মনের আঙিনায় পর্ব-১২

0
22

#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১২
রাতের আগে নীলাদ্রি আর উচ্ছ্বাসের সামনে আসেনি। নীলাই এত বড় পেটটা নিয়ে এই ঘর থেকে ওই ঘরে ছুটাছুটি করে উচ্ছ্বাসকে জামাই আদর করেছে।সবার এত আদর আপ্যায়নের মাঝেও উচ্ছ্বাসের চোখ একজনকেই খুঁজছে। দুপুরের পর তাকে বেরোতে হয়েছিল। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেছে। রাতে খাবার টেবিলে বসে এত বিশাল আয়োজন দেখে উচ্ছ্বাস মনে মনে নিজের জন্য দোয়া করে নিলো। তাকে খেতে দেওয়ার সময় নীলাদ্রিকেও কাছেপিঠে দেখা গেল। নীলাদ্রি এই লোকের কাছাকাছি থাকতে না চাইলেও বোনের চোখ রাঙানি দেখে থাকতে হচ্ছে। উচ্ছ্বাস বেশ বুঝতে পারছে এই মেয়ে বাড়িতে এসে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। ঠিক আছে। সময় এবং সুযোগ সে-ও পাবে। তখন হিসেব বুঝে নিবে। নীলা তার বোনকে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত চিনে। তাই তো জোর করে সাথে রাখছে। উচ্ছ্বাসের আশেপাশে থাকুক। একদিনে ভালোবাসা তৈরি না হলেও কাছাকাছি থাকলে জড়তা কেটে যাবে। নীলা তাই নীলাদ্রিকে উচ্ছ্বাসের পাতে খাবার তুলে দিতে বলছে। ইচ্ছে না করলেও নীলাদ্রিকে বোনের কথা শুনতে হচ্ছে। নীলা আরেকটা জিনিসও লক্ষ্য করেছে, তারা কিছু দিতে গেলে উচ্ছ্বাস না করছে। পেট ভরে গেছে, আর খেতে পারবে না কত বাহানা। অথচ নীলাদ্রি দিলে কিছুই বলছে না। উল্টো চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার পর্ব সেরে উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির ঘরে চলে এলো। আজ তাদের থাকার প্ল্যান ছিল না। যাওয়ার কথা বললে নীলাদ্রির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়েই আজকের রাতটা থেকে যাবে ঠিক করল। নীলাদ্রি বোনের ঘরে এসে বসে আছে। সে জিজ্ঞেস করল,

-আপু দুলাভাই কবে আসবে?

-এই লোকের কথা আমার কাছে জানতে চাইবি না। সে দেশ সেবা করে জাতিকে উদ্ধার করে ফেলুক। বউ সেবা তাকে করতে হবে না। আগে জানলে এই গরুকে বিয়ে করার থেকে ভালো উচ্ছ্বাসকেই বিয়ে করে নিতাম।

কথাটা বলেই নীলা জিভ কামড় দিল। ভুলেই গিয়েছিল উচ্ছ্বাস এখন তার বোনের বর। এসব কথা মুখে আনাও পাপ। আগে যা হবার হয়েছে। এখন সম্পর্ক বদলে গেছে। নীলাদ্রি ইচ্ছে করেই বোনের সাথে সময় ব্যয় করছে। ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। নীলাও বেশ বুঝতে পারল। হাই তুলতে তুলতে নীলাদ্রিকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল,

-ঘুম পাচ্ছে। তুইও গিয়ে শুয়ে পড়।

কী আর করার? সারারাত তো সে আপুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তাই ধীর পায়ে নীলাদ্রি নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে। ঘরে এসে দেখল উচ্ছ্বাস ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। সে এক মুহূর্তও দেরি করল না। তাড়াতাড়ি গিয়ে বিছানায় একপাশে জায়গা রেখে অন্য পাশে শুয়ে পড়ল। নীলাদ্রি ঘরে পা রাখার পরই উচ্ছ্বাস ওর উপস্থিতি টের পেয়েছে। কল শেষ করে রুমে এসে দেখল নীলাদ্রি শুয়ে পড়েছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। একে তো ঘরে আসতে এত সময় লাগিয়েছে। এখন আবার এসেই শুয়ে পড়েছে। এই মেয়েকে কী শাস্তি দেওয়া উচিত? হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেলে নীলাদ্রি কেঁপে উঠল। তবে সে কিছুই বলতে পারল না। সে মুখ খুললেই লোকটা জেনে যাবে সে জেগে আছে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির পাশে এসে শুয়ে পড়ল। নীলাদ্রি নড়াচড়া বিহীন শক্ত হয়ে পড়ে রইল। ওই মানুষটা তার পাশেই শুয়েছে। অস্বস্তিতে নীলাদ্রি জমে যাচ্ছে। লাইটটাও অফ করা। নীলাদ্রি হঠাৎ তার পেটে কারো স্পর্শ অনুভব করল। উচ্ছ্বাস আচানক দু’হাতে নীলাদ্রির কোমর ধরে টেনে ওকে কাছে নিয়ে এলো। নীলাদ্রির দম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। থরথর করে কাঁপতে লাগল বেচারি। নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। উচ্ছ্বাস আদেশের সুরে বলল,

-নিঃশ্বাস ছাড়ো নীলাদ্রি।

নীলাদ্রি আটকে রাখা নিঃশ্বাস শব্দ করেই ছাড়ল। উচ্ছ্বাস আগের থেকেও কড়া গলায় বলল,

-কাঁপাকাঁপি বন্ধ করো।

নীলাদ্রি কাঁপা-কাঁপি বন্ধ করতে পারল না। বরং আরও বেশি কাঁপতে লাগল। উচ্ছ্বাস নিঃশব্দে হাসল। কন্ঠ স্বর নরম করে বলল,

-চোখ বন্ধ করে ঘুমাও।

বলেই সে নীলাদ্রির গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। এদিকে নিজের বুকের ধুকপুকানি নীলাদ্রি পরিষ্কার শুনতে পারছে। ফ্যানের নিচেও দরদর করে ঘামছে। কয়েকবার ঢোঁক গিলেও শুকনো গলা ভেজাতে পারছে না। লোকটা ঘুমাতে বললেই কি সে আজ ঘুমাতে পারবে? নাকি তার চোখে ঘুম আসবে?

_____
বিদায় সবসময়ই বেদনাদায়ক হয়। একটা রাত বাড়িতে ছিল। আজ ফিরে যাওয়ার সময় নীলাদ্রির মনে হচ্ছে সে তার সবকিছু ফেলে যাচ্ছে। অবশ্য ফেলেই তো যাচ্ছে। বাবা মা বোন দাদা। মাকে জড়িয়ে নীলাদ্রি কাঁদলে নীলা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-কী শুরু করলি হ্যাঁ? প্রতিবার এসে যাওয়ার সময়ই কি তুই এভাবে কাঁদবি? তাহলে তো উচ্ছ্বাসকে বলতে হবে তোকে যেন আর নিয়েই না আসে।

গাড়িতে বসেও নীলাদ্রির কান্না চলমান রইল। উচ্ছ্বাস ড্রাইভ করতে করতে নীলাদ্রিকে দেখছে। নীলাদ্রির দিকে রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলল,

-যদিও প্রথম সন্তান আমি মেয়েই চাইতাম। কিন্তু তোমাকে দেখে চাওয়া পাল্টে গেছে। আমার মেয়েও যদি স্বামীর সাথে যাওয়ার সময় এভাবে কাঁদে আমি ওকে যেতে দিব না। তোমার বাবা মা তো তবুও দিয়েছে।

উচ্ছ্বাসের এই কথা শুনে নীলাদ্রি কাঁদতে ভুলে গেল। এই লোক কতদূর ভেবে ফেলেছে! কল্পনায় মেয়ে জন্ম দিয়ে তার বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে! নীলাদ্রি ফ্যালফ্যাল চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। উচ্ছ্বাস সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করলেও বুঝতে পারছে নীলাদ্রি তাকেই দেখছে। ভীষণ কষ্টে হাসি চেপে রাখল সে। নীলাদ্রির কান্না থামানোর জন্যই এসব কথা বলেছে সে।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে নিয়ে বাড়িতে পা দিয়েই একটা খুশির খবর শুনলো। উৎসব খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-আমাকে কংগ্রাচুলেশন বল।

উচ্ছ্বাস প্রথমে বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

-কোন দুঃখে?

-দুঃখে না গাধা সুখে। আমি বাবা হতে যাচ্ছি। আর তুই চাচা।

উচ্ছ্বাস নিজেও অনেক বেশি খুশি হলো। ভাইকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

-তুমি আগে আমাকে কংগ্রাচুলেশন জানাও। আমি চাচা হচ্ছি।

নীলাদ্রি এই খুশি উপলব্ধি করতে পারে। আপুর প্রেগন্যান্সির খবর শুনে সে-ও এতটা খুশিই হয়েছিল। জেবা লজ্জিত মুখে বসে বসে এদের কান্ড দেখছে। তার বর দেবর দুইটাই পাগল। নীলাদ্রি জেবার পাশে বসলে জেবা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-পাগলদের কান্ড দেখো!

নীলাদ্রি মৃদু হাসল। জেবার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া যাচ্ছে সে কতটা খুশি। উচ্ছ্বাস জেবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-ভাবী আমার কিন্তু জুনিয়র ইউসুফ খান লাগবে।

জেবা অবাক হবার নাটক করে বলল,

-ও মা, তুমি কবে থেকে ছেলে পছন্দ করো! আমি তো জানতাম তুমি মেয়ে পছন্দ করো।

উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির দিকে চোখ রেখে বলল,

-মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতে হবে ভাবী।

নীলাদ্রি লজ্জা পেলো। এই লোক এমন কেন? জবা হো হো শব্দে হেসে উঠে বলল,

-ঘরজামাই নিয়ে আসবে নাহয়।

-না। ওসব ঘরজামাই শব্দ ভালো শোনায় না।

জেবা নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাসকে জিজ্ঞেস করল,

-তুমি কবে খুশির খবর দিচ্ছ দেবরজি?

-আমি একা তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না ভাবী। যার মাধ্যমে আসবে সে তৈরি থাকলে সামনের বছরই বড় আম্মু ডাক শুনতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

নীলাদ্রির কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই লোক এত ঠোঁটকাটা! হায় আল্লাহ! নীলাদ্রির মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে ইচ্ছে করছে।

ছয়টা বছর অপেক্ষা করার পর আল্লাহ জেবাকে এই খুশি দিয়েছেন। বাড়ির সবাইও অনেক খুশি। জেবা কেন মা হতে পারছে না তা নিয়ে কেউ অবশ্য কিছু বলেনি। তবে মনে মনে সবাই চাইত বাড়িতে একটা বাচ্চা আসুক। জেবা নিজেই সবথেকে বেশি চাইত। জেবা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে একটা আবদার রাখল। উচ্ছ্বাস আর নীলাদ্রির বিয়েটা যেন তারা মেনে নেয়। ছেলের বউয়ের খুশির দিকে তাকিয়ে মিসেস শর্মিলাকে বিয়েটা মেনে নিতে হলো। ছেলে বউ নিয়ে বাড়িতে এসেছে শুনে ইউসুফ খান তো বউমাকে না দেখেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মিসেস শর্মিলা মন থেকে এখনও মেনে নিতে পারেনি। আর না ভবিষ্যতে পারবে। তারপরও বড় ছেলের বউয়ের জন্য কিছু বলল না। ঠিক হলো রিসিপশন অনেক বড়ো করে রাখা হবে। নীলাদ্রির কাছে এসব আনুষ্ঠানিকতা ঝামেলা ছাড়া কিছুই মনে হয় না৷ তবে তার বলারও কিছু নেই। উচ্ছ্বাস নিজেও চায় সবাই জানুক নীলাদ্রি তার স্ত্রী। সে আড়ালে ভাবীকে ছোট্ট করে বলল,

-থ্যাংকস ভাবী।

জেবা হেসে বলল,

-ওসব থ্যাংকস ট্যাংকস চাই না। বড়ো আম্মু ডাক শুনতে চাই।

_____
দুই পরিবারের সামনাসামনি বসা উচিত। বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন সামাজিকতা মেনে বাকি অনুষ্ঠানও হয়ে যাক।

ইউসুফ খান বড় ছেলেকে নিয়ে বৌমার বাবা মা’র সাথে দেখা করতে এসেছে। উচ্ছ্বাসও সাথে এসেছে। মিসেস শর্মিলা আসেননি। ইউসুফ খান এই পরিবারকে চিনতে পেরেছেন। ছেলের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলেন তিনি। বড়ো মেয়ের সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছিল। বিয়েটা হয়নি। এই ছেলে ওই পরিবারের ছোট মেয়েকেই বিয়ে করেছে! শর্মিলা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে। বেয়াই বিয়াইনের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইউসুফ খান বললেন,

-বিয়ে করার জন্য এদের মেয়েকেই পেলি বাপ? তোর মা জানতে পারলে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। ওই ঘটনা তোর মা এখনও ভুলতে পারেনি।

উচ্ছ্বাস হাই তোলার মতো করে বলল,

-তুমি আছো কেন? নিজের বউকে একটু বোঝাতে পারবে না?

-তুই কি চাচ্ছিস তোর সাথে তোর বাপও বাড়ি ছাড়া হোক?

উৎসব হাসতে হাসতে বলল,

-তুমি মাকে এত ভয় পাও কেন?

-তুই তোর বউকে ভয় পাস না?

উৎসব আর কিছু বলল না। বউকে সে বাঘের মতো ভয় পায়।

মাঝে দুইটা দিন কেটে গেল। ইচ্ছে না থাকলেও মিসেস শর্মিলাকে ছেলের রিসিপশনে চেনা পরিচিত অনেক জনকে দাওয়াত দিতে হলো। মিসেস শর্মিলা তার ঘনিষ্ট বান্ধবী মারজিয়াকে বলতে পারল না। তবে মিসেস শর্মিলা না বললেও মারজিয়া শোনার বাকি থাকেনি।

মারজিয়া আজ খান বাড়িতে এসেছে। মিসেস শর্মিলার সাথে তার সম্পর্কে অনেক দিনের পুরোনো। তার মেয়েকে ছেলের বউ করবে আশা দিয়ে কেন মেয়েটার স্বপ্ন ভেঙেছে এর জবাব নিয়ে যাবে। বাড়িতে পা রেখেই তিনি চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলেন। জেবা কানে দেওয়ার জন্য তুলো খুঁজতে লাগল।

-তুফান এসে গেছে।

চলবে