#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪.
নারী মানেই সুন্দর। ভীষণ সুন্দর অথবা অল্প সুন্দর। কারও না কারও চোখে তো এরা সুন্দর হয়ই। সেই সুন্দর দেখে অভ্যস্ত শারফান। তাই আড়ম্বর করে কখনো নারী সৌন্দর্যের প্রশংসা করার প্রয়োজন মনে হয়নি ওর কাছে৷ বিশেষ বলেও মনে হয়নি নারীর এ বৈশিষ্ট্যকে৷ না কখনো হয়েছে সে কোনো সুশ্রীর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন৷ কিন্তু কোনো এক নারী কণ্ঠ আজ দু দুবার ওর মনোযোগ আকৃষ্ট করে নিলো! বিশেষভাবেই এখন আগ্রহ অনুভব করছে সেই নারীর মুখটা কেমন হয় তা দেখার জন্যও!
জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে অনির ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়াল সে৷ অনি হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মার্কার কলমে লিখছে এখন। তার ক্লাসে ঢোকার পর কীভাবে মেয়েটিকে খুঁজে বের করবে এ চিন্তা ভাবনাতেও এলো না শারফানের৷ বোর্ডে লেখা শেষে অনি ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকানোর সময় দরজায় চোখ পড়ল তার৷ শারফানকে এগিয়ে আসতে দেখে দু আঙুলের ইশারায় ওকে দু মিনিট অপেক্ষা করার কথা বলে মনোযোগ দিলো ছাত্র-ছাত্রীর দিকে৷ শারফান মানল না তার ইশারা। দরজার মুখে আসতেই পেছন থেকে আচমকা ডেকে উঠলেন অনির বাবা‚ “কী খবর রে‚ শায়াফ? কবে আসলি বাড়ি?”
সব সময়ই পিছু ডাক অতি অপছন্দ শারফানের৷ মেজাজ নষ্ট হয় ওর। এ মুহূর্তেও বিরক্ত হলো সে। উপরন্তু মুরব্বি বলে ভদ্রতা দেখাতে আধ খাওয়া সিগারেটটাও এখন ফেলতে হলো। পায়ের নিচে ওটা মাড়িয়ে দিয়ে দরজা থেকে ফিরে এলো শারফান। অনির বাবার সাথে কুশল আলাপ করতে করতে তার আবদার রাখতে যেতে হলো ওকে বাড়ির ভেতরে অনির মায়ের সাথে দেখা করতে। মধ্যবিত্ত পরিবার এদের। শারফানের মতোই দুই ভাই-বোন অনি৷ অনির বাবা বাজারে ফাস্ট ফুডের একটা দোকান চালান৷ আর অনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা শেষে চাকরির চেষ্টা করছে অনেক দিন ধরেই। মনঃপূত চাকরি না মেলায় বাড়িতে বসে তাই বছর দুই হলো পড়াতে শুরু করেছে৷
বিত্তবান‚ প্রভাবশালী বাড়ির ছেলে বিধায় শারফান এলে ওর আদরযত্ন একটু বেশিই করেন অনির মা। তাই জোর করেই ওকে নাশতা করতে বসালেন তিনি৷ এর মাঝে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রী পড়া শেষে একে একে বের হতে শুরু করল আর তৃতীয় বর্ষ ঢুকতে থাকল রুমে৷
সানা বের হওয়ার আগ মুহূর্তে রিয়ার ডাকে সে বাড়ির দাঁড়াল মূল ফটকের সামনে গিয়ে৷ অনির ছোটো বোনই রিয়া। সানার কাছে এসে ওকে জিজ্ঞেস করল সে‚ “তুই না সেদিন বললি পিকনিকে যাবি? আজকে না বললি ক্যান?”
“ভেবেছিলাম রাঙামাটি‚ বান্দরবন যাবে”‚ চুলের ডগা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল সানা পানসে মুখ বানিয়ে‚ “আজকে শুনি আলামিনদের কাছে সুন্দরবন যাবে ওরা। সুন্দরবন যেয়ে বাঘ‚ হরিণ দেখার চেয়ে চিড়িয়াখানা যেয়ে দেখায় তো ভালো।”
“আরে এক দিনেই যাতে ফিরে আসা যায় তাই সুন্দরবন যাওয়ার ডিসিশন নিছে সবাই।”
“ভালো কথা‚ যা তোরা। আমি যাব না।”
“যাবি না ক্যান‚ বাল”‚ চেঁচিয়ে উঠল রিয়া হঠাৎ‚ “আমি টাকা জমা দিয়ে দিছি। টাকা কি ওরা আর ব্যাক দেবে? তুই যাবি। আমার জন্য তোর যাওয়া লাগবে।”
“হে হে… তাই নাকি?” বিদ্রুপ করে হেসে সানা বলল‚ “ওই আটশো টাকায় সুন্দর গজ কাপড় কিনে চারশো টাকা মজুরি দিয়ে এক সেট থ্রি পিস বানানো হয়ে যাবে আমার৷ তোর জন্য আমি আটশো টাকা গচ্চা দেবো ভাবলি ক্যামনে‚ শালী!”
সানার কথা শুনে রিয়া কপট ক্ষিপ্ততা দেখিয়ে ওর ব্যাগ ধরে টান দিলো৷ উদ্দেশ্য ব্যাগে টাকা পেলে সেই টাকা নিয়ে এক্ষুনি সে জমা দিয়ে দেবে আলামিনদের কাছে৷ পিকনিকের তালিকায় নাম লিখিয়ে দেবে বান্ধবীর। সানা দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকে‚ ঠোঁট ফুলিয়ে অদ্ভুম মুখভঙ্গি বানিয়ে হাসতে থাকল রিয়ার ব্যাগ তল্লাশি দেখে। কারণ‚ বিশ টাকার দুটো নোট ছাড়া আর এক পয়সাও নেই এতে। তা দেখেই হতাশ হলো রিয়া। রেগেমেগে তাই কথা শুনাতে শুরু করল ওকে ছোটো লোক‚ ছোটো আত্মা‚ ফকিরের বাচ্চা বলে। জবাবে সানাও চুপ রইল না। সবাই দুই বান্ধবীর ঝগড়া‚ তামাশা উপভোগের সঙ্গে দেখল যেতে যেতে।
ঝগড়া করতে করতে সানা গেটের বাইরে বেরিয়ে গেছে প্রায়। সে সময়ই শারফান ফিরে এলো৷ অনিকে দেখল চেয়ারে বসে ঘরের বাইরে তাকিয়ে হাসছে। এসে বসল তার পাশেই। বন্ধু
কী দেখে হাসছে সে তা দেখার জন্য দরজার বাইরে তাকাল ও-ও। তাকাকেই থমকাল ওর চাউনি।
হেয়ার ব্যান্ডে ঢিলা করে বাঁধা কোমর ছড়িয়ে যাওয়া মেয়েটার চুল। হলুদ‚ আকাশীর মিশেলে সেলোয়ার-কামিজ তার পরনে—মাথায় আকাশী রঙা ওড়না দেওয়া। কাঁধে ঝুলছে ডি গ্রেজিয়া হ্যান্ডব্যাগ আর হাতে ধরা অ্যাকাউন্টিং বিষয়ের একটি বই। উচ্চতা বড়োজোর পাঁচ ফিট দুই কি তিন হবে৷ স্বাস্থ্য মাঝারি। পৃষ্ঠদেশ আর সুগঠিত নিতম্ব দেখে শারফানের মনে হলো ওর দেখা সৌষ্ঠবমণ্ডিত‚ নিখুঁত মেদশূন্য মেয়েগুলোর মতো অতটাও আকর্ষণীয় নয় মেয়েটির শারীরিক গঠন। তবে খারাপও বলা যায় না৷ পেছন থেকে দেখেই সানাকে মাপঝোঁক করা হয়ে গেল ওর। রিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মেয়েটা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে৷ তার কণ্ঠস্বরেই শারফান আটকে থাকল কেবল। কী কথা বলছে মেয়েটা তা শুনেও শুনতে পেল না যেন৷ মুগ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে সে ব্যাকুল হয়ে রইল মেয়েটি একবার ফিরে চাক ওর দিকে‚ এ আশায়।
“এই দুই ঝগড়াটে‚ ঝগড়া থামা”‚ অনি আকস্মিক ধমকে উঠল রিয়া‚ সানাকে। “তোদের দুই বান্ধবীকে একই ঘরে বিয়ে দেবো। তারপর করিস চুলোচুলি। এখন ফোট আমার ক্লাসের সামনে থেকে।”
রিয়াকে মুখটা ঝামটি মেরে সানা গেটের বাইরে পুরোপুরি বেরিয়ে গেল৷ ওর লম্বা রেশমি চুলের গোছা তখন বেজায় জোরে বাড়ি খেল রিয়ার চোখে-মুখে। তাতেই আবার চটে গিয়ে সে তেড়ে গেল বান্ধবীর পিঠে দু ঘা বসানোর জন্য।
সানার যাত্রাপথে চেয়ে থেকে শারফান বিস্মিত চোখজোড়া ফেরাল অনির দিকে। “মেয়েটা কি এতক্ষণ ঝগড়া করল রিয়ার সাথে?” কণ্ঠে অবিশ্বাস ওর।
“হ‚ বিশ্ব ঝগড়াটে দুইটাই।”
“সিরিয়াসলি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ওরা ঝগড়া করল?”
অনি শারফানের চেহারার হতবাক অভিব্যক্তি দেখে সন্দিগ্ধ হয়ে বলল‚ “জীবনে শুনিস নাই মেয়েদের ঝগড়া?”
“শুনব না ক্যান? কিন্তু আমার ক্যান মনে হলো মেয়েটা চড়ুইয়ের মতো কিচির-মিচির করে গল্প করছিল? একবারও বুঝলাম না ওটা আসলে ঝগড়া ছিল!”
শারফানের কথা শুনে কতক পল তাকিয়ে থেকে আচমকা হেসে ফেলল অনি হো হো করে৷ বুঝতে পেরেছে সে বন্ধুর অবিশ্বাস করার কারণ। হাসি একটু থামিয়ে বলল ওকে‚ “সানার ভয়েজই অমন মোলায়েম আর কথা বলার সময় প্রতিটা শব্দ এত স্লোলি উচ্চারণ করে দেখে ও ঝগড়া করলেও মনে হয় নরমাল কথা বলতেছে। কণ্ঠও উচুঁ হয় না ঝগড়ার সময়।”
“যাহশ্শালা”‚ মৃদু হেসে শারফান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল‚ “এরকম মেয়েকেই তো বউ করা দরকার দেখি। এমন মাসুম ভয়েজ নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করলেও আমার চান্দি গরম হবে না তাইলে।”
হা হা করে অনি আরেক চোট হাসল বন্ধুর মন্তব্যে। “তোর চান্দি গরম হবে না৷ কিন্তু তোর বউয়ের কলিজা শুকায় যাবে তোর হাস্কি গলায় প্রেমের বদলে ঝাড়ি খেলে। তাই বউ ঘরে টিকাতে চাইলে রাগ কমানো শুরু কর‚ মামা।”
“মনে হয় ঠিকই বলছিস। বউ ভাগতে দেওয়া যাবে না একদম”‚ গালের দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল শারফান‚ “ইজ্জত থাকবে না আমার বাপের। বাকি শেয়ারও আর মিলবে না আমার।”
“তোর বাপের ইজ্জত পরে‚ ব্যাটা৷ তোর ইজ্জতের কী হবে? খালি শেয়ারের চিন্তায় মরিস!”
“পুরান গেলে নতুন আসে”‚ বলেই ফিচেল হাসল সে‚ “আমার লাভ ছাড়া লস নাই‚ মামা।”
***
“এই দিনা‚ তানহা কি কোনোভাবে অটিস্টিক? ও কোনো সময় নরমালি কথা বলতে পারে না কেন?”
পেয়ারায় কামড় বসাতে যাচ্ছিল দিনা৷ সম্পর্কে সানার মেজো চাচার ছোটো মেয়ে সে। ফরিদপুর স্টেডিয়ামের কাছে সানার বাবা সৈয়দ মোস্তফার মেজো ভাই সৈয়দ মিজানুর বাড়ি করে সেখানেই থাকেন পরিবার নিয়ে। আজ দিনা ছোটো চাচার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। হঠাৎ সানার কথা অদ্ভুত কথাটা শুনে ওর দিকে তাকাল সে ভ্রু কুঁচকে‚ “অটিস্টিক হতে যাবে কেন? ও আমাদের ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট।”
মেহা চুল বিনুনি করছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সানা জবাবটা দিলো বোনের দিকে তাকিয়ে‚ “একটা মানুষ সব সময় কীভাবে ন্যাকাপনা করতে পারে? প্রত্যেকটা কথায় বলে ন্যাকান্যাকা গলায়। গতকাল দেখা হলো আমার আর রিয়ার সাথে কলেজের মাঠে। এসে গল্প শুরু করল ওর বিখ্যাত স্টাইলে। কথার শেষে এমন টান দেয়! আমি তো মাঝেমধ্যে ভেবে ফেলি ও মনে হয় কথার মধ্যেই গান গাওয়া শুরু করে দিছে৷ তো গল্পের ফাঁকে ওর ক্রাশ আসিফের কথা উঠল এক সময়৷ আসিফ সিগারেট খায় কি নতুন? ও দেখেছে মনে হয় প্রথমবার। বলে‚ ‘বাউন্ডারির ওইপাশে দাঁড়ায়ে আসিফকে দেখলাম জুস খাচ্ছে‚ জানো?’ রিয়ার তো এমনিতেই ত্যারা বাঁকা কথা বলার স্বভাব৷ ও বলল‚ ‘জুসের দাম কি মিলিয়ন ডলার? এটা ব্রেকিং নিউজের মতো বলার কী আছে?’ আমি ভাবলাম এবারই মনে হয় ঝগড়া লাগাবে তানহা। উলটে সে মুখ চেপে হাসল। তারপর বলল‚ ‘আরে তুমি যে জুস ভাবছ সেটা না৷ সিগারেটের কথা বলছি আমি।’ আমি গতকাল ওর এই নতুন ঢং দেখে টোটালি স্পেলবাউন্ড। সিগারেটকে সিগারেট না বলে ও জুস বলার কী আছে‚ ভাই?”
“এ আবার কোন কিসিমের ন্যাকামি”‚ চুল বিনুনির মাঝে মেহা হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে গেল। দিনাও হাসল।
ওদের হাসাহাসির মাঝে সানা ফেসবুকের নিউজফিডটাও ঘুরাঘুরি করছিল৷ হঠাৎ সামনে এলো পান্থ চৌধুরী নামের আইডিটা থেকে প্রোফাইল ছবির পোস্ট৷ ট্যুরে গেছে সে বন্ধুদের সঙ্গে সিলেট শ্রীমঙ্গলে৷ চা বাগানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। লাইক‚ কমেন্টের বাহার ছেলেটার ছবিতে৷ সানা জানে কমেন্টবক্সে ঢুকলে ছেলেদের চেয়েও মেয়েদের কমেন্টই বেশি পাবে সে৷ আর সেসব কমেন্টের রিপ্লাইতে চলে পান্থর ফ্লার্টিং। কিন্তু কেন যেন তা দেখেও সানার রাগ হয় না‚ বিশেষ কোনো অনুভূতিই হয় না। কেন হয় না তা সে নিজেও বোঝে না। এই যে দায়সারাভাবে কেবল একটা লাইক দিয়ে স্ক্রলিং শুরু করল৷ সেটা পাশে বসে দিনা লক্ষ করে বলে উঠল‚ “এত সুন্দর ছবিটা দেখে একটা কমেন্টও করতে মন চায় না তোর?”
“চায় না তো”‚ নির্বিকারভাবে বলল সানা‚ “কী করব?”
“তোরা লাস্ট কথা বলছিস কবে?”
“মনে হয় বিশ-পঁচিশ দিন আগে। কেন কী হয়েছে?”
পান্থর ব্যাপার সানার গা ছাড়া ভাবটা নতুন নয়। সম্পর্কের শুরু থেকেই দেখে আসছে দিনা৷ জিজ্ঞেস করল‚ “পান্থ সিলেট গেছে তা তুই জানতি আগে থেকে?”
“নাহ‚ ছবি দেখে জানলাম৷ ও বোধ হয় লাস্ট যেদিন কথা হলো সেদিন বলেছিল কোথাও একটা ট্যুর দেওয়ার প্ল্যান করছে৷ আমার মনে নেই সিলেটের কথা বলছিল কিনা।”
“এটাকে কী ধরনের রিলেশন বলে?” কথাটা সানার উদ্দেশে হলেও দিনা মেহাকে বলল‚ “কেউই ওরা ঠিকমতো ফোনে কথা বলে না‚ চ্যাট করে না। যোগাযোগ থাকেই না ওদের মাঝে একরকম। এমনভাবে প্রেম হয়?”
“হয় না”‚ বিনুনির আগায় হেয়ার ব্যান্ড পেঁচাতে পেঁচাতে মেহা জবাব দিলো‚ “ওদের এই অপ্রেমের রিলেশনও খু্ব বেশিদিন লাস্টিং করবে না।”
“কথাটা ভুল বলিসনি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই টেকে না আজ-কাল দূরত্বে থাকলে৷ পরকীয়াতে লিপ্ত হয়ে যায় যে-কোনো একজন। আর সেখানে তো প্রেমের সম্পর্ক।”
“এটাকে আদৌ প্রেম বলে?” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে মেহা পড়ার টেবিলে বসল। কাঙ্ক্ষিত বইটা টেনে নিয়ে পাতা উলটাতে উলটাতে উত্তরটাও দিলো সে-ই‚ “এই সম্পর্টকাকে খালি চোখে প্রেম বলা যায়৷ কিন্তু জেনুইনলি ওরা কোনো প্রেমেই নাই।”
“লজিক আছে তোর কথায়৷” দিনা সায় দিয়ে বলল‚ “সম্পর্কটা কেবল কারের মতো না যে একা একাই দৌড়াবে। দুই পাশ থেকেই এফোর্ট দিতে হয়৷ কিন্তু ওরা কেউ-ই তা করছে না৷ ওই শালারপুত কী বলল? সেই নাকি প্রেম আর পড়া একসাথে মেইনটেইন করতে পারে না। তাই কানাডা ঢুকে আগে ক্যারিয়ার গড়বে তারপর সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবে। তাইলে শালা তুই লাইন মারলি কেন আর পছন্দের কথা জানালি কেন? একেবারে ক্যারিয়ার বানায়েই বিয়ে করতে আসতি। এই হালারপোর মধ্যেই আসলে ঘাপলা।”
“ঘাপলা তো আছেই। ওর প্রতিটা ফটোর কমেন্টবক্সে ঢুকলেই পাওয়া যাবে ওর হালি হালি জিএফ।”
“তোর বোনের মধ্যেও সমস্যা আছে। পান্থর জন্য আমি তো ওর মধ্যে কোনো ফিলিংস‚ ইমোশন‚ কিছুই টের পাই না।”
“হা হা হা”‚ মেহা হাসতে হাসতেই বলল‚ “তুই এই কথা কি আজকে বুঝলি‚ বোন? আমি তো প্রথম থেকেই বুঝছি।”
ফোন থেকে চোখদুটো তুলে এতক্ষণে সানা তাকাল একবার চাচাতো বোনের দিকে‚ আরেকবার আপন বোনের দিকে‚ “তোরা আমার প্রেম নিয়ে গবেষণা শুরু করলি ক্যান হঠাৎ?”
“তুই চুপ থাক‚ বালডা”‚ দিলো এক ঝাড়ি মেরে দিনা। বিরক্ত মুখশ্রী করে বলল‚ “পান্থ তোকে কী ঘোড়ার মাথার অজুহাত দেখাল আর তুইও তাই মেনে ওরে ছেড়ে দিয়ে বসে আছিস।”
“তো আমি কি ছ্যাঁচড়ার মতো ওকে কল দিয়ে রাতদিন গুঁতাগুঁতি করব”‚ বেশ চটেই গেল সানা‚ “কেউ আমার সাথে কথা বলতে‚ দেখা করতে আগ্রহী না হলে আমি বেলেহাজের মতো তাকে নক করব ভাবিস তোরা? আর ওর অজুহাত শক্তপোক্ত তখনই হয়েছে যখন আমিই সরাসরি নিষেধ করে দিয়েছি দেখা-সাক্ষাতের জন্য। আমার ওর সাথে দেখা করতে‚ কথা বলতে ইন্ট্রেস্ট না হলে জোর করে এসব করব নাকি? আজব!”
মেহা ঘুরে বসে দিনাকে বলল‚ “দ্যাখ দিনা আপা‚ ওকে ফোর্স করাটা ঠিক হবে না। পান্থর প্রপোজাল ও অ্যাক্সেপ্ট করেছে তোর আর রিয়ার কথায় প্রভাবিত হয়ে৷ এটা তো স্বীকার করিস?”
দিনা মাথা ওপর-নিচ করে হ্যাঁ জানাল বটে। তবে বলল‚ “ওর মন সায় না দিলে কিন্তু আমাদের কথাতে রাজি হত না‚ তাই না?”
“হ্যাঁ সত্য। পান্থর কিউটনেস বেশিরভাগ মেয়েকেই ইমপ্রেস করে। পান্থর সাথে ওর পরিচয়ও আবার অনেক দিনেরই৷ সেখানে পান্থর প্রতি ইন্ট্রেস্টেড হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না৷ কিন্তু সে যখন প্রপোজ করল ওকে‚ ও কিন্তু এক মাস পেন্ডিং রেখেছিল পান্থর প্রপোজাল৷ পেছন থেকে তুই আর রিয়া যদি ধাক্কাটা না দিতি ও উৎসাহই পেত না রিলেশনে যাওয়ার। কিন্তু ধাক্কাধাক্কিতে ভালোবাসানো তো আর সম্ভব না।”
সানার দিকে মুখ ফেরাল দিনা‚ “তাহলে তুই বের হয়ে আসছিস না কেন এই ছিঁড়ি ছাড়া সম্পর্ক থেকে?”
“ট্রাই করেছিলাম একবার।” হাই তুলতে তুলতে বলল সানা‚ “প্রচণ্ড ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল। আর ওর ইমোশনাল কথার চাপে আমি চ্যাপ্টা হয়ে গেছিলাম। উলটে দুটো বছর সময় চেয়ে নিলো আমাকে বিয়ে করার জন্য।”
“হ্যাঁ… শালার মতিগতি বোঝা শেষ। দুটো বছর কেন‚ ছয় বছরেও ও পারবে না তোকে বিয়ে করতে। সামনের বছরই দেখা গেল দাদী ধরে বেঁধে ফারনাজ ভাইয়ের ঘরে পাঠায় দিছে তোকে।”
“ধুর”‚ বিরক্ত দেখাল সানাকে। “কীসের মধ্যে কী বলিস? দাদী চাইলেই সব হবে নাকি?” কোনা চোখে একবার বোনের মুখটা দেখল সে৷ এতক্ষণ আমোদে থাকা মেহার চেহারাতে মলিনতা ভিড় করেছে। তা দেখে সানা জোরালভাবে দিনাকে বলল‚ “আমি তো যাবই না ফারনাজ ভাইয়ের ঘরে। আর তার চেয়েও বড়ো কথা আব্বু-আম্মু আর কোনোদিও রাজি হবে না এই প্রস্তাবে৷ আব্বুর আত্মসম্মানবোধ কত কঠিন জানিস না? সবাই ভুলে গেলেও বড়ো কাকির বলা সেদিনের কথাবার্তা আব্বু ভোলেনি। এখন বড়ো কাকা যদি এসে পায়েও ধরেন আব্বুর‚ তাও আব্বু রাজি হবে কিনা সন্দেহ। তাই এই বিষয় নিয়ে আর মজা নিস না তো।”
“কালকে সকালে ফারনাজ ভাই বাসায় আসছে”‚ কথাটা জানাল মেহা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে নির্বিকার স্বরেই।
“তাই নাকি?” দিনা বলে উঠল‚ “অনেকদিন পর দেখা হবে ভাইয়ার সঙ্গে।”
সানা কোনো কথা বলল না আর এ ব্যাপারে। এর মাঝেই পাশের ঘর থেকে নাজমা বেগমের ডাক এলো রাতের খাবারের জন্য।
***
বেলা ১১:১৫
জেসমিন ভিডিয়ো কলে বড়ো জায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছেলের ঘরে ঢুকলেন৷ শারফান ঘুমিয়ে আছে চিত হয়ে বাচ্চাদের মতো হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে। পরনে গতকালের পোশাকই। মাঝরাত পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে কোথায় বসে আমোদ‚ ফূর্তি করেছে কে জানে! গা দিয়ে মদের গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি‚ রাতে যখন ঘরে ঢোকার সময় দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন৷ ছেলে নেশা করে এ কথা দূরে বসেই শুনেছেন এতকাল৷ গতকাল হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলেন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ওই মাঝরাতেই। শারফান হুঁশেই ছিল। মাতাল হওয়ার মতো নেশা সে করেনি। কারণ‚ মাথায় ছিল সে এখন বাড়িতে আছে৷ গতকাল বাপ আর চাচা তাকে শেয়ার লিখে দিয়েছে পঁচিশ পার্সেন্ট। এই খুশি উদযাপন করতেই বন্ধুদের নিয়ে একটু মৌজ‚ মস্তি করেছিল আরকি৷
যদিও চল্লিশের কথা বলেছিল সে৷ তবে সেটা মুখে মুখেই বলেছিল কেবল৷ কারণ‚ নিজেদের থেকে বেশি শেয়ার ওকে দেওয়া হবে না তা সে জানতই। মূলত এই পঁচিশের মালিকই হতে চেয়েছিল সে। পঁচিশের কথা বললে দেখা যেত শাফিউল সাহেব পনেরো পার্সেন্টও দিতেন কিনা সন্দেহ।
মাকে কোনোরকমে শান্ত করে‚ আশ্বাসবাণী দিয়ে তারপর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ করার কথা মনে ছিল না বিধায় জেসমিন এখন ভেতরে আসতে পেরেছেন৷
“আপা‚ ঘুমাচ্ছে আপনার ছেলে এখনো৷ ঘুম থেকে জাগলে আমি কল করতে বলবানে আপনাকে।” বললেন জেসমিন বড়ো জা হাফসাকে৷ জবাব এলো তারপর হাফসার থেকে আহ্লাদিত সুরে‚ “একটু ফোনডা ঘুরাও দেহি আমার হবু জামাইবাবার দিকে। কতদিন দেহি না অরে! এক ঢাকায় থাইকাও পোলাডা আসে না একবার চাচি আম্মারে দেখবার।”
পেছন ক্যামেরাতে কীভাবে দেখায় তা বোঝেন না জেসমিন। এমন বড়ো বড়ো টাচ মোবাইল আজ-কাল নতুন নতুন সবাইকেই ব্যবহার করতে দেখেন৷ কিন্তু তিনি অভ্যস্ত হতে পারছেন না৷ তাই সামনের ক্যামরাতেই দেখানোর চেষ্টা করলেন ফোনটা শারফানের দিকে ঘুরিয়ে৷ মায়ের পাশেই বসে ছিল মিথি। শারফানকে দেখা যাচ্ছে তা দেখতে পেয়েই দ্রুত উঁকি দিলো ফোনের স্ক্রিনে৷ কিন্তু চোখ‚ কপাল প্রায় ঢেকে আছে শারফানের ওর বড়ো বড়ো চুলগুলোতে। জেসমিন ছেলের শিথানে বসে সযত্নে কপাল থেকে সরিয়ে দিলেন তা৷ মিথি তখনই বলে উঠল‚ “কাকি‚ ভাইয়াকে চুল কাটতে বলেন না কেন?”
“ও কি কারও কথা শোনে রে‚ মা?” হেসে বললেন জেসমিন‚ “চুলের কথা তো বলায় যায় না ওকে৷ এই চুলের জন্য স্কুলে থাকতে কত মার খেয়েছে তোর কাকার কাছে! এখন কি আর সেই শাসন করা যায়?”
“আমার পোলার বয়সই বা কত হইছে রে?” হাফসা সেই আহ্লাদ জড়ানো গলাতেই বললেন‚ “পোলাপানি বুদ্ধিসুদ্ধি এহনো যায় নাই তাই৷ ঘরে বউ পাওনের পর দেহিস সব ঠিক হইয়া যাইব।”
লাজুক হলো মিথি৷ সরে গেল সে ফোনের সামনে থেকে। শারফান আর তাকে নিয়ে দুই জা নানান জল্পনা-কল্পনা করতে থাকলেন এরপর৷ শামসুল সাহেব শেয়ার লিখে দেওয়ার পর থেকে শারফানের প্রতি তার পরিবার আলাদা অধিকারবোধ অনুভব করছেন৷ মেয়ের জামাই করা হবে বলেই তো ভাতিজাকে শেয়ার দিতে বেশি ভাবলেন না—এমনই চিন্তাধারা তাদের। তাই তারা ধরেই নিয়েছেন শারফান আজ থেকে তাদের বাড়ির জামাই পুরোপুরি।
শাকিবুল সাহেব ছোটো ভাই শাফিউলের মতো ফরিদপুর থাকেন না পরিবার নিয়ে৷ ঢাকাতে বসবাস শুরু করেছেন বহু বছর আগে থেকেই৷ কিন্তু শাফিউল সাহেব ফরিদপুরের মায়া কাটাতে পারেননি৷ তাই যতই দৌড়াদৌড়ি করতে হোক ঢাকাতে। তবুও ফরিদপুর ছেড়ে চিরতরে ঢাকায় বসবাসের কথা ভাবতেই পারেন না নিজের বাবা-চাচার মতোই। ছেলেকেও ঢাকাতে পড়তে পাঠাতে একদমই রাজি ছিলেন না। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর প্রায় সকল বন্ধুরা ঢাকায় পড়তে চলে যাচ্ছিল দেখে শারফান এমন জেদ ধরেছিল যে‚ বাধ্য হয়েই ওকে পাঠাতে হয়েছিল বড়ো ভাইয়ের কাছে৷ কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পর ছেলে আরেক জেদ ধরল বন্ধুদের সাথে মেসে থাকবে আর নয়ত আলাদা ফ্ল্যাটে তুলে দিতে হবে ওকে৷ চাচার বাসায় নাকি প্রাইভেসি সমস্যায় ভুগছিল সে৷ এক্ষেত্রে অবশ্য শাফিউল সাহেব তেমন অরাজি ছিলেন না। ব্যবসার কাজে তাকেও গিয়ে থাকতে হত ভাইয়ের বাসায়৷ ছেলের কথাতে তিনি প্রয়োজন অনুভব করলেন ঢাকাতে স্থায়ীভাবে থাকা হোক বা না হোক। নিজেদের আলাদা একটা বাড়ি থাকা অবশ্যই প্রয়োজন৷ এরপরই শারফানকে আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়ে ওকে একা থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো৷ বছর তিন গেলে দ্বিতীয় আরেকটি বাড়ি করলেন তিনি ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশে। সে বাড়ি বর্তমান চারতলা। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। ব্যবসা থেকে যতটুকু যা মুনাফা পেতেন শাফিউল‚ তা বেশিরভাগ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির কাজেই ব্যবহার করে এসেছেন৷
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাকিবুল সাহেব এমপি নির্বাচিত হলে তিনি ব্যবসাতে তেমন সময় দিতে পারছিলেন না৷ একা একা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন শাফিউল৷ ওদিকে ছেলেটাও দিন দিন বখে যাচ্ছে। এ দুই চিন্তা থেকেই ছেলের কাঁধে অল্প বয়সে বড়ো দায়িত্বের ভার তুলে দেন৷ ছেলে যতই উচ্ছন্নে যাক‚ মনের কোথাও একটা ছেলের প্রতি বিশ্বাস কাজ করত তার৷ তাই ম্যানেজারের চেয়ারে ওকে বসাতে তেমন ভয় পাননি৷ এই বিশ্বাসটুকুর কারণ আছে অবশ্য৷ সেটি হলো তার ছেলের মাঝে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতার গুণ আছে কিনা!
***
নিজের গাড়ি বাড়িতে রেখে এসে বাবার সাদা হাইস গাড়িতে চড়ছে শারফান। গাড়িতে বসা বন্ধু-বান্ধব সকলে নির্বাচনি নানান কথায় ব্যস্ত। কিন্তু সে চুপচাপ সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে৷ লম্বা সোজা চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে চোখে-মুখে পড়ে বিরক্ত করছে৷ সেটাও আপাতত চুপচাপ সহ্য করছে সে।
ঘুম ভালো না হওয়ায় আর মাথা ব্যথায় মন-মেজাজ জঘন্যভাবে চটে আছে ওর৷ আয়তাকার কালো চোখজোড়া রক্তজবার মতো‚ দাড়িতে ঢেকে থাকা ডিম্বাকৃতি মুখের চোয়ালও কঠিন হয়ে আছে। চুলগুলোতেও এখন অবধি চিরুনি চালানোর সুযোগ হয়নি। কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে সঙ্গী-সাথী নিয়ে বের হতে হয়েছে চাচার প্রতীকী প্রচারের কাজে৷ জায়গায় জায়গায় বিলবোর্ড আর পোস্টার টাঙানোর কাজও দেখতে হচ্ছে৷ কিন্তু সবটাই করছে সে তিক্ত মেজাজ নিয়ে।
এখন এসে ঢুকল ওদের গাড়িটা বন্ধু সোহানের এলাকাতে। গাড়ি থেকে নেমে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে শারফান সোহানকে কল লাগাল। সে সময়ই আরেকটা হাইস গাড়ি এসে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল ওর গাড়ির মুখোমুখি। ফোন কানে ধরেই হালকা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল শারফান সেদিকে৷ নেমে এলো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে ফরসা মতো একটা পুরুষ৷ খোঁচা দাড়ি মুখে‚ চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা। কিন্তু ওর মতো স্টাইলিশ করতে পারেনি লোকটা। চোখে কালো রোদচশমা তার৷ স্বাস্থ্য অবশ্য ওর মতোই কিছুটা ভারী। কেবল উচ্চতায় ওর থেকে কম একটুখানি৷ পাশ থেকে সাদ্দাম কানে কানে বলল‚ “চিনস নাই? ফারনাজ ভাই। স্বতন্ত্রে দাঁড়ানো সেই ফারনাজ কবির।”
তাকে শারফান দেখেছে বোধ হয় বহু আগে। কিন্তু মুখটা বিশেষ খেয়ালে ছিল না৷ তার পোস্টারও এখন অবধি চোখে পড়েনি। সাদ্দাম বলার পর সে মনে করতে পারল ফারনাজকে।
চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে গাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়েই ফারনাজ শারফানের উদ্দেশে রুক্ষস্বরে “ওই” করে উঠল। আঙুলের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল‚ “শাফিউল হকের পোলা না তুই? এদিকে আয়।”
সোহান কল রিসিভ করেছে৷ প্রখর রোদের কারণে শারফান চোখ কুঁচকে ফারনাজের দিকে চেয়েই কথা শুরু করল ফোনে‚ “উঠিস নাই এখনো?” সোহান জবাব দিলে তাকে নিজের ভরাট কন্ঠে জানাল‚ “তোর বাড়ির রাস্তায় আমার গাড়ি৷ ওয়েট করছি।”
ফারনাজ শক্ত চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকল তার ডাক অবজ্ঞা করা শারফানের আচরণ। কী মনে করে নিজেই এগিয়ে এলো সে। সাথে এলো তার শাগরেদগুলোও৷ শারফানের হাতে থাকা আইফোন সিক্স প্লাস ফোনটা দেখে সে কিছুটা ওজন করতে পারল ওকে। ফোনটা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সহজলভ্য হয়নি বোধ হয়৷ তার আগেই ছেলে ব্যবহার শুরু করেছে! দেশের বাইরে থেকে এনেছে বোধ হয়। টাকার দাপট সাথে নিয়ে চলে ছেলে। বেশ বুঝতে পারল ফারনাজ। ভারী শরীর আর চেহারার বেপরোয়া ভাব দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপই তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল ঠান্ডাভাবেই‚ “এই ওয়ার্ডের ভোট ফারনাজ কবির ছাড়া অন্যদিক ঢুকবে না। সেটা মনে হয় শাকিবুল হক জানায়নি তোকে। আচ্ছা সমস্যা নাই৷ আসছিসই যখন তখন ঘোরাঘুরি কর কেবল…” ভ্রু উঁচু করে আঙুলের ইশারায় মসজিদের অপরপাশে থাকা বাড়িটাকে দেখাল‚ “ওই সৈয়দ বাড়ির গেট পার হবি না৷ আমি এই এলাকায় থাকি বা না থাকি। কিন্তু এখানে নতুন কে আসলো‚ এসে কোথায় কী করল‚ সবই নিউজ হয়ে আসে আমার কাছে। তো মনে থাকবে কী বললাম? শেষবারের মতোই বললাম কিন্তু।”
পেছনে থাকা শারফানের বন্ধু আর চ্যালাগুলো মনে মনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল৷ এমন হুমকি-ধমকি‚ আদেশসূচক কথাবার্তা শারফান গায়ে সওয়াতে পারে না তেমন ছোটো থেকেই। আর এখন কিনা সেটাই ওকে শুনতে হচ্ছে চাচার প্রতিদ্বন্দীর থেকে! তফসিল ঘোষণার পর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় খুনোখুনির ঘটনা ঘটে গেছে৷ ফরিদপুরও যে আজকে থেকে গরম হবে তা বুঝতে বাকি নেই কারও৷ আহারে! উচিত ছিল এমন কিছুর প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামা। কী ভুলটাই না করল তারা! ফারনাজ কবির নিশ্চয়ই এ বোকামি করেনি? কিন্তু শারফান যদি শুরু করে হাতাহাতি‚ তারা কি আর চুপচাপ কেটে পড়তে পারবে? সাদ্দাম আর রিপন ভাবল কানে কানে বলবে শারফানকে আপাতত শান্ত থাকতে। কিন্তু তা বলতে হলো না। তাদের ভয়মুক্ত করে শারফান চুপই থাকল ফারনাজের দিকে চেয়ে৷ ওকে চুপ থাকতে দেখে ফারনাজও কথা বাড়াল না আর৷ বিদায় নিলো সে। সে সময় দেখা গেল গলি থেকে বেরিয়ে আসছে সোহান শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে। সানার বাড়ি পার হওয়ার আগেই শারফান গলা ছেড়ে বলে উঠল‚ “ওখানেই দাঁড়া।”
ছেলে-পুলেদের যে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল তা শুরু করতে বলে সে এগিয়ে এলো দুই বন্ধুকে নিয়ে সোহানের কাছে৷ “ঢোক সৈয়দ বাড়ি”‚ সোহানের হাতে ইশতেহারের কাগজগুলো তুলে দিয়ে বলল বন্ধুদের।
“ফারনাজ বান** চাচার বাড়ি ঢুকতে নিষেধ করল কী কারণে? আমাদের চেহারা দেখে ওর চাচার বাড়ির ভোট কি আমাদের হয়ে যাবে ভাবছে?” বলে উঠল রিপন।
কথাটা শুনে সোহান অবাক হয়ে শারফানকে জিজ্ঞেস করতে যাবে ব্যাপারটা‚ তার আগেই শারফান একটা সিগারেট বের করে জ্বালাতে জ্বালাতে উত্তর দিলো‚ “মনে হয় ওর না হওয়া শ্বশুরের মেয়ের সাথে গতকাল ফাইজলামি করেছি। সেন্টুর মতো ছ্যাঁচড়া স্পাই সেটাই ওর কানে তুলে দিয়েছে।”
“ফারনাজ ভাইয়ের সাথে কোথায়‚ কখন কথা হলো তোর? কী বলছে তোকে?”
অবাক সোহানের প্রশ্নগুলো না শোনার মতো করে শারফান সানার বাসার দিকে এগোলো। সিগারেট দু আঙুলের ফাঁকে ধরা। এখনো টান দেয়নি তাতে। ফারনাজের কথায় মাথাটা বেজায় গরম হয়ে আছে ৷ তবুও কিছু একটা ভেবে সে নীরবেই হজম করে গেছে হুমকিটা। কিন্তু ভুলবে না।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৫.
সানাদের বাড়ির দোতলার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ শুরু হতে আরও দু বছর দেরি৷ তাই ছাদটাকে ফুল গাছের ছোটো একটা ছাদবাগানে তৈরি করেছে সানা। নাজমা বেগম এর ফাঁকে অবশ্য একটা‚ দুটো সবজি গাছও রোপণের ব্যবস্থা করেছেন।
ভালো রোদ লাগবে এমন জায়গাতে টবগুলো পরিবর্তন করে রাখতে ব্যস্ত সানা। দিনাও একটু আধটু সাহায্য করছে ওকে৷ কেবল মেহা ছাদের কোনায় বসে বোনের সদ্য কেনা টাচ ফোনটাতে বোনেরই ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঘোরাফেরা করছে।
দুপুর প্রায়। সৈয়দ মোস্তফা কলেজে আছেন এখন। সানার মা আর দাদী বড়ো উঠানের এক পাশে বানানো ঢেঁকিঘরে চাল ছাঁটাতে ব্যস্ত৷ গ্রামের খুব ভেতরে ছাড়া ঢেঁকি দেখা যায় না৷ কিন্তু সানার দাদীর জন্য ছোটো ছেলে মোস্তফা শহরাঞ্চলে বসবাস করেও বাড়িতে ঢেঁকিকলের ব্যবস্থা রেখেছেন অনেক আগে থেকেই৷ ছেলেবউ হয়ে নাজমা বেগমও শাশুড়িকে খুশি রাখার জন্য বাজারে মেশিনের পরিবর্তে ঢেঁকিই ব্যবহার করেন।
এর মাঝেই শারফান বাসার মূল ফটক খোলা পেয়ে নির্দ্বিধায় ভেতরে ঢুকে পড়ল হনহনিয়ে। ঢুকেই সোহানকে ইশারা করল ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে।
“কাকা‚ আছেন বাসায়?” দরজায় ঠকঠক করে ডাকল সোহান।
নিচতলায় কেউ এসে ডাকাডাকি করছে তা মেহা শুনলেও কোনো কথা বলল না। ভাবল‚ মা গিয়ে দেখবে। মিনিট দুই যেতে সোহান আবারও ডেকে উঠলে নাজমা বেগম শুনতে পেলেন। তিনি চেঁচিয়ে মেয়ে দুজনকে বললেন‚ “এই সানা‚ মেহা। গিয়ে দ্যাখ তো কে আসলো?”
“মেহা‚ নামিস না কেন?” সানা বলে উঠল।
আরামে বসে ছিল। এখন আবার নিচে নামতে হবে দেখে বিরক্ত হলো মেহা৷ মনটাও তার কেন যেন ভালো নেই ফারনাজের দেখা পাওয়ার পর থেকে। সিঁড়ি বেঁয়ে নেমে আসতে আসতে দেখল ঘরের সামনে চারজন ছেলেকে। সে মুখোমুখি দাঁড়াল সোহানের‚ “কী চাই?”
“বাসার বড়োদের কাউকে”‚ জবাব দিলো সোহান‚ “মোস্তফা কাকা নেই বাড়িতে?”
“না‚ আব্বু নেই। কিছু বলার থাকলে বলেন৷ আসলে জানিয়ে দেবো।”
“তুমি তাহলে তোমার আম্মুকে আর দাদীকে একটু ডেকে আনো‚ আপু৷ ওনাদের সাথে কথা বললেই হবে।”
সোহানের হাতে ছাতা মার্কার লিফলেট দেখে তার মিষ্টি আচরণও বিরক্ত লাগল মেহার‚ “ওওও… ভোট চাইতে আসছেন? জানেন না ফারনাজ ভাইয়ের চাচার বাড়ি এটা? তাকে রেখে আপনাদের ছাতাতে ভোট দিতে যাবে কে এ বাড়ি থেকে? হুদাই সময় নষ্ট করতে আসছেন‚ ভাই। মাফ করেন‚ অন্য জায়গায় চেষ্টা করেন।”
সোহানের মৃদুহাস্য মুখটাই অপমানের আঁচ লেগে হাসিটা বিব্রতকর হাসিতে পরিণত হলো৷ সাদ্দাম আর রিপনকেও দেখাল হতবুদ্ধি। ওরা কি ফকির? চাল‚ ডাল ভিক্ষা করতে আসছে নাকি যে ফকিরদের বলা ডায়ালগ মারছে মেয়েটা?
এদিকে শারফান দাঁতে দাঁত চেপে শুনে যাচ্ছিল ফারনাজকে নিয়ে বলা মেহার কথাগুলো। কিন্ত শেষ কথাতে আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না সে‚ “চোপ! বালপাকনা পোলাপান”‚ মস্ত এক ধমক লাগিয়ে বলল‚ “যাও গিয়ে বড়োদের ডেকে আনো। যাও!”
কেঁপে উঠে বুকের ভেতরের ছোট্ট হৃদযন্ত্রটা বন্ধ হয়ে গেল মনে হলো মেহার। শারফানের হৃষ্টপুষ্ট দেহের প্রশস্ত বুক‚ উঁচু স্কন্ধ‚ মোটা বাহু‚ লাল দুটি চোখ‚ এলোমেলো বড়ো বড়ো চুল‚ রাগে শক্ত হয়ে থাকা চোয়াল আর সিগারেটপোড়া কালচে প্রায় পুরু ঠোঁটদুটো দেখে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাসই করে নিলো‚ শারফান সন্ত্রাস বাহিনীর বস। চল্লিশ কেজির পাতলা শরীরটা নিয়ে ভয়ে‚ আতঙ্কে ফড়িঙের মতো উড়াল দিলো সে ছাদে। বোনের কাছে ছুটে এসে জানাল ভীত স্বরে‚ “এই আপু‚ ছাতা মার্কাওয়ালা ওই ব্যাটা এক সন্ত্রাস লিডারকে পাঠিয়েছে ভোট আদায় করার জন্য৷ কী ভয়ঙ্কর গলায় আমাকে ধমক মারল বালপাকনা পোলাপান বলে! যেয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয় প্লিজ। আমি ভয়েই দৌড় দিয়েছি।”
“হ্যাঁ!” বিস্মিত হয়ে হাতে লাগা মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে সানা উঠে দাঁড়াল‚ “সিরিয়াসলি সন্ত্রাস লিডার আসছে? তোকে বালপাকনা মেয়ে বলেছে?”
“সাথে আবার এলাকার সোহান পোলাডাও আছে।”
“এই‚ তাহলে সন্ত্রাসের সাথে সোহান কী করবে?” দিনা কপাল কুঁচকে বলল সানাকে‚ “তোর বোনই দ্যাখ কী বলে এসেছে ওদের উলটোপালটা।”
“উলটোপালটা বললেও ভোটা চাইতে এসে ধমক লাগাবে কেন? বালপাকনা পোলাপানই বা বলে কোন সাহসে?” ওড়না ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে নিচে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সানা।
“ধর এই বালছাল”‚ লিফলেটের কাগজগুলো সাদ্দামের কাছে ছুঁড়ে দিলো শারফান‚ “আমি বের হয়ে যাচ্ছি।” বলে সত্যিই বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো সে।
কেউ বাধা দিলো না ওকে। ও থাকলে ওর মুখ থেকে আর ভালো কথা বের হবে না এই মুহূর্তে। তার থেকে ওর চলে যাওয়ায় ভালো মনে করল সবাই।
“কী হয়েছে আপনাদের?”
সহসা আরেক নারী গলা পেয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকাল সোহানরা। সানা দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়িতেই। গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল‚ “ভোট চাইতে আসছেন ভালো কথা। ধমকা-ধমকি‚ গালাগালি করে ভোট নিতে চান না-কি?”
গেটের বাইরে সবে এক পা এগিয়েছিল শারফান। ওভাবে দাঁড়িয়েই ঝট করে ঘাড় ঘুরাল সে সানার কণ্ঠ পেয়ে।
“ওহ সানা?” সোহান অপ্রস্তুত হেসে বলল‚ “স্যরি আপু। আমার বন্ধু একটা কারণে রেগে ছিল তো। তাই তোমার ছোটোবোনের কথাবার্তা শুনে সিন ক্রিয়েট করে ফেলছিল একটু৷”
“কী এমন বলেছিল ও আপনাদের?” ভ্রু বাঁকা হলো সানার।
“ওই আরকি… তোমরা ফারনাজ ভাইয়ের রিলেটিভ। তাই ফারনাজ ভাইকে ছাড়া ছাতাতে ভোট দেবে না বলে আমাদের চলে যাইতে বলছিল।”
“চলে যাইতে বলছিল যেমনে ভিক্ষুকদের বিদায় করে মানুষ। মাফ করেন‚ অন্য জায়গা চেষ্টা করেন”‚ নালিশ গলায় কথাটা জানাল সাদ্দাম।
এবার সানা হলো অপ্রস্তুত। দিনাও সঙ্গেই ছিল ওর৷ সাদ্দামের কথাটা শোনা মাত্রই সে ফিক করে হেসে ফেলল। নম্র গলায় তখন বলল সানা‚ “ভাইয়া‚ ও ছোটো মানুষ। কিছু মনে কোরেন না আপনারা। হিসেবে আবার ওর কথা ভুলও ছিল না৷ ক্যান্ডিডেটের নিজের বাড়ির লোক তো আর বাইরে ভোট দেবে না। কিন্তু ওর বলার ওয়ে আরকি ভালো হয়নি।”
“অথচ ভোটটা দেওয়া উচিত জনগণের যোগ্য প্রার্থীকে”‚ বলতে বলতে গেটের কাছ থেকে আকস্মিক ফিরে এলো শারফান। “পরম আত্মীয় যদি অনভিজ্ঞ‚ অযোগ্য হয়। কেবল আত্মীয়তার দোহাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোটগুলো নষ্ট হতে দেওয়া উচিত?”
বিদ্যুৎ গতিতে গেটের দিকে তাকাল সানা৷ মেহাও দাঁড়িয়েছিল ওপরের সিঁড়িতে। তবে তকে দেখতে পাচ্ছিল না কেউ। শারফানের গলা শোনা মাত্রই সে “ওই লোক‚ আপু! ওই লোকই সন্ত্রাস!” বলে চেঁচিয়ে উঠল ওপর থেকে।
বোনের কথায় আবার সানা বিব্রত হয়ে পড়ল ছেলেগুলোর সামনে। মেহার কথাতে সোহানদের সবার নজরই একবার ওপরে গেল। শারফানকে সন্ত্রাস বলতে দেখে হাসল তারা। হাসতে হাসতে শারফানকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলল সোহান।
তবে সানার কাঁচুমাচু হওয়া চন্দন বর্ণের চৌকা মুখটা হলো দেখার মতো। শারফানের প্রচণ্ড ভরাট কণ্ঠটা গতকাল একবার শুনেই যেভাবে মনটা ধাক্কা খেয়েছিল ওর‚ এখন দ্বিতীয়বার এত কাছ থেকে শুনে গতকালের চেয়েও দ্বিগুণ জোরে খেল ধাক্কাটা। আবার মেহার কথাকেও গুরুত্ব দিতে বাধ্য হলো। দাম্ভিক পদচারণা শারফানের৷ এসে দাঁড়িয়েছে সোহানের পাশে। তাকে আগাপাছতলা দেখতে দেখতে সত্যিই ওরও মনে হলো‚ এ ছেলে সন্ত্রাস লিডার হলেও হতে পারে। অত্যধিক জলদগম্ভীর যে কণ্ঠ শুনে সে মুগ্ধ হয়েছিল সেই কণ্ঠ আর শারীরিক কাঠামো‚ চেহারার ভাবগতিও আসলেই সুবিধার ঠেকছে না তাকে সামনাসামনি দেখে।
শারফানও স্থিরভাবে দেখছে সানাকে ওপর-নিচ‚ সবটাই জহুরি দৃষ্টিতে। এমন দৃষ্টির মুখে পড়ে সানা শুধু ভেতরে ভেতরেই না‚ বাইরে থেকেও গুটিয়ে যেতে চাইলো৷ আড়ষ্টতায় আড়ালে দিনার হাতটা চেপে ধরে সোহানকে বলল‚ “আম্মুকে ডেকে আনছি। আম্মুর সঙ্গে কথা বলেন আপনারা।”
“আর ডাকতে হবে না”‚ জবাব দিলো শারফান স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তাতেও চমকাল সানা। তীক্ষ্ণ নজর তো ফেলছেই না লোকটা ওর ওপর থেকে। তাছাড়াও শারফানের সাধারণ‚ স্বাভাবিক কথাবার্তাও যেমন শোনায়‚ গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাও তেমনই শোনায়।
সোহানের হাত থেকে দুটো লিফলেট নিয়ে সে এগিয়ে ধরল সানা আর দিনার উদ্দেশে। যে ধরে নেবে আরকি৷ দিনা ধরল না দেখে সানাই ধরল কাগজদুটো৷ সে সময় একবার ভুলবশত শারফানের একরোখা চাউনিতে চোখ পড়তেই শারফান বলে উঠল‚ “ফারনাজ কবিরকে এবার দল থেকে নিষেধ করেছিল দাঁড়াতে৷ কিন্তু সে সরাসরি নেত্রীকেই অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলো৷ একই দলে রেষারেষি করে চলা লোকের বুদ্ধি‚ বিবেচনায় ঘাটতি থাকে।”
“আচ্ছা‚ থাক এসব কথা”‚ সোহান বন্ধুকে দ্রুত বাধা দিলো‚ “এসব বড়োদের কথাবার্তা। ওদের এসব বলছিস কেন?” সানাকে বলল‚ “আমরা আসি। কাকা আর কাকিকে আমার সালাম জানাইয়ো‚ ঠিক আছে?”
সানা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাল। কিন্তু শারফানের সাংঘাতিক নজরে আটকে থাকায় বুঝতে পারল না ওর মাথাটা নড়েইনি।
বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেও শারফান পেছন ফিরে সানাকে দেখে নিলো একবার ঠান্ডা চোখে। তাতে জমে যাওয়া সানার ভীত মনটা বলল‚ “আমার পান্থই ভালো… আমার পান্থর চিকন গলায় ভালো।”
“ওই দ্যাখ সেন্টু হারামজাদা”‚ রিপন দেখাল মসজিদ থেকে বের হতে থাকা সেন্টুকে। সেন্টুও দেখল শারফানদের সানার বাসা থেকে বের হতে৷ তাকে ডাকার আগে সে-ই এক গাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো শারফানের কাছে, “আসসালামু আলাইকুম‚ শায়াফ ভাই।”
পকেটে ডান হাত পুরে দাঁড়িয়ে পড়ল শারফান। সেন্টু হাসি মুখে বাকিদেরও সালাম দিলে সাদ্দাম বিড়বিড়িয়ে বলল সোহানকে‚ “শেয়াল যখন বাটপারি করতে সিংহের কাছে আসে।”
হাসল সোহান ঠোঁট টিপে। শারফান জিজ্ঞেস করল সেন্টুকে‚ “কয় রাকাআত পড়লি নামাজ?”
“জোহরের যে কয় রাকআত পড়া লাগে ভাই”‚ ক্যাবলা হাসিটা হাসতে হাসতে বলল সেন্টু।
“কয় রাকাআত পড়া লাগে?” শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করল শারফান। কিন্তু সেন্টু বিপদের আভাস বুঝল যেন কীভাবে। দাঁত বের করা হাসিটা তার বিদায় নিলো চট করেই। ইতিউতি চেয়ে বলল‚ “ইয়ে… ভাই‚ আট রাকাআত মনে হয়।”
‘মনে হয়’ কথাটা পরিষ্কার শোনা গেল না সেন্টুর৷ আট বলা মাত্রই বেচারা “উঁমাগোওওও” করে উঠে গরম হয়ে ওঠা গালটা চেপে ধরল… ছিটকে সরে এলো শারফানের থেকে দূরে৷ হাতটা সরালে বাকিরা দেখতে পেত কালো হয়েও ওই গালে শারফানের আঙুলের ছাপ পড়ে গেছে।
“এদিকে আয়”‚ ডাকল শারফান সেন্টুকে। ব্যথায় সেন্টুর চোখ টলমল করছে৷ ভয়ে সে এক পাও এগোলো না৷ ধমক লাগাল শারফান‚ “কাছে আয়‚ বোকা**।”
ভীত পায়ে কিছুটা কাছে এসে দাঁড়াল তখন সেন্টু৷ তাকে জিজ্ঞেস করল শারফান “শুনবি না মার খেলি কেন?”
সেন্টু কোনো কিছুই বলল না। গালটা চেপে ধরেই কান্না চোখে তাকিয়ে থাকল শারফানের দিকে৷ শারফান তাই নিজেই জবাব দিলো‚ “নামাজ কয় রাকাআত তার উত্তর ভুল দিয়েছিস। ঠিকঠাক জেনে তারপর নামাজে যাবি‚ বুঝেছিস?”
মাথা ডানে কাত করে সায় দিলো সেন্টু। তারপর তাকে বলল শারফান‚ “আমার বাপের বাসার কেয়ারটেকার হয়ে বেতন পাস যা। তা আর পাবি না তুই৷ তোর চাকরি নট।” বলেই আর দাঁড়াল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল গাড়ির দিকে৷ এক পলকের ভেতর হঠাৎ চাকরি হারিয়ে সেন্টু প্রতিক্রিয়াটুকুও দেখানোর সুযোগ পেল না। শারফানের পেছনে ছুটল আহাজারি করতে করতে।
এই পুরোটা দৃশ্য ছাদে দাঁড়িয়ে দেখল সানারা তিন বোন। ওদের বিস্মিত হওয়া চেহারাগুলো দেখে মনে হচ্ছে সেন্টুকে দেওয়া থাপ্পড়ের ওজন কতটা ভার ছিল তা ওরা ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেই মেপে নিতে পেরেছে। দিনা আর মেহা শারফানের চলে যাওয়া গাড়িটার দিকেই তাকিয়ে তখনো। এর মাঝে সানা বিস্ময় কণ্ঠেই স্বগতোক্তি করে উঠল‚ “কেবল নামাজের ওয়াক্ত ভুল বলার জন্য এরকম বিরাশি সিক্কার চড় দিলো!”
“এই শালা সেকেন্ড টাইম ভোট চাইতে আসলে তোরা দুজন আর সামনে যাবি না কিন্তু”‚ দিনা সতর্ক গলায় বলল‚ “শালার চোখ ভালো না। তোকে যেমনে দেখছিল… যেতে যেতেও ঘুরে দেখছিল”‚ সানার দিকে ভয়ার্ত চোখ করে তাকাল সে‚ “মনে হচ্ছিল তোর বডি পার্টস চোখ দিয়েই গিইল্লা খাচ্ছে।”
“গেটই খুলব না শালার ব্যাটারে দেখলে”‚ আক্রোশ নিয়ে বলল মেহা চকিতে। কিন্তু সানা নির্বিকার৷ ওর বিস্ময় কেটে গিয়ে এবার কৌতূহল জেগেছে শারফানকে নিয়ে।
***
শীতের বেলা ছোটো হওয়ায় আর শীতে ঠান্ডার সমস্যা প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় শীতকাল সানার কাছে বিরক্তিকর। রিয়ার কল পেয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টা হলো রিয়ার বাসায় এসেছে সে। আরও দুজন বান্ধবীও এসেছে। উদ্দেশ্য ছিল সবার গ্রুপ স্টাডি করা৷ কিন্তু বান্ধবীরা একত্র হলে বাড়তি সময়ও তো প্রয়োজন আড্ডার জন্য৷ আড্ডা দেওয়া শেষে অঙ্ক করতে বসতে না বসতেই সন্ধ্যা লেগে গেল। তেমন কিছুই করতে পারেনি। বাসায় ফিরে বাবা তো রাতে এই খাতা ওলট-পালট করে দেখবে‚ কী অঙ্ক করে এসেছে তার মেয়ে। চিন্তা তাই এটাই সানার‚ কী দেখাবে সে বাবাকে? বিরক্তি আরও বাড়ল কারেন্ট চলে যাওয়ায়৷ চার্জার লাইটটা নিয়ে ওরা যাওবা কাজ চালাচ্ছিল। কিন্তু হট্টগোল বেঁধে গেল অনির ঘরে। এসে চার্জার লাইটটা নিয়ে গেল অনি৷ রিয়া তাই পিছু পিছু দেখতে গেল এই অবেলায় ভাইয়ার ঘরে একগাদা ছেলেদের কাজ কী? আজ তো কোনো ছাত্র পড়াবে না বলে গতকাল শুক্রবারে পড়িয়ে দিয়েছে অনি সবাইকে৷ একটু পর ফিরে এসে জানাল সে বান্ধবীদের‚ “ভাইয়ার বন্ধুরাসহ আরও অনেক পোলাপান। নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আলোচনা‚ কথাবার্তা চলছে।”
“তাহলে আজ আর হবে না”‚ রত্না বলল জুঁইকে‚ “কী করবি? চল‚ বের হয়ে পড়ি আমরা৷ যাওয়ার পথে বাজার করে নিয়ে যাবনে।”
ওরা দুজন মেসে থাকে। জুঁই রিয়া আর সানাকে বলল‚ “এজন্যই বলছিলাম তোরা আমাদের মেসে আয়।”
“ওয়াসিত্ব টাওয়ার আর আমার বাসার দূরত্ব জানিস‚ ছাগল?” সানা বলল‚ “রিয়ার তো তাও কিছুটা কাছেই৷ আমার কি কাছে?”
“আচ্ছা আজকের মতো যা তোরা। পরের সপ্তাহে বসবানে আবার।” জুঁই আর রত্নাকে বলেই রিয়া সানাকে জিজ্ঞেস করল‚ “একা যেতে পারবি?”
“পারব না কেন?”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো। নাকি আঙ্কলকে ফোন দিয়ে বলবি এসে নিয়ে যেতে?”
“আরে অন্ধকার তো হয়ে যায় নাই। একাই যেতে পারব।”
“না‚ দাঁড়া৷ তোর বাপের ভয় আছে আমার। অনি ভাই ফ্রি হবে কখন শুনে আসি। তারপর আমি আর ভাইয়া তোকে এগিয়ে দিয়ে আসব।”
সৈয়দ মোস্তফা মেয়ে দুজনের বেলাতেই ভীষণ রক্ষণশীল মানসিকতার। আজ পর্যন্তও সানা বা মেহা‚ কেউ-ই বিকালের পর একা একা কোথাও যাতায়াত করেনি৷ করতে দেয়নি ওদের বাবা। ব্যতিক্রম যেদিন ঘটেছিল সেদিন রিয়া মুখোমুখি হয়েছিল মোস্তফা সাহেবের শাসনের। সেজন্যই বান্ধবীর প্রতি তার এতটা খেয়াল।
নির্বাচনের আমেজ কেমন তা রিয়ার জানা ছিল না৷ এবারই জানতে পারছে সে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো অনির ঘরে। সবার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে শারফান৷ কিছু কাগজপাতি হাতে ওর। ওকে ঘিরে বসা আর দাঁড়ানো ছেলেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে ওর৷ কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রিয়া ভাইকে ডাকও দিতে পারছে না৷
হঠাৎ চোখ পড়ল অনির বোনের দিকে‚ “তুই এখানে দাঁড়ায় কী করিস?” রিয়া জবার দেওয়ার আগেই সে বলল‚ “মার কাছে যেয়ে দেখে আয় তো নাশতা রেডি হয়েছে নাকি?”
“তোমার সাথে একটু দরকার ছিল‚ ভাইয়া। বাইরে আসো।”
“পরে শুনছি৷ যা আগে দেখে আয়।”
সানাকে একাই যেতে হবে বুঝতে পেরে রিয়া এসে সানাকে জানাল তা। সানা তাই ঝটপট বেরিয়ে পড়ল। যাতে পুরোপুরি অন্ধকার হওয়ার আগে রিকশা নিতে পারে।
কথাবার্তা শেষে শারফান অনিকে বলল‚ “তুই সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যা এখনই৷ নয়টার আগে এলাকা সফর দেওয়া শেষ হয় যেন৷ মিটিং শুরু করবে কাকা দশটার ভেতরে৷ আমার বাসায় চলে আসিস সবাই তার আগেই।”
“আচ্ছা বের হচ্ছি৷ হালকা কিছু নাশতা পানি করে যাক ওরা।”
“তাহলে নাশতা করা”‚ উঠে পড়ল শারফান চেয়ার ছেড়ে‚ “আমি বের হব এখনই। বসার সময় নাই আর।”
“আরে অল্পস্বল্প খেয়ে তারপর বের হ। মা পিঠা নিয়ে আসছে।”
“আমি পিঠা খাই না জানোস না? ওদের খাওয়া৷ কিন্তু দেরি করিস না বেশি৷”
ছেলেদের থেকে বিদায় নিয়ে শারফান বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে৷ নিজের লাল রঙা সেডান এখন সাথে ওর৷ যেতে হবে বাসস্ট্যান্ডে ফুপাতো ভাইকে এগিয়ে নিয়ে আসতে৷ ওরই সমবয়সী সে৷ বছর তিন হলো স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে৷ দেশে ফিরেছে দিন পনেরো হলো৷ মামার নির্বাচনি কাজ করতে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে। পৌঁছে যাবে আর আধ ঘণ্টার মাঝেই।
গলিতে ঢুকল শারফানের গাড়িটা। বেশ দূরে থাকতেই দেখল রাস্তার মাঝখান জুড়ে একটা মেয়ে হেঁটে চলেছে৷ হেডলাইটের আলো পড়তেই মেয়েটি সরে যাচ্ছিল। তারপরও সে হর্ন বাজাল সতর্কতার জন্য৷
কিন্তু কান ধরানো হর্নের আওয়াজটা অকারণ মনে হলো সানার। বিরক্ত মুখশ্রী করে তাই পেছন মুড়ে দেখল একবার গাড়িটিকে৷ তখনই হেডলাইটের আলোয় শারফানের মুখটা দেখতে পেয়ে অভিব্যক্তি বদলে গেল তার৷ দ্রুত রাস্তার পাশে চেপে গেল৷ কিন্তু তাকে আতঙ্কিত করে গাড়িটা হঠাৎ এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল তার খুব কাছ ঘেঁষেই। গাড়ির আড়ালে একদম ঢাকা পড়ে গেল সে। চোখ-মুখ খিঁচে তাকিয়ে দেখল‚ তার দিকের জানালা দিয়ে চেয়ে আছে শারফান সেই দুপুর বেলার মতো। মূলত তার কাছেই কেবল মনে হলো শারফানের দৃষ্টি একদম ভালো না—বাজে। এর মাঝেই আবার শুনতে পেল আত্মা কাঁপানো কথা—
“তোমাকে তো আমার গাড়িতে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে।”
নীরব গলি। আপাতত আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না কারও। মাগরিবের ওয়াক্ত বলে হয়ত সব মসজিদে ঢুকে পড়েছে। কিংবা কেউ থাকলেও সানা দেখতে পাচ্ছে না। এমন নিরালা স্থানে ভীষণ পৌরুষপূর্ণ কণ্ঠতে কথাটা শুনে সে মুগ্ধ হওয়া তো দূর‚ না চাইতেও ঘাবড়াল৷ গায়ের চাদরটা শক্ত করে ধরে এঁটে রাখা ঠোঁটদুটো ছড়াল—ধারাল কিছু একটা বলবে এ আশায়৷ কিন্তু কী বলবে? না-কি বাবাকে কল করবে দ্রুত?
চলবে।