#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬
বিয়ে বাড়ির কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে নীলাদ্রি এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে বধূ সেজে বসে আছে। আজ তার বিয়ে। পারিবারিকভাবে বিয়েটা ঠিক হলেও নীলাদ্রির মতামত নেওয়া হয়েছে। পাত্র ভালো, পরিবার ভালো দেখে বাবা মা আগ্রহ দেখালেন। নীলাদ্রিরও না করার কোন কারণ ছিল না। কলেজ শেষ করে ভার্সিটির দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও তার জীবনে কোন ছেলে মানুষ আসতে পারেনি। ভবিষ্যতে আসবে এরকমও কোন সম্ভাবনা নেই। বিয়ে সে পরিবারের পছন্দেই করবে। নীলা তার সাত মাসের উঁচু পেট নিয়ে খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। তবুও বোনের কাছে এসে পাশে বসে বলল,
-বউ মানুষ মুখে একটু হাসি রাখবি না! তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমরা জোরজবরদস্তি তোর বিয়ে দিচ্ছি।
নীলাদ্রি অসহায় চোখে আপুর দিকে তাকাল। বিয়েতে সে রাজি থাকলেও এখন এসব ভালো লাগছে না। নীলা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে বলল,
-বিয়ের দিন ভয় লাগা স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রতিটা মেয়েরই লাগে।
-তোমার লাগেনি, তাই না?
-হুম। আমার লাগেনি কারণ আমি আমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছি। তুইও যদি তোর পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতি তাহলে তোরও ভয় লাগত না।
-আমার পছন্দের মানুষ নেই।
-আমরা জানি। সেজন্যই তো নিজেরা পাত্র খুঁজেছি।
নীলা বোনের সাথে কথা বলছে এসময় একজন এসে জানাল,
-নীলা আপু তোমার একজন গেস্ট এসেছে।
নীলা কপাল কুঁচকে বলল,
-আমার গেস্ট! কে রে?
-চিনি না। তবে স্যুট-কোট পরা জেন্টেলম্যানস টাইপ লোক।
কে লোকটা? নীলা দেখার জন্য চলে গেলে নীলাদ্রি দুরুদুরু বুক নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মা বাবা পরিবারের মানুষকে খুঁজছে। নীলা তার চাচাতো ভাইয়ের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
-কোন লোক? কোথায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস?
-এইতো।
লোকটাকে দেখে নীলা বিশাল বড়ো চমক পেল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আশেপাশের মানুষদের ভুলে চেঁচিয়ে উঠল,
-উচ্ছ্বাস, তুমি! ও মাই গড! সত্যিই তুমি এসেছ?
নীলার কন্ঠ শুনে উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। নীলা ভাবতেই পারছে না উচ্ছ্বাস তার দাওয়াত রেখেছে।
-দেশে কবে এসেছ তুমি?
-আজই।
-আজ এসেছ! ভালোই করেছ। তুমি ভেতরে না এসে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো। আসো আসো।
উচ্ছ্বাস ভেতরে যেতে ইতস্তত করছে দেখে নীলা বলল,
-ওসব কথা এখন আর কেউ মনে রাখেনি। আর মনে রাখলেও তোমাকে কেউ কিছু বলবে না। সবাই এখনও এটাই মনে করে এনগেজমেন্ট আমি ভেঙেছি।
সেবার ওরা রাজশাহী থাকার সময় উচ্ছ্বাসের সাথে শেষ বার দেখা হয়েছিল। তারপর উচ্ছ্বাস মাস্টার্স করার জন্য ইউরোপ গিয়েছিল। শুরুর দিকে ফেসবুকে মাঝে মাঝে কথা হতো। সময়ের সাথে উচ্ছ্বাস নিজের ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হয়ে যায়। নীলাও সংসারে মনোযোগী হয়। মাঝখানে অনেকদিন কথা হয়নি। নীলাদ্রির আংটি পরানোর দিন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল। উচ্ছ্বাস সচারাচর তার পোস্টে কমেন্ট না করলেও সেদিন জানতে চেয়েছিল কার বিয়ে। নীলা তখনই সুযোগ বুঝে ইনবক্সে উচ্ছ্বাসকে দাওয়াত দিয়ে বসে। যদিও জানত না উচ্ছ্বাস তখনও দেশে এসেছে কি-না।
উচ্ছ্বাসকে দেখে নীলার বাবা মা-ও অনেক বেশি খুশি হয়েছে। ছেলেটাকে জামাই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। এ নিয়ে তাদের আফসোস কম ছিল না। নীলার বাবা উচ্ছ্বাসের হাত ধরে বললেন,
-তোমার আসাতে আমি অনেক খুশি হয়েছি বাবা। তুমি কিন্তু বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাবে না।
উচ্ছ্বাসও হেসে জানাল,
-জি আঙ্কেল।
বাবা মা দাদা সবার সাথে উচ্ছ্বাসের দেখা করিয়ে নীলা এবার ওকে নীলাদ্রির কাছে নিয়ে এলো। নীলাদ্রি বসে বসে নিজের সাথেই কথা বলছিস। বিয়ে তো সবারই হয়। তারও হচ্ছে। এত ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই।
-নীলাদ্রি, দেখ কাকে নিয়ে এসেছি।
আপুর কথা শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে নীলাদ্রির চোখজোড়া আটকে গেল। চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে। এই লোক এখানে কী করছে! তার বিয়েতে কে দাওয়াত দিয়েছে?
লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত পুতুল পুতুল চেহারার মেয়েটাকে দেখে উচ্ছ্বাস আজ সাথে সাথেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারল না। শেষবার রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল। চার বছর পর আজকে আবার দেখছে। নীলাদ্রি জমে বসে আছে দেখে নীলা বোনের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল,
-সাধারণ ভদ্রতা টুকুও কি ভুলে গেছিস? তোর স্যারকে সালাম দিলি না!
নীলাদ্রি থতমত চোখে একবার বোনকে দেখে আরেকবার উচ্ছ্বাসকে দেখে। উচ্ছ্বাস মেয়েটার নার্ভাসনেস আর না বাড়িয়ে বলল,
-ইট’স ওকে। কয়েকদিনের জন্য আমি ওর স্যার হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি ওর স্যার না।
নীলা নীলাদ্রির সামনেই উচ্ছ্বাসের সাথে ওর পাত্র, শ্বশুরবাড়ি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে।
-নীলাদ্রির বর তো সদ্য পাস করা ডাক্তার। বাবার বন্ধুর ছেলে। দেখাশোনা আগে থেকেই ছিল। ওরা প্রস্তাব দিলে বাবাও না করেনি।
উচ্ছ্বাস নীলার সাথে কথা বলতে বলতেও কয়েকবার নীলাদ্রিকে দেখেছে। নীলাদ্রি মাথা নিচু করে কাচুমাচু মুখে বসে আছে। নীলার ডাক পড়েছে। যাবার আগে নীলা উচ্ছ্বাসকে বলে গেল,
-তুমি বসো। আমি ওয়েটার পাঠাচ্ছি, কিছু নাও। আমি দু’মিনিটে আসছি।
উচ্ছ্বাস বসল না। এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। নীলাদ্রিকে দেখে তার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
বরযাত্রী কখন রওনা দিয়েছে। এতক্ষণে পৌছে যাওয়ার কথা ছিল। এত সময় তো লাগার কথা না। ভেতরে ভেতরে এ বিষয় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। সবার মাঝে চাপা টেনশন দেখা যাচ্ছে। মেহমানদের খাওয়া শেষ। সবাই বিয়ে দেখার জন্য বসে আছে। যথচ বরযাত্রীর বাকি দুইটা গাড়ি চলে এলেও বরের গাড়িই আসছে না। বরের গাড়িতে শুধু বর আর তার বন্ধুরা ছিল। কল করে ওদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। নীলা বাবা মা’কে টেনশন না করতে বলে নীলাদ্রিকে দেখার জন্য এলো। উচ্ছ্বাস কয়েকজনের ছোটাছুটি দেখেই কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-ইজ এভ্রিথিং ওকে নীলা? যদিও আমার জিজ্ঞেস করা উচিত হচ্ছে না। কোন সমস্যা দেখা দিলে শেয়ার করতে পারো।
নীলা বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার যেন কেঁদে ফেলবে। উচ্ছ্বাসের হাত ধরে অন্য দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
-বরযাত্রীর গাড়ি চলে এলেও বরের গাড়ি এখনও এসে পৌঁছায়নি।
-এজন্য প্যানিক করছো? কল করো। দেখো হয়তো পথেই আছে।
-কল করিনি মনে করেছ? বর সহ বরের গাড়িতে যারা যারা ছিল কেউ কল তুলছে না।
উচ্ছ্বাস তারপরও চিন্তিত না হয়ে বলল,
-কাউকে পাঠিয়েছ?
-কোথায় পাঠাব?
-আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি প্যানিক কোরো না। তোমার এ অবস্থায় এত বেশি স্ট্রেস নেওয়া ঠিক হবে না।
উচ্ছ্বাস আঙ্কেল আন্টির কাছে এসে বলল,
-আমি দেখছি আন্টি কী করা যায়।
উনারাও শেষ ভরসা হিসেবে উচ্ছ্বাসের কথাতে নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। উচ্ছ্বাস উনাদের সামনেই তার কোন একজন পুলিশ অফিসার বন্ধুকে কল করল। বন্ধুর সাথে কথা বলার মাঝেই নীলার বাবার ফোনে মেসেজ এলো। উনি সেই মেসেজ পড়ে সাথে সাথে নিচে বসে পড়লেন। বাবাকে বসে পড়তে দেখে নীলা চেঁচিয়ে উঠল।
-বাবা! বাবা, কী হয়েছে তোমার?
নীলার মা-ও স্বামীর এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। উচ্ছ্বাস এক হাঁটু ভাজ করে বসে আঙ্কেলের হাত থেকে ফোন নিয়ে মেসেজটা পড়ল। যেখানে স্পষ্ট দেখা আছে,
-আমাকে ক্ষমা করবেন আঙ্কেল। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। বাড়িতে এ বিষয়ে জানা থাকলেও উনারা আমার উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন আমি যেন নীলাদ্রিকে বিয়ে করি। কিন্তু আমার পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না।
রায়হান সাহেব বিলাপ করে বলতে লাগলেন,
-আমার মেয়েটা কী দোষ করেছিল? কেন আমার মেয়েটার সাথে এমন হলো? বিয়েটা তো আমি ঠিক করেছিলাম। দোষও তাহলে আমিই করেছি। আমার দোষের শাস্তি কেন আমার মেয়েটা পেলো?
আনন্দঘন পরিবেশ মুহুর্তেই বিষাদময় হয়ে গেল। বাবা মা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন। নীলাও টেনশন করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেহমানরাও এতক্ষণে বুঝে গেছে কোথাও গন্ডগোল হয়েছে। যদিও নীলাদ্রি এখনও এব্যাপারে কিছুই জানে না। এসব ঘটনা তার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।
-আমি নিজের হাতে আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিলাম। আমার মেয়ে আমার পছন্দ মেনে নিয়েছিল। আমি কীভাবে একটা ভুল মানুষকে আমার মেয়ের জন্য পছন্দ করলাম?
নীলাদ্রির দাদা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উনার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ছোট নাতনিকে তিনি অত্যধিক ভালোবাসেন। এই নাতনির সাথেই কেন এমন হলো? সকলে যখন মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তায় গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে উচ্ছ্বাস তখন উনাদের জন্য শক্ত এক ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের গাম্ভীর্য রুপ ধরে রেখে বলল,
-আঙ্কেল আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
উচ্ছ্বাসের একথায় সকলের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। মেহমানরা নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। নীলাদ্রির বাবা মা ভাবছে এই প্রস্তাব উনারা কীভাবে নিবেন। নীলা সবার আগে বলে উঠল,
-তুমি সত্যিই আমার বোনকে বিয়ে করতে চাও উচ্ছ্বাস!
নীলাদ্রির দাদা আর কারো কোন কথা কানে নিলেন না। তিনি উনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে বললেন,
-বিয়ে আজই হবে। এক্ষুনি হবে। এই ছেলের সাথেই হবে। আমি বলে দিয়েছি। আমার কথাই শেষ করা।
নীলাদ্রিও এতক্ষণে ধারণা করতে পেরেছে কিছু একটা তো ঘটেছে। নাহলে সবাই নতুন বউকে ছেড়ে ওদিকে কেন ভীড় করবে? দাদাজান নীলাদ্রির কাছে এলেন। নীলাদ্রির পাশে বসে ওর হাত ধরে বলতে লাগলেন,
-তুই আমাকে কতটা বিশ্বাস করিস দিদিভাই?
প্রশ্নটা শুনে নীলাদ্রি অবাক হয়েছে। দাদাজান কেন এই কথা জানতে চাচ্ছেন?
-আমার উপর তোর বিশ্বাস আছে তো?
-তুমি এসব কথা কেন বলছো দাদাজান?
-আমি যা করবো তোর ভালোর জন্যই করব দিদিভাই। এই বিয়েটাও তোর ভালোর জন্যই হচ্ছে।
-আমি জানি দাদাজান। তোমরা যা করবে আমার ভালোর জন্যই করবে।
দাদাজান নীলাদ্রির হাতের উপর পিঠে চুমু খেয়ে বললেন,
-আমার উপর বিশ্বাস থাকলে আমি যা বলবো তা করবি তো?
নীলাদ্রি কিছু না বুঝেই বলল,
-হুম।
-তোর বিয়ে ওই হতচ্ছাড়া ডাক্তারের সাথে হবে না। তোর জন্য আমি এর থেকেও ভালো পাত্র ঠিক করেছি।
দাদাজানের কথাগুলো নীলাদ্রির মাথার উপর দিয়ে গেল। তবে যখন জানতে পারল উচ্ছ্বাসের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে তখন বেচারি পুরোপুরি শকের মধ্যে চলে গেল। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব ভাবার সময়টুকুও পেলো না। তার আগেই লোকটার সাথে তার বিয়ে হয়ে গেল। কবুল বলে ফেললেও নীলাদ্রি বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না এই লোকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। লোকটা আজ তার বিয়েতে কেন এসেছিল? বিয়ে খেতে এসে নিজেই বা কেন বর হয়ে গেল।
চলবে