#মনের_মানুষ❤️
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি🌸
মাঝেমাঝে কিছুটা সময় শুধু নিজের জন্যই রাখা ভালো…..যেসময়ে নিজেকে নিয়ে ভাবা যায়,নিজের সাথে অনেকটা সময় কাটানো যায়।ক্যালেন্ডারের পাতার হিসাব অনুসারে আহেলি মুম্বাই এসেছে আজ নিয়ে তিনমাস ছদিন হলো…..অফিস থেকে প্রথমে কোয়ার্টার দেবে বললেও,আহেলি কে একটা এক-কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট দিয়েছে।সেখানেই আহেলি নিজের জন্য ছোট্ট একটা সংসার পেতেছে।রোজ সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে আহেলি কাজের উদ্দেশ্যে বেরোয়…..সকালের ব্রেকফাস্ট নিজে বানিয়ে খায় আর দুপুরটা অফিস ক্যান্টিনে।রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় পছন্দমতো বাজার করে রাত্রের রান্না করে…..এসব করতে করতে প্রায় অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।অফিসের কোনো কাজ পেন্ডিং থাকলে সেটা কমপ্লিট করে আহেলি যখন বিছানায় বসে তখন সাড়ে এগারোটা বেজে যায়…..এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস নেই আহেলির,বাড়িতে থাকাকালীন ঘুমাতে অন্তত একটা বাজতো।এখন রোজ অফিস যেতে হবে তাই বারোটা কিংবা সাড়ে বারোটার সময় আহেলির বেডরুম অন্ধকার হয়।মাঝের এই সময়টুকু আহেলি নিজের মতো করে কাটায়…..কখনো ফোন নিয়ে,বা কখনো গল্পের বই পড়ে আর নয়তো ল্যাপটপে ওয়েব সিরিস দেখে।আহেলির সময়টা বেশ ভালোই কাটছে তাও যে ওর কেনো মনখারাপ সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না।আহেলির মনের তিক্ত স্মৃতিগুলো অনেকটাই ফিকে হয়েছে সময়ের সাথে…..কিন্তু আজকাল একজনকে ভীষণ মিস করে আহেলি।কর্ম ব্যস্তময় জীবন থেকে আহেলি একটু ছুটি নিতে চায়…..রোজকার দিনের থেকে একটু অন্যরকমভাবে কাটাতে চায়।তখনই মনে পড়ে প্রান্তিকের কথা…..অবসর সময়গুলো প্রান্তিক কিসুন্দর করে কাটায়।কখনো মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে গিয়ে সেখানকার মানুষের সাথে মিশে,নয়তো প্রত্যন্ত কোনো এক নাম না জানা জায়গায় সময় কাটিয়ে আসা।যেখানে গেলেই একনিমেষে মনটা ভালো হয়ে যায়।
আহেলি রবিবার ছুটি পেলেও একা একা কোথাও যায় না….সবেমাত্র এখানে নতুন তাই কারোর সাথে তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়নি।অফিসে কয়েকজন বন্ধু থাকলেও সেটা অফিসে সীমাবদ্ধ…..বাকি সময়টা আহেলি একেবারে একা।প্রথম প্রথম আহেলি এই একা থাকাটা এনজয় করতো কিন্তু যতই দিন এগোয় ততই আহেলির বিরক্ত লাগে….মনেহয় কবে বাড়ি ফিরবে!কবে বাবা মায়ের মুখোমুখি হবে।ওই ছেলেটার সাথে একটু সময় কাটাবে…..মনে একরাশ দুঃখ থাকলেও সেটা দূর হয়ে যায় প্রান্তিকের ছোয়ায়।আহেলির একটা কথা বারবার মনেহয়,প্রান্তিকের মতো সাধারণ ছেলে আর হয় না….আর সাধারণ হওয়াটা এতটা সোজা নয়।
রাত প্রায় বারোটা বাজে…..আধঘন্টা ধরে ল্যাপটপে নানান ধরনের ওয়েব সিরিস বেছেও একটাও দেখতে ইচ্ছা করলো না।ল্যাপটপ রেখে আহেলি ইয়ারফোন নিয়ে কানে গুজলো….দু-একটা গান শোনার পরেই আবার বিরক্ত হলো।তৎক্ষনাৎ কান থেকে ইয়ারফোন খুলে সেটাও একপাশে রাখলো……কিছুই ভালো লাগছে না আহেলির।কাল রবিবার,সারাদিন ছুটি।কিকরে যে গোটা একটা দিন কাটাবে কে জানে।
মস্তিষ্ক না বললেই মনের কথায় আহেলি হাতে নিলো ফোনটা তারপর কললিস্ট থাকা দ্বিতীয় নাম্বার ডায়াল করতে কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো….ওপাশ থেকে কিছু বলার আগে আহেলি নিজেই বললো,,,
“দুপুরে কল করলাম…তখন ধরলেন না!আবার বিকেলে কল করলাম তখনো বিসি বললো ফোনটা।কোথায় ছিলেন আপনি?ঠিক আছেন তো?একবারও কল ব্যাক করলেন না যে?”
“কোন প্রশ্নের উত্তরটা আগে দেবো আহেলি?”
“সরি….আসলে এরকম কোনোদিন হয় না তো তাই বললাম।”
“না ঠিক আছে…..তো এবার বলি,আজ যখন দুপুরে আপনি কল করেছিলেন তখন আমি রেস্টুরেন্টে ছিলাম তাই কল রিসিভ করা হয়নি।লাঞ্চের পরই ডিউটি জয়েন করি তাই আর কলব্যাক করা হয়নি।এইমাত্র বাড়ি ফিরলাম আর আপনারও ফোন এলো।”
“ওহ….আমি ভাবলাম হয়তো আপনার শরীর ভালো নেই।তো হটাৎ রেস্টুরেন্টে গেছিলেন যে?একাই?”
“নাহ একা নয় সাথে রিমিকা ছিলো….একচুয়ালি ওর অনুরোধেই যাওয়া।”
“রিমিকা মানে আপনার জুনিয়র সেই মেয়েটা?”
“ইয়েস…আসলে সামনেই পুজো।আপনি তো জানেন রিমিকা নর্থ বেঙ্গলের মেয়ে।পুজোতে হয়তো ও বাড়ি ফিরতে পারবে না তাই নিজের জন্যে শপিং করতে গেছিলো…..এখানে তেমনকিছু চেনে না তাই আমায় সাথে যেতে বলে আর শেষে লাঞ্চ করে আমরা একসাথেই হসপিটালে এলাম।”
“ওহ…..ভালোই সময় কাটালেন তাই না?”
“এটা একদম ঠিকই বলেছেন আহেলি….রিমিকার সাথে সময়টা বেশ ভালোই কাটে।মেয়েটা অনেকটা আমার মতোই….সহজে সব্বার সাথে মিশে যায়।”
“বাহঃ ভালোতো….আমারও পুজোয় ফেরা হবে না।এখানে নবরাত্রি হলেও আমার অফিসে মাত্র দুদিন ছুটি আর তারমধ্যে কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়।”
“তাতে কি?মুম্বাইতেও দুর্গাপুজো হয়….ওখানের পুজোটা এনজয় করুন।নতুন অভিজ্ঞতা হবে।”
“ঠিকই বলেছেন….চাইলে এখানেও আমি আনন্দ করতে পারি।আসলে পাড়ার পুজোতে প্রতিবছর থাকি তো তাই….বাবা মাকেও ছেড়ে!”
“কলকাতায় না থাকতে পারলে মন তো খারাপ হবেই….আচ্ছা তাহলে একদিন নয় আমি বরং আপনার পাড়ায় যাবো আর ভিডিওকলে সবটা দেখিয়ে দেবো কেমন?তাহলে আর মনখারাপ থাকবে না।”
“আমার জন্য আপনাকে এতো ব্যস্ত হতে হবে না প্রান্তিক……বাবা মা আছে তো।আর আপনিও হয়তো এবছর আপনার রিমিকা কে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন!না মানে কলকাতায় নতুন,ওকে নিশ্চই আপনি পুজোটা ঘুরে দেখাবেন।”
“এইই দারুন একটা আইডিয়া দিলেন তো…..থ্যাংক ইউ সো মাচ আহেলি।এই নাহলে বন্ধু?এভাবে রিমিকা আর আমি অনেকটা সময় কাটাতে পারবো তাই না?”
“হুমমম….তাই জন্য তো বললাম।আচ্ছা প্রান্তিক এবার আমি রাখি কেমন?কাল সকালেই তো অফিস।”
“ওকে গুডনাইট…..টেক কেয়ার।”
আহেলি ফোনটা কেটে বিছানার একপাশে ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ালো…..কাঁচের জানলাটা টানতেই কিছুটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুয়ে গেলো আহেলিকে।এসময় কলকাতায় থাকলে ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস পাওয়া যায় যা মা দুর্গা আসার আগাম বার্তা বয়ে আনে….কিন্তু এই মুম্বাই শহরে এসব ভাবাও বৃথা।আহেলি বুঝতে পারছে প্রান্তিক ক্রমশ রিমিকার উপর দুর্বল হয়ে পড়ছে আর তা ওর কথা-বার্তায় বোঝা যায়।আর হবে নাই বা কেনো?প্রান্তিক যখন আহেলিকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো তখন আহেলি নিজেই তাতে ফুলস্টপ দিয়ে গল্পটা শুরুর আগেই সমাপ্ত করেছিলো যদিও তার কারণ আছে।এরপর আহেলির সাথে প্রান্তিকের একটা সম্পর্ক অবশ্যই গড়ে উঠেছে তবে তা শুধুই বন্ধুত্বের…..তার বেশি কিছুই নয়।তাই প্রান্তিক যদি নিজের মনের মানুষ খুঁজেও নেয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।আহেলি তো নিজেও তাই চেয়েছিলো……তবে আজ এতো খারাপ লাগছে কেনো আহেলির?জানলা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো আহেলি….আবারো ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুক ওন করলো।ফ্রেন্ডলিস্টে না থাকলেও আহেলির সার্চলিস্টে সবার প্রথম রিমিকার প্রোফাইল…..তাতে আঙুল ছোঁয়াতে খুলে গেলো প্রোফাইলটা।স্ক্রল করতে শুরু করেই এক জায়গায় এসে থামলো আহেলি…..আজকে বিকেলেই পোস্ট করা কতগুলো ফটো দেখতেই আহেলির মনখারাপের পাল্লা আরো ভারী হলো।
নেভি ব্লু শার্ট আর জিন্স প্রান্তিককে বেশ লাগছে…..পাশেই মেয়েটা।রিমিকাকে দেখতে বেশ সুন্দর…বিশেষ করে চোখ আর নাকটা।ফটগুলোর কমেন্ট সেকশনে গিয়া আরো অবাক আহেলি….সকলের একটাই কথা’একেবারে পারফেক্ট ম্যাচ’আরো নানান ধরনের কমেন্ট।প্রতিটা ছবি রিমিকা প্রান্তিককে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে।এর আগে তো প্রান্তিকের সাথে আহেলি নিজেও ফটো তুলেছে কৈ প্রান্তিক কখনো এসব পোস্ট করেনি তো সোশ্যাল মিডিয়ায়।আহেলি দেখলো প্রান্তিক আর রিমিকা দুজনেই একটিভ আছে….বাকিটা বুঝতে দেরি হলোনা আহেলির।বালিশে মুখ গুজে আহেলি ঘুমানোর চেষ্টা করতেও ঘুম এলো না….চোখের সামনে প্রান্তিকের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ভেসে উঠতে লাগলো একের পর এক।তৎক্ষনাৎ আহেলির ঠোঁটে তাচ্ছিলের হাসি ফুটে উঠলো…..একমাত্র আহেলি বাদে সকলেই নিজের মনের মানুষের সন্ধান পায় যার সাথে রঙিন মুহূর্ত কাটানো যায়।একটা সময় আহেলি ভেবেছিলো সত্যিই হয়তো ও একজন মনের মানুষ পেয়েছে কিন্তু সে যে আসলে এমন হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি আহেলি…..তাও আহেলি পুরোনো স্মৃতি ভুলে একটু একটু করে নিজের মনে আরেকজনকে যখন জায়গা তৈরি করে দিচ্ছিলো তখন সেও আহেলির থেকে দূরে চলে গেলো…..
আহেলি আজ একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝেছে ওর জীবনটা হয়তো ভালোবাসাহীন…..এটা সেই অর্থের ভালোবাসা যা একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের থেকে দাবি করে।সকলেই কি আর নিজের মনের মানুষ খুঁজে পায়?কেউ কেউ একাই রয়ে যায় সারাজীবন……ঠিক আহেলির মতন।
চলবে……..
#মনের_মানুষ ❤️
#চতুরবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে একবার মাকে কল করে নিলো আহেলি…..হাজার মনখারাপের মাঝে বাড়ি ফেরার আনন্দে এখন অনেকটা ভালো লাগছে।অনেকবার রিকোয়েস্ট করার পর আহেলি চারদিনের ছুটি পেয়েছে,সেটা কোনোভাবে নষ্ট করতে চায় না আহেলি।দুর্গাপুজোর সময় বাড়িতে ফেরার চেয়ে আনন্দ হয়তো আর কিছুতেই নেই…..তাই আজ আহেলি বাড়ি ফিরছে।যদিও কলকাতায় পুজো শুরু হয় তৃতীয়া থেকেই….সেই হিসাবে আহেলি পৌঁছাতে অনেকটা লেট কারণ আজ সপ্তমী।তবুও এটাই বা কম কি?
ফ্লাইট যখন কলকাতার মাটি স্পর্শ করলো তখন বেলা বারোটা……আগেরবার যাওয়ার সময় যতটা মনখারাপ ছিলো এখন ঠিক ততই ভালো লাগছে।অনেকগুলো দিন পর বাবা মায়ের কাছে ফিরছে আহেলি….অল্প সময়ের জন্য হলেও তা অনেকটা আনন্দের।
হলুদ ট্যাক্সিটা যখন শহরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো আহেলি জানলা দিয়ে বাচ্ছাদের মতো বাইরেটা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলো……এই দুপুরেও প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড়,মাইকে পুজো স্পেশাল গান,রাস্তায় দুধারে নানান ধরনের দোকান।এসব অন্য শহরে থেকে কোনোভাবে উপলব্ধি করা যায় না….দুর্গাপুজোটা একমাত্র এই বাংলায় এসে অনুভব করা যায়।
আহেলির পাড়াতেও থিমের পুজো হয়।ছোটো থেকে আহেলি পুজোর সময় ভীষন এক্সসাইটেড থাকতো….ওই চারটে দিন ছুটি,পড়ার চাপ নেই,সারাদিন প্যান্ডেলে থাকা মায়ের হাতে রোজকার সুস্বাদু সব রান্না আর ঠাকুর দেখতে যাওয়া।আজ আবারো আহেলির সেই ছোট্ট বেলার মতো ফিলিংস আসছে…..হলুদ ট্যাক্সিটা বড়ো রাস্তার সামনে দাঁড়াতে আহেলি চটপট নেমে পরলো।লাগেজটা নিয়ে রাস্তা ক্রস করে এপারে এসে প্রানভরে একটা নিশ্বাস নিলো……বড়ো রাস্তা থেকে আহেলির বাড়ি যাওয়ার পুরো রাস্তাটা রঙিন আলো আর ফুলে সাজানো।কতো মানুষ যাচ্ছে ঠাকুর দেখতে…..একবার মাথার ওপরে থাকা গেটটার দিকে চোখ বুলিয়ে আহেলি সামনে পা বাড়ালো।
বাড়ি ফেরার সময় অনেক চেনা মানুষের সাথে দেখা হলো আহেলির….সকলেই আহেলির সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।প্যান্ডেলের দিকে যেতে চাইলেও আহেলি প্রথমে নিজের মা আর বাবাকে দেখতে চায় তাই বাড়ির গেটের সামনে এলো…..এই সময়টা আহেলির বাবা বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ে।আহেলি কে ঢুকতে দেখেই কাগজ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,,,,
“ওগো দেখে যাও…..আহু এসেছে।আয় মা যায়…সেই কখন থেকে আমি অপেক্ষা করছি।দে ব্যাগটা আমার হাতে দে।আসতে আবার কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
অমিও বাবুর কথা বলার মাঝেই উমা দেবী এসে উপস্থিত হয়….মা বাবাকে প্রণাম করতেই উমা দেবী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলেন,,,,
“আমি বলেছিলাম না তোমায়….আমার মেয়েটা ঠিক পুজোর সময় ফিরবে।মিললো তো?দেখো…..ইসসস গরমে একেবারে ঘেমে গেছিস তো।চল আগে একগ্লাস গ্লুকোষের জল খেয়ে তারপর স্নানটা সেরে নিবি।”
বাবা মাকে দেখে আহেলির চোখে জল এলো….এই মুহূর্তে কোনোমতে অশ্রুপাত করতে চায় না আহেলি।তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বাবা মায়ের সাথে ঘরে ঢুকলো।
🌸🌸🌸
“আহু তুই একাই এলি যে?প্রান্তিকের কি ডিউটি আছে?তাই তোকে বাড়ি অব্দি ছেড়ে গেলো?”
“আরে না না….আহু তো ট্যাক্সিতে এলো।প্রান্তিক বোধহয় এয়ারপোর্ট থেকেই হসপিটাল চলে গেছে।ডাক্তার মানুষ হলে যা হয়….পুজোর সময়েও ছুটি নেই।”
মা বাবার কথা শুনে আহেলি অবাক হয়ে বললো,,,,
“প্রান্তিক আবার আমায় দিয়ে যাবে কেনো?আমি কি একা আসতে পারিনা?”
“আরে তা হবে কেনো?যাওয়ার দিন তো তোকে দিয়ে আসলো তাই তুই যখন বললি কাউকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে না ভাবলাম প্রান্তিক হয়তো যাবে।”
“আহঃ মা…..ওর তখন সময় ছিলো।কিন্ত এখনো যে ওর ইম্পর্টেন্ট কাজ ফেলে আমায় নিতে যাবে এটা আশা করছো কেনো?”
“তুই রাগ করছিস কেনো আহু?ছেলেটা কি তেমন?এই যে ওর এতো কাজ তারমধ্যে ঠিকই আমাদের কাছে আসে।যে যে দায়িত্বগুলো তোর কাঁধে ছিলো সেগুলো নিজে পালন করে।আমরা বললেও তো শোনে না….”
আবারো অবাক হলো আহেলি।ওর বাবা সম্মতি জানিয়ে বলেন,,,
“ঠিকই তো….আজকাল ওরকম ছেলে সত্যিই পাওয়া যায় না।এইতো পুজোর আগে এসে আমাদের জন্য কেনাকাটা করে দিয়ে গেলো।আমি এতো বারন করলাম তাও কি শুনলো?বরং বললো আমায় কি আপনে ভাবেন না আঙ্কেল?”
“প্রান্তিক তোমাদের জন্য শপিং করে দিয়ে গেছে?”
“তা নয় তো কি?মহালয়ার দিন দুপুরে এসে আমার শাড়ি,তোর বাবার পাঞ্জাবি এমনকি তোর জন্যেও একটা শাড়ি দিয়ে গেছে।আমি শুধু অবাক হয়ে দেখি ছেলেটাকে…..”
খাওয়া শেষে মায়ের কথামতো আলমারি খুলে একটা প্যাকেট বের করলো আহেলি….খুলে দেখলো তাতে একটা লাল রঙের জামদানি শাড়ি।আহেলির বড্ড পছন্দের এই রঙটা…..আর সেটাই কিনা প্রান্তিক ওর জন্য কিনেছে?এখনো ছেলেটা ওর কথা ভাবে?তবে মাঝের কেটে যাওয়া এই একটা সপ্তায় প্রান্তিক তো ওরসাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করেনি….তাই আহেলিও আর চেষ্টা করেনি।এখন হয়তো সে নতুন মানুষের সাথে সময় কাটাতে ব্যস্ত……তাই আহেলি যে ফিরছে এই খবরটাও দেওয়া হয়নি।
শাড়িটা রেখে হাতে ফোন নিলো আহেলি….প্রান্তিকের নাম্বারটা ডায়াললিস্টে খুঁজে বের করেও আবার ফোনটা রেখে দিলো।একটু বেশিই নিজে থেকে ভাবছে আহেলি…ওর বাবা মায়ের জন্য কিনেছে বলেই হয়তো ওর জন্য একটা শাড়ি কিনেছে এটা নিয়ে অন্যকিছু ভাবার কোনো কারণ নেই।আহেলি নিজেও বাবা মায়ের জন্য এখনো কিছু কেনেনি….ভেবেছিলো আজ বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেয় বেরোবে।সেইমতো আহেলি বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার নাম করে বিকেলে বাড়ি থেকে বেরোলো…..যদিও উদ্দেশ্য বাবা মায়ের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা।
ভিড়ে ভরা শহরে আহেলি হেঁটে হেঁটেই কোনোরকমে কাছের মলটায় এলো…..প্রথমে বাবার জন্য আর তারপর মায়ের জন্য শপিং করে ফিরে আসছিলো।কি মনেহতে একবার আহেলি আবার গ্রাউন্ড ফ্লোরের মেন্স কালেকশনে গেলো।অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর একটা ব্লু স্কাই রঙের শার্ট আর জিন্স কিনলো।ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আহেলি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো….হটাৎ একটা জায়গায় চোখ যেতেই আহেলি অবাক হলো।ও কি ঠিক দেখছে?এরআগে যদিও মেয়েটাকে ফটোতে দেখেছে…হ্যাঁ এটাই তো রিমিকা।সাথে একটা ছেলে না?আহেলি তৎক্ষনাৎ মুখটা ছোটো করে এগিয়ে যাবে তার আগেই ছেলেটা আহেলির দিকে ফিরলো।নাহ এটা তো প্রান্তিক নয়…..
আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আহেলি এগিয়ে গেলো সেদিকে…..মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বললো,,,,
“রিমিকা?”
আহেলির কথায় রিমিকা প্রথমে ওরদিকে তাকালো তারপর অবাক হয়ে বললো,,,
“আহেলিদি……আপনি এসেছেন কলকাতায়?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি আমায় চিনলে কিকরে?”
“আপনাকে চিনবো না তো আর কাকে চিনবো?প্রান্তিকদা তো সারাক্ষণ আপনার নাম জপ করে যায়…..বাপরে।তবে সে যে বললো আপনি আসবেন না!”
“ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছি….কিন্তু তুমি আজ প্রান্তিকের সাথে বেরোয় নি?”
“প্রান্তিকদার সাথে আমি?ওর ওতো সময় কোথায়?বেচারা এমনিই সবসময় মনখারাপ করে থাকে…..আর এখন তো আরো।ইভেন একটাও ছুটি নেয়নি পুজোয়।আমিও আজকের দিনটা পেয়েছি তাই এনার সাথে বেরিয়ে পড়েছি।ফার্স্ট কলকাতার পুজো উইথ বয়ফ্রেন্ড মিস করলে চলে?”
পাশের ছেলেটা আহেলির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।রিমিকার কথাতেই জানা গেলো রিমিকার বয়ফ্রেন্ড সৌমাল্য প্রান্তিকের খুব ভালো বন্ধু…..রিমিকা আর সৌমাল্যর লাভ স্টোরি গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি নাকি প্রান্তিকের অবদান।রিমিকা আর প্রান্তিক একে অপরের সাথে বেশ সহজভাবে মেশে বলে অনেকেই ওদের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবে যদিও তাতে ওরা কর্নপাত করে না।
আহেলি যাহোক করে বেরিয়ে এলো মল থেকে…..সবটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।সকলেই জানে প্রান্তিক আহেলিকে পাগলের মতো ভালোবাসে অথচ এই খবরটা আহেলি নিজেই জানে না।আর কিকরে জানবে?যে মানুষটা গত কয়েকদিন ধরে ওকে ইগনোর করছে,রিমিকা কে জড়িয়ে নানান কথা বলছে নিজে থেকেই সে যে আসলে আহেলি কে চায় এটা কিকরে বুঝবে?
কোনোরকমে একটা ট্যাক্সি পেলো আহেলি….তবে বাড়ি ফেরার রাস্তায় না গিয়ে প্রান্তিকের এপার্টমেন্টের ঠিকানাটা বললো।ভিড় ঠেলে যেতে বেশ সমস্যা হচ্ছিলো…তাই দেরিও হলো।আহেলি যখন এপার্টমেন্টের সামনে নামলো তখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে…কোনদিকে না তাকিয়ে আহেলি সোজা লিফটে গিয়ে উঠলো।প্রান্তিকের মুখে যেটুকু বিবরণ শুনেছিলো তাতে ভরসা করে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো…..কলিং বেলে কয়েকবার চাপ দিতেও ওপাশ থেকে দরজা খুলে গেলো।
প্রান্তিক ডিউটি সেরে ফিরে সবেমাত্র স্নান করেছে…..এখনো ভিজে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।দরজা খুলে আহেলি কে সামনে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই অবাক হলো….প্রান্তিক সরে দাঁড়াতে আহেলি চুপচাপ ঘরের মধ্যে ঢুকলো।দরজা আটকে আহেলির সামনে এসে প্রান্তিক অবাক করা গলায় বললো,,,
“আপনি কলকাতায়?আসবে..
প্রান্তিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই আহেলি কঠিন গলায় বললো,,,,
“আমি এসে পড়ায় ভীষণ সমস্যা হলো তাই না?রিমিকার সাথে কেমন প্রেম গড়ে উঠেছে?আজ দুজনে ঘুরতে বেরোয় নি?”
“আহেলি আপনি এভাবে চলে আসবেন সত্যিই জানা ছিলো না….আর রিমিকার কথা নয় পরে আলোচনা করা যাবে।”
হাতের শপিং ব্যাগগুলো ফেলে প্রান্তিকের সামনে এসে দাঁড়ালো আহেলি….একহাতে প্রান্তিককে অল্প ঠেলে দিয়ে বললো,,,
“আর কতো মিথ্যে বলবেন প্রান্তিক?আপনাকে কে বলেছে আমার বাবা মায়ের এতো খেয়াল রাখতে?হ্যাঁ…..আমার জন্য আবার শাড়ি কিনেছেন?কেনো?দয়া করে?রিমিকার সঙ্গে তো আপনার নাকি দারুন সম্পর্ক…..এসবই তো বলতেন আমায় তাই না?কেনো প্রান্তিক?আমায় কষ্ট দিতে খুব ভালোলাগে?আমি কাঁদলে বুঝি আপনার ভালোলাগে তাই না?তাইতো সবসময় আমার কানের সামনে রিমিকা রিমিকা করতেন যাতে আমি কষ্ট পাই….আমি কেনো সবসময় এতো কষ্টভোগ করবো বলতে পারেন?
আহেলি কথা বলার সাথে সাথে প্রান্তিকের গায়ে আঘাত করছিলো আর প্রান্তিক পিছিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে…..এবার প্রান্তিক আহেলির হাতদুটো চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে বললো,,,
“আমি যদি মিথ্যে বলি তাতে আপনার কি?আপনার কষ্ট কেনো হয়?আমার সঙ্গে যার ইচ্ছা সম্পর্ক থাকুক…তাতে আপনার কষ্ট কেনো হবে?”
প্রান্তিকের কথায় আহেলি কান্নাভেজা গলায় বললো,,,
“বোঝেন না কেনো?এতদিনে আমার মনের এটুকু অনুভূতি আপনি বুঝতে পারেন নি?এইতো সকলের মনের কথা বুঝে যান…আর আমারটা?আমারটা বোঝেন নি?”
“না বুঝিনি….সবসময় আমি কেনো বুঝবো?আপনি বলতে পারেন না?”
প্রান্তিকের অভিমানী গলার প্রশ্নে আহেলি কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো….কান্নার চোটে হেঁচকি উঠতে শুরু করেছে আহেলির।তাও কোনোরকমে নিজেকে সামলে আহেলি নাক টেনে বললো,,
“আপনি কেনো বোঝেন না প্রান্তিক,যে আমি আপনাকে চাই….ভীষণভাবে আমার পাশে চাই।আর তা শুধু বন্ধু হিসাবে নয় মনের মানুষ হিসেবে…যে হবে একান্ত আমার।”
আহেলির উত্তরে প্রান্তিকের চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পরলো।আহেলি আরো কিছু বলবে তার আগেই প্রান্তিক আহেলির মুখটা দুহাতে ধরে নিজের ঠোঁট নিয়ে আহেলির ঠোঁটে মিশিয়ে দিলো।ঘটনার আকস্মিকতায় আহেলি চমকে উঠলেও আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো……প্রান্তিকের এই স্পর্শে কতখানি ভালোবাসা আছে তা উপলব্ধি করতে পারছে আহেলি।কে বলেছে ভালোবাসা অনুভব করা যায় না?সঠিক মানুষকে পেলে তার থেকে ভালোবাসার প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করা যায়।
আহেলি আর প্রান্তিকের এরকম মধুর মুহূর্তে এপার্টমেন্টের মন্ডপে বাজছে,,,,,
পথিক কয় ভেবোনা রে
ডুবে যাও রূপসাগরে
পথিক কয় ভেবোনা রে
ডুবে যাও রূপসাগরে
বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা
একবার ধরতে পেলে মনের মানুষ
ছেড়ে যেতে আর দিও না
ধরতে পেলে মনের মানুষ
ছেড়ে যেতে আর দিও না
দেখেছি, দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা
চলবে……