মনের আঙিনায় পর্ব-০৮

0
21

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা

চার বছর পর উচ্ছ্বাস নিজের ঘরে এলো। তা-ও বউ সমেত! নীলাদ্রিকে কোলে নিয়েই এক হাতে দরজা খুলেছে। ভেতরে এসে নীলাদ্রিকে নামিয়ে দেওয়ার বদলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখছে। নীলাদ্রি নিঃশ্বাস আটকে, জমে বসে আছে। উচ্ছ্বাস তাকে না নামানো পর্যন্ত দম ছাড়ল না। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও সামনে বসল। নীলাদ্রি এখনও সহজ হতে পারছে না। উচ্ছ্বাস জিজ্ঞেস করল,

-পায়ে কী হয়েছে? কোথাও ব্যথা পেয়েছ?

নীলাদ্রির থেকে জবাব পাবে না জানাই ছিল। সে নিজেই নীলাদ্রির পা ধরতে গেলে নীলাদ্রি আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নিল। উচ্ছ্বাস ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-দেখতে না দিলে বুঝব কীভাবে?

নীলাদ্রি কোনভাবেই সহজ হতে পারছে না। উচ্ছ্বাস ছোট্ট একটা দম ফেলে একপ্রকার জোর করেই নীলাদ্রির পায়ের জুতা খুলে দিল। এবার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে। হিল পরে থেকে পা অনেকটা ছিলে গেছে। জায়গাটা লাল হয়ে আছে। উচ্ছ্বাস জানে তার ঘরে ফাস্টএইড পাওয়া যাবে না। তাই ঘর থেকে যাওয়ার আগে নীলাদ্রিকে বলল,

-ভয় পেয়ো না। আমি এক্ষুনি চলে আসব।

উচ্ছ্বাস যাওয়ার সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তার পেছনে কেউ যেন নীলাদ্রির কাছে আসতে না পারে। নীলাদ্রি বুঝতে পারছে এবাড়ির মানুষ গুলো তাকে মেনে নিবে না। তবে সে লোকটার আচরণ দেখে অবাক হচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে, না জানিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছে। তবুও কতটা স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন কোন অন্যায়ই করেনি। নিচেও কাউকে কিছু না বলে সোজা ঘরে চলে এসেছে। উনার কি ভয় হচ্ছে না? বাবা মা পরিবারের মানুষদের কী জবাব দিবে এবিষয়ে ভাবছেন না? বিয়ে তো উনি শখে করেননি। উনার নিজেরও তো শকের মধ্যে থাকার কথা ছিল। অথচ লোকটা কতটা স্বাভাবিক আছে।

ভাইয়ার ঘরে ফার্স্টএইড পাওয়া না গেলেও বাব মা’র ঘরে পাওয়া যাবে। তাই উচ্ছ্বাস সোজা বাবা মা’র ঘরেই গেল। সবাই তখনও নিচে। তাই তাকে এমুহূর্তে কারোর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে রুমে চলে এলো। দরজায় শব্দ শুনে নীলাদ্রি জড়োসড়ো হয়ে গেল। কে এসেছে? উচ্ছ্বাস ভেতরে এসে স্বচ্ছ হেসে বলল,

-বলেছিলাম না এক্ষুণি চলে আসব।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির পায়ের কাছে বসে তুলো দিয়ে ঔষধ লাগাচ্ছে। লোকটা এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তার পা ধরেছে। অস্বস্তিতে নীলাদ্রি কুঁকড়ে যাচ্ছে। বাঁধা দেওয়ার শক্তিও হচ্ছে না তার। ঔষধ লাগানোর সময় একটু জ্বালা করছে তবে ওসব এখন গুরুত্ব পেলো না। উচ্ছ্বাস অবশ্য খেয়াল রাখছে নীলাদ্রির যেন কষ্ট না হয়। তাই ঔষধ লাগানোর সময় মুখে ফুঁ দিচ্ছে। নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের দিকে না তাকালেও উচ্ছ্বাস মাঝে মাঝেই চোখ তুলে ওকে দেখছে।

-যে জিনিস পরে তুমি কম্ফোটেবল ফিল করবে না আজকের পর থেকে সেসব পরতে হবে না।

ঔষধ লাগানো শেষে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়াল। বলল,

-আমি নিচে গিয়ে গাড়ি থেকে তোমার লাগেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে বিয়ের সাজপোশাক পাল্টে নিও। ততক্ষণে আমি একটু পরিবারের সাথে দেখা করে আসি। তোমার কাছে অবশ্য আজ কেউ আসবে না। তুমি রুমে রিলাক্সে থাকতে পারো।

উচ্ছ্বাস চলে গেলেও নীলাদ্রি আগের মতোই বসে রইল। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না।

নিচে এসেই দাদীর সাথে দেখা হলো। তিনি এতক্ষণে সব জানতে পেরেছেন। নাতির দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

-এসব আমি কী শুনছি? তুই নাকি বিয়ে করে বউ নিয়া আসছিস ভাই!

উচ্ছ্বাস দাদীর কাছে এসে দাদীর জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে আদর করে দিল। দাদীও নাতির পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় জানতে চাইল,

-সত্যিই তুই বিয়া করছোস?

-হ্যাঁ দাদী।

-আমার নাতবউ কই? তারে আমার কাছে কেন নিয়া গেলি না? এক্ষুনি চল, আমি আমার নাতবউরে দেখব।

মিসেস শর্মিলা শাশুড়ির আদিখ্যেতা দেখে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণ খুব তো হৈচৈ করছিল। এখন নাতির ভালোবাসায় গলে সবকিছু ভুলে গেছে। মিসেস শর্মিলা কঠিন কন্ঠে বললেন,

-আম্মা আপনি ঘরে যান। ওর সাথে আমাদের কথা আছে।

-রাখো তোমার কথা। আমি আগে আমার নাতবউরে দেখব।

মিসেস শর্মিলা আগের থেকেও কঠিন গলায় বললেন,

-কথা শুনেন আম্মা। যাকে তাকে নাতবউ বানিয়ে ফেলবেন না।

এই বাড়িতে জাহানারা বেগমও ছেলের বউকে ভয় পান। বউমা তো নয় একটা দজ্জাল এনেছেন তিনি। উচ্ছ্বাস সবার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল।
-আমি জানি তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত।

ছেলের কথা শুনে মিসেস শর্মিলা তিক্ত মেজাজে তাকালেন। এত বড় একটা কান্ড করে এসেও কত স্বাভাবিক আচরণ করছে।

-কে এই মেয়ে?

-আমার স্ত্রী।

-তুমি যাকে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে আমরা সে মেয়েকে মেনে নিব ভাবলে কী করে?

-যাকে তাকে বিয়ে করিনি। ওর ব্যাপারে সবকিছু জেনেই বিয়ে করেছি।

-বিয়ে করার আগে পরিবারের অনুমতি নেওয়ার কথাও নিশ্চয় ভাবোনি।

-ভেবেছিলাম। কিন্তু অনুমতি যে নেব সেই সময়টুকু পাইনি।

-কেন? কেউ তোমাকে জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে নাকি?

-না। বিয়ে আমি সজ্ঞানে নিজের ইচ্ছেতেই করেছি।

উৎসব ভাইয়ের বেপরোয়া জবাব শুনে মনে মনে বলল, কেন মাকে রাগাচ্ছিস? বউ নিয়ে বাড়িতে থাকতে চাস তো নাকি! জঙ্গলেই যখন থাকতে হবে তখন বাঘকে না খোঁচানোই তো বুদ্ধিমানের কাজ। মা’র রাগ থেকে উচ্ছ্বাসকে বাঁচাতে উৎসব এগিয়ে এলো। মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে বলল,

-কয়েক বছর বাড়ি থেকে দূরে থেকে বেয়াদব হয়ে ফিরেছিস। তুই বিয়ে করতে চাস ভালো কথা। আমাদের বললে কি আমরা তোকে বিয়ে করাতাম না? তোর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করাতাম। আজই দেশে এসে বিয়ে করে নেওয়ার মানে কী? মেয়ে কি পালিয়ে যাচ্ছিল?

উচ্ছ্বাস বিড়বিড় করে বলল,

-পালিয়ে না গেলেও অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল।

-কিরে কথা বল। এখন চুপ করে আছিস কেন?

উচ্ছ্বাস জানে তার ভাই মা’র হাত থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য অ্যাক্টিং করছে। মনে মনে হাসলেও চেহারার ভাব গম্ভীর রেখে বলল,

-এখন তো বিয়ে করে ফেলেছি। বউ নিয়েও বাড়ি চলে এসেছি। এখন তোমরা কী চাও বলো।

উৎসব গর্জে উঠে বলল,

-কী চাই মানে? তুই বুঝতে পারছিস না কী চাই? মা’র কাছে ক্ষমা চা। মা’র পায়ে ধরে বল তোর ভুল হয়ে গেছে।

জেবা স্বামীর অ্যাক্টিং বুঝতে না পেরে মনে মনে দেবরের জন্য সহানুভূতি দেখিয়ে বলল,

-আহারে বেচারা! বিয়েই তো করেছে। কোন মানুষকে তো খুন করে আসেনি। এত কেন রাগ দেখাতে হবে?

উৎসব ধমক দিয়ে বলল,

-এখনও দাঁড়িয়ে আছিস!

উচ্ছ্বাস ছোট্ট একটা দম ফেলে বলল,

-কী করব?

-মা’র পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি।

মিসেস শর্মিলা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার বললেন,

-কোন প্রয়োজন নেই। আমি কাউকে ক্ষমা করার কে? আমার দুই ছেলেই নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছে। একজনও বাবা মা’র কথা ভাবেনি তাতে কী হয়েছে? ওরা নিজেদের জীবনে খুশি থাকলেই হবে। বাবা মা’র খুশির কথা ওদের ভাবতে হবে না।

মিসেস শর্মিলা কারো সাথে আর কোন কথা না বলে ঘরে চলে গেলেন। মা যাওয়ার পর উৎসব স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। উচ্ছ্বাস জানে মাকে সে কষ্ট দিয়েছে। সহজে মা তাকে ক্ষমা করবে না। ভাইয়ার ঘটনার পর সে-ও এমন কিছু করবে মা হয়তো কল্পনাও করেনি। কিন্তু তারও তো কিছু করার ছিল না। উৎসব ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে সাবধানতা অবলম্বন করে নিচু গলায় বলল,

-অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেছিস।

উচ্ছ্বাস ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-অভিনয় তো আগেই ভালো করতে, কিন্তু বিয়ের পর পাক্কা অভিনেতা হয়েছ।

শাশুড়ি মা প্রস্থানের পর জেবা উৎসুক হয়ে ছুটে এলো।

-এটা কোন কাজ করলে দেবরজি? একটা মাত্রই দেবর আমার। সে-ও দাওয়াত না দিলেই বিয়ে করে ফেলল! এই দুঃখ আমি কাকে দেখাব?

-দুঃখ আপাতত তোমার বরকে দেখাও ভাবী। আগে কিছু খাবার বেড়ে দাও। আমার বউ না খেয়ে আছে।

-হায়! একটু আগে বিয়ে করে এখনই বউয়ের প্রতি কত ভালোবাসা জেগে উঠেছে। তোমার ভাইকে দেখে কিছু শিখো আন রোমান্টিক লোক। জীবনে তো শাসুমার সামনে আমার পক্ষ নিয়ে দুইটা কথা বলতে পারো না।

জেবা মুখ মোচড় দিয়ে বরের সামনে থেকে চলে গেল। উৎসব চোখ পাকিয়ে ছোট ভাইকে শাসন করে বলল,

-ছোট হয়েও সব বিষয়ে কেন বড়ো ভাইকে পেছনে ফেলে দিস!

জেবা খাবার বেড়ে দিয়েছে। উচ্ছ্বাস ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। জেবা বলল,

-আমিও তোমার সাথে আসি? দেবরানীকে ভালো করে দেখা হয়নি।

উচ্ছ্বাস দুঃখিত মুখে বলল,

-কাল সকালে দেখা কোরো ভাবী। বুঝতেই তো পারছো, বউ ভয় পাচ্ছে। এমনিতেই ভীষণ লাজুক।

জেবা নিজের গালে হাত দিয়ে ফোঁস করে দম ফেলে বলল,

-হায়! এত ভালোবাসা এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে দেবরজি? তোমার ভেতরেও যে একটা রোমিও লুকিয়ে আছে আমি তো জানতামই না।

উচ্ছ্বাস ভাবীর কথার জবাব না দিয়ে হেসে ওখান থেকে চলে এলো। রুমে ঢোকার আগে গলায় শব্দ করে জানান দিল সে এসেছে। দরজা খুলে ভেতরে পা রেখে উচ্ছ্বাস দেখল নীলাদ্রি চেঞ্জ করে নিয়েছে। ওর পরনে একসেট সুতির থ্রিপিস। হাতমুখ ধুয়ে মেকআপ তুলে ফেলার পর স্নিগ্ধ লাগছে। উচ্ছ্বাসকে রুমে আসতে দেখে নীলাদ্রি জড়োসড়ো হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে রইল। একটু আগেই একজন মহিলা তার লাগেজ দিয়ে গেছে। যদিও মহিলা ভেতরে আসেনি। লাগেজ বাইরে রেখে ডেকে বলে গেছে। বিয়ের ভারী শাড়ি গহনায় দম আটকে আসছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে চেঞ্জ করে নিয়েছে। লোকটা বলেছিল রুমে কেউ আসবে না। সত্যিই কেউ আসেনি। যাক এটা একটু স্বস্তি। কেউ তাকে কোনকিছু জিজ্ঞেস করবে না।

উচ্ছ্বাস খাবারের প্লেট হাতে বিছানায় এসে বসে বলল,

-তোমার হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে। এসো, খেয়ে নাও।

উচ্ছ্বাস খাওয়ার জন্য ডাকলেও নীলাদ্রি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস পলকহীন চোখে কতক্ষণ নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা দম ফেলল। সে সামনে এলে এই মেয়ে নিঃশ্বাস নিতেও দ্বিধাবোধ করে। এতটা জড়তা কেন?

-নীলাদ্রি!

লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে নীলাদ্রি অনেকটাই ভড়কে গেল। ঝট করে একবার তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নিল।

-তুমি নিজের হাতে খাবে নাকি আমি তোমাকে খাইয়ে দেব? কোনটা চাচ্ছ তুমি?

চলবে