মনে রবে কিনা রবে আমাক পর্ব-১২

0
15

মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা

পর্ব -১২

শীত আসি আসি করছে, শহর জুড়ে দারুণ একটা শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে গতকাল। লাবণ্যরা এসে পৌঁছেছে রাতে।
তারপরে ফ্রেশ হয়ে ভিডিও কল দিয়েছিলো অরণ্যকে,জনাব কথা বলেছে কম, মুখটা ছিল থমথমে।
লাবণ্য খুব হাসি পাচ্ছিল, কী অভিমানি ছেলেরে বাবা!
বিয়েবাড়িতে এত লোক, তার মধ্যে এত কথা বলা যায়! উনার ডিমান্ড আবার ভিডিও কল। ওরে বাবা বসতে পারে না, শুতে চায় অবস্থা একদম।

অরণ্যদের অবশ্য পরীক্ষা চলছে, এ মাসের শেষের দিকে শেষ হয়ে যাবে।
লাবণ্য দেখা করার কথা বলেছিল, অরণ্য বলেছে পরীক্ষা শেষ হলে।
লাবণের মনটা কিঞ্চিত খারাপ হয়েছে। যাক, ওর নিজেরও ব্যাপক পড়াশোনা, ওর পরীক্ষা সামনে।

বিয়েবাড়ির সব কথা অরণ্যকে বলা যাবে না,
বিশেষ করে ওর বিয়ে নিয়ে এত কথা হয়েছে ওখানে।, মেজাজ খারাপ লাগছিল খুব লাবণ্যর।
তারপর, এর মধ্যে বাবা সবাইকে বলেছে
সবাই যেন ছেলে দেখে লাবণ্যর জন্য। সোনার টুকরা মেয়ে তার আরও কত স্তুতি বাক্য।

আয়নার সামনে দাঁড়ালো লাবণ্য, নিজের ভিতরের অস্থিরতা টুকু আয়নায় আবিষ্কার করল।
একটা নি:শ্বাস ফেললো, বাবাকে কিভাবে রাজি করাবে জানে না।

তখনই ফোনটা বেজে উঠল

“আবার ফোন করলে যে?”

“তোমাকে কি বারবার ফোন করতে মানা? নাকি এটা তোমাদের বিয়ে বাড়ি? রেখে দিই তাহলে!”

“এত রাগ কোথা থেকে পাও তুমি?” হাসছে লাবণ্য। “সব বুঝি আমি। আমার উপরে রাগ দেখাচ্ছ। অথচ নিজেকে দেখা করবে না, সেটার কী?”

“দেখা করব, কাল বিকেলে। নিজেকে আটকাতে পারছি না। কালো জাদু করেছ নাকি?”

“না, সাদা জাদু।”

“আচ্ছা, শাড়ি পরে আসব হলুদ?” হাসে লাবণ্য।

“তোমার ইচ্ছা। এরপর কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না।” কন্ঠে স্পষ্ট দুষ্টামি।

“কিসের জন্য?” অবাক হল লাবণ্য।

“তোমার মাকে দেওয়া তোমার কথা ভেঙে গেলে।”

বুঝতে খানিক সময় লাগলো লাবণ্যর।
“তুমি খুবই অসভ্য! পরব না শাড়ি। যাও।”

“ম্যাডাম ভয় পেলেন?”

“চুপ!”

লাবণ্য ফোন রেখে আয়নার দিকে তাকালো। মুখ লাল হয়ে গেছে। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল আপন মনেই, “বিয়ের আর কত দেড়ি লাবণ্য, দুই দিকেই তো অস্থিরতা।”
__________

হলের টানা বারান্দায় দুপুরের পরন্ত রোদের লুকোচুরি , কয়েকটা চড়ুই পাখি তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। একটা মা বেড়াল আয়েশ করে এক কোনে চোখ মুদে আছে, শরীরে যেন শীতকালের আলস্য। শীত শীত তবুও একটা উষ্ণতা তূর্যদের ঘরটায় ছড়িয়ে আছে যেন। বিছানার চাদরে গা মুড়ি দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে অরণ্য। হাতে এক কাপ আধা খাওয়া চা, যার ধোঁয়া এখন আর নেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। পড়া গুলো ঝালিয়ে নিচ্ছে আজানের পরেই বের হবে, মুখে হাসি ফুটলো। লাবণ্যকে কাল ভরকে দিলেও নিজেকেও বিশ্বাস করে না অরণ্য, ইদানিং লাবণ্যকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে আর…. মাথা ঝাকালো নাহ! বিয়েটা দ্রুত করে ফেলতে হবে।

তূর্য জানালার ধারে বসে আছে, হাতে নোটবুক, নতুন আসা চিঠিটা আবার পড়ছে। সেদিন চিঠিটা পেয়ে, মনে হচ্ছিলো কোন যুদ্ধ যেন জয় করেছে।

অরণ্য হাই তুলে বলল,
“তুই বল তো আজ ওই শেষ প্রশ্নটা কি শয়তানি ছিল না?”

তূর্য হেসে ফেলল,
“শয়তানও এমন ফাঁদ পাততে পারে কিনা সিন্দেহ! কি অবস্থা, আমি তো প্রশ্ন দেখে প্রথমে নিজেকেই সন্দেহ করলাম, আমি কি সত্যি পরিক্ষার হলে নাকি কোন স্বপ্ন।”

অরণ্য চায়ের কাপটা উঁচিয়ে বলল,
“আহা! তুই ব্যাটা,প্রতিবার এমন ঢং করিস। যাক সব উত্তর তো দিছি। একটু পর যাব আরেক জনের পরিক্ষা নিতে।”

তূর্য চোখ টিপে বলল, “সে আবার না তোর পরিক্ষা নেয়।”

দুজনেই হেসে উঠল। তূর্য আবার চিঠিতে দৃষ্টি ফেরালো।

প্রিয় তূর্য সাহেব,
আসসালামু আলাইকুম।
আপনি কি আমাকে মিস করছেন?আমাকে করছেন না আমার চিঠিকে করছেন, অর্থাৎ আমার কথাকে! আপনি ওরকম একটা স্ট্যাটাস কেন দিয়েছিলেন?জানেন আমি কত কষ্ট পেয়েছিলাম! আমি তো আপনার শক্তি হতে চেয়েছিলাম, আপনার কষ্টের একটা নিরাময়। আপনি আমাকে বানিয়ে দিয়েছেন…….. থাক সেসব কথা! সামনে পরীক্ষাটা ভালোমতো দেন। আরেকটা কথা আপনার হৃদয় কি এখনো সেই মেয়েটার রাজত্ব! যদি থাকে তবে ভালো করে সিগারেট খান, আপনার কলিজাটা জ্বলুক সাথে সেই মেয়েটা। আর যদি আপনার হৃদয়ে সে না থাকে, অন্য কেউ অল্প একটু জায়গা নিয়ে থাকে তবে তাকে পোড়াবেন না প্লিজ।

আমি কে? আপনি আমার একটা নাম দেন তো।

__________

আজকের বিকেলটা অন্য রকম লাগছে লাবণ্যর যেন কতদিন পর দেখবে অরণ্যকে অথচ ওদের পারিচয়টা হয়েছিল কি হাস্যকর ভাবে। লাবণ্য একটা হলুদ তাঁতের শাড়ি পড়েছে। আজকেও হাতগুলো খালি, অরণ্যকে একটা পরীক্ষা করতে চায়। দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডি লেক এর কাছাকাছি। অরণ্য আসলে কোন একটা রেস্টুরেন্টে যাবে।

“এই যে ম্যাডাম, আপনার তো অনেক ইচ্ছে মায়ের কথা ভাঙার।” ফু দিয়ে লাবণ্যর চুল উড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিস করল অরণ্য। ঠান্ডা আবহাওয়া নাকি অন্য কিছু কে জানে লাবণ্য কেঁপে উঠলো মৃদু।

“তুমি কোন দিক দিয়ে আসলে?আমি তো রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কালো জাদু জানো নাকি?” এক হাত কোমরে রাখলো লাবণ্য। রেগে গেছে যেন। অরণ্যকে দেখছে, সবুজ একটা টি-শার্ট পরেছে এটা লাবণ্যর দেওয়া, চুল আর্মি কাট দিয়েছে।

“জ্বি না আমি আরও পনেরো মিনিট আগেই এসেছি…আপনাকে দূর থেকে দেখছিলাম। অবিবাহিত ছেলেকে বিয়ের তাড়া দিচ্ছেন কেন?”

“আ আমি কি করলাম?আর এরকম চুল কেটেছো কেন?” মাথা নাড়লো লাবণ্য।

“বউ এর দু:খে…বউ হবে তখন চুল বড় রাখবো বউ এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো। বউ চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। আহ!”

লাবণ্য কপট রাগে মুখ বাঁকায় “ ন্যাকামি যত্তসব।”

রেস্টুরেন্টের একদম কর্নার টেবিলে বসল অরণ্য জায়গাটা আধার আধার।

খাবার অর্ডার দিয়ে ধীরেসুস্থে মোবাইলটা বের করে লাবণ্যর পোস্ট করা ভিডিও গুলো বের করল। সবাই মিলে গানের কলি খেলছে আর এক কোনে বসা ভদ্র চেহারার একটা যুবক এক দৃষ্টিতে লাবণ্য কে দেখছে। কয়েকটা ভিডিও প্লে করল অরণ্য সব গুলাতেই এই ভদ্রলোকের তাকিয়ে থাকা কমন। অরণ্যের মুখ থমথমে।

চুপচাপ বসে আছে দুইজন,বাইরের আলো ভেতরে ঠিকমতো আসছে না, আলো-আঁধারিতে লাবণ্যর মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে, চোখে স্পষ্ট অস্বস্তি।ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে, ও বিষয়টা লক্ষ্যই করেনি। শুকনো ঢোক গিললো। ব্যাটার শকুনের দৃষ্টি মাইরি… মনে মনে আউড়ালো।

লাবণ্য আস্তে করে অরণ্যের হাতে হাত রাখলো
“খুব রাগ করেছো? আমি না খেয়ালই করি নাই। সত্যি।”

অরণ্য মোবাইলটা টেবিলে রেখে চোখ তুলে তাকাল, চোখে থাকা কঠিন অভিমান স্পষ্ট
“রাগ করার মতো কিছু হয় নাই? আমি তো ভয় ও পেয়েছি।”

লাবণ্য তাড়াতাড়ি কিছু বলতে যাবে, অরণ্য থামিয়ে দেয়।
“তুমি জানো না লাবণ্য, ওই ভিডিওতে ওর চোখে যা ছিল… আমি হাজারবার দেখেছি, বারবার প্লে করে দেখেছি। খুন করতে ইচ্ছে করছে এই ভদ্রলোককে। ”

লাবণ্য মিনমিন করে বলে, “ এত রাগ হচ্ছ কেন? বাদ দাও না। বিয়ে বাড়িতে মানুষ এরকম তাকায়…”

“যার দিকে ইচ্ছে তাকাক, শুয়ে পড়ুক কিন্তু তোমার দিকে….”

এবার লাবণ্য হেসে ফেলে, “ ওরে বাবা এত্ত হিংসা…শুন উনি আমার মামাত বোন আশার ভাসুর। তাও আবার দূরসম্পর্কের বিসিএস ক্যাডার। হতে পারে না পুরো বিষয়টা কাকতালীয়?”

“না লাবণ্য, হতে পারে না, তোমাকে দেখছিল।”
অরণ্যের কণ্ঠে ঈর্ষা ছিল আর ছিল একটা আতঙ্ক।

লাবণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর শান্ত গলায় বলে,
“আচ্ছা, তুমি কি বিশ্বাস করো আমি এসব পাত্তা দিই? বাদ দাও না।” লাবণ্য এক মুহূর্ত থেমে অরণ্যের চোখে তাকায়।
“তুমি কি এখনো বিশ্বাস করো না আমি তোমার?”

এই কথা অরণ্যের বুকে গিয়ে লাগে,অরণ্য নিচু গলায় বলে, “বিশ্বাস করি। কিন্তু ভয় পাই… হারিয়ে ফেলবো ভেবে। এই লোক বিয়ের প্রস্তাব দিলে? এই প্রেম ভালোবাসা এগুলোর কোন মূল্য নেই যতক্ষন না আমরা বিয়ে করছি।”

লাবণ্য এবার হাত বাড়িয়ে অরণ্যের হাতটা চেপে ধরে, “ আমি দু:খিত, আমার সত্যি হয়ত উচিৎ হয় নি সেজেগুজে বিয়ে বাড়িতে যাওয়া।” কন্ঠ ভার হয়ে আসে, দৃষ্টি আরেকদিকে ফেরায়। অরণ্যর রাগী রাগী চেহারাটা ওর সহ্য হচ্ছিল না।

একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে অরণ্য। “তুমি কাউকে তোমাকে দেখতে দিও না লাবণ্য, এমনভাবে অন্তত। আমার বুকের ভেতর খুব জ্বলে।আমি জানি হয়ত এটা ঠিক না, কিন্তু…”

লাবণ্য একবার হেসে ফেলে,
“তাহলে আমি জ্বলে উঠলে এত কথা শোনাও কেন?”

এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা… তারপর দুজনেই হেসে ওঠে, এরপর, আকস্মাৎ ওর হাত ধরে অরণ্য বলল, “আগে চল তোমাকে চুড়ি কিনে দেই, আজ ও হাত খালি।”

“না, লাগবে না.. মুখ অন্যদিকে ফেরালো খুশি লুকাতে।

লাবণ্যর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অরণ্য সব ভুলে গেল। চুড়ি কিনে রিক্সায় করে এক সাথে খানিক ঘুরতে ঘুরতে লাবণ্য আইসক্রিম নিল। অরণ্য খেয়াল করলো লাবণ্যর ঠোঁটের কোনে আইসক্রিম লেগে আছে। আঙুল স্পর্শ করে মুছে দিতেই লাবণ্য চমকে গেল!

“কি হল?”

“সীমার মধ্যে থেকেই তোমাকে সাহায্য।” হাসে অরণ্য।

“মানে কি!”

“মানে আজ তুমি বউ হলে আঙুল না ঠোঁট স্পর্শ করে দিতাম আরকি!”

লাবণ্য লজ্জা পায়, অরণ্যর হাতের বাধন শক্ত হয়।

_____________

তটিণীর ইদানিং মন-মেজাজ একেবারে ফুরফুরে থাকে, উচ্ছল প্রানবন্ত সারাদিন। আয়নায় শ’খানিকবার নিজেকে দেখে, নিজেই হেসে ফেলে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাবে উদাস হয়ে যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবার পরমুহূর্তেই গুনগুনিয়ে গান ধরে। এসবের পিছনে আছে ওর চিঠি, যেটা সে তূর্যকে লিখেছিল। আর তারই উত্তর হিসেবে তূর্য ওর প্রোফাইলে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। তটিনী বেশ বুঝতে পারছে৷ চিঠিতে ওর কথাগুলোর উত্তর দিয়েছে তূর্য, ছবিতে আর গান অথবা কবিতায়।

তটিণী প্রতিদিন সেই স্ট্যাটাসটা পড়ে। চোখ বুঁজে বারবার মনে গেঁথে নেয় লাইনগুলো, পুরো মুখস্ত যাকে বলে।

“আমি তোমার ভালোবাসা চাই
তাই তোমায় ভালোবেসে যাই
বলো আমার এমন চাহিদায়
কি মন দেয়া যায়
জীবন দেয়া যায়
হৃদয় দেয়া যায়
মন ঘুমায় তোমার কোলে হায়
চিনি না তোমায়
অনামিকা বলে ডাকতে পারি কি তোমায়?”
– রূপম

তার সাথে একটা ছবি—ধূমপানকে না বলুন।
প্রথম দিন ছবিটা দেখেই হেসে ফেলেছে তটিণী। সবাই নিশ্চয়ই ভাবছে, রোমান্টিক কবিতার পাশে এমন ছবি! কতই না বিরোধিতা! কিন্তু রহস্য শুধু ও জানে, কি মজা! এই মুহুর্ত আর এই সময়টাই তটিনীর জীবনের সেরা সময়।

আজ হঠাৎ কী মনে হতে কয়েকটা লাইন কপি করে গুগলে সার্চ দিল। জানতে চায়, এই স্ট্যাটাসের লাইনগুলো আদৌ কবিতা, না গান?

আরে এটা তো গান। তাও আবার কী ভয়ানক রকমের গান! আল্লাহ! পুরো লিরিক পড়ে তটিণীর কান রীতিমতো গরম হয়ে গেল! ভাগ্যিস ভদ্রলোক, মানে তূর্য, বেছে বেছে শুধু নিরীহ কিছু লাইন তুলে দিয়েছে, নইলে তটিণী তো লজ্জায় একা একাই শেষ হয়ে যেত।

তটিনী চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দেয়।হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবনায় ঢুকে পড়ে একটা চেহারা তন্দ্রা আপু।একটা সময়… এমন কিছু কি তন্দ্রা আপুর সাথে তূর্যের জীবনেও ঘটেনি? দুজনের ভালোবাসার দিন গুলো। মানুষ কিভাবে পারে ভালোবাসা ভুলে যেতে?

এইসব ভাবতে ভাবতে একটা সাদা কাগজ তুলে নিল তটিণী। শুরু করল একটা চিঠি লেখা,এই চিঠিটা পোস্ট করবে। কিছু স্টিকার বের করল ড্রয়ার থেকে।

ঠিক তখনই মা দরজায় টোকা দিল,

“তটু মা, পড়ছো?”

তটিণী চিঠিটা তাড়াতাড়ি ড্রয়ারে রাখে। “ না মা তুমি ভেতরে এসো।” ওর মা কলেজের প্রফেসর, খুব শিষ্টাচার মেনে চলা মানুষ, মেয়ের রুমেও দুম করে ঢুকে পরে না। অপরদিকে ওর ব্যাবসায়ী বাবা হাসতে হাসতে খিস্তি করে। পুরাই বিপরীত দুইজন অথচ কোথাও খুব কাছাকাছি যেন।

“কি ভাবছিস?” ওর মা ওর মাথায় হাত রাখে, অরণ্যের ঐ বন্ধুর কথা।

“ মা….. এই বিষয়ে এত ক্ষেপাও কেন?” মৃদু হাসে মাকে সব বলেছিল কোন এক মন খারাপের দিনে কারন মা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।

“যেন তুই বিষয়টা ভুলে যেতে পারিস সোনা! ভুল মানুষকে মনে রেখে কি লাভ?আয় চুল বেধে দেই। তোর বিয়ের কথা তোর বাবা প্রায় বলে।”

“ বলুক।” মুখ শক্ত করে, তটিনী “অন্তত আরও দুই বছর থাকি না তোমাদের সাথে।”

“আচ্ছা বাবা,আমিও তাই বলেছি।”

“মা!”, মৃদু ডাক দেয় তটিনী বলে দেবে মাকে? পরে ভাবে না আগে তূর্য নিজের মুখে বলুক তারপর।

“ কিছু বলবি?”

“উহু।”

_________________

দেখতে দেখতে আরো ছয়টি মাস কেটে গেল, লাবণ্য খেয়াল করেছে, ওর মানসিক সমস্যার বিভিন্ন লক্ষন গুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে।

বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। জানালার বৃষ্টি জলের ছিটা আর বৃষ্টির শব্দ। মনে পুরোনো স্মৃতির আনাগোনা লাবণ্য জানালার ধারে বসে আছে। ওর চোখের সামনে এক সময় একটা ট্রিগার ছিল আগুন, অন্ধকার, আর রাতে বিভিন্ন দূর্ঘটনার আর স্বপ্ন আর হঠাৎ বাজ পড়লে তো কথাই নেই, শরীর কেঁপে উঠতো। একসময় ছিল প্রায় দিন স্মৃতির পীড়া, আতঙ্ক, দমবন্ধ হয়ে আসা।

আজও বাজ পড়ে কোথাও। কিন্তু লাবণ্য চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। কাল ওদের রান্নাঘরেই মায়ের গরম জিনিস ধরার কাপড়ে কি দাউদাউ আগুন লেগেছিল। কিন্তু ও স্থির ছিল, আলহামদুলিল্লাহ।

“তুই ঠিক আছিস?” পাশে এসে দাঁড়ায় ওর মা। “ভয় পাচ্ছিস না তো!”

লাবণ্য একটুখানি হাসে। “ মা,আজ বাজের শব্দে কাঁপিনি,” ও আস্তে বলে। “ কাল আগুন দেখেও স্থির ছিলাম।”

ওর মা বলে, “ আলহামদুলিল্লাহ।” মা মেয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে।

“জানো মা, এসব সবই অরণ্যের জন্য হয়েছে,” লাবণ্যের মুখে এক অপার্থিব হাসি ফুটে ওঠে। চোখে একধরনের শান্তি, নিজের ভিতরের ভয়টাকে হারিয়েছে অরণ্যের ভালোবাসায়।

ওর মা জানালার পাশে আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়ায়, মুখের ভাব একটু চিন্তিত, “তুই এভাবেই আগের সব বাজে স্মৃতি ভুলে যা মা… খুব ভালোবাসিস বুঝি, ঐ অরণ্যকে…” এক মুহূর্ত থেমে প্রশ্নটা আস্তে ছুড়ে দিলেন, “ওর পড়াশোনা শেষ কবে?” উনার চেহারার একটা চিন্তার ছাপ।

লাবণ্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজার কাছে বাবার গলা, “মা-মেয়ের এত কি গল্প? এসো ডাইনিং এ, নাস্তা খেতে খেতে গল্প করি।”

ডাইনিং টেবিলে বসেছে সবাই। টেবিলজুড়ে গরম পুড়ির ঘ্রাণ। বাবার কাজ লাবণ্য হাসে। এখনো বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টির দিনে তেলেভাজা জিনিস লাবণ্যর খুব প্রিয়।

হঠাৎ বাবার গলা একটু যেন গম্ভীর হয়, “একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। আশার মামাতো ভাসুর, আকাশ।” বলে মা মেয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেন, দুজনের মুখে কেমন হঠাৎ ম্রিয়মান হয়ে আছে, “ বিয়েতে দেখেছ তোমরা, বিসিএস ক্যাডার, এডমিন সার্ভিসে, বর্তমানে সহকারী কমিশনার—জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পোস্টিং।”

চায়ের কাপ থেমে যায় লাবণ্যের হাতে, কি বলছে বাবা এগুলো।

মা পাশ থেকে হালকা হাসেন, “ছেলে তো ভালো, তবে এখন তো লাবণ্য পড়ছে। পড়া শেষ হোক আগে…”

লাবণ্যর বাবা চোখ তুলে তাকালেন, সে চোখে স্পষ্ট শাসন, নরম অথচ দৃঢ় স্বরে বলেন, “দেখো, একবার দেখা মানেই তো আর বিয়ে হয়ে যাওয়া নয়। আমি আমার মেয়ের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখি। ওর পছন্দ, ওর মতামত, সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি জানি, আমার পছন্দ ওর অপছন্দ হবে না।”

ঘরের মধ্যে হঠাৎ এক ধরনের নীরবতা নেমে আসে। কেবল বাইরের বৃষ্টির…. হঠাৎ একটা তীব্র বজ্রপাত আকাশ কাঁপিয়ে বাজ পড়ে কাছাকাছি কোথাও। লাবণ্য চমকে উঠে, চায়ের কাপটা পড়ে যায় হাত থেকে। ডুকরে কেঁদে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে যায়। আবার ওর ভয় ওকে গ্রাস করলো প্রিয়জন হারাবার ভয়।

চলবে….

#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা