যাট। আই হ্যাভ নেভার নিডেড টু পুল এনিওয়ান ক্লোজ লাইক দ্যাট। অনলি ইউ… ইউ আর দ্য ফার্স্ট৷ যাকে আমি মাত্র দশটা মিনিটের জন্য হলেও পেতে মরিয়া হয়েছি৷ অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ। আমি এখন আর অতৃপ্ততায় ভুগব না‚ না পাওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করব না‚ বিরক্ত হবো না আর হঠাৎ হঠাৎ। আমি এখন আমার আগের স্বেচ্ছাধীন সময়ে ফিরতে পারব।”
সরে এলো তারপর সানার থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে দেখতেই ফোনটা বের করল পকেট থেকে। সাইলেন্ট করে দিয়েছিল বলে মোস্তফা সাহেবের থেকে আসা কল তিনবার মিসড কল হয়ে উঠে আছে স্ক্রিনে৷ সানাকে ফিরিয়ে দিলো এবার। জড়ীভূতের মতো ফোনটা হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করে দরজার দিকে রওনা হলো সে৷
“শোনো”‚ পিছু ডাকল শারফান। কিন্তু দাঁড়াল না সানা। তবুও শারফান বলল তাকে এক নিঃশ্বাসে‚ “আজকের পর আর আমাকে তুমি দেখতে পাবে না‚ তোমাকে আর আতঙ্কে থাকতে হবে না‚ তোমার ফোনও মুক্তি পাবে আমার কল‚ মেসেজ থেকে। তুমি ফ্রি… একদম ফ্রি আমার থেকে। আমি চলে যাচ্ছি কালই আমার গন্তব্যে।” কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামল। তারপর আবার বলল‚ “চাইলে শেষবারের মতো ভালো-মন্দ যা কিছু বলে যেতে পারো।”
শেষ কথাটাই দরজার খিলটা খুলেও দাঁড়িয়ে পড়ল সানা। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শারফানের দিকে পৃথিবীর সবটুকু ঘৃণা নিয়ে৷ রুদ্র রোষে বলল‚ “এই যাওয়ায় যেন আপনার শেষ যাওয়া হয়। আপনার ধ্বংসস্তূপও যেন কেউ খুঁজে না পায়।”
“মৃত্যু!” প্রচণ্ড বিস্ময় গলায় বলল শারফান‚ “একদম ডিরেক্ট মৃত্যু চাইলে?”
“আপন কাউকে স্মরণ করার সময়টুকুও যেন না পান”‚ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে জবাবটা দিলো সানা।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল তখন শারফান। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ রাগল না মোটেও। বরঞ্চ সাবলীল সুরে জিজ্ঞেস করল‚ “আচ্ছা ধরো মরেই যাব ঢাকা ফেরার পথে। তো মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে কিছু চাওয়ার নেই?”
“হ্যাঁ‚ আছে। আমার ছবি দুটো আর ভিডিয়োটা নষ্ট করে দেবেন৷ কিন্তু আমি জানি আপনি দেবেন না”‚ বলার পর আর দাঁড়াল না সানা৷ দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু জবাবটা নিয়ে গেল না বলে শারফান স্বগতোক্তি করল‚ “ছবি তো দুটো না। অগণিত। সেদিন দুপুরে ঝোঁকের মাথায় কী করেছি আমি! কেন যে তুলেছিলাম তোমার এলোমেলোভাবে কতগুলো ছবি! ভিডিয়োটাও এক্সাক্ট কোনো কারণবশত করিনি। এতগুলো দিন সেসব ছবি‚ ভিডিয়ো যখন-তখন দেখে গিয়েছি পাগল‚ ছাগলের মতো। এখন তা ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগছে।কিন্তু কথা দিলাম যাও‚ তোমার সব কিছু মুছে দেবো।”
চলবে।