#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৯.
গালে মেখে থাকা ক্রিম হাতে মুছতে মুছতে সানা ঢুকল তারপর বাথরুমে আর দরজাটা তখন দড়াম করে বাড়ি খেল কিছু একটার সাথে। বুঝতে সময় লাগল না ভেতরে কেউ আছে৷ রিয়া কানি তাহলে কোন চোখ দিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই? দ্রুত সে পিছিয়ে আসতেই দরজাটা সরল সামনে থেকে আর উদয় হলো এক কাঠিন্য মুখাবয়ব। দু’বার চোখের পাতা ঝাপটাল সানা। সহসাই চেহারা বিকৃতি হয়ে গেল ওর। “উইমাআআ”‚ মৃদু আওয়াজে আর্তনাদ করেই প্রলাপ সুরে বলল‚ “দোয়া পড়ে ঢুকিনি বলে কি বাথরুমের জিন হাজির হলো ওই জাউরার চেহারায়?” এক পলের বিরতিতেই জলদি দোয়া ইউনুস পাঠ শুরু করল অনবরত‚ “লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ-জালিমি…”
“চোপ!” আচমকা ঢোলের বাড়ি পড়ার মতোই শারফানের ধমকটা বেজে উঠল বাথরুমের ভেতর।
স্বাভাবিকইভাবেই ভয় পেয়ে থামল সানার দোয়া পাঠ। শারফান বেরিয়ে এসে দাঁড়াল ওর মুখোমুখি। বুকের কাছে হাতটা চেপে ধরে সানা অবিশ্বাস নিয়ে দেখতে থাকল তাকে। ফিসফিসিয়ে স্বগতোক্তি করল‚ “জিন টিন না তাহলে? সেই জাউরাটাই সামনে?”
স্পষ্টই শুনল শারফান গালিটা। কিন্তু না রেগে বরং গালির জবাবে “হুঁ” করে সম্মতি জানিয়ে বলল‚ “জিনের থেকে বড়ো জাউরাই তোমার সামনে এখন। কী করবে?”
“কী করব?” হতবুদ্ধি বনে গেছে সানা। সে বুঝতে পারছে না অনি ভাইয়ের ঘরে এই ছেলে কেন?
“ভাবো কী করবে৷” বলে হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল শারফান। রিয়ার দরজা আটকে যাওয়ার কথাটা কানে এসেছিল তার৷ শুনেও চুপচাপ টয়লেটের কাজ সারছিল সে৷ তারপর অপেক্ষায় ছিল সানার আগমনের। দরজাটা হঠাৎ ভেতর থেকেও বন্ধ করে সানার কাছে ফিরে এলো সে‚ “বিশাল বিপদের সামনে তুমি এখন৷ খালি দোয়া ইউনুস পড়ে তো রক্ষা পাবে না। জিন হলে পেতে৷ কিন্তু আমি তো জিনের দাদা।”
গতকাল সন্ধ্যায় যে ভয়টা সানা পেয়েছিল শারফানকে দেখে‚ সেই ভয়ই পুনরায় ফিরে এলো ওর। আগেপিছে কিছু ভাবার সময় নষ্ট করল না আর গতকালের মতো। “আআআ… রিয়া রে বাঁচাআআ”‚ অবিলম্বেই চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সবটাই আটকা পড়ল শারফানের খসখসে চামড়ার হাতের তালুতে। সিগারেটের বেজায় গন্ধ সেই হাতের মধ্যে। সানার ছটফটানি আর ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল এরপর।
“ল্যাদা খুকি! ন্যাকার বাল”‚ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ধমকাল শারফান‚ “চাচাতো স্বামীর কোলে ঢুকে নালিশ ঠেঙাও‚ হ্যাঁ?”
কেঁদে ফেলল সানা মুহূর্তেই। সেই ভেজা চোখদুটো দেখে না চাইতেও দয়া হলো একটু শারফানের৷ ওর মাথার পেছনও তার এক হাতে শক্তভাবে চেপে ধরা। সে হাত কিছুটা শিথিল করল। তবে ছাড়ল না। পূর্বের রাগান্বিত সুর বজায় রেখেই বলল‚ “সকালে তো ঢিল মারার সাহস দেখে এমন ন্যাকা মাল মনে হয়নি! ইনোসেন্ট ফেইসের তলে কত বড়ো মিনমিনে খাচ্চরনী তুমি‚ সেটাই এখন দেখব। তোমার চু**র ভাই নায়ককে এবার নালিশ লাগাবা ক্যামনে? আমার বোনকে ব্যাট দিয়ে মেরেছিল ওর জারজ কুত্তার ছা। আর আমি কী করব জানো? তোমার মুখ ধরব কমোডের ভেতর ঠেঁসে। তারপর মাথার ওপর তুলে দেবো এক আছাড়।”
এমন বিচ্ছিরি কথাগুলোতে ভয়টা সানার বাড়ল ঠিকই৷ কিন্তু একটা বিষয় আবছা আবছা পরিষ্কার হলো‚ ফারনাজই তবে এই খারাপ লোকের রেস্টুরেন্টে ভাংচুর করিয়েছে।
“চুত*** কী থ্রেট করেছে আমাকে? তোমাকে জ্বালালে আমার চোখ গেলে নেবে‚ পার নলা কেটে রাখবে‚ না? কিন্তু আমি যদি কাউকে জ্বালাই তাহলে সুন্দর করে মশলা মেখে জ্বালাই‚ পারফেক্ট বারবিকিউ বানাই৷ তারপর হাড্ডি-গুড্ডি আলাদা করে খেয়ে ফেলাই৷ তোমাকে নিয়ে তাহলে কী করব বুঝতে পারছ?”
উন্মাদের মতো মাথা একবার ডানে-বামে আরেকবার উপর-নিচে ঝাঁকাল সানা। তা দেখে শারফান ভ্রু বাঁকাল—ছিট আছে না-কি মেয়ের মাথায়? সানার চোখের পানিতে তার হাত ভিজতে শুরু করেছে৷ সেসবে পাত্তা না দিলেও ওর মাথা ঝাঁকানোর অদ্ভুত নিয়ম আর টলমল করা চোখদুটো দেখে মনটা তার আরেকটু নরম হলো বোধ হয়৷ ওর মুখ ছেড়ে দেওয়ার আগে শাসাল‚ “চিৎকার চেঁচামেচি করে আমাকে বদনাম করলে একদম মেরে ফেলব কিন্তু। তাছাড়া আমি বদনাম হলে তুমিও বদনাম হবে। অনি আমার ছোটোবেলার বন্ধু৷ অনির বাপ-মা আমার ভক্ত৷ তাই আমার কথারই দাম আর কদর বেশি হবে।”
সবটাই মানতে আর বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো সানা। শারফানের হাতটা মুখ থেকে সরা মাত্রই ঠোঁটসহ ঠোঁটের চারপাশ ওড়নার আচঁলে জোরে ঘষাঘষি করে মুছল সে৷ যেন এত সময় নোংরা মেখে ছিল তাই পরিষ্কার করে নিলো৷
এর মূল কারণ ছিল সিগারেটের গন্ধযুক্ত হাতটা শারফানের বাঁ হাত। শারফান কিন্তু এই বিষয়টা বুঝল না৷ বরং সে মনে করে নিলো তাকে ঘৃণা দেখাতেই ফাজিল মেয়েটা এমনটা করল। এতক্ষণে যে রাগ দেখাচ্ছিল তা কিছুটা মিছেমিছি হলেও এই কাজের পর ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠার মতোই রাগটা ঠেলে উঠল সোজা তার মাথায়। হাতে থুথু মেখে সানার গালে চটাস করে একটা থাপ্পড় বসাবে আর সে সময়ই সানার ললিত স্বরে শুনল‚ “ফারনাজ ভাই আমার গার্ডিয়ান নয় একদম৷ আমি তাকে কোনো নালিশ করিনি। আব্বুকে করতে চেয়েও ভুলে গিয়েছি আজ৷” শেষ কথাটা মুখ ফসকেই বলে ফেলল সে। আর বলা মাত্রই মুখ চেপে ধরল৷ ভীত হরিণীর মতো একবার শারফানের চোখে চেয়ে কপট কান্না গলায় বলল‚ “জীবনেও আর বলব না। আমাকে ছেড়ে দেন প্লিজ! আপনার ছোটো বোনের মারের বদলে আমাকেও একটা মেরে দেন… তাও ছেড়ে দেন… ছেড়ে দেন গো‚ ভাই!”
“ডোন্ট!” শারফান ধমক লাগাল ভাই বলতে শুনেই। “ডোন্ট কল মি ভাই৷ কল মি শারফান অর শায়াফ। আমার বোন ছাড়া আমি কাউকেই বোন মানি না৷”
আজ্ঞাবহরূপে মাথাটা একবার কাত করল সানা সম্মতি প্রকাশে। ওর বড়ো বড়ো চোখদুটোর নিচটা একটু দাবা৷ চোখের পানি মুছলেও ডান চোখের দাবা জায়গায় এক বিন্দু আটকে আছে৷ ঘন পাপড়িগুলো ভেজা‚ নাকের ডগাও হয়ে আছে রাঙা৷ শারফান হঠাৎ চুপচাপ ওকে দেখতে থাকল৷ দেখতে দেখতে ওর আরেকটা সৌন্দর্য আবিষ্কার করল সে। ডান চোখের বেশ খানিকটা নিচে কালো একটা তিল সানার। সকালে তা নজরে পড়েনি কেন? তখন কি ভালোভাবে দেখেনি মেয়েটাকে? হবে হয়ত। কিন্তু ওকে ভালো দেখায় তিলটাই। এই সারা মুখটাতেই তো দারুণ মিষ্টতা‚ সরলতা আর অনুভব হয় কেমন পবিত্রতা। তাই তো জারার মারের বদলা নিতে চাওয়ার যে ভয়াবহ চিন্তা সে করেছিল শুরুতে‚ সেই চিন্তা শেষ অবধি ধরে রাখতে পারল না। তবে যতই নিরীহ‚ নিষ্পাপ হোক। ছেড়ে সে দেবে না ফারনাজ কবিরকে। আর ফারনাজ কবিরকে পাওনা ফেরত দিতে হলে এই মেয়েকেই ফাঁসতে হবে।
সানার চোখের কোলে লেগে থাকা নোনাজলটুকু মুছে দেওয়ার ইচ্ছাকে সংবরণ করে বলল শারফান রূঢ়ভাবেই “তো নালিশ না দিলে ওই চুতি**‚ বান** জানল কীভাবে‚ হ্যাঁ? তোমার গার্ডিয়ান না হলে তোমাকে নিয়ে এত প্রোটেক্টিভ বিহেভিয়ার কেন করবে?”
এত নোংরা গালি-গালাজ শুনে সানার ইচ্ছা করল বই ভর্তি কাঁধের ব্যাগটা দিয়ে দুমদাম মেরে সন্ত্রাসটার চোপা ভেঙে দিতে। কিন্তু বদলে শিকার হওয়া খরগোশের মতো গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল সে। তাছাড়া ব্যাগের আধখোলা এক চেইনের ভেতর উপহার পাওয়া কাঠবিড়ালির একটা ছানাও রয়েছে৷
এর মাঝে অনি দোকান থেকে ফিরল। রিয়া তখন মাঝের ঘরে দুজন বান্ধবীর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আর সানার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ অনিকে দেখেই জানাল সে‚ “তোমার বাথরুমে সানা আছে‚ ভাইয়া। ঘরে ঢুকো না এখন।”
হাতে পাঁচ লিটার দুধের বোতল অনির৷ পিঠা ভেজাবে মা। সেই দুধ আনতেই সে গিয়েছিল দোকানে। রিয়ার কথা শোনা মাত্রই বাজে আশঙ্কায় ধপাস করে বোতলটা মেঝেতে রাখল৷ “শায়াফকে দেখেও কোন আক্কেলে আমার ঘরে ঢুকতে দিলি ওকে?” রাগান্বিত হয়েই চেঁচাল অনি৷
বান্ধবীদের সামনে ভাইয়ের থেকে বকা খেয়ে বেশ অপমানবোধ করল রিয়া। তাই রেগেমেগে বলল‚ “আমার কি কমনসেন্স নেই যে শায়াফ ভাইকে দেখেও ওকে তোমার বাথরুমে যেতে বলব? তোমার বন্ধু ছিলই না ঘরে।”
“সিরিয়াসলি!” একটু অবিশ্বাস ঠেকল কথাটা। জিজ্ঞেস করল অনি‚ “তুই দেখেছিস ওকে যেতে?”
“না‚ দেখিনি৷ ঘরের ভেতরও দেখিনি৷ কখন চলে গেছে তা জানি না।”
এমন স্বভাব তো না শারফানের৷ চলে যাওয়ার সময় অন্তত তাকে কল করে জানানোর কথা। বিষয়টা একটু খটকা মতো লাগলেও বোনের কথাও অবিশ্বাস হলো না অনির৷ ঘরে থাকলে রিয়া নিশ্চয়ই দেখতে পেত শারফানকে৷ অমন মোটাতাজা শরীরের মানুষ তো আর চোখের কোনায় হারিয়ে যেতে পারে না। চিন্তামুক্ত হয়ে দুধের বোতল তুলে নিয়ে সে চলে গেল রান্নাঘরে৷
ঠিক তখনই ঘরের ভেতর শারফান সানাকে প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত আর অসহায় করে তুলেছে৷ ওকে আচ্ছামতো বেকায়দায় ফেলে বলল সে‚ “তোমার ভাই কীভাবে জেনেছে তার কৈফিয়ত আমার দরকার নেই৷ আমার দরকার ক্ষতিপূরণ‚ আমার বোনকে মারা আর অপমানের প্রতিশোধ। সব কিছু ছাড় দিলেও আমার বোনের গায়ে হাত তোলার মামলা তো ছাড়ব না। তোমার ভাই থাকলে ছাড়ত?”
অবনত রাখা মাথাটা নাড়িয়ে না বলল সানা। মৃদুস্বরে বলল‚ “ফারনাজ ভাই অন্যায় করেছে আপনার বোনের গায়ে হাত তুলে। যদিওবা সরাসরি সে কিছু করেনি। আপনিও তাকে মারুন৷ আমি কিছুই মনে করব না।”
“তুমি মনে করলেই বা আমার কী? কিন্তু এখানে ইনডিরেক্টলি হলেও তোমারও দায়ভার আছে।”
মাথাটা ঝট করেই তুলল সানা‚ “কিন্তু আপনারই তো দোষ ছিল।” প্রতিবাদ না করে পারল না সে‚ “গতকালের কথা বাদ দিলেও আজ আপনি আমাকে খুব পেরেশান করেছেন‚ আমার চাদরটাও নিয়ে গেছেন। এতে তো আমার রিয়্যাক্ট করা স্বাভাবিকই‚ তাই না?”
“সেটা জায়গামতো না করে অজায়গায় করেছ তুমি”‚ কর্কশ গলায় বলল শারফান‚ “আর তার ফল আমি পাইনি‚ পেয়েছে আমার বোন। আমার বোন শুধু মারই খায়নি। কতটা ভয় পেয়েছে জানো? বাচ্চা মানুষ। তোমার ছোটো বোনও তো নাকি ওরই বয়সী বললে৷ ওইখানে তোমার বোন থাকলে কেমন লাগত তোমার?”
শারফানের গরম চোখে আর চোখ রাখতে পারল না সানা৷ দৃষ্টি নুয়িয়ে ফেলল “একটুও ভালো লাগত না। আমি সত্যিই খুব স্যরি ফিল করছি‚ ভা…” ভাইয়া কথাটা বলতে গিয়েই থামল দ্রুত। বলল‚ “যদি আমাকে মারতে চান তার জন্য‚ তবে মারুন না হয়।”
“ফোনটা দাও”‚ হঠাৎ আদেশ শারফানের৷ হাতটা বাড়াল তারপর সানার দিকে।
বিভ্রান্ত চোখে তাকাল সানা‚ “জরিমানা বাবদ ফোন দাবি করছেন?”
“ছোটোলোক লাগে আমাকে?” আবারও ধমকে উঠল শারফান। “জরিমানা ধরলে পুরো তোমাকেই দাবি করতাম। দাও ফোন।”
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে অসহায়ের মতো ফোনটা বের করে দিলো সানা। কোনো লক নেই ফোনে৷ ওয়ালপেপারে মুখের একপাশ ঢেকে রাখা ওর মুচকি হাসির ছবি। কাজল আর টেনে আইলাইনার পরা এক চোখ‚ গাঢ় মেরুন রঙের লিপস্টিক মাখা অর্ধেক ঠোঁট। দু’নজর ছবিটা দেখে দৃষ্টি তুলে একবার সানার দুঃখী মুখে তাকাল শারফান৷ তারপর ডায়াল প্যাডে নিজের নাম্বারটা তুলে কল দিলো। পকেটে নিজের ফোনটা বেজে উঠলে বের করে কল কেটে দিলো সানার নাম্বারটা দেখেই। বলল‚ “আমার যখন দরকার হবে তখন কল করব তোমাকে। সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ করবে কল৷ করবে তো?”
“বাল করব”‚ মনে মনে এই ভর্ৎসনাটা করলেও মাথা নেড়ে সম্মতিই জানাল সানা।
“না করলেই ভেবে নেব তুমিই নালিশ জানিয়েছিলে ফারনাজকে।”
“এ আবার কেমন কথা!” গলায় মেকি সরলতা ঢেলে বলল সানা‚ “অনেক সময় হতে পারে ফোনের কাছেই নেই আমি। আমার আব্বু ফোন ইউজের ব্যাপারে অনেক রেস্ট্রিকশন দিয়েছে তো…”
“অত এক্সকিউজ শুনতে পারব না আমি”‚ রুক্ষতার সঙ্গে বলে উঠল শারফান সানার কথার মাঝ পথেই। “আমি যাকে তাকে কল করে বেড়াই না‚ বুঝেছ? তোমার মতো মেয়েকে যখন করতে চেয়েছি তখন বুঝে নাও দরকারেই চেয়েছি৷”
“বুঝলাম”‚ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সানা।
ফোন নাম্বারটা নিজেই সেভ করে দিলো শারফান। তবে সেই সাথে আরও কিছু একটা করল সে। সানাকে দেখতে বা বুঝতে দিলো না সেটা। ফোনটা ফিরিয়ে দিলো ওকে‚ “যাও‚ বের হও এবার।”
মুখ-চোখ ধোয়া আর হলো না সানার। অবশ্য তা আর মাথাতেও নেই ওর। এখান থেকে কেবল বের হতে পারলেই রক্ষা। তবে একটা চিন্তা চট করেই মাথায় আসলো। ও বের হওয়ার পর যখন অনি ভাই বা অন্যরা দেখবে বন্ধ দরজার এপাশে শারফানও ছিল‚ তখন কী ভাববে সবাই ওদের নিয়ে? শারফান স্থির তাকিয়েই ছিল তখন ওর দিকে। চিন্তিত মুখটা তুলে সানাও তাকাল তার দিকে। জিজ্ঞেস করতে চাইলো এ ব্যাপারে৷ কিন্তু ওকে একটু অবাক করে শারফান নিজেই বলে উঠল‚ “অনিকে ম্যানেজ করে নেব আমি৷ তোমাকে নিয়ে কিছু ভাববে না।”
“কেন ভাববে না? ভাবাই কি নরমাল না?” প্রশ্নগুলো করতে চেয়েও করল না সানা। খচ্চর ব্যাটা যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে এই-ই ঢের। নয়ত যে ভয়টাই না পায়িয়ে দিয়েছিল ওকে! আর দাঁড়াল না৷ চঞ্চল গতিতে এগিয়ে দরজার ছিটকিনিটা সবে নামাল আর অমনি শুনল পেছন থেকে‚ “আমার দরকার যেদিন ফুরোবে সেদিন তোমার চাদরও ফেরত পাবে।”
“ওরে পাজির পা-ঝাড়া‚ তোর গায়ে দেওয়া চাদরে বসে আমি ইয়ে করব”‚ চোখ-মুখ শক্ত করে সানা মনে মনেই বকে তুষ্ট হলো। কিন্তু মুখে কোনো জবাব না পেয়ে শারফান ডাকল‚ “ওই কাঠবিড়ালির ছানা‚ শোনোনি কী বললাম?”
“শুনেছি তো”‚ আচমকাই ক্ষিপ্ত স্বর সানার। বহু কষ্টে দাবিয়ে রাখা রাগ আর বিরক্তিটা মনের ভুলে বের করেই দিলো সে৷ তা খেয়াল হতে ভীত চোখে একবার তাকাল শারফানের চোখ মটকে তাকানো দৃষ্টিতে। তারপরের মুহূর্তটা তৈরি হলো শূন্য সেকেন্ডের মাঝে। শারফান চোখের পলক ফেলার আগেই দরজা খুলে মারল সে ঝেড়ে দৌড়।
চলবে।
#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১০.
খ্যাতি আর পয়সা এক সঙ্গে অর্জন করার সৌভাগ্য সৃষ্টিকর্তা সবাইকেই দেন না। যাকে দেন তাকে তার কর্মফল হিসেব করে দেন৷ সৈয়দ কবির জীবনে তা কতটুকু অর্জন করেছেন আর ধরে রাখতেই বা পেরেছেন কতটুকু—তা নিয়ে আজ-কাল সমাজের বিশেষ মহল ছাড়াও সাধারণ মানুষগুলোও তুলনা করে ছেলে ফারনাজ কবিরের খ্যাতির সঙ্গে। মাত্র পাঁচটি বছরে সে তার স্তুতিবাণী জনসাধারণের মুখে মুখে যেভাবে তুলে দিয়েছে‚ তা সৈয়দ কবিরের করতে সময় লেগেছে তারা প্রায় গোটা জীবনটিই৷ নিজের প্রতিপত্তির পাশাপাশি এমন ছেলের বাবা হতে পেরে গর্ব তার পাহাড় ছুঁতে চায় এখন৷ তার সারা পরিবারটিই ফারনাজের জন্য আলাদা এক গরিমা নিয়ে চলে৷ লোকে আড়ালে আবডালে তা নিয়ে চর্চাও করে বটে। কিন্তু তাতে নেতিবাচক প্রভাব তেমন পড়ে না ফারনাজের ইমেজে৷ কেননা‚ নিজেকে সে জনসাধারণের সম্মুখে ঘরের ভাই‚ ঘরের সন্তানের মতো উপস্থাপন করে৷ নেতাকে সাধারণ‚ সাদামাটাভাবে মিশতে দেখে‚ চলাফেরা করতে দেখে মানুষগুলো তাকে আপনই ভেবে নিয়েছে৷
কিন্তু গর্ব কি ফারনাজ নিজেও করে না নিজেকে নিয়ে? গর্ব আর অহংকার কথাটা আক্ষরিকভাবে ভিন্ন দেখালেও ভাবার্থ প্রকাশে কিন্তু খুব বেশি পার্থক্য নেই৷ কারও কারও ক্ষেত্রে ওই গর্বটাই একটি সময় ধীরে ধীরে অহংকারে পরিণত হয়। হয়েছে তাই ফারনাজের বেলাতেও৷ ওসি মেহেদী হাসান বসে বসে ফারনাজকে দেখছিল আর এটাই ভাবছিল৷ অথচ সাধারণ জনতা তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবে না হয়ত। বুঝতে দেওয়া হবে না তাদের।
গাঁজা‚ ইয়াবা আর বাংলা মদে মারাত্মক আসক্ত পাতি মাস্তানগুলোর দুজনকে ধাওয়া করে ধরার পরই থানায় আনা হয়। শাফিউল আর শাকিবুল সাহেবের চাপে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চরম উত্তম-মধ্যম দিয়ে পেট থেকে কথাও বের করা হয়৷ কিন্তু সে মুহূর্তে দুজনই ছিল টালমাটাল অবস্থায়। তাই জবানবন্দি পেলেও তা নিয়ে সৈয়দ কবিরের সামনে দাঁড়াতে পারেনি ওসি সাহেব। মাতাল বা বেহুঁশ লোকের জবানবন্দির কোনো সত্যতা নেই নাকি। তাই ফারনাজও যাবে না এ ব্যাপারে কোনো জবাবদিহি করতে৷ এমনটিই বলে দিয়েছিলেন কবির সাহেব। তারপর আজ সকালে আসামি দুজন পুরোপুরি স্বাভাবিকে চেতনায় ফিরলে ওসি পুনরায় জবানবন্দি নেয়। এবং খুশি হয় এজন্যই যে‚ গতকালের চেয়েও বেশি কিছু বের করা গেছে ওদের পেট থেকে।
“আসলে মাইরের ওপর আর কোনো ওষুধ হইতেই পারে না”‚ বলে খিকখিক করে হেসে ফেলল মেহেদী।
দুপুরে কল দিয়ে সে আসামির জবানবন্দি জানায় ফারনাজ আর কবির সাহেবকে। এরপরই থানায় আসতে বাধ্য হয় ফারনাজ। আসার পর থেকে সাহেবের মতো পায়ের ওপর পা তুলে বসে নির্বিকার চেহারায় পত্রিকা পড়ছে শুধু৷ নূন্যতম সৌজন্যটুকুও দেখায়নি সে মেহেদী হাসানকে। আসার পর তার বক্তব্য এতটুকুই ছিল‚ যে তার নামে মামলা করেছে তাদেরও থানাতে উপস্থিত চাই। পথিমধ্যেই আছেন এখন শাফিউল সাহেব।
“ছিচকে চোর‚ গুণ্ডার কথাও বিশ্বাসযোগ্য হয় না”‚ পত্রিকাটা টেবিলের ওপর রেখে বলল ফারনাজ‚ “নিয়ে আসুন দেখি মাতালদুটোকে। আমার সামনে আরেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করুন।”
হাসল অফিসার‚ “আমি যে রেকর্ডিং শোনালাম। সেটাকে আপনি ফেইক বলতে চাইছেন না-কি?”
“তা কখন বললাম?” হাসল ফারনাজও‚ “আমার সামনে ওদের একবার দাঁড় করাবেন না?”
“করব তো নিশ্চয়ই”‚ বলে কনস্টেবলকে ইশারা করল ওসি।
গায়ে গতরে ব্যথায় জর্জরিত আসামিদুটোকে দুজন কনস্টেবল মিলে ধরে নিয়ে এলো ফারনাজের সামনে। ছেলেদুটোর বয়স বাইশ-তেইশের আশেপাশে হবে৷ ঢুলুঢুলু লাল চোখ আর রুগ্ন শরীরই প্রমাণ দেয় কোন পর্যায়ের মাদকাসক্ত দুজন। ফারনাজকে দেখে চেহারার অভিব্যক্তি তেমন বদলাল না তাদের৷ ফারনাজ হেসে জিজ্ঞেস করল দুজনকেই‚ “আমার সঙ্গে সরাসরি বা ফোনে তোদের কথা হয়েছে?”
ছেলেদুটোর মধ্যে একটা বিভ্রান্ত ভাব লক্ষ করল মেহেদী। ধমকে উঠল তক্ষুনি‚ “মুখ খুলিস না কেন‚ হারামির বাচ্চা? সকালে যা যা বললি বল!”
কাঁচুমাচু করে রুহুল নামের ছেলেটা বলল‚ “ফোনে যার সাতে ডিল হইছিল তার গলা ছিল আরাকরকম”‚ ফারনাজকে দেখাল‚ “এমন ছিল না।”
কপাল কুঁচকে ফেলল ওসি। চেয়ার ছেড়ে তেড়ে গেল ওদের কাছে। “কুত্তার বাচ্চা”‚ দশাসই এক থাপ্পড় বসাল রুহুলের গালে‚ “তাহলে আজ বললি কীসের ভিত্তিতে ফারনাজ ভাই ছিল ফোনে?”
গতকালের মারের চোটেই দাঁড়ানোর মতো আর সহ্য করার মতো শক্তি নেই ছেলেটার। ব্যথায় ককিয়ে উঠে কাঁদতে কাঁদতে বলল‚ “ফারনাজ ভাইয়ের পরিচয়ই তো দিছিল‚ স্যার৷ আমাগের ডেরায় টাকার খামও থুইয়া গেছিল আইসা কহন জানি৷ কেউ দেহি নাই। কী কী কথা কইছিল ফোনে সবই কইছি আপনেরে।”
“ফারনাজ কবিরকে সামনাসামনি দেখে ভয় পাচ্ছিস না তো আবার?” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করলেন শাফিউল হক৷
ঘাড়টা ঘুরিয়ে ফারনাজ চকিতে তাকাল পেছনে। শাফিউল সাহেব কী বললেন তার তোয়াক্কা না করে সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েই সালাম জানাল মুচকি হেসে। কুশল আলাপ করল‚ “কেমন আছেন‚ আঙ্কেল? এভাবে এমন পরিবেশে‚ অপবাদ নিয়ে আপনার মুখোমুখি হব কখনো ভাবিনি।”
কী অমায়িক হাসি আর আন্তরিক আচরণ! ভাবলেন শাফিউল সাহেব‚ প্রতিপক্ষ না হলে নির্দ্বিধায় আজ সুনাম করতেন ফারনাজের এই চতুরতায়৷ পরম শত্রুও এমন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সালামের জবাব না দিয়ে পারবে না।
“আল্লাহ পাক যেমন রেখেছেন।” এগিয়ে এসে ফারনাজের পাশের চেয়ারেই বসলেন তিনি‚ “তা তুমি কেমন আছ‚ তরুণ সমাজের আইকন? সত্যিই তোমার থেকে এমন কিছু পাবো তা আনএক্সপেকটেড ছিল আমার জন্যও।”
হাসল ফারনাজ আগের মতোই‚ “আমাকে যে ধরে বেঁধে ফাঁসানো হচ্ছে আর আপনাদের শত্রু বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে‚ তা আপনি এখনই জেনে যাবেন‚ আঙ্কেল।”
“তাই?” বলে তাকালেন শাফিউল ওসির দিকে। তার প্রশ্ন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে ওসি জানাল‚ “কথার সুর বদলাচ্ছে এখন।”
“স্টেটমেন্ট বারবার চেঞ্জ হচ্ছে কেন? কেমন আপ্যায়ন করলেন তাহলে?”
কনস্টেবলের কাছ থেকে লাঠি নিয়ে ওসি এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল আবার ছেলেদুটোকে৷ একটু থেমে ওদের হুমকি দিলো‚ “আরেক রাউন্ড খাওয়ার আগে ঠিক ঠিক ঘটনা জানা।”
ওরা কাঁদতে কাঁদতে ওসির পা ধরল জড়িয়ে৷ রুহুল বলল‚ “রতন ভাই হলো আমাগের লিডার৷ তার ফোনেই কল আইছিল৷ ডিল হওয়ার সময় ফোনের স্পিকার বাড়ায়ে আমাগের শুনায়ছিল কথাবার্তা। নিজির পরিচয় দিয়ে সৈয়দ বাড়ির মাইয়ারে দিশ্টাব করার কথাও কইছিল ওই লোকই৷”
রুহুলের চুলের গোছা টেনে ধরল ওসি‚ “ওই লোকের কথাবার্তার সাথে ফারনাজ ভাইয়ের কথাবার্তা আর গলার মিল নাই?” দ্বিতীয় ছেলেটাকেও করল একই প্রশ্ন। সে-ই জবাব দিলো‚ “না স্যার‚ নাই৷ ওই লোক এমন ভালো কইরা কথা কয় নাই৷ আমাগের মতো কথা কইছে। গলাও অইন্যরকম। রতন ভাইরে ধরবার পারলি ওর ফোনেরতে শুনবার পারবেন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওসি ছেড়ে দিলো ওদের। তখন ফারনাজকে জিজ্ঞেস করলেন শাফিউল সাহেব‚ “সৈয়দ বাড়ির মেয়েকে বিরক্ত করছে আমার ছেলে? তোমার বাড়ির কোনো মেয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে না-কি‚ ফারনাজ?”
তিনি আসার পরই ফারনাজ দু পা মিশিয়ে নম্র‚ ভদ্রভাবে চেয়ারে বসেছে৷ চোখের দৃষ্টিতেও এনেছে কোমলতা৷ সটান বসে হাতদুটো কোলের কাছে জড়ো করে রাখা। শাফিউল সাহেবের প্রশ্নে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ থাকল সে। বুঝেশুনেই প্রশ্নটা করা হয়েছে তাকে। একবার সানার নাম উল্লেখ করে যাতে নিজের কথার জালে নিজেই ধরা পড়ে সে। কিন্তু এই ভুল করা কি তার মতো মানুষের সঙ্গে মানায়? সরল হেসে তাকাল সে শাফিউল সাহেবের দিকে‚ “যে আসল কালপ্রিট তাকে ধরলে জানতে পারতাম আমিও। আপনি চাইলে এই গ্যাংটাকে ধরার কাজে আমি সহায়তা করতে পারি‚ আঙ্কেল৷ তাছাড়া আমার ওদের ধরা উচিতও৷ কারণ‚ এই মিথ্যা অপবাদটা আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতির জন্যই করছে কোনো তৃতীয় পক্ষ। কিংবা আমার সদ্য সৃষ্টি হওয়া কোনো শত্রু।”
শেষ কথাটা পরোক্ষভাবে ফারনাজ কাকে ইঙ্গিত করল তা বুঝতে অসুবিধা হলো না কারোরই। শাকিবুল সাহেব থাকলে ঝামেলা একটা লেগেই যেত এখন। কিন্তু যে মামলাটা তিনি করেছেন ফারনাজের নামে‚ সেটা নিয়ে এখন ভাবতে হবে৷ প্রমাণ হতে হতেও যে হলো না। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে তো নাম দেওয়ায় যায় ফারনাজের৷ তাই ওসিকে বললেন তিনি‚ “আপনি তাহলে গ্যাংটাকে ধরার চেষ্টা করুন। পরিষ্কারভাবে প্রমাণ না হওয়া অবধি আমি কেসটা উইথড্র করতে পারছি না।” বলেই তাকালেন ফারনাজের দিকে‚ “স্যরি‚ ইয়াংম্যান।”
“কোনো সমস্যা নেই”‚ এক গাল হাসল ফারনাজ‚ “আমার নাম যেহেতু জড়িয়ে এখানে৷ আমাকে তো ঝামেলা পোহাতেই হবে।”
“এক্সাক্টলি”‚ মৃদু হাসলেন শাফিউল৷ “উঠি তবে এখন। আপডেট জানিয়েন ফোনে”‚ বললেন ওসিকে।
“ইন্টারোগেশন শেষ হলে আমিও উঠি‚ অফিসার?” বলল ফারনাজ‚ “আমাকেও কলে জানিয়েন সব।”
“অফকোর্স। আসুন আপনিও।”
এক সঙ্গেই থানা থেকে বের হলো দুজন৷ ফারনাজের এলিয়নের সামনে রাখা হয়েছে শাফিউল সাহেবের ল্যান্ড ক্রুজার। কিন্তু একই পথ ধরে আসায় হিসেবে গাড়িটা দাঁড়াবে এলিয়নের পেছনে৷ আর আগে থাকতে হলে বেকার কষ্ট করে এলিয়নকে টপকে সামনে পার্ক করতে হবে৷ যেটা কোনো ড্রাইভার বা গাড়ির মালিকের মনে হবে না করাটা প্রয়োজন। শাফিউল সাহেবের মতো মুরব্বি মানুষ তো এমন ছেলেমানুষী করবেনই না৷ যে কারণে অদ্ভুত লাগল ফারনাজের৷ তা সে মনে মনেই ভাবল কেবল। গাড়িতে ওঠার আগে শাফিউল সাহেবকে বলল সে‚ “আশা করি খুব শীঘ্রই আমাদের ভেতরকার ভুল বোঝাবোঝি মিটে যাবে৷ দোয়ায় রাখবেন আমাকে‚ আঙ্কেল।”
“সে না হয় রাখব। কিন্তু একটা বিষয় ক্লিয়ার হলো না‚ বাবা!” ভ্রু কুঁচকে কপট ভাবুক চেহারায় বললেন‚ “আমাদের মধ্যে যদি ঝামেলা পাকাতে চায় কেউ তবে এই সামান্য ব্যাপার ধরে কেন? মানে তোমার বাড়ির মেয়েকে বিরক্ত করছে আমার ছেলে৷ ইভটিজিং বিষয়টা কি দুর্বল হয়ে গেল না খুব? আরও সিরিয়াস বিষয়কে তুলতে পারত আমাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির জন্য। তাই না? সেটাই তো করার কথা বুদ্ধিমান হলে।”
“কারণ”‚ জানালার হালকা খোলা কাচটা পুরোপুরি নামিয়ে তাদের মাঝে শারফান নিজেকে উদয় করল আর বলল ফিচেল হেসে‚ “লোকটা নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করলেও আদতে একটা খ্যাপা ষাঁড়ের মতো নিরেট মাথার আসলে। ওই যে‚ লাল কাপড় দেখানো মাত্রই তেড়েফুঁড়ে আসা ষাঁড়ের কথা বলছি।”
মিছে হাসি হাসি রাখা মুখটা শারফানকে দেখামাত্রই গম্ভীর বনে গেল ফারনাজের৷ ড্রাইভিং সিটে বসে শারফান হাসছে তখনো। গাড়ি পার্কিংয়ের ছেলেমানুষীটাও কে করেছে তা বুঝতে পারল ফারনাজ।
“কেমন আছ‚ ব্রাদার অপোনেন্ট? আমি কিন্তু যাব আজ-কালের মধ্যে তোমাদের এলাকায়। রাগ টাগ করবে না তো?”
“ছোটো ভাইইই”‚ টানটা দিলো বড়ো করেই ফারনাজ। চওড়া হাসি ধরে বলল‚ “তুমি তো থাকো বোধ হয় ফরিদপুরের বাইরে৷ তাই আমার বিষয়ে খুব একটা জানো না আমি কেমন৷ আমার এলাকাতে গিয়েই না হয় জেনো‚ যদি ইচ্ছে হয়। আমি যে-কোনো শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মন খুলে মিশতে ভালোবাসি। ন্যায়-অন্যায় বোধটুকু আমার আব্বা আমার ভেতরে এমনভাবে দিয়েছেন যে‚ ছোটো-বড়ো যে মামলায় হোক৷ আজ পর্যন্ত কেউ হতাশ হয়ে ফেরেনি আমার থেকে। বলতে পারেনি আমি সুবিচার দিতে পারি না৷ জনগণের ভোটে জয় বিজয় নিশ্চিত হবে৷ সেখানে আমার এলাকার মানুষ যদি আমাকে ছেড়ে শাকিবুল আঙ্কেলকে ভোট দেয় সেটা তাদের মৌলিক অধিকার। তুমি প্লিজ ভয়-ডর পুষে রেখো না আমার এলাকায় ঢোকার জন্য৷ নিশ্চিন্তে যাবে আর নিশ্চয়ই আমার বাসাতে এক কাপ চা হলেও খেতে আসবে৷ এই বড়ো ভাইয়ের দাওয়াত ফেলো না কিন্তু। আর হ্যাঁ‚ প্রথমদিনের কথাও ভুলে যেয়ো। সেদিন আনুষাঙ্গিক কাজে বেশ নাজেহাল ছিলাম বলে অযথা রুড হয়ে গিয়েছিলাম মনে হয় তোমার সাথে। মাফ করে দিয়ো ভাইয়াকে‚ কেমন?”
তেরছা হেসে বাধ্য ছোটো ভাইয়ের মতোই ঘাড় নাড়ল শারফান‚ “দেখা হবে জলদি।”
হাসছিলেন শাফিউল সাহেবও ফারনাজের কথা শুনতে শুনতে৷ তার সামনে দাঁড়িয়েই তার ছেলেকে কত সূক্ষ্মভাবে হুমকি দিয়ে দিলো! সেটা ভেবে মনে মনে মুগ্ধও হলেন ফারনাজের প্রতি—এমন সাহস‚ এমন অসংশয়ে কথা বলার স্পর্ধা কয়জন তরুণ নেতা রাখে? আড়চোখে তাকালেন একবার ছেলের দিকেও। ছেলের মিটিমিটি এই হাসির সঙ্গে যদি ফারনাজ পরিচিত থাকত পূর্বে‚ কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করত সে নিশ্চয়ই। তবে তিনি এই দুজনের হাঙ্গামা বড়ো হতে দেবেন না। প্রথমবারের মতো ছাড় দেওয়া উচিত। ছেলেকে তা বোঝাবেন৷ কিন্তু ফারনাজ না থামলেই হয়ে যাবে মুশকিল।
***
মিছিল‚ জায়গায় জায়গায় সমাবেশ—যতদিন দিন এগোচ্ছে ততই নির্বাচনের আমেজ বাড়ছে৷ কোথাও কোথাও মারামারি‚ সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। নভেম্বরের পঁচিশ তারিখে তফসিল ঘোষণার পর থেকে এই সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাতে। সেদিক থেকে ফরিদপুর কিছুটা শান্তই ছিল শুরুতে। কিন্তু এখানের পরিস্থিতিও খারাপ হতে চলেছে৷ অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে ২০১৪ এর নির্বাচন।
সকালের নাশতা করতে বসেছেন মোস্তফা সাহেব। খেতে খেতে মেয়েদের বললেন‚ “আপাতত ক্লাস করার দরকার নেই। পরিবেশ গরম খুব৷ প্রাইভেট পড়েই সোজা বাড়ি চলে আসবে দুজনই।”
জোহরা খাতুন ফারনাজের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন যখনই শোনেন বাইরের পরিবেশ‚ পরিস্থিতি ভালো না। জলচৌকিতে নামাজ পড়েন‚ ওখানে বসেই খাওয়া-দাওয়া করেন৷ ছেলের কথা শুনে ভাতের প্লেট থেকে হাত তুলে আতঙ্কিত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে৷ ফারনাজের ব্যাপারে কথা শুরু করবেন‚ তার আগেই মোস্তফা জিজ্ঞেস করলেন সানাকে‚ “অনির কাছে পড়তে যাচ্ছিস না কেন?”
সেদিনের পর চারদিন হলো কেটে গেছে৷ এর মাঝে দুদিন ছিল অনির প্রাইভেট। কিন্তু শারফানের ভয়ে সানা যায়নি৷ মাকে বলেছে ছুটি নিয়েছে অনি ভাই কদিনের জন্য৷ তাই সে কথায় জানাল সে বাবাকেও। গম্ভীর চোখে তাকালেন তখন মোস্তফা‚ “কোনো সমস্যা ফেস করলে সরাসরি বলবি। মুখের মধ্যে কথা রেখে সমস্যা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনো প্রয়োজন আছে?”
একটু বিচলিত দেখাল সানাকে‚ “না‚ আমি বলব তোমাকে কোনো সমস্যায় পড়লে৷” শারফানের ব্যাপারে জানানোর সিদ্ধান্তটা আপাতত স্থগিত রেখেছে সে৷ অনেক ভাবনাচিন্তার ব্যাপার আছে এখানে। যেহেতু ফারনাজও জড়িয়ে পড়েছে তার বিষয়ে৷ তাই বাবাকে সবটা জানানোর আগে কথা বলতে হবে ফারনাজের সঙ্গে।
নাজমা বেগম পরিষ্কার বুঝলেন না বাবা-মেয়ের কথার প্রসঙ্গ৷ জিজ্ঞেস করতে যাবেন এ ব্যাপারে‚ কিন্তু তিনিও সুযোগ পেলেন না। কারণ‚ তার পূর্বেই জানালেন মোস্তফা‚ “দুপুরে দাওয়াত আছে রিটায়ার্ড প্রফেসর আবুল কালামের বাসায়৷ ওনার ছেলের বউভাতের দাওয়াত। তোরা দুই বোন যেতে চাইলে বারোটার ভেতরই তৈরি হয়ে নিস।”
“ওহ”‚ চেয়ারে বসেই মেহা আনন্দে নেচে উঠল‚ “কতদিন পর বিয়ে বাড়ির ডাল খাবো!”
হেসে ফেলল সবাই। সানা বলল‚ “তোর তো যাওয়ায় উচিত না। ডাল খেয়ে বাসায় এসে তো ডাল হাগু দিস‚ পাজামা নষ্ট করে ফেলিস।”
দাওয়াত খেয়ে আসার পরই মেহার পেটের সমস্যা হয়ে যায় প্রতিবার। তবুও সে দাওয়াত খাওয়া বাদ দিতে রাজি নয়। সানাকে বলল‚ “সমস্যা কী? তুই সাফ করিস।”
“হোপ্!”
আবার হাসাহাসি চলল সবার। খাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘরে ফিরতেই দিনার কল এলো সানার কাছে৷ রিসিভ করে পড়ার টেবিলে এসে বসল সানা‚ “বল‚ কী করিস?”
“আমি আর কী করব? তোর ফোনের কী হয়েছে সেটা বল? ফোন কি কাকু নিয়ে গেছে? ধরা পড়ে গেছিস বাড়ি?”
দিনার কথাবার্তায় দারুণ অবাক হলো সানা‚ “ধুর! ধরা পড়ব কেন? ফোন আব্বুর কাছে থাকলে তোর কল রিসিভ করলাম কীভাবে?”
“তাহলে পান্থ কল করে তোকে পায় না কেন? যতবার কল করেছে ততবারই নাকি কোন ব্যাটা হ্যালো বলেছে?”
“মানে? কোন ব্যাটা হ্যালো বলে? আমার ফোন তো আমার কাছেই থাকে আর মেহা ধরে।”
“আজ তিনদিন হলো তোকে কল দিলেই কোনো ব্যাটা হ্যালো বলছে বলল। তাই তো আমাকে কল দিয়েছে আজ। তুই সমস্যায় পড়েছিস নাকি জানতে চাচ্ছে।”
ভয়ে‚ দুশ্চিন্তায় চাদরের ভেতর শরীরটাই ঘাম ছুটে গেল সানার। কতক্ষণ ভাবনাচিন্তা করেও কোনো কুল-কিনারা পেল না এমন সমস্যার। জিজ্ঞেস করল‚ “তোর কল তো ঠিকই আসলো আমার কাছে। তাহলে ওর কল কেন আসলো না?”
এই ছানারা বলুন তো‚ কেন আসলো না পান্থর কল?
কভার ফটো – মাকসুদা রত্না
চলবে।