মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-০৬

0
2

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৬.

“হেই পামকিন‚ বলো‚ তোমার বডি প্রাইস কত? কত লাখ মুক্তিপণ দাবি করা যাবে ফারনাজ কবিরের কাছে?”

আচ্ছা‚ তাহলে রাজনৈতিক প্যাঁচে পড়ে গেছে সে? কিন্তু ফারনাজ ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ থাকলে এই বোকার ধাড়ি ব্যাটা ওকে কেন তুলে নেবে? নেবে ফারনাজ ভাইয়ের আপন বোনকে। নাকি ওকেই আপন বলে ভেবে নিয়েছে? ভুলটা কি ধরিয়ে দেবে একবার? যদি ছেড়ে দেয় তাতে? ধ্যাত্! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাধার মতো চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সে। এত কিছু ভাবার সময়ই নেই এখন। ভেবে নিলো সানা‚ কী করবে। হাতের ব্যাগ আর বইটা শক্তভাবে জাপটে ধরে এখনই দেবে এক ভোঁ-দৌড়। যদিও সাতান্না কেজি ওজন নিয়ে দৌড়ে দ্রুত পালাতে পারবে কিনা সন্দেহ৷ কিন্তু দৌড় দেওয়া ছাড়া ভালো কোনো উপায়ও নেই৷

“না থাক‚ আজকের মতো ছেড়ে দিই তোমাকে৷ কী বলো?” স্টিয়ারিং হুইলে আঙুল নাচাতে থাকল শারফান চোখে-মুখে দুষ্টুমি নিয়ে৷ সানার ডাগর ডাগর চোখের ভয় আর বিভ্রান্ত চাউনি তাকে মজা দিচ্ছে বেশ।

কিন্তু ভয়ের সঙ্গে সানার ভেতরে একটি অনুভূতি কাজ করল৷ শারফানকে ভয়াবহ দুটো গালি শোনাতে পারার ভীষণ আফসোস সেটা৷

স্টিয়ারিং হুইলের ওপর রাখা তিন আঙুল তুলে শারফান বলল‚ “তিন মিনিটের ভেতর যদি এক দৌড়ে মেইন রোডে চলে যেতে পারো তাহলে ছেড়ে দেবো৷ আর না পারলে…”‚ থামল একটু। মুখটা কপট গম্ভীর করে পাঁচ আঙুল মুঠো পাকিয়ে দেখাল‚ “খপ করে তুলে নেব!”

বলতে দেরি‚ কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ জপতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা দাপাদাপি করে ফেটে যাওয়ার আগেই সানা ওর জীবনের সেরা দৌড়টা দিতে দেরি করল না৷ শীতে আড়ষ্ট হয়ে থাকা অলস শরীর। মোটেই নড়তে চায় না। চিড়বিড়িয়ে গালি দিলো তাই নিজেকেই‚ “শালী কুমড়োপটাশ‚ দে দৌড়!”

আর ওই দৌড় দেখে প্রচণ্ড হাসতে হাসতে শারফান স্টিয়ারিং হুইলে মাথা ঠেকাল৷ সেই অট্টহাসির আওয়াজ মাত্র বারো হাত দূরে যেতে পারা সানা শুনতে পেয়ে ওর মনে হলো‚ হিন্দি সিনেমার সেরা খলনায়ক অমরেশ পুরীর হাসি ওটা। দাঁড়িয়ে পড়ে ফিরে তাকাল ও। দেখল‚ ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে পেছন থেকে ওর দৌড়নোর চিত্রটা ফোনে ধারণ করে নিচ্ছে হারামী‚ বজ্জাতটা। তা দেখে এবার ওর আরেকটা আফসোস হলো৷ রাস্তা থেকে একটি ইটের টুকরো তুলে ওই গাড়ির কাচটা ভাঙত পারত যদি! ইস‚ কী মারাত্মকভাবেই না ভয় দেখাল ওকে!

***

রিকশা বাসার রাস্তায় ঢুকতেই সানার চোখ ছানাবড়া। এত লোক কেন মসজিদের মাঠে? শামিয়ানা টাঙিয়েছেই বা কেন মাঠে? কী হবে এখানে? বাসার সামনে রিকশা থামলে দেখতে পেল ফারনাজের গাড়িটা দাঁড়ানো। ওর বাসার গেটের ভেতরও লোকজন আসা-যাওয়া করছে। এবার বুঝল সানা। জনসভার আয়োজন করেছে ফারনাজ। ওই তো‚ মাইক লাগানোর কাজও চলছে। কত রাত চলবে কে জানে! কান‚ মাথা আজ আর টিকবে না বোধ হয়।

ভাড়া মিটিয়ে গেটের ভেতর ঢুকতেই দেখল‚ ঘরের সামনে একগাদা ছেলেপুলে হাত কলস মার্কার লিফলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে৷ চেনা মুখের মাঝে অচেনা মুখই বেশি৷ অস্বস্তি নিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। না ফিরে চেয়েও অনুভব করল‚ ছেলেগুলো তাকিয়ে ছিল ওর পেছন দিকেই। এরকম চাহনিগুলো সব সময়ই ওকে এই অনুভবটা দেয়‚ যেন গা ঘিনঘিন করা কোনো কীট কিলবিল করছে পিঠের মধ্যে। এ কারণেই বড়ো চাচা আর ফারনাজ কবিরের উপস্থিতি ওর পছন্দ নয়। তারা যখনই আসে তখনই সাথে তাদের এমন দলবল থাকে৷ আর আসেও তো তখনই‚ যখন রাজনৈতিক সম্পর্কিত কোনো দরকার থাকে তাদের।

উঠানের মাঝখানেও নিজেদের আত্মীয় স্বজন গিজগিজ করছে। ওদের বংশটা বড়ো কিনা! যখন ডাক পড়ে তখন সবাই-ই এসে হাজির হয়। এরা যদি আজ থাকে তবে আজ আর বিছানায় জায়গা হবে না ওদের দু বোনের। শারফানের কাণ্ডে এমনিতেই মেজাজ চটে ছিল বেচারির। আত্মীয়-স্বজনের আচমকা আগমনে আরও বেশি তেতে উঠল তা। আব্বু-আম্মুর ঘরটা পেরোনোর সময় শুনতে পেল বাবা‚ চাচা‚ ফারনাজ‚ আরও কয়েকজনের কণ্ঠ। নিজের ঘরে ঢোকা মাত্রই মাত্রই মেহার প্রশ্ন মুখে পড়ল‚ “দেরি করলি কেন এত?”

পড়ার টেবিলে বই আর ব্যাগটা ঠাস করে রেখেই বিছানায় চিত হলো সানা‚ “দুপুরের ওই সন্ত্রাস কুত্তাটা রাস্তা আটকে কী ভয়টা দেখিয়েছে আমাকে‚ জানিস?”

“কী করেছে?” বিস্মিত‚ আতঙ্কিত হলো মেহার মুখটা। এসে দাঁড়াল বিছানার পাশে।

সমস্ত ঘটনা সানা বলতেই মেহা রাগে উত্তেজিত গলায় বলল‚ “ফারনাজ ভাইকে এখনই জানাব আমি। সাহস কত বড়ো! সৈয়দ বাড়ির মেয়েকে তুলে নিতে চায়? সেই ক্ষমতা আছে শালার?”

সানা চোখ উলটে তাকাল। “তোর ফারনাজ ভাই জানলেই বা কী লাভ হবে শুনি”‚ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল‚ “কবে দেখেছিস বড়ো ভাই হয়ে আমাদের জন্য কিছু করতে? মুখে মুখেই বুলি ছাড়ে ছোটো চাচা ওনার বন্ধু সমতুল্য। সেই বন্ধু সমতুল্য মানুষকে ওনার মা-বোন যেদিন অপমান করেছিল। তা জানার পর একটা টু শব্দ করেছিল? করেছিল কোনো প্রতিবাদ? এত আশা করিস কেন তার কাছে তুই?”

মেহা কিছু বলার আগেই সানা বলল আবার‚ “আব্বুকে যতটুকু যা করতে দেখছিস তা স্রেফ মানবিকতা আর হলো ভাতিজার প্রতি স্নেহ থেকে। বংশের প্রথম ছেলে কিনা! কোলেপিঠে করে বড়ো করেছিল। সেই আদর ভালোবাসা থেকে না বলতে পারেনি আব্বু৷ নয়ত খেয়াল করে দেখিস বড়ো কাকুর সাথে আব্বু কেবল লোক সম্মুখে দায় ঠেকে কথা বলে। ওই পরিবারের কারও কাছ থেকে আব্বু কিচ্ছু প্রত্যাশা করে না। তাই আমাদেরও করা উচিত না। তুই যথেষ্ট বুঝদার‚ মেহা। তারপরও ভুল জায়গায় ভুল আবেগ খরচা করছিস৷ আর করিস না৷ যদি কন্ট্রোল করতে না-ই পারিস‚ মনে করবি তখন বড়ো কাকি আর ফারিয়া আপুর বলা কথাগুলো।”

সৈয়দ গোষ্ঠীর মধ্যে ফারনাজের আগে সবচেয়ে বেশি সুর্দশন ছিলেন সৈয়দ মোস্তফা। বয়স বাড়লেও শারীরিক কাঠামো‚ মুখের শক্তপোক্ত গড়ন এখনো প্রশংসনীয় তার। উচ্চতাতেও ছিলেন সবার থেকে বেশিই তিনি। ফারনাজ এই ছোটো চাচারই সব কিছু পেয়েছে। মোস্তফা সাহেবের কাছেও ভাতিজা ছিল খুব আদরের৷ তাই তিন ভাই আলাদা আলাদা বাড়ি-ঘর করার পরও ফারনাজ ছোটো চাচার টানে তার কাছে চলে আসত মাঝেমধ্যেই। বয়সে সে সানার থেকে তেরো বছরের বড়ো হলেও সুঠাম সুন্দর দৈহিক গঠনের জন্য দেখতে শুনতে তা বোঝার উপায় নেই। এদিকে অতিরিক্ত প্রেমের উপন্যাসে আসক্ত মেহা দশম শ্রেণীতে পড়াকালীনই ফারনাজের সৌন্দর্যে কাবু হয়ে পড়ে। এর মাঝেই রোজার ইদে বড়ো ভাইয়ের বাড়িতে মোস্তফা সাহেব স্ব-পরিবারে দাওয়াত রক্ষা করতে যান৷ সেদিন দুপুরে গল্প‚ আড্ডার মাঝে সানার দাদী ফারনাজের সঙ্গে সানার বিয়ের দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ছেলে আর ছেলেবউদের কাছে৷ ভাই-বোনদের মাঝে ফারনাজের বাবা সৈয়দ কবিরই বিত্তবান। আবার রাজনীতিতে ভালো একটি অবস্থানও আছে তার। সে কারণে তার স্ত্রী‚ সন্তানদের অহংকারটাও সব সময়ই বেশি৷ বৃদ্ধা জোহরা খাতুনের কথার জের ধরে কবির সাহেবের স্ত্রী আর বড়ো মেয়ে মোস্তফা সাহেবের পরিবারকে হাসি ঠাট্টার ছলে প্রত্যক্ষ‚ পরোক্ষ‚ উভয়ভাবেই অপমানজনক নানান কথা বলে বসে। সেসব কথার জবাব নাজমা বেগম না দিয়ে থাকতে পারেননি। আর তারপরই দুই পরিবারের মাঝে তর্কবিতর্ক থেকে ঝগড়াবিবাদ শুরু হয়ে যায়৷ প্রচণ্ড অপমান হয়ে সেদিন মোস্তফা সাহেব পরিবার নিয়ে বড়ো ভাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। মা জোহরা খাতুনও তখন ভীষণ রেগে বড়ো ছেলে আর ছেলেবউকে গালাগাল করে চলে আসেন ছোটো ছেলের হাত ধরে। ফারনাজ সে সময় বাড়িতে ছিল না। পরবর্তীতে সে জানলেও ছোটো চাচার কাছে এসে চাচা-ভাতিজার সম্পর্কটাই কেবল বাঁচিয়েছিল। কিন্তু প্রিয় চাচার অপমানের প্রতিবাদ সে করেনি সেদিন।

রাত ৯:৩০ ।
মাথা যন্ত্রণার কথা বলে মেহা না খেয়েই লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সানার কথা মতো বছরখানিক আগের সেই দিনটার কথায় শুয়ে শুয়ে স্মরণ করছে সে। সেদিন ফারনাজ ভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর অটোরিকশাতে বাবার পাশে বসে দেখেছিল বাবার ভেজা দুটি চোখ। কোনোদিন বাবার অমন লাল‚ টলমল চোখ সে দেখেনি৷ তাই বিভ্রান্ত ছিল বাবা কি কাঁদছিল? বোনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখেছিল‚ বাইরে মুখ ঘুরিয়ে বোনও কান্না ঠেকানোর চেষ্টা করছে। দাদীও কাঁদছিল মায়ের পাশে বসে৷ মা তো নিকাব পরে ছিল। নিকাবের আড়ালে তাই মায়ের কান্না সে বুঝতে পারেনি তখন৷ কিন্তু সবার কান্না ছাপিয়ে বাবার ভিজে আসা চোখদুটিই কেবল ভাবিয়েছিল তাকে৷ একমাত্র সে-ই ওইদিন কাঁদেনি৷ কারণ‚ ফারিয়া আপু আর বড়ো চাচির কথাবার্তায় তার শুধু মুখের ভাষা খারাপ করে জঘন্য জঘন্য কথা শোনাতে ইচ্ছা করেছিল তাদের—প্রচণ্ড রাগটাই কেবল অনুভব করেছিল সে৷ আর আশা করেছিল‚ ফারনাজ ভাই সব জানার পর নিশ্চয়ই রাগারাগি করবে বাড়ির লোককে৷ কিন্তু কিছুই তো করেনি লোকটা৷ তারপর যতবারই মানুষটা এ বাড়িতে এসেছে‚ আগের মতো আর সহজভাবে কেউ মিশতে পারেনি তার সাথে৷ বড়োবোনকে দেখে সেও দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে ফারনাজের সঙ্গে। আগের মতো সেই কথাবার্তা হওয়া‚ কোনো কিছুর আবদার করা তো দূর৷ সানার দেখাদেখি ফারনাজের মুখোমুখিও দাঁড়ায় না সে। নিজেকে সে সত্যিই বোঝায়। তবুও যেদিন ফারনাজের দেখা পায় সেদিনই মনটা ক্ষণিকের জন্য এলোমেলো হয়ে যায়৷

মেহাকে প্রকাশ করতে হয়নি সানার কাছে মনের এ অসুখের কথা। সানা কীভাবে যেন টের পেয়ে গিয়েছিল৷ তাদের দু বোনের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো খোলামেলা হওয়ার পরও এই একটি বিষয়েই আজকের আগে কখনো কথা হয়নি দুজনের। আজই প্রথম সানা পরোক্ষভাবে বলল কিছু৷ যা মেহার মাঝে গভীরভাবেই প্রভাব ফেলেছে। তবে সানা বিশ্বাস করে‚ মেহার বয়সের দোষে সৃষ্টি হওয়া তুচ্ছ এই আবেগ‚ মোহ একদিন হারিয়ে যাবে। আর বোনটাও তো ওর খুব শক্ত মনের।

মেহা ঘুমিয়েছে ভেবে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিলো সানা৷ জানালাটা খোলা রাখল শুধু। রাস্তার কিনারা ঘেঁষেই তো ওদের বাড়িটা। তাই রাস্তার পাশের দোকানপাটের আলো অনায়াসেই ঘরে চলে আসে৷

বাড়ি ভর্তি মানুষের মাঝে পড়াশোনা সম্ভব নয় বলে এত দ্রুত মেয়েদের শুয়ে পড়তে দেখে কিছু বললেন না নাজমা বেগম। অধিকন্তু ভীষণ ব্যস্ত তিনি নাশতার আয়োজন করতে৷ এলাকার মানুষের ভিড়ও শুরু হয়েছে মসজিদের মাঠে৷ দলীয় ছোটোখাটো নেতা-কর্মীদের বক্তৃতা আরম্ভ হয়েছে৷ একটু পরই ফারনাজ আর সৈয়দ কবিরও যাবেন কথা বলতে৷

আজ হঠাৎ করে কল এসেছে পান্থর। কথা বলার সুযোগ থাকলেও সানার আপাতত ইচ্ছা করছে না কথা বলতে। রিং বাজতে থাকা ফোনটা টেবিলে ফেলে রেখেই ঘরের বাইরে বের হতে গেল সে। আচমকা ধাক্কা খেল তখনই সামনে কারও সাথে৷ সেই ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল তখন। দ্রুত পিছিয়ে এলো সানা। অপ্রস্তুত হলো বেশ ফারনাজকে দেখে। দরজার মুখে দাঁড়িয়েই ওকে জিজ্ঞেস করল ফারনাজ‚ “স্যামসাঙের চার্জার আছে নাকি তোর?”

“হ্যাঁ‚ লাগবে?”

“আমার ফোনটা চার্জে বসাতে হবে।”

“ও আচ্ছা‚ দিয়ে যান তাহলে।”

ঘরে ঢুকে পড়ল ফারনাজ৷ তাতে আরও বেশি অপ্রস্তুত হলো সানা। সে ভেবেছিল ফোনটা ওর হাতে দিয়ে চলে যাবে৷ ফারনাজকে বলল‚ “দাঁড়ান‚ লাইট জ্বালাই। মেহা ঘুমাচ্ছে তাই লাইট নিভিয়ে ফেলেছি।”

“থাক”‚ বলেই এগিয়ে গেল ফারনাজ চার্জিং পয়েন্টের কাছে। চার্জে বসাতে বসাতে জিজ্ঞেস করল সানাকে‚ “ঠিকঠাক পড়ছিস তো?”

“হুঁ।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে চুপ রইল সানা। ফারনাজের উপস্থিতি ওকে অস্বস্তি নয় বরং বিরক্ত করে এখন।

হঠাৎ গলা খাঁকরি দিয়ে উঠল ফারনাজ। বিছানায় লেপের নিচে ডুবে থাকা মেহার দিকে একবার তাকিয়ে সে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল সানার কাছে। সানা তখন পড়ার টেবিলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো৷ তাকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত ফোনটা নিয়ে ব্যস্ততা দেখানোর চেষ্টা শুরু করল। গত বছর ওই ঝামেলার পর থেকে ফারনাজের চোখের ভাষা বদলেছে—তা সে বুঝতে পারে। তাই তো যখন যেভাবে সম্ভব সেভাবেই এড়িয়ে চলে সে ফারনাজকে৷

“নতুন নাম্বার নিয়ে ভাই-বোন সবাইকে নাম্বার জানিয়েছিস”‚ মৃদুস্বরে বলে উঠল ফারনাজ‚ “কই আমাকে তো জানাসনি?”

“ওদের সঙ্গে নিয়মিত প্রয়োজনে‚ অপ্রয়োজনেও কথাবার্তা হয়‚ যাওয়া-আসা হয়। তাই জানিয়েছি।” শ্রাগ করে নির্বিকার মুখভঙ্গিতে বলল সানা‚ “আপনার সঙ্গে তো তেমন কিছুই হয় না। তাই মনে হয়নি জানানো দরকার।”

“আচ্ছা”‚ বুঝতে পারল এমনভাবে মাথা দুলাল ফারনাজ। তীক্ষ্ণ চাউনিতে জিজ্ঞেস করল‚ “আর আমার কল রিসিভ না করার কারণ?”

“আপনার কল?” একটু অবাকের ভান করল সানা‚ “কল করেন না-কি আমাকে?”

আলো-আঁধারির মাঝে সানার চৌকাকৃতি মুখটা স্পষ্ট। ঘন পাপড়ির বড়ো বড়ো চোখদুটোই স্থির চেয়ে ফারনাজ রাগটা সামলাল৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাসটা ফেলে তাকাল সানার ফোনটার দিকে‚ “বাইরের অন্যান্য পুরুষের কলও নিশ্চয়ই আনরিসিভড থাকে?”

সাবলীল ঢঙে ধারাল জবাবটা দিলো সানা‚ “এই ফোনে প্রয়োজনীয় ফোনকলই কেবল রিসিভ হয়‚ ভাইয়া।”

“গুড।” নিম্নঠোঁট কামড়ে সানার দিকে চেয়ে একটু সময় চুপ থাকল ফারনাজ। তারপর বলল‚ “বড়ো হয়ে যাচ্ছিস খুব৷ প্রয়োজনীয়‚ অপ্রয়োজনীয়র হিসেবটা ভালো বোঝালি”‚ বলে মাথাটা একবার কাত করল‚ “মনে থাকবে।” ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বলেই৷ সানা সেদিকে চেয়ে থেকে বিড়বিড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে একটা গালি দিলো তাকে।

আর মেহা? সে বেচারির এলোমেলো হওয়া মন ওদের এটুকু সময়ের কথোপকথন শুনেই হঠাৎ গুছিয়ে আসতে শুরু করল। ঠোঁট কামড়ে‚ চোখ ঠেঁসে বন্ধ করে রোধ করতে থাকল নোনাপানিকে। দৃঢ়ভাবে সমস্ত আবেগকেও সঞ্চয় করার পালা এখন।

***

শীতকালে শীতটা যতই বাড়ুক। বেলা হতেই মিষ্টি রোদ গায়ে মাখানো গেলে আর সমস্যা নেই। কিন্তু গত বছরের শীতেও শৈত্যপ্রবাহ দেখা গেল‚ এবারও তাই। ছেলেদের নাকি এমন আবহাওয়াও পছন্দের৷ কিন্তু সানার খুব বিচ্ছিরি লাগে। ওর মতো শীতকাতুরে মানুষ হালকা শীতেই জুবুথুবু অবস্থা। এই সকাল আটটায় যেখানে লেপের নিচে সবাই‚ একটা দোকানপাটও খোলেনি। সেখানে ওকে ইনকোর্সের নম্বর সম্পূর্ণ পাওয়ার জন্য ছুটতে হচ্ছে তথাকথিত প্রাইভেট পড়তে জমির স্যারের কাছে৷ যার হাতেই গচ্ছিত থাকে ইনকোর্স নম্বর৷ যারা পড়ে ওঁর কাছে‚ তাদের নামসহ ক্লাস রোল নম্বর তিনি ডায়ারিতে টুকে রাখেন৷ যাতে নম্বর দেওয়ার সময় নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের চিহ্নিত করতে অসুবিধা না হয়। অথচ পড়তে গেলে কী যে অঙ্ক করান তা সানা চেয়েও দেখে না৷ তার ওপর স্যারের প্রতিবন্ধী ছেলেটা যেদিন ঘুম থেকে জলদি জেগে যায় সেদিন জনমের ভোগান্তি। বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে দেয় ছেলেটা৷ বন্ধু-বান্ধবীরা বলে ওকে জমির স্যারের এই অন্যায় কাজকর্ম মোস্তফা সাহেবকে জানিয়ে দিতে৷ কিন্তু সানার মনে হয় তাতে সাময়িক সময়ের জন্যই লাভ। বছর তিনেক পর বাবা যখন অবসরে যাবে তখন তো আবার শুরু করবেন তিনি। মাঝখান থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে সে৷ ভবিষ্যতে মেহাও তো এখানেই পড়বে। সেই ঝামেলার খেসারত যদি মেহাকে দিতে হয়?

শারফানও রাস্তায়। ঢলঢলে সাদা টিশার্টের ওপর জারার থেকে কেড়ে নেওয়া কালো চাদরটা গায়ে জড়ানো। চলছে সে বাড়ির পথে৷ গতরাতে কাজকর্ম শেষে বাসায় ফেরা হয়নি তার। বন্ধুরা মিলে আবারও সাদ্দামের ঘরে মৌজ শেষে একটু নেশা করে ফেলেছিল । ওই অবস্থায় আর বাসায় ফেরেনি মায়ের কান্নাকাটির চিন্তা করে৷ কিন্তু সকাল হতে না হতেই বাড়ি থেকে একের পর এক কল আসতে শুরু করে৷ এখনো পকেটে ফোনটা কাঁপছে৷ মনে হয় এবার স্বয়ং শাফিউল সাহেবই কল করছেন৷ তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই তার৷ কানদুটো বন্ধ করে ঘরে পৌঁছেই দেবে দরজায় ছিটকিনি। তারপর দরজার ওপাশে কেয়ামত হয়ে গেলেও কোনো আপত্তি নেই।

নত দৃষ্টিতে পকেটে দু’হাত পুরে ধীরেসুস্থে এগোচ্ছিল সে। সামনে হাত ছয়েক দূরত্বে তখন সানার অবস্থান৷ আচমকা হাঁচি দিয়ে উঠল মেয়েটা। সেই শব্দে নজর উঁচু হলো তার৷ পেছন থেকে সানার দৈহিক কাঠামো চেনা চেনা লেগেও অচেনা তার কাছে৷ কিন্তু মাথায় ক্লিক করে গেল গতকাল সানার গায়ে দেখা মাখন রঙা চাদরটা। তারপর মাত্র এক মুহূর্ত লাগল সানাকে চিনতে। কিছুক্ষণ চুপচাপ পিছু পিছুই হাঁটল ওর৷ দেখতে চাইলো সামনের দুটি মোড়ের কোন মোড়ে যায় মেয়েটা। সেই সাথে ভাবতে থাকল আরও কিছু। মিনিট তিনেক পর দেখল‚ ওদের চলার পথ একই হলো। একটু হাসল শারফান। চোখের সামনে ঝুলতে থাকা চুলগুলোকে ঠেলে পেছনে দিয়ে নাকের ডগা দু আঙুলে রগড়ে নিলো। এগোলো তারপর সানার কাছে৷ অনুমান করল ‚ মেয়েটা বোধ হয় যাবে একদম সোজা। আর তার বাসা ডানের গলিতেই।

প্রায় ছুঁইছুঁই যখন সানা‚ তখনই পেছন থেকে বলল শারফান কোমল করে‚ “হেই হানি‚ ডিড ইউ মিস মি?”

ঘুম ভাঙার পর এটাই প্রথম কথা শারফানের৷ তাই দারুণ পরূষ কণ্ঠটা তার এখনো ঘুম জড়ানো শোনাল৷ কিন্তু সানা একটু চমকালই৷ আচমকা শুনল কিনা! ঝট করে পিছু ফিরল সে৷ শারফান তখন চোখের পাতাজোড়া একবার ঝাপটে মুচকি হাসল—চমৎকার লাগল সেই হাসি। থমকাল সানা। দেখতে থাকল অপলক‚ দুই গালের মাঝে উপরিভাগে সামান্য খাঁজ ছেলেটার। হাসিটা তার চোখ ছুঁতেই রক্তিম চোখদুটোও লাগল ভীষণ সরল।

শারফানও স্পষ্ট টের পেল ওর বিস্মিত চোখদুটোই নিজের জন্য মুগ্ধতা। তাতে আরও সুবিধা হলো দুষ্টুমি করতে৷ বলল মুচকি হেসেই‚ “খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছ আমার গলিতে?”

আহারে! কী দারুণ শোনায় কণ্ঠটাও! হাসি আর এই কণ্ঠেই ছেলেটা কাবু করে নেয় বোধ হয় মেয়েদের? সানার পান্থর কথা ভেবে আফসোস হতে থাকল এতখানি‚ যে শারফানের বলা কথাটা কোনো গুরুত্বই পেল না ওর কাছে৷

কিন্তু শারফানের দুষ্টুমি চিন্তাভাবনা বাড়তে থাকল ওর নীরবতা দেখে। মনে মনে আবার ফুপাতো ভাই রিহানকে ধন্যবাদও জানাল৷ গতকাল রাতে সে ফরিদপুর নেমেই ওকে ধরে আগে জেন্টস পার্লার নিয়ে গিয়েছিল৷ চুল কেটে খুব সামান্য ছোটো করেছে তখন‚ গালের দাড়িগুলোও আরও কিছুটা ট্রিম করিয়েছে৷ তারপর দুজন মিলে ফেসিয়াল ট্রিটমেন্টও নিয়েছে৷ এসব যে রিহান শাফিউল সাহেবের কথামতোই করেছে তা সে বুঝেছিল অবশ্য। তিন মাসের অযত্নে বনমানুষের মতোই দেখাচ্ছিল তাকে৷ তাই আর আপত্তি করেনি গতকাল৷ তাতে যে কতটা লাভ হয়েছে তা সানার সামনে দাঁড়িয়ে সে বেশ বুঝতে পারছে। হাসির সাথে তাই চকচক করা গালটাও ঘষতে থাকল সন্তুষ্টিতে।

চলবে।