মনের অনুরণন পর্ব-৬+৭

0
2

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ০৬

আবরাহাম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে চিঠির দিকে। তার উপর কেউ উঁচু গলায় কথা বলে না। আর এই মাইয়া তো রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে।

আবরাহাম সেই চিঠি রেখে আরেকটা চিঠি তুলে নিলো তাতে লেখা,

**আপনার জন্য আমি পড়ায় মন দিতে পারছিনা। কি মুশকিল বলুন তো! এমন করে যদি আমি পরীক্ষায় ফেল করি তখন কি হবে আমার! বাবা যদি সত্যি সত্যি আমাকে রিক্সাআলার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয় তখন আপনার কি হবে!**

আবরাহাম চিঠিগুলো পড়ে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, যে এই চিঠিগুলো একটি কিশোরী মেয়ের লেখা। সেই চিঠিগুলোর ভাষা, ভাব প্রকাশ, এবং বিষয়বস্তু এমনই ছিল যা তার অভ্যস্ত জগৎ থেকে অনেক দূরের। মেয়েটি খুব স্বাভাবিকভাবেই আবরাহামের কাছে নিজের অনুভূতি ও উদ্বেগগুলো প্রকাশ করেছে, যা আবরাহামের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো,
“কেন এই মেয়েটি আমার সাথে এমনভাবে জড়িত হতে চাইছে? এর পেছনে কোনো কারণ আছে?”

চিঠিগুলোর ভেতরের সরলতা এবং অদ্ভুত রকমের আন্তরিকতা আবরাহামের মধ্যে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি জাগালো। তিনি একদিকে উদ্বিগ্ন হলেও, অন্যদিকে সেই মেয়েটির অনাকাঙ্ক্ষিত সংশ্লিষ্টতা তার ভাবনার জগতে এক নতুন প্রশ্ন তুলে দিলো।

চিঠির পর চিঠি পড়ার পর আবরাহাম স্থির হলো—এই রহস্যের পেছনে কিছু না কিছু আছে, যা তাকে উদঘাটন করতে হবে।

আবরাহাম চিঠিগুলো রেখে পেছনের দিকে হেলান দিলো, মাথার ভেতর প্রশ্নের বন্যা বইতে শুরু করলো। এই মেয়েটি কে হতে পারে? তার জীবনের সাথে এমন গভীরভাবে জড়িত হওয়ার কারণ কী? মেয়েটির প্রতিটি চিঠিতেই যেমন সরলতা, তেমনই এক ধরনের ছলনাময় রহস্য লুকিয়ে ছিল।

চিঠিগুলোর কিছু অংশে সেই মেয়েটি যেন হাসি-মজার ছলে কথা বলছে, কিন্তু আবরাহাম স্পষ্টই বুঝতে পারছে—এই মজার কথার আড়ালে এক ধরনের গভীর অস্থিরতা, এক ধরনের আশা-নিরাশার যুদ্ধ চলছে। মেয়েটি তার কাছ থেকে কি চাচ্ছে? কিংবা এই চিঠি আদৌ আবরাহামের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল, নাকি এটা ছিল কোনো ভুল বোঝাবুঝি?

আবরাহামের মাথায় তখন একটাই চিন্তা—এখনই তো এই চিঠির লেখককে খুঁজে বের করতে হবে, কোনোভাবে তাকে খুঁজে না পেলে, হয়তো আরও কিছু ঘটনা সামনে আসবে, যা আবরাহামের জীবনে নতুন ঝড় তুলতে পারে।

পরক্ষণেই চিঠিতে দেওয়া তার নামটা মনে পড়তেই হাসি পেল তার। “কুচুপু নেতামশাই”

আবরাহাম নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো। এমন করে শেষ কবে হেসেছে তার মনে নেই। কি যেন ভেবে কাগজ কলম নিয়ে বসলো সে।

কলম নিয়ে বেশকিছুসময় তা ঘোরালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝট করে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে ফেলল অচেনা মেয়েটার জন্য।

চিঠি লেখা শেষে সযত্নে চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দিলো। কাল সকালেই মেয়েটার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবে। পরমুহূর্তেই আবরাহাম নিজ মনেই ভাবলো,
“আচ্ছা চিঠি মেয়েটা কেমন রিয়েকশন দিবে!অপেক্ষার অবসান হওয়াতে কি মেয়েটা খুশি হবে! হয় তো হবে।”

আবরাহাম একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। টাউজারের পকেটে বাম হাত ঢুকিয়ে ডান হাত গ্ৰিলে হাত রেখে আকাশ পানে তাকালো। মেঘগুলো যেন ধীরে ধীরে তার চিন্তার মতোই ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই মেয়েটির চিঠির সরলতা এবং অদ্ভুত রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব এখন তার মনে কৌতূহলের ঢেউ তুলেছে। আকাশের মেঘগুলোর মতো তার ভেতরেও চিন্তাগুলো ক্রমাগত রূপ বদলাচ্ছে।

———————

কেটে গেছে বেশকিছুদিন, আজ সামিয়ার পরীক্ষা। সে তুমুল ব্যস্ততা নিয়ে রেডি হয়ে নিলো। এ কয়েকদিন বাড়ির বাহিরে যায়নি সে। কোনোমতে আয়েশা বেগম জোর করে কিছুটা খাবার খাইয়ে দিলেন সামিয়াকে।

ইকবাল সাহেব ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছেন।

সামিয়া স্কুলে পৌঁছানোর পরপরই তার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করল। আজকের পরীক্ষার চাপে নয়, বরং অন্য কিছু তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আবরাহামের চিঠি। সকালেই সে সেই চিঠি পেয়েছিল, কিন্তু আবরাহামের সেই গভীর অর্থবহ চিঠি এখনো তার মনে গেঁথে আছে। আবরাহামের মনের কথা জানার আকাঙ্ক্ষা এবং সেই চিঠির প্রতিক্রিয়া কী হবে, এই চিন্তাগুলো পরীক্ষা নিয়ে তার মনোযোগ পুরোপুরি ছিনিয়ে নিয়েছে।

চিঠিতে বেশি কিছু লেখা ছিলোনা কয়েকটা শব্দ লেখেছিলো আবরাহাম। যেখানে লেখা ছিলো,

“কলঙ্কিত পুরুষের কাছে ভালোবাসা চাইলে নিজেকেও কলঙ্কিত হতে হবে মেয়ে। ওহে মেয়ে কলঙ্কময় জীবন কি এতই সহজ!”

চিঠিটার পুরোভাব এখনো বোধগম্য হয়নি ছোট্ট সামিয়ার। এত কঠিন ভাষায় চিঠি লেখায় নেতামশাইয়ের উপর বেশ রাগ করেছে সামিয়া। প্রথম চিঠির উত্তর পেয়ে সে যতটা না খুশি হয়েছিলো, আবরাহামের কথা ঠিকমতো বুঝতে না পারায় ততটাই দুঃখ পেয়েছে। একে তো সে আর সময় পায়নি পরীক্ষার দিন চিঠির উত্তর দিয়েছে। তার উপর এমন আন্ডা মার্কা চিঠি।

পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলেও সামিয়া কিছুতেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারছে না। তার মনের কোণে কোথাও আবরাহামের সেই চিঠির প্রতিক্রিয়া প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তার কি আবরাহামের সঙ্গে দেখা করা উচিত? সামিয়ার মনে নতুন করে অনুভূতির ঝড় তুলেছে সে।

সামিয়া ক্লাসরুমে ঢুকে নির্দিষ্ট সিটে বসল, কিন্তু মনের ভেতরের উথাল-পাথাল ভাবনা কিছুতেই থামাতে পারছে না। তার কলমও যেন চুপচাপ, কাগজে নেমে আসছে না। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েও সে প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তার চিন্তা যেন সেই প্রশ্নপত্রের ধারে কাছে নেই।

সামিয়ার মাথায় পরীক্ষার বদলে বারবার ঘুরছে আবরাহামের চিঠি। সে বুঝতেই পারছে না, কেন আবরাহাম এমন জটিল ভাষায় উত্তর দিলো। তার মন অশান্ত হয়ে উঠছে, প্রশ্নের উত্তর লিখতে বসে বারবার কলম থেমে যাচ্ছে।

আবরাহামের লেখা “কলঙ্কিত পুরুষের কাছে ভালোবাসা চাইলে নিজেকেও কলঙ্কিত হতে হবে”—এই কথার অর্থ তাকে আরও বিভ্রান্ত করছে। ছোট্ট সামিয়ার পক্ষে এত গভীর ও কঠিন ভাবনার অর্থ ধরা সহজ নয়।

পরীক্ষার খাতায় প্রথম পাতাটি এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। সামিয়া প্রশ্নের দিকে তাকিয়েও কিছু লিখতে পারছে না। তার মন যেন সম্পূর্ণ অন্য কোথাও ভেসে আছে, আবরাহামের উত্তর আর তার মনের কৌতূহল তাকে পরীক্ষা থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

চোখ বুজে সে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে তুমুল বেগে লেখা শুরু করলো। হুমায়রা বেশ কয়েকবার সামিয়ার এমন অস্থিরতা খেয়াল করেছে। কিন্তু পরীক্ষার হল হওয়ায় তেমন কিছু বলতে পারেনি। তার উপর তাদের সিটটাও বেশ দূরে।

তিনঘন্টার পরীক্ষা শেষ করে সব শিক্ষার্থী চলে গেছে ইতিমধ্যে। সামিয়া চুপচাপ বসে আছে খাতা জমা দিয়ে। হুমায়রা নিজের সবকিছু গুছিয়ে সামিয়ার কাছে এগিয়ে এলো। নরম কন্ঠে ডেকে উঠলো,
“সামু”

সামিয়া চোখ তুলে তাকালো হুমায়রার দিকে। হুমায়রা খানিকটা ভ্রুকুচকে বলে উঠলো,
“সামু, কী হয়েছে? এত চুপচাপ কেন?” হুমায়রার কন্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট।

সামিয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকল, যেন হুমায়রার কথা তার কানে ঢুকছে না। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“কিছু না, পরীক্ষার চিন্তায় ছিলাম।”

হুমায়রা সামিয়ার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না।
“তুই তো এমন ছিলি না, সামু। আজকাল খুব অস্থির দেখাচ্ছে তোকে। আবরাহামের ব্যাপারটা না?”

সামিয়ার চোখে মুহূর্তের জন্য একটা দৃষ্টি ফুটে উঠল, তারপর সে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। হুমায়রা বিষয়টা ধরতে পেরে সামিয়ার কাঁধে হাত রাখল।
“আচ্ছা, সব ঠিক আছে তো?”

সামিয়া মৃদু হেসে বলল,
“হুম, ঠিক আছি।”

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, আবরাহামের চিঠি তার মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল আর দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। তার মনে হয়েছে, আবরাহামের চিঠির প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।

সামিয়া আর হুমায়রা একসঙ্গে স্কুলের গেটের দিকে হাঁটতে লাগল। সামিয়ার মন তখনও আবরাহামের চিঠির গভীরে হারিয়ে রয়েছে। তখনই পিছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“মাধবীলতা”

সামিয়া চোখ বুজে ফেলল। একে তো তার এখন ভালো লাগছে না তার উপর এখনি কি আরিশকে আসতে হলো।

সামিয়া আর হুমায়রার সামনে এসে দাঁড়ালো আরিশ। আরিশে এলোমেলো চুল, ইন ছাড়া কলেজ ড্রেস, ঠোঁটের মুচকি হাসি সবটাই আড়চোখে এক পলক দেখে নিলো হুমায়রা। সামিয়া মাথা নিচু করেই আছে।

আরিশ কিছুক্ষণ সামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“মাধবীলতা, তুমি ঠিক আছো তো!”

সামিয়া কিছুটা থেমে জবাব দিলো,
“ভাইয়া প্লীজ আমাদের রাস্তা ছাড়ুন। ভালো লাগছেনা।”

আরিশ অস্থির হয়ে বলে উঠলো,
“শরীর খারাপ লাগছে?”

সামিয়া বেশ বিরক্ত হলো। বিরক্তি নিয়েই খানিকটা জোরেই বলে উঠলো,
“রাস্তা ছাড়তে বললাম না আপনাকে!”

আরিশের হাস্যজ্জ্বল মুখটা মলিন হয়ে এলো সামিয়ার কথায়। সে আর কিছু না বলে আস্তে করে সরে গেল। সামিয়া গটগট পায়ে রওনা দিলো। হুমায়রা একপলক আরিশের দিকে তাকিয়ে সামিয়ার পিছনে গেল।

আরিশ পলকহীন তাকিয়ে রইলো সামিয়ার যাওয়ার দিকে।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ০৭

আবরাহাম সভা শেষ করে স্টেজ থেকে নামতে নিবে তখনই রেদোয়ান ফিসফিসিয়ে আবরামের কানে কানে বলল,
“ফারিয়ার স্বামী ওকে তালাক দিয়েছে।”

আবরাহাম রেদোয়ানের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুচকে বলল,
“কোন ফারিয়া?”

রেদোয়ান অবাক হলো। খানিকটা থেমে বলল,
“তোর সঙ্গে যার..!”

রেদোয়ান হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে আবরাহাম বলল,
“ওর তালাক হোক নাকি মরে যাক আমার কিছু আসে যায় না। নেক্সট টাইম ওর নাম নিবিনা আমার সামনে বলে দিলাম।”

কথা বলা শেষে আবরাহাম রেদোয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট পায়ে গাড়ির দিকে যেতে লাগল।

আবরাহাম গাড়িতে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল, কিন্তু তার মনের মধ্যে রেদোয়ানের বলা কথাগুলো বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। ফারিয়া। সেই নামটাকে সে বহুদিন আগেই তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তালাক, সম্পর্ক, প্রতিশ্রুতি—এসব শব্দ যেন এখন তার জীবনে কেবল একটা অস্পষ্ট ছায়া। তবে রেদোয়ানের মুখে সেই নাম শুনে তার ভেতরে একটা চাপা রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

গাড়ি চলতে শুরু করল, কিন্তু আবরাহামের মন বারবার অতীতে চলে যাচ্ছিল। ফারিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক, যেটা সে একসময় অনেক যত্ন নিয়ে গড়ে তুলেছিল, সেটাই তার জন্য কেমন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন ফারিয়ার তালাক হওয়ার খবর তাকে স্পর্শ করছিল না, বরং বিরক্তি আর ক্রোধে ভরিয়ে দিচ্ছিল। সে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল—তাহলে কি সত্যিই তার কোনো অনুভূতি বেঁচে নেই এই সম্পর্কের জন্য? নাকি সে নিজেই এতো পাথর হয়ে গেছে যে কিছুই আর তাকে নাড়া দিতে পারে না?

অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছিল, আর আবরাহামের মন আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল।

আবরাহাম চোখবুজে সিটে গা এলিয়ে দিলো। কিছু তিক্ত স্মৃতি ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। বাহিরে তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল থেকেই এমন অবস্থা আকাশের। আবরাহাম যে কতটা সময় চোখবুজে ছিলো তার খেয়াল নেই। ড্রাইভারের ইতস্তত কন্ঠে চোখ মেলে তাকালো সে। সামনের সিটে বসে থাকা আধবয়স্ক হাকিম সাহেব বললেন,
“স্যার রাস্তায় গাছ পড়ে আছে। কি করবো এখন!”

আবরাহামের চোখমুখ বিরক্তিতে কুচকে গেল। পিছনেই রেদোয়াদের গাড়ি ছিলো। আবরাহাম বিরক্তি নিয়ে বলল,
“দ্রুত সরানোর ব্যবস্থা করেন।”

আবরাহাম চোখমুখ বিরক্তিতে কুচকে বসে ছিল। বৃষ্টির তীব্র শব্দ আর ভিজে রাস্তা তাকে আরও অস্থির করে তুলছিল। হাকিম সাহেব তার নির্দেশের অপেক্ষায় সামনের সিটে সোজা হয়ে বসেছিলেন। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ সরানো সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে এমন বৃষ্টির মধ্যে। কিন্তু আবরাহাম কোনো বিকল্প ভাবতে চাইছিল না। তার মন এই মুহূর্তে একটাই কথা ভাবছিল—কেন আবার ফারিয়ার নাম উঠে এলো তার জীবনে?

“গাড়ি থেকে নেমে সাহায্য নিয়ে গাছ সরানোর ব্যবস্থা করেন,” আবরাহাম কঠোর গলায় বলল।

হাকিম সাহেব মাথা নাড়লেন, দ্রুত নেমে গেলেন গাড়ি থেকে। আবরাহাম আরেকবার চোখ বন্ধ করল, কিন্তু এবারও শান্তি পেল না। তার মনে হচ্ছিল ফারিয়ার সাথে জড়িত স্মৃতিগুলো আবার তাকে টেনে আনছে অন্ধকারে, যেখান থেকে সে বহু কষ্টে নিজেকে মুক্ত করেছিল।

পিছন থেকে রেদোয়ানের গাড়ির হর্নের শব্দ তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। রেদোয়ান নেমে এসে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিল। আবরাহাম চেয়েছিল তার সঙ্গে এখন কোনো কথা না বলতে, কোনো ব্যাখ্যা না দিতে।

বৃষ্টির তীব্রতা আর পরিস্থিতির অবনতি দেখে, হাকিম সাহেব কয়েকজনকে নিয়ে দ্রুত গাছ সরানোর কাজে লেগে গেলেন। আবরাহাম গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল। এই মুহূর্তে তার একটাই ইচ্ছা—এই রাস্তাটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করা।

রেদোয়ান চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আজ আমাদের ঢাকায় ফেরা হবে নারে।”

রেদোয়ানের এমন কথা শুনে আবরাহাম ওর দিকে কপাল কুচকে তাকালো। রেদোয়ান আবরাহামের তাকানির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,
“এখানকার স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে ঝড়ের কারণে রাস্তায় অনেক গাছ ভেঙে রাস্তা বন্ধ। আর বৃষ্টি তো এখনো থামেই নি।”

আবরাহাম গভীর একটা শ্বাস নিল। রেদোয়ানের কথাগুলো আরও বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। ঢাকায় না ফেরার সম্ভাবনা তাকে বিচলিত না করলেও, পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছিল। বৃষ্টি, ঝড়, ভাঙা গাছ—সবকিছু যেন একটা বন্ধন তৈরি করছিল তার চারপাশে, তাকে অতীতের সেই অস্বস্তিকর স্মৃতির সঙ্গে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলছিল।

“কেন জানি না, আজকের দিনটা যেন শেষ হতে চায় না,” আবরাহাম চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠল, নিজেকেই যেন কথাটা বলছে।

“স্যার, পুলিশ কর্মকর্তারা বলছে, রাস্তা পরিষ্কার করতে সময় লাগবে,” হাকিম সাহেব কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল। আবরাহামের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি সামলাচ্ছিল, কিন্তু এখন সবকিছু একসাথে যেন তাকে পিষে ফেলতে চাইছিল।

রেদোয়ান আবরাহামের দিকে তাকিয়ে একটা হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“এখনও মনে হচ্ছে, সব ঠিক আছে?”

আবরাহাম রাগ সামলানোর চেষ্টা করল।
“ঠিক আছে, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এবার দয়া করে চুপ করো,” সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল।

রেদোয়ান কিছু বলল না, কেবল মাথা ঝাঁকালো।

আবরাহাম আবার জানালার বাইরে তাকাল, বৃষ্টির তীব্রতা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইছিল।

আবরাহাম অনুভব করছিল, বৃষ্টি আর ঝড় থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়ের খোঁজে তাকে আর বেশি সময় অপচয় করা যাবে না। হাকিম সাহেব এবং রেদোয়ানও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছ সরানোর কাজ বিলম্বিত হচ্ছে, আর বৃষ্টির তীব্রতা আরও বাড়ছে। এমন অবস্থায় গাড়িতে বসে থাকাটা নিরাপদ নয়—এটা আবরাহাম বুঝতে পারছিল।

“হাকিম সাহেব, কাছাকাছি কোনো নিরাপদ জায়গা আছে যেখানে আমরা একটু আশ্রয় নিতে পারি?”আবরাহাম কড়া গলায় জানতে চাইল।

হাকিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “স্যার, কিছুটা সামনে একটা পুরনো ডাকবাংলো আছে। যদিও এখন সেটার অবস্থা তেমন ভালো না, কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে সেটা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।”

আবরাহাম এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “ওখানেই যাও। এখানে বসে থাকার কোনো মানে নেই।”

হাকিম দ্রুত গাড়ি চালানো শুরু করল। রাস্তা ভেজা, পিচ্ছিল, আর চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। আবরাহাম জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল ঝড়ের সঙ্গে তার ভেতরকার আবেগও যেন এভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণ পর গাড়ি একটা ছোটো কাঁচা রাস্তার দিকে ঘুরে গেল। বনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, পুরনো, ভাঙাচোরা ডাকবাংলোটির ছায়া দেখা গেল। জায়গাটি একসময় হয়তো সুন্দর ছিল, কিন্তু এখন তা প্রায় পরিত্যক্ত। পলেস্তারা খসে পড়েছে, আর দরজাগুলো শিকল দিয়ে আটকানো।

“এটাই কি জায়গা?” রেদোয়ান বিষণ্ণ গলায় জানতে চাইল, সন্দেহের সুরে।

আবরাহাম জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এর চেয়ে ভালো কিছু এখন আর আশা করা যায় না। হাকিম, দরজা খোলার ব্যবস্থা করো।”

হাকিম নেমে গিয়ে শিকল সরিয়ে দরজাটা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে সবাই টের পেল, জায়গাটা ভিজে আর ঠাণ্ডা, কিন্তু ঝড়ের থেকে অন্তত নিরাপদ। আবরাহাম ভেতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল। জায়গাটি ভাঙাচোরা হলেও একসময় এখানে জীবনের চিহ্ন ছিল—আলো আর হাসির দিনগুলো হয়তো এখানেই কেটে গিয়েছিল।

রাতের বাকি অংশটা এখানে কাটানোই এখন তাদের একমাত্র উপায়।

ডাকবাংলোর ভেতরে ঢুকে সবাই চারপাশটা ভালো করে দেখল। ঘরটা ছিল পুরনো, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, আর বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা বৃষ্টির ঠাণ্ডা ভিজে গন্ধ ঘরটাকে আরও ভৌতিক করে তুলেছিল। মেঝেটা ভেজা, আর ঘরের কোণায় ইঁদুরের কাটা কাগজের টুকরো ছড়িয়ে ছিল।

আবরাহাম মৃদু একটা শ্বাস নিল, যেন বেঁচে থাকার জন্য এই শীতল স্থানে আশ্রয় নেওয়াটাই তার নিয়তি। রেদোয়ান অসহায়ভাবে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। আর হাকিম দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকল, জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আর কিছু লাগবে?”

“না, আপাতত এখানে একটু শান্তিতে থাকি,” আবরাহাম গম্ভীর কণ্ঠে বলল। বাইরে ঝড়ের শব্দ আরও জোরালো হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখার শপথ নিয়েছে।

ঘরের ভেতরে থমথমে নীরবতা নেমে এলো। আবরাহাম ধীরে ধীরে একটা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে গাছপালার ফাঁকে ভেজা অন্ধকারে ঝড়ের উন্মত্ততা চলছিল, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলোয় বনভূমির ছায়া এক ঝলক দেখা দিচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই নির্জনতার মধ্যেই যেন তার নিজের ভেতরের সমস্ত হতাশা ও অস্থিরতা প্রতিফলিত হচ্ছে।

হঠাৎ রেদোয়ান ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল,
“তোর মাথায় কি চলছে আবরাহাম? কিছু তো বলছিস না। ফারিয়ার নাম শুনে তোর ভেতরে কি অনুভূতি জাগলো, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”

আবরাহাম কোনো উত্তর দিল না। সে জানালার বাইরে তাকিয়েই রইল, যেন বাইরে বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গেই তার মন পড়ে আছে। রেদোয়ানের প্রশ্ন শুনে তার ভেতরে চাপা একটা জ্বালা জেগে উঠল, কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করতে চাইলো না। এতদিন ধরে সবকিছু চাপা দিয়ে রেখেছিল, আর আজ সেই ক্ষত আবার প্রকাশ্যে এসে পড়ছে।

“রেদোয়ান, আমি ফারিয়ার বিষয়ে কথা বলতে চাই না। তুই বুঝতে পারছিস না, আমি সব ভুলে যেতে চাই,” আবরাহাম ধীর অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল।

রেদোয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ঘরের ভেতরের নীরবতা বৃষ্টির তুমুল শব্দের সাথে মিশে গিয়ে একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। কিছুক্ষণ পর রেদোয়ান আবার বলল,
“কিন্তু তুই কি সত্যি ভুলতে পেরেছিস? তোর এই অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছে না।”

#চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )