মনে রবে কিনা রবে আমাকে
কাজী জেবুন্নেসা
২৩
পুকুরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকের ভেতর শূন্য হয়ে আসে অরণ্যের। লাবণ্য এখানে কেন আসলো? ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, লাবণ্য চেহারাটা চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। অরণ্য তো এত খারাপ ব্যবহার করতে চায়নি, কিন্তু নিজেকে ধরেও রাখতে পারেনি। ঠিক তখন অনুভব করল পাশে কেউ এসে বসেছে।
“তুই তো কিছুই ভুলিস নি, শুধুই অভিনয় করছিলি তাই না?”
তূর্যের কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় অরণ্য, “ আর কোন রাস্তাই তো ছিল না।”
“তুই লাবণ্যর সাথে এতটা রূঢ় ব্যাবহার কীভাবে করতে পারলি? মেয়েটা কতদূর থেকে ছুটে এসেছে তোর জন্য….! “
“এই নামটাও আমি আর শুনতে চাই না, অন্য কোন কথা থাকলে বল।”
তূর্য ওর ঘাড়ে হাত রাখলো, “ তুইতো কমায় চলে গিয়েছিলি, তুই কি জানিস লাবণ্যর কি হয়েছিল? তোর কোমার খবর শুনে বেচারা জ্ঞান হারায় মাথায় আঘাত আর মানসিক আঘাত দুইটার মিলিত প্রতিক্রিয়ায়, অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়। তিনটা মাস মানসিক হাসপাতালে থাকে। তবুও কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয় না!”
অরণ্য ভেতরে ভেতরে চমকে যায়। দৃষ্টি এখনো পুকুরের জলে। “ এরপর?”
“এরপর যেটা হয় সেটা হল হ্যালুস্যলেশন, ক্রমশ বাস্তবতা ছেড়ে কল্পনার জগৎ এ আটকে যেতে থাকে। দিন দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ঠিক সেই সময় ওর বাবা মা একটা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। লাবণ্য কে জানানো হয় তুই আর বেঁচে নেই।”
“কী?” অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্য।
“এবার বল লাবণ্যর দোষ কোথায়?”
“তবুও বিয়ে…? আমি কিছুতেই মানতে পারছি না, হয়ত আমার মন সংকীর্ণ।”
“অরণ্য কোন বিয়ে হয় নাই রে ব্যাটা….বিয়ে ভেঙে গেছে।”
অরণ্য এবার বোকার মত তাকায়, “ কিন্তু কিন্তু লাবণ্যর মা যে বললো?”
“এটাও তোর মৃত্যু সংবাদের মত একটা মিথ্যা কথা।বিয়ে ঠিক ছিল হয়ে যায় নি।”
অরণ্য দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। “তারমানে হয়েই যেত আমি ফিরে না আসলে তাই না?মাত্র দেড়টা বছর অপেক্ষা…!
তূর্য ওকে থামিয়ে দেয়, “তাছাড়া বিয়ে কখনোই করত না লাবণ্য, আসলে ওর বাবার সুস্থতার জন্য এটা একটা অভিনয় ছিল মাত্র। তুই আজ মেয়েটাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিলি না অথচ ও নিজের বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে তোর কাছে ছুটে এসেছিলো পাগলের মত।নিজেরটাই বুঝে গেলি, এখনো তাই… কখনো ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখ। কত কঠিন ছিল এই যুদ্ধটা লাবণ্যর জন্য?”
অরণ্য কোন কথা বলতে পারছে না, কথা গুলো গলার কাছে আটকে আছে। ভাবছে নিজের করা ব্যাবহারের কথা, লাবণ্যর কষ্টের কথা। ওর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে লাবণ্যর সেই কান্নাভেজা চোখ, অসহায়ের মত চেয়ে থাকা মুখটা। যে মেয়েটা সব ফেলে ছুটে এসেছে ওর কাছে, যে মেয়েটা ওকে ভালোবেসেছে এতদিন,নির্বাক, নিঃশব্দ।একা একা যুদ্ধ করে গেছে তবুও ভালোবেসেছে। আর অরণ্য ? অরণ্য কী করেছে?
অভিমানে পাথর হয়ে থেকেছে, প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে তাই ব্যাবহার করেছে, একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি ওর চোখের ভাষা, কন্ঠের অসহায়ত্ব।
“আমি কি মানুষ ?” নিজেকেই প্রশ্ন করে অরণ্য।
নিজেকে ঘৃণা হয়, কেন এতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেল?
এক মুহূর্ত বসে থাকতে পারে না।
হঠাৎ একরকম ছটফট করে উঠে দাঁড়ায়। “আমি লাবণ্যর কাছে যাব।”
তূর্য পিঠে হাত দেয়, “ দাড়া আগে তটিনী কে ফোন দেই।”
তূর্য তটিনীর কাছে ফোন লাগিয়ে অরণ্যর হাতে দেয়।
অরণ্য সালাম দিতেই তটিনী নির্লিপ্ত গলায় বলে
“কিছু বলবে ভাইয়া?”
অরণ্য সে স্বর শুনে দমে যায়, ইতস্তত করে বলে, “ লাবণ্য কি করছে? আমি একটু কথা বলতে চাই!”
“উহু! কথা বলা যাবে না, যথেষ্ট বলেছ একদিনের জন্য।”
“শুন তটিনী প্লিজ এক মিনিটের জন্য।” কন্ঠটা কাতর।
“শুন ভাইয়া মেয়েটা সারাটা রাত নির্ঘুম থেকে ছুটে এলো তোমার কাছে আর তুমি? যাইহোক ও এখন ঘুমুচ্ছে…!”
“একটু ডেকে দে..আমি শুধু ওর কন্ঠ শুনতে চাই প্লিজ।” অরণ্য মরিয়া।
তটিনী এবার হেসে ফেলে, “ উহু! আজ এশার পর লাবন্যর বিয়ে এখন ওর ঘুম খুব প্রয়োজন বুঝলে? আর শুন ভাইয়া আমরা কিন্তু মেয়ে পক্ষ।”
অরণ্যের মাথা ফাঁকা হয়ে আসে, “ বিয়ে?”
“জ্বি, আমার বাবা মা, লাবণ্যর বাবা মা আর ভাইজান মিলে সব ঠিক করে ফেলেছে। তুমি ফোনে সময় নষ্ট না করে নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনে ফেল। বিয়ে বলে কথা পুরান জামা পরে করবা নাকি!”
অরণ্য পায়ে জোর পাচ্ছে না। তূর্য ফোন রেখে ওর দিকে তাকায় হঠাৎ অরণ্য তূর্য কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তূর্য খেয়াল করে অরণ্য হালকা কাঁপছে।
_____________
অরণ্যদের বাসায় হঠাৎ যেন হুলস্থুল লেগে গেল। অরণ্যদের বাসায় যেন হঠাৎ একটা উৎসবের ঢেউ এসে পড়েছে। এক মুহূর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল যেন। একটা আনন্দ, ফিরে আসার পরিবারের একজনের। অরণ্যর সুস্থতা আর এরকম বিয়ে হঠাৎ করেই। প্রথমেই ওর বড় ভাই এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো।
“তুই ঠিক আচিস, সুস্থ আচিস।আল্লাহ রহমত।এখন জলদি মার্কেটে যা, বউ এর জন্য অন্তত একটা শাড়ি কিনে আন নিজের জন্য পাঞ্জাবী।” বলে কিছু টাকা বের করে দিল।
ওর বড় ভাবি এসে বললো, “ জলদি যাও ভাই আমি বাড়িঘর পরিষ্কার করি। অনেক কাজ সময় কম। বাব্বাহ! খালাম্মারা তো কত আয়োজন করছে, হলুদ ও হবে আসরের পর।তারা নাকি মেয়ে পক্ষ।”
অরণ্যের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো হলুদ শাড়িতে লাবণ্য,যার ঠোঁটে লেগে আছে অভিমান, কিন্তু চোখে রয়ে গেছে ভালোবাসা।অস্থির লাগছিল।
সেটা লক্ষ্য করে,তূর্য খোচা দিল, “ সবুর কর দোস্ত, সবুরের ফল মিস্টি হয়।”
তখনই অরণ্যের বড় ভাই ফোন কানে নিয়ে এগিয়ে এলেন, চোখের ইশারায় ইঙ্গিত দিলেন ফোনটা নিতে।
“কথা বলবি,এই নে, খুকি তোকে কিছু বলতে চায়।”
অরণ্য ফোনটা কানে নিয়েই শুনতে পেল ফুপিয়ে ওঠা বড় আপার কণ্ঠ,
“ভাই, তুই পুরোপুরি সুস্থ হয়েও এমন করলি কেন? ভাবতেই পারিনি…”
অরণ্য কিছু বলতে পারে না। গলার কাছে কেমন দলা পাকিয়ে আসে, অপরাধবোধে ওর মাথা নিচু হয়ে আসে। ধীরে বলে, “ভালো আছো আপা?”
ওপাশ থেকে ওর বোনের কান্না মেশানো খুশি খুশি কণ্ঠ জবাব দেয়,
“আজ আমি সবচেয়ে ভালো আছি ভাই। জানিস, মায়ের তো আর কোনও গয়নাই নেই। আমি বিকাশে কিছু টাকা পাঠাচ্ছি, তুই বউয়ের জন্য একটা সোনার আংটি নিয়ে নিস। একদম তোর পছন্দমতো।”
অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। চোখে পানি এসে যায়। কষ্ট আর কৃতজ্ঞতা একসাথে মিশে যায় বুকের ভেতর।কারন আজ ও পুরাই রিক্ত।
“আপা, প্রয়োজন নেই…পরে দেওয়া যাবে।”
ওপাশ থেকে বোনের রাগী কন্ঠ,
“থাপ্পড় খাবি! এতটুকু তো বউকে দিতেই হবে। পাকনামি করিস না।”
অরণ্য হাসে। চোখে ঝাপসা জল। ভিতরে ভিতরে সে উপলব্ধি করে, তার চারপাশে মানুষজন তাকে যতটা ভালোবাসে, সে বোধহয় কখনো ঠিক করে বুঝেই ওঠেনি। আজ যেন অন্ধকার থেকে একটুখানি আলো এসে ওর জীবনটাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল।নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবান মনে হয়।পরিবার অনেক বড় শক্তি।
___________
ঘুম ভাঙতেই বিছানায় উঠে বসে লাবণ্য। থম ধরে বসে আছে, ঘড়ির দিকে একবার তাকাল, জোহরের ওয়াক্ত প্রায় শেষ।
“ডাক দিবি না? এত বেলা হয়ে গেল!” রেগে গেল লাবণ্য।
তটিনী কেমন একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“আজ রাতে তো ঘুমাতে পারবি না… ভাবলাম একটু বেশি ঘুম হোক না হয় !”
“কি যে বলিস! ঘোড়ার ডিম!” বলে গম্ভীর মুখে লাবণ্য গোসলের জন্য বেরিয়ে গেল।
নামাজ গোসল শেষ করে ভাত খেতে লাগলো লাবন্য তখনই খেয়াল করলো ওর বাবা মা এখানে আর পুরো বাসায় একটা সাজ সাজ রব। উঠানে রান্নার আয়োজন। কথা না বাড়িয়ে দ্রুত খেয়ে তটিনীর ঘরে গেল,
“আমার বাবা মা এখানে কেন? তুই এনেছিস?”
“হ্যা,প্রয়োজন ছিল তাই। মেয়ের বিয়েতে অভিভাবক লাগে দোস্ত।” বলে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
লাবণ্য থমকে গেল। কণ্ঠটা কেমন শুকিয়ে গেল যেন।
“…মানে কী বলছিস তুই? কার বিয়ে?”।
“কার আবার তোর তাও মহামান্য খোকন তালুকদারের সাথে।” বলেই হেসে গড়িয়ে পরলো।
লাবণ্ থমকে গেল। কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করল। “কি বলছিস এসব? অরণ্য তো আমাকে সহ্যই করতেই পারছে না।” বলেই চোখ নামিয়ে ফেললো।
তটিনী ওর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরলো,
“এদিকে এখন একশবার ফোন করে ফেলেছে ! বলছে তোকে একটাবার দেখতে চায়, কথা বলতে চায়। সত্যিটা জানার পর থেকে ভেঙে পড়েছে… অনুশোচনায়। আর আমি? আমিও পাজি আছি পাত্তাই দিচ্ছি না।”
লাবণ্য আচমকা জড়িয়ে নিল তটিনীকে ফিসফিস করলো, “ এসব কি সত্য নাকি আমার আবার কোন হ্যালুস্যালেশন হচ্ছে?”
“এসব কিছুই সত্যি দোস্ত। খুব জলদী তুমি আমার মত কুরবানী হচ্ছ।”
তক্ষুনি তটিনীর ফোন বেজে উঠলো, ওপাশের কথা শুনতে শুনতে একটা ভ্রুঁ উঁচু করলো, “উহু! হলুদের সাজ দেখার কিছু নাই তোমার বন্ধুকে বল এত উঁকিঝুকি না করতে।”
ফোন রেখে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিল, “ তূর্যকে দিয়ে ওকালতি করাচ্ছে, তোকে দেখতে চায় হলুদ শাড়িতে।”
লাবণ্যর গাল লাল হয়ে গেল, ইশ! আগে জানলে হলুদ জামদানী টা নিয়েই আসতো।
____________
সেদিনের বিকেলটা যেন অনেক সুন্দর।এক জোড়া ভালোবাসার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবার দিন আজ। লাবণ্য লাল পাড়ের এক সাদামাটা হলুদ শাড়ি পরেছে,স্থানীয় বাজার থেকে তড়িঘড়ি করে কেনা। হালকা সাজসজ্জা করে ফুলের গয়না গায়ে। মুখে এক রাশ প্রশান্তি।
তটিনীদের বাড়িটা অনেক বড়, উঠোনজুড়ে রান্নার গন্ধ।এক রুমে ছোট করে করা হলুদের আয়োজন। আশেপাশের ছোট ছোট পিচ্চিরা গান বাজিয়ে নাচছে, কেউ তাল দিচ্ছে, কেউ ফুল ছিটাচ্ছে।
লাবণ্যর মা কয়েকবার এগিয়ে এসে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু লাবণ্য তাকায় না, কথা ও বলে না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে, চোখে আর ঠোঁটে এক অভিমানী নিরবতা নিয়ে।বাবা দূর থেকেই দেখছে ওকে।
এদিকে বিয়ের শাড়ি নিয়ে অরণ্যের ভাবি এসেছে, সাদামাটা একটা কাতান শাড়ি। লাবণ্য খুশি হল খুব হালকা তাই।
হলুদের আনুষ্ঠানিকতা খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। তটিনীর মায়ের কড়া নির্দেশ, “এশার পর বিয়ের কাজ, এখন মেয়েটাকে বিশ্রাম নিতে দাও।”
তটিনীর ঘরে এসে লাবণ্য দরজা টেনে দিল, একা হবে কিছুক্ষণের জন্য। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে,শাড়ি খুলবে।জানলা দিয়ে আসা হালকা রোদে ফুলের গয়না গুলো ঝিকমিক করছে।
ঠিক সেই সময়, বারান্দার কাঠের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
লাবণ্য চমকে ফিরে তাকাল।
“অরণ্য!” কাঁপতে লাগলো কাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখে।
তটিনীর ঘরের সাথে যে বারান্দা সেটা দিয়ে বাইরে যাওয়া আসার একটা দরজা আছে। তূর্য আগে থেকেই সেই বারান্দার দরজাটা খুলে রেখেছিল। কেউ কিছু জানে না।অরণ্য এতক্ষণ বারান্দায় বসেই ছিল।
লাবণ্য কিছু বলতেই পারে না।অসহ্য অনুভূতির কারনে কথা যেন হারিয়েই গেছে। আয়নায় দেখে অরণ্য ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। দম আটকে আসে ওর।
“লাবণ্য…” অরণ্যের কি নিষিদ্ধ ইচ্ছে হচ্ছে লাবণ্যকে বুকের মধ্যে নিয়ে পিষে ফেলার।
লাবণ্য কিছু বলল না, বলতে পারে না।
অরণ্য এবার ধীরে ধীরে বলল,
“আমাকে মাফ করে দিবে? আমি কীভাবে তোমাকে এত আঘাত দিলাম। আমি জানো নিজের মধ্যে ছিলাম না।তুমি অন্য কারো এ বিষয়টা যেন আমার জন্য মৃত্যুর মতো। ”
লাবণ্য এবার চোখ নামিয়ে ফেলল। চোখে জল জমছে।
অরণ্য আবার বলল,
“মাফ করবে না?তুমি জানো, তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি ভেবে যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম,এখন যখন তোমাকে পেতে যাচ্ছি, ঠিক ততোটাই ভয় পাচ্ছি। তোমাকে সত্যিই পাব তো?”
লাবণ্য এবার ঘুরে দাঁড়ালো, আলতো করে অরণ্যের মুখে নিজের হাত বুলিয়ে দিল। অনুভব করলো অরণ্যকে আঙুলের ডগায় কিছু বলার আগেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল।
অরণ্য ঝুকে লাবণ্যর চুলের ভাজে আদর একে দিল, “ যাই এখন রাতে নিয়ে যাব ইন শা আল্লাহ।”
লাবণ্যর মুখে এক চিলতে সুখের হাসি ফুটে উঠে।
_______________
বিয়েটা হয়ে গেল এশার নামাজের পরপরই।
লোকজন তেমন নেই।অল্প বিস্তর যা এসেছিল উঠোনে খাবার খেয়েই চলে গেছে। আজ রাতের বাতাসেও এক ধরনের শান্তি। যেন পৃথিবীর সব প্রশান্তি আজ এই খানে লাবণ্য আর অরণ্যর বিয়েতে উপস্থিত।
তটিনীর ঘরে একটা চেয়ারে কাজি সাহেব, পাশে থাকা দুজন সাক্ষী। বিছানায় বসে আছে লাবণ্য, লালচে এক ওড়নায় মুখ ঢাকা, খুব সাধারণ সাজসজ্জা।
তারপর লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে কাজী সাহেব বললেন,
“লাবণ্য হাসান, আপনি কি জনাব খোকন তালুকদারকে মোহরানা এক লক্ষ টাকায় বিয়ে করতে রাজি আছেন?”
লাবণ্যর বুক ধুকধুক করছিল। এই উচ্চারণের পর সবকিছু বদলে যাবে।কত কাঙ্ক্ষিত দিন।
সে চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তের জন্য হৃদয়ের সমস্ত আবেগ একত্রিত করে, চোখ নামিয়ে রেখে বলল,
“জি, রাজি আছি, কবুল ।”
কবুল বলার মুহূর্তটা যেন লাবণ্যর স্মৃতির খাতায় খোদাই হয়ে রইল।এত স্বপ্ন, এত কান্না, এতদিনের প্রতীক্ষা… সব মিশে গেল এই একটুকু উচ্চারণে।
তিনবার বলার পর,সবাই “মাশাআল্লাহ” বলে উঠল। লাবণ্যর মা শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে নিল। পাশেই তটিনী আরেক পাশ থেকে জড়িয়ে নিল। হঠাৎ মায়ের প্রতি লাবণ্যর অভিমান গুলো যেন গলে যেতে লাগলো। বাবা কই? এই কথাটাই মাথায় আঘাত করলো।
বর কনেকে পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হল। লাবণ্যর কেমন অচেনা অনুভূতি হচ্ছিলো হঠাৎ যেন এক রাশ লজ্জা এসে ওকে ঘিরে ফেললো।
তটিনীর আম্মা একটা সোনার চেইন পরিয়ে দিল,
“এটা কিন্তু অরণ্যের পক্ষ থেকে, বুঝলা? দেনমোহর উসুল করে দিলাম।”
তখনই লাবণ্যর বাবা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালেন ওদের সামনে। চেয়ারে বসে পরলেন।খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল সাথে খুব তৃপ্ত। চোখদুটো পানিতে ঝাপসা, কণ্ঠ কাঁপছে।
“বাবা আমি তোমাদের দুইজনের অপরাধী আমাকে মাফ করে দিও।” মাথাটা নীচু। সেদিক তাকিয়ে লাবণ্যর বুকের মধ্যে কিছু যেন ভাঙতে লাগলো। তারপর,অরণ্যের হাতে লাবণ্যর হাতটা তুলে দিতে দিতে বললেন,
“আমার মেয়েটা যতটা নরম, তার চেয়েও বেশি শক্ত, এই দেড় বছর ও একা একা একটা যুদ্ধে করেছে…বাপ হয়ে আমি ওর মুশকিল বাড়িয়ে দিয়েছি ভালো করার আশায়।” একটু থামলেন ভেজা চোখ তুলে তাকালেন অরণ্যর দিকে, “আমি আর কিছু চাই না,বাবা! তুমি ওর পাশে থেকো। আমার সমস্ত পৃথিবী আমার লাবণ্য, আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম।” কান্নায় ভেঙে পরলেন আর কিছুই বলতে পারছেন না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তটিনীর বাবা নিজের চোখ বারবার মুছছেন। উনার মনটা বড্ড নরম।
অরণ্য থেমে গেল। এদিকে লাবণ্যর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।লাবণ্যর হাতটা নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল,
“আমিও লাবণ্যর কষ্টের সব ঋণ শোধ করতে চাই, ইন শা আল্লাহ ওর চোখে আর জল আসতে দেবো না। আপনারা দুয়া করবেন ভরসা রাখবেন…আর আপনাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগে নেই। আমি স্বামী হিসেবে চাইবো আমার স্ত্রীও মনে কোন কষ্ট না রাখুক। সন্তান কখনো বাবা মাকে শাস্তি দিতে পারে না।”
লাবণ্য হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো অস্ফুট উচ্চারণ করল, “বাবা!” সাথে সাথেই ওর বাবা ওকে বুকে আগলে নিল। ওর মা ও এসে মেয়েকে জড়িয়ে নিলেন।
মাত্র একদিন আগে ভেঙে পড়া পরিবারটা আজ আবার জুড়ে গেল সাথে নতুন সদস্য।
___________
আজ পূর্ণিমা, ঘরে বাইরে পূর্নিমার নরম আলো।লাবণ্য আর অরন্যর বিবাহিত জীবনের সূচনা হল এমন একটি চমৎকার রাতে।
আকাশে মেঘ নেই, ঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে রূপালি জ্যোৎস্না। অরণ্যের ঘরের ভেতরে অতিরিক্ত কিছুই নেই,না কোনো সাজসজ্জা, না কৃত্রিম ফুল, না লাইটিং।
শুধু সবকিছু অদ্ভুতভাবে পরিপাটি।
লাল চাদরের ওপর সাদা বালিশ দুটো পাশাপাশি। ঘরে এক ধরনের হালকা ঘ্রান।
অরণ্য ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে। অরণ্যের অন্য রকম অনুভব হচ্ছে, লাবণ্য এখন ওর, মুখে মুখে না আইনত এবং ধর্মীয় ভাবেই। প্রত কদমে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে।
লাবণ্য বিছানার উপর বসে আছে, ঘোমটা টানা। এই মুখ ওর খুব চেনা তবুও আজ কি এক তীব্র আকর্ষণ। অরণ্য পায়ে পায়ে গিয়ে পাশে বসে।
মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অরণ্য বুঝতে পারছে,লাবণ্য কাঁদছে।
অরণ্য থেমে যায় কিছুক্ষণ।তারপর ধীরে ধীরে বলে,
“লাবণ্য..”
লাবণ্য উত্তর দেয় না। অরণ্য খুব অস্থির বোধ করে। ঘোমটা তুলে দেয়, জ্যোৎস্না লাবণ্যর মুখে পড়ে, আর অরণ্যের বুকটা হালকা কেঁপে ওঠে। এত অপূর্ব কেন এই মেয়ে!
“কাঁদছ কেন বউ? আজ কি কাঁদার কথা?” এরপর দুই হাতে কান ধরে, “দেখ আমি খুব সরি, তুমি বললে কান ধরে উঠ-বস করি? মাত্র তোমার বাবাকে কথা দিয়ে আসলাম তুমি আর কাঁদবে না…!”
লাবণ্য এবার হঠাৎ অরণ্যের উপর যেন ঝাপিয়ে পরলো শক্ত করে জড়িয়ে নিল। এত শক্ত যেন অরণ্যের দেহের একটা ছাপ নিজের মধ্যে তুলে নিচ্ছে। অরণ্য ঘটনায় আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গেল, দ্রুত ব্যালেন্স রেখে নিজেও জড়িয়ে নিল লাবণ্যকে তারপর কানের কাছে আলতো কন্ঠে বললো,
“ম্যাডাম এত জোরে ধরলে শেষে অক্কা পাব, কাল নিউজ হবে বিয়ের রাতে স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। মানুষ শেষে কি না কি ভাববে!”
লাবণ্য ছেড়ে দেয় না, ফোপাঁতে থাকে। অরণ্যের পাঞ্জাবী চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। “তুমি আমাকে ঘৃনা করেছ?”
“সেটা কি আদৌও সম্ভব? রাগে বলেছি।” অরণ্য লাবণ্যর কাধে নিজের ঠোঁটের অস্তিত্বের জানান দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শান্ত করার প্রচেষ্টায়।
লাবণ্য এবার মুখ তুলে তাকায়, অরণ্যের মুখ দুই হাতের আজলায় ধরে , “ তুমি কখনো বুঝবেও না হারিয়ে পাওয়ার অনুভূতি কি? আমি জানো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম একদম। কাল যখন শুনলাম সব মিথ্যে আমি….. পাগলের মত ছুটে এসেছি। তোমার জন্য কত সহজ আমাকে ধাক্কা মারা তাই না?” চোখে অভিমান, সব বুঝেও লাবণ্য আজ অবুঝ।
অরণ্য অভিমানী বউ এর কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে, এরপর দুই চোখে, “আমি একটা খুব খারাপ মানুষ একদম বাজে….!”
লাবণ্য এবার অরণ্যের কপালে যত্ন করে আদর একে দেয়, “ হুশ! আমার জামাইকে বাজে বলার সাহস দিল কে শুনি? অরণ্য আর কখনো হারিয়ে যেও না কিন্তু। আমি তো চাই আল্লাহ তোমার আগে আমার মৃত্যু দেক।”
অরণ্য লাবণ্যর হাত ছাড়িয়ে নেয়, “মানে একটা দুয়া কর তাও নিজের মতলবের, আমার কথা কখনো ভাব? তোমার বিয়ের কথা শুনে আমি উম্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। দুয়া রিভার্স কর জলদি।” লাবণ্যর কোলে মাথা রেখে সটান শুয়ে পরে।
লাবণ্য হাসে, “ তুমি একদম জ্বলে পুড়ে গিয়েছিলে সেটা আমি জানি।” অরণ্যের চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়।
“এবার ফিল হচ্ছে আমি বিবাহিত।” তারপর কি মনে হতে, “ তুমি কাপড় এনেছো?নইলে আমার গেঞ্জি প্যান্ট পরতে পার, দিব?এই শাড়ি কতক্ষণ পরে থাকবে।”
লাবণ্য ফিক করে হেসে ফেললো, “ এনেছি। উঠ আমি বদলে আসি।”
লাবণ্য ফ্রেশ হয়ে একটা সবুজ সালোয়ার কামিজ পরে নেয়। মাথায় ওটনা পেচিয়ে বের হয়। অরণ্য মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। অরণ্যের রুমে একটা ছোট আয়না, লাবণ্য সেটার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। অরণ্য পেছনে এসে দাঁড়ায়, “লাবণ্য জোনাক পোকা দেখবে?”
লাবণ্য ফিরে তাকায়, “ হ্যা অবশ্যই, আর ঝিঝি পোকারা তো রীতিমতো গান জুড়ে দিয়েছে।”
“হ্যা!” বলে অরণ্য লাবণ্যর একটা হাত নিজের হাতে নেয়, পকেট থেকে একটা গয়নার বাক্স বের করে আংটি পরিয়ে দেয় লাবণ্যর আঙুলে।
পেছনের দরজা খুলে দুইজন দুই পার্টের দরজায় দুই অংশে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। পুকুর পাড়টা নরম আলোয় স্নান করছে যেন। জ্যোৎস্নার আলো পুকুরের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকারা গানের আসর বসিয়েছে। আর গাছে গাছে মিটমিট করছে জোনাক পোকা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দুইজন।শুধু একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে আর উপলব্ধি করছে নিজেদের পবিত্র সম্পর্কটাকে।
অরণ্য হঠাৎ বলে,
“তুমি জানো? এখন আমি কিছু চাই না, শুধু এই মুহূর্তটা চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাই।যেই মুহুর্তে তুমি শুধুই আমার। যখন কবুল বললে! আচ্ছা তোমার মা কোন সিমানা টিমানার শর্ত দেয় নি তো!” মুখে দুষ্টু হাসি।
“মজা নিচ্ছ না!” লাবণ্য মুখ নামায়। হাত পা মৃদু কাঁপছে।
অরণ্য ধীরে ধীরে লাবণ্যর মুখোমুখি দাঁড়ায়, লাবণ্য থমকে যায়, জ্যোস্নার আলোতে ওর মুখের লালিমা স্পষ্ট।লাবণ্যর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“একটা শাস্তির কথা ছিল মনে আছে বউ?”
লাবণ্য ধীরে মাথা নাড়ে। “কিসের শাস্তি?”
অরণ্য এবার ওর কপালে আলতো করে আদর দেয়।তারপর মৃদু আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয়। “জড়িয়ে থাকবো অনেকক্ষন, এটা!ভুলে গেলে?”
লাবণ্য হাসে, “ এটা শাস্তি! এটা তো আমার জন্য শান্তির আশ্রয়।” নিজে মাথা এলিয়ে দেয় অরণ্যের বুকে।
ঘরটা এখনো নিঃশব্দ, চাঁদের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে বিছানার একপাশে এসে পড়েছে।
লাবণ্য বিছানায় বসে ধীরে ধীরে চুল খুলে দেয়।
অরণ্য ওর পাশে এসে বসে। কোনো শব্দ নেই, শুধু দুজন দুজনকে দেখছে।খোলা চুলে লাবণ্যকে এই প্রথম দেখলো অরণ্য।নিজের ভেতর একটা মধুর অস্থিরতা খেয়াল করে।
অরণ্য ধীরে বলল,
“আজ রাতে আমি ঘুমাব না, শুধু তোমাকে দেখে যাবো। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য তুমি, লাবণ্য। আর আজ, এই প্রথম, তুমি শুধু আমার।”
লাবণ্য হাসে, চোখে জল।
“তোমার হাত ধরে ঘুমিয়ে পড়তে পারি আজ?”
“আজ কেন, সারাজীবন পার, আমার বুকে।” বলেই অরণ্য এবার ওকে কোলে তুলে নেয়। নিজের আধিপত্য আর অধিকারের জানান দেয় আদরের স্পর্শে লাবণ্যর সমস্ত কায়াতে। লাবণ্য অরণ্যের পাগলামিতে মুখ লুকায় ওর বুকে, তবে অস্থির অরণ্য ওর সব আড়াল গুড়িয়ে দেয়। আজ যেন সব কিছুই খুব সুন্দর আর ভালোবাসাময় ঠিক গলে পরা জ্যোস্নার মত।
ধীরে ধীরে জ্যোৎস্না যেন আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। পুকুরের জল, জোনাক পোকা, রাতের নিস্তব্ধতা, সব মিলিয়ে যেন দুনিয়ার সমস্ত শব্দ থেমে আছে আজ, শুধু একটিই সত্য দুইজন মানুষ উপলব্ধি করছে, “আজ ভালোবাসা পূর্নতা পেয়েছে পবিত্র বন্ধনে।”
#মনে_রবে_কিনা_রবে_আমাকে
#কাজী_জেবুন্নেসা
সমাপ্ত।