#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#শেষ_যাত্রা
৫৪.
রাত ১০: ০৭
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর সানা খাবার টেবিলে এল। হঠাৎ করে বৃষ্টিতে ভেজায় ঠান্ডা লেগে গেছে তার। জ্বরটাও আসি আসি করছে। তবে খেতে আসতে না চাওয়ার প্রধান কারণ হলো বাবা।
মোস্তফা সাহেব বাড়ি ফিরেছেন পর থেকে কেমন একটা গম্ভীর বনে আছেন। মেয়ে যে শাফিউল সাহেবের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরল‚ এ নিয়ে একটা কথা বা প্রশ্ন অবধি করেননি মেয়েকে। এমনকি এও জানতে চাননি মেয়ের পরীক্ষা কেমন হলো। বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা তিনি এখনো জানেন কিনা সেটাই বুঝতে পারছে না সানা। বাবার এমন ভাবভঙ্গি দেখেই বোধ হয় ভয়ে ওর জ্বরটা আসতে চাইছে। বাবার সামনে বসে খাওয়ার সাহসটুকুও হলো না ওর৷ টিভি দেখার বাহানায় প্লেট নিয়ে চলে গেল বসার ঘরটিতে৷ সঙ্গে গেল মেহাও। কারণ‚ বড়োবোন কোনো অপরাধ করলে বড়োবোনের সঙ্গে সব সময় তাকেও ছেঁচাটা খেতে হয় কেন যেন। আর বোনকে বকাঝকার সময় মা তো অপরিহার্যভাবে এ কথা বলবেনই ওকে‚ “আগের হাল যেদিকে যায় পিছের হালও সেদিকে যায়। তুইও কি আর ভালো হবি…”
খেতে খেতে নাজমা বেগম কিছুটা ভয় নিয়েই স্বামীকে জানালেন‚ শাফিউল সাহেব গাড়িতে করে সানাকে পৌঁছে দেওয়ার কথাটা। তা দেখে আবার পাশের বাড়ির দুয়েকজন পড়শীরা এসে জিজ্ঞাসা করেছিল নানান কথা—এও জানালেন। গাড়িতে শারফানের উপস্থিতিটা দেখতে পেয়েই কানাঘুঁষাটা শুরু হয়েছে পাড়া জুড়ে। সেটা আর অত খোলাখুলি বললেন না তিনি।
মোস্তফা সাহেব নির্বিকারভাবে সবটা শুনলেন। কোনো জিজ্ঞাসা বা কোনো কথাই বললেন না দেখে মনে মনে বেশ অবাক হলেন নাজমা বেগম। ফারনাজের পরিণতির জন্য‚ ভাইয়ের পরিবারের শোচনীয় অবস্থার জন্য যারা দায়ী‚ সেই তারা এসে মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন—ব্যাপারটা নিয়ে ভালো বা মন্দ‚ কিছু তো অন্তত প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা!
খাওয়াটা প্রায় শেষের পথে। ঠিক সে মুহূর্তে মুখ খুললেন মোস্তফা সাহেব‚ “ঢাকা থেকে যাদের আসার কথা ছিল‚ তারা আসবে না।”
“কেন?” চমকালেন বটে নাজমা বেগম। তিনি তো ভেবেছিলেন বিয়েটা এখানেই হয়ে যাবে৷ কারণ‚ ছবি দেখে তারা সানাকে খুব পছন্দ করেছিল। “কোনো সমস্যা? পরে আসবে বলেছে?”
“আগে‚ পরে‚ কখনোই আসবে না। কী হয়েছে জানি না৷”
“আলম কিছু জানে না?”
“ছেলে ফরিদপুর বিয়ে করবে না নাকি‚ সেটাই বলল আলম। খোঁড়া অজুহাত আরকি।”
মনটা মুহূর্তেই ভেঙে গেল নাজমা বেগমের৷ সম্বন্ধটা বেশ মনে ধরেছিল তার৷ বিষণ্ণ চেহারায় মুখে ভাতের লোকমা তুলতেই মোস্তফা সাহেব তাকে আরেক চমক দিলেন‚ “তিন-চারদিন আগে আরেকটা প্রস্তাব এসেছে।”
“তিন চারদিন আগে?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন নাজমা‚ “জানাওনি কেন আমাকে? আলমই আনল প্রস্তাব?”
“আরে নাহ। আবুল ভাই দিয়েছেন।”
“তোমার ওই প্রফেসর আবুল কালাম? ওনার ছেলের বউভাতের সময় যেটা দিয়েছিল সেটাই নাকি?”
“না”‚ সরাসরি বউয়ের দিকে চাইলেন এবার মোস্তফা সাহেব‚ “শাফিউল ভাইয়ের ছেলের জন্য ছিল। আবুল ভাইকে মধ্যস্থকারী করেছেন উনি। বেশ ভালোভাবেই ধরেছেন আবুল ভাইকে। আর আমাকে তো আজ সরাসরিই কল করেছিলেন৷ মনে হয় সানাকে পৌঁছে দিয়ে যাওয়ার পরই কল করেছিলেন। কথায় কথায় ইনডিরেক্টলি প্রস্তাবের কথাটা স্মরণ করালেন।”
একদম অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনে নাজমা ভাষা হারালেন যেন। ভাতের প্লেটে থাকা হাতটা থেমে গেল তার৷ চেয়ে রইলেন কৌতুহল চোখে স্বামীর মন্তব্য জানার আশায়।
একটু সময় চুপ থাকলেন মোস্তফা সাহেব‚ যেন কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন‚ “আবুল ভাইয়ের থেকে শুনে সেদিন থেকেই চিন্তাই পড়েছি।”
সানার মতোই আজ তিনিও দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে। সৈয়দ কবির তার আপন ভাই‚ ফারনাজ তার নিজের ভাতিজা। শাফিউল সাহেবের সঙ্গে যদি আত্মীয়তা হয়‚ তবে কি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো থাকবে? যদিও ফারনাজের অপকর্মের সবটা জানার পর থেকে তার মন থেকেই বেরিয়ে গেছে ছেলেটা৷ একটাদিনও তিনি যাননি জেলে‚ ফারনাজকে দেখতে। কেবল দায়িত্ববোধ থেকে ভাইয়ের বাড়িতে ফোন করেন‚ তাদের খোঁজ খবর জানার জন্য৷ এর মাঝে ফারিয়ার সংসারটাও ভাঙনের পথে! তার ব্যাভিচারের ঘটনা সাকিব জেনে ফেলেছিল বাচ্চাটা গর্ভপাত করে আসার পরই। সেদিনই বাসা থেকে বের করে দিয়েছে সে ফারিয়াকে৷ বাবার বাড়িতে এসে পড়ে আছে মেয়েটা অনেকগুলো দিন হলো৷
স্বামীর মুখপানে চেয়ে নাজমা বেগম আন্দাজ করতে পারলেন তার ভেতরের চলমান সংঘাতটা৷ এখানে একজন ভাইয়ের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সত্যিই জটিল৷ কিন্তু সেই ভাইয়ের বউয়ের জন্য নিশ্চয়ই জটিল নয়? কারণ তিনি কেবল নিজের মেয়ের ভালো কিসে‚ সেটাই বিবেচনা করবেন। কেননা যে পরিবার থেকে তিনি‚ তার স্বামী‚ তার মেয়েরা অপমান ছাড়া কখনো সম্মান পাননি‚ কদর পাননি… সেই পরিবারের কথা ভেবে কেন মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবেন?
মোস্তফা সাহেবকে বলে উঠলেন‚ “ছেলে কেমন কী? শীতের মধ্যে বাড়িতে এল যেদিন‚ দেখতে টেখতে তো মন্দ লাগল না৷ বেশ ভালোই লেগেছিল। কথাবার্তাও ভালোই মনে হয়েছিল৷”
প্রস্তাবটা নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকলেও শারফানের প্রতি কিসের এক টান থেকেই যেন ওর ব্যাপারে ইতোমধ্যে খোঁজ নিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। এলাকার মানুষজন থেকে শুরু করে মসজিদের মুসল্লীদের কাছ থেকেও ওর স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপারে তথ্য নিয়েছেন তিনি৷ খুব একটা খারাপ কিছু বলেনি কেউ-ই৷ কারণ‚ শারফান বাড়িতে থেকেছেই যে কিশোর বয়স অবধি৷ এখন ওকে যতটুকু দেখে সবাই বিচার করেছে তার ওপরই সবার কথাবার্তা ছিল৷ সিগারেট খেতে দেখা‚ পাড়ার চায়ের দোকানে মাঝেমধ্যে বসে আড্ডা দেওয়া‚ প্রতিনিয়ত গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করা‚ কখনো অনেক রাত করে ওর বাড়ি ফেরার কথা‚ কেবল জুমাবারে নামাজ পড়া… এমন খুঁটিনাটি অনেক খোঁজই বের করেছেন মোস্তফা সাহেব৷ তবে সব থেকে চমকপ্রদ যে তথ্যটা পেয়েছেন তিনি‚ এই ছেলে যাকাত আদায়ে কখনো কার্পণ্য করে না না-কি! কোনো রমজানে নিজ হাতেই যাকাত আদায় করে‚ তো কোনোবার বাবার হাত দিয়ে৷ আবার বাবার সঙ্গে শামিল হয়ে প্রতিবারই রোজাদার‚ বা এতিম শিশুদের ইফতারও করিয়ে থাকে!
ওদিকে‚ ঢাকায় শারফানের অফিসেও খোঁজ নিয়েছেন সানার মামা। অফিসের দারোয়ান আর পিয়োনের মুখ থেকে কথা বের করতে কিছু টাকা খরচাও করতে হয়েছে তাকে। তবে সেখান থেকেও খুব একটা অসন্তোষজনক খবর মেলেনি৷ কেবল জানা গেছে‚ ছেলেটা বেশ মাথাগরম স্বভাবের৷ বাদবাকি ওর আচরণ সবার সঙ্গে বেশ ভালো আর খোলামেলা। শুধু ওর বাসার ওদিকটা থেকেই খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি এখনো৷ সেটাও চেষ্টা করছেন সানার মামা।
সব কিছু মিলিয়ে শারফানের প্রতি মোস্তফা সাহেবের মনোভাব ইতিবাচকই। আর ইতিবাচক হবে নাইবা কেন? ওর ক্লাবে যাওয়া‚ বারে মদ খাওয়া‚ মারামারি করা‚ এসব মামলা যখন যেখানে হয়‚ তখন সে মামলা সেখানেই সে দাফন করে আসে যে৷ তাই মোস্তফা সাহেবের মতো কোনো পাত্রীপক্ষই হয়ত কোনোদিনই জানতে পারবে না ওর ফেলে আসা এই অতীতের কথা।
তবে এ বাদেও শারফানের একটি কাজ মোস্তফা সাহেবের হৃদয়ে দাগ কেটেছে খুব। বোনের অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ওর কাজটা যথেষ্ট হঠকারী আর বোকামি সিদ্ধান্ত হলেও‚ ওই কাজের মাধ্যমেই ওর চরিত্রের একটি দিক তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। পরিবারের জন্য নিজেকে কতখানি উৎসর্গ করতে পারে শারফান‚ সেটারই উদারহরণ তৈরি করেছে সে ওই ঘটনা দ্বারা। আর যেটা কোনো সাধারণ ঘটনাও নয়৷ জীবন বাজি রাখার মতো সিদ্ধান্তে নেমেছিল ছেলেটা৷ ওকে দেখে নিশ্চয়ই প্রতিটি বাবা-মা আর বোনেরা ওর মতোই একজন সন্তান‚ একজন বড়ো ভাই আশা করে! কারণ‚ সেদিন তো ছেলেটা শুধু নিজের বোনের কষ্টেরই প্রতিশোধ নেয়নি… কতগুলো মেয়ে সেদিন মায়ের বুকে ফিরে যেতে পেরেছিল ওর ওই দুঃসাহসিক পদক্ষেপটার জন্যই। সেই ছেলের প্রতি কি শ্রদ্ধা না এসে থাকে কারও? মুগ্ধ হয়েছিলেন তাই মোস্তফা সাহেবও। আর একইসাথে ফারনাজের জন্যও মনটা প্রচুর হতাশা আর আফসোসে জ্বলেপুড়েও গিয়েছিল তার। নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন কিনা! চেয়েছিলেন নিজের আদর্শে তাকে উজ্জীবীত করতে। সেই ছেলের কিনা এমন অধঃপতন! ফারনাজকে নিয়ে তার এই কষ্টটা মনে থেকে যাবে আজীবনই।
বউয়ের জবাবে তিনি বললেন‚ “ভালো ছেলে। শাফিউল ভাইও খুব ভালো মানুষ। কিন্তু অত বড়োলোক ঘরে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা কখনো ভেবেছি? তাদের থেকে প্রস্তাব এসেছে‚ সেটাই তো কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।”
“বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা রাখো৷ এখন কী চাও সেটা বলো”‚ খুব গম্ভীর গলায় বললেন নাজমা বেগম‚ “মেয়েকে নিয়ে পাড়ায় যা বলাবলি করে সবাই‚ তাতে এমন একটা ঘরে মেয়ে বিয়ে দিলে সবার মুখ যেমন বন্ধ হবে‚ তেমন কড়া জবাবও পাবে তারা নিজে থেকেই। আমার কাছে সব থেকে বড়ো বিষয় হলো ঢাকা‚ চট্টগ্রাম‚ সিলেট পাঠানোর বদলে আমার মেয়ে আমার হাতের কাছেই থাকবে৷ মন চাইলে যখন খুশি তখন গিয়ে এক নজর দেখে আসতেও পারব… খোঁজ নিতে পারব৷ কতটা চিন্তামুক্ত থাকব এখানে বিয়েটা হলে‚ ভাবো! ছেলে ভালো হলে‚ পরিবার ভালো হলে আমি আর এখানে ভাবার মতো কিছু দেখি না। তোমার ভাই কী ভাববে… তারা কী বলবে‚ অন্যরা কী বলবে‚ সেসব দেখে তো আমার মেয়ের জীবন চলবে না৷ আমি আমার মেয়ের ভালো যেখানে পাবো‚ সেখানেই তো যাব৷ শাফিউল ভাই যদি না ভাবেন‚ যাদের জন্য তার মেয়ের ক্ষতি হলো‚ সেই গোষ্ঠীর মেয়ে আমি নেব না… তাহলে আমরা কেন ভাবব? আর তাছাড়া এই অছিলাতে কবির ভাই কিন্তু ফারনাজের জন্য শাফিউল ভাইয়ের সাথে একবার কথা বলার সুযোগও পেতে পারে। হাতে-পায়ে ধরে হলেও যদি মাফ আদায় করতে পারে‚ সেই চেষ্টাই করতে বোলো কবির ভাইকে।”
“ও যা করেছে…” ফারনাজের কথা মনে করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মোস্তফা সাহেব। বললেন‚ “তা কি মাফ পাওয়ার যোগ্য?”
“না‚ আমাদের মেয়ের সাথে এমন হলে আমরাও পারতাম না মাফ করতে। কিন্তু খারাপটা লাগে তোমার ভাইয়ের জন্য। শরীর বলতে তো আর কিচ্ছু নেই৷ কখন যেন খারাপ একটা সংবাদ শুনতে হবে৷ সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে একদম। এক সময় কী বড়োলোকি চালে চলেছে তারা! আর এখন তাদের সংসার চালানোর মতোই পরিস্থিতি নেই৷ এক ফারনাজ ছাড়া এই পরিবারের হাল ধরার মতো কেউ আছে? কবির ভাইয়ের কিছু একটা হয়ে গেলে তোমার ভাবি‚ তোমার ভাতিজিরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ভালো একটা ঘরে নিশার বিয়ে দেওয়ার মতোও কেউ থাকবে না। আর ফারিয়ার কথা কী বলব! কী আছে ওদের কপালে আল্লাহই জানেন!”
এঁটো হাতটা ধুয়ে নিয়ে মোস্তফা সাহেব সোজা হয়ে বসলেন। বউয়ের কাছে সঠিক পরামর্শের জন্য জিজ্ঞেস করলেন‚ “এগোব না-কি তাহলে? মেজো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখব একবার?”
সরাসরি বারণ করলেন নাজমা বেগম‚ “না। ভালো সম্পর্ক থাকলেও কার মনে কতটুকু হিংসা আছে তা বলা যায় না। ওয়াজিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছ না? ভাই কী বলে?”
“তোমার মতোই বলল যে‚ ফরিদপুরের ভেতর হলে সেখানেই ভাবতে। ছেলে‚ পরিবার‚ সব যদি ভালো হয়। ছেলেকে দেখে পছন্দ হয়েছে তারও…”
“বাবাহ্…”‚ ফোঁরন কাটলেন নাজমা বেগম‚ “আমার কাছে আগে কিছু না বলে আমার ভাইয়ের সাথে আগে আলোচনা করেছ!”
খোঁচাটা খেয়ে কোনো প্রত্যুক্তি করলেন না মোস্তফা সাহেব৷ কথা বাড়ার আগেই তিনি শারফানকে নিয়ে আলোচনায় ফিরলেন৷
সেসবের সবটাই সানা আর মেহা বসার ঘরে বসেই শুনতে পাচ্ছে। শারফানকে নিয়ে টুকটাক ভালো মন্তব্যই চলছে তাদের মাঝে। কিন্তু সানা একদম স্থির হয়ে গেছে শারফানের সঙ্গে নিজের ‘বিয়ে’ শব্দটা জুড়তেই। যাকে ঘিরে ভালো লাগা আর খারাপ লাগা দ্বন্দটাই আজ অবধি ঠিকঠাক কাটিয়ে উঠতে পারল না‚ সেই তার নামেই নিজেকে লিখে দিতে হবে?
মেহা একগাদা কী যেন বকাঝকা করে চলেছে শারফানের নামে। কাছে বসেও তার কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছে না সানা।
হঠাৎ কিছুক্ষণ পরই নাজমা বেগমের আগমন ঘটল বসার ঘরে। সানার কোলের ওপর রাখা প্লেটটা দেখে ধমকে উঠলেন‚ “না খেয়ে টিভি গিলছিস শুধু? ভাত‚ তরকারি সবই তো প্লেটে ধরা।”
মায়ের ধমকেই চিন্তার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরল সানা৷ এক লোকমা ভাত মুখে তুলল ঝটপট। তখন কী ভেবে যেন নাজমা এসে বসলেন ওর পাশে৷ টিভি দেখার কপটতা দেখিয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলেন‚ “শাফিউল হকের ছেলেকে কেমন লাগে রে?”
ভাতটা গলা থেকে নামাল সানা বহু কষ্টে। বুকের ধড়ফড়ানি নিয়ে সে জবাব দিল‚ “তেমন কিছুই লাগে না।”
মনে মনে খুশি হলো মেহা বোনের জবাবে। কিন্তু তারপরই মায়ের গুরুগম্ভীর কথাটা শুনে থেমে গেল ওর খাওয়াও।
“মেজরের থেকেও তো ভালো দেখতে। তেমন কিছুই লাগে না বলছিস তাও? তোর আব্বুর তো বেশ পছন্দ। আমার ভালোই লাগে। ওই ছেলের জন্য তোর প্রস্তাব আসছে কদিন আগে। ওখানেই কথাবার্তা বলা হবে তাই। পরশুদিন তো মেজর ছেলেটার আসার কথা ছিল। ভাবছি‚ সেদিনই আসতে বলব ওনাদের।”
“আম্মু‚ তোমরা পুরোপুরি রাজি হয়ে গেলে?” বিস্মিত চেহারায় মেহা ফট করেই জিজ্ঞেস করে বসল।
কিন্তু ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নাজমা বেগম সানার দিকে চাইলেন। ওর স্তম্ভিত মুখভঙ্গি দেখে একটু চিন্তায় পড়লেন। বললেন‚ “তুই কী বলিস‚ সানা? এখনই জানা। তোর আব্বু কথা বলতে পাঠাল আমাকে। কাল ফোন করতে চাইছে ওনাদের।”
মানসিক দোটানা থেকে সানা জবাবটা রাখল‚ “আম্মু‚ মাত্রই তো পরীক্ষাটা শেষ হলো৷ আমি একটা মাস ফ্রি সময় কাটাই… বিয়ের জন্য মনটাকে ভালোভাবে প্রস্তুত করি‚ তারপর না হয় এসবের চিন্তাভাবনা কোরো।”
“ঠিক আছে‚ মাসখানিক পরেই না হয় সব কিছু হবে। কিন্তু এই প্রস্তাবটা নিয়ে তোর কোনো সমস্যা আছে কি নেই‚ সেটা আমাদের পরিষ্কার করে বল। তাই বুঝে আমরাও ভাবনাচিন্তা করব।”
না… ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে খুব একটা ভালোভাবে কথা বলতে জানে না সানা। তা বুঝতে পেরে মনে মনে খুব অসহায় বোধ করল সে। নিজের প্রতি বিরক্তও হলো খুব। অত ভাবাভাবি বন্ধ করে বলে দিল‚ “আমি ফরিদপুরের ভেতর বিয়ে করতে চাই না।”
কথাটা বলে আর বসল না সে৷ এরপর আরও বেশি কথা বাড়ালে দেখা গেল‚ ওকে সন্দেহ করতে শুরু করবে মা। কিন্তু নাজমা বেগম সন্দিগ্ধ হওয়ার বদলে হলেন খুব বেশি নারাজ। কারণ‚ তিনি বিশ্বাস করেন এমন সুন্দর সম্বন্ধ আর দ্বিতীয়টি আসবে না মেয়ের জন্য। আর যা আসবে‚ তা ওই দূর দূর থেকেই আসবে হয়ত। কিন্তু মেয়েকে জোরাজুরি করার কথাও তিনি ভাবতে পারলেন না। কী যেন চিন্তা করতে করতে চলে গেলেন স্বামীর কাছে।
***
২৫ জুন
সকাল ৯: ৩০
চার‚ পাঁচটা চড়ুইয়ের ঝগড়াঝাঁটি চলছে বারান্দায়৷ আর সেটা দর্শক হয়ে উপভোগ করছে ডাল বেঁয়ে গ্রিলের কাছে এসে উঁকি দেওয়া কাঠবিড়ালি। সে আসলে অপেক্ষায় আছে কখন ঝগড়ুটে চড়ুইগুলো ঝগড়া থামিয়ে বিদায় নেবে আর কখন গিয়ে সে বারান্দার মেঝেতে পড়ে থাকা বাদামগুলো খাবে!
এই দুর্দান্ত মুহূর্তটা দেখার সময় কি আছে শারফানের? সে বেছে বেছে সব ভালো জামাকাপড়গুলো ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত। এর মাঝেই চেঁচামেচি করতে করতে ঘরে এলেন শাফিউল হক। পিছু আছেন জেসমিন বেগমও। ওকে সাহেব বাবুটি সেজেগুজে ব্যাগ গোছাতে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন শাফিউল সাহেব৷ বউয়ের মুখে এতক্ষণ শুনছিলেন ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে নাকি! একটুও বিশ্বাস করেননি তা। অধিকন্তু রেগে ছিলেন ছেলের ওপর‚ যে সে কার কাছে অনুমতি নিয়ে তার ভাড়াটেকে উলটো-পালটা কথা শুনিয়েছে ফোনে! তাদেরকে বাধ্য করেছে দোতলা থেকে চারতলায় উঠতে! এ নিয়েই চোটপাট করতে করতে এলেন। কিন্তু এসে এই দৃশ্য দেখে তিনি ভুলে গেলেন সেসব কথা৷ শারফানের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন‚ “এসব কী করছিস? যাচ্ছিস কোথায় তুই? অফিস টফিস শুরু করবি না‚ না-কি?”
“দেরি আছে অফিসে বসা”‚ হাতের কাজ চালাতে চালাতে শারফান বলল‚ “তুমি তো ভালোই দেখছ আমার কোম্পানিটাও। গুড জব৷ চালিয়ে যাও।”
ছেলের তেল মর্দনে কানের নিচে একটা থাবড়া দেওয়ার ইচ্ছাটা দমন করে নিরেন শাফিউল সাহেব৷ জোর গলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন‚ “কোথায় যাবি তুই? এত জামা-কাপড় নিচ্ছিস কেন?”
গোছানো শেষ শারফানের। লম্বা করে দম ছেড়ে বাবার দিকে তাকাল এবার‚ তারপর মায়ের কান্না কান্না ভাব চেহারাটার দিকে। দেখা শেষে একদম আকাশ থেকে পড়ার মতো একটা ভান ধরল যেন‚ “কী হয়েছে তোমাদের?”
জবাবে তারা চুপচাপ গম্ভীর হয়ে চেয়ে রইলেন। শারফান তখন বলল‚ “এত হাইপার কেন তোমরা? আমি কি দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না-কি? তোমাদের বাড়িতে গিয়েই তো থাকব। চাইলে তোমরাও আসতে পারো যখন তখন। কিন্তু পার্মানেন্টলি না৷ দিনে যাবে‚ দিনেই ফিরবে।”
কপালে ভাঁজ পড়ল শাফিউল সাহেবের। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন—ঠিক কী বোঝাল শারফান‚ তা বোঝার জন্য৷ তবে বুঝতে আর সময় লাগল না। অবাক হয়ে বলে উঠলেন‚ “তুই কি নিজে থাকার জন্য দোতলা ফাঁকা করেছিস?”
“হ্যাঁ”‚ শ্রাগ করে বলল শারফান‚ “নয়তো কী জন্য ভাড়াটে তাড়ালাম!”
“হঠাৎ ওই বাড়ি গিয়ে তোর থাকা লাগবে কেন?” কান্নার ভঙ্গিমা ছেড়ে এবার রেগেমেগে বললেন জেসমিন বেগম‚ “লোকে কী ভাববে‚ হ্যাঁ? ভাববে‚ আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করে তুই ওখানে গিয়ে থাকছিস।”
“ভাবুক। আমার কী তাতে?” গা ছাড়া ভাব নিয়ে কথাটা বলেই শাফিউল সাহেবকে ঠান্ডাভাবে জানাল সে‚ “যাচ্ছি অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমার কাজ যেদিন শেষ হবে‚ সেদিনের পর থেকে আমি অফিস শুরু করব। এর মাঝে আমাকে কোনো বিরক্ত করবে না কেউ।”
জবাবে শাফিউল সাহেব পুরোপুরি নির্বাক৷ কী আর বলবেন তিনি? প্রথমবার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেন কোথাও। সেখান থেকে একরকম প্রত্যাখ্যাতই হলো ছেলেটা৷ ব্যাপারটা তিনিই মানতে পারছেন না৷ ছেলে কি আর মানবে? যদিও তিনি বোঝেন‚ ‘না’ শব্দটা বলার সম্পূর্ণ হক আছে সানার৷ এজন্যই আর বেশি কিছু বলেননি মোস্তফা সাহেবকে। কিন্তু তিনি বুঝলেও তার এই জন্মগত বেপরোয়া‚ ত্যাঁদড় স্বভাবের ছেলে যে বুঝতে চাইবে না—এ তো জানাই ছিল!
স্বামী একটি কথাও বললেন না দেখে জেসমিন বেগম চেঁচামেচি শুরু করলেন‚ “কী এমন কাজ‚ হ্যাঁ? যে ভাড়া দেওয়া বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে? এত পাগলামি কিন্তু সহ্য হবে না‚ শায়াফ…”
চলতেই থাকল মায়ের চেঁচামেচি। তার মাঝেই শারফান বিদায় নিল বাসা থেকে। তবে যাওয়ার আগে মাকে সে বলে গেল‚ “রাগ টাগ বাদ দিয়ে দোয়া কোরো যেন যে কাজে যাচ্ছি সে কাজে সফল হই৷ তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা হবে।”
***
বিকাল ৫: ৪৫
পশ্চিমের আকাশে যেন আগুন লেগেছে। লাল-কমলা রঙা মেঘেরা হুটোপুটি খায় সেখানে। চারদিকে হালকা বাতাস… বাতাসে গাছের পাতারা দুলে দুলে গাইছে যেন সময়ের গান। বিকালের এই শান্ত আর উচ্ছ্বাস মিশ্র মুহূর্তে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষগুলোও যেন এক হয়ে গেছে। পাড়ার বাচ্চারা মসজিদের মাঠে জমে উঠেছে ক্রিকেট খেলায়—তাদের ছোটাছুটি আর কোলাহলে পুরো এলাকাটাই প্রাণবন্ত থাকে।
এদিকে‚ খোলা ছাদের মাঝখানটাই বসে গল্প করছিল সানা আর মেহা৷ গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ওরা দেখছিল সেই কাঠবিড়ালিটাকে‚ যেটা একদম ছোট্ট থাকতে পোষ মানিয়েছিল সানা। ছুটে বেড়াচ্ছে সে ছাদের আশেপাশের গাছগাছালির ডালপালা ধরে। ওকে অনেক আগেই মুক্ত দিয়েছে সানা৷ কিন্তু তার সঙ্গে এক সময়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এখনো তাকে ভুলতে পারেনি কাঠবিড়ালিটা। তার আরও একটি কারণ‚ সানা এখনো নিয়মিত ওকে বাদাম‚ ভুট্টা আর ফল খেতে দেয় কখনো ছাদের রেলিঙে… কখনো ছাদের মেঝেতে৷ এইতো একটু আগেই গাল ভরে কতগুলো বাদাম নিয়ে সে ছুট দিয়েছে।
হঠাৎ সানা উঠে পড়ল হাতে আরও কয়েকটা বাদাম নিয়ে। এল দুই দালানের মাঝে থাকা মেহগনি গাছটার কাছে। হাতটা বাড়িয়ে রেখে জিভ আর দাঁতের ফাঁকে চিক চিক শব্দ তৈরি করে ডাকল কাঠবিড়ালিটাকে‚ “হ্যাজেল‚ আয় আয়… এদিয়ে আয়‚ দ্যাখ বাদাম।”
হ্যাজেল মেহগনি গাছের ওপরের ডালে বসে ছিল। সানার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ওর হাতে বাদাম। লোভে পড়ে এক দৌড়ে চলে এল ওর কাছে। হাতের ওপর থেকে খপ করে ধরে একটা একটা নিয়ে মুখে পুরতে লাগল। ঠিক তখনই সামনের দালানের দোতলার ব্যালকনি থেকে ভেসে এল‚ “আমি তো ভাবলাম আমাকে ডাকছ৷ ছুটে এলাম তাই৷ আমাকেও দেবে নাকি কটা বাদাম?”
গোল গোল চোখদুটো তুলে সানা সামনে তাকাতেই চমকে উঠে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে ফেলল‚ “আপনি…! আপনি এখানে কী করেন?”
মুখে নির্বিকার অভিব্যক্তি শারফানের। “ফার্নিচার সেট করে একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। এর মাঝে তুমি আবার টক্ টক্ শব্দ করে হ্যাজেল বলে ডাকলে। আমিও তো হ্যাজেল কালারই”‚ কথাটা বলেই হাসল সে‚ “ভাবলাম আমাকেই ডাকছ… তাই বিছানা ছেড়ে তোমার ডাকে সাড়া দিতে এলাম।”
কণ্ঠটা শুনেই মেহাও চলে এল এদিকটাতে। আর ওকে দেখা মাত্রই প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে‚ “ওমা… এই সন্ত্রাস ব্যাটা শিফা আপুদের বাসায় ক্যান?”
‘সন্ত্রাস’ কথাটা শোনা মাত্রই শারফানের হাসিটা উধাও হয়ে গেল। তবে মেজাজ খারাপ হলেও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না…গুরুত্বই দিল না মেহাকে। সানার দিকে ফিরেই ভ্রুজোড়া নাচাল‚ “আরে তোমার ছোটো হ্যাজেল তো পালিয়ে গেল। তা বড়ো হ্যাজেলকে দেবে না-কি কয়টা বাদাম?” বলেই হাতটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে দিল।
হঠাৎ নিচ থেকে তখনই মেহাকে ডেকে উঠলেন নাজমা বেগম। জানালেন‚ ওর প্রাইভেট টিউটর চলে এসেছে। তা শুনতে পেল শারফানও৷
মেহা বিস্ময়টুকু আপাতত দমিয়ে সানাকে টানল‚ “আপু‚ চল… ঘরে চল।”
তা দেখেই শারফান ওকে বলে উঠল‚ “কী‚ টিঙ্কারবেল? আপুকে রেখে যেত ভয় পাচ্ছ না-কি? আমাকে দেখে এত ভয় কেন তোমাদের? ডু আই নট অপিয়ার চার্মিং?”
ভ্রু‚ চোখ কুঁচকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে শারফানকে আপাদমস্তক দেখল যেন মেহা‚ “অ্যাঁহ্… কিসের চার্মিং আপনি! কেঁচো একটা!” তারপরই সে বলতে চাইল‚ তার বোনের থেকে যেন একদম দূরে থাকে! কিন্তু এমন হুমকি বাণীটা দেওয়ার আগেই মায়ের ডাক পড়ল আবার। বোনের হাত টেনে ধরে বলল তখন‚ “চল তো‚ আপু। সন্ধ্যা হয়েও যাচ্ছে।”
এদিকে ‘কেঁচো’ সম্বোধনটা শুনেই নাক কুঁচকে ফেলল শারফান। মেহাকে কঠিন একটা ধমক দিতে পারল না বিধায় বক্রোক্তি করল আবারও‚ “সন্ধ্যা হয়েছে তো কী? অন্ধকার হয়ে গেলে চোখে দেখে না ও? রাতকানা তোমার বোন?”
এবার রেগে গেল সানা। ধমকে উঠল মুহূর্তেই‚ “আপনি রাতকানা! বেয়াদব ব্যাটা কোথাকার!”
ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হাসল শারফান‚ “তাহলে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে কেন তোমার বোন? নাকি তোমার বোনই রাতকানা?”
“উলটো-পালটা কথা বললেই ইট ছুড়ে একদম চোখ কানা করে দেব।”
“অ্যাই‚ তুমি আমার চোখের পিছে পড়লে কেন হঠাৎ?” ভীষণ গম্ভীর চেহারা করে শারফান বলল‚ “শরীরে আমার শুধু এটাই সলিড আছে। তাছাড়া সবখানেই ছুরি‚ কাঁচি চালিয়ে জোড়াতালি লাগানো। তাই চোখটার ওপর অন্তত জুলুম কোরো না‚ মাই নাটি লাভ।”
“অ্যাই ব্যাটা‚ অ্যাই… শালার সন্ত্রাস ব্যাটা‚ ওকে লাভ বলেন কেন‚ হ্যাঁ? কত বড়ো সাহস?” বোনের পিছে দাঁড়িয়ে চোটপাটটা দেখাল মেহা। কারণ‚ শারফানের গম্ভীর চাহনিতে ভয়টা ভালোই পায় সে।
ব্যাপারটা শারফানও কিছুটা বুঝে গেল মেহার চোখ-মুখ দেখে। তাই এবার আর রাগল না সে। দুই বোনেরই রাগান্বিত মুখটা একইরকম লাগছে দেখে মজায় লাগল ওর। হাসতে হাসতে বলল মেহাকে‚ “তা কি তোমাকে বলব? কী বলব? বুশি বেল‚ না-কি নাটি বেল? নাহ‚ টিঙ্কারবেলই ঠিক আছে। লাভ টাভ তোমার সঙ্গে যাবে না। দুঃখ পেয়ো না‚ বাবু সোনা!”
“অ্যাই‚ আপনি চুপ করবেন?” মস্ত এক ধমক দিয়ে বসল সানা। শারফানকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে দেখতে বলল‚ “যে মতলবেই এখানে এসে থাকুন! বেশি ফাজলামি করলেই এলাকা থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করব বলে দিলাম!”
“বেশি কষ্ট করতে যেয়ো না৷ শুধু রাতের বেলা চুপিচুপি তোমাদের ছাদে ডেকো আমাকে। এই যে এই মেহগনি গাছ বেঁয়ে চলে আসব। তারপর তোমার কাছে এসে দাঁড়াতেই চিল্লাচিল্লি শুরু করতে বলবে তোমার বোনকে। ব্যাস… মিশন সাকসেস”‚ বলেই বাঁ চোখ টিপে মুচকি হাসল শারফান।
কথাগুলোই রাগ তো হলোই সানার‚ মেহার সামনে বলায় ভারি লজ্জাও পেল সে৷ হাতের মুঠোয় থাকা সবগুলো বাদাম শারফানের মুখে ছুড়ে মেরেই ছাদ থেকে চলে গেল মেহাকে নিয়ে। দৃষ্টিসীমার বাইরে এখন সানা। তাই শারফানও আর দাঁড়াল না৷ প্রফুল্ল হাসিটা মুখে নিয়েই ঘরে চলে এল সেও।
বাড়িদুটোর মাঝে একদম অল্পখানি দূরত্ব৷ শাফিউল সাহেবের বাড়ির প্রতিটি ফ্লোরে তিনটি করে ফ্ল্যাট। শারফানের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিটা একদম সানাদের ছাদ বরাবর। এমনকি ওর শোবার ঘরের জানালাটাও সানাদের বাসামুখোই৷ উঠান থেকে শুরু করে উঠানের কোণে থাকা রান্নাঘর‚ টিউবওয়েলের পার‚ সবই চোখে পড়ে ওই জানালা থেকে।
***
নতুন বাসা‚ নতুন এলাকা‚ চেনা মানুষগুলো বদলে চারপাশে নতুন সব মুখ‚ চিরাচরিত আড্ডা দেওয়ার জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গাতে অভ্যস্ত হওয়া … তবুও শারফানের মন্দ লাগছে না কিছুই। কারণটা আর ভেঙে বলার প্রয়োজন নেই বৈকি! সকালবেলা ঘুম থেকে জেগেই সে শিথানের পাশের জানালাতে গিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই চোখের সামনেই দেখতে পায় সানাকে৷ কোনোদিন ওর সদ্য ঘুম ভাঙা মুখটা দেখে—ব্রাশ করতে করতে উঠানে নেমে আসে‚ কোনোদিন দুপুরের রান্নায় মাকে সাহায্য করতে দেখে‚ ওড়না কোমরে বেঁধে টুকটাক রান্নাবান্না করে সে নিজেও‚ কোনোদিন গোসল শেষে চুল শুকাতেও এসে বসে থাকে উঠানে। সে সময়ে হাতে থাকে ফোনটা৷ কানে ইয়ার ফোন গুঁজে চুপচাপ গান শোনে‚ নয়তো কোনো নাটক‚ সিনেমা দেখে। আবার কখনো বিকাল হলে ছোট্ট উঠানটা ঝাড়ু দিতেও দেখা যায়। কেবল ছাদে আসাটাই বন্ধ করে দিয়েছে সানা। তাতে অবশ্য শারফানের অসুবিধা নেই৷ জানালা থেকেই মেয়েটার যে ঘরোয়া মুহূর্তগুলো দেখতে পাচ্ছে রোজ… সে মুহূর্তগুলোই তার রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিতে চায়৷ এলোমেলো ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর মেলে যখন রোদে বসে মেয়েটা‚ ওর চন্দন বর্ণের মুখখানিতে তখন কী যে লাবণ্যতা ছড়ায়‚ শারফান চোখই ফেরাতে পারে না! যতবারই সানা হাজির হয়‚ ততবারই গাঢ় চাউনিতে ওকে দেখে যায় অপলক। দেখতে দেখতে শুধু আফসোস করে‚ “আমাকে বুদ্ধিমান বলে কে? সে-ই তবে আমার সব থেকে বড়ো শত্রু। কতটা নির্বোধ‚ গোঁয়ার হলে আমি কখনো স্বীকার করতে চাইনি ওর প্রতি আমার মুগ্ধতাকে!”
মোস্তফা সাহেবের অনুপস্থিতিতে মাঝেমধ্যে কিছু গানও উৎসর্গ করে সে সানাকে৷ এই তো আজ দুপুরেই সে সাউন্ডবক্সে বাজিয়ে দিল একটা গান—
“এত কিছু বোঝো আর মন বোঝো না
কত কিছু তুমি খোঁজো
আমায় তো খোঁজো না।
আমি দুহাত বাড়িয়ে
আছি দাঁড়িয়ে… বিরহী প্রতিক্ষণ
তুমি রাঙা চরণে আমার শিথানে
এসে দাঁড়াও কখন..”
রোজকার মতো সানা আজও চুল শুকাতে বসেছিল উঠানে৷ গানটা শোনা মাত্রই সে ঘাড় ফিরিয়ে শারফানের জানালাতে তাকায় তখন। সাদা রঙা পাতলা একটা পর্দা টাঙানো ওই জানালাতে। তাই আড়াল হয়ে পর্দার এপাশ দাঁড়িয়েও শারফান স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল সানার সন্ধানী দৃষ্টিজোড়া।
কেবল আজই প্রথম নয় সানা তাকিয়েছে। উঠানে এলেই ওর ষষ্ঠেন্দ্রীয় কঠিনভাবে সঙ্কেত দেয়‚ ওই জানালা থেকে কেউ দেখছে ওকে গভীর চোখে। তাই তো আজ-কাল উঠানে নামতেও ভীষণ জড়তা কাজ করে ভেতরে৷ আবার কৌতুহলী মনকে শাসন করেও সামলাতে পারে না‚ জানালাটার দিকে একবার তাকানো থেকে। শুধু কি এ অবধিই?
গতকাল রাতের ঘটনা। সানার ঘরের জানালার সামনে হালকা হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়েছে টেবিল ল্যাম্প থেকে। দিনার সঙ্গে তখন ফোনে কথা বলছিল সানা৷ আচানক রাস্তার দিকে দৃষ্টি যেতেই থমকে গেল ওর কথা। ফার্নিচারের দোকানের সামনের সাদা টিউবলাইটের আলোয় ভেসে উঠেছিল শারফানের অবয়ব। আলস্য ভঙ্গিমায় গা ছাড়াভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে‚ আঙুলের ফাঁকে সিগারেটের ধোঁয়া ঘুরপাক খাচ্ছিল মৃদু বাতাসে। পাশেই ছিল সোহান। দু’জনের মাঝে চলছিল স্বাভাবিক গল্প। কিন্তু মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে শারফানের চোখ নির্দ্বিধায় ঘুরে আসছিল সানার জানালার দিকে। যেন অদেখা কোনো টান টেনে আনছিল তার দৃষ্টিকে।
কিন্তু তার দুর্ভাগ্য‚ সানা তাকে দেখতে পেলেও সে কোনোভাবেই দেখতে পায়নি সানাকে। গত কয়েক মাসে রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে গজিয়ে উঠেছে বুনো ঝোপঝাড়। সেটাই আড়াল করে দিয়েছে জানালার প্রায় পুরো অংশ। বাইরে থেকে ওই ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরের ভেতর কিছুই বোঝা যায় না তাই৷ অথচ ঘরের ভেতর থেকে বাইরের সবটাই স্পষ্ট দেখা যায়।
সানা তাকিয়ে ছিল সেদিন স্থির চোখে। সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর শারফানের মুখ বারবার অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল। যতবার সে দেখছিল জানালার দিকে‚ ততবার সানার শ্বাসটাও ভারী হয়ে উঠছিল… হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল ওকে দেখতে পাচ্ছে বলেই শয়তানটা বারবার চাইছে। বোধ হয় মিনিট পাঁচেকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল শারফান। পুরোপুরি চোখের আড়াল হতেই ওর বুকের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত এক শূন্যতা জমে উঠেছিল তখন। সে চলে যাওয়ার পরও ওর চোখদুটো বারবার খুঁজে যাচ্ছিল তাকে।
যবে থেকে শারফানের আগমন ঘটল ওর প্রতিবেশী হয়ে‚ তবে থেকেই ওর দিনগুলো শুরু হতে লাগল শারফানকে ভেবেই আর শেষও হতে লাগল তাকে ভেবেই। সপ্তাহের সাতটা দিন তারা মুখোমুখি না হলেও অন্তত তিনটা দিন দেখা হয়েই যেত দুজনের। কখনো সানা উঠান থেকে ওই জানালাতে দেখতে পেত শারফানের শয়তানি হাসিমুখটা আর বেহায়া দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটা৷ কখনো বেহায়াটা মুচকি হাসতে হাসতে চলে আসত ব্যালকনিতে‚ ছাদে ওর উপস্থিতি টের পেতেই‚ কখনোবা একটু দরকারে সে বাইরে বের হলেই তার দেখা পেয়ে যেত রাস্তার মোড়ের মুদি দোকানটাই। সোহান‚ রিপন‚ ওদের সঙ্গে বসে বসে গল্প করত আর চা খেতো। ওকে দেখা মাত্রই তার চঞ্চলতাও বেড়ে যেত আর হাসিটাও চওড়া হত৷ তিনটা সপ্তাহ কেটে গেল ওদের‚ ঠিক এমন করেই।
***
১৯ জুলাই
দুপুর ১২: ১০
ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে ঢুকিয়েই শারফান মসজিদে ছুটল৷ গত এক সপ্তাহ হলো সে কেবল জুমাবার ছাড়াও নিয়মিত চার ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছে৷ ওর এত চমৎকার পরিবর্তনের পেছনেও একটি গল্প আছে। সোহান এখন প্রায়ই তার কাছেই এসে থাকে৷ ওর কার্যকলাপ নিয়ে খুব ঠাট্টা তামাশা করলেও সে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ওকে। সে বলে‚ “কেবল শ্বশুরের মেয়ের সামনে ঘোরাঘুরি করলেই কি তোর কপাল খুলে যাবে? শ্বশুররে হাত করবি না?”
এ ব্যাপারটা যে শারফানের মাথাতে আগে আসেনি তা নয়। কিন্তু কীভাবে মোস্তফা সাহেবের কাছাকাছি যাওয়া যায়‚ সেই বুদ্ধিটাই খুঁজে পাচ্ছিল না। বুদ্ধিটা দেয় তখন সোহান‚ “মোস্তফা কাকা মসজিদ কমিটির সভাপতি। তার কাছাকাছি যাওয়ার একটাই পথ‚ রোজ মসজিদে যাওয়া। কারণ‚ কাকাকে পাঁচ ওয়াক্তের তিন ওয়াক্তই মসজিদে পাবি৷ যোহর আর আসর বোধ হয় কলেজের মসজিদে পড়ে। কোনো কোনো দিন পুরো পাঁচ ওয়াক্তই এই মসজিদে পাওয়া যায়। তাই তোরও এখন নামাজ পড়া ধরতে হবে৷ যদিও ইবাদত হওয়া উচিত শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। আল্লাহর জন্যই নামাজটা পড়া শুরু কর… আল্লাহর কাছেই চা সানাকে। দেখবি সব সমস্যা পানির মতো ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”
এত দারুণ বুদ্ধিটার জন্য শারফান খুশিতে সোহানের হাতে নগদ পাঁচ হাজার টাকা বকশিস তুলে দেয় তক্ষুনি৷ নামাজের পর আল্লাহর কাছে সবার আগে সে এই শুকরিয়া জ্ঞাপন করে‚ ওকে ভালো মানুষের মতো কতগুলো বন্ধু দিয়েছেন তিনি!
তবে এই নামাজের অছিলাতে সত্যিই শারফান মোস্তফা সাহেবের সান্নিধ্য পেতে শুরু করেছে৷ প্রথম দিন জামাতে আচমকা ওকে নিজের পাশে দেখে ভীষণ অবাক হলেও নামাজ শেষে শারফান নিজে থেকেই কথা শুরু করে তার সঙ্গে৷ সে থেকেই মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে ওর দেখা হয় রোজ… কথাও হয়৷ নামাজ শেষে কজন মুসল্লি মজলিশ বসিয়ে তালিম শুরু করলে কেবল তার জন্যই শারফানও যোগ দেয় মজলিশে। একদিন দুপুরের পর তালিমের ওয়াজের মাঝে এমন ঘুম এল ওর‚ কোনোভাবেই চোখদুটো আর খুলে রাখতে পারছিল না৷ বারবার মাথাটা ঢুলে পড়ছিল আর তারপরই চমকে উঠে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল দেখে মোস্তফা সাহেব হঠাৎ নিঃশব্দে হেসে ফেলেন। ওর কাঁধ জড়িয়ে তখন কোমল গলায় বলেন‚ “তালিমের সময় আল্লাহর ফেরেশতারা তাঁদের রহমতের ডানায় সবাইকে আগলে রাখেন বলে এমন শান্তির ঘুম পায়। আমারও পায় মাঝেমধ্যে। কোনো সমস্যা না।”
যাতে সে অপ্রস্তুত না হয় বা লজ্জা না পায়‚ এবং তালিমের প্রতি যেন অনাগ্রহী না হয়ে পড়ে‚ কথাটা সেজন্যই বলেছিলেন মোস্তফা সাহেব।
আরেকদিন ঘটল মজার ঘটনা৷ আসরের নামাজ শেষে যখন তালিমে মশগুল সবাই‚ তখন এলাকার একটি ছেলে হাজির হলো ইমামের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে। ছেলেটা মাস তিনেক প্রেম করে বিয়ে করেছে দু‘মাস হলো। কিন্তু হঠাৎ করে তার বউয়ের প্রতি আগেই সেই আকর্ষণ কাজ করছে না‚ বউকে আর ভালো লাগছে না‚ বউয়ের কোনো কিছুই তার মনের মতো হচ্ছে না৷ ইমামের কাছে তার প্রশ্ন ছিল‚ এ অবস্থায় সে কী করে বউয়ের সঙ্গে সংসার করবে? অথবা কী করে বউয়ের প্রতি আগের ভালো লাগাটা ফেরাবে?
এমন আজগুবি বিষয়ে মজলিশের কেউ কেউ বেজায় বিরক্ত হলো ছেলেটার প্রতি‚ কেউ কেউ হাসতে লাগল৷ কিন্তু শারফান হঠাৎ নির্বিকার সুরে ছেলেটিকে বলে বসল‚ “তালাক দিয়ে দেন। দিয়ে আবার তিন মাস প্রেম করেন৷”
কথাটা শুনে সবার আগে হেসে লুটোপুটি খান ইমাম সাহেব৷ তারপর মোস্তফা সাহেবসহ মুসল্লি সকলেই। ওই ঘটনার পর থেকেই হঠাৎ মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও সহজ হয় শারফানের। কারণ‚ তিনি ওর চরিত্রের আরও একটি দিক আবিষ্কার করেছিলেন ওই কদিনে—গায়ে গতরে আর বয়সে ছেলেটা বাড়লেও তার মাঝে ছেলেমানুষি আচার-আচরণ‚ চিন্তাভাবনা এখনো রয়েই গেছে৷ এই যে নিজের বাড়ি ছেড়ে ওর এখানে এসে থাকার মতলবটা বুঝতে সময় লাগেনি তার। মাঝেমধ্যে তিনিও দেখে ফেলেন নিজের ঘরের জানালার কাছে এসে বারবার ওর ঘুরঘুর করা। তাও আবার ভাতের থালা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে থাকে আর সানাকে খুঁজকে থাকে। বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রতিবার তার বাড়ির ছাদের দিকে চাওয়াটাও লক্ষ করেন। এর মাঝে জুমাবারে তিনি দেখে ফেললেন আরও একটি ঘটনা। নামাজ শেষে মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিনি কমিটির কিছু সদস্যদের সঙ্গে। পাশে তখন শারফানও ছিল দাঁড়িয়ে। আলোচনাতে ওকেও শামিল করা হয়েছিল৷ শাফিউল হকের ছেলে বলেই নয় শুধু‚ মোস্তফা সাহেবের মতো সম্মানার্হ ব্যক্তি ওকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন বলে ভালোই কদর পাচ্ছিল সে মসজিদের মুসল্লিদের থেকেও৷
সেদিন কথার মাঝে হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন‚ চোখ-মুখ শক্ত করে শারফান তার বাসার ছাদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল‚ “ফাজিল মেয়ে! বোঝে না ছাতার মাথাও!”
কোণা চোখে তখন ছাদের দিকে মোস্তফা সাহেবও তাকান আর দেখতে পান তার মেয়ের উপস্থিতি।
মূলতঃ মরিচ রোদে শুকাতে দিতে সানাকে সেদিন দুপুরবেলাতে ছাদে পাঠান নাজমা বেগম। ওই সময় মাঠে তাকাতেই বাবার পাশে শারফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সানা। বাবার সঙ্গে ইদানীং ওর সম্পর্কটা গল্পগুজব‚ হাসাহাসির পর্যায়ে চলে গেছে কী করে—তা ভাবতে ভাবতেই সে দেখতে থাকে শারফানকে৷ একই সময়ে শারফানের দৃষ্টি গিয়েও পড়ে ওর দিকে৷ ওদিকে নামাজ শেষ করে রাস্তা ধরে যেতে যেতে কিছু ছেলেরাও বারবার ছাদের দিকে তাকাচ্ছিল। তা চোখে পড়ে যায় শারফানের৷ তখনই সানার দিকে কঠিন দৃষ্টি ছুড়ে মাথাটা মৃদু নাড়িয়ে ইশারায় সে বোঝায়‚ “বাসার ভেতর যাও!”
অদূরে থাকায় ইশারাটা ভালোই স্পষ্ট ছিল। সানা তাই দেখতে পেলেও কিন্তু অমন ইশারার কারণটা বুঝতে পারে না। কেবল ওকে চোখ গরম দেখাচ্ছে দেখে উলটো সেও চোখ গরম দেখায়… মুখ ঝামটাও দিয়ে বসে। যা দেখে শারফান আরও রেগে ওঠে আর বিড়বিড়িয়ে বকতে থাকে ওকে।
চলবে।