#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৯
নীলাদ্রি ফ্যালফ্যাল চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্ছ্বাস নিজেই এবার উঠে নীলাদ্রির সময় গিয়ে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাস সামনে আসাতে নীলাদ্রি একটু পেছনে সরে গেল। উচ্ছ্বাস শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-খাবে না?
থুতনি বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে নীলাদ্রি সামান্য মাথা নেড়ে ‘না’ জানাল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির হাত ধরতে গেলে আঁতকে উঠে পেছনে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে মাথার পেছনে বাড়ি খেলো। উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখছে।
-তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ নীলাদ্রি?
নীলাদ্রি কী বলবে ভেবে পেলো না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। উচ্ছ্বাস হঠাৎ করেই হেসে উঠে বলল,
-তুমি আমাকে ভয় কেন পাবে? আমি তোমার জন্য সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ নই। আগেও আমাকে দেখেছ। আমার সম্পর্কে খুব বেশি না জানলেও একটু হলেও জানো।
উচ্ছ্বাস রয়েসয়ে নীলাদ্রির হাত ধরলে বুঝতে পারল মেয়েটা কত বেশি ভয় পাচ্ছে। তার হাতে ধরা হাতটা থরথর করে কাঁপছে। নীলাদ্রির মনে হচ্ছে সে এই মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। সত্যিই যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তাহলে বিশ্রী একটা কান্ড ঘটবে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির হাত ছেড়ে দিল। বলল,
-ঠিক আছে। আমি তোমাকে জোর করব না। খাবার রেখে যাচ্ছি। যদি ক্ষিধে পায় তাহলে খেয়ে নিও।
উচ্ছ্বাস ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ধরলে নীলাদ্রি ভাবল তার জন্যই হয়তো লোকটা রাগ করে চলে যাচ্ছে। নীলাদ্রি উনাকে রাগাতে চায়নি। নীলাদ্রি কি ডাকবে? বলবে, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন? বরাবরের মতোই সে যা চায় মুখ ফোটে তা বলতে পারল না। ডাকতে গিয়েও গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
উচ্ছ্বাস বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলে নীলাদ্রি দেয়ালে হেলান দিয়েই মেঝেতে বসে পড়ল।
বাবা মা কেন উনার সাথে তার বিয়েটা দিতে রাজি হলো? আগে যার সাথে বিয়ে হচ্ছিল তাকে নিয়েও মনে সংশয় ছিল। ভয়ভীতিও ছিল। কিন্তু অনেকদিন সময় নিয়ে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছিল। বিয়ের দিন আজ এমনকিছু হবে এব্যাপারে কি কেউ আগে থেকে জানত? নীলাদ্রি কীভাবে জানবে? উনাকে একসময় বড়ো বোনের ফিয়ন্সে হিসেবে দেখেছে। তার আরও কয়েকবার পর কলেজের স্যার হিসেবে। এখন হঠাৎ করে উনাকে নিজের বর হিসেবে মেনে নিতে অস্বস্তি লাগছে। কলেজে ক্লাস নেওয়ার সময় মানুষটাকে যতটা গম্ভীর, বদমেজাজি মনে হতো এখন ঠিক তার উল্টো লাগছে। তার সাথে প্রতিটা কথা নরম সুরে বলছে। তার অসুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রাখছে। তারপরও নীলাদ্রি কেন যে উনার সামনে সহজ হতে পারছে না!
নীলাদ্রি বুঝতে পারছে, বাবা মা নিজেদের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই মানুষটার সাথে অন্যায় করে বসেছে।
পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। কল ধরার জন্যই মূলত উচ্ছ্বাস রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। নীলার কল। উচ্ছ্বাস কল তোলার সাথে সাথেই নীলা ওপাশ থেকে বলে উঠল,
-এ মুহূর্তে তোমাদের বাড়ির পরিবেশের একটু বর্ণনা দিবে আমায়? এমনিতেই আমি প্রেগন্যান্ট মানুষ। আর টেনশন নেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বাবা মা কেঁদেকেটে অস্থির। ওদিকে আবার বোনটার জন্যও চিন্তা হচ্ছে। আমি একা একটা মানুষ কয় দিক দেখব বলো?
নীলার কথা উচ্ছ্বাস সামান্য হাসল।
-তোমার বোন সুস্থ আছে, স্বাভাবিক আছে। আমাদের বাড়ির পরিবেশও শান্ত। নাতি বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে দাদীজান এতেই খুশি। ভাইয়া ভাবীও পরোক্ষ ভাবে আমার সাপোর্টে। না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলায় মা একটু কষ্ট পেয়েছে। তিনি রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ রাখবেন। তবে তোমার বোনকে কিছুই বলবে না। বাবা এখনও বাড়ি ফিরেনি। তাই বাবার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছি না।
নীলা শব্দ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল।
-বাঁচালে ভাই। টেনশন অনেকটা কমেছে। তোমাকে যে আল্লাহ আজ কোত্থেকে ফেরেশতা বানিয়ে পাঠাল! তুমি না এলে কী হতো এটাই ভাবছি।
উচ্ছ্বাস নিজে নিজেই বলল,
-আমাকে তো আসতেই হতো।
-কিছু বলেছ?
-বলেছি আমাকে তো আসতেই হতো। তুমি ইনভাইট করেছ। আমি কি না এসে পারি?
-তুমি তো আগেই আমার পছন্দের তালিকায় ছিলে। আজকে তো আমার চোখে হিরো হয়ে গেছ। নীলাদ্রিটা এখন বুঝতে পারছে না তো কত ভাগ্যবতী। নাহলে এত সহজে কেউ তোমার মতো ছেলেকে পেয়ে যায়!
-কই রে, ওই কুত্তার বাচ্চা কই?
বাবার কন্ঠ পেয়ে উচ্ছ্বাস নীলার থেকে বিদায় নিয়ে কল কেটে নিচে নেমে আসতে আসতে বলল,
-কেন নিজেকে গালি দিচ্ছ?
-গালি দিব না? দুইটা কুত্তার বাচ্চা পয়দা করেছি।
উচ্ছ্বাস বাবার কাছাকাছি চলে এলে ইউসুফ খান কন্ঠস্বর নিচু করে বললেন,
-বাঘের বাচ্চা বলা যদি গালি না হয় তাহলে কুত্তার বাচ্চা গালি হয় কীভাবে? বাঘ কি কুকুরের থেকে বেশি লয়াল?
উচ্ছ্বাস বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাসল। কতদিন পর বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারছে সে। ইউসুফ খান ছেলের কানে কানে বললেন,
-তোর মাকে শুনিয়ে একটু উৎপাত করব। গালিগালাজ গুলো গায়ে মাখিস না। আর এক দুইটা চড় দিলেও মনে নিস না বাপ।
সাথে সাথে আবার গলা উঁচিয়ে হুংকার ছাড়লেন,
-জানোয়ার ছেলে, বাবা মায়ের কথা ভাবেনি। বের হ আমার বাড়ি থেকে। আমার বাড়িতে দুই কুত্তার বাচ্চার কোন জায়গা নেই। বড়টাকেও আজ বাড়ি থেকে বের করে দিব।
বাবার চেঁচামেচি শুনে উৎসবও বেরিয়ে এসেছে। মুখ ভোতা করে সে বলল,
-আমি কী করেছি বাবা?
-তুই-ই তো আগে করেছিস হারামজাদা। তোকে দেখেই তো ছোটটা শিখেছে।
মিসেস শর্মিলা ঘরে বসে সব শুনছেন। স্বামীর উৎপাত শুনে তার রাগটা কিছুটা পড়ে এসেছে।
ইউসুফ খান এত জোরে জোরে কথা বলছেন নীলাদ্রিও ঘরে বসে শুনতে পেলো। ভয়ে বেচারি চুপসে গেল। আবার এটা ভেবেও খারাপ লাগছে তার জন্য মানুষটাকে কত কথা শুনতে হচ্ছে।
ইউসুফ খান হাসি-হাসি মুখে নিচু স্বরে জানালেন,
-বউমা বাড়িতে পা রেখেই কোটি টাকার ডিল পাইয়ে দিয়েছে। এমন লক্ষী বউমা কোথায় পেয়েছিস বাজান?
উৎসব বাবার হাবভাব বুঝতে পেরে অবাক গলায় বলল,
-তুমি এতক্ষণ অ্যাক্টিং করছিলে বাবা!
ইউসুফ খান চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
-এতদিনেও নিজের বাপকে চিনতে পারিসনি গাধা! তোকে তো সত্যি সত্যিই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত।
মনিকা জেবার রুমে আছে। সন্ধ্যা থেকে মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। জেবার ভীষণ মায়া হচ্ছে। ভালোবাসা এরকমই। একজন পূর্নতা পেলে অপরজন কষ্ট পাবে এটাই নিয়ম। মনিকা উচ্ছ্বাসকে ভালোবাসলেও উচ্ছ্বাস কোনদিন মনিকাকে ভালোবাসেনি। জেবা তার বরকে গেস্ট রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজকে রাতে মনিকাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না। উচ্ছ্বাস আসার খুশিতে মেয়েটা এসেছিল।
ইউসুফ খান স্ত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে দুই ছেলেকে বকতে বকতে রুমে চলে এলেন। উৎসব সোফায় বসতে বসতে বলল,
-বাপ সত্যিই বাপই হয়। চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে দুই ছেলেকে গালি দিয়ে স্ত্রীর মন রাখছে। ছেলেদেরও আবার ভাগিয়ে এনে বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
উচ্ছ্বাস ফোনে সময় দেখল। রাত মোটামুটি অনেক হয়েছে। সে ঘরে যাওয়া ধরলে উৎসব বলল,
-কোথায় যাচ্ছিস?
-রুমে। আর কোথায় যাব?
-বোস একটু। দুই ভাই মিলে গল্পগুজব করি।
উচ্ছ্বাস অনুসন্ধানী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। যে লোক সন্ধ্যার আগে ঘরে দরজা আটকে দেয় সে আজ মাঝরাতেও ঘরে না গিয়ে ভাইয়ের সাথে গল্প করতে চাচ্ছে!
-ভাবী কি তোমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে?
উৎসব মাথা চুলকিয়ে বলল,
-বের করে দেয়নি। আমাদের রুমে মনিকা,,,
উৎসব কথা শেষ করতে পারল না। উচ্ছ্বাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-মনিকা এখন আমাদের বাড়িতে আছে?
-কেন তুই দেখিসনি? তোর আসার উপলক্ষেই তো এসেছিল।
উচ্ছ্বাস সত্যিই খেয়াল করেনি। মা মনিকার মাথায় উল্টাপাল্টা সব কথা ঢুকিয়ে রেখেছে। তাহলে তো মনিকা নীলাদ্রিকে দেখে কষ্ট পেয়েছে। অজান্তে মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য উচ্ছ্বাসের অনুশোচনা হলো।
-আমার কি মনিকার কাছে যাওয়া উচিত?
উৎসব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-এখন না গেলেই ভালো হবে।
উচ্ছ্বাস ভাইয়ের পাশে বসল। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
-মেয়েটা সত্যিই তোকে ভালোবাসত।
-আই নো। কিন্তু আমি তো কখনও মনিকাকে ওই চোখে দেখিনি।
-দোষ আসলে তোর না। মনিকারও না। মা-ই ওকে বউমা করতে চেয়েছিল। মনিকাও সেই আশায় স্বপ্ন দেখেছে। তোর তো কখনও গার্লফ্রেন্ড ছিল না। কাউকে পছন্দের কথাও বলতে শুনিনি। বিয়ে মা’র পছন্দেই করবি এমনটাই তো ভাবতাম আমরা। কিন্তু তুই যে এরকম হুট করে দেশে এসে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবি ব্যাপারটা সবার জন্যই শকিং ছিল।
উচ্ছ্বাস চুপ করে আছে। উৎসব জানতে চাইল,
-তুই কি মেয়েটাকে আগে থেকে চিনতি?
ভাই কোন মেয়ের কথা বলছে বুঝতে না পেরে উচ্ছ্বাস তাকালে উৎসব বলল,
-তোর বউয়ের কথা বলছি।
-হ্যাঁ, চিনতাম।
-রিলেশন ছিল?
-না।
-তাহলে বিয়ে কীভাবে করেছিস?
-অনেক কাহিনি ভাই। এখন বলা শুরু করলে রাত শেষ হয়ে যাবে।
-যাক। আমি আছি। বল তুই।
-কিন্তু আমি থাকতে পারছি না। বউ ঘরে একা আছে। আমাকে যেতে হবে।
উচ্ছ্বাস সত্যিই যাওয়া ধরল। উৎসব মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-তোর লাভারের চক্করে আমার বউ আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আর তুই এখন নিজের বউয়ের কাছে যাচ্ছিস! কত বড় স্বার্থপর দেখেছ!
উচ্ছ্বাস গলায় শব্দ করে ভেতরে ঢুকে দেখল নীলাদ্রি বিছানার একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার রেখে যাওয়া খাবার থেকে সামান্য একটু খেয়েছে মনে হয়।
উচ্ছ্বাস নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে নীলাদ্রির মাথার কাছে দাঁড়াল। ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখতে দেখতে ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে উঠল। ঘুমিয়ে আছে বলে আচরণে জড়তা, চেহারায় ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। জেগে থাকলে নিশ্চয় সে ঘরে আসার সাথে সাথেই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকত।
—–
রাতে বিশাল আয়োজন থাকলেও কারোরই খাওয়া হয়নি। সকালে খাবার টেবিলে সবাই এলেও মিসেস শর্মিলা আসেননি। জাহানারা বেগম নাতবউকে বললেন,
-খেতে দাও নাতবউ। তোমার শাশুড়ি খাবে না দেখে কি আমাদেরও ক্ষিধে পাবে না?
জেবা দাদী শাশুড়িকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে শ্বশুরকে বলল,
-আব্বা মা রাতেও কিছু খায়নি।
ইউসুফ খান উঠতে নিয়ে বললেন,
-খাবার বাড়ো। আমি তোমার শাশুড়িকে নিয়ে আসছি।
বাবা যাবার আগেই উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে উঠে বলল,
-মা আমার উপর রাগ করেছে। তাই রাগ ভাঙানোর দায়িত্বও আমারই।
ইউসুফ খান আবার বসে পড়ে বললেন,
-যা গিয়ে দেখ। ব্যর্থ হয়ে ফিরলে বাপকেই দরকার পড়বে।
উচ্ছ্বাস মা’র কাছে যাচ্ছে। উৎসব জেবাকে জিজ্ঞেস করল,
-মনিকা আসবে না?
-মনিকা সকালেই চলে গেছে।
জাহানারা খেতে খেতে বললেন,
-সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমার নতুন নাতবউ কই? নাতি কি বউরে ঘরে রাইখা একা একাই দেখব। আমাদের দেখতে দিব না?
চলবে