মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
১৯
রিয়াদ আহমেদ, সাইকিয়াট্রিস্ট, বয়স একত্রিশের কোঠায়, ধীরে পা ফেলছেন লাবণ্যর কেবিনের দিকে। এই রোগীটা তার চেনা। কিছু বছর আগে ট্রমাটিক ইনসিডেন্টের কারনে PTSD-এর চিকিৎসা নিয়েছিল তার কাছেই।মেয়েটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরেছিল।
কিন্তু এখন…গভীর চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। সবটা শুনেছেন ওর বাবার কাছে, মানুষ এভাবেও ভালবাসতে পারে? ভালোবাসা সম্পর্কে, ওর ধারণাটাই বদলে গেল।
লাবণ্যকে মনোরোগ বিভাগে আনা হয়েছে চার দিন হলো। অরণ্যর বিষয়ে অবগত হয়ে, নিজের পুরাতন ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে, মাথায় আঘাত, সব মিলিয়ে সে শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই দারুন বিপর্যস্ত।
লাবণ্যর স্মৃতিতে গোলমাল হয়ে গেছে। এটাকে ডাক্তারের ভাষায় বলে,
ট্রমা-ইনডিউসড ডিজসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া (Dissociative Amnesia) হঠাৎ কোনো ভয়ংকর মানসিক আঘাত পেলে সাধারণত এরকম হয়। লাবণ্যর ক্ষেত্রে ভালোবাসার মানুষ কোমায় চলে যাওয়া, নিজে ফিট হয়ে আঘাত পাওয়া দুইটাই হয়ত ওর স্মৃতি আংশিক বা সম্পূর্ণ মুছে দিয়েছে।
এই অ্যামনেশিয়া হতে পারে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থায়ী।
—
ডা:রিয়াদ আহমেদের চেম্বার। চেয়ারে বসে আছেন লাবণ্যর বাবা, মুখে চাপা উদ্বেগ। রিয়াদ তার টেবিলের ওপারে বসে লাবণ্যের মেডিকেল ফাইলটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডা: রিয়াদ মুখ খুললেন,
“আঙ্কেল, আমি যা বলব, সেটা শুনে ভয় পাবেন না। বরং বুঝার চেষ্টা করুন। লাবণ্যর ট্রমা-রেসপন্সটা একটু জটিল ধরণের। ওর মস্তিষ্কের কিছু অংশে হালকা একটা ছোট আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। তবে বিষয়টা তেমন জটিল নয়।”
লাবণ্যের বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
“তাহলে মানসিক কিছু?”
“হ্যাঁ। ওর এখনকার অবস্থা আমরা ডাক্তারি ভাষায় বলি বলি Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD),মানে খুব গভীর মানসিক আঘাত থেকে তৈরি হওয়া অবস্থা। তার সঙ্গে আছে (Dissociative Amnesia) যার ফলে ওর মধ্যে স্মৃতিভ্রংশ, বাস্তবতা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে।”
লাবণ্যের বাবা নীচু কন্ঠে বললেন,
“কিন্তু… ও তো মাঝে মাঝে ঠিকঠাক কথা বলে! আবার কখনো চুপ করে থাকে। এটা কেন? কখনো খুব স্বাভাবিক কখনো…!
“ঠিক তাই। কখনো কখনো স্মৃতি ফিরে আসে, আবার হারিয়ে যায়। কখনো নিজেকে স্কুলছাত্রী ভাবে, আবার কখনো আজকের ঘটনাও মনে করতে পারে না। কথাবার্তায় অসংলগ্নতা আছে। কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে,কখনো একবার চুপচাপ। আরেকবার হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে। মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, যেন এখনকার সময়টা কোনো বাস্তব জিনিস না। প্রচুর হ্যালোসিনেশন হচ্ছে।”
“ডাক্তার, ও কি… আগের মত হয়ে উঠবে না আর?” কান্না কান্না গলা লাবণ্যর বাবা।
“আমরা আশা হারাচ্ছি না, আঙ্কেল। ওনার যে মানসিক অবস্থা এটা আসলে মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যখন মানসিক আঘাত সহ্য করার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন মস্তিষ্ক নিজেই কিছু স্মৃতি বা বাস্তবতা মুছে দেয়।
“মানে ও ভুলে যেতে চায়…?”
“হ্যাঁ, সেটাই। নিজের অজান্তেই। এটা ইচ্ছাকৃত নয়। তবে ভালো খবর হলো, এই অবস্থার উন্নতি সম্ভব। এর জন্য নিয়মিত থেরাপি, সঠিক ওষুধ, আর সবচেয়ে বড় কথা, ভালোবাসা আর ধৈর্য। আপনাদের ওর পাশে থাকতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে। দুয়া জারি রাখেন। সেই ছেলেটা কেমন আছে?”
“আমার মেয়ের এই অবস্থা আর ওদিকে অরণ্য ছেলেটার অবস্থা ও একই রকম। কোন উন্নতি নেই।”
________________
তিন মাস কেটে গেছে। লাবণ্য এখন সুস্থ, আজ ওর রিলিজ ডেট। ডা:রিয়াদ আহমেদের চেম্বারে আজ শেষ ফলোআপ। ঘরটা নীরব, জানালার পাশে হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে। বাইরের মৃদু আলো ঘরে তীর্যক ভাবে প্রবেশ করছে।লাবণ্যর বাবা চুপচাপ বসে আছেন, মুখে একধরনের ক্লান্ত প্রশান্তি। আজ অরণ্যকে দেখে এসেছেন, অন্য একটা হাসপাতালে শিফট করা হয়েছে অবস্থার উন্নতি নেই।
রিয়াদ তার ফাইল বন্ধ করে রেখে একটু হেলান দিয়ে বসলেন। মুখে সন্তুষ্টির ছাপ, তবে চোখে একটা অজানা বিষণ্নতা।মনটা খারাপ লাবণ্য চলে যাবে তাই।কিন্তু কেন?
“আঙ্কেল… শেষ তিন মাস আমরা যা যা করতে পেরেছি, বলা যায় তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছে। নিয়মিত সাইকোথেরাপি, অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি মেডিসিন, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ওর চারপাশের পরিবেশ। ও আপাতত সবকিছু ঠিকভাবে রেসপন্স করেছে।”
“লাবণ্য এখন… ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ চিনছে।সবকিছুর প্রতি ওর সাড়া ফিরে এসেছে। আচরণ স্বাভাবিক এখন।ওর স্মৃতিগুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে।এখন ও স্থিতিশীল। যদিও কিছু স্মৃতি ঝাপসা থাকবে হয়তো, কিন্তু ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।”
“এই কয়েক মাস… ও একবারও অরণ্যর কথা বলেনি বা আমাদের কথা?”
ড: রিয়াদ একটু চুপ থাকেন,এরপর একটু চিন্তিতভাবে বলেন।
“আপনাদের কথা বলেছে, তবে অরণ্য…না বলেনি।কখনো কখনো মস্তিষ্ক যা ভুলে যেতে চায়, তাকে এড়িয়ে চলে। এই মুহূর্তে এটা নিয়ে চাপ না দিলেই ভালো। আমি আপনাদের একটা পরামর্শ দিয়েছিলাম, মনে আছে তো?”
“কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা?”
“হ্যাঁ। ওকে এই চেনা পরিবেশ,এই চাপ, সম্পর্ক, স্মৃতি, সবকিছু থেকে একটু দূরে যেতে দিন। প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যান। প্রকৃতি একটা ন্যাচারাল হিলিং দেবে ওর ব্রেইনকে।”
“আপনাদের যে কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব…” কথা জড়িয়ে এলো যেন।
“তবে একটা জিনিস… অরণ্যর বিষয়ে ওর এই নিশ্চুপ বিষয়টা, এটুকুই আমাকে ভাবায়। না জানতে চেয়েছে কী অবস্থা, না চেয়েছে দেখতেও। হয়তো এটা একটা মানসিক রক্ষণ… অথবা ভেতরের গভীর কোনো ক্ষত। আমাদের ব্রেইন একটা রহস্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো সব সমাধান করতে পারেনি। কোন অস্বাভাবিক আচরণ দেখলে আমাকে ফোন দেবেন প্লিজ। ”
________________
তটিনীর নতুন সংসার শুরু হয়েছে এ মাসেই। সংসার গুছিয়ে নিচ্ছে অল্প অল্প। প্রথম দিন রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। তূর্য অনেক বকা দিয়েছে…তারপর আদর। অনেক কিছুই তটিনী নিজেই কিনছে তূর্য ছেলে মানুষ বুঝে না তেমন, হাসলো তটিনী।
অরণ্য ভাইয়ার কোন উন্নতি নেই, এদিকে লাবণ্যর এই অবস্থা। রিয়া আর তটিনীকে এক এক দিন চিনেও না, কখনো কি গল্প। সবচেয়ে আশ্চর্য অরণ্য ভাইয়ার কথা তুলেই না একদম।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো ,লাবণ্যর বাবা! তাকে দেখলে মনটাই ভেঙ্গে যায় তটিনীর। কথা শেষ করে আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, অরণ্য ভাইয়া আর লাবণ্য এদের ভাগ্যে কি আছে?নাকি সবকিছু আর ঠিক হবে না?
তূর্য তখনই এসো ওর পাশে দাঁড়ালো। “কে ফোন করেছিল?”
“তূর্য লাবন্যর বাবা ফোন করেছিল, উনি চাচ্ছেন আমিও লাবণের সাথে সিলেট যাই। আমি কি যাব?”
“অবশ্যই যাবে।” ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে নিলো তূর্য, “আজকে অরণ্যকে দেখে আসলাম।শুধু নিঃশ্বাসটা চলছে, আর কিছুই যেন নেই। আমার না ইদানিং খুব ভয় লাগে, ও আবার ফিরবে তো?”
তটিনী তোর চোখে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেলল, “ আমি এসব ভাবতে চাই না। আপনি আমাকে একটি শক্ত করে জড়িয়ে রাখুন।”
ট্রেনে করে সিলেট যেতে যেতে, লাবণ্য বাইরে দৃশ্য দেখছিল। হঠাৎ ওর মনে হলো ওর মুখোমুখি অরণ্য বসা। লাবণ্য নিজে নিজে হেসে ফেলল, “আজকে কিন্তু কোন টাইম ট্রাবল হয়নি। আমি আমার সিটেই বসেছি।”
অরণ্য হেসে ফেলল, “জী ম্যাডাম কিন্তু বাইরে মেঘ করেছে ছাতা এনেছেন কি?”
পাশেই তটিনী বিষয়টা লক্ষ্য করলো, “ এই লাবণ্য কার সাথে কথা বলিস?”
“কেন অরণ্য, ঐ তো ও….!”
তটিনীর গায়ে কাঁটা দিল। জড়িয়ে ধরলো লাবণ্যকে। খুব বুঝতে পারল লাবণ্য মোটেও সুস্থ হয়নি।
লাবণ্যর মামার বাড়িটা পুরোনো, ঘন গাছপালার পাশে ছায়া ঘেরা বারান্দা। পেছনেই টিলামত সব পাহাড়। সন্ধ্যা হলেই লাবণ্য একা একা বারান্দায় বসে থাকে।
চোখে দূরের দিকে তাকানো, কিন্তু ঠোঁট নড়ছে, যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে।
বিষয়টা সবাই খেয়াল করে, একদিন ওর মা খুব খেয়াল করে শুনে ও বলছে।
“তুমি ফিরবে তো? একটু হাত ধরো না প্লিজ… আমি আবার সেই প্রথম দিনের মতো সাজবো তুমি আসলে।” কোনো মানুষ নেই, কেউ নেই পাশে।
___________
ডা. রিয়াদ যখন ফোন পান, তখন রাত ১টা। লাবণ্যর বাবার নাম্বার ওকে চমকে দেয়।
এত রাতে ফোন দিয়ে লাবণ্যর বাবা যা বলেন তার সারমর্ম হল, “ লাবণ্য আগের চেয়ে চুপচাপ, কিন্তু সারাক্ষণ একা একা কারও সঙ্গে কথা বলে।
সে বলে অরণ্য এখনো তার পাশে বসে, তার হাতে হাত রাখে। কখনো দেখে৷ ওর মুখেও হাসি। কখনো কাঁদে।”
রিয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তারপর বলেন
“আমি আসছি।”
বারন্দায় গিয়ে চাঁদের দিকে তাকায় ডা. রিয়াদ, শুরুতে ভেবেছিলেন, হয়তো এ ভুলে যাওয়ার অংশ, হয়তো মস্তিষ্ক নিজেকে রক্ষা করছে কিছু স্মৃতির ব্যাথা থেকে কিন্তু আজ… লাবণ্যর বাবার মুখে কিছু নির্দিষ্ট কথা শুনে, আর নিজস্ব ক্লিনিকাল পর্যবেক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন,লাবণ্য ভুলে যায়নি। বরং সে এত বেশি মনে রেখেছে যে তার মস্তিষ্ক অরণ্যকে ধরে রাখার একটা বিকল্প বাস্তবতা তৈরি করেছে।
লাবণ্য মুখোমুখি হচ্ছে বিভিন্ন কাল্পনিক অভিজ্ঞতার। সে অরণ্যকে দেখতে পায়, শুনতে পায় তার কণ্ঠ, অনুভব করে তার উপস্থিতি,যদিও বাস্তবে অরণ্য সামনে নেই।আএটা হল হ্যালুসিনেশন।স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে আটকে আছে লাবণ্য।তিনি আতঙ্কিত বোধ করলেন।
কিছু ক্ষেত্রে Post-Traumatic Stress Disorder এত তীব্র হয় যে মস্তিষ্ক রক্ষা করতে গিয়ে তৈরি করে—হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন, এমনকি কল্পিত বাস্তবতা।
চাঁদের আলোয় নিজেকে অসহায় মনে হয় রিয়াদের। লাবণ্যকে এখন শুধু ওষুধ আর থেরাপি দিয়ে নয়, তাকে বুঝিয়ে, নিঃশব্দে, ধৈর্যের সাথে সত্যে ফিরিয়ে আনতে হবে।সে যে জগতে বাস করছে—সেই স্বপ্নের জগতকে ভেঙে দিতে হবে, না হলে সে কখনোই সম্পূর্ণ ফিরে আসবে না।
__________
লাবণ্য একদিন হঠাৎ খেয়াল করে, সবাই কেমন কেমন করে ওকে দেখছে। মায়ের চোখে জল, প্রশ্ন করলে কেউ কোন উত্তর দেয় না। তটিনী হুট করে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করল,তারপর ঢাকায় চলে গেল বেশ তাড়াহুড়ো করে।
উত্তর না পেয়ে লাবণ্য মামার বাড়ি থেকে চুপচাপ বেরিয়ে যায় পরদিন খুব ভোরে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের ছোট টিলার মতো একটা উঁচু জায়গায় উঠে বসে। পূর্ব আকাশ ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে। সূর্য উঠবে এখনই।
হঠাৎই লাবণ্য চোখ বন্ধ করে নেয়।
“না! না! আমি সূর্যোদয় দেখবো না,” ফিসফিস করে বলে।এইসব কিছু অরণ্যকে ছাড়া একেবারে অর্থহীন।
ঠিক তখনই ধুপ করে কেউ পাশে বসে। বুক কেঁপে ওঠে লাবণ্যের।
অরণ্য?
চমকে তাকায় সে। কিন্তু না—এ তো অরণ্য নয়।
একটা চেনা মুখ। ড:রিয়াদ! হাসিমুখে বসে আছে।
লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিরক্ত হয়। আবার শুরু হবে থেরাপি।
“আপনি কি আমার মতই সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন?”
লাবণ্য উত্তর দেয় না, বিরক্ত হয়। এক ঝলক মিষ্টি বাতাস এসে ওর চুল এলোমেলো করে দেয়।
“ উত্তর দিচ্ছেন না কেন? তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে দেখুন দেখুন সূর্যোদয়।”
লাবণ্য দেখে না,ওর হঠাৎ কান্না পায় ও বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ডেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর পাশে রিয়াদ বসে পরে ওর দিকে কি ভীষন মমতা নিয়ে তাকায়, আশ্চর্য উনার চোখেও জল।
লাবণ্য চোখ মুছে আবার উঠে দাঁড়ায় হাঁটতে থাকে হাঁটতে হাঁটতে বড় একটা গাছের নিচে বসে পরে। অরণ্যের কথা কিছু একটা মনে করে হাসে।
“আপনি তো বেশ অদ্ভুত, একটু আগে কাঁদছিলেন এখন হাসছেন?”
লাবণের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় ও চোখ তুলে তাকায় ঐ ড:রিয়াদ!উনি কি চায়? “ আপনার কি চাই?” জানতে চায় লাবণ্য।
“ আপনার হাসি।” সরল উত্তর দেয় রিয়াদ।
লাবণ্য এই কথায় খুব মজা পায় উঠে দাঁড়ায়, “কেন?”
“কারণ আমি আপনাকে ভালবাসি”। ডা: রিয়াদের আশ্চর্য ঠান্ডা একটা ঘোর লাগা কন্ঠে বলে।
“ জানতে চাইবেন না কবে থেকে ভালবাসি? যেদিন প্রথম আপনাকে হাসপাতালে আনা হয়। আপনার তখন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান আসার পর আপনার স্মৃতি গোলমাল হয় আপনি কিছু বলতেন না, বুঝতেন না কাউকে চিনতেন না।”
“আচ্ছা মানলাম আমি পাগল ছিলাম,কাউকে চিনতাম না তো কি হয়েছে ? আপনি যখন আমার ডাক্তার তাহলে তো আপনার জানা উচিৎ কি কারণে আমি পাগল হয়েছিলাম।” একটু দম নেয় লাবণ্য “তারপর ও প্রেম এ পরে গেলেন ? ”
“ হ্যাঁ, ঠিক তাই , আমি প্রেমে পরলাম সেই মেয়ের যে মেয়ে ভালবাসতে জানে জীবনটা কি অদ্ভুত, আপনাকে যেদিন প্রথম হাসপাতালে আনা হয় আপনাকে দেখে আমার মনে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড মায়া এত ভালবাসা নিয়ে এ মেয়ে বেঁচে আছে কীভাবে?কেউ কাউকে এত ভালবাসতে পারে! আপনাকে দেখে তাই এতদিন পর আবার মনে হলো—ভালোবাসা বলে কিছু এখনো আছে। নইলে এক মেয়ের বিশ্বাসঘাতকতা, আমার ভেতরটা তিক্ত করে দিয়েছিল।আপনি অরণ্যকে ঠিক যেভাবে ভালোবাসেন ওর জন্য যেভাবে ভাঙেন, সেই ভালোবাসাটা আমায় গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে।”
লাবণ্য চুপ থাকে। চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।
“আপনি জানেন আমি অরণ্যকে ভালোবাসি। তবে?”
“আমি জানি,” শান্ত স্বরে রিয়াদ বলে।
“আমি আপনার সেই ভালোবাসাটার পাশে থাকতে চাই। আমি প্রতিযোগী নই, আমি চাই আপনি শুধু ভালো থাকেন। “
_______
অরণ্যের কথা জানতে চাইলে সবাই গুটিয়ে যায়। লাবণ্যর কিছুই ভালো লাগে না। তটিনী ফিরে যাবার আগে কি একটা বলতে গিয়েও বলেনি।
লাবণ্য রাত-দিন ঘুমহীন চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই আকাশের নিচে ওরা দুজন আছে। একই চাঁদ, একই সূর্য ওদের প্রতিদিন দেখেছে। সকালবেলার প্রথম আলো তো একইসাথে ওদের দুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে রুদ্র গোস্বামীর একটা কবিতা মনে পড়ে যায় ওর,
“অপেক্ষা করতে করতে আতশবাজির মতো
কখন যে ফুরিয়ে গেছি, তোমার ঈশ্বরও জানেন না।অথচ আধাঁর পেরোবার আগে, তোমার আমাকে আকাশ ভরা সূর্যোদয় দেবার কথা ছিল।”
জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“তুমি কথা রাখবে না অরণ্য? উঠে যাও না ঘুম থেকে।তারপর দেখে, ঐ তো অরণ্য! দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।
দিন যেতে থাকে।একদিন ছাদে বসে আকাশ দেখছে লাবণ্য, হঠাৎবৃষ্টি নামে। লাবণ্য উঠে না।
বসে বসে স্বপ্ন দেখতে থাকে—চারপাশে সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাঁপতে কাঁপতে লাবণ্য রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে।
চারদিকে গাছ, কৃষ্ণচূড়ার আগুনরঙা ফুল।
হঠাৎ দেখে,এই তো, অরণ্য ওর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু ওর দিকে তাকাচ্ছে না।
দারুণ অভিমান হয় লাবণ্যর।তবু দৌড় দেয়।
পড়ে যায়।শব্দ শুনে অরণ্য ফিরে তাকায়, ছুটে আসে।সেও পড়ে যায়।লাবণ্য হেসে ওঠে। অরণ্যও।
“আপনি বৃষ্টিতে এভাবে ভিজছেন কেন?”
কানের পাশে শব্দ হয়।
লাবণ্য চোখ খুলে তাকায়, ডা: রিয়াদ।
প্রচণ্ড রাগ হয় ওর।
এই ডাক্তার কেন ওকে শান্তিতে স্বপ্ন দেখতে দেয় না?
“আমার ইচ্ছা তাই। আমার ইচ্ছা তাই।”
শান্ত গলায় বলে লাবণ্য।
“এই নাকি! আপনার ইচ্ছাতেই বুঝি সব হয়?”
বিদ্রূপ ঝরে পড়ে রিয়াদের কণ্ঠে।
“আমি তা বলিনি, শুধু বলেছি, আমার জীবনে আমি যা ইচ্ছা তাই করব।”
“আপনার জীবন! বাহ! দারুণ তো! এই জীবনটার ওপর যদি অধিকার আপনারই হয়, তাহলে আপনার মা–বাবা কেন এত কষ্ট করছেন? আপনাকে নিয়ে পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করেছেন। আপনার চোখে তো তাঁদের কোনো অস্তিত্বই নেই।”
রিয়াদ নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দেয়।
এরকম একটা খবর ওকেই দিতে হবে আজ।
জীবনে কি আর ওকে মাফ করবে লাবণ্য?
তবু বলতেই হবে—রোগীর চিকিৎসক হিসেবে সে এতটা স্বার্থপর হতে পারে না।
“সারাদিন শুধু স্বপ্ন দেখেন, চিন্তা করেন অরণ্যকে… সেই অরণ্য… যে আর ফিরে আসবে না।”
রুক্ষ কণ্ঠে বলে রিয়াদ।
“চুপ!”
চিৎকার করে ওঠে লাবণ্য।
“তুই কে আমার অরণ্যের ব্যাপারে বলার?”
ওর শরীর কাঁপছে, জ্ঞান হারানোর উপক্রম।
সবাই তখন ছাদে উঠে এসেছে।
“মা, ওকে যেতে বল… বল, ওকে যেতে বল।”
লাবণ্য কাঁপতে থাকে, অসুস্থ রোগীর মতো।
“আমি যাব না। কী করবেন আপনি? সত্য না জেনে আপনি আর অসুস্থ হয়ে যাবেন, তখন আর স্বপ্নের জগৎ থেকে আপনাকে বের করে আনা সম্ভব হবে না। অরণ্য আর নেই, লাবণ্য।
He is dead. সে কোমায় চলে গিয়েছিল, আর সেখান থেকেই আর ফিরে আসেনি… সে আপনাকে খুব ভালোবাসত। তাই একটানা যুদ্ধ করে গেছে… কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।”
কথাগুলো বলে যেন নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয় রিয়াদ। যেন মুক্তি পায় দীর্ঘ ভার থেকে।
লাবণ্য অনেক কষ্টে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়।
চিৎকার করে ওঠে—
“ অরণ্য কেন মরবে! কেন হার মেনে যাবে?”
শুধু এইটুকুই বলে লাবণ্য।
না জ্ঞান হারায়, না কান্না করে।
চুপচাপ ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড়েই বসে থাকে।
চলবে।
মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
২০
এরপর লাবণ্য স্বাভাবিক হতে থাকে অল্প অল্প করে। ওর মন আর মস্তিষ্ক যেটার ভয় পাচ্ছিল, অরণ্য হারিয়ে যাবে৷ সেটা সত্যি হবার পরে মানসিক সমস্যাগুলো অনেকটাই যেন কমে আসলো। ক্লাসে যাচ্ছে না, বাসায় থাকে সারাক্ষণ। এই বছরটা লস দিবে।
ডা: রিয়াদ প্রায়ই ওদের বাসায় আসতেন ওকে দেখতে। দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে যায়। লাবণ্য অরণ্যর কথা মনে করতই না।
কিন্তু রাত গভীর হলে দুটি নির্ঘুম চোখ কী যেন খুঁজে বেড়াত দূর আকাশে।
“শহর ঘুমিয়ে গেলে জেগে থাকে যে চোখ
সেই চোখ জানে ভালোবাসা কত ভয়ানক অসুখ।”
মুহাম্মদ রাকিবের এই দুই লাইনের কবিতা এক জায়গায় দেখে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে, আহা! কী সত্যি, কী তীব্র সত্যি!
মাঝে মাঝে মনে হতো, অরণ্য ওর পাশে বসে বলছে, “লাবণ্য, বৃষ্টিতে ভিজবে?”
আবার মাঝেমধ্যে অরণ্য আসে, ওকে অতীতের কথা শোনাতে।লাবণ্য অধৈর্য হয়। ও শুনতে চায় ভবিষ্যতের কথা।অরণ্য অবাক হয়, “আমি তো শুধুই তোমার অতীত। ভবিষ্যৎ হবো কীভাবে?”
একদিন বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎই অরণ্যর কথা মনে পড়ে যায়। বুকটা শূন্য লাগে।ঠিক এমন সময় রিয়াদ ওদের বাসায় আসে। উনি মাঝেমধ্যে আসেন।লাবণ্য এখনো মানসিকভাবে স্থির নয়। কাউন্সেলিং, ওষুধ—সব কিছুই তিনিই দেখেন। বাবা-মায়ের জন্য যেন ঘরের ছেলে। তবে লাবণ্য বিরক্ত হয়। ওর বলতে ইচ্ছে হয়,
“কেন আসেন আপনি বারবার?” কিন্তু বলতে পারে না।
“এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনাকে দেখে যাই। কেমন আছেন আপনি?” রিয়াদ যেন লাবণ্যের মন পড়তে পারেন।
লাবণ্য প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়।
“আপনার জন্য কিছু আনবো?”
“চা হলে ভাল হয়। আঙ্কল-আন্টি কোথায়?”
“নেই।”
“আপনি এত কম কথা বলেন কেন?”
লাবণ্য উত্তর দেয় না। ধীর পায়ে চা বানাতে যায়।
রিয়াদ কি সত্যিই ওকে ভালোবাসেন? জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় লাবণ্য। কতক্ষণ যে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে পারে না।
হঠাৎ গরম কিছু স্পর্শ করে। ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর জামায় আগুন।
লাবণ্য দাঁড়িয়ে থাকে। আগুন যেন হা করে ওকে গ্রাস করতে আসে।
চিৎকার করে ওঠে “অরণ্য! বাঁচাও!”
ড্রইং রুম থেকে দৌড়ে আসে রিয়াদ। প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে যায়।পরক্ষণেই ওর ওড়নাটা টেনে ফেলে দেয়। ততক্ষণে আগুন জামায় পৌঁছে গেছে।হাত দিয়ে থাপড়াতে থাকে, এরপর রান্নাঘরে রাখা কলসি ভর্তি পানি ওর গায়ে ঢেলে দেয়।
প্রচণ্ড রাগে রিয়াদ ওর দিকে তাকায়। প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে,
“মন কোন দিকে থাকে?”
“কোন দিকে না।” লাবণ্য বিরক্ত হয়।
“বিরক্ত হবেন না, খবরদার! আপনার মতো পাগল আমি অনেক দেখেছি। আজ যদি কিছু হয়ে যেত!”
“কি হতো? মারা যেতাম।”
“মৃত্যু এত সহজ না। এক মৃত্যুর পরিণাম দেখছেন আপনি? আপনি মারা গেলে আপনার বাবা-মায়ের কী হতো?…আর আমি?
অরণ্যকে হারিয়ে আপনার যে অবস্থা হয়েছে, আপনি কি চান, আমারও তাই হোক?”
লাবণ্য উত্তর দেয় না। ওর ইচ্ছেও করে না।
রিয়াদের হাত পুড়ে গেছে,ও দেখে, কিন্তু কিছু করতে ইচ্ছে করে না।
শান্ত কণ্ঠে বলে,
“চলে যান। দরজা ঐ দিকে।কি মনে করেন আপনি নিজেকে? যা মুখে আসে তাই বলবেন?আমি আপনাকে ভালোবাসি না।আমি তো আপনাকে ডাক দিইনি।
বের হয়ে যান।”
এরপর আরও তিন মাস কেটে যায়। রিয়াদ একদিনও আসে না।লাবণ্য নিজেই নিজেকে সামলে নেয়।
আবার ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করে। তটিনী আর রিয়ার সঙ্গে দেখা হয়।
তবে তটিনী ওকে এড়িয়ে চলে—ও খেয়াল করেছে। হয়তো নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।
________
তটিনী রান্না করছে আর আকাশ দেখছে।
মানুষের জীবন কত বিচিত্র।অরণ্য ভাইয়ার কথা মনে হলে ওর খুব কষ্ট হয়।মানুষ এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে যেতে পারে?আচ্ছা, লাবণ্য কি সত্যিই অরণ্য ভাইয়াকে ভুলে গেছে?
“কি ভাবছো?”পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তূর্য।
“আমি লাবণ্য আর অরণ্য ভাইয়ার কথা ভাবছিলাম। এমন কেন হল?জানো, আমি লাবণ্যর থেকে পালিয়ে বাঁচি। পাছে সত্যিটা…”
“এত চিন্তা করো না। আল্লাহ ভরসা।”
তূর্য কথাটা ঘুরিয়ে দেয়, “কি রান্না করছো?”
“আজ ভালো লাগছে না একদম।”
দুই হাতে চোখ মুছে তটিনী বলে, “অরণ্য ভাইয়ার এক্সিডেন্টের আজ এক বছর পূর্ণ হল।
আমাদের স্বপ্নগুলো এভাবে ভেঙে গেল কেন?”
তূর্য নিজের স্ত্রীকে জড়িয়ে নেয় স্নেহে, কোমলতায়।ওর ও আজ ভালো লাগছে না কিছুই।রাফি আর ও গিয়েছিল আজ অরণ্যর কাছে……
“আমি রান্না করি, তুমি একটু রেস্ট নাও।”
“আরেহ না, আপনি অফিস থেকে এসেছেন, বসুন আমি নাস্তা দেই।সরি, কী কাণ্ড, আজ সব ভুলেই গিয়েছি। আজ দেরি হল যে!”
তূর্য ধীরে বলে,“অরণ্যর কাছে গিয়েছিলাম আজ।” গলা কেঁপে যায়।
তটিনী কিছু বলে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
ওর চোখে জল এসে যায়, অরণ্যের ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়।
তূর্য এবার ওর কাঁধে হাত রাখে,
“তুমি জানো, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি ভুলে যেতে। এই অনিশ্চয়তা আর কষ্ট নিয়েই আমাদের বাঁচতেই হবে। আমি আছি পাশে সব সময় এই কষ্টটার অংশীদার হতে।”
তটিনী তূর্যের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।এ জীবনে তূর্যই এখন ওর আশ্রয় ওর জীবন তো পূর্ন কিন্তু লাবণ্য?
_________
আজ সেই ভয়ংকর দিনের এক বছর। আকাশের দিকে তাকায় লাবণ্য।
প্রিয় পৃথিবী, মনে মনে বলে লাবণ্য,
তোমায় কিছু বলার ছিল। ছিল কিছু জানাবার। তোমার বুকে বাস করি তাই ভাবলাম, তোমার তো জানার অধিকার আছে।
জানো, আমি খুব একা। সবার মাঝেও একদম একা! মাঝে মাঝে অরণ্য আসে আমাকে পুরানো দিনের কথা শোনাতে। আমার ভালো লাগে না, ইচ্ছে করে পুরানো সেই দিনের মতো ধমক দিই। বলি,
“এই, তুমি থামবে? মাথাটা খাবে নাকি এ যাত্রা!”
কিন্তু না, আমি কোনো কথা বললে অরণ্য এখন আর শোনে না।
তবুও আমি চিৎকার করে বলি, বলতে চাই,
“অরণ্য, ভবিষ্যতের কথা বলো, বর্তমানের কথা বলো।”
জানি, আমার কথা শুনে অরণ্য অবাক হয়! আশ্চর্য কণ্ঠে বলে,
“লাবণ্য, তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যতে তো আমি নেই। অরণ্য নেই!”
আমি তো এ সত্য জানি! জেনেও বিশ্বাস করতে পারি না।না থেকেও যে অরণ্য আমার আত্মায় মিশে আছে।কেন আছে?
তবে কি অরণ্যের উপস্থিতি আমি চাই না?
সত্যি বলব, মিথ্যে বলব না, কারণ যেখানে ভালোবাসা, সেখানে মিথ্যে থাকে না।
আর অরণ্য আমার প্রথম ভালোবাসা।হ্যাঁ, আমি অরণ্যকে ভুলতে চাই।চাই, ও আমার মনে স্বর্ণালী স্বপ্ন হয়ে থাকুক।যে স্বপ্ন দেখা যায়, আপন ভাবা যায়, অথচ ছোঁয়া যায় না।
চাই না অরণ্য আমার মনে না-পাওয়া যন্ত্রণা হয়ে থাকুক।অরণ্য জানে আমি অরণ্যকে ভালোবাসি।
কিন্তু সে ভালোবাসা একান্তই আমার।তবে কেন ও আসে?থমকে থাকা পৃথিবীর মাঝে, জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই আমাকে বুঝিয়ে দিতে,
“অরণ্য ছাড়া লাবণ্য নিঃস্ব!”
কি নিষ্ঠুর! কি নিষ্ঠুর!
কিন্তু আমি ওই অনুভূতির মুখোমুখি হতে চাই না।
তাই তো অরণ্যকে নিয়ে একদম চিন্তা করি না।
আচ্ছা বলো তো, যে মানুষটার চেনা জগৎ হঠাৎ পালটে যায়, তার কি জানার অধিকার থাকে না, যে তার পৃথিবীটা পালটে গেছে?
আমার সঙ্গে এমন কেন হল?
আমি তো জানতেই পারলাম না।
হঠাৎ দুর্যোগের মতো খবর এলো—অরণ্য নেই।
যে অরণ্য আমাকে স্বপ্ন দেখাত, বলত ছয়টা মাস পর সে আমাকে নিয়ে যাবে, সে নেই!
ছয় মাস দূরে থাক, অরণ্য তো আমাকে একদিন সময় পর্যন্ত দিল না।চলে যাওয়ার এত তাড়া ছিল ওর?যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল।
ভালোবাসা এত সুন্দর, এত তীব্র, এত অসহায়, এত বোকা,তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম অরণ্যকে ভালোবেসে।আর অরণ্য?
অরণ্য আমায় এত ভালোবেসেছিল কেন?
এক জীবনে এত ভালোবাসা কি কারো পাওয়া উচিত?না কেউ পায়?আমি ভাগ্যবান, কারণ আমি ভালোবেসেছি।চোখ খুলে, চোখ বন্ধ করে, হেসে, কেঁদে—প্রতিটা মুহূর্তে আমি ভালোবাসার মধ্যে থেকেছি।
আমি ভাগ্যবান, কারণ অরণ্য আমায় ভালোবেসেছে!কখনো উন্মাদের মতো, কখনো সুবোধ বালকের মতো, কখনো বা বোকার মতো।
অরণ্যের ভালোবাসাটা কোনো প্রতিদান চাইত না, শুধু দিয়েই যেত।এখন যেন প্রতিনিয়ত কানে কানে ফিসফিস করে,“এত কষ্ট কেন পাচ্ছো, বোকা মেয়ে?”এক জীবনে বুঝি এত কষ্ট কেউ পায়?
অরণ্য বলত, ও নাকি আমায় এত শক্ত করে বেঁধেছে যে ভূমিকম্প এলেও আমার কিছু হবে না।ঠিকই বলত, তাই তো আজও আমি আছি পৃথিবীর বুকে।
কিন্তু আমার বন্ধন হয়তো তেমন শক্ত ছিল না।
তাই তো অরণ্য নেই।
অরণ্য থাকলে গলা ফাটিয়ে তর্ক করতাম,
কিন্তু আজ আমি চিৎকার করে বলতে চাই,
“অরণ্য, তুমি আমায় বেশি ভালোবাসতে!”
স্বপ্নের মতো এক ভালোবাসা—
যা শুধু অরণ্যই আমাকে ভালোবাসত!
কে জানে, হয়তো আজও ভালোবাসে!
জানো, অরণ্যকে একবার বলেছিলাম,
“তুমি কেন আমার মাথায় ঢুকে বসে থাকো?
যদি বলি বের হও, তবে আবার হাসো! সে কি হাসি!”
অরণ্য আজও আমার মাথার ভেতর চুপটি মেরে বসে থাকে।কখনো বা পুরানো দিনের মতো করে হাসে।
আচ্ছা, অরণ্য এখনো কেন অমন করে হাসে?
যে হাসি ভুলতে আমার এত চেষ্টা!চেষ্টায় কি না হয়, তাই তো একটু একটু করে অরণ্য অপষ্ট হচ্ছে।
তবে আমি জানি, ও থাকবে আমার আশেপাশেই, আমাকে ঘিরে।প্রচণ্ড কোনো বৃষ্টির দিনে আমার হাত স্পর্শ করে বলবে, “এই পাগল মেয়ে, ভিজবে? চল!”
যখন অমাবস্যার আধারে আশেপাশ সব অলিয়ে যাবে,অরণ্য অভয় দিয়ে বলবে,“ভয় পেয়ো না, এই তো আমি!”
যখন ভয়াবহ কষ্টে আমি একটু একটু করে গা ভাসাবো,অরণ্য হাত বাড়িয়ে বলবে, “এই তো আমি! তুমি কেন তবে কষ্টের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছ?”
জানি না, আমার এই চিঠি,মনে মনে লেখা এই চিঠি,কেউ পড়বে কিনা। অথবা আদৌ এটা কোনো চিঠির আকৃতি পেল কিনা!আমি শুধু জানি,
অরণ্য নামের একটা ছেলে আমাকে অসম্ভব ভালোবাসত।আমাকে হাসাত, গান শোনাত আর দারুণ সব স্বপ্ন দেখাত।সব ভালোবাসার পরিণতি হয়তো সুন্দর হয় না।হয়তো বা ভালোবাসার মানুষ দুজন এক হতে পারে না।
কিন্তু আমার সঙ্গে এ কী হল?আমার ভালোবাসাটা আমার সামনেই চলে গেল, হারিয়ে গেল,আর আমি বুঝতেও পারলাম না!
আর এই ভালোবাসার কথা সবাইকে জানাতেই আমার এ চিঠি লেখা।অরণ্যর মতো কেউ হয়তো আমায় আর ভালোবাসবে না।
তবুও মাঝরাতে কষ্টগুলো যখন গলার কাছে আটকে যায়, আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সেই সময় মনে হয়, ভালোবাসা ভালো না।
সেই সময় আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি অরণ্যকে ভুলে যেতে।অরণ্য তার জীবনের পাঁচটি নীলপদ্ম একজনকে অনেক ভালোবেসে দিয়েছিল।আর এই নীলপদ্ম দিয়ে গিয়েছে সে।আর এই ভার সহ্য করতে পারছে না।
সে উপায় খুঁজছে মুক্তির!অপাত্রে দান—মনে হয় একেই বলে।তবে একটা প্রশ্ন ছিল আমার অরণ্যের কাছে,“কোনটা বেশি সহজ?
“ভালোবেসে ভালোবাসাকে একা ফেলে আসা?
নাকি- “ভালোবেসে ভালোবাসাকে ভুলে যাওয়া?”
চোখ মুছে মুছে ক্লান্ত লাবণ্য।এমন সময় মায়ের চিৎকার শুনতে পেল।দৌড়ে বাবা-মায়ের ঘরে গেল লাবণ্য।
“বাবা!”
আর্তচিৎকার বের হয়ে এল ওর বুক চিরে।
_____
ডা: বেলালের চেম্বারটা বিকেলের নরম আলোয় ভরা। দেয়ালে ঝোলানো স্টেথোস্কোপের পাশের কেবিনেটে, কিছু মেডিকেল সার্টিফিকেট। একটা পেইন্টিং,কোনো এক গ্রামের দৃশ্য, এবং ছোট্ট একটা আয়াতুল কুরসি বাঁধানো কাঠের ফ্রেমে। টেবিলে কিছু এলোমেলো প্যাড, কলম।
লাবণ্য সোফার এক পাশে চুপ করে বসে আছে। হাতে শক্ত করে চেপে ধরা বাবার রিপোর্টগুলো। চোখের নিচে হালকা কালি, খুব ক্লান্ত আর বিদ্ধস্ত লাবণ্য।
ডা: বেলাল চশমা খুলে রাখলেন ডেস্কের ওপর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন লাবণ্যের দিকে।
“এদিকে এসো, মা?”
গলার স্বরটা নরম, ধীর, আর অভিভাবক সুলভ।
লাবণ্য সামনের চেয়ারে বসে ফাইল এগিয়ে দেয়। মুখে শংকা।
“তোমার বাবা আমার খুব পুরনো বন্ধু। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। তখন থেকেই মানুষটা একরোখা, জেদি, কিন্তু পরিবার নিয়ে যেন অসম্ভব দুর্বল। বারবার একটা কথাই বলছিল তোমার বাবা যখন তার জ্ঞান ফিরলো, “আমার লাবণ্য একা হয়ে যাবে। ওর বিয়ে আমি দেখে যাব না? ”
লাবণ্য এবার মুখ তুলে তাকালো। দৃষ্টিতে ধরা পড়ে এক ধরনের অসহায়ত্ব। নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ডা: বেলাল একটু সময় নিয়ে বললেন,
“ডায়বেটিস অনেকদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ছিল। হার্টে ব্লকটা আগে থেকেই ছিল, এবার স্ট্রোকের পরে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে। এন জিও গ্রামে তিনটা ব্লক ধরা পড়েছে। অপারেশন করতে হবে।”
“কবে করবেন আঙ্কেল?” মৃদু কন্ঠ লাবণ্যর।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি আবার বলেন,
“তবে শুধু অপারেশন করলেই তো হবে না। মানসিক স্থিতিও দরকার। আর এখন ওর মানসিক অবস্থা দুর্বল, উদ্বেগপ্রবণ। আমি দেখেছি, তোমাকে নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তিত। বারবার একটা কথাই বলছে, ‘আমি না থাকলে ওর কী হবে?’ ”
লাবণ্য এবার মুখ নিচু করে ফেলে। হাতে ধরা রিপোর্টগুলো কাঁপছে।
ডা: বেলাল এবার একটু সামনে ঝুঁকে এলেন,
“মা, তোমাকে কিছু বলব, রাগ কোরো না। কখনো কখনো সময়, পরিস্থিতি আমাদের এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, যা হয়তো হৃদয়ের পক্ষে সহজ না, কিন্তু জীবনের পক্ষে দরকারি।”
লাবণ্য চুপ। গলার কাছে কী যেন আটকে আছে।
“তোমার বয়স হয়েছে। তুমিও তো চাইলে একটা পরিবারের আশ্রয়ে যেতে পারো। একজন জীবনসঙ্গী,যার ওপর ভরসা রাখা যায়। আমি বলছি না তুমি এখনই বিয়ে করে ফেলো। কিন্তু অন্তত নিজের জন্য আর তোমার বাবার শান্তির জন্য, ভবিষ্যতের কথা একটু ভাবো। তুমি তো জানো, উনি খুব বেশি সময় নিয়ে নিতে পারবেন না।”
একটু থামলেন।
“তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে তোমাকে বড় করেছেন। এখন সে চায়, মেয়েটার একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় হোক। আমি জানি তুমি অরণ্যকে ভুলতে পারোনি এখনো। কিন্তু নিজের পারিবারের কথাও ভাবো একবার। তুমি বিয়েতে রাজি এটা অনেক মানসিক প্রশান্তি দিবে তোমার বাবাকে। শারিরীক অনেক বিষয় সহজ হবে।”
লাবণ্যর চোখ ছলছল করে উঠল এবার। ঠোঁটটা কেঁপে উঠল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে রাখে।
“আপনি যা বলছেন, আমি বুঝি। কিন্তু আমার মন… এখনো… আচ্ছা অপারেশন করলে পুরো সুস্থ হতে কতদিন লাগবে? — লাবণ্য ফিসফিস করে বলে।
ডা: বেলাল মৃদু হাসেন।
“মন কখনো কখনো যুক্তির কথা শুনে না। যাইহোক আশা করি তিন মাস।”
চেম্বারের বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে।সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। রিক্সা নিয়ে দ্রুত গেল ডা:,রিয়াদের চেম্বারের দিকে।
_______
দুপুরের ক্লান্ত রোদটা ক্যান্টিনের জানালার গ্লাসে পড়ে কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে। লাবণ্য বসে আছে চুপচাপ,সাথে রিয়া। চা রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে, কিন্তু কারো হাতে কাপ ওঠেনি এখনো। দুইজনের চোখেমুখেই কষ্ট।
তটিনী ঢুকলো হুরমুর করে ক্যান্টিনে, চেয়ার টেনে বসল লাবণ্যর আরেক পাশে।মুখে একটু কৃত্রিম হাসি ফুটালো,যেটা শুধু সৌজন্যের খাতিরেই নইলে খবর টা শুনে নিজের ভাইয়ের জন্য কলিজা পুড়ে যাচ্ছে তটিনীর।
“বিয়ে ঠিক?”রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল সে, তারপর লাবণ্যের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিল।
“এই তো, বাবা সুস্থ হলে, তিন মাস পর।। তুই চা নে ?” লাবণ্য তাকালো নীচের দিকে,কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু তটিনীর সামনে খুব অসহায় লাগছে নিজেকে।
তটিনী চুপ করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, চুমুক দিল না। আবার রেখে দিল।
“তিন মাস পর… বিয়ে?”
ভাঙা গলায় বলে ফেলল তটিনী, যেন নিজের কানেও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।
লাবণ্য চোখ নামিয়ে নিল। মাথা নাড়ল হালকা করে।
“হ্যাঁ, বাবা শুধুমাত্র ডা: রিয়াদকে ভরসা করতে পারেন। তিনিই তিন মাস সময় চাইলেন।” লাবণ্যর আত্মা যেন অনুপস্থিত।
তটিনী গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে লাবণ্যর দিকে।
“তুই কি খুশি ?”
লাবণ্য এবার তটিনীর চোখে চোখ রাখে।
“রাজি হতে হয়েছে।” এই উত্তরে কোনো অভিযোগ নেই, আছে অনুশোচনা।
তটিনী চোখ ফিরিয়ে নেয় জানালার দিকে।
একটা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল দূরে।
কিছু সময় চুপচাপ কেটে যায়।
তারপর তটিনী ধীরে বলে,
“তুই সুখী হ দোস্ত….আরও কিছু বলতে চায় কিন্তু রিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে।
লাবণ্যর নিঃশ্বাসটা একটু গভীর হয়। “ সুখ দাফন হয়ে গেছে তার সাথেই যাকে ভালোবাসি।” বলে ব্যাগ কাঁধে নেয়।
“আমি চাই না তুই তোর সুখ এভাবে…..তটিনীর গলা কেঁপে ওঠে এবার।
লাবণ্য এবার মুখ তুলে তাকায়, চোখে জল সাথে একরাশ ক্লান্তি।
“ আমি আসলে মরে গেছি আগেই। এখন শুধু একটা দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি ঋন বলতে পারিস। তোর ভাই কথা রাখেনি।একা ফেলে চলে গেছে।”
রিয়া চোখ নামিয়ে ফেলে। তটিনীও দৃষ্টি লুকায়।
তটিনী উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে যেন কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায়। তারপর হঠাৎ বলে,
“ ভাইয়া থাকলে এসব হতো না।”
ঘরে যেন একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে।
লাবণ্য কিছু বলে না। তটিনীও আর কিছু না বলে চলে যায়। তিন জন চুপচাপ প্রস্থান করে। চায়ের কাপগুলো তখনো টেবিলে, অস্পর্শিত।যেন নিরব সাক্ষী কিছু চাপা কষ্টের।
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা
চলবে…….