#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৫.
হুডিতে মুখের অনেকটাই ঢাকা৷ তবুও সানার চোখে পড়ল ওরই মতো কপালের একদম একই জায়গাতেই আঘাতের চিহ্ন শারফানের। এছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না তার‚ কেবল নিজের প্রতি এক প্রগাঢ় চাউনি ছাড়া। প্রশ্নটার জবাবে কী উত্তর দেওয়া উচিত‚ আদৌ দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি-না‚ এমন ভাবনাতে কতক পল নীরবেই চেয়ে থাকল সে শারফানের চোখে চোখ রেখে।
শারফানও আর অপেক্ষা করল না জবাবের। একই কণ্ঠেই বলল সে‚ “কিছুক্ষণ আগেও আমি ভেবে রেখেছিলাম ঠিক কী বলব তোমাকে। তবে গতকাল রাতেও জানতাম না আজ সকালেই তোমার কাছে আসব। গত চারদিন… এই চারদিন ধরেই আমার মাথায় আঘাতের পেইন থেকেও বেশি পেইন করছিলে তুমি। বুঝতে পারছিলাম না কী করব! হঠাৎ আজ কোনো ডিসিশনে পৌঁছনোর অপেক্ষা না করে স্রেফ মন যা চাইলো তাই করলাম। অ্যান্ড নাও আই অ্যাম ফ্রি ফ্রম দ্য পেইন… অফ সানা।”
থামল এক মুহূর্তের জন্য সে৷ হয়তো ভাবার জন্য সময় নিলো। তারপরই কেমন অন্যরকম গলায় বলল‚ “আই জাস্ট রিয়েলাইজড দ্যাট‚ আমার সাব-কনশাস মাইন্ড তোমাকে দেখতে চাচ্ছিল। কিন্তু কেন? এজন্য কি যে তুমি আমার মৃত্যু কামনা করেছিলে বাট আই কেম ব্যাক অ্যালাইভ? অথবা আল্লাহ আমাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার জন্যই? না-কি এর কোনোটাই না? শুধু তোমাকে দেখতে মন চাইছিল বলেই ছুটে এসেছি আমি?”
সানার মনে হলো সপ্তাহখানিক আগের দেখা শারফান ওর সামনে নয় এখন। বরঞ্চ শারফান রূপেই কোনো গোলকধাঁধা এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। যার কথায় ও পুরোদস্তুর বিভ্রান্ত৷ কিংবা বলা চলে শারফানের কোনো কথারই ঠিকঠাক অর্থোদ্ধার করতে পারছে না ওর মস্তিষ্ক। তাই বাধ্যই হলো পুনর্বার চুপ থাকার।
এবং আগের মতোই শারফানও আশা করল না ওর উত্তরের। “মাই সাব-কনশাস মাইন্ড ইজ আ ক্রুয়েল ডেভিল”‚ নিবিড়ভাবে ওকে দেখতে দেখতে সে অচঞ্চল গলায় বলল‚ “যার জন্য আমি অনেকগুলো দিন অশান্তি পুহিয়েছি। আর যার জন্যই খেসারত গুণতে হয়েছিল তোমাকেও। কিন্তু তোমার সামনে যেহেতু আমাকে সে আবার টেনে আনলই‚ এ যাত্রায় তোমার অভিশাপ থেকেও পার পেলাম… দেন আই শুড অ্যাপোলোজাইজ টু ইউ। আই কনফেস মাই গিল্ট‚ সানা।”
পেছনে সোফায় বসা রিহান এতখানিই আশ্চর্য হলো যে‚ “ও আল্লাহ গো” বলে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে দ্রুত সামলাল সে নিজেকে। আর সানা তো নির্বাকই। শারফান নির্বিকারভাবে বলল ওকে‚ “ক্ষমা করবে কি করবে না একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু‚ তোমার প্রতি আমার যে অবসেশন তৈরি হয়েছিল সেটা যেন আমার সাময়িক সময়ের জন্যই হয়—কেবল এই প্রার্থনা কোরো তুমি আল্লাহর কাছে।”
শেষ কথাটাই অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভব করল সানা। আর
এ কথার পরই মেহার উপস্থিতি দেখতে পেলো শারফান সানার পেছনে। বেচারির মেজাজ খিঁচড়ে ছিল ঘুম থেকে জোর করে তোলার জন্য। উপরন্তু বিশেষ অতিথি বলতে যে মা শারফানকে বলেছে তা জানার পর আরও রাগান্বিত দেখাল মেহাকে৷
কিন্তু শারফান পাত্তা দিলো না তাকে আর তার বিরক্তিপূর্ণ চাউনিকেও। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে সানার দিকে তাকাল আবার। জিজ্ঞেস করতে কেমন দ্বিধা হচ্ছে‚ তাও করল সে‚ “ফারনাজ ওয়াজ ইনভলভড্ ইন ট্রায়িং টু কিল মি। ডিড ইউ নো দ্যাট?”
থমকে থাকা চোখের পাতাজোড়া এবার কাঁপল সানার। ফারনাজের ক্রোধের শিকার হয়ে একটা বাচ্চা ছেলের মৃত্যু ঘটেছে‚ এ কথা স্মরণ হতে চেহারার রং উবে গেল ওর। অপরাধবোধে দগ্ধ তো হচ্ছিলই৷ কিন্তু কারও সামনে ওকে এই সত্য স্বীকার করতে হবে‚ এর আগাম প্রস্তুতি যে নেওয়া হয়নি। ভাবনাতেই আসেনি শারফানের সামনে কখনো এর জবাব দিতে দাঁড়াতে হবে ওকে!
আর পারল না সে শারফানের চোখে চোখ রাখতে। নিম্ন ঠোঁটটা একবার কামড়ে ধরে দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে ফেলল। আত্মগ্লানির কান্না রোধের চেষ্টায় কাঁপতে থাকল ওর ঠোঁট আর কোমল দুটো গালও।
“তোমার অভিশাপটা ফলেনি”‚ ফিসফিসানির মতো শোনাল শারফানের কণ্ঠ‚ “ফলানো হয়েছে। অ্যান্ড ইউ নিউ দ্যাট‚ রাইট?”
ভিজে আসা চোখদুটো বন্ধ করে নিশ্চুপ রইল সানা। “সাব-কনশাস মাইন্ড”‚ কেবল মনের গহিনে আওড়াল সে‚ “আমার সাব-কনশাস মাইন্ডও ভয়ানক এক পিশাচ৷ যে আমার ঘৃণা আর ক্ষোভের সুযোগে চেয়েছিল আপনার ক্ষতি হোক‚ এক ক্ষমতাধর কেউ শাস্তি দিক আপনায়। অতঃপর সেই ক্ষমতাধর কথা রাখল আমার৷ তবে কি আমিও খুনি নই? কিন্তু আপনি আমার অন্তরটাই ঢুকুন… দেখতে পাবেন প্রত্যেকটি দিন বিবেকদংশনে মরছে আমার আত্মাটা।”
নির্নিমেষ ওকে চেয়ে দেখতে থাকা শারফানের চোখের পাতায় অবিশ্বাসের ছায়া নেমেছিল এক মুহূর্তের জন্য। তাই ক্ষিপ্ত হলো সে নিজের প্রতিই যে‚ কী এমন সম্পর্কের জোরে এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল ওর মন? সহসাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে সানার থেকে। “আমেইজিং”‚ মাথাটা মৃদু দোলাতে দোলাতে বিদ্রুপ করল‚ “মেয়ে জানের ওপর কোপ মারে আর বাপ গিয়ে রক্ষা করে!”
কয়েক মুহূর্ত মৌনতা বিরাজ করল এরপর দুজনের মাঝে। সানার নুইয়ে রাখা মুখপানে চাইলো শারফান শেষবারের মতো‚ “ইউ মেড মাই ডে।” স্বগতোক্তির মতো বলল তারপর‚ “সো হোয়াটস দ্য নিড টু অ্যাপোলোজাইজ এনিমোর? যেখানে অপরাধের সাজা দেওয়া হয়ে গেছে আমাকে দ্বিগুণ থেকেও চারগুণ।”
“হ্যাঁ‚ সত্যিই”‚ মনে মনেই বলল সানা‚ “প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সাজার ভুক্তভোগী আপনি৷ যার ফলস্বরূপ বেকসুর এক ছেলের জীবন গেল৷ অথচ শাস্তিটা কেবল আপনার আমার থেকে পাওনা ছিল। অন্য কারও অধিকার ছিল না আমার হয়ে আপনাকে আঘাত করার৷ এখন তাই আমিই হয়ে গেছি আপনার চেয়েও বড়ো অপরাধী!”
মুখ ফুটেও কথাগুলো বলতে চাইলো সানা। চোখের কোন মুছে তাই তাকাল শারফানের দিকে। কিন্তু তার চোখে চোখ রাখতে গিয়েই হঠাৎ বেশ অপ্রতিভ হলো সে। মনে মনে সাজানো কথাগুলোও এলোমেলো হয়ে গেল। ওর প্রতি শারফানের আজকের চাউনি কেমন যেন হৃদয়ে খামচি দিয়ে ধরার মতো এক অনুভূতি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সে চাউনিতে রাগ বা ক্ষোভের প্রকাশ নেই। আছে অব্যক্ত অভিমান‚ অভিযোগ আর তীব্র ভর্ৎসনা। আর এটাই ওকে আরও বেশি অপরাধী ভাবাল‚ দুর্বল করে তুলল। ধরে রাখতে পারল না কান্নাটুকুও। দাঁড়িয়ে থাকারও আর সাহস হলো না৷
“আপনি নিশ্চয়ই আজ জানিয়ে যাবেন আমার আব্বুকে‚ তার মেয়ে ওই বাপ্পি নামের ছেলেটার হত্যাকারী”‚ চলে যাওয়ার আগে এ কথায় বলে গেল সে শারফানকে।
মেহা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছুই দেখল আর শুনল। কিন্তু কিছুই না বুঝতে পেরে প্রথমে পা বাড়াল সানার পিছু পিছু যাওয়ার জন্য৷ কিন্তু ওর মনের অবস্থা ভীষণ খারাপ‚ এটুকু বুঝে আর এগোলো না আপাতত৷ তাই পরবর্তীতে পা বাড়াল শারফানের দিকে৷ কিন্তু শারফানও হঠাৎ করেই ব্যতিব্যস্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল রিহানকে ফেলেই। তার কথা সে ভুলেই গেছে। তখনই তার মুখোমুখি হলো মেহা৷ কিছুক্ষণ আগেও সে বুঝতে পারেনি ঘরে শারফান ছাড়া এই ছেলেটাও উপস্থিত ছিল৷
আহাম্মক বনে যাওয়া রিহান মাত্রই উঠে দাঁড়াল শারফানের পিছু ছোটার জন্য। কিন্তু মেহার ডাকে ফেঁসে গেল সে।
“কী হয়েছে‚ ভাইয়া? বিস্মিত মেহা জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “কী বিষয়ে কথা বলছিল ওরা?”
উত্তর না দিয়ে তো এবার চলে যাওয়া উচিত হবে না। আর শারফানের এমন করে চলে যাওয়াটা নিয়ে মোস্তফা সাহেবের স্ত্রী নিশ্চিত আরও সন্দেহ করবেন। সেটাও এখন তাই তাকেই সামাল দিয়ে তারপর যেতে হবে৷ তাছাড়া মেহাও অনেক কিছুই শুনে ফেলেছে। তাকেও তো দুয়েকটা জবাব না দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
***
দোকানে দড়ির সঙ্গে ঝোলানো গ্যাস লাইটটা থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে এসে বসল শারফান গাড়ির হুডের ওপর।
তার থেকে তখন হাত দশেক দূরত্বেই রিহান। মেহাকে সেই সময় নিজের মতো করে বোঝানোর মাঝেই এসে পড়েন মোস্তফা সাহেব৷ না চাইতেও নাশতার টেবিলে তাই বসতে হয় তাকে। শারফানের আকস্মিক বিদায় নিয়েও মনগড়া এক যুক্তি খাঁড়া করাতে হয় সবার কাছে।
হেঁটে আসতে আসতে রাস্তার বিপরীত পাশে চোখ গেল তার৷ শারফানকে দেখা মাত্রই রাগে হুঁশ হারিয়ে গালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল‚ “এই হারামির বাচ্চাআআআ!” বলেই পাগলের মতো আশেপাশে লাঠি জাতীয় কিছু খুঁজতে আরম্ভ করল। সেরকম কিছু পেলো না। তাই হাত দিয়েই মারবে বলে সোয়েটারের হাতা গুটাতে গুটাতে ছুটল সে শারফানের কাছে। মস্ত এক ঘুষি ওর গায়ের মধ্যে দিতে গিয়েই মনে পড়ে গেল‚ ইতোমধ্যে পঞ্চাশের সমান আঘাত মজুদই আছে ওর শরীরে। বহু কষ্টে তাই হাতটা নিয়ন্ত্রণে নিলো সে৷ আর এজন্য শারফানও চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে অনড়ই ছিল।
“গিধড়ের বাচ্চা‚ গুয়ার মধ্যে কি কৃমি ঠেলা দিয়েছিল যে দৌড় মারলি? কত বড়ো কৃমি ঝুলছে দেখা… দেখা তোর পাছা আমাকে”‚ চেঁচামেচি করে সত্যি সত্যিই শারফানের পেছন দেখার জন্য ওকে ঠেলাঠেলি শুরু করল রিহান।
মেজাজ খারাপ থাকা শারফান বিরক্তে অস্থির হয়ে মারল এক ধাক্কা তাকে৷ “বাড়ি যা”‚ ধমক লাগিয়ে বলল‚ “গাড়ি টারি নিয়ে চলে যা।”
“এই‚ তুই কাকে চোটপাট দেখাস!” তেড়ে এসে কনুইয়ের এক গুঁতো মারল রিহান ওর পিঠের মধ্যে৷
রাগের চোটে এবার পায়ের স্লিপার খুলতে উদ্যত হলো শারফান। ইজ্জতের দফারফা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল দেখে রিহান জলদি এসে ওকে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইতে চাইতে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল।
“সর!” ভারী ওজনের ধমক লাগিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো শারফান। আর কিছু বলল না তারপর। আগের মতোই এসে হুডের ওপর বসে পড়ে সিগারেট শেষ করায় ব্যস্ত হলো।
রিহানও এসে ওর পাশেই বসল। ওর চেহারাটা ভালো করে দেখে সে জিজ্ঞেস করল‚ “হতাশ লাগছে কেন তোকে? সানাকে ওর জায়গার ওপর গেঁড়ে রেখে আসতে পারলি না বলে হতাশ লাগছে?”
খেপাটে দৃষ্টিতে তাকাল শারফান। “বুঝেশুনে কথা না বলতে পারলে সরে যা আমার হাতের কাছ থেকে”‚ শক্ত গলায় বলল রিহানকে হুমকি দেওয়ার মতো।
“তাহলে তুই-ই বল‚ এমন ব্রোকেন হার্টেড লাভারের মতো চেহারা করে আছিস কেন?”
শারফান ভাবান্তরহীন। বেশি খানিক্ষণ চুপ থাকার পর নিজের প্রতি বিতৃষ্ণ জাহির করল‚ “আমি আজ-কাল মানুষ চিনতে এত ভুল করছি কীভাবে? তাও আবার মেয়ে মানুষ!”
বলার পর পকেট থেকে ফোনটা বের করল হঠাৎ৷ ছবির সকল সংগ্রহে ঢুকে স্ক্রলিং করতে করতে স্থির করল সানার একটা অপ্রস্তুত ছবি। হাতে শরবতের গ্লাস ধরা ওর। সেদিকে খেয়াল রেখে হেঁটে আসছিল। ওই সময়ই চুরি করে তুলেছিল সে ছবিটা। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর ফোন হাতে পেয়ে সে আবিষ্কার করেছিল সানার এই ছবিগুলো এখনো ওর আমানতে থেকে গেছে।
রিহানের সামনে ছবিটা মেলে ধরে বলল‚ “এই চেহারার মেয়েটা রাগের বশে আমাকে খতম করতে বলেছিল ফারনাজকে। আই অ্যাম টোটালি শকড। কারণ‚ আমার ধারণা ছিল ওর সঙ্গে যেটা করেছি তার জন্য ও কিছুদিন ডিপ্রেসড থাকবে। নয়তো নিজের মা-বাবা‚ বোন‚ সর্বোচ্চ তাদের কাউকেই জানাবে। আর যদি কোনোদিন সুযোগ পায় তো বড়োজোর আমার গালে থাপ্পড় দেওয়ার একটা চেষ্টা করবে। কিন্তু এই সরল‚ সুন্দর মুখটার মানুষ আমার ধারণা অনুযায়ী ইমোশনাল নয়। সে কিনা ফারনাজের মতোই খতরনাক মানসিকতা রাখে। আর আমি তা এই দুটো মাসে একটুও ফিল করিনি! কেন চিনতে পারলাম না ওকে?”
“সত্যি বলতে তুই তো দুটো মাসের অবজারভেশনে ওকে প্রচণ্ড ইনোসেন্ট‚ ইমোশনাল ভেবেছিস৷ আর আমি মাত্র একদিনের দেখাতেই তা ভেবেছিলাম। এর মানে কি ও‚ ওর ফ্যামিলি ফারনাজের এমন মার্ডারাস পরিচয়ের সঙ্গে পরিচিত? নয়তো কেন ফারনাজের কাছেই বলবে তোর অপরাধের কথা?” ভাবুক গলায় বলল রিহান‚ “না-কি আমরাই একটু বেশি বেশি ভাবছি? কিন্তু ও তো অস্বীকারও করল না তোর কথাগুলোকে।”
আকাশ অভিমুখে ধোঁয়া ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শারফান। “না বলত… স্রেফ একবার”‚ উদাসভাবে মৃদু কণ্ঠে বলল সে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল রিহানের। শারফানের অভিব্যক্তিতে আর সানার সত্যটা জেনেও।
“লিভ ইট!” আধ ফুরোনো সিগারেটটা শারফান আচমকা মাটিতে পিষে দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল নিজের নিস্পৃহতাকেও। বলল স্বভাবজাত বলিষ্ঠ গলায়‚ “ও একদম ধুয়ে-মুছে যাক আমার মাথা থেকে।” তারপরই সানার সমস্ত ছবি‚ ভিডিয়ো ডিলিট করল‚ “ভুলক্রমেও ওর কোনো স্মৃতি না থাকুক আমার মেমোরিতে। সেটাই ভালো ওর জন্য।”
“তুই বলছিস তুই ওকে ছেড়ে দিলি?”
“দিলাম”‚ বলে ফোনটা পকেটে পুরে গাড়িতে উঠে পড়ল সে।
রিহান বিস্ময়টুকু হজম করে এসে বসল ওর পাশে৷ গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে সে বলল‚ “এসবের মাঝেও আমার আসলে ভালো লাগছে যে‚ তুই নিজের ভুলটা বুঝে মাফ চেয়েছিস ওর কাছে। আর এই প্রথম তোর ক্ষতি করতে চাওয়া কোনো ব্যক্তিকে পালটা ক্ষতির চিন্তা করিসনি। মাফ চেয়ে তুইও গুড ফিল করছিস‚ তাই না?”
“গুড‚ ব্যাড‚ কোনোটাই ফিল করছি না।”
“ধুর ব্যাটা! কিছুই ফিল না করলে মাফ চাওয়ার সুবুদ্ধি আসলো কেন তোর? আসার পথে বললিও তো না কিছু এই ব্যাপারে।”
“কারণ‚ ওর স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য এসেছিলাম আমি।”
“অ্যাহ্”‚ বোকা চোখে তাকাল রিহান‚ “তো কখন নিলি স্টেটমেন্ট?”
কথা বলতে একেবারেই ভালো লাগছে না শারফানের৷ তাই নিরুত্তর রইল সে। এদিকে না চাইতেও মনের ভেতর ঘুরতে থাকল সানার বিক্ষিপ্ত আর বিষণ্ণ মুখটা।
সানার মুখোমুখি হয়ে সে কী বলবে বা কী করবে তা না ভেবেই ছুটে এসেছিল। যখন ওর ঘরে প্রবেশ করল তখন সে ঠিক করল‚ কিছু জবাব চাইবে সে ওর কাছে। ক্ষমা চাওয়া বা অপরাধবোধ হওয়া‚ এ সে ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি করেনি যতক্ষণ না সানা এসে দাঁড়াল তার সামনে। কাছ থেকে ওকে দেখার পর‚ ওর চোখে চাইবার পর হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেল তার বুকের গহিনে৷ সে মুহূর্তে সানাকে দেখে তার বিশ্বাস হলো না দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা জ্বরে পড়েই মেয়েটার হাল অমন বেহাল হয়েছে৷ সপ্তাখানিক আগের চঞ্চলতা‚ উজ্জ্বলতাপূর্ণ মুখটাই হঠাৎ স্ফূর্তি-শূন্যতা খুঁজে পেলো সে‚ বসে যাওয়া চোখের তারায় স্পষ্ট দেখতে পেলো অন্তর্বেদনা। আর তারপরই মনে হলো এর জন্য একমাত্র দায়ী সে-ই। যে অপরাধবোধ সেদিন দুপুরে বদ্ধ ক্লাসরুমে হয়নি ওকে কাঁদতে দেখেও। তা সে অনুভব করল আজ রুগ্ন‚ বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন ওকে দেখে৷ তখনই অন্যায়ের স্বীকারোক্তিও দিয়ে বসল কোনো দ্বিধা‚ কোনো বিলম্ব ছাড়াই৷ এবং তার অহংবাদী সত্ত্বাটাও ওই মুহূর্তে একবারও কোনো বাধা দিলো না তাকে।
অথচ অতীতে শেষবার কবে নিজের অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে বুঝেছে আর কার কাছেই বা ক্ষমা প্রার্থনা করেছে? মনে পড়ল না শারফানের। কারণ‚ এমন কিছু আজ অবধি কখনো হয়নি বলেই তার স্মৃতি ভাণ্ডারেও তা নেই।
“ওই‚ কথা বলিস না কেন?”
“মুড খারাপ আছে‚ রিহান”‚ সতর্কতা দিলো শারফান শীতল সুরে‚ “বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত চুপ থাক।”
বক্রোক্তি করতে গিয়েও হঠাৎ কিছু ভেবে সত্যিই চুপ করে গেল রিহান। হতাশ হয়ে শুধু দেখল একবার শারফানকে।
“কোনো মানুষই সব দিক থেকে জ্ঞানসম্পন্ন হয় না আসলে”‚ শারফানকে নিয়েই মনে মনে ভাবল সে‚ “এত অল্প বয়সে যে ছেলে ব্যাবসায়িক জ্ঞান‚ বিদ্যা অর্জন করেছে‚ কত কত রাঘব-বোয়ালদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে চলছে‚ হাই ক্লাসে বিলং করা‚ পশ লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা সুন্দরীদের আঙুলের ডগায় নাচাচ্ছে‚ সে কিনা প্রেমের জ্ঞানে নবডঙ্কা!”
অবাক হলেও তারপরই আবার ভাবল রিহান ‚ “সময়ই তো দেয়নি কখনো প্রেম‚ বিয়ে নিয়ে ভাবার জন্য। প্রয়োজন ছাড়া‚ স্বার্থ ছাড়া কখনো মিশেছে ব্যাটা কোনো মেয়ের সঙ্গে? এই প্রথমবার এমন হলো যেখানে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া জাস্ট ফ্লার্ট করে গেছে ও৷ আর তা করতে করতেই আবুলটা যে ফেঁসে গেছে—তা যেদিন টের পাবে ও‚ সেদিন সানা মেয়েটার সত্যিকারের নাজেহাল হওয়ার দিন শুরু হবে। কিন্তু সেই দিন আসবে কবে? আসার আগেই তো সবটা জটিল থেকেও জটিল হয়ে যাচ্ছে। এই হকের পোলার প্রেম-পিরিতের ভাগ্য রেখাটা মনে হয় জটিলই।”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৬.
গাড়িটা বাসার নিচে থামলে রিহান বের হলো আগে। আগামীকাল ঢাকা চলে যাবে সে। বাড়ি ফিরেই তার জন্য মেয়ে দেখতে যাবে মা‚ এ কথা মনে করাতে থাকল শারফানকে। যেন তার আগেই শারফান সুস্থ হয়ে ওঠে৷
কিন্তু শারফান হঠাৎ মন্তব্য করে বসল‚ “সৈয়দ বাড়ির জামাই হ। ইব্রাহীম ভাই হচ্ছে সানার মেজো চাচার জামাই। তুই মেহাকে বিয়ে করে হ সৈয়দ মোস্তফার জামাই। আর তোদের লেজ ধরে আমি হতে যাব সৈয়দ কবিরের জামাই। তাহলে ফারনাজকে বানর নাচ নাচাতে আমার সুবিধা হবে প্রচুর।”
“বুদ্ধি খারাপ না। কিন্তু…” চিন্তার নাটক করল রিহান‚ “সানাকে টপকে মেহাকে কেন বিয়ে করতে হবে? সানাই তো পারফেক্ট৷ মাকে দেখালে মা কালকেই যেয়ে সানার বাপের কাছে…” কথা সম্পূর্ণ করা হলো না তার। কথার মাঝেই আচমকা চিৎকার করে “ও আব্বা রেএএএ” বলে উঠেই লাফ দিয়ে সে গাড়ির ছাদের ওপর উঠে পড়ল।
শারফানের চোখদুটো বিস্ফারিত। গাড়ির সামনেই দাঁড়ানো ও৷ রিহান ভয়ার্ত চেহারায় চিৎকার করতে করতে ওকে বলল‚ “ছাগলের বাচ্চা ছাগল‚ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওপরে উঠে আয়।”
না‚ গাড়ির ছাদে আর ওঠার সুযোগ হলো না শারফানের৷ বাড়ির আঙিনার বাঁ দিক থেকে ছাব্বিশ ইঞ্চি লম্বার বিশাল দেহি কালো অ্যালসেশিয়ান উলফ ডগ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। সেটাকে আঁকড়ে ধরেই গাড়ির হুডের ওপর এসে পড়ল সে।
তখন গগনবিদারী চিৎকার কাকে বলে তা রিহান করে দেখাল। “ও মামারেএএএ… ও আব্বাআআ… ওরে কেউ বাঁচাও শায়াফকে” বলতে বলতে নিজেই নেমে এলো শারফানকে কুকুরটা থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওদের কাছে আসা মাত্রই শারফান হঠাৎ কুকরটাকে জড়িয়ে আবেগী হয়ে উঠল আর কুকুরটাও ওর গালে আর জামার ওপর প্রশ্রয়ের থাবা বসালো কবার‚ আলতো আলতো আঁচড়ও দিলো‚ তার মাঝে আবার জিভ দিয়েও চাটল ওর হাত।
এদিকে রিহানের চেঁচামেচিতে বাসার ভেতর থেকেও সবাই ছুটে এলো ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে করতে। তখন শারফানকে কুকুরটার সাথে দেখে নতুন একটি পুরুষ সদস্য এগিয়ে এলো ওদের কাছে‚ “তুলতে পারলি ওকে?”
মৃদুহাস্য মুখটা তুলে একবার তাকাল শারফান। তারপর আবার কুকুরটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল‚ “কত হয়েছে জাঙ্গ? এত দ্রুত বড়ো হয়ে গেল!”
“এইটটি এইট পাউন্ড। বড়ো হয়ে গেছে আর ওর প্রভু বদলানোর সময়ও হয়ে গেছে।”
“আর তুই ওরকম গলা ফাটালি কেন?” বারান্দা থেকে হঠাৎ রিহানের বাবা সেলিম জিজ্ঞেস করলেন রিহানকে।
এতক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে সামলে উঠেছে রিহান। আঙুলের ইশারায় কুকুরটাকে দেখাল‚ “ওটা যেভাবে দৌড়ে আসছিল তা দেখেই আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে ভেবেছিলাম৷ জানে কে‚ এই জাইঙ্গা ওর মতো আরেক জাইঙ্গাকে দেখে খুশির চোটে দৌড় মেরেছে?”
হেসে ফেলল সবাই। কেউ কেউ শব্দ করে হেসে উঠল। জারার খিলখিল করা হাসির শব্দটাই বেশি কানে বাজল। শারফানের মেজাজ ভালো হয়ে গেছে জাঙ্গকে পেয়ে৷ তাই আপাতত গায়ে নিলো না সে রিহানের উপহাসকে। “কখন আসলি তুই?” জিজ্ঞেস করল নতুন মানুষটিকে‚ “তোর ছুটি হলোই বা কবে?”
“ইয়াজ আসছে আধ ঘণ্টা হলো”‚ বললেন শাফিউল‚ “কিন্তু তোরা দুইটা বের হয়েছিলি কোথায়?”
“প্রফেসরের বাসায়”‚ অকপটেই স্বীকারোক্তি দিয়ে শারফান উঠে দাঁড়াল জাঙ্গকে নিয়ে। ইয়াজ ছেলেটার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করতে গেলে জেসমিন বেগম ডাকলেন আগে নাশতা করার জন্য।
শারফান আর রিহানের জন্যই অপেক্ষা করছিল সবাই৷ মিথি‚ জারাসহ বাড়ির সকল পুরুষকে আগেভাগে খায়িয়ে দেওয়া হলো। খাওয়া শেষ করে রিহান ঘরে যাওয়ার আর সুযোগ পেলো না৷ শাফিউল সাহেবের গুরুগম্ভীর আদেশ পেয়ে তার ঘরে যেতে হলো তাকে। আর শারফান বেরিয়ে এলো ইয়াজ আর জাঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পেছনটাই। নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য বাড়ির কর্টইয়ার্ডের পরিবর্তে সে ব্যাকইয়ার্ডকেই বেছে নিয়েছে। তাই এখানেই বসার ব্যবস্থা করা।
ধুপছায়া আচ্ছন্ন প্রকৃতি। ছায়াবত নানান গাছের ফাঁকফোকর থেকে রোদ উঁকিঝুঁকি দেয়৷ আর সকাল‚ বিকাল এখানে নিয়ম করে মেলা বসায় কখনো চড়ুই‚ কখনো শালিক। দোয়েলকেও দেখা যায় তাদের সাথে। এখন হাট বসেছে চড়ুই‚ শালিক‚ দুই দলেরই।
চেয়ারে গা এলিয়ে চারপাশটা দেখে আরাম লাগল ইয়াজের। “পায়রা পালবি?” শারফানকে প্রস্তাব দিলো‚ “কয়েকটা স্কুইকার এনে দিই। এখানে ভালো পরিবেশ আছে ওদের জন্য।”
নিচে শালিকের বিচরণ দেখে জাঙ্গ অস্থির হয়ে উঠল শিকারের জন্য। তাই শারফান ছেড়ে দিলো তাকে। “পায়রা টায়রা পোষার শখ নাই‚ সময়ও নাই আমার”‚ জানাল সে ইয়াজকে‚ “জারার শখ আছে অবশ্য।”
কথাটা শুনতে শুনতেই চোখ পড়ল ইয়াজের ছাদে। পিছু ফিরে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জারা। তার সামনে দাঁড়ানো বোধ হয় মিথিও৷ গল্প করছে দুজন। কথার ফাঁকে ফাঁকে আবার দৃষ্টিও ফেলছে ওরা নিচে৷ ঠিক সে সময়ই ইয়াজের চোখে চোখ পড়ে গেল জারার। ধরা পড়ে প্রথমে বিব্রত হয়ে নজর লুকাল সে। কিন্তু একটু পরই আবার আড়দৃষ্টিতে তাকাল। তা দেখতে পেয়ে চোখে হাসল ইয়াজ। “জারা? তোর বোন?” ছাদের দিকে চেয়েই জিজ্ঞেস করল‚ “কোন ভার্সিটিতে পড়ছে ও?”
“ভার্সিটি?” হাসল একটু শারফান‚ “গায়ে-পায়ে দ্রুত বেড়েছে। হেলদিও একটু বেশি৷ তাই বড়ো মনে হয় কিডোটাকে। এইচএসসি ক্যানডিডেট।”
“এইচএসসি!” অবাক হয়েই হেসে ফেলল ইয়াজও।
“হুঁ‚ তাই নজর হটা”‚ শারফান বলে উঠল কপট গাম্ভীর্যের সাথে।
শুনে ইয়াজও কপট ভীত চেহারা করল‚ “আরেযযাহ্! বড়ো ভাইয়ের কাছে কট খেয়ে গেলাম?” বলেই হাসল আরেক চোট। “ভাইদের পেছনেও চোখ নিয়ে ঘুরতে হয় না-কি? তোর কিডো ছাদে বুঝলি কখন?”
“তুই গভীরভাবে তাকালি যখন।”
“অ্যাডমিরেবল”‚ হেসে ঠোঁট বাঁকাল ইয়াজ। “ঠিক আছে‚ হটালাম নজর। তবে ইয়াজের যদি ভুলবশত কখনো ইয়াদ টিয়াদ হয় তাহলে কিন্তু কোনো বড়ো ভাই টাই তোয়াক্কা করবে না।”
“আসিস… চ্যালাকাঠ দিয়ে ভাঙব তোর কোমরের হাড্ডি”‚ ঠাট্টা করে বলল শারফান‚ “হাই প্রোফাইল না লো প্রোফাইলের জব ক্যারি করিস‚ না-কি জবলেস‚ তাই জানা নেই। আবার লাইন মারতে চাস আমার বোনকে!”
“লাগাম ধরিস কিন্তু”‚ হুঁশিয়ার করল ইয়াজ‚ “এমনিতেই ভেঙেচুরে আছিস। আমি শট মারলে সব খুলে গড়াগড়ি খাবে মাটিতে।”
“তা তুই কি ভাবছিস আমার হাড্ডি দুর্বল? আর আমি পাড়া-মহল্লায় দু-চারটা পোলাপান মেরে শুধু হাত চালানো শিখেছি?”
“না‚ তা না। হাড্ডি দুর্বল হলে ছয়দিনেই দাঁড়িয়ে যেতে পারতি না৷ ঘুসোঘুসিতেও তোর বীরত্ব আছে জানি৷ কিন্তু জয়েন্টে জয়েন্টে খেলা করার নিয়ম তুই পারফেক্টলি জানিস না৷ ওটাতেই তুই শুয়ে পড়বি আমার কাছে।”
মাথা দুলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল শারফান‚ “এবারের ছুটিতে তাহলে কাজে লাগাতে হবে তোকে।”
“চল চট্টগ্রাম। সাত দিনেই প্যাঁচ শিখে যাবি।”
“তুই থাকবি এখানে। অসুস্থ মানুষকে টেনে নিয়ে যেতে চাস কেন?”
বাঁকা হাসল ইয়াজ‚ “আমি থাকলে বোন পাহারা দিতে গিয়ে তোর ঘুম হারাম হবে।”
“নাকটা সুন্দর তোর। ওটাকে বোঁচা বানাতে চাস না”‚ বিদ্রুপ করল শারফান‚ “যেদিন আইডেনটিটি ক্লিয়ার করবি সেদিন হিম্মত দেখাবি আমার বাড়ি এসে।”
“আমি হাইড করেছি আমার আইডেনটিটি? তোর সাথে আমার পরিচয় কত বছরের? তিন। তিন বছরে যে কবার মিট করেছিস একবারও জিজ্ঞেস করেছিস আমার প্রফেশন?”
“তুই বলেছিস? তুই সব বললেও ওটাই হাইড করেছিস। তাহলে আমি জিজ্ঞেস করব কেন?”
“আবারও হাইডের কথা বলছিস? তাহলে তুই বুঝলি কী করে আমি এমন কোনো স্পেশাল অরগানাইজেশানের সঙ্গে যুক্ত‚ যেটা সরকার আর দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত?”
“হুঁ‚ বুঝেছি তোর কিছু কিছু কথায় সেটা৷ কিন্তু সেটার নাম তুই স্ট্রেইটঅ্যাওয়ে বলেছিস? বলিসনি।”
“কিছু কিছু কথায় বুঝেছিস মানে আমি বোঝাতে চেয়েছি তাই বুঝেছিস৷ স্ট্রেইটঅ্যাওয়ে বলিনি কারণ আমি চেয়েছি তোর কিউরিওসিটি হোক আর কিউরিওসিটি থেকে তুই জিজ্ঞেস কর আমাকে।”
“হুহ্”‚ কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল শারফান। “তুমি রিজার্ভ দেখাবা নিজেকে আর আমি ছ্যাঁচড়ার মতো জিজ্ঞেস করতে যাব‚ তাই না?”
“না‚ জিজ্ঞেস করবি কেন? তোর শরীরের প্রতিটি গহ্বরে হলো ইগো ঠাসা। তা কি আমি জানি না?”
“আর তোর গহ্বরগুলো থেকে যেন রস ঝরে‚ না-কি?”
ইয়াজ উত্তর দিতে গেলে শারফান ওকে বাধা দিলো‚ “ইগোর খেলা আমার সঙ্গে খেলতে আসবি না। এমন দিন আসবে যেদিন তুই নিজে থেকেই জানাবি আমাকে।”
“সেদিন দেখা গেল তোরই কোনো প্রয়োজনে আমি মুখ খুলব”‚ মুচকি হেসে বলল ইয়াজ।
বছর তিন আগে ওদের দুজনের আলাপ হয়েছিল নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট থেকে। শারফান গিয়েছিল ব্যাবসায়িক সফরে আর ইয়াজ গিয়েছিল ভাইয়ের কাছে ছুটি কাটাতে৷ আলাপের পর দুজনের ব্যক্তিত্ববোধ আর রুচিতে কিছু সাদৃশ্য থাকায় দুজনেরই দুজনকে পছন্দ হয়েছিল বেশ। তামাটে বর্ণের সুগঠিত‚ দৃঢ়কায় ইয়াজ যেমন সৌম্যদর্শন। চলাফেরা আর কথাবার্তায় তেমন বুদ্ধিদীপ্ত সে। তাকে ভালো লেগেছিল বিধায় অবসরে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করতে সম্মত হয় শারফান। সেদিন আশ্চর্যভাবে ওরা দুজনের আরও একটি মিল পায়।
জার্মান শেফার্ড অ্যাডপ্ট করার শখ শারফানের বহুদিনেরই ছিল৷ তেমন ইয়াজেরও ইচ্ছা ছিল প্রভুভক্ত একটা কুকুরকে নিজের মন মতো প্রশিক্ষণ দেবে৷ তাই এক সঙ্গেই দুজন কুকুর অ্যাডপ্ট করতে গিয়ে ছয় মাসের জাঙ্গকে পছন্দ করে ফেলে একত্রে৷ যদিও ইয়াজ শারফানকেই দিয়েছিল জার্মান শেফার্ড ছানাটা। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করা শারফান চিন্তাভাবনা করে মাস তিনেক জাঙ্গকে নিজের কাছে রেখে হঠাৎ একদিন ইয়াজের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ইয়াজও নির্দ্বিধাতেই অভিভাবক হয়ে যায় জাঙ্গের। মূলত জাঙ্গের মাধ্যমেই দুজনের মাঝে গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয় দ্রুত। বছর দুইয়ের বড়ো ইয়াজকে শুরুতে শারফান ‘তুমি’ সম্বোধন করলেও ধীরে ধীরে তুইতে নেমে আসে। কারণ‚ ততদিনে সম্পর্কটা কাছের বন্ধুতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল৷ এখন জাঙ্গ পূর্ণবয়স্ক। এতগুলো সময় ইয়াজের কাছেই থেকেছে আর তার দেওয়া প্রশিক্ষণ পুরোপুরি রপ্ত করে নিয়েছে৷ শারফানের সঙ্গে জাঙ্গের শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় আট মাস পূর্বে৷ ইয়াজের সঙ্গে তার সর্বাধিক সময় কাটলেও শারফানকেও সে ভোলে না কখনো৷ বরং দুজনের প্রতিই তার অগাধ স্নেহ আর ভালোবাসা।
“কী বলছিলি তখন?” জিজ্ঞেস করল শারফান‚ “জাঙ্গের প্রভু বদলের সময় হয়ে গিয়েছে মানে কী?”
“এবার লং টাইমের জন্য যেতে হবে আমাকে ট্রেনিঙে”‚ পাখির পেছনে ছুটে বেড়ানো জাঙ্গকে দেখতে দেখতে বলল ইয়াজ‚ “এতদিন আমার অনুপস্থিতিতে ওকে ট্রেইনারের দায়িত্বে রেখে যেতাম যাতে ওর ট্রেনিংটা শেষ হয়। এখন ও পুরোপুরি কোয়ালিফাইড। আর হঠাৎ তোর ঘটনাও জানলাম৷ তাই ডিসিশন নিলাম পরের কাছে আর কেন থাকবে? এবার নিজের মালিকের কাছে থাকুক। তোর খেয়ালও রাখুক। আমি ফিরে আসি। তারপর দেখা যাবে পরেরটা।”
“ছুটি কতদিন তোর?”
“ছুটি নেই। এমারজেন্সি বলে দেখতে এসেছি তোকে আর জাঙ্গকে রেখে যেতে। এখন বল‚ কন্ডিশন কী শরীরের?”
“দেখে বুঝছিস না?”
“কিছুদিন ডক্টরের অবজারভেশনে থাকা উচিত ছিল তোর। মাথার চোটটা অবহেলা করছিস তুই। বেড রেস্টও করছিস না। শরীরের ওপর জোর দিয়ে এরকম ছোটাছুটি করার মানে কী?”
“আমার ঘুম ছাড়া হুদাই শুয়ে-বসে থাকা সম্ভব না৷ ভালো লাগে না।”
“হুদাই? শরীরকে ফিট করার জন্য পর্যাপ্ত বেড রেস্ট করা হুদাই? তোর মতো অস্থির‚ চঞ্চল স্বভাবের মানুষকে ঘরে ধরে রাখার জন্য দরকার হলো সুন্দরী একটা বউ। তোর বাপকে বলে যাই‚ কী বলিস?”
“যাস বলে‚ তোর বোনের কথা”‚ ফিচেল হেসে বলল শারফান।
হাসল ইয়াজও‚ “তোর ব্যাড লাক। আমার বোনের ফার্স্ট অ্যানিভার্সারি চলে গেল গত ডিসম্বরে।”
“আহ্হা”‚ নকল আফসোসের সুর তুলল সে।
“এবার ঘটনা বল তো খোলাখুলি”‚ পিঠ টান টান করে বসে গম্ভীর হলো ইয়াজ‚ “ফোনে ওসব কথা শুনে আরাম নেই তাই শুনিনি।”
পা দুটো সামনে সটান করে দিয়ে চেয়ারে হেলে বসল শারফান। তারপর বিস্তারিত জানাতে শুরু করল ফারনাজের বিষয়টা। তবে মাঝ থেকে সানার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা কিছু কিছু বাদ দিলো‚ যা অপ্রয়োজনী মনে হলো ওর। সব কিছু শোনা শেষে ইয়াজ জিজ্ঞেস করল‚ “ফারনাজকে সরাসরি ইঙ্গিত করে এমন ছোটোখাটো কোনো ক্লুই পাসনি?”
“না”‚ চিন্তামগ্ন চেহারা শারফানের‚ “ও প্রচণ্ড নিখুঁতভাবে কাজটা করেছে৷ পুলিশের ইনভেস্টিগেশনের রেজাল্ট অনুযায়ী ভোরবেলা কেউ গ্যারাজের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে ওই লিকেজটা করে রাখে। আর গ্যারেজের মালিক বা কোনো কর্মীর দ্বারা এটা হয়নি সেটা আমার বিশ্বাস। কারণ‚ দ্যাখ ওরা যদি কেউ করে থাকত তাহলে করার পরই ফরিদপুর ছেড়ে কোথাও গা ঢাকা দেবে। পুলিশ যে ওদের সন্দেহজনক ভেবে তুলে নিয়ে যাবে এই কমনসেন্স তো নিশ্চয়ই থাকবে ওদের৷ তো কাজটা যে করেছে তাকে তালা খোলার জন্য ডুপ্লিকেট চাবির প্রয়োজন পড়েনি৷ সে চুরির পেশায় কোনো ইনটেলিজেন্ট চোর৷ এর চেয়েও কঠিন লক সে খুলে ফেলতে পারে আবার গাড়ির ব্যাপারেও এক্সপার্ট। যাকে ফারনাজ ভাড়া করে এনেছে ফরিদপুরের বাইরে থেকে।”
“তাহলে সে কোনো চোর না হয়ে পেশাদার খুনিও হতে পারে।”
“হ্যাঁ‚ সেটাও হতেই পারে।”
“কিন্তু ভোরবেলা যখন গ্যারেজে ঢুকল সে তখন রাস্তাঘাটের কেউ-ই কি দেখল না?”
“তাই তো বলছে আশেপাশের মানুষ। হতে পারে ফজরেরও কিছু সময় আগে। অথবা ঠিক যখন ফজরের নামাজ পড়ে মানুষ সে সময় তো মসজিদে থাকবে তারা। ওই সময়টাতেই কাজটা করেছে।”
“ফারনাজকে ইন্টারোগেট করা দরকার। কিন্তু ওর মতো সিয়ানাকে ইন্টারোগেট করার জন্য লাগবে জুডিশাস‚ রাফ অ্যান্ড টাফ ইনভেস্টিগেটরকে। তুই চাস তো আমি কথা বলি এমন একজনের সঙ্গে।”
“চাইলে তো তুই বলার আগে আমিই বলতাম তোকে।”
ভ্রুকুটি করে তাকাল ইয়াজ‚ “তাহলে তুই কী করতে চাচ্ছিস?”
“ভাবছি। ভাবা শেষ হলে জানাব”‚ বলে মুচকি হাসল শারফান।
আর এ হাসিটাই কোনো ভালো ইঙ্গিত নেই তা চট করেই ধরে ফেলল ইয়াজ। “শোন”‚ গাম্ভীর্যের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল সে‚ “যতটুকু বুঝেছি তোকে তাতে আমি জানি তুই কখনো কোর্টের বারান্দায় যেতে পছন্দ করিস না। তুইও রাফ অ্যান্ড টাফ চরিত্রের মানুষ। অনেকটা ক্রুয়েলও তুই। কিন্তু খুনখারাবি করার মতো চিন্তাভাবনা তোর মাঝে নেই। অন্তত আজকের আগে আমাদের শেষ দেখার দিন অবধি এটাই বুঝেছি তোকে। এখন তুই পরিস্থিতির কারণে যদি তোর রিভেঞ্জ নেচার থেকে আইনকে অবমাননা করতে চাস আমি সেটাতে খুশি হতে পারব না‚ শায়াফ।”
“খুন! ডাজ এভরিওয়ান গেট স্যাটিসফেকশন ফ্রম কিলিং? তোর ভাবনায় কী বলে?”
প্রশ্ন রাখলেও ইয়াজের জবাব আসলে চাইলো না শারফান। তাই বলল আবার নিজেই‚ “আমি এখন অবধি জীবনে বহু অপরাধ করেছি৷ এজন্য একটা সময় পর্যন্ত আব্বুর কাছে প্রতিনিয়ত কঠিন মার খেয়েছি‚ মার ছাড়াও নানারকম পানিশমেন্টও পেয়েছি। তখন কিছুটা সংযত আর সাবধান হতে বাধ্য হয়েছি তাই। কিন্তু এখন মারধর খাই না প্রথমত‚ বড়ো হয়ে গেছি বলে৷ দ্বিতীয়ত‚ আমার কর্মকাণ্ডের ধরন বদলেছে৷ কথাটা অপরাধ বললাম না। কেননা আমি বিশ্বাস করি যার সঙ্গে যেটা করেছি সে সেটা ডিজার্ভ করে এবং তার কর্মেরই ফল সেটা। ফারনাজও ওর কর্মের ফল পাবে… এবং অবশ্যই কেবল আমার থেকেই পাবে৷ তবে খুন করে ওকে আমার থেকে মুক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে দেবো না। হ্যাঁ‚ বলতে পারিস বেঁচে আর যাবে কী়ভাবে? আবার ফাঁসির ব্যবস্থার কথাও বলতে পারিস। তারপর পরকালের শাস্তি আছে সেটাও বলতে পারিস। ভাই‚ আমার অত ধৈর্য নেই। কবে আমি মরব আর কবে ওকে শাস্তি দিতে দেখব আল্লাহকে! আমার নিজস্ব যে ধ্যানধারণা তা হলো‚ খুন করলে তো মরেই গেল। কিন্তু জীবিত থেকে সারাটা জিন্দেগি পিপাসিত কুত্তার মতো আধ হাত জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতেই কেটে যাবে ওর৷ এমন পরিণতি করে তা দেখার মতো শান্তি খুন করে আছে?”
“এটাও ক্রিমিনালি চিন্তাভাবনা।”
“তো তুই কি আমাকে ভালো মানুষ ভেবেছিলি? কবে ভেবেছিলি?” বলেই হা হা করে হাসল শারফান।
“তুই ভালো অবশ্যই৷ আর সেই ভালোটা কেমন ভালো তা ওজন করেই আমি মিশেছি তোর সাথে। তোর মধ্যে আনকমপ্রোমাইজিং ক্রিমিনালি নেচার দেখলে আজকে তোর সাথে তুইতোকারির বন্ধুত্ব হতো না।”
“তুইতোকারির শত্রু হয়ে যেতি?” কপট বিস্মিত হয়ে বলল শারফান।
তা দেখে মৃদু হাসল ইয়াজ। হাসল শারফানও। কথাবার্তা আরও কিছুক্ষণ চলল ওদের৷ ব্যাবসা‚ অর্থনীতি‚ দুর্নীতি‚ রাজনীতি‚ বিশ্ব রাজনীতি‚ অনেক প্রসঙ্গে।
তারপর হঠাৎ প্রস্তাব দিলো ইয়াজ‚ “চল‚ কয়েকটা প্যাঁচ শিখিয়ে দিই। প্র্যাকটিস রাখবি কদিন। আয়ত্তে চলে আসবে। চল‚ ওঠ।”
মানা করল না শারফান।
দুজনের মাঝে অদ্ভুত কৌশলের হাতাহাতি‚ লড়াই দেখে ছাদে দাঁড়ানো জারা আর মিথি প্রথমে অবাক হলেও পরে হাসতে হাসতে উপভোগ করল দুই বন্ধুর হাত-পা চালানোর কৌশলগুলোগুলোকে।
***
১৫ জানুয়ারি
দুপুর ১: ২০ মিনিট
অনার্স শাখার পথটা ছায়াবীথির পথ৷ ফারনাজের গাড়ি চলছে এখন এ রাস্তা ধরেই। দিনার থেকে লোকেশন জেনে নিয়েছে। কিন্তু তাও খুঁজে পেতে সময় লাগছে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটা।
কলেজ থেকে এবার পিকনিকে গত বছরের ডিসেম্বরে যাওয়ার কথা থাকলেও গেছে নির্বাচনের পর। সানা যেতে চেয়েছিল আর মোস্তফা সাহেবেরও অনুমতি ছিল। কিন্তু মনের হালচাল ভালো না থাকায় গেল না সে। ওর জন্য গেল না দিনা আর রিয়াও। রিয়াকে মূলত যেতে দেয়নি অনি‚ সানা যায়নি বিধায়। আবার পিকনিকের তারিখ পেছানোর জন্য সানার মতো আরও কয়েকজন যেতে পারেনি ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে৷ যে কজন চেয়েও যেতে পারেনি তারা সবাই পরিকল্পনা করে‚ কলেজের আশেপাশেই কোথাও পিকনিকের আয়োজন করবে তারা। নিজেরাই রান্নাবান্না করবে‚ খাওয়া-দাওয়া করে বিকাল অবধি আড্ডা দেবে। আজই সেই দিনটা।
দিনার বিয়ে এ মাসের শেষ দিকে৷ বিয়ের আগে বন্ধুদের সাথে এমন একটা আড্ডা আর ঘোরাফেরা মিস করতে চায়নি। তাই ছোটো চাচা-চাচিকে বলে সানাকেও রাজি করিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে সে। পিকনিকটা হচ্ছে কলেজের এদিকেই। এক বান্ধবীর বাসার পেছন দিকটাতে। সেখানে সেগুন গাছের বিশাল বাগান আর একটা পুকুরও আছে। সেই বাগানটাই খুঁজছে ফারনাজ। রাস্তার ধার ঘেঁষে নাকি বাগানটাকে দেখা যায়।
এলাকার স্থানীয়দের কাছে শুনতে শুনতে খুঁজে পেলো সে অবশেষে। গাড়িটা নামিয়ে দিলো বাগানের ভেতরে। কিন্তু খুব বেশি দূরে এগোনো গেল না। নেমে কল করল সে সানাকে৷ বাড়িতে ওর সঙ্গে কথা বলার মতো সুযোগ পাচ্ছে না একদম। সবার সামনে জোরাজুরিও করতে পারে না। আজকে যেহেতু বাইরে বেরিয়েছে সানা। তাই এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলো না সে।
বেশ কয়েকবার কল করার পর রিসিভ করল সানা‚ “কী সমস্যা?” অশ্রদ্ধা ভরে জিজ্ঞেস করল সে ফারনাজকে‚ “এত বার কল করার মানে কী?”
গাড়ির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল ফারনাজ। “বিশেষ দরকার আছে বলেই তো এত বার করে কল দিচ্ছি”‚ নরম গলায় বলল‚ “আমি ওয়েট করছি তোর পিকনিক স্পট থেকে সামান্য দূরে। চলে আয়।”
“ফাইজলামি!” রুক্ষ ভাষা প্রয়োগ করল সানা‚ “কোথাও আসব না আমি৷ আমাকে একদম বিরক্ত করবেন না বলে দিচ্ছি। চলে যান।”
রাগ হলো না ফারনাজের। বরঞ্চ আরও কোমল করে বলল‚ “অনলি টেন মিনিটস‚ সানা। প্লিজ! আমি ওয়েট করব তুই না আসা পর্যন্ত।” ফোনটা কেটে দিলো তারপর। সামনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল পিকনিকের জায়গাটা। কিন্তু বাগানের মাঝখানে পড়েছে দোচালা একটা ঘর। কেউ বসত করে কিনা কে জানে। ঘরটার জন্যই ওপাশে আর কিছু দেখা যায় না।
ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখতে দেখতে পেরোলো পনেরোটা মিনিট। তবুও হতাশ হলো না ফারনাজ। এই ফাঁকে সানাকে মেসেজ করে আরেকবার জানিয়েছে তার অপেক্ষার কথা।
আশপাশটা একটু নিরিবিলি। মিষ্টি রোদের তেজ। দাঁড়িয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না তার। এমন মুহূর্তে তাকে সঙ্গ দিতেই বোধ হয় রাস্তার কিনারায় এসে থামল হঠাৎ একটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। কপালে ভাঁজ ফেলে ঘুরে তাকাল ফারনাজ। একটু বেশিই চকচক করছে কালো গাড়িটা৷ হয়তো সেরকম একটা বাইরে বের করে না গাড়ির মালিক। কিন্তু মনের ভেতর কিছু একটা খারাপের সঙ্কেত পেলো সে। ভেতরে যে আছে সে নিশ্চয়ই তার সন্ধান নিয়ে এখানে পৌঁছে গেছে৷ নয়ত ভেতরের এই রাস্তায় গাড়িটা থামবে কেন? ফোনটা পকেটে রেখে‚ সানগ্লাসটা চোখ থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ফারনাজ। পাজামা-পাঞ্জাবির বদলে আজ ক্যাজুয়ালে আছে সে। পরনে ডেনিম প্যান্ট আর কালো পলো-শার্ট।
অপেক্ষা বেশি সময় করতে হলো না তাকে। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো শারফান৷ বরাবরের মতো সুরুচিসম্মত ওর পরনে সাদা স্ট্রাইপের বেবি ব্লু শার্ট আর ক্রিম রঙা প্যান্ট। মাথায় সাদা বেসবল ক্যাপ। শার্টের হাতা গুটানো। বোতাম তিনটা খোলা থাকায় লোমশ বুকটাই নজর চলে যায় চট করেই। হাতে ফারনাজের মতোই দামী একটা রিস্ট ওয়াচ৷ পায়ে দামী স্নিকার্স। তবুও ফারনাজ আনমনেই মুগ্ধ হলো ওর ফ্যাশান সেন্স দেখে।
গাড়ির চাবির রিংটা শারফানের আঙুলের ডগায় ঘুরছে। ধূর্ত এক মুচকি হাসি ঠোঁটে নিয়ে সে আসতে থাকল ফারনাজের কাছে। “কী ব্যাপার বল তো?” বলতে বলতে এসে দাঁড়াল তার মুখোমুখি‚ “তোর পদচারণা দেখি গলি-ঘুপচির ভেতরেও চলে। তোর লোকেশন জেনে তো বোকচন্দ্র হয়ে গেছিলাম প্রথমে।”
‘তুই’ সম্বোধনটাতেই মাথার রক্ত টগবগিয়ে উঠতে চাইলো ফারনাজের৷ বাকি কথাবার্তা তো পড়েই রইল। কিন্তু কিছু একটা ভেবে ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করল সে‚ “তুই আমার পিছে ফেউ লাগিয়েছিস?”
“তোর সামনে‚ পিছে‚ ডানে‚ বাঁয়ে‚ কোথায় কয়টা চোখ সেঁটে আছে তা তুই টেরও পাচ্ছিস না৷ শুধু তুই না। তোর বাপ‚ তোর বোন এমনকি তোর মাও বাইরে বের হলেই আমার চোখগুলো লেগে যাচ্ছে ওদের পেছনে।”
ফরসা চোয়ালজোড়া মুহূর্তেই কঠিন হয়ে উঠল ফারনাজের৷ তা লক্ষ করে হাসি চওড়া করল শারফান। আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো তার৷ বলল চুপিসারে‚ “আমাকে যেভাবে দুলুনি দিলি। কেমন হয় তোর মা-বাপ‚ বোনকেও দুলুনিটা দিলে? মাল লোড করা একটা ট্রাক ভুল করে একটুখানি ছুঁয়ে দেবে ওদের গাড়িটা।”
“তোর বাপ-মা‚ বোন কি তাহলে আরামে থাকবে?” ঠান্ডা গলাতেই হুমকিটা দিলো ফারনাজও।
কিন্তু হাসিটা তাতে আরও বড়ো করল শারফান‚ “একটু ছোঁয়ার চেষ্টা করিস তো!” বেজায় হেসে নিয়ে বলল‚ “খেপা ষাঁড়ের শিঙের গুঁতো একবার খেলেই মানুষ দ্বিতীয়বারে সতর্ক হয়ে যায়। তাই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ও খুব সাবধান হয়ে যায় সে। সেখানে আমি তো আজরাইলের মুখ দেখতে দেখতে বেঁচে গেছি। আমি কতটা সতর্ক হতে পারি ভাব তো? আচ্ছা থাক ভাবিস না আপাতত৷ তোর বাপের গাড়িটা ভাঙ্গা মহসড়কে চলছে এখন। তার আগে পিছে টোকা দেওয়ার মতো কিছু আছে না-কি এটা খোঁজ নে।”
বুকের ভেতর ধক করে উঠল ফারনাজের৷ এতক্ষণে দেখাল তাকে শঙ্কিত৷ কারণ‚ কবির সাহেব ভাঙ্গাতে গিয়েছেন আজ সকালে৷ ফেরার কথা এই দুপুরেই। রাগে‚ শঙ্কায় অস্থির হয়ে ফেটে পড়ল ফারনাজ৷ খাবল দেওয়ার মতো করে দুহাতে এসে চেপে ধরল শারফানের কলার। “পুঁতে ফেলব তোকে এখানেই”‚ দাঁতে দাঁত চেপে হুঙ্কার ছেড়ে উঠল সে‚ “শুয়া** বাচ্চা‚ একটা টোকা ফ্যাল আমার বাপের গায়ে! এবার আর বেঁচে মার কোলে ফিরবি না তুই।”
“তাহলে তো আমার গাটস কতখানি দেখাতেই হয়”‚ বিকারশূন্য চেহারায় বলল শারফান‚ “অর্ডারটা পাঠাই?”
“শারফান”‚ গর্জন ছাড়ল যেন ফারনাজ। গলার রগ ভেসে উঠল তার। “কসম আল্লাহ! তুই জ্যান্ত ফিরবি না কিন্তু।”
“উরি বাবারে… ভয় পাচ্ছি গো বাবা”‚ কৌতুক করে উঠেই হেসে ফেলল শারফান। “আচ্ছা রিল্যাক্স হ”‚ বলতে বলতে কলারটা ছাড়িয়ে নিলো সে‚ “তোর বাপটাকে জ্যান্তই ছেড়ে দিচ্ছি৷ কিন্তু খেলতে তো হবে কাউকে নিয়ে। তুই-ই বল‚ আমার পুতুলনাচের পুতুলটা কে হবে? তুই না-কি তোর বোন?”
“মরার আগে পাখা গজায় উইপোকার”‚ হিংস্রতার সঙ্গে বলল ফারনাজ‚ “এজন্যই তোর পাখা গজিয়েছে‚ তাই না?”
“শোন”‚ ঠোঁটজোড়া জিভের ডগায় ভিজিয়ে নিয়ে বলল শারফান‚ “তোর পরিবারের কারও শরীরেই আমি কোনো টোকা দেবো না। তুই ফেরত পাবি অনেক কিছুই‚ সাফারও করবি অনেক কিছু। কিন্তু তুই দেখবি তোর জন্য তোর পরিবারকেও কীভাবে সাফার করতে হয়৷ তোকে আমি বুকে নয়‚ পিঠেও নয়…” ফারনাজের পেটে আঙুল তাক করল সে‚ “তোকে আগে আমি এখানে মারব। ভাতে মারব।” স্বাভাবিক সুরেই বলতে থাকল সে‚ “পাগল হয়ে যাবি তুই। দিশাহারা হয়ে যাবি কোথায় গেলে‚ কী করলে নিস্তার পাবি আমার থাবা থেকে। আগাম সতর্ক বার্তাটা দিতেই তোকে খুঁজে নিয়ে বলতে এলাম। আমি তোর মতো আড়াল থেকে‚ লুকিয়ে চুরিয়ে স্টেপ নিই না। শত্রুকে আগাম বার্তা দিয়ে‚ তাকে চিন্তায় ডুবিয়ে‚ ভয় পায়িয়ে অস্থির করে তুলি। তারপর দিই একদিন ফাটিয়ে… মানে তার বেলুন। উফ্… পুরো সময়টা কী রোমাঞ্চকর লাগে যে আমার! তুই আজ বাসায় ফিরে কঠোর নিরাপত্তা জারি করবে সবখানে‚ এভরি মোমেন্ট আপডেট নিবি সব ঠিকঠাক আছে কিনা‚ নিজে প্রতিনিয়ত খোঁজ রাখবি আমার। আমি কোথায় যাই‚ কী করি‚ কাদের সাথে মিট করি‚ কাদের সাথে ফোনে কথা বলি‚ এসব উদ্ঘাটনের পেছনই তোর দিন যাবে‚ রাত যাবে। তবুও মনে হবে কোথাও কি সতর্কতায় ফাঁক থেকে গেল? এই টেনশনে রাতের ঘুমটাও ঘুমাতে পারবি না ঠিকঠাক। এসবই হবে আজ থেকে তোর জীবনের ডেইলি রুটিন।”
স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ফারনাজ। শারফানের কথাগুলোতে হুঁশিয়ারি স্পষ্ট। ওর কোনোটাই ফাঁকা আওয়াজও নয়। এটাই বলছে তার ষষ্ঠেন্দ্রিয়। যদি কোনো ভয়াবহ পরিকল্পনা সত্যি করেই থাকে শারফান‚ তবে কেনই বা সে সুস্থ বেশে ছেড়ে দেবে ওকে? কেন কিছু করার মতো সময়টা দেবে সে ওকে? রাগে‚ ঘৃণায় মেজাজের লাগাম হারিয়ে মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে শারফানের ওপর।
চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল শারফান। সামান্যর জন্য মাথাটা ছুঁলো না মাটিতে৷ ফারনাজ ওর বুকের ওপর চড়ে মুঠো পাকানো হাতটা উঁচু করে ওর মুখের ওপর বসাতে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই তা নিজের থাবার মধ্যে পাকড়াও করে দু হাতে এত দ্রুত মোচড় দিয়ে ধরল ওই হাতটা যে‚ অন্য হাত তুলে আঘাত করার সুযোগটাই পেলো না ফারনাজ৷ এরপর চিত্রটা পালটে গেল৷ গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে ধাক্কা মেরে তাকে ফেলে দিলো শারফান৷ সে সোজা হওয়ার আগেই তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে চড়ে বসল তার বুকের ওপর। ঝরের গতিতে একেকটা ঘুসি পড়তে থাকল ফারনাজের মুখে৷ পালটা আঘাত করা তো দূর! ঘুসিগুলো ঠেকিয়েই পার পেলো না সে৷ নাক ফেটে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে পড়ল তার। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল সারা মুখ। চোয়ালের ওপরও মারের দাগ বসে গেল। গলা থেকে কখন যেন তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বের হয়ে গেল তার৷ একই সময়ে সানাও এসে হাজির হলো৷ রক্তে ফারনাজেন মুখটা আর চেনার উপায় নেই৷ তবুও থামার লক্ষণ নেই শারফানের৷ যেন হিংস্র নেকড়ে শিকারকে নৃশংসভাবে হত্যা করছে। সামনের এ চিত্রটা দেখা মাত্রই সহজাত প্রবৃত্তি থেকে চিৎকার করে উঠে বলল সানা‚ “ছাড়ুন ওনাকে! ছেড়ে দিন বলছি। নয়তো পুলিশ ডাকব আমি।” তীব্র আতঙ্কে মুখে যা এলো তাই বলে গেল সে শারফানকে। “কুত্তা‚ জানোয়ার” বলে গালাগাল পর্যন্ত করে বসল। এমনকি হাতে শুকনা একটা ডালও তুলে নিলো ওকে আঘাত করার জন্য।
এসব দেখে সত্যিই থেমে গেল শারফান। বাদামী বর্ণের মুখটা হিংস্র রাগে পুরোপুরি কালো হয়ে উঠেছে ওর৷ চোখের চাউনিও খুনে রাগের চাউনি৷ হাঁপাতে হাঁপাতে স্থির সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকল সানাকে। যে দৃষ্টি সানার মতো যে কারোরই অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম৷ ডালটা হাতে নিয়েও নিজের অজান্তেই তাই কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে৷
ঘাড়টা পাশ ফিরিয়ে ফারনাজ কাতরাতে কাতরাতেই দেখল সানাকে। হঠাৎ তখনই তাকে ছেড়ে দিয়েই শারফান ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গেল সানার দিকে৷ সেটা দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠে ফারনাজ বলল‚ “এই শুয়া** বাচ্চা! ওকে কিছু করবি না তুই। ওর গায়ে হাত দিবি না।”
সানাও একই আতঙ্কে কেঁদে চিৎকার করে উঠলে শারফান তার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ বাতাসের বেগে দৌড়ে আসা জাঙ্গের ভয়ঙ্কর আক্রমণকে প্রতিহত করল সে তার সামনে নিজেকে আছড়ে ফেলে। ধারাল নখের থাবা গিয়ে পড়ল তখন ওর খোলা বুকের মাঝখানে। ফিরে তাকিয়ে সেই দৃশ্যটা দেখে একদম জড়ীভূত হয়ে গেল সানা। ফারনাজও ব্যথা ভুলে থমকে চেয়ে রইল মাটিতে পড়ে থেকেই।
শারফান বিপদে পড়েছে এর আভাস পাচ্ছিল জাঙ্গ গাড়িতে বসে‚ যখন চিৎকার করছিল ফারনাজ৷ গাড়ির দরজাটা খুলে সে যখন ঢুকে পড়ল বাগানে ঠিক সে সময়ই দুর্ভাগ্যক্রমে সানা আক্রমণাত্মক হয়ে শারফানকে গালাগাল করছিল‚ ওর ওপর চেঁচামেচি করছিল৷ হাতে আবার ডালটাও ছিল তার৷ জাঙ্গের তখন বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি তার মনিবকেই সানা যা-তা বলছে আর মারতেও চাইছে। আর মনিবের জন্য যে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক ‚ তাকে আক্রমণের জন্য সে এক মুহূর্ত ব্যয় করে না তখন। সানার পেছন থেকে শারফান তা দেখা মাত্রই জীবনের সর্বোচ্চ গতির দৌড়টা দেয় সে জাঙ্গকে থামানোর জন্যই।
সানার দিকে চেয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে বিরতিহীন ঘেউঘেউ করেই যাচ্ছে জাঙ্গ৷ তাকে বুকে আগলে ধরে শারফান শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে‚ “কুল‚ মাই বয়। কুল। আই অ্যাম পারফেক্টলি ওকে৷ দেখ আমাকে‚ কোনো ক্ষতি হয়নি আমার। থাম এবার‚ বাপ। থাম তুই।” বলতে বলতে সানার দিকে তাকাল একবার৷
থরথরিয়ে কাঁপছে সানা৷ কী বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে তা বোঝার পরই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল তার।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৭.
পরনে লাল‚ সবুজ‚ হলুদের মিশেলে সেলোয়ার-কামিজ। ওপরে কালো কাশ্মীরি শাল জড়ানো সানার। চুলগুলো তার ভেজা। সদ্য গোসল করে আসায় প্রসাধনীবিহীন মুখটাই স্নিগ্ধতা আর সতেজতায় আবৃত। রোদ পড়ে যেন চন্দন বরন ত্বকটা অন্যরকম উজ্জ্বলতা দিচ্ছে। ঠিকরে পড়া ওই সৌন্দর্য থেকে নজর ফিরিয়ে নিলো শারফান। প্রথম যেদিন দেখেছিল মেয়েটাকে সেদিন কেবল আকর্ষণীয় কণ্ঠটা ছাড়া বাকি আর কিছু টানেনি ওকে৷ কিন্তু হঠাৎ বিয়ের অনুষ্ঠানের সেই দিনটা থেকে বদলে গেল ওর ধারণা। এরপর সামনে যত দিন এগোচ্ছে আর তাকে দেখছে‚ ততই যেন তার কমনীয়তা ধরা পড়ছে ওর চোখে। আজ আবিষ্কার করল সে‚ ওর দেখা প্রথম নজরেই নজরকাঁড়া সেই রূপসীদের মতো না সানা। বরং তার রূপ মাধুর্য একটু একটু করে বা ধীরে-ধীরে টানবে পুরুষকে। তারপর একদিন সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেবে। যাতে মানুষটা আর ছুটে যেতে না পারে। নিশ্চয়ই ফারনাজের পরিণতিও তাই-ই করেছে মেয়েটা? নয়তো শত শত লাস্যময়ীকে হাতের নাগালে পেয়েও কেন মফস্বলের এই মেয়ের পিছেই ছুটে বেড়াচ্ছে সে? না-কি অন্য কোনো কারণ আছে এর?
তা নিয়ে আর ভাবল না শারফান৷ জাঙ্গের গলার বেল্টটা ধরে দাঁড়াল সে। তাকাল ফারনাজের দিকে। যে উঠে বসতে চেষ্টা করছে ধীরে ধীরে। তাকিয়ে আছে ওর আর সানার দিকেই। “বেওয়ারিশের বাচ্চা‚ শোন”‚ হাঁক ছেড়ে ডেকে তাকে বলে উঠল শারফান‚ “ভাবিস না এটা বাপ্পির মার্ডার বা আমাকে মারতে চাওয়ার শোধ দিলাম। এটা তোর আজকের স্পর্ধার ফল৷ বাপ্পির মৃত্যুর ফল তোর মরনের আগ পর্যন্তও ভোগ করতে হবে৷ বাড়ি যাহ্। বাড়ি যেয়ে…” তাকাল তখন তিরস্কারপূর্ণ চোখে সানার দিকে‚ “আরামের মালিশ ডল শরীরে। ডলে তাজা হ।” দাঁড়াল না আর তারপর। চলে গেল জাঙ্গকে নিয়ে।
সানা বুঝল না ওর বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যটা। কারণ‚ ভয়টা আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে এখনো৷ ফ্যাকাশে চোখে তখনো দেখে চলেছে সে বিদায় নেওয়া শারফান আর জাঙ্গকেই৷ বহুবার ইংলিশ সিনেমাগুলোতে সে দেখেছে এমন কুকুর। সেগুলো দেখতে কালো আর বাদামী৷ সেসব সিনেমায় কখনো পুলিশ‚ আর্মি কুকুরগুলোকে ভয়ঙ্কর শিকারী বানিয়ে অপরাধীকে পাকড়াও করেছে। কখনো তাদের আক্রমণের শিকার হয়ে অপরাধীরা মরেছে। আজ নিশ্চয়ই তারও পরিণতি এমনই হতো যদি কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করত শারফান কুকুরটাকে ঠেকাতে?
দিনা আর রিয়াসহ আরও তিনটা মেয়ে দৌড়ে এসে ইতোমধ্যে হাজির হয়েছে। জোরে গান বাজিয়ে ওরা কাজ করছিল‚ গল্প করছিল। এর মাঝে ফারনাজের চিৎকারটা ওদের কানে এলেও ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারেনি। তবে সন্দেহ হওয়ায় দ্বিতীয়বার কোনো চিৎকার কানে আসে কিনা বোঝার চেষ্টা করে ওরা৷ তখনই সানার কণ্ঠটা সবাই শুনতে পায়। তারপর আর বসে থাকেনি কেউ। আসতে আসতে শারফানের শেষ কথাগুলো কানে আসে ওদের৷
সানার সঙ্গে কিছু হয়েছে কিনা এই ভাবনা সবার হতে না হতেই আচমকা দিনা চিৎকার করে উঠল। তখন সবার নজর গেল অদূরে দাঁড়ানো রক্তাক্ত ফারনাজের দিকে৷ ছুটে গিয়ে তাকে জলদি ধরল দিনা‚ “ভাইয়া‚ কী হয়েছে আপনার?”
ওর আতঙ্কিত উচ্চকণ্ঠে সানাও যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো৷ শারফানের গমন পথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখল ফারনাজকে।
বাকিরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখছে শুধু সবটা। রাস্তায় দু-চারজন পথচারীরাও দেখছে এই পরিস্থিতি। দু দুটো দামী গাড়ি আর শারফান‚ ফারনাজের মতো ভারী দেহের দুটো পুরুষ৷ বুঝেছে এরা বড়ো বড়ো পর্যায়ের মানুষ। আর ফারনাজ তো এবারের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল। কিন্তু কী কারণে অমন মারামারি করেছে তারা‚ তা এসে দেখার বা জিজ্ঞেস করার কৌতুহল থাকলেও ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে আর এগোয়নি। সানাকে দেখে তারা আরও কৌতুহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। তবে শারফান বিদায় নেওয়ার পর দুয়েকজন নিজের গন্তব্যে রওনা হয়ে গেছে।
দিনার সাহায্যে এলোমেলো পা ফেলে সানার সামনে এসে দাঁড়াল ফারনাজ। কপাল‚ চোয়াল‚ চোখের কোন ফুলে প্রায় কালো হয়ে উঠেছে তার। নাকটা থেকে রক্ত পড়ছে এখনো। শঙ্কিত দিনা সবে মাত্র বলল সানাকে‚ “কী করে এই অবস্থা হলো ভাইয়ার?”
আর তক্ষুনি সানা ঝাঁঝালো গলায় বলল‚ “সেটা তোর ভাইয়াকেই জিজ্ঞেস কর।”
“সানা!” রেগে ধমকে উঠল দিনা‚ “এটা কেমন টোন? ঠিক করে কথা বল আর ধর ভাইয়াকে।”
“যা তো”‚ বিতৃষ্ণায় মুখটা ফিরিয়ে নিলো সানা ফারনাজের ওপর থেকে‚ “তুই ধরে নিয়ে যা তাকে তার বাড়িতে। মানুষের ক্ষতি করলে এমন কত মাইর খেতে হয়!”
তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে চলে গেল পিকনিকের জায়গাতে। মাথাটা ঘুরছে ফারনাজের৷ তবুও এতক্ষণ মনের কোনে কেমন ভালো লাগা অনুভব হচ্ছিল তার৷ কারণ‚ একটু আগে সানাকে যেভাবে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতে দেখেছিল নিজের জন্য! তাতে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল তাকে নিয়ে সে কতটা উদ্বিগ্ন আর উত্তেজিত ছিল। তাহলে এখন কেন আবার সেই পূর্বের ঘৃণা ফিরে এলো ওর মাঝে? না-কি তারই ওকে বুঝতে ভুল হয়েছিল তখন? স্রেফ মনুষ্যত্ব আর ন্যায়-অন্যায় সংশ্লিষ্ট বিবেকের তাড়না থেকেই তাকে বাঁচাতে চেয়েছিল শারফানের থেকে!
সকলের সামনে সানার এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য আচরণ সহ্য হলো না ফারনাজের। দিনাকে ছেড়ে দিয়ে সে নিজের গাড়ির কাছে ফিরে এলো৷ পিছু পিছু দিনাও ছুটে এলো। ছাড়ল না তাকে একা।
***
“ব্যাটা‚ তুই তো দেখি আমার চেয়েও রুড আর রুথলেস”‚ রসিক গলায় জাঙ্গকে বকুনি দিতে দিতে শারফান বাসার ভেতর ঢুকল‚ “অমন টসটসে নরম সরম শরীরের ওপর ঝাঁপ মারতে গেলি কী করে‚ হ্যাঁ? সরল সরল মুখটা দেখে মায়া হলো না একটুও? বুকও কাঁপল না তোর? ইয়াজের কাছে কমপ্লেইন দেবো এখন‚ দাঁড়া।”
ঘেউঘেউ করে উঠল জাঙ্গ নালিশ দেওয়ার কথা শোনা মাত্রই৷ তারপরই শারফানের হাঁটুতে গাল ঘষতে আরম্ভ করল। এই ভাবসাব দেখে মুচকি হাসল শারফান‚ “আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। আর সোহাগ করতে হবে না। বলব না ইয়াজকে৷ ভালোই তো ভয় পাস দেখি ওকে।”
বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন বাপ্পির মা জোবেদা। আর জারা মেঝেতে বসে তার কাছে চুলে তেল নিচ্ছে টিভি দেখতে দেখতে। হাতের আন্দাজেই জেবেদা দারুণ করে তেল দিচ্ছেন ওর চুলগুলোতে।
“যা‚ খবর নে তো বাপ্পির মার। দুপুরে খেয়েছে নাকি শুনে আয়”‚ সোফায় বসতে বসতে জাঙ্গকে বলল শারফান।
দৌড়ে তখন চলে গেল জাঙ্গ জোবেদার কাছে। ওর নিজস্ব ভাষাতে শারফানের বলা কথাগুলোই বলল৷ অন্ধ জোবেদা প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন। বুঝলেনও না কেন ঘেউঘেউ করছে জাঙ্গ। তাই শারফানই জানাল তাকে জাঙ্গের প্রশ্ন৷ তা শুনে মলিন হাসলেন তিনি। ভয় কাটিয়ে উত্তরও দিলেন। বাড়ির মানুষগুলোর সাথে তার সম্পর্কটা এ কটা দিনে বেশ উন্নত হয়েছে৷
জেসমিন বেগম একজন বুয়াও রেখেছেন এর মাঝে৷ যে তার কাজেও সহায়তা করবে আবার জোবেদারও দেখাশোনা করবে৷ কিন্তু জোবেদার তেমন সাহায্যের দরকার পড়ে না৷ নিজের কাজসহ ঘরকন্নার কাজ তিনি অনায়াসেই করতে পারেন। অন্ধকার জগতটার মাঝে আজ কতগুলো বছর আছেন তিনি! এভাবেই নিজেকে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছেন বহু আগে৷ এমনকি চাইলে রান্নাবান্নাও তিনি সামলে নিতে পারেন। সমস্যা হয় কেবল চলাফেরায়৷ নিজের বাড়ির আনাচে-কানাচে চলতে চলতে সব চেনা হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু নতুন জায়গায় সেভাবে সব চিনতে সময় লাগছে৷ শারফান তাই কিছু কৌশল শিখিয়ে দিয়েছে৷ যেমন গুনে গুনে পা ফেলা‚ সব কিছুর শব্দ করে শব্দগুলো চিনে নেওয়া। এমন কৌশলগুলো অনুসরণ করায় বেশ কাজে দিয়েছে তার। এখন তাই একা একাই সিঁড়ি বেয়ে ঘরে যেতে পারে৷ তবে নতুন সদস্য জাঙ্গ আসার পর থেকে শানফান ওকে দায়িত্ব দিয়েছে তার খেয়ালটা বেশি রাখার৷ কিন্তু ওর সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময়ই লাগছে তার।
বাড়িটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। তিন দিন হলো সবাই ফিরে গেছে ঢাকাতে৷ রিহানটা কতগুলো দিন ছিল সঙ্গে সঙ্গে। তাকে বড্ড মিস করছে শারফান। বাবাকেও মিস করছে বেশ। বাড়িতে এক সাথে এতগুলো দিন থাকা হয়নি তাদের বহুদিন৷ এজন্যই এবার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর মনের ভেতরও। কিন্তু তা সে প্রকাশ করছে না ভুল করেও৷
ছেলে ফিরেছে শুনে জেসমিন বেগম এসে বকাঝকা করলেন ওকে‚ দুপুরে না খেয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য৷ তার বকা শুনতে শুনতেই শারফান ঘরের উদ্দেশে পা বাড়াল হাত-মুখ ধোঁয়ার জন্য। বুকে যে আঁচড়টা পড়েছে জাঙ্গের‚ সেটা যাতে বাড়ির কেউ না দেখে তার জন্য আসার পথেই ওটার ব্যবস্থা করে এসেছে সে। নয়তো বেচারা জাঙ্গকেও মন্দ কথা হজম করতে হতো। শাফিউল সাহেব তাকে বাসার ভেতর থাকার অনুমতি দেননি এমনিতেই। তার কথা‚ কুকুর হলো নাপাক প্রাণী৷ তার জন্য ঘরে ফেরেশতা থাকবে না৷ তাই বাধ্য হয়ে শারফান তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঘরের বাইরে।
***
রাত ৭: ৩৫ মিনিট
ফোনটা কার্নিশের ওপর। পাশেই খুলে রাখা হেডফোনটা ছড়িয়ে। মৃদু আওয়াজে ফোনে বেজে চলেছে—
“এক মুঠো রোদ্দুর হাতে‚ এক আকাশ নীল
আজ তোমার জন্য ব্যস্ত শহরে‚চলছে ভালবাসার মিছিল
শুধু তোমার জন্য‚ প্রেমের জোয়ারে ভাসল দু’কূল
রাতের আকাশ জাগে,তারার চাদরে
বৃষ্টি ভেজা বাতাস বহে রাতের আদরে
পাহাড়ে পাহাড়ে ফুটল বনফুল
শুধু তোমার জন্য‚ প্রেমের জোয়ারে ভাসল দু’কূল”
হাতে সাদা একটা বেসবল ক্যাপ নিয়ে সানা দাঁড়িয়ে আছে ছাদে৷ মনটা অশান্ত ওর। কারণ‚ অনেকগুলো ভাবনা একত্রে মন মস্তিষ্কে ছুটছে আর বারবার তা ছন্নছাড়া হয়ে পড়ছে। অথচ ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু একজনই—শারফান। এই যে ওর হাতে ধরা এখন তারই বেসবল ক্যাপটা। ফারনাজের সঙ্গে মারামারির সময় যেটা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে৷ বাড়িতে ফিরে আসার আগে সেই জায়গাটিতে দ্বিতীয়বার গিয়েছিল সে কেবল এই ক্যাপটি তুলে আনার জন্য। কিন্তু কেন আনল? সেটাই এখন ভাবছে সে৷ ভাবছে নির্বাচনের দিনে ওর সঙ্গে করা শারফানের অন্যায়টাও‚ গত একটি মাস ধরে যখন তখন ওকে কল করে ঘণ্টা ভরে বিরক্ত করাও৷ সব থেকে বেশি ভাবনাতে আসছে আজকের ঘটনা আর সেদিন সকালে এসে লোকটা ওকে বলে গেল যে কথাগুলো। সেই কথাগুলোতে আসলে কী ব্যক্ত করেছিল সে‚ কী হুঁশিয়ারি দিয়েছিল‚ তা নিজের মতো বুঝে নিয়েছে ওর মন। কিন্তু সেটা কতটা সঠিক সেটা নিয়েও দ্বিধান্বিত আর বিভ্রান্ত সে।
শারফানকে ঘিরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি! ভালোলাগা‚ মন্দলাগা‚ পছন্দ-অপছন্দ—নির্দিষ্টভাবে ঠিক কোন অনুভূতির স্থানে আছে শারফান‚ নিজেই তা নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছে না সানা। জটিল মানুষটা আচমকা উড়ে এসে জুড়ে বসল ওর জীবনে। যার জন্য নানানভাবে সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে সে আর এখন অবধিও পড়ছে। অথচ অতীতে কোনোদিন কোনো কিছুতে ওর সঙ্গে সম্পৃক্ততাই ছিল না ওই মানুষটার। তবুও বর্তমান জুড়ে যা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে‚ ভুক্তভোগী হচ্ছে ও‚ তার জন্য দায়ী শুধুই সে-ই।
“এই আপু”‚ নিচ থেকে ডাক এলো মেহার‚ “নিচে আয়‚ ছাদে আর কতক্ষণ থাকবি?”
কোনো জবাব দিলো না সানা। বাড়িতে এখন শুধু ওরা দু বোনই। ফারনাজের মার খাওয়ার ঘটনাটা জানার পর মোস্তফা সাহেব বিকালে গেছেন ভাতিজাকে দেখতে। সামাজিকতা রক্ষার্থে সঙ্গে গেছেন নাজমা বেগমও। আর কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবেন তারা।
কিন্তু সানা একটা ব্যাপারে আশ্চর্য হয়েছে। সবাই জিজ্ঞেস করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মারার মতো স্পর্ধাটা কে দেখাল? অথচ ফারনাজ কোনোভাবেই শারফানের নামটা নাকি নেয়নি৷ কথাটা দিনা জানাল কল করে৷ তাকেও নাকি নিষেধ করে দিয়েছে শারফানের কথা সবার সামনে না বলতে৷ আর এটা যে মোটেই ভয় পেয়ে নয় তা সানা ভালো করেই বুঝেছে। কোনো না কোনো বৃহৎ উদ্দেশ্যর জন্যই নামটা জানায়নি সে কাউকে। সেই উদ্দেশ্যটাও যে ভালো কিছু নয় সেটা দিনাও বুঝে গেছে। কিন্তু সানার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে‚ এদের দুজনের বিবাদের জন্য কোনোভাবে যেন আবারও না জড়িয়ে যায় সে!
***
৩১ জানুয়ারি
দুপুর ২ টা
দিনার বউভাতের আয়োজনে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে বাড়ির উঠোন থেকে বাড়ির ছাদ অবধি৷ নিমন্ত্রিত অতিথি অনেক৷ নিজেদের আত্মীয় আর গ্রামবাসীদের আপ্যায়ন চলছে এখনো।
শহর থেকে বেশ ভেতর দিকেই সাদ্দামদের বাড়িটা। তবে রাস্তা ঘেঁষেই৷ তাই দিনার আত্মীয়দের গাড়িগুলো এসে দাঁড়াতে পারল ভালোভাবেই। মোট চারটা গাড়ি। প্রথম গাড়িটা ফারনাজের৷ বউভাতে সে আসবে তা ভাবেইনি কেউ। গাড়ি থেকে একে একে তার পরিবারের মানুষগুলোই নামল। তারা গাদাগাদি করে বসতে পারবে না বলে কাউকে আর এ গাড়িতে তুলতে পারেনি ফারনাজ৷ সানারা এসেছে তাই অন্য গাড়িতে।
ওদের সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল সাদ্দামের পরিবার৷ সানা আর মেহা একটু পেছনেই ছিল। বাড়ির ভেতর প্রবেশের সময় হঠাৎ কানে এলো কিছু কিছু কথা। এলাকার কয়েকজন মহিলারা ফারনাজের দুই বোন ফারিয়া আর নিশাকে নিয়ে বলাবলি করছে আরকি৷ ওদের পরনের শাড়ি আর লেহেঙ্গা দিনার বিয়ের শাড়ি থেকেও ভীষণ দামী আর চাকচিক্যময়। এমনকি আজকে দিনার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ওদের সাজসজ্জায়। তবে শুধু মহিলারাই নয়‚ নিমন্ত্রিত প্রায় সকল পুরুষেরও নজর কাঁড়ছে ওরা দু বোন৷ দেখতে শুনতে ফারনাজের মতোই সুন্দর ওরা।
সবার দৃষ্টি লক্ষ করে মেহা চেহারা কুঁচকে ফেলে ফিসফিস করল‚ “ওদের জামাকাপড় আর থোবড়াটা দেখে এরা সবাই চিৎ হয়ে পড়তে চাচ্ছে‚ আপু৷ কিন্তু ওদের মনের ভেতরটাই কী পরিমাণ পঁচা গু ভরা তা আর কেউ টের পাবে না। আফসোস!”
মুচকি হাসল সানা। কোনো কথা বলল না। এখানে রওনা হওয়ার আগ মুহূর্তে ও আর মেহা ফারিয়ার কাছে খুব বিচ্ছিরিভাবে বিদ্রুপের শিকার হয়েছিল। পরনে ওদেরও চটকদার পোশাক। তবে সেটা ফারিয়া আর নিশার চেয়ে তিনগুণ কম দামী৷ আবার সাজটাও ওরা ইচ্ছা করেই সামান্য রেখেছে৷ এজন্য সকলের সামনেই ফারিয়া অভদ্রোচিত মন্তব্য করে বসে‚ “শহরে থাকিস‚ কলেজে পড়াশোনা করিস তোরা! অথচ ফ্যাশান সেন্স এত বাজে ক্যান তোদের? এসব কী পইরা যাচ্ছিস দুইজন?” বলেই নাজমা বেগমকেও খোঁচা মেরে ওঠে‚ “ওদের একটু দামী‚ রুচিসম্মত জামাকাপড় দিতে পারো না‚ কাকি? অবিয়াইত মেয়ের সব সময় ভালোভাবে রাখতে হয়। নাইলে ভালো ঘরের সম্বন্ধ পাবা না তো। যেমন পোশাক পরায় রাখবা তেমন ঘর থেকেই আসবে প্রস্তাব।”
প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন নাজমা। সেখানে তখন ফারনাজ আর মোস্তফা সাহেব ছিলেন না৷ যেসব আত্মীয়রা ছিল তাদের মাঝে কেউ কেউ ঠোঁট টিপে হেসেছিল আর কেউ আবার বলেছিল‚ “খারাপ কুথায় ওগের জামা? তুরা ঢাকার বড়ো বড়ো দুকানেরতে জামা কিনিস কইয়া ফরিদপুরির জামা কাপড় তুগার ভাল ঠেকে না।”
চুপ করেই ছিলেন নাজমা। মেয়েদেরও কথা না বলতে ইশারা করেছিলেন‚ যেন ফারিয়ার কথার কোনো দামই নেই তাদের কাছে এমন ভাবভঙ্গিমাতে থাকে ওরা। কিন্তু প্রতিবারই চুপ থাকার পরও তো ফারিয়া ওদেরকে অপমানের সুযোগ পেলে ছাড়ে না৷ এর একমাত্র কারণ কী? কারণ হলো‚ ফারনাজ সানাকে খুব পছন্দ করে আর ছোটো চাচার প্রতি সে অনুগত। যেটা ফারিয়া‚ নিশা আর ওদের মাও পছন্দ করে না কখনোই।
মায়ের কথামতো মেহা চুপ থাকলেও সানা অনেক ভেবেচিন্তে মাকে অমান্য করে তখন। পরনে ওদের দু বোনেরই মেরুন আর সোনালী রঙের ঘেরের গোল জামা। জর্জেট ওড়নার আঁচলের এক কোনা হাতে বাঁধতে বাঁধতে হঠাৎ বলে ওঠে সানা‚ “দাদীর কাছে শুনেছি‚ আপু৷ হাইস্কুল অবধি ফারনাজ ভাইয়া নাকি নামেই বড়ো কাকুর ছেলে ছিল। স্কুলের সবাই নাকি প্রথমে জানত ভাইয়া আমার আব্বুর ছেলে। কারণ‚ ভাইয়া আমার আব্বুর এমন গোঁড়া ভক্ত ছিল যে আব্বু নিজের ছেলে থাকলে ছেলের খরচ যেভাবে বহন করত সেরকম নাকি ভাইয়াকে ভালোবেসে ক্লাস টেন পর্যন্ত ভাইয়ার যাবতীয় খরচা দিতো। হাত খরচা থেকে শুরু করে পায়ের জুতা কেনা পর্যন্ত। সেটাতে কোনোদিন বড়ো কাকু বা বড়ো কাকি বাধা দেয়নি নাকি। আমার আব্বুর বড়ো মন আর হাত খুলে খরচা করার পরিচয় পাওয়া যায় না এখানে বলো? নিজের ভরা সংসারের দায়িত্বের পাশাপাশি ফারনাজ ভাইয়ার জীবনের অর্ধেকটা সময় অবধি আব্বু তার দায়িত্বও স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সেই ব্যক্তি কি তার দু মেয়ের বেলায় কঞ্জুস হতে পারে? আর রুচিশীল‚ দামী পোশাকের কথায় যখন বললে তখন এই কথাটা না বলে পারছি না‚ আপু…” হেসে ফেলে সানা‚ “আল্লাহ যদি দুলাভাইয়ের মতো টাকাওয়ালা কাউকে বর বানায় আমাদের। তখন আমরাও না হয় তোমার মতো ঢাকার বড়ো বড়ো শপিং মল থেকে এক্সপেনসিভ গর্জিয়াস শাড়ি‚ কাপড়চোপড় কিনব। বিয়ের আগে তো আর পারছি না সেটা। যেমন তুমিও পারোনি। কারণ‚ আমরা মেয়েরা তো বাপের পরিশ্রম দেখে বড়ো হই‚ তাই না? তাই খরচের সময় নিজেরাই বিবেচনা করি‚ থাক এত দামের জামাকাপড় কিনব না।”
এ কথার শেষ পথেই ফারনাজ এসে হাজির হয়েছিল। তাই আর চাইলেও ফারিয়া ভালো-মন্দ কিছু বলতে পারেনি সানাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে কিছুটা ভারী সাজ রাখতেই পারত সানা। কিন্তু সেবার কনভেনশন হলে যাওয়ার পর মোস্তফা সাহেবের কাছে দু মেয়ের জন্যই বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল৷ আর যারা দিয়েছিল তারা আবার সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষই৷ যাদের মুখের ওপর না তো বলায় যায় না৷ ঘুরিয়ে না বলতে গেলেও তারা অপমানিত বোধ করে। এজন্য দারুণ বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ প্রস্তাব খারাপ ছিল না। কিন্তু পাত্র ছিল বেশ বয়স্ক এবং স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেছে দেশের বাইরে। বিয়ের পরই সানাকেও নিয়ে যাবে। কিন্তু মোস্তফা সাহেব দূরদূরান্তে মেয়েদের বিয়ে দিতে নারাজ। তাছাড়া একেবারেই অচেনা পর্যায়ের কারও সঙ্গে আত্মীয়তাও করতে চান না। বিয়ের প্রস্তাব যেন না আসে তাই আজ ছিমছামভাবে তৈরি হয়েছে ওরা দু বোন।
মফস্বলের বিয়ে বাড়িতে বাংলা-হিন্দি গান বাজবে না তাই কি হয়? এখানেও বাজছে কোথায় যেন। দিনার আত্মীয়দের জন্য যতটা সম্ভব খেতে বসার স্থান বিশেষভাবে করা হয়েছে৷ যেন কোনোরকম অস্বস্তি বা অসুবিধা না অনুভব করে কেউ৷ প্যান্ডেলের মাঝখানে সামিয়ানা টাঙিয়ে অন্যদের থেকে বিভক্ত করা হয়েছে। যেহেতু একটু দেরি করেই এসেছে ওরা তাই স্ন্যাক্সের পরিবর্তে সরাসরি দুপুরের প্রধান খাবারের এন্তেজাম করা হচ্ছে। এর মাঝে সবাই দিনাকে দেখতে গেছে দোতলায়।
যেতে পথে অনি‚ রিপন‚ সোহানদের সঙ্গে দেখা হয়েছে সানার৷ শারফানকে আশেপাশে কোথাও নজরে পড়েনি ওর৷ অথচ বিয়ের দিন থেকেই ওই লোকটাকে খুঁজে চলেছে সে‚ ব্যাগের মধ্যে তার ক্যাপটা নিয়ে। সেদিন বরযাত্রীতে তার সব বন্ধুদের আগমন হলেও আশ্চর্যভাবে তাকে দেখা যায়নি। ভেবেছিল সেটা ফেরত দেওয়ার অছিলায় কিছু কথা বলবে সে তার সঙ্গে। সেই কথার মাঝে বাপ্পির মায়ের প্রসঙ্গও ছিল৷ বাপ্পির মৃত্যুর অনুশোচনার ভার কোনোদিনই যাবে না ওর। তাই ভেবেছিল আজ অবধি যতটুকু অর্থ জমিয়েছে তার সবটাই বাপ্পির মায়ের হাতে তুলে দেবে৷ এতে হয়তো মুক্তি পাবে না নিজের অপরাধবোধ থেকে। কিন্তু একটুখানি হলেও শান্তি অনুভব করতে পারবে সে৷ রিহানের কাছ থেকে সেদিন জানতে পেরেছে‚ অসহায় মহিলাটির সারাজীবনের দায়িত্ব শারফান নিয়ে নিয়েছে। এমনকি নিজের বাড়িতেই তাকে আপনজনের মতো জায়গা করে দিয়েছে। এজন্যই না চাইলেও বাপ্পির মায়ের ব্যাপারে কথা বলতে হলে তার সঙ্গেই তো বলতে হবে।
তবে অপ্রকাশিত সত্য হলো‚ এ ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছিল ওর আর ওদের পরিবারের সবারও। তাছাড়া ওর সঙ্গে করা অন্যায়ের জন্য লোকটা মাফও চাইলো‚ দিন পনেরো আগে আরও একবার ওকে বিপদ থেকে রক্ষা করল। সব কিছু মিলিয়েই শারফানের প্রতি পূর্বকার রাগ‚ ঘৃণা তেমন আর অনুভব করে না সে।
দিনার কাছে ওরা সবাই আসার কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করল বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে৷ সঙ্গে সাদ্দামের মা। “দেখি‚ একটু জায়গা দাও তুমরা”‚ মেয়েটির হাত ধরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি সবাইকে বললেন‚ “আমার ছেলে বউরে দেখবার জন্যি পাগল হইয়া গ্যাছে আম্মাজান। ওরে ইটু বসার জায়গা দাও তো।”
মেয়েটা বেশ বিব্রত হয়ে হাসল‚ “বসতে দিতে হবে না‚ আন্টি। ভাবিকে দেখেই বেরিয়ে যাব।”
একটু ভারী স্বাস্থ মেয়েটার। তবে লম্বা বেশ। টকটকে রাঙা ফরসা আর মুখটা ডিম্বাকৃতি। কিন্তু হাসিটা খুব পরিচিত লাগল সানার। বিশেষ করে হাসির সময় গালের মাঝে তৈরি হওয়া দুটো খাঁজ।
দিনা মুচকি হেসে হাত ধরে মেয়েটাকে নিজের কাছে আনল। কারণ‚ শাশুড়ি যেহেতু এত আদর করছে তার মানে অবশ্যই বিশেষ কেউ হবে মেয়েটা। সাদ্দামের মা পরিচয় করিয়ে দিলেন‚ “ও হইলো শাফিউল ভাইর মাইয়া। ওই যে এমপি যে হইলো তার ভাতিজি। ওর ভাই শারফান আমাগের সাদ্দামের বন্ধু৷ ভাইর সাথে আইছে বউ দেখবার। আমাগের বউ পছন্দ হইছে গো‚ জারা?” শেষ প্রশ্নটা জারার উদ্দেশে করলে জারা ঘাড় কাত করে মুচকি হেসে ‘হ্যাঁ’ জানাল।
এবার সানা বুঝল কেন মেয়েটার হাসি পরিচিত লাগছে ওর। ঠিক যেন শারফানের হাসি। পরনের পোশাক আর চেহারা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে মেয়েটা ওর পরিবারে ভীষণ আদরের। রূপকার্থে বললে বাবার রাজকুমারী। রূপালী বর্ণের ঝলমলে এক পাকিস্তানি আনারকলি স্যুট তার পরনে। গলা‚ কানে আর হাতে অল্পস্বল্প যে গহনা তা সাদা সোনা আর হীরার তৈরি। তাকে দেখে রীতিমতো তাক লেগে গেল জেরিনের মতো মানুষগুলোর মাঝে। না বললেও তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না অমন পোশাক আর গহনা সরাসরি এ দেশের বাইরে থেকেই কিনে আনা।
হ্যাঁ সত্যিই তাই। বাইরের কেউ না জানলেও শারফানের নিকটতম মানুষগুলো জানে‚ জারা বাবার তৈরি রাজকুমারীর চেয়েও ভাইয়ের তৈরি রাজকুমারী বেশি। নিজে পোশাকআশাকে যেমন চটকদার সে—দেশের বাইরে থেকে কেনাকাটা না করে এ দেশেরই দক্ষ আর যোগ্য ডিজাইনারের থেকে নিজের পছন্দমতো জামা-কাপড় বানিয়ে নেয়। তাতে খরচার ধার ধারে না কখনো। তেমন মা-বোনের ক্ষেত্রেও একইরকম বেহিসাবি সে। বিশেষতঃ বোনের পোশাক-পরিচ্ছদ‚ সাজ-সরঞ্জামের সমস্ত খেয়াল তারই। কেননা বোনের আবদারই থাকে সেরকম।
জারাকে দেখতে দেখতেই ফারিয়া আর নিশার মন আপনা-আপনিই বলে উঠল‚ মেয়েটা তাদের থেকেও ফিটফাট ও চটপটেভাবে চলাফেরা করে! অথচ একটু আগে পর্যন্ত তাদের ধারণা ছিল সারা ফরিদপুরে তাদের চেয়ে বিত্তশালী থাকলে অন্তত তাদের মতো চালচলন কারও নেই।
“এই মেয়েটা তাহলে ওই সন্ত্রাসী ব্যাডার বোন‚ আপু”‚ অবাক হয়ে মেহা ফিসফিস করল‚ “কী কিউট দেখতে মেয়েটা! কে বলবে এত সুন্দর মেয়ে ওই ব্যাটার বোন?”
“সবাই-ই বলবে”‚ কোনোরকমে ঠোঁট নাড়িয়ে নিচুস্বরে বলল সানা‚ “মেয়েটার হাসি খেয়াল কর। ওই ব্যাটার হাসিটা একেবারে ছাপ্পা মেরে বসানো মনে হচ্ছে।”
বোনের কথা মতো জারার হাসি ভালোভাবে লক্ষ করল মেহা‚ “হ্যাঁ‚ সত্যিই। হাসলে একইরকম লাগে। খালি একজন কালো আর আরেকজন ফরসা‚ এই আরকি। কিন্তু এরা ভাই-বোন দুইটাই প্রচুর লম্বা আর মোটাতাজা।”
“মোটা!” ভ্রু কুঁচকাল সানা।
“ওই আরকি। লম্বাচওড়া হিসেবে স্বাস্থ্য মানানসই আছে।”
সানা আর কথা বলল না। শারফান এসেছে শোনার পরই হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে ওর। লোকটার সামনে গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে সেই সাহসই জোগাচ্ছে এখন সে মনটাকে।
***
মা‚ বোন আর প্রিয় ছোটো চাচার পরিবার এক সঙ্গে নিয়ে ফারনাজ খেতে বসেছে৷ সেখানে সাদ্দাম নিজে দাঁড়িয়ে খাবার তদারকি করছে। সবার প্লেটে খাবার তুলে দেওয়ার ফাঁকে তার চোখ গেল প্যান্ডেলের বাইরে‚ যেখানে বন্ধুরা জড়ো হয়েছে হঠাৎ। খেয়াল করল সবাই জড়ো হয়েছে আসলে শারফানকে ঘিরে৷ সকাল থেকে তার কাজে সহযোগিতা করে চলে গিয়েছিল শারফান বেলা বারোটায়৷ বাড়ি গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওকে ফোন করতে করতে পাগল হওয়ার দশা হয়েছিল তার৷ শেষে বাধ্য হয়ে জারাকে কল করে বলে দেয় ভাইকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ওর সঙ্গে চলে আসে যেন দ্রুত।
আসার পরই শারফান আর জারার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিল সাদ্দাম। পরে খাবে জানিয়ে রাজি হলো না শারফান। শুধু জারার ব্যবস্থা করে দিতে বলল সে৷ কিন্তু পরে আর কখন খাবে? তখন কি রোস্ট‚ মাছ মাংসের ভালো ভালো পিস পড়ে থাকবে? চোখের ইশারায় বন্ধুদের একজনকে ডাকল সাদ্দাম। সোহান এলে তাকে ফারনাজদের টেবিলের দায়িত্ব দিয়ে গেল সে শারফানের কাছে‚ “ওই‚ তুই খাবি কখন? এখানে বসতে না চাইলে জারার সাথে ঘরের ভেতর গিয়ে বস।”
“তোর খাইজেনদারি শেষ?” বলে তাকাল শারফান ফারনাজের টেবিলে।
“আমার খাইজেনদারি শেষ দিয়ে তোর কী? তুই কি আমার হাতে খাবি?”
হেসে উঠল অনি আর রিপন৷ “তোর হাতে খাবে না৷ তোর বেয়াইনদের হাতে খাবে বলে বসে আছে”‚ হাসতে হাসতে বলল অনি।
“তাই? তা কোনডার হাতে খাবি? পাছে ফারনাজ তোর পেট ফেড়ে সেই খাবার বের করে আনবে না তো?”
“টিপে টুপে আগে দেখে আয় সেদিন দুইশো পাউন্ডের একেকটা ঘুসি খেয়ে হাড়গোড় ঠিকঠাক আছে নাকি”‚ বলল রিপন।
“ঠিকই আছে”‚ সাদ্দাম বলল‚ “না হলে কি আর বোনের বিয়ের পোলাও‚ রোস্ট খেতে চলে আসে?”
“ওদের খাওয়া শেষের দিকে মনে হচ্ছে?” দৃষ্টি ফারনাজের টেবিলেই শারফানের‚ “শেষ পাতে দই‚ মিষ্টির টাইম এখন।”
সাদ্দাম ফিরে তাকিয়ে দেখল‚ “ওরে তাই তো‚ থাক তোরা। দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে যাই আমি।”
“তোকে যেতে হবে না। হাঁড়িটা এনে দে”‚ বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শারফান‚ “তোর বেয়াইনদের হাতে খাওয়ার আগে তাদের মিষ্টি মুখ করিয়ে আসি।”
“এই শায়াফ”‚ সাবধানী গলায় বলল সাদ্দাম‚ “ফারনাজ কিন্তু এখন বিশেষ অতিথি।”
“আমি কখন বললাম ও আমার সুমুন্দি?”
হাসল তিন বন্ধু এক সাথেই। দইয়ের হাঁড়ি এক হাতে নিয়ে রওনা হলো শারফান। পেছন থেকে অনি টিটকারি মেরে বলল‚ “খাইজেনদারি যারা করে তারা সানগ্লাস‚ স্যুট পরে করে কবে থেকে রে?”
কথাটা কানে আসলে চোখ থেকে সানগ্লাসটা নামাল শুধু শারফান। তা দেখে ঠাট্টা করে বলল সাদ্দামও‚ “ওরে শালা‚ ব্লেজারটাও খোল। খাবারের দাগ জড়াতে পারে। পাঙ্কু মেরে খাইজেনদারি করতে হয় না। গামছা একখান ঘাড়ে নে‚ ব্যাটা।”
সোহানের হাতে সালাদের প্লেট ছিল৷ সাহেবি বেশভূষায়
শারফানকে হঠাৎ দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে আসতে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে ফেলতে গেল। শারফান চোখ গরম করে তাকালে সে বিদায় নিলো ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতেই।
কালো ব্লেজার স্যুট পরনে ফারনাজের৷ চেহারায় মারের দাগগুলো প্রায় গায়েব। শারফানকে খেয়াল করেনি সে এখনো। কিন্তু টেবিলের কারও কারও চোখ স্থির হয়ে গেছে ওর ওপরই৷ আর দুঃখজনকভাবে সানার খাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে তখনই। শারফান কোনা চোখে খেয়াল করল সবটাই৷ এটাও দেখতে পেলো ফারনাজের দুই বোনই হাঁ করে দেখছিল ওকে৷ দেখার পর হঠাৎ কানাকানি শুরু করল। হয়তো বলছে‚ এই হারামজাদাই ওদের সুদর্শন ভাইটাকে ঘুসিয়ে নাক-মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল সেদিন। ভাবতেই দুষ্টু হাসিটা চলে এলো ওর ঠোঁটের কোনে।
সবার আগে ফারনাজের পাশে এসে দাঁড়াল সে। তার প্লেটের পাশে রাখা বাটিটাতে দই দিতে দিতে আচমকা চুপিসারে বলে উঠল‚ “কীরে শালা সুমুন্দি‚ দই খাবি?”
ঝট করে পাশ ফিরে তাকাল ফারনাজ। নিমেষেই শক্ত হয়ে গেল তার মুখটা আর চাউনিও। তা দেখে আরও হাসল শারফান‚ “গরু খেয়ে কষে গেছে না-কি? দই খেয়ে হইহই করে বাথরুমে যা‚ ভাই। হাগুটা ক্লিয়ার করে আয়।”
বলেই চলে গেল সে মোস্তফা সাহেবের কাছে। বিনয়ী হেসে কুশল বিনিময় করতে করতে দই দিলো তাকে আর নাজমা বেগমকে। তাদের পরেই বসা নিশা আর ফারিয়া। নিশার কাছে এসে হঠাৎ কথার সুর‚ হাসির ধরন আর চাহনিও বদলাল ওর। সেটা অনায়াসেই চোখে বিঁধল কারও কারও। ফারিয়া তো ভারি অবাক হলো ওর দুঃসাহস দেখে। তার আর ফারনাজের সামনেই তাদের বোনের সাথে ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করছে!
নিশাকেও দেখাল বেশ বিস্মিত আবার অভিভূতও। সাদা শার্টের ওপর বেইজ রঙা স্যুট প্যান্ট‚ গুছিয়ে রাখা ঝরঝরে বড়ো বড়ো চুল‚ সাথে মানানসই গোঁফ-দাড়িও আছে। শারফানকে প্রথম নজরে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল সে। সেটাই কানে কানে বোনকে বলছিল‚ “ভাইয়ার মুখে যা শুনেছি তা শুনে তো ভেবেছিলাম রাস্তার বখাটে নয়তো পাড়ার মস্তানদের মতো হবে। কিন্তু বাস্তবে তো পুরোই উলটো‚ আপা।”
“তা হোক উলটো”‚ জবাবে বলেছিল ফারিয়া‚ “এই হারামির বাচ্চারে যে কুনোদিন দাফন কইরে দেবে বড়ো ভাই৷ তাই ভুলেও প্রেমে টেমে পড়িসনে।”
বোনের সতর্কতা একটু আগেও মনে রেখেছিল সে৷ কিন্তু টোল পড়া গালে সুন্দর করে মুচকি হাসায় আর মারাত্মক ভারী‚ পৌরুষপূর্ণ কণ্ঠে আলতো সুরে কথা বলায় তার নাজুক মনটা অবাধ্য হয়ে হোঁচট খেয়েই বসল শারফানের ওপর।
“এই মেহা‚ আমি উঠছি”‚ সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল সানা‚ “তোর হলে ওঠ।”
“দই টই খাবি না?” জিজ্ঞেস করল মেহা।
কিন্তু সানা সে কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়েই থাকল না৷
***
আর ঘণ্টাখানিক পরই ফারনাজরা বেরিয়ে পড়বে দিনা আর দিনার বরকে নিয়ে। ছোটাছুটির ফাঁকে সাদ্দাম এসে আরেকবার ধাক্কাল শারফানকে‚ “এই খচ্চর‚ তুই কি খাবি না বলে পণ করছিস?”
“খাওয়ার কথা বলতেছি তো তখন থেকেই”‚ রিপন বলল‚ “কথা শোনে না।”
“খাবো‚ কিন্তু আমার নিরিবিলি ঘর দরকার।”
সাদ্দাম বিরক্ত হলো‚ “বাড়ির পায়খানাগুলোও তো নিরিবিলি নাই। আর তুই ঘর খুঁজতেছিস নিরিবিলি?”
“তুই দিতে পারলে বল না হলে ফোট।”
“ওর পুরো কথা শুনে নে”‚ অনি বলল সন্দেহ চোখে তাকিয়ে‚ “ওর ফাঁকা ঘর লাগবে মানে কোনো আকাম করার ফন্দি আঁটছে।”
“এই সত্যিই?” সন্দিগ্ধ হলো সাদ্দামও।
“হুঁ‚ আমি ঢোকার পরই তোর বেয়াইনকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করবি ওখানে।”
“মেজাজ টেজাজ কিন্তু এইবার খারাপ হয়ে যাবে কইলাম”‚ চটে গেল সাদ্দাম‚ “তুই এই লোকজন ভরা বাড়িতে ফাঁকা ঘরে আমার বেয়াইন নিয়ে ঢুকবি। কেউ দেখে নিলে কী কেলেঙ্কারি হবে জানিস না?”
“কেউ দেখবে কেন”‚ নির্বিকার সুরে বলল শারফান‚ “তোর ঘর ফাঁকা কর। ঘরের ভিতর তোর বন্ধুরা আছে বলে দিবি যাতে কেউ পা-ই না দেয় ওদিকে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কাজ করার নাটকও করবি তোরা।”
সাদ্দামকে আরও বিরক্ত দেখাল। তা দেখে শারফান শ্রাগ করল‚ “আমি তো জোর করছি না৷ তুই খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিস তাই বললাম আমার সুবিধার কথাটা।”
“করবি কী ঘরে নিয়ে? তোর করার মতো মেয়ের অভাব যে তুই এইখানে করা করি করবি? তাও আবার শত্রুমার্কা বেয়াইন নিয়ে?”
“বোকা** ‚ ওই করা করির জন্য তোর ঘরে ঢুকব আমি?”
শেষে বন্ধুদের কৌতূহলী মুখগুলো দেখে সে ব্যক্ত করল মনের ইচ্ছাটা। সন্দেহপূর্ণ অনি জিজ্ঞেস করল শুধু‚ “তুই চাচ্ছিস কোনটাকে ঘরের ভেতরে?”
শারফান মুখে না জবাব দিয়ে দৃষ্টিপাত করল সামনে৷ ওর সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে অনিরাও তাকাল সেদিকে৷ যেখানে ফারিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে নিশা আর চোরা চোখে দেখছে বারবার শারফানকেই। খাওয়ার পর্বের পর থেকেই ওদের দুজনের চোখাচোখি হতে দেখছে তারা। কিন্তু অনি তাও বারবার ওকে খোঁচাল নামটা শোনার জন্য। কারণ‚ নিশার বরাবরই পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সানা‚ কোলে তার ছ’মাসের এক বাচ্চা। গল্প করছে বাচ্চাটার মায়ের সাথে। সাদ্দাম আসার আগে শারফানকে তার দিকেও তাকাতে দেখেছে সে।
চলবে।