#মনের_আঙিনায়
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১৪
উচ্ছ্বাস রাতে বাড়ি ফিরেছে। রুমে গিয়ে নীলাদ্রির সাথে কোনরূপ কথা না বলে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে এলো। দাদীর সাথে বসে কতক্ষণ গল্প করল। তারপর বাবা এলো। সবাই খাবার টেবিলে বসলে তার আর নীলাদ্রির রিসিপশন কবে রাখলে ভালো হবে সে ব্যাপারে কথা উঠল। জেবা উচ্ছ্বাসের প্লেটে খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় নিচু গলায় বলল,
-দেবরজি, আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য আজকের রান্না আপনার বউ করেছে।
উচ্ছ্বাস একবার খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
-এতসব ও করেছে? তুমি ওকে কেন রান্নাঘরে যেতে দিয়েছ ভাবী।
বউয়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসা দেখে জেবার জ্ঞান হারানোর দশা।
-মা গো মা! তোমার বউ রেঁধেছে শুনে এত কষ্ট লাগছে! সারাবছর যে আমি রাঁধি আমার বেলা কষ্ট লাগে না?
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে বলল,
-তুমি তো শখ করে রাঁধো ভাবী। বাড়িতে তিনটা কাজের লোক আছে।
-তোমার বউও শখ করেই রেঁধেছে। আর সবকিছু ও রাঁধেনি। গরুর মাংস আর ইলিশ মাছ রেঁধেছে। বাকিগুলো আমি রেঁধেছি। এতটাও অমানবিক না আমি। নতুন বউকে দিয়ে সব রাঁধাব।
উচ্ছ্বাস হাসল। নীলাদ্রি কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে একপলক তাকিয়ে ভাবীকে বলল,
-ধন্যবাদ ভাবী।
-অত ধন্যবাদ দিয়ে কাজ নেই। কী কথা ছিল সেটা মনে রাখলেই হবে।
স্বামীদের খাওয়ার পরই বউদের খেতে হবে এবাড়িতে তেমন কোন নিয়ম নেই। সবাই একসাথেই খেতে বসে। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রিকে ডাকার আগেই জেবা ওকে উচ্ছ্বাসকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল। নীলাদ্রি খাওয়ার মাঝেও যে তাকে দেখছে উচ্ছ্বাস ঠিকই বুঝতে পারছে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে উচ্ছ্বাস মা বাবার ঘরে গেল। মারজিয়া আন্টি ঘটনাটা অন্যভাবে মা’র কানে তুলতে পারে। তাই উচ্ছ্বাসই মাকে জানাতে এলো ওবাড়িতে কী কী হয়েছে। নীলাদ্রি ঘরে চলে এসেছে। উচ্ছ্বাসের আসার অপেক্ষা করছে। লোকটা কি তার উপর রাগ করে ঘরেও থাকতে আসবে না? সে কীভাবে এই লোকের রাগ ভাঙাবে? জেবা ভাবীর বলা কথাটা মনে পড়ে যেতেই নীলাদ্রি দু’পাশে সজোরে মাথা নাড়াল। না বাবা, ওসব তাকে দিয়ে হবে না। তার থেকে ভালো রাগ করে থাকুক। উচ্ছ্বাস ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। শব্দ পেয়ে নীলাদ্রি সেদিকে তাকাল। কিন্তু উচ্ছ্বাস তার দিকে দেখল না। এতে নীলাদ্রি একটু যেন কষ্ট পেলো। উচ্ছ্বাস শুয়ে পড়েছে। নীলাদ্রি বসে আছে। মানুষটার এরূপ আচরণ সত্যিই তাকে কষ্ট দিচ্ছে।
-লাইট অফ করো নীলাদ্রি।
মানুষটা প্রয়োজনে কথা বলছে। তবুও তো বলেছে। নীলাদ্রির এতেই খুশি লাগল। সে আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল। নীলাদ্রি মনে মনে ভাবছে প্রতিদিন তো লোকটা তাকে কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমায়। আজ রেগে আছে বলে নিশ্চয় এমনটা করবে না। নীলাদ্রির ভাবনা ভুল প্রমাণ করে তখনই উচ্ছ্বাস দু’হাতে ওকে কাছে টেনে নিল। নীলাদ্রি আজ জমে গেল না। উল্টো সে যেন স্বস্তি পেলো।
-আমার রাগ ভাঙানোর জন্য নাকি তুমি আজ রান্না করেছ?
ভাবী তাহলে বলেই দিয়েছে। নীলাদ্রি বলতে না করেছিল।
-আমার রাগ ভাঙানোর জন্য তোমাকে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করে রান্না করতে হবে না। আবার যদি আমি কখনও রেগে যাই তাহলে একবার জড়িয়ে ধরো। তাহলেই হবে।
লজ্জা পেয়ে নীলাদ্রির কান গরম হয়ে গেল। ভাবীও তাকে এই কথাই বলেছিল।
——
দেখতে দেখতে রিসিপশনের দিন চলে এলো। রিসিপশন বাড়িতেই করা হয়েছে। এত এত মেহমানরা আসছে। নীলাদ্রি বেশি মানুষের সামনে যেতে পারে না৷ আজ তো সবাই তাকেই দেখতে এসেছে। অস্বস্তি, ভয়, নার্ভাসনেসে বেচারির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। উচ্ছ্বাস অবশ্য নীলাদ্রির খেয়াল রাখছে। সে ভাবীকে অনুরোধ করে বলেছে এক মিনিটের জন্যও যেন নীলাদ্রিকে একা না ছাড়ে। জেবাও তাই দেবরের অনুরোধ রেখে নীলাদ্রির সাথে চিপকে আছে। ভাবী সাথে আছে বলে নীলাদ্রি এখনও জ্ঞান হারায়নি। নীলাদ্রিকে সাজাতে বাড়িতে পার্লারের মেয়েরা এসেছে। উচ্ছ্বাস ব্যস্ত থাকলেও এক ফাঁকে এসে ভাবীকে বলে গেছে,
-ভাবী ওর চুলে কিছু কোরো না। আমার বউয়ের চুল এমনিতেই সুন্দর। শুধু শুধু হেয়ার স্টাইল করে সুন্দর চুলগুলোর সর্বনাশ করার দরকার নেই।
জেবা গালে হাত দিয়ে বলল,
-বাবা গো বাবা! দেবরজি, তোমার আর কত নতুন রুপ দেখব বলো তো! আমি তো রীতিমতো কানা হওয়ার পথে।
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে নীলাদ্রি লজ্জায় মিইয়ে যায়। লোকটা কেন তাকে এত লজ্জায় ফেলে। তাকে কীভাবে সাজাবে এটা কি লোকটাকে বলে দিতে হবে?
নীলাদ্রির বাবা মা বোন এসেছে। দুলাভাইকে দেখে নীলাদ্রি সবথেকে বেশি অবাক হলো। দুলাভাই কবে এসেছে! দুলাভাই নীলাদ্রির কাছে এসে বলল,
-কী শালিকা, দিনকাল কেমন কাটছে?
নীলাদ্রি তার বিস্ময় না লুকিয়ে বলল,
-আপনি কবে এসেছেন দুলাভাই?
দুলাভাই হেসে বলল,
-চলে এলাম। তিনি কোথায়? আমি তার হবু বউকে বিয়ে করে নিয়েছি দেখে সে আমার শালিকে বিয়ে করে শোধ নিলো নাকি!
নীলা কনুই দিয়ে স্বামীর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল,
-পুরোনো কথা এখন কেন তুলছো?
-ও বাবা, তুলবো না! যার জন্য দিনেদুপুরে তোমার মার খেতে পারছি তাকে একটা ধন্যবাদ না দিলে চলে?
নীলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-ঢং কোরো না তো।
নীলাদ্রির পরিবারকে দেখার পর মিসেস শর্মিলার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। এই বিয়ে তিনি আগেই মেনে নিতে চাননি। এখন তো কিছুতেই মানবে না৷ ওই পরিবারের এক মেয়ে একবার তাদের সম্মান নিয়ে খেলেছে। তাই ওই পরিবারের আরেকটা মেয়েকে কিছুতেই তিনি নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন না। মিসেস শর্মিলা নীলাদ্রির বাড়ির মানুষদের থেকে দূরে দূরে থাকলেন। মেহমানরা যাবার আগেই তিনি রুমে ফিরে এলেন। বাবা মা যাবার সময় আজও নীলাদ্রি কেঁদেছে। নীলা ধমক দিয়ে বলেছে,
-বিয়ে তো কবেই হয়ে গেছে। এখনও কেন কাঁদছিস?
সেদিন বাসরঘর সাজানো না হলেও আজ সাজানো হয়েছে। জেবা নীলাদ্রিকে ঘরে নিয়ে এলো। ঘরের ভেতর পা রেখেই বাহারি ফুলের ম-ম ঘ্রাণে জেবা সহ নীলাদ্রিও মাথা ঘুরিয়ে উঠল। হঠাৎ করে অজানা ভয়ে নীলাদ্রির হাত-পা কাঁপতে লাগল। সারাদিনের ছোটাছুটিতে জেবাও ক্লান্ত।
-আমি ভাই আর সময় নষ্ট করব না। তুমি বসো। আমি গিয়ে তোমার পতিদেবকে পাঠাচ্ছি।
নীলাদ্রির ভাবীর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে করল, না ভাবী। উনাকে পাঠিয়ো না।
উচ্ছ্বাস বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে রুমেই ফিরছিল। এর মাঝে পকেটে ফোন বেজে উঠলে চেনা নম্বরটা দেখে হেসে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে হাসোজ্জল গলা শোনা গেল।
-উচ্ছ্বাস ভাই!
-হ্যাঁ ভাই।
-বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে ভাই?
উচ্ছ্বাস হাসল। এই ফারদিন ছেলেটাকে দেখে গম্ভীর মনে হলেও এই ছেলে ভেতরে ভেতরে শয়তানের চূড়ান্ত।
-আমার বিবাহিত জীবন স্বপ্নের থেকেও সুন্দর কাটছে। মালদ্বীপে তোমার হানিমুন কেমন কাটছে?
ফারদিন এতক্ষণ হাসি হাসি গলায় কথা বলেও এবার যেন একটু গম্ভীর হলো।
-বউটা অবুঝ ভাই। আমাকে ছাড়া বাঁচবে না বলে কত কান্নাকাটি করল। একটা বিয়ের পর আবার বাবা মা’র জন্য কাঁদে।জেনেশুনেই তো পালিয়েছে ভাই। তারপরও সব দোষ এখন আমাকে দেয়।
নীলা যেদিন ফেসবুকে নীলাদ্রির এনগেজমেন্টের ছবি পোস্ট করেছিল সেদিনই উচ্ছ্বাস ফারদিনকে খুঁজে বের করেছে। কথায় কথায় জানতে পেরেছে ফারদিন বিয়েটা করতে চায় না। ওর বাবা জোর করে এনগেজমেন্ট করিয়েছে। সে অবশ্য পরিবারকে বোঝানোর সবরকম চেষ্টা করছে। পরিবার না মানলে পালিয়ে যাবে। সব শুনে উচ্ছ্বাস ফারদিনকে রিকোয়েস্ট করেছে ও যেন তাকে কিছু দিন সময় দেয়। উচ্ছ্বাস দেশে এসে সব ঠিক করে দিবে। ফারদিন উচ্ছ্বাসের কথা শুনেছে। বিয়ের দিনের আগে কোনভাবেই উচ্ছ্বাস আসতে পারত না। তাই বেচারা দাঁতে দাঁত চেপে বিয়ের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে।
-আমি তোমার বাবার সাথে দেখা করেছি ফারদিন। আঙ্কেল প্রথমে বুঝতে চাননি। কিন্তু একটু বোঝানোর পরে অবশ্য বুঝেছে। তোমরা ফিরে এসো। আঙ্কেলের কাছে ক্ষমা চাইলেই উনি তোমাদের ক্ষমা করে দিবে।
ফারদিনের সাথে কথা বলা শেষে উচ্ছ্বাস ঘরে এসেছে। উচ্ছ্বাসকে দেখেই নীলাদ্রি ঘামতে শুরু করেছে। লোকটা তার স্বামী। তাদের বিয়ে জোরজবরদস্তি হয়নি। তারপরও কেন সে এই লোকের সাথে সহজ হতে পারছে না?
-তোমার গরম লাগছে নীলাদ্রি?
হঠাৎ উচ্ছ্বাসের ডাকে নীলাদ্রি কেঁপে উঠল। উচ্ছ্বাস এসি অন করে দিয়ে বলল,
-আর গরম লাগবে না।
নীলাদ্রি কিছুই বলতে পারছে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধরলে নীলাদ্রি কেমন যেন মিইয়ে গেল। উচ্ছ্বাস তা লক্ষ্য করেও নীলাদ্রিকে এনে বিছানায় বসালো।
-আমরা একসাথে আছি বেশ কিছু দিন হয়েছে। অথচ তোমার কাঁপা-কাঁপি দেখে মনে হচ্ছে আজই আমাদের ফার্স্ট নাইট।
নীলাদ্রি চোখ তুলে তাকালে উচ্ছ্বাস হাসল। নীলাদ্রির কাঁপা-কাঁপি আরও বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বাস টুপ করে গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। এই এক চুমুতেই নীলাদ্রির অবস্থা যায় যায়। উচ্ছ্বাস ওকে দেখে শব্দ করে হেসে উঠল। মনে মনে ভাবল, তার কপালে এটা কী বউ জুটেছে! উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির আরেকটু কাছে চলে এলো। আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাইল। ঠিক তখনই নীলাদ্রি ঝট করে দাঁড়িয়ে উঠে কম্পিত গলায় বলল,
-আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি জানি আমি অন্যায় করছি। কিন্তু এই সম্পর্কে সহজ হতে আমার একটু সময় লাগবে।
উচ্ছ্বাস জানত। সে-ও নীলাদ্রিকে সময় দিতে রাজি আছে। তারপরও ব্যথিত মুখে বলল,
-আরও সময় লাগবে!
নীলাদ্রি অপরাধীদের মতো মাথা নিচু করে ফেলল। উচ্ছ্বাস নীলাদ্রির সামনে এসে জিজ্ঞেস করল,
-আমাকে মেনে নিতে আর কতদিন লাগবে তোমার?
নীলাদ্রি উত্তর দিতে পারল না। সে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। উচ্ছ্বাস ফোঁস করে দম ফেলে বলল,
-তুমি কি আমাকে একটুও পছন্দ করো না নীলাদ্রি?
নীলাদ্রি একপলক তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল।
-আমাকে অপছন্দ করার কারণ কী?
নীলাদ্রি ঢোঁক গিলে পিছিয়ে গিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল,
-অপছন্দ করি না।
উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হাসল। নীলাদ্রির আরেকটু কাছে এসে দাঁড়াল।
-তার মানে পছন্দ করো?
নীলাদ্রি এতটাই ঘাবড়ে গেছে সে হ্যাঁ, না কিছুই বলতে পারল না।
-তুমি আমাকে পছন্দ করো। তারপরও আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছো! এটা কেমন পছন্দ করা জানতে পারি?
নীলাদ্রি কথা বলতে পারছে না। উচ্ছ্বাসও আর তার বেচারি বউকে জ্বালাল না। বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল,
-ফুলের উপর শোয়া যাবে না। বিছানাটা ঝেড়ে নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নীলাদ্রি ভাবল উচ্ছ্বাস হয়তো তার উপর রাগ করেছে। মাথা নিচু রেখে ক্ষীণ গলায় সে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
উচ্ছ্বাস যেতে নিয়েই ফিরে তাকাল।
-তুমি আমার রাগের পরোয়া করো?
নীলাদ্রি থুতনি বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে উপর-নীচ সামান্য মাথা নাড়ল। উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
-আমি রাগব না যদি তুমি আমাকে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে দাও।
নীলাদ্রি মেনে নিল। এটা আর নতুন কী? প্রতিদিনই তো জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।
চলবে