#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৫.
❝Everyone must check the footnote.❞
গাড়ির দরজা খুলে নেমেই হনহনিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকে গেল শারফান। পেছন ফিরে দেখলও না বাবার কী অবস্থা। দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় প্রেশার বেড়ে গেছে শাফিউল সাহেবের। রিহান তাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল সারা পথ৷
লিভিংরুমে অপেক্ষারত বন্ধুমহল আর মায়ের দিকেও না ফিরে সরাসরি উপরে উঠে গেল সে। বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজতে আরম্ভ করল৷ কখনো বালিশের নিচে‚ কখনো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে৷ অবশেষে ক্যাবিনেটের নিচের ড্রয়ারে খুঁজে পেল চাবির তোড়াটা। ক্যাবিনেটের ভেতরের গুপ্ত ড্রয়ারটি খুলে টেনে আনল কাঙ্ক্ষিত বস্তু—একটি Glock 19, 9mm পিস্তল। নিঃশব্দে ম্যাগাজিনে গুলি ভরে সেটি প্রবেশ করাল পিস্তলে‚ এরপর স্লাইড টেনে প্রথম রাউন্ডটি এনে রাখল চেম্বারে। নির্ভার ভঙ্গিতে পিস্তলসহ হোলস্টারটি প্যান্টের ভেতর গুঁজে নিয়ে বেল্টে আটকে দিল।
ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই হঠাৎ তার কোমরের পাশে থাকা হোলস্টারের ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া পিস্তলের ধাতব কালো ঝিলিক সবার দৃষ্টি টেনে নিল মুহূর্তেই। কারও আর বুঝতে বাকি নেই সামনের পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে। শাফিউল সাহেব সোফায় বসে পানির গ্লাসটা সবেই মুখে নিয়েছিলেন—তার আর খাওয়া হলো না পানিটা।
নিচে নামার পরই কল এল এএসপির৷ ফোনটা কানে নিয়ে তার কথা চুপচাপ শুনতে শুনতে শারফান বের হতে গেলে ওর পথ আগলে দাঁড়ালেন শাফিউল তড়িঘড়ি করে। “তুই ওটা নিয়ে বের হচ্ছিস কেন?” উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন‚ “বের হচ্ছিস কোথায়? খোল ওইটা… বের কর৷ আমার হাতে দে‚ শায়াফ।”
“এখনো একই জায়গাতেই আছে গাড়িটা?” বাবার দিকে আগুন চোখ করে তাকাল শারফান ফোনে কথা বলার ফাঁকেই।
“হ্যাঁ”‚ জানাল এএসপি‚ “ভেড়ামারা থানা থেকে ফোর্স বেরিয়ে পড়েছে৷ আশা করছি আমাদের আগেই পৌঁছে যাবে।”
ফোনটা কেটে দিয়েই বাবাকে বর্জ্রস্বরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল শারফান‚ “সরে যাও সামনে থেকে… সরো বলছি!”
জোবেদা আর জেসমিন বেগম কেঁপে উঠলেন। ভয় পেয়ে গেলেন দুজনই৷ কাঁদতে কাঁদতে জেসমিন বেগম ছুটে এসে ছেলের বাহু জড়িয়ে ধরে অনুনয় করতে লাগলেন‚ “ও বাবা‚ পিস্তলটা রেখে যা তুই… দোহাই লাগে তোর!”
নিশানাভেদের চর্চা শুরু করেছিল শারফান‚ বছর দেড়েক আগে ইয়াজের হাত ধরে। শখের টানেই বাবার লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি পিস্তল নিয়ে মাঝেমধ্যে অনুশীলন করত একা একা। কিন্তু তার উগ্রমেজাজি স্বভাবের প্রতি আস্থা না থাকায় শাফিউল সাহেব সেটি জোর করেই নিজের হেফাজতে ফিরিয়ে নেন। অবশ্য এরপর আর কখনো অস্ত্রটির প্রয়োজন হয়নি—তাই আজকের আগে তার দিকেও ফিরে তাকায়নি শারফান।
সাদ্দাম‚ অনি‚ সবাই-ই বোঝাতে শুরু করল ওকে। পুলিশ যেহেতু ট্রেস করে ফেলেছে জারার অবস্থান‚ তাই আর শারফানকে বের হতে দিতে রাজি নয় কেউ৷ মূলতঃ ওর বিপজ্জনক রাগকে ভয় করেই চাইছে না কেউ৷
এর মধ্যেই কাঠের শক্তপোক্ত দরজাটাই দড়াম করে এক লাথি বসিয়ে দিল শারফান। দরজার কবজা একটা খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো তাতে৷ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে জেসমিন বেগম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলে ছেলের ওপর চিৎকার করে উঠলেন শাফিউল সাহেব‚ “কুকুরের বাচ্চা ঘরে যা বলছি! কোত্থাও বের হবি না তুই।”
“চুপচাপ বসে বাতাস খাও”‚ পালটা ধমকে বলল শারফান‚ “একটা সাউন্ডও করবে না কেউ। তোমাদের জন্য আজকের এই বিপদ ওর! আমার পারমিশন ছাড়া মেয়েকে মেলায় পাঠাও! আবার তা গোপন রাখা চো** আমার কাছে?” শেষোক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলে গলার রগ ফুলে উঠল ওর। শাফিউল সাহেবের দিকে রক্ত লাল চোখদুটো স্থির রেখেই বলল বন্ধুদের‚ “এদেরকে সামলা। হসপিটাল নিয়ে যাওয়া লাগতে পারে মনে হলে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বসিয়ে রাখ।”
আর কেউ ধরে রাখতে পারল না ওকে। বন্ধুদের ধাক্কা মেরে‚ তাদের হাত ঝাড় দিয়ে ফেলে বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে৷
“ওকে কেউ ঠেকা গিয়ে… ওর সাথে যা কেউ”‚ হাঁসফাঁস গলায় বলতে বলতে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লেন শাফিউল সাহেব। জেসমিন বেগম দৌড়ে এসে তাকে ধরলেন দুই হাতের মাঝে৷ আর রিহান ছুটল শারফানের পিছু পিছু।
সেই বিকাল পাঁচটার পর থেকে মেয়েটা নেই৷ রাত বাজে এখন দশটারও বেশি। এতগুলো সময় মেয়েটা কোথায় আছে‚ কী অবস্থায় আছে? ওর সঙ্গে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা করে বুকের ভেতর নিঃশব্দ বর্জ্রপাত হতে থাকল শাফিউল সাহেবের৷ সোফার গায়ে মাথা এলিয়ে নীরবে চোখ ভাসালেন৷ ড্রাইভার খালিদও ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছেন অবিরত। ছেলের গায়ে হাজারটা মার পড়লেও মেয়েটার গায়ে আজ অবধি আঙুলের টোকাও দেননি কেউ। শারফানই বা শেষ কবে বোনটাকে চড়‚ থাপ্পড় মেরেছে তাও বলতে পারবে না কেউ।
কলেজ আর ভাইয়ের রেস্ট্রন্ট—এই অবধিই ছিল জারার যাতায়াত। প্রাইভেটটাও পড়ানো হত তাকে বাসায় শিক্ষক রেখে। একা বা বন্ধুদের সাথে এর বাইরে আজ পর্যন্ত কোথাও যাওয়ার অনুমতি দেয়নি শারফান। এমনকি জেসমিন বেগমও৷ বাচ্চাকাল থেকেই বয়স অনুযায়ী ওজন‚ উচ্চতা আর শারীরিক বিকাশ একটু বেশি তার। আবার সৌন্দর্যেও কম নয়। তাই তাকে নিয়ে সাবধান থাকতে হত অতিরিক্ত।
আর আজকে সেই মেয়ের সাথেই যদি কিছু হয়ে যায় তবে এর দায়ভার সব থেকে বেশি নিজের মনে করবেন শাফিউল সাহেব। পরিবারের কারও অবাধ্য নয় মেয়েটা‚ একদম অবুঝও নয়। সে ভেবেছিল বরাবরের মতোই মেলা‚ কনসার্টে যাওয়া পছন্দ করে না ভাইয়া তাই যেতে দিতে রাজি না কেউ তাকে৷ কিন্তু যখন যাওয়ার জন্য জেদ করল তখন যদি অনুমতির বদলে একটু বুঝিয়ে বলতেন পরিস্থিতিটা‚ তাহলে নিশ্চয়ই আর জেদ করত না সে। অথচ কী বোকামিটাই না করলেন তিনি! যে ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক দ্বন্দ‚ এসবের কিছুই জানে না‚ বোঝে না৷ তাহলে তাকে কেন এসবের মাঝে টানল ওই অমানুষটা? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণ ভেজাতে থাকলেন।
***
ফোনটা বেজে চলেছে বিরতিহীন—ফারনাজের কল। ওর কলের জ্বালায় অতিষ্ঠ রোহান৷ ছবি‚ ভিডিয়ো নেওয়া শেষ হয়েছে কিনা তা জানার জন্য কতবার যে কল করেছে ফারনাজ এই ঘন্টা দুটোর মাঝে! সব থেকে বেশি বিরক্ত সে জারাকে নিয়ে ওর বারবার নিষেধাজ্ঞা শুনতে শুনতে।
ফারনাজের একমাত্র উদ্দেশ্য শারফানের পরিবারের সম্মান নষ্ট করা। কোনো ধর্ষণ ঘটনা এর মাঝে টানতে চায় না সে। যদি দু পক্ষের সম্মতিক্রমে কিছু হত সেখানে অবশ্য আপত্তি ছিল না৷ তাছাড়া জারার বয়সটাকে হিসেব করেই আসল ভয় পাচ্ছে সে৷ রোহান‚ রাজন‚ দুজনকেই জানে৷ এরা পীড়নলোলুপ—নিষ্ঠুরতায় আনন্দ খুঁজে পায়৷ মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি দিলে মেয়েটা শেষ অবধি বাঁচবে কিনা সন্দেহ৷ তখন আবার খুনের মামলায় ঢুকে পড়বে ঘটনা৷ জলঘোলা আরও হলে বিপদ দ্বিগুণ।
তবে রাজনের কাছে টাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই ফারনাজের আদেশকে অমান্য করার চেষ্টা করেনি৷ এর আরও বড়ো কারণ হলো‚ শারফানকে মারতে না পারার কারণে সেবার টাকাটা পুরোপুরি মেলেনি৷ এবারও এমন হোক তা সে চায় না কোনোভাবেই। আপাতত সহচরকে নিয়ে বাইরে আছে। যাওয়ার আগে রোহানকে ভালোভাবে সাবধান করে রেখে গেছে।
কিন্তু দিপু কোনোভাবেই নড়ল না জারার কাছ থেকে৷ রোহানকে খুব অনুরোধ করল‚ “একবার চান্স দে‚ মামা। একবারে কিছু হবে না৷ এরকম সলিড মাল সব সময় ভাগ্যে জোটে না।”
“আমি চান্স দেওয়ার কে? রাজন এসে দেখলে গলা এক্কেরে নামায় ফেলবে তোর।”
“ভুল কইলা। ও দেখার পর ব্রেইন আউট হয়ে প্যান্ট খুলেই দৌড়ায় আসবে।”
হেসে উঠল দুজন এক সাথেই৷ হাসতে হাসতেই অচেতন থাকা জারার দু পাশে এসে দাঁড়াল দুজন৷ মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ওর গালে‚ ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল রোহান‚ “সেই খাসা চমচম। মাছি আসবে প্রচুর। ভিডিয়োগুলোে চড়া দাম হবে।”
“একটু চেটে দেখি‚ আয় মামা।”
“দেখব? সত্যি?”
দিপু জবাব দেওয়ার আগেই তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ ভেতরে ঢুকল রাজন। আতঙ্কগ্রস্ত লাগল তাকে৷ রোহান তাকাতেই সে গালি দিয়ে চেঁচাল‚ “আমার কল ধরোস না ক্যা‚ মাদার**?”
“ওহ‚ তুমিও কল মারাচ্ছিলে না-কি?” বলতে বলতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল রোহান মিসডকলগুলো।
“ওরে মাদার**‚ পুলিশের গাড়ি দেখছে খসরু বাজারে দাঁড়ায়ে। এইদিকেই আসতেছে গাড়ি৷ ফোনে কইল। তাড়াতাড়ি বাইর হ।”
অবাক হলো রোহান‚ “এত জলদি খোঁজ পেয়ে গেল? ক্যামনে?”
কোনো জবাব দিল না রাজন। বেরিয়ে পড়ল সে ঘর থেকে৷ কীভাবে এত জলদি খোঁজ পেল পুলিশ‚ প্রশ্নটা তারও৷ তাদেরকে ট্রেস করার মতো কিছু কি ছিল মেয়েটার সাথে? না‚ তা থাকার কথা না। ভালো করেই চেক করা হয়েছিল ওকে—কোনো ফোন ছিল না ওর কাছে।
রোহান‚ দিপু বেরিয়ে এল ব্যাগপত্র নিয়ে৷ রাজনকে গাড়ির কাছে দেখে জিজ্ঞেস করল রোহান‚ “দাঁড়ায় আছ কেন?”
ভাবনাচিন্তা করছিল রাজন৷ রোহানের কথা শুনে বলল‚ “গাড়িটার মায়া ছাইড়ে যাইতে হবে। এই গাড়ির মাধ্যমেই হদিস খুঁইজা পাইছে।”
“হতেও পারে। নয়ত এত ফাস্ট লোকেশন খুঁজে পাবে ক্যামনে?”
“আর মেয়েটারে কী করবা?” জিজ্ঞেস করল দিপু। জারাকে না পাওয়ার আফসোস থেকে সে বেরই হতে পারছে না।
তবে তার কথার কোনো জবাব দিল না কেউ৷ গাড়ি না নিতে পারলে পালানোটা কষ্টকর৷ তাই চিন্তায় পড়েছে রোহানও৷ শেষমেশ রাজনের পরামর্শে ওরা পায়ে হেঁটেই রওনা হলো সঠিক পথের উলটো দিকে।
সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ কাটতে না কাটতেই পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল ওরা চলে যাওয়ার পরেই। গুদামঘরের দরজা অর্ধখোলা, ভেতরে আলো জ্বলছে। সন্দেহ নিয়ে‚ স্নায়ু টানটান করে দলটি ঢুকল ভেতরে। আবিষ্কার করল‚ জলচৌকির ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে জারা। মৃতদেহের মতো নিস্তেজ ওর শরীরটা৷ কারণ‚ কেটামিন দেওয়া হয়েছিল ওকে আবারও। দুই মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ওর জামাকাপড় ঠিক করল‚ নিল নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব পরীক্ষা করে। এর মাঝে তিন কনস্টেবল ছড়িয়ে পড়ল গুদামের চারপাশে৷ আশপাশে ছায়াময় কোনো চিহ্ন বা অপরাধীর খোঁজ করল—কিন্তু কিছুই মিলল না। ঠিক তখনই প্রধান অফিসার মোবাইল হাতে তুলে বিস্তারিত জানাল এসবির এএসপি-কে। জারার অবস্থা‚ উদ্ধারসংক্রান্ত সব তথ্য জানানো মাত্রই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ আসলো ওপার থেকে। তাই দ্রুত জারাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হলো। ভর্তি করল ভিআইপি ওয়ার্ডে।
রাত সাড়ে বারোটায় শারফান পৌঁছালো হাসপাতালে। মাত্র দোতলায় উঠতে গিয়েই অধৈর্য হয়ে পড়ল ও৷ এতটুকু পথ—কিন্তু ওর মনে হলো যেন বোনের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা বহুদূর৷ পুলিশ অফিসার আর ডাক্তার ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে জারার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করছিল৷ দোতলায় পৌঁছে শারফান তাদের দেখা মাত্রই আবেগময় ও উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল‚ “হোয়ার হ্যাভ ইউ টেকেন মাই সিস্টার?” সঙ্গে এসে দাঁড়াল রিহানও। ওদেরকে দেখেই বুঝে গেল সবাই‚ জারার আপনজন তারা।
শারফানকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার সময় ডাক্তার জানাল‚ “আপনার বোনকে এক ধরনের সেডেটিভ ইনজেক্ট করা হয়েছে। আমরা সন্দেহ করছি, কেটামিন। এখনো ও পুরোপুরি চেতনা ফিরে পায়নি। তবে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক‚ পালসও স্থির। আমরা আইভি ও অক্সিজেন দিয়ে রেখেছি। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো‚ ওর স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ঠিকঠাক আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। চিন্তার খুব একটা কারণ নেই৷ তবে একটু সময় লাগবে পুরোপুরি সুস্থ হতে।”
“এছাড়া শারীরিক আর কোনো ক্ষতি হয়নি ওর”‚ পাশ থেকে জানাল পুলিশ অফিসার।
কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না শারফান। বেডের কাছে এসে নিমেষহীন জারার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু৷ ওর মনের হাল টের পেয়ে পুলিশের সাথে কথাবার্তা এগোল রিহান। অপরাধীরা আগেই কোনোভাবে টের পেয়ে উলটো পথে ভেগেছে। জারা জ্ঞান ফেরার পর যদি কিছু বলতে পারে তাদের ব্যাপারে‚ তাহলে সুবিধা পাবে তদন্তটা৷ কিন্তু কেটামিনের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব সম্পর্কে জানে রিহান—ফার্মাসিতে পড়ছে বিধায়। এটি শক্তিশালী ডিসোসিয়েটিভ অ্যানেস্থেটিক। অতিরিক্ত বা অপব্যবহারে এটি অচেতনতা‚ স্মৃতিভ্রষ্টতা‚ এমনকি হ্যালুসিনেশনও তৈরি করে। অপব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি ডেট রেপ ড্রাগ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তাই কেটামিনের কথা শোনার পরই রিহান বুঝে গেছে অপরাধীদের উদ্দেশ্য কী ছিল৷ শারফানের সামনে সেসব আলোচনায় গেল না সে পুলিশের সাথে৷ ওদের কথাবার্তার মাঝে আচমকা বেজে উঠল শারফানের শীতল কণ্ঠ‚ “ওকে কখন ছাড়া হবে?”
“পুরো একদিন অবজারভেশনে না রাখতে চাইলে কমপক্ষে বারো ঘন্টা তো রাখতেই হবে”‚ বলল ডাক্তার‚ “সেই সঙ্গে কিছু মেডিকেল টেস্ট ও কনসালটেশন লাগবে। সব নিশ্চিত হলেই ছাড়ার ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে।”
দ্বিরুক্তি করল না শারফান৷ বুকের ভার কমাতে প্রলম্বিত শ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে ফিরে দাঁড়াল পুলিশের দিকে।
***
৯ মার্চ
সকাল ৮: ১০ মিনিট ।
আকাশে হালকা সোনালী আভা আর বাতাসে মৃদু শীতের রেশ৷ এই বাতাসে কাঁপন ধরায় না। কেবল সতেজতা অনুভব করায়। প্রকৃতির রং বদলাতে শুরু করেছে যে। রাস্তার পাশের গাছের ডালে একদিকে কচি পাতারা দুলছে আর অন্যদিকে বাসের হর্ন‚ রিকশার ঘন্টি আর মানুষের হুড়োহুড়ির শব্দ। চায়ের দোকানগুলোতে ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে উঠছে‚ খদ্দেরের এক হাতে খবরের কাগজ‚ আরেক হাতে চায়ের কাপ। এটাই শহুরে আর মফস্বল জীবনের চেনা দৃশ্য।
মোস্তফা সাহেব মুদি দোকান থেকে চিপস‚ চকলেট আর জুস কিনে বাসে উঠে পড়লেন। দুই মেয়ের হাতে তুলে দিলেন সেসব৷ ঢাকাগামী বাসটা ছাড়বে আর কিছু সময়ের মাঝেই৷ সানা আর মেহার এক মাত্র মামা ছুটিতে এসেছেন দেশে—দুবাই প্রবাসী তিনি। ভাগনিদের ডেকে পাঠিয়েছেন আরও সপ্তাখানিক আগে। আজ সময় হলো ওদের মামার কাছে রওনা হওয়ার। ওদের খালাত ভাই-বোনেরা চলে গেছে ইতোমধ্যে। তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হবে বহুদিন বাদে। তাই দু বোনকেই লাগছে ভীষণ আনন্দোচ্ছ্বল।
আর ঠিক একই সময়েই জারা হাসপাতালের বিছানাতে। স্বাভাবিক জ্ঞানে ফিরেছে সে৷ এখন সে মুখোমুখি হতে চলেছে এএসপি মিজান খানের জিজ্ঞাসাবাদের। কেবিনে এখন শুধু ডাক্তার আর রিহান উপস্থিত৷ শারফান গেছে ওয়াশরুমে। সারা রাত জেগেই ছিল সে৷ সাধারণত নিজের ব্যক্তিগত নিবাস ছাড়া যেখানে-সেখানে ঘুমাতে পারে না কখনোই৷ উপরন্তু বোনের চিন্তা মাথায় নিয়ে আরও ঘুম হয়নি।
অফিসার মিজান খানের সঙ্গে জারার হালকা আলাপ ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। নিজেকে হঠাৎ করে হাসপাতালে আবিষ্কার করে‚ সামনে ভাইকে দেখতে পেয়ে এবং সঙ্গে অফিসারের উপস্থিতিতে জারা একরকম ভীত আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
“জারা‚ তোমাকে একদম চাপ দেওয়া হবে না”‚ শান্ত কণ্ঠে বললেন মিজান খান‚ “আমরা শুধু জানতে চাই কী ঘটেছিল। তুমি যতটুকু মনে করতে পারো‚ সেটুকুই বলো।”
“কিন্তু আমার কী হয়েছিল?” জিজ্ঞেস করল জারা‚ রিহানের দিকে তাকিয়ে‚ “আমাকে কেন হাসপাতালে আনা হলো? আর ভাইয়া ঢাকা থেকে ফিরল কখন?”
ঠিক তখনই প্রবেশ করল শারফান। সে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো শুনে ফেলেছে। রিহান কিছু বলার আগেই সে স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিল‚ “আমার ফেরার খোঁজ নিয়ে লাভ নেই। তুই কিডন্যাপড হয়েছিলি মেলা থেকে। অফিসার যা জানতে চাচ্ছে‚ সেটার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা কর শুধু।”
জারার ভয় আরও বাড়ল ভাইকে দেখে। এবং নিজের অপহরণের বিষয়টি জেনে। অথচ এ ব্যাপারে কিছুই তো মনে পড়ছে না ওর! কেবল শারফানের স্থির দৃষ্টি দেখে যতটুকু মাথায় আছে সেটাই জানাতে চেষ্টা করল‚ “রেখা আর অনিমার সাথে মেলায় ঘুরছিলাম‚ ফুচকা খাচ্ছিলাম…” হঠাৎ থেমে গেল সে এরপরই৷ হাসিবের কথা মনে পড়ে গেল। তার কথা ভাইয়ের সামনে বলতে হবে ভেবেই বুক কাঁপতে শুরু করল৷
“তারপর বল”‚ ঠান্ডা আদেশ করল শারফান‚ “একটা শব্দ লুকাবি না খবরদার।” বোনের কাঁচুমাঁচু মুখ দেখেই সে বুঝে গেছে ওর মনের কথা৷
জারাও বুঝে গেল এতে‚ কিছু আড়াল করার আর জায়গা নেই৷ “এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করি এরপর”‚ নিচু স্বরে বলল জারা‚ “হাসিব ওর নাম। স্টেডিয়ামের বাইরে ছিল ও৷ ওর সাথে কথা বলার মাঝে হঠাৎ পেছন ঘুরে এক লোককে দেখতে পাই। তারপর কী হলো… সব ঝাপসা হয়ে এল সামনে।”
“কিছু স্প্রে করেছিল তোমার নাকে?” জিজ্ঞেস করল অফিসার মিজান‚ “কিংবা কোনো রুমাল চেপে ধরেছিল? এমন ধরনের কিছু কি মনে পড়ছে না?”
একটু সময় নিল জারা। মনে করার চেষ্টায় একটু সফলতা লাভ করল তারপর‚ “হ্যাঁ‚ মুখে পানির ছিটার মতো পড়েছিল কিছু। এরপরই ঝাপসা হয়ে এল চোখের সামনে। আর মনে নেই কিছু।”
“আরেকটু মনে করার চেষ্টা করো‚ জারা”‚ কোমল গলায় বলল অফিসার।”
চলতে থাকল জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব অনেকক্ষণই৷ প্রথমবার কেটামিন দেওয়ার পর জারার কাছে পরিবেশটা ছিল ঘোলাটে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য ধরতে পারছিল না সে৷ এক পর্যায়ে কিছু কথা বলতে পারল সে‚ “আমি কোথায় ছিলাম কিছুই বুঝিনি৷ আলো কম ছিল জায়গাটার। কেউ যেন কাছে এসেছিল আমার… আমাকে কিছু করছিল… কিন্তু শরীরটা নড়াতে পারছিলাম না৷ মুখটা মনে নেই তার৷ কথাবার্তার শব্দগুলো দূর থেকে আসছিল মনে হচ্ছিল… ঘুমিয়ে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম? খুব ভয় পাচ্ছিলাম আমি।”
প্রথমবারের প্রভাব কেটে যাওয়ার আগেই দ্বিতীয়বার ওকে কেটামিন দিয়েছিল রোহান৷ আর তারপরই সে বেহুঁশ ছিল বাকিটা সময়৷ ওই সময় তার আর দিপুর গোপন উদ্দেশ্য ছিল ফারনাজকের বারণকে অমান্য করা। কেবল রাজনের উপস্থিতির জন্যই সেই সময়টুকু কাজে লাগানোর সুযোগ পায়নি দুজন৷
জারার খণ্ড খণ্ড কথাগুলো শুনে শারফানের বুঝতে আর বাকি নেই মাত্র একটা ঘন্টা দেরি হলে কাল কী হতে পারত ওর বোনের সঙ্গে। ডাক্তার জারার রিপোর্টগুলো দেখে আর তাকে পর্যবেক্ষণ করে ওকে ধারণা দিয়ে রাখল আগামী পরিস্থিতির বিষয়ে। সেসব শোনার পর থেকেই ওকে দেখাল একেবারে শান্ত। যেটা বরাবরের মতোই দুশ্চিন্তার। এবং দুশ্চিন্তায় অস্থিরও হয়ে উঠল রিহান। কারণ‚ এখনো ওর জিম্মাতে রয়েছে পিস্তলটা।
ফরিদপুর
দুপুর ১: ২০ মিনিট।
ডাক্তার চাইলেও শারফান আর রাজি হলো না জারাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে৷ গাড়ির পেছনের সিটে জারা একাই বসে—নিস্তব্ধভাবে। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে রিহান বসে‚ শারফানের পাশে। ফরিদপুর পুরোনো বাস স্ট্যান্ড পার করার পর ওদের গাড়িটা হঠাৎ মোড় নিল অন্য রাস্তাতে৷ তা নিয়ে আপাতত কিছু বলল না রিহান ওকে। বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়িটা যখন ফারনাজের বাসার রাস্তায় ঢুকল ঠিক তখনই রিহান দুঃসাহসিক পদক্ষেপটা নিল। খপ করে পিস্তলটা টেনে বের করে আনল শারফানের কোমরের হোলস্টার থেকে। স্টিয়ারিং হুইলে হাত থাকায় ঠেকাতে দেরি করে ফেলল শারফান৷ গাড়িটাকে দাঁড় করিয়েই চেঁচিয়ে উঠল সে‚ “রিহান! মার না খেতে চাইলে ফেরত দে এখনই।”
ওর হুমকিকে তোয়াক্কাই করল না রিহান। দ্রুত নেমে পড়ল গাড়ি থেকে৷ জারা কিছুটা হকচকিয়ে গেছে দুজনের কাণ্ডে৷ শারফান ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এল। কিল‚ ঘুসি খেতে হবে এখন‚ তা জেনেও রিহান সটান দাঁড়িয়েই রইল নিজের জায়গায়। শারফান তার এসেই শার্টের কলার চেপে ধরে চেষ্টা চালাল পিস্তলটা কেড়ে নেওয়ার। তখন সত্যিই দুটো মারও খেল রিহান। তাও জিদ্দি হয়ে আঁকড়ে ধরে রাখল সেটা হাতের মাঝে। এতে যে-কোনো সময় গুলি বেরিয়ে যেতে পারে ভেবে ছেড়ে দিল শারফান৷ “চুপচাপ আমার হাতে দে‚ রিহান” ক্ষুব্ধ‚ ঝাঁঝাল স্বরে বলল সে‚ “দিবি না?”
“গাড়ি টার্ন করবি‚ তারপর পাবি”‚ নির্লিপ্ত গলায় বলল রিহান।
জারাকে পাওয়ার পর থেকে মাথা অনেকটাই ঠান্ডা হয়েছিল শারফানের। কিন্তু বোনের জবানবন্দি পাওয়ার পর থেকে সেই তাণ্ডবী রাগ ভর করেছে আবার৷ রিহানকে নিষ্ঠুর একা ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসল৷ তাকে ফেলেই এগোল ফারনাজের বাসার সামনে৷ গেটটা খোলা পেয়ে কোনো অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়লে দারোয়ান চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল গাড়ির পেছনে৷ গাড়ি থেকে নামতে নামতে জারাকে রুক্ষ স্বরে বলল শারফান‚ “এক পা নিচে নামবি না।”
ভয়ে জুবুথুবু জারা মাথা নেড়ে জবাব দিল শুধু৷ দারোয়ান ছেলেটা এসে শারফানকে বকাঝকা আরম্ভ করলে তাকে চড়াত করে এক থাপ্পড় মেরে দিল। কানে যেন ঘুঘু ডেকে উঠল ছেলেটার‚ এমন অনুভব করল সে৷ তাই আর আটকানোর মতো সাহসটুকু দ্বিতীয়বার দেখাল না।
বুক ভরা আগুন নিয়ে শারফান হনহনিয়ে পেরোল সিঁড়িগুলো। মূল দরজায় এসেই ঔদ্ধত্যভাবে কড়া নাড়ল একবার আর সেই সঙ্গে অবিরত চাপতে থাকল কলিংবেল৷
নিশা লিভিংরুমে বসে টিভি দেখছিল‚ ফারিয়া রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত‚ জাহিদা বেগম স্বামীর সেবায় আর ফারনাজ নিজের অফিস রুমে। এমন অভদ্রের মতো কলিংবেল বাজানোতে নিশা চিড়বিড়িয়ে গালাগাল করতে করতে এসে দরজাটা খুলল৷ জীবনের সবচেয়ে চমকটা পেল তারপরই৷ পরিবারে দুর্দিন আসার আগেও যাকে পাগলের মতো ফোন আর মেসেজ করে গেছে‚ তাকে আজ সরাসরি সামনে দেখে বিস্ময়ে মূক সে। কপাল ঢেকে গিয়ে চোখ ছুঁইছুঁই এলোমেলো রেশম চুল‚ গা হিম করা চাউনির রাঙা দুটো চোখ‚ ঘন দাড়ির নিচে কঠিন করে রাখা চোয়ালজোড়ার সঙ্গে লালচে-কালো পুরু ঠোঁটজোড়াও শক্ত করে রাখা আর পরনে সবজে-নীল এক শার্ট ও সাদা স্ল্যাকস। নিশার মনে হলো‚ কেমন একটা মেঘলা দিনের মতো ধোয়া ধোয়া চেহারা মানুষটির। অথচ চোখে চাইলে অনুভব হয় ভয়ার্ত আগ্নেয়গিরি।
“আপনি?” প্রশ্নটা মুখে আনল বটে নিশা। কিন্তু সম্পূর্ণ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল সে এক পাশে৷ ঝড়ের মতো ভেতরে ঢুকে পড়ল শারফান৷ লিভিংরুমের মাঝে দাঁড়িয়ে ঘরগুলো দেখতে দেখতে গর্জন গলায় জিজ্ঞেস করল নিশাকে‚ “শুয়ো** বাচ্চাটা কোথায়? কোথায় ফারনাজ?”
নিশা চেঁচামেচি করার আগেই ফারিয়া ছুটে এল রান্নাঘর থেকে৷ বোনের কাছে দ্রুত দৌড়াল নিশা৷ শারফানকে দেখে গলা ছেড়ে ফারিয়া ফারনাজকে ডেকে উঠতে না উঠতেই ফারনাজ বেরিয়ে এল নিজের ঘর থেকে৷ বেরিয়ে এল জাহিদা বেগমও আতঙ্কিত হয়ে৷ শারফান কারও দিকে তাকাল না কেবল ফারনাজ ব্যতিত। সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করলে সে বর্জ্রপাতের মতো এগিয়ে গেল ফারনাজের সামনে৷ একদম চোখের পলকে তাকে ঠেলে ফেলল ঘরের মধ্যে—মেঝেতে গিয়ে পড়ল ফারনাজ। নিশারা দৌড়ে আসার আগেই দরজাটা লাগিয়ে দিল সে।
মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল ফারনাজ। শারফান ঝাঁপিয়ে পড়ল তার পূর্বেই। দু’হাতে তার কাঁধ চেপে ধরে দেওয়ালে ঠেলে দিল। কিন্তু ফারনাজও থেমে রইল না আর। শক্ত এক ধাক্কায় ওকে ছিটকে ফেলে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে‚ তারপর এক ঘুসি বসাল ওর গাল বরাবর। ঘুসিটা পড়তেই ওর মাথার ভেতর যেন ছ্যাঁকা দিয়ে উঠল একটা শব্দ। রক্তাভ চোখ মুহূর্তে আরও রক্তাভ দেখাল তখন। দেরি করল না শারফান পালটা আক্রমণের জন্য। পুরোনো শক্তিতে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারনাজের হাত চেপে ধরে ওকে চক্রের মতো ঘুরিয়ে মেঝের দিকে ঠেলে দিল। ফারনাজ হাবুডুবু খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার পেল হাতের নাগালে। এক হাতে টেনে তুলে ছুঁড়ে মারল শারফানের দিকে। শারফান ঘায়েল হওয়ার আগেই সেটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এল। আজ যেন দুজনের মাঝেই অসুর ভর করেছে৷
একসময় শারফানের হাতে পড়ে গেল ফারনাজের কব্জি। ঘুরিয়ে পেছন দিকে চেপে ধরতেই তার গোঙানি বেরিয়ে এল। তারপরই মেঝের দিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাকে পেড়ে ফেলে হাঁটু দিয়ে বুক চেপে ধরল। ঠিক সেদিনের মতোই লাগাতার ঘুসিয়ে গেল তার চোখ-মুখে। ছটফটিয়ে ওঠা ছাড়া ফারনাজ আর কিছু করতে পারল না তখন৷
ওদিকে দরজায় বিরতিহীন ধাক্কাধাক্কি আর সবার চেঁচামেচি‚ কান্নাকাটির শব্দ৷ এক পর্যায়ে থেমে গেল শারফান। কাতর স্বরে ফারনাজ হাঁপাতে থাকল৷ তারপরই তার চোখের সামনে মেলে ধরল ফারিয়ার ভ্রষ্টাচার কীর্তির প্রমাণ। “দ্যাখ জারজের বাচ্চা”‚ উন্মত্ত ক্রোধের সঙ্গে বলল ও‚ “আমার ক্ষমতার জোর দ্যাখ। এই ক্ষমতার নিকৃষ্ট ব্যবহার আমিও করতে পারতাম—করিনি। নারীকে‚ নারী সম্মানকে অস্ত্র বানিয়ে প্রতিশোধ তোলার মতো কাপুরুষসুলভ রুচি আমার ছিল না৷ কিন্তু এখন আমি ভাবব।”
মারের কষ্ট ভুলে ফারনাজ স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইল ফোনের স্ক্রিনে। ফোনের দিকে হাত বাড়াতেই শারফান বজ্রমুষ্টির শেষ ঘুসিটা লাগাল তার চোয়ালে। তখনই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সবাই৷ দুজনের চোখে-মুখেই আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট৷ কিন্তু ফারনাজকে শারফানের নিচে দেখে আর তাকে রক্তাক্ত দেখে মাথা ঠিক থাকল না কারোরই৷ শারফানকে গালি দিতে দিতে ওর দিকে কবির সাহেব আর ফারিয়া তেড়ে আসতেই শারফান ছুঁড়ে দিল এক উগ্র হুঙ্কার‚ “থাম! দাফন করে দেব সবকটাকে এখানেই।” চোখে-মুখে রাগের দাবানল৷ প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারপাশ‚ থমকে গেল কবির সাহেবও। আর ফারনাজ জড়ীভূতের মতো পড়ে রইল।
“আমার বোনের দিকে হাত বাড়ানোর ফল আমি শায়াফ সাতদিনের মধ্যে ফেরত দেব তোমাদের”‚ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল শারফান সবাইকে‚ “এই বাড়ি নিলামে তুলে বাঁচার পথ খুঁজতে হবে। আর তুই…”‚ বলে ফারনাজের দিকে তাকাল‚ “তোর পলিটিক্স ক্যারিয়ার খাব এবার‚ তারপর তোর কলিজা ছিঁড়ে বের করে দেখব কত বড়ো কলিজা দিয়ে বানিয়েছে তোকে আল্লাহ।”
“ভাইয়া… এই ভাইয়া!”
কান্নায় অস্থির জারার ডাক! দরজার দিকে তাকাল শারফান৷ রিহানও দাঁড়িয়ে জারার সাথে৷ “তোকে পুলিশে নিয়ে যাবে‚ ভাইয়া?” কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকল জারা ত্রস্ত পায়ে।
ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার পরই পুলিশকে খবর দিয়েছেন কবির সাহেব৷ রিহান যখন জারাকে রেখে বাসার ভেতরে ঢোকার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল‚ তখন পুলিশ আসতেই দারোয়ান তাকে আর জারাকে দেখিয়ে শারফানের নামে নালিশ জানায়। ভাইয়ের বিপদ বুঝতেই জারা আর বসে থাকতে পারেনি গাড়িতে৷
লিভিংরুমে ওসি আর দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। কবির সাহেব তাদের দেখেই দ্রুত চলে গেলেন তাদের কাছে। তখনই ফারনাজের বুকের ওপর এক পাড়া দিল শারফান‚ “হাজতে পাঠানোর শখ তোর আমাকে? আমাকে হাজতে ঢোকাবি তুই!”
রাগ নয়‚ ওর বলা এই দুই বাক্যের সুরে যে অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল তা কেবল ফারনাজ উপলব্ধি করল। আর এদিকে ফারিয়া আর জাহিদা বেগম আবার বিলাপ শুরু করলে কবির সাহেব পুলিশকে নিয়ে ছুটে এলেন। তা দেখতে পেয়েই ফারনাজ উঠে বসল আর পুলিশকে বলল‚ “চলে যান আপনারা৷ আমার কোনো অভিযোগ নেই৷”
“এই‚ তুই কিসের ভয় পাচ্ছিস”‚ ধমকে উঠলেন কবির সাহেব।
“আমি কোনো ভয়-ডর পাচ্ছি না”‚ বলতে গিয়ে কেশে উঠল ফারনাজ। তারপর চেঁচাল বাবার ওপর‚ “তোমাকে কে বলেছে আমাকে জিজ্ঞেস না করে পুলিশকে ডিস্টার্ব করতে? আপনারা প্লিজ…” ওসিকে উদ্দেশ্য করল‚ “মাফ করুন আমাদের৷ এটা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়৷ আমরা মিটমাট করে নেব নিজেরাই। প্লিজ‚ আসুন আপনারা।”
জারা হঠাৎ ভাইয়ের মুখে মারের দাগ দেখতে পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল৷ সবাইকে ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাইয়ের বুকে। বোনকে জাপটে ধরে শারফান ধমকে উঠল রিহানকে‚ “বাড়ি না গিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছিস কেন?”
পুরো পরিস্থিতি দেখে রিহানের দিশাহারা অবস্থা প্রায়। মামাকে ফোন করবে কি করবে না এই দ্বিধায় এতক্ষণ ভুগছিল সে। এর মাঝে শারফানের ধমক খেয়েই বুদ্ধি ফিরল তার৷ ডাকল জারাকে দ্রুত‚ “এদিকে আয়‚ জারা। বের হব আমরা।”
“আব্বুকে কল করুন‚ ভাইয়া”‚ জারা শারফানের শার্ট আরও চেপে ধরল। “আব্বুকে আসতে বলুন তাড়াতাড়ি।” ভাইকে পুলিশের থেকে না বাঁচিয়ে কোনোভাবেই নড়বে না সে—সেটিই বোঝাল।
এই পুরোটা মুহূর্ত ফারনাজের চোখ এঁটে থাকল তার ওপর—কেউ খেয়াল করল না তা৷
ওসি তো পূর্ব থেকেই অবগত এই দুজনের দ্বন্দ সম্পর্কে৷ কিন্তু দুজনকেই আঘাতপ্রাপ্ত দেখে আর ফারনাজের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে ও শারফানের পারিবারিক ক্ষমতাকেও বিচার করে কোনো পদক্ষেপ নিল না৷ অধিকন্তু শান্ত গলায় দুজনকে বুঝ দিতে শুরু করল। সেসব আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনার পরোয়া করল না শারফান। ওসির কথার মাঝপথেই জারাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে৷ তাতে কিছুটা অপমানিত বোধ করল ওসি‚ রাগও হলো তার৷
এদিকে কবির সাহেব ফারনাজকে আবার বকাঝকা শুরু করলেন। ফারনাজের কানে তা পৌঁছাল কিনা সন্দেহ। আশ্চর্যভাবে তার স্তিমিত দৃষ্টিজোড়া স্থির রইল জারার যাত্রাপথে।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩৬.
১০ মার্চ
রাত ১০: ২০ মিনিট
গুনগুনিয়ে ফারিয়ার কান্নার শব্দটা অনেকক্ষণ ধরে ভেসে আসছে পাশের ঘর থেকে। ওই শব্দ ফারনাজের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে যেন। আর কবির সাহেব তো জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছেন।
গতকাল পুলিশ বিদায়ের পর সবাই ফারনাজের ওপর চেঁচামেচি করলে ফারনাজ তা কতক্ষণ চুপচাপ সহ্য করার পর একটা পর্যায়ে সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারিয়ার ওপর৷ মারতে মারতে তাকে মেরেই ফেলত যদি সবাই না থামাত। তারপর যখন লিঙ্কনের সাথে তার ব্যাভিচারের ঘটনা জানল বাড়ির সকলে‚ সে মুহূর্তে ফারিয়া আরেক দফা মার খায় জাহিদা বেগমের হাতে৷ তবে মার খাওয়ার মাঝ পথে সে জ্ঞান হারালে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সবাই৷ ফারনাজের মারটা ভয়ঙ্কর ছিল কিনা! তাকে হাস্পাতালে নেওয়া হয় দ্রুত৷ তারপরই জানতে পারে সবাই আরও এক দুঃসংবাদ—প্রায় সতেরো সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ফারিয়া৷ অথচ চার মাসেরও অধিক সময় পর বাড়িতে ফিরেছে সাকিব। কারও আর বুঝতে বাকি ছিল না এ সন্তানের বাবা কে তবে। হাসপাতালের করিডরেই তখন জাহিদা বেগম লুটিয়ে পড়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করেন আর রাগে-দুঃখে ফারিয়ার মৃত্যু কামনা করেন।
হতবাক হয়ে গিয়েছিল ফারিয়াও। আমোদ-ফুর্তির মাঝে এতটাই ডুবে ছিল সে‚ যে নিজের শরীরের পরিবর্তন এতদিনেও টের পায়নি! মাসিক চক্র ওর কখনোই নিয়মিত ছিল না। প্রথম সন্তান হওয়ার পর থেকেই ওর হরমোনাল ভারসাম্য কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। যেটা নিয়ে ডাক্তারও ওকে সাবধান করেছিল৷ তাছাড়া ওজনও একটু বেড়ে গিয়েছিল। ফলে শারীরিক পরিবর্তনগুলো বিশেষ করে পেটের হালকা ফোলা বা ক্লান্তি‚ সবই ওর কাছে মনে হয়েছিল সাধারণ।
হঠাৎ ধরা পড়ে যাওয়া সত্যিটা তাকে করে তোলে ওকে ভীত-সন্ত্রস্ত। পরিবারের এই ঘোর বিপদের মধ্যে সাকিব যেভাবে আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছিল‚ তাতে এই পাপের কথা যদি কখনো তার কানে পৌঁছায়‚ তাহলে কী ঘটতে পারে সে ভাবনা থেকেই যেন মস্তিষ্ক অবশ হয়ে যায় ফারিয়ার। আরও বিষণ্ণ করে তোলে তাকে পরিবারের প্রতিক্রিয়া। বাড়ি ফিরেই তাই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সে। ওই মুহূর্তে তাকে রক্ষা করে ফারনাজই।
তারপর পরিস্থিতি সামলে সবার সিদ্ধান্ত হয়‚ গর্ভপাত করানো হবে। তাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে যায় জাহিদা বেগম। কিন্তু ডাক্তার জানায়‚ ভ্রূণের বয়স অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখন গর্ভপাত করলে তা ফারিয়ার জীবনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এমন খবরে তিনি আর কোনো সিদ্ধান্তে যাননি। নিঃশব্দে ফিরে আসেন হাসপাতাল থেকে।
“এখানের কোনো হাসপাতালে অ্যাবরশান না করানোই ভালো”‚ মায়ের উদ্দেশ্যে নীরব ঘরটাই বেজে উঠল ফারনাজের গম্ভীর কণ্ঠ‚ “সাকিব ভাইকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে কালই ওকে নিয়ে ঢাকা চলে যাও তোমার বোনের বাসায়। ওদিক থেকে কাজ শেষ করে তারপর ফিরবে।”
“ডাক্তার যে নিষেধ কইরলো করবার”‚ দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন জাহিদা।
কথাটা শোনা মাত্রই ফারনাজ সামনের টি টেবিলটাই লাথি মেরে বসল—চেঁচিয়ে উঠল সহসাই‚ “তাহলে পয়দা করতে চাও জারজটাকে?”
জবাব দিলেন না জাহিদা—চোখ ভরে উঠল নিজেদের চরম বেহাল দশার কথা ভেবে।
ফারনাজের অসহ্য লাগছে এই কান্নাকাটি—বিরক্ত লাগছে ঘরের প্রতিটি সদস্যকে৷ লিভিংরুম ছেড়ে চলে এল শোবার ঘরে৷ যদি পারত তো ফারিয়াকে জীবিতই কবর দিত সে৷ একমাত্র ওর জন্যই নিজেকে অসহায় লাগছে তার সকল দিক থেকে৷ এমনকি শারফানের কাছেও আর পুলিশের সামনেও। জারার অপহরণ মামলায় সন্দেহজনক আসামি হিসেবে তাকে আজ দুপুরেই এএসপি মিজানের জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সামান্য কোনো সূত্র পেলে যে তার হাতে হাতকড়া উঠে যাবে—তার ইশারা খুব ভালোভাবেই দিয়ে গেছে অফিসার।
ফোনটা হাতে তুলে কল লাগাল সে রোহানকে। নিশ্চুপভাবে অপেক্ষা করল কলটা ঢোকার—কিন্তু গতকালের মতোই একই অবস্থা। নাম্বারটা বন্ধ রোহানের।
কুষ্টিয়া ছেড়ে পালানোর পর ঢাকায় ঢুকে রোহান আর দিপু রাজনের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারপর থেকে ওদের দুজনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করতে পারছে না ফারনাজ। গতকাল শারফান আসার আগ পর্যন্তও সে লাগাতার চেষ্টা করে গেছে রোহানকে কলে পাওয়ার।
ছবি আর ভিডিয়োগুলো আজকের মাঝে দেওয়ার কথা দিয়েছিল রোহান। যদিও গতকালের পর থেকে এ ব্যাপারে ফারনাজের সমস্ত চিন্তা বদলে গেছে৷ প্রথমত‚ নিজের পরিবারের সম্মান এখন শারফানের হাতেই৷ তাই আর জারাকে বদনাম করার কথা সে ভাবতেই পারবে না। দ্বিতীয়ত‚ অপরাধবোধ। নিজের মধ্যে কিছুটা অপরাধবোধ জন্মেছিল ওই বাচ্চা মেয়েটাকে সামনাসামনি দেখার পর। নিষ্পাপ মুখশ্রীটা দেখে মায়াও অনুভব হচ্ছিল৷ সামনে সারা জীবনটাই তো পড়ে আছে মেয়েটার৷ এমন এক বদনাম ঘাড়ে পড়লে বাঁচবে কী করে? এই শত্রুতার মাঝে কেনইবা নারী মানুষকে জড়াতে গেল সে? উপলব্ধিটা যতখানি হয়েছে না শারফানকে দেখে‚ তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজের বোনের সঙ্গে আজ বিপদটা ঘটার কারণেই।
কিন্তু রোহানকে কোনোভাবেই ফোনে না পাওয়া—এটা বিপদের আশঙ্কা ছাড়া কিছুই নয়।
রাত ১১: ২০ মিনিট।
ঢাকার মিরপুরের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে ফারনাজের এই বিপদ আশঙ্কাকে সত্যি করে রোহান এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ করল ভিডিয়ো এডিটিংয়ের কাজ। ভিডিয়োটা আবার চালু করে বারবার দেখতে থাকল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
দিপুর মুখের জায়গায় বসানো হয়েছে ফারনাজের মুখ। উদ্দেশ্য একটাই—ফারনাজেরও কেলেঙ্কারি। তাই ইচ্ছা করেই ভিডিয়োর রেজুলেশন একটু নামিয়ে এনেছে সে৷ যেন এডিটিংটা চোখে না পড়ে সহজে‚ সত্যি বলে বিশ্বাস হয় সবার।
“চমৎকার”‚ নিজেই নিজের প্রশংসায় গদগদ হয়ে উঠল রোহান। চোখে-মুখে উত্তেজনার ঝিলিক‚ “কী রিয়েল বানাইছি শালা আমি! ওয়াও!”
ওর উল্লাসধ্বনি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিপু। ইয়াবার ধোঁয়ায় ডুবে আধো বুঁদ হয়ে বসে ছিল ঘরে। ভিডিয়োতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে‚ “কী করছোস মামা? আমার জাগায় ফারনাজরে লাগাইছোস ক্যা?”
রোহান ঠোঁটের কোণে এক কুটিল হাসি ফুটিয়ে বলল‚ “কারণ, এটাই তো ছিল আমার আসল উদ্দেশ্য‚ ভাগনা।”
দিপুর কপালে ভাঁজ পড়ল‚ “কসনাই তো আগে? কাহিনি কী?”
“যেদিন ও আমার গোটা ব্যবসা ধ্বংস করে দিল”‚ রোহানের চোখে তখন ফারনাজের প্রতি চাপা ঘৃণার আগুন স্পষ্ট হলো‚ “সেদিন থেকেই ওর সর্বনাশ করার শপথ নিয়েছিলাম। ওর জন্যই আমাকে পেট চালাতে হয় দুই টাকার চাকরি করে। অথচ ওর মুখে সদা নৈতিকতার বুলি! এখন ঠিকই নিজের স্বার্থে আমাকে কাজে লাগাচ্ছে‚ খান** বাচ্চা! ভাবছে‚ আমি চুনোপুঁটি। এবার জানবে‚ এই চুনোপুঁটিই তাকে কত গভীরে ডুবাতে পারে!”
বলা শেষেই ভিপিএন ব্যবহার করে ভিডিয়োটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করল সে বেশ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন নামের অ্যাকাউন্ট ও পেইজ থেকে৷ প র্নো সাইটে করতে চেয়েও করল না। কারণ‚ রেজুলেশন তেমন ভালো নয়। আবার পুরোপুরি নগ্নও নয় দুজন। তাই ভিউ সেভাবে হবে না ভিডিয়োটার। উদ্দেশ্য যেহেতু ফারনাজের বদনাম‚ তাই ফেসবুকে ছড়ালেই উদ্দেশ্যটা পূরণ হবে ঠিকঠাক।
ওর মনের এই হিংস্র বাসনা আর প্রতিশোধস্পৃহার গভীরতা জেনে বেশ চমকাল দিপু। কতগুলো টাকা হাতছাড়া করল সে! আর পুলিশ তো পিছু পড়ে আছেই! তবে কি এজন্যই আজ রাতে সে ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে পাড়ি দেবে? হ্যাঁ‚ এ কারণেই। সব কিছু গুছিয়ে তবে পালানোর সময় হয়ে গেছে তারও।
রাত ১২: ০৫ মিনিট
গতকালের দৌড়ঝাঁপ‚ দুশ্চিন্তা আর নির্ঘুম রাতের পর আজ সারাটাদিনেও গাটা ঠিকঠাক বিছানায় ছোঁয়াতে পারেনি শারফান‚ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে। তার মধ্যে রিহানের মা আর শাকিবুল সাহেবের পুরো পরিবার হাজির হয়েছে আবার। যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই জারাকে জড়িয়ে ধরে মরাকান্না জুড়েছে চাচি। রীতিমতো কোলাহল চলেছে বাড়িটাই পুরো দিন৷
এখন এক নিঃসীম নিদ্রার ঘরে মাত্রই প্রবেশ করছিল শারফান৷ ফোনটা আজ সাইলেন্ট মোডে রাখেনি সে ইচ্ছাকৃতই। তাই ঘুমের দফারফা করতে সেটা আকস্মিক চিৎকার করে উঠল সেন্টারটেবিলের ওপর। এক মুহূর্ত সময় লাগল কেবল ঘুমের ঝটকাটা কাটতে৷ এভাবে কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় ওর সঙ্গে সঙ্গেই। সেই যন্ত্রণাতেই চোখ-মুখ খিঁচিয়ে উঠল। হাতটা বাড়িয়ে ফোনটা হাতে তুলে দেখল‚ সাদ্দামের কল। রিসিভ করতে দেরি করল না। কারণ‚ এমন সময়ে বন্ধুরা কেউ কখনো কল করে না জরুরি ছাড়া। তারা জানে ওর ঘুমের সময়সূচি।
“বল।”
“মেসেঞ্জারে যা”‚ কণ্ঠটা অন্যরকম শোনাল সাদ্দামের।
চোখদুটো ডলে মেসেঞ্জারে ঢুকল শারফান। মুহূর্তেই ভেসে উঠল আরও কয়েকজন বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীর মেসেজ। একটির পর একটি ঢুকতে থাকায় সাদ্দামের কনভারসেশনটা নিচে সরে গেল। তবু চোখ ঠিক সেদিকেই আটকে রইল ওর। সবার আগে সেটাই খুলে দেখল। তিনটি টেক্সট লিংক সারি ধরে পাঠানো। প্রিভিউ থাম্বনেইলের ঝলকেই বুকের রক্ত ছলকে উঠল। বিদ্যুৎবেগে উঠে বসল শারফান। লিংকে ঢোকার পর কয়েক সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। ফোনটা সরিয়ে ভূতগ্রস্তের মতো নিথর হয়ে রইল শুধু। ধীরে ধীরে চোখজোড়া রক্তিমা ধারণ করল‚ ভিজেও উঠল অজান্তেই। রাগের তীব্র হলকায় না-কি বোনের রত্নতুল্য সম্ভ্রমটুকু শত শত চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাওয়ার কষ্টে‚ তা ঠিক জানা নেই।
মেসেঞ্জার টুংটাং করে বেজেই চলেছে৷ সবারই যে একই বার্তা‚ তা নতুন করে চেক করে জানার দরকার হলো না ওর। সাদ্দামের কল এল আবার। নিঃশব্দে ফোনটা কানে ঠেকাল সে। উত্তেজিত স্বরে বলল সাদ্দাম‚ “ঘন্টাখানিকও হয় নাই ছড়াইছে৷ আরও বেশি ছড়ানোর আগেই সরায় ফেলতে হবে। রিপোর্ট করার কথা কইছি আমি সবাইরে।”
“হুঁ‚ রাখ”‚ নিস্তেজ গলায় বলে ফোনটা কেটে দিল শারফান৷ না চাইতেও ওর চোখের সামনে জারার সংবেদনশীল স্থানগুলোই ফারনাজের চুমু খাওয়ার দৃশ্যগুলোই আসতে থাকল শুধু।
মাথাটা আচমকা ঝাঁকিয়ে উঠল সে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকছে কেন? ভাবতেই চোখদুটো টিপে অশ্রুকে দূর করে ফোনবুকে ঢুকল দ্রুত—কল করল অফিসার মিজানকে।
***
পরবর্তী সকালটাই কবির সাহেব আর শাফিউল সাহেব‚ দু পরিবারের পরিণতিই হলো ভঙ্গুর দশার মতো। ফারনাজের ফোনটা রাত থেকে অনর্গল বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে আছে এখন৷ বন্ধুবান্ধব‚ রাজনৈতিক দল‚ সবখান থেকে ফোন করে তাদের একই বুলি‚ “এসব কী‚ ফারনাজ?”
এতখানি দিশাহারা অবস্থা কোনোদিনও হয়নি তার। একদিকে চিন্তা কী করবে‚ কোথায় যাবে সে? আর অন্যদিকে শারফানের প্রতিক্রিয়ার ভয়। এমন চাপ নিয়ে ঘরে বসে থাকাটাই হলো তার জন্য দুষ্কর। দ্বিতীয় ফোনটা পকেটে পুরে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে কোথাও একটা। সেই সাথে রোহানকে খুঁজে বের করার জন্য ভেতরে ভেতরে মরিয়াও হয়ে উঠল। এ যে রোহানের প্রতিশোধ তা সে বুঝে গেছে সহজেই।
আর শাফিউল সাহেবের ঘরটা যেন একেবারে শ্মশানপুরী। মেয়ের চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার সেই ভয়ানক ভিডিয়োর কথা জানার পর শাকিবুল হক হা-হুতাশ করলেও শাফিউল সাহেব এখনো বাইরে থেকে নিশ্চুপ। কিন্তু ভেতরটা যেন ভেঙেচুরে খানখান। লুকিয়ে চোখের পানি যে কতবার মুছেছেন‚ তা হিসাবহীন। আর ওদিকে‚ জেসমিন বেগম মেয়ের সামনে কাঁদতে না পেরে রান্নাঘরে বসে গোপন আর্তনাদে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন।
গতকাল বাসায় ফিরে বাবা-মা আর ভাইয়ের স্বাভাবিক আচরণের পরও নিজের ভেতরের অস্বস্তি‚ ভয়-ভীতি আর অপহরণ হওয়ার পরের টুকরো টুকরো এলোমেলো স্মৃতি‚ এসব নিয়ে ভীষণ নাজুক অবস্থায় ছিল জারা দিনের বেলাটাই। তবে আজ সকালে ঘুম থেকে জেগে আগের দিনের চেয়ে কিছুটা হালকা অনুভব করছিল৷ কারণ‚ সারা রাত মা আর বাবার পাশে থাকা‚ তাদের স্নেহ‚ ভাইয়ের অবাধ্য হয়ে এমন বিপদ ঘটানোর পরও তার সহজ আচরণ আর মনকে সামলে ওঠার জন্য তার কতরকম প্রেরণা জোগানো!
কিন্তু ওর সমস্ত আত্মবিশ্বাসের ধ্বংস বয়ে আনল মিথির বাড়াবাড়ি উত্তেজনা আর তার মেকি কষ্ট৷ জেসমিন বেগম তখন ছিলেন না ঘরে৷ কান্না করতে করতে এসে আচমকা জারাকে জড়িয়ে ধরে মিথি বলে ওঠে‚ “এখন কী হবে রে‚ আপু? কী হবে তোর জীবনের? কত জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে ভিডিয়ো। সব কি আর মুছে ফেলা যাবে?”
“কিসের ভিডিয়ো?” নির্লিপ্ত অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চায় জারা।
না বলার ভান ধরে কতক্ষণ এদিক-ওদিক করে যায় মিথি৷ শেষ পর্যন্ত সবটাই বলে দেয় ওকে।
আর এখন‚ বিছানার এক কোণায় প্রস্তরীভূতের মতো বসে আছে জারা। ওর পাশে বসে কখনো মিথি‚ কখনো মিথির মা বিষাদভেজা আহাজারি শুনিয়ে চলেছেন। তাদের কথায় উঠে আসছে একটি কথায়—জীবনটা শেষ জারার। ওর এই কলঙ্ক আর কোনোদিনও মুছে যাওয়ার নয়৷
শাফিউল হক শারফানকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছেন৷ যাতে সে খুনচাপা রাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে কবির সাহেবের বাসায় ঢুকে রক্তপাত ঘটিয়ে না বসে। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে জারার সামনে তুলে ধরলেন তারা ভুল ব্যাখ্যা করে—কোথাও আর মুখ দেখানোর উপায় নেই ওর বাবা আর ভাইয়ের৷ লজ্জায়‚ দুঃখে এই পুরুষগুলো কান্না লুকাতে ঘর আটকে বসে আছে তাই।
নাজুক‚ সরল ওইটুকু মনে জারা ভাবল‚ “সত্যিই তো! আমি নিজেই বা মুখ দেখাব কী করে বাইরে? আমার সমস্ত বন্ধু এতক্ষণে নিশ্চয়ই দেখে নিয়েছে… ভেবে নিয়েছে আমি নষ্টা একটা মেয়ে। কোনোদিনও আমি আর ওদের সামনে দাঁড়াতে পারব না। আমার জন্য আমার ভাইয়া‚ আব্বু-আম্মুও কত অপমানিত হবে!”
চাচির বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল‚ “আম্মু কোথায়? একটু আম্মুকে ডেকে নিয়ে এসো‚ কাকি।”
“তোর আম্মুর মুখির দিকও তাকানোর কায়দা নাই রে‚ মা”‚ বিলাপ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন হাফসা জেসমিনকে ডাকতে।
তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরই দরজাটা বন্ধ করে দিল জারা।
অফিসার মিজান সিআইডির আইসিটি সেলকে দায়িত্ব দিয়েছে রাতের মাঝেই৷ বেশ কয়টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আর পেইজ থেকে ভিডিয়োগুলো ইতোমধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে। এখনো কাজ চলছে৷ তবে একশো ভাগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কমই। চৌদ্দ সালে দাঁড়িয়ে এ দেশের অনলাইন অপরাধ দমন করতে পারাটা কঠিন। শাকিবুল হকের রাজনৈতিক প্রভাব আর দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি হওয়ার দাপটে আর তাদের চাপেই কেবল কাজ দ্রুততা আর গুরুত্বের সঙ্গে করা হচ্ছে।
কিন্তু এতটুকু সময়েই তো কত মানুষের চোখে পড়ে গেছে ভিডিয়োটা! কেউ কেউ হয়ত বিকৃত মজার ছলে নিজের ফোনে ডাউনলোড করেও রেখেছে। এই ক্ষতির পূরণ হওয়া সম্পূর্ন রূপে সম্ভব নয় আসলে। এ অপারগতার কারণেই শারফানের ভেতরটা গুঁড়িয়ে গেছে‚ শোকগ্রস্তের মতো হয়ে আছে সে।
ঘরের মধ্যে রিহান আর শাকিবুল সাহেবও বসে আছেন। সবাই ব্যস্ত ফোনকলে৷ বারবার খোঁজ নিচ্ছেন অফিসারদের কাছে। এ পরিস্থিতিতে অফিস সংক্রান্ত কাজেও কথা চালাতে হচ্ছে‚ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কলও ধরতে হচ্ছে।
দরজায় কড়া পড়ল এর মাঝে৷ জেসমিন বেগমের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠটা ভেসে এল। রিহান উঠে দরজাটা খুলতেই তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত‚ আকুল গলায় জানালেন‚ “আমার মেয়ে দরজা খোলে না। আমাকে ডেকে পাঠাল আপাকে দিয়ে৷ এসে দরজা ধাক্কাই‚ কিন্তু দরজা তো খোলে না৷”
মায়ের পুরো কথা শেষ পর্যন্ত শোনার অপেক্ষায় বসে থাকেনি শারফান৷ চলে এসেছে সে বোনের ঘরের সামনে৷ বোনকে ডাকার আগেই ভেতর থেকে জাঙের চেঁচামেচি। অযথা এমন চেঁচামেচি জাং কখনোই করে না। ভেতরে তাই বিপদের আভাস বুঝতে দেরি হলো না শারফানের। গগনবিদারী চিৎকারে ডেকে উঠল সে বোনকে‚ “জারা‚ দরজা খোল!”
কোনো জবাব এল না ভেতর থেকে। জবাবের অপেক্ষাও করল না শারফান৷ ছুটে গিয়ে বাবা-মায়ের ঘর থেকে চাবির গোছা নিয়ে এল। শাফিউল সাহেব‚ জেসমিন‚ দুজনই কান্নাভেজা আদুরে স্বরে ডাকতে শুরু করেছেন মেয়েকে৷ সবাই-ই ডাকছে৷ অন্ধ জোবেদাও থেমে নেই—বিলাপ সুরে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে শুধু৷
যে ভয়ে তারা কান্নাকাটি জুড়েছে‚ দরজাটা খুলতেই তা-ই দেখা গেল। সিলিং ফ্যানে ওড়না জড়িয়ে গলায় বেঁধেছে জারা। কিন্তু চমকপ্রদ দৃশ্য হলো‚ ওর জামা ধরে টেনেহিঁচড়ে নামানোর চেষ্টা করছে জাং। তার শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল হচ্ছে বিধায় অঘটনটা ঘটাতে পারছে না সে।
শারফান দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উঠে জারার গলা থেকে ওড়নাটা খুলে নিল। শক্ত কতগুলো থাপ্পড় তার গালে ফেলতে যাবে‚ রিহান তার পূর্বেই ওকে জাপটে ধরে টেনে আনল জারার কাছ থেকে। জেসমিন এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন আর বকতে থাকলেন। শাফিউল সাহেব কয়েক পল দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চলের মতো৷ তারপর দুর্বল পায়ে হেঁটে এসে ক্ষীণ সুরে কেবল বললেন‚ “আমাদের শেষ করে তারপর মরতে আসতে‚ মা! নয়ত তোমার লাশ দেখে আমাদের জ্যান্ত লাশ হয়ে থাকতে হবে যে।”
কান্নার ঝড় বয়ে গেল তখন ঘরটাই৷ দুক্কারে কেঁদে উঠে বাবার বুকে এসে পড়ল জারা আর বিলাপ করল‚ “ওরা কেন আমার ক্ষতি করল‚ আব্বু? আমি তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি৷ আমি বিশ্বাস করেছিলাম ওদেরকে৷ সেটাই আমার ভুল হলো‚ আব্বু৷ আমি কী বোকা! দু মাসের পরিচয়ে কেন বিশ্বাস করলাম হাসিবকে? কেন আমি একদিনের পরিচয়ে মেহার বোনকে বিশ্বাস করলাম? সব দোষ আমার… আমার জন্য তোমরা কেউ কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না… আমি পারব না! আমি বাঁচব কীভাবে‚ আব্বু?” মেয়েকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন শাফিউল সাহেব।
কিন্তু এদিকে‚ ভয়ঙ্কর রাগ সামলে দাঁড়িয়ে থাকা শারফানের নিঃশ্বাস হঠাৎ থমকে পড়ল এক মুহূর্তের জন্য। ভুল কিছু শুনল কি? কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে এল জারার কাছে। তার বাজু চেপে ধরে ফেরাল নিজের পানে‚ “হাসিব আর কার কথা বললি? গত পরশু তুই সবটা খুলে বলিসনি আমাদের?”
“তখনো বুঝতে পারিনি‚ ভাইয়া…”‚ কান্না ভাঙা গলায় বলল জারা‚ “বুঝতে পারিনি হাসিবের সঙ্গে উনিও যুক্ত থাকতে পারে।”
“উনি কে?”
“মেহার আপু… সাদ্দাম ভাইয়ার ভাবির কাজিন।”
“সানা!” নামটা উচ্চারণ করল শারফান অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে।
চমকাল রিহানও৷ সে-ই জিজ্ঞেস করল‚ “কী করেছিল মেহার আপু?”
মেলায় সেদিন সানার ভূমিকাটুকু জানাল জারা ধীরে ধীরে৷ মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত জারার বিধ্বস্ত মন সানাকেও দোষী ভেবে নিয়েছে৷ সানার বয়ে আনা হাসিবের চিরকুট‚ তারপর হাসিবকে প্রশংসায় ভাসানো—সব মিলিয়ে তার মনে হয়েছে‚ সানা ওদের দেখা করানোর পেছনে সেদিন ইচ্ছে করেই জড়িয়েছিল।
হাসিবের প্রতি রাগ হওয়ায় তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাটা ওর চলে গিয়েছিল শুরুতে৷ কিন্তু সানা এসে হাসিবকে ওর কাছে তুলে ধরল অন্তর্মুখী এক সরল ছেলে রূপে। সেই বিশ্বাস থেকেই কিনা দ্বিতীয়বার আগ্রহী হয়েছিল দেখা করতে! অথচ বাস্তবে প্রকাশ পেল হাসিবের এক ভয়ংকর‚ বিকৃত রূপ।
জারার প্রতিটি বাক্য শোনার পর রিহান‚ শারফান‚ দুজনের কাছেই সানা পরিণত হলো ঠান্ডা মাথার কুচক্রী হিসেবে। কেননা সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই স্রেফ কাকতালীয়ভাবে জড়িয়ে যেতে পারে সে‚ তা বিশ্বাসযোগ্য হলো না ওদের কারো কাছেই। জারা যেহেতু রেগে ছিল হাসিবের প্রতি‚ তাহলে কেন সে চিরকুট হাতে করে ভুল ভাঙাতে এল‚ যদি হাসিবের সঙ্গে জড়িত না-ই থাকবে?
শারফানের মস্তিষ্কে নাড়া দিল পুরোনো ঘটনাটাও৷ ওর মৃত্যুর ফাঁদ সম্পর্কেও অবগত ছিল সানা। সে চেয়েছিল ওর মৃত্যু। তাই তো ফারনাজ নির্বাচনের হারার ক্ষোভ আর ভালোবাসার মানুষকে জোরপূর্বক ছোঁয়ার রাগ‚ দুইয়ে মিলিয়েই প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হলো। সেটা নিশ্চয়ই সহ্য হয়নি সানার! তাই সহজেই রাজি হয়ে গেল ওর বোনের ক্ষতি করতে? না‚ কারণ কেবল এটাই হতে পারে না৷ তবে আর কী কারণ? ভাবতে ভাবতে অতীতের ঘটনাগুলোর মধ্যে থেকে দুটো ঘটনাকে গুরুত্ব দিল শারফান—ফারনাজের সঙ্গে ওর প্রথম লড়াইয়ের দিন আর ফারনাজকে দেউলিয়া বানানোর দিনটাই সানার ফোনকল। সানার প্রতিক্রিয়াগুলো স্মরণ করল তারপর৷ এরপরই পেয়ে গেল গোপন সূত্র—সেও তবে ভালোবাসে ফারনাজকে!
“আরে তাই তো”‚ অবাক হওয়া মনটা বলে উঠল শারফানের‚ “আর এজন্যই তো আমার নামে অভিযোগটা ও ফারনাজকেই করেছিল। আর কাউকে নয়। ভালোবাসে বলেই না প্রেমিকের ধ্বংস সহ্য হয়নি ওর। এই তবে ওর প্রধান কারণ আমার বোনের সর্বনাশ করার জন্য!”
আত্মঘাতী কষ্টের ভার বইতে না পেরে হঠাৎ জ্ঞান হারাল জারা। ভাইয়ের বুকেই হেলে পড়ল। শারফান কোলে তুলে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই রিহান জলদি জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল ওর৷ কিছুক্ষণের মাঝেই চোখজোড়াও মেলল জারা। তারপরই শারফান চলে এল নিজের ঘরে৷ ব্যালকনিতে এসে কিছু ভাবনাচিন্তায় ডুবল। এই প্রথম কোনো নারীকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগল ওর মনে৷ পুলিশের মাধ্যমে যার সাজা ওকে তৃপ্ত করবে না। কিন্তু গতকালের মতো মাথা গরম করেও শিকার হাতছাড়া করতে চায় না সে দ্বিতীয়বার। কল লাগাল সেন্টুকে৷ ছেলেটার কেয়ারটেকারের চাকরিটা সে কেড়ে নিলেও শাফিউল সাহেব আবার তাকে নিযুক্ত করেছেন। তবে শারফানকে এখন আজরাইলের মতো ভয় পায় ছেলেটা। সে রিসিভ করতেই শারফান সরাসরি নির্দেশ করল তাকে‚ “সানা যখনই বাসা থেকে বের হবে‚ তোর কাজ এক সেকেন্ড দেরি না করে আমাকে কল করে জানানো। বোঝা গেছে?”
মেহাকে সেন্টু পছন্দ করে বিধায় সে এমনিতেও দিনের অধিকাংশ ভাগ মোস্তফা সাহেবের বাড়িতে নজর রাখে। তাই সে চট করেই জানাল‚ “সানা আপা তো বাড়ি নাই‚ ভাই৷ ঢাকা গ্যাছে কাইলকে।”
“ঢাকা? ঢাকা গেছে কেন?”
“বেড়াবার মনে হয়। সানা আপার দাদীর মুখি শুনছিলাম।”
বিনা বাক্যেই ফোনটা কেটে দিল শারফান। একে তো ফারনাজ গা ঢাকা দিয়েছে৷ সেই সাতসকালে গাড়ি নিয়ে বের হলে ওকে নজরে রাখা লোকটি হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেলে ওর গাড়িটা৷ উপরন্তু সানারও ঢাকায় গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকার কথা শুনে মুখ থেকে বিচ্ছিরি দুটো গালি বেরিয়ে এল শারফানের। ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই কল করল এবার সাদ্দামকে। সাদ্দামসহ ওর প্রায় সকল ঘনিষ্ঠ বন্ধুই রাত থেকে নির্ঘুম৷ ভিডিয়োগুলো তারা নিজ দায়িত্বেই খুঁজে খুঁজে রিপোর্ট করে চলেছে। এখনো সাদ্দাম সে কাজেই ব্যস্ত৷ তাই ফোন ধরেই বলল‚ “হাজার হাজার আইডি‚ পেইজে যায় নাই মনে হয়‚ বুঝলি? রাতের মধ্যেই পেয়ে গেছিলাম তো। তারপর থেকে রিপোর্ট মারা শুরু করছি৷ ইনশা আল্লাহ সব ডিলিট হবে৷ টেনশন নিস না।”
কৃতজ্ঞতায় কতক পল বাকরুদ্ধ হয়ে রইল শারফান। মনে মনেই শ্রদ্ধা জানাল সে বন্ধুকে। মুখে ফুটে কেবল রাগটুকু ছাড়া স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করা আর কারও কাছে ক্ষমা চাইবার মতো ক্ষমতা ও যোগ্যতা ওর নেই৷ “ঠিক আছে”‚ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সাদ্দামকে‚ “আরেকটা কাজ করে দে আমাকে৷ এখনই।”
“কী কাজ‚ ক?”
“তোর ভাবির কাছ থেকে সানার খোঁজ বের কর। ও ঢাকা কোথায় আছে সেটা।”
“সানাকে দিয়ে কী করবি এখন?” অবাক কণ্ঠ সাদ্দামের।
“দরকার আছে। আগে খোঁজটা নে।”
বুঝতে পারল সাদ্দাম‚ অকারণে বন্ধু এমন সময়ে সানার খোঁজ নেবে না। কিন্তু বলল‚ “হুট করেই ওর খবর জিজ্ঞেস করলে কেমন দেখায় না?”
বিরক্ত হলো শারফান। “দেখালে দেখাক”‚ ধমকে উঠল বন্ধুকে। “আর জিজ্ঞেস করারও বহু উপায় আছে৷ যেভাবে জিজ্ঞেস করলে কেমন দেখাবে না সেভাবে জিজ্ঞেস করবি৷ এই বালও কি শিখিয়ে দেওয়া লাগবে? দশ মিনিটের মেসেজে জানাবি৷ রাখছি।”
দশ মিনিট নয়‚ বিশ মিনিট পর সাদ্দামের মেসেজ এল। সানার মামা বাড়ির ঠিকানা—বাড়ি নং: ১২৭/এ‚ রোড নং: ৫‚ মালিবাগ চৌধুরীপাড়া‚ রামপুরা‚ ঢাকা-১২১৯ ।
“কান টানলেই মাথা আসবে”‚ ঠিকানাটা দেখতে দেখতে সানার উদ্দেশ্যে আপন মনেই বিড়বিড়াল শারফান‚ “তোমার থেকে ফারনাজ‚ ফারনাজের থেকে হাসিবসহ সবকটা ক্রিমিনাল। প্রত্যেককে আজরাইল দর্শন করাব—কসম!”
চলবে।