মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
2

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৮.

জলদি জলদি বেরিয়ে পড়ার কথা থাকলেও দিনাদের বের হওয়ার সময়টা শুধু পেছাচ্ছেই। তাই সবাই ততক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সানাও বের হবে বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসার জন্য। আসার পথে নদীর পারের মনোরম একটা নিরিবিলি জায়গা চোখে পড়েছিল।

মেহার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। দুপুরে ভাতঘুমের অভ্যাস তার৷ তাই হেঁটে আসার মতো আগ্রহ পেলো না সে। বরং গল্প করার সঙ্গী জুটেছে তার৷ জারা একাকী হওয়ায় চঞ্চল মেহাকে পেয়ে আড্ডায় মেতেছে দুজন৷ বয়সে মাত্র বছরখানিকের পার্থক্য ওদের।

সানা তাই একাই বেরিয়ে এলো দিনার ঘর থেকে। সিঁড়ির মাঝপথে হঠাৎ বিপ বিপ করে ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করল ওর—পান্থর কল! আজ সকাল থেকে সে উদয় হয়েছে আবার৷ মাঝখানে অনেকগুলো দিন গায়েব ছিল। কারণ‚ ওর রূঢ়ভাবে বলা মেসেজটা পেয়েছিল নির্বাচনের পরদিনই৷ তাই ভেবেছিল আর এগোবে না হয়তো। কিন্তু এই চকলেট বয় আখ্যায়িত ছেলেটা ওর মায়া ছাড়তে পারছে না কেন কে জানে? আর কতবার কেটে দেওয়া যায় কল? তার থেকে রিসিভ করে এবার সরাসরি কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়া যাক৷ কিন্তু তার জন্য দরকার ফাঁকা স্থান। রিসিভ করল ও‚ “এটা কী‚ পান্থ? কলটা বারবার কাটছি মানে আমি কথা বলার মতো ফ্রি নেই। এটুকু বোঝা উচিত ছিল তোমার।”

“ফার্স্ট অফ অল‚ আই অ্যাম ভেরি স্যরি ফর দ্যাট”‚ বেশ উগ্রভাবে বলল পান্থ‚ “বাট তোমারও তাহলে বোঝা উচিত ছিল নির্লজ্জের মতো এত বার করে কল করছি যেহেতু তার মানে কোনো দরকার আছে নিশ্চয়ই? নয়তো অপমানিত হওয়ার পরও তোমাকে কল করার মতো চিপ পার্সোনালিটি আমার নয়‚ ইউ নো দ্যাট।”

বিরক্তিটা দমাল সানা কিছুটা‚ “আচ্ছা বুঝতে পেরেছি৷ আমি একটা বিয়ের প্রোগ্রামে আছি। দশ মিনিট পরে কল ব্যাক করছি তোমাকে।”

“কৃতজ্ঞ হলাম৷ কিন্তু দশটা মিনিট নয়৷ আমি এখনই একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই৷ মাত্র এক মিনিটের জন্য।”

সানা নিচে নেমে এসেছে৷ এক মিনিট কথা বলতে চাইছে শুনে আর বারণ করল না‚ “ঠিক আছে‚ বলো শুনছি।”

“আমার সঙ্গে তুমি ব্রেক আপ করেছ ভালো কথা৷ কিন্তু কী বলে ব্রেক আপ করেছ সেটা কি তোমার বান্ধবীদের বলার দরকার ছিল? সবার কাছে আমাকে এতটা ছোটো করার মানে কী? শুধু সম্পর্কটা নিজে থেকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছি বলে খুব ছোটো হয়ে গেছি?”

“আমি কাকে কী বলেছি?” অবাক হলো সানা‚ “আমাদের ব্যাপারে কেবল রিয়া আর আমার বোনরা ছাড়া আর তো কেউ জানে না।”

“রিয়ার কথাই বলছি। সে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। তার সান্ত্বনার কথাগুলো সান্ত্বনার বদলে আমাকে কী পরিমাণ অপমানিত করেছে তার কোনো ধারণা আছে তোমার?”

সানার মনে পড়ল না রিয়াকে সে ওই মেসেজ সম্পর্কে আদৌ কিছু বলেছিল কিনা৷ যদি জেনেই থাকে রিয়া তবে সেটা হয়তো ওর অগোচরে ওর ইনবক্সে ঢুঁ মেরে দেখে নিয়েছে। কিন্তু সে কেন পান্থকে সেটা নিয়ে সান্ত্বনা দিতে গেল? আশ্চর্য! আর এই ব্যাপারে কথা কি এক মিনিটে শেষ করা সম্ভব? নিজের দিকটা পুরোপুরি পরিষ্কার করতে হবে ওকে। তাই বলল‚ “তুমি ভুল বুঝছ‚ পান্থ৷ আমি তোমাকে কিছুক্ষণ পরই কল ব্যাক করে সবটা ক্লিয়ার করছি। প্লিজ ওয়েট করো পাঁচটা মিনিট।”

পান্থর জবাব শোনার অপেক্ষা করল না৷ কলটা কেটে নিচতলার বারান্দা থেকে নেমে গেল সানা৷ উঠানে ফারিয়া আর নিশাকে দেখা গেল চেয়ার পেতে বসে কজন ওদের মতো বিত্তবান আত্মীয়দের সঙ্গেই গল্পগুজব করছে। ফারনাজ আর মোস্তফা সাহেব দিনার শ্বশুরের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত। বাবাকে জিজ্ঞেস করল সানা‚ “আমি একটু সামনে থেকে হেঁটে আসি‚ আব্বু?”

“আঁমি এঁকটুঁ হেঁটেঁ আঁসি আঁব্বু”‚ মোস্তফা সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই বারান্দায় দাঁড়ানো শারফান কথাটা শুনে হঠাৎ নাকিসুরে ব্যঙ্গ করে উঠল। “ওরে আমার ইনুশেন্ট হানি বানি… আব্বুর কী বাধ্য সুকইন্যে! যার বয়ফেরেন্দও আছে গোপনে গোপনে। আর এই সুকইন্যেকে আমিও বোকা** কী ভালো মেয়েটাই না ভেবেছিলাম!”

নিচে নেমে কথা বলার সময় সানা খেয়াল করেনি শারফানকে। খেয়াল হলো না এখনো ওর। বাবার অনুমতি পেয়ে চলে গেল বাইরে। সেদিকে খেপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শারফান নির্নিমেষ৷ “এই সরল সিধে চেহারার মানুষগুলোই হয় চাপা শয়তান”‚ বিড়বিড় করে বলে উঠল সে।

নিচতলার ঘরগুলো খাবার রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সাদ্দাম শারফানকে জোর করে টেনে নিয়ে এসেছিল সেখানেই তাকে বসিয়ে খেতে দেবে বলে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল শারফান। তাই না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। তখনই সানা কথা বলতে বলতে নিচে নামছিল৷ ওর বলা কোনো কথা তাই আর কানে না এসে থাকেনি তার।

হতাশ‚ ব্যর্থ সাদ্দাম ঘাড়ের রগ বাঁকা বন্ধুর পরিবারের জন্য খাবার প্যাকিং করে রেখে দিলো আলাদা। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বলল‚ “চল ঘরে। খাবার পাঠাচ্ছি। সাথে তোর…” উঠোনে বসা নিশা আর ফারিয়ার দিকে তাকাল সে‚ “শত্রুর বোনকেও পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু ছোটো মাছটার পিছু পিছু বঁড়শিতে ওই বড়ো মাছটাও গেঁথে গেলে আমি কিছু করতে পারব না বলে দিলাম। ওই বেডি তো দেখি বোনরে শাড়ির আঁচলে আঁচলে নিয়ে ঘুরতেছে।”

“মাছ খাওয়ার আর রুচি নাই”‚ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলল শারফান। “সর সামনে থেকে”‚ পথের সামনে থেকে সাদ্দামকে ঠেলে সরিয়ে নেমে গেল সে উঠোনে৷ তারপর রওনা হলো বাড়ির বাইরের পথে।

“না খেয়েই রুচি চলে গেল!” আহাম্মকের মতো দেখাল সাদ্দামকে‚ “তা যাচ্ছিস কোথায়?”

শারফানের কানেই যায়নি তার কথা। রাস্তায় দুই দিকে চোখ বুলাল শারফান৷ তারপর খুঁজে পেলো সানাকে। যদিও অনেক দূরে চলে গেছে সানা৷ দূ্র থেকেই ওর মেরুন রঙা জামাটা দেখে চিনে গেছে সে।

রাস্তার ডানেই নদীর পারটা। পারে বিরাট একটা আম গাছ আছে৷ সানা এসে দাঁড়াল সেখানেই৷ বাতাস প্রচুর এখানটাই। এক হাতে ওড়না ভালোভাবে ধরে রেখে কল করল পান্থকে। পান্থ রিসিভ করল একটু সময় নিয়েই৷ কণ্ঠস্বর রুক্ষ বেশ। সানা তাকে বোঝালো রিয়াকে তাদের বিচ্ছেদের সেই মেসেজ সম্পর্কে কিছুই বলেনি। রিয়াই বা কেন তাকে সান্ত্বনা দিতে গেছে এ ব্যাপারেও কিছু জানে না সে। কিন্তু পান্থর মনে আছে তাদের সম্পর্কের শুরুতে রিয়া আরেকবার মেসেজ করেছিল তাকে ফেসবুকে। এই সম্পর্কে রিয়ার কতটা অবদান ছিল সেটাই জাহির করেছিল রিয়া তার কাছে। তাই রিয়াকে যে সানা কিছু জানায়নি এ কথা সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করল না। দুজনের বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে সানা কুৎসিত এক গালি দিয়ে বলল‚ “তুমি বিশ্বাস করলে করো না করলে নাই৷ তাতে আমার চুলটাও ছেঁড়া যাবে না‚ হালারপো!” খট করে কলটা কেটে দিলো তারপরই৷ সঙ্গে সঙ্গেই নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টও করে ফেলল।

ওর মেজাজ খিঁচড়েছে শুধু পান্থর ওপর না‚ রিয়ার ওপরও। রিয়া কেন এমন কাজ করতে গেল সেটা ভাবলেই যা বের হচ্ছে ভাবনা থেকে‚ তাতে বিশ্বাস ব্যাপারটা আরও নড়বড়ে হয়ে গেল ওর রিয়ার প্রতি৷ এমনিতেও ও জানত কোনো কথা পেটে রাখার স্বভাব নেই তার৷ তাই বলে বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিকের কাছেও পেটের কথা উগড়াতে যাবে? আর ওর অনুমতি ছাড়া কোন সাহসেই বা ইনবক্সে ঢুকেছিল? কালকেই গিয়ে কথা বলবে সে এই বিষয়ে।

হাঁটতে হাঁটতে আম গাছের অপরপাশে এলো সানা৷ সোনা রোদ্দুরে ঝিলমিল করছে নদীর পানি৷ কিন্তু এটা আসলে নদীর পার নয়৷ কোনো এক বর্ষাতে ভাঙন ধরেছিল এখানে। সামনের বর্ষাতে যদি আরও ভাঙন ধরে তবে তলিয়ে যাবে আম গাছটা।

হঠাৎ বাতাসে ছুটে এলো সিগারেটের তীব্র গন্ধ। একটু আগে কোনো লোককেই চোখে পড়ল না! ভ্রু কুঁচকে সানা চারপাশে তাকাল ধূমপায়ী ব্যক্তিটাকে দেখার জন্য—পেয়েও গেল। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ওর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল শারফান। কিন্তু ভাবটা এমন যে দেখেইনি ওকে৷ সত্যিই কি দেখেনি? না-কি দেখেও কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না? ভ্রু কুঁচকে চেয়েই ভাবল সানা বিষয়টা। লোকটার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ছিল ওর ঘণ্টা দুই আগেও। কিন্তু সে ইচ্ছা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে খাবার টেবিল থেকেই।

চোখ-মুখ শক্ত করে সরে এলো সানা সেখান থেকে৷ এসে দাঁড়াল আবারও আম গাছের ছায়াতে। “এখনকার পুরুষরা কি এই বড়োলোকের বাচ্চাটার মতোই বহুরুপী”‚ বিড়বিড় করে সে বকে চলল শারফানকে‚ “একটা ছেলের আসলে কত রূপ থাকতে পারে‚ আল্লাহ? না-কি আমার সাথেই এর সমস্যা? চিরশত্রু মনে করে আমাকে! দুনিয়ার সব খাইশ্টা দূষিত আচরণ তাই আমার সাথেই শুধু।”

তারপরও আম গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিলো সে। দাঁড়িয়েই আছে শারফান। আরামে সিগারেট টানতে এসেছে বোধ হয়। ভাবনায় পড়ল সানা—গিয়ে কথাবার্তা কি বলবে? অন্য কথা না হোক অন্তত টাকাগুলো দিয়ে আসবে না হয় বাপ্পির মায়ের জন্য। দ্রুত চিন্তা শুরু করল। আজকের পর আর সুযোগ নাও পেতে পারে এই ব্যাটার সাথে কথা বলার৷ কারণ‚ এখন আর হুটহাট তাদের দেখা হয় না রাস্তায়। সেই পিকনিকের দিনটার পর আজই দেখা হলো দুজনের৷ আবার থাকে নাকি লোকটা ঢাকাতে। নিশ্চয়ই চলে যাবে যে-কোনোদিন? একা যেহেতু পাওয়াই গেছে তবে কথা বলেই আসা যাক।

পা বাড়াল সে শারফানের উদ্দেশে৷ কিন্তু যেতে যেতে আচমকা কোথা থেকে এসে ওর মনের মধ্যে উদয় হলো চুমুর সেই দুর্ঘটনাটা। মুহূর্তেই অস্বস্তি‚ আড়ষ্টতায় চলার গতি শ্লথ হয়ে গেল। সমস্ত আগ্রহ ফুরিয়ে গেল কথা বলার৷ মাত্র হাত পাঁচেক দূরত্ব দুজনের মাঝে৷ ফিরতি পথে পা বাড়াল সানা চকিতেই।

“কী ব্যাপার? স্টক করছিলে না-কি আমাকে?”

চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সানা‚ “কী বললেন?” নির্বিকার রূপে ধোঁয়া ছাড়তে থাকা শারফানের দিকে তাকাল সে বিস্মিত চোখে।

“বললাম চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছিলে আবার কাছে এসে দেখে পালিয়েও যাচ্ছিলে। কেন?”

“আমি এসেছি আগে এখানে”‚ অপ্রতিভ কণ্ঠে বলল সানা‚ “আপনিও এলেন তারপর৷”

“আমি কখন বললাম আমি আগে এসেছি?” উদাসীনের মতো দৃষ্টিজোড়া তার নদীতে‚ “আমি তো আর তোমাকে উঁকি মেরেও দেখিনি‚ কাছে গিয়ে দেখে এসে পালাতেও চাইনি।”

কথায় পারা মুশকিল এত! “উফঃ”‚ বিরক্ত হলো সানা নিজের প্রতিই। ইতস্ততভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কী করবে ভেবে। ভাবা শেষে প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলল আস্তে করে। বিব্রতপূর্ণ পরিস্থিতিটা থেকে উদ্ধার পেতে হঠাৎ ক্যাপটা বের করল সে ব্যাগ থেকে৷ বাড়িয়ে দিলো তখনই শারফানকে‚ “এটা আপনার।”

এক ভ্রু উঁচু করে পাশ ফিরে তাকাল শারফান৷ নিজের হারিয়ে ফেলে ক্যাপটা দেখে ভ্রুজোড়ার মাঝে ভাঁজ পড়ল তার৷ কিন্তু ধরল না সেটা। সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “আমার হলে তোমার কাছে কী করছে?”

“সেদিন ফেলে রেখে গিয়েছিলেন৷ আমি পেয়েছিলাম। তাই তুলে নিয়ে এসেছিলাম।”

“সিরিয়াসলি”‚ ক্যাপটা একবার দেখে পুনর্বার তাকাল শারফান সানার চোখে—একটু বিস্ময় নিয়েই। “আমার জেনেও তুলে নিয়েছিলে তুমি? আবার ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরেও বেড়াচ্ছ!”

“ঘুরে বেড়াচ্ছ আবার কী কথা”‚ থতমত খেলো সানা। ব্যাপারটা এক হিসেবে সত্যিই। দিন দশেক আগেও অনির কাছে পড়তে যাওয়ার সময় দুদিন করে ক্যাপটা ব্যাগে নিয়ে রেখেছিল সে। আবার দিনার বিয়ের দিনও তো রেখেছিল। “আপনার সঙ্গে আজ দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করেই সঙ্গে এনেছি এটা”‚ বলল দৃঢ়ভাবে।

সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সানার মুখোমুখি দাঁড়াল শারফান‚ “সামহাও ক্যাপটা ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে তুমি কি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করতে চাইছো সেদিন আমার জাঙ্গ থেকে তোমাকে সেইফ করেছি বলে?”

“অনেকটা তাই”‚ ইতস্তত কণ্ঠে বলল সানা। “আর আপনার অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটাই আমি…”

“ডোন্ট কল দ্যাট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট”‚ সানাকে বাধা দিয়ে শক্তভাবে বলল শারফান‚ “কল ইট অ্যাটেমটেড মার্ডার।”

অস্বস্তির সঙ্গে মিশল এবার স্নায়বিক উদ্বেগও। কিছুটা ভয়েই সানা তাকাল না শারফানের দিকে। ওকে যদি দোষারোপ করে কথা বলতে শুরু করে আবার তাহলে কী বলবে ও?

কিন্তু ওকে দেখতে দেখতে শারফান সে প্রসঙ্গে গেল না আর কী ভেবে যেন‚ “লিভ ইট।” জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি সিরিয়াসলিই চাও আমাকে থ্যাঙ্কস জানাতে?”

প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ায় অনেকটা স্বস্তিবোধ করল সানা৷ কিন্তু সেই স্বস্তি নিয়ে শারফানের চোখে চোখ মেলাতে পারল না কোনোভাবেই৷ “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ”‚ ইতিউতি চেয়ে বলল শারফানকে‚ “সেদিন প্রাণ সংশয় হতে পারত আমার।”

“হুঁ‚ পারত। ও মালিকের প্রতি অনুগত খুব।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“কিন্তু আমি বুঝিনি।”

জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো সানা‚ “কী বোঝেননি?”

“ইলেকশনের দিনটার পর তুমি যে যেচে পড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে… তাও কিনা একা একাই! কেবল থ্যাঙ্কস দেওয়ার জন্য? ইজ ইট ট্রু?”

“তুই ব্যাটা খুব সেয়ানা”‚ কথাটা মনে মনে বললেও সানা মুখে বলল‚ “ইলেকশনের দিন যেটা করেছিলেন আপনি… তারপর আসলেই আপনার সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস আর রুচি ছিল না৷ কিন্তু নিজের অপরাধ আপনি উপলব্ধি করেছেন‚ আমার প্রতি রাগ থাকলেও নিজের মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছেন আমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে। তাই আর দ্বিধা হয়নি আপনার সামনে এসে দাঁড়াতে‚ কথা বলতে।”

মাথাটা দুলাতে দুলাতে নিজস্ব ভঙ্গিমায় ঠোঁট বাঁকাল শারফান। তারপর খুব সাবধানে দুষ্টু হাসি খেলে গেল অন্যদিকে চেয়ে থাকা তার চোখজোড়ায়‚ “তাহলে বলছ তুমি আর ইনসিকিউরড হচ্ছ না আমার সামনে দাঁড়িয়ে?”

জবাব দিলো না সানা। মুখে মুখে ধন্যবাদ দিলেও সত্যিটা হলো সেদিনের ভয়টা এখনো কাটেনি ওর৷ এই লোকের হাড়েমজ্জায় শয়তানি—কথাটা ওর সহজাত অনুভূতিই জানান দেয় মুখোমুখি হলে। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল‚ “আমি অন্য এক ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে। একটা জিনিস দিতে চাই আপনাকে।”

“দিতে চাও”‚ মাটিতে গেঁথে থাকা ইটের খোয়াটা জুতা দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বলল শারফান‚ “আমি নিতে চাই কিনা সেটাই প্রশ্ন।”

“জিনিসটা কী তা না জেনেই নেবেন না বলছেন?”

“না”‚ মাথা তুলে তাকাল শারফান‚ “জিনিস নয়। তোমার থ্যাঙ্কসটা আমি নিয়েছি কিনা সেটা তো জানতে চাইলে না।”

“নেননি?” ভ্রুদুটো কপালে তুলে প্রশ্ন করল সানা। একটু হতবাকই হলো বেচারি।

“যে ইনজুরি নিয়ে ঘুরছি তার ক্ষতিপূরণ নেওয়ার বদলে উলটে কল্যাণ করেছি তোমার৷ তার জন্য তোমার ওই শুকনো থ্যাঙ্কস আমার পোষাবে না।”

“তাহলে নদীতে নামি? কাগজে লিখে থ্যাঙ্কসটাকে চুবিয়ে আনি?” মেজাজটা দ্বিতীয়বার খিঁচড়াল সানার। আসলে দোষটা ওরই৷ এই শয়তানের চ্যালাটা বিশ্বাসের যোগ্যই না‚ এটা জেনেও কেন আসতে গেল সে? কিন্তু এবার আর নিস্তার দেবে না একদম। লাথি মেরে না ফেলতে পারলেও ধাক্কা দিয়েই নদীতে ফেলে দেবে ইতরটাকে।

শারফানের মুখের ভাবটা গম্ভীর হলো ওকে কটমট করে তাকাতে দেখে। “গরম দিচ্ছ না-কি? কাকে দিচ্ছ‚ হুঁ?” কড়া গলায় বলল ওকে‚ “সেদিন গালাগালি করে রক্ষা পেয়ে গেছ বলে কি আশকারা পেয়ে গেছ?”

“আমি আপনার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য এসেছিলাম”‚ দাঁতে দাঁত চেপে বলল সানা‚ “আপনি তা না শুনে আবারও সেদিনের মতো ক্ষতিপূরণের কথা বলছেন? নিশ্চয়ই আবারও নোংরামি করার ফন্দি আঁটছেন?”

“মনের মধ্যে ঢুকে বসে আছ? নিশ্চিত হয়েই গেছ যখন তখন যাও… দৌড় লাগাও৷ এখানে তো আর ক্লাসরুম নেই যে পালানোর সুযোগ পাবে না। দাঁড়িয়ে আছ কেন এখনো? যাও!”

“আপনার আমার সঙ্গে সমস্যা কী আসলে?” হতাশ সুরে বলল সানা‚ “এমন কেন করেন আপনি? নিজেকে এমনভাবে প্রেজেন্ট করেছেন যে আপনার উপকারগুলো ম্লান হয়ে যায় আমার মন থেকে।”

“তো কে বলেছে তোমাকে আমার উপকারকে ধামায় ভরে নিয়ে হইহই-রইরই করে বেড়াতে? আমি বলেছি সেই ধামা ধরে আমার কাছে এসো‚ এসে কথা বলো? আমার উপকারকে গ্লোরিফাই করার কোনো প্রয়োজন নেই তো… যখন অলরেডি গ্লোরিফাই করার মতো মানুষ পুষছোই তুমি। এর জন্যই তো বলি এত তেল খসিয়েও ফারনাইজ্জা কেন খুশি করতে পারে না!”

“কী”‚ কথাগুলোর অর্থ বুঝতে বুঝতেও বুঝে উঠল না যেন সানা। “কীসের মধ্যে কী বলেন? বুঝিনি কিছুই।”

“বোঝানোর ঠেকা নেই আমার”‚ বক্রোক্তি করল শারফান‚ “কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন সেটাই তো বুঝছি না। ভয়ে তোমার ঠ্যাঙের সাথে ঠ্যাং বাড়ি খাওয়ার কথা এতক্ষণে। খাচ্ছে না কেন? না-কি তলপেটে চাপ দিচ্ছে? দেখো আশেপাশে কিন্তু টয়লেট নেই। সময় থাকতে বাড়িতে দৌড় মারো।”

“আল্লাহর কসম”‚ চিড়বিড় করে ওঠার মতো বলল সানা‚ “পঁচা কাদা‚ পানির মধ্যে আপনাকে ঠেসে ধরে কয়েক ঘা মারার ইচ্ছেটা আমাকে একবার পূরণ করতে দিন শুধু। আমি সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।”

তখনই দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে আনল শারফান। “আমাকেও তাহলে শুধু একবার তোমাকে ঠেসে ধরে পরাণ ভরে চুমু খেতে দাও”‚ সানাকে নকল করেই বলল সে‚ “ওই যে বাচ্চাটাকে যেভাবে চটকে চটকে আদর করছিলে আর চুমু খাচ্ছিলে‚ ঠিক ওরকম করে। আমিও কৃতজ্ঞ থাকব তোমার কাছে৷ কিন্তু সারা জীবনের জন্য না। ততদিনের জন্য‚ যতদিন না তোমাকে আর মনে পড়ে।”

“কুত্তার লেজ আসলে কোনোদিন সোজা হয় না”‚ খেঁকিয়ে উঠল সানা নিমিষেই‚ “চূড়ান্ত শিক্ষা হলো আমার। নিশার সাথে ম্যানারলি কথা বলেছিলেন দেখে ভেবেছিলাম আজ আমার সঙ্গেও কিছুটা হলেও হয়তো তেমনই আচরণ করবেন। কিন্তু আমি তো আপনার জন্মশত্রু‚ না? যত নোংরা লোভী নজর তাই শুধু আমার ওপর।”

“নিশা কে?” শারফান সত্যিই চিনল না প্রথমে। তারপর খেয়াল হলো আজ তো একজনের সঙ্গেই অতিরিক্ত ভদ্র হয়েছিল সে। “ও… আচ্ছা। ফারনাজের বোন?” বলার পর সে হাসল একটু‚ “ওসব নিশা নেশার মতো বাংলা মদের সঙ্গে সানার মতো ডেজার্টের তুলনা করলে হয়? লোভী নজর তো মানুষ মিষ্টিতেই দেয়‚ না-কি?”

হাতে ধরা ক্যাপটা ফিকে মারল সানা শারফানের মুখের ওপর। প্রস্তুত ছিল না শারফান৷ তাই মুখে গিয়েই পড়ল সরাসরি। তারপরই বলল সানা‚ “দুনিয়ার সবচেয়ে নোংরা গালিগুলোও আপনার জন্য কম হবে। তাও বলতে মন চাচ্ছে।””

“দিয়েই দেখো একটা”‚ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ল যেন শারফান।

“দেবো না। আপনার মতো বেয়াদব না-কি আমি? আর স্বীকার করতেও অসুবিধা নেই যে আপনার মতো জঘন্য লোকের সামনে একা দাঁড়িয়ে গালাগালি করার মতো দুঃসাহস আমার নেই।”

“তুমি তো আবার আদব জানো মেলা…”‚ ছোটো বাচ্চাদের সঙ্গে আদর সুরে বিকৃত কণ্ঠে কথা বলার মতো করেই বলে গেল শারফান‚ “হেই‚ বাবার বাধ্য কন্যা! কী অনেস্ট গো তুমি‚ মাগো মা! চুরি করে কোনোদিন প্রেমও করো না! নির্জনে এসে বয়ফ্রেন্ডের মানভঞ্জনও কভু করো না। কারণ‚ তুমি তো বাবার সহজ-সরল সুকন্যা‚ তাই না?”

ধারাবাহিক রোজ দেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আবারও বলছি কথাটা৷ ধারাবাহিক সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুদিন দিতে চেয়েছি আমি। সেখানে যখন সম্ভব হলে দুদিনের বেশিও দিচ্ছি… তাও বড়ো বড়ো পর্বে৷ কিন্তু আপনারা এটা ভেবে রাখবেন আমি দুদিন-তিনদিন পর পরই দেবো। আবার আমার সুযোগ হলে একদিন পরই পাবেন। তাই বলে সব সময়ই একদিন পর একদিন পাবেন‚ এটা ভেবে আমাকে প্রেশার দেবেন না প্লিজ৷

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
২৯.

“আপনি আড়ি পেতে শুনেছেন”‚ বিস্মযোক্তি করে উঠল সানা অবিলম্বেই‚ “মানুষ এত্ত খারাপ হয় কীভাবে?”

“কোথাকার কে তুমি‚ হে রমণী”‚ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল শারফান‚ “তোমার মতো একটা মাছির ভ্যানভ্যাননি আড়ি পেতে শোনার সময় নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না শারফান। সত্যি জিনিস এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে যায়—যতই লুকোছাপা করতে চেষ্টা করো‚ বুঝলে?”

“না‚ বুঝিনি”‚ ক্ষিপ্ত স্বরে বলল সানা‚ “আমি মাইক নিয়ে কথা বলিনি যে আপনার মতো শয়তানের কানে বাতাসে ভেসে গিয়ে পৌঁছবে আমার কথা৷ আপনি নিশ্চয়ই আড়ি পেতে শুনেছেন৷ আর এজন্যই আমার পিছু পিছু এসেছেন বাকিটাও শোনার জন্য‚ তাই না? বুকে সৎ সাহস থাকলে খবরদার অস্বীকার করবেন না।”

ধরা পড়েও দমে গেল না শারফান। উপরন্তু ফিচলেমো করল‚ “বুকে আমার সৎ নাকি অসৎ সাহস তা তুমি জানবে কেমন করে? বলো তো খুলে দেখাই?”

বেজায় ধৈর্যচ্যুত হলো সানা। ওর ইচ্ছা করল পায়ের হিলটা খুলে ধুপধাপ শারফানের পিঠের ওপর কতগুলো বসাতে আর নয়ত তার পশ্চাদ্দেশে জোরে একটা লাথি মেরে নদীতে ফেলে দিতে। কিন্তু ষাঁড়ের মতো এমন বিরাট দেহবিশিষ্ট লোকটাকে আঘাত করে বিপৎসীমার বাইরে যাওয়ারও তো ফুরসত পাবে না। আবার কথা যত বাড়াবে সে ততই যে শারফান বজ্জাতি করবে তাও বুঝতে পারল ভালোভাবেই। কোনোরকমে শান্ত হয়ে বলল‚ “আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই৷ আর যদি থাকতও আপনি জেনে ফেলায় আমার কিচ্ছু যায় আসত না আর আসবেও না৷”

“তাই না-কি? তা কী যেন নাম বলছিলে? পান্থ না শান্ত? পান্থ মনে হয়‚ না? আমি চাইলে এই নামটা থেকেই পোলার সমস্ত ঠিকুজিকোষ্ঠী বের করে ফেলতে পারি। কবে থেকে প্রেম করছ দুজন‚ আর কী কী করে বেড়িয়েছ দুজন—এসব ইনফরমেশনও আমি ঘণ্টাখানিকের মধ্যে জোগাড় করে প্রফেসরের কাছে সাবমিট করতে পারি। করব?” শেষে কথায় ভ্রুজোড়া নাচাল শারফান।

মনের মধ্যে সানার ভয় আর টেনশন কাজ করল বটে। কিন্তু অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল করেও নিজের ভয় প্রকাশ করল না সে। আর কোনো দুর্বলতার সুযোগও সে নিতে দেবে না তাকে। বরঞ্চ আত্মবিশ্বাসের উচ্চতা আরও বাড়াল৷ বলল নির্বিকার স্বরে‚ “বের করুন। যেখান থেকে খুশি সেখান থেকে ইনফরমেশন নিন। কোনো ইনফর্মার যদি এমন এভিডেন্স দেখাতে পারে আমরা যেখানে সেখানে প্রেম করেছি‚ তাহলে আমার সামনে দাঁড়িয়েই আপনি তা দেখাবেন আব্বুকে।”

“দুর্দান্ত কনফিডেন্স দেখছি”‚ ঠোঁক বাঁকাল শারফান। বিদ্রুপ সুরে বাহবা দিলো ওকে‚ “এত টাইট সিকিউরিটি নিয়ে ডেট করেছ? ওয়াহ্! ছেলেও নিশ্চয়ই এখানকারই?”

“ছেলে এখানকার হোক আর জাহান্নমের হোক—হু আর ইউ টু কুয়েশ্চন?” ধমকটা মেরে সানা দাঁড়াল না আর৷ কয়েক পা এগিয়ে আবার কী মনে করে যেন থমকাল। ফিরে তাকাল শারফানের দিকে। পকেটে হাত গুঁজে সে স্থির‚ শান্ত চোখে দেখছিল ওকেই।

“এটা নিয়েও যদি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার ফন্দি করেন”‚ চরম সাহসের সঙ্গে তাকে হুমকি দিলো সানা‚ “একদম টুঁটি চেপে ধরব আপনার।”

“কী চেপে ধরবে?” যেন ভারি বিস্মিত হলো শারফান। “নাগাল পাবে আমার টুঁটি ধারার?” বলতে বলতে এগোলো সানার কাছে।

“করুন আন্ডারস্টিমেট। যখন ধরব তখন তো দেখতেই পাবেন।”

“আমি এখনই দেখতে চাই”‚ বলে নিজেই একটু ঝুঁকল শারফান‚ “নাও‚ ধরো দেখি।”

রেগেমেগে হাতদুটো বাড়িয়েই দিয়েছিল সানা। গলাটা চেপে ধরার আগ মুহূর্তে নিজেদের স্থান বিবেচনা করে সামলাল নিজেকে। তা দেখে মুচকি হাসল শারফান। কাছে থাকায় দাড়ির ভিড়েও তখন তার গালের খাঁজদুটো স্পষ্ট দেখা গেল—সুন্দর লাগল হাসিটা। ঠিক এমন করেই হেসেছিল লোকটা নিশার সামনে। নিশারও নিশ্চয় ভালো লেগেছিল?

“সাহস হলো না বুঝি?” অমন হাসিটা নিয়েই বলে উঠল শারফান।

চিন্তার দৌড় থামল সানার। জবাব দেওয়ার সময় হঠাৎ পকেট থেকে শারফানকে ফোন বের করতে দেখে সতর্ক হলো সে‚ “এই খবরদার!” দ্রুত দূরে সরে এসে হুমকি দিলো‚ “ছবি টবি তুললে একদম বেইজ্জতি করে দেবো বললাম। লোকজন ডেকেডুকে বলে দেব বিনা অনুমতিতে আমার ছবি তুলেছেন।”

এমন কোনো চিন্তা আপাতত ছিল না শারফানের৷ সানার বোকামিতেই পরিকল্পনাটা এলো মাথায়—হেসে ফেলল সে। “এতক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে যার সঙ্গে কথা বলছ নিশ্চিন্তে৷ তাকে এমন চিজি বাহানায় ফাঁসাতে পারবে?”

কথা বলার সুযোগ দিলো না ওকে‚ “বললে যখন তখন তুলেই দেখি কী হয়।” তারপরই ফোনটা উঁচু করল শারফান ছবি তোলার ভঙ্গিমায়।

সানা চট করে ঘুরে দাঁড়াল। “একটা ছবি যদি ওঠে…”‚ প্রচণ্ড গম্ভীর হয়ে বলল‚ “আমি সরাসরি আপনার বাপের কাছে অভিযোগ করব‚ কসম।”

“হ্যাঁ? কার কাছে?” মুহূর্তেই কপালে ভাঁজ পড়ল শারফানের‚ “পুলিশের কথা বলতে গিয়ে ভুল করে আমার বাপের কথা বললে না-কি?”

কথাটা শুনে ফিরে তাকাল সানা। ওটা মুখ ফসকেই বলে ফেলেছে সে। কিন্তু শারফানের চেহারাটা দেখে ভ্রুকুটি হলো ওর। “ইবলিশের চ্যালাটা দেখি সিরিয়াস হয়ে গেছে”‚ মনে মনে ভাবল সে‚ “ভয় টয় পায় না-কি বাপকে?” ব্যাপারটা মনে হতেই অবাকও হলো একটু৷ পরক্ষণে মুখে হাসিও ফুটতে চাইলো ওর।

“পুলিশ তো ফাইনাল স্টেপ”‚ একদম গুরুগম্ভীর মুখ করে বলল সে‚ “সেখানে অভিযোগের আগে সেমি ফাইনাল স্টেপ হলো আপনার বাপ। আমি সিরিয়াসলি বলছি কিন্তু। এতদিন যা যা করেছেন তার সব কিছু জানাব আপনার বাপকে।”

“চুমু খেয়েছি কবে‚ কীভাবে সেটাও?”

“লুচ্চাআআআ”‚ চেঁচিয়ে উঠল সানা। এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না তারপর। আর শারফান তখন গা কাঁপিয়ে হাসতে থাকল।

বিকাল ৫: ২০ মিনিট।
বাসার ভেতর আর ঢোকার প্রয়োজন পড়েনি সানার৷ সবাই গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে৷ কেউ কেউ আগেভাগে সিটও দখল করে বসে পড়েছে। দিনাকে গাড়িতে ওঠানো হলেই সবাই উঠে পড়বে।

মেহাকে দেখা গেল জারার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করেই চলেছে। তার কাছে সানা এগোনোর পথে হঠাৎ পেছন থেকে নিশার ডাক পড়ল। ওর কাছে এসে খুব সাবধানী গলায় বলল সে‚ “তুই একটা হেল্প করবি আমার।”

“কী হেল্প?”

পার্স থেকে সে ভাঁজ করা একটা টিস্যু বের করল। সেটা ওর হাতে গুঁজে দিলো হঠাৎ‚ “প্লিজ না করবি না। এই টিস্যুটা ওই যে…”‚ চোখের ইশারায় শারফানকে দেখিয়ে বলল‚ “ওনার কাছে দিবি এটা বলে ‘নিশা দিয়েছে’। পারবি না?”

বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অনির সঙ্গে কথা বলছে শারফান। সানা আর নিশাকে কিছুটা আড়াল করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা। তাই ওদেরকে চোখে পড়েনি শারফানের।

সেদিকে চেয়ে হতাশার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সানা। “অলওয়েজ আমিই কেন? কেন‚ বাল?” বিড়বিড়িয়ে উঠল সে।

“কী বললি?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিশার।

নিরীহ চেহারা করে ফিরে তাকাল সানা‚ “সে বর্তমান তোর ভাইয়ের টপ লিস্টেড শত্রু। তার সঙ্গে…? সিরিয়াসলি ক্যামনে?”

বছর দুয়ের বড়ো নিশা সানার থেকে। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই ওর প্রতি নিশার মারাত্মক ঈর্ষাপরায়ণ কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে শ্রদ্ধা ভরে আপু ডাকা ত্যাগ করেছে সে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। এ নিয়ে কম কথাও শুনতে হয়নি অবশ্য তাদের দু বোনের থেকে।

“শোন‚ অ্যাডভান্স বুঝিসনে। এই কথা আমার মাথায়ও আছে৷ খাবার টেবিলে খেয়াল করছিলি ও আমারে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছিল?”

উত্তর দিলো না সানা। ওই মুহূর্ত মনে পড়তেই শারফানের ওপর রাগ আরও প্রকট হলো ওর।

“ওরে যদি জালে ফাঁসাতে পারি তাইলে ভাইয়ার জন্য আরও সুবিধা হবে‚ বুঝছিস? এজন্যেই নিজেই দু পা বাড়াচ্ছি। যেহেতু সে এক পা আগাইছে।”

“একেই বলে একই ছাঁচ”‚ মনে মনে বলে উঠল সানা‚ “ক্রিমিনালের বোন ক্রিমিনাল।”

ওকে চুপ থাকতে দেখে নিশা নরম হলো বেশ‚ “প্লিজ কাউরে বলবি না। তুই খুব ভরসা যোগ্য আর বিশ্বস্ত বলেই তোর কাছে হেল্প চাইছি। দে না একটু হেল্পটা করে!”

কৃত্রিম হাসি ফোটাল সানা। টিস্যুটা নিশার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল‚ “ওই লোক আমাকে সহ্যই করতে পারে না। তাই নিজের কাজ তুই নিজের কর‚ ঠিক আছে?” চলে এলো তারপর সেখান থেকে৷ আর কোথাও দাঁড়াল না৷ নির্ধারিত গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল জানালার ধারে।

দিনাও বেরিয়ে এসেছে। সবাই গাড়িতে উঠছে একে একে। গ্রামবাসী এর মাঝে এসে ভিড় জমিয়েছে নতুন বউ আর বউয়ের বাড়ির মানুষদের দেখার জন্য। ঠিক এই সুযোগে শারফান আর নিশা পাশাপাশি হলো৷

সাদ্দামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল শারফান ভিড়ের মধ্যে। নিশা তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ধীর স্বরে ‘হ্যালো’ বলে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। তবে ওই মুহূর্তে শারফানের চোখদুটো চারপাশে ঘুরছিল। খুঁজছিল বোধ হয় সানাকে৷ ওকে দেখেনি সে গাড়িতে উঠতে৷ নিশার ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে খুবই সাবধানে তার হাতের মাঝে টিস্যুটা দিয়েই সে চলে গেল নিজেদের গাড়ির কাছে। সাদ্দাম বেকবুের মতো চেয়ে সবটাই দেখল চুপচাপ।

হাতের মুঠোয় থাকা টিস্যুটা এক নজর দেখে তাকাল শারফান নিশার দিকে৷ গাড়িতে ওঠেনি তখনো সে। ওর থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ও তাকানো মাত্রই সে মুচকি হাসল সবার অগোচরে। জবাবে ঠোঁটের কোন বাঁকিয়ে হাসল শারফানও৷ তা দেখে নিশার চোখে-মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ল যেন চতুর্গুণ৷ সে বাস্তবিকই ওকে পছন্দ করে ফেলেছে। তার মনের বাসনা সানাকে বলা কথার সম্পূর্ণ উলটোটাই। শারফানকে যদি দুর্বল করতে পারে তবে ভাইয়ের সঙ্গে শত্রুতা বন্ধ করে সন্ধি করার ব্যবস্থাটাই করবে সে।

***

এবার যেন শীতটা সহজে বিদায় নিতে চাচ্ছে না৷ রাত ফুরোলেই জানুয়ারি বিদায় নেবে৷ কিন্তু ফেব্রুয়ারিরও প্রায় পুরোটাই শীত থাকবে—এ কথা মনে হলেই সানার বিরক্ত লাগছে ভীষণ৷ গায়ের মধ্যে দু-তিনটা কাপড় ঢুকিয়ে আরও কতদিন ঘুরে বেড়াতে হবে! ওর অবশ্য এ মুহূর্তে সবেতেই বিরক্ত লাগছে। পরনের কাপড়টা পালটাতে বিরক্ত লাগছে‚ হাত-মুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে যেতেও বিরক্ত লাগছে‚ গরম কাপড় পরতেও বিরক্ত লাগছে।

মেহা তো আসা মাত্রই ঘুম৷ মোস্তফা সাহেবও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বেরিয়েছেন৷ আর নাজমা বেগম জাকে সাহায্য করতে নেমেছেন দিনার বাড়িতে। ফিরবেন একটু রাত করেই৷ বৃদ্ধা জোহরা বেগম আবার চলে এসেছেন এখানে। তার নিরিবিলি‚ হইচইশূন্য পরিবেশ পছন্দ৷ বাসায় ফিরে নিজের বরাদ্দকৃত ঘরে আরামে দু পা মেলে বসে পান ছেঁচছেন৷ অথচ সানাই কেবল যেমন বেশে ছিল তেমনই আছে৷ আসার পর কতক্ষণ গুম হয়ে বসে ছিল বিছানায়। এখন সে ঘর জুড়ে পায়চারি করছে—মাথায় গভীর এক চিন্তা নিয়ে। এই চিন্তার শুরু হয়েছে গাড়িতে থাকতেই। এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে এখনই। জারার কাছ থেকে মেহা ওর কথামতো ছলচাতুরী করে শাফিউল সাহেবের ব্যক্তিগত নাম্বারটা চেয়ে নিয়ে এসেছে। এই নাম্বারটাই এখন ওর ফোনের ডায়াল প্যাডে। কল দেওয়ার আগে ভালোভাবে চিন্তা করে নিচ্ছে কীভাবে নিজের নাম‚ পরিচয় আড়াল করে ঠিক কী কী বলবে তাকে।

কিন্তু একা একা কাজটা করতে সাহসে কুলোচ্ছে না ওর৷ ছুটে গেল বিছানার কাছে। মেহাকে ঠেলাঠেলি করল জাগার জন্য। জাগাতে না পেরে তাকে টেনে ধরে বসাল‚ “বেয়াদব‚ জলদি ওঠ৷ নয়ত হরর মুভিটা মিস করবি।”

হরর সিনেমা ভারি পছন্দের মেহার। চোখজোড়া ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল‚ “কত বাজে?”

“বাজে রাত সাড়ে সাতটা। চোখ খুলে তাকা আমার দিকে”‚ বলে নিজেই মেহার মুখটা ধরে ফেরাল সানা‚ “আমি জারার বাপকে কল করব এখন‚ বুঝলি? নালিশ করব শায়াফ হারামির নামে।”

আঁতকে উঠল মেহা‚ “কী!” ঘুম একদম উবে গেল তার।

“হ্যাঁ‚ সত্যি। কী বলব সব ভাবা শেষ। তুই চুপচাপ বসে সব শুনবি শুধু।”

বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল মেহা তার ভীতু বোনের দিকে৷ বিশ্বাসই করতে পারছে না সে ওর কথা। কিন্তু সানা তাকে অবিশ্বাস করে থাকার সুযোগ দিলো না বেশিক্ষণ। কল ঢুকেছে শাফিউল সাহেবের নাম্বারে৷ তা দেখে ওদের দুজনেরই বুকের মধ্যে ডামাডোল শুরু হয়ে গেল। সানার হাতের তালু রীতিমতো ঘেমে একাকার। এমনকি ওর ফোন ধরা হাতটাকে কাঁপতে পর্যন্ত দেখল মেহা। তবুও ওকে জেদি সিদ্ধান্তটা থেকে নড়তে দেখা গেল না।

রিসিভ হলো কল। সেকেন্ড ওঠা শুরু হতেই সানা কথা বলল‚ “হ্যালো? আসসালামু আলাইকুম।” চেষ্টা করল ওর মিহি গলাটাকে আরও মৃদুস্বরে করার। কিন্তু সেই চেষ্টা বৃথায় গেল অবশ্য।

“ওয়ালাইকুমুসালাম”‚ স্বভাবজাত ভারী গলায় জবাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শাফিউল‚ “কে বলছেন?” যদিও কণ্ঠটা তার কাছে বাচ্চা বাচ্চা শোনাল। কিন্তু অপরিচিত বিধায় তুমি সম্বোধনে গেল না।

কানটা ফোনের কাছে এগিয়ে নেওয়া মেহার। শাফিউল সাহেবের গলা শুনেই বুকটা চেপে ধরে সে সরে এলো আর ভীত চেহারায় ইশারা করে বোনকে বোঝাল‚ “কল কেটে দে রে। কাট তাড়াতাড়ি। সময় আছে এখনো।”

হাত-পায়ের কাঁপুনি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে সানার। কিন্তু তাও শুনল না মেহার কথা৷ বলল ধীরে ধীরে‚ “আমি খুবই দুঃখিত‚ আঙ্কেল। এভাবে কল করে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য৷ আর নিজের পরিচয়টা আমি সরাসরি দিতে পারছি না বলেও দুঃখিত। কিন্তু আমি ফরিদপুরেরই মানুষ। যে এলাকাতে আপনার বাড়ি ভাড়া দেওয়া আমি সেই এলাকারই মানুষ। খুব বিপদে পড়ে আপনাকে আসলে কল করেছি। আশা করছি‚ আঙ্কেল‚ আমার সমস্যাটা বুঝবেন আপনি।”

ইতোমধ্যে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে শাফিউলের৷ সামনে কাজের কতগুলো ফাইল জমা হয়ে আছে এই মুহূর্তে। একটু বিরতি নিতেই ফোনটা হাতে নিয়ে বাসায় কথা বলতে চাচ্ছিলেন সবে। এমন সময় এরকম উদ্ভট একটা কল ঢুকল ফোনে। সানার কথা শুনতে শুনতে বিরক্তই হলেন তাই৷ অধিকন্তু নাম পরিচয়ও জানাবে না বলছে। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর আর ধীর সুরের কথা বলার ভঙ্গিমার জন্যই পারলেন না ধমকটা দিতে। “শুনে দেখি তোমার সমস্যাটা আগে”‚ নির্দ্বিধায় তুমিতে নেমে এলেন তিনি এবার‚ “দেখি বুঝি কিনা। কিন্তু পরিচয় কেন দিতে পারবে না আগে সেটা বলো।”

“জড়তা-সঙ্কোচ থেকে‚ আঙ্কেল৷ এর জন্য আমি মাফ চাচ্ছি”‚ চোখ-মুখ খিঁচে একটানা বলে গেল সানা‚ “আমি আপনার ছেলে শায়াফকে নিয়ে কিছু অভিযোগ জানাব…”

সেই শুরুর দিন থেকে আজকের দিন অবধি শারফানের প্রায় সমস্ত কর্মকাণ্ডের কথা জানিয়ে দিলো সানা৷ শুধু নির্বাচনের দিনে ওর সঙ্গে করা শারফানের অসভ্যতার কথাগুলো বলতে গিয়েই কবার থামল৷ শেষমেশ লজ্জায় সে কথা মুখে আনার মতো ক্ষমতা ওর হলো না। কেবল বলল‚ “হি অলসো অ্যাসলটেড মি।”

চুপচাপ কথাগুলো শুনতে শুনতে ঠিক এ পর্যায়ে এসে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলেন শাফিউল। বললেন‚ “নাম পরিচয় ছাড়া আমি তোমার সব কথা শুনে বিশ্বাস করে নিলেও এ কথায় এসে প্রশ্নবিদ্ধ না করে যে পারছি না। ওর দ্বারা তুমি অ্যাসলটেড হলে এতদিন বাদে কেন আমাকে অভিযোগ করছ? তাছাড়া তোমার তো তাহলে উচিত ছিল তোমার বাবা-মায়ের মাধ্যমে আমাকে বিচার দেওয়া। কারণ‚ তুমি যে ব্লেইমটা করছ শায়াফকে নিয়ে সেটা কিন্তু মোটেও ছোটোখাটো কোনো ঘটনা নয়। এবং আমাকে জানতেও হবে কতখানি ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে ও তোমাকে৷ কথাগুলো ভীষণ সেন্সিটিভ জানি৷ তবুও আমাকে বিশ্বাস করতে হলে ডিটেইলস তো জানতেই হবে।”

হাঁসফাঁস লাগল সানার৷ মেহা তো বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে ওকে সমানে বকে যাচ্ছে। ঘাড়টা ডলতে ডলতে সানা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বলল রয়ে সয়ে‚ “বারো তারিখে সকাল বেলা উনি আর রিহান আমার বাসায় আসেন হঠাৎ৷ এসে নিজের অন্যায়ের জন্য ক্ষমাও চান। এজন্যই তখন ভাবিনি আপনাকে জানানোর ব্যাপারে। তাছাড়া ভেবেছিলাম আর আমাকে বিরক্ত করবেন না উনি৷ কিন্তু আজ আবার সেই আগের মতো আমাকে টিজ করেছেন। আমি আমার আব্বু-আম্মুকে এসব জানিয়ে টেনশনের চাপ দিতে চাইনি আর সাহসও পাইনি আসলে৷ তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাপারটা আপনাকে জানাই। আপনি যদি কোনো স্টেপ নেন এ ব্যাপারে তাহলে আর আব্বু-আম্মুকে জানাতে হবে না৷ জানালে দেখা যাবে সত্যি সত্যিই আব্বু আপনার কাছে বিচার জানাবেন। ব্যাপারটা আরও বড়ো পর্যায়ে যাবে তাতে।”

নিজের বাবা-মাকে এতদিনে কিছুই না জানিয়ে সরাসরি আজ তাকে জানানোর কথাটাই বেশ ঘাপলা পেলেন শাফিউল৷ কিন্তু তা নিয়ে কিছু বললেন না একটা কারণবশত। এমনকি তিনি যে সানার নাম না জানলেও সানার বাবার পরিচয় বুঝে গেছেন তাও প্রকাশ করলেন না৷ বরঞ্চ সানাকে অবাক করে দিয়ে বললেন‚ “নিশ্চয়ই স্টেপ নেব আমি৷ আপাতত তোমার বাবা-মাকে কিছু জানিয়ো না। আমি আগে দেখছি বিষয়টা‚ ঠিক আছে? এখন বলো‚ আরও কিছু বাকি আছে অভিযোগ? আর কী কী করেছে ও?”

“থ্যাঙ্ক ইউ‚ আঙ্কেল৷ সবটাই জানিয়েছি আমি৷ আর কিছু বলার নেই।”

“ও.কে। রাখতে পারো তাহলে।”

বিদায় বাক্যে দ্রুত সালাম জানিয়ে কলটা কাটল সানা। বুকের বাঁ পাশে হাতটা চেপে ধরতেই টের পেল কী অস্থির গতিতে হৃৎপিণ্ডটা কাঁপছে ওর।

মেহা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো‚ “তুই কীভাবে পারলি‚ আপু‚ এত কথা অনায়াসেই বলে দিতে? আর নির্বাচনের দিন ওই সন্ত্রাসটা কী করেছিল তোর সাথে? আমাকে বলিসনি কেন?”

“কারণ‚ রাগের মাথায় তুই বলে দিতি আম্মুকে”‚ ফোনটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল সানা‚ “ফ্রেশ হয়ে আসি আগে৷ তারপর সব বলছি।”

***

মেয়েলি ব্যাপারে প্রথম নালিশ পেয়েছিলেন শাফিউল সাহেব যখন ক্লাস টেনে পড়ে শারফান৷ গালে থাপ্পরের দাগ নিয়ে মেয়ে বাবা-মাকে সঙ্গে করে বাড়ি বয়ে এসে সেই নালিশ দিয়ে গিয়েছিল৷ তার ছেলের এক থাপ্পরেই নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। সেদিন সন্ধ্যার পর শারফান বাড়ি ফিরেছিল গায়ে কতগুলো আঘাতের চিহ্ন নিয়ে। সেই আঘাতগুলো দেখেই রাগ পড়ে গিয়েছিল শাফিউলের৷ ছেলেকে জেরা করে জানতে পারেন ছেলের প্রথম প্রেম তোয়ার বিষয়ে৷ থাপ্পরের প্রতিশোধ নিতে আবার এসেছিল তোয়ার কলেজ পড়ুয়া চাচাতো ভাই‚ সঙ্গে দুজন বন্ধু নিয়ে। শারফান একা ছিল না৷ সাথে ছিল সাদ্দাম আর সোহানও৷ ছজনের মাঝে মারামারি শুরু হলে শারফানের বিপজ্জনক একেক ঘুসি আর লাথির জন্যই তাদেরকে সহজে ধরাশায়ী করে ফেলেছিল সাদ্দাম‚ সোহান।

নালিশও করল আবার ছেলেকে মারতেও পাঠাল মেয়েটা। এ কারণেই কঠিন বিচার থেকে সেদিন ওকে মুক্তি দিয়েছিলেন শাফিউল। এরপর যে আর কখনো মেয়েলি বিষয়ে অভিযোগ আসেনি তা নয়৷ তবে সেটা স্কুল‚ কলেজ‚ ভার্সিটি থাকাকালীন নয়৷ যখন ছেলেকে ব্যাবসাতে ঢোকালেন তার পর থেকে অভিযোগ পেতে শুরু করলেন। সেসব অভিযোগকারী মেয়েগুলো অবশ্য সানার মতো এমন হয়রানি হয়নি। তারা শারফানের সঙ্গে যুক্ত ছিল হয় ব্যাবসায়িক মারফতে‚ নয়ত রাজনৈতিক আর নয়ত অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে। তাদের অভিযোগ নিয়ে বিচার করতে গিয়ে দেখা যেত স্বভাব‚ চরিত্রে কেউ-ই সু্বিধার নয়। আবার কেউ কেউ তার ছেলেকে নিজেদের জালে আটকাতে না পেরেই রাগে-ক্ষোভে মরিয়া হয়ে উঠত ওকে নানানভাবে ফাঁসানোর। এদের জন্য আর যার তার সঙ্গে মারামারি‚ শত্রুতা সৃষ্টি করার জন্যই ওকে বারবার পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তা সামাল দিতে দিতে ক্লান্তও শাফিউল৷ কিন্তু আজকের অভিযোগ তাকে অন্যরকম চিন্তায় ডুবাল। চোখের সামনেই ছেলেকে অফিসের কম বয়সী‚ বেশি বয়সী‚ সুন্দর‚ অসুন্দর‚ সকল নারী কর্মীদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে দেখেছেন। কিন্তু তা নিয়ে কেউ কোনোদিন অভিযোগ করতে আসেনি৷ কারণ‚ ছেলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা হচ্ছে বন্ধুসুলভ। আর ওর ওসব ফ্লার্ট ছিল ওই অফিস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাইরে যাদের সঙ্গে যেটুকু যা করে তার হদিস তিনি সবটা না পেলেও অন্তত এটুকু জানেন‚ ছেলের চরিত্র একেবারে ঢিলে নয়৷ যদি তার জানার বাইরে ঘনিষ্ঠতা কারও সঙ্গে হয়েও থাকে‚ তবে সেটা সেই মেয়েটির অসম্মতিতে নয় নিশ্চয়ই—এ তার ছেলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস৷ সেই ক্লাস টেনের ঘটনার পর থেকেই মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে ছেলেকে সব সময় বোঝাতে চেষ্টা করেছেন সংযত থাকতে‚ মেয়েদের প্রতি কঠোর না হতে‚ তাদের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে আর সব চেয়ে কড়াকড়ি হয়েছেন যেন চরিত্রের শুদ্ধতা ধরে রাখে ছেলেটা৷ সত্যি বলতে বদমাশ ছেলে তার সেসব জ্ঞান কানে তুলতে দেরি করলেও কান থেকে বের করে দিতে দেরি করেনি৷ তাই বলে সবটাই অমান্য করেনি তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন৷ যেসব মেয়ে ওকে ফাঁসাতে চেষ্টা করেছে বহুভাবে‚ তারা আগে চেষ্টা করেছে ওর চরিত্রকে দোষারোপ করার৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে দোষটা তাদের চরিত্রের ওপর গিয়েই পড়েছে। কত শত্রু খুঁজতে চেষ্টাও করেছে ওর স্ক্যান্ডাল। কিন্তু যা ওর জীবনে নেই তা কেউ পাবেই বা কীভাবে? অথচ আজ শাফিউল সাহেব যতখানি হতাশ হয়েছেন ততখানি অবাকও হয়েছেন।

ভাবনাচিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে কল দিলেন রিহানকে। ওয়েটিং দেখালেও গুরুত্ব দিলেন না তিনি৷ রিহানও রিসিভ করতে খুব বেশি সময় নিলো না‚ “হ্যাঁ‚ মামা? কেমন আছেন?”

“ওই মেয়ের নাম কী?” গম্ভীর গলায় আরও গম্ভীরতা শাফিউলের।

“কোন মেয়ে‚ মামা?” থতমত গলায় জিজ্ঞেস করল রিহান৷ কারণ‚ এই মুহূর্তে ফোনে ছিল ওর তথাকথিত তিন নাম্বার প্রেমিকা৷ বোকার মতো তাই ভেবে বসল তারই কথা জিজ্ঞেস করছে মামা।

“যে মেয়েকে তোর ভাই আড়াইটা মাস ধরে অতিষ্ঠ করে ফেলেছে রাত-দিন বিরক্ত করে করে। প্রফেসর মোস্তফার মেয়ে‚ তাই না? নাম কী ওর?”

জিভের ডগায় কামড় বসাল রিহান। “মামা শালাকে জানাল কোন শালায়?” মনে মনে বলে উঠে চিন্তায় পড়ল কতটুকু জানানো ঠিক হবে মামাকে।

“এই চোরের শাগরেদ”‚ ধমকে উঠলেন শাফিউল‚ “চুপ করে আছিস কেন? কথা বল। কিচ্ছু গোপন করবি না কিন্তু৷ সব জানি আমি ও কী কী করেছে মেয়েটার সাথে।”

কানের পর্দা যেন সামান্যর জন্য বাঁচল ওর—এত জোরে ধমক লাগিয়েছেন শাফিউল! সব জানেন যেহেতু বলছেন তিনি‚ তার মানে সত্যিই সব জানেন৷ তাহলে আর গোপন করার প্রশ্নই আসে না৷ নয়ত ছেঁচা‚ গুঁতো তার নসিবেও কম পড়বে না। “মেয়েটার নাম”‚ গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সে বলল‚ “সানা। মোস্তফা আঙ্কেলেরই মেয়ে… বড়ো মেয়ে আরকি।”

“অমানুষ‚ জানোয়ারটা আমার ইজ্জত‚ সম্মান‚ টাকা‚ সব না খাওয়া পর্যন্ত থামবে না। অ্যাক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটিয়ে নিয়েও ওর শয়তানি কমে না? নির্বাচনের দিন ওই মেয়ের সঙ্গে কী করেছে ও? সত্যি করে বলবি কিন্তু‚ রিহান। নয়ত তোকে নিয়ে তোর বাপের সাথে বসে বোঝাপড়া করব বলে দিলাম।”

“মামা‚ আপনি মাথা ঠান্ডা করেন৷ আমি বলছি… সব বলছি আপনাকে। ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি।”

“তুই সরাসরি বল ও কী করেছে সেদিন?”

“ওই মানে… একটু আরকি”‚ সানার মতোই রিহানও লজ্জায় পড়ে তোতলাল‚ “মানে একটু… একটু আধটু ধরে… ধরে জোর করে… ধরে ফেলেছিল সানাকে৷”

“ঠিক করে কথা বল!”

দ্বিতীয দফার ধমক খেয়েই রিহান ফট করে বলে দিলো‚ “ভুল করে দুইবার চুমু খেয়ে ফেলেছিল‚ মামা।”

বিব্রত হয়ে পড়লেন শাফিউল। “চোপ! হারামজাদা”‚ শেষ দফায় ধমকটা দিয়ে দ্রুত কলটা কাটলেন।

রিহান যদি একবার অস্বীকার করত এই কথাটা তাহলে সত্যিই তিনি বিশ্বাস করে নিতেন তা। এই একটা কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্যই তো কল করলেন।

কিন্তু মাথা গরম করলেন না আর৷ সানার কথাগুলো মস্তিষ্কে পুনর্বার ঘোরালেন। ছেলের জীবনে এটাই প্রথম মামলা—যেখানে টাকা ছাড়া‚ কোনো স্বার্থ ছাড়া একটা মেয়ের পিছে অকারণে সময় দিচ্ছে। সেটা যদিও ভালো পন্থায় না৷ কারণ‚ ছেলেটাই তো ভালো না৷ তার কাজের পন্থা আর ভালো হবে কী করে? এই যে জোরাজুরি করে মেয়েটাকে চুমু খাওয়ার ঘটনা‚ এটা নিয়ে ভাবা তার জন্য যতই অস্বস্তিদায়ক হোক। তাও না ভেবে পারছেন না তিনি৷ ফরিদপুর থেকে ঢাকা‚ ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য জেলা‚ কোথাও ছেলের বন্ধুর কমতি নেই৷ কাছের বন্ধুও হাতে গুণে শেষ করা যাবে না৷ এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে বাধ্য হয়েছেন তিনি৷ তার একমাত্র সুপুত্রের গুনের শেষ নেই কিনা! কিন্তু এরাও যথেষ্ট জানে শারফানকে। তাদের মুখেও তো কোনোদিন এমন সাংঘাতিক মেয়েঘটিত ঘটনা শোনেননি! আর সব থেকে অবাকের বিষয় যে‚ ছেলে আবার মাফ পর্যন্ত চাইতে গিয়েছিল সরাসরি মেয়ের বাড়িতে! সেদিন রিহানকে অবশ্য জেরা করেছিলেন তিনি‚ কেন গিয়েছিল ওরা মোস্তফা সাহেবের বাড়িতে? রিহান যে আধা সত্য আর আধা মিথ্যা বলেছিল তা আজ টের পেলেন। ভাবনাচিন্তার অঙ্ক কষে হিসাব যা মেলালেন তাতে না খুশি হতে পারলেন আর না অখুশিও হলেন৷ কিন্তু একটু বাজিয়ে দেখা দরকার ছেলেটাকে। তাই ফোন লাগালেন শারফানকে।

জোবেদা খালার কান্নাকাটি শুনে ভীষণ মনে পড়ছিল বাপ্পিকে। তাই বাপ্পির বন্ধ দোকানটার সামনে এসে বসেছে শারফান। সাথে রিপনসহ আরও দু-তিনজন। গল্প চলছিল ওদের। বাবার কল দেখেই কলটা রিসিভ করল সে‚ “বলো। এত ঘনঘন তো মাদারকেও স্মরণ করো না মনে হয়।”

“তোর মাদার কি তোর মতো আমার ধনসম্পদ‚ ইজ্জত লুটেপুটে খাচ্ছে? খাচ্ছে আল্লাহর কাছ থেকে ডেকেডুকে‚ চেয়ে আনা তার ইতরটা। স্মরণ তো তাই তাকেই করতে হয় ঘনঘন।”

“শোনো‚ দরকারি কথাবার্তা না থাকলে আমাকে ফোন টোন দেবে না। এসব আজাইরা প্যানপ্যানি শোনার জন্য বসে থাকি না”‚ কাঠখোট্টাভাবে বলল শারফান।

“পাছার ছাল উঠিয়ে ফেলব একদম‚ খাচ্চর!” ধমক শেষে বললেন‚ “তোকে বখাটেপনা করার জন্য খাইয়ে‚ পরিয়ে মানুষ করেছি আমি? বদমাশ! তোর বখাটেগিরি জন্য যদি ফারদার আমার কাছে কমপ্লেইন জানায় মেয়েটা‚ তাহলে সোজা একেবারে বিয়ে পড়িয়ে তোর ঘরে তুলব ওকে।”

বসে পায়ের ওপর আরেক পা তুলে নাচাতে নাচাতে সিগারেট ফুঁকছিল শারফান। কথাটা শোনার পরই পা নাচানো থেমে গেল‚ “কমপ্লেইন করেছে মানে? কোন মেয়ে কমপ্লেইন করেছে? কীসের কমপ্লেইন?”

“ক বললে কলকাতা বোঝা চিজ তুমি। নাটক কোরো না আর! রাস্তাঘাটে‚ গাড়িতে তুলে‚ যেখানে সেখানে মেয়েটাকে যদি আর উত্ত্যক্ত করো তাহলে আমার সম্মান বাঁচানোর তাগিদে তাকেই আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আসতে হবে। কথাটা মাথায় রেখো। টাকার ছাড় দিচ্ছি বলে ভেবে নিয়ো না আমার সম্মানের বেলায়ও ছাড় দেব। আর বিয়ের বয়সও হচ্ছে যেহেতু। তাহলে বলো‚ কথাবার্তা বলে আসি ওদের বাড়িতে।”

“তোমার বাপকে কবর থেকে তুলে এনে বিয়ে করাও”‚ ধমকে উঠেই খট করে কলটা কেটে দিলো শারফান।

বিভ্রান্তে পড়ে গেলেন শাফিউল সাহেব৷ তিনি ভেবেছিলেন বাঁকাভাবে হলেও শারফান সায় দেবে হয়তো বিয়ের কথায়। কিন্তু বিয়ের কথা শোনার পর প্রতিবারই এটাই হয় ওর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কোনোভাবেই সে বিয়ে‚ সংসারের কথা শুনতে পারে না৷

“ও সত্যি সত্যিই কমপ্লেইন করল আব্বুকে!” পুরো তাজ্জব বনে গেছে শারফান।

“কে কমপ্লেইন করেছে?” জিজ্ঞেস করল রিপন‚ “আর কী নিয়ে করেছে?”

জবাব দেওয়ার আগেই আবার কল এলো শারফানের ফোনে৷ রিহানের কল এবার৷ রিসিভ করল কলটা‚ “বল।”

“এই বাটপার‚ তোর লীলা কীর্তির কথা তো মামা জেনে গেছে।”

“সানা নাকি কমপ্লেইন দিয়েছে তোর মামাকে।”

“কীহ্! সত্যি?”

“হুঁ‚ সাহসটা দেখলি? মন্দ লাগল না অবশ্য।”

“তোর তো ওর সবই মজা লাগে। কিন্তু তুই আবার কী করেছিস যে ও ডিরেক্ট তোর বাপকে নালিশ করে বসল?”

রিপনদের থেকে হঠাৎ বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল সে। “করার আগেই নালিশ করে দিয়েছে”‚ বলল রগড় গলায়‚ “চেয়েছিলাম তো কত কিছুই করতে।”

“কুইত্ত্যার ল্যাজ কি আর ইহ জিন্দেগীতে সোজা হয়?”

“ধলা কুত্তার ছা‚ তোর বা* টেনে সোজা করে দিচ্ছি। আয় আবার।”

“আমার বা* সোজা‚ বাঁকা করার দায়িত্ব তোকে দিয়েছি‚ লুইচ্চার জাত লুইচ্চা? বাইসেক্সুয়াল শালা!”

“চাপার দাঁত সব খসিয়ে দেবো কিন্তু!”

“দেওয়া তো দরকার তোর। তুই আবার ওর পিছে পড়লি কেন? আর পড়ার সময় লজ্জা করল না? সেদিন ওর বাড়ি গিয়ে কী বড়ো বড়ো বক্তৃতা ঝেড়ে আসলি!”

“বক্তৃতায় কি এটা বলেছিলাম পিছে আর পড়ব না?”

“শায়াফ”‚ গম্ভীর স্বর শোনাল এবার রিহানের‚ “তুই কী চাচ্ছিস তা কি তুই জানিস? মানে নিজে বুঝছিস তো কেন ঘুরেফিরে বারবার সানার পিছেই পড়ছিস তুই?”

“ইয়া”‚ মুচকি হেসে বলল শারফান‚ “আই অ্যাকচুয়ালি ইনজয় টিজিং হার। অ্যাক্সিডেন্টের পর এতগুলো দিনে আজকে আমার কী যে আরাম লাগছে!”

চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিহান৷ কথা আর এগোলো না এ প্রসঙ্গে৷ জিজ্ঞেস করল‚ “মামা কী বলে ঝাড়ল তোকে?”

“কী আর বলবে? যা বলে সব সময়‚ তাই৷ বিয়ে করিয়ে দিতে চাইলো ওর সাথে।”

“এই মামা শালাটাকে এইজন্যই এত পছন্দ আমার। এক্কেরে ঠিক জায়গায় টোকা দিয়েছে। করে ফেল। করে আমাকেও করিয়ে দে মেহার সাথে।”

“জনমের বিয়ে পড়াব সবগুলোকে। রাখ ফোন”‚ ধমক লাগাল শারফান। কলটা কেটে দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল তারপর। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চিন্তা করে নিল কাল সানা নামের মুরগিটাকে আরেকবার খাঁচায় পুরবে না-কি ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দেবে।

শারফানকে কিছুটা সময় নিয়ে ভাবার আহ্বান রইল পাঠকদের কাছে। শুধু পড়েই যাবেন না৷ ভেবে দেখুন সে প্রেমিকা বানিয়ে প্রেমিক বনে যাওয়ার মতো পুরুষ কি-না! প্রেম বিষয়টা ওর সঙ্গে যায় কি-না! এটাও ভাবুন‚ সে তুলে নিয়ে বিয়ে করার মতোও পুরুষ কি-না! ওর রাগ‚ ওর চিন্তাভাবনার ধরন‚ ওর একরোখা স্বভাব‚ ওর মনটাই বা কতখানি কঠিন বা নরম‚ এসবও ভেবে দেখুন। উপন্যাসের মূল বা প্রধান কেন্দ্রবিন্দু সে-ই। একটু ভাবলেই বুঝে যাবেন ওর ব্যক্তিরূপকে।

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩০.

হাত ঘড়িতে সময়টা দেখল সানা—চারটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে দেখবে। এর মাঝে অনি না ফিরলে চলে যাবে সে। কী একটা কাজে নাকি বেরিয়েছে। ওদেরকে অপেক্ষা করার কথা বলে গেছে রিয়ার কাছে। আধা ঘন্টা হলো বসে অপেক্ষা করছে সানা।

মুঠো ভর্তি বরই নিয়ে ঘরে ঢুকল রিয়া। সানাকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল‚ “ওরা সবাই ছাদে যাচ্ছে বরই পাড়তে। চল‚ আমরাও যাই।”

“না”‚ বরই ফিরিয়ে দিলো সানা‚ “আরেকটু বসব। অনি ভাই না এলে বাসায় চলে যাব।”

“ঠিক আছে‚ যাস”‚ বলতে বলতে ওর পাশে বসল রিয়া। “কিন্তু আমার সঙ্গে ঠিক করে কথা বল একটু। আমি তো স্যরি বললাম না-কি? ওই বেয়াদব ছেমরা যে তুই থাকতেও ডজন ডজন মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করে‚ কথা বলে‚ ডেটও করে। আবার তোকেও লিস্টে রেখে প্রেমিকার সিরিয়াল লম্বা দেখাতে চায়। এর জন্যই সান্ত্বনার নামে একটু অপমান করছিলাম। তুই খুশি না হয়ে উলটে রাগারাগি করলি আমারে।”

“এটা থেকেও বেশি রাগ হয়েছে তুই আমার আড়ালে আমার ইনবক্স চেক করেছিস‚ রিয়া। এই কাজ মেহা করলেও আমি রিয়্যাক্ট করতাম।”

“স্যরি বলছি তো‚ আপা। মনের শয়তানির ঠেলায় ভুল করে ফেলছি। মাফ করে দে না রে‚ বোন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বরই তুলে নিলো সে রিয়ার হাত থেকে৷ অর্থাৎ ক্ষমা মঞ্জুর করল—হাসল রিয়া। বরইগুলো টক আবার মিষ্টিও৷ নুন মেখে খেতে দারুণ লাগছে৷ খেতে খেতে রিয়া গল্প চালাল৷ কিন্তু সানাকে দেখাল কিছুটা চিন্তান্বিত। গতকালের কাণ্ডটা ঝোঁকের বশে করে ফেলার পর আজ সকাল থেকে বুঝতে পারছে‚ সাহসটা একটু বেশিই দেখিয়ে ফেলেছে কাল৷ তার জন্য অবশ্য আফসোস হচ্ছে না৷ কিছুটা টেনশন আর ভয় হচ্ছে শুধু। শাফিউল সাহেবকে যা যা বলেছে সে‚ সেসব কথাতে যে অনেক গোঁজামিল ছিল৷ যেমন নিজের পরিবারকে শারফানের করা অত বড়ো অপরাধটা সম্পর্কে অবগত না করে সে কিনা একা একা নালিশ করল আগে তাকে! তাও আবার সেই ঘটনার প্রায় মাসখানিক পর! কিন্তু লোকটা কি ধরতে পারেনি ওর কথার অসামঞ্জস্যতা?

“কী হইছে রে তোর?” ওর বাহুতে ঠেলা দিলো রিয়া‚ “কী ভেবে যাচ্ছিস? পান্থকে নিয়ে? ব্রেক আপের পর ফিল করতে শুরু করলি না-কি?”

‘ফিল’ কথাটাই কেবল মস্তিষ্কে স্থায়ী হলো সানার৷ গতকাল থেকে কিছু অন্যরকম অনুভব হচ্ছে ওর৷ অবশ্যই তা শারফানকে কেন্দ্র করেই। আগের দিনগুলোতেও হচ্ছিল। কিন্তু তা ছিল তার ব্যক্তিত্বের রূপ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বপূর্ণ অনুভূতি। আর বর্তমানের অনুভূতিগুলো একদমই অদ্ভুত। রিয়াকে কোনো উত্তর না দিয়ে কিছু একটা ভাবল সে।

“রিয়া”‚ স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে বলল সানা‚ “আমি গতকাল রাতে একটা উর্দু ভাষার ড্রামা দেখছিলাম‚ বুঝলি? ড্রামার একটা এপিসোড আরকি৷ সেটাই মাথার মধ্যে খালি ঘুরপাক খাচ্ছে।”

“কী ড্রামা?”

“নামধাম খেয়াল করিনি৷ মেহা দেখছিল‚ তাই একটু দেখেছিলাম তখন। তোকে কাহিনিটা বলব। শুনবি?”

“অবশ্যই শুনব৷ তোর মাথার মধ্যে পড়া বাদ দিয়ে ড্রামার কাহিনি ঘুরপাক খাচ্ছে মানে নিশ্চয়ই ইন্টারেস্টিং কিছু।”

শারফানকে প্রথম দেখার দিন থেকে গতকাল অবধি সমস্ত ঘটনার সারসংক্ষেপ খুব সাবধানে ব্যাখ্যা করল সানা। শারফানকে ঘিরে ওর শুরুর দিকের রাগ‚ ঘৃণা আর বর্তমানের মিশ্র অনুভূতিগুলোও তুলে ধরল কথার মাঝে। তারপর বলল‚ “উর্দু‚ হিন্দি আমি তো তেমন বুঝি না জানিসই। তাই আসলে এটা বুঝিনি ওই ভিলেনের ওপর তো মেয়েটার প্রচণ্ড রাগ ছিল। এক সময় তো ঘেন্নাও ছিল খুব৷ তাহলে ওই ভিলেন অন্য মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করলে বা নাম্বার দেওয়া-নেওয়া করলেই বা কি ওই মেয়ের? ওর কেন মেজাজ খারাপ হবে?”

“আরে বুঝিসনি তুই? নায়িকাটা পছন্দ করতে শুরু করছে নায়করে৷ আর তুই ভিলেন ভিলেন বলতেছিস ক্যান? ওটাই তো ড্রামার হিরো।”

“বালের হিরো। হিরো হবে নিশ্চয়ই আরেকজন। যার এন্ট্রি এখনো হয়নি”‚ ভ্রু কুঁচকে বলল সানা। “আর তুই বুঝিসনি কাহিনি। মেয়েটা যদি পছন্দই করত তাহলে কি ছেলেটার বাবার কাছে নালিশ দিত?”

“ড্রামাটা দেখতে পারলে ভালোভাবে বুঝতাম। কিন্তু তুই কাহিনি যা বললি তাতেও বোঝা যাচ্ছে নায়িকা পছন্দ করে ফেলছে ছেলেটারে। আর ও নালিশ করছে মূলত রাগ আর জেলাসি থেকে।”

“জেলাসি!” বিস্মিত দেখাল সানাকে।

“হ‚ জেলাসি”‚ নির্বিকারভাবে বলে গেল রিয়া‚ “ছেলেটারে অন্য মেয়ের সঙ্গে মিশতে দেখেই তো নায়িকার রাগ হইছে বেশি আর জেলাসও হইছে সে৷ তাই আগের রাগ আর এখনের রাগ-ক্ষোভ‚ জেলাসি মিলিয়েই ছেলের বাপের কাছে নালিশ দিছে।”

“সর তুই”‚ ধমক লাগিয়ে বসল সানা। “আন্দাজি! ওই ছেলে যে জঘন্য অপরাধ করেছে মেয়েটার সঙ্গে। এরপর আর যাই হোক তাকে পছন্দ করা সম্ভব? বড়োজোর তার কিছু ভালো কাজের জন্য তার প্রতি একটু সফট্ আর কাইন্ড হতে পারে মেয়েটা।”

“সেটা তো হইছেই নায়িকা৷ আর ছেলেটা যেদিন নিজের অপরাধের জন্য মাফসাফ চাইলো সেদিন থেকেই নায়িকা ওরে নিয়ে ভাবনাচিন্তায় পড়ে‚ তাই বললি না? এর কারণ হলো‚ যে ছেলে সর্বক্ষণ ফোনে জ্বালাত‚ পথেঘাটে বিরক্ত করত‚ তা সব কিছুই তো বন্ধ করে দিলো‚ তার অ্যাক্সিডেন্টটার জন্য নায়িকা অনুশোচনায়ও ভুগতে শুরু করল। আবার ওই সময়গুলোতে ছেলেটার ভালো দিকটা সম্পর্কেও জানল। তারপরই আবার নায়িকারে প্রাণে বাঁচাল ছেলেটা। এই সব চিন্তা করে নায়িকা রিয়েলাইজ করছে যে যত খারাপ সে ভাবছিল তারে সে আসলে ওরকম খারাপ না। তারে নিয়ে এত কিছু ভাবতে ভাবতেই ফল করতে শুরু করছে নায়িকা৷ এটা তো ড্রামায় বুঝায় দেওয়ার কথা৷ তুই ভাষা বুঝিস না বলেই বুঝতে পারিস নাই।”

“তাহলে ওই নায়িকা কেন নিজের পছন্দ করার ব্যাপারটা বুঝবে না?” বিদ্রুপপূর্ণ হাসল সানা‚ “যে ফল করেছে সে নিজে সেটা টের পাবে না? আজব!”

ধৈর্য হারানোর পথে রিয়া। প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে জবাব দিলো‚ “দ্যাখ‚ এখানে নায়ক নায়িকার কেমিস্ট্রিটাই জটিল। তাই অন্য সব প্রেমের ড্রামার মতো চট করেই দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে যাবে না৷ ভালোবাসাটা হতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে৷ কিংবা হচ্ছে একটু একটু করে৷ আর একটু একটু করে হচ্ছে বলেই নায়িকা নিজের ফিলিংস ধরতে পারতেছে না। ওহ‚ এখানে আরেকটা কারণও আছে ছেলেটার জন্য নায়িকার ফিলিংস আসার। ওই যে অতগুলো দিন ফোনে কথা বলছে দুজন…”

“একজন”‚ কথার মাঝ পথেই সানা শুধরে দিলো রিয়াকে‚ “ওই ছেলে একা নিজের মতো নিজে প্যাচাল পাড়ত। মেয়েটাকে বাধ্য করত কথার আন্সার করতে।”

“ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার দেখি। আচ্ছা দুজন যেমনেই কথা বলুক৷ বলছে তো না-কি? সেটা একটা‚ দুইটা দিন না৷ অনেকগুলো দিন কিন্তু। আস্তেধীরে এক সময় ওইটা দুজনেরই অভ্যাসে পরিণত হয়৷ তারপর এক সময় ফিলিংস চলে আসে একজন আরেকজনের ওপর। নায়িকার মাথার মধ্যে সব সময় তারে নিয়ে চিন্তাভাবনা চলত না তখন? এটা দেখাইছে ড্রামায়?”

“হুঁ”‚ গম্ভীর দেখাল সানার মুখটা।

“চিন্তাভাবনা চলাটাই নরমাল। প্রেমে তো চালাকচতুর ছেলেরা এভাবেই ফেলে মেয়েদের। তাছাড়া অনেক সময়…” হাসতে হাসতে বলল রিয়া‚ “কাহিনিতে টুইস্ট আনার জন্য ডিরেক্টর দেরিতে বুঝতে বলে নায়ক নায়িকারে ওদের ফিলিংস।”

“এক্সাক্টলি। তুই যেটা বলছিস সেটা ডিরেক্টরের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী হয়। কিন্তু বাস্তবে না‚ তাই না?”

“বাস্তবে হয় কি হয় না তা বলব ক্যামনে? একেক মানুষের বোধবুদ্ধি‚ চিন্তাভাবনা‚ মানসিকতা‚ বৈশিষ্ট্য একেক রকম। কারও সিক্সথ সেন্স প্রখর‚ কারও কম। এই ড্রামার নায়িকার মতো যদি কেউ প্রেম-ভালোবাসা‚ ফিলিংস‚ এসবে আনাড়ি হয় তাহলে তারও বুঝতে সময় লাগবে। কিন্তু বুঝবে তো এক সময় ঠিকই।”

হতাশ হলো সানা। সমাধান পাওয়ার বদলে ওর মনে হলো রিয়ার কথাগুলোতে ওর চিন্তাভাবনার মধ্যে আরও গোলমাল বেধে গেছে। নিজের সমস্যার সমাধান তাই নিজেরই করা উচিত ছিল ওর। এটা ভাবতে ভাবতেই বিদায় নিল সে। কিন্তু ঘরের বাইরে পা দেওয়া মাত্রই ওর মুখ থেকে বিস্ময়কর বাক্য বের হলো‚ “কী অবস্থা গো‚ আল্লাহ!”

আজ সকাল থেকেই আবার নিম্নচাপ আরম্ভ হয়েছে৷ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই দেখেছিল আবহাওয়ার অবস্থা বাজে৷ কিন্তু পশ্চিমের আকাশে যে দৈত্যাকার মেঘ জমেছে তা দেখে আর বুঝতে বাকি নেই একচোট ঢল নামবে কিছুক্ষণের মাঝেই। ইতোমধ্যে ইলশেগুঁড়ি পড়া শুরু হয়ে গেছে। গতকাল নাকি সিলেটে শিলাবৃষ্টি হয়েছিল—খবরে দেখেছিল সে।

“শীতের আজাব কি কম হচ্ছিল‚ আল্লাহ‚ যে বৃষ্টি দিয়ে গজব দেবে এখন?” বিড়বিড় করতে করতেই পা চালাল সে।

চলতে চলতে একটা রিকশার আশা করল খুব। কিন্তু আশা পূরণের আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করল। অনির বাসা থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে ও৷ আরেকটু সামনে যাওয়ার সুযোগ পেলে হয়ত রিকশার সিরিয়াল দেখতে পেত। কিছু কিছু দোকান ঝাঁপি নামিয়ে ফেলছে। সানা রাস্তার দু পাশে তাকিয়ে চায়ের টং দোকানটাই এসে আশ্রয় নিল। দোকানদার লোকটা ছাড়া আপাতত আর কেউ নেই দেখেই বসল বেঞ্চিতে। ভেজা মুখ আর কপাল ওড়নায় মুছে নিয়ে ব্যাগ থেকে বের করল ফোনটা।

এর মাঝেই তিনটা ছেলে হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে দোকানে ঢুকল। “ও কাকা”‚ বলে উঠল একটা ছেলে‚ “ভিজে গিলাম তো পু্রো। গামছা গুমছো আছে নাকি?”

“আছে।”

গামছাটা দিয়ে তিনজনে গা-মাথা মুছতে মুছতে সানাকে আপাদমস্তক দেখল কিছুক্ষণ। তারপর নিজেদের মাঝে গল্প আরম্ভ করল। বেঞ্চি থেকে উঠে দোকানের এক কোণে এসে দাঁড়াল সানা। ঠিক তখনই একটা বাইক এসে থামল রাস্তার ওপাশে—সাদ্দাম আর শারফান। চোখদুটো আতঙ্কে এক মুহূর্তের জন্য জন্য বড়ো বড়ো হলো সানার। তারপর দ্রুত চাদরে মাথা আর মুখ ঢাকার চেষ্টা করল।

রাস্তার ওপাশের এক মুদির দোকানের নিচে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে ওরা৷ অনির সঙ্গে দরকার আছে বিধায় বাসায় না ফিরে শারফান তার বাড়িতে যাচ্ছিল। পথিমধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির কবলে পড়ল।

“চাদরটা দিয়ে মাথা মুছে ফ্যাল”‚ সাদ্দাম বলল শারফানকে।

“তখন বললাম সাইড করতে। মাতব্বরি করে টান মারলি।”

কিছু বলার মুখ নেই সাদ্দামের৷ চুপচাপ সিগারেট ধরাল সে। কিন্তু ঠান্ডার প্রকোপে শারফানের গলা ভেজাতে মন চাইলো এখনই‚ “চা দরকার।” বলতে বলতেই সামনের সামনের টং দোকানটাই চোখ গেল ওর। “খাবি চা?” জিজ্ঞেস করল সাদ্দামকে।

সে নাকচ করল‚ “আবার কীরা ভিজে রাস্তা পার হবে?”

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দোমনা করল শারফান৷ কিন্তু গায়ের মধ্যে শীতের খোঁচা খেয়ে বেশিক্ষণ আর থাকতে পারল না। সাদ্দামকে রেখেই এক দৌড়ে চলে এলো চায়ের দোকানটাই। এবার নির্বাচনের জন্য সদরের ছোটো-বড়ো প্রায় সব দোকানদারই শারফানের মুখ চিনে নিয়েছে। এমপির ভাতিজাকে তাই চিনতে অসুবিধা হলো না কারও৷ গামছাটা নিজে থেকেই এগিয়ে দিলো দোকানদার‚ “গামছাডা নিবেন না-কি‚ বাপ?”

“দুধ চা দেন”‚ বলে গামছাটা হাতে নিলো শারফান।

“মালাই চা খাইবেন?”

“বানান না-কি?”

“হ‚ বানাই তো৷ ইট্টু সবুর করেন‚ দিতেছি এহনি।”

বেঞ্চিতে বসে চুলগুলো মোছার ফাঁকে ছেলে তিনটাকে দেখল একবার। এলাকার চেনাজানা বলে মনে হলো না৷ ছাত্র মনে হচ্ছে। হয়তো মেসে‚ হোস্টেলে থাকে। গামছাটা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় অবশেষে চোখটা আটকাল ওর সানার ওপর৷ যদিও মাথায় ঘোমটা টেনে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিন্তু গত দুটো মাসে তাকে দেখতে দেখতে তার শারীরিক কাঠামো চিনতে তো এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না শারফানের। দারুণ অবাক হয়েছে সে। আবার মনে মনে বেশ খুশিও। আজ সারাদিন বিশেষ এক কাজে ব্যস্ত ছিল বিধায় সানাকে নিয়ে ভাবার অবকাশ পায়নি। কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাতের তীব্র ইচ্ছাটা মনের কোণে সুপ্তাবস্থায় ছিল।

“চা দুটো করেন‚ মামা”‚ সানাকে দেখতে দেখতেই বলল সে‚ “দু কাপ লাগবে আমার।”

কোনাচে চোখে তখনই একবার তাকাল সানা৷ কিন্তু ওড়নার জন্য দেখতে পেল না শারফানের ভাবভঙ্গি। ভাবল‚ চিনে ফেলেছে না-কি তাকে? চা হঠাৎ দু কাপ চাইলো কেন শয়তানটা?

এ ভাবনার মাঝ পথেই শারফান পা বাড়াল তার দিকে। “স্প্লেনডিড! অসময়ের বৃষ্টিও এত উপকারী হয়”‚ আপনা-আপনি বলতে বলতে এসে দাঁড়াল সে সানার পাশে। ঠান্ডা হয়ে আসা হাতদুটোকে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে আবার বলল‚ “আহা বৃষ্টি… কী যে রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে!” বলেই মুখটা এগিয়ে উঁকি দেওয়ার মতো চাইলো সানার দিকে৷ “আপনার হচ্ছে না‚ আপা”‚ তাকে জিজ্ঞেস করে বসল আচমকা।

চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সানা৷ চোখ পড়ে গেল তখন দুষ্টু হাসি খেলতে থাকা শারফানের চোখদুটোই।

“আসসালামু আলাইকুম‚ আপাআআআ”‚ মুচকি হাসতে হাসতে সুর দিয়ে ডাকল শারফান।

“কী সমস্যা? বিরক্ত কেন করছেন?” কপট রাগ গলায় ধমকে উঠল সানা।

“সালাম দিলে কি আপা বিরক্ত হন? তাহলে অন্য কিছু দিই?”

দোকানদার চা বানাতে বানাতে বাঁকা চোখে দেখল শারফানকে। মনে মনে রাগ হলেও কিছু বলার সাহস পেল না। কিন্তু বেঞ্চিতে বসা ছেলে তিনটা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেশ উপভোগ করল শারফানের তামাশা। তারা ওর বলা ‘রোমাঞ্চকর অনুভূতি’ কথাটাকে ধরে নিল অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ রোমান্স অর্থে। অধিকাংশ ক্ষমতাবান নেতাদের ছেলেপুলে‚ আত্মীয়রা খারাপ আর অসৎ চরিত্রের হয় আর ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তারা কত মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলা করে—এ ধারণা এদের সবারই আছে। ভেবে নিল শারফানকেও তেমনই।

“ভালো আর হবেন না‚ তাই না?” কটমট করে বলল সানা।

জবাব দেওয়ার মুহূর্তেই ফোনটা বেজে উঠল শারফানের। এ সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কল আসার কথা ছিল। দ্রুত কলটা রিসিভ করল তাই।

দোকানদারের চা বানানো শেষ৷ শারফান ফোনে কথা বলতে বলতেই চায়েক কাপ নিল একটা৷ আরেকটা কাপ সানাকে দিতে ইশারা করলে দোকানদার কাঁচুমাঁচু করে তাকাল সানার দিকে। গরম চোখে সানা একবার শারফানকে দেখে নিয়ে বাইরেটা দেখল। ধরে আসছে বৃষ্টি। চাদর মাথায় দিয়ে নেমে পড়লে খুব একটা ভিজবে না হয়ত। দাঁড়িয়ে থাকলে ওই চা নয়ত তাকে খাইয়েই ছাড়বে শারফান। আর সঙ্গে উলটা-পালটা কথাবার্তা তো ফ্রি৷ কিন্তু ভীষণ এক ইচ্ছা দমন করে রাখতে হচ্ছে বলে আফসোস হলো তার৷ শারফানের গায়ে জড়ানো চাদরটা তারই। হাড় বজ্জাত সেটা কোনোদিন নিজে থেকে ফেরত দেবে না। মন চাইছে তাই জোর করেই খুলে নিতে৷ কিন্তু শারফানের চাদরটা তো আবার দাদীর খুব পছন্দ হয়ে গেছে বিধায় সেটা তিনি ব্যবহার করছেন। তাই চাদর অদল বদল করতে চাইলেও তা মসিবত।

আফসোসটা নিয়েই নেমে পড়ল সানা রাস্তায়। খেয়াল করল না শারফান৷ ফোনের ওপাশ থেকে বলা কথাগুলো শুনতে এতটাই মনযোগী সে‚ যে চায়েও চুমুক দিতে ভুলে গেছে। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে দোকানদার বিনয়ী হয়ে আলগোছে বলল‚ “চা তো ঠান্ডা হইয়ে যাইতেছে‚ বাপ। আফনে কথা শ্যাষ কইরে খাইয়েন। আমি গরম কইরে রাখতেছি ততক্ষণ?”

কাপটা তাকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে তখন খেয়াল করল শারফান‚ সানা চলে যাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। সানা তখন ছ কদম এগিয়েছে সবে। সাদ্দাম ওদিকে গল্পে মজেছে দোকানে বসে৷ তাই সে দেখতে পেল না তাকে।

কিন্তু মাত্র কিছুদূর যেতেই আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ল সানা। কোমরের নিচে হাত চলে গেল তার। বেশ ব্যথা পেয়েছে সেখানে৷ কিন্তু ব্যথার চেয়েও বেশি ভাবাল আর অবাক করল‚ এই রাস্তার মধ্যে তার পেছনে ঢিলটা ছোড়ার মতো অসভ্যতা কী করে করতে পারল শারফান? ক্লাসরুমের সেই দিনটার কথা আজ আবার মনে পড়ে গেল৷ যে দিনটার জন্য মাফও চেয়েছিল শারফান আর সেও মাফ করে দিয়েছিল। তারপর তো সে ভুলে যেতেই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অসচ্চরিত্রের মানুষ কি আদতে কোনোদিন শুধরায় না নিজের অন্যায়ের জন্য মনে তাদের অনুশোচনা জন্মায়?

মাথার চাঁদিতে যেন আগুন জ্বলে উঠল সানার। ধিক্কার নিয়ে ফিরে তাকাল পেছনে—শারফানের দিকে। উলটো মুখ করে দাঁড়িয়ে সে কথা বলার ভান করতে ব্যস্ত এখন৷ যেন কিছু করেইনি বোঝাতে তৎপর৷

অথচ রিয়া বলছিল কিনা এই ছেলের জন্য তার মনে অনুভূতি আছে! কোনোদিন সম্ভব এমন এক লম্পটের প্রতি প্রেম অনুভব করা? রাগে‚ লজ্জায় চোখে পানি চলে এলো তার৷ ইটের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে গেল শারফানের কাছে।

কথা বলতে বলতে শারফান টের পেল পেছনে কারও উপস্থিতি ঘটেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সানাকে হঠাৎ দেখে একটু অবাক হলো—চলে গেল না তখন মেয়েটা? আবার ফিরল যে? খেয়াল করল চোখে তার পানি! অবাকের মাত্রা বাড়ল আরও। ফোনের ওপাশে কথা চলছে বিধায় ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় তাকে জিজ্ঞেস করল‚ “কাঁদছ কেন? হয়েছে কী?”

“মেয়েদের সম্মান করার নূন্যতম শিক্ষাটুকু ভেতরে নেই‚ না?” কেঁপে ওঠা গলায় ভর্ৎসনা করল সানা‚ “মা‚ বোনকে সম্মান করেন তো? তাদের কাছে গিয়ে কখনো বলেছেন আমাকে কী চোখে দেখেন‚ কীভাবে আমাকে যখন তখন টিজ করেন‚ শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত করেছেন?”

শুনতে শুনতে দৃষ্টিজোড়া‚ চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে উঠল শারফানের। “চোপ্”‚ বাজখাঁই গলায় অপ্রত্যাশিত ধমকটা দিলো সে৷ ফোনটাও কেটে দিলো তারপরই। এমনিতেই বজ্র কণ্ঠ‚ সেই কণ্ঠে আবার এমন আচমকা ধমকে সানা তো চমকালই। দোকানের বাকি চারজন পুরুষও ভড়কাল বেশ৷

“কী হয়েছে?” ধমকের সুরেই বলল শারফান‚ “ঘটনার মাথা নেই‚ পাছা নেই‚ এসে নীতিবচন শুরু করে দিয়েছ। কী হয়েছে‚ হ্যাঁ? কান্নাকাটি লাগিয়েছ কেন?”

বিস্ময়াভিভূত সানা৷ জবানে যেন তালা পড়ে গেছে৷ শুধু স্তব্ধীভূত চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে আর ভাবল‚ “চোরের মায়ের বড়ো গলা তাহলে একেই বলে?”

আবারও ধমকে উঠল শারফান‚ “এই চুপ করে আছ কেন? কী হয়েছে‚ বলো! এখন কথা না বললে থাপ্পড় দিয়ে কথা বলাব।”

এই ধমকের জোর রাস্তার ওপাশে দোকানগুলোর মানুষও টের পেল। বৃষ্টির জোর কমে গেছে বিধায় অনেকেই শুনতে পেল আওয়াজ৷ সাদ্দাম তো ভয়ই পেয়ে গেল ধমকানিটা সানাকে দিতে দেখে। বন্ধুর এমন রাগের শিকার ও বেচারিটা হলো কী করে? চিন্তায় ছুট দিলো সে ওদের দিকে।

অপরাধ করে তা অস্বীকরার মতো মানুষ তো মনে হয়নি শারফানকে! আরও গলা বাড়িয়ে তার স্বীকারোক্তি দিতে দেখা গেছে নির্বিকারভাবে। তাহলে এমন না জানার নাটকটা করছে কেন এখন? না-কি সত্যিই কিছু করেনি সে? একটু বিভ্রান্ত দেখাল সানাকে‚ “আপনি… আপনি আমার পেছনে ঢিল ছুড়লেন কেন?”

“ঢিল ছুড়েছি? কখন?”

“ধমকাবেন না একদম”‚ গলা উঁচু করল সানাও। ইটের টুকরোটা দেখাল ওকে‚ “আমি কি মিথ্যা বলছি?” তাকাল তারপর দোকানদারের দিকে। জিজ্ঞেস করল তাকে‚ “আপনি দেখেননি তাকে ছুড়তে?”

শারফানও তাকাল দোকানদারের দিকে৷ সাদ্দাম এলো তখনই। “কী হয়েছে তোদের?” জিজ্ঞেস করল ওদের দুজনকে৷ কিন্তু কেউ-ই উত্তর দিলো না৷ কারণ‚ ওরা দোকানদারের জবাবের অপেক্ষায়। কিন্তু দোকানদার হতাশ করল দুজনকেই। আকাশ থেকে পড়ার মতো অভিভ্যক্তি নিয়ে জানাল‚ “আমি তো কিছুই দেহিনেই। দুকানের ভিতরে গিছিলাম বৈয়ামে চিনি ঢালবার।”

শারফান কাঠিন্য চেহারায় সানার দিকে তাকাল তখন৷ তার মধ্যে ছেলে তিনটা হঠাৎ তড়িঘড়ি করে বেঞ্চি ছাড়ল৷ “কাকা‚ আমাগের বিল নেন”‚ বলল ওদের একজন।

শারফানের নজর গেল আবার তখন ওদের দিকে৷ একেকজনের চেহারার ভঙ্গিমাটা একটু বেশিই স্বাভাবিক। কিন্তু দোকানের ভেতর এমন তামাশা দেখার পর একটুও কৌতূহলবোধ হবে না বা তামাশা উপভোগ করার অভিব্যক্তি চেহারায় পড়বে না‚ তা তো অসম্ভব! শারফানের সন্দেহ হতে লাগল ওদের ঘিরে। হাঁক দিলো‚ “ওই দাঁড়া।” শাসানোর গলায় বলল ওদের‚ “একটাও দোকান থেকে নড়বি না।”

“ঢিলটা এখান থেকেই গেছে‚ শিউর তুমি?” জিজ্ঞেস করল তারপর সানাকে।

জবাবে মাথা ওপর-নিচে দুলাল সানা। নিজেই তার হাত থেকে ইটের টুকরোটা নিয়ে নিল শারফান৷ সাদ্দাম আন্দাজ করেও পুরো ঘটনা বুঝতে পারেনি এখনো৷ তবুও চুপচাপ রইল আর দেখতে থাকল পরিস্থিতি।

ছেলে তিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল শারফান। একজন উচ্চতায় ওর গলা ছুঁইছুঁই‚ বাকি দুইজন চিবুক অবধি। স্বাস্থ্য তিনজনেরই মাঝারি। গায়ের রং দুজনের চাপা আর আরেকজন উজ্জ্বল শ্যামলা। ঢিলটা দেখাল ওদের। জিজ্ঞেস করল‚ “এটা ওর গায়ে মেরেছে কে? দেখেছিস তোরা?”

“না‚ ভাই”‚ সমস্বরেই উত্তর দিলো ওরা।

“ও যেহেতু বলেছে এটা এখান থেকে মারা হয়েছে‚ তাহলে এখান থেকেই গেছে৷ আমি কলে বিজি ছিলাম৷ দোকানী মামা ভেতরে গেছিল। ছিলি তোরা তিনটা শুধু। আমি লাস্ট টাইম জিজ্ঞেস করছি‚ ওকে মেরেছে কে?”

“সত্যিই জানি না‚ ভাই”‚ বলল সবার থেকে বেঁটে মতন ছেলেটা‚ “আমরা তো কাউরে মারতে দেখি নাই।”

প্রত্যেকের চোখ-মুখ খেয়াল করছিল শারফান। সাবলীলভাবে মিথ্যা বলার কৌশল যে জানে‚ কারও সেই কৌশল ধরতেও সে পটু থাকে। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ ওদের দেখে ফোনটা পকেটে ভরল ও। তারপর বলল‚ “যদি স্বীকার যেতি‚ তাহলে যে কাজটা করেছে পানিশড শুধু তাকে করতাম। বাকি দুজনকে অল্পের ওপর ছেড়ে দিতাম। কিন্তু স্বীকার যেহেতু করলি না!”

কথা শেষ করার পরই ওর রুক্ষ হাতের দানবীয় দুটো থাপ্পড় পড়ল সবার থেকে বেঁটে ছেলেটার গালে। গালদুটো জ্বলেপুড়ে ওঠায় ককিয়ে উঠল সে৷ বাকি দুজন দেখেই বুঝে গেছে ওই থাপ্পড়ের ওজন কত। “ভাই… ভাই… শোনেন‚ ভাই”‚ বলতে বলতে ওরা পেছাতে গেলে দুজনেরই শার্টের কলার এক সঙ্গে চেপে ধরে টেনে এনে লাগাতার ছটা থাপ্পড় কষল পেছানোর জন্য। বেঁটে ছেলেটাকে আবার ধরলে সে তখন দেখিয়ে দিলো আসামিকে‚ “ও মারছিল‚ ভাই।” উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ ছেলেটা।

“তোরা তিনটাই সমান কালপ্রিট। এখন একটাও কম চো** খাবি না।”

“এই শায়াফ”‚ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল সাদ্দাম‚ “কী করছে ওরা?”

“ওই দুইটাকে ধর। দৌড় যেন না দেয়”‚ অভিযুক্ত ছেলেটার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলল শারফান‚ “সাল্লু মনে করেছিল নিজেদের। আর ওকে…”‚ সানাকে দেখাল ‚ “মনে করেছিল মাধুরী। আমার সামনে বসে ওরা সাল্লু‚ মাধুরী খেলা খেলছিল! কত খেলার জোর এই হাতে‚ দেখব এখন।” বলেই ছেলেটার কব্জি ধরে এমন এক মোচড় দিলো যে তার যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার শুনে দোকানদার ভয় পেয়ে বলল‚ “আর কয়ডা চড় থাবড় দিয়ে ছাইড়ে দ্যান‚ বাপ৷ হাত মাত ভাঙার দরকার নাই।”

সানার দিকে তাকানোর খেয়ালই হলো না কারও৷ সাদ্দাম সত্যি সত্যি চেপে ধরেছে বাকি দুজনকে৷ এ তামাশা দূর থেকে দেখে দোকানের সামনে দু-চারজন এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। তা দেখে আর শারফানের রাগ দেখে সানার মন চাইলো পাখির মতো ফুড়ুৎ করে এখান থেকে কেটে পড়তে।

“তাহলে র‍্যাগ দিই”‚ যেন দোকানীকে জিজ্ঞেস করল শারফান। “সেই বছর তিনেক আগে মনে হয় সেকেন্ড ইয়ারের এদের মতো কয়টা বালপাকনাকে ধরে দিয়েছিলাম।”

“দে তো”‚ উৎসাহী হয়ে বলল সাদ্দাম‚ “তোর র‍্যাগ দেওয়ার গল্প শুনছিই খালি অনির কাছে। আজকে দেখা একটু।”

“ওই‚ শার্ট খোল তিনটাই”‚ হুকুম করল শারফান। “দোষ তোদের‚ শার্টের না। তাই শার্টকে ছাড় দিলাম। খোল শার্ট।”

ছেলেগুলো কাকুতি-মিনতি শুরু করলে সাদ্দাম দিলো মাথার পেছনে থাবড়া আর শারফান দিলো আবারও গালে৷ সেই মার খেয়েই শার্ট খুলল ওরা৷ সাদ্দামকে বলা হলো ভিডিয়ো আরম্ভ করতে। তারপর শুরু হলো ওদের শাস্তি৷ দোকানের সামনে ঢালু মতন একটু জায়গাতে বৃষ্টির পানি জমেছে বেশ খানিকটা৷ মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে ওই পানিটুকু পুরোটা তিনজনকে খেয়ে শেষ করতে হবে। খেতে না পারলেই প্যান্ট খুলে পশ্চাদ্দেশে একটা করে লাথি খেয়ে শার্ট-প্যান্ট ছেড়েই পালাতে হবে—সাবধানবাণীটা দিলো শারফান।

কিন্তু ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? সানা ভাবল সেটাই৷ ভার্সিটিতে র‍্যাগ দেওয়ার গল্প টুকিটাকি শুনেছে সে৷ কিন্তু তা বাস্তবে কেমন হয় সে ধারণা নেই ওর। এগিয়ে এসে নিষেধ করতে চাইলো শারফানকে। তখনই সাদ্দাম হঠাৎ বলে উঠল‚ “পানি তো ম্যালা রে‚ শায়াফ৷ ওরা খাইয়ে শেষ করতে পারবে না। একটু ছাড় দিই।”

সানা মনে মনে খুশিই হতে যাচ্ছিল সাদ্দামের মানবিকতায়৷ কিন্তু সেই ছাড় যে কতখানি মানবিকতার তা বুঝল একটু পরই৷ ছেলে তিনটাকে কুকুরের মতো বসিয়ে জিহ্বা দিয়ে পানি চেটে চেটে খেতে বলার হুকুম দিলো সে। শারফানের কঠিন করে রাখা মুখটা দেখে আর ওর হাতের চড়গুলো খাওয়ার ভয়ে ওরা তাই-ই করল—অন্তত পাঁচবার চেটে খেল পানি। সাদ্দাম ভিডিয়ো করতে করতে বলল‚ “এবার কান ধরে বল‚ আমরা আর কোনোদিন সালমান খান হবো না‚ কোনো মেয়েরে মাধুরী মনে করে তাদের পেছনে ঢিল মারব না।”

“ভাই‚ ভিডিয়োডা ফেসবুকে দিয়েন না”‚ কাঁদতে কাঁদতে বলল ওদের একজন।

কথাটা শুনে সানাও সাদ্দামকে বলে উঠল‚ “ফেসবুকে ছড়ানোর প্রয়োজন নেই‚ ভাইয়া। ওটা করবেন না প্লিজ।”

“প্লিঁ…ইইজ?” চকিতেই বিকৃত সুরে কথাটা উচ্চারণ করল শারফান। “আমাকে কথা শোনানোর সময় তো প্লিঁইজ মুখে আসেনি!”

“এই‚ তোরা পরে ঝগড়া কর”‚ সাদ্দাম বাধা দিলো। “আগে এদের র‍্যাগ শেষ করি৷ আমারে মজা নিতে দে।” ছেলেগুলোকে বলল তারপর‚ “শুরু কর তোরা।”

আর কখনো কোথাও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবে না‚ অসম্মান করবে না এমন কথা স্বীকারোক্তি নিয়ে ভিডিয়োটা সম্পূর্ণ করল সাদ্দাম। ওদের শার্ট ফিরিয়ে দেওয়ার সময় শারফান আবার দুটো চড় কষতে গেল সানা বাধ সাধল‚ “আরে হয়েছে তো। ছেড়ে দিন এবার। ওদের গালে আর জায়গা নেই।”

“তাহলে কি তোমার গালে দেব?” ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে খেপা গলায় বলল শারফান।

“কথা মুখ সামলে বলবেন”‚ রেগেমেগে ধমকে উঠল সানা। “আপনি যেন খুব ভালো কিছু করেছেন অতীতে যে আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা পূতপবিত্র থাকবে? ভুল করে কথা শুনিয়ে ফেললেও একটা কথাও কি ভুল বলেছি? আপনাকে ভুল বোঝার জন্য আপনিই দায়ী।”

রাস্তার মধ্যে অপমানিত হতে হচ্ছে একটা মেয়ের কাছে! আবার সে মেয়ে ধমকানিও দিচ্ছে—খেপা শারফান আরও খেপে গেল। সানার দিকে দু পা যখন বাড়াল তখন সানার কলিজার পানি শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। কিন্তু সে মুহূর্তেই ঘটে গেল বিস্ফোরণটা। ওদের দুজনের মাঝে তর্কবিতর্ক হতে দেখে ছেলে তিনটার মধ্যে একজন সাহস করে শারফানকে নিয়ে বলে উঠল সানাকে‚ “ওই ভাই তহন আপনারে টিজ করতেছিল আর ব্যাড সাউন্ড দিতেছিল দেখেই আমরা এমন একখান কাজ করার সাহস করে ফেলছিলাম‚ আপু৷ মাফ করে দিয়েন আমাগের।”

“লে হালুয়া”‚ ভ্যাবাচ্যাকা খেল সাদ্দাম। বিড়বিড়িয়ে বকল শারফানকে‚ “তোরেও যদি এখন সবাই র‍্যাগ দিতে কয়? শালা খাইশ্টা!”

যে-কজন মানুষ জড় হয়েছিল তাদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টির কবলে পড়ল শারফান। এক নিমষেই সানার অভিব্যক্তিও তখন বদলে গেল৷ ক্ষিপ্ত হয়ে শারফানের দিকে তাকালে শারফান একটুখানি দমল৷ কিন্তু নিজের ইমেজ রক্ষার জন্য আর সহজাত রগচটা স্বভাবটা ধরে রাখতে উপস্থিত বুদ্ধিতে পটু সে ছেলেটার ওপর ধমক বসাল আরও জোরে‚ “লাথি মেরে পেট ফাটাব‚ বান**! ও আমার কী হয় জানিস?”

“কী হয়?” তাজ্জব চেহারায় ঝট করে তাকিয়ে ফিসফিসাল সাদ্দাম।

আর সানা চেয়ে রইল ভ্রু কুঁচকে৷ সবাই-ই শোনার আশায় তাকিয়ে আছে দেখে শারফান জোর গলায় জানাল‚ “ও আমার বেয়াইন হয়।”

ফোঁস করে শ্বাসটা বের করে দিলো সাদ্দাম। দমটা যেন আটকেই রেখেছিল শারফানের উত্তর কী হবে তা ভুলভাল আন্দাজ করে। ওদিকে সানার কুঞ্চিত ভ্রু দুটোর সাথে বিরক্তিতে তার নাকও কুঁচকে গেল।

“তোদের কি বেয়াইন লাগে ও‚ যে আমাকে দেখে টিজ করার সাহস দেখালি? আর আমি কি টিজ করেছি? ব্যাড সাউন্ডই বা কখন দিলাম‚ হ্যাঁ?” শেষ প্রশ্নটা করল শারফান সানার দিকে ঘুরে। সানার কঠিন চাউনি দেখে মনে মনে কটা হালকা গালি দিলো সে৷ তারপর জিজ্ঞেস করল আবার‚ “বলো না কেন? ব্যাড সাউন্ড দিয়েছি না টিজ করেছি তোমাকে? বেয়ায় বেয়াইনের মশকরা যদি টিজ হয় তাহলে তুমি যে সেদিন আমার রেড জোন নিয়ে মেসেজ করলে সেটাও তো টিজ হয়ে যাবে‚ ঠিক না?”

হতবুদ্ধি চেহারা হয়ে গেল সানার‚ “কিসের মধ্যে কী?”

শারফানের চোখের তারায় শয়তানির ইঙ্গিত স্পষ্ট। বুঝতে পারল সানা‚ এখন যদি সে ওর বিপক্ষে কোনো কথা বলে তাহলে ওই মেসেজ সবাইকে দেখাতে একটুও দেরি করবে না। অর্থাৎ আবারও ব্ল্যাকমেল! চিড়বিড়ানো রাগটা দাবিয়ে রেখে ছেলেগুলোকে বলল‚ “সে কোনো টিজ করেনি আমাকে। আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পেরে মাফ চেয়েছেন‚ মাফ করেছি আমি৷ যান এখন আপনারা।”

তবে ছেলেগুলো যাওয়ার আগে সে-ই ওই স্থান ত্যাগ করল। আজ কী বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেল সে! লজ্জা আর অস্বস্তিতে আজকের পর এই রাস্তা ধরে যাওয়া আর সম্ভব হবে তার? এখানের প্রতিটি মানুষ তামাশা দেখেছে। এবং তামাশার কেন্দ্রবিন্দু সে‚ সেটাও দেখেছে৷

“ওই দাঁড়াও‚ দরদি বেগম”‚ পিছু পিছু চলে আসলো শারফান।

ওকে দেখা মাত্রই সানা বিচ্ছিরি এক গালি দিতে গিয়ে সংযত করল মুখটা৷ দাঁড়াল না একবারও। অবশ্য হাঁটার গতি বাড়িয়েও রক্ষা পেল না শারফানের কবল থেকে৷ বড়ো বড়ো পায়ের কদম ফেলে ধরে ফেলল তাকে‚ “এদিকে যাচ্ছ কেন?”

“তা কি গোরস্থানে যাব?” ছ্যাঁৎ করে উঠল সানা মুহূর্তেই।

“আমাকে মেজাজ দেখাও‚ আমার বাপকে নালিশ দাও। এত সাহস ধার করলে কোথা থেকে? না-কি ব্যাঙ্কে সেভিংস করে রেখেছিলে?”

“যেখানে খুশি সেখানে রাখি। আপনার মতো মানুষের সাথে এর থেকেও বেশি কিছু করা উচিত।”

“তা বুঝলাম। কিন্তু ওদিকে যাচ্ছ কেন? রেগেমেগে কি অনির বাসার পথ ভুলে গেছ?”

“আমি বাড়ি যাচ্ছি”‚ ঝাড় দিয়ে বলল সানা। “আমার সঙ্গে আসবেন না একদম!”

“না চাইলেও পাশাপাশি হেঁটেই তো যেতে হবে। কারণ‚ রাস্তা তো একটাই তোমার বাড়ির।”

“তো আপনি কি আমার বাড়ি যেতে চাচ্ছেন? ফাজলামি বাদ দিয়ে আমার কাছ থেকে তফাৎ যান বলছি! পরিচিত কেউ দেখে নিলে আমাকে ভুল বুঝবে।”

“তোমাকে ভুল বুঝলে আমার কী? তোমার বাবা বাড়ি আছে এখন? সেটা বলো। না-কি তোমার মতো কলে কথা বলে নালিশ করব?”

“কিসের নালিশ?” থমকে গেল সানা।

“সেদিন বললাম না?” হাসল শারফান‚ “তোমার প্রেমিকের ইনফরমেশন সাবমিট করার কথা ছিল তোমার আব্বুর কাছে। ভুলে গেছ?”

ভড়কে গেল সানা‚ “কিন্তু আমি তো আজ পর্যন্তও মিট করিনি পান্থর সাথে। কথাবার্তাও বলেছি মাসে হাতে গুণে কবার! তাহলে কিসের ইনফরমেশন দেবেন আপনি আব্বুর কাছে? মিথ্যে বলবেন‚ তাই না?”

“মিথ্যে বলব কেন? তুমি যেমন করে প্রেম করছ তেমনটাই তো জানাব তোমার আব্বুকে।”

“আমি কোনো প্রেম করছি না”‚ প্রতিবাদ করে বলল সানা‚ “আমাদের মধ্যে প্রেমের তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না।”

“তো কেমন কোনো সম্পর্ক ছিল?” ঝুঁকে এলো শারফান। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল‚ “লাইভ চুমু খেতে না তোমরা? না-কি স্বপ্নে স্বপ্নে খেতে শুধু?”

হাতের ব্যাগ দিয়ে সানা একটা বাড়ি বসিয়ে দিলো ওর বুকে‚ “আপনাকে আমার খুন করা উচিত।” রাগে মুখটা সঙ্গে সঙ্গেই লাল হয়ে উঠল তার‚ “নিজের মতো নোংরা ভাবেন আমাকে? আপনার মতো নিকৃষ্ট কেউ কোনোদিন হয়নি আমার সঙ্গে‚ কেউ এমন দুঃসাহস দেখায়নি। মানুষ হিসেবে আপনি কী জঘন্য সেটা আমাকে অনেক ভালোভাবে দেখিয়েছেন সেদিন। আপনাকে আমার আসলে মাফ করা উচিতই হয়নি।”

“মাফ চাইব আর তুমি মাফ করবে না মানে? করতেই হবে।” বুকটা ডলতে থাকল শারফান। বইয়ের ব্যাগ তাই ব্যথা পেল ভালোই‚ “উফঃ! ডাইনি একটা। কী করেছি‚ হ্যাঁ? এত জোরে মারলে কেন?”

জবাবের বদলে সানা তেড়ে গিয়ে আরেকটা দিতে উদ্যত হলেই এক পথচারী মুরুব্বি যেতে যেতে হঠাৎ বললেন‚ “এত মারামারি‚ ঝগড়াঝাঁটি করার শখ তো বাড়ি যাইয়ে বাপ-মারে কও দুইজন। ঘরে বইসে ঝগড়া করার ব্যবস্থা কইরে দিক।”

“দেখেশুনে‚ জেনেজুনে এই খানে দজ্জাল ঘরে নেবে কে?” জবাব দিলো শারফান‚ “পায়ে পড়লেও তো নেব না।”

“আপনার পায়ে পড়বে আমার লাথি”‚ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে পালটা জবাব দিলো সানা। শারফানের উত্তর শুনতে না চাওয়ার জন্য পা বাড়াল সে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

“তো আমার ওপর রেগে কি পড়া মিস দিচ্ছ?”

“আপনাকে আমি জুতার দাম দিই”‚ হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর দিলো সে‚ “আপনার দোস্ত বাড়ি নাই৷ তাই ফেরত যাচ্ছি।”

“আমি ওকে পাঠিয়েছি একটা কাজে। চলে আসবে একটু পরই। চলো‚ ততক্ষণ আমি পড়াচ্ছি।”

“তাহলে তো পড়বই না”‚ চেঁচিয়ে উঠল সানা‚ “দূর হন আপনি!”

“পড়তে না আসলে…” পেছন থেকে গলা ছেড়ে হুমকি দিলো শারফান‚ “এই যে কল দিলাম কিন্তু তোমার আব্বুকে। বললাম তোমার পান্থ শান্তর কথা?”

“অসহ্য!” বিরক্তিতে মাটিতে লাথি মেরে বসল সানা। ফিরে আসতে বাধ্য হলো শারফানের কাছে।

হাসতে হাসতে শারফান বাঁকা একটা মন্তব্য করতে গেলে সানা ওকে ফেলেই লম্বা লম্বা কদম ফেলে এগোলো। নিঃশব্দে তার পিছু নিল সে। দুজন পাশাপাশি হলে সানা বলল‚ “আপনি কি পয়দাও হয়েছিলেন আপনার বাপ-মাকে ব্ল্যাকমেইল করে?”

মুহূর্তেই ছোটো করে একটা চাটি মেরে বসল শারফান তার মাথায়৷ চাটিটা খেয়ে হতবাকই হলো সানা। তারপরই গেল আবার রেগে। কিন্তু কিছু বলার আগেই শারফান জানাল তাকে‚ “আমাকে কান্নাকাটি করে‚ ডেকেডুকে এনেছে তারা। তাদের সারা জীবনের সাধনা আমি‚ ঠিক আছে?”

“কেন? মধ্য আকাশে ঝুলে ছিলেন না-কি?”

“আরেকটা চাটি দেব কিন্তু!”

“দিয়েই দেখেন! তখন বুকে মেরেছি‚ এখন একদম মাথায় মারব।”

আসলেই ভরসা নেই৷ একদিনে অনেক বেশিই রাগানো হয়েছে৷ আজকের মতো এটুকুই থাক। তাই আর চটাল না শারফান৷ বলল‚ “আম্মুর প্রেগন্যান্সিতে ঝামেলা ছিল। কনসিভ করার সম্ভাবনা ছিল মাত্র টেন পারসেন্ট। এজন্যই তাদের সাধনার আমি।”

“তাহলে জারা কী?”

“ডিম্পলস তো আল্লাহর রহমত। ওকে না চাইতেই পেয়েছি। আব্বু আম্মুর ওপর খুশি হয়ে আল্লাহ গিফ্ট করেছে ওকে।”

এতগুলো দিনে শারফানের এ কথাগুলোই কেবল শুনতে ভালো লাগল সানার৷ বোনকে যে খুব আদর করে তা বেশ বুঝল সে।

“আর শোনো”‚ হঠাৎ গম্ভীর হলো শারফান‚ “আমি কিন্তু মোটেও তখন ব্যাড সাউন্ড দিইনি। আমার ব্যাড সাউন্ড যে পায় শুধু সে-ই শোনে আর সে-ই জানে কতটা স্পাইসি অ্যান্ড বিটার হয় আমার ব্যাড সাউন্ড।”

“হ্যাঁ সত্যিই”‚ তিরস্কার করে বলল সানা‚ “তা আর আমার থেকে ভালো কেউ জানে?”

তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল শারফান‚ “তুমি কীভাবে জানলে? তোমাকে আমি কবে তিতা‚ ঝাল দিলাম?”

মুখটা গোঁজ করে রইল সানা। সেই মুখটা দেখে শারফান টের পেল কী ইঙ্গিত করেছে সে। ঠোঁট চেপে তাই হাসল একটু। “নো মাই মাফিন”‚ বলল ওকে মৃদুস্বরে‚ “ওটা ছিল মিষ্টিমুখ। ঝাল‚ তিতা খাওয়ার দুর্ভাগ্য তোমার কোনোদিন না হোক।”

চলবে।