মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে পর্ব-১১+১২

0
3

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১১.

বেলা ১২:৩০ ।
মুখ গোঁজ করে এসে দাঁড়াল জারা ভাইয়ের বিছানার পাশে৷ হাঁক ছেড়ে উঠল‚ “এই ওঠ‚ ভাইয়া৷ তোর বাপ‚ চাচা সেজেগুজে বসে আছে বিয়ে খাওয়ার জন্য। তুই কখন সাজবি?”

শাফিউল আর শাকিবুল সাহেব যাবেন এখন বিয়ের এক নিমন্ত্রণে। সঙ্গে নিয়ে যাবেন শারফানকেও। যেতে চেয়েছিল তাই জারাও। কিন্তু নেবেন না তাকে শাফিউল সাহেব। কত অনুনয় করল সে মা আর চাচার কাছে‚ যেন রাজি করান তারা বাবাকে। কিন্তু কেউই রাজি হলো না। এজন্যই মেজাজ চটে আছে জারার।

শারফানের মাথার চাঁদিটা একটুখানি বেরিয়ে আছে কম্বলের ভেতর থেকে৷ সেদিকে তাকিয়ে সে আবারও উচ্চরবে ডেকে উঠল‚ “এই‚ উঠিস না কেন? না গেলে বলে দে।”

কোনো উত্তর না দিয়ে শারফান একটু নড়ল চড়ল শুধু কম্বলের নিচে৷ তিরিক্ষি হয়ে তাই জারা সবার ওপরের রাগ ভাইয়ের চুলের ওপর প্রয়োগ করল। যতটুকু উঁকি দিচ্ছিল কম্বলের ফাঁক থেকে‚ খাবল মেরে সেটুকু চুল ধরে দিলো টান‚ “ওই‚ তুই উঠবি না? যাবি না তুই? না গেলে তাদের বলে দে যেন আমাকে নিয়ে যায়।”

চেঁচিয়ে ‘উহ্’ কাতর শব্দ করে উঠল তখন রিহান। গায়ের ওপর থেকে সে কম্বলটা সরালে বাথরুমের দরজা খুলে বের হলো সে সময় শারফান। কোমরে সাদা-কালো চেকের গামছা প্যাঁচানো ওর৷ গোসলে ছিল সে এতক্ষণ। গা থেকে হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসছে সাবান‚ শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। জারা ভূত দেখার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইল ঘাড় ফিরিয়ে।

“কী হয়েছে তোদের?” বলতে বলতে এগিয়ে এলো শারফান। জিজ্ঞেস করল জারাকে‚ “তুই কী করছিস এখানে?”

ব্যথায় মুখ বিকৃতি করে নালিশ করল রিহান‚ “আমার চুল টেনে কতগুলো ছিঁড়ে নিয়ে আসছে তোর বোন‚ দেখ।”

“আমি তো জানি তুই ঘুমাচ্ছিলি মুড়ি দিয়ে”‚ কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে জবাবদিহি করল জারা৷ খুব লজ্জায় পড়ল মেয়েটা৷ ফুপাতো ভাই হলেও রিহান বয়সে বেশ বড়ো হওয়ায় কখনো সেভাবে কথাবার্তা হয়নি তার সঙ্গে৷ যতটুকু যা হয়েছে সৌজন্যতা বজায় রাখতেই কেবল।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটা অপছন্দ হলো শারফানের৷ জারার দিকে শাসনের নজর বিদ্ধ করল‚ “বিদায় হ এখনই।” বলল তারপর ভারিক্কি সুরে‚ “এখন থেকে দরজায় নক করবি আগে। কোনো সাড়া না পেলে চলে যাবি। ঘরে ঢুকবি না একদম।”

বলা মাত্রই ছুট লাগাল জারা। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শারফান ধমক লাগাল রিহানকে‚ “হারামজাদা‚ আমার কম্বলে ঢুকেছিস কেন?”

“আরে ঘুমের মধ্যে টেনে গায়ে নিয়েছি মনে হয়।”

“তোর শোয়াও ভালো না‚ শালা বেয়াক্কেলে। ঠেলে গায়ের ভেতরে চলে আসিস। আজকে থেকে তোর বড়ো মামার কোলের ভেতরে গিয়ে ঘুমাবি।”

“আমার শোয়া ঠিকই আছে”‚ গর্জে উঠল রিহান মুহূর্তেই‚ “শালা অজগর‚ তুই ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাস। জায়গায় পাই না আমি। অথচ এত বড়ো বিছানায় আরামসে চারজন ঘুমানো যায়। বউ আসলে সকালে ঘুম ভেঙে দেখবি খুঁজেই পাচ্ছিস না৷ লাথি মেরে খাটের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিস।”

হাসতে হাসতে ওয়াল কেবিনেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শারফান‚ “বউ মনের মতো হলে কোলবালিশের জায়গা পাবে। নয়ত খাটের তলাতেই ঠাঁই হবে।”

“তুই আশা করিস কীভাবে তোর মতো শয়তান পাপীর ঘরে ভালো জিনিস আসবে?” বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেতে যেতে বলে গেল রিহান।

সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে ঢুকিয়ে শারফান জবাব দিলো‚ “ভালো জিনিস পায়ে হেঁটে না আসলে ধরে বেঁধে নিয়ে আসব।”

“তাও পালিয়ে যাবে দেখিস”‚ বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে বলল রিহান।

“চেতাস না আমাকে৷ বাইরে থেকে আটকে রাখব কিন্তু।”

***

প্রচুর মানুষ নিমন্ত্রিত। কনভেনশন হলে প্রবেশ করতেই সানার হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করল৷ সিঁড়ি বেঁয়ে ওঠার সময় পা ফেলার মতোই জায়গা নেই৷ না চাইতেও অন্যদের সঙ্গে গা ঘেঁষে চলতে হচ্ছে। মেহার হাতটা ধরে মোস্তফা সাহেবের পিছু পিছু বহু ঠেলাঠেলি করে নির্দিষ্ট ফ্লোরে এসে পৌঁছল সে। আশ্চর্য হলো তারপরই। তৃতীয় তলায় এত শান্তশিষ্ট পরিবেশ! কিন্তু দোতলায় কত ভিড়!

কনের বাবা ছিলেন গতবারের কাউন্সিলর। তাই কনেপক্ষের থেকে আসা আত্মীয়দের মাঝে যারা রাজনৈতিক আর অন্যান্য পেশায় মান্যগণ্য ব্যক্তি‚ তাদের এবং বরপক্ষের আমন্ত্রিত সম্মানিত অতিথিদের জন্য এই তৃতীয় ফ্লোরে একটু বিশেষভাবে সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে৷ বরের বাবা আবু কালাম হলেন মোস্তফা সাহেবের একরকম শুভাকাঙ্ক্ষী। তাকে দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনিয়ম করে তিনি নিজেই একটা টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালেন সানাদের। জিজ্ঞেস করলেন মোস্তফাকে‚ “কবির ভাই আর ফারনাজ আসবে না?”

পক্ষপাতশূন্যতা বজায় রাখতে তিনি সবাইকেই আমন্ত্রণ করেছেন। মোস্তফা সাহেব উত্তর দিলেন‚ “আমার জানা নেই তো‚ ভাই। কবির ভাই না আসতে পারলেও হয়ত ফারনাজ আসবে।”

দুজনের কথাবার্তার মাঝেই আগমন ঘটল শাকিবুল হকের। সাথে শাফিউল সাহেবকেও দেখা গেল। চেহারার মিলে সানা আর মেহা বুঝতে পারল তারা দুই ভাই৷ কালাম সাহেব তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চলে গেলেন৷ বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই হক সাহেবদের ঘিরে। গতবারের মেয়রও এসে পড়ল এর মাঝেই৷ তাদেরকে এক সঙ্গে এক টেবিলে বসিয়ে চারজন ক্যাটারিং স্টাফকে নিয়জিত করা হলো সেখানে৷

মেহা বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখছে। এত চাকচিক্যময় এখানের সবার বেশভূষা! পোশাকে আর নারীদের সাজগোজ‚ অলঙ্ককারেই বোঝা যাচ্ছে উচ্চবিত্ত পর্যায়ের মানুষ এরা৷ কিন্তু মেহার পাশে বসে সানা এসবের কিছুতেই আগ্রহ পাচ্ছে না৷ সারাটা সময় সে নিজের ফোনের চিন্তায় অস্থিরতার মাঝে আছে। সকালে দিনার সাথে আলোচনা করে সে বুঝতে পেরেছে কল ফরোয়ার্ড সিস্টেম চালু করে রাখা হয়েছে ওর ফোনে। দুর্ভাগ্যবশত পান্থর কলটা যে দুবার এসেছিল সে দুবারই সে ধরতে পারেনি। আর তখন ওই কল অন্য নম্বরে ফরওয়ার্ড হয়ে গেছে এবং সেই ব্যক্তিটি কলটা গ্রহণ করেছে। তার উদ্দেশ্য ওর ব্যক্তিগত তথ্য বা কলারের কথোপকথন যাতে শুনতে পারে। ঠিক একইভাবে কলের মতো মেসেজও সেই অন্য নম্বরে ফরোয়ার্ড হয়ে যায়৷ আবার ফোনে মিসড কল নোটিফিকেশনও সানা পায়নি মেহার কারণে৷ ভুলবশত মেহা ভেবেছিল সানা হয়ত ইচ্ছা করেই কল ধরেনি পান্থর। তাই সে নোটিফিকেশনও মুছে দিয়েছিল।

এখন সেই নম্বরটা কী এবং কার‚ কীভাবে নম্বরটাকে ব্লক করবে‚ এর কিছুই জানা নেই সানা আর দিনার। তবে এটা আন্দাজ করছে সানা‚ সেদিন শারফানই কিছু একটা করে রেখেছে৷ হয়ত শারফানের ফোনেই গেছে ওর রিসিভ না করতে পারা কলগুলো। কিন্তু তাকে ফোন করার দুঃসাহস তো হচ্ছে না ওর। সমাধান পেতে রিয়াকে কল করেছিল সে। রিয়াও জানে না। বিশ্বস্ত কোনো ছেলে বন্ধুও নেই। এই চিন্তা নিয়ে কোনোভাবেই সে সুস্থির হতে পারছে না।

সবাই টেবিলে বসতেই হলে ঢুকল শারফান। ভি শেপ গলার সাদা টি-শার্ট‚ ওপরে কালো রঙা ক্যাজুয়াল স্যুট আর প্যান্ট আর পায়ে সাদা স্নিকার্স। স্যুটের হাতা গুটিয়ে রেখেছে বেশ খানিকটা ওপরে। হাতে চকচক করছে রোলেক্সের ঘড়িটা৷

মেহা চোখ বড়ো করে‚ ভ্রু টানটান করে তাকিয়ে রইল শারফানের দিকে। প্রথম দর্শনে শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্যাডার ভাবা ছেলেকে দ্বিতীয় দর্শনে আপাদমস্তক সৌমর্দশন রূপে আবিষ্কার করে সে বিমূঢ়। সেই লাল চোখ‚ এলোমেলো বড়ো চুল আর একগাদা গোঁফ-দাড়ির বদলে সম্পূর্ণ পরিপাটি চেহারা। তবে প্রথম দিনের মতোই মুখটাতে কাঠিন্যতা রয়েছে। বসল গিয়ে শারফান শাফিউল সাহেবের পাশে।

“আপু! এই আপু‚ ওই দ্যাখ”‚ শারফানের দিকে চেয়েই মেহা খোঁচাতে থাকল সানাকে।

“কী দেখব?”

“তোকে বিরক্ত করেছিল যেই ব্যাটা‚ ওই দ্যাখ।”

মেহার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল সানা সামনে। আশ্চর্যভাবে তখনই কথা বলতে বলতে নজর ঘুরাল শারফান সানাদের টেবিলে। নিমেষেই চোখে চোখ পড়ে গেল দুজনের। শারফানকে দেখে মেহার মতো সানাও হলো বিস্ময়াভিভূত। তবে তা স্রেফ কিছুক্ষণের জন্যই। টেবিলে বসা সবার অগোচরে শারফান ভ্রু নাচিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকি হাসতেই সানা চোখ সরিয়ে নিলো তক্ষুনি।

খাওয়ার সারাটা সময়ের মাঝেই সানা বন্দি রইল শারফানের নজরে। যে কারণে মেইন কোর্সের পর স্বাদের ফালুদাটুকু খাওয়ার আর ধৈর্য রইল না সানার। সবার আগে কোনোরকমে খেয়েদেয়ে উঠে পড়ল সে৷ অতিথিদের বিশ্রাম করে বসার জায়গাতে গিয়ে বসল চুপচাপ। কিন্তু শান্তি মিলল না সেখানেও। কয়েকজন মহিলা ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে শুরু করল ওকে। তাদের মাঝে একজন সরাসরি এসেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল ওর পরিচয় সম্পর্কে।

পনেরো মিনিট বাদে মেহা সানার কাছে গেল আর মোস্তফা সাহেব এলেন দোতলায়। সেখানেই বোধ হয় উপঢৌকন বা উপহার প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপহারের বদলে তিনি কিছু নগদ অর্থ দেবেন৷ দেখলেন‚ অতিথিদের বিশ্রামের জায়গাতে এক যুবক বসে আছে সামনে টেবিল নিয়ে। সেখানেও ভিড় লেগে আছে। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে গিয়েই হলেন বেকুব৷ মানিব্যাগ নেই৷ বুকের ভেতর খচ করে উঠল তার। পাজামার পকেটেও খোঁজ করতে থাকলেন ভালোভাবে। না‚ মানিব্যাগ নেই কোথাও। কিন্তু ভুলো মনা মানুষ তো নন তিনি! তার স্পষ্ট মনে আছে পাঞ্জাবি পরেই মানিব্যাগটা পকেটে পুরেছিলেন। তাহলে কি এখানে এসেই কেউ পকেট থেকে তুলে নিলো? হয়ত ওপরে ওঠার সময় ওই ভিড়েই কেউ কাজটা করেছে৷ কেমন অস্থির অনুভব করলেন তিনি৷ মান সম্মানের প্রশ্ন কিনা। কালাম সাহেবের সাথে সুসম্পর্ক বটে। মানিব্যাগ চুরির কথা জানলে ভদ্রলোক নিজেই দেখা গেল অস্বস্তিতে পড়বেন আর উপঢৌকনের কোনো প্রয়োজন নেই‚ এমনটিই বারবার প্রকাশ করতে চাইবেন। তবুও লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে তো বাঁচবেন না তিনি৷ ভাবলেন‚ বাড়িতে কল করে নাজমা বেগমকে জানাবেন যেন কাউকে দিয়ে টাকা বিকাশ করে দেন তাকে। তবে তার আগে সানাকে কল করলেন। যদি সানার কাছে কিছু পাওয়া যায় এই আশায়। টাকা জমানোর স্বভাব মেয়েটার স্কুল জীবন থেকেই৷ অনেক টাকা হয়ে গেলে পরবর্তীতে তা নিজেই মায়ের হাতে তুলে দেয়। অথবা কিছু কেনার প্রয়োজন হলে৷

কল তুলল সানা‚ “হ্যাঁ‚ আব্বু?”

কণ্ঠ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মোস্তফা‚ “তোমার ব্যাগে কি পাঁচ হাজার টাকা হবে‚ মা?”

“এত টাকা নিয়ে তো বের হই না‚ আব্বু। কী হয়েছে?”

“মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। আচ্ছা রাখো‚ দেখছি আমি।”

ফোনটা কেটেই বাড়িতে কল করলেন তিনি। কিন্তু রিসিভ হলো না। লাগাতার করতেই থাকলেন৷ ফলাফল শূন্যই পেলেন বারবার৷ নিশ্চয়ই ভাতঘুমে আছে সবাই আর ফোন পড়ে আছে হয়ত অন্য ঘরে৷ ঠোঁট কামড়ে ভীষণ চিন্তিত মুখ করে ফোনের কনট্যাক্ট লিস্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাবতে থাকলেন‚ কার থেকে সাহায্য নেওয়া যায়।

ঠিক এই মুহূর্তে পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটি দেখে যাচ্ছিল শারফান। সেও নগদ টাকা দেবে বলেই এসেছিল শাফিউল সাহেবের নির্দেশে৷ সানার কাছে বলা মোস্তফা সাহেবের কথাগুলো শুনতে পেয়েই বুঝতে পেরেছে তার বিপদটা৷ তবে তার বিপর্যস্ত পরিস্থিতি দেখে ওর বেশ মায়া অনুভব হলো। বিশেষ করে মোস্তফা সাহেবের সরল মুখে গাঢ় চিন্তার ছায়া দেখতে পেয়ে৷ কারণ‚ তিনি যে মানিব্যাগ হারানোর থেকেও সম্মানের চিন্তায় ঘেমে যাচ্ছেন‚ এটা সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। এজন্যই কোনো ভাবনাচিন্তা না করে আচমকা গলা খাকড়ি দিয়ে ডেকে উঠল তাকে‚ “এক্সকিউজ মি‚ আঙ্কেল?”

ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত ছিলেন বলে শারফানের অমন ভারী স্বর হঠাৎ শুনে চমকালেন তিনি৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন‚ “আমাকে ডাকছ?”

“হ্যাঁ”‚ কণ্ঠ খাটো করে শারফান বলল‚ “আনএক্সপেকটেডলি আমি আপনার প্রবলেমের বিষয়ে সবটা শুনেছি৷ কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে হেল্প করি?”

অচেনা‚ অজানা কারও থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা শুনলে যেমন অভিব্যক্তি হওয়া উচিত তেমনই হলো মোস্তফা সাহেবের৷ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন তিনি৷

“আপনি এমব্যারেসড হবেন না প্লিজ৷ আমার নাম্বার রেখে দিন। সময় করে বিকাশে রিটার্ন করবেন না হয়।”

“তোমার নাম কী? বাবার নাম কী? থাকো কোথায়?” ভ্রু কুঁচকে জেরা করার মতোই প্রশ্নগুলো করলেন মোস্তফা সাহেব।

আর তার এই তিনটি প্রশ্নের ধরনেই শারফান কিছুটা ওজন করে নিলো মোস্তফা সাহেবের ব্যক্তিরূপকে। বলল অনায়াসেই‚ “আমি শারফান শায়াফ। শাফিউল হকের ছেলে। আপনি ভরসা করতে পারেন আমাকে। ব্যাপারটা নিয়ে কোথাও চর্চা করব না আমি৷”

এক দৃষ্টিতে মোস্তফা সাহেব দেখলেন তখন শারফানকে৷ ভাইয়ের প্রতিপক্ষ দলের মানুষ হলেও ছেলেটার কঠিন রাশভারী গলায় বলা এই কথাগুলোতে কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারলেন না। কিছু একটা তাৎপর্যময়ও অনুভব করলেন ওর কণ্ঠে আর ব্যক্তিত্বেও। এদিকে বাড়ি থেকে ফিরতি কলও এলো না এখনো। একটু ভেবে শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন তিনি‚ “তোমার বিকাশ নাম্বারটা দাও।”

“দিচ্ছি। আগে টাকাটা নিন”‚ বলে মৃদু হেসে মানিব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিলো শারফান।

বিব্রত হেসে তা গ্রহণ করলেন মোস্তফা সাহেব। তবে টাকা দেওয়া শেষে শারফানের দেওয়া মিঠা পান মুখে পুরে তিনি কথাবার্তা জুড়ে দিলেন ওর সঙ্গে৷ শারফান আগাগোড়াই বাকপটু৷ ব্যবসার খাতিরে তা আরও কিছুটা প্রশংসনীয় হয়েছে। ধীরে ধীরে মোস্তফা সাহেবকে সহজ করে তুলল সে৷ তিনিও মজা পেলেন ওর সঙ্গে কথা বলে৷ এর মাঝে সানাকে কল করে সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে তা জানিয়েও দিলেন।

তৃতীয় ফ্লোরে পৌঁছে মোস্তফা সাহেব বিদায় নিলেন শারফানের থেকে। মেয়েকে ফোন করতে করতে চলে গেলেন নিজের কলিগদের কাছে।

এদিকে ওয়াশরুমে লম্বা সিরিয়াল দেখে সানা এসেছে একজন স্টাফের পরামর্শে চতুর্থ তলায়৷ এখানেও কিছু মানুষের আনাগোনা আছে৷ তাদের রুফটপে যেতে দেখল সানা। তবে তারাও বোধ হয় এসেছিল ওয়াশরুমের তাগিদেই। আপাতত পুরো ওয়াশরুমই ফাঁকা এখন। কাজ সেড়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে ঠোঁটে লিপস্টিকটা ঠিকঠাক করার জন্য। বাবার কল এলো তখনই। তাকে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়ে লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে ছোঁয়াল সবে আর অমনি বাইরে থেকে কানে এলো‚ “এই তুমি শায়াফ না?”

কথাটা বলল এক মেয়ে কণ্ঠ। সানার বুক কেঁপে উঠল তাতেই। নামটা ঠিকই শুনল তো সে? বিভ্রান্ত মন নিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিতে চেষ্টা করল একবার৷ দেখা গেল না কাউকে। তাই একটু বেরিয়ে এলো। এবার স্পষ্ট দেখল শারফানকে অদূরেই। পকেটে এক হাত পুরে‚ ভ্রু বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে এক মেয়ের কাছে৷ মেয়েটাকে চিনিয়েছিল বাবা। মেয়েটা মেয়রের হয় নাকি। দেখতে একদম নায়িকাদের মতো সুন্দর৷ গায়ের রং এতই ফরসা যে‚ সানার মনে হয় একটু আলতো করে ধরলেও রক্ত বেরিয়ে আসবে৷ রিবন্ডিং করা খোলা চুলগুলো বিচ ব্রাউন বর্ণের৷ চোখে গাঢ় ধূসর রঙা লেন্স। আর উচ্চতাও বেশ। শারফানের মতো লম্বা ছেলের নাক ছুঁয়ে যাচ্ছে একদম৷ বর্ণোজ্জ্বল রুপালি রঙের পরনের শাড়িটার কারুকাজ এত জমকালো যে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ এই মেয়েটার সাথে তিন-চার বছরের একটা শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাকেও দেখেছে সানা। সম্ভবত ছেলে হবে৷ মাম্মি বলে ডাকছিল মেয়েটাকে।

“সিরিয়াসলি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি‚ শায়াফ?” মেয়েটার চোখে-মুখে কেমন অভিমান উপচে পড়তে চাইলো৷

নিচে ওয়াশরুমে সিরিয়াল দেখে শারফানও এসেছিল টয়লেটের কাজ সেড়ে রুফটপে যাবে বলে। কোম্পানি থেকে জরুরি একটা কল এসেছে। নিরিবিলিতে কথা বলা দরকার। এর মধ্যে পিছু ডাক। এই পিছু ডাক স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার দিলেও সে ভালোভাবে নিতে পারবে না। এতখানিই অসহ্য লাগে ওর! নয়-দশ বছর পর জীবনের প্রথম আর শেষ প্রেমকে দেখেও তাই খুশি হতে পারল না।

“আমার চোখের পাওয়ার ফ্যালকন থেকে কম না‚ তোয়া। তামাটে রং থেকে ধুতুরা ফুলের মতো সাদা হয়ে গেছ। এই তো? না চেনার কী আছে?”

আড়ালে দাঁড়ানো সানা ক্ষিপ্ত চাউনি নিয়ে তাকাল শারফানের দিকে৷ কী বিশ্রী ব্যবহার শয়তানটার!

“তুমি বদলাওনি‚ শায়াফ”‚ মাথাটা ঝুঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তোয়া।

“বদলাব মানে?” বিরক্ত চেহরায় বলল শারফান‚ “আমি কি দেখতে মানুষের মতো না? উল্লুক লাগে নাকি তোমার যে বদলাতে হবে?”

নিজের কপালে আস্তে করে এক চাপড় বসাল তোয়া‚ “বাবা ভুল হয়েছে আমার। রিল্যাক্স! তুমি দেখতে আরও ড্যাশিং‚ মাচো ম্যান হয়েছ এতে সন্দেহ নেই৷ আমি তোমার রুক্ষ স্বভাবের কথা বলছি।” বলেই ঠোঁট মেলে হাসল সে৷

“আর ইউ রিয়্যালি স্মাইলিং?” শারফান জিজ্ঞেস করল কপালে ভাঁজ ফেলে‚ “আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে মন চাচ্ছে? পুরোনো সব কিছু ভুলে গেছ?”

হাসি মুছল না তোয়ার‚ “ফল্ট তো আমারই ছিল তখন৷ সেটা ওই ষোলো বছরে না বুঝলেও এখন বুঝি। তুমি কেমন ছিলে তা তো জানতামই৷ তারপরও ক্লাসে রায়হানের সাথে‚ সালমানের সাথে কথা বলতাম। তুমি ফুটবল ম্যাচের সবার সামনে একটা থাপ্পড় মেরেই আমাকে সেন্সলেস করে দিয়েছিলে‚ সেদিন তো আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে‚ জেদ ধরেই মাঠের মধ্যে রায়হানের পাশে বসেছিলাম। আমাকে নিয়ে তুমি কতটা প্রোটেক্টিভ‚ পজেসিভ আর ইনসিকিউর ফিল করো…”

“ডু দ্য কারেকশন”‚ তোয়ার কথার মধ্যেই বলল শারফান‚ “করতাম। সেই দশ বছর আগের গল্প বলছ খেয়াল নেই? তবে শুধু পজেসিভ ছিলাম। কারণ‚ যে জিনিস আমার তা আমার দখলেই থাকবে। অন্য কেউ এক ইঞ্চি ভাগও পাবে না সেটার৷ তা আমার যে-কোনো জিনিসের বেলাতেই৷ অ্যান্ড আই অ্যাম স্টিল লাইক দ্যাট৷”

“জানি তো। যা তোমার তার প্রতি তোমার ভালোবাসা না থাকলে কি পজেসিভ হতে পারো?”

শ্রাগ করল শারফান‚ “ধারণা নেই এসব আননেসেসারি বিষয়ে।”

“আননেসেসারি? লাভ‚ পজেসিভনেস তোমার কাছে আননেসেসারি‚ শায়াফ?” অবাক যেন তোয়া।

সানা বুঝল এরা স্কুল জীবনের ভেঙে যাওয়া প্রেম নিয়ে স্মৃতিচারণ করছে৷ আগ্রহই নেই ওর এসব বিষয়ে৷ নিচে কীভাবে যাবে সে এই চিন্তায় করতে শুরু করল এখন।

“এই‚ তুমি এখন রাস্তা ছাড়ো আমার”‚ বিরক্তিটা এবার সরাসরি প্রকাশ করল শারফান‚ “আমার কাজ আছে।” বলে তোয়ার পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো সে৷

তা দেখে সানাও মনে মনে বকল‚ “যা জলহস্তী! অন্যখানে গিয়ে মর।” কিন্তু তারপরই চমকে গেল সে তোয়ার আকস্মিক কাণ্ডে।

শারফানের কব্জি টেনে ধরেই তোয়া জাপটে ধরল শারফানকে‚ “তুমি কী করে আমাকে ইগনোর করতে পারো‚ শায়াফ? আমার দিকে তাকিয়ে কি তুমি বুঝতে পারোনি আমি কেন এসে দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে?”

মুখে হাত চেপে‚ বড়ো বড়ো চোখে সানা দেখতে থাকল৷ শারফানকে এখন পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে সে৷ তাই ওর অভিব্যক্তি জানল না। মিনিটখানিক পর দেখা গেল‚ শারফান তোয়ার বাহুতে হাত দিলো। অমনি সানা বুঝে নিলো কিছু নিষিদ্ধ দৃশ্য ঘটবে এখন ওর সামনে৷ মুহূর্তেই মাথায় খেলে গেল বিদঘুটে এক পরিকল্পনা। ফোনটা বের করে প্রথমে ভিডিয়ো করে নিলো সানা৷ তারপর ছবি তুলতে গিয়ে ফোন ক্যামেরার শব্দ হলো মৃদুভাবে৷

শব্দটা তোয়ার কানে না পৌঁছলেও শারফানের কানে যেতে এক সেকেন্ড সময় লাগল না। চকিতে ঘাড় ঘুরাল পেছনে। সানাও তখনই ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমের ভেতরে। ফোনটা বুকে চেপে ধরল। প্রচণ্ড জোরে ধুকপুক করছে ওর হৃৎপিণ্ডটা।

নির্বিকারভাবে ঘাড় ফিরিয়ে শারফান তোয়াকে জোর করেই সরাল বুকের কাছ থেকে। বলল ভীষণ তিরস্কারের সঙ্গে‚ “গায়ের তিন শেড চামড়া তুলে সাদা হও আর ছয় শেড তুলে সাদা হও৷ সেকেন্ডহ্যান্ড তো সেকেন্ডহ্যান্ডই আমার কাছে৷ যে বিদেশীটাকে ভেড়া বানিয়েছ সেটাতেই কাজ চালাও। না চললে ওই যে ইলেকট্রিক ওরাল…” থেমে গিয়ে চোখ টিপে শয়তানের মতো হাসল‚ “কিনে দিতে বোলো ভেড়াটাকে।”

প্রত্যাখ্যানের অপমানে তোয়া রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলল। তবুও শারফানকে আবেগী সুরে বলল‚ “সে ভেড়া নয়৷ সে অত্যন্ত রুড আর ডমিন্যান্ট হাজবেন্ড। আমি ডিভোর্স নিয়েছি বহু কষ্টে।”

“এখন তাহলে একটা গুয়ের ডোবা খুঁজে ঝাঁপ মারো”‚ ভ্রুয়ের নিচে চুলকে নিয়ে বলল শারফান। “আর নয়ত দেখো অন্য কেউ পিনিক কমাতে পারে নাকি তোমার। আমাকে আর ডাকাডাকি‚ ধরাধরি কোরো না৷ আমি ফুটবলে আগেও ভালো ছিলাম‚ এখনো ভালো আছি কিন্তু।” বলে নিচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে ইশারা করল সে।

তোয়ার চেহারায় এবার স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠল। তা দেখে শারফানের মুখটা হলো বেজায় কঠিন‚ “আম্রিকা গিয়ে কি ভুলে গেছ ফুটবল খেলা কী? সকার খেলা জানো নিশ্চয়ই? লাথি মারার খেলা‚ বেইব।”

আর দাঁড়াল না তোয়া। শাসানোর ভঙ্গিতে একবার শারফানকে দেখে নিয়ে হাই হিলের খটখট্ আওয়াজ তুলে নিচে নেমে গেল।

সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে শারফান ওয়াশরুমের দিকে ফিরল এবার৷ তারপর শিস বাজিয়ে উঠল হঠাৎ। বাজাতে বাজাতে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে।

চলবে।

#মনাকাশে_ধ্রুবতারা_বেশে
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
১১.

বেলা ১২:৩০ ।
মুখ গোঁজ করে এসে দাঁড়াল জারা ভাইয়ের বিছানার পাশে৷ হাঁক ছেড়ে উঠল‚ “এই ওঠ‚ ভাইয়া৷ তোর বাপ‚ চাচা সেজেগুজে বসে আছে বিয়ে খাওয়ার জন্য। তুই কখন সাজবি?”

শাফিউল আর শাকিবুল সাহেব যাবেন এখন বিয়ের এক নিমন্ত্রণে। সঙ্গে নিয়ে যাবেন শারফানকেও। যেতে চেয়েছিল তাই জারাও। কিন্তু নেবেন না তাকে শাফিউল সাহেব। কত অনুনয় করল সে মা আর চাচার কাছে‚ যেন রাজি করান তারা বাবাকে। কিন্তু কেউই রাজি হলো না। এজন্যই মেজাজ চটে আছে জারার।

শারফানের মাথার চাঁদিটা একটুখানি বেরিয়ে আছে কম্বলের ভেতর থেকে৷ সেদিকে তাকিয়ে সে আবারও উচ্চরবে ডেকে উঠল‚ “এই‚ উঠিস না কেন? না গেলে বলে দে।”

কোনো উত্তর না দিয়ে শারফান একটু নড়ল চড়ল শুধু কম্বলের নিচে৷ তিরিক্ষি হয়ে তাই জারা সবার ওপরের রাগ ভাইয়ের চুলের ওপর প্রয়োগ করল। যতটুকু উঁকি দিচ্ছিল কম্বলের ফাঁক থেকে‚ খাবল মেরে সেটুকু চুল ধরে দিলো টান‚ “ওই‚ তুই উঠবি না? যাবি না তুই? না গেলে তাদের বলে দে যেন আমাকে নিয়ে যায়।”

চেঁচিয়ে ‘উহ্’ কাতর শব্দ করে উঠল তখন রিহান। গায়ের ওপর থেকে সে কম্বলটা সরালে বাথরুমের দরজা খুলে বের হলো সে সময় শারফান। কোমরে সাদা-কালো চেকের গামছা প্যাঁচানো ওর৷ গোসলে ছিল সে এতক্ষণ। গা থেকে হুড়মুড়িয়ে ভেসে আসছে সাবান‚ শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। জারা ভূত দেখার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইল ঘাড় ফিরিয়ে।

“কী হয়েছে তোদের?” বলতে বলতে এগিয়ে এলো শারফান। জিজ্ঞেস করল জারাকে‚ “তুই কী করছিস এখানে?”

ব্যথায় মুখ বিকৃতি করে নালিশ করল রিহান‚ “আমার চুল টেনে কতগুলো ছিঁড়ে নিয়ে আসছে তোর বোন‚ দেখ।”

“আমি তো জানি তুই ঘুমাচ্ছিলি মুড়ি দিয়ে”‚ কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে জবাবদিহি করল জারা৷ খুব লজ্জায় পড়ল মেয়েটা৷ ফুপাতো ভাই হলেও রিহান বয়সে বেশ বড়ো হওয়ায় কখনো সেভাবে কথাবার্তা হয়নি তার সঙ্গে৷ যতটুকু যা হয়েছে সৌজন্যতা বজায় রাখতেই কেবল।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটা অপছন্দ হলো শারফানের৷ জারার দিকে শাসনের নজর বিদ্ধ করল‚ “বিদায় হ এখনই।” বলল তারপর ভারিক্কি সুরে‚ “এখন থেকে দরজায় নক করবি আগে। কোনো সাড়া না পেলে চলে যাবি। ঘরে ঢুকবি না একদম।”

বলা মাত্রই ছুট লাগাল জারা। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শারফান ধমক লাগাল রিহানকে‚ “হারামজাদা‚ আমার কম্বলে ঢুকেছিস কেন?”

“আরে ঘুমের মধ্যে টেনে গায়ে নিয়েছি মনে হয়।”

“তোর শোয়াও ভালো না‚ শালা বেয়াক্কেলে। ঠেলে গায়ের ভেতরে চলে আসিস। আজকে থেকে তোর বড়ো মামার কোলের ভেতরে গিয়ে ঘুমাবি।”

“আমার শোয়া ঠিকই আছে”‚ গর্জে উঠল রিহান মুহূর্তেই‚ “শালা অজগর‚ তুই ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাস। জায়গায় পাই না আমি। অথচ এত বড়ো বিছানায় আরামসে চারজন ঘুমানো যায়। বউ আসলে সকালে ঘুম ভেঙে দেখবি খুঁজেই পাচ্ছিস না৷ লাথি মেরে খাটের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছিস।”

হাসতে হাসতে ওয়াল কেবিনেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল শারফান‚ “বউ মনের মতো হলে কোলবালিশের জায়গা পাবে। নয়ত খাটের তলাতেই ঠাঁই হবে।”

“তুই আশা করিস কীভাবে তোর মতো শয়তান পাপীর ঘরে ভালো জিনিস আসবে?” বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেতে যেতে বলে গেল রিহান।

সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে ঢুকিয়ে শারফান জবাব দিলো‚ “ভালো জিনিস পায়ে হেঁটে না আসলে ধরে বেঁধে নিয়ে আসব।”

“তাও পালিয়ে যাবে দেখিস”‚ বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে বলল রিহান।

“চেতাস না আমাকে৷ বাইরে থেকে আটকে রাখব কিন্তু।”

***

প্রচুর মানুষ নিমন্ত্রিত। কনভেনশন হলে প্রবেশ করতেই সানার হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করল৷ সিঁড়ি বেঁয়ে ওঠার সময় পা ফেলার মতোই জায়গা নেই৷ না চাইতেও অন্যদের সঙ্গে গা ঘেঁষে চলতে হচ্ছে। মেহার হাতটা ধরে মোস্তফা সাহেবের পিছু পিছু বহু ঠেলাঠেলি করে নির্দিষ্ট ফ্লোরে এসে পৌঁছল সে। আশ্চর্য হলো তারপরই। তৃতীয় তলায় এত শান্তশিষ্ট পরিবেশ! কিন্তু দোতলায় কত ভিড়!

কনের বাবা ছিলেন গতবারের কাউন্সিলর। তাই কনেপক্ষের থেকে আসা আত্মীয়দের মাঝে যারা রাজনৈতিক আর অন্যান্য পেশায় মান্যগণ্য ব্যক্তি‚ তাদের এবং বরপক্ষের আমন্ত্রিত সম্মানিত অতিথিদের জন্য এই তৃতীয় ফ্লোরে একটু বিশেষভাবে সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে৷ বরের বাবা আবু কালাম হলেন মোস্তফা সাহেবের একরকম শুভাকাঙ্ক্ষী। তাকে দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনিয়ম করে তিনি নিজেই একটা টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসালেন সানাদের। জিজ্ঞেস করলেন মোস্তফাকে‚ “কবির ভাই আর ফারনাজ আসবে না?”

পক্ষপাতশূন্যতা বজায় রাখতে তিনি সবাইকেই আমন্ত্রণ করেছেন। মোস্তফা সাহেব উত্তর দিলেন‚ “আমার জানা নেই তো‚ ভাই। কবির ভাই না আসতে পারলেও হয়ত ফারনাজ আসবে।”

দুজনের কথাবার্তার মাঝেই আগমন ঘটল শাকিবুল হকের। সাথে শাফিউল সাহেবকেও দেখা গেল। চেহারার মিলে সানা আর মেহা বুঝতে পারল তারা দুই ভাই৷ কালাম সাহেব তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চলে গেলেন৷ বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই হক সাহেবদের ঘিরে। গতবারের মেয়রও এসে পড়ল এর মাঝেই৷ তাদেরকে এক সঙ্গে এক টেবিলে বসিয়ে চারজন ক্যাটারিং স্টাফকে নিয়জিত করা হলো সেখানে৷

মেহা বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখছে। এত চাকচিক্যময় এখানের সবার বেশভূষা! পোশাকে আর নারীদের সাজগোজ‚ অলঙ্ককারেই বোঝা যাচ্ছে উচ্চবিত্ত পর্যায়ের মানুষ এরা৷ কিন্তু মেহার পাশে বসে সানা এসবের কিছুতেই আগ্রহ পাচ্ছে না৷ সারাটা সময় সে নিজের ফোনের চিন্তায় অস্থিরতার মাঝে আছে। সকালে দিনার সাথে আলোচনা করে সে বুঝতে পেরেছে কল ফরোয়ার্ড সিস্টেম চালু করে রাখা হয়েছে ওর ফোনে। দুর্ভাগ্যবশত পান্থর কলটা যে দুবার এসেছিল সে দুবারই সে ধরতে পারেনি। আর তখন ওই কল অন্য নম্বরে ফরওয়ার্ড হয়ে গেছে এবং সেই ব্যক্তিটি কলটা গ্রহণ করেছে। তার উদ্দেশ্য ওর ব্যক্তিগত তথ্য বা কলারের কথোপকথন যাতে শুনতে পারে। ঠিক একইভাবে কলের মতো মেসেজও সেই অন্য নম্বরে ফরোয়ার্ড হয়ে যায়৷ আবার ফোনে মিসড কল নোটিফিকেশনও সানা পায়নি মেহার কারণে৷ ভুলবশত মেহা ভেবেছিল সানা হয়ত ইচ্ছা করেই কল ধরেনি পান্থর। তাই সে নোটিফিকেশনও মুছে দিয়েছিল।

এখন সেই নম্বরটা কী এবং কার‚ কীভাবে নম্বরটাকে ব্লক করবে‚ এর কিছুই জানা নেই সানা আর দিনার। তবে এটা আন্দাজ করছে সানা‚ সেদিন শারফানই কিছু একটা করে রেখেছে৷ হয়ত শারফানের ফোনেই গেছে ওর রিসিভ না করতে পারা কলগুলো। কিন্তু তাকে ফোন করার দুঃসাহস তো হচ্ছে না ওর। সমাধান পেতে রিয়াকে কল করেছিল সে। রিয়াও জানে না। বিশ্বস্ত কোনো ছেলে বন্ধুও নেই। এই চিন্তা নিয়ে কোনোভাবেই সে সুস্থির হতে পারছে না।

সবাই টেবিলে বসতেই হলে ঢুকল শারফান। ভি শেপ গলার সাদা টি-শার্ট‚ ওপরে কালো রঙা ক্যাজুয়াল স্যুট আর প্যান্ট আর পায়ে সাদা স্নিকার্স। স্যুটের হাতা গুটিয়ে রেখেছে বেশ খানিকটা ওপরে। হাতে চকচক করছে রোলেক্সের ঘড়িটা৷

মেহা চোখ বড়ো করে‚ ভ্রু টানটান করে তাকিয়ে রইল শারফানের দিকে। প্রথম দর্শনে শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্যাডার ভাবা ছেলেকে দ্বিতীয় দর্শনে আপাদমস্তক সৌমর্দশন রূপে আবিষ্কার করে সে বিমূঢ়। সেই লাল চোখ‚ এলোমেলো বড়ো চুল আর একগাদা গোঁফ-দাড়ির বদলে সম্পূর্ণ পরিপাটি চেহারা। তবে প্রথম দিনের মতোই মুখটাতে কাঠিন্যতা রয়েছে। বসল গিয়ে শারফান শাফিউল সাহেবের পাশে।

“আপু! এই আপু‚ ওই দ্যাখ”‚ শারফানের দিকে চেয়েই মেহা খোঁচাতে থাকল সানাকে।

“কী দেখব?”

“তোকে বিরক্ত করেছিল যেই ব্যাটা‚ ওই দ্যাখ।”

মেহার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল সানা সামনে। আশ্চর্যভাবে তখনই কথা বলতে বলতে নজর ঘুরাল শারফান সানাদের টেবিলে। নিমেষেই চোখে চোখ পড়ে গেল দুজনের। শারফানকে দেখে মেহার মতো সানাও হলো বিস্ময়াভিভূত। তবে তা স্রেফ কিছুক্ষণের জন্যই। টেবিলে বসা সবার অগোচরে শারফান ভ্রু নাচিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মুচকি হাসতেই সানা চোখ সরিয়ে নিলো তক্ষুনি।

খাওয়ার সারাটা সময়ের মাঝেই সানা বন্দি রইল শারফানের নজরে। যে কারণে মেইন কোর্সের পর স্বাদের ফালুদাটুকু খাওয়ার আর ধৈর্য রইল না সানার। সবার আগে কোনোরকমে খেয়েদেয়ে উঠে পড়ল সে৷ অতিথিদের বিশ্রাম করে বসার জায়গাতে গিয়ে বসল চুপচাপ। কিন্তু শান্তি মিলল না সেখানেও। কয়েকজন মহিলা ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে শুরু করল ওকে। তাদের মাঝে একজন সরাসরি এসেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল ওর পরিচয় সম্পর্কে।

পনেরো মিনিট বাদে মেহা সানার কাছে গেল আর মোস্তফা সাহেব এলেন দোতলায়। সেখানেই বোধ হয় উপঢৌকন বা উপহার প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপহারের বদলে তিনি কিছু নগদ অর্থ দেবেন৷ দেখলেন‚ অতিথিদের বিশ্রামের জায়গাতে এক যুবক বসে আছে সামনে টেবিল নিয়ে। সেখানেও ভিড় লেগে আছে। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে গিয়েই হলেন বেকুব৷ মানিব্যাগ নেই৷ বুকের ভেতর খচ করে উঠল তার। পাজামার পকেটেও খোঁজ করতে থাকলেন ভালোভাবে। না‚ মানিব্যাগ নেই কোথাও। কিন্তু ভুলো মনা মানুষ তো নন তিনি! তার স্পষ্ট মনে আছে পাঞ্জাবি পরেই মানিব্যাগটা পকেটে পুরেছিলেন। তাহলে কি এখানে এসেই কেউ পকেট থেকে তুলে নিলো? হয়ত ওপরে ওঠার সময় ওই ভিড়েই কেউ কাজটা করেছে৷ কেমন অস্থির অনুভব করলেন তিনি৷ মান সম্মানের প্রশ্ন কিনা। কালাম সাহেবের সাথে সুসম্পর্ক বটে। মানিব্যাগ চুরির কথা জানলে ভদ্রলোক নিজেই দেখা গেল অস্বস্তিতে পড়বেন আর উপঢৌকনের কোনো প্রয়োজন নেই‚ এমনটিই বারবার প্রকাশ করতে চাইবেন। তবুও লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে তো বাঁচবেন না তিনি৷ ভাবলেন‚ বাড়িতে কল করে নাজমা বেগমকে জানাবেন যেন কাউকে দিয়ে টাকা বিকাশ করে দেন তাকে। তবে তার আগে সানাকে কল করলেন। যদি সানার কাছে কিছু পাওয়া যায় এই আশায়। টাকা জমানোর স্বভাব মেয়েটার স্কুল জীবন থেকেই৷ অনেক টাকা হয়ে গেলে পরবর্তীতে তা নিজেই মায়ের হাতে তুলে দেয়। অথবা কিছু কেনার প্রয়োজন হলে৷

কল তুলল সানা‚ “হ্যাঁ‚ আব্বু?”

কণ্ঠ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মোস্তফা‚ “তোমার ব্যাগে কি পাঁচ হাজার টাকা হবে‚ মা?”

“এত টাকা নিয়ে তো বের হই না‚ আব্বু। কী হয়েছে?”

“মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। আচ্ছা রাখো‚ দেখছি আমি।”

ফোনটা কেটেই বাড়িতে কল করলেন তিনি। কিন্তু রিসিভ হলো না। লাগাতার করতেই থাকলেন৷ ফলাফল শূন্যই পেলেন বারবার৷ নিশ্চয়ই ভাতঘুমে আছে সবাই আর ফোন পড়ে আছে হয়ত অন্য ঘরে৷ ঠোঁট কামড়ে ভীষণ চিন্তিত মুখ করে ফোনের কনট্যাক্ট লিস্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাবতে থাকলেন‚ কার থেকে সাহায্য নেওয়া যায়।

ঠিক এই মুহূর্তে পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটি দেখে যাচ্ছিল শারফান। সেও নগদ টাকা দেবে বলেই এসেছিল শাফিউল সাহেবের নির্দেশে৷ সানার কাছে বলা মোস্তফা সাহেবের কথাগুলো শুনতে পেয়েই বুঝতে পেরেছে তার বিপদটা৷ তবে তার বিপর্যস্ত পরিস্থিতি দেখে ওর বেশ মায়া অনুভব হলো। বিশেষ করে মোস্তফা সাহেবের সরল মুখে গাঢ় চিন্তার ছায়া দেখতে পেয়ে৷ কারণ‚ তিনি যে মানিব্যাগ হারানোর থেকেও সম্মানের চিন্তায় ঘেমে যাচ্ছেন‚ এটা সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। এজন্যই কোনো ভাবনাচিন্তা না করে আচমকা গলা খাকড়ি দিয়ে ডেকে উঠল তাকে‚ “এক্সকিউজ মি‚ আঙ্কেল?”

ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত ছিলেন বলে শারফানের অমন ভারী স্বর হঠাৎ শুনে চমকালেন তিনি৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন‚ “আমাকে ডাকছ?”

“হ্যাঁ”‚ কণ্ঠ খাটো করে শারফান বলল‚ “আনএক্সপেকটেডলি আমি আপনার প্রবলেমের বিষয়ে সবটা শুনেছি৷ কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে হেল্প করি?”

অচেনা‚ অজানা কারও থেকে সাহায্য পাওয়ার কথা শুনলে যেমন অভিব্যক্তি হওয়া উচিত তেমনই হলো মোস্তফা সাহেবের৷ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন তিনি৷

“আপনি এমব্যারেসড হবেন না প্লিজ৷ আমার নাম্বার রেখে দিন। সময় করে বিকাশে রিটার্ন করবেন না হয়।”

“তোমার নাম কী? বাবার নাম কী? থাকো কোথায়?” ভ্রু কুঁচকে জেরা করার মতোই প্রশ্নগুলো করলেন মোস্তফা সাহেব।

আর তার এই তিনটি প্রশ্নের ধরনেই শারফান কিছুটা ওজন করে নিলো মোস্তফা সাহেবের ব্যক্তিরূপকে। বলল অনায়াসেই‚ “আমি শারফান শায়াফ। শাফিউল হকের ছেলে। আপনি ভরসা করতে পারেন আমাকে। ব্যাপারটা নিয়ে কোথাও চর্চা করব না আমি৷”

এক দৃষ্টিতে মোস্তফা সাহেব দেখলেন তখন শারফানকে৷ ভাইয়ের প্রতিপক্ষ দলের মানুষ হলেও ছেলেটার কঠিন রাশভারী গলায় বলা এই কথাগুলোতে কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারলেন না। কিছু একটা তাৎপর্যময়ও অনুভব করলেন ওর কণ্ঠে আর ব্যক্তিত্বেও। এদিকে বাড়ি থেকে ফিরতি কলও এলো না এখনো। একটু ভেবে শেষমেশ রাজি হয়ে গেলেন তিনি‚ “তোমার বিকাশ নাম্বারটা দাও।”

“দিচ্ছি। আগে টাকাটা নিন”‚ বলে মৃদু হেসে মানিব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিলো শারফান।

বিব্রত হেসে তা গ্রহণ করলেন মোস্তফা সাহেব। তবে টাকা দেওয়া শেষে শারফানের দেওয়া মিঠা পান মুখে পুরে তিনি কথাবার্তা জুড়ে দিলেন ওর সঙ্গে৷ শারফান আগাগোড়াই বাকপটু৷ ব্যবসার খাতিরে তা আরও কিছুটা প্রশংসনীয় হয়েছে। ধীরে ধীরে মোস্তফা সাহেবকে সহজ করে তুলল সে৷ তিনিও মজা পেলেন ওর সঙ্গে কথা বলে৷ এর মাঝে সানাকে কল করে সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে তা জানিয়েও দিলেন।

তৃতীয় ফ্লোরে পৌঁছে মোস্তফা সাহেব বিদায় নিলেন শারফানের থেকে। মেয়েকে ফোন করতে করতে চলে গেলেন নিজের কলিগদের কাছে।

এদিকে ওয়াশরুমে লম্বা সিরিয়াল দেখে সানা এসেছে একজন স্টাফের পরামর্শে চতুর্থ তলায়৷ এখানেও কিছু মানুষের আনাগোনা আছে৷ তাদের রুফটপে যেতে দেখল সানা। তবে তারাও বোধ হয় এসেছিল ওয়াশরুমের তাগিদেই। আপাতত পুরো ওয়াশরুমই ফাঁকা এখন। কাজ সেড়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে ঠোঁটে লিপস্টিকটা ঠিকঠাক করার জন্য। বাবার কল এলো তখনই। তাকে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়ে লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে ছোঁয়াল সবে আর অমনি বাইরে থেকে কানে এলো‚ “এই তুমি শায়াফ না?”

কথাটা বলল এক মেয়ে কণ্ঠ। সানার বুক কেঁপে উঠল তাতেই। নামটা ঠিকই শুনল তো সে? বিভ্রান্ত মন নিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিতে চেষ্টা করল একবার৷ দেখা গেল না কাউকে। তাই একটু বেরিয়ে এলো। এবার স্পষ্ট দেখল শারফানকে অদূরেই। পকেটে এক হাত পুরে‚ ভ্রু বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে এক মেয়ের কাছে৷ মেয়েটাকে চিনিয়েছিল বাবা। মেয়েটা মেয়রের হয় নাকি। দেখতে একদম নায়িকাদের মতো সুন্দর৷ গায়ের রং এতই ফরসা যে‚ সানার মনে হয় একটু আলতো করে ধরলেও রক্ত বেরিয়ে আসবে৷ রিবন্ডিং করা খোলা চুলগুলো বিচ ব্রাউন বর্ণের৷ চোখে গাঢ় ধূসর রঙা লেন্স। আর উচ্চতাও বেশ। শারফানের মতো লম্বা ছেলের নাক ছুঁয়ে যাচ্ছে একদম৷ বর্ণোজ্জ্বল রুপালি রঙের পরনের শাড়িটার কারুকাজ এত জমকালো যে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ এই মেয়েটার সাথে তিন-চার বছরের একটা শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাকেও দেখেছে সানা। সম্ভবত ছেলে হবে৷ মাম্মি বলে ডাকছিল মেয়েটাকে।

“সিরিয়াসলি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি‚ শায়াফ?” মেয়েটার চোখে-মুখে কেমন অভিমান উপচে পড়তে চাইলো৷

নিচে ওয়াশরুমে সিরিয়াল দেখে শারফানও এসেছিল টয়লেটের কাজ সেড়ে রুফটপে যাবে বলে। কোম্পানি থেকে জরুরি একটা কল এসেছে। নিরিবিলিতে কথা বলা দরকার। এর মধ্যে পিছু ডাক। এই পিছু ডাক স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার দিলেও সে ভালোভাবে নিতে পারবে না। এতখানিই অসহ্য লাগে ওর! নয়-দশ বছর পর জীবনের প্রথম আর শেষ প্রেমকে দেখেও তাই খুশি হতে পারল না।

“আমার চোখের পাওয়ার ফ্যালকন থেকে কম না‚ তোয়া। তামাটে রং থেকে ধুতুরা ফুলের মতো সাদা হয়ে গেছ। এই তো? না চেনার কী আছে?”

আড়ালে দাঁড়ানো সানা ক্ষিপ্ত চাউনি নিয়ে তাকাল শারফানের দিকে৷ কী বিশ্রী ব্যবহার শয়তানটার!

“তুমি বদলাওনি‚ শায়াফ”‚ মাথাটা ঝুঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তোয়া।

“বদলাব মানে?” বিরক্ত চেহরায় বলল শারফান‚ “আমি কি দেখতে মানুষের মতো না? উল্লুক লাগে নাকি তোমার যে বদলাতে হবে?”

নিজের কপালে আস্তে করে এক চাপড় বসাল তোয়া‚ “বাবা ভুল হয়েছে আমার। রিল্যাক্স! তুমি দেখতে আরও ড্যাশিং‚ মাচো ম্যান হয়েছ এতে সন্দেহ নেই৷ আমি তোমার রুক্ষ স্বভাবের কথা বলছি।” বলেই ঠোঁট মেলে হাসল সে৷

“আর ইউ রিয়্যালি স্মাইলিং?” শারফান জিজ্ঞেস করল কপালে ভাঁজ ফেলে‚ “আমার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে মন চাচ্ছে? পুরোনো সব কিছু ভুলে গেছ?”

হাসি মুছল না তোয়ার‚ “ফল্ট তো আমারই ছিল তখন৷ সেটা ওই ষোলো বছরে না বুঝলেও এখন বুঝি। তুমি কেমন ছিলে তা তো জানতামই৷ তারপরও ক্লাসে রায়হানের সাথে‚ সালমানের সাথে কথা বলতাম। তুমি ফুটবল ম্যাচের সবার সামনে একটা থাপ্পড় মেরেই আমাকে সেন্সলেস করে দিয়েছিলে‚ সেদিন তো আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে‚ জেদ ধরেই মাঠের মধ্যে রায়হানের পাশে বসেছিলাম। আমাকে নিয়ে তুমি কতটা প্রোটেক্টিভ‚ পজেসিভ আর ইনসিকিউর ফিল করো…”

“ডু দ্য কারেকশন”‚ তোয়ার কথার মধ্যেই বলল শারফান‚ “করতাম। সেই দশ বছর আগের গল্প বলছ খেয়াল নেই? তবে শুধু পজেসিভ ছিলাম। কারণ‚ যে জিনিস আমার তা আমার দখলেই থাকবে। অন্য কেউ এক ইঞ্চি ভাগও পাবে না সেটার৷ তা আমার যে-কোনো জিনিসের বেলাতেই৷ অ্যান্ড আই অ্যাম স্টিল লাইক দ্যাট৷”

“জানি তো। যা তোমার তার প্রতি তোমার ভালোবাসা না থাকলে কি পজেসিভ হতে পারো?”

শ্রাগ করল শারফান‚ “ধারণা নেই এসব আননেসেসারি বিষয়ে।”

“আননেসেসারি? লাভ‚ পজেসিভনেস তোমার কাছে আননেসেসারি‚ শায়াফ?” অবাক যেন তোয়া।

সানা বুঝল এরা স্কুল জীবনের ভেঙে যাওয়া প্রেম নিয়ে স্মৃতিচারণ করছে৷ আগ্রহই নেই ওর এসব বিষয়ে৷ নিচে কীভাবে যাবে সে এই চিন্তায় করতে শুরু করল এখন।

“এই‚ তুমি এখন রাস্তা ছাড়ো আমার”‚ বিরক্তিটা এবার সরাসরি প্রকাশ করল শারফান‚ “আমার কাজ আছে।” বলে তোয়ার পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো সে৷

তা দেখে সানাও মনে মনে বকল‚ “যা জলহস্তী! অন্যখানে গিয়ে মর।” কিন্তু তারপরই চমকে গেল সে তোয়ার আকস্মিক কাণ্ডে।

শারফানের কব্জি টেনে ধরেই তোয়া জাপটে ধরল শারফানকে‚ “তুমি কী করে আমাকে ইগনোর করতে পারো‚ শায়াফ? আমার দিকে তাকিয়ে কি তুমি বুঝতে পারোনি আমি কেন এসে দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে?”

মুখে হাত চেপে‚ বড়ো বড়ো চোখে সানা দেখতে থাকল৷ শারফানকে এখন পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে সে৷ তাই ওর অভিব্যক্তি জানল না। মিনিটখানিক পর দেখা গেল‚ শারফান তোয়ার বাহুতে হাত দিলো। অমনি সানা বুঝে নিলো কিছু নিষিদ্ধ দৃশ্য ঘটবে এখন ওর সামনে৷ মুহূর্তেই মাথায় খেলে গেল বিদঘুটে এক পরিকল্পনা। ফোনটা বের করে প্রথমে ভিডিয়ো করে নিলো সানা৷ তারপর ছবি তুলতে গিয়ে ফোন ক্যামেরার শব্দ হলো মৃদুভাবে৷

শব্দটা তোয়ার কানে না পৌঁছলেও শারফানের কানে যেতে এক সেকেন্ড সময় লাগল না। চকিতে ঘাড় ঘুরাল পেছনে। সানাও তখনই ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমের ভেতরে। ফোনটা বুকে চেপে ধরল। প্রচণ্ড জোরে ধুকপুক করছে ওর হৃৎপিণ্ডটা।

নির্বিকারভাবে ঘাড় ফিরিয়ে শারফান তোয়াকে জোর করেই সরাল বুকের কাছ থেকে। বলল ভীষণ তিরস্কারের সঙ্গে‚ “গায়ের তিন শেড চামড়া তুলে সাদা হও আর ছয় শেড তুলে সাদা হও৷ সেকেন্ডহ্যান্ড তো সেকেন্ডহ্যান্ডই আমার কাছে৷ যে বিদেশীটাকে ভেড়া বানিয়েছ সেটাতেই কাজ চালাও। না চললে ওই যে ইলেকট্রিক ওরাল…” থেমে গিয়ে চোখ টিপে শয়তানের মতো হাসল‚ “কিনে দিতে বোলো ভেড়াটাকে।”

প্রত্যাখ্যানের অপমানে তোয়া রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলল। তবুও শারফানকে আবেগী সুরে বলল‚ “সে ভেড়া নয়৷ সে অত্যন্ত রুড আর ডমিন্যান্ট হাজবেন্ড। আমি ডিভোর্স নিয়েছি বহু কষ্টে।”

“এখন তাহলে একটা গুয়ের ডোবা খুঁজে ঝাঁপ মারো”‚ ভ্রুয়ের নিচে চুলকে নিয়ে বলল শারফান। “আর নয়ত দেখো অন্য কেউ পিনিক কমাতে পারে নাকি তোমার। আমাকে আর ডাকাডাকি‚ ধরাধরি কোরো না৷ আমি ফুটবলে আগেও ভালো ছিলাম‚ এখনো ভালো আছি কিন্তু।” বলে নিচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে ইশারা করল সে।

তোয়ার চেহারায় এবার স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠল। তা দেখে শারফানের মুখটা হলো বেজায় কঠিন‚ “আম্রিকা গিয়ে কি ভুলে গেছ ফুটবল খেলা কী? সকার খেলা জানো নিশ্চয়ই? লাথি মারার খেলা‚ বেইব।”

আর দাঁড়াল না তোয়া। শাসানোর ভঙ্গিতে একবার শারফানকে দেখে নিয়ে হাই হিলের খটখট্ আওয়াজ তুলে নিচে নেমে গেল।

সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে শারফান ওয়াশরুমের দিকে ফিরল এবার৷ তারপর শিস বাজিয়ে উঠল হঠাৎ। বাজাতে বাজাতে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে।

চলবে।