#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩১.
অনির বাসার সামনে চলে এসেছে ওরা। শারফানের কথার জবাব দিতে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল সানা। সেজন্য দাঁড়াতে হলো শারফানকেও। তখনই সানা বলল ওকে‚ “আপনি কি জানেন ওই র্যাগটা আপনিও ডিজার্ভ করেন? আমারও আপনার মতো ক্ষমতা থাকলে অবশ্যই দিতাম শাস্তিটা।”
তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসল শারফান‚ “আমাকে কেউ কোনোদিন র্যাগ দিতে পারেনি। সেখানে তুমি?”
মুখ ঝামটা দিয়ে সানা ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ হাসতে হাসতে শারফানও ঢুকল। এর মাঝে সাদ্দামকে মেসেজ করে দিলো তাকে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে।
ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল রিয়া। সানাকে হঠাৎ দেখে অবাক হলো‚ “কিছু ফেলে গিয়েছিস না-কি?”
জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না সানা৷ গটগটিয়ে চলে গেল পড়ার ঘরে। ততক্ষণে শারফানের দেখা পেয়ে গেছে রিয়া। শারফান তাকে জিজ্ঞেস করল‚ “চলে গেছে স্টুডেন্টস?”
“না‚ ভাইয়া৷ ওরা ছাদে বরই খাচ্ছে।”
“সবাইকে ডেকে নিয়ে পড়তে আসো”‚ বলে পা বাড়াল সে ঘরের ভেতরে। যেতে যেতে বলে গেল‚ “অনি না আসা পর্যন্ত আমি পড়াব।”
নিশ্চল কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল রিয়া৷ হিসাব বুঝতে চেষ্টা করল—সানা আর শারফান এক সঙ্গে কীভাবে?
বেঞ্চের মাঝখানে এসে সবেই বসেছে সানা। তখনই দরজার কাছে দেখা পেল শারফানের৷ ভেতরে পা দেবে সে এমন মুহূর্তেই ওকে নিষেধাজ্ঞা দিলো সানা কড়া গলায়‚ “সবাই আসবে আগে৷ তারপর ভেতরে ঢুকবেন।”
এক পলের জন্য শারফান থমকালেও পরমুহূর্তেই ঘরে ঢুকে পড়ে হেলে-দুলে হাঁটতে হাঁটতে এলো তার কাছে৷ বেঞ্চের মাঝখানে বসেছে দেখে হাসল দুষ্টু চোখে চেয়ে‚ “ভয় পাচ্ছ?”
নীরবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সানা। হাতের মুঠোয় কলমটা শক্ত করে চেপে ধরা। একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার শারফানের দিকে তাকাল৷ অর্থাৎ দেখিয়ে দিলো আজ সে অপ্রস্তুতও নয়‚ নিরস্ত্রও নয়।
শারফান মুচকি মুচকি হাসল শুধু তা দেখে৷ তারপর বসল গিয়ে অনির চেয়ারটিতে। “লুসেন আপ”‚ আশ্বস্ত করতে বলল সানাকে‚ “এমনিতেও এখন সুযোগ নেই।”
“সুযোগ পেলে চেষ্টা করতেন?”
“আমি কি তা একবারও বলেছি? আমি যা-ই করি তা বলে কয়েই করি। তুমিই নিজের মতো নিজে সবটা ভেবে নিয়েছ।”
“কারণ‚ সাপে আর শারফান শায়াফে আমি কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারব না”‚ শুষ্ক গলায় বলল সানা।
শ্রাগ করল শারফান‚ “হু ওয়ান্টস ইয়োর ট্রাস্ট?
দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় মনোযোগ দিলো সানা। আর শারফান বসল চেয়ারে হেলান দিয়ে‚ পায়ের ওপর পা তুলে৷ ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ধরে নির্দ্বিধায়‚ নিঃশঙ্কোচে দেখতে থাকল তাকে।
হঠাৎ একটা বিষয় মনে হতেই মুখটা তুলে ওকে জিজ্ঞেস করল সানা‚ “আপনি অ্যাকাউন্টিংয়ে এমবিএ করেছেন?”
“হুঁ”‚ পা নাচাতে নাচাতে বলল শারফান‚ “সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। ব্যাবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করতে হবে বলে বাপ পড়াল না।”
“কোন ভার্সিটি থেকে পড়েছেন?”
“তোমাদের অনি ভাই যেখান থেকে পড়েছে।”
“আর বিবিএ?”
“জাবি থেকেই।”
হোঁচট খেল যেন সানা‚ “আপনি জাবিতে চান্স পেয়েছিলেন?”
ওর প্রতিক্রিয়া দেখে সোজা হয়ে বসল শারফান। ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “এতে চমকানোর কী হলো?”
“আপনি পড়াশোনা করা পাবলিক তা মনে হয়নি আগে। এজন্যই আরকি।”
“তোমার অমন মনটাকে তুলে দাও আমার হাতে… ধরে শ্রাদ্ধ করে দিই”‚ গম্ভীরমুখে বলল শারফান‚ “আমার চেহারায় কি লেখা আছে আমি আবুল? আমার মেধা নেই?”
“তা লেখা নেই”‚ হেসে উঠে বলল সানা‚ “কিন্তু একটা ভাদাইম্যা ভাইব আছে। দেখলেই মন বলে বোহেমিয়ান শারফান!”
স্থির কয়েক পল তাকিয়ে থাকল শারফান। তারপর মিটমিটিয়ে হেসে বলে উঠল ফিচলেমি করে‚ “যেমন তোমাকে দেখলেই মন বলে‚ পুরোই বাটারস্কচ… ইয়ামি ইয়ামি। মনটাই চায় একদম জাপটে ধরে…”
হাতের মধ্যে কলমের ক্যাপ আলাদা করা ছিল সানার। কথাটা শেষ করার আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে শারফানের মুখ বরাবর ছুড়ে মারল ক্যাপটা। সেটা ক্যাচ ধরতেও সময় নিল না শারফান। হাসির মাঝেই পকেটের মধ্যে ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠল ওর—কল এসেছে। বের করে স্ক্রিনে দেখল সেভ না করা একটা নাম্বার৷ কিন্তু চেনা চেনা লাগল নাম্বারটা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল এক নারী কণ্ঠ‚ “হ্যালো? শারফান বলছেন?”
“হুঁ‚ বলছি”‚ রসিকতাপূর্ণ সুরটা বদলে রাশভারী হলো ওর গলা।
“আপনার কল করার কথা ছিল। করলেন না যে?”
গলাটাও চেনা চেনা লাগল শারফানের৷ কিন্তু ছাঁটাই করা ওর তথাকথিত প্রেমিকাদের কেউ নয়। তাই বলল‚ “নাম-ধাম বলে দেন মেইন পয়েন্টে ঢুকুন‚ ম্যাডাম। দরকার ছাড়া হুদাই কাউকে কল টল করার ধার ধারি না আমি।”
“আমি নিশা কবির।”
“নিশা কবির?” একটু জোরেই উচ্চারণ করল শারফান। তাকাল তারপর সানার দিকে। “ফারনাজ কবিরের বোন না-কি?” প্রশ্নটা ফোনের ব্যক্তিটির সঙ্গে সানাকেও করল মনে হলো।
কিন্তু জবাব দিলো না সানা৷ কেবল তার চোখের চাউনিতে দেখা গেল কৌতূহল আর বিস্ময়ও।
“যাক‚ চিনেছেন তবে?” বলল নিশা‚ “আমি কাল অপেক্ষায় ছিলাম আপনার ফোনকলের। অপেক্ষার দাম পেলাম না বলে নিজেই আপনার নাম্বার ম্যানেজ করে কল করলাম।”
“কিন্তু আমি তো বলিনি কল করব”‚ কথা বলতে থাকল শারফান সানার দিকে চেয়েই‚ “অপেক্ষার দায়ভারও তাই নিতে পারছি না‚ বিউটিফুল।”
“ও আচ্ছা।” কিছুটা বিভ্রান্তে পড়ে গেল নিশা। অবমূল্যায়নও করছে তাকে আবার বিউটিফুল বলেও ডাকছে ছেলেটা৷ বুঝে উঠল না সে শারফানের মনের ভাব। দ্বিধান্বিত মন নিয়ে বলল‚ “তাহলে বিরক্ত হলেন বোধ হয়৷ রেখে দিই?”
“ইয়া‚ আই অ্যাম টাইড আপ। হিট ইউ আপ লেটার”‚ বেশ কাটকাট গলায় বলে কলটা কেটে দিলো শারফান।
এরপরই অনির সকল ছাত্র-ছাত্রীকে আসতে দেখা গেল। অনির বদলে অনির কোনো বন্ধু পড়াবে তা ওরা সহজে বিশ্বাসই করেনি। ভেবেছিল রিয়া ওদের ছাদ থেকে নামাতে মিথ্যা বলছে। তাদের বিশ্বাস করাতে করাতেই কিছুটা দেরি হলো রিয়ার ওদের ডেকে নিয়ে আসতে।
ছেলেগুলো মোটামুটি ভালোই চেনে শারফানকে। ওকে দেখে তাদের মাঝে বেশ স্ফূর্তি দেখা গেল৷ রিয়া আর সানাসহ ওদের আরও তিনজন বান্ধবী পড়ে। বাদ বাকি সবাই ছেলে৷ তাই সামনের বেঞ্চ জুড়ে শুধু মেয়েরাই বসল সব সময়ের মতো।
ছেলেদের একজনের থেকে বিজনেস ম্যাথমেটিক্সের বই নিল শারফান। ওদের থেকেই জেনে নিল অনি কিসের অঙ্ক করাচ্ছে এখন। জানার পর বলল‚ “অনি যেটা করাচ্ছে করাক। তোমরা বলো তোমরা কী করতে চাও।”
মেয়েরা কিছুই বলল না। ছেলেদের যেখানে সমস্যা সে অনুযায়ীই অঙ্কে ঢুকল শারফান। মার্কার পেনটা হাতে নিয়ে খুব অভ্যস্ত হাতে হোয়াইটবোর্ডে লিখতে থাকল আর সাবলীলভাবে বোঝাতে থাকল সবাইকে৷ তার ফাঁকে ফাঁকে ভীষণ মিশুকভাবে ওর গল্প আর হাসি-ঠাট্টাও চলল ছেলেদের সাথে। গল্পগুলোও আবার অ-মহিলাসুলভ—সামনের ফিফা বিশ্বকাপ‚ ভার্সিটির নানান বিষয়বস্তু। সেসব গল্পে মেয়েদের আগ্রহ কমই। বরং তাদের প্রত্যেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু দেখা গেল শুধু শারফানকে ঘিরে।
যেমন সানা না পারতেই মিনিটে মিনিটে কখনো চোরা চোখে দেখছে‚ কখনো আবার সরাসরিও৷ তবে মনে মনে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে৷ কারণ‚ সে ভেবেছিল নামেই পড়াতে এসেছে বজ্জাতটা। দেখা যাবে পুরোটা সময় বিভিন্ন কৌশলে ওকে বিরক্ত করবে আর যতসব আজগুবি গল্প চালাবে সবার সাথে‚ তাও কেবল তাকে বিরক্ত করার বাহানাতেই। কিন্তু অঙ্কের বইটা হাতে গেছে পর থেকে পুরোদস্তুর ভিন্ন ব্যক্তিত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে যেন লোকটা৷ গল্প করছে ঠিকই; কিন্তু তা সীমারেখার মাঝে থেকে৷ সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকছে ওই হোয়াইটবোর্ডে আর লেকচারেই৷ মাঝে মাঝে ওদের দুজনের চোখাচোখি হচ্ছে। কিন্তু এমনভাবে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সে‚ যেমনটা নিচ্ছে অন্য মেয়েগুলোর বেলাতেও। অধিকন্তু ওকে মেয়েদের থেকে বেশি মিশুকে‚ স্বাচ্ছন্দ্য আর আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে ছেলেদের সঙ্গেই। মনেও হচ্ছে না আজই প্রথম শিক্ষক বেশে সে।
এদিকে রিয়ার সঙ্গে বাকি তিনটি মেয়েও লেখার মাঝেই শারফানকে দেখতে দেখতে ওকে নিয়ে কী সব যেন ফিসফিস করছে একে অপরের সাথে। হঠাৎ করে রিয়ার হুঁশিয়ারি শুনতে পেল সানা‚ “তোরা ফিদা হ আর ক্রাশ খা…খবরদার! এর বেশি কিছু করার চেষ্টা করবি না কেউ। সে আমার—আরও তিন বছর আগে থেকে নজর দিয়ে রাখছি। তোরা জানিসও না সে কী চিজ!”
“কিন্তু তুই কি আমার চেয়েও খুব জানিস?” প্রশ্নটা গলাতেই আটকে রাখতে হলো সানাকে। ভারি অবাকও হলো সে৷ গত দু বছর ধরে ওদের বন্ধুত্ব৷ অথচ আজ জানল কিনা তার বান্ধবী এই বড়োলোক বাপের হাড়বজ্জাত ছেলেটার ভেতর মন হারিয়ে বসে আছে! তাহলে কোনোদিন যদি জানে আজ মিথ্যা ড্রামার আড়ালে যে গল্পটা শুনিয়েছে সে‚ তা তার আর শারফানকে ঘিরেই—কী বলবে সেদিন রিয়া?
হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল অনি। কাজটা শেষ করে ফিরতে এত দেরি হবে জানলে সানাদের ব্যাচটাকে আজ নিষেধ করে দিত। পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ শারফানের লেকচার কানে পৌঁছল তার৷ পর্দা ফাঁক করে দেখল বন্ধুর নতুন রূপকে। অবশ্য নতুন কেবল এই শিক্ষার্থীদের কাছে। তার কাছে তো পুরোনোই। মুখে হাসি ফুটল তার। গলায় নকল কাশির আওয়াজ তুলে মিছে আনুষ্ঠানিকতা দেখাল‚ “মে আই বি অ্যালাওড টু এন্টার‚ স্যার?”
হোয়াইটবোর্ড থেকে নজর হটিয়ে তাকাল শারফান। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে বলল‚ “ইউ আর সুপার লেট!”
হাসতে হাসতে ভেতরে এলো অনি। সবাইকে বলল‚ “কতজন টাকা দিয়েও পেল না৷ আর তোরা ফ্রিতেই দামী টিচারের সেবা পাচ্ছিস। পায়ে ধরে সালাম করিস কিন্তু।”
“হপ”‚ ধমকাল শারফান।
কিন্তু কৌতূহলীদের কৌতূহল দমন করল রিয়া প্রশ্ন করে‚ “শারফান ভাইয়াও কি পড়াত আগে?”
“প্রফেশনালি না। ভার্সিটি থাকতে ওর জিনিয়াস বন্ধু আর বড়ো ভাই বেরাদারদের নাম করা সানশাইন কোচিংয়ে মাঝেসাঝে প্রক্সি দিত তাদের অনুরোধে। বাপের ব্যাবসাতে না ঢুকলে ওকে চ্যাংদোলা করে হলেও কোচিংয়ে নিয়ে নিত তারা।”
“এজন্যই তাহলে এত নিটলি পড়াতে পারছিল”‚ মনে মনে বলে প্রশংসায় ঠোঁট উলটাল সানা। কিন্তু তার জন্য যে চমক আরও কিছুটা অপেক্ষা করছিল তা বুঝতে পারল অনির পরবর্তী কথাগুলোতে।
ছেলেরা সবাই-ই প্রশংসা করছিল শারফানের অঙ্ক বোঝানোর দক্ষতা দেখে। তা শুনে বন্ধুর প্রশংসার সঙ্গে দুর্নামের ডালিও খুলে বসল দুষ্টু অনি‚ “বন্ধু আমার পড়ালেখায় জিনিয়াস হলেও প্রেমে ছিল ডাল। ওর ভার্সিটি ফ্রেন্ডদের কাছে শোনা। ফ্রেশারদের মধ্যে বিখ্যাত এক সুন্দরীর সঙ্গে নাকি কিছু মিছু একটা হবে হবেই ভাব। দু-চারদিনের মধ্যেই প্রপোজাল আসত মেয়েটার থেকে। কিন্তু ওই সানশাইন কোচিংয়েই মেয়ের ছোটো বোন অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করত৷ পড়ানোর সময় সেই বেচারিকে ওর ডাকাতি গলার ধমক খেতে হয়েছিল। বাড়ি গিয়ে সে বড়ো বোনকে অভিযোগ দিলে বোন আবার অভিমান‚ অভিযোগ জানাতে এসেছিল ওর কাছে। ছোটো বোন আর কতটুকু ওজনের ধমকই বা খেয়েছিল! সেদিন ক্যাম্পাসের মধ্যে সুন্দরীটা পাঁচ মণ ওজনের ধমক খেয়ে সে তো ভ্যানিশ হয়েছিলই। সেই ধমকের নমুনা দেখে ওর আরও আরও অ্যাডমাইরার্স নাকি চিরকালের জন্য কেটে পড়েছিল! সেদিনের পর থেকে আমার দুর্ভাগা বন্ধুর বদনাম হয়ে গেল ‘শর্ট টেমপারড খেপা ষাঁড়’। ভুলেও আর কোনো সুন্দরীরা ওর রাস্তায় পা মাড়ায়নি।”
ভীষণ মজা পেল সবাই। রিয়ারা খিলখিলিয়ে হাসলেও ছেলেরা প্রশংসায় করল‚ “একেই বলে ম্যান‚ ভাই। ব্যাটা লোক তো এরকমই হবে। কোনো ন্যাকাপনা‚ ঢঙ্গিদের ন্যাকামো দেখার সময় নাই।”
“আরে ভার্সিটির সুন্দরীরা পালিয়ে গেলেও ডান্স ফ্লোরের রূপসীরা এখনো খোঁজে আমার দোস্তকে। ডান্সেও তোদের শারফান ভাই আউটস্ট্যান্ডিং।”
“জিপ ইট‚ অনি”‚ এবার তীব্র ধমক বসাল শারফান। শেষ কথা তাই পুরোপুরি বলল না অনি৷ হাসল শুধু।
কিন্তু ছেলেগুলো নাছোড়বান্দা। তাদের চাপে পড়ে অনি শারফানকে বলল‚ “মুখ ফসকে যখন অর্ধেক বলে দিয়েছি তখন বাকিটা না জানালে আমার স্টুডেন্টগুলোর কষ্ট হবে‚ বাডি।” শারফানের কোনো অনুমতি ছাড়াই সে জানিয়ে দিলো‚ “ট্যাঙ্গো আর ব্যাকটা নাচে হেব্বি আমার বন্ধু।”
“থাম‚ শালা ডামঅ্যাস”‚ আরেকবার ধমকে উঠল শারফান। “পোলাপানগুলোকে খামোখাই ডেকেছিস আজকে।”
রিয়া তার মেজাজকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল‚ “লাস্ট কবে‚ কোথায় ডান্স করেছেন‚ শারফান ভাই? ভার্সিটির কোনো প্রোগ্রামে‚ তাই না?”
“আরে নাহ”‚ বলল অনি‚ “ভার্সিটির স্টেজে নাচা বান্দা না তোর শারফান ভাই।”
“ও ভাইয়া বলেন না! প্লিজ একটু বলেন।” আবদার ধরল রিয়া ভালোভাবেই।
ছেলেদেরও কয়েকজন জানতে চাইলে শারফান ভারী গলায় এক বাক্যে জানাল‚ “লাস্ট ইয়ার‚ পিএইচডি টেরেস।” তারপরই জিজ্ঞেস করল অনিকে‚ “তুই কি ওদের পড়াবি না ছাড়বি?”
“ছেড়ে দেব। টায়ার্ড লাগছে খুব”‚ বলে সবাইকে আজকের মতো বিদায় নিতে বলল অনি।
এজন্য আর কেউ শারফানের বিষয়ে কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না। এমনকি বুঝলও না গত বছরে ‘পিএইচডি টেরেস’ বলতে কী বোঝাল সে। ছেলেগুলোর থেকে একজন ওকে বলল শুধু‚ “ভাই‚ সময় পাইলে আরেকদিন অনি ভাই’র সাথে আপনার ফ্রি সেবা দিয়েন। ভাল্লাগছে আপনারে।”
মৃদু হেসে শুধু ছেলেটার পিঠ চাপড়াল শারফান। আর জবাব দিলো অনি‚ “ভাল্লাগলেও লাভ নেই৷ ভাই হলো বাপ-চাচার সাম্রাজ্যের একমাত্র প্রিন্স। কত দায়িত্ব তার! আর তার গোল কি আমার মতো গাধা পিটিয়ে মানুষ বানানোর? তার গোল হলো বিজনেস টাইকুন হওয়ার। কাল পরশুই ভাই আমাদের গুড বাই করে ঢাকা ফিরে যাবে।”
দুম করে পিঠে একটা কিল মেরে বসল শারফান। ব্যথায় অনি ‘আহ্’ করে উঠতেই তার ঘাড় জড়িয়ে ধরে সেভাবেই তাকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে৷ সানার উপস্থিতির কথা আর খেয়ালই করল না।
***
১৫ ফেব্রুয়ারি
বিকাল ৪: ৩০ মিনিট।
অফিস রুমে বসে হিসাবের খাতাপত্র দেখতে মশগুল ফারনাজ৷ এর মধ্যে রুমে লিঙ্কন প্রবেশ করল—ওর ডান হাত বা সকল ধরনের কাজের সহায়ক। মাঝারি উচ্চতা‚ উজ্জ্বল শ্যামলার চলনসই চেহারা তার। স্বাস্থ্যটাও পরিমিত। শার্ট ইন করে‚ গলায় টাই ঝুলিয়ে আর চোখে আয়তাকার কালো ফ্রেমের চশমায় তাকে দেখা যায় সব সময়। সর্বক্ষণ ফরমাল আউটফিটে থাকতে সে পছন্দ করে।
টাইয়ের নট ধরে একটু টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল ফারনাজের সামনে। বলল হাঁপ ছেড়ে‚ “সব ঠিক আছে‚ স্যার৷ কারখানায় ওই লেবার গাঞ্জা টাইনে টাল হইয়ে ছিল। তাই ভুল কইরে তেলের ড্রামে পানি ফেলায় দিছিল। দিছি ধোলাই আচ্ছামতো। কারু সাথে যোগসাজশ থাকলি ধোলাই খাইয়ে বইলে দিত। গত এক মাস ধইরে আমরা মনে হয় খালি খালিই প্যারা খাচ্ছি‚ স্যার। ওই শালায় আসলে আপনারে টেনশনে রাখতি চাপা মারছিল।”
সেই হুমকির দিনটাতে শারফানের যে রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল ফারনাজ‚ আজও তা ভোলেনি সে৷ ভুলবেও না—যতদিন অবধি এর জবাব না ফিরিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু স্বীকার না গেলেও ফারনাজ তার সমস্ত ব্যাবসাতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে রেখেছে গত এক মাস ধরেই। অফিস‚ জুট মিল থেকে শুরু করে সরিষার তেলের কারখানা‚ পেঁয়াজ‚ রসুনের গুদামঘর‚ সবখানে শক্ত পাহাড়ার ব্যবস্থা করা ছিল এতদিন৷ ছোটোখাটো কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলেও উত্তেজিত হয়ে পড়তে হয়েছে তাকে। এমনকি শারফানের ওপরও সত্যি সত্যিই নজরদারি করিয়েছে সে। সন্দেহজনক কিছুই পায়নি এখন পর্যন্ত। বরং মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকতে থাকতে কর্মীরা‚ শ্রমিকরা দিনে দিনে বিরক্ত হয়ে উঠছে৷ নিজেও কি কম পেরেশান? গত একটা মাসেরও বেশি দিন হলো মস্তিষ্ক সর্বক্ষণ সজাগ রাখতে গিয়ে ভীষণ ক্লান্ত আর মেজাজ খিটমিটে হয়ে গেছে তার৷
কিন্তু সব থেকে নিশ্চিন্তের ব্যাপার হলো শারফান ফরিদপুর নেই আজ অনেকদিন। হক ইন্ডাস্ট্রিসহ নিজের নতুন কোম্পানি নিয়ে পাগল হওয়ার জোগাড় ওর৷ দম ফেলার মতো ফুরসতটুকুও পাচ্ছে নাকি। তাই পছন্দের বারগুলোতেও পা পড়েনি ঢাকায় ফিরেছে অবধি। নজরদারি করিয়ে এতটুকু খবর উদ্ধার করতে পেরেছে সে। এ কারণেই লিঙ্কনের কথাগুলো ভুল মনে হলো না৷ যতটা ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল শারফান‚ তাতে এতগুলো দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কথা তো ছিল না। কিছু করার ক্ষমতা থাকলে বা সাহস থাকলে কি এতদিন চুপচাপ বসে থাকত ও?
ঘাড়টা চারদিকে ঘুরিয়ে ঘাড়ের ব্যায়াম করল দুবার। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বুজে ফারনাজ বলল‚ “আজকে পাঁচটায় বেরিয়ে পোড়ো৷ আমিও আজ বেশ রেস্ট করব।”
চওড়া হাসি দিলো লিঙ্কন৷ কতগুলো দিন ঠিকঠাক যে ঘুমাতে পারে না সে! আবার শরীর গরম করার সুযোগটাও পাচ্ছিল না বলে ম্যাডামের কাছে গালাগালি খেতে হচ্ছিল—যা সহ্য করার মতো না৷ অফিস থেকে বেরিয়েই ম্যাডামকে একটা মেসেজ করে দেবে আগে।
“থ্যাঙ্ক ইউ‚ স্যার”‚ গদগদকণ্ঠে বলল সে। দায়িত্বশীলতা দেখাতে আবার বলল‚ “অতিরিক্ত সিকিউরিটিও সরায়ে দিলে ভালো হয় না? হুদাই টাকাগুলো যাইতেছে গার্ডগুলোর পিছনে।”
“হুঁ?” চোখদুটো খুলে তাকাল ফারনাজ লিঙ্কনের দিকে। কয়েক মুহূর্ত তার কথাটা ভেবে শেষে সায় দিলো‚ “ঠিক আছে‚ সরিয়ে দাও।”
ঠিক পাঁচটা বাজতেই লিঙ্কন বেরিয়ে পড়ল বাজারে। ভালো একটা বডি স্প্রে কিনল‚ কিছু ফাস্ট ফুড আর কিনল কনডম। বাসায় যেতে যেতে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে মেসেজ করে জানাল তার ছুটির খবরটা৷ মেসেজ ফিরতি জবাব পেল তিন মিনিটের মাঝেই৷ খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল সে—সন্ধ্যার পরই আসতে চেয়েছে ম্যাডাম। “আয়‚ শালীর বেটি শালী”‚ মেসেজটা দেখতে দেখতে বিড়বিড় করল সে‚ “এতদিন যে গালি-গালাজ দিছস আমারে। তার ঝাল তুলব আজ এক ঘন্টাতেই।”
তিন গলি পেরিয়ে লিঙ্কনের রিকশাটা থামল তার বাড়ির গেটে। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে সে। একতলায় বাড়িটা৷ বাড়িওয়ালা অন্যখানে থাকে বিধায় আজ পর্যন্ত কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি তার গোপন অভিসারের জন্য।
ঘরে ঢুকে পোশাক না পালটেই আগে বিছানা পরিপাটি করল‚ সারা ঘর গোছাল‚ জানালাগুলো বন্ধ করল। বিছানা আর ঘর পরিষ্কার না থাকলে আবার আরেক দফা গালাগাল করবে তার ম্যাডাম। তারপর গেল গোসলে৷ আরামদায়ক গোসলটা শেষ করে বডি স্প্রে মাখল ভালোভাবে আর মুখে মাখল ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম। ঢেউ খেলানো ভেজা চুলগুলো হাত দিয়েই পরিপাটি করে নিল৷ পরনে জিন্স প্যান্ট আর টি শার্ট ঢুকিয়ে নাশতা গোছাতে দৌড়াল রান্নাঘরে। আসার সময় হয়ে গেছে ম্যাডামের। বড়োলোক ঘরের মেয়ে গাড়ি নিয়েই আসে। কিন্তু ভেবে পায় না লিঙ্কন‚ ড্রাইভারের মুখ বন্ধ রাখে কী করে তার ম্যাডাম? সেই লোকের সঙ্গেও কি ঘুমায়? না‚ সেটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ তাহলে কি আর তার কাছে আসতে না পেরে পাগল হত? তা ভেবেই অহমিকার এক হাসি ফুটল ঠোঁটে।
গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্কস ঢালতে ঢালতেই দরজায় হঠাৎ ছোটো করে দুবার টোকা পড়ল৷ এটা চির পরিচিত সঙ্কেত। কে এসেছে তা বুঝতে পেরেই উত্তেজিত হয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে দরজাটা খুলল লিঙ্কন। কালো বোরখায় দাঁড়িয়ে আছে ম্যাডাম। মুখে নিকাব। তাই একেবারেই চেনার উপায় নেই তাকে। গাড়ি রেখে এসেছে মূল সড়কে৷ ভুল করেও কখনো গলিতে নিয়ে আসে না সে গাড়িটা।
আশেপাশে কেউ দেখে নেওয়ার আগেই ঘরে ঢুকল ওরা। এক টানে মুখের নিকাবটা খুলল ফারিয়া। বোরখাটা খুলতে খুলতে আদেশ দিলো‚ “পানি আনো ফাস্ট।”
লিঙ্কন পানির গ্লাসসহ নাশতার ট্রে এনে হাজির করল তার সামনে৷ মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করল‚ “আসতে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?”
জবাব দিলো না ফারিয়া। পানি চাইলেও কোল্ড ড্রিঙ্কস দেখে ঢকঢক করে সেটাই খেয়ে নিল৷ নাশতার ট্রে ইশারায় সরিয়ে রাখতে বলল—পরে খাবে। ট্রে রেখে এসে বিছানায় এসে বসল লিঙ্কন ফারিয়ার গা ঘেঁষে। জিজ্ঞেস করল‚ “ওয়াশরুমে যাইতে হবে না?”
“হ যাব। তার আগে কও তুমার কাজের চাপ কি কমাইছে ভাইয়া?”
“হ”‚ এক গাল হেসে বলল লিঙ্কন‚ “আজকেরতে আমি আগের মতো ফ্রি৷ কাজের চাপ আর নাই। আপনার ভাইরেও এহনতে টেনশন মুক্ত দ্যাখবেন।”
যে জন্য কড়া পাহারাদার বসিয়েছিল ফারনাজ বাড়ি থেকে শুরু করে সবখানে‚ তার সমাধান হয়ে গেছে কিনা তা জিজ্ঞেস করল না ফারিয়া৷ কাজের কোনো কথায় সে তুলল না৷ চুপচাপ চলে গেল বাথরুমে। মিনিট দুয়েক পর বের হলো ভিন্ন পরিচ্ছদে৷ সেলোয়ার-কামিজের নিচে ছিল ফিনফিনে জর্জেট কাপড়ের খোলামেলা নাইটি। সেই বেশে এসে দাঁড়াল লিঙ্কনের দু পায়ের ফাঁকে মধ্যবর্তী স্থানে। কামুক চোখে চেয়ে হাঁ করে থাকা লিঙ্কনের ঊরুতে বসতেই তার কোমর জড়িয়ে ধরল লিঙ্কন। দুজনের নীরব সম্মতিতে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল তারা আরও গভীরে।
ফোনের স্ক্রিনে এ মুহূর্তগুলো দেখে তিনজোড়া পুরুষের চোখ ছানাবড়া অবস্থা৷ অনি মাঝে আর তার দু পাশে সাদ্দাম‚ রিপন। আড়চোখে ওদের দুটোর হাঁ করে গিলতে থাকা চেহারা দেখে ফট করে ফোনের স্ক্রিনটা দিলো উলটে। তারপরই দিলো এক ধমক‚ “জীবনে দেখিসনি?”
“দেখছি”‚ বলল সাদ্দাম‚ “এদের চেয়েও ভালো পারফরম্যান্স দেখছি। কিন্তু এইটার মতো এত ইন্টারেস্টিং লাগে নাই‚ মামা।”
“আরে ফারনাইজ্জার বোন তো এইটা নষ্ট দেখি!” অবাক গলায় বলল রিপন‚ “রুচি অত নিচু ক্যান? শেষে কিনা কর্মচারীর সাথে!”
“শালা ফোন সোজা কর”‚ ধমক দিলো এবার সাদ্দাম। “বড়ো লোক ভাতার রাইখে কর্মচারীর সাথে আইসে শুচ্ছে মানে ভিতরে কাহিনি আছে।”
“দাঁড়া‚ শায়াফকে আগে জানিয়ে দিই”‚ বলে হোয়াটসঅ্যাপে শারফানকে মেসেজ দিলো অনি।
লিঙ্কনই হলো ফারনাজকে জব্দ করার একমাত্র চাবি। তাই সেদিন অনিকে পাঠিয়েছিল শারফান তার ঘরে স্পাই ক্যামেরা লাগাতে৷ ইলেকট্রিসিটির কাজ জানে এমন দুজন ছেলেকে অনি পাঠিয়েছিল লিঙ্কনের বাসায়। ডিশ লাইনের তারে একটু সমস্যা হয়েছে এ বাহানায় তারা ঘরে ঢুকেছিল৷ সিলিঙের সাথে লেগে থাকা ওই ডিশ লাইনের তারের সাথেই স্পাই ক্যামেরা জুড়ে দিয়ে এসেছিল। এতগুলো দিনে যেসব রেকর্ড হাতে পেয়েছে তা দিয়েই ইতোমধ্যে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা শেষ শারফানের৷
ঢাকার জ্যামে আটকা পড়ে গাড়িতে বসে আছে শারফান। কিন্তু মোটেও কাজ ছাড়া বসে নেই৷ নতুন কোম্পানির জন্য বড়ো বড়ো ক্লায়েন্ট ধরতে ব্যস্ত সে। এই মুহূর্তে কলে কথা চলছে এমনই একজনের সঙ্গে। কথা শেষ করে অনির মেসেজটা দেখতে পেয়ে অ্যাকাউন্টে লগইন করল ফোন থেকেই। অমনিই চোখের সামনে শুরু হয়ে গেল লিঙ্কন আর ফারিয়ার লাইভটা। “আরিশ্শালা”‚ চমক পেল শারফান। দেখতে দেখতেই হাসল একটু বাঁকা ঠোঁটে। ফোনের স্ক্রিন লক করে কিছু একটা ভাবতে শুরু করল৷ তার মাঝেই জ্যাম ছাড়ল হঠাৎ। গাড়িটা ঢুকে পড়ল বসুন্ধরা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে৷ বাড়ি পৌঁছে গেল সে কিছুক্ষণের মাঝেই।
প্রথমে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকলেও পরবর্তীতে সেটা বিক্রি করে এই ট্রিপলেক্স বাড়িটা কিনে দেন ছেলেকে শাফিউল সাহেব। না‚ পুরোপুরি ট্রিপলেক্স নয় যদিও। আবার ডুপ্লেক্সও নয়৷ সুন্দর একটা কোর্টইয়ার্ড থাকলেও ছিল না একটা সুইমিং পুল। গত বছর রুফটপে নিজের পছন্দসই সেটাও করিয়ে নিয়েছে শারফান। বাসায় ঢুকেই রোজ নিয়ম করে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় না এলিয়ে ছেড়ে দেয় আগে সেখানেই। কারণ‚ ঢাকায় আর শীত নেই এখন।
সুট আর অফিস ব্যাগটা লিভিংরুমের সোফায় ফেলে রেখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে দোতলায় রওনা হলো সে৷ ঘরে ঢুকে আর দেরি করল না শার্ট প্যান্ট পালটাতে। কাজের জগতে ঢুকে পড়লে সারা দিন যত যা-ই করুক রাতে ওর লম্বা একটা ঘুম দিতেই হবে। তাই বারে বা অন্য কোথাও বের হলেও কখনো কোথাও রাত পার করেনি সে।
বিরক্তে কপাল কুঁচকে ক্যাবিনেটে খুঁজতে থাকল একটা টি শার্ট। আজ ওটা পরেই শোবে সে—বেশ নরম কাপড় কিনা। খুঁজতে খুঁজতে হাতে এলো চাদর। সব সময় ওর জামাকাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে দেয় মা নয়ত জারা। তারাই কেউ চাদরটা দিয়ে দিয়েছিল।
সেটা দেখতেই কেমন নস্টালজিক হয়ে গেল শারফান। মনে পড়ে গেল‚ নেহাৎ বিরক্ত করতেই সেদিন চাদরটা ছিনতাই করেছিল সে। বিগত দিনগুলোই নিজের উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য পূরণে এতটাই মগ্ন হয়ে ছিল যে সানার কথা ভুলতেই বসেছিল প্রায়। কী খবর এখন মেয়েটার? নিষ্কৃতি পেয়েছে নিশ্চয়ই বেচারি? কিন্তু সে তো এক বিন্দু শান্তিতে নেই—কত কাজ! মনে মনে তাই হিংসা হলো সানার জন্য। কেমন হয় তার শান্তিটাকেও একটু বিনষ্ট করলে? ভেবেই মুচকি হেসে উঠল সে। চাদরটা রেখে টি শার্টটা খুঁজে বের করল। চলে এলো তারপর পুলে৷ পানিতে নেমে এ-মাথা থেকে ও-মাথা সাঁতার কাটতে কাটতেই মাথার ভেতর কিছু চিন্তাভাবনা চালাল৷ হঠাৎ এসে থামল পুলের পাশা রাখা ফোনটার কাছে৷ হাতটা তোয়ালেতে মুছে নিয়ে কোনো দ্বিধা ছাড়াই কল লাগাল বিশেষ নাম্বারটাই৷
রাত বাজে ৮: ৩০ মিনিট। টেবিলে বসে পড়ছিল সানা। ফোনটা তার মেহার হাতে। স্ক্রিনে ‘এসএস’ নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে মেহা জিজ্ঞেস করল‚ “এসএস কে রে‚ আপু?”
কথাটা শোনা মাত্রই চমকাল সানা‚ “কেন? কী হয়েছে?”
“কল দিচ্ছে।”
বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল সানার৷ ছোঁ মেরে ফোনটা বোনের হাত থেকে নিয়ে নিল সে৷ রিসিভ করবে কি করবে না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল দু সেকেন্ড। কিন্তু রিসিভ করার জন্যই মনটা ছটফট করল বেশি৷ মেহার উপস্থিতি পরোয়া না করে কানে ফোনটা ঠেকাল সে—কিন্তু মৌন রইল একদম।
“হ্যালো?” ভেসে এলো শারফানের পৌরুষ‚ দৃপ্ত কণ্ঠ।
বেশ অনেকদিন পর কণ্ঠটা শুনতেই কেমন শিরশিরানি এক অনুভূতি টের পেল সানা বুকের ভেতর। “কে বলছেন?” চিনেও না চেনার ভানটা করল কেন যেন।
“আরে… বেঁচে টেচে আছ দেখি!”
টিটকারিটা শুনেই সানার ভ্রু জোড়া বেঁকে গেল। বিড়বিড় করল‚ “শয়তান তো শয়তানই৷ শয়তান কি আর ভালো হয়?” নিঃশব্দে হতাশাপূর্ণ শ্বাসটা ফেলে বলল‚ “আপনিও দেখি বেঁচেই আছেন।”
“কেন? এবারও কি আমার পটল তুলতে যাওয়ার দোয়া করেছিলে?”
মুহূর্তেই মেজাজটা নষ্ট হয়ে গেল সানার। “ফোন দিয়েছেন কেন?” কঠিন গলায় ধমকে উঠল তাই।
হাসল শারফান‚ “একটু ভিডিয়ো কলে আসো। মাখন কি আরও বেড়েছে না কমেছে‚ দেখি একটু।”
“কথা কিন্তু ঠিকঠাক করে বোলেন”‚ অনুচ্চ গলায় বলল সানা‚ “নয়ত ফোন রেখে দেব।”
“আহা! রাখবে কেন? শুধু তো দেখতেই চাইলাম। খেতে তো আর চাইনি। একটু খেতে দিলে উপকারই হত অবশ্য। মাখনের যে কী দাম!”
এসব কথায় আগে ভীষণ রাগ আর গালাগাল করত সানা। কিন্তু তাতে দেখা যেত আরও বেশি বেশি তাকে খেপাত শারফান। তাই আজ রাগ হলেও খেপল না সে৷ “তাহলে বমি করে পাঠাই?” ঠান্ডা স্বরেই জবাব দিলো ওকে‚ “আমার বমিতেও মাখন আছে। দেখবেন না-কি খেয়ে?”
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩২.
জিভের ডগায় এমন এক উত্তর চলে এলো শারফানের‚ কেবল ফোনের ওপাশের মেয়েটা সানা বলেই জিভকে ঠেকাল। তাতে আবার নিজেই নিজের প্রতি একটু অবাক হলো। কবে থেকে সে রাখঢাক করে‚ ভদ্রতা জ্ঞান করে কথা বলা শুরু করল? ভাবতেই মনে পড়ল ওর‚ ডিসেম্বরে ফোনে সানার সঙ্গে যেভাবে কথোপকথন শুরু করেছিল তা ছিল সানার জন্য ভীষণ রুচিহীন‚ লজ্জাজনক আর বিব্রতপূর্ণ। এজন্য একটা সময় নিজের অজান্তেই কিছুটা সংযত করে নিয়েছিল ভাষাকে। আর এই সতর্কতাটা আজও ওর অবচেতন মন খেয়াল রেখেছে! আশ্চর্য তো! কেন রাখছে সে এত কিছু খেয়াল? সানা যদি লজ্জা পায়‚ বিব্রত হয়‚ তাতেই বা কী ওর?
“কী হলো? মনে মনেই খেতে শুরু করেছেন না-কি?” শারফানের চিন্তার মাঝে হঠাৎ বলে উঠল সানা।
তাতে ভাবনার সুতো কাটল শারফানের। উত্তর দিল কপট বিস্মিত গলায়‚ “সে কী! তুমি পেট থেকে উগড়ে দিয়ে আবার চেটে খাও তা? ইস… সানা‚ এমন গিধড় তুমি! যতই মাখন থাকুক আর ক্রিম‚ বমিকে বিপজ্জনক তরল বলে‚ জানো না?”
“চুপ করুন! ওটা আপনি খান। আমি না।”
“তুমি না বললে আমি তো জানতামই না তোমার বমিতে মাখন থাকে”‚ রসিক গলায় বলল শারফান‚ “তুমি জানো মানে নিশ্চয়ই তুমি খেয়েছ বলেই জানো। আরে লুকোনোর কী আছে? বাচ্চারা তো কত কিছুই খায় না বুঝে‚ না জেনে। এমন উলটাপালাটা আর কী খাও তুমি? বলতে পারো আমাকে৷ বকা দেব না‚ প্রমিস।”
“আপনার মাথাটা কুরিয়ার করে পাঠাবেন? হাতুড়ি দিয়ে ওটাকে শায়েস্তা করতাম তাহলে।”
“বলো তো পুরো আমাকেই পাঠাই? হাতুড়ি না‚ ঠোঁট দিয়ে শায়েস্তা করলেই হবে। একটুও রাগ করব না।”
গালদুটো লাল টুকটুকে হয়ে উঠল সানার নিমেষেই। ঠাস করে ফোনটা কেটে দিতে গিয়েও দিল না। কয়েকটা বকা না শুনিয়ে এমনিই রেখে দেওয়া যায়? বলল কিড়মিড়িয়ে‚ “আপনি কোন লেভেলের পারভাট জানেন? লুচ্চার চেয়েও নীচ কোনো শব্দ থাকলে সেটাই আপনি। ফাতরা‚ ছ্যাঁচড়া‚ খচ্চর‚ ইতর…” বলতে বলতে একটু থামল আরও কিছু গালি মনে করার জন্য।
তা বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে শারফান নিজ দায়িত্বেই জানাল‚ “লেচার‚ উইমেনাইজার‚ ক্রিপ‚ স্কাউন্ড্রেল‚ ফিলান্ডেরার। আরও লাগবে?”
“এত ক্রিঞ্জ আপনি! আপনার প্রেমিকা থাকে না আসলে আপনার এসব ছ্যাঁচড়ামির জন্য‚ বুঝলেন?”
“কে বলেছে তোমাকে? ওদের আমার বাঁ হাতের প্যাঁদানি বদহজম হয়ে যায় বলে থাকে না। এরকম ছ্যাঁচড়ামি করলে তো ওরা উঠতে‚ বসতে‚ খেতে‚ হাগতে আমাকে চুম্মাইতে চু্ম্মাইতে ধ্বংস করে ফেলত। তুমিই খালি এর মর্যাদা দিলে না।”
“যত দুনিয়ার ঢপ শুধু আমার কাছেই দিতে পারেন। কোনো মেয়েই আপনার এসব ফাতরামি সহ্য করবে না।”
“কোনো মেয়ের কাছে যাচ্ছেই বা কে‚ হানি? তোমার মতো কেষ্ট তো আর কারও হয়নি। তুমিই একমাত্র কপালিনি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সানা পরাজয় স্বীকার করল। ঝগড়ায় সে এতটাও পটু না। সেখানে শারফানের মতো ঝানু লোকের সঙ্গে কথায় পারা তো আরও অসম্ভব। হঠাৎ করে মনে পড়ল নিশার কথা৷ এই বদমাশ তো নিশার সাথে মনে হয় প্রেম শুরু করেছে। তার সঙ্গে যা অসভ্যতা করে তা কি নিশার সাথেও করে সে? ওর কথা অনুযায়ী নিশা কি তখন সত্যিই খুশিতে চুমু খায়? আগে পিছে না ভেবে শুনেই বসল শারফানের কাছে‚ “আপনাকে একটুও গালাগালি করে না নিশা?”
“নিশা? নিশা টপকাল আবার কোত্থেকে?”
প্রশ্নটা শুনে দ্বিধায় পড়ে গেল সানা—দুজনের সম্পর্কটা কি তবে হয়নি? কথা বলল না কোনো। তার নীরবতা দেখে শারফানই বলল‚ “নিশা পাশাকে টলারেট করার ধৈর্য নেই আমার। ছুকরিটাকে চেয়েছিলাম যে কাজে সে কাজে লাগল না।”
“কী কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন ওকে?”
“ওই তোমাকে দিয়ে যেটা হলো না… সেটাই।”
“আমাকে নিয়ে আর কী ভেবেছিলেন?” গলাটা গম্ভীর হলো সানার কিছুটা।
“কী আর ভাবব? ভেবেছিলাম ফারনাজের রাসলীলা দেখে ওকে দূরছাই করে দেবে আর আমার হয়ে একটু স্পাইগিরি করবে। কিন্তু করলে তো উলটো”‚ উপহাসপূর্ণ হাসল শারফান। “আর তোমাদের বোন তো আরেক সেয়ানা। সরাসরি জামাই বানানোর ধান্দায় ছিল মনে হয়। আমি কি গু খেয়েছি যে ওসব ডাবলিং করা চিজ ঘরে আনব?”
ঠাট্টার ছলে খোঁচা দিতে এত দক্ষ শারফান! তা আজ ভালোভাবে বুঝল সানা। অবশ্য সেদিনের রাগ আর ক্ষোভের বশে করা ভুলটার জন্য সে তো এমনিতেই সারাজীবন পুড়বে।
“ডাবলিং বোঝো?” জিজ্ঞেস করল শারফান।
ওর দুর্ঘটনাটার কথা মনে পড়ে মেদুর ছায়া ভর করেছে সানার মনে। “না”‚ জবাব দিল কেমন মন্থর সুরে।
“এক সাথে দুদিকে চালানো হলো ডাবলিং। তোমার বোন আমাকেও লাইন মারে আবার ওদিকে তার খালাত ভাইকেও ব্যাকআপ রাখে। মানে আমি যদি জাল থেকে ছুটেই যাই তখন যেন হতাশ হতে না হয়। তাই পুরোনো প্রেমকেও অবহেলা করে না সে।”
“এত খোঁজ রেখেছেন ওকে নিয়ে?”
“রাখতে হয়। সবাইকে নিয়েই রাখতে হয়।”
“ঠিক আছে‚ রাখতে থাকুন। কাটছি কল। পড়ব আমি।”
“হলো কী? ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেল না-কি? গলায় একটু আগের এক্সাইটিবিলিটি গেল কোথায়?”
“আপনার মতো ফুল অফ এনার্জি না আমার ব্যাটারি”‚ নীরস কণ্ঠে বলল সানা।
“আমাকে দাও তোমার ব্যাটারির দায়িত্ব। এনার্জি ওভারলোডেড করে দেব একদম।”
আবার সেই ফিচলেমি কথাবার্তা! বিষণ্ণ মন‚ ব্রীড়া‚ দুয়ে মিলিয়েই ফোনটা এবার কেটে দিল সানা।
শারফানও আর কল করল না। ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকা অভিব্যক্তি নিয়েই পুল থেকে উঠে পড়ল৷ “আজকের মতো ডোজ এতটুকুই থাক”‚ বিড়বিড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল তারপর।
***
১৮ ফেব্রুয়ারি
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা সভা চলছে আজ। তাই গতকালই ঢাকা চলে গেছে ফারনাজ। ফিরবে হয়ত সপ্তাখানিক পর৷ ব্যাবসার সমস্ত দায়িত্ব এখন পালন করছে কবির সাহেব আর লিঙ্কন। ফারনাজ না থাকলে কাজের চাপ অবশ্য বেড়ে যায় লিঙ্কনের। তাও সে খুশি। কারণ‚ সন্ধ্যার পর ফারিয়ার সঙ্গে এখন প্রায় প্রতিদিনই অভিসার চলছে। আজও সে আসবে নাকি নিজে থেকেই একবার জিজ্ঞেস করবে ভাবল৷ পকেট থেকে ফোনটা বের করে জুট মিল কারখানার গেটের বাইরে চলে এল। মেসেজ করল ফারিয়াকে। জবাবের অপেক্ষায় হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দিকে আসতেই মেসেজ টোন বেজে উঠল ফোনে—না বলল ফারিয়া। তার বর ফিরেছে ঢাকা থেকে। থাকবে দিন দশেক। এ কদিন আর দেখা হবে না ওদের৷
এ মেসেজটা পড়েই বিচ্ছিরি এক গালি দিয়ে উঠল লিঙ্কন। সেটা ফারিয়াকে না-কি ফারিয়ার স্বামীকে‚ তা নির্দিষ্টভাবে বোঝা গেল না। কারখানার ভেতর যেতে যেতে হঠাৎ খিস্তি দিয়ে বসল ফারিয়ার স্বামীকে‚ “শালা মরদহীন পটকা‚ দশটা দিন আমার শান্তি কাইড়ে নিলি।”
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী সাকিব হাসান একজন বড়ো ব্যাবসায়ী। ফারিয়ার সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান আঠারো বছর হলেও বিয়েতে অমত ছিল না ফারিয়ার। বছর সাতেক হলো তাদের বিয়ের বয়স। পাঁচ বছরের একটা কন্যা সন্তান আছে। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ফারিয়া আবিষ্কার করে সাকিবের অর্থ থাকলেও তাকে দৈহিক তৃপ্তি দেওয়ার মতো সামর্থ্য তেমন নেই৷ তার শারীরিক অক্ষমতা দিনে দিনে বেড়েই চলে৷ চিকিৎসা চালিয়েও যখন কোনো ফল এল না তখন থেকেই এ নিয়ে তুমুল অশান্তি শুরু করে ফারিয়া। সাকিব এই অশান্তি থেকে বাঁচতেই ব্যাবসার অজুহাতে ঢাকাতে পড়ে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়গুলো। নাম মাত্রই সংসারটা টিকে আছে তাদের৷ আর এর মাঝেই গত বছর লিঙ্কনকে হঠাৎ চোখে লেগে যায় ফারিয়ার৷ কেবল নিজের কামনা পূরণে সে ব্যবহার করে চলেছে তাকে৷ লিঙ্কনও বিনা আপত্তিতেই ফায়দা লুটে নিচ্ছিল৷ কিন্তু কে জানত এই ফায়দাই তার জীবনের সব থেকে বড়ো ক্ষতির কারণ হবে?
জুট মিলের গেটের মধ্যে প্রবেশ করার পরই তার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ ঢুকল। নাম্বার অচেনা। প্রোফাইলে কোনো ছবিও নেই। কিন্তু মেসেজটার ভিডিয়ো খুব চেনা। ভিডিয়োটার একটুখানি দেখতেই তার বুকের ভেতর কেউ খামচি দিয়ে ধরল যেন। কেমন সম্মোহিতের মতো চেয়েই রইল ভিডিয়োতে। নিজের ঘর থেকে নিরাপদ জায়গা আর কোথাও হবে না বলেই জানত সে। আচ্ছা‚ ফারিয়া নিজে করেনি তো? না‚ এ ভাবনা সব থেকে বড়ো বোকামি ভাবনা। বরং প্রতিটি মুহূর্তে ফারিয়া নিজেই শাসিয়ে থাকত তাকে‚ যেন চালাকি করে কোনো ভিডিয়ো বা ছবি রাখার চেষ্টা না করে সে। তাহলে কীভাবে ঘটল এত বড়ো বিপদ? পায়ের ওপর ভর দিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। নাম্বারটাই কল ঢোকানোর চেষ্টা করল তারপর—ঢুকল না। তখনই ‘প্রাইভেট নাম্বার’ থেকে কল এল তার কাছে৷ নাম্বার হাইড করে কেউ কল দিচ্ছে তাকে! ইতোমধ্যে গলা শুকিয়ে গেছে তার৷ রিসিভ করল কলটা। “কে বলছেন?” জিজ্ঞেস করল মৃদুস্বরে।
“পরিচয় শুনে আর কী করবি?” বলল ফোনের ওপাশ থেকে‚ “কেমন লাগল বল? আরও দুটো দেখবি না-কি?”
“কে ভাই আপনি?” কান্না উঠে এল লিঙ্কনের কণ্ঠে‚ “কীভাবে পাইলেন এসব? আপনার কি কোনো ক্ষতি করছি আমি?”
“ধুর ব্যাটা!” দিল এক ধমক ফোনের ব্যক্তিটি। “মেয়েদের মতো ডায়ালগ ছাড়ছিস যেন তোর ইজ্জত খেয়ে দিয়েছি আমি। কান্নাকাটি থামা আর আমাকে জিজ্ঞেস কর‚ কী চাই আপনার‚ ভাই?”
“কী চান‚ ভাই?”
“তোর জান না। ভয় নেই। অবশ্য ফারনাজের হাতে এই জিনিস গেলে তোর গলা পাড়া দিয়ে ধরেই ছিঁড়ে নেবে গলাটা।”
কথা সত্য৷ সে ভয়েই ফুঁপিয়ে উঠল লিঙ্কন। ফোনের ব্যক্তিটি জিজ্ঞেস করল তখন‚ “বাঁচতে চাস?”
“ভাই… আমারে মাইরেন না… ফারনাজ ভাইরে কিছু কইয়েন না‚ ভাই”‚ কাঁদতে কাঁদতেই বলল লিঙ্কন।
“তখনই বলব‚ যখন আমার কথা মতো কাজ করতে না পারবি।”
“আপনি যা করতি কন সব করব আমি”‚ হড়বড়িয়ে বলে গেল লিঙ্কন‚ “আমি আপনার চাকর হয়ে থাকব‚ ভাই।”
“ওয়েল…” তারপরই বলে চলল সে কী চাই তার লিঙ্কনের কাছে।
সবটা শোনার পর প্রস্তরীভূতের মতো দেখাল লিঙ্কনকে। “এই কাজ করলি আমি এমনিতিই মরব”‚ ফিসফিসানিতে মৃত্যু ভয় তার।
“সাবধানে না করলে মরবি তো নিশ্চয়ই। কীভাবে করলে বেঁচে থাকবি আর আমার কাজও হয়ে যাবে‚ এ দায় তোরই। সময় দিলাম ঘণ্টাখানিক৷ ভেবেচিন্তে নে। তারপর কল পাবি আবার”‚ বলেই ফোনটা কেটে দিল ব্যক্তিটি।
কয়েক মুহূর্ত ঠায় বসেই থাকল লিঙ্কন। তারপর হঠাৎ বেরিয়ে গেল কারখানা থেকে৷
***
আবহাওয়াটা দিনের বেলা চমৎকার ছিল। ফাগুন বাতাস বইছে কিনা! না শীত আর না গরম। আলোচনা সভার পর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায় ফারনাজের৷ শাকিবুল সাহেবের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছে এবার৷ কড়া বাক্যই হজম করতে হয়েছে তাকে সবার কাছে৷ এরপরই আবার নেত্রীর সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল তার৷ আগামীর মাঠ যে পুরোটাই তার দখলে থাকবে—এ আশ্বাস দিয়েছে তাকে নেত্রী। সাথে আরও একটা খুশির সংবাদ পেয়েছে সে। ফরিদপুর ১ আসনের এবার মন্ত্রী হয়েছে খলিলুর রহমান। স্থানীয় সরকার‚ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। অনেক টাকার কাজ পেতে চলেছে সে। সেই কাজের একাংশ দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সে ফারনাজকে। আর দায়িত্ব নেওয়া মানেই তো টাকার বাণ্ডিল নিয়ে খেলা।
বনানী
রাত ৪: ২০ মিনিট ।
নিজের নামে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে ফারনাজ গত বছরই। ইচ্ছা আছে এ বছরই বিয়েটা করে বউ নিয়ে চলে আসবে এখানে। তবে ছোটো চাচা যদি রাজি না হন তাহলে বছর দুয়েক পরই না হয় আসবে সানাকে নিয়ে। আর ব্যাবসা দেখাশোনা করবে এখানে বসেই।
সারা দিনের খুশির সংবাদ নিয়ে ঘুমটা খুবই আরামের হচ্ছিল ফারনাজের৷ যাকে বলে গাঢ় ঘুম। তাই ফোনকলের ভাইব্রেশন টের পেতে সময় লাগল তার অনেক। চোখদুটো খুলে ঝাপসা চোখে যখন ফোনের স্ক্রিনে তাকাল তখন পঁচিশটা মিসড কল উঠে আছে সেখানে। প্রতিটি কল বাড়ির সদস্য আর লিঙ্কনের। এত রাতে সবাইকে এমন মরিয়া হয়ে কল করতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল সে। কল ব্যাক করার প্রয়োজন পড়ল না। লিঙ্কনের কল এল তার আগেই৷ রিসিভ করে দ্রুত কানে চেপে ধরল ফোনটা‚ “কী হয়েছে‚ লিঙ্কন? আব্বা‚ আম্মার শরীর ভালো আছে তো?”
“স্যার”‚ উচ্চরবে কান্নার সুর তুলে বলল লিঙ্কন‚ “পাটের গুদামে আগুন লাইগে সব শ্যাষ। কাঁচামালের ঘরও। ফায়ার সার্ভিস আসার পরও কোনো লাভ হইতেছে না। কী আগুন! নিভেবারই পারতেছে না। কবির স্যার অসুস্থ হইয়ে পড়ছে। উনারে হাসপাতালে নিয়াইছি।”
“আর সিকিউরিটি গার্ড” চিৎকার করে উঠল ফারনাজ‚ “ওই কুত্তার বাচ্চাগুলো কোথায় ছিল? ওরা কী করছিল? নাকি ওরা পুড়ে গেছে?”
“ওগের আইজকে মরার ঘুমে ধরছিল‚ স্যার। এহনো উরা চোখ খুলে তাকাবার পারতেছে না ভালোমতো৷”
এরকম ঘুম তো তারা কোনোদিনও ঘুমায়নি। তাছাড়া ঢাকায় আসার আগে ফারনাজ তাদেরকে সতর্ক থাকতে বলে এসেছিল। সেই আদেশ অমান্য করার মতো পাহারাদার তো তারা না‚ যে এখনো ঠিকমতো চোখ খুলতে পারছে না ঘুমে! এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েই ফারনাজের মাথার ভেতর খোঁচা দিল একটা নাম—শারফান৷ নামটা মনে আসতেই কেমন পাথরমূর্তির মতো বনে গেল সে। ওর বলা হুমকি বাক্যগুলো একে একে মনে পড়ল। সবটাই তো তাকে জানিয়ে দিয়েছিল শারফান। তারপরও সে পারল না বিপদ ঠেকাতে? কেন ভেবে নিল তার কিছুই করতে পারবে না ও? আজকের এই বিপদের দায়ভার তবে তো তার নিজেরও।
লিঙ্কন অস্থির হয়ে ডাকাডাকি করতে থাকল ফোনের মধ্যে। কোনো উত্তর নিল না ফারনাজ। ফোনটা কেটেই ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি বের করতে বলে দিল।
ফরিদপুর
সকাল ৯: ৪৫ মিনিট ।
রাত থাকতে বেরিয়ে পড়ায় রাস্তায় আর ফেরিঘাটে জ্যাম ছিল না বিধায় দ্রুতই পৌঁছল ফারনাজ। পথিমধ্যে পুলিশসহ বিশেষ বিশেষ কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা চলল তার৷ শারফানের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কেও জেনে নিল। ও ঢাকাতেই আছে। কিন্তু কাজটা যে ওরই তা বুঝতে চাক্ষুষ প্রমাণের প্রয়োজন নেই তার। অন্তত সিকিউরিটি গার্ডগুলোর অমন মরার ঘুম হওয়াটাই বলে দেয় মূল রহস্য কী। তবে পুলিশ দিয়ে তাদের জেরা করা হলে জানা গেছে‚ গত রাতে তারা কেউ বাইরের খাবার খায়নি। বাড়ি থেকে আনা খাবারই খেয়েছিল শুধু। আর খাবারের বক্স তো সিকিউরিটি রুমেই রাখা থাকে। সেখানে তারা ছাড়া আর কেউ কখনো প্রবেশ করে না‚ গতকালও নাকি করেনি। আপাতত তাদের আটক করা হয়েছে।
হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে ফারনাজের মা-বোন৷ যে পাট আর কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল এই জুট মিল‚ তা সব শেষ। কোটি কোটি টাকার কাজ বন্ধ আর ক্ষতি। আগুনের হলকা আর নিকষ কালো ধোঁয়া আকাশের মেঘ ছুঁতে চাইছে। দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সেই আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে হায় হায় করছে সকল মানুষ। ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ কেউ আবার আল্লাহকে শুকরিয়া জানাচ্ছে‚ ভাগ্যিস কোনো শ্রমিক বা কর্মী আগুনে পোড়েনি। কিন্তু তা শুনে একদম সহ্য হলো না ফারনাজের৷ ওর ক্ষিপ্ত‚ হিংস্র মনটা দোষারোপ করল আল্লাহকে‚ কটা জীবনের বিনিময়েই না হয় তার ক্ষতিটা আটকাতেন তিনি! কেন তা করলেন না? রাক্ষুসে ওই আগুন দেখতে দেখতে একটা সময় মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল তার। জলদি এসে তাকে জাপটে ধরল লিঙ্কন। চেয়ারে কোনোরকমে বসিয়ে মাথায় পানি ঢালতে আরম্ভ করল।
বেলা ১২: ১৫ টা।
দ্বিতীয় দুঃসংবাদ—সবাই যখন আগুন নেভানোতে ব্যস্ত তখনই রাতের আঁধারে কেউ বা কারা তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পেঁয়াজ‚ রসুনের গুদাম অর্ধেক শুন্য করে ফেলেছে। এ খবর পাওয়া মাত্রই জাহিদা বেগম দু হাত তুলে বিছানা চাপড়াচ্ছেন আর আর্তনাদ করছেন। পুলিশকে নামতে হলো এ তদন্তেও৷ এলাকার স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারল‚ একটা ট্রাক এসে দাঁড়াতে দেখেছিল দুয়েকজন। কিন্তু আগুন নেভানোর কাজে লেগে পড়ায় সেভাবে কেউ গুরুত্ব দেয়নি ট্রাকটাকে।
ঠিক এমন মুহূর্তেই ঢাকার একটি বাজারে হাট বসেছে। সেখানে পেঁয়াজ‚ রসুনের খুচরা ব্যবসায়ীরা ভীষণ উচ্ছ্বাসিত হয়ে দোকান সাজাচ্ছে।
বেলা ২: ২৬ মিনিট।
রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ নেতা‚ প্রশাসনে জড়িত কজন হর্তাকর্তা গোছের অফিসার‚ ব্যবসায়িক বন্ধুমহল‚ আত্মীয়-স্বজন‚ সবাই উপস্থিত ফারনাজের বাসায়৷ নানানরকম কথাবার্তা‚ বুদ্ধি‚ পরামর্শ‚ উপায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে তাদের ফারনাজ আর কবির সাহেবের সঙ্গে৷ নার্ভ দুর্বল কবির সাহেব বিছানা শয্যা হলেও ফারনাজ এখনো শক্ত অনেকটাই।
ঠিক তখনই লিঙ্কনের কাছে থাকা ফারনাজের ফোনটা বেজে উঠল৷ সরিষার তেলের কারখানা থেকে কল এসেছে। ধুকপুক করা বুকটা নিয়ে লিঙ্কন চিন্তা করল‚ এখন এখান থেকেও কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হবে কিনা কে জানে! রিসিভ করল সে। ওপাশের কথা শুনতে শুনতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল তার। ভুল অনুমান করেনি সে। ফোনটা রেখে তাকাল একবার ফারনাজের দিকে৷ স্যারের অস্বাভাবিক ঠান্ডা চেহারাটা দেখে হাঁটুর কাঁপুনি অনুভব করল সে৷ ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল তার কাছে৷ নীরবে কথা শুনছিল ফারনাজ পুলিশ অফিসারের৷ চোখ তুলে লিঙ্কনের দিকে তাকাতেই লিঙ্কন মৃদু কণ্ঠে বলল‚ “স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে খাদ্য পরিদর্শক কর্মকর্তা আইছে কয়জন তেলের কারখানায়। তেলের ভেজাল ধরছে আইসে। আপনারে ডাকতেছে এখনে। মেলা সাংবাদিকও নাকি আইছে।”
কথাগুলো কবির সাহেবের কানে পৌঁছয়নি। তার সামনে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না ফারনাজ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল লিঙ্কনকে নিয়ে৷ কারখানায় ফোন করল। কথাবার্তা বলার পর ফিরে এসে আলাদা ঘরে নেতা গোষ্ঠী আর পুলিশের সঙ্গে আলোচনায় বসল সে।
সারাটা দিন পেরিয়ে গেল সবার ছোটাছুটি করতে করতেই৷ সরিষা তেলের কারখানার সুরাহা মিলল না স্বাস্থ্য দপ্তরের উপর মহলে কথাবার্তা বলেও৷ কারণ‚ মিডিয়া কর্মীদের খবর তারা দেয়নি কেউ৷ তাদেরকে ডেকে কে পাঠিয়েছিল তাও জানা নেই৷ তাদের মাধ্যমেই ইতোমধ্যে খবরের দুটো স্বনামধন্য চ্যানেলে প্রচার হয়ে গেছে ঘটনা৷ তাই বাধ্য হয়ে কারখানা সিল করতেই হবে তাদের৷ আইনি প্রক্রিয়া না মেটা পর্যন্ত চালু করার অনুমতি দিতেও অক্ষম তারা।
তবে এর মাঝে ফারনাজের কিছুটা স্বস্তির বিষয় হলো—গুদামে থাকা পাট‚ তৈরি পণ্য বা কাঁচামাল চুরি‚ অগ্নিকাণ্ড বা অন্য ক্ষতির বিরুদ্ধে বিমা করা ছিল। এ মুহূর্তে বিমা কোম্পানির সঙ্গেই কথাবার্তা চলছে তার। আর পুলিশ ভালোভাবেই নেমে পড়েছে তদন্তে।
***
গুলশান
হেরিট্যান্স ক্লাব
রাত ১০: ০৫ মিনিট
ইউরোপীয় লাউঞ্জের আদলে সাজানো হয়েছে এই প্রাইভেট ও এক্সক্লুসিভ লাউঞ্জ ক্লাবটি। ভেতরটা দারুণ বিলাসবহুল। হালকা হলুদাভ আলো‚ বার কাউন্টারের পেছনে বোতলের ব্যাকলিট শেলফ‚ ব্যাকলিট দেওয়াল‚ এলইডি ব্যাকলিট টিভি। আর চকচকে‚ মসৃণ‚ ঠান্ডা পাথরের মতো হোটেলের মেঝে‚ কাউন্টার টপ‚ দেওয়াল।
চকলেট রঙা চামড়ার বড়ো সোফাটাই রিহান ও জিসান৷ আর সিঙ্গেল সোফাটা শারফানের দখলে। এর মাঝে সার্ভার এল হাতে এসপ্রেসো মার্টিনি নিয়ে। সামনের গোল টেবিলটাই রাখল গ্লাস তিনটা৷ চকলেটের জেস্ট দিয়ে রিম করা গ্লাসগুলোর দিকে চেয়েই রিহান আর জিসানের চোখ জুড়িয়ে গেল। ধোঁয়ার ইফেক্ট দিয়ে চমৎকারভাবে পরিবেশন করা হয়েছে গ্লাসগুলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে দুজনেই এক সঙ্গে চুমুক বসাল। আঙুলের ইশারায় বলল রিহান‚ “লাজবাব‚ ভাই।”
বারটেন্ডার যে দারুণ পেশাদার তা আগেই বলেছিল শারফান৷ এবং ওর সঙ্গে খুব আন্তরিক সম্পর্কও তার৷ জিসানও সুনাম করল বেশ। শারফান মুচকি হাসল শুধু আর সফট রিমিক্সের সঙ্গে সোফার হাতলে আঙুল বাজাতে থাকল৷ চারপাশে শুধু কর্পোরেট সেক্টরের মানুষ‚ কজন খ্যাতিমান তারকা‚ সমাজের প্রভাবশালী‚ মর্যাদাপূর্ণ ব্যবসায়ী। এর মাঝে কেউ কেউ জিসানকে দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। তাদের অস্বস্তিপূর্ণ চাউনিগুলো লক্ষ করে সে হাসতে শুরু করল‚ “কী এক যন্ত্রণার পেশায় ঢুকেছি যে!”
“কেন? কী হলো‚ ভাই?” জিজ্ঞেস করল রিহান।
“দেখো সো কলড সেলেব্রেটিগুলোকে৷ যদি পারত তো আমাকে লাথি মেরে বের করে দিত এখান থেকে। অথচ আমি কিন্তু হলুদ সাংবাদিক নই।”
“হলুদ সাংবাদিক না হও”‚ বলল শারফান‚ “তোমার হাতে পায়ের তলে যে বহু হলুদ সাংবাদিক ঘুরে বেড়ায় তা ওরা জানে। বেচারাদের জন্য একটা ঝান্ডু বাম তুমি।”
হেসে উঠে সোফায় হেলে বসল জিসান। পেশায় সে একজন টেলিভিশন সাংবাদিক—প্রখ্যাত এক বেসরকারি চ্যানেলের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার ভালো পরিচিতি আর একটা বিশাল ভক্তগোষ্ঠী আছে৷ তবে শখের বশে মাঝেমধ্যে তদন্ত সাংবাদিকও হয়ে যায় সে। এ সত্য তার খু্ব কাছের কয়েকজন ছাড়া আর কেউ তেমন জানে না৷ এবং এ কাজে সে দুর্দান্ত দক্ষও। সম্পর্কে শারফানের ভার্সিটির বড়ো ভাই এবং বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দুজনের। ফারনাজের সরিষার তেলের ভেজাল বিষয়ক তথ্যগুলো আজ সবার আগে সেই টেলিকাস্ট করেছিল। এমনকি তার বিরুদ্ধে যেসব তথ্য প্রমাণ যোগাড় করেছে শারফান এতদিনে‚ সেটাও তারই বদৌলতেই পাওয়া৷
“আমি তো তার জন্যই কেবল ঝান্ডু বাম হই‚ যার বিষ বেশি”‚ বলার পর গ্লাসে চুমুক লাগাল জিসান। তারপর হঠাৎ গম্ভীর বনে হাতটা বাড়িয়ে দিল শারফানের দিকে‚ “দে‚ আমার সম্মানী বুঝে দে এখন।”
গা ছেড়ে বসে গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ভ্রু বাঁকাল শারফান‚ “অমনে হাত পাতলে ইজ্জত লুট হয়ে যাবে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায়। কে যে কখন একটা ক্লিক করে নিয়ে ছেড়ে দেবে তোমার ভিক্ষুক রূপটাকে!”
“দিক‚ তাতে তোর কী? তুই মাল ছাড়। আমি বেনিফিট ছাড়া কাজ করি না‚ দেখিস না? সেখানে জুনিয়র ভাই বেরাদারের হাতে সোনার ডিম তুলে দিচ্ছি। মাল ছাড় তাড়াতাড়ি‚ ব্যাটা।”
পায়ের ওপর পা তুলে নির্বিকার ঢঙে পা নাচাতে শুরু করল শারফান। বলল তারপর‚ “যে প্রিমিয়াম ককটেলে চুমুক বসাচ্ছ‚ ওটার বিল পে করে দিয়ো তাহলে।”
“এই শালা একখান কঞ্জুস খঞ্জিরাম‚ ভাই”‚ চোখ-মুখ কুঁচকে নালিশের সুরে বলল রিহান‚ “ওর চিপা থেকে একটা একশো টাকার নোটই বের করতে পারিনি জীবনে৷ এই যে আসছি দেশে৷ বিদায় নেব নেব ভাব। আর কেবল আজকে আমাকে নিয়ে বের হলো‚ শালা বিলকাটার বাটপার।”
“ওকে আবার চিনি না—সেভিংস সিংহ একটা! ওর সেভিংসের আবার দামও নাই৷ এক হাতে জমায় আরেক হাতে উড়ায়।” তারপরই শারফানকে বলল‚ “বিলের কথা বললে তোর মুখ ছেঁচব আমি৷ বলেছিলি ‘ইউ আর ইনভাইটেড—নো ওয়ালেট নিডেড।’ সেই মুখে আবার বলিস বিল পে করার কথা? নির্লজ্জ!”
“লিকুইড মানি দিয়ে ডিল করি না আমি নিজের লোকের সাথে”‚ মুচকি হাসতে হাসতে হাতের গ্লাসটা ইশারা করে বলল শারফান‚ “আজকে রাতে যত খুশি তোমাদের জন্য। নো ওয়ালেট নিডেড।”
ফারনাজকে নাস্তানাবুদ করার আনন্দ উদযাপনের অছিলায় ওকে রিহান ধরে-বেঁধে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কৃতিত্ব অনেকটাই তো জিসানেরও। তাই তাকেও ডেকে আনা হয়েছে পরবর্তীতে।
এদিকে শাফিউল সাহেব লাগাতার কল করেই যাচ্ছেন ওকে। তা দেখেও কোনো হেলদোল হলো না ওর। ফোনটা কেটে দিয়ে আস্তে করে টেবিলের ওপর রাখল শারফান। মনোযোগ দিল তারপর অদূরের সোফায় বসা এক সুশ্রী অভিনেত্রীর দিকে। এসেছে পর থেকেই ওকে চোখের দৃষ্টিতেই প্রলুব্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ যেন সে নিজে থেকেই তার কাছে এগোয় আর আলাপ জমায়।
বেচারির এত পরিশ্রমকে একেবারেই কদর না করলে হয়? তাছাড়া আজ মনটা ভালো ওর। আসার পথে আজ যতজন ফকির গাড়ির কাছে এসে হাত পেতেছে‚ সবাইকেই খুশি করেছে সে। সেখানে এমন অভিজাত ভিক্ষুককে ফিরিয়ে দেওয়া বিবেকবর্জিত কাজ হবে না? মনে মনে এমনটাই ভাবল সে। সার্ভারকে ডাকল তাই। মেয়েটার দিকে দৃষ্টি রেখে নিজের হাতের পানীয়টাই তাকে গিয়ে পরিবেশন করতে বলল। বসে বসে আড়চোখে সবটাই লক্ষ করল মেয়েটা। এবং খুশিও হলো খুব।
ফারনাজের খবরগুলো জানার পর থেকেই শাফিউল সাহেব অস্থির হয়ে আছেন। আজ হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত পিঠের ওপর দুমদাম কটা কিল বসাতেন ওর। ছেলের বয়সের তোয়াক্কা করতেন না মোটেও। শুধু অস্থিরতায় না‚ যা করেছে শারফান তা জানার পর থেকে নিদারুণ চিন্তায়ও পড়ে গেছেন। এরকমভাবে আজ অবধি কত শত্রু যে পয়দা করেছে সে‚ তা বোধ হয় হিসাবহীন৷ কিন্তু সবাই কি ভয় পেয়ে কিংবা শিক্ষা পেয়ে দমে যাবে? ফারনাজ যদি নির্বাচনে হারার প্রতিশোধ তুলতে ওর জানের ওপর হামলা চালাতে পারে‚ তাহলে সেই ছেলে যে একই কাজ করবে না বা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে না‚ তা ভাবাটাই তো হবে ভুল৷ মাত্র ছেলেটা সুস্থ হলো৷ এর মাঝেই কিনা আবার একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! এবং তা তিনিও ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না! কেমন বাপ সে? নিজেকে নিজেই অপদার্থ বাবা বলে আখ্যায়িত করলেন শাকিবুল সাহেবের কাছে৷
কিন্তু তা শুনে শাকিবুল সাহেব যারপরনাই বিরক্ত। ছোটো ভাইয়ের মাত্রাতিরিক্ত চিন্তাগুলো তার নিছক আদিক্ষেতা ছাড়া কিছু নয়। খুব দম্ভের সঙ্গে বললেন তিনি‚ “আমাদের শায়াফ হলো যুদ্ধের মাঠের একা সেই বীর‚ যে সামনের হাজার হাজার সৈন্যকে পরাস্ত করে জয়ের পতাকা মাটিতে গাঁড়ে। ফারনাজ যা করেছে তার বিনিময়ে ওর এই সবটাই প্রাপ্য ছিল৷ ওর বাপের ক্ষমতা হবে না শায়াফের একটা চুল বাঁকানোর। কারণ‚ প্রথমবারের আক্রমণের পর ও এখন প্রতি পদে পদে এলার্ট। আমরাও এলার্ট৷ ও ঠান্ডা মাথায় সব গুটি সাজিয়ে তারপরই খেলায় নেমেছে। তুই আর ফালতু টেনশন নিস না তো‚ ছাই! আমার টেনশনও আর বাড়াস না।”
চলবে।