মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
২১
ফোনটা তখন থেকেই বেজে যাচ্ছে একটানা
অধৈর্য ভাবে। লাবণ্য একটু বাসার বাইরে গিয়েছে।
লাবণ্যের মা এক প্রকার বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুললেন।
“লাবণ্য? আমি… আমি অরণ্য।” ওপাশের গলাটা যেন উত্তেজনায় কেঁপে আসছে।
ওপাশের কণ্ঠটা শুনে উনি জমে গেলেন।
কোনো ভুল নেই, সেই কণ্ঠ,“অরণ্য…।”
দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালেন।
আর এক মাস পরেই তো লাবণ্য আর রিয়াদের বিয়ে।রিয়াদ অন্তত তাই বলেছে।
ওই ঘরে শুয়ে আছে উনার স্বামী, অপারেশন থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন।
না, এই মুহূর্তে অতীত সেই মিথ্যে পোশাক ছেড়ে সামনে আসতে পারে না।
“আমি লাবণ্যের মা বলছি… লাবণ্যের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বাবা।”
কথাটা শুনে অপর পাশ থেকে ফোনটা মুহূর্তে কেটে গেল, যেন আর কিছু শোনার বা বলার অবকাশ নেই তার।
লাবণ্যের মা দরদর করে ঘামছেন।মোবাইলটা মনে হচ্ছে যেন কোনো আগ্নেয়াস্ত্র।একছুটে বারান্দায় গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেললেন।আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। এক গ্লাস পানি,বড্ড প্রয়োজন।
—
যশোরগামী ট্রেনটি জোরে ছুটছে।ট্রেনে বসে আছে রাফি, তূর্য আর তটিনী।তটিনীর চোখে জল, সেটা আনন্দের। ওর অরণ্য ভাইয়া ফিরে এসেছে!
গত মাসে বড় ভাই অরণ্যকে যশোর নিয়ে গিয়েছিল,কারণ কোমার রোগীর তেমন চিকিৎসা ঢাকাতেও নেই।কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়নি,তাই শুধু স্যালাইন, ক্যাথেটার চেঞ্জ,এইসবই চলত।
অরণ্য সাড়া দেওয়া শুরু করেছে গত প্রায় সাত দিন ধরে।সাথে বিভিন্ন থেরাপি।গতকাল থেকে মোটামুটি সুস্থ,কথা বলতেও পারছে।
তবে বড় ভাই বলেছেন,
“ও যে চাকরি করতে গিয়েছিল, পাশ করেছে, এসব কিছু জিজ্ঞেস করলে তাকিয়ে থাকে।এমনকি লাবণ্যের কথাও বলে না।”
তাই তূর্যদের বলেছে এসে দেখতে।
ডাক্তার বলেছেন,এ ধরনের রোগী কখনো কিছু স্মৃতি হারিয়ে ফেলে।
তটিনী তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“এবার নিশ্চয়ই লাবণ্যর বিয়েটা ভেঙে যাবে…!”
তূর্য অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল,
“আগে দেখি ওর কী অবস্থা।”
“জানেন, আমি আঙ্কেল আর আন্টির এই মিথ্যেটা মানতে পারিনি কিছুতেই।”
“তাদের অবস্থাটাও বোঝার চেষ্টা করো। কোমা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না।তারা আর কী-ই বা করতে পারত।যাই হোক, এখন সব ঠিক হলেই হয়।”
—
অরণ্যের ঘরটা খুব সুন্দর।রুম থেকে বের হলে বারান্দা, তারপর পেছনে বড় একটা জায়গা আর ঘাট বাধানো পুকুর।
অরণ্য এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়।অনেক দুর্বল, তবে শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক আঘাত আকাশচুম্বী।ওর ফোনটা কীভাবে যেন হারিয়ে গেছে।
ভালোই হয়েছে, কোনো ফোন দরকার নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
গানের কয়েকটা লাইন যেন মাথায় ধাক্কা মারছে—
“ যদি আবার দেখা হয় তোমার আমার
ভুলে যেও সব অভিমান
ছিল যত ঋণ
আছি আজো, আমি শুধুই তোমার…
জানি তুমি অন্য কারো
আমি দিশাহীন…
আমার মন খারাপের সুর
মিশে গেছে যত দূর।
তুমি শুনতে কি পাও, এই গান?”
চোখ দুটো যেন নিষ্প্রাণ। পানি পড়ছে শুধু।
কেন ফিরে এলো, অরণ্য? এরচেয়ে মরে গেলেই ভালো হত না! অনন্তকাল…হাহ! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লাবণ্য আমার জন্য দেড়টা বছর অপেক্ষা করলে না তুমি।তুমি অন্য কারো…উফ!
ঠিক তখনই হুরমুর করে রুমে ঢুকে পড়ল রাফি, তূর্য আর তটিনী। অরণ্য উঠে বসে মুখে হাসি ফুটে উঠে।
তটিনী ছুটে গিয়ে পাশে বসে পড়ে।
“অরণ্য ভাইয়া! কেমন আছো তুমি? দুর্বল লাগছে, চোখ লাল কেন?” আতঙ্ক আর ভালোবাসা মেশানো কণ্ঠ কেঁপে গেল অল্প।
অরণ্য ওর দিকে তাকায়। একটু সময় নেয়।
তারপর আস্তে বলে,
“তটিনী? তুমি… ঢাকায় চলে গিয়েছিলে না? কী… কী খবর? কবে আসলে?”
তূর্য একটু হাসে, সামনে এগিয়ে আসে।
সাবধানে মুখ খোলে,
“আমরা এসেছি তোকে নিয়ে যেতে।তুই কথা বলছিস দেখে খুব ভালো লাগছে।”
অরণ্য মাথা নাড়ে ধীরে ধীরে।
“আমি আর ফিরব না ঢাকা। কেন, তোদের তো বলেছি… আমার পড়াশোনার শখ মিটে গেছে।
যেভাবে র্যাগ দিল, আমি ভাই কৃষিকাজ করেই খাব।”
তটিনী অশ্রুসিক্ত চোখে তূর্যের দিকে তাকায়।
দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা—“ভাইয়া, এ সব কী বলছে?”
অরণ্য এবার চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে।
রাফি গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে,
“আরে র্যাগিং দিলেই তুই লুকিয়ে থাকবি?রুবি ম্যামকে বলব যা বলার।”
অরণ্য কপাল কুঁচকে তাকায়,
“রুবি ম্যাম কে? আমি তো চিনি না। ঢাকায় ফিরতে বলো না। আমি আর ঢাকায় ফিরব না।”
তিনজনই চুপ হয়ে যায়।রাফি আর তূর্যের দৃষ্টি বিনিময় হয়।রুবি ম্যাম তো ওদের সেকেন্ড ইয়ারের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন!মানে অরণ্যের দ্বিতীয় বর্ষের কোনো স্মৃতিই নেই… লাবণ্যর স্মৃতি ও নেই।
ওদের হঠাৎ মনে হয়,
এই ফিরে আসা যেন ঠিক ফেরা নয়,এই ফিরে পাওয়া যেন ঠিক পাওয়া নয়। একটা বিষন্নতা যেন পুরো রুম জুরে।
—
তটিনীর বাবা ঢাকার স্থানীয়। তাই তটিনীর মায়ের গ্রামে জায়গা কিনে থাকার জন্যই এখানে বিশাল বাড়ি করেছেন। সেই বাড়িতেই এসেছে তটিনী ও তূর্য।রাফি অরণ্যর কাছে রয়ে গেছে।
তূর্য ও তটিনী দুজনেই ফ্রেশ হয়ে এখন যাবে এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে দুইজন।
সালাম বিনিময়ের পর অরণ্যের অবস্থা ব্যাখ্যা করে তূর্য প্রশ্ন করে,
“তার মানে কি এই ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে অরণ্য র্যাগিংয়ের পরে রাগ করে গ্রামে চলে এসেছিল।
এবং তার স্মৃতিটা সেখানেই আটকে আছে?”
ডাক্তার মাথা নাড়ে।
“হ্যাঁ, আমরা যাকে বলে সিলেক্টিভ রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়া। মানসিক বা শারীরিক ট্রমা থেকে এমন হতে পারে।তবে উনার বর্তমান স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে। কিন্তু অতীতের কিছু অংশ, মুছে গেছে।কোমা রুগির জন্য এটা স্বাভাবিক। ”
তটিনী কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এই স্মৃতি ফিরবে না কখনো?”
ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলেন,
“হতে পারে সারাজীবন ফিরবে না। আবার হঠাৎ কোনো ঘটনায় ফিরে আসতেও পারে।আমরা জোর করতে পারি না, শুধু সময় দিতে পারি। নিশ্চিত কিছুই না। ”
তটিনী ও তূর্য একে অপরের দিকে তাকায়।
ওদের মনে হয়, এখন লাবণ্যর কিছুই জানানো ঠিক হবে না।
ফিরে আসতে আসতে তূর্য ধীরে বলে,
“আমরা কিছু বলব না লাবণ্যকে, লাবণ্য নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে।ওর জন্য এখন এ সত্যটা জানা মানে আবার সবকিছু ভেঙে পড়া।ও যেন এগিয়ে যাক কি বল? আমরা এমনিতেই লাবণ্যর বাবা মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ”
তটিনী একটুও দ্বিমত করে না কিন্তু ওর মন মানে না।জল ভর্তি চোখ নামিয়ে নেয়।
________
অরণ্য পুকুর পাড়ে বসে স্থির দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে হ্যাঁ, অরণ্য অভিনয় করছে।
ভুলে থাকার, না জানার, না চেনার অভিনয়।
এই অভিনয়ের সিদ্ধান্তটা কোনো হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি বরং এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল এক ভয়ানক মুহূর্তে।
যেদিন লাবণ্যের মা ফোনের ওপার থেকে বলেছিলেন,
“লাবণ্যের বিয়ে হয়ে গেছে, বাবা।”
সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল—সমস্ত শরীরটা যেন জমে গেল,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
তবু শব্দ বেরোয়নি, শুধু চুপচাপ ফোনটা কেটে দিয়েছিল।
সেই একটিমাত্র বাক্য, অরণ্যের ভিতর সবকিছু পাল্টে দিয়েছিল। অরণ্য সেদিন অনেক কান্না করে, সর্বহারার মতো কান্না।
“বিয়ে হয়ে গেছে…” এই কথাটি যতবার মনে হয়, নিজেকে নিঃস্ব অনুভব করে।
নিজের সাথে যুদ্ধ করে, অভিমানে, অপমানে,
সে নিজেই স্থির করে ফেলে—ফিরে যাবে না আর ঢাকায়।সেই শহরে ফিরবেই বা কীভাবে,
যে শহরের প্রতিটা গলিতে লাবণ্যের কথা ভেসে বেড়ায়, যে শহরের বাতাসেও যেন লাবণ্যের গন্ধ!
কিন্তু এখন সে অন্য কারো!
অরণ্য চায় না এমন শহরে ফিরতে।চায় না কোথাও হঠাৎ দেখা হয়ে যাক ওদের। অন্য কারো হাত জড়িয়ে থাকা লাবণ্যকে কিভাবে দেখবে অরণ্য?
তাই সে অভিনয় করে—যেন কিছু মনে নেই।
যেন জীবনটা আটকে আছে সেই ফার্স্ট ইয়ারেই।
অরণ্য ধীরে ধীরে মানিব্যাগ বের করে।
ভেতরে যত্নে রাখা একটা ছোট ছবি—লাবণ্যের ছোট্ট হাসি ধরা মুখ। সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ।
“আমি জানি না তোমার ছবি দেখা এখন আমার জন্য পাপ নাকি পূণ্য।কিন্তু যদি এটা পাপ হয়, তাও আমার কিছু করার নেই।আমি হৃদয়ের হাতে অসহায়।আল্লাহ আমাকে অনেক বেশি দুর্বল বানিয়ে দিয়েছেন, লাবণ্য।অনেক বেশি ভালোবাসার ক্ষমতা দিয়েছেন, এই ক্ষমতা এখন আমার দুর্বলতা।
অরণ্য চোখ বন্ধ করে। বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট উঠে আসে।
“তুমি সত্যিই সুখে থাকো, তবে আমাকে ভুলে যাও,একেবারে ভুলে যাও।
হাতটা শক্ত করে ছবি চেপে ধরে।
তারপর আস্তে করে আবার রেখে দেয় মানিব্যাগে।
অরণ্য চুপচাপ বসে থাকে।
শব্দহীন, স্তব্ধ, অথচ ভেতরে চলতে থাকে এক অসীম ঝড়।সেই ঝড়ের নাম—ভালোবাসা আর অভিমান।
_________________
ক্লাসের পড়া মন দিয়ে পড়তে পড়তে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় লাবণ্য। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনে ক্যালেন্ডারের দিকে—হ্যাঁ, আর মাত্র পনেরো দিন, তারপর ডা: রিয়াদ আসবে ওদের বাসায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আশ্চর্য, নিজের ফোন আজ পনেরো দিন ধরে নিখোঁজ। অবশ্য খুব বেশি কষ্ট নেই, ওর ফোন দিয়ে কী করবে?
বাটন ফোন নিয়েছে একটা, সেখানেই ক্লাসমেট দীপ্তি ফোন করল। কথা শেষ করে ল্যাপটপ ওপেন করল,কিছু নোট মেইল করেছে। হঠাৎ ফেসবুকের লোগোটার দিকে দৃষ্টি গেল। অরণ্যের প্রোফাইলে ঢোকার একটা অদম্য ইচ্ছে হল। আগে ঘুরে বেড়াতো, ইদানীং যায় না অনেক দিন। না, ওর প্রোফাইলে কোনো মৃত্যু নিয়ে কিছু লেখা নেই। অরণ্য অবশ্য সব লক করেই রাখত। আজও ঘুরে এলো, শেষ সেই পোস্টটাই….সিলেট যাচ্ছে নতুন চাকরি, রেল স্টেশনে একটা হাসিখুশি ছবি।
কমেন্ট অনেক… লাবণ্য কী মনে করে কমেন্ট দেখতে লাগল। আগে কখনোই দেখে নাই।
পাঁচ মিনিট পর লাবণ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে। পানি পড়ছে টপ টপ করে। বুকের কাছটা দুই হাতে চেপে ধরল—এত বড় প্রতারণা, এত বড় মিথ্যে! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চোখে পানি, কিন্তু মুখে হাসি। নিজেকে সামলে আলমারির কাছে গেল। আলমারির ভেতর থেকে নিজের ব্যাগটা বের করল। ব্যাগের ভেতর যে মানিব্যাগ, তাতে অরণ্যের ছবি আছে, সেটা শত আদরে ভরিয়ে দিল।
“আমি আসছি অরণ্য।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পাগলের মতো বেরিয়ে গেল। কিছু মানুষের সাথে বোঝাপড়া আছে। প্রথম গন্তব্য—ডা: রিয়াদের চেম্বার। কমেন্টগুলো বারবার চোখের সামনে ভাসছে, আর লাবণ্য আনন্দ অশ্রুতে তলিয়ে যাচ্ছে।
“অরণ্য ফিরে এসেছে… আমাদের অরণ্য প্রায় দেড় বছর পর কোমা থেকে, আলহামদুলিল্লাহ।”
“মৃত্যু পারেনি, জীবন ছিনিয়ে এনেছে দোস্ত তোকে… আলহামদুলিল্লাহ।”
এরকম আরও কত মেসেজ। কিন্তু অরণ্য আমার খোঁজ করল না কেন? কলিজায় একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল লাবণ্যর। তবে কি আমাকে ওর মনে নেই?
____________
ডা. রিয়াদের সামনে বসে আছে লাবণ্য।
মেয়েটাকে কেমন এলোমেলো লাগছে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।চোখ লাল হয়ে আছে, সম্ভবত খুব কেঁদেছে।মুখটা থমথমে, কিন্তু চোখে একরাশ রাগ।
রিয়াদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আবার কি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে লাবণ্য?
“জী, বলুন। কী বলতে চাচ্ছিলেন? আপনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে, আমি দুঃখিত। রোগী ছিল…”
লাবণ্য কড়া চোখে তাকাল রিয়াদের দিকে।
“আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছিলেন কেন? কী ভেবেছিলেন আপনি, এই মিথ্যে বলে আপনি আমাকে জয় করে নেবেন?” উত্তেজনায় গলা কাঁপছে, যেন রাগ আর কান্না একসাথে বুকের ভিতর জমে আছে।
রিয়াদ চেহারায় স্পষ্ট বিভ্রান্তি নিয়ে তাকায়, “কোন মিথ্যে?”
লাবণ্য হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
টেবিলের ওপর দুই হাত রাখে। কণ্ঠে কাঁপুনি।
“অরণ্য মারা গেছে,এই মিথ্যে কথাটা!
আপনার সাহস হলো কী করে এভাবে একটা মিথ্যে বলার, আমার জীবন নিয়ে খেলার?”
রিয়াদের মুখ থেকে যেন রঙ সরে যায়। এটা যদি অভিনয় হয়, তবে ডাক্তার রিয়াদ অনেক বড় অভিনেতা হতে পারতেন।
চোখ কপালে তুলে বলেন,
“কী বলছ তুমি এসব! অরণ্য বেঁচে আছে?
তবে… তবে তোমার বাবা কেন আমাকে বললেন ও মারা গেছে, আর আমাকে বরটা তোমাকে দিতে বললেন?”
লাবণ্য ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে।
চোখে জল, অস্পষ্ট ফিসফিস করল,
“বাবা…!”
রিয়াদ গলা নিচু করে ধীরে ধীরে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি তারা তোমাকে মিথ্যে বলেছে।তারা ভরসা করতে পারেনি যে অরণ্য ফিরে আসবে।কোমা থেকে ফিরে আসাটা তো নিশ্চিত কিছু ছিল না।তুমি বাবা-মাকে দোষ দিও না। বাবা-মা হিসেবে তারা….”
“আমি এসব শুনতে চাই না।”
লাবণ্য এক হাত তোলে বাধা দেওয়ার মতো।
“আপনি জানতেন কি না, আর এই নাটকে আপনার হাত ছিল কি না, এইটুকু জানতে চেয়েছিলাম।”
রিয়াদ নিচু গলায় বলে
“লাবণ্য, এসব করে আমার কী লাভ হতো?
আপনাকে পাওয়া? নাহ! তিন মাস আগে কি কথা হয়েছিল মনে আছে আমার।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা ঘিরে ধরে দুজনকে। দুইজন যেন ফিরে যায় তিন মাস আগের একটা দিনে।
ডা. রিয়াদের চেম্বারে সেদিন হন্তদন্ত করে ঢুকেছিল লাবণ্য। সামনের চেয়ারে বসে হরবর করে বলে উঠে,
“আমি জানি, আপনি আমাকে সম্মান করেন।
আর আপনি আমার বাবার কাছেও আপন মানুষ।
আমি একটা অনুরোধ করতে এসেছি। দয়াকরে মানা করবেন না প্লিজ।”
রিয়াদ তখন বুঝতেও পারেনি কী কথা বলবে। “আগে শুনি।” বলে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলো লাবণ্যকে।
“আমার বাবার এখন অপারেশন দরকার।হার্টে ব্লক, কিন্তু আমার জন্য তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ডাক্তার বলেছেন, তাঁকে কিছু একটা নিশ্চয়তার অনুভূতি দিতে হবে।আমি চাই আপনি আমার বাবা-মাকে বোঝান যেন তারা ভাবেন, আমার বিয়েতে আপত্তি নেই, আমি বিয়ে করব।” একটু থেমে, “ আপনাকেই।”
রিয়াদ চমকে গিয়েছিল, সাথে অবশ্যই আপ্লুত হয়েছিলো।
“আপনি কী বলছেন?আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি? বাসায় কথা বলতে বলছেন?”
“হ্যাঁ… তবে শুধু অভিনয় আমি বিয়ে করতে প্রস্তুত নই। এই তিন মাসে যদি আমার বাবা সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমি আমার সিদ্ধান্ত নিজেই নেব।”
রিয়াদ চুপচাপ বসেছিল।তার সামনে বসে থাকা মেয়েটা যে তার জীবনের ভালোবাসা হতে পারত।কিন্তু কি ভাগ্য মেয়েটা তাকে ‘অভিনয়ে’র জন্য অনুরোধ করছে।
তবে রিয়াদ সম্মত হয়েছিল।
রিয়াদ তাকিয়ে আছে লাবণ্যের চোখের দিকে,
নিশ্চয়তা আর ক্লান্তি মেশানো এক কণ্ঠে বলে উঠে,
“তাহলে… এই অভিনয়টা কি আজই শেষ হবে?
আপনি কি চান, আমি এখনই সবাইকে বলি এই বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছে?”
লাবণ্য মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার চোখের কোণ বেয়ে একটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে।
“আমি দু:খিত, আপনি আজই ভেঙে দিন প্লিজ। আমার আরও একজনের সাথে বোঝাপড়া আছে তারপর বাসায় যাবো, আপনি এক্ষুনি জানিয়ে দিন। আমি এখন কোন কিছু বোঝার অবস্থায় নেই! “
“রাত হয়ে যাচ্ছে আমি গাড়ি করে নিয়ে যাই, কোথায় যাবেন?”
“না, আমি একাই যাব।ধন্যবাদ।”
চলবে…..
মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
২২.
রাত এখন দশটা,লাবণ্যর ফোনের টা বেজেই যাচ্ছে। বাসা থেকে, বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে ফেললো। এখন তটিণী-র বাসার সামনে। দরজায় পাগলের মত বেল বাজাতে লাগলো। তূর্য আর তটিনী কেবল খাওয়া শেষ করেছে। দরজায় লাবণ্যকে দেখে অবাক হয়ে গেল।
লাবণ্য ভেতরে ঢুকেই তটনীর হাত শক্ত করে চেপে ধরলো চেহারায় উম্মাদের দৃষ্টি, “ তুই তো আমার বান্ধবী ছিলি! এত বড় মিথ্যা কীভাবে বলতে পারলি?”
“ক কোন মিথ্যা?” তটিনী তূর্যের দিকে তাকালো, চোখে অসহায়ত্ব।
“নিজের জ্যান্ত ভাইকে মৃত বলার মিথ্যে, আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেবার মিথ্যে…!” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরলো লাবণ্য, “ আমি তোর কী ক্ষতি করেছিলাম?”
তটিনী ফট করে লাবণ্য কে জড়িয়ে ধরলো, “ আমার উপায় ছিল না, মিথ্যে না বলে।”
“কেন? কি এমন হয়েছে যে তোকে এই মিথ্যে বলা লাগলো?” লাবণ্য ছটফট করতে লাগলো নিজেকে ছাড়াতে।
তূর্য আগে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। “এটা খেয়ে একটু ঠান্ডা হও।”
তক্ষুনি তটিনীর ফোন বেজে উঠলো তটনী লাবণ্যকে ওর বিছানায় বসিয়ে ফোন ধরল। ওপাশে কাউকে বললো, “ হ্যা আমার বাসায়, আমি পৌঁছে দিব ইন শা আল্লাহ।”
“ফোন রেখে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লাবণ্যের দিকে।
“তুই… আঙ্কেল আন্টিকে কিছু না বলে এত রাতে চলে এলি…?”
লাবণ্য চোখ সরিয়ে ফেলে। দৃষ্টিতে হালকা ঘৃণা মেশানো অভিমান।
“আমি এসব শুনতে আসিনি, তটিনী। আমি শুধু জানতে চাই, কেন?”
তটিনী এবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে।
কণ্ঠটা শান্ত, কিন্তু থেমে থেমে কাঁপছে।
“তুই জানিস না, কী ভয়ংকর সময় পার করছিল আঙ্কেল আর আন্টি। তোর মানসিক কোন স্থিরতা ছিল না। কল্পনা আর বাস্তবতার জগৎ এ আটকে ছিলি। এদিকে অরণ্য ভাইয়া যখন কোমায় গেল, তখন তাঁরা সব বড় বড় ডাক্তার, স্পেশালিস্ট
যাকে পেরেছেন যোগাযোগ করেছেন।
সবাই একটাই উত্তর দিয়েছেন, বলেছেন, ফিরে আসার আশা খুব কম।একটা দুইটা উদাহরণ হয়তো আছে,কিন্তু বেশিরভাগ সময় এদের জেগে ওঠা হয় না।বরং দিনে দিনে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে…হয়ত কখনোই আর জাগবে না অথবা হঠাৎ মৃত্যু বরন করবে।”
তটিনীর চোখে জল চলে আসে। সেটা সামলে বলে,
“তখন আঙ্কেল একটা ভেঙে যাওয়া মানুষ। মুখটা দেখেছি আমি,একটা ভাঙা মানুষ, একটা অসহায় বাবা…উনি একদিন বললেন,
“আমি আর পারছি না।আমার মেয়েটা যদি এইভাবে অপেক্ষা করতে করতে নিজেকেই শেষ করে ফেলে?”
“ উনার কোন এক ডাক্তার বন্ধু পরামর্শ দেয় তোকে একটা চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি দাড় করাবার। যা তোকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনবে। তারপর আমাকে প্রতিজ্ঞা করায়, আমি যেন চুপ থাকি।তারা চাচ্ছিলো,তুই যেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারিস…এই একটা মিথ্যে ছাড়া তখন আর কোনও রাস্তা ছিল না।”
তটিনী থেমে যায় জলভরা আঁখি তোলে,
“তবে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম লাবণ্য।
আমি থাকতে পারিনি, তাই সিলেট ছেড়ে চলে আসি।”
লাবণ্য চুপ করে আছে। চোখে শূন্যতা।
“আমি জানি তুই ভেবেছিস, আমি কীভাবে তোকে অন্ধকারে রাখলাম? তুই জানিস না, তোর কান্না তোর কষ্ট আমাকে প্রতি রাতে জাগিয়ে রাখত!বিয়েতে রাজি হবার পর মনে হয়েছিল হয়ত তুই এবার জীবনে এগিয়ে যাবি।”
তূর্য এবার সামনে এগিয়ে আসে।
“তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে কি না জানি না…তবে একটা কথা বলি,তোমার বাবা-মা তোমার ক্ষতি চায়নি।তারা শুধু চেয়েছিল, তুমি যেন সব ভুলে এগিয়ে যাও জীবনে।”
লাবণ্য চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর নিচু গলায়, একরাশ কষ্ট নিয়ে বলে,
“তবুও… এখন তো অরণ্য জেগে উঠেছে।
এখন তো বলতে পারতে! এখন কেন বললি না?”
তটিনী মাথা নিচু করে। চোখের কোণে জল জমে।
তূর্য ধীরে ধীরে বলে—
“কারণ অরণ্য এখনো… পুরোপুরি ফিরে আসেনি, ওর মনে শুধুই প্রথম বর্ষের কিছু টুকরো স্মৃতি আছে। যেখানে তুমি নেই, অরণ্য তোমাকে ভুলে গেছে, কখনো আর স্মৃতি ফিরবে কিনা কেউ জানে না, তাই….
লাবণ্য হতবাক হয়ে তাকায় তূর্যের দিকে।
তটিনী এবার বলে,
“ভাইয়া এখনো ভাবে ও র্যাগিংয়ের পর রাগ করে গ্রামে চলে এসেছে। ভাইয়ার কাছে সময় থেমে আছে, ডাক্তার বলেছে হয়তো এ স্মৃতি ফিরবে না কোনোদিন… আবার ফিরতেও পারে।”
তূর্য গভীর কণ্ঠে বলে,
“তাই আমরা চেয়েছিলাম তোমাকে সুখী দেখতে।
তোমার তো বিয়েও ঠিক তাই ভেবেছি..
লাবণ্যের চোখে এবার ঝলকানির মতো আগুন জ্বলে ওঠে।
“তোমরা ভাবো আমি এতটাই দুর্বল?আমি কি খেলনা? আমি অরণ্যকে এত দ্রুত ভুলে বিয়ে করে ফেলবো?আমি তো মৃত অরণ্যকে মনে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”
তটিনী এবার অবাক,
“তাহলে বিয়েটা?”
“কোন বিয়ে হবে না বা হত না।,রিয়াদকে আমি শুরুতেই বলেছিলাম,এই বিয়ে ছিল একটা সময় চাওয়া কেবল মাত্র বাবার সুস্থতার জন্য। একটা অভিনয় মাত্র।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাবণ্য।
“আমি কখনোই বিয়ে করতাম না, তটিনী
অন্তত অরণ্যকে ভুলে, সেটা কখনোই সম্ভব ছিল না।”
তটিনী হঠাৎ সামনে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে।
“কি করতে চাস এখন? ভাইয়া তো তোকে ভুলে গেছে।”
চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে লাবণ্যের গাল বেয়ে।
“ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায় না, তটিনী।
ভালোবাসা শুধু… ভেতরে পাথর হয়ে জমে থাকে।
আমি যাব অরণ্যের কাছে ব্যাস আপাতত এতটুকুই জানি,আমি অরণ্যের সামনে দাঁড়াতে চাই।এইবার আমি মুখোমুখি হতে চাই ওর সেই অজানা চোখের।সে যদি চিনতে না পারে, তবুও আমি তাকে দেখে বলতে চাই,আমি শুধু ওকেই ভালোবাসি।”
____________
বাসায় এসে লাবণ্য পাগলের মত ব্যাগ গোছাতে থাকে। সাথে এসেছে তূর্য আর তটিনী। তটিনী ই ওর বাবা,মাকে সব বলে। লাবণ্যর মা শব্দ করে কান্না,করে তার অনুশোচনা আকাশ ছোয়া। এদিকে যেই বিয়ের জন্য এতবড় সত্য গোপন করলো সেটাও ভেঙে গেছে ।
বিছানায় বসে অসহায় চেহারায় তাকিয়ে আছেন লাবণ্যর বাবা।
একবার বলার চেষ্টা করেন,
“মারে… মাগো…”
কিন্তু লাবণ্য তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না।
লাবণ্য ব্যাগ গুছাতে গুছাতে তূর্যর দিকে তাকায়, “ ভাইয়া ট্রেনের টিকেট পেয়েছেন?” বাবাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেন।
“হ্যা, এগারোটা পয়তাল্লিশ এর টিকেট আছে, নিয়েছি অন লাইনে। ছুটির দিন না, তাই ফাঁকাই আছে।”
“আমরাও যাব।” বলে উঠে লাবণ্যর বাবা….
“কোন প্রয়োজন নেই, প্লিজ অনেক করেছ আমার জন্য তোমরা অনেক ভেবেছ, আর না..!” ঝাঝিয়ে উঠলো লাবণ্য।
তটনীর খুব খারাপ লাগে দ্রুত নিজের বাবাকে ফোন করে কিছু বুঝিয়ে বলে।
“কথাটা শোন!…… বলার চেষ্টা করে ওর মা।
“ প্লিজ চাচী, কিছু শুনতে চাই না, শুধু দোয়া কর অরণ্য যেন আমাকে দেখে ওর স্মৃতি ফিরে পায়।”
“চাচী।” হাহাকার করে উঠেন ওর মা, “ আমি তোর মা নই আর? অরণ্যের স্মৃতি নেই মানে?”
লাবণ্য ওর বাবা আর মায়ের উপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনে, “ তোমরা আমার বাবা মা হলে এরকম করতেই পারতে না।”
তটনী দ্রুত এসে ওকে জড়িয়ে নেয়, “ প্লিজ শান্ত হ দোস্ত। নিজের বাবা মাকে এভাবে শাস্তি দিস না।”
“আর আমি যে এতদিন কষ্ট পেলাম? তার কি হবে?”
হঠাৎ লাবণ্যর মা কান্নায় ভেঙে পরেন “ একটা কথা বলার ছিল, হয়ত এরপর তুই আমাকে ঘৃনা করবি। তোর বাবা কিছু জানে না, তাকে ভুল বুঝিস না।…. ইতস্তত করে বললো, “ অরণ্য ফোন করেছিল তোর ফোনে, আমি-ই… আমি-ই অরণ্যর ফোন ধরেছিলাম।
অরণ্য বলেছিল, ‘আমি অরণ্য, আমি লাবণ্যকে চাই।’ আর আমি বলেছিলাম…
বলেছিলাম… ‘লাবণ্যর বিয়ে হয়ে গেছে।’”
ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।লাবণ্য ধপ করে মাটিতে বসে যায়। “ তারমানে অরণ্যের স্মৃতি যায় নি।”
তূর্য ফিসফিস করে বলে,
“মানে… এই কারণেই… ও ভুলে যাবার অভিনয় করছে!”
লাবণ্য ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, চোখ মাটিতে।
“আমি জানতাম, অরণ্য আমাকে ভুলতে পারে না কিছুতেই না। এখন ওর রাগ আর অভিমান আমাকে সইতে হবে।”
ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন,
“তুই যা ইচ্ছে শাস্তি দে মা, আমি ভয় পেয়েছিলাম তোর বাবা এদিকে অসুস্থ….কিন্তু দয়া করে, মাকে এমনভাবে ভুলে যাস না, তোর মা হবার অধিকার কেড়ে নিস না।”
লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার চোখে জল নেই, কিন্তু কান্না জমে আছে বুকে।
“এটাই তোমাদের শাস্তি আজ থেকে আমি এতিম, আমার কোন বাবা মা নেই।”
পুরো ঘরে একটা গুমোট কান্না যেন ছড়িয়ে পরে, এই ঘরে একটা হাসিখুশি পরিবার ছিল। আজ সবাই যেন নিদারুন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
______
সারারাত একটানা ছুটে যায়,ট্রেনটি ধীরে ধীরে ঢুকছে যশোর স্টেশনে।
রাতের আকাশে এখনো পুরোপুরি আলো ফোটেনি,তবু পূর্ব দিগন্তে হালকা কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ছে। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে।
স্টেশন চত্বর নিস্তব্ধ, ট্রেনের চাকা স্লিপারে ঘষা খেতে খেতে শব্দ করছে একটানা,
একটা দীর্ঘ হুইসেলের সাথে ধোঁয়ার কুন্ডলি উঠে যাচ্ছে ওপরে।
ট্রেন থামতেই ধাক্কা খেয়ে একটু কেঁপে ওঠে লাবণ্য।পাশে বসা তটিনী নিঃশব্দে ওর কাঁধে হাত রাখে।লাবণ্য সারা রাত এক ফোটা ঘুমায়নি।
এদিকে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সবে জীবন জেগে উঠছে।একটা চায়ের দোকানে আগুন জ্বালানো হয়েছে, কেতলিতে জল গরম হচ্ছে।সেই ধোঁয়া উঠে মিশে যাচ্ছে আকাশে।
তূর্য নিচু গলায় বলে,
“নেমে পড়ি? আরও তো অনেক রাস্তা অটো নিতে হবে। বেশি লোকজন হয়নি এখনো। ভিড় কম থাকলে ভালো। চা খাবে তোমরা?”
লাবণ্য ধীরে মাথা নাড়ে। “আমি দ্রুত অরণ্যের কাছে যেতে চাই।”
ট্রেন থেকে নামার সময় পা মাটিতে পড়ে একটু কাঁপে, কিন্তু ও নিজেকে সামলে নেয়।
এই তো, সেই যশোর যেখানে অরণ্য, লাবণ্যর অরণ্য। যে ভালোবেসে নির্বাসন নিয়েছে এখানে।
রেলস্টেশনের বাতিগুলো তখনো নিভেনি সেই আলোতে লাবণ্যকে কেমন অদ্ভুত দেখায়।
_______
তূর্য তটিনী আর লাবণ্য অরণ্যদের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। ক্ষেতে, মাঠে মানুষ কাজ করা শুরু করেছে। ফুলের ক্ষেত দেখে লাবণ্যর মনটা ভালো হয়ে যায়।
অরণ্যদের ভিটাতে যখন প্রবেশ করে বড় ভাবি তখন রান্নাঘরে কাজ করছেন। তটিনীর গলা শুনে বের হয়ে আসেন।
লাবণ্যকে দেখে চিনে ফেলেন, খুশি হয়ে যান।
“তুমি এসেচো এবার যদি অরণ্য সব মনে করতে পারে।” চোখে পানি চলে আসে, “ সারাটা দিন পুকুর ঘাটে বসে থাকে। তারপর চোখ মুছে বলে তটিনীকে বলে, “ তোমার ভাইজান তোমাদের বাসায় গিয়েছে। তোমার বাবা-মা ও এসেছে কি জানি দরকার জানো কিছু?”
তটিনী কিছু বলেনা, ও জানে লাবন্যর বাবা-মা এসেছে ওর বাবা-মার সাথেই প্রাইভেট কারে। বড় ভাইজান গিয়েছে কারন তটিনীর বাবার ইচ্ছে, লাবণ্য আর অরণ্যর বিয়ে উনি নিজে দিবেন। লাবণ্যর বাবা মায়ের অমত নাই তারা এখন নিজেদের কৃতকর্মের ভারে জর্জরিত। ভাইজান ও দ্বিমত করবেন না কারন তটিনীর বাবার বেশ প্রভাব এই পরিবারে।
তটিনী লাবণ্যকে নিয়ে অরণ্যের ঘরে যায়।প্রতি কদমে একটা অন্য রকম শিহরণ অনুভব করে লাবণ্য। প্রথম প্রেমে পড়ার, প্রথম স্পর্শের মত সেই অনুভূতি যেন। এতদিন পর, এত রাতের কান্না, প্রশ্ন, ভেঙে-পড়া সব কিছুর পর
অবশেষে আজ ওরা মুখোমুখি হবে।
অরণ্যের অভিমান অভিযোগ নিশ্চয়ই আকাশ ছোঁয়া। কতটা কষ্ট পেয়েছে লাবণ্যর বিয়ের কথা শুনে? বুক ধুক ধুক করছে, হৃদপিণ্ড যেন বের হয়ে আসতে চাচ্ছে লাবণ্যর।
তূর্য আর তটিনী অরণ্যের ঘরের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে,চোখে এক অজানা উৎকণ্ঠা কি হবে এরপর?
লাবণ্য লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নেয়।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পুকুর ঘাটের দিকে।
ঘাটের সেই পুরোনো সিঁড়িতে বসে আছে অরণ্য,
একাগ্র চোখে পুকুরের জলে তাকিয়ে।
সূর্যের আলো ঝলমল করছে জলে, একটা দুইটা ঢিল ছুড়ছে অরণ্য ক্লান্ত ভঙ্গিতে।
লাবণ্য কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়ায়।
তাকিয়ে থাকে সেই চেনা পিঠ, চুলের ভাঁজ৷ বাতাসেও যেন অরণ্যের গায়ের ঘ্রান, ওর গায়ে কাটা দেয়।
তারপর ধীরে ধীরে বলে ওঠে,
“অরণ্য…”
অরণ্য চমকে ওঠে না, মাথা ঘোরায় না। নিজেকে বুঝায় সেই নারী এখানে নেই, ব্যস্ত নিজের সংসারে। এটা তোর শোনার ভুল।
হঠাৎ বাতাসে পুকুরের জলে হালকা ঢেউ ওঠে,
আবার লাবণ্য ডাক দেয় এবার খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে আছে,
“অরণ্য!”
অরণ্য এবারো মাথা ঘোরায় না। বুকের ভেতর দারুন ঝড় এই মেয়ে সত্যি এসেছে? কি জন্য? ন্যাকামি করতে? কণ্ঠে একরাশ অনাগ্রহ আর শীতলতা ফুটিয়ে বলে,
“আপনি কে?” এখনো দৃষ্টি পুকুরের জলে। ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে ফিরে তাকাতে।
লাবণ্য থমকে যায়। নিঃশ্বাস আটকে আসে।
“তুমি… আমাকে চিনতে পারছ না? আমি লাবণ্য, অরণ্যের লাবণ্য।”
“ ও আচ্ছা আপনি লাবণ্য। আমি কাউকে মনে করতে পারছি না। আপনি প্লিজ কথা বলবেন না আর। তাতে আমার মাথায় যন্ত্রণা বাড়ে।”এরপর নিজের ইচ্ছের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে তাকায়।
সেই সময় যেন থমকে যায়।কতদিন পর পরস্পরকে দেখে ওরা! অরণ্য বারবার করে চাচ্ছে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে।কিন্তু লাবণ্যর দিকে তাকালে বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে সে অনুভূতির সঙ্গে যুদ্ধ করা খুব সহজ নয়। কিন্তু…
দুই চোখে এতদিনের না-দেখার তৃষ্ণা জমে আছে।
এই যে সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে লাবণ্য। এই চেহারাটা দেখে অরণ্য কিছুতেই নিজেকে নির্লিপ্ত রাখতে পারছে না।
এই মেয়েটার সামনে ভুলে যাওয়ার অভিনয় করা যে কতটা কঠিন,এখন টের পাচ্ছে।
যা-ই হোক, নিজেকে শক্ত করল অরণ্য।আজ ওরা যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সমস্ত দায় লাবণ্যর। তাই নিজের সব দুর্বলতা চাপা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে, অরণ্য নিজেকে দৃঢ় রাখল।
লাবণ্য আরও এগিয়ে আসলো সামনে,
“তুমি আমাকে ভুলে যাবে হতেই পারে না।” অরণ্যের হাত স্পর্শ করল আলতো করে, “ কেন অভিনয় করছো?”
এই কথাটা শোনা মাত্র অরণ্য যেন বিদ্যুৎ খায়।চোখে আগুন।
“হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমি অভিনয় করছি! আমি ভুলে থাকার অভিনয় করছি! এর কারন তুমি? এর কারণ আমার বেঁচে থাকার আর কোনো মানে নেই!”
লাবণ্য পেছনে এক কদম সরে যায়। চমকে যায় তার চেহারার তীব্রতা দেখে। “ অরণ্য শোন…!
“তুমি তো বেঁচে ছিলে ঠিকই… কিন্তু আমার জন্য না! তুমি কীভাবে পারলে? কীভাবে তুমি অন্য কারোর হাতে হাত রাখতে পারলে? অনন্তকাল অপেক্ষা, হাহ! মাত্র দেড় বছর অপেক্ষা করতে পারলে না তুমি!” লাবণ্যর দুই বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। ব্যাথা পায় লাবণ্য।
“তুমি তো বলেছিলে, আমিই তোমার সব, তুমি শুধু আমার… তাহলে তুমি আমার কোমার সুযোগে কিভাবে অন্যের হয়ে গেলে?” শব্দ করে থু থু ফেললো মাটিতে।
লাবণ্য কিছু বলার চেষ্টা করে। ঠোঁট কাঁপে। অরণ্যের হাতের চাপ বাড়ে,লাবণ্যর মুখে ওর গরম নি:শ্বাস পরে।
“অরণ্য, শোন…তুমি যা জানো…” ব্যাথায় কষ্টে চোখ দিয়ে জল গড়ায় লাবণ্যর।
“চুপ! আমি কিছু শুনতে চাই না! তুমি এখন অন্য কারো।তোমাকে দেখে আমার ঘৃনা হচ্ছে, আমি উত্তেজিত হচ্ছি, প্লিজ তুমি এখন যাও। নাকি চাচ্ছো আমি উত্তেজিত হয়ে আবার একটা সমস্যার পরি, বা কোমায় চলে যাই?” ধাক্কা মেরে দূরে এক প্রকার ছুড়ে ফেললো লাবণ্যকে। “ যাও, দূর হও।”
লাবণ্য এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
চোখ ভেসে যাচ্ছে কান্নায়, কিন্তু কোনও কথা মুখে আসছে না। পেছনে ঘুরে পুকুরঘাট ছাড়ে সে। পা টলমল করছে,যেন জ্ঞান হারাবে।”
সেদিক তাকিয়ে ভিতরে ভিতরে কোনো অজানা শূন্যতা ছিঁড়ে ফেলছে অরণ্যকে ।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে , কিন্তু নিজেকে আবার শক্ত করে তোলে।
তটিনী আর তূর্য ঘরের ভেতর বাকরুদ্ধ, তটিনী দ্রুত লাবণ্যকে জড়িয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে লাবণ্যর ঘুম দরকার এখন। ইশারা করে তূর্য কে অরণ্যের সাথে কথা বলতে।
(আবার অরণ্য শাস্তির কাজ করে ফেললো! কি শাস্তি দেওয়া যায়?!)
চলবে….
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা