মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
১৪
আজ তূর্য রিলিজ পেয়েছে, হলেও ফিরে গেছে। তটিনী অনেক কিছু রান্না করে পাঠিয়েছে। তবে এর মাঝে কথা হয়নি আর। কেমন একটা অন্যরকম অনুভব লাগছে যেন।
আজ ফেসবুকে গিয়েই দেখে এই মানুষের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। সাথে সাথেই একসেপ্ট। একটু পরেই টুং করে একটা মেসেজ আসলো—
প্রিয় তটিনী (আমার অনামিকা)
ভালোবাসা জিনিসটা কি সত্যি কোনো সংজ্ঞায় ধরা যায়? কেউ পারে?
তবে এইটুকু বুঝি, যখন কাউকে না দেখে মন কেমন করে, যখন তার নাম শুনলে ভেতরে একটা হাল্কা কম্পন হয়, যখন দিনের শেষে চোখ বন্ধ করলেই তার মুখটাই মনে পড়ে, তখন সেটা কিছু তো একটা হয়ই—ভালোবাসা না হোক, মায়া তো বটেই। তাই না?
আমি জানি, আমি তোমার মনের জগতে আজ বহু বছর, কিন্তু তুমি হয়তো ভাবতেও পারবে না তূর্য নামে কেউ তোমাকে ঘিরে নিজের জগৎ সাজিয়ে ফেলেছে। এর কৃতিত্ব তোমার!
আমার তোমাকে নিয়ে গল্প লিখতে ইচ্ছে করে, তবে হুমায়ূন আহমেদের মতো কোনো ট্র্যাজেডি গল্প না।
আমি তোমার সাথে আমার ভারি বর্ষায় ভেজা প্রেম, নদীর পাড়ে বসে বলা কথা, সমুদ্রের ঢেউয়ে পা ভেজানোর উচ্ছ্বাস—এসব নিয়েই গল্প লিখতে চাই। আমাদের গল্প, যেখানে আমার চশমাটা তুমি যত্ন করে তোমার শাড়ির আঁচলে মুছে দাও, আমি তোমার অগোছালো চুলগুলো যত্নে গুছিয়ে দিই—সেই গল্প।
তুমি শুনবে?
তুমি কি জানো, তোমাকে দেখে আমার হিমু হতে ইচ্ছে করে না, হতে ইচ্ছে করে গল্পের কোনো পারফেক্ট চরিত্র। যে সারাদিন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে ক্লান্ত হয়ে নীড়ে ফিরে বলে—
“তটিনী, তুমি থাকলে আমার আর কোনো বৈজ্ঞানিক থিওরি লাগবে না, তুমিই আমার চূড়ান্ত সত্য।”
তুমি যেদিন একটা মেরুন শাড়ি পরে, কানে ছোট্ট দুল, হাতে চুড়ি… আসবে কাছাকাছি—
আমি সেদিন লাজুকভাবে তোমার সামনে দাঁড়াবো, হাতে একটা সাদা গোলাপ, আর বলবো—
“তটিনী, বউ হবে আমার? প্রেম ভালোবাসায় আমার বিশ্বাস নেই!”
ইতি,
তোমার তূর্য।
মেসেজটা হাজার বার পড়ে ফেললো। দুই হাতে মুখ ঢেকে হাসতে লাগলো—এত আনন্দ কেন লাগছে?
আরেকটা মেসেজ আসলো—
“উত্তরটা চিঠিতে চাই।”
সেটা দেখে ওর বুক আরও কাঁপতে লাগলো। দ্রুত হাতে আলমারি খুললো, মেরুন শাড়ির খোঁজে।
—
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরে এসেছে লাবণ্য, মা বকাবকি করেছে—স্বাভাবিক, বাসা কাছাকাছি হলেও রাত এখন।
লাবণ্য কিছু না বলেই রুমে চলে যায়।
মোবাইলটা হাতে নেয়, প্রায় পঞ্চাশটা মিসকল অরণ্যের।
ও নাম্বার ব্লক করে, মেসেজ না পড়েই ডিলিট করে দেয়।
বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধোয়, তক্ষুনি বাথরুমের আয়নায় নিজের দিকে তাকায়। নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে, একটা শিহরণ বয়ে যায় তনু মনে,সেই ঘটনা মনে করে। আশ্চর্য, রাগটা মরে আসছে।
অরণ্যের স্পর্শ ওর তো অনাকাঙ্ক্ষিত না।তাই বলে এভাবে? নিজেকে বকে দেয় লাবণ্য। কাজ হয় না, একটা মৃদু হাসি মুখে ছড়িয়ে যায়।
পাগল একটা!
লাবণ্য কি কাগজ যে তাতে অরণ্য স্ট্যাম্প বসাবে!
ঘরে এসে প্রথমেই আশাকে ফোন করে।
“আসসালামু আলাইকুম।”
আশার কণ্ঠ খুশি খুশি। খুব চাইছে বিয়েটা হয়ে যাক। খুবই যোগ্য পাত্র।
“শুন আশা, তোর বিসিএস ক্যাডার ভাসুরকে আমি বিয়ে করতে পারব না। উনি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতেন তাও করতাম না। এখন এই বিয়েটা তুই ভাংবি। কিভাবে, আমি জানি না।”
“পাগল তুই? এত ভালো সম্বন্ধ কেউ হাতছাড়া করে? তাও কার জন্য? সে ছেলেকে খুব ভরসা করছিস, তাই না?”
“পাত্র যখন এত ভালো, তুই নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একে বিয়ে করে ফেল। আমার মাথাটা খাবি না।
অরণ্য ভালো হলেও আমার, মন্দ হলেও আমার।
তুই বিয়েটা কিভাবে ভাঙবি, আমি জানি না। আধা ঘন্টার মধ্যে আমাকে ফোন করে বলবি দিয়ে ভেঙে গেছে।
আমি কেরোসিন কিনে নিয়ে এসেছি, ফেসবুক লাইভে এসে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিব, তুই দেখবি?”
“কি বলছিস এসব! আমি ফুপাকে এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি।” চিৎকার করে উঠলো আশা।
“চৌদ্দগুষ্টি সবাইকে ফোন দে। আমি একটা সিল্কের ড্রেস পড়া আছি, আগুন খুব দ্রুত লাগবে। তাই তুই দ্রুত এখন বিয়েটা ভাঙ্গ অথবা আমার লাইভ ভিডিওটা ইনজয় করিস।রাখলাম।আর এসব কথা ফাঁস হলে আমিও তোর বহু কিছু ফাঁস করে দেব, মীরজাফর ম্যাডাম।”
২০ মিনিট পরে, লাবণের মা এসে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে।
“লাবণ্য, বিয়েটা… ওরা আসছে না তোকে দেখতে আর! তোর মামা ফোন দিয়েছিল। আশা নাকি চাচ্ছে না এক পরিবারে দুই বোন যাক। তোর মামা মন খারাপ করেছে। নিজের মেয়েকে গালমন্দ করেছে, কিন্তু কিছু তো করার নেই।”
লাবণ্য হাসলো। দুনিয়াটা হল শক্তের ভক্ত, নরমের যম।
মনে মনে বললো—এবার অরণ্য, তোমার পালা।
___________
অরণ্য ক্লান্ত হয়ে হলে ফিরে এসেছে। অনুশোচনার ছাপ ছাপিয়ে মনে একটাই চিন্তা—লাবণ্য কেমন আছে? একটা ফোনও ধরে নি, উপরন্তু এখন ব্লক করে দিয়েছে। এত নিষ্ঠুর কেন এই মেয়েটা? অরণ্য কি ওর কেউ না? কী করবে ভাবছে! তটিনীকে ফোন করল অনেক ভেবে।
লাবণ্য এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভালোবাসা মানে কি আধিপত্য, ছিনিয়ে নেওয়া, নাকি জয় করা? অরণ্য তো লাবণ্যকে জয় করেই নিয়েছে, তবু এত ভয় কেন ছেলেটার? লাবণ্য কি বলেনি—ও শুধু অরণ্যের? চা খাচ্ছে ছোট ছোট চুমুকে। ভালো লাগছিল। মাথায় অরণ্যের গায়ের ঘ্রাণটা টোকা দিচ্ছে… ধুর… তবুও সেই মুহূর্তগুলোই চোখের সামনে যেন।
অনেক বড় একটা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ঝোঁকের মাথায় আশাকে ফোনটা করেছে বলেই করতে পেরেছে। তা না হলে এই বুদ্ধি ওর মাথায় আসতো না। কিন্তু অরণ্যকে নিয়ে কী করবে? একটা কঠিন শাস্তি দিতে হবে। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল ওর। তটিনী। নিশ্চিত অরণ্য ফোন করিয়েছে।
“আসসালামু আলাইকুম দোস্ত, কি খবর?” তটিনীর খুশি খুশি কণ্ঠ, “আমার ভাই আবার কী করল?”
“তোর ভাই আমাকে তন্দ্রার সাথে তুলনা দিয়েছে। কত বড় কলিজা ভাব একবার। শোন, তোর ভাইকে বলে দিস রাতে যেন শান্তিতে ঘুমায়। আমি বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি।”
“আচ্ছা বলব!”
“আরেকটা কথা বলবি—যেটা করেছে তার শাস্তি পাবে। আগামী দুই মাস তার সাথে আমি কোনো কথা বলব না। কোনো মাধ্যমেই না। কোনোভাবেই যেন চেষ্টা না করে।”
“আরে লাবণ্য, মাফ করে দে না দোস্ত। রাগে বলেছে এই কথা। রিয়ার ব্যাপারটা কী দরকার ছিল জানানোর?”
“নিজের আপন মানুষটাই তো আমাকে কথার আঘাত দেয়। অন্যদের আর কী দোষ! যা বলেছি, বলে দিস। ওকালতি করবি না একদম।”
“আর কী করছে?”
“কিছু না। এতটুকুই বল।”
ফোন রেখে লাবণ্য আকাশের দিকে তাকালো। তোমার থেকে পাওয়া এমন কোনো দুঃখ আমি অন্যকে বলতে পারি না—যা তোমাকে ছোট করে। আমি তো বারবারই বলি, অরণ্য, আমি তোমার। তবুও তোমার কিসের এত সন্দেহ?
______________
ঢাকার অদূরে ১০০ ফিটের একটা রিসোর্ট। চারিদিকে জলাশয় দিয়ে ঘেরা, আর ফুলের বাগান সব জায়গায়। খোলা মস্ত মাঠ, কী যে সুন্দর! সকালের রোদে সেই দীঘির জলে হালকা ঝিলিক।
তটিনী সকাল সকাল এসেই উপস্থিত, মেরুন শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি আর ছোট কানের দুল। ওকে নামিয়ে দিয়ে রিয়া কৌতুক করেছে,
“যাবার সময় তো তার কোলে চরেই যাবি, জানা কথা।”
“হুশ!” কৃত্রিম রাগ দেখায় তটিনী। বুক অসম্ভব কাঁপছে, তবে এই অনুভূতির দহন উপভোগ করছে। জানে, একসময় এরকম থাকবে না সব।
টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই ফোন বেজে উঠে,
“তুমি গেটেই দাঁড়িয়ে থাক, আমি আসছি। কাছাকাছি আছি দেখেছি।”
তটিনী আনমনে হাসে—বাহ! ভালো উন্নতি, একেবারে তুমি দিয়েই কথা শুরু।
পেছন থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠ,
“এতক্ষণ ধরে ভাবছিলাম, তুমি আসবে তো? তোমাকে দেখে জানো, অন্যরকম একটা শান্তি লাগছে।”
তটিনী চমকে চোখ তুলে তাকায়। এখন তূর্য একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একটা নেভি টি-শার্ট পরেছে, মুখের দিকে অবশ্য তাকাতে পারছে না। একটা অস্বস্তি লাগছে কেমন।
“না আসার মত কোনো সংকেত কি আমি দিয়েছি? জায়গাটা সুন্দর, তবে বেশ ভেতরে।”
“চল হাঁটি, ভেতরে জলাশয়ের পাশে বেঞ্চ পাতা আছে, গাছের নিচে… এত সুন্দর।” এরপর তটিনীকে দেখতে দেখতে বলল,
“বাহ! তুমি পুরো আমার কথামতো তৈরি হয়ে এসেছো। যেন কোনো কবির কবিতার মতো তার প্রেয়সী সেজে এসেছে…”
তটিনী হালকা হাসে,
“কবিতা খুব পছন্দ মনে হয়? লেখেন নাকি?”
ওরা ততক্ষণে অসম্ভব সুন্দর জায়গাটায় চলে এসেছে। পাশাপাশি বসে একদম নিরিবিলি জায়গাটা। তটিনীর গায়ে কাঁটা দেয় কেমন।
বিশ্বাস কী দারুণ জিনিস! বিশ্বাসের ভুলে মানুষ কত বিপদে পড়ে।
“হ্যাঁ, কবিতা খুব পছন্দ, একটু বেশি। কিন্তু লিখতে পারি না। তুমি বেশ চিঠি লেখো। আজ আনোনি?”
“আপনার লোভ বেড়ে যাচ্ছে!” হাসে তটিনী, “কতগুলো দিলাম ঐ দিন।”
তূর্য দীঘির দিকে তাকিয়ে হাসে,
“আমি সারাজীবন এমন লোভী থাকতে চাই… তোমার চিঠির।”
তটিনী চুপ করে থাকে। পানিগুলো এত সুন্দর টলটলে… গাছের পাতা কাঁপছে কেমন।
একটা পাখি খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল। তটিনী চোখ মেলে দেখল। তূর্যও তাকালো পাখিটার পেছনে, তারপর একটু চুপ থেকে বলল,
“কিছু কথা আছে, যেগুলো অনেকদিন ধরে মনে ছিল, কিন্তু বলা হয়নি। আজ বলতে চাই।”
তটিনী এবার সরাসরি তূর্যের চোখের দিকে তাকায়। তারপর আস্তে বলে,
“বলুন, শুনছি।”
সারা গা যেন কাঁপছে ওর। সেই কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো তবে কি আর শুনবে? তূর্যের মুখে ভালোবাসার কথা শুনতে কেমন লাগবে? তটিনী লাল হয়ে যাচ্ছে।
তূর্যের চোখে মুগ্ধতা নামে, একটু সাহস করে,
“তটিনী, তুমি সব জানো আমার আর তন্দ্রার বিষয়ে। এই বিষয় নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পার। আজ আমি তোমার সাথে নতুন সম্পর্কে সূচনা করতে চাই। আর কখনো চাই না অতীত আমাদের সামনে আসুক। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”
তটিনী একটু থেমে, শাড়ির আঁচলে আঙুল জড়ায়, শুকনো ঢোক গিলে,
“একটা প্রশ্ন ছিল… আপনি আর তন্দ্রা আপু কি কখনো… মানে?”
“ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম? হ্যাঁ, একবার,” মাথা নিচু করে তূর্য, “আমরা…!”
তটিনীর গা কাঁপতে থাকে,
“কতটা? মানে…!” চোখে পানি চলে আসছে। প্রাণপণে নিজেকে ধরে রেখেছে।
ওর প্রতিক্রিয়া দেখে তূর্য জোরে বলে ওঠে,
“না… না এত কিছু ভাবো না, একবার জড়িয়ে ধরেছিলাম শুধু, আর ওর গালে…।”
এবার তটিনী চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে মনে মনে ভাবে—যাক, ডাইনি গিলে খায়নি।
একটা হাওয়া এসে তটিনীর চুল উড়িয়ে দিল। তূর্য চুল সরিয়ে দিতে গিয়ে থেমে গেল, তটিনীর দিকে তাকিয়ে রইল।
তটিনী ডাক দেয় তূর্য, “কিছু তো বল… শুধু জানতে চাই, তুমি কি জীবনের সফরে… আমার সঙ্গে হাঁটবে?”
তটিনী নরম চোখে তাকায়,
“আপনি আমার প্রথম ভালোবাসা। আপনার সাথে আমি হাঁটব, থামব, দৌড়াব—হ্যাঁ… তবে একটা শর্ত আছে।”
তূর্যের চোখে দুষ্টু হাসি,
“উফ! আবার শর্ত! বলো শুনি।”
তটিনী তূর্যের দিকে লাজুক চোখে তাকায়,
“আজ যেভাবে আমাকে ভালোবাসেন, বাকি জীবনেও যেন সেটা না বদলায়।”
“প্রতিদিন কথা দিচ্ছি, তোমাকে দেখে আবার প্রেমে পড়ব… আরও বেশি ভালোবাসব।”
“সাদা গোলাপ কই আমার?” হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে নেয় তটিনী।
“আমার সাদা গোলাপ তো আমার পাশেই।” জলে একটা ঢিল ছুড়তে ছুড়তে বলে তূর্য। আড়চোখে তাকায়।
তটিনী মুখে দুই হাত চেপে হাসছে…
“আহ! কী বুদ্ধি! ফুল আনতে ভুলে এখন উলটো পালটা উপমা দেওয়া হচ্ছে।”
তূর্য মাথা চুলকায়,
“ফুল আনিনি ঠিকই, কিন্তু যদি চাও, আমরা একটা চিঠির বিনিময়ে একটা ফুল এই চুক্তিতে আসতে পারি।”
তটিনী চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে… কী ভীষণ ভালো লাগে,এবার চোখে সত্যিই জল, তবে সেটা আনন্দের।
__________
দেখতে দেখতে প্রায় পনেরো দিন পার হয়ে গেছে। লাবণ্যর সাথে অরণ্য কোনো কথাই বলেনি এতদিন। মাফ চাওয়ার সুযোগটুকু দিচ্ছে না এই মেয়ে। হলের বেশির ছাত্রের নাম্বার লাবণ্যর ব্লক লিস্টে। সব জায়গায় ব্লক অরণ্য। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।
“হুহ! সারাক্ষণ মুখে ফেনা তোল তুমি আমার, আমার তুমিকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করাতেই এত অপরাধ! আর অপরাধ হলে শাস্তি দিবা, কিন্তু এগুলো কি শাস্তি! আমি আর মানতে পারছি না, তোমাকে দেখার তৃষ্ণা হৃদয় পোড়ায়। কত কথা জমে গেছে জানো? বেয়াদব মেয়ে একটা। একবার বউ হও, গুনে গুনে শোধ তুলব।”
“এই, ঘুমাতে আয়…” ডাক দিল তূর্য। “আরও প্রায় অনেক দিন বাকি তোর শাস্তির, তাই না?”
অরণ্য কপাল কুঁচকে নেয়, “শালা, খুব আমোদ তাই না? তোর সাথেও…!”
দ্রুত ওর মুখ চেপে ধরে তূর্য, “অভিশাপ দিস না দোস্ত, এমনিতেই তোর খালু দেখা করতে বলছে। সেই টেনশনে বিপি লো হয়ে যাচ্ছে।”
অরণ্য হাসে, “আরে দূর, উনি খুব মজার মানুষ। বিয়ে দিয়ে দিবেন ধরে তোদের!”
“তাই?” অবাক তূর্য।
“শুন, আমার নানাভাই এই পাত্রের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে চান নাই। উনি অনেক যুদ্ধ করেছেন আমার খালাকে জয় করতে। উনি ঠাট্টা করে প্রায় বলতেন, কোনো যোগ্য ছেলে তার মেয়েকে পছন্দ করলে সে নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিবেন।”
“আমি কি তার দৃষ্টিতে যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করব?”
“অবশ্যই। এখন চল, ঘুমাই, কাল ক্লাস আছে।”
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে অরণ্য উঠে বসে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, কাল দেখা করতেই হবে লাবণ্যর সাথে। জাহান্নামে যাক শাস্তি।
আজ ক্লাস শেষ করে বান্ধবীদের সাথে বিদায় নিয়ে একটু দোয়েল চত্বরের দিকে যাচ্ছে লাবণ্য। মা কয়টা মাটির জিনিস নিতে বলেছে। আকাশের অবস্থা অবশ্য ভালো না। এরকম মেঘ বৃষ্টির দিনে ওর মন আরও খারাপ হয়। শাস্তি দিল অরণ্যকে, কষ্ট পাচ্ছে ও নিজেই। শুকিয়ে গেছে আরও, সারাক্ষণ দুর্বল লাগে। মন বড্ড বেহায়া আজকাল, শাসনে বেঁধে রাখা মুশকিল। তবুও নিজের জেদ আর রাগ ধরে আছে।
রিক্সা করে ও উঠার সাথে সাথেই পাশ থেকে অরণ্য রিক্সায় উঠে বসলো। বসেই গলা চড়িয়ে বলল, “মামা, একঘণ্টা ঘুরাবেন। নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে নিয়ে যান। হুডটা তুলে দিন।”
লাবণ্য কোনো কথা বলছে না একদম। বুক অসম্ভব কাঁপছে, ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রেখেছে বুকের কাছে, হাতটাও কাঁপছে।
অরণ্য মনোযোগ দিয়ে লাবণ্যকে দেখছে, মনে হচ্ছে যেন একটু রোগা হয়েছে। কি রাগ, মেয়ের বাবা রে বাবা! তাকাচ্ছে না ওর দিকে।
“কেমন আছ?”
লাবণ্য এবার তাকালো অরণ্যের দিকে। মায়া লাগলো খুব বেশি অরণ্যকে দেখে।
“এরকম যদি আমার কথা না শুন, শাস্তির মেয়াদ কিন্তু বাড়বে?”
অরণ্য হাসে, “ম্যাডাম, শাস্তি বাড়লে অপরাধও বাড়বে।”
লাবণ্যর একটা হাত নিজের মুঠোয় করলো।
“অসভ্য, বেয়াদব একটা…!”
“এই পনেরো দিনে যেন পনেরো বছর কেটে গেছে।” অরণ্য বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
“জানো, কথা না বলে থাকাটা আসলে সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তি। তুমি নিজেও তো কষ্ট পাচ্ছ, পাচ্ছ না?”
“আমার কষ্টে কারোর কিছুই এসে যায় না। আমাকে মানুষ তো অন্য নারীর সাথেও তুলনা দেয়… আমার চরিত্র…!”
অরণ্য লাবণ্যের ঠোঁটে নিজের আঙুল রাখলো, শক্ত করেই।
লাবণ্য সেই স্পর্শে কেঁপে উঠলো।
“হুশ! আমি রাগে বলেছি এসব। তুমি কি এটাতেই এত কষ্ট পেয়েছো, নাকি…?”
“সবটাতেই। তুমি ওমন করলে কেন? রাগ উগরে দিলে সব আমার উপর। আমাকে কি ভেবেছো বল?”
“তুমি আমার না?” কথা ঘুরায় অরণ্য।
“হুম।” মাথা নিচু করে লাবণ্য।
“তুমি আমার বলেই একটুখানি আদর করতে গিয়েছিলাম। নিজের রাগ নয় অধিকারবোধ থেকেই… তাতেই তুমি এত রেগে গেলে? সত্যি বল, আমার স্পর্শ তুমি এতটাই ঘৃণা করেছ?”
লাবণ্য এবার চোখে বিস্ময় নিয়েই তাকায়,
“এখনো নিজের সাফাই দিচ্ছ? যা করেছ, তা নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই?”
“আছে! যা করেছি তা নিয়ে না, তুমি কষ্ট পেয়েছো, তাই।”
“থাক। আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না। তোমাকে ভালোবেসেছি, কষ্ট তো পেতেই হবে।”
আরেকদিকে তাকায় লাবণ্য।
অরণ্য অনেকক্ষণ চুপ থাকে,
“তাই! আমি এত খারাপ, লাবণ্য? যে আমাকে ভালোবাসা মানেই কষ্ট! আমি আজ কেন ছুটে এসেছি জানো? কাল স্বপ্নে দেখলাম, তোমার সাথে রাস্তায় দেখা… তুমি আমাকে চিনছ না একদম। আমাকে তোমার মনে নেই। আমি জানো, এরপর থেকে নির্ঘুম। আমার এই ভালোবাসার দাম নেই তোমার কাছে?”
লাবণ্য এবার নিজেই কষ্ট পায়। ও তো এরকমভাবে বলতে চায় নাই।
অরণ্য ওর যেই হাত ধরেছে, তাতে নিজের অন্য হাতটা রাখে,
“সরি। আমি এরকম বুঝাইনি, সত্যি। আমার জীবন যদি নিউজপেপার হয়, তুমি তার হেডলাইন। আমার জীবন যদি গাছ হয়, তুমি তার ফুল। আমার জীবন যদি…”
“থামো… কী সব উপমা, আহা! এখন এত মিষ্টি কথা বলে লাভ নাই।”
ওর গালে হাত বুলিয়ে দেয় অরণ্য মুখে হাসি।
“তুমিও শাস্তি পাবে।”
“কি শাস্তি? নিজের শাস্তি পূরণ করে না,এসেছে মানুষকে শাস্তি দিতে!” ভেংচি কাটে লাবণ্য।
“বিয়ের পর প্রতিদিন তোমাকে ঘণ্টা খানেক জড়িয়ে ধরে রাখব, তাও এমনভাবে…..ছাড়িয়ে যেতেও পারবে না।”
“এটা শাস্তি?” হাসে লাবণ্য। চোখে ছায়া ফেলে সেদিনের স্মৃতি, আর গালে জমে হালকা লাল রঙ।
“এটাকে তুমি শাস্তি বলছ, না নিজের পুরস্কার! বাটপার!”
“আমার দয়ার শরীর তোমার মতো না আমি। শাস্তি দিব এমন, যাতে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ হয়।”
লাবণ্য ভ্রু কুঁচকে নেয়,কি অসভ্য এই ছেলে!
মুচকি হেসে, “আমি কিন্তু পালিয়ে যাব…”
“পালিয়ে দেখাবে পারলে। আমার বুকেই ধরা পড়বে। জানোই তো, তোমার সব রাস্তা আমার দিকেই যায়।”
“সেটা জেনেই তো এত কষ্ট দাও…!”
“আচ্ছা, সরি। বল তো, বিয়ে ভাঙলে কিভাবে?”
লাবণ্য সব খুলে বললো।
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“সত্যি, তুমি তাই করতে?”
লাবণ্য জবাব দেয় না।
“আর কখনো এরকম ভাববে না প্লিজ। তুমি নিজের ক্ষতি করবে, এই চিন্তায় আমি নিজেই স্ট্রোক করে ফেলছিলাম।”
ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে ততক্ষণে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে দুইজনের গায়েই। রিক্সার নীল পলি সংকোচে নেওয়া যায় না। লাবণ্য ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে। অরণ্য হুড ফেলে মাথার উপর ছাতা মেলে দেয়।
তারপর গভীর স্বরে বলে,
“এটা কখনো সম্ভব, তুমি বা আমি একে অপরকে ভুলে যাব? তবুও এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম?”
লাবণ্য আরেকটু সরে আসে অরণ্যের দিকে। ভেজা কাঁধে নিজের মাথা রাখে,
“কখনোই এসব সম্ভব না। তুমি আমাকে হারাতে ভয় পাও, তাই এসব দেখ। এই দেখ, আমি তোমার।”
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা