মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব ৩
আজ লাবণ্যদের নবীন বরণ, নীল কাতানটা পরেছে লাবণ্য। খোঁপা করে তাতে দিয়েছে বেলি ফুলের মালা। খুবই হালকা সাজসজ্জা, বাবা-মায়ের সামনে সাজতে কেমন লজ্জা লাগে। কালকের পাশের বাসায় আগুনের দৃশ্যটা চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। বাবা তো খুব জোরাজুরি করছিল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। আয়নার দিকে তাকালো লাবণ্য, মনে মনে বলল, “আমি তো পাগল না, হ্যাঁ আমার একটা ট্রমা আছে।” যদিও সেসব ভাবতে চায় না, প্রায় এগারো বছর হলো সেসব স্মৃতি পিছে ফেলে এসেছে, কিন্তু স্মৃতির জ্বালা বড় যন্ত্রণাময়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কলাভবনের প্রতিটা সিঁড়ি পেরোতে পেরোতে লাবণ্যের চোখে বিগত মাসের কষ্টগুলো ভেসে উঠলো। কাঙ্ক্ষিত কোনো জায়গায় চান্স না পেয়ে একদম ভেঙে পড়েছিল। এই সাবজেক্টটা যে খুব পছন্দ, তা নয়, কিন্তু তবুও—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়াশোনা, কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি, রাত জেগে প্রশ্নব্যাংক সলভ আর অনেকদিন চান্স না পাওয়ার আশঙ্কায় কান্না, মন খারাপ, দুয়া। সেসব দিন পেছনে ফেলে লাবণ্য আজ প্রার্থিত প্রাঙ্গণে পা রেখেছে।
তবে আজকে খানিকটা ভয় আর চাপা উত্তেজনা আছে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি। তবে লাবণ্যের ভয়-শঙ্কা আর অন্যরকম অনুভূতিতে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিল যেন শিক্ষক-সিনিয়রদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, উপদেশ ও আন্তরিকতা।
দেখা হলো তটিনীর সাথেও, একটা নীল জামদানিতে অপূর্ব লাগছিল মেয়েটাকে। দুইজন অনেক গল্প করলো। আজ লাবণ্য একটু নিউ মার্কেটে যাবে। তটিনীকে সাথে যাবার কথা বলতে গিয়েও বলা হল না।
রাস্তায় বের হয়ে লাবণ্য নবীন বরণে পাওয়া ফুল হাতে আকাশের দিকে তাকালো। রোদ একদম যাকে বলে ঝাঁঝাঁ। তবু আজই যেতে হবে, কাল তার মায়ের আর বাবার বিবাহবার্ষিকী। একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো লাবণ্য।
নিউ মার্কেটে এসে লাবণ্য ভেতরের ফাঁকা জায়গায় হাঁটছে আর ভাবছে কি নিবে? তখন থেকে অযথা শুধু ঘুরেই যাচ্ছে, শাড়ি পড়ে অভ্যস্ত নয় তাই গরম লাগছিল খুব। হঠাৎ একটা কণ্ঠ কানে বারি মারলো, “এই বন্য, এই…”
কণ্ঠটা পরিচিত। লাবণ্য ঘুরে তাকালো—না, কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না। বরঞ্চ দোকানদার কিছু মুখ টিপে হাসছে। রাগ লাগছিলো লাবণ্যের, দ্রুত হেঁটে কিছুদূর সামনে চলে গেল। তখনই কণ্ঠটা আবার শুনতে পেল,
“মাফ করবেন, আমার ছাতাটা রাখুন। এতে রোদ কম লাগবে।”
লাবণ্য ঘুরে তাকাতেই অরণ্যকে দেখতে পেল, ছাতাটা মাথার উপরে ধরে রেখেছে।
“আপনি একটু আগে আমাকে বন্য বলে ডাকছিলেন কেন?”
অরণ্য ছাতাটা বাড়িয়ে ধরল, “এটা ধরুন। আপনার নামের বাকি অংশ ভুলে গিয়েছি তাই।”
লাবণ্য হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিল, তারপর অরণ্যের হাসিহাসি মুখের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল, “আপনি মানুষটা ভালো, কিন্তু সব সময় এরকম খোঁচা দেন কেন?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ, আমি আপনাকে খোঁচা দিলাম কখন? কত দূরে দাঁড়িয়ে আছি!” এখনো মুখে একই রকম হাসি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো লাবণ্য, তারপর অরণ্যের দিকে তাকাল। অরণ্য এদিক সেদিক দৃষ্টি দিচ্ছে। রোদ চোখে মুখে আঘাত করছে। লাবণ্যের মন চাইলো রোদগুলোকে দুহাতে আটকে দিতে। কেন? নিজের মনের অবাধ্য চাহিদায় অস্থির লাগছিল লাবণ্যর।
“শুনেন, আপনি কি ব্যস্ত?!”
“আমি? অবশ্যই ব্যস্ত, সামনে আমাদের থার্ড ইয়ার ফাইনাল। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, আর কিছু ফটোকপি করতে। আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে ফুল হাতে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করতে দেখছি। কার জন্য অপেক্ষা করছেন?”
“আরে না, আজ আমাদের নবীনবরণ ছিল। কাল আমার মা-বাবার বিবাহবার্ষিকী, তাদেরকে কিছু দিব। এর জন্যই মার্কেটে এসেছি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না কী নেব।” মুখ কুঁচকে নিল লাবণ্য।
দুজনে এখন হাঁটছে। অরণ্য লাবণ্যের দিকে তাকালো। এই মেয়েটার সাথে বারবার কেন দেখা হয়ে যায়? মেয়েদের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ কিছুই নেই অরণ্যের। তবে ‘তন্দ্রা’ নামক মেয়েটা মেয়েদের প্রতি ইদানিং ওকে একটু বিরাট ভাজন করে রেখেছিল যেন। অনেকক্ষণ দুজন চুপচাপ হাঁটছিল। এক পর্যায়ে লাবণ্য ছাতাটা বন্ধ করে অরণ্যের হাতে দিয়ে বলল,
“আর লাগবে না, ধন্যবাদ। মার্কেটের ভেতরে তো রোদ নেই। কিন্তু কী নেব বুঝতে তো পারছি না!”
অরণ্য খানিক ভেবেই বলল, “এক কাজ করেন, আপনার আম্মাকে হ্যান্ডব্যাগ আর আপনার আব্বাকে মানিব্যাগ গিফট করেন। অথবা ঘড়ি।”
বুদ্ধিটা পছন্দ হলো লাবণ্যের। কেনাকাটা শেষ করে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বইয়ের দোকানগুলোর সামনে চলে এলো। রাস্তায় বিভিন্ন খাবারের দোকান। ফুটপাতে বিভিন্ন জিনিসের পশরা। ফলের দোকান। মানুষের ভীর অল্প।
“আপনাদের থিম কি নীল রঙ ছিল? আপনাকে কিন্তু সবুজে বেশি মানাত।”
ফুটপাতে কিছু একটা দেখছিল লাবণ্য। অরণ্যের কথা শুনে চমকে গেল।
“হুম, ভালো কথা, আপনার খালাতো বোন আর আমি কিন্তু একই সাবজেক্ট, দর্শন। এর চেয়ে ভালো সাবজেক্ট পেলাম না জানেন?” লাবণ্যের মুখটা করুণ হয়ে গেল।
“তাহলে প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে যেতেন।”
“প্রাইভেট অনেক খরচ। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান, সেটা ঠিক। কিন্তু আমার বাবার চাকরি আর বেশিদিন নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা আমার বাবা-মা ই তো লাগবে। সেসব ভেবেই…”
“বাহ! আপনি তো দারুণ ম্যাচিউর। কথাবার্তায় কিন্তু সব সময় মনে হয় না। আপনি বুঝি আপনার বাবা-মায়ের শেষ বয়সের সন্তান, আমার মত?” কথাগুলো সহজ কণ্ঠে বলল অরণ্য। ভাবছিল, মেয়েটাকে একটা ডাব খাওয়াবে কিনা।
কিন্তু লাবণ্যর ওর কথাটা পছন্দ হলো না। এমন কিছু পরিচয় তো না। কিছু বলল না, চেহারাটা অপ্রসন্ন করে রাখলো।
হাঁটতে হাঁটতে অরণ্য খেয়াল করে লাবণ্য কোনো কথা বলছে না। গলা খাকাড়ি দিল অরণ্য,
“আমি দুঃখিত, আমার কথা যদি আপনি কষ্ট পেয়ে থাকেন। আপনার বাবা-মার বয়স নিয়ে বললাম। আসলে আমি একটু এরকমই,কথা চেপে রাখতে পারি না। আসেন, ডাব খাই।”
লাবণ্য এবার হেসে দিল, “আরেকদিন খাব, এখন বাসায় যেতে হবে। আপনাকে ধন্যবাদ।”
লাবণ্য রিকশায় উঠে চলে গেল। অরণ্য সেদিকে তাকিয়ে ছিল। এই মেয়েটার সাথে ওর যেন হঠাৎ দেখা হওয়ার সম্পর্ক। তবে খেয়াল করেছে, মেয়েটার সাথে কাটানো সময়গুলো পরবর্তীতে ভাবতেও বেশ ভালো লাগে। তূর্যের মুখটা মনে হলো। নারীজাতি বড় ছলনাময়ী।
______________
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে কঠিনতম সময় হচ্ছে ‘১৪তম সপ্তাহ’ আর ‘টার্ম ফাইনাল’। টার্মের শেষ সপ্তাহই হল সেই ১৪ তম সপ্তাহ। পুরো টার্মের ফাঁকিবাজ থেকে পড়ুয়া সবাই এই এক সপ্তাহ পড়ার মাঝে ডুবে যায়। বাকি থাকা সকল ক্লাস টেস্ট, কুইজ, ভাইভা, অ্যাসাইনমেন্ট সব কিছুই যেন এই এক সপ্তাহেই এসে উপস্থিত হয়। তাই ছাত্রদের কাছে এক সপ্তাহ ‘হেল উইক’ নামে পরিচিত। আর এই হেল উইকের পরেই আসে টার্ম ফাইনাল। অরণ্যদের তো এই বছরের শেষ পরিক্ষা।
তবে এত ব্যাস্ততার মাঝেও ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যাফেটেরিয়া, অডিটোরিয়ামের সামনে আড্ডা চলে।
অরণ্য তূর্য আর রাফি আড্ডা দিচ্ছিল, তখন দৌড়ে এসো ওদের সাথে যোগ দিলো রফিক। আড্ডার বিষয়বস্তু নানাবিধ। হঠাৎ রফিক মুখ খুলল ছুড়ে দিল তুর্যের দিকে,
“একটা সত্যি কথা বলবি, তূর্য নামটা কি তুই নিজে রেখেছিস? না মানে, তোর বাবা মা এই নাম রাখতে পারে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না।”
তূর্য হেসে ফেলল, “ ঠিক ধরেছিস, এই নাম রেখেছে আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধু। উনি আবার লেখালেখি করেন। আমার ভাল নাম তো রিয়াজ হোসেন।”
রাফি হেসে ফেললো, “আমাদের চিত্রনায়ক।”
অরণ্য দাঁত নিয়ে নক কাটছিলো ওর বদ অভ্যাস, কেউ জিজ্ঞেস করার আগে নিজেই মুখ খুললো, “আমার নাম, আমার বোন রেখেছে। কি একটা নাকি নাটক দেখত সেই নায়কের নাম ছিল অরণ্য।”
হেসে ফেলল সবাই, রফিক চোখ সরু করে বলল, “তোর ভালো নাম কি?”
অরণ্য অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো, “খোকন তালুকদার।”
হাসির একটা হুল্লাড় উঠে গেল, রাফি ছড়া কাটলো,
“খোকন খোকন ডাক পাড়ি খোকন মোদের কার বাড়ি?” তারপর হঠাৎ তূর্যর দিকে তাকালো, “এই তন্দ্রা কি হয়েছে রে? আমাকে হঠাৎ ব্লক করে দিল।”
তূর্য উঠে দাঁড়ালো, “ ওর ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন হইছে।” তারপর সোজা হাঁটা দিল।
রফিক হাত উল্টে দিল, “ ব্রেকআপ! প্রেম পিরিতি কি জ্বালা।”
এরপর আড্ডা আর জমলো না। সবাই উঠে গেল। আকাশ কালো হয়ে আছে। অরণ্য হঠাৎ ভাবলো আচ্ছা লাবণ্য কি এখন ঢাবি ক্যাম্পাসে, ছাতা এনেছে কি? হঠাৎ এরকম ভাবনা ওর ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
________________________
লাবণ্য ভর্তি হয়েছে ক্লাস করছে প্রায় এক মাস। ক্লাস করতে ভালো লাগে, অনেকগুলো নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে, হইচই আড্ডা। তটিনীর সাথে ভাল সখ্যতা হয়েও গেছে। তবে লাবণ্য কখনোই অরণ্যর কথা জিজ্ঞেস করে না তটিনীকে। খুব অস্বস্তি লাগে। তবে অরণ্যর ইন্সটাগ্রাম এবং ফেসবুক কিন্তু খুঁজে ঠিক বের করে ফেলেছে। লক করা নাই মাঝেমধ্যে অরণ্যর ছবিগুলো দেখে। কেন দেখে? জবাবটা নিজে জানলেও, আবার জানতে চায় না। বাবাকে কথা দিয়েছিল, বাবার পছন্দই হবে ওর পছন্দ। আর ও কখনোই বাবার কথা কে ফেলতে পারে না। আজ শুক্রবার, বাবা জানি কোথায় নিয়ে যাবে ওকে তৈরি হতে বললো।
আসলে জাভেদ সাহেব মেয়েকে আজ সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবেন। এমনিতে লাবণ্যর কোন সমস্যা নেই, কিন্তু মাঝেমধ্যে ওর হ্যালিসল্যুশন হয়। নিজে বাবা-মাকে দেখে। আগুন দেখলে কোন দুর্ঘটনা দেখলে ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। তবে বিষয়টা এমন না যে আগুন দেখলেই কোন দুর্ঘটনা দেখলে এরকম হয়। কখনো কখনো হয়। বিষয়টা নিয়ে উনি অনেক চিন্তিত। আজ হোক কাল হোক লাবণ্যকে বিয়ে দিতে হবে। উনি চান না ওনার মেয়ে বিষয়টা নিয়ে কোন কথা শুনুক। ছোট ভাই জসিমের একমাত্র মেয়ে লাবণ্য, এখন উনার নিজের কলিজার টুকরা। নিঃসন্তান জাবেদ সাহেব কে, মধ্যবয়সের ও পরে লাবণ্য দিয়েছে পিতৃত্বের স্বাদ।
“বাবা, কি ভাবছো?”
ফিরে তাকালেন, কি সুন্দর লাগছে না মেয়েকে। “ কিছু না মা চলো।”
হাসপাতালের কাছাকাছি এসে লাবণ্য বুঝে ফেলল বিষয়টা কি। রাগ লাগছিল, কিন্তু চেপে গেল। বাবার মুখের দিকে তাকালে ওর দুনিয়াটা এলোমেলো হয়ে যায়, বুঝতে পার ওকে নিয়ে খুব টেনশন করে। কিন্তু, লাবণ্য নিজেও জানে এসব করে লাভ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আকাশের দিকে তাকালো, চমৎকার নীল আকাশ। এরকম সুন্দর আবহাওয়ায় চুপ করে লাবণ্য মনে অরণ্য উঁকি দেয়। লাবণ্য নিজের উপরেই প্রচন্ড বিরক্ত।
লাবণ্য চেম্বারে একাই গেল। ডাক্তার যিনি তার বয়স দেখে বোঝার উপায় নেই কত? প্রথমে চোখ যায় মাথা কামড়ে থাকা কোঁকড়া চুলের দিকে। তারপর চোখের দিকে, খুব সুন্দর চোখের মনি ব্রাউন ব্রাউন। লাবণ্য চুপচাপ বসে আশেপাশে চেম্বারটা দেখছিল।
হঠাৎ ডাক্তার বললেন, “ আসসালামু আলাইকুম,আমি ডাক্তার রিয়াদ। বাবা মা ডাকে রোদ। আপনার নাম কি?”
লাবণ্য বিরক্ত হল, এই যে শুরু হয়েছে পাগল ভোলানো কথাবার্তা। ওর সমস্ত কিছু বাইরে একটা ইন্টার্নি ডাক্তার লিপিবদ্ধ করেছে। তারপর সেই ফাইলএখানে পাঠানো হয়েছে, ফাইলের ভেতরে গোটা গোটা অক্ষরের নাম বয়স সব লেখা আছে।
“অলাইকুমুস সালাম আমার নাম লাবণ্য।” একটু থেমে ভাবল, সমস্যা গুলো বলে ফেলবে। “… আমি ছোটবেলায় আমার বাবা-মাকে চোখের সামনে আগুনে পুড়ে যেতে দেখি। আমি কিছুই করতে পারিনি…ছোট ছিলাম!” গলাটা খানিক ম্রিয়মাণ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তারা আমাকে একজন উদ্ধার কর্মীর হাতে তুলে দেয় কিন্তু…এখন কখনও কোন দূর্ঘটনা দেখলে বুক ধড়ফড় করে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে…কখনো জ্ঞান হারাই।
ডা. রিয়াদ শান্তভাবে বললেন,
“লাবণ্য, আমি আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। আপনি খুব কঠিন একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। আপনি যা অনুভব করেন। এই যে আপনার আতঙ্ক, কোন দুর্ঘটনা দেখলে ট্রমাটাইজ হয়ে যাওয়া, ভয় পাওয়া, নিজের বাবা মাকে দেখা যাকে বলে দৃষ্টি ভ্রম, এগুলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের লক্ষণ হতে পারে।”
লাবণ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,” আমি কি আদৌ কখনোও এই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারব? এরকম ট্রমায় আক্রান্ত হতে, হতে আমি ক্লান্ত।”
ডা. রিয়াদ ওর দিকে তাকালেন, মেয়েটার মুখটাতে অসম্ভব মায়া, চোখে আদ্রতা,
“অবশ্যই পারবেন। ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করতে হবে। প্রথমেই আমরা থেরাপি শুরু করব, যেটা আপনার ভেতরের ভয়কে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে।”
লাবণ্য চমকে তাকায়, “ আপনার কি আমাকে পাগল মনে হচ্ছে?আর থেরাপি মানে? ইলেক্ট্রিক শক টক দিবেন?”
ডা. রিয়াদ হেসে ফেলে শব্দ করে, “ আমাদের দেশে, মানসিক অসুখকে পাগলামি বলা হয়। এটা খুবই হতাশা জনক, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কোন না কোন মানসিক সমস্যায় জর্জরিত।” একটু থেমে, আপনার ভয় নেই। আমরা ধীরে ধীরে কাজ করবো। যেমন CBT (Cognitive Behavioral Therapy) এর মাধ্যমে…
“এটার মানে কি?”
ভ্রুঁ কুঁচকে রেখেছে লাবণ্য, ডাক্তারকে ই ওর পাগল মনে হচ্ছে।
ডা.রিয়াদ আবার হেসে ফেললো, হাসার সাথে সাথেই গালে একটা টোল পরে, “ Cognitive Behavioral Therapy (CBT) হল এক ধরনের মনোবিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে রোগীর চিন্তা (cognitive) এবং আচরণ (behavior) পরিবর্তনের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করা হয়।”
“ও আচ্ছা।” একটা বোকা হাসি দিল লাবণ্য।
“যা বলছলাম CBT এর মাধ্যমে আপনার ভয়গুলো কীভাবে তৈরি হচ্ছে, তা চিনে, সেটা বদলানোর চেষ্টা করবো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “এছাড়া exposure therapy আছে সেখানে খুব আস্তে আস্তে আপনাকে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতির মুখোমুখি হতে শেখাবো, যাতে ভয়টা আর এতটা না আপনাকে অস্থির করতে না পারে।”
লাবণ্য অস্থির হয়, “ কিন্তু জানেন আমি সেসব ভুলতে চাই…আমার চাচা-চাচীকে আমি বাবা- মা সম্বোধন করি। আমি চেষ্টা করি কিন্তু…
আমার ঘুমও আসে না মাঝে মাঝে… রাতেও মাঝেমধ্যে আগুনে পোড়া সেই দৃশ্য দেখি…অথচ তখন আমার বয়স মাত্র আট।” বলতে বলতেই চোখে জল চলে আসলো লাবণ্যর।
ডা. রিয়াদ নরম গলায় বললেন, “ আপনি ভুলতে চান না.. তাই ভুলতে পারেন না। স্মৃতি গুলোকে আর বাবা মায়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা, কাতরতা সব মুক্ত করে দিন। কি লাভ সেই স্মৃতি মুঠিবন্ধ করে যা কষ্ট দেয়। অবচেতন মনে আপনি সেই স্মৃতি যত্ন করে ধরে রেখেছেন। আমি কিছু হালকা ওষুধ দেব, যেগুলো ঘুম ও ভয় নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করবে।”
লাবণ্য মুখ নিচু করে মৃদু কন্ঠে, “ আপাতত নিজে চেষ্টা করি৷ থেরাপি কিছুদিন পর নেই।আপনার সাথে মন খুলে কথাগুলো বলতে পারলাম।
আমার কাউকে বলতেও ইচ্ছে করে না… কেউ বুঝবেও না…”
বিদায় নিয়ে লাবণ্য চলে গেল। ডা.রিয়াদ কি মনে করে রাস্তার দিকে মুখ করা জানলার সামনে দাড়ালো। কিছুক্ষণ পর বাপ আর মেয়েকে দেখলো হেটে যাচ্ছে, একটা রিক্সা নিল। যতক্ষণ দেখা গেল রিক্সাটা রিয়াদ দাঁড়িয়েই রইলেন। কিছু মানুষ অন্যকে আচ্ছন্ন করতে পারে লাবণ্য তেমন একজন অথবা…… কাধ ঝাকিয়ে নিজের চেয়ারে বসে বেল বাজালো, নেক্সট রুগির জন্য।
চলবে……
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা
(CBT সম্পর্কে তথ্য চিকিৎসার ধরন এগুলো তথ্য গুগল আর চ্যাট জিপিটি থেকে নেওয়া।)