মনের অনুরণন পর্ব-৮+৯

0
2

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ০৮
আবরাহাম এবার রেদোয়ানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে একটা ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সেই ক্লান্তির আড়ালে একটা গভীর বিষণ্ণতা ছিল, যেটা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল। “তুই যা বলছিস, সেটাও সত্যি,” আবরাহাম মৃদু স্বরে বলল।

“কিছু জিনিস ভুলে যাওয়া সহজ না।”

রেদোয়ান তাকিয়ে রইল আবরাহামের দিকে, কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুপ করে রইল। তার মনে হলো, আবরাহাম এখন নিজের ভেতরে একটা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, আর সেই লড়াইয়ে সে কাউকে অংশ নিতে দিতে চায় না।

এমন সময়, বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে এক প্রচণ্ড আওয়াজ হলো। ঘরের দরজাটা হালকা কেঁপে উঠল। বাইরের ঝড় আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে। আবরাহাম জানালার দিকে তাকিয়ে আরও গভীরভাবে নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগল।

রেদোয়ান কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব এখন আরও প্রবল হয়ে উঠেছে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘরের অন্ধকার মাঝে মাঝে ফেটে যাচ্ছে। হঠাৎ বাইরে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল, যেন কিছু ভারী কিছু পড়ে গেল। রেদোয়ান দ্রুত দরজার দিকে ছুটে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, একটা বড় গাছ ভেঙে পড়ে তাদের গাড়িটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।

“আবার বিপদে পড়লাম,” রেদোয়ান বিষণ্ণ স্বরে বলল, তার মুখে আতঙ্ক আর ক্লান্তির মিশ্রণ।

আবরাহাম জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। বাইরের ঝড়ের আওয়াজ যেন তাকে অতীতের কোনো স্মৃতিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তার চেহারায় তখনও কোনো স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

কিছুক্ষণ পর আবরাহাম ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে। এই ঝড় আমাদের আটকে রাখতে পারবে না। এখানে চুপ করে বসে থাকা মানে বিপদ বাড়ানো। আর যেকোনো মুহূর্তে বাড়িটা ভেঙে পড়তে পারে।” তার কণ্ঠস্বর ছিল অটল, দৃঢ়। যেন ঝড়ের ভয়াবহতা তাকে কিছুমাত্র স্পর্শ করতে পারছে না।

তারা পাঁচজন। দুইজন বডিগার্ড, ড্রাইভার, রেদোয়ান আর আবরাহাম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু ঝড় এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। ঝড়ের তীব্র বাতাসে আশেপাশের গাছপালা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, আর তাদের গাড়ি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ঠিক তখনই, দূর থেকে এক ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির হেডলাইটের আলো তাদের চোখে পড়ল। গাড়িটি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে এল। রেদোয়ান অবাক হয়ে দেখল, গাড়ি থেকে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক নামলেন, কিন্তু আবরাহাম তার আগেই চিনতে পেরেছিল তাকে।

“ইকবাল সাহেব!”

আবরাহামের কণ্ঠে গভীর বিস্ময়ের ছোঁয়া।

ইকবাল সাহেব একটু হাসলেন, ঝড়ের তীব্র বাতাসের মধ্যেও তার স্বভাবসুলভ শিষ্টাচার বজায় ছিল। “তোমাকে এমন ঝড়ের মধ্যে আটকে থাকতে দেখব ভাবিনি,”

তিনি মৃদু স্বরে বললেন, তার চোখে কৃতজ্ঞতার ঝিলিক।

রেদোয়ান এখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল কীভাবে এই বৃদ্ধ মানুষটি এবং আবরাহাম একে অপরকে চেনেন।

আবরাহাম ইকবাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে বলল,
“আপনার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল যেদিন আপনার গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, আর আমি আপনাকে উদ্ধার করেছিলাম।”

ইকবাল সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
“তোমার সেই উপকার কখনও ভুলতে পারব না। তুমি আমাকে সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলে।”

আবরাহাম শুধু মাথা নেড়ে ইকবাল সাহেবকে ধন্যবাদ জানাল, এবং বলল,
“আমাদের হয়তো আবার দেখা হওয়ারই কথা ছিল।”

এরপর, ইকবাল সাহেব তাদের গাড়িতে আশ্রয় দিলেন। ঝড়ের প্রলয় থেকে রক্ষা পেতে তারা ইকবাল সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা দিল। আর বাড়ি সামনেই বৃষ্টির জন্য অফিসের গাড়ি নিয়ে এসেছে। রাস্তায় যে আবরাহামের সঙ্গে তার দেখা হবে, তিনি কল্পনাও করেন নি।

এই গাড়ি যাত্রার সময় রেদোয়ান বারবার আবরাহামের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কিছু একটা বুঝে উঠতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আবরাহাম চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, তার মনে হয়তো পুরোনো সেই দিনের ঘটনা ভেসে উঠছিল—
সেদিনের কথা যেদিন ইকবাল সাহেবের সঙ্গে আবরাহামের প্রথম দেখা হয়েছিলো। ঘটনাটি ছিল একেবারেই আকস্মিক, অথচ তাতে মিশে ছিল এক ধরনের অদ্ভুত নিয়তি। সে দিনটা ছিল অনেকটা আজকের মতোই—আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, ঝড়ের পূর্বাভাস। আবরাহাম তখন নিজের কাজে ডুবে ছিল, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না, সামনে তার জীবনে এক মোড় ঘুরবে।

সেদিন বিকেলে আবরাহাম শহরের বাইরে একটা জরুরি মিটিংয়ে যোগ দিতে গাড়ি নিয়ে রওনা দেয়। সড়ক ফাঁকা থাকলেও আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই সামনে বিশৃঙ্খলভাবে ব্রেকের শব্দ ভেসে আসে। সামনে গিয়ে দেখে, একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। চারপাশে কেউ নেই, ঝড়ের পূর্বাভাসে রাস্তাও শুনশান।

আবরাহাম গাড়ি থামিয়ে দ্রুত গিয়ে দেখল, গাড়ির ভেতরে একজন মানুষ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। রক্ত ঝরছে, তবে ক্ষতটা প্রাণঘাতী মনে হচ্ছে না। আবরাহাম বুঝতে পারল, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সেই মানুষটির বাঁচার সম্ভাবনা কম। সে এক মুহূর্তও দেরি না করে নিজের গাড়ি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার কিট নিয়ে এল। তারপর কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢুকে আহত ব্যক্তিকে টেনে বের করল।

আহত ব্যক্তিটিই ছিলেন ইকবাল সাহেব। চেতনা ফিরে পাওয়ার পরও তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন, তবে আবরাহামের দ্রুত পদক্ষেপ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে ইকবাল সাহেব কৃতজ্ঞতার সুরে বললেন,
“আমি জানি না তুমি কে, কিন্তু তুমি আজ আমার জীবন বাঁচালে। এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না।”

আবরাহাম সামান্য হেসে বলেছিল,
“আপনাকে বাঁচানো আমার দায়িত্ব ছিল। কাউকে বিপদে দেখলে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।”

এরপর তারা আর কখনও দেখা করেনি। কিন্তু সেই দিনের ঘটনা ইকবাল সাহেবের মনে গভীরভাবে গেঁথে ছিল। তিনি সবসময় মনে মনে দোয়া করতেন, যেন আবার একদিন সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়।

আজ ঝড়ের রাতে, অনেক বছর পর, সেই আকস্মিক মিলনের মুহূর্ত যেন আবার ফিরে এল। আবরাহাম যখন ইকবাল সাহেবকে চিনতে পারল, তার ভেতরেও এক ধরনের অনুভূতির ঢেউ বয়ে গেল। সে জানত না কেন, কিন্তু সেই দিনের সেই ত্রাণকর্তার ভূমিকা আজকে তার নিজের জীবনের গল্পে ফিরে এসেছে, যেন পুরোনো কোনো ঋণ মেটাতে।

আবরাহামের ভাবনার মাঝেই ইকবাল সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
“তোমার সেই উপকার আমি কোনোদিন ভুলিনি। তুমি হয়তো মনে রাখোনি, কিন্তু আমি সবসময় মনে করেছি, একদিন আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে।”

আবরাহাম তার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, “মনে রাখিনি এমনটা নয়, তবে হয়তো এই দেখা হওয়াটাও কোনো কারণে লেখা ছিল।”

তার চোখে ছিল এক ধরনের গোপন অনুভূতি, যেন তাদের মিলন কেবল পুরোনো ঋণ শোধ নয়, বরং আরও কিছু গভীর সংযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ঝড়ের তাণ্ডবের মধ্যে গাড়ির ঝাঁকুনি যেন আবরাহামের চিন্তার স্রোতকেও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় বেঁধে ফেলেছে। রাস্তাটা ছিল অন্ধকারে ঢাকা, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি সেই অন্ধকারকে ফাঁকি দিয়ে চেনা দৃশ্য ফিরিয়ে আনছে। ইকবাল সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন ধীরগতিতে, কিন্তু তার চোখে-মুখে একটা শিষ্টাচারপূর্ণ স্থিরতা। রেদোয়ান চুপচাপ বসে আছে, তার চোখে প্রশ্নের ছায়া, কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছিল না। আবরাহাম জানালার বাইরে তাকিয়ে, নিজের মনের গভীর কোন খাঁজে ডুবে ছিল।

ইকবাল সাহেব আবারো বলে উঠলেন,
“তুমি সেই সময় আমাকে বাঁচিয়েছিলে, আজ আবার দেখো, আমি তোমাদের বাঁচানোর সুযোগ পেলাম।” তার কণ্ঠে এক ধরনের আনন্দ মিশ্রিত কৃতজ্ঞতা।

আবরাহাম তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল। ইকবাল সাহেবের প্রতি তার এক ধরনের শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু সেই শ্রদ্ধার গভীরে আরও কিছু ছিল—একটা অদ্ভুত বোধ। যেন সেই দুর্ঘটনা, আর আজকের এই মিলন, সবকিছু পরিকল্পিত ছিল কোনো অজানা হাতের ইশারায়।

“কোনো কিছুই কাকতালীয় নয়,” আবরাহাম হঠাৎ বলে উঠল, তার কণ্ঠ গভীর। রেদোয়ান আর ইকবাল সাহেব দুজনেই তার দিকে তাকাল।

“কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আসে একসময়কার কিছু ঋণ শোধ করতে,” আবরাহাম চোখ বন্ধ করে বলল। তার নিজের ভেতর যেন কিছু খুলে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে।

এই কথার মধ্যে একটা গভীর অনুরণন ছিল। ইকবাল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়লেন,
“হয়তো তোমার কথাই ঠিক।”

গাড়ির গতিটা ধীর হয়ে আসছিল।গাড়ি এসে থামলো ইকবাল সাহেবের বাসার সামনে। পার্কিং এ গাড়ি রেখে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন,
“আমার বাসায় কারেন্টের বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আইপিএসটা কিছুদিন আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে আপনাদের সমস্যা হবে না তো।”

আবরাহাম খানিকটা থেমে বলল,
“আপনি আমাদের জন্য যা করছেন এই অনেক। এত চাপ নিয়েন না।”

আবরাহামের কথায় ইকবাল সাহেবের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ইকবাল সাহেব বললেন,
“তোমাদের থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না, যদিও কারেন্ট নেই। আশা করি ঝড়ের তাণ্ডব কাটলেই বিদ্যুৎ ফিরে আসবে।”

আবরাহাম একটু হাসল।
“আপনি আমাদের জন্য যা করছেন, সেটা অনেক বড় কথা। এমন অবস্থায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ০৯

ইকবাল সাহেব দরজায় টোকা দিতেই সামিয়া এসে দরজা খুলে দিলো। সামিয়া দরজা খুলতেই বাতাসের সঙ্গে বয়ে আসা বৃষ্টির শব্দ ঘরে ঢুকে পড়ল। তার চোখ প্রথমে ইকবাল সাহেবের ওপর পড়ে, তারপর এক ঝলক আবরাহামের দিকে। মুহূর্তের জন্য তার হৃদস্পন্দন থেমে গেল বলে মনে হলো। আবরাহাম তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা যেন সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।

ইকবাল সাহেব সামিয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,
“সামিয়া, এরা বিপদে পড়েছিল। ভাবলাম, আমাদের এখানে একটু আশ্রয় দিলে ভালো হয়।”

সামিয়া একমুহূর্তে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। আবরাহামের গভীর দৃষ্টিতে যেন একটা রহস্য ছিল, এমন কিছু যা সামিয়ার ভেতরে চাপা পড়া অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার মনে হঠাৎই একটা প্রশ্ন জাগল—কেন হচ্ছে তার সঙ্গে এমন, মনের ভিতরে তোলপাড় শুরু হলো কেন আবরাহামকে দেখে!টিভিতে তো দেখে তখন তো এমন হয়না।

সামিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটে ইকবাল সাহেবের গলা শুনে,
“ওনাদের জন্য গেস্টরুমটা একটু পলিষ্কার করে দেও তো। আর তোমার মাকে নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলো।”

সামিয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। গেস্টরুমে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করেই ধপ করে বসে পড়লো বিছানায়। হাত পা অসম্ভব কাঁপছে তার। বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক নিলো সে। তার হৃদয়ে অজানা এক উত্তেজনা আর শঙ্কা মিলেমিশে তৈরি হলো, যেন আবরাহামের আগমন কেবল একটি কাকতালীয় ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও কিছু—একটা অদ্ভুত টান, যা তাকে আবরাহামের দিকে আরও আকর্ষণ করছে, অথচ সেটা বুঝতে পারছে না।

সামিয়া উঁঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে দরজার পাশে গিয়ে টুকি দিলো বসার রুমের দিকে।

আবরাহাম বসে ফোনে কি যেন করছিলো।হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকানোর দিকে তাকাল। সামিয়া লক্ষ্য করল, আবরাহামের চেহারায় গভীর একটা বিষণ্ণতা রয়েছে, যেন সে নিজেও কোনো অদৃশ্য যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলছে। সামিয়ার মনে হতে লাগল, আবরাহামের সাথে তার এই পরিচয় হয়তো অনেক কিছু বদলে দেবে—কিন্তু কীভাবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

রহস্যের আবরণে মোড়া এই মুহূর্তে সামিয়া যেন নিজের ভেতরেও একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন অনুভব করল।

সামিয়া পলকহীন তাকিয়ে ছিলো তখনি আবরাহাম চোখ ঘুড়িয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হলো তাদের। সামিয়া দ্রুত পায়ে সরে দাঁড়ালো দরজা থেকে। কপাল কুচকে এলো আবরাহামের। ক্ষীণ আলোই এই ছোট্টো মেয়েটা এতো কেন টানছে তাকে। গভীর সেই চাহনী, পাতলা ঠোঁটে কাঁপনি কেন বারবার নাড়া দিয়ে তুলছে আবরাহামের কঠোর হৃদয়কে। তার কলঙ্কিত জীবনে এমন অনুভূতির যে কোনো জায়গা নেই। কেন সে বারংবার ভুলে যাচ্ছে সে। আবরাহাম চোখ বুজে কয়েকটা নিশ্বাস ছাড়লো। তখনি নাস্তার প্লেট নিয়ে হাজির হলেন আয়েশা বেগম। টেবেলি নাস্তা রাখতেই চোখ পড়লো আবরাহামে গম্ভীর মুখপানে। হুট করেই ওনি বেশ চমকিত হলেন। যেন বড় কোনো ধাক্কা খেলেন। আবরাহামের চাহনীতে তিনি আতকে উঠলেন। টিভিতে খুব কম সংখ্যক বার আবরাহামকে দেখলেও সামনাসামনি এই প্রথম দেখে আয়েশা বেগম হতভম্ভ হয়ে গেলেন।

আয়েশা বেগমকে এমন অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে সবাই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো ওনার দিকে।

ঘড়ি শব্দ করে জানান দিচ্ছে রাত এখন একটা। ইয়ানা আর ইহসান অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সামিয়া তার মায়ের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ।

ইকবাল সাহেব কপাল কুচকে বললেন,
“আয়েশা কি হয়েছে তোমার! এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন তোমাকে!

আয়েশা বেগম হুট করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। সামিয়া গেস্টরুমের বিছানা ঠিক করে বসার রুমে এসে মাকে এই অবস্থায় দেখে বিচলিত হলো।

চারপাশে থমথমে পরিবেশ। কিছু সময় পর পর সো সো করে আওয়াজ হচ্ছে। বাতাস এসে বারি খাচ্ছে জানালায়।

সামিয়া হতবাক হয়ে দেখছিল, তার মায়ের এমন আচরণ কেন।
“আম্মু, মা, তুমি কি ঠিক আছো?”সে জিজ্ঞেস করল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ ছিল।

আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তার চোখে জল ঝরছিল।
“আমি… আমি ঠিক আছি, কিন্তু…” তিনি থেমে গেলেন। যেন বলতে পারছেন না কেন তিনি এত অস্থির হয়ে পড়েছেন।

ইকবাল সাহেব দ্রুত এসে বলেন,
“আয়েশা, কিছু বলো। এরকম কেন হচ্ছে!”

আবরাহাম তীক্ষ্ম চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে। রেদোয়ান নিরব দর্শক হয়ে সবটা দেখছে। ড্রাইভার আর বডিগার্ডরা চিলেকোঠার রুমে চলে গেছে ওনেক আগেই। ওখানেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইকবাল সাহেব ওনাদের নাস্তা দিয়ে এসেছেন।

হুট করে আয়েশা বেগম আবরাহামের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“রিহু বাবা, ভাইজান কেমন আছেন!”

বাহিরে আবারো তীব্র বর্ষণ শুরু হলো। আবরাহাম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আয়েশা বেগমের দিকে। এই নামে তো শুধু তার দাদি আর ফুফু ডাকতো। যাদের সঙ্গে তেইশ বছর আগেই সম্পর্ক ছেদ হয়েছে। হুট করেই আয়েশা বেগমের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলো সে। অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
“ফুপি!”

আবরাহামের মুখ থেকে “ফুপি!” শব্দটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের পরিবেশ যেন আরও ভারী হয়ে গেল। সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। সামিয়া কিছুটা হতবাক হয়ে তার মায়ের দিকে চাইল, আবরাহাম তার মাকে “ফুপি” বলে ডেকেছে—এটা কীভাবে সম্ভব?

আয়েশা বেগম চোখের জল মুছে ধীরে ধীরে বললেন,
“তুই… তুই কি রিয়াদ ভাইজানের ছেলে?”

আবরাহাম তখনো চুপ। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু তার ভেতরে একটি অজানা স্মৃতির ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। বহু বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা অনুভূতিগুলো যেন হঠাৎ করে ভেসে উঠল। সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

আয়েশা বেগমের চোখ ভিজে উঠল। তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“আমি জানতাম না, এত বছর পর তুই এভাবে আমার সামনে দাঁড়াবি, তোর ফুপির কাছে ফিরে আসবি।”

ইকবাল সাহেব হতবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সামিয়া বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেল। এতদিনের অজানা সম্পর্কের জাল যেন হঠাৎই তার সামনে এসে খুলে গেল। আবরাহামের সঙ্গে তাদের এত গভীর পারিবারিক সম্পর্ক, অথচ সে কোনোদিন জানত না।

আয়েশা বেগম আলতো হাতে আবরাহামের গাল ছুঁয়ে দিলেন। কাঁপা কন্ঠে বললেন,
“পাঁচবছরের ছোট বাচ্চাটা নাকি এখন নেতা। আমি ভাবতেও পারছিনা। কত যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাইজান করেননি। আব্বার কড়া নিষেধ ছিলো আমি যাতে তোদের সঙ্গে যোগাযোগ না করি। তাহলে তারা আমার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখবেনা।”

আবরাহাম চুপ করে আয়েশা বেগমের কথা শুনছিলো। তার ভেতরে স্মৃতির ঢেউ আছড়ে পড়ছে, কিন্তু বাইরে থেকে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। মুহূর্তটি ছিল অদ্ভুত, এত বছর পর নিজের পরিবার সম্পর্কে এত কিছু জানতে পেরে আবরাহামের মনে যেন মিশ্র অনুভূতির ঝড় বইছিল।

“ফুপি, আমি তোমাদের থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু কখনো ভুলিনি,” আবরাহাম ধীরে ধীরে বলল, তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছিল।

আয়েশা বেগমের চোখে আবার জল টলমল করতে শুরু করল।
“তোর দাদী তোকে কত ভালোবাসতো, তুই জানিস না। কতবার তোর খবর জানতে চেয়েছি, কিন্তু আব্বা আর ভাইজানের নিষেধাজ্ঞা সব কিছুকে আটকে দিয়েছে।”

এবার আবরাহাম আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে ফুপির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। “ফুপি, আমি জানি না কীভাবে সবকিছু এত জটিল হয়ে গেল। কিন্তু আমি তোমাদের সবাইকে খুঁজে পেতে চাই।”

আয়েশা বেগম চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “তুই ফিরে আসবি, আমি জানতাম। তুই কখনো আমাদের ভুলতে পারবি না।”

এ দৃশ্য দেখে সামিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এতদিনের সম্পর্কের জটিলতা, পারিবারিক ইতিহাস, সবকিছু যেন এক মুহূর্তে তার সামনে খুলে গেল। আবরাহামের প্রতি তার আকর্ষণ এবং তার মায়ের সাথে আবরাহামের সম্পর্ক—সবকিছুই এখন অন্যরকম মনে হচ্ছিল।

ইকবাল সাহেব তখনো নীরবে সব কিছু দেখছিলেন। তিনি ধীরে ধীরে সামিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
“কিছু সম্পর্ক কখনো শেষ হয় না, সামিয়া,” তিনি ধীরে ধীরে বললেন। “এগুলো সময়ের সাথে সাথে ফিরে আসে।”

সামিয়া কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সে হতভম্ব। তার নেতামশাই নাকি তার মামাতো ভাই ভাবা যায়। কিন্তু কি এমন হয়েছি যে তাদের যোগাযোগ ছিলোনা। তার ছোট মাথায় সবকিছু মিলেমিশে আন্দোলন করা শুরু করে দিয়েছে। মাথা ভনভন করছে, কান দপদপ করছে, মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেছে।

সময় যেন থমকে গেছে। আয়েশা বেগম বেশকিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বললি নাতো ভাইজান কেমন আছে, আর ভাবি?”

#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)