মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-৩৩+৩৪

0
8

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৩.

স্ক্রিনে ভেসে উঠল— +1 (202) 555-0199 – USA

পেছনে যেন কুকুর তাড়া করেছে এমন ভাবে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল লিঙ্কন। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে তারপর ফোনটা রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে কথা আসার আগে ব্যাকুলিত হয়ে নিজেই বলল‚ “ভাই‚ আপনারে কল করার মতো নাম্বার দ্যান আমারে‚ প্লিজ। আমি সময় মতো আপনারে পাইনে।”

“আমাকে দিয়ে তোর কী লাভ? আমাকে তোর ফোন করতে হবে কেন?”

বিছানায় এসে বসল লিঙ্কন। ঘরের চারকোণায় চোখ বুলাতে বুলাতে বলল‚ “আমার ঘরের ক্যামেরাগুলো কনে? প্লিজ কন‚ ভাই? প্রাইভেসির একখান ব্যাপার থাকে তো।”

হা হা করে হেসে ফেলল ব্যক্তিটি ফোনের ওপাশে। তারপর বলল‚ “সে জিনিস কি আর আমি ফেলে রেখেছি‚ বোকা ছেলে? তুই এখন নিশ্চিন্তে হাগতে‚ মুততে পারিস। চাইলে ফারনাজের বোনকেও ডাকতে পারিস।”

অবাক হয়ে কথায় বলতে পারল না লিঙ্কন৷ কখন‚ কীভাবে এই লোক সব করছে? তার ঘরে যখন তখন কেউ চুরি করে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে! ঝটকা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল‚ “কখন সরালেন‚ ভাই?”

“যখন তুই মিলে ঢুকে আগুন লাগাতে ব্যস্ত।”

ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করল লিঙ্কন। রান্নাঘরে এসে দ্রুত পানি খেল এক গ্লাস৷ তারপর জিজ্ঞেস করল‚ “ঘরের কনে লাগাইছিলেন ওইডা?”

“তোর পাছার মধ্যে‚ হারামির বাচ্চা”‚ আচমকা ধমকের সঙ্গে বলল সে‚ “তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে আমার?”

“না না‚ ভাই… সেরকম কিছু না। ভুল বুইঝেন না আমারে৷ আমি এমনিই কিউরিয়াস হইয়ে শুনলাম।”

“চুপ! অত কথা বলবি না”‚ রূঢ়ভাবে বলল লিঙ্কনকে‚ “তোর কিউরিওসিটি দেখার জন্য ফোন দিই নাই। তোর ভাগ্য নির্ধারণ করা শেষ। সেটাই জানানোর জন্য ফোন দিয়েছি। প্রস্তুত হ।”

“ভাগ্য নির্ধারণ মানে‚ ভাই?” বুক ধড়ফড় আরম্ভ হলো লিঙ্কনের।

“তুই হলো আপন মুখে বিষ ছিটানো বেজন্মা। যে পাতে খাস সেই পাতই ফুটো করিস। ফারনাজ যদি কোনোদিন জানে তুই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কত কত সর্বনাশ করেছিস ওর ‚ ও তোকে জঘন্যভাবে খুন করবে।”

“জানবে ক্যা‚ ভাই?” লিঙ্কনের গলা কেঁপে উঠল‚ “আপনি তো কইছেন কিছু জানাবেন না স্যাররে।”

“অবশ্যই জানাব না। তোকে আমি বাঁচানোর পথ দেখিয়ে দিতেই কল করেছি। পুলিশ যেহেতু খাবার আর পানির পাত্রগুলো ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে গেছে। তাহলে জেনে যাবে পানিতে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস ফরেনসিক ইউনিট থেকেও জেনে যাবে‚ আগুনের উৎস ছিল মিলের স্টোররুম। যেখানে অদ্ভুতভাবে আগুন ধরার মতো জিনিস ছড়ানো ছিল। তারপর পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করে জানবে সিসিটিভি ফুটেজ হঠাৎ কাজ করেনি কেন? এটাও অদ্ভুতভাবে দুই ঘন্টা আগে থেকে বন্ধ হয়ে ছিল—যা পুরোপুরি সন্দেহজনক। মিলে তখন ওই মুহূর্তে যে যে ছিল সবাইকেই সন্দেহ করা হবে। ভাবিস না তুই ফারনাজের বিশ্বাসভাজন বলে তোকে ও ইন্টারোগেট করতে দেবে না। বরং তোকেই বেশি সন্দেহ করবে পুলিশ। যেহেতু সব কিছুর দায়িত্ব তোকেই দিয়ে গেছিল ফারনাজ। পুলিশের ঘাই খেয়েছিস কোনোদিন? পারবি তখন মিথ্যে বলে বেঁচে যেতে?”

ভয়ের চোটে কান্না করে বসল লিঙ্কন‚ “আমি আপনার সব কথা শুনসি‚ ভাই। আমারে বাঁচায় নেন প্লিজ!”

“হুঁ‚ বাঁচানোর বুদ্ধি দিতে পারি সর্বোচ্চ৷ সেই মোতাবেক কাজ করবি কিনা সেটা তোর ডিসিশন।”

“কন‚ ভাই৷ যা কবেন তাই শুনব। আমি খালি বাঁচপার চাই।”

“সারেন্ডার করবি পুলিশের কাছে”‚ ভণিতা ছাড়াই বলল সে‚ “স্বীকার করবি‚ মিলে আগুন লাগিয়েছিস তুই। এবং কাজটা করেছিস ফারনাজের কথাতেই। ফারনাজ কেন নিজের মিলে নিজে আগুন দেবে‚ এ কথা যখন জিজ্ঞেস করবে তখন তুই সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বলবি সবটা। যেমন—অনেক দেনায় পড়ে গিয়েছে ও। যেটা আসলেই সত্য। আবার তোদের বিমা যেহেতু বেশি টাকার। আর এদিকে মাল তোদের কম। তাই আগুন লাগিয়ে অতিরিক্ত টাকার দাবি করার জন্যই এই কাজ করতে বলেছে তোকে ফারনাজ। যেটা মিথ্যা। কিন্তু তুই এই দুটো বিষয় মিলিয়েই একেবারে সত্যের মতো স্বীকারোক্তি দিবি পুলিশকে। এতে তোর হয়ত সর্বোচ্চ দু-চার বছরের সাজা হবে। কিন্তু ফারনাজের হাত থেকে বেঁচে যাবি৷ নয়ত ইনভেস্টিগেশনে তুই একবার দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর ও তোকে অ্যারেস্ট হওয়ার আগেই মেরে দেবে যে-কোনোভাবে৷ তাই তার আগেই তুই নিজেকে পুলিশের হেফাজতে তুলে দিবি৷ দোষ স্বীকার করে নিলে অনেক সময় সাজা কম আসে। আর হ্যাঁ‚ তুই যদি এটা ভাবিস যে তোকে ব্ল্যাকমেইল করে এসব করানো হয়েছে‚ সেটা তুই বলে দিলেই বেঁচে যাবি…” হাসল সে এ কথার পরই‚ “পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে? দেশের বাইরে বসে আছি আমি। তাছাড়া আমি ধরা পড়ি বা না পড়ি‚ তুই কিন্তু তাতেও বাঁচবি না৷ একেবারে দেউলিয়া করে দিয়েছিস তুই ফারনাজকে৷ তার আগে থেকেই আবার ওর বোনের সঙ্গেও খেলাধুলা করিস৷ তোকে তো…”

হাউমাউ করে কান্না করে উঠল লিঙ্কন আগের দিনের মতোই। কথা তাই শেষ করল না আর ব্যক্তিটি৷ শেষবারের মতো বলল ওকে‚ “সারেন্ডার করে যা বললাম তাই স্বীকারোক্তি দিস৷ তাহলে জানেও বাঁচবি আর সাজাও কম পাবি।” ফোনটা কেটে দিল এরপর।

পাগলের মতো মাথার চুল ধরে টানাটানি করে কান্না করতে থাকল লিঙ্কন।

আর ঠিক সে সময়ে হেড ফোনটা খুলে টেবিলে রেখে রিফাত গাল ফুলিয়ে বড়ো এক শ্বাস ফেলল। চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড়ানির মতো বলল‚ “তোর জন্য জীবনের প্রথম ক্রাইম করলাম‚ হারামি বদমাশ। নেহাৎ এই মালটা নরম কচ্ছপ‚ পাক্কা বোকা**। ভয়ে এতক্ষণ মনে হয় হেগে‚ মুতে ফেলেছে।”

“তুই ভয় পাস না‚ ভাই”‚ বলে এক থাবা বসাল শারফান রিফাতের বাহুতে। “আগামী কালই তো তোর ফ্লাইট। কে আর ধরতে পারছে তোকে? তাছাড়া তোর কাছে পৌঁছতে হলে আগে আমাকে টপকাতে হবে। আমার অবধি আগে পৌঁছাক।”

চেহারা বিকৃতি করে‚ সরু চোখে তাকাল রিফাত বন্ধুর দিকে৷ বাহুর যেখানটাই থাবা দিয়েছে শারফান সেখানে জ্বলে যাচ্ছে একদম। তা বুঝতে পেরে মিটমিটিয়ে হেসে শারফান ঠাট্টা করল‚ “মিসটেক করে ভুলে লেগে গেছে‚ শালা। চেতিস না।”

ওর মশকরা দেখেই রেগেমেগে ঝেড়ে এক লাথি মারল রিফাত। বিছানাতে আধশোয়া হয়ে ছিল শারফান। বিপজ্জনক লাথিটা আসার আগেই দ্রুত সরে খাটের এক পাশে চলে গেল আর ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকল।

“তোর বাপ শালা”‚ লাথিটা মিস হওয়ায় খেঁকিয়ে উঠল রিফাত। “শালা কস তুই আমারে! তোর মতো শয়তানের প্র্যাকটিস ভার্সনের কাছে আমার বোন বিয়ে দেব? খবরদার আর শালা বলবি না।”

হাসতে হাসতে বিছানার মাঝখান থেকে কোণায় এসে বসল শারফান। তারপর ফোনের মেসেঞ্জার থেকে একটা কনভারসেশন বের করে মেলে ধরল বন্ধুর সামনে। একটা মেয়ের সঙ্গে আরও মাস কয়েক আগে হাই‚ হ্যালো আর সাধারণ কিছু কথাবার্তা দেখা গেল সেখানে। আর সেই মেয়েটা রিফাতেরই বোন৷ শারফানের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে মেসেজ করেছিল সে৷ তাই সেদিন টুকটাক কথাবার্তা হয়েছিল দুজনের৷ এরপর অবশ্য আবারও হাই দিয়েছিল মেয়েটা। কিন্তু শারফান আর জবাব দেয়নি৷ বন্ধুর বোন বলেই আরকি এগোয়নি সে।

বেশ বিব্রত হলো প্রথমে রিফাত৷ পরমুহূর্তেই হুশিয়ারি দিল‚ “একেবারে খাইয়ালামু—যদি পোংটামি করিস রিমুর সাথে।”

‘চাপ নিস না’ বলার ঢঙে অভিব্যক্তি দেখিয়ে শারফান বলল‚ “আরে আমার ডলি আর রিমুকে আলাদা চোখে দেখি না-কি?” তারপরই জিজ্ঞেস করল‚ “কাল আসলি না কেন ক্লাবে? ফোনও তুললি না?”

“কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলাম। মেয়ে মানুষের সঙ্গে বের হলে কী প্যারা খাওয়া লাগে জানিস না? এসব রাখ। আমাকে বল‚ তুই যেটা করছিস সেটার জন্য পরে ভুগতে হবে না তো তোকে? যা জানলাম ওই ক্রিমিনালটার ব্যাপারে‚ তাতে তো ভরসা পাচ্ছি না তোর জন্য। তুই ওপেন প্লেসে যেভাবে একা চলাফেরা করিস‚ কোনো বডিগার্ড নিতেও রাজি হোস না৷ বহুত টেনশন হচ্ছে আমার তোকে নিয়ে।”

উচ্চ শিক্ষার জন্য রিফাত থাকে কানাডা। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারই বলা যায় তাকে৷ শীতের অবকাশে দেশে এসেছে৷ ছুটিও শেষ তার—কালই ফিরে যাবে। শারফানের দুর্ঘটনার খবর শোনার পর ঢাকা হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল সে। সেদিনই টুকটাক জেনেছিল ফারনাজের ব্যাপারে৷ তারপর শারফান যখন ঢাকা ফিরল তখন থেকেই ওর পরিকল্পনার একটা অংশ হিসেবে যুক্ত হলো সে। ফেলতে পারেনি বন্ধুর আবদার৷ ঘরে বসেই VoIP (Voice over IP) প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশি নাম্বার স্পুফ করে সে লিঙ্কনকে কল করে কথা বলেছে গত দুদিন ধরে। যাতে লিঙ্কন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় তার ব্ল্যাকমেইলার একজন প্রবাসী।

বন্ধুর চিন্তা দেখেও বিকারশূন্য শারফান‚ “পারবে না। এবার আমার গায়ে একটা টোকা দেওয়াও ওর জন্য কঠিন। তবে এরপরও যদি ও না থামে তাহলে ওর মাথার ওপরের ছাদটাও আমি গায়েব করে দেব… কসম।”

***

লিঙ্কন আত্মসমর্পণ করেছে। রিফাতের শিখিয়ে দেওয়া বুলিই আওড়েছে সে কাঁদতে কাঁদতে। তার জবানবন্দি নেওয়ার পরই ফারনাজকে ডাকা হয় থানায়৷ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্বয়ং এসপি। লিঙ্কনের কিছু কিছু কথার সাথে তার কথার মিলও পায়৷ যেমন—ইদানিং দেনাদারদের চাপ‚ ব্যাবসাতেও চলছিল লোকসান‚ নির্বাচনেও প্রচুর টাকা ব্যয় হওয়াতে সব কিছু মিলিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে থাকতেন কবির সাহেব আর সেও।

লিঙ্কনের স্বীকারোক্তি পুরো ঘটনার মোড় বদলে দিয়েছে একদম। পুলিশের কাছে সে মারধর খেয়েছে খুব। তারপরও একই কথাতেই অটল থেকেছে। কারণ‚ কোনোভাবেই সে ফারনাজের হাতে পড়তে চায় না।

সেদিনের কথা—কঠিন বিপদের সাগরে পড়েও ফারনাজের মতো পুরুষ যে প্রশংসীয়ভাবে নিজেকে স্থির রেখে ঠান্ডা মাথায় বিপদ সামলে নিতে চেষ্টা করছিল‚ সে অতি দুঃখজনকভাবে ঘায়েল হয়েছিল তার বিশ্বাসঘাতকতায়। গারদের ভেতরে থাকা লিঙ্কন যতটা সম্ভব দৃষ্টি লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত ছিল তখন। আর গারদের বাইরে দাঁড়ানো ফারনাজ ঠিক ততটাই প্রথমে বিস্ময়াহত হয়ে‚ পরবর্তীতে খুনে চোখে তাকে দেখতে মগ্ন ছিল৷ লিঙ্কন অনেকগুলো বছর ধরে ওকে চেনে। তাই বুঝে গিয়েছিল ওই ক্ষিপ্ত চোখে তাকে খুন করতে না পারার আফসোস কতখানি মিশে ছিল।

বিমা কতৃপক্ষ এমনিতেই তদন্ত চালাচ্ছিল মিলের আগুনটা দুর্ঘটনা না-কি ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগ। কিন্তু লিঙ্কনের স্বীকারোক্তির পর তার সত্যতা যাচাই আরম্ভ হলে সেখানে দুর্ভাগ্যক্রমে ফেঁসেই যায় ফারনাজ। কোনোভাবেই লিঙ্কনের জবানকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেনি সে। আর বিমা প্রতারণা ফৌজদারি অপরাধ। সেক্ষেত্রে তার জেল‚ মোটা অঙ্কের জরিমানা এবং সব ধরনের বিমা বাতিল হওয়ার আশঙ্কা পুরোপুরি। বিমা কোম্পানি মামলা দেওয়ার পর একবার চার্জশিট হয়ে গেলে আর কোনো রক্ষা নেই। তখন অকূলপাথারে পড়ে যাওয়ার দশা হবে৷

তার আগেই ফারনাজ ভেবেচিন্তে এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে অপরাধ না করেও তা স্বীকার করে নেয় বিমা কতৃপক্ষের কাছে। অতি আকুলভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এবং বিরাট অঙ্কের জরিমান দিয়ে মামলা হওয়াটা ঠেকায় সে। এর মাঝে সরিষার তেলের কারখানাটাকেও চালু করার অনুমতি আদায় করে মন্ত্রি খলিলুর রহমানের সাহায্যে। কিন্তু তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। দেনাদারদের নিষ্ঠুর চাপে কারখানাটা বিক্রি করে তাদের দেনা শোধ করতে বাধ্য হয়। জুট মিলটাও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ মিলটাকে চালু করার মতো সামর্থ্য আপাতত আর নেই ফারনাজের।

***

৩ মার্চ
সন্ধ্যা ৬ টা

নিজ ঘরের বারান্দায় আর্মচেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে ফারনাজ। পরনে কুঁচকে থাকা একটা ছাই রঙা টি শার্ট—গত দুদিন হলো এটাই পরনে৷ মুখের গোঁফ-দাড়ির দীর্ঘতা বেড়েছে বেশ আর চোখের নিচে কালির পুরূতাও। মাত্র পনেরোটা দিনে জীবন কোথা থেকে কোথায় পৌঁছাল‚ সামনের দিনগুলো কতটা দূরাবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে—একাকী‚ নির্জনে সেটাই ভেবে চলেছে সে। কে আসল বন্ধু আর কে ছিল মুখোশের আড়ালে শত্রু‚ কে আপন আর কে ছিল পর—বহু মানুষের স্বরূপ চিনতে পেরেছে এ কদিনেও। নিজের কঠিন এই পরিস্থিতি এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া মানুষগুলো ছিল কমই৷ সেই সাহায্যকারীদের মাঝে নিজের দুই চাচা আর এ বাড়ির একমাত্র জামাইটা আছে এগিয়ে। এই তিনটি মানুষের কাছে সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে কবির সাহেব আর ফারনাজ৷ কারণ‚ এই বিপদে তাদের সাহায্য ছোটো হোক কিংবা বড়ো‚ সেই ঋণ আসলে কোনোদিনও শোধ হওয়ার মতো না।

কিন্তু ফারনাজের সব থেকে বড়ো কষ্টটা হলো‚ সে জানে ওকে প্রায় সর্বস্বান্ত করার পেছনে মূল হোতা কে। অথচ প্রমাণের অভাবে এবং সুযোগের অভাবে একটা আঁচও দিতে পারছে না তার গায়ে। কারণ‚ রাজনৈতিক প্যাঁচ জড়িয়ে আছে এখানে৷ শাকিবুল হক ভালোই চাল চেলেছেন দলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে৷ যাদের কানে পৌঁছানো হয়েছে‚ তার কাছে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ তুলতেই শারফানকে হত্যাচেষ্টা করেছিল সে। ওদের দুজনের মাঝে হওয়া পূর্বকার ঘটনাগুলোকেও সংযুক্ত করেছেন শাকিবুল‚ যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয় সবার কাছে। অবশ্য এসব বিষয় ওদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের উল্লেখ করে কেউ তেমনভাবে মাথা ঘামায়নি। বরঞ্চ দুজনকেই আপোষ করে‚ মিলেমিশে কাজ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর শারফানকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করলে স্বাভাবিকভাবে সরাসরি ওর দিকেই আঙুল তুলবে সবাই। তাতে ওর রাজনৈতিক পেশাজীবনও শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

তাই বলে কি চুপচাপ সবটা হজম করা সম্ভব? না‚ ফারনাজ পারবে না ওর থেকে বয়সে ছোটো কারও এবং তার ক্ষমতা‚ তার দুঃসাহসিকতা আর তার ঔদ্ধত্যের কাছে নতিস্বীকার করে নিতে। বরং শত্রুর নিয়মই অনুসরণ করবে সে—আড়ালে বসে‚ গুটি ব্যবহার করে‚ সূক্ষ্ম উপায়ে। কিন্তু শত্রুর চেয়েও পাষাণ হয়ে।

গত দু মাস ধরে চলা কার্যক্রমটার হদিস নেওয়ার পালা এখন। চেয়ার ছেড়ে ঘরে উঠে এল সে। বিছানার ওপর থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে কল করল কাউকে। রিসিভ হলো একটু পরই। ওপাশ থেকে খুব বিনয়ী কণ্ঠে সালাম জানাল ওকে৷ জবাবের বদলে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল‚ “যে কাজ করতে বলেছিলাম তোকে‚ তা কি চালিয়ে যাচ্ছিস?”

“জি…” বেশ আড়ষ্ট কণ্ঠে জানাল ছেলেটি‚ “জি‚ ভাইয়া।”

কথা চলল আরও কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে। তারপর কল লাগাল ঢাকাতে আরও বিশেষ একজনের কাছে।

***

মোশতাক সাহেব এসেছেন বাসায়৷ রাতের খাবারের সময় হয়ে যাওয়ায় মোস্তফা সাহেব না খেয়ে যেতে দিলেন না মেজো ভাইকে৷ খাবার টেবিলে বসে বিভিন্ন কথাবার্তা চলতে চলতে শুরু হলো ফারনাজের প্রসঙ্গ। বড়ো ভাইয়ের অবস্থা তো খারাপই৷ ফারনাজও বেশ ভেঙে পড়েছে‚ এ নিয়েই দু ভাই চিন্তা প্রকাশ করছেন৷ কারণ‚ ছেলেটা যে কঠিন ধাতুর। সেই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে গোটা পরিবার সামলাবে কে? সানা আর মেহারও খারাপ লাগছে কিছুটা বড়ো চাচার পরিবারের জন্য। যতই হোক‚ একই গোষ্ঠী এবং রক্তের সম্পর্ক বলে কথা৷ কিন্তু একটা কথা না বলে থাকতে পারল না মেহা। “এই টাকা-পয়সা‚ ধন-সম্পদের জন্য একটা সময় কত অহংকার করত ওরা”‚ ফিসফিস করে বলল সানাকে।

সানাও মাথা নেড়ে জবাব দিল‚ “আমার আব্বু-আম্মুর চোখের পানির মূল্যও হতে পারে এটা। আল্লাহ তো সবই দেখেন৷ তিনি না চাইলে তো কারও ক্ষমতা হত না এই ক্ষতি করার।”

খাবার টেবিলের কাছে দাঁড়ানো নাজমা বেগম। মেয়েদের কথাবার্তা সবই কানে আসছে তার৷ কিছু বলল না তবু৷ সানার কথাটা শুনে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল শুধু। না চাইতেও মনে পড়ল‚ কতবার আর কতভাবে বড়ো জা‚ বড়ো জায়ের মেয়েদের কাছে ছোটো-বড়ো কথা শুনেছেন‚ অপমানিত হয়েছেন আজ অবধি! সেই পরিবারকেই আজ আর্থিক‚ মানসিক‚ সবদিক থেকেই সাহায্য নিতে হচ্ছে তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের থেকে।

খাওয়া শেষ করে উঠে দু ভাই টিভি দেখতে দেখতে আলোচনা চালিয়ে গেলেন৷ তখনই হঠাৎ সানার কানে এল ‘শাফিউল হকের ছেলে’ বলে একটা কথা৷ দ্রুত কানটা খাঁড়া করল সে।

ফারনাজ আর শারফানের মাঝে ভালোই ঝামেলা আছে। তাই আজকের এই অবস্থার জন্য ফারনাজ দোষারোপ করছে শারফানকেই—এটাই বললেন মোশতাক সাহেব। চুপচাপ সেসব কথা শুনলেন মোস্তফা৷ ওদের দুজনের মাঝে সম্পর্কটা তেমন ভালো না‚ এ বিষয়ে আগে থেকেই কিছুটা জানা আছে তার। সেটা ফারনাজই জানিয়েছিল নির্বাচনের আগে৷ তবে নিজের ভাতিজা কেমন সে ধারণাও যেহেতু তার আছে আর শারফানের সঙ্গে দু-তিনবার মুলাকাত হওয়ায় এবং শাফিউল হকের সঙ্গেও পুরো একদিন কথাবার্তা হওয়ায় তাদের ব্যাপারেও একটা ধারণা তার হয়েছে৷ তাই বিশ্বাস করলেন না তিনি ফারনাজের অভিযোগটাকে৷ যেমন এ মুহূর্তে যদি বলা হয়‚ এক নিষ্ঠুর ও ক্রূর মানুষ ফারনাজ। যে খুন করার মতো মানসিকতা বহন করে—বিশ্বাস করবেন না তিনি এ কথাও। মূলতঃ যে ব্যক্তিকে তিনি একবার স্নেহ করেন‚ ভালোবাসেন এবং আপন ভাবেন। তাদের নিয়ে নেতিবাচক কথা তিনি সহজে ভাবতে পারেন না।

কিন্তু ফারনাজের এই অভিযোগটা অমূলক নয়‚ তা অনেকটাই বিশ্বাস হলো সানার৷ এঁটো হাতটা ধুয়ে সে শোবার ঘরে চলে এসে দরজাটা ভিড়িয়ে দিল হঠাৎ। বিছানায় বসে নখ কামড়াতে কামড়াতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকল—মুখটা চিন্তিত। শারফানকে কল করে সরাসরি এ কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবনায় পড়েছে সে৷ অদম্য কৌতূহল জাগছে কিনা! কিন্তু এই লোককে নিজে থেকে কল করার সাহস দ্বিতীয়বার করাটাই তো কঠিন ওর জন্য। শয়তান ব্যাটা সেদিনের পর আর কোনো কল করেনি ওকে।

মিনিট পাঁচেকের মতো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে কলটা করেই বসল শারফানকে। কিন্তু রিসিভ হলো না। সবে দশটা বাজে। ঘুমিয়ে পড়েছে না-কি খ্যাপা বাদুড়টা? না-কি ইচ্ছা করেই ধরল না? সানাও কল করল না আর৷ ফোনটা রেখে বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠতেই মৃদুভাবে বেজে উঠল রিং। স্ক্রিনে ‘এসএস’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। মন উচাটন শুরু হয়ে গেল তা দেখেই। ক্ষণকালের মতো সময়টা ব্যয় করে ধরল সে।

“হেই হানিবান‚ মিস মি ইয়েট?”

বুকটা ধড়াস করে উঠল সানার কণ্ঠটা শুনতেই। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে কৃত্রিম বিরক্তের সঙ্গে বলল‚ “এসব আজেবাজে নামে অ্যাড্রেস করবেন না আমাকে। কল দিয়েছিলাম জরুরি একটা ব্যাপারে। কোনো মিস ফিসের মামলা নেই।”

“অনেস্টলি! শারফান শায়াফের সঙ্গে তোমারও তাহলে জরুরি ব্যাপার থাকতে পারে?” বলেই অপ্রয়োজনে গলা খাঁকড়ি দিয়ে উঠল শারফান। ফিসফিসানির মতো বলল‚ “আমার সঙ্গে মেয়েদের বহুদিন জরুরি ব্যাপার স্যাপার হয় না। মাই হার্ট ইজ রেসিং‚ লাভবাগ!”

“উফঃ! শুরু হয়ে গেছে”‚ এবার সত্যিই বিরক্ত হলো সানা।

কিন্তু তবুও থামল না শারফান‚ “কই শুরু করলাম? কাছেই তো পেলাম না।”

“চুপ”‚ বিশাল এক ধমক বসাল সানা। “ভুলই হয়েছে আমার কল দেওয়াটা।”

এক মুহূর্তের জন্য সত্যিই চুপ হয়ে গেল শারফান। এমন সুরের ধমকটা মোটেও বরদাস্ত করল না সে৷ “সে ইট
এগেইন”‚ ধীর‚ দৃঢ় স্বরে হঠাৎ বলে উঠল ওকে‚ “ইফ ইউ ডেয়ার।”

হকচকিয়ে গেল সানা৷ কী হলো? ব্যাটার রসিকতার সুর হারিয়ে গেল কেন হঠাৎ? রেগে গেল ধমক খেয়ে? “বাবাহ্‚ ভালোই তো রাগ”‚ মনে মনে বলে উঠল সে। না‚ সাহস করে আর দ্বিতীয়বার ধমক দিতে গেল না মোটেও। প্রসঙ্গ পালটাতে আসল কথা পাড়ল ঝটপট‚ “যদি কিছু মনে না করেন‚ ফারনাজ ভাইয়ের ব্যাপারে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।”

আরও গম্ভীর বনে গেল শারফান৷ ফারনাজের নামটা কেন যেন খুব বিষ লাগল সানার মুখে শুনতে। “মনে করার মতো কথা বললে মনে আমি করবই”‚ বলল ঠান্ডা কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে।

তা শুনে সানার একটু আগের স্পর্ধা সব গায়েব হয়ে গেল৷ এখনো কানে বাজে ওর‚ বাজারের মধ্যে শারফানের দেওয়া সেদিনের ধমকটা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত ওই ধমক আর খেতে চায় না সে আরও একবার। “ঠিক আছে‚ ব্যাপার না”‚ অপ্রতিভ কণ্ঠে বলল সে‚ “রাখছি তবে।”

“উহুঁ‚ যা বলতে চাইছ তা বলবে। তা শুনে আমি কিছু মনে করলে সেটাও হজম করবে। তারপর রাখারাখি।”

কথার ভাবখানা দেখে বিড়বিড়িয়ে দুটো গালি দিল সানা। কিন্তু হঠাৎ করেই আসল কথা বলার সাহসটাও ফিরে পেল। তাই চট করেই বলে ফেলল‚ “ফারনাজ ভাই বলছে ওনাদের মিলে নাকি আগুনটা লাগিয়েছে যে লোক সে নাকি আপনার কথা মতো সব করেছে। এটা কি সত্যি?”

অল্প কিছুক্ষণের জন্য মৌনতা বিরাজ করল ফোনের ওপাশে। তারপর পালটা প্রশ্ন এল শারফানের ভারি কণ্ঠ থেকে‚ “কী বলবে সত্যি হলে?”

“আমি? আমি বলার কে? জাস্ট কিউরিওসিটি থেকে জানতে চাইছি।”

“প্রশ্নটা সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতে।”

“কেন? ফোনে কেন উত্তর পেতে পারি না?”

“হেই বাটারকাপ”‚ বিদ্রুপপূর্ণ হেসে বলল সে‚ “আমাকে কি ঠনঠনিয়া শারফান ভাবো তুমি? তোমাকে যে ফেম ফাটালের মতো ফারনাজ ব্যবহার করছে না‚ এমন বিশ্বাস রাখি না আমি৷”

কপাল কুঁচকে গেল সানার‚ “ফেম ফাটাল মানে?”

“ঘাতক… নারী”‚ কথাটা টেনে বলল। তারপরই হাসল শারফান‚ “ধ্বংস ডেকে আনে যে রহস্যময় নারী। যেমন এ মুহূর্তে ফোনের রেকর্ডার চালু করে আমার ধ্বসের চ্যানেল বানানোর চেষ্টায় আছ।”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি ফারনাজ ভাইয়ের কথা মতো আপনাকে ফাঁদে ফেলতে কল করেছি?” খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সানা।

শারফানও জবাব দিল চকিতেই‚ “করোনি যেন? নয়ত যাকে দেখতেই পারো না তাকে নিজে থেকে কল করেছ আজ৷ তাও আবার কী…” শ্লেষোক্তি করল‚ “ফারনাজ ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে! ওহো রে আমার সুইট অ্যান্ড ক্লুলেস‚ হাহ্!”

ব্যঙ্গাত্মক সুরটা তীক্ষ্ণভাবে বুকে বিঁধল সানার৷ কতটা জঘন্য আর নীচ ভাবে ওকে শারফান‚ তা এতদিনে টেরও পায়নি সে! চোখদুটো টাটিয়ে উঠল সহসাই। চোখে পানি ধরেই জিজ্ঞেস করল‚ “তার মানে আপনি আমাকে সব সময় ফারনাজ ভাইয়ের স্পাইয়ের মতো ভাবেন?”

“ভাবাভাবির কী আছে? যে যেটা করে তাকে সেটা দিয়েই মাপি আমি৷ কষ্ট হচ্ছে খু্ব ফারনাজ ভাইটার জন্য?”

শেষ প্রশ্নটার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত কী বোঝাল শারফান তা বুঝতে পেরেই নগ্ন থাকার মতো লজ্জাবোধ হলো ওর৷ জবাবের পরিবর্তে জানাল মৃদুস্বরে‚ “রাখছি আমি।”

“কী ব্যাপার? ধরা পড়ে লজ্জা পেলে না-কি? আমার কাছে লজ্জা শরম না করলেও চলবে৷ আমরা আমরাই তো‚ না?” হাসতে হাসতেই বলল শারফান কটাক্ষ করে।

কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকল সানা। “আপনি আমাকে কত বড়ো অপবাদ দিলেন‚ শায়াফ”‚ নড়বড়ে কণ্ঠে বলল হঠাৎ‚ “একবারও বুঝতে পেরেছেন? আপনি আমার ব্যক্তিত্ব‚ আমার চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করলেন!”

“তাই?” বলে উঠল সে অবজ্ঞার সঙ্গেই৷ কিন্তু দ্বিতীয়বার সানার মুখে নিজের ঘরোয়া নামটা আর ওর কান্না ভেজা গলাটা শুনে মনের ভেতরে কোথাও একটা কিছু হলো যেন৷

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে

#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৩৪.

৮ মার্চ

ফরিদপুর সদর স্টেডিয়াম

বিকাল ৫ টা

উন্নয়ন মেলা আরম্ভ হয়েছে গত দুদিন হলো। পরিবেশটা বেশ জমজমাট‚ রঙিন আর প্রাণবন্ত৷ চারপাশে স্থানীয় খাবারের গন্ধ‚ কচি-কাঁচা ছেলেমেয়ের হাসাহাসি‚ লোকজনের আনাগোনা—প্রচণ্ড ভিড়। রাত হলে আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে দোকানগুলো। এটি জেলা প্রশাসন কতৃক আয়োজিত মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বড়ো একটা মঞ্চ করা হয়েছে। শাকিবুল হক ছিলেন এ মেলার উদ্বোধক। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরা‚ জনসচেতনতা তৈরি‚ স্থানীয় সাংস্কৃতিক চর্চা উজ্জীবিত করায় এ মেলার উদ্দেশ্য।

নানান ধরনের দোকানের মাঝে হস্তশিল্প‚ মৃৎশিল্প‚ জামদানি বা তাঁতের কাপড়ের তৈরি কিছু দোকান বসেছে আর ডিজিটাল সেবা বা প্রযুক্তি বিষয়ক প্রদর্শনীও রয়েছে। সেসবের গল্প শুনে জারা আজ মেলায় ছুটে এসেছে প্রিয় দুই বান্ধবীর সঙ্গে৷ তাছাড়া আরও একটি কারণ আছে৷ সেটা বাড়িতে জানানোর সাহস হয়নি৷ এমনিতেই আসার অনুমতি নিতে গিয়ে আজ গোটা দিন না খেয়ে‚ ঘরে বসে কান্নাকাটি করতে হয়েছে৷ তারপরও বাবা অনুমতি দিলেও ভাইয়ের অনুমতি পেলই না। তাই ভাইকে না জানিয়েই বাবার কঠোর নির্দেশে বাড়ির গাড়িতে করে আসতে হয়েছে। ড্রাইভার চাচা খালিদ—অনেক পুরোনো আর বিশ্বস্ত মানুষ তিনি। অনেকটা জোবেদা খালার মতোই কাছের সম্পর্ক তার সঙ্গে হক বাড়ির। জারা তাই হাজারবার বলেও তাকে নিজের পিছু ছাড়াতে পারল না৷ সঙ্গে সঙ্গে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাকে‚ তা সে অক্ষরে অক্ষরেই পালন করবে। তাতে জারা রেগেমেগে‚ চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও কিছু মনে করবে না সে। তবে চিৎকার-চেঁচামেচির বদলে জারা করল পাগলামি। খালিদের চোখের সমস্যা হয়েছে ইদানিং। সময় করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না তার৷ স্বাস্থ্য ক্যাম্পের সামনে গিয়ে হঠাৎ তার হাত চেপে ধরল সে আর বলল এক ডাক্তারকে‚ “এই যে ভাইয়া‚ শুনুন। আমার আঙ্কেলের চোখটা পরীক্ষা করা দরকার। জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। কারণ‚ সে ভাবছে আপনারা টাকা নেবেন। আপনারা কি সত্যিই টাকা নেবেন?”

ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সবাই হাসল। “একদম ফ্রি ট্রিটমেন্ট‚ আপু”‚ বলল একটি ছেলে‚ “কোনো টাকা লাগবে না।”

নাস্তানাবুদ অবস্থা খালিদের। বিব্রত স্বরে জারাকে বলল‚ “আমি এহনে কোনো পরীক্ষা টরিক্ষা করব না‚ আম্মা৷ মধুখালী চক্ষু হাসপাতালে যাইয়ে করবানে একবারে।”

“সে যেদিন মধুখালী যাওয়ার সেদিন যাবেন আপনি। আজকে ফ্রিতে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ যেহেতু পাচ্ছেন তাই এখনই পরীক্ষা করতে হবে।” জেদি জারা জোর করেই তাকে ডাক্তারগুলোর কাছে গছিয়ে দিয়েই দিল দৌড়। বান্ধবীদের কাছে এসে তাদের বলল‚ “তাড়াতাড়ি কল দে হাসিবকে। জলদি আসতে বল।”

জারার নিজস্ব ফোন থাকলেও তা সর্বক্ষণ কাছে রাখার অনুমতি নেই৷ মায়ের হাওলাতেই থাকে সেটা। বাড়িতে দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত তাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হলেও বাড়ির বাইরে ফোন নিয়ে আসা একেবারেই নিষেধ। একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্টও ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে সে৷ তাও সেটার অ্যাক্সেস শারফানের কাছেও রয়েছে। কিন্তু বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে চুরি করে আরেকটা অ্যাকাউন্ট খুলেছে জারা। যেটাতে নাম‚ পরিচয় বদলে অনেকের সাথেই যুক্ত হয়েছে সে৷ এমনভাবে মাস দুই আগে পরিচয় হয়েছে একটি ছেলের সাথে৷ সে-ই হাসিব৷ তার মতোই এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মধুখালীতে থাকে‚ সেখানের কলেজেই পড়ে। টুকটাক কথাবার্তা হতে হতে এখন ভালো বন্ধুত্ব ওদের৷ আর জারার মাধ্যমেই জারার বান্ধবীদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়েছে কিছুটা৷ গতকাল হাসিব জানিয়েছে সে ফরিদপুর মেলাতে ঘুরতে আসছে আজ৷ যদি সম্ভব হয় তাহলে জারার সঙ্গে দেখাও করবে। ছেলেটা পড়াশোনায় খুব মেধাবী‚ কথাবার্তা আর আদবকায়দাতেও খুব মার্জিত। তবে জারার থেকে বয়সে একটু বড়ো৷ তার পড়াশোনা ছিল প্রথমে মাদ্রাসাতে৷ সেখানে হাফেজি পাশও করেছিল। তারপরই স্কুলে ভর্তি হয় হঠাৎ। আর এজন্যই কিছুটা পিছিয়ে বয়স অনুযায়ী।

ফেসবুকে যতটুকু কথা বলার সুযোগ হয় ওদের‚ তা বেশিরভাগ সময় হয় পড়াশোনার ব্যাপারেই৷ অনেক সাজেশনও দেওয়া-নেওয়া হয় দুজনের মধ্যে। সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে পড়ায় কখনো কোনো ছেলে বন্ধু হয়নি জারার৷ এজন্যই হাসিবের সঙ্গে বন্ধুত্বটা একটু বিশেষ। তবে সেটা প্রেমমূলক কিছু নয়।

হাসিবের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলল জারার বান্ধবী রেখা৷ কথা শেষে জারাকে বলল‚ “ছেলে মানুষ এত লাজুক হয় জানতাম না। মেসেজে যাওবা একটু আধটু কথা বলত। কলে তো ঠিকমতো কথায় বলতে চাইল না। ও বোধ হয় আসবে না আমাদের সামনে৷ কারণ‚ ও তোর সঙ্গে যতটা ফ্রেন্ডলি ততটা আমাদের সাথে না৷ তাই লজ্জা পাচ্ছে আসতে।”

“আজব”‚ বিরক্ত হলো জারা‚ “লজ্জার কী আছে বুঝলাম না। কোথায় ও?”

“তা বলল না। চলে যাবে বলল৷”

“এত যুদ্ধ করে আসলাম ওর জন্য! আর ও দেখা না করেই চলে যাবে? এটা কোনো কথা?” রাগ হলো জারার খুব‚ “লজ্জা না ছাই! ভাবের চোটে তামাশা লাগিয়েছে বেয়াদবটা। দেখছে তিন তিনটা মেয়ে দেখা করতে এসেছি ওর সঙ্গে। কল লাগা তো। গালাগালি দেব আমি।”

এদিকে মেহার জোরাজুরিতে সানাও আজ এসেছে। সঙ্গে দিনা আর দিনার বরও আছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দোকানের মাঝে একটা দোকান দিনার এক দূর সম্পর্কের ননদের। তার দোকানে বসেই আড্ডায় ব্যস্ত ওরা। কিন্তু মেহার ঠেলাঠেলিতে বসে থাকা সম্ভব হলো না সানার। বোনকে নিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। ঘুরতে ঘুরতে মেহার দেখা হয়ে গেল তার এক বান্ধবীর সাথে। সানাকে বলল‚ “তুই স্টলে গিয়ে বসলে বস‚ আপু৷ আমি আর শিফা এক্সিবিশনগুলো দেখে আসি?”

কঠিন চোখে বোনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর অনুমতি দিল সানা‚ “আমার ফোনটা নিয়ে যা। দিনার ফোন থেকে কল করার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হবি।”

“দে দে”‚ খুশিই হলো মেহা‚ “কয়টা সেলফি নিতে পারব।”

সানা যদিও ফিরল না দোকানে। হস্তশিল্প আর শাড়ির দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল। এর মাঝেই চোখ পড়ল জারার ওপর৷ কিছুটা দূরেই বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে মুখটা ভার করে৷ রেগে আছে বোধ হয় কোনো কারণে৷ কিন্তু রাগলেও মেয়েটাকে বেশ মিষ্টি লাগে তো!

তবে জারাকে দেখে জারার ভাইয়ের ব্যবহারের কথা মনে পড়ে গেল সানার। সেদিনের কষ্টের ছাপটা বিবর্ণ হয়নি এখনো কেন যেন৷ অতীতে কত কিছুই তো হলো তার সঙ্গে৷ কিন্তু কখনো এমন মনঃকষ্ট অনুভব করেনি সানা। খানিকটা অভিমানও মিশে আছে তাতে। সেটা অবশ্য বোধগম্য হচ্ছে না ওর৷ আর এ অভিমানই অটল করে রেখেছে ওর কষ্টটাকে।

শারফানের কথা মনে পড়ে একটু উদাসীনের মতো হলো সে। সেদিন কলটা কেটে দেওয়ার পর যোগাযোগ হয়নি আর ওদের। যোগাযোগ শারফান করতে চাইলেও সে আর সাড়া দিত কিনা সন্দেহ। ভবিষ্যতেও আর কোনোরকম দেখা-সাক্ষাৎ‚ কথা না হোক‚ এমনটাই চায় সে। কিন্তু এ চাওয়া তো কতবারই চাইল আজ অবধি৷ কখনোই তা পূরণ হয়নি৷ এবারও হবে কিনা কে জানে!

মাটিতে চোখ রেখে হাঁটতে হাঁটতে দিনার ননদের দোকানের দিকে এগোল সানা৷ অপ্রত্যাশিতভাবে তখনই ধাক্কা খেল একটি ছেলের পিঠের সঙ্গে৷ ওর থেকে কিছুটা সামনেই ছিল ছেলেটা৷ হাঁটছিল সেও৷ হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে পড়লে সানা খেয়াল না করায় ধাক্কাটা খেতে হলো। ব্যাপারটা খুব বিব্রতকর। সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা। লজ্জা পেয়ে তার মুখটাও দেখল না চোখ তুলে। “সরি‚ ভাইয়া”‚ নিচু স্বরে বলেই কেটে পড়তে চেষ্টা করল।

কিন্তু হলো না। পেছন থেকে হঠাৎ ডেকে উঠল ছেলেটা‚ “অ্যাই সানা আপু?”

থমকে গিয়ে বিস্ময়ে পেছন ফিরে তাকাল সানা। ছেলেটাকে দেখে বিস্ময়ের মোড় এবার বদলাল ওর‚ “হাসিব‚ তুমি? কী খবর রে‚ ভাই? ফরিদপুর ঢুকলে কবে?”

“এইতো আপু আজই”‚ অপ্রতিভ হেসে বলল হাসিব‚ “কেমন আছেন? আঙ্কেল‚ আন্টিও আসছে?”

“আরে না। মেহা আর দিনার সঙ্গে এসেছি। তুমি কি একাই? না বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে?”

“একাই‚ আপু৷ এইতো চলে যাব এখনই।”

“চলে যাবে কেন? বাসায় চলো। আব্বু আম্মুর সঙ্গে দেখা করে আজকে থেকে যাও।”

“না‚ আপু। সামনে পরীক্ষা তো৷ পড়া মিস যাবে তাইলে।”

“তাও ঠিক। তা চলো‚ দিনা আর মেহার সাথে দেখা করবে।”

“আজকে থাক‚ আপু। আসব আরেকদিন।”

হাসিবকে দেখাচ্ছে বেশ চিন্তিত৷ মুখটা উৎকণ্ঠিত আর সাংঘাতিক ঘামছেও ছেলেটা। তা খেয়াল করে কেমন খটকা লাগল সানার। মধুখালী থেকে ফরিদপুর মেলা দেখতে এসেছে‚ তাও আবার একা একা! এটা অদ্ভুতই লাগল ওর। সন্দেহ করল কিছু একটা হয়েছে ছেলেটার। কারও সঙ্গে দেখা করতে এসেছে না-কি? প্রেমঘটিত কোনো বিষয় হবে হয়ত। দেখতে-শুনতে ভালোই ছেলেটা। লোকে তার চেহারাটাকে বলে নুরানি চেহারা। প্রেম করা অস্বাভাবিক কিছু না।

সম্পর্কের খাতিরে হাসিবের বাবা মোস্তফা সাহেবের চাচাত ভাই হয়। আপন না চাচাত ভাই না যদিও। কিন্তু সম্পর্ক অটুট আছে বিধায় হাসিবের পরিবার ওঠা-বসা করে সৈয়দ পরিবারগুলোতে৷ ভীষণ গরিব হাসিবের পরিবার। অন্যের মাঠে চাষাবাদ করে জীবিকা চালায় হাসিবের বাবা। বউ আর তিন ছেলে-মেয়ের ভরনপোষণ বহন করা কষ্টসাধ্যই হয়ে যায় তাতে। তাই সাহায্য-সহযোগিতার জন্য প্রায়ই আসতে হয় তাদের সানার বাবা-চাচাদের কাছে।

হাসিবের বয়সটা সানার বয়সের কাছাকাছিই৷ কিন্তু তবুও সে আপু বলেই সম্বোধন করে এসেছে শৈশব থেকে৷ এমনকি মেহাকেও ছোটো আপু বলে ডাকে সব সময়। আপু ডাকার জন্য আবার সানাও ছোটো ভাইয়ের মতোই ভাবতে বাধ্য হয় তাকে। এ মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি দেখে তাই অকপটেই সে জিজ্ঞেস করে বসল‚ “কী ব্যাপার‚ হাসিব? নার্ভাস লাগছে কেন তোমাকে? দেখা করতে এসেছ না-কি কারও সাথে?”

বেশ লজ্জা পেল হাসিব। সে বাস্তবিকই লাজুক প্রকৃতির ছেলে। “তেমন কিছু না‚ আপু”‚ বিব্রতপূর্ণ হেসে ইতিউতি করল।

যা বোঝার বুঝে গেল সানা৷ অবাক হয়ে বলল‚ “তুমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারো সত্যি? জীবনে তো আমাদের সঙ্গেই ‘কেমন আছেন’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারোনি।”

ঠোঁট চেপে বিব্রত চেহারাটা এদিক-ওদিক ঘোরাতে থাকল হাসিব। সানা তাই আরও চেপে ধরল‚ “মেয়েটা কে‚ হ্যাঁ? এসেছে নিশ্চয়ই? বলো বলো… তাড়াতাড়ি বলো৷ নাহলে মেহাকে ডাকলে একদম ঘাড় চেপে ধরে কথা বের করবে।”

“এই না আপু”‚ তড়িঘড়ি করে বলল হাসিব‚ “ছোটো আপুকে ডেকেন না।”

মেহা তাকে খুব খ্যাপায় এত লাজুক প্রকৃতির হওয়ার কারণে৷ বাসায় গেলে মেহার খ্যাপানোর জ্বালাতেই অস্থির হয়ে পড়ে সে। তাই বেশ ভয়ই পায় মেহাকে।

“তাহলে বলো‚ মেয়েটা কে? দেখা করা শেষ না-কি?”

ইতোমধ্যে জারার বকুনি খাওয়া শেষ হাসিবের৷ সেই বকুনি খাওয়ার পর আর দেখা হবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু দেখা না করলেও তো চলবে না। এবং সেটা সে একাকীই করতে চায়। সানার সহযোগিতা নেবে না-কি? চিন্তা করল হাসিব৷ কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময়ও নেই। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল—সানার মাধ্যমেই দেখা করার চেষ্টা করবে। না পারলে আর কিছু করার নেই৷ চলে যাবে তারপর।

জারার কথা একটু খুলেই বলল হাসিব সানাকে। জারা বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে চায় বলেই সে সাহস পায়নি দেখা করার। এ কথা বলে হাসিব জানাল‚ “আপনি যা ভাবছেন এমন কিছু না আসলে‚ আপু৷ এমনিই ফ্রেন্ডশিপ আরকি। যদি একটু ম্যানেজ করেন ওকে‚ একটা চিরকুট দিতাম আপনার কাছে৷ ওকে গিয়ে দিয়ে আসতেন শুধু।”

“ছবি আছে জারার?” কপাল কুঁচকে বলল সানা‚ “ছবি থাকলে একটা ছবি দাও তো দেখি।”

মূলতঃ জারার নাম আর সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী শুনে সানা সংশয়ে পড়ল শারফানের বোনই কিনা সে৷ তাছাড়া এই মুহূর্তে মেলাতে তো জারাও আছে।

“ছবি তো নাই‚ আপু। জারার বান্ধবী ছবি আপলোড করেছিল ওদের৷ তখন দেখেছিলাম শুধু৷ সেটা দেখাব?”

“দেখাও।”

হাসিব রেখা মেয়েটার ফেসবুক আইডিতে ঢুকে ছবিটা খুঁজে বের করল। দেখাল সানাকে৷ জারাকে দেখে অনেকটাই অবাক হলো সে। এতক্ষণ যতখানি মজা করছিল তা দূর হয়ে গম্ভীরতা ভর করল ওর মাঝে। জিজ্ঞেস করল শক্ত কণ্ঠে‚ “তোমাদের মধ্যে সত্যিই কোনো সম্পর্ক নেই‚ হাসিব? সত্যিটা বলো আমাকে।”

ঘাবড়ে গেল হাসিব। এমনিতেই টেনশনে অস্থির অবস্থা তার৷ সানার অভিব্যক্তি দেখে আরও বেশি টেনশন বেড়ে গেল। মাথা নাড়িয়ে বলল ব্যাকুল স্বরে‚ “ভালো ফ্রেন্ডশিপ শুধু। আর কোনো সম্পর্ক নেই‚ আপু৷ সত্যি। আল্লাহর কসম।”

“কখনো এমন প্রস্তাব যদি দেয়ও জারা। তাও রাজি হইয়ো না‚ ভাই”‚ কোমল গলায় বলল সানা‚ “সিনেমার ডায়ালগের মতো বলতে হচ্ছে‚ ওদের ফ্যামিলির মান-মর্যাদা আর টাকা-পয়সার সঙ্গে আকাশ-পাতাল দূরত্ব তোমাদের। আর ওর ভাইটাকে চেনো?”

“সেভাবে না।”

“খুব ডেঞ্জারাস সে। কিন্তু বোনকে খুব ভালোবাসে। সীমার মধ্যে থেকেই কথা বোলো দুজন।”

“জারার দিক থেকেও কিছু নেই‚ আপু। আপনার সতর্কতার পর আমি ইনশা আল্লাহ আরও সাবধান হব।”

“এখন বলো‚ দেখা করতে চাইছ?”

দৃষ্টি নুইয়ে ফেলল হাসিব‚ “আপনি না বললে করব না।”

“তোমার ইচ্ছে‚ ভাই। আমার বলা‚ না বলার কথা আসছে না এখানে।”

সত্যি বলতে হাসিবের একটুও আগ্রহ বা সাহস‚ কোনোটাই হচ্ছে না জারার সঙ্গে দেখা করার৷ কিন্তু না করে যে উপায়ও নেই৷ এদিকে সানাকে বেশ মান্য করে বলে কিছু বলতেও পারল না। নীরবই রইল৷ আর তার নীরবতায় জবাব দিল সানাকে৷ জিজ্ঞেস করল সানা‚ “চিরকুটে কী লিখবে?”

“জারা আমাকে ভুল বুঝছে‚ আপু৷ ভাবছে আমি বেশি ভাব নিচ্ছি বলে দেখা করিনি ওর সাথে৷ ওর বান্ধবীদুটো খুব চঞ্চল তো৷ আমার আসলে একটু অস্বস্তিই হচ্ছে ওদের সামনে যেতে। জারা যদি চায় তাহলে নিজেই এসে কোথাও একটা দাঁড়িয়ে কথা বলে যাবে। আর না চাইলে সমস্যা নেই। চলে যাব আমি।”

হাসিবকে ছোটো থেকে চেনেই বলে সানা জানে বাবা-মায়ের বেশ বাধ্য সন্তান সে। অভাব-অনটন তার দুটো বোনের থেকেও বেশি ভালো বোঝে সে-ই৷ তাই কাজ করার মতো সামর্থ্যবান হওয়ার পর থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রীর কাজ করে শুরু করে৷ কেবল নিজের পড়াশোনার খরচ আর সংসারের খরচ কিছুটা বহন করার জন্যই৷ এতে কখনো পড়াশোনাতেও গাফিলতি করেনি সে৷ মোস্তফা সাহেব সব সময় হাসিবের অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের প্রশংসা করেই ওদের দু বোনকে অনুপ্রাণিত করেন৷ এমন ছেলের নিশ্চয়ই বাস্তবতার বুঝটাও থাকবে বলেই বিশ্বাস সানার।

কিন্তু জারা যে হাসিবের সঙ্গে দেখা করতেই বান্ধবীদের নিয়ে মেলায় এসেছে‚ সেটা জেনে সানার সন্দেহ হচ্ছে জারার ভাবমূর্তির ব্যাপারে৷ কথা বলতে পারলে আরেকটু পরিষ্কার হওয়া যেত। তাই রাজি হলো হাসিবকে সাহায্য করতে৷ একটা দোকান থেকে এক টুকরো কাগজ যোগাড় দুটো লাইন কথা লিখে দিল হাসিব। চিরকুটটা নিয়ে আপাতত তার থেকে বিদায় নিয়ে সানা চলে গেল জারাকে খুঁজতে৷ এই ফাঁকেই মেলা থেকে বেরিয়ে পড়ল হাসিব৷ মনে মনে খুব প্রার্থনা করল‚ দেখা করতে যেন রাজি না হয় জারা।

ড্রাইভার খালিদের চোখের পরীক্ষা শেষ। জারাকে খুঁজে বের করে তার কাছে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ একটা ছেলে এল তার কাছে। তাকে জানাল‚ বাইরে পার্ক করে রাখা গাড়ির জানালার কাচ নাকি ভেঙে ফেলেছে দুটো ছেলে। খালিদ জিজ্ঞেস করল‚ “তুমি জাইনলে ক্যাম্বা আমার গাড়ি?”

“আপনারে ওই গাড়ি থেইকে নামবার দেখছিলাম কইয়াই তো আপনারে খুঁইজে কবার আসলাম। পোলা দুইডা এহনো আছে। ধরবার চালি যান এহনই”‚ বলল ছেলেটা।

বিশ্বাস অবিশ্বাস দোলাচালে পড়ল খালিদ৷ জারা ফুচকার স্টলে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে। খেতে যেহেতু সময় লাগবে‚ ততক্ষণে দেখে ফিরে আসা যাবে। বেরিয়ে পড়ল সেও মেলার মাঠ থেকে।

সে সময়ই সানা খুঁজে পেল জারাকে৷ দিনার বউভাতে মেহার মাধ্যমে একবার আলাপ হয়েছিল দুজনের৷ তাই কথা বলতে জড়তা হলো কারোরই। সৌজন্যপূর্ণ কথাবার্তার পর সানা বের করল চিরকুটটা৷ জারাকে সেটা দিতে দিতে বলল‚ “হাসিবের আপু হই আমি৷ জানাল আজ তোমার ব্যাপারে। ও খুব লাজুক তো‚ তোমাদের সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছিল খুব৷ তাই চিরকুট পাঠাল আমার হাত দিয়ে।”

“ভাবা যায়? চিরকুট!” দারুণ অবাক হলো জারা৷ বলল‚ “এত লাজুক স্বভাব তো এখন মেয়েদেরও হয় না‚ আপু৷”

“সত্যিই হয় না”‚ মুচকি হেসে বলর সানা‚ “ছোটোবেলা থেকেই মুখচোরা ও। কিন্তু তোমাদের ফ্রেন্ডশিপ হলো কী করে?”

জারা নিঃশঙ্কোচেই জানাল পরিচয় হওয়ার গল্পটা থেকে বাকি সবটাই৷ যেহেতু হাসিবের আপু সে। সেসব কথাতেই সানা বুঝল জারার মনের ভাব৷ না‚ সত্যিই জারার মধ্যেও প্রেমের কোনো ইশারা ইঙ্গিত নেই। তাই আশ্বস্ত হয়ে বলল‚ “হাসিব স্টুডেন্ট হিসেবে খুবই ভালো৷ ছেলেটাও বেশ ভদ্র৷ ভুল বুঝো না ওকে৷ ও সত্যিই মেয়েদের সঙ্গে খুব একটা মিশতে পারে না৷ সেখানে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে জেনে অবাক হয়েছি। ও বোধ হয় আছে আশেপাশেই৷ যদি সমস্যা না হয় তো চাইলে গিয়ে কথা বলতে পারো।”

“ঠিক আছে‚ আপু”‚ মিষ্টি করে হাসল জারা।

দু ভাই-বোনের চেহারাতে একটু আধটু মিল থাকলেও স্বভাবে মনে হলো সানার‚ শারফানের একেবারে বিপরীত জারা। শারফান যতটা তেতো‚ জারা যেন ততটাই মিষ্টি।

★★★

চিরকুটটা হাতে নিয়ে জারা মেলা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ সানার মুখে হাসিবের প্রশংসা শুনে রাগটা পড়ে গেছে। ছেলেটা গত দু মাসে পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক সাহায্যই করেছে ওর৷ এজন্যই দেখা করার আগ্রহটা একটু বেশি। স্টেডিয়ামের বাইরে সামনের দিকটাই ভালোই মানুষজনের আনাগোনা। আর হাসিব আছে স্টেডিয়াম থেকে কিছুটা দূরে। এদিকটা চেনাজানা আছে জারার৷ তাই হাসিবের বলা জায়গায় পৌঁছতে সময় লাগল না ওর৷ তবে এদিকের রাস্তাটা এখন একটু নিরিবিলি। দু-চারজন করে যাতায়াত করছে। রাস্তার পাশেই একটা কালো গাড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল হাসিবকে। তার কাছে এসেই জারা দিল এক ধমক‚ “ছেলে মানুষ এমন হয়?” তারপরই শুরু করল দ্বিতীয় দফার বকুনি‚ “কী হত রেখাদের সঙ্গে দেখা করলে? ওরা কী আনস্মার্ট মনে করল তোমাকে‚ জানো? সানা আপু না বললে তো আসতামই না আমি।”

চোখদুটো লাল হাসিবের৷ বাঁ গালটাও লাল তার— শক্ত হাতের থাপ্পড় পড়লে যেমন লাল হয়। হাত-পাও কাঁপছে তার অনবরত৷ রাগে আর বিরক্তিতে সেসব খেয়াল করল না জারা৷ সানা আসলে ভুল চিনেছে ওকে। মেজাজ কিছুটা ভাইয়েরই মতো পেয়েছে সেও। আচ্ছামতো ধমকানি আর বকুনি দিতে থাকল সে হাসিবকে। ঠিক তখনই ষণ্ডামার্কা এক বিশাল দেহী লোক এসে দাঁড়াল ওর পেছনে৷ তাকে দেখতে পেয়েই হাসিবের গলা-বুক শুকিয়ে গেল৷ রক্তশূন্য হয়ে গেল মুখটা। জারা তার চেহারা আর দৃষ্টি লক্ষ করে বকাঝকা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে পেছনে মুড়ল আর চোখের পলকেই ওর নাকে এসে লাগল পানি। সেটা আদতে ক্লোরোফর্ম স্প্রে। গাড়ির দরজা খুলে গেছে এর মাঝেই। হাসিবকে খুনে চোখদুটোর ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলল ভয়ঙ্করদর্শন লোকটা৷ কোনো কথা না বলে উঠে পড়ল হাসিব। চেতনা হারিয়ে লোকটার গায়ে পড়ে আছে জারা। আশেপাশে ভালোভাবে দেখে নিয়ে ওকেও তুলে দিল ভেতরে—হাসিবের পাশেই৷ ভেতরে আরও একজন ছিল৷ সে হাসিবকে ডিঙিয়ে গিয়ে বসল জারার অপর পাশে৷

মহাসড়কে উঠে পড়ল গাড়িটা। তারপর চলতে শুরু করল দ্রুতই৷ পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করছে হাসিবের৷ কিন্তু বের করে দেখার সাহস নেই তার৷ কলটা করছে সানা৷ ওদের দুজনকে খুঁজছে সে মেলার মধ্যে৷

নির্বাচনের দিন পনেরো আগে শারফান প্রতিপক্ষের সঙ্গে যে ঝামেলাটা করিয়েছিল ফারনাজের। ঠিক সেদিন থেকেই ওকে জব্দ করার রাস্তা খুঁজে বের করেছিল ফারনাজ৷ একটু খোঁজ নিতেই জেনে গিয়েছিল বোনের প্রতি ওর ভীষণ সযত্ন আচরণ। জারাকে ফাঁদে ফেলার মতো চকলেট বয় ধরনের ছেলের অভাব নেই৷ কিন্তু সে বেছে নেয় হাসিবকে। তার প্রধান কারণ‚ ছেলেটা অত্যন্ত সরল আর ভীতু। হাসিবের পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা বেশি করে থাকেন কবির সাহেবই৷ যেহেতু তিনি বিত্তবান ছিলেন৷ এমনকি হাসিবের বোনের বিয়ের পাত্র যোগাড় করা থেকে বিয়ের যাবতীয় খরচার বেশিটাই তিনি দিয়েছেন। ছেলে প্রবাসী৷ আসবে এ মাসের শেষেই৷ তারপরই বিয়ে। ফারনাজ হাসিবকে কাজে লাগানোর সুযোগটা পেয়েছে এখানেই৷ যেদিন শারফানের হাতে আহত হলো সে‚ সেদিনই হুমকি দেয় হাসিবকে—জারাকে প্রেমের ফাঁদে না ফেলতে পারলেই বোনের বিয়েটা ভাঙবে সে৷ এতে কত বড়ো ক্ষতি হবে তার বোনের‚ তা ভেবেই হাসিব ভয় পেয়ে যায় এবং রাজিও হয় শেষমেশ। কিন্তু আজকের আগ পর্যন্তও সে জানত না জারার জন্য আসলে কী পরিকল্পনা ছিল ফারনাজের। প্রেমের ফাঁদে না ফেলতে পারলেও হাসিব জারার বিশ্বাসটা অর্জন করেছে দেখেই খুশি ফারনাজ। তার বিশ্বাসটাকে ব্যবহার করেই তো পেল জারাকে হাতের মুঠোয়।

কান্নাটা বহু কষ্টে আটকে রেখেছে হাসিব৷ জেনে-বুঝে জারার ক্ষতি হতে দিতে বিবেকে বাধছিল বলেই ওই অজানা আততায়ী লোকটাকে অনুরোধ করেছিল অপহরণ না করতে৷ তখনই কঠিন থাপ্পড়টা খেতে হয় তাকে।

গাড়িটা থামল মধুখালীর দিঘলিয়াতে—নিরিবিলি পার্কটার সামনে৷ “ওই নাম”‚ সামনে থেকে আততায়ী লোকটা হঠাৎ ধমকে উঠল হাসিবকে‚ “চুপচাপ ঢাকার গাড়িতে উঠে পড়বি৷ তোর পলায় থাকার ব্যবস্থা করা শেষ। কারও কাছে মুখ খুললেই তোর জান নিয়ে নেওয়ার পারমিশন আছে আমার।”

শেষবার জারাকে দেখে নেমে পড়তে বাধ্য হলো হাসিব। জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেল না কোথায় নিয়ে যাবে তারা জারাকে।

★★★

সন্ধ্যা ৬ টা

টেবিল থেকে উঠে কেবিনের ডিভানে এসে গাটা এলিয়ে দিল শারফান৷ দুই অফিস এক সাথে সামলাতে গিয়ে আজকে দুপুরের খাওয়ার কথায় ভুলে গেছে সে‚ তা এতক্ষণে মনে পড়ল ওর৷ খাবার আনার জন্য বাপের ব্যক্তিগত সহকারীটাকে পাঠানো হয়েছে ইতোমধ্যে। তার ফেরার অপেক্ষায় আছে সে। এই অপেক্ষার মাঝেই আচমকা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন শাফিউল সাহেব। “ও শায়াফ”‚ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলেন‚ “জারাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না খালিদ।”

“কী?” চমকে গিয়ে লাফিয়ে ওঠার মতো দাঁড়িয়ে পড়ল শারফান।

“তোর বন্ধুগুলোকে জলদি বল স্টেডিয়ামে যেতে”‚ অস্থির গলায় বললেন শাফিউল‚ “চারপাশে খোঁজ লাগা।”

“বানি স্টেডিয়ামে গেল কখন?” ধমকে উঠল শারফান।

অসহায়ের মতো দেখাল শাফিউল হকের মুখটা৷ মেয়ের বায়না রাখতে গিয়ে ছেলের কড়া নির্দেশকে অবমাননা করে কি বিরাট ভুল করলেন? জানালেন কখন নিয়ে গিয়েছিল খালিদ৷ আর খালিদের ওপর ভরসা ছিল বলেই অত চিন্তা করেননি।

মাথায় ধ্বংসাত্মক রাগ চাপল শারফানের। স্থান বিবেচনাবোধ হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বাপের ওপর‚ “তুমি চিন্তা করলে কী করে আমার নিষেধ অমান্য করার? আমার কথার দুই টাকার দাম দিতে মন চায় না তোমার?”

“তুই তাড়াতাড়ি সাদ্দামদের ফোন লাগা‚ আব্বা৷ আমাকে পরে গালাগাল দিস।”

ফোনটা টেবিলের ওপর৷ ক্ষিপ্ত দৃষ্টিজোড়া বাবার ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছে যেতে পথে চেয়ার পড়ল সামনে। লাথি মেরে চেয়ারটাকে ফেলে দিয়ে ফোনটা হাতে নিল৷ লাগাতার কল করল অনেককেই। সব শেষে ফারনাজের ওপর নজরদারি করা ছেলেটা জানাল‚ ফারনাজ আজ কয়েকটা দিন একেবারেই বাড়ির বাইরে যায় না৷

কথাবার্তা শেষ করে শারফান ফোনটা পকেটে পুরেই বেরিয়ে পড়ল কেবিন থেকে। স্যুটটা চেয়ারে ফেলে রাখা‚ বাবার পিছু ডাক‚ কিছুই গরজ করল না।

ঘন্টা আরেকটা পার হয়ে গেল। রাত নেমে পড়ায় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল রাজন৷ ষণ্ডা মতন লোকটাই রাজন। খুনখারাবি‚ চাঁদাবাজি‚ ডাকাতি‚ সন্ত্রাসী করা একটি পেশাদার দলের মূল মাথা সে৷ এ সময়ের বহু রাজনীতিবিদ আর বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও অপ্রকাশিত সংযোগ আছে তার। মোটা অঙ্কের কোনো কাজ হাতে পেলেই কেবল সে নিজে মাঠে নামে৷ যেমন ফারনাজের থেকেই গতবার পেয়েছিল শারফানকে মেরে দেওয়ার দায়িত্ব। এমন দায়িত্ব যতবার পেয়েছে ততবারই মানুষগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে৷ ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু শারফানের বেলাতেই। তাই দ্বিতীয়বার ফারনাজের কল পেলে সে চেয়েছিল শারফানকে এবার স্নাইপার শুট করতে। ফারনাজ রাজি হয়নি বলে একটু মনঃক্ষুণ্নই হয়েছে তাই। কারণ‚ এই প্রথম তার কাজের সুনাম নষ্ট হলো৷

কুষ্টিয়ার ডাউদপুরে ঢুকল গাড়িটা। ভেড়ামারা উপজেলার একটি শান্ত গ্রাম। কিছুটা বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির।

রাজনের হাত লম্বা বিধায় আস্তানা গড়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। জারাকে বের করে ঢুকল একটা ছোটো গুদাম ঘরে। জলচৌকিতে ওকে শুইয়ে দিতেই এসে হাজির হলো আরও দুজন ব্যক্তি৷ এদের বেশভূষা আর চেহারাতে ভদ্রলোকের ছাপ। বয়সটা ত্রিশের মাঝে৷ একজন রোহান‚ আরেকজন দিপু। জারাকে দেখেই ওদের চোখজোড়া চকচক করে উঠল৷

“একেবারে চেহারাতেই বলে দিচ্ছে বড়োলোকের রাজকন্যা”‚ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠল রোহান।

রাজন কোনো জবাব দিল না। কথা মতো জারার কয়েকটা ছবি তুলে পাঠাল ফারনাজের কাছে৷ তারপরই কল লাগাল তাকে। শোবার ঘরে বসে অপেক্ষাতে ছিল ফারনাজ। রিসিভ করতে তাই দেরি করল না‚ “বলো‚ রাজন।”

“মাল নিয়ে পৌঁছে গেছি।”

“তোমার ডিউটি আবার মাঝ রাতে। ফরিদপুর মাগুরা হাইওয়ের কোনোখানে ওকে ফেলেই চলে যাবে। ফোনের স্পিকার লাউড করে রোহানকে দাও।”

রাজন বেশ চুপচাপ প্রকৃতির। সে হলো কথা কম‚ কাজ বেশি ধরনের মানুষ৷ ফোনটা নীরবেই এগিয়ে দিল রোহানকে। কানে ধরে রিহান লম্বা করে সালাম জানাল ফারনাজকে। সালামের জবাব দিল না ফারনাজ। সরাসরি বলল‚ “হাতে সময় কম তোর৷ শারফান পাগলা কুত্তার মতো হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শুঁকে শুঁকে পৌঁছে যেতে পারে। ভরসা নেই। ঝটপট কাজ শুরু করে দে৷ ছেলে রেডি আছে তো?”

“হ্যাঁ‚ ছেলে তো পুরাই নায়ক”‚ বলতে বলতে দিপুর পিঠ চাপড়ে তার ঘাড় জড়িয়ে ধরল রোহান। “তুমি কোনো চাপ নিয়ো না‚ বস। ছবি‚ ভিডিয়ো‚ সব হবে একের।”

“দেখার পরই বুঝব তা। শেষ একটা কথা মাথায় রাখ। নুডিটি বোঝা যাবে স্রেফ৷ তার মানে এই না একেবারে ন্যাকেড করতে হবে মেয়েটাকে। আর এর চেয়ে বেশি চিন্তা যেন মনেও যেন না আসে৷ আসলেও বাড়াবাড়ি কিচ্ছু করবি না—আই অ্যাম ওয়ার্নিং ইউ। রাজনকেও একই ওয়ার্ন করছি।”

তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসল রোহান‚ “মেয়ে তো এমনিই বদনাম হবে। তাহলে কী এসে যায়?”

“কী এসে যায় সেটার কৈফিয়ত তোকে দেব না”‚ ধমক লাগাল ফারনাজ। “আমার কথার নড়চড় হলে বাকি পেমেন্ট কেউ পাবি না। ছবি আর ভিডিয়ো নিতে এক ঘণ্টা সময় লাগারও কথা না। কাজ দ্রুত শেষ করে আমাকে জানা।” ফোনটা কেটে দিল তারপরই।

হোয়াটসঅ্যাপে জারার ছবিটা বের করে ওকে দেখতে থাকল নিষ্পলক। “সম্পদ‚ টাকা চাইলেই আবার তৈরি করা যায়”‚ স্বগতোক্তি করে উঠল হঠাৎ ছবিটা দেখতে দেখতেই‚ “কিন্তু ইজ্জত একবার গেলে কি ফিরে পাওয়া যায়? আমাকে ভাতে মারলি‚ শারফান। আর আমি মারব হক পরিবারের সুনামে‚ তোর সম্মানে। নাইবা ক্ষমতা থাকল তোর প্রতিপত্তি ধ্বংস করার। যে অহংকার‚ যে দাপট নিয়ে ঘুরিস। আজকের পর তা দেখাস দেখি!”

জ্ঞান ফেরার মুহূর্তেই কম ডোজের কেটামিন পুশ করে দেওয়া হয়েছে জারাকে। এখন সে জেগেই। চোখের পাতা আধ খোলা‚ দৃষ্টি ঝাপসা‚ কণ্ঠ রুদ্ধ। আর শরীরটা যেন কাঠের পুতুল। শুধু বুকের হালকা ওঠানামা জানান দিচ্ছে—সে এখনো জীবিত।

ওড়না আর মাথার হিজাবটা খুলে নিল রোহান৷ খোঁপা করা চুলগুলোও খুলে দিল। পরনের ফ্রক জামাটার পেছনের চেইনটা টেনে নামিয়ে আনল বুকের মাঝামাঝিতে। ভেতরের ইনার তাতে অনেকটাই বেরিয়ে পড়ল৷ রোহানের কামুক চোখদুটো সেখানে পড়তেই

হাত নিশপিশ করল ওকে ছোঁয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত ফারনাজের হুকুম সে মানবে কিনা সন্দেহ—ভাবল দিপু। আর রোহান হুকুম পালন না করা মানেই তারও সুযোগ। রাজন গেছে আপাতত বাইরে৷ বলে গিয়েছিল সে ফেরার পর যেন কাজ আরম্ভ করে ওরা। কিন্তু রোহানের যে আর তর সয়নি।

“মামা‚ শুইয়া পড়ি?” চোখে লালসা আর মুখে বিকৃত রসের হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল দিপু।

খিকখিক করে হাসল রোহান‚ “তলপেটের নিচে লম্ফঝম্প শুরু হয়ে গেছে‚ ভাগনা?”

একইভাবেই হাসতে থাকল দিপু জারাকে দেখতে দেখতে৷ রোহান বলল‚ “ক্যামেরা রেডি করি৷ ততক্ষণে তুইও রেডি হয়ে যা।”

গায়ের শার্টটা দ্রুত খুলে ফেলে দিপু শুয়ে পড়ল জারার কাছে৷ দিপু বয়সে তেইশ-চব্বিশের হলেও শরীরটা বিশাল। দেখলে মনেই হয় না ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে সে৷

ক্যামেরা প্রস্তুত৷ শুরু হলো রোহানের নির্দেশনা। জারাকে পুতুলের মতোই যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ব্যবহার করছে দিপু। নিজের সঙ্গে ওকে মিশিয়ে নিচ্ছে‚ চুমু খাচ্ছে শরীরের যেখানে-সেখানে। প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই ভঙ্গিমাগুলো দেখানো হচ্ছে ভিডিয়োতে।

রোহানকে বলা যায় চতুর ভিজ্যুয়াল কারিগর। ছবি তোলায় পটু আর ভিডিয়োতে জাদুকর৷ ডিজিটাল খেলোয়াড় বা ডিপফেক শিল্পীও বলা যায় তাকে। যে ছবি বা ভিডিয়োতো সত্য আর ভ্রমের তফাতটুকু মুছে দিতে পারে অনেকটাই নিখুঁতভাবে। কিন্তু এত দারুণ দক্ষতাকে সে ব্যবহার করত নোংরা কাজে। পেশাতে ছিল সে অতীতে অশ্লীল ভিডিয়ো ব্যবসায়ী। তার সেই ব্যাবসাতে থাবা বসিয়েছিল ফারনাজ। তারপরই ফরিদপুর ত্যাগ করে ঢাকায় পাড়ি জমায় সে৷ কিন্তু তবুও ফারনাজকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। যার জন্য বাধ্য হয়ে এখন এক বিবাহ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ক্যামেরাম্যানের দায়িত্বে। আজ হঠাৎ করে সেই ফারনাজের থেকেই এমন এক প্রস্তাব পেয়ে নিজেকে বহুদিন পর সুখী লাগছে তার।

★★★

রাত ৮: ২০ মিনিট

বাসের একদম পেছন সিটে বসে আছে হাসিব। মুখটা ঢেকে কান্নাকাটি করছে সে৷ ফারনাজের ব্ল্যাকমেইলিং তাকে তো বিপদে ফেলেছেই‚ তার পরিবারকেও হয়ত ভুগতে হবে৷ এ আশঙ্কা আর জারাকে বিপদে ফেলার জন্যই গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে যেতে ইচ্ছা করছে তার। ফারনাজ যতই বলুক পরিবারের খেয়াল সে একশোভাগ রাখবে৷ কিন্তু তবুও মনটা তার মানছে না৷ নিজের বোনের সঙ্গে আজ কেউ এমন করলে কী করে সহ্য করত সে? কথাটা ভীষণভাবে আঘাত করছে তার হৃদয়ে৷

চোখদুটো মুছে মিনিট দুই ভাবল কিছু একটা৷ অ্যানড্রোয়েড ফোন কেনার আগে একটা বাটন ফোন কিনেছিল সে৷ খুব গোপনে সেই ফোনটা গাড়ির সিটের ফাঁকে গুঁজে দিয়েছে এই ভেবেই‚ যদি জারার হাতে পড়ে কোনোভাবে? কিন্তু এখন আরও একটা চিন্তা মাথায় এল তার৷ নাম্বার দিয়ে নাকি কী করে যেন জায়গা চিহ্নিত করে পুলিশেরা! সে যদি জানিয়ে দেয় জারার বাড়িতে‚ তাহলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে ওকে যেখানে রাখা হয়েছে। হ্যাঁ‚ তাই-ই করবে সে৷ কিন্তু জানাবে কাকে? জারার ফোন নাম্বার জানা আছে। কোনোদিন ফোন করার সাহস হয়নি৷ কারণ‚ তাকে জানানো হয়েছিল ফোনটা সব সময় ওর মায়ের কাছেই থাকে। এখনো নিশ্চয়ই থাকার কথা? ফোন করে বলার মতো বুকের পাটা তার নেই৷ তাই মত বদল হওয়ার আগে জারার ফোন নাম্বারে ঝটপট মেসেজ করল একটা। উল্লেখ করল না ফারনাজের কথা‚ আর না নিজের পরিচয়। কেবল ঘটনার মূল বর্ণনা রাখল‚ নিজের ফোনটার কথা নাম্বারসহ জানাল আর রাজনের গাড়ির নাম্বারটাও লিখল৷ গাড়ি থেকে নামার পর বুদ্ধি করে এটাও মুখস্থ করে নিয়েছিল সে। তবে তখনো ভাবনায় ছিল না এভাবে সবটা জানাবে সে জারার পরিবারকে।

মেসেজটা পাঠানোর পর ভয় আর দুশ্চিন্তার মাত্রা কমল না হাসিবের। বরং বাড়ল। যদি ফোনটা না থাকে কারও হাতে? থাকলেও যদি তাও খুঁজে না পায় জারাকে? আর যদি মেসেজটা কেউ দেখে তাহলে কি তার ফোন নাম্বারের মাধ্যমে তাকে খুঁজে নেবে? খুঁজে পেলে তাকে কী করবে জারার পরিবার? এসব ভেবেই সিমকার্ডটা আচমকা খুলে জানালার বাইরে ছুঁড়ে মারল সে

রেখা আর অনিমা—জারার বান্ধবী দুজন৷ এই মুহূর্তে জারার বাসার লিভিংরুমে বসে আছে ওরা৷ সাথে আছে তাদের অভিভাবকও৷ সাদ্দাম আর রিপন তাদেরকে পরোয়া না করেই চড়া গলায় জেরা করে যাচ্ছে মেয়ে দুটোকে৷ আশ্চর্যের বিষয়‚ ভয়ে কান্নাকাটি করলেও হাসিবের নামটা ওরা কোনোভাবেই মুখে আনছে না। ওরা আসলে বিশ্বাস করে জারা আর হাসিব প্রেমের সম্পর্কে ছিল৷ কিন্তু তা কখনো জারা ওদের কাছে স্বীকার যায়নি৷ এবং আজ ওরা পালিয়ে গেছে। আর পালিয়ে যাওয়ার জন্যই জারা অমন মরিয়া হয়ে আজ মেলায় গিয়েছিল। কেননা হাসিব গরিব বিধায় কখনো তাকে মেনে নেবে না জারার বাবা‚ ভাই৷ এখানে ওদের আসল ভয় হলো‚ হাসিবের কথা বললে সবাই যদি ভাবে জারাকে পালাতে সাহায্য করেছে ওরাই? তাই দুজন আগে থেকেই পরামর্শ করে সবটা গোপন করে যাচ্ছে।

“তোমরা যদি কিছু লুকিয়ে থাকো এখনো সময় আছে সব বলার”‚ কঠোর হয়ে বলল সাদ্দাম‚ “জারার ভাই আসছে। সে এসে যদি ধরে তোমাদের আর যদি বুঝতে পারে তোমরা মিথ্যে বলছ৷ তাহলে কিন্তু ও কাউকেই মানবে না তোমাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে।”

কথাটা শেষ করার পরই জারার ফোনটা বেজে উঠল এক মুহূর্তের জন্য৷ জেসমিন বেগমের হাতে ফোনটা৷ কান্নাকাটি করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ তাকে সামলাচ্ছে জোবেদা আর জারার বান্ধবীর মায়েরা। ফোনটা চেক করা হয়ে গেছে সাদ্দাম আর রিপনের৷ দুর্ভাগ্যক্রমে জারার দ্বিতীয় অ্যাকাউন্টের হদিসটা জানতে পারেনি ওরা৷ কারণ‚ কাজ হওয়ার পর ভাইয়ের ভয়ে অ্যাকাউন্টটা ফোনেই রাখত না সে৷ মা কিছু না বুঝলেও সদা সতর্কতা অবলম্বন করত।

সোফার হাতল থেকে মাথা তুলে ভেজা চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকালেন জেসমিন বেগম। ঝাপসা চোখে কিছু বুঝলেন না৷ ততক্ষণে সাদ্দাম উঠে এসেছে ফোনটা দেখার জন্য৷ তিনি তুলে দিলেন ওর হাতেই৷

হাসিবের মেসেজ! মেসেজটা পড়তে পড়তেই উত্তেজনায় হাত কেঁপে উঠল সাদ্দামের৷ দ্রুত সেটা ফরোয়ার্ড করল শারফানের কাছে‚ শাফিউল সাহেবের কাছেও৷ হাসিবের নাম্বারটাও মেসেজ করল তাদের। তারপরই কল লাগাল শারফানকে৷

জ্যামে আটকে বসে থাকতে হবে বলে শাকিবুল সাহেবের গাড়িটা নিয়েছে শারফান৷ যাতে এমপির গাড়ি দেখেই ট্রাফিক পুলিশ বেরিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে দেয়৷ শাকিবুল সাহেব সরাসরি ওপরমহলে জানিয়ে রেখেছেন—জ্যামে যেন আটকে না পড়ে তার গাড়ি৷ প্রয়োজনে রুট ফাঁকা করে দেওয়ারও অনুরোধ করেছেন।

এই মুহূর্তে তাই ফেরি ঘাটে শারফান৷ সঙ্গে শাফিউল সাহেব আর রিহানও। কলে ইতোমধ্যে এসবির সহকারী পুলিশ সুপারের সাথে কথা চলছে ওর৷ তদন্তে নেমে পড়েছে তারা। কথার মাঝেই সাদ্দামের ফোন ঢুকল৷ কথা শেষ করে তার ফোন ধরল শারফান। জিজ্ঞেস করল‚ “নতুন কোনো আপডেট?”

“মেসেজ দেখ ফাস্ট।”

কলটা কেটে দিয়ে ইনবক্স চেক করল শারফান। মেসেজ দেখেই হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল ওর৷ সঙ্গে সঙ্গেই মেসেজদুটো ফরোয়ার্ড করল এএসপিকে। তারপরই কল করল তাকে৷ রিসিভ হতে ঝড়ের গতিতে নির্দেশ দিল‚ “ডোন্ট ওয়েস্ট আ সেকেন্ড। পিনপয়েন্ট দ্য ফোন’স লোকেশান অ্যান্ড লোকেট দ্য ভিয়াকল—রাইট নাও।”

চলবে।