মনের আঙিনায় পর্ব-১১

0
19

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১১
উচ্ছ্বাস ভাবীর এত প্রশ্নের একটার জবাবও ঠিক ভাবে দিল না। চতুর হেসে বলল,

-প্রতিশোধই তো। ওদের মেয়েকে আমার তিন বাচ্চার মা বানিয়ে ওর পরিবারের থেকে প্রতিশোধ নিব।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। সকালে তারও খাওয়া হয়নি। ভাবীর জেরার মুখোমুখি হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। আধা ঘন্টা ধরে পুলিশের মতো ইনকয়ারি করে তার উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হয়ে তবেই ছেড়েছে। দরজায় নক করে উচ্ছ্বাস ভেতরে ঢুকলো। নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসকে দেখে মাথার ওড়না আরেকটু টেনে নিল। নীলাদ্রিকে বউ বউ লাগছে। উচ্ছ্বাস পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে কতক্ষণ নীলাদ্রিকে দেখে বলল,

-খেতে আসো নীলাদ্রি।

নীলাদ্রিরও ক্ষিধে পেয়েছে। বিয়ের দিন সকালে আপু যে খাইয়ে দিয়েছিল সেই খাওয়া। রাতে যদিও লোকটা খাবার এনেছিল কিন্তু নীলাদ্রি খেতে পারেনি। ক্ষিধেয় এখন পেট জ্বলছে। তবুও খেতে লজ্জা লাগছে। উচ্ছ্বাস এই মেয়ের কান্ডকারখানা দেখে ভাবল, বউয়ের সাথে কথাবার্তা বলার মতো সহজ একটা সম্পর্ক তৈরি করতে না জানি কত বছর লেগে যায়। রোমান্স টোমান্সে পৌছতে নিশ্চয় জীবনই শেষ হয়ে যাবে।

এত বেশি পরিমাণ খাবার দেখে নীলাদ্রি ভাবছে সব কি তার জন্য এনেছে! উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির পাশে বসতে বসতে বলল,

-আমারও খাওয়া হয়নি। সকলের ব্রেকফাস্ট করা শেষ। যদিও একটু পরই লাঞ্চের টাইম হয়ে যাবে।

উচ্ছ্বাস প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলল,

-তোমারও নিশ্চয় ক্ষিধে পেয়েছে। নাও এবার হা করো।

উচ্ছ্বাস খাবার নিয়ে নীলাদ্রির মুখের সামনে ধরলে অবাক হয়ে তাকাল নীলাদ্রি। এই লোকের হাতে খেতে হবে ভেবেই তার ক্ষিধে ফুরিয়ে গেল। উচ্ছ্বাস ছোট্ট একটা দম ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,

-হাত ব্যথা হচ্ছে। হা করো।

কথাটা ধমকের মতো শোনালে নীলাদ্রির কলেজের দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তখনও এরকম ভাবেই ধমক দিয়ে দাঁড় করাত। লোকটার এই রুপ তার ভালো করেই চেনা।

কাল রাত থেকে উচ্ছ্বাস যথেষ্ট নরম আচরণ করার চেষ্টা করেছে। ভেবেছে সে নরম হলে নীলাদ্রির সহজ হতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। তার নরম কথায় কাজ হয়নি। বরং ধমক দেওয়ার পরে নীলাদ্রি হা করেছে। উচ্ছ্বাস পরোটার অংশটুকু নীলাদ্রির মুখে দিয়ে বলল,

-আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে নীলাদ্রি। আমি তোমার হাসবেন্ড। এই কথাটা যত দ্রুত মনে ও মাথায় ঢুকিয়ে নিতে পারবে তোমার জন্য সবকিছু ততই সহজ হয়ে যাবে।

খাবার গলায় আটকে গেলে নীলাদ্রি কাশতে লাগল। উচ্ছ্বাস ওকে পানি খাইয়ে বলল,

-আগেও বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছে। তুমি আমাকে চেনো। চেনো না?

নীলাদ্রি খেতে খেতেই উপর-নীচ মাথা দুলাল।

-আর যদি না-ও চিনতে তাহলেও এই বাড়িতে আমিই তোমার সবচেয়ে আপন লোক। তোমার যেকোনো সমস্যার কথা তুমি আমাকে বলবে। বলবে তো?

-হুম।

উচ্ছ্বাস হাসল। বলল,

-গুড গার্ল। শুধু আমার কথায় মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালেই হবে না। তুমিও আমার সাথে কথা বলো।

নীলাদ্রি উচ্ছ্বাসের দিকে না তাকিয়েই মিনমিন করে বলল,

-কী কথা বলব?

উচ্ছ্বাস এবার শব্দ করে হেসে উঠলে নীলাদ্রি মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল।

-স্বামী স্ত্রীর মাঝে যেসব কথা হয়।

নীলাদ্রি মুখ নিচু করে বসে আছে। অকারণেই হাত-পা কাঁপছে। লোকটার কিছুক্ষণ আগের গম্ভীরতা কেটে গিয়ে আবার অন্য মানুষ হয়ে গেছে। এবার উচ্ছ্বাস মুখের সামনে হাত তুললে নীলাদ্রি মৃদু গলায় বলল,

-আর খেতে পারব না।

উচ্ছ্বাস জোর করল না। খাবারটা নিজের মুখে পুরে নিয়ে বলল,

-আজ তোমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাব।

এই কথা শুনে নীলাদ্রি ভেতরে ভেতরে খুশি হয়ে গেল। পরক্ষণে একটা ভাবনা মনে আসতে মুখ অন্ধকার হয়ে এল। বাধোবাধো গলায় জানতে চাইল,

-আপনার বাড়ির লোকেরা,,,

কথা শেষ করল না নীলাদ্রি। তবে সে যে এটুকু জিজ্ঞেস করেছে উচ্ছ্বাস এতেই খুশি। অন্তত শ্বশুরবাড়ির মানুষদের কথা ভাবছে তো।

-বেরোবার আগে তোমাকে সবার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

সবার সাথে দেখা করতে হবে শুনেই নীলাদ্রির কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেল। তার জীবনে সবথেকে বড়ো আতঙ্ক তো এটাই। অচেনা মানুষদের সামনে গেলেই তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিয়ে নিচে এসে জানতে পারল বাবা অফিসে চলে গেছে। ভাইয়াও বেরিয়েছে। ভাবী আগেই নীলাদ্রিকে দেখেছে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিয়ে দাদীর ঘরে এলো। নীলাদ্রির ভয় কমাতে উচ্ছ্বাস হাতের মুঠোয় নীলাদ্রির হাত ধরে রাখল। জাহানারা বেগম নাতি, নাতবউকে দেখেই নাখুশ মেজাজে বললেন,

-আমার কাছে আসার সময় হইছে তাইলে! আমি তো কই বউরে ঘর থেকে বাইরই করবি না। তোর বউয়ের যদি আবার আমার নজর লেগে যায়।

নীলাদ্রি ভেতরে যেতে ভয় পাচ্ছে। উচ্ছ্বাস ওকে আশ্বস্ত করে বলল,

-আমার উপর রেগে আছেন। তাই এমনিতেই এসব বলছে। তোমাকে কিছু বলবে না।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিয়ে দাদীর সামনে এসে বলল,

-আমার বউকে দেখে তোমার হিংসে হচ্ছে বুড়ী? তোমার সতীন নিয়ে এসেছি বলে সহ্য করতে পারছো না।

-আহারে আমার সতীন রে! তোর বউয়ের আমার সতীন হওয়ার যোগ্যতা আছে। এই মাইয়া দেখি এদিকে আসো। আমার চামড়ার সাথে তোমার চামড়া মিলাইয়া দেখি।

জেবা হুড়মুড়িয়ে দরজায় এসে পড়লে জাহানারা বেগম তিক্ত গলায় বললেন,

-আরেক সতীন আসছে দেখো! এরে বাড়িতে জায়গা দিয়াই তো শনিটা লাগছে। এর লেঙ্গুর ধইরা ছোডডাও ওই ধারাতেই আসছে।

জেবা গাল ফুলিয়ে বলল,

-নতুন বউয়ের সামনে কেন দজ্জালের মতো আচরণ করছেন দাদী। বেচারি আপনাকে ভয় পেয়ে যাবে।

-ভয় পাওয়া ভালা আছে।

দাদী মুখে মুখে যত কথাই বলুক নাতবউকে কাছে ডেকে বসালেন। নরম সুরে নতুন বউয়ের সাথে কথা বলছেন। নীলাদ্রির হাত ধরে বললেন,

-কইতরের লাহান কাঁপতাছো কেন? ওইসব কাঁপা-কাঁপি তোমার বেডা আদর সোহাগ করার সময় কইরো। আমার সাথে শক্ত হয়ে বসো।

কথাটা শুনে নীলাদ্রি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কান দিয়ে ধোয়া বের হতে তার। উচ্ছ্বাস এখানে বউয়ের পক্ষ নিয়ে বলল,

-তুমি যেভাবে ভয় দেখাচ্ছ আমার বউ কাঁপবে না তো কী করবে? ধমকে কথা না বলে মিষ্টি করে বলো। তাহলেই আর কাঁপবে না।

নীলাদ্রি একটা জিনিস খেয়াল করেছে এই লোক দাদীর সামনে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে। হাস্যোজ্জ্বল মিশুক একজন মানুষ মনে হচ্ছে। জেবা জিজ্ঞেস করল,

-মা’র সাথে নীলাদ্রির দেখা করাবে না?

উচ্ছ্বাস বলল,

-আমরা এখন মা’র কাছেই যাচ্ছি।

জাহানারা বেগম ছেলের বউয়ের চরিত্র সম্পর্ক জানেন। মেয়েটা এমনিতেই ভয় পাচ্ছে। এখন ওই ঘরে গেলে কথার তিক্ততায় মেয়েটাকে কাঁদিয়ে ছাড়বে। তাই তিনি বললেন,

-অহন আর তোর মা’র কাছে গিয়া কাম নাই। কয়টা দিন যাক। তোর মা’র মাথাও ঠান্ডা হোক।

দাদী মানা করলেও উচ্ছ্বাস এমনটা করতে পারবে না। দাদীর বারণ না শুনে নীলাদ্রিকে নিয়ে সে মা’র ঘরে চলে এলো। ভেতরে ঢোকার আগে নীলাদ্রিকে বলল,

-মা এমনিতে রাগী মানুষ না। মাকে তুমি যখন জানতে শুরু করবে তখন বুঝবে আমার মায়ের মতো মানুষ হয় না। এখন অবশ্য একটু রেগে আছে। তোমাকে যদি কিছু বলেও তাহলেও তুমি কষ্ট পেয়ো না।

নীলাদ্রি মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। মিসেস শর্মিলা শাশুড়ির ঘরে ছেলের শব্দ পেয়েই অন্য পাশে মুখ করে শুয়ে পড়েছিলেন। উচ্ছ্বাস ডাকলেও তিনি তাকালেন না। এমনকি একটা শব্দ পর্যন্ত করলেন না। উচ্ছ্বাস জানে মা’র রাগ এত সহজে পড়বে না। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

——–
বাড়িতে এসে নিজের বাবা মাকে দেখে নীলাদ্রি কান্না আটকিয়ে রাখতে পারল না। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মা পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-কাঁদছিস কেন পাগল মেয়ে? মাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় কাঁদিস। আবার মা’র কাছে ফিরে এসেও কাঁদিস!

তার বোনের কান্নাকাটি নতুন কিছু না। নীলা উচ্ছ্বাসকে নিয়ে দাদার ঘরে বসাল। দাদার সাথে থাকলে বেচারা অন্তত বোর হবে না। দাদা আবেগে নাতজামাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

-কেমন আছো ভাই?

উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে বলল,

-গতকাল যেমন দেখেছিলেন। আজ অবশ্য গতকালের থেকেও ভালো আছি।

-আদরের নাতনিকে দিয়ে দিয়েছি। ভালো থাকবে না কেন শুনি?

উচ্ছ্বাস আশেপাশে তাকিয়ে দাদাজানের আদরের নাতনিকে খুঁজল। উঁহু, কোথাও নেই। বাড়ি আসার পর যে উধাও হয়েছে একবারও দর্শন দেয়নি। নীলাদ্রি ঘরে এসে তার ফোন হাতে নিয়ে দেখল বান্ধবীদের অসংখ্য অগণিত মিসড কল। সে ওয়াইফাই কানেকশন দেওয়ার সাথে সাথে টুংটাং শব্দে মেসেজের নোটিফিকেশনের ঠেলায় ফোন হ্যাং মরার দশা। নীলাদ্রি অনলাইনে এসেছে দেখেই মুন ভয়েস মেসেজ পাঠাল,

-এই শালি, এক রাতও হয়নি। জামাই পেয়ে এখনই বান্ধবীদের ভুলে গেছিস?

সব কয়টা অনলাইনেই ছিল। ভিডিও কল দিলে নীলাদ্রিকেও জয়েন করতে হলো। রাফা বিয়ে করে বর নিয়ে জাপান চলে গেছে। নেহা কাশ্মীর ঘুরতে গেছে। যে কারণে ইচ্ছে থাকলেও মুন একা রাজশাহী থেকে নীলাদ্রির বিয়েতে আসতে পারেনি। তবে কথা ছিল নীলাদ্রি বাসর ঘরে বসে ভিডিও কল করবে।
নেহা বলল,

-নীলাদ্রি কী হারামি রে তুই! বাসর রাতে জামাই পেয়ে আমাদের কথা ভুলে গেলি?

রাফাটা আগেও ঠোঁটকাটা ছিল। বিয়ের পর আরও হয়েছে। সে বলল,

-তোরাও না! আমার বান্ধবীকে কেন দুষছিস? বান্ধবী নিশ্চয় কল দিত। কিন্তু দুলাভাই হয়তো ওকে সেই সুযোগটাই দেয়নি। তোদের তো আর বিয়ে হয়নি। তাই বুঝবি না।

নেহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-বিয়ে হয়নি তো কী হয়েছে? তোর সাথে থেকে থেকে কম অভিজ্ঞতা তো আর অর্জন করিনি।

দুইটা মিলে আরও নানান কথাবার্তা বলছে। এদের এসব কথাবার্তা শুনে নীলাদ্রির গাল লাল হয়ে গেছে। এত ফাজিল এরা! মুন এদের থামিয়ে দিয়ে বলল,

-এই তোরা থামবি? ঝগড়া করার হলে দূরে গিয়ে কর। নীলাদ্রি তুই বিয়ের পিক দে। এখনও দুলাভাইকেই দেখা হয়নি।

পিকের কথা শুনে নীলাদ্রি ভাবনায় পড়ে গেল। ফারদিন মানে যার সাথে প্রথমে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার ছবি ওদের দেখিয়েছিল। কিন্তু বিয়েটা তো ফারদিনের সাথে হয়নি। যার সাথে হয়েছে তাকে এরা খুব ভালো করেই চিনে। একসময় তো ক্রাশ খেয়ে উলটে পড়েছিল। এখন যদি এরা জানতে পারে তার বিয়ে উচ্ছ্বাস স্যারের সাথে হয়েছে তাহলে নিশ্চয় তাকে নিয়ে মজা উড়াবে। নীলাদ্রি ঠিক করল সে কোন ছবি টবি দিবে না।

-কিরে ছবি দে।

-ছবি নেই। কল কাটছি আমি। আমাকে ডাকছে।

মিথ্যা বলে নীলাদ্রি দ্রুত কল কেটে দিল।

চলবে