মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-০৮

0
2

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৮.

ঘরের সাফাই কাজ করে মধ্যবয়সী নামিরা। জেসমিন বেগমকে বসার ঘরের সোফাতে বসিয়ে সে শান্ত করার চেষ্টা করছিল খুব৷ এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে শারফানকে নিচে নামতে দেখা গেল। পরনে ছিল হাঁটু ছুঁই কালো শর্টস প্যান্ট আর সকালের সেই সাদা টি শার্টটা৷ কানে ফোন ঠেকিয়ে ওয়ালেটটা পকেটে গুঁজতে গুঁজতে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। ওর পেছন পেছন ছুটল রিহান৷ ওদেরকে যেতে দেখে জেসমিনও বেরিয়ে এলেন বাইরে৷ রিহানকে বললেন পেছন থেকে‚ “ওর সাথে থাকিস রে‚ রিহান৷ ওকে সামলাস।”

রিহান আশ্বাস দেওয়ার মধ্যেই মূল ফটকের ভেতর হঠাৎ বাইক নিয়ে ঢুকে পড়ল সাদ্দাম। শারফান সবেই ওর সেডানের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাদ্দামকে দেখে তার বাইকের পেছন সিটে উঠে পড়ল দ্রুত। রিহানও বসল শেষে৷ শারফানকে ফোনে না পেয়ে শাফিউল সাহেবের পর কর্মচারীগুলো কল করেছিল ওর বন্ধুদেরও। সাদ্দাম বাসাতেই ছিল৷ তাই কল পেয়েই ছুটে এসেছে আগে শারফানের কাছে৷ অনি আর রিপন বাইরে কাজে আছে। তারা ইতোমধ্যে রওনা হয়ে গেছে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে।

“কাকা কই এখন?” জিজ্ঞেস করল সাদ্দাম। শারফানের তখনো কানে ফোন ধরা৷ একের পর একে কল করে যাচ্ছে সে কর্মীদের৷ কেউ তুলছে না৷ তাই উত্তর দিলো রিহান‚ “মামা তো থানায় কল করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা।”

শারফান চেঁচিয়ে উঠল এর মধ্যেই‚ “বোকা** ফোন ধরিস না ক্যান? সবগুলো মরে গেছিস?”

ফোনের ওপাশ থেকে এক কর্মচারী বর্তমান পরিস্থিতি জানাতে থাকল শারফানকে। হামলাকারী ছিল প্রায় সাত-আটজন। হাতে ব্যাট আর মোটা লোহার রড ছিল তাদের৷ বাইরে সব ভাংচুর শেষে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কর্মচারীরা সবাই মিলে ঠেকায়। তাতে প্রায় সবাই কম-বেশি মারধোর খেয়েছে৷ তারপর আর দাঁড়ায়নি একটাও৷ পালিয়ে গেছে৷ শাফিউল সাহেব পৌঁছেছেন সবেই। তিনিও গিয়ে কাউকে পাননি।

শারফান পৌঁছল সেখানে৷ আহামরি ক্ষতি হয়নি। রেস্টুরেন্টের সামনে খুব বেশি জায়গা ছিল না বসার জন্য৷ তিনটা টেবিল আর নয়টা চেয়ার পেতে রাখা হয়েছিল। সেগুলোই ভাঙতে পেরেছে শুধু৷ ভেতরে এলো ও৷ জারাকে দেখা গেল বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে আর তার বান্ধবীগুলো ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়ানো৷ অন্যান্য কাস্টোমার যারা ছিল ভেতরে তাদের চেহারাতেও একটু আধটু আতঙ্কের ছাপ। শারফানকে দেখে ম্যানেজার লোকটি দ্রুত এগিয়ে এলো। তখনই থানার ওসি ঢুকল ভেতরে। শাফিউল সাহেব ইশারায় ছেলেকে কী যেন বললেন সে সময়। তা দেখে শারফান কোমরে হাত ঠেকিয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল৷ এই ফাঁকে ওসির সাথে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন শাফিউল৷ ম্যানেজার জসিম চাপা গলায় জানাল শারফানকে‚ “ওরা মারামারি করার মাঝখানে আপনারে গালি-গালাজ করতাছিল। বলতাছিল‚ সৈয়দ বাড়ির মাইয়ার দিকে চোখ দিছেন‚ জ্বালাইতাছেন। আপনারে হাতের নাগালে পাইলে চোখ গাইলা নিবে‚ পার নলা কাইটা রাখবে।”

চুপচাপ শুনে শারফান প্রখর দৃষ্টিতে কান্নারত বোনের দিকে তাকাল‚ “ফুটেজ দেখান আমাকে।”

ম্যানেজার নিয়ে গেল ওকে ক্যাশ কাউন্টারে। ওসি আর শাফিউল সাহেবও এসে দেখতে চাইলেন সিসিটিভি ফুটেজগুলো৷ শারফান দিলো না দেখতে৷ আগে সে দেখবে। জারার বাহুতে ব্যাটের আঘাত করেছিল যে ছেলে আর ধাক্কা মেরে নিচে যে ফেলে দিয়েছিল‚ তাদের দুজনকে দেখার পর ম্যানেজারের থেকে চিনে নিলো শারফান তাকে‚ যে গালাগাল করেছিল ওকে৷ দেখা শেষে ওসিকে ডেকে বলল‚ “মামলা করার ফরমালিটি করতে করতে শু**রের বাচ্চাগুলো এলাকা ছেড়ে পালাবে৷ স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারনাজ কবিরের এলাকায় চলে যান ফুটেজগুলো দেখা শেষ করে। আপনারা এখনই না গেলে আমি আমার মতো কাজ করব৷”

ওসি জিজ্ঞেস করল‚ “ফারনাজ কবিরের এলাকায় যাব কেন? ছেলেগুলো কি ওই এলাকার?”

“এবং ফারনাজ কবিরের পোষা”‚ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল শারফান‚ “একটাকে ধরতে পারলেই ক্লিয়ার হবেন।”

“ফারনাজ কবির কেন হঠাৎ তোর রেস্টুরেন্টে হামলা করাল?” অবাকই হলেন শাফিউল সাহেব।

চোখের মনিদুটো ধীর গতিতে বাপের দিকে ঘুরাল শারফান। কয়েক পল স্থিরভাবেই চেয়ে রইল৷ এ চাউনির ধরন শাফিউল সাহেবের খুব চেনা৷ ছেলের এমন দৃষ্টির পেছনে নির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ থাকে৷ ও প্রচণ্ড রাগান্বিত থাকলে‚ সামনের কেউ ওর কথার মাঝে কথা বলে উঠলে আর ভুল বা বেফাঁস কিছু বলে ফেললেই ওর বিশেষ এই দৃষ্টি মুখে পড়তে হয়। শাফিউল সাহেবের বুঝতে অসুবিধা হলো না তিনি ভুল জায়গাতে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছেন। ওসির উপস্থিতির কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল৷ অপ্রস্তুতভাবে ছেলের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন ওসিকে‚ “সবটাই বেরিয়ে আসবে। আপনি দ্রুত অ্যাকশনে নামুন।”

ছেলে আর ছেলের বাপের দিকে ওসি পরখ করার মতো এক মুহূর্ত দেখে নিয়ে ফুটেজ দেখতে বসল। সবগুলো মুখ চিহ্নিত করে নিয়ে বিদায় নিলো আপাতত। তবে সে যাওয়ার আগে শারফান তার বলিষ্ঠ গলায় বলল‚ “চেষ্টা করবেন আজ অথবা কালকের মধ্যেই এর বিহিত করতে। আজ আমার রেস্ট্রন্টে হামলা হয়েছে‚ আমার বোনকে হিট করা হয়েছে৷ কাল যে আমাদের জানের ওপর হামলা হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই কিন্তু।”

জবাবে ওসি মাথা ঝাঁকিয়েছিল শুধু। এর মাঝে শারফানের এক ঝাঁক বন্ধু এসে হাজির হলে তাদের সাথে কথাবার্তা শেষে শাফিউল সাহেব মেয়েকে নিয়ে তার ল্যান্ড ক্রুজারে চেপে বসেন৷ সঙ্গে ছেলেকেও নিয়ে যাবেন বলে বারবার ডাকতে থাকলেন। শারফান তখন বারবার হাতের ইশারায় তাকে চলে যাওয়ার ইশারা করলেও নাছোরবান্দার মতো বসেই রইলেন তিনি। এই মুহূর্তে ছেলেকে বাসার বাইরে ছাড়লেই বিপদ। শারফান হার মানল বাবার জেদের কাছে। আপাতত বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে এসে বসল বোনের পাশে। ছোটো থেকে ভাইকে খুব কাম কাছে পেলেও জারা বাবার থেকে ভাইয়ের প্রতিই বেশি ভরসা আর বিশ্বাস কেন যেন। ভাইয়ের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে চোখদুটো বুঁজে নিলো সে।

“খুলে বল”‚ শাফিউল তপ্ত কণ্ঠে বললেন‚ “ফারনাজ কেন হঠাৎ তোর রেস্ট্রন্টে হামলা চালাল? অকারণে কোনো ঝামেলা করা মানুষ সে না৷”

ফারনাজের ব্যাপারে বেশ ধারণাই আছে তার। এই ছেলের নানান কর্মকাণ্ড থেকে বুঝেছিলেন বাপের থেকেও চালাকচতুর হয়েছে। নেত্রী নিষেধ করার পরও স্বতন্ত্রে দাঁড়ানোর সাহস সে এমনি এমনি করেনি৷ গত পাঁচ বছরে ফরিদপুরে সামাজিক ও মানবিক কাজে এত প্রশংসা কুড়িয়েছে যে এ বছর শাকিবুল হকের থেকেও সমর্থক বেশি হয়েছে তারই৷ নেত্রী সেটা বোঝার পর এখন গোপনে গোপনে তাকে বেশ সৌজন্য প্রদর্শন করছে৷ সাম্প্রতিক এ খবর কানে এসেছে তাদের৷ এখন এমন একটি মুহূর্তে গোলমাল করে ইমেজ খারাপ করার মতো ভুল তো করার কথা না ফারনাজের।

“আমাকে গত পরশু থ্রেট করেছে”‚ কথার মাঝে নাকটা একটু টানল শারফান। সর্দি সর্দি ভাব নাকের। জানাল‚ “ভোট চাইতে সারা এলাকায় ঘুরলেও সৈয়দ বাড়িতে যেন না ঢুকি।”

“এমন থ্রেটই বা কেন দেবে?” আরও অবাক হলেন শাফিউল‚ “সৈয়দ বাড়িতে ঢুকলে ক্ষতি কী? ঢুকলেই কি ভোট আমাদের হয়ে যাবে?”

“না”‚ হালকা সুরে উত্তর দিলো শারফান‚ “ওই বাড়ির মিষ্টি কুমড়া যদি চুরি করে নিয়ে আসি আমি! সেই ভয়ে থ্রেট দিয়েছিল। আর আমি হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারি না তা তো জানোই তুমি।”

জারাও অবাক হয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল‚ “তুই তো মিষ্টিই পছন্দ করিস না‚ মিষ্টি কুমড়াও খাস না৷ তোকে হুদাই মিষ্টি কুমড়া চোর মনে করতে গেল কেন আবাল ব্যাটা?”

“ইয়াহ”‚ শ্রাগ করল শারফান‚ “আই লাইক হট অ্যান্ড স্পাইসি৷” বলে জানালার বাইরে চেয়ে অভ্যাসজাত গালের দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড়াল‚ “বাট সৈয়দ বাড়ির মিষ্টি কুমড়া স্পেশাল‚ ভেরি স্পেশাল মনে হয়। এবার তো টেস্ট করে দেখতেই হবে।”

“শায়াফ!” হঠাৎ ধমকে উঠলেন শাফিউল। গাড়ির ড্রাইভারসমেত জারাও তাতে চমকে উঠল। কেবল শারফান পরিবর্তনশূন্য৷ বাবার দিকে তাকালও না একবার৷ ও যতই হেঁয়ালি করে কথা বলুক৷ ও যে কিছু একটা ঘটিয়েছে বলেই ফারনাজ আজকের পদক্ষেপ নিয়েছে‚ তা তিনি বুঝে গেছেন। ওকে বললেন তিনি‚ “মাত্র পঁচিশ দিন বাকি নির্বাচনের৷ এই পঁচিশটা দিনেই অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে যেটা হওয়ার কথা ছিল না৷ তোর কারণে যদি তাই হয় তাহলে কিন্তু খুব খারাপ করব তোর সাথে৷ আবারও সাবধান করছি আমি।”

এবারও কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখাল না শারফান৷ বাড়ির ভেতর গাড়ি ঢুকে পড়ল এরপরই৷ সে জারাকে নিয়ে নামল আগে৷ শাফিউল সাহেব নামার পর কড়াকড়ি বললেন ওকে‚ “সন্ধ্যার আগে তুই বাসা থেকে বের হবি না একদম৷”

“ঠিক আছে‚ দুইদমে হব তবে”‚ ভেতরে যেতে যেতে বলে গেল শারফান।

জারা বাপের সাথেই ঢুকছিল বাসার ভেতর। ভাইয়ের কথায় ভীত চোখে বাবাকে দেখল একবার আড়নজরে৷ কলেজ ছুটির পর বাসায় না ফিরে রেস্টুরেন্ট ঢুকেছিল বলে ভাইয়ের ওপরের রাগ না এখন তার ওপর দিয়ে নেয় বাবা!

***

ফোনে কথা বলতে বলতে বাইক নিয়ে মোস্তফা সাহেব গেটের বাইরে অপেক্ষার করছিলেন সানার জন্য। বাবার কাছে হঠাৎ আবদার ধরেছে সে‚ প্রাইভেটে ওকে পৌঁছে দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় যেন ওকে পড়া শেষে নিয়েও আসেন তিনি৷ এতে কিছু একটা আন্দাজ করেছেন মোস্তফা সাহেব। মেয়ে কোনো বখাটের পাল্লায় পড়েছে নিশ্চয়ই। এজন্য ভেবে রেখেছেন‚ অনি ছেলেটার সঙ্গেও কথাবার্তা বলে আসবেন আজ। ছেলেটা ভালো পড়ায় যদিও৷ কিন্তু ওই এলাকায় গিয়ে মেয়ে কোনো সমস্যা পড়ছে কিনা সেটা আগে দেখতে হবে।

আজ আবার সানার জন্মদিনও৷ বন্ধুদের জন্য পাটিসাপটা পিঠা বক্সে সাজিয়ে নিয়ে বের হলো সে৷ মাকে জানিয়ে দিলো‚ ফিরতে একটু দেরি হতে পারে আজ। বাবাকে জানাবে প্রাইভেটে পৌঁছনোর পর৷ তবে যেতে যেতে শারফানের কথাটাও জানাবে কিনা ভাবছে। গেটের বাইরে এসে দেখল‚ কথা বলায় ব্যস্ত বাবা। ওড়নাটা ভালোভাবে মাথায় টেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল কথা শেষ হওয়ার৷ এর মাঝেই শুনতে পেল বাবার অনুচ্চকথা‚ “ওসি কেন ওকে ডাকছে?”

ফোনের ওপাশের কে আছে সানা এখনো বুঝতে পারেনি৷ কিন্তু ওসির কথা শুনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল বাবার কাছে৷ মোস্তফা সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে। বললেন ফোনে‚ “যে দুই ছেলে ওর নাম নিচ্ছে তারা তো সজ্ঞানে নেই। নেশায় থাকা পোলাপানের কথার ভিত্তিতে কেন ফারনাজকে ডাকবে থানায়? বড়োসড়ো কেউ পেছনে আছে দেখো। তুমিও যাও সাথে। ঝামেলা যেন বড়ো না হয়।”

আরও কিছু সময় কথাবার্তা চলল। সানা বুঝতে পারল ফোনের ওপাশে বড়ে চাচা আছেন। বাবার কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করল‚ “কী হয়েছে‚ আব্বু?”

“শাকিবুল হকের ভাতিজার রেস্ট্রন্টে কতগুলো নেশাখোর গিয়ে হামলা করেছে। শাকিবুল হকের ভাতিজি ছিল ওখানে। তাকেও মেরেছে। এখন ওসি ওই নেশাখোরদের মধ্যে দুজনকে ধরে থানায় আটকেছে। তারা তোর ফারনাজ ভাইয়ের কথা বলছে যে ওর কথামতো নেশাখোরগুলো করেছে এই কাজ। এর জন্য ওদের নেশা করার টাকাও দিয়েছে নাকি ফারনাজ।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে সানা বাইকে উঠল। শাকিবুল হকের ভাতিজা তো ওই বলিষ্ঠ‚ সুন্দর কণ্ঠের ছেলেটা। তার রেস্টুরেন্ট আছে আর সেখানে ভাংচুর করিয়েছে ফারনাজ‚ এ দুটো কথায় সারা পথ ভাবতে ভাবতে পৌঁছল সে প্রাইভেটে। যার জন্য শারফানের বিরক্ত করার কথাটা বলতে খেয়াল হলো না ওর। বাসার ভেতরে যখন ঢুকলেন মোস্তফা সাহেব তখন অনিকে ক্লাসরুমে পাওয়া গেল না। জানা গেল‚ ভেতরে আছে সে কিছু বন্ধুদের সাথে৷ কথাবার্তার আওয়াজও আসছে ভেতরের ঘর থেকে। সেসব শুনে মোস্তফা সাহেব বুঝলেন নির্বাচনি কাজে যুক্ত আছে অনি আর সেটা শাকিবুল হকের জন্য। সানা বলল বাবাকে‚ “আমি ডেকে নিয়ে আসি ভাইয়াকে৷ তুমি বসো।”

তিনি আপত্তি জানালেন‚ “না৷ তুই কল কর এখানে দাঁড়িয়েই।”

সানা তা-ই করল৷ কারণ‚ ছেলেদের আড্ডার আসর বা কথাবার্তা চলছে বিধায় সেখানে মেয়েকে যেতে দেবেন না বাবা। কিন্তু কলটা ধরল না অনি। সানা তখন বলল‚ “রিয়ার কাছে যাই৷ ওকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসতে বলি?”

মোস্তফা সাহেবকে একটু সময়ের জন্য ভাবুক দেখাল এবার৷ যেহেতু নির্বাচনি কাজে আলোচনা চলছে ভেতরে। তাই তার কথাবার্তার জন্য এমন সময়টা উপযুক্ত নয়। বরং বিরক্ত করা হবে। আবার তাকেও এখনই কলেজ যেতে হবে একবার৷ ভাবল‚ পড়া শেষে যখন নিতে আসবেন মেয়েকে তখন কথা বলে নেবেন। বিদায় নিলেন তাই।

সন্ধ্যা ৫: ৫০ ।
ক্লাসরুমে সন্ধ্যাদীপ জ্বেলে অনি বেরিয়ে এলো ছাত্র-ছাত্রীদের কিছুক্ষণ আনন্দ‚ উল্লাসের সুযোগ দিয়ে। সানার জন্মদিনটা বন্ধুরা ছোটোখাটো করে একটু উদযাপন করতে চাইছে‚ তাই। সানার দেওয়া একটা পিঠা খেতে খেতে নিজের ঘরে ঢুকেই দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো সে। বসল এসে শারফানের পাশে।

বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে শারফান সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত৷ অনিকে পিঠা খেতে দেখে বলল‚ “কাকি কি দৈনিক দৈনিকই পিঠা বানায়?”

“না৷ সানার জন্মদিন উপলক্ষে ট্রিট।”

“সানা”‚ পুনরূক্তি করল শারফান। মৃদু হাসল তারপর৷ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ওর এই হাসিটা অনির কাছে দেখাল একদম সিনেমার লম্পট শয়তানদের মতো৷ অবশ্য এ খেতাব দিলে তা পুরোপুরি মিথ্যাও হবে না৷ পানি খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে অনি জিজ্ঞেস করল‚ “এখন বল‚ কী জন্য থেকে গেলি?”

“সানার পেটে কত পোনা তাই দেখার জন্য।”

“কী?” আঁতকেই উঠল যেন অনি। ঘাড়ের রগ বাঁকা‚ দুষ্টু বন্ধুর খপ্পরে সানার মতো সরল‚ সুন্দরী মেয়ে পড়লে তো বিপদ। রয়েসয়ে সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে শারফান সমস্তটা খুলে বলল তাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল যেন অনির৷ ফারনাজ কবিরের মাত্র একটা হুমকি বাণীর জন্য বেচারি সানাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছিল শারফান‚ তা একটাবারের জন্যও বলেনি তাকে এই ছেলে! আর আজকে যা ঘটিয়েছে ফারনাজ‚ তার জন্য সানাকে কতটা ভুগতে হবে তা কিছুটা ধারণা করতে পারলেও কীভাবে ভুগতে হবে তা তো সে একটুও ধারণা করতে পারছে না। কিছুই জানাবে না তাকে শারফান। এই ছেলেকে সামলানোর ক্ষমতা তো শাফিউল সাহেবেরই নেই৷ সে কী করে সামলাবে? বেচারি সানাকে রক্ষা করবে কীভাবে? কিন্তু করতে তো হবেই। বিস্ফারিত দৃষ্টি কষ্টেসৃষ্টে কঠিন করে তুলল সে‚ “দ্যাখ শায়াফ‚ সানাকে আমি যতটা চিনেছি তাতে মেয়েটাকে লেগেছে খুব সেনসিটিভ আর ইমোশনাল। তুই আজ সকালে যেটা করেছিস সেটা যদি কেউ জারার সাথে করত। জারাও কিন্তু তখন নিশ্চয়ই তোকে নালিশ করত। তুই কি ছেড়ে দিতি সেই ছেলেকে? তুই নিজেও কিন্তু বাড়াবাড়িটাই করেছিস।”

শারফান চটল না। টান টান করে মেলে রাখা ডান পা’টা নাচাতে থাকল‚ “তাহলে বাড়াবাড়িটা শুধু আমার সাথেই করত ওই মাদার**! আমার বোনের গায়ে হাত তুলে নিজের নসিবে আগুন দিলো।”

“এই শালা! তুই কিন্তু বলেছিলি ফরিদপুরের কোনো মেয়ের সাথে কিছুতে জড়াবি না কখনো।”

হা হা করে হেসে ফেলল শারফান‚ “শালা‚ তুই এত ডর খাচ্ছিস ক্যান?”

“আমি খাবো না তো কে খাবে ডর? ও আমার ছাত্রী আর তুইও আমারই ন্যাংটো কালের শালা। ফাঁসলে আমি ফাঁসব না?” শেষে হুমকির মতো বলে উঠল অনি‚ “তুই তোর কথার বরখেলাপ করবি না কিন্তু‚ শালা!”

হাসতেই থাকল শারফান‚ “আমি বলেছিলাম‚ বিয়ে-থা কোনোদিন ফরিদপুরের মেয়েকে করব না। কিন্তু সানাকে কানা করব না তা তো কখনো বলি নাই৷ আমি আমার কথা নিশ্চয়ই রাখব‚ শালা। টেনশন নট।”

“শায়াফ”‚ গম্ভীর হলো অনি‚ “তোর একটা ভুল পদক্ষেপ কিন্তু শাকিবুল কাকার জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে৷ আর সানাও নির্দোষ।”

“জারা নির্দোষ ছিল না?” সিগারেটে চুপচাপ কয়েকটা টান দিয়ে কথাটা বলল শারফান।

অনি রীতিমতো দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল৷ মাত্রাতিরিক্ত রাগ‚ ক্ষোভ‚ প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা থেকে শারফান আজ অবধি অনেকের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে৷ দুর্ভাগ্যবশত তাদের মাঝে মেয়ে মানুষও আছে৷ তাদের মতোই কিছু একটা ক্ষতি সানার হলে বিচ্ছিরি একটা ঝামেলায় ফেঁসে যাবে সে৷ যদি তাকে নাও ফাঁসায় শারফান তবুও সে কোনোভাবেই চায় না সানার কিছু হোক। উদগ্রীব হয়ে শারফানকে আরেকবার বোঝানোর জন্য উদ্যত হলো সে‚ তখনই ঘরের বাইরে থেকে ডেকে উঠল তার বাবা। অনি শারফানকে বলল‚ “আমার কথা শেষ হয়নি৷ চুপচাপ বসে থাক ঘরে। আসছি আমি।”

মুচকি হেসে বাধ্য ছেলের মতো শারফান মাথা নাড়াল। বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুলে সিগারেট ধরে সে৷ প্রথমটা শেষ করে দ্বিতীয়টা ধরিয়ে ঠোঁটে নিয়ে একটুখানি ভাবনায় আনল অনির কথাগুলো৷ ফারনাজের দাম্ভিক সুরের হুমকিটার জন্যই সানাকে কিছুটা বিরক্ত করেছিল সে। যেটা আগামী দিন থেকে এমনিতেই বাদ দিতো৷ কারণ‚ সানার মতো মফস্বলি সাদামাটা সুন্দরী ওর রুচি বা কামনার সঙ্গে যায় না৷ খোলামেলা‚ লাস্যময়ী নারী দেখে সে অভ্যস্ত। তাদের মতো রূপসীও টিকতে পারে না ওর উগ্র আচরণের কাছে৷ গভীর প্রেম‚ প্রণয়ে তাই আজও অবধি জড়ানো হয়নি আর না আগ্রহী হয়েছে সে৷ কিন্তু বলা জরুরি এখন‚ বিলাসিতা করা আর চাকচিক্যপূর্ণ জীবনযাপন করা নির্মেদ সুন্দরীদের বদলে আজ সে আগ্রহবোধ করছে সানার মতো চাকচিক্যশূন্য মেয়ের প্রতি৷ যে মেয়ের জন্য ফারনাজ কবিরের মতো সদা সতর্ক‚ ধূর্ত শেয়াল নির্বাচন সামনে নিয়েও কেলেঙ্কারি ঘটাতে দুবার ভাবল না! আর এখানেই তো শারফানকে করেছে সানার প্রতি তুমুল আগ্রহী এবং কৌতূহলী। সানা এখন ওর কাছে প্রচুর টুইস্ট থাকা একটি ফ্যান্টাসি জনরার বইয়ের মতো। যে বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা না পড়া অবধি সে শান্ত হতে পারবে না। তবে সানাকে নিয়ে অনির বলা দুটি শব্দ সে মাথাতে নিলো কেবল। ‘সেনসিটিভ এবং ইমোশনাল’।

প্রায় মিনিট পনেরো বসেই থাকল শারফান। অনির হদিস নেই দেখে ভাবল চলে যাবে এখন। ছেলেদের সাথে রাতে বের হতে হবে কাজে৷ কিন্তু বিছানা থেকে নামতেই খেয়াল হলো একবার বাথরুমে যাওয়া দরকার। সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে প্যান্টে হাত দিতে দিতে বাথরুমে ঢুকল সে৷ কিন্তু দরজার ছিটকিনি না আটকিয়ে শুধু ভিড়িয়ে দিলো।

ঘরে ঢুকল রিয়া তখনই। ভাইকে দোকানে পাঠিয়েছে বাবা। তাই সে জানে ঘরটা ফাঁকায় আছে। শারফানের উপস্থিতির ব্যাপারে একদমই অনবগত সে। হাতছানি দিয়ে ডাকল সানাকে‚ “এদিকে আয়। ঘরে নেই ভাইয়া৷ ওর বাথরুম ফাঁকা।”

কেকের ক্রিম নিয়ে বান্ধবীরা মাখামাখি করেছে একজন আরেকজনকে৷ অন্য বান্ধবীগুলো রিয়ার ঘরের বাথরুম দখল করে নেওয়ায় সানাকে নিয়ে এলো রিয়া অনির ঘরে৷ সানা জিজ্ঞেস করল‚ “যদি অনি ভাই ফট করে ঘরে চলে আসে?”

“আমি তাহলে বাইরে থাকছি। ভাইয়া দোকান থেকে এলেই বলব ঘরে না ঢুকতে।”

তাও ইতস্তত করতে থাকল সানা৷ বাইরের পুরুষের বাথরুমে যাওয়ার ব্যাপারটা একটু কেমন কেমনই লাগে যেন৷ কিন্তু ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে রিয়া বিরক্ত হলো‚ “আরে ধুর! কয়েক মিনিটেরই তো কাজ৷ যা তো। যতক্ষণ দাঁড়ায় দাঁড়ায় মোচড়ামুচড়ি করছিস ততক্ষণে কাজ হয়ে যায় কিন্তু। আমি থাকছি বাইরে।”

“খবরদার”‚ সানা সতর্কতা জারি করল‚ “ভাইয়া যের ঘরে না চলে আসে। তাহলে কিন্তু দুঃখ আছে তোর কপালে।”

চেহারা কুঁচকে মুখটা ঝামটা দিয়ে রিয়া বেরিয়ে গেল তখন৷ যাওয়ার সময় ঘরের দরজাটা টেনে দিলো সে। গালে মেখে থাকা ক্রিম হাতে মুছতে মুছতে সানা ঢুকল তারপর বাথরুমে।

চলবে।