#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৩.
“গোশত বেশি নিস না। তোর ভাইয়ের হবে না অতটুকুতে। এই তরকারি নিয়ে যা”‚ বলে ডিমের কোরমার বাটি মেয়েকে এগিয়ে দিলেন জেসমিন।
মেজাজ খারাপ হলো জারার‚ “আম্মু‚ আমার বান্ধবী তিনজন৷ গুণে গুণে দুই পিস মাংস দেবো না-কি ওদের? ইজ্জত থাকবে হক বাড়ির? আর তোমার ছেলের এই রাক্ষুসে খাওয়া কমাতে বলবা না? এক কেজি গোরুর মাংস যদি ওর এক বেলাতেই লাগে তো শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আদর পাবে ও?”
“ওর শ্বশুর বাড়ি নিয়ে তোর ভাবতে হবে না”‚ শারফানের জন্য খাবার বেড়ে রাখতে রাখতে জেসমিন ধমকালেন জারাকে‚ “ব্যাটা ছেলেরা একটু বেশিই খায়। তুই ওর খাওয়া নিয়ে খবরদার ফাউল কথাবার্তা বলবি না! বাড়িতে আসলো ও কতগুলো মাস পর সে কথা তো ভাবিস না। যা বের হ তরকারি নিয়ে।”
“এত দরদ দেখাও না ছেলেকে নিয়ে? এই ছেলেই একদিন তোমাকে কাঁদাবে দেইখো”‚ রেগেমেগে মেঝেতে পা গুঁতিয়ে বেরিয়ে গেল জারা রান্নাঘর থেকে। মেয়ের যাওয়ার পথে তখন আগুন চোখে তাকিয়ে থাকলেন জেসমিন।
ডাইনিংয়ে বান্ধবীদের খেতে দিয়ে জারা বসল সবেই। এর মাঝে বসার ঘরে আগমন ঘটল শারফানের৷ ডাইনিং থেকে বসার ঘরটা চোখে পড়ে। খেতে থাকা জারার বান্ধবী একজন শারফানকে দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে জারাকে কনুইয়ের গুঁতা দিলো‚ “তোর ভাই চলে আসছে‚ জারা৷ ওনাকে আমাদের সাথে খেতে বসতে বল প্লিজ।”
বাকি দুই বান্ধবীও শারফানকে দেখে আবদার ধরল জারার কাছে৷ এরা মূলত এসেছেই শারফানের সাথে কথা বলতে‚ ওকে দেখতে। জারা সেসব জানেও৷ সেও চায় ভাই তার প্রিয় বান্ধবীদের কারও সাথে সম্পর্কে জড়াক‚ বউ করুক। কিন্তু ভাইকে ডাকার আগে ভাইয়ের মেজাজ বুঝতে হবে। সে উঠে এসে শারফানের পিছু পিছু সিঁড়িতে উঠতে থাকল‚ “ভাত খাবি না‚ ভাইয়া?”
পেছন থেকে হঠাৎ বোনের ডাক শুনে হাঁটার মাঝেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শারফান‚ “আম্মুকে বল আর নয়ত তুই আমার ঘরে নিয়ে আয় ভাত৷ খিদে পেয়েছে খুব।”
“আমি সব ডাইনিংয়ে নিয়ে আসছি। তুই ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে আয় না!”
“কথা বাড়াস না তো”‚ হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে ঘরের দিকে এগোলো শারফান‚ “যা বললাম কর। খেয়েই বের হতে হবে আবার।”
“ভাইয়া‚ প্লিজ… আয় না”‚ ন্যাকান্যাকা স্বরে জারা অনুরোধ করল। “আমার বান্ধবীরা তোর অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে দেখতে আসছে। ওদের সঙ্গে অন্তত একবার দেখা কর।”
ঘরের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল শারফান ভ্রু কুঁচকে। বোনের দিকে ওভাবেই একটু সময় চেয়ে থেকে তারপর ঢুকেই পড়ল ঘরে৷ বলল‚ “খাওয়ার মাঝখানে কারও ছোঁচা নজর সহ্য হবে না আমার। পাছে এঁটো হাত দিয়েই কার গালে আদর করে বসব তার ঠিক নাই।”
এত অনুরোধেও ভাই রাজি হলো না! উপরন্তু বলে কিনা এঁটো হাত দিয়ে বান্ধবীদের থাপ্পড় মারবে? ছোটোখাটো একটা ঝগড়া শুরুই করতে যাচ্ছিল জারা। তখনই শারফান বলল‚ “আমার খাওয়া শেষে ওদের নিয়ে আসিস আমাকে দেখাতে। খাওয়ার মাঝে এসে যেন কেউ ছোঁচামি না করে।”
***
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল সানা৷ হুট করে মেহা এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে হিজাব পরতে আরম্ভ করল৷ খেপা চোখে বোনের দিকে তাকিয়েই হাঁক দিয়ে উঠল সে‚ “কীরে! তুই আমার নতুন হিজাব পরছিস কেন? জিজ্ঞেস করেছিস আমাকে?”
“তুই হিজাব পরতে জানিস‚ বলদ? কিনে কিনে তো ঘরেই ফেলে রাখছিস।”
“আশ্চর্য! আমি যেদিন খুশি সেদিন পরি তাতে তোর কী? আমি পরার আগে তুই ক্যান পরবি?”
“তুই তো পরতেই পারিস না হিজাব”‚ মেজাজ খারাপ নিয়ে মেহা বোনকে বলল‚ “এক হিজাব পরতে যেয়ে দুই ঘণ্টা লাগাস। তাও ঠিকঠাক হয় না। ঘরে ফেলে রাখবি তা আমাকে পরতে দিবি না। আরেকটা কথা বল হিজাব টয়লেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখব!”
“তোকে আমি আস্ত রাখব?” চেঁচিয়ে উঠল সানা।
দুই বোনের তর্কবিতর্ক পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়ে মা নাজমা চলে এলেন জায়নামাজ ছেড়ে। তাকে দেখেই সানা নালিশ দিলে মেহা বলল‚ “কয়টা হিজাব কিনে শোকেসে রেখেছে তোমার মেয়ে দেখেছ? একটাও পরে ও? আমি আজকে পরছি দেখে কী শুরু করেছে!”
“তোর জিনিস তোর বোন পরবে না তো কে পরবে?” নাজমা বকে উঠলেন সানাকেই‚ “হিংসামি করা শিখেছিস কার থেকে? তুই ওরটা পরবি ও তোরটা পরবে। তাতে এত ঝগড়াঝাঁটি হবে কেন?”
“আমি কি পরতে ওকে নিষেধ করেছি? আমি পরার আগে ও কেন পরে ফেলবে?”
“তা তুই পরিস না কেন? ছয় মাস ধরে শোকেসে ফেলে রাখছিস কেন না পরে?” বললেন নাজমা।
“ও নিজেও পরবে না আমাকেও পরতে দেবে না”‚ বলে ভেংচি কেটে মেহা হিজাব পরে নিলো।
সানা তখন রেগেমেগে মাকে বলল‚ “আমি হিজাবগুলো কিনেছি পাঁচশো-সাতশো দাম দিয়ে। কোনো বিয়ে‚ অনুষ্ঠানে পরব তাই৷ তোমার মেয়ের মতো দেড়শো-দুইশো টাকার হিজাব কিনিনি যে প্রতিদিন কলেজ‚ প্রাইভেটে পরে বেড়াব।”
“আচ্ছা ঠিক আছে‚ আজকের দিনটা পরেছে পরুক। ওর শখ হয়েছে একটু শখ মিটাক। তোরই তো বোন।”
সোফায় রাখা ব্যাগ নিয়ে মেহা জলদি কেটে পড়ল৷ নয়ত সুন্দর হিজাব পরার শখ আজ আর পূরণ হবে না। তবে যাওয়ার আগে সানাকে আড়ালে দাঁত বের করা হাসি দেখাতে ভুলল না। সেই হাসি দেখেই সানা মনে মনে ভেবে রাখল পাঁজি বোনটাকে শায়েস্তা করবে আজ রাতে কীভাবে!
মায়ের কথার কোনো জবাব দিলো না সানা রাগ করে৷ চুলটা বেঁধে‚ গায়ে ওড়না জড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেও প্রাইভেটের উদ্দেশে।
***
“আব্বু ওকে গালাগাল করে একদম উচিত কাজ করে৷ তোমার ছেলের মতো ফাতরা‚ ফালতু আর খবিশ কোনো ছেলে দুনিয়াতে নাই”‚ জারা চেঁচাতে চেঁচাতে বলল‚ “ও কি ওর সম্মান নষ্ট করল? ও তো আমার ইজ্জত খেয়ে দিলো ওদের কাছে৷ ওরা তো কলেজ গিয়ে সবার কাছে বলে বেড়াবে আমার ভাই কত বড়ো খবিশ।”
পনেরো মিনিট হলো জারা এভাবেই শারফানের ওপর চেঁচামেচি করছে ওর ঘরে দাঁড়িয়েই৷ জেসমিন বেগম আদর গলায়‚ ধমক সুরে‚ কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না মেয়েকে৷ ভাবছে‚ ছেলে যদি রেগে দু-চারটা চড় লাগিয়ে বসে? কিন্তু শারফান নির্বিকার। সে ওর বড়ো চুলের পরিপাটি নিয়ে ব্যস্ত। সিঁথি কেটে এক পাশের বেশি চুলগুলোকে তিন আঙুলে ক্রিম মেখে কিছু চুল এদিক-ওদিক করে বসিয়ে দিলো। হালকা ফুলে থাকল সেই চুলগুলো৷ আর অপরপাশের চুলগুলোকে একটু ব্যাকব্র্যাশ করে চাপিয়ে দিলো সেগুলো। পাজামা-পাঞ্জাবি পালটে ঢিলেঢালা হাফ হাতার ছাই রঙা একটা গেঞ্জি আর কালো ট্রাওজার পরেছে। হাতে পরা কালো বেলটের নতুন আরেকটি ঘড়ি। মানিব্যাগ আর ফোন পকেটে পুরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগোতেই বোনের রাগী মুখটা দেখে তার সামনে এসে দাঁড়াল হঠাৎ। মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল‚ “তিন ছোঁচাকে নিয়ে গিয়ে হয় তিন প্লেট ফুচকা খায়িয়ে দিস। আর নয়ত আমার রেস্ট্রন্ট নিয়ে আড়াইশো টাকার তিনটা প্লেটার দিস। দেখবি তোর ভাইয়ের খবিশগিরি দেখেও কাউকে কিচ্ছু বলবে না।”
টাকাটা সামনে আসতে দেরি কিন্তু জারা খপ করে সেটা ধরতে দেরি করল না। চেঁচামেচিও বন্ধ হয়ে গেল৷ তবে কপট রাগটা দেখাতে বলল‚ “তুই ওদের সামনে কেন কান খুঁচিয়ে আমার গায়ে মুছলি কটন বাড? আবার সেই কটন বাডের উলটো পাশ দিয়ে আবার নাকের ভেতরের ময়লাও বের করলি ওদের সামনে। তোর লজ্জা শরম নাই একটুও?”
কোনো জবাব না দিয়ে শারফান গটগটিয়ে চলে গেল। যেতে যেতে সে যে ঠোঁট কামড়ে একটুখানি হাসল‚ তা ওরা কেউ জানতে পারল না।
জেসমিন বেগম মেয়ের গায়ে একটা চাপড় মারলেন‚ “তুই ওকে দেখানোর জন্য তোর বেয়াদব বান্ধবীদের ডেকে এনেছিস কেন? এর জন্যই তো শয়তানি করেছে ওদের সামনে। আর তুই জানিস না তোর আব্বু আর কাকা মিথির কথা ভেবে রেখেছে ওর জন্য?”
“মিথির চাইতে তো আমার বান্ধবীগুলো দেখতে সুন্দর। মিথি খালি একটু ফরসাই বেশি। কাকুর জন্য তুমি মিথিকে আমার ভাবি বানাবা? ভাইয়ার পছন্দ দেখবা না?”
“তোর ভাইয়ের পছন্দ দেখা আছে আমার৷ ওই তো বাশারের বুড়ি মাইয়া ডায়ানার সাথে লটরপটর করে বেড়িয়েছে নাকি! পাছে ওরকম বুড়িধুড়ি একখানই যদি ধরে নিয়ে আসে? ওর ওপর ভরসা নাই। মিথি দেখতে খারাপই বা কই? লম্বাও আছে‚ সুন্দরও আছে আর ঘরের সব কাজও জানে।”
“আর ঝগড়াও জানে তোমার কলিজা ভাজা ভাজা করার জন্য”‚ ফোঁড়ন কেটেই জারা সরে পড়ল দ্রুত আরেকটা চাপড় খাওয়ার আগে।
***
দু কাপ মালাই চা এনে বসল অনি চেয়ারটা টেনে৷ ফোন থেকে চোখদুটো তুলে এক কাপ হাতে নিয়ে শারফান জিজ্ঞেস করল‚ “কয়টা ব্যাচ পড়াস এখন?”
“এসএসসির ব্যাচ বাদ দিয়ে দিছি। সামনের বছর থেকে এইচএসসির ব্যাচও বাদ দেবো৷ অনার্সের ব্যাচগুলোই পড়াব শুধু।”
“ছেলে হবে কতগুলো?” চায়ের কাপে এক চুমুক বসিয়ে জিজ্ঞেস করল শারফান‚ “কাজে লাগাতে পারবি?”
অনিও চায়ে দু বার চুমুক দেয়া শেষে জবাব দিলো‚ “ওদের এই কয়টা মাস যদি ফোনের ইন্টারনেট আর চা-সিগারেটের খরচ দিস৷ ওরা মাঠ গরম করে রাখতে পারবে।”
“সবগুলো অনি ভাই ভক্ত‚ তাই তো?” হাসতে হাসতে বলল শারফান।
একটু লাজুক হাসল অনি‚ “পরিচিত হয়ে গেছি তো৷ এজন্যই আরকি!”
“কয়েকটা মেয়ে থাকলেও ভালো হত।”
“থাকবে তো৷ মেয়ের ব্যবস্থা কলেজের ভিপি মিলন করে দেবে। গার্লস হোস্টেলের মেয়েগুলোকে সমাবেশে নিতে পারবে ও৷”
“তাহলে কাল থেকে ছেলেগুলোকে রেডি করে ফেলিস”‚ বলে পকেট থেকে টাকার একটা মোটা বান্ডিল সে এগিয়ে দিলো অনিকে‚ “তোর টুয়েন্টি পার্সেন্ট রেখে বাকি ওদের ভাগ বাটোয়ারা করে দিস কাজ শেষে।”
টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে অনি কিছুক্ষণের জন্য শারফানকে বসতে বলে চলে গেল পাশের রুমে। নিজের বাড়ির দুটো রুমে অনি ছাত্র-ছাত্রী পড়ায়। এখন অ্যাকাউন্টিং বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের বিশ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ছে। তাদের অঙ্কের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এলো আবার৷ তখন বলল শারফান‚ “তুই ঠিক করে বল তো আসলেই আমার কাকার ফিল্ড ভালো আছে না-কি? ফারনাজ কবিরের যে ক্লিন ইমেজের গল্প শুনলাম আজকে‚ তাতে তো আমার ভাবগতি সুবিধের লাগছে না। পাছে যদি দেখি আমি ঠকা মালকে জেতাতে হুদাই দৌড়াদৌড়ি করছি তখন কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবে।”
“টেনশন নিস না। যদি আমার বিচার সাপেক্ষে বলি তাহলে ফিফটি ফিফটি দুজনের বেলাতেই৷ এক্ষেত্রে যে যত বেশি পাবলিককে নিজের প্রতি ইমোশনাল করতে পারবে‚ সেই আরকি ভোটটা হাতাতে পারবে বেশি।”
একটা সিগারেট ধরাল শারফান‚ “সোহান বলল ওর এলাকায় নাকি ফারনাজের সমর্থক বেশি।”
“ওর চাচা সৈয়দ মোস্তফা ওই এলাকার মসজিদ কমিটির সভাপতি হয়েছে এবার৷ তাছাড়াও শিক্ষক হিসেবেও বেশ সুনাম আছে৷ বুঝতে পারছিস এবার?”
চিন্তিত মুখ দেখাল শারফানের৷ ধোঁয়া ছেড়ে বলল‚ “তবুও আমি ওই এলাকাতেই কাল আগে ঢুকব ভাবছি।”
এর মাঝেই সামনের রুম থেকে ডেকে উঠল এক কোমল‚ বাচ্চা কণ্ঠের মেয়ে‚ “অনি ভাই‚ একটু এদিকে আসেন।”
চমকে উঠে কণ্ঠটা অনুসরণ করে তাকাল শারফান‚ “সানা!” বিড়বিড়িয়ে উঠল অজান্তেই।
চলবে।