#মনের_পাশে
#নূপুর_ইসলাম
#শেষ_পর্ব
ইশিতা বাসায় ফিরেই পাই টু পাই আজিজুল হক কে বললো। আঙুলের কথাও বললো। নেকুঢেকু হলেও মনের দিক থেকে ভালো। লোভ নেই বাবা। তা না হলে আজকে মনে হয় আঙুল আর একটাও সোজা থাকতো না। সুন্দর মতো বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে।
আজিজুল হক অবাক হয়ে শুনলেন। তার ছেলে এমন কাজ করেছে, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট’ই হলো।
ইশিতা অবশ্য এতো কষ্ট টষ্টের ধারের কাছে গেলো না। কেন যাবে? কাউকে তুলে নেওয়া। ছোট কথা নাকি? তাই সোজা বললো, “এর যদি বিচার না করেন আঙ্কেল আপনার সাথে ফ্রেন্ডশিপ শেষ। ”
— একজনের অন্যায়ের শাস্তি তো আরেক জনকে দেওয়া ঠিক না।
— পুত্রটা কার? যার, তাকে দেওয়াই যায়। গাছের বরই যদি টক হয়। বরই ফেলেতো লাভ নেই। ফেলতে হবে গাছ। আর তাছাড়া এই খিচুড়ির মূল হোতা তো আপনি। তাই শাস্তির ভাগও আপনার। আর আমি এটাই বুঝিনা। হাতের কাছে এমন রসগোল্লা রেখে, আমাকে প্রস্তাব দিয়েছেন কেন?
— কোন রসগোল্লা?
— দিসা রসগোল্লা। আপনাদের সাথে তো এমন রসগোল্লাই যায়। আমার মাথা খাচ্ছেন কেন?
আজিজুল হক হাসলেন! হেসে বললেন, — আমার ছেলের জন্য হয়তো রসগোল্লা চাই না তাই।
— না চাইলে নেই। যাদের মাথা তাদের ব্যথা। এতে আমার মাথার কাজ কি? আমার ব্যথাতো আমি বিচার চাই। যদি না করেন। শেষ, একদম শেষ। বলে রাখলাম।
আজিজুল হক চোখে মুখে হতাশের চিহ্ন নিয়ে বসে রইলেন। তিনি তার আদরের পুত্রের কি বিচার করবেন ভেবে পেলেন না। তাছাড়া তুলে নিলো কেন? নিয়েছে নিয়েছে, বলদের বাচ্চা বিয়ে টিয়ে করে ফেলতি। তা না, আবার ছেড়েও দিয়েছে? অযথা বদনাম ঘাড়ে নিয়ে লাভ আছে। এখন সে করবেই টা কি?
ইশিতা এতো কিছু বুঝলে তো। তার হুমকি ধমকি এক চোট চললো। সেই চলা ইশিতার ভাইও বসে বসে দেখলো। দেখে হাই তুলে বললো — লক্ষণ ভালো না।
ইশিতা ভ্রু কুঁচকে বললো, — কিসের লক্ষণ?
— তুলে নিয়ে সসম্মানে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া।
— তো কি হয়েছে?
ইশিতার বড় ভাই উত্তর দিলো না। জীবনে বড় বড় মোড় গুলো ঝট করে ঘুরে। ম্যাজিকের মতো। তার কেন জানি মনে হলো, তার এই ছোট্ট বোনটার জীবনের মোড় ওর নিজের অজান্তেই ঘুরে গেছে।
ইশিতা মাথা ঘামালো না। কিছু কিছু জিনিস যত তাড়াতাড়ি জীবন থেকে ছু’মন্তর করা যায় ততোই ভালো। তাই সেই দিনের কাহিনীও ছু’মন্তর করে ফেললো। টাকা, আহারে টাকা। আজ যদি তার কাছে টাকা থাকতো, তা না হলে দেখতিরে ব্যাটা, ইশিতা কি চিজ। ষাঁড়, গন্ডার দিয়ে তুলে নেওয়া। তোকে তো ডাইনোসের পায়ে পিষে পিষে ভর্তা করতো। আজ নেই বলে বেঁচে গেলি।
ইশিতা সব ভুলে টুলে আগের মতোই চলতে লাগলো। চলতে লাগলো তার লেখাপড়া আর স্বপ্নের রেল গাড়ি ও। তার সাথে আরও চলতে লাগলো তার মায়ের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। গরীব ঘরের মেয়ে। এতো পড়ালেখার কোন দরকার ? বয়স বেশি হলে নেবে কে?
না নিলে না নিক। সংসার করার জন্য তো সে মরে যাচ্ছে না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াও। তারপরে আরেক জনের ঘাড় মটকাও।
সেই মটকা ফটকা কাহিনীর মাঝে এই আব্বার হাম্বার সাথে আবার দেখা হলো। কিভাবে হলো কে জানে? এই রাস্তায় তার কি কাজ, সেটাই ইশিতা বুঝতে পারলো না।
সে তো ভাই আপন মনে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল। ফেরার সময় তার মা ফোন করে কিছু বাজারের লিস্ট দিলো। নতুন না, ভাইয়া ব্যস্ত থাকে। মাসিক বাজার ছাড়া বাকি টুকটুাক মা তাকে দিয়েই করায়। সে দিনও করে দুহাতে বাজার নিয়ে ফিরছিল। পেছন থেকে বিকট শব্দে দিলো এক হর্ন। তার তো আত্মা উড়ে যাওয়ার জোগাড়। বাজার দিলো ঠাস করে ছেড়ে। ডিম ছিল শেষ, ডালের ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে গেলো। সে আগুন চোখে তাকালো।
তার আগুনের ধার ধারে কে? গাড়ি নিজ গতিতে পাশ দিয়ে গেলো। গাড়ির গ্লাস নামানো। হাম্বাকে ঠিক দেখলো।সে আছে আগের মতোই। কাপড় চোপড়ের ভালো কোন বালাই নেই, মাথা কাউয়ার বাসা। তার তো এটাই মাথায় আসে না। টাকা পয়সা করে কি? দেখা যায় গরু ছাগলের মতো। গল্প উপন্যাসে দেখে, বাবারে বাবা, বিজনেস ম্যানদের ভাবই আলাদা । তারা বাথরুমেও যায় স্যুট ব্যুট পরে। আর এদিকে রিয়েলিটি দেখো। মনে হচ্ছে হাই ভোন্টেজের গাঞ্জাখোর।
সে রাগে গজগজ করতে করতেই বাজার গোছালো। ছয়শো টাকার বাজার। তার মধ্যে ডিম আর ডাল শেষ। এই টাকা ওয়ালা বড়লোকদের কপালে লাথি। রাস্তার সাইডের মানুষদের তো এরা মানুষ’ই মনে করে না। হাহ্!
আরেকদিন দেখা হলো রাতে। তার এক বন্ধুর বিয়ে। ঢাকার সব অনুষ্ঠান হয়’ই রাতে। ফিরতে ফিরতে তাই কিছুটা রাত হলো। রিকশায় উঠবে তখনি সাইড দিয়ে শা করে এক গাড়ি গেলো। প্রথমে সে বুঝেনি। খেয়াল করতেই দেখলো, আরে এটাতো হাম্বার গাড়ি।
হাম্বার গাড়ি হোক আর টাম্বার। তার সমস্যা নেই। তবে বিকেলে হয়েছে বৃষ্টি। রাস্তায় দুনিয়ার পানি কাদা। তাকে পুরো মাখিয়ে দিয়ে গেলো। সে তো হতম্বভ। হতম্ভব হয়েই গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। এগুলো কোইন্সিডেন্স নাকি ইচ্ছাকৃত তার মাথায় আসছে না।
তবে যাই থাক, তার সাথে পুরো সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে দেখা হলো অনেকটা দিন পরে। তখন সে সবে মাত্র ফাইনাল ইয়ারে। আঙ্কেলের অসুস্থের খবর শুনলো। যতোই উপরে রাগঢাক দেখাক। এই মানুষটার সাথে অদৃশ্য এক বাঁধনে সে আটকে গেছে। শুনতেই দৌড়ে গেলো। আঙ্কেল কে দেখে বের হবে, তখন দেখলো গেইটের সামনে এই হাম্বা দাঁড়িয়ে। হাতে সিগারেট। তবে ঠোঁটে রাখছে না কেন কে জানে? এমন ভাব, খুব চেষ্টায় আছে। তবে সিগারেটের অনুমতি পাচ্ছে না বলে ঠোঁটে পারছে না রাখতে। আর পারছে না বলেই চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।
ইশিতা ফিরেও দেখলো না। সে মুখ বাঁকিয়ে বেরুতে যাবে দারোয়ান গেইটই খুললো না। সে বিরক্ত মুখে বললো, — কি সমস্যা?
দারোয়ান উত্তর দিলো না। তবে একবার এই হাম্বার দিকে তাকালো। ইশিতা ঠিক বুঝলো। হাম্বা আবার হাম্বা গিরি শুরু করেছে। কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে আল্লাহ’ই জানে। জীবনকে তেজপাতা করে দিচ্ছে। সে বিরক্ত মুখে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু নাচিয়ে আবার বললো — সমস্যা কি?
জাওয়াদও তার মতো বললো, — কোন সমস্যা নেই।
— পায়ে পারা দিয়ে দিয়ে ঝামেলা বাঁধানের চেষ্টা করছেন কেন? বয়স তো কম হলো না। এই সব ফাজলামি বন্ধ করেন। বিয়ে টিয়ে করে একটু মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেন। অন্তত আঙ্কেলের কথা ভেবে না হয় করেন।
— ওকে।
— কিসের ওকে।
ইশিতার কথার জাওয়াদ উত্তর দিলো না। তবে দারোয়ানকে গেইট খোলার ইশারা দিলো।
ইশিতা মুখ বাঁকিয়ে চলে এলো। ঢং দেখে আর বাঁচে না। ভালোয় ভালোয় খুলেছে। তা না হলে আজকে এই লোকের খবর ছিল। সব সময় মন শয়তানকি। একবার তুলে নেওয়া, আবার আটকে ফেলা। কেনা গোলাম আমি। ভাগ্য ভালো! অল্পতে সুমতি হয়েছে। তা না হলে কাউয়ার বাসা আজকে ধু ধু মরুভূমি হতো।
ইশিতা তো জানে না কি করে এসেছে সে। কেননা তাকে পুরো ঝটকা পটকা দিয়ে, সেই বাড়ি থেকে তার পরের দিনই ঘটা করে বিয়ের প্রস্তাব এলো। প্রস্তাব নিয়ে এলো স্বয়ং আজিজুল আঙ্কেল। দুনিয়া দারি নিয়ে। তিনি অসুস্থ ছিলেন। সেই অসুস্থ কোথায় গেলেন কে জানে। তাকে দেখে লাগছে কৈশোরের ছেলেপেলেদের মতো উজ্জ্বল। ইশিতা হা হয়ে গেলো। হা হয়েই বললো, — আপনি না অসুস্থ?
— হ্যাঁ মা, তবে খুশিতে অসুস্থতা কিছুটা ভাটা পড়েছে।
— কিসের খুশি? আমি আপনাকে অনেক আগেই ক্লিয়ার করে নিষেধ করেছিলাম আঙ্কেল।
আজিজুল হক হাসলেন। হেসে বললেন, — সেটা তো আমাকে করেছিলে। এবার প্রস্তাব আমি রাখিনি ইশুমনি। শুধু ডাক পিয়ন হয়ে এসেছি।
ইশিতা চোখ, মুখ, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তার মা খুশিতে টইটুম্বুর। সোনার হরিণ সেঁধে এসেছে। এর চেয়ে আর খুশি কি হতে পারে। ইশিতার ভাই ও হাসলেন। তার হাসিই বলে দিলো। বলেছিলাম না লক্ষণ ভালো না।
লক্ষণ ভালো হোক খারাপ। ইশিতা এবার নিষেধ করার সুযোগই পেলো না। ইশিতার ভাই ইশিতার আশে পাশেও ঘেষলো না। ইশিতা অবশ্য কয়েকবার মায়ের আশে পাশে ঘুরঘুর করলো। ইশিতার মা দেখেও দেখনো না। কেননা সে ভালো করেই জানে। এই সুযোগে এই মেয়ের গলায় ঘন্টা না বাঁধলে, আর সুযোগ পাবেন কি না সন্দেহ। যত দিন যাচ্ছে এই মেয়ের ততো পেখম হচ্ছে। আর এমন সম্বন্ধ বার বার আসে নাকি । তাই হাত চেপে কোমল স্বরে বললেন, — কোন ঝামেলা করিস না মা। তোর বিয়ের ইচ্ছে না থাক, ভাইয়ের দিকে তাকা। ওর বয়স হচ্ছে না। তোকে কোন গতি না করে ও সংসার করবে?
ব্যস, ইশিতা আটকে গেলো। বাবার পরে আছে আর তার কে? তাই বিনা অনাড়ম্বরেই সেই দিন রাতে তাদের বিয়ে হলো। আজিজুল আঙ্কেল হোক আর তা মা কেউই সুযোগ ছাড়লেন না। ইশিতা রাগে দুঃখে চুপচাপ বসে রইল। তার স্বপ্ন! সে জানতো হয়তো তার স্বপ্ন পূরণ হতো না। তবুও বিয়ে তো সে এখন করতে চায়নি। তাও আবার এই হাম্বাকে? সবাই আঙুল তুলে বলবে, — টাকা দেখে গলায় ঝুলে গেছে। এই যে সে এতো ভালো ভালো রেজান্ট করছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কতো চেষ্টা করছে। কেউ কি জানে? ভার্সিটি থেকে ক্লান্ত শরীরে বসে বসে টিউশনি করতে কেমন লাগে। কেমন লাগে সেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার অর্ধেক রাত পর্যন্ত বসে বসে অ্যাসাইনমেন্ট করতে। কেউ জানে না। জানবেও না। সবাই দেখে টাকা। যার টাকা বেশি। তার সাইড ভারীও বেশি। তাই সবাই দেখবে গরীর ঘরের মেয়ে টাকা দেখে ঝুলে পড়েছে। টাকা, আহারে টাকা। যার টাকা নেই, তার কিছুই নেই।
সেই দিন রাতে বিয়ে হলেও তাকে নিয়ে যাওয়া হলো না। কেন নিয়ে যাওয়া হলো না ইশিতা জানে না। জানার ইচ্ছেও নেই। তবে তারা যাওয়ার আগে দুজনকে এক রুমে কিছুক্ষণের জন্য বসানো হলো। ইশিতা কঠিন মুখ করে বসে রইল। আব্বার হাম্বাও তার মতো বসে রইল। আজকে অবশ্য লায়েক কাপড় আছে গায়ে। পাঞ্জাবি পরেছে, ঝাঁকড়া কাউয়ার বাসা আজকে মোটামুটি পরিপাটি। পরিপাটি হলেও স্বভাবে তেমন পরির্বতন দেখা গেলো না। অবশ্য হাতের সিগারেট আজকে ঠোঁটে গেছে। সেই সিগারেট’ই বসে বসে পরপর দু,তিনটা খেলো। এই অখাদ্য যে কেউ এতো আয়েশ করে খেতে পারে ইশিতা এই লোককে না দেখলে জানতো’ই না। দরজা জানালা বন্ধ। পুরো ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে পুড়িয়ে সে নিজের মতোই চলে গেলো।
সেই যে গেলো, নিজে থেকে আর খোঁজ খবর করেনি। ইশিতাও করেনি। কোন দরকার! তবে হঠাৎ হঠাৎ কোইন্সিডেন্সের ঝামেলা বন্ধ হলো। যাক বাবা, বিয়ে করে অন্তত একটা ফয়দা হয়েছে। আর তুলে নিয়ে না যাওয়ার কারণটাও জানতে পারলো। তারা চাইছে ইশিতার যতোটুকু পড়ার ইচ্ছা পড়ুক। বাকি সব কিছু পরেও করা যাবে। তাদের কোন তাড়া নেই।
ইশিতার তাতেও কোন বিকার হয়নি। সে এমনিতেও পড়তো। কারো ঘাড়ের বোঝা সে হবে না। তাদের টাকা আছে ইশিতার কি? ইশিতার থাকবে নিজের টাকা। তাই তার জীবন আগের গতিতেই চলছে। সে ভার্সিটি টিউশনি আগের মতোই করছে। তার জীবনে কেউ কোন কারণে হস্তক্ষেপ করেনি। তবে আজিজুল আঙ্কেলের সাথে তার মিষ্টি একটা সম্পর্ক ছিল। ইশিতা সেটার ইতি টেনেছে। অনেক আগেই দরকার ছিল। তা না হলে আজ এমন দম বন্ধের একটা সম্পর্ক তৈরিই হতো না।
আজিজুল আঙ্কেল অবশ্য প্রতিদিনই ফোন করছেন। খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ইশিতা শুধু হু হা তে কথা শেষ করছে। কেননা সবার চোখে এই সম্পর্ক সোনার হরিণ হলেও তার কাছে আস্ত এক দম বন্ধের কারণ।
তার দম বন্ধ হোক আর যাই হোক। উপরওয়ালার ইচ্ছে অন্য কিছু। তাই তো এক সেকেন্ডে তার সাজানো গোছানো জীবন তছনছ হয়ে গেলো। ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হলো। গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট। ইশিতার তখন দিশেহারা অবস্থা। মাকে সামলাবে, হসপিটালে দৌড়াবে, নাকি টাকা জোগাড় করবে। এক সেকেন্ডের ফুসরত নেই, নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। এই যে তার ভাইয়া আইসিইউতে পড়ে আছে। তার মনে হচ্ছে কেউ ধারালো চাকু দিয়ে ভেতর টা কেটে টুকরো টুকরো করছে। সেই ব্যথা বোঝারও সময় টুকুও নেই।
তার এই বিপদের সময় সে এসে হাজির হলো। জানতো আসবে। টাকা আছে! টাকা তাদের হাতের ময়লা। তবে যেটা সে আশা করেনি সেটাও এই লোক করলো। এসে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো। ইচ্ছে করলেই টাকা দিয়ে দায় সারতে পারতো, লোক দিয়ে সব করাতে পারতো। তবে সেই রকম কিছুই করলো না। ইশিতার যায়গায় সুন্দর মতো সে দাঁড়িয়ে গেলো। তার ভাগের কাজটুকু সব দৌড়ে নিজে করলো। মাকে সামলালো। কোন সামান্য একটা কারণেও কেউ আর ইশিতাকে বিরক্ত করলো না। ইশিতা অনেকদিন পরে নিশ্চিন্তে নির্ভারে চুপচাপ বসে রইল। আঙ্কেল পরম আদরে মাথায় হাত রাখলো। ইশিতা ঝাপটে তার বুকে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে উঠলো। যেমনটা কাঁদতো তার বাবার বুকে মাথা রেখে।
ভাইয়া কিছুটা সুস্থ হলো সপ্তাহ খানেক পরে। মাকে বাসায় রেখেছে, ইশিতা হসপিটালেই আছে। তার সাথে আছে জাওয়াদ। কাজ ব্যতিত বাকি টুকু সময় এখানেই আছে। মেয়েরা আসলেই বোঝা। তা না হলে বসে বসে কাঁদা ছাড়া কি করলো সে। এক ঋণ শোধ করতে করতে অর্ধেক জীবন শেষ। এখন যে হলো, এগুলো শোধ করতে করতে বাকি জীবন শেষ।
সে ক্লান্ত ভাবেই বাইরে এসে বসলো। তাকে অবাক করে প্রথম বার জাওয়াদও তার পাশে বসলো। দুনিয়ার চেয়ার খালি। তবে সে বসলো, একেবারে ঠিক ইশিতার পাশের চেয়ারে। গায়ের সাথে গা লাগেনি তবে জাওয়াদের গায়ের সুবাস ইশিতাকে ঠিক ছুঁয়ে গেলো। ছুঁতেই ইশিতা শক্ত হয়ে বসে রইল।
জাওয়াদ অবশ্য স্বাভাবিক! নিজের মতো সিটে গা এলিয়ে বললো, — সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।
ইশিতা শক্ত ভাবেই বললো, — ইচ্ছে করলে খান, এখানে তো সম্ভব না। তাই অন্য কোথাও যান। আমাকে শোনানোর কি হলো?
— বাইরে গেলে তো ঠোঁটে রাখতে পারি না।
— কেন? মোমের তৈরি ঠোঁট আপনার। বাইরে গেলে রোদের তাপে গলে যাবে।
জাওয়াদ হাসলো! তবে আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপই বসে রইল। জাওয়াদ কেন রইল ইশিতা জানে না। তবে ইশিতা এতো এতো ঋণের বোঝায় লজ্জায় এতোটুকু হয়ে রইল। যেমন হয়েছিল সেই দিন, যখন বাড়ি ভাড়ার অনেক দিনের পাওনা টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিল।
জাওয়াদ কি বুঝলো! হয়তো। তাই সোজা বসে শান্ত ভাবে বললো, — সম্পর্ক কখনো বোঝা হয় না ইশিতা। না হয় মেয়েরা। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাক আর না থাক। পাশে থাকার ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতাকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা কম পুরুষের’ই আছে।
তাই তোমার মাও যে থাকেনি তা কিন্তু না। শুধু টাকা দিয়ে পাশে দাঁড়ালেই দাঁড়ানো হয় না ইশিতা। আমি মানছি টাকা দরকার, অবশ্যই দরকার। তবে টাকা যে কেউই দিতে পারে। এই যে আমি যদি না দিতাম। ধরো আমাকে চিনোই না। তুমি কি বসে থাকতে। না, যে কোন উপায়ে ঠিক জোগাড় করে ফেলতে। হয়তো কষ্ট হতো। তবে ঠিক হয়ে যেতো।
আবার এক সময় শোধও করে ফেলতে। তবে মনের যে একটা শান্তি, সব বিপদ পাড়ি দেওয়ার শক্ত মনোবলের শক্তি এটা একমাত্র নিজের মানুষেরাই দিতে পারে। তোমার মাও সেটা দিয়েছিল। দিয়েছিল বলেই তোমার বাবা এতো বিপদের মাঝেও টিকে থেকেছে। তোমার ভাইকে দাঁড় করিয়েছে। তোমাকে করিয়েছি।
আমার বাবাকে দেখো। সব হারিয়েও দিব্যি বেঁচে আছে। তার যে অ্যাক্সিডেন্টে হয়েছিল সেই অ্যাক্সিডেন্টে সে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে। তবুও ভালো আছে। কেন জানো? কারণ তার ভালো থাকার শক্তি তার সন্তান আছে।
টাকার প্রয়োজন কম থাক বেশি। সেটা এক উপায়ে না এক উপায়ে মেটানো’ই যায়। তবে ভালোবাসার প্রয়োজন তুমি হাজার চেষ্টা করলেও মেটাতে পারবে না। সেটার জন্য ভালোবাসা দরকার, ভালোবাসার মানুষদের দরকার। টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি বলে লজ্জায় ভেঙে চুরে যাচ্ছো। অথচ আমি এমন এক জায়গায় বড় হয়েছি সেখানে আমার কোন অস্তিত্ব’ই নেই। আমার নিজের বলে কিছুই নেই। তাহলে চিন্তা করো আমি বেঁচে আছি কি করে?
ইশিতা ঝট করে চোখ তুলে তাকালো। জাওয়াদ সেই চোখে চোখ রেখেই আবার বললো, — আমার কিচ্ছু নেই ইশিতা। আছে শুধু মায়ার এক বাঁধন। আমার বাবা! এই বাঁধনের কাছে সব টাকা নস্যি। এই পৃথিবীতে সবার কাছে টাকা নেই ইশিতা। তাই সাহায্য নিলে কেউ ছোট হয় না। অথচ তুমি টাকার হিসেব ছাড়া আর কোন হিসেব’ই বুঝো না। তোমার ধারণা, টাকা আছে দিয়েছে। এই আর কি? তবে টাকা থাকলেই কি সবাই দেয়? না দেয় না। দেওয়ার জন্য মন থাকতে হয়, মনের টান থাকতে হয়। আর মনের টান আসে সম্পর্কে।
সম্পর্কের জন্যই দুনিয়া হয়। তোমার মা টাকা দিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ায়নি তবে মনের পাশে ঠিক দাঁড়িয়েছে। এই দাঁড়ানোর জন্য দুনিয়ার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। কোন টাকার প্রয়োজন নেই। তোমার ধারণা লেখা পড়া শিখে, বড় চাকরি করে টাকা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোই দাঁড়ানো। আজ টাকা আমি দিয়েছি তাই তুমি বোঝা। ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে পারোনি। তবে এই যে দিন রাত এক করে ভাইয়ের পাশে আছো, সেবা করছো, ভাইকে সাহস দিচ্ছো, সব ঠিক হওয়ার আশ্বাস দিচ্ছো, মাকে আগলে রাখছো, এটাও পাশে দাঁড়ানো। মনের পাশে দাঁড়ানো। এই দাঁড়ানো কখনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না।
আমি জানি আমার সব টাকা তুমি শোধ করেই দেবে। যে তেজ তোমার। তবে এই যে বিপদে মনের পাশে দাঁড়ালাম। আমার বাবা স্নেহের পাশে দাঁড়ালো। এগুলো শোধ কি দিয়ে করবেন হাম্বার হাম্বাওয়ালী?
ইশিতা যেমন ঝট করে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো। আবার ঝট করেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার চোখ লাল। যে কোন সময় বৃষ্টি ঝরে পড়বে।
ইশিতা নিলেও জাওয়াদ চোখ ফেরালো না। ইশিতা কান্না ফেরাচ্ছে। ফেরাতে গিয়ে মুখ নাক লাল হচ্ছে। জাওয়াদের দেখতে ভালো লাগছে। তাই সে আগের মতোই চোখ রেখে বললো, — টাকা যদি শোধ হয়, আমার বাকি সব কিছুর’ই শোধবোধ চাই। দেখতে যেমন তেমন যাই হই, হিসেবে আমি খুব পাক্কা।
ইশিতার দৃষ্টি নিচে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললো — আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?
জাওয়াদ আবার আয়েশ করে বসলো। মুখ ফিরিয়ে দৃষ্টি রাখলো সামনে। রেখেই বললো, — তা তো জানি না। আমার মা চলে যাওয়ার পরে আমি আমার বাবা শূণ্য হয়ে গিয়েছিলাম। সব কিছুতেই শূণ্য। টাকা সেই শূণ্যতা পূরণ করতে পারেনি ইশিতা। কিন্তু সেইদিন হোটেলে যখন লাল শাড়িতে তোমাকে দেখলাম। কেন জানি মনে হলো, আমাদের এই শূণ্যতাগুলো হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে।
— কেন?
— কারণ তুমি কিছুটা দেখতে আমার মায়ের মতো। শুধু যে দেখতে তা না, স্বভাবেও।
— তাই বুঝি সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
— হ্যাঁ!
— যদি দেখতে না হতাম?
জাওয়াদ হাসলো!
— হাসছেন কেন?
— কারণ ঘুরে ফিরে আমাদের জীবনের অংকের সমাধান একই হতো।
— কেন?
— কারণ আমরা যত যা’ই করি। কিছু কিছু জিনিস উপরে যে আছেন তিনি তৈরি করেন। সেগুলো খন্ডানোর সাধ্য কারো নেই।
— তা না হয় বুঝলাম। তো গাড়ি দিয়ে এমন জ্বালিয়ে মেরেছেন কেন?
— আমার প্রিয় সিগারেট বিরক্ত লাগছিলো। যখনি ঠোঁটে রাখি হাত কাঁপে, গলা শুকিয়ে আছে। বুকে অন্য রকম যন্ত্রতা। আর এই যন্ত্রনা সৃষ্টি করে দিব্যি আরামে আছো। তোমার আরাম আমার সহ্য হচ্ছিলো না।
— উল্টো আমি ভাবলাম প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেছেন কি না।
জাওয়াদ উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ সেই ভাবেই নিশ্চুপ বসে রইল। তারপর বললো, — তোমার তো ধারণা সম্পর্ক হতে হয় সমানে সমান। সেই সমানে সমান হিসেব করলে আমি তোমার চেয়ে অনেক নিচুতে ইশিতা। আমার রক্তের কোন পরিচয় নেই। তাই প্রেমে পড়ার মতো বোকামি কি করে করি বলতো?
— প্রেমে পড়ার বোকামি করেন নি, বিয়ে তো ঠিকিই করে ফেলেছেন।
জাওয়াদ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বললো — সেটা বাবার জন্য । বাবার আবার এই পুত্র বধুই চাই।
— আপনার মায়ের মতো বলে।
— না। তার ধারণা তার পুত্রের জন্য এই মেয়ে ছাড়া অন্য কোন মেয়ে ঠিক’ই হবে না। এই মেয়েই সব জেনে বুঝে তার ছেলেকে আগলে ধরবে। যেমন ধরেছিল আমার মা। বাকি সবাই আসবে টাকা দেখে। আর এই মেয়ের টাকাই জাতশত্রু। টাকাকে সে দিনে রাতে হাজার বার শাসায়, হাজার বার ইচ্ছে মতো ছেঁচে ভর্তা বানায়।
ইশিতাও হেসে ফেললো। এই বাবা পুত্র আস্ত এক চিজ। সাধে বলে আব্বার হাম্বা।
সে হেসেই বললো, — বাবার জন্য বিয়ে করেছেন। সে দুঃখেই বুঝি নতুন বউর বাড়ি ঘর উড়িয়ে পুড়িয়ে ইচ্ছে মতো সিগারেট খেলেন।
— চেইন স্মোকার আমি। মিনিটে মিনিটে সিগারেট লাগে আমার। সেই মানুষ সিগারেট খেতে পারছে না। যন্ত্রনা বুঝো?
— তখন তো দিব্যি টেনে টেনে দু’তিনটা খেয়ে ফেললেন।
— তুমি পাশে ছিলে যে তাই।
— বুঝলাম, সবই বুঝলাম। বউ লাগবে আপনার বাবা আর অতি প্রিয় সিগারেটের ঠোঁটে রাখার জন্য।
জাওয়াদ ঘাড় কাত করে আবার ইশিতার দিকে ফিরলো। ফিরে শান্ত ভাবে বললো — উঁহু, ভুল! প্রেমে পড়ার জন্য। বোকামি করতে ইচ্ছে করে বাবার ইশুমনি। সাহস হয় না। তাই সিগারেটে জ্বলে মরি।
ইশিতা আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না। চঞ্চল ইশিতা বরফের মতো জমে গেলো। তবে ঠিক বুঝলো জাওয়াদ এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার শরীর ঝিমঝিম করতে লাগলো। সেই করার মাঝেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বলতে গেলে হনহন করেই ভাইয়ার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো। একে অবশ্য এগিয়ে যাওয়া বলে না, বলে পালানো। কেননা এই ঝিম ঝিমের মাঝেই হঠাৎ করেই তার একটা আজব ইচ্ছে হলো।এই ঝাঁকড়ার কাউয়ার বাসাটা হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে। আর বলতে আপনার এক টাকাও আমি ফিরিয়ে দেবো না, না ফিরিয়ে দেবো অন্য কিছু। দিলেই তো শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি আপনার কাছে ঋণি থাকতে চাই। আজীবন ঋণি। সেটা টাকার হোক বা অন্য কিছুর।
দেখতে দেখতে তার ভাইয়া সুস্থ হলো। কিছুদিন পরেই আবার চাকরিতে জয়েন করবে। এর মধ্যে তার ফাইনাল ইয়ারও শেষ হলো। ইশিতা মন দিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করলো। আর ম্যাজিকের মতো কানাডার এক ইউনিভার্সিটিতে তার চান্সও হয়ে গেলো। কিভাবে কি হলো ইশিতা জানে। তবে এবার সে লজ্জায় ভেঙে চুরে এক হলো না। বরং ভালো লাগার সিগ্ধ এক পরশ তাকে ছুঁয়ে গেলো।
কারণ সে জানে, এই পাশে দাঁড়ানো শুধু টাকা বা ক্ষমতা না। সম্পর্কের পাশে দাঁড়ানো। প্রিয় মানুষের স্বপ্নের পাশে দাঁড়ানো আর তার মনের পাশে দাঁড়ানো।
#সমাপ্ত